৪
শনিবার সকালে যখন বাঘু প্র্যাকটিস করার জন্য জঙ্গলে যাচ্ছে, তখন তার পোষা কুকুর ট্যাবি সঙ্গে যাওয়ার জন্য এত লাফঝাঁপ শুরু করে দিল যে, কিছুতেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। অন্যদিনও এই রকমই করে। তবে আজ বড্ড নাছোড়পানা করছিল বলে সঙ্গে নিতেই হল। ট্যাবি একটা ভুটিয়া কুকুর, স্বভাবে ভারী লক্ষ্মী, কামড়ায় না। তবু বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় বাঘু তাকে একটা সরু চেনে বেঁধে নেয়, আজও নিল। জঙ্গলে এসেই অবশ্য ডেই রাখল। একটু দৌড়াদৌড়ি করুক। তারপর দু’হাত মুখের দু’ধারে চোঙার মতো ধরে চেঁচিয়ে ডাকল, “নীলু! ও নীলু! কোথায় তুমি?”
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বট গাছটার তলায় নীলুকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
“এই তো আমি! তোমার জন্যেই বসে ছিলাম।”
নীলুকে দেখে ভারী খুশি হল বাঘু। কিন্তু হঠাৎ ট্যাবির কী হল কে জানে! সে আচমকা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করতে-করতে চারদিকে বিভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়াতে লাগল। একবার এদিকে যায় তো আর-একবার ওদিকে যায়। বাঘু তাড়াতাড়ি ট্যাবির বকলস ধরে তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করছিল, হঠাৎ শুনতে পেল অনেকটা উপর থেকে নীলু বলছে, “তুমি কুকুরটাকে এনেছ কেন? কুকুর যে আমি ভীষণ ভয় পাই!”
বাঘু অবাক হয়ে উপরে তাকিয়ে চারদিকে খুঁজে অবশেষে দেখতে পেল নীলু একটা মস্ত শিশু গাছের একেবারে মগডালে বসে আছে। আশ্চর্য ব্যাপার! মুহূর্তের মধ্যে এত উঁচু গাছে ও চড়ল কী করে?
বাঘু বলে, “আমার কুকুর কাউকে কামড়ায় না।”
“তা হোক, কুকুরকে আমি ভীষণ ভয় পাই।”
“কিন্তু তুমি এত তাড়াতাড়ি ওই উঁচু গাছে উঠলে কী করে?” “আমি তো তাড়াতাড়িই গাছ বাইতে পারি।”
ট্যাবি মোটেই শান্ত থাকতে চাইছে না। বকলস ছিঁড়ে ছুটে যেতে চাইছে, গোঁ গোঁ করে রাগের আওয়াজ ছাড়ছে। ট্যাবি এরকম কখনও করে না তো! আজ করছে কেন?
সে উপর দিকে চেয়ে নীলুকে বলে, “আজ আমার আর প্র্যাকটিস করা হবে না। ট্যাবির যেন কী হয়েছে। আমি বরং বাড়ি যাই!”
নীলু বলে, “সেই ভাল। আর কখনও কুকুর নিয়ে এসো না। তা হলে আমি আসতে পারব না।”
বাঘু ট্যাবিকে নিয়ে বাড়িতে রওনা হল। কিন্তু তার মন থেকে খটকাটা যাচ্ছে না। সে নিজেও ভালই গাছ বাইতে পারে। কিন্তু এক লহমায় অত উঁচু গাছে কী করে ওঠা যায়, এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। নীলু যত বড় গাছুড়েই হোক, মাত্র তিরিশ-চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে অত বড় একটা গাছে ওঠা অসম্ভব বলেই বাঘুর মনে হচ্ছে। তার ওপর ট্যাবির এরকম আচরণই বা কেন? এত শান্ত, লক্ষ্মী কুকুরের হঠাৎ খেপে ওঠার কারণই বা কী? ভারী অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি ফিরল বাঘু। তার বুকটা আজ কেন যেন ধকধক করছে।
বাড়ি ফিরেও ট্যাবি খুব একটা শান্ত হল না, কেবল কুঁইকুঁই করে যাচ্ছে। মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য বাঘু ট্যাবিকে স্নান করিয়ে বাইরের মাঠটায় রোদে ছেড়ে দিল। অন্যদিন মাঠে এলেই ছোটাছুটি করে খেলায় মেতে থাকে ট্যাবি, কিন্তু আজ গুটিসুটি মেরে বসে মাঝে-মাঝেই কুঁইকুঁই করতেই থাকে। ভয় পেয়ে বাঘু তার মাকে ডেকে আনে।
“দ্যাখো তো মা, ট্যাবির কী হয়েছে! এরকম করছে কেন?”
মা দেখেটেখে বলে, “ও মা! ও তো ভয় পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে! কোথায় নিয়ে গিয়েছিলি? জঙ্গলে নাকি?”
“হ্যাঁ মা, কিছুতেই ছাড়ছিল না আমাকে।”
“তা হলে জঙ্গলেই কিছু দেখে ভয় পেয়েছে।”
“কিন্তু জঙ্গলে তো ভয় পাওয়ার মতো কিছুই ছিল না! শুধু আমার স্তু নীলু ছিল।”
“কী জানি বাবা, তবে কুকুরেরা নাকি এমন কিছু দেখতে পায় যা আমরা পাই না। এমনি দু’দিন বাড়িতে থাক, ও ঠিক হয়ে যাবে। আর জঙ্গলে নেওয়ার দরকার নেই।”
“ঠিক আছে মা।”
মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না বাঘুর। খটকাটা লেগেই আছে। কেন যেন একটু ভয়-ভয়ও করছে। শিশু গাছটার গুঁড়ি খুব মোটা। আর মোটা গাছে ওঠা খুব শক্ত, কারণ মোটা গাছ হাত-পা ছড়িয়েও বেড় পাওয়া যায় না। একটা বাচ্চা ছেলের পক্ষে আরও অসম্ভব। তা হলে নীলু উঠল কী করে? আর কুকুরকে এত ভয় পাওয়ারই বা কী আছে? নাহ, কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার।
ঘরে এসে পড়তে বসতেই উলটো দিকের জানলায় গোপালকাকুকে দেখতে পেল বাঘু। খুব অন্যমনস্ক হয়ে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। গোপালকাকু বড্ড ভাল লোক। সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা কন। ভারী শান্ত আর নিরীহ মানুষ।
বাঘু বলল, “কাকু, কী ভাবছেন এত?”
গোপাল যেন একটু লজ্জা পেয়ে বলে, “এই একটু পুরনো কথা মনে করার চেষ্টা করছিলাম।”
“কিছু মনে পড়ল?”
গোপাল হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলে, “না, সব যেন স্লেটের লেখার মতো মুছে গিয়েছে।”
“ভাবতে-ভাবতে ঠিক মনে পড়ে যাবে দেখবেন!”
গোপাল ম্লান মুখে বলে, “দেখি চেষ্টা করে। আচ্ছা, তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়ো!”
“ক্লাস সেভেনে।”
“তোমাদের কী-কী পড়ানো হয়?”
“এই তো ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল এইসব। কেন কাকু?”
“আসলে আমি লেখাপড়া শিখেছি কিনা সেটাই আমার মনে নেই তো। আমার কেবল মনে হয়, আমি কি লেখাপড়া করেছি? নাকি আমি মুখ্যু? ভাবছি তোমার বইপত্রগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখলে যদি কিছু মনে পড়ে!”
“তা হলে আপনি চলে আসুন না আমার ঘরে। এখনই আসুন।” গোপালের মুখখানা যেন উদ্ভাসিত হয়ে গেল, একগাল হেসে বলে, “আসব? কেউ কিছু মনে করবে না তো!”
“কে কী মনে করবে? আপনাকে তো আমরা সবাই চিনি।
“আচ্ছা তা হলে আসছি।”
বাঘু বাইরে গিয়ে গোপালকে তার পড়ার ঘরে নিয়ে এল। ভারী সঙ্কোচের সঙ্গে
কুণ্ঠিত পায়ে জড়োসড়ো হয়ে এল গোপাল। মুখে একটু হাসি। গোপাল আসতেই ট্যাবি ভারী খুশি হয়ে গোপালের পায়ের কাছে ঘুরে-ঘুরে খুব লেজ নেড়ে আহ্লাদ জানাতে লাগল।
বাঘু অবাক হয়ে বলে, “ট্যাবি কি আপনাকে চেনে?”
ভারী লজ্জার হাসি হেসে গোপাল বলে, “হ্যাঁ, ও যখন এই মাঠে ছোটাছুটি করে তখন আমি মাঝে মাঝে এসে ওকে একটু আদর করি কিনা, বিস্কুটও খাওয়াই, তাই আমার সঙ্গে বেশ ভাব।”
“বিস্কুট খাওয়ান?”
“হ্যাঁ, ও-বাড়ির মা লক্ষ্মী সকালে চায়ের সঙ্গে দু’টি বিস্কুট দেন তো, তার একখানা আমি ট্যাবির জন্য রেখে দিই।”
“কেন কাকু, নিজের বিস্কুট ওকে খাইয়ে দেন কেন?”
“আহা, ভাগজোক করে খাওয়াই তো ভাল। ভাগ করে খেলে ভালবাসা বাড়ে।”
বাঘু একটু হেসে বলে, “আপনি একজন বেশ লোক।”
পড়ার ঘরে এসে বাঘু তার বইপত্র বের করে বলে, “এই দেখুন কাকু, আমার সব বই। নেড়েচেড়ে দেখুন!”
একটা কাঠের চেয়ারে বসে গোপাল সাগ্রহে বইগুলো উলটেপালটে দেখল অনেকক্ষণ ধরে। একটা বই তুলে নিয়ে বলল, “এটা অ্যালজেব্রা না?”
“হ্যাঁ তো! এই তো আপনার মনে পড়েছে! একটা ইকুয়েশন করে দেখবেন?”
“ও বাবা, সে আমি পারব না।”
“দেখুন না চেষ্টা করে। না পারলে না-ই পারবেন। দাঁড়ান, আমি অঙ্কটা আপনাকে খাতায় টুকে দিচ্ছি।”
গোপাল কিছুক্ষণ অঙ্কটার দেকে চেয়ে রইল। তারপর পেনসিলটা দিয়ে খসখস করে কষতে লাগল। তারপর খাতাটা বাঘুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “হয়নি, না?”
বাঘু অবাক হয়ে বলে, “হয়নি মানে? একদম কারেক্ট হয়েছে! আপনি তো অ্যালজেব্রা ভালই জানেন দেখছি!”
বাঘু খুব খুশি হয়ে বলে, “দাঁড়ান, এবার দেখছি আপনার ভূগোল পরপর বেশ কয়েকটা অঙ্ক কষে ফেলল গোপাল।
মনে আছে কিনা। বলুন তো ব্রাজিলের রাজধানী কী?” “ব্রাসিলিয়া না?”
“হ্যাঁ। আর রোমানিয়ার রাজধানী?”
“বুখারেস্ট হবে কি?”
“বাহ কাকু, আপনার তো সবই মনে আছে দেখছি! আচ্ছা, আকবরের বাবা কে ছিলেন বলুন তো!”
“ও তো হুমায়ুন। ঠিক বলেছি?”
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট। প্রথম পানিপথের যুদ্ধ কবে হয়েছিল?”
গোপাল একটু ভেবে তারপর বলে, “পনেরোশো ছাব্বিশ হতে পারে কি?”
“কাকু, আপনি তো কিচ্ছু ভোলেননি! তা হলে নিজের পরিচয় মনে নেই কেন?”
গোপাল হতবুদ্ধি হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলে, “না, আমার কিছু মনে নেই তো! তুমি যেই জিজ্ঞেস করলে অমনি জবাবগুলো মাথায় এসে গেল। আমি ভেবেচিন্তে কিছু বলিনি!”
“কিন্তু মনে না থাকলে বললেন কী করে?”
গোপাল খুব ভাবিত হয়ে বলে, “সেদিনও একটা কাণ্ড হয়েছিল। দীনেশবাবু আমাকে লাঠি চালাতে বললেন, আর আমি লাঠিখেলার কিছু না-জেনেও আন্দাজে লাঠি ঘোরাতে লাগলাম। উনি বললেন, আমি নাকি একজন পাকা লাঠিয়াল! এসব কী যে হচ্ছে! আমি কোনওদিন লাঠিখেলা শিখেছিলাম বলে মনে তো পড়ে না!”
বাঘু অবাক হয়ে বলে, “আপনি কার কথা বলছেন? কে আপনাকে লাঠি চালাতে বলল?”
“রমেশবাবুর বাবা দীনেশ গুণমশাই।”
চোখ বড়-বড় করে বাঘু বলে, “দীনেশদাদু! ওরে বাবা! আপনি দীনেশদাদুর ভূত দেখেছেন!”
“উনি আমাকে দেখা দেননি, তবে কথাবার্তা হয়েছে।”
“শুনে যে ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!”
“তা ভূতকে ভয় পাওয়া ভাল, ভয় না পেলে ওঁরা একটু অসন্তুষ্ট হন কিনা। ভয় না লাগলে অন্তত ভয়ের ভান করাও ভাল, বুঝেছ! আমি ভয় পেতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে উনি ভারী অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন!”
“সর্বনাশ, ভূত দেখে আপনার কি ভয় লাগল না?”
ভারী লজ্জার হাসি হেসে গোপাল বলে, “আসলে ভয় পাওয়ার কথাটা খেয়াল ছিল না কিনা!”
“ভূতের সঙ্গে কথা বলেছেন! আপনার তো ভীষণ সাহস কাকু!” “সহবত বলেও তো একটা ব্যাপার আছে! উনি যদি কিছু জিজ্ঞেস করেন তা হলে আমাকেও তো তার জবাব দিতে হয়, তাই না? নইলে যে অভদ্রতা হবে! তা ওই করতে গিয়েই আরও পাঁচটা কথা উঠে পড়ল কিনা, তাই ভয় পাওয়াটা আর হয়ে ওঠেনি।”
“আমারও এক বন্ধু আছে, নীলু, সেও নাকি ভূতের সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে।”
“তাই নাকি? তা ভাবসাব করে নিলে ওঁরা লোক তেমন খারাপ নন। দীনেশকাকাবাবু তো আমাকে বেশ স্নেহই করেন। অনেক গল্পটল্প হয়।”
বাঘু চোখ বড়-বড় করে বলে, “ওরে বাবা, দীনেশদাদু তো আমাকেও খুব স্নেহ করতেন। কিন্তু এখন যদি স্নেহ করতে এসে হাজির হন তা হলে যে আমার দাঁতকপাটি লাগবে!”
“আহা, তা কেন? বাঁচা আর মরার মধ্যে তফাত তো তেমন কিছু নেই। এই এপাশটায় যেমন আমরা আছি তেমনি ওপাশটায় ওঁরা। মাঝখানে একটা পরদামতো আড়াল আছে বটে, কিন্তু যদি আড়ালটা সরিয়ে দেওয়া যায় তা হলে দু’পক্ষের বেশ মিলমিশ হতে পারে কিন্তু! তাই না! তখন ধরো, ওপাশের এঁরা এপাশে এসে ছেলেপুলে নাতিপুতির সঙ্গে গল্পগাছা করে গেলেন, এপাশের এঁরা ওপাশে গিয়ে একটু বেড়ালেন আর ওইসঙ্গে পরলোকটাও দেখা হয়ে গেল। তারপর মনে করো দু’পক্ষের মধ্যে মাঝে-মাঝে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা হতে পারে কিংবা দুই তরফ মিলেমিশে হইহই করে চড়ুইভাতি করে আসা যায়। কী বলো!”
বাঘু হি হি করে হাসল, তারপর বলল, “দূর! ভূত যদি ওরকম জলভাত হয়ে যায় তা হলে কি ভাল হবে? তা হলে যে গা-ছমছমে ভাবটাই আর থাকবে না! তখন ভূতের গল্পের বইও কেউ পড়বে না যে! ভূতের গল্প পড়তে কী ভালই না লাগে বলুন!”
গোপাল খুব চিন্তিত হয়ে বলে, “তা অবিশ্যি ঠিক। ভূতকে ভয় না পাওয়াও ভাল কথা নয় বটে!”