২
হিরণগড়ের জঙ্গলটা খুব গহিন আর ঘন। বাঘু এই জঙ্গলে প্র্যাকটিস করে। সে হতে চায় টারজ়ান। লতা ধরে ঝুল খেয়ে এ-গাছ থেকে ও-গাছে লাফিয়ে যাওয়া, জন্তুজানোয়ারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা, এসবই তার স্বপ্ন। তবে এই জঙ্গলে জন্তুজানোয়ার তেমন নেই, যাও বা আছে তারা বন্ধুত্ব করতে তেমন রাজি নয়। আর এই জঙ্গলে লতাপাতা তেমন মজবুতও নয়, ঝুল খেতে গেলেই ছিঁড়ে যায়। বাঘু ভালই গাছ বাইতে পারে, কয়েকটা গাছে সে মজবুত পাটের দড়ি লাগিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে। তাতে সে ঝুল খায় বটে, কিন্তু এখনও ঠিক এক গাছ থেকে অন্য গাছে পৌঁছতে পারেনি। তবে সে ছুটিছাটার দিনে প্রায় সারাদিন প্র্যাকটিস করে। তার বাবা নীলমণি মান্না এই জঙ্গলের চৌকিদার। এখানে কাঠচোরদের খুব উপদ্রব। তার বাবা প্রাণ দিয়ে জঙ্গলটা বাঁচাতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে একা মানুষ, এত বড় জঙ্গলটা পাহারা দেওয়া কি সোজা? কাঠচোরদের দেখলেই নীলমণি তাড়া করে বটে, ছিঁচকে চোর হলে পালিয়েও যায়। কিন্তু যারা দল বেঁধে আসে তারা উলটে টাঙি কুড়ুল নিয়ে তেড়ে আসে। নীলমণি পারবে কেন? গাঁয়ে খবর দিলে লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে আসে, তখন পালায়। তবু চোরাগোপ্তা গাছ কাটা হয়ই। বাঘু ঠিক করে রেখেছে টারজানের মতো গায়ে জোর করবে আর গাছে-গাছে টারজানের মতোই লাফিয়ে বেড়াবে, আর কাঠচোরদের শায়েস্তা করে দেবে। বাবাকে সে ভীষণই ভালবাসে। সে তার বাবার মতোই এই অরণ্যকে ভালবাসে এবং সে বড় হয়ে একে রক্ষা করবেই করবে।
রোববার ভোরবেলাতেই সে জঙ্গলে ঢুকে শিমুল গাছ থেকে দড়ি ধরে ঝুল খেয়ে সামনের বট গাছের একটা ডালে পৌঁছনোর চেষ্টা করছিল, অল্পের জন্য হচ্ছিল না। এমন সময়ে দেখতে পেল একটা তার বয়সি ছেলে, নীচে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে তাকে হাঁ করে দেখছে। ছেলেটার গায়ে আধময়লা একটা নীলরঙা গেঞ্জি আর কালো হাফপ্যান্ট। মাথা ন্যাড়া।
বাঘু বলল, “তুমি কে বলো তো!”
ছেলেটা সেকথার জবাব না দিয়ে বলে, “তুমি ওখানে কী করছ?” বাঘু একটু হেসে বলে, “আমি গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে যাওয়া প্র্যাকটিস করছি।”
ছেলেটা বলে, “পারবে?” “প্র্যাকটিস করলে ঠিক পারব।” ছেলেটা বলে, “আমি কিন্তু পারি।”
বাঘু অবাক হয়ে বলে, “যাহ, সত্যিই পার?”
“হ্যাঁ তো। আমার বাপ-দাদা-খুড়ো জ্যাঠা সবাই গাছুড়ে কিনা!” “গাছুড়ে কী?”
“যারা বড়-বড় গাছ বেয়ে উঠে ফলপাকড় পাড়ে, নারকোল-সুপুরি নামায় তাদের গাছুড়ে বলে।”
“আচ্ছা তা হলে এই দড়ি ধরে ঝুল খেয়ে ওই বট গাছের নিচু ডালটায় যেতে পারবে?”
“এ তো খুব সোজা
“দেখি কেমন পার, ” বলে বাঘু নেমে এল।
ছেলেটা একগাল হেসে দড়িটা বেয়ে টক করে বেশ খানিকটা উঠে মনে-মনে একটু মাপজোখ করে আবার একটু নামল, তারপর দোল খেতে-খেতে হঠাৎ খুব জোরে একটা ঝুল খেয়ে অনায়াসে বট গাছের ডালটা ধরে ফেলল। তারপর একদম বাঁদরের মতো এডাল-ওডালে ঝুল খেয়ে নীচে নেমে এল।
বিস্ময়ে বাঘু হাঁ। অবাক গলায় বলে, “তুমি তো দেখছি খুদে টারজান! আমাকে শিখিয়ে দেবে ভাই? আমি তো অনেক প্র্যাকটিস করেও এরকম পারিনি তোমার মতো!”
“আমি গাছপালা খুব ভালবাসি কিনা, তাই পারি। তুমি গাছপালা ভালবাস তো?”
“হ্যাঁ, খুব বাসি। আমি বড় হয়ে এই জঙ্গলের চৌকিদার হব, আমার বাবার মতো। কাঠচোরদের শায়েস্তা করব।”
“তা হলে শেখাব।”
“আমার নাম বাঘু। তোমার নাম কী ভাই?”
“আমি নীলু। এই বনের ওপাশে থাকি। যখন সময় পাই তখন তো আমি এই বনের মধ্যেই ঘুরে ঘুরে বেড়াই কিনা।”
“লেখাপড়া করো না?”
“করতাম, ক্লাস ফাইভে উঠে আর হল না।”
“কেন নীলু, লেখাপড়া হল না কেন?”
“আমরা খুব গরিব কিনা। আমাকে খেতখামারে কাজ করতে হত, লোকের বাড়ির নারকোল আর সুপুরি বা তাল, কখনও বা আম পেড়ে দিয়ে পয়সা রোজগার করতে হত। কখনও লোকের বাড়িতে কুয়োয় ঘটিবাটি, সোনার জিনিস বা আর কিছু পড়ে গেলে তা কুয়োয় নেমে ডুব দিয়ে তুলতে হত। তাই আর লেখাপড়া হল না।”
“তুমি তা হলে নিশ্চয়ই খুব ভাল সাঁতার জান?”
“ওসব না জানলে কি আমাদের চলে? যত জানা যায় ততই রোজগার। আমি লাঙল চালাতে শিখেছিলাম, মই দিতে পারতাম, সার চিনতাম, ধান কাটতে বা ঝাড়াই করতে জানতাম।”
“ও বাবা, তুমি তো অনেক জান!”
নীলু হি হি করে হাসল। তারপর বলল, “আচ্ছা তুমি তো বনের পাহারাদার হতে চাও, তা হলে লেখাপড়া করছ কেন? পাহারা দিতে তো আর লেখাপড়া লাগে না!”
“সেটা ঠিক, তবে আমার বাবা চায় না যে আমি চৌকিদারি করি। বাবার ইচ্ছে বড় হয়ে আমি যেন ম্যাজিস্ট্রেট হই। কিন্তু আমার খুব শখ এই জঙ্গলটা পাহারা দেব। কাউকে গাছ কাটতে দেব না। এই জঙ্গলটাকে আমি ভীষণ ভালবাসি তো।”
“আমিও। কিন্তু বনটা থাকবে না।”
“কেন?”
“রাতের বেলা চুপিচুপি চোরেরা আসে, তখন আর কে পাহারা দেয় বলো। গাছ কেটে-কেটে নিয়ে যায়। ওরা সব খুনে লোক। আটকাতে গেলেই মেরে ফেলবে।”
“তুমি ওদের চেন?”
“মুখ চিনি। আমার চোখের সামনেই তো
কাটে।”
বাঘু অবাক হয়ে বলে, “রাত্রিবেলায় তুমি জঙ্গলে ঘুরে বেড়াও নাকি?”
“হ্যাঁ, যেদিন ঘুম আসে না সেদিন বনে এসে ঘুরে-ঘুরে বেড়াই। বেশ লাগে।”
“ও বাবা, তোমার তো খুব সাহস!”
“হ্যাঁ ভাই, সাহস না থাকলে কি আমাদের চলে?”
“এই জঙ্গলে তো সাপখোপ আছে, মাঝে-মাঝে বুনো শুয়োর আর ভালুকও নাকি বেরয়। এত সাহস কিন্তু ভাল নয়!”
“ওরা আমাকে কিছু করবে না। এই বনটা তো আমার ভীষণ ভাল বন্ধু।”
“তোমার ভূতের ভয় নেই? আমার তো বাবা ভীষণ ভূতের ভয়!”
নীলু ফের হি হি করে হেসে বলে, “না তো, ভূতকে আবার ভয় কিসের? ভাবসাব করে নিলে কিচ্ছু ভয় নেই। আমি তো কত ভূত দেখি! মদন জ্যাঠা, পানু ঘড়াই, মুকুন্দ পাল, গয়াদাদু, গেনু দাস, আরও কত্ত! কথাবার্তাও হয়। একদম ভয় লাগে না তো!”
শুনে বাঘুর চোখ গোল্লা-গোল্লা হয়ে গেল। সে বলে, “বাপ রে! তুমি ভূতের সঙ্গে কথাও বলেছ? তোমার তো দুর্জয় সাহস! আমি তো ভূত দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাব!”
“প্রথম-প্রথম আমারও ভয় লাগত। তারপর একটু-একটু করে ভাব হয়ে গেল। এখন আর ভয় তো হয়ই না, বরং দেখা না হলেই ভাল লাগে না।”
“ওরে বাপ রে! রক্ষে করো, আমার আর ভূতের সঙ্গে ভাব করার দরকার নেই!”
নীলু খিকখিক করে হেসে বলে, “অত ভয় থাকলে তুমি টারজান হবে কী করে? আর রাতবিরেতে বনে টহল না দিলে তুমি কাঠচোরদের শায়েস্তা করবেই বা কী করে?”
“হুঁ. সেটাও ভাববার কথা। তবে সঙ্গে তোমার মতো কেউ থাকলে বোধ হয় অত ভয় করবে না।”
“ঠিক আছে, যখন তুমি বন পাহারা দেবে তখন আমাকে ডেকো, আমি ঠিক চলে আসব।”
“তা হলে তো দারুণ হবে! আচ্ছা, তোমার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে বলো তো! আমি তো শুধু শনি আর রবিবার প্র্যাকটিস করতে আসি। অন্যদিন স্কুল থাকে, পড়া থাকে।”
“আমি জানি তো। তোমাকে আমি আড়াল থেকে লক্ষ করি যে। লজ্জা করছিল বলে এতদিন ভাব করিনি।”
“তাই বুঝি! তা হলে এখন তো ভাব হয়ে গেল, কী বলো?” “হ্যাঁ তো।”
জঙ্গলের মধ্যে একজন নতুন বন্ধু পেয়ে ভারী খুশি মনে বাড়ি ফিরল বাঘু। কী ভাল ছেলেটা! আর কী ফিট বড়ি! কেমন অনায়াসে দড়িতে ঝুল খেয়ে ট্রাপিজ়ের খেলোয়াড়ের মতো বটের ডালটা ধরে ফেলল! সে নিজে কি কখনও পারবে ওরকম!
পড়ার টেবিলটা গোছাতে গিয়ে বাঘু দেখল উলটো দিকের জানালা দিয়ে সেই ফরসা, লম্বা চেহারার লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। লোকটার নাকি অতীতের কথা কিছু মনে নেই। রমেশকাকু তাই ওকে আশ্রয় দিয়েছে আজ দু’দিন হল। পরশু লোকটা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ও খোকা, এখন ক’টা বাজে বলো তো!” আর কাল জিজ্ঞেস করেছিল, “খোকা, এখানে উত্তর দিকটা কোন দিকে বলবে?”
চোখে চোখ পড়তেই বাঘু বলল, “কাকু, কিছু বলবেন?”
লোকটা চোখ বড়-বড় করে একটু চাপা গলায় বলে, “আচ্ছা খোকা, এই ঘরে কি আমি ছাড়া আর কেউ থাকে?”
বাঘু অবাক হয়ে বলে, “না তো! এই ঘরে আগে রমেশকাকুর বাবা থাকতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকে ঘরটা তো বন্ধ ছিল। আপনি আসায় খোলা হয়েছে।”
“হ্যাঁ, সে তো ঠিক কথাই। কিন্তু আমার মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমি ছাড়াও আর কেউ যেন আছে।”
“কাউকে দেখেছেন?”
“না, এখনও কাউকে দেখিনি, তবে টের পাই। আচ্ছা, আশপাশের কেউ কি তামাক খায়?”
বাঘু হেসে বলে, “না কাকু, এখানে কেউ তামাক খায় না। তবে দীনেশদাদু খেতেন।”
“দীনেশদাদু কে?”
“রমেশকাকুর বাবা। কেন বলুন তো!”
“আমি মাঝে-মাঝে এই ঘরে তামাকের গন্ধ পাই।”
বাঘু একটু হেসে বলে, “উনি তো দু’বছর হল মারা গিয়েছেন।
এতদিন কি তামাকের গন্ধ থাকে? ওটা বোধ হয় আপনার মনের ভুল!” লোকটা বলে, “তাই হবে হয়তো!”
বাঘু বলে, “আপনি কি ভয় পেয়েছেন?”
গোপাল মাথা নেড়ে বলে, “না তো! ভয়টয় পাইনি। শুধু মনে হচ্ছে যদি কেউ থেকে থাকে তা হলে আমার জন্য তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা! তা হলে আমাকে অন্য
ব্যবস্থা করতে হয়। কী বলো!”
“আরে না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ও-ঘরে কেউ থাকে না। আমি জানি।”
বাসুলি রায়ের সঙ্গে গর্জন পানির রোজকার ঝগড়াটা চলছে আজ প্রায় দশ বছর ধরে। গন্ডগোল জমি নিয়ে। বাসুলি রায়ের ধারণা, গর্জন পানি বাড়ি করার সময় তার এক হাত জমি দখল করে দেওয়াল তুলেছে আর উলটো দিকে গর্জন পানিরও বিশ্বাস, বাসুলিই তার জমি এক হাত গাপ করে দেয়াল তুলেছে। আদালতে তা নিয়ে মামলাও চলছে বটে, আবার ঝগড়াটাও বজায় আছে। যদি একজন জামাইষষ্ঠী করতে শ্বশুরবাড়ি যায় বা আর-একজন যদি তীর্থ করতে কাশী-বৃন্দাবন যায় তখন ঝগড়া মুলতুবি থাকে বটে, কিন্তু তখন দুইজনেরই ভারী আইঢাই হয় বলে রটনা আছে। আর ঝগড়াটাও হয় শৃঙ্খলা মেনে। সময়ের নড়চড় নেই। ঠিক সকাল সাড়ে সাতটায় দু’জনেই বাইরের বাগানে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায় এবং কাঁটায়-কাঁটায় আটটা বাজলেই দু’জনে ঝগড়া থামিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে জলখাবারটাবার খায়। ঝড়-জল হলে অন্য ব্যবস্থা। তখন দু’জনে নিজেদের বৈঠকখানার মুখোমুখি জানলায় দাঁড়িয়ে নিয়মমাফিক ঝগড়াটা সেরে নেয়। আজও যথারীতি সকাল সাড়ে সাতটায় দু’জনে মুখোমুখি হল।
“এই যে এলেন আজেবাজে কথা কইতে! লোকের তো হায়ালজ্জাও থাকে, নাকি? দিনেদুপুরে অন্যের জমি গাপ করে আবার বড়-বড় কথা!”
“মুখ সামলে, মুখ সামলে! জমি নিয়ে কোনও কথাই হবে না।
এখনও আকাশে চাঁদ-সুয্যি ওঠে, এত পাপ ধর্মে সইবে না বলে দিচ্ছি!” “এহ, আমাকে এলেন ধম্ম শেখাতে! কত বড় ধার্মিক রে! চোরের আবার ধর্ম কিসের?”
“কে চোর তা সবাই জানে। হনুমান কোথাকার
!” “আর নিজে তো একটা শিম্পাঞ্জি!”
“শকুনির মতো নিচু নজর যাদের তাদের ভদ্রসমাজে বাস করাই উচিত নয়।”
“ফরসা জামাকাপড় পরলেই কি আর ভদ্রলোক হওয়া যায়! মন নোংরা হলে ভদ্রলোক সেজেও লাভ নেই। গা থেকে ছোটলোকের গন্ধ বেরয়।”
“কাকের মতো কা কা করলেই তো হবে না। গলার জোরে সব কিছু হয় না।”
“কে শিয়ালের মতো হুক্কাহুয়া করছে তা সবাই শুনতে পাচ্ছে। চেঁচিয়ে কিছু প্রমাণ করা যায় না।”
ইত্যাদি।
এইভাবেই আটটা বেজে যায়, সঙ্গে সঙ্গেই ঝগড়া বন্ধ করে দু’জনে ঘরে ঢুকে পড়ে। রোজ।
তবে আজ একটা বাধা পড়ল। দু’জনের কেউই লক্ষ করেনি যে, গুনেন খাস্তগির রাস্তায় ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের ঝগড়া শুনছিলেন। ঝগড়া থামতেই তিনি অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বলে উঠলেন, “যাচ্ছেতাই! যাচ্ছেতাই! হোপলেস! এটা কী ঝগড়া হচ্ছে হে? এ যেন দু’জনে মিনমিন করে নামতা মুখস্থ বলে যাচ্ছ! কোনও ভ্যারিয়েশন নেই, ভ্যারাইটি নেই, অ্যাকসেন্ট নেই, ইনটোনেশন নেই! তোমাদের ভোকাবুলারি এত কম কেন হে? গত চার-পাঁচদিন প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফেরার পথে তোমাদের ঝগড়া শুনতে একটু দাঁড়িয়ে যাই, যদি একটু এন্টারটেনমেন্ট পাওয়া যায়! তা কোথায় কী! রোজই সেই একই হনুমান, সেই একই শিম্পাঞ্জি, সেই একই শিয়াল, সেই একই কাক! ছ্যাঃ ছ্যাঃ, শুনে-শুনে কান পচে গেল যে! ঝগড়ার কি একটা আর্ট নেই? একটা প্রেজেন্টেশন নেই? ইনোভেশন নেই?”
বাসুলি ভারী লজ্জা পেয়ে ঘাড় চুলকোতে-চুলকোতে বলে, “আজ্ঞে মেসোমশাই, সকালের দিকে আমার মাথাটা ভাল কাজ করে না কিনা। তাই।”
গর্জনও ভারী থতমত খেয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলে, “যে আজ্ঞে, প্রাতঃকালে আমার মাথাটাও বড্ড ভোম্বল হয়ে থাকে কিনা, তাই মাথাটা খেলে না।”
গুনেনবাবু গাঁয়ের একজন বিশিষ্ট লোক, মাতব্বর, প্রভাবশালী মানুষ। কাঁচি ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা, হাতে রুপোর হাতলওয়ালা লাঠি। ফরসা এবং লম্বা-চওড়া চেহারা। হাতের লাঠিগাছা বারকয়েক রাস্তায় ঠুকে জলদগম্ভীর গলায় বলেন, “সব কিছুরই একটা শিক্ষা আছে, বুঝলে! ঝগড়াটাও এন্টারটেনিং হওয়া চাই। আর বাংলাতেই ঝগড়া করতে হবে এমনও তো কথা নেই! ইংরেজিতে কত চোখা চোখা কথা আছে, গ্রিক, ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান সব ভাষাতেই আছে, সেগুলো কালেক্ট করতে পার না? ও কী মাতামারা ঝগড়া তোমাদের! শুনলে কানে হাতচাপা দিতে হয়।”
বাসুলি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে, “আজ্ঞে ওসব ভাষার তেমন চর্চা নেই কিনা!”
গর্জনও তোতলাতে-তোতলাতে বলে, “আজ্ঞে এই পাড়াগাঁয়ে ওসব শেখায় কে বলুন!”
গুনেনবাবু প্রায় গর্জন করে উঠে বলেন, “কেন, আমি থাকতে শিক্ষকের অভাব কী! ফাঁক মতো সময় করে আমার বাড়িতে যাবে, একেবারে তৈরি করে দেব। দেখো, তখন লোকে টিকিট কেটে তোমাদের ঝগড়া শুনতে আসবে। আরে তেমন উঁচুদরের ঝগড়া করতে গেলে একটু অভিনয় জানতে হয়, স্বরক্ষেপ শিখতে হয়, গলার ওঠাপড়ায় নজর রাখতে হয়, প্রবাদবাক্য মুখস্থ করতে হয়, আর ঠান্ডা মাথায় উকিলের মতো সওয়াল করতে হয়। এসব না শিখলে কিস্যু হবে না, বুঝলে?”
বাসুলি ঘাড় অনেকটা কাত করে গদগদ কণ্ঠে বলে, “যে আজ্ঞে মেসোমশাই। আপনি আমার পিছনে থাকলে আমি আর কাকে ভয় করি?”
গর্জনও হাতজোড় করে মাথা নুইয়ে বিনয়ে গলে গিয়ে বলে, “এ তো আমার সৌভাগ্য মেসোমশাই! আপনি আমার পাশে দাঁড়ালে আমার আর কাকে পরোয়া?”
“তা হলে এই কথাই রইল, ” বলে জুতোর মশমশ শব্দ তুলে দৃপ্ত পদক্ষেপে গুনেনবাবু বিদায় হলেন।
বাসুলি এবার গর্জনের দিকে চেয়ে বক দেখাল, আর গর্জন বাসুলিকে মুখ ভেঙিয়ে দু’জনেই ঘরে ঢুকে গেল।
বিষণ্ন রমাচরণ চৌপথীর বটতলায় বাঁধানো চাতালে বসে ছিল। মুখখানা যথারীতি রোজকার মতোই গম্ভীর আর দুঃখী এবং চিন্তাকুল।
পরান ঘড়াইয়ের বাড়িতে আজ তার বড় জামাইবাবাজি আসবেন। কিন্তু হাতে মোটে টাকাকড়ি নেই। শ’পাঁচেক টাকা হাওলাত না পেলে সম্মান থাকে না। একটু ভাল-মন্দ বাজারহাট না করলেই নয়। কিন্তু গাঁ-ঘরে ফস করে পাঁচশো টাকা বের করে দেওয়ার মতো লোক বেশি নেই। তাই সকাল থেকে একটু তক্কে তক্কে ছিল পরান। বটতলায় রমাবাবুকে দেখে একটু ভরসা হল। রমাবাবুর বাতিক হল দুঃখ, দুঃখের কথা কইলে তিনি ভারী খুশি হন, চিঁড়ে ভিজতে পারে। তাই সে গিয়ে সন্তর্পণে একটু দূরত্ব রেখে বসল। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “রমাবাবু, আজও কি মনটা ভাল নেই?”
রমাচরণ যেন স্বপ্নোত্থিত হয়ে অবাক গলায় বলে, “কে?” পরান বিনয়ের সঙ্গে বলে, “আজ্ঞে আমি পরান।”
রমাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “অ! হ্যাঁ, কী যেন জিজ্ঞেস করছিলেন?”
“আজও কি মন ভাল নেই?”
মাথাটা ডাইনে-বাঁয়ে নাড়া দিয়ে রমা বলে, “না পরানবাবু, এ মন আর ভাল হওয়ার নয়। সর্বদাই হু হু করে মন, বিশ্ব যেন মরুর মতো। চারদিকে এত দুঃখ থাকলে মন ভাল হবে কী করে বলুন তো! দেখছেন না চারদিকে দুঃখের ঢেউ উঠছে, দুঃখের বাতাস বইছে, দুঃখ ছাড়া আর কিছু কি দেখতে পান দুনিয়ায়? আমি তো দেখতে পাই না। জাগলে দুঃখ, ঘুমোলে দুঃখ, মেঘ করলে দুঃখ, রোদ উঠলে দুঃখ। এই তো সেদিন ছেলে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে বলে আমাকে মার্কশিট দেখাচ্ছিল। অঙ্কে একশোয় একশো, ভূগোলে একশোয় একশো, বিজ্ঞানে একশোয় একশো, ইংরেজিতে আটানব্বই, বাংলায় পঁচানব্বই। কই আমার তো একটুও আনন্দ হল না! নম্বর আর নম্বর, ও দিয়ে কি আর পৃথিবীর দুঃখ ঘুচবে? আমার মেয়ের কথাই ধরুন। গান গেয়ে খুব নাম করেছে, কাঁড়িকাঁড়ি প্রাইজ় এনে ঘর ভরিয়ে ফেলেছে, লোকে বলে কোকিলকণ্ঠী। তাতে তো বাপ হিসেবে আমার আনন্দ হওয়াই উচিত! কী বলেন? কিন্তু হচ্ছে কই?”
“তা বটে। নাহ, দুঃখটা দেখছি একেবারে পেড়ে ফেলেছে আপনাকে!”
রমা আর-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সেকথা এই আপনিই একমাত্র বুঝলেন। আর কেউ তো বুঝতেই চায় না মশাই! লোকে কী বলে জানেন? বলে, রমাচরণের কত জমিজমা, ফলাও চাষবাস, চালের কল, আটাচাক্কি, মুড়িভাজার মেশিন, ওর লাল মুড়ি দিনে চার-পাঁচশো প্যাকেট বিক্রি, ওর কারবারে পঁচিশ-তিরিশজন লোক খাটছে দিনরাত। ওর আবার দুঃখু কিসের। ওসব শখের দুঃখ, ভণ্ডামি। বলুন তো এতে আমার আরও কত দুঃখ হয়!”
“বটেই তো! শুনে আমারও তো একটু দুঃখ-দুঃখ ভাব হচ্ছে!” “হবেই
দেখলেই বোঝা যায়। তারপর ধরুন আমার শ্বশুর বেজায় বড়লোক, তার তেলের কল, কাপড়ের কল, ঢালাই কারখানা, পাঁচ-সাতখানা গাড়ি, গোটাআষ্টেক বিরাট-বিরাট বাড়ি, টাকার তো লেখাজোকা নেই। লোকে সেই খোঁটা দিতেও ছাড়ে না। তা আপনিই বলুন, শ্বশুর বড়লোক হলে আমার কী লবডঙ্কা! আমি যে-তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছি।”
তো! আপনি যে একজন ভাল লোক তা আপনাকে
“তাই তো দেখছি রমাবাবু, দুঃখটা তো বড়ই শিকড় গেড়ে বসেছে! উপড়ে ফেলা শক্ত হবে বলেই মনে হয়! এত দুঃখ থাকলে যে ক্ষুধামান্দ্য, অনিদ্রা এসবও দেখা দেবে কিনা!”
আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমা বলে, “তা কি আর বাকি আছে পরানবাবু! এমনিতেই আমার পাখির আহার, তার উপর খেতে বসে টেরও পাই না ভাত খাচ্ছি না রুটি, পায়েস খাচ্ছি না অম্বল, পিঠে খাচ্ছি না পাউরুটি! শুয়ে পড়ার পর বুঝতেই পারি না জেগে আছি না ঘুমোচ্ছি, স্বপ্ন দেখছি না সত্যি দেখছি! দুঃখের কথা কী জানেন, লোকে আমার তেল চুকচুকে শরীরটাই দেখে, ভিতরে ভিতরে যে আমি ফোঁপরা সেটা আর টের পায় না। পাশের বাড়ির হিংসুটে কাশীনাথ তো বলে, আমার নাকের ডাকে নাকি রাতে তার ঘুম হয় না। বলুন তো পরানবাবু, এসব কি আমাকে হেয় করার জন্যই বলা নয়? তারপর এই দেখুন না, গত শ্রাবণে কালী পাণ্ডার মেয়ের বিয়েতে অন্যমনস্কতার দরুন বাষট্টিটা রসগোল্লা খেয়ে ফেলেছিলুম। তাই নিয়ে কত টীকাটিপ্পনী মশাই! লোকে বুঝলই না যে, আমি কী খাচ্ছি, কতটা খাচ্ছি তার হুঁশই আমার নেই! আমিই কি খেয়েছি নাকি? খেয়েছে তো আমার বুক জুড়ে থাকা দুঃখ।”
দুঃখটা বুঝল না!” “আজ্ঞে, সে তো বটেই! আমার তো মনে হয় বুকজোড়া দুঃখ পেটেও গোঁত্তা মারতে ছাড়ে না। আর তখন মানুষ তো একটু বেশি খেয়ে ফেলতেই পারে। আমি তো তার মধ্যে কোনও দোষ দেখছি না।” “আরও দুঃখ কী জানেন? লোকে আমার খাওয়াটাই দেখল, কিন্তু
“কিন্তু আমি তো দিব্যি বুঝতে পারছি মশাই! খাওয়ার ভিতরেও যে কত দুঃখ ঘাপটি মেরে বসে থাকে তা কি আর সবাই বোঝে? আজ্ঞে আপনি ওসব কথায় কান না দিয়ে বুক ফুলিয়ে চলুন দেখি, আমি দুঃখে আছি তো বেশ আছি, একশোবার দুঃখে থাকব, তাতে কার কী?”
“আমার কী মনে হয় জানেন? মনে হয় আপনি একজন সাচ্চা
“আজ্ঞে কী যে বলেন! তবে আমি সাচ্চা থাকারই চেষ্টা সব সময়ে করি কিনা। লোকে বলে আমার নাকি কথার নড়চড় হয় না! হেহ হেহ!”
রমাচরণ উঠে পড়ে বলে, “বিষয়আশয় হল বিষ, বুঝলেন! টাকাপয়সা ছুঁতেও যেন ঘেন্না করে। কিন্তু বিধাতা আমাকে সেই বিষয়আশয় আর টাকাপয়সার সঙ্গেই যেন জুতে দিয়েছেন! চাইলেও ছেড়েছুড়ে বিবাগী হয়ে যেতে পারি না। এ যে কী জ্বালা তা বুঝবেন না! এই তো এখন গিয়ে দোকানপাট খুলে বসতে হবে, তারপর সারাটা দিন লাখো লাখো টাকা গোনা আর লাভ-লোকসানের হিসেব কষা। নাহ, জীবনটায় ঘেন্না ধরে গেল মশাই!”
“যে আজ্ঞে, আপনার অবস্থা দেখে সত্যিই চোখের জল রাখা যায় না এই বলে ধুতির খুঁটে চোখটা একটু মুছে পরান বলে, “ইয়ে, তা একটু কথা ছিল রমাবাবু!”
“আহা, কথা তো থাকতেই পারে। অত সঙ্কোচ কিসের! বলে ফেললেই তো হয়।”
“যে আজ্ঞে, এই বলছিলাম কী, বড্ড ঠেকায় পড়ে গিয়েছি কিনা। হাজারপাঁচেক টাকার বড় দরকার। যদি একটু ব্যবস্থা করে দেন, দশ দিনের মধ্যেই শোধ করে দেব।”
রমাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তা এ আর বেশি কথা কী? আজ দুপুর বারোটা নাগাদ আমার গদিতে আসুন, হয়ে যাবে। মানুষকে মানুষ সাহায্য না করল কে করবে বলুন! আর আমার মনটাও বড্ড নরম কিনা, তাই কাবলিওয়ালা তো হতে পারি না। লোকে বলে বটে যে, ওহে রমাচরণ, এত কম সুদ নিলে যে তোমার বড্ড লোকসান হয়ে যাবে! তবু আমি বলি, তা যাক, অভাবী লোকদের গলায় গামছা দিয়ে আমি বেশি সুদ নিতে পারব না। আপনি দশদিনের জন্য এই নামমাত্র দশ পার্সেন্ট সুদ দিলেই হবে। তা হলে চলি?” বলে রমাবাবু বিদায় নিল।
পরান ঘড়াই নিচু গলায় বলে, “ব্যাটা কসাই।”
চিতু বৈরাগী দূর থেকে খগেন মালোকে দেখে সুট করে হাটখোলার মোড়ের লাল ডাকবাক্সটার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। তা এই গা ঢাকা দেওয়াটা চিতুর নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন লোককে দেখে বিভিন্ন সময়ে তাকে প্রায়ই গা ঢাকা দিতে হয়। পরশুদিনই সে খগেনের ফলাও বাগান থেকে এককাঁদি মর্তমান কলা আর একটা বড়সড় পাকা কাঁঠাল সরিয়েছে। গাদপুর বাজারে দুটোই বেশ ভাল দামে বিকিয়েও গিয়েছে। তবে চিতু শুনেছে পরশু থেকেই একখানা কাটারি হাতে নিয়ে খগেন তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভয়ে আর বাড়িতে রাত কাটায়নি চিতু। গুনেনবাবুর বাড়ির হাতায় যে রোয়াক আছে, তাতে গামছা পেতে ঘুমিয়েছে। এসব ভয়ভীতি নিয়েই তাকে বেঁচে থাকতে হয়। লোকচরিত্র না জানলে এসব কাজে সুবিধে হয় না। চিতু ভালই জানে, লোকের রাগ বেশিদিন থাকে না। দু’-চারদিন গেলেই ঠান্ডা মেরে যায়। গরমাগরম আলুর চপ যেমন বাসি হলেই ন্যাতা, এ-ও তেমনি। তার দোষের ফিরিস্তি তো কম লম্বা নয়। এই তো রমেশবাবুর বাজারফেরত বারোটা টাকা আজ পর্যন্ত দিয়ে উঠতে পারেনি সে। রমেশবাবু দু’-চারদিন তাগাদা দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু মাত্র বারোটা টাকার কথা আর কতদিন মনে রাখা যায়? এই তো গত মাসে গুনেনবাবু তাকে চারজোড়া জুতো পালিশ করিয়ে আনতে বলেছিলেন। তার মধ্যে একজোড়া নিউকাট জুতো হাতছিপ্প করেছিল সে। আর সেটা মদনপুরের নিতাই সাহুর পায়ে এমন ফিট করে গেল যেন, খাপে খাপ কেদারের বাপ। তা নিতাই তাকে অনেক টালবাহানা করে চল্লিশটা টাকা দিয়েছিল। কয়েকদিন গা ঢাকা দেওয়ার পর একদিন গুনেনবাবুর মুখোমুখি পড়ে যাওয়ায় তিনি বাজখাঁই গলায় শুধু বলেছিলেন, “তোকে জুতোপেটা করা উচিত!” তা নিতান্তই অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে বলতে হয়।
চিতু ভাল করে ঠাহর করে দেখল, আজ খগেন মালোর হাতে দা বা কাটারি নেই। বাঁচোয়া। খগেন এখন শ্রীপদ মিস্ত্রির সঙ্গে কথা কইছে। চিতু কোলকুঁজো হয়ে একটু পিছু হটে কদম গাছটার আড়ালে গিয়ে আর-একবার উঁকি মেরে দেখল, না, খগেন এইদিকেই পিছন ফিরে আছে। গরিবকে ভগবানই দেখেন। চিতু মসৃণভাবে রাস্তা থেকে নাবালে নেমে নর্দমাটা ডিঙিয়ে পালবাড়ির পাশ দিয়ে কুমোরপাড়ায় ঢুকে পড়ল। চারদিকে এত চোখ তাকে খুঁজে বেড়ায় যে, গা ঢাকা দেওয়া ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠছে। বুক চিতিয়ে হাঁটার উপায় নেই। সর্বদাই চারদিকে নজর রাখতে হয়।
গুনেনবাবু একদিন তাকে ডেকে বলেছিলেন, “ওরে, তোর তো ট্যালেন্ট আছে, । ছিপছেপে, বুদ্ধিও কম নয়। তা হলে ছ্যাঁচড়া চোর হয়ে গাঁয়ে পড়ে আছিস কেন? চোর হলে বড় চোর হতে হয়। গাঁয়ে কি তোর কোনও ফিউচার আছে? আমি বলি, বড় শহরে গিয়ে হাতমকশো কর, মাছে-ভাতে থাকবি। থালাবাসন, ফলপাকড়, মাকড়ি, নথ চুরি করে কি আর জীবন চলবে! তোর বড় হওয়ার ইচ্ছে হয় না?”
ঘাড়টাড় চুলকে ভারী লজ্জা পেয়ে চিতু বলে, “তা কি আর হয় না জ্যাঠামশাই!”
“তবে? যাই কর না কেন, অ্যাম্বিশন থাকা চাই। মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। বুঝলি?”
চিতু যে বোঝে না তা নয়। সে লজ্জা-লজ্জা ভাবটা বজায় রেখেই বলে, “আজ্ঞে শহরে কি আর আমি কল্কে পাব জ্যাঠামশাই?”
“আহা, প্রথম প্রথম তো অসুবিধে আছেই। মনে রাখিস হাঁটিতে শেখে না কেহ না খেয়ে আছাড়। প্রথম প্রথম ধরা পড়বি হয়তো, চড়চাপড়ও হয়তো খেলি, কিছুদিন জেলও হয়তো খাটতে হল, তারপর সব সড়গড় হয়ে যাবে। কষ্ট না করলে কি আর কেষ্ট মেলে রে! যেদিকেই উন্নতি করতে চাস সেদিকেই প্রথমে খুব কষ্ট। ওসব গায়ে মাখতে নেই। নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য। চোরকে খানিকটা ম্যাজিশিয়ান, খানিকটা অ্যাক্রোব্যাট, খানিকটা অদৃশ্য মানুষ, খানিকটা ভূত আর খানিকটা ডাকাবুকো হতে হয়। বুঝলি? আমার তো মনে হয় চেষ্টা করলে তোর হবে। তোর গুণের অভাব নেই, শুধু চেষ্টার অভাব। তা তুই ছদ্মবেশ ধরতে পারিস তো?”
“ওই যাত্রা-থিয়েটারে যেমন হয়?”
“তাই। তবে পাকা কাজ হওয়া চাই। ধর, কারও বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ সেজে ঢুকে পড়লি। ধরা পড়লেও লোকে রবীন্দ্রনাথ দেখে ঘাবড়ে যাবে, তখন পালাতে সুবিধে। কিংবা অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, বিরাট কোহলিও সাজতে পারিস। যেখানে যেটা সুবিধে, বুঝলি তো! লোকে প্রথমে ধরতে সাহসই পাবে না, বরং ভারী অবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকবে। সেই ফাঁকে পিঠটান দিবি। ধর একটা ঘোড়া জোগাড় করলি, তারপর তার উপর সওয়ার হয়ে মাঝরাতে ঘোড়াসুদ্ধু কারও শোওয়ার ঘরে ঢুকে পড়লি। তখন লোকটা ঘুম ভেঙে উঠে শোওয়ার ঘরে ঘোড়সওয়ার দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে না? যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ওই ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা থাকতে থাকতেই কাজ হাসিল করে বেরিয়ে এলি! আরও কত ফন্দিফিকির আছে, মাথা খাটিয়ে বের করতে হয়।”
“আজ্ঞে সেটা কী রকম জ্যাঠামশাই?”
“ভাব, ভাবতে থাক। মাথাটা একটু না খাটালে কি হয়?”
চিতু যে ভাবেনি তা নয়। তবে তার মনে হয়েছে, গুনেন খাস্তগির তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। তার অত প্রতিভা নেইও। বোধ হয় সে গাঁ থেকে বিদেয় হলে গুনেনবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। তবে কথাটা ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। আরও কষে ভাবছে সে। আর ভাবতে গিয়েই আনমনা হয়ে পড়ায় আচমকা ব্রজমাস্টারমশাইয়ের কাছে ধরা পড়ে গেল।
“এই যে হতভাগা, আমার দু’-দুটো কাঁসার থালা কী করেছিস বল! কাকে বেচেছিস?”
চিতু আকাশ থেকে পড়ে বলে, “আমি! না-না মাস্টারমশাই, আমি আপনাদের থালা নিয়ে কি পাপের ভাগী হব? সব দোষ আমার ঘাড়ে এসে পড়ে বলে আমি আজকাল পরদ্রব্যের দিকে তাকাই না পর্যন্ত।”
“ওরে আমার ধর্মপুত্তুর রে! পরদ্রব্যের দিকে তাকান না! সেদিন আমার বাগানের আগাছা কাটতে গিয়ে কুয়োতলায় এঁটো বাসন থেকে দুটো থালা সরাসনি তুই? এ কাজ তুই ছাড়া আর কারও নয়!”
চিতু হেসেটেসে বিগলিত গলায় বলে, “দেশে চোরছ্যাঁচড়ের অভাব কী মাস্টারমশাই! এই তো সেদিন শেতলামন্দিরের বাইরে থেকে আমার চটিজোড়া চুরি হয়ে গেল! বাহান্ন টাকা দিয়ে কিনেছিলুম। দেশের অবস্থা আর কহতব্য নয় মাস্টারমশাই!”
“আর কত মিথ্যে কথা বলবি রে মর্কট? তোকে যে কেন পুলিশে ধরে না তা জানি না।”
“কী যে বলেন মাস্টারমশাই, থানার বড়বাবু তো আমাকে ছোট ভাইটির মতোই স্নেহ করেন!”