হিরণগড়ের ব্যাপারস্যাপার – ৩

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গোপাল উঠে বসল। ঘরে কে যেন ঢুকেছে! চোর নাকি?

কাছ থেকেই কে যেন ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, “আরে না, চোরটোর নয়।”

ভারী বিনয়ের সঙ্গে গোপাল বলে, “তা হলে আপনি কে আজ্ঞে?”

“আমি হলুম দীনেশ গুণ, রমেশ গুণের বাবা।”

গোপাল বিগলিত হয়ে বলে, “কী সৌভাগ্য আমার, কী সৌভাগ্য! একটু পায়ের ধুলো নেওয়া যাবে কি?”

“আরে না! পা দু’খানা আছে বটে, কিন্তু ধুলো পাব কোথায়?”

“আজ্ঞে আমি আপনার ঘরখানা দখল করে আছি বলে আপনার কি খুব অসুবিধে হচ্ছে কাকাবাবু?”

“তা অসুবিধে তো হচ্ছেই বাপু! আর রমেশকেও বলিহারি, অজ্ঞাতকুলশীল একজনকে ফস করে বাড়িতে এনে তুলেছে! কবে যে ছেলেটার বিষয়বুদ্ধি হবে কে জানে!”

গোপাল খুব করুণ গলায় বলে, “আজ্ঞে, সে তো ঠিকই। কাজটা রমেশবাবুর অবিবেচকের মতোই হয়েছে বটে! আমি তো পইপই করে বারণ করলাম, কিন্তু উনি গেরাহ্যিই করলেন না!”

গুড়ুক গুড়ুক হুঁকোর শব্দ শোনা যাচ্ছে আর সেইসঙ্গে বেশ ভাল তামাকের গন্ধ।

হুঁকো থামিয়ে দীনেশ গুণ তেমনই ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, “তা তোমার মতলবটা কী বলো তো! চোর-ডাকাতদের সঙ্গে ষড় আছে নাকি?”

“আজ্ঞে, তা তো থাকতেই পারে! কিছুই বিচিত্র নয়! দিনকাল যা পড়েছে তাতে কাউকেই বিশ্বাস নেই কাকাবাবু।”

“দাঁড়াও, তোমার নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে তোমার মগজের ভিতরটা একটু দেখে আসি, যদি কিছু বোঝা যায়!”

“ওরে বাবা! নাকে সুড়সুড়ি লাগলে যে আমার বড্ড হাঁচি হবে কাকাবাবু!”

দীনেশ গুণ বিরক্ত গলায় বলে, “আরে, আমি কি নস্যির গুঁড়ো না দেশলাইকাঠি যে নাকে ঢুকলে সুড়সুড় করবে! ও তুমি টেরই না

“যে আজ্ঞে। কিন্তু মগজের ভিতরটা তো অন্ধকার, একটা টর্চবাতি নিয়ে গেলে হত না?”

“আরে না, ওসব ব্যবস্থা আছে। আমরা তো আর তোমাদের মতো নই! আমরা অন্ধকারেও দিব্যি দেখতে পাই।”

“যে আজ্ঞে, মরার তো অনেক সুবিধেও আছে দেখতে পাচ্ছি কাকাবাবু!”

“তা আছে বাপু। বেঁচে থাকার অনেক ঝঞ্ঝাট হে! বলতে নেই, পটল তোলার পর এখন বেশ তোফা আছি। এখন একটু স্থির হয়ে বোসো তো! সাবধান, হাঁচিটাচি দিয়ো না, তা হলে আমি আবার ছিটকে বেরিয়ে আসব।”

“যে আজ্ঞে, হাঁচিটাচি চেপে রাখারই চেষ্টা করছি।”

এর পর আর কিছুক্ষণ দীনেশ গুণের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তবে গোপাল টের পেল তার মাথার ভিতরে একটা নাড়াঘাঁটা হচ্ছে যেন! তা হোক, নাড়াঘাঁটার দরুন যদি পুরনো কথা মনে পড়ে যায় তা হলে তো বেশ হয়।

সে একটু হেঁকে বলল, “কাকাবাবু, মাথাটা ভাল করে ঘেঁটে দেবেন কিন্তু!”

তা প্রায় আধঘণ্টা পর দীনেশ গুণ বেরিয়ে এসে বলে, “না হে, ডাক্তার তো বলল, তোমার স্মৃতিভ্রংশই হয়েছে।”

গোপাল অবাক হয়ে বলে, “ডাক্তার! ডাক্তার কোথায় পেলেন কাকাবাবু?”

“কেন হে, আমাদের এখানে কি ডাক্তারের অভাব? মেলা ডাক্তার শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছে। আর আমি যাকে ডেকে এনেছিলাম সে মস্ত বড় নিউরোসার্জন কান্তি ঘোষ। দু’হাজার টাকা ভিজিট ছিল।”

“ওরে বাবা! তা হলে তো মস্ত ডাক্তার! তা কাকাবাবু, তিনি আমার রোগটা সারিয়ে দিতে পারেন না?”

“তা পারবে না কেন? দু’হাজার টাকা ভিজিট দিতে পারবে তো?” “আজ্ঞে, মারা যাওয়ার পর আর ভিজিট দিয়ে উনি কী করবেন?”

“আহা, সে মরলেও তার বউ-বাচ্চারা আছে না! তাদের নামে দু’হাজার টাকা যদি পাঠাতে পার, তবেই চিকিৎসা হতে পারে, বুঝলে!” গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “যে আজ্ঞে, আমার দেখছি সব সময়েই তীরে এসে তরী ডোবে।”

দীনেশ গুণ আবার তামাক খেতে-খেতে বলে, “পিছনের কথা ভুলে গিয়ে তুমি খারাপটাই বা আছ কী? দিব্যি তো আমার ছেলের ঘাড়ে ভর করে তিনবেলা ভালমন্দ খ্যাঁটন সাঁটাচ্ছ! তার উপর আমার ঘর দখল করে আমারই বিছানায় শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ!”

ভারী লজ্জা পেয়ে গোপাল বলে, “আজ্ঞে, আপনার অসুবিধে হলে আমি বরং অন্য ব্যবস্থা দেখি কাকাবাবু!”

বুড়ো খ্যাঁক করে উঠে বলে, “থাক, আর শান্তিপুরী ভদ্রতা করতে হবে না। আর যাবেই বা কোন চুলোয়? আমার ছেলেটাই যা আহাম্মক, নইলে এই হিরণগড় গাঁয়ে আর কে তোমার জন্য কোল পেতে বসে আছে হ্যাঁ? যাও না, ঘুরে দেখে এসো না, দেখি কে তোমাকে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত আর মাথার উপর চালা দেয়!”

“আজ্ঞে রমেশবাবুর কথা আর কবেন না, উনি মনিষ্যি নন, ছদ্মবেশী ভগবান। বাড়ির মা লক্ষ্মীটিও যেন ভগবতী!”

বুড়োটা ভারিক্কি গলায় বলে, “আহা, ওসব কথা তো তুমি এখন বলবেই! বিনা পয়সায় দু’বেলা তিনবেলা ঠেসে খাওয়া, ঘরভাড়া দিতে হচ্ছে না! এখন দুটো মনরাখা কথা না বললে কি হয়? চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা জিনিস আছে!”

গোপাল চোখের কোলটা ধুতির খুঁটে মুছে ধরা গলায় বলে, “আজ্ঞে কাকাবাবু, সেই জন্য আমি মরমে মরে আছি। আমি তা হলে ভোরের আগেই বিদেয় হব ‘খন। সত্যিই তো আপনার ঘর আমি তো অন্যায্যভাবেই দখল করে আছি।”

দীনেশ গুণ তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, “আর নাকিকান্না কাঁদতে হবে না হে! আমি মাপজোক করে দেখেছি তুমি লোক তেমন খারাপ নও।” “অনেক সময় বাইরে থেকে দেখে লোক চেনা যায় না কিনা কাকাবাবু! তাই সাবধান হওয়া ভাল।”

“তা বটে! তবে তোমার যতদিন না পিছনের কথা মনে পড়ছে ততদিন নিশ্চিন্ত। বুঝলে!”

“যে আজ্ঞে। তা হলে কি এ ঘরেই থাকতে পারি কাকাবাবু?”

খিটকেল বুড়োটা ফের খ্যাঁক করে উঠল, “যখন ঢুকেছিলে তখন কি অনুমতি নিয়ে ঢুকেছিলে? তা হলে এখন ঢং করে অনুমতি চাইছ কেন? আর আমার বউমা হল সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী, সে যখন থাকতে দিয়েছে তখন আর কথা কিসের?”

গোপাল একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বলে, “আজ্ঞে, আপনারা সবাই দেখছি ভারী ভাল লোক!”

“উঁহু, উঁহু! ওই ভুলটি কোরো না। আমার ছেলে আর বউমা ভালমানুষ হলেও আমি কিন্তু মোটেই ভালমানুষ নই! আমার সব দিকে নজর। আজ অবধি কেউ আমার চোখে ধুলো দিতে পারেনি, বুঝলে! আমি বেজায় ট্যাটন। ভালতে ভাল, আবার মন্দতে মন্দ। কথাটা যেন খেয়াল থাকে!”

“খুব খেয়াল থাকবে আজ্ঞে। তা কাকাবাবু, আপনার গলার স্বরটাই শুধু শুনতে পেলাম, কিন্তু এই পাপচোখে চাক্ষুষটা যে হল না!”

“আমাকে দেখে হবে কোন লবডঙ্কা! আমি তো আর উত্তমকুমার নই রে বাপু! বায়ুভূত হয়ে আছি এই ভাল, ঘনীভূত হলে আবার কার দাঁতকপাটি লাগে তার ঠিক কী?”

“তা অবিশ্যি ঠিক। আপনি বিবেচক মানুষ বটে কাকাবাবু।”

– তা বাপু , তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, বলি তুমি কি পুরনো প্রথা-প্রকরণ, সংস্কার সব ভুলে মেরে দিয়েছ নাকি?”

গোপাল একটু থতমত খেয়ে বলে, “আজ্ঞে কোন প্রথাপ্রকরণের কথা বলছেন?”

“চিরকাল জেনে এসেছি যে ভূতকে লোকে ভয় পায়। আর সেটাই প্রথা, সেটাই নিয়ম। কিন্তু তুমি তো দেখছি ভয়ের ধারও মাড়ালে না! ব্যাপারটা কী বলো তো! ভূতের কি কোনও মানসম্মান নেই নাকি?”

গোপাল জিভ কেটে ভারী অনুতাপের সঙ্গে বলে, “ইস, ছি ছি, বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে কাকাবাবু! এক্কেবারে খেয়াল ছিল না। আপনি একটু দাঁড়িয়ে যান, আমি ভয় পাওয়ার চেষ্টা করছি! একটু চেষ্টা করলেই হয়ে যাবে দেখবেন!”

“থাক, আর ধ্যাষ্টামো করতে হবে না, বেয়াদব ফাজিল কোথাকার!”

তারপর হঠাৎ “চলি হে, ” বলে দীনেশ গুণ গায়েব হয়ে গেল।

হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল গোপালের। ভদ্রলোককে একটু ভয় পাওয়া তো অবশ্যই উচিত ছিল তার, ওঁর মানসম্মানেরও তো একটা ব্যাপার আছে! ছি ছি, এর ফলে যদি দীনেশ গুণ খেপে গিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয় তা হলে তো হাতে হারিকেন! ইস, সেই তীরে এসে তরী ডুবল তার! এ কথা তো ঠিকই যে, ভূতকে ভয় পাওয়ার একটা নিয়মও আছে। সবাই পায় এবং পাওয়াই উচিত। সে নিজে কোথাকার কে খাঞ্জা খাঁ যে, সামনে জ্বলজিয়ন্ত ভূতকে টের পেয়েও গেরাহ্যিই করল না?

গুনেনবাবু সব শুনেটুনে বললেন, “এহ, বড্ড কাঁচা কাজ করে ফেলেছ যে! প্রেস্টিজ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে! সবাইকেই তার পাওনা সম্মানটা দিতে হয়, বুঝলে! যে ঠাকুরের যে পুজো! দীনেশ এমনিতেই রাগী মানুষ, তার উপর তার ঘর বেদখল, তার বিছানায় একজন অজ্ঞাতকুলশীল, আরও বড় কথা, তাকে তুমি তেমন আমলই দিলে না, এতে তো চটে যাওয়ারই কথা কিনা! ভয় নয় না-ই পেলে, কিন্তু একটু অভিনয় করতে কী দোষ ছিল?”

গোপাল কাহিল গলায় বলে, “আজ্ঞে বড়ই বেয়াদবি হয়ে গিয়েছে। ভয় পাওয়ার কথাটা খেয়াল ছিল না।”

“তা বললে কি হয়? ওরে বাপু, শেক্সপিয়র বড় জব্বর কথা বলে গিয়েছেন, জীবনটা হল একটা রঙ্গমঞ্চ, বুঝলে? এখানে সর্বদাই নানা পার্ট করে যেতে হয়। যখন যেরকম দরকার। কখনও সিরাজ, কখনও হ্যামলেট, কখনও শাহজাহান, কখনও শ্রীকৃষ্ণ। এখানকার ভূতেদের আবার আত্মসম্মানবোধ ভারী টনটনে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে বেজায় চটে যায়। তাই আমি ভূত দেখলে তো প্রথমেই আঁতকে ওঠার অভিনয় করি, তারপর কিছুক্ষণ আঁ আঁ করে শব্দ করি, কাঁপা গলায় রামনামও করি, তারপর হেসেটেসে কথাবার্তা শুরু করে দিই। দিব্যি আড্ডাও হয়। সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না, বুঝলে কিনা! এটিকেটও বজায় থাকল আর আত্মরক্ষাও হল।”

“আপনি ভূত দেখেন নাকি?”

“দেখব না মানে? হিরণগড়ে বাস করে ভূত না দেখে উপায় আছে? এখানে যে ডাইনে-বাঁয়ে ভূত! থাকো না ক’দিন, দেখবে চারদিক ভূতে ভূতাক্কার!”

“সে না হয় হল, এখন দীনেশবাবুর মেজাজ কী করে ঠান্ডা করি সেটা যদি বলেন!”

“আচ্ছা ঠিক আছে। একটু ভয় খাওয়ার অভিনয় করে দেখাও তো!”

গোপাল যথাসাধ্য চেষ্টা করে চোখ বড়-বড় করে মুখ হাঁ করে দেখাল।

গুনেনবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, “আরে দূর-দূর, ওটা কি ভয় পাওয়া হচ্ছে নাকি? ওভাবে তো বাচ্চাদের ভয় দেখানো হয়। প্রথমে আঁতকে উঠতে হবে না? আগে আঁতকে তো ওঠো, তারপর ভয়ের এক্সপ্রেশন দাও। নাও শুরু করো। ধরো আমি ভূত, আমাকে হঠাৎ দেখতে পেয়েছ, এইবার শুরু করো।”

গোপাল সাধ্যমতো ঘাড়টার ঝাঁকিয়ে চমকাল, তারপর হাত পা শক্ত করে দম বন্ধ রেখে ভয়ের এক্সপ্রেশন দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল।

গুনেনবাবু অট্টহাসি হেসে বলেন, “তোমার অভিনয়প্রতিভা তো একেবারে জিরো হে! ও তো কাকতাড়ুয়ার এক্সপ্রেশন! আর চমকানোর বদলে মৃগীরুগির মতো খিঁচুনি খেলে কি হয়? ভয়ের নামগন্ধও নেই। এই যে আমাকে দেখো, এক্সপ্রেশন দিচ্ছি, শিখে নাও।”

গুনেনবাবুর ভয়ের এক্সপ্রেশন দেখে গোপাল মুগ্ধ হয়ে গেল। হাত কচলে বলে, “আজ্ঞে আপনি তো দেখছি বিরল প্রতিভা! ওরকম কি আমি পেরে উঠব?”

“আহা, প্র্যাকটিস করলে পারবে না কেন? ঘরে আয়না নেই?” “একখানা হাত-আয়না আছে বটে।”

“ওতেই হবে। আজ থেকেই আয়নার সামনে প্র্যাকটিস শুরু করে দাও। এবার দীনেশ এলেই তাকে ইমপ্রেস করতে হবে, মনে থাকে যেন! ঠিক আমি যেমন করলাম।”

“যে আজ্ঞে!”

তা আয়নার সামনে খুব নিষ্ঠার সঙ্গেই ভয় পাওয়ার অভিনয় অভ্যেস করতে লাগল সে। দিনদুয়েক পর তার মনে হল, সে দিব্যি ভয়ের অভিব্যক্তি দিতে পারছে! প্রতিবিম্ব দেখে তার বেশ পছন্দই হল। এখন দীনেশবাবুর পছন্দ হলেই হয়। তা হলেই মার দিয়া কেল্লা!

তিনদিনের মাথায় মাঝরাতে আবার উদয় হল দীনেশ গুণ। গুড়ক গুডুক হুঁকোর শব্দে ঘুম ভাঙতেই গোপাল উঠে বসে ভয়ের এক্সপ্রেশ দিতে শুরু করে দিল। আঁ আঁ করে ককিয়ে ওঠা, মুখ বিকৃত চোখ তাড়াং তাড়াং করে খোলা সব ঠিকঠাকই হল।

দীনেশবাবুর তামাক খাওয়ার শব্দটা থেমে গেল। বিরক্ত গলায় বলল, “ও কী হে, কাকে মুখ ভ্যাঙাচ্ছ? আচ্ছা বেয়াদব তো!

গোপাল অবাক হয়ে বলে, “আজ্ঞে, মুখ ভ্যাঙাচ্ছি না তো! আমি তো ভয় পেয়েছি!”

“আহা ভয় পাওয়ার কী ছিরি! ভয় পেলে কেউ কি সার্কাসের জোকারের মতো ভাবভঙ্গি করে? আর ন্যাকামি করতে হবে না তো!”

ভারী হতাশ হয়ে গোপাল বলে, “আমি কিন্তু সত্যিকারেরই ভয় পেয়েছিলাম। পেটের মধ্যে এখনও গুড়গুড় করছে।”

“আর কত মিথ্যে কথা কইবে?”

গোপাল করুণ গলায় বলে, “চেষ্টা কিন্তু করেছিলাম কাকাবাবু!”

“তোমাকে ভয় পেতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছে, হ্যাঁ? তুমি যে ভয়

পাওনি তাতে আমি বরং খুশিই হয়েছি। এরকম একজন ডাকাবুকো লোককেই আমার দরকার।”

গোপাল অবাক হয়ে বলে, ডাকাবুকো? আমাকে কি ডাকাবুকো বলে মনে হয় কাকাবাবু?”

“হ্যাঁ, আর সেটা একটু ভয়েরও ব্যাপার! ডাকাবুকো মানে তুমি গুন্ডা-বদমাশ বা ডাকাতও হতে পার।”

“আজ্ঞে সে তো বটেই।”

“তার উপর তোমার চেহারাখানা ছিপছেপে হলেও বেশ পেটানো এবং মজবুত। ষন্ডাগুন্ডাদেরই এরকম চেহারা হয়। তবে ভরসার কথা হল তোমার পুরনো কথা মনে নেই। তাই নিরাপদ।”

দীনেশ গুণ এরপর কিছুক্ষণ মন দিয়ে তামাক খেয়ে হঠাৎ বলে. “ঘরের ওই দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেয়ালে একখানা পাকা বাঁশের লাঠি দাঁড় করানো আছে। ওটা নিয়ে একটু উঠোনে এসো তো!”

গোপাল অবাক হয়ে বলে, “লাঠি! এই মাঝরাতে লাঠি দিয়ে কী করবেন কাকাবাবু?”

“তোমার এলেমটা একটু পরখ করি!”

“সর্বনাশ! আমি যে লাঠির কিছুই জানি না কাকাবাবু!”

“আহা, না-জানলে ক্ষতি নেই। সব যখন ভুলে মেরে দিয়েছ তখন নিরখপরখ করে দেখা দরকার তোমার ভিতরে কোনও গুপ্তবিদ্যা আছে কিনা।”

“যে আজ্ঞে”

গোপাল বুঝল বুড়োকে ভজাতে হলে অবাধ্যতা করলে চলবে না। সে লাঠিটা নিয়ে উঠোনে নামল। বেশ জ্যোৎস্নারাত্রি। চারদিক শুনশান। গোপাল লাঠিটা একটু নাড়াচাড়া করে দেখল, বেশ ভারী মজবুত লাঠি। এ লাঠি ঘোরানোর সাধ্য তার নেই।

“এবার কী করতে হবে কাকাবাবু?”

“লাঠিটা চালানোর চেষ্টা করো তো দেখি!”

গোপাল লাঠিটা বাগিয়ে ধরতেই লাঠি যেন ম্যাজিকের মতো বিদ্যুৎগতিতে ঘুরতে শুরু করল। গোপাল আপনা থেকেই লাফিয়েলাফিয়ে পাসাট মেরে বনবন করে চারদিকে লাঠি ঘোরাচ্ছে আর মুখে নানা রকম অদ্ভুত শব্দ করে যাচ্ছে, শব্দগুলো সে নিজেই চেনে না। এসব কী হচ্ছে তা বুঝতেই পারছে না সে। কিন্তু থামতেও ইচ্ছে করছে না, তার গা গরম হয়ে উঠছে, কোথা থেকে যেন হাতে-পায়ে বাঘের মতো জোর এসে যাচ্ছে, আর লাঠি প্রবল বেগে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে! শরীরটাও হালকা বোধ হচ্ছে। হাঁফও ধরছে না। বেশ ভালই লাগছে তার। মিনিটদশেক লাঠি চালিয়ে সে ক্ষান্ত দিতেই দীনেশ গুণ বলে উঠল, “সাবাস! তুমি তো পাকা লাঠিয়াল হে!”

গোপাল স্তম্ভিত হয়ে হাতের লাঠিগাছটার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের গলায় বলে, “কিন্তু আমি যে লাঠিখেলার কিছুই জানি না!”

“কে বলল জান না? শুধু জানই নয়, তুমি যে-কোনও ওস্তাদ লেঠেলকে ঘোল খাওয়াতে পারবে হে! আমি নিজে লাঠি খেলতাম, তাই পাকা লেঠেল চিনতে আমার ভুল হয় না। শুধু তাই নয়, যে স্পিডে তুমি লাঠি চালিয়েছ তাতে তুমি একাই পাঁচ-সাতজন লেঠেলের মহড়া নিতে পারবে।”

অবাক হয়ে হাতের লাঠিগাছটার দিকে চেয়ে সে অবিশ্বাসে মাথা নাড়তে-নাড়তে মিনমিন করে বলে, “আমিই কি লাঠিটা চালালুম? কী আশ্চর্য!”

দীনেশ গুণ বলে, “চলো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।”

ঘরে এসে বসার পর দীনেশ গুণ বলে, “বাপু হে, এ বাড়িতে যে আদরে-আহ্লাদে আছ, তাতে আমার আর কোনও আপত্তি নেই, বুঝেছ! তবে আমার একটু উপকার করতে হবে বাপু!”

গোপালের মাথাটা এখনও ভোম্বল হয়ে আছে, দীনেশ গুণের কথা তার মাথায় তেমন সেঁধোচ্ছে না।

দীনেশ গুণ আরও একবার তামাক খেয়ে বলে, “আমার ছেলেটার ব্যবসায় মাথা আছে বটে, কিন্তু বড্ড ভালমানুষ। রোজ ধরো বিজনেসে বিশ-তিরিশ হাজার টাকা লেনদেন হয়। তা সেই নগদ টাকা বাড়িতেই এনে রাখে। তারপর ধরো, আমার বউমার প্রায় পঁচিশ ভরির সোনার গয়না আছে। সেসবও বাড়িতেই। আমার ভয় হয় কোনদিন চোর বা ডাকাত পড়বে আর প্রাণ নিয়ে টানাটানি। তা বাপু, তুমি যদি বাড়িখানা একটু আগলে রাখো, তা হলে আর আমার চিন্তা থাকে না।”

এবার গোপাল একটু গা-ঝাড়া দিয়ে বলে, “রমেশবাবু আর বাড়ির মা লক্ষ্মীর জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। ও নিয়ে আপনি চিন্তাই করবেন না।”

“বাঁচালে বাপু! তা হলে আমি আজ আসি? আবার টুক করে একদিন এসে পড়ব’খন।”

“যে আজ্ঞে।”

বিস্ময়ে রাতে আর ঘুমই হল না গোপালের। আমি কি তা হলে একজন লেঠেল? শুধুমাত্র লেঠেল! কিন্তু এই যুগে শুধুমাত্র একজন লেঠেল হয়ে লাভ কী? লাঠিবাজি করে তো আর পেট চলবে না! তবু যা হোক, এটুকু তো জানা গেল যে, তার আর কোনও গুণ না থাকলেও সে অন্তত লাঠিখেলাটা জানে! এইভাবেই যদি পুরনো কথা একটুএকটু করে ফিরে আসে! গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজে পড়ে রইল। হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসল। সর্বনাশ! সে কি তা হলে সত্যিই ষন্ডাগুন্ডা, ডাকাত? পুলিশ কি তাকে খুঁজছে? তার নামে কি হুলিয়া আছে? তার চেহারা গুন্ডার মতো, সে ওস্তাদ লেঠেল, এ তো দুইয়ে দুইয়ে চার! সে ফেরারি আসামি নয় তো!