হিরণগড়ের ব্যাপারস্যাপার – ১

আজ্ঞে এ গাঁয়ে কি কোনও মন্দির আছে মশাই?”

“তা আছে বই কী। তা আপনি কোন ঠাকুরের মন্দির খুঁজছেন? মা কালী না কৃষ্ণঠাকুর?”

“ঠিক মন্দির নয় বটে, আমি খুঁজছি চণ্ডীমণ্ডপ বা দুর্গামণ্ডপ।”

“কেন মশাই, চণ্ডীমণ্ডপই বা খুঁজছেন কেন?”

“আজ্ঞে, আমার একটু মাথা গোঁজার জায়গা দরকার।”

“আপনার মতলবটা কী বলুন তো মশাই? এখানে মাথা গোঁজার

জায়গা খুঁজছেন যে বড়? কে আপনি, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?”

“আজ্ঞে এ বড় শক্ত প্রশ্ন, আমিও নিজেকে বারবার জিজ্ঞেস করছি, ‘তুমি কে বাপু’, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ তা এখনও অবধি জবাব পাইনি।”

“মশকরা হচ্ছে নাকি মশাই? আপনি নিজের নাম জানেন না, ঠিকানা জানেন না, তবে এখানে উদয় হলেন কী করে?”

“না মশাই, না। নাম আমার একটা আছে। মনে পড়ছে না বটে, কিন্তু আছে। আর ঠিকানাও যে নেই তাও নয়, থাকারই কথা। কিন্তু মুশকিল হয়েছে বরচড়াইয়ের হাটে আমি অজ্ঞান অসহায় পড়েছিলাম, যখন জ্ঞান এল তখন লোকে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। নাম, ধাম, বাপের নাম কত কী। আমি হাঁ করে অনেকক্ষণ ভেবেও কিছুই মনে করতে পারলাম না। লোকে নানা রকম সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগল, এমনকী পুলিশে দেওয়ার কথাও বলছিল। তাই কোনও রকমে পালিয়ে এসেছি। তা এ গাঁয়ে কি একটু জিরোতে পারি?”

“না মশাই, আপনার কথায় একটা মারপ্যাঁচ আছে বলে মনে হচ্ছে। আপনি বড় সোজা লোক নন। একটা কোনও মতলব নিয়ে আমাদের গাঁয়ে হানা দিয়েছেন। স্মৃতিভ্রংশ হওয়াটা একটা ধাপ্পা ছাড়া কিছু নয়।”

“আমি বুঝতে পারছি আমার কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, কিন্তু কী যে করি তাও বুঝে উঠতে পারছি না। তা আপনাদের গাঁয়ে একটু জিরোতে দেবেন কি? একটু হাঁফ ছেড়ে তারপর না হয় চলে যাব।”

“সেটা মন্দ কথা নয়। একটু জিরিয়ে নিয়েই কিন্তু গাঁ ছেড়ে চলে যেতে হবে, মনে থাকে যেন।”

“যে আজ্ঞে, তাই হবে। এ গাঁয়ের নামটা কী, জানতে পারি?”

এ গাঁয়ের নাম হিরণগড়। এক সময় হিরণ রাজাদের রাজধানী ছিল। এখন অবশ্য সেই সবের চিহ্নও নেই। তবে মনে রাখবেন এ হচ্ছে লেঠেলদের গাঁ। মতিওস্তাদ, গেনুওস্তাদ, করালী লেঠেলদের নাম শুনেছেন তো! এই গাঁয়েই তাদের বসবাস, এখানে তাই কারও গাঁইগুঁই চলে না।”

“আজ্ঞে আমাকে আর ভয় দেখাবেন না, আমি ভয়ে এমনিতেই কাঠ হয়ে আছি।”

“ভয় থাকা ভাল, ভয় আমাদের অনেক বিপদ থেকে বাঁচায়। বুঝলেন?”

“যে আজ্ঞে।”

লোকটা তেমন হাট্টাগাট্টা নয়, তবে লম্বাপানা বটে। দেখে খারাপ লোক বলে মনেও হচ্ছে না ঠিকই, তবু দিনকাল তো ভাল নয়, কার মনে কী আছে তা কে জানে। তাই রমেশ গুণ লোকটাকে আড়চোখে বারবার মাপজোক করছিল। নাহ, এ বোধ হয় একেবারেই ভেজা মুড়ির মতো ন্যাতানো লোক।

রাধামাধব জিউর মন্দিরের সামনে দিব্যি বাঁধানো চণ্ডীমণ্ডপ। রমেশ বলে, “ওই চণ্ডীমণ্ডপ। ওপাশে টিউবওয়েল আছে, জল খাবেন কি?”

লোকটা এই প্রথম একগাল হেসে বলে, “বড্ড তেষ্টা পেয়েছে, কণ্ঠা থেকে পেট অবধি শুকনো। বাঁচালেন।”

রমেশের একটু মায়া হল, বলল, “চলুন, পাম্প করে দিচ্ছি।”

ঘোঁতঘোঁত করে অনেকটা জল খেল লোকটা। চোখেমুখে জল থাবড়াল। তারপর ধুতির খুঁটে মুখ মুছে বলল, “আমার প্রাণ রক্ষা করলেন মশাই।”

লোকটা যে সোজাসরল মানুষ তা বুঝতে পারছে রমেশ। তাই তার আরও একটু মায়া হল, বলল, “কিছু খেতে চাইলে ওই সামনের দিকে রাস্তার উপর মুড়িচিঁড়ের দোকান আছে।”

লোকটা কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “আজ্ঞে খিদের কথা আর করেন না। ও হরবখত পেয়েই আছে। কিন্তু পেলেই তো হবে না, ও সইয়ে নেওয়াই ভাল।”

“সইয়ে নেবেন কেন মশাই? পকেটে পয়সা নেই বুঝি!”

“আজ্ঞে আমার মনে হচ্ছে যেন পকেটে পয়সা ছিল, থাকারই কথা কিনা। হাটে যখন এসেছিলাম তখন কিছু কিনতেই এসেছিলাম নিশ্চয়ই। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর দেখছি পকেটে কিছু নেই। তা আপনি ব্যস্ত হবেন না, জল খাওয়ার পর খিদে মরে গিয়েছে। এখন বেশ কিছুক্ষণ চলে যাবে।”

রমেশ চিন্তিত হয়ে বলে, “না-না, শত হলেও আপনি গাঁয়ের অতিথি, উপোসি থাকলে গাঁয়ের বদনাম হবে।”

“না-না, আমি কাউকে কিছু বলব না।”

“আহা, আমাদের বিবেক বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। আপনি বসুন, আমি আসছি এক্ষুনি।”

রমেশ গিয়ে দোকান থেকে একটা বড় ঠোঙায় মুড়ি আর মুড়কি মিশিয়ে নিল আর শালপাতার বাটিতে দুটো রসগোল্লা। আয়োজন দেখে লোকটার চোখ কপালে উঠল, বিনয়ে-কৃতজ্ঞতায় যেন গলে পড়ছে। হাত কচলাতে কচলাতে বলল, “আপনার বড় দয়া, আপনার মন কত্ত বড়। উহ! ভাবা যায় না, আজকের যুগেও এত ভালমানুষ আছে! কত কী এনেছেন, রসগোল্লা অবধি, উরেব্বাস রে!”

ভারী যত্ন করে সবটা মুড়িমুড়কি খেল লোকটা, একটা দানাও মাটিতে পড়েনি। রসগোল্লা দুটো একটু-একটু করে কৃপণের মতো খেয়ে রসটুকুও গলায় ঢেলে দিল। খাওয়া দেখে চোখে জল আসছিল রমেশের। সে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে, “শুনুন মশাই, আমি কিন্তু ভারী হিসেবি লোক, বাজে খরচা পছন্দ করি না। তবে আমার গিন্নি আমার মতো নয়, ভারী ধর্মভীরু মানুষ, দানধ্যান, গরিব-দুঃখীকে খাওয়ানো তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এখন মোটে সাড়ে এগারোটা বাজে। আপনি এখানেই বিশ্রাম করুন। ভাত খাওয়ার সময় হলে আমি আপনাকে ডেকে নিয়ে যাব।”

“ভাত!” বলে লোকটা হতবুদ্ধির মতো হাঁ করে চেয়ে রইল, যেন ভাত কথাটা জীবনে প্রথম শুনছে। তারপর হঠাৎ ভ্যাক করে কেঁদে ফেলল। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, “জীবনে যে আর কখনও ভাত খাব তা মনেই হচ্ছিল না। আপনি বোধ হয় ভগবান।”

রমেশ ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “আরে, দুটো ভাত খাবেন, এ আর বেশি কথা কী! তবে আপনার এখন একটা নাম দরকার। একটা ভাল দেখে কাজ চালানোর মতো নাম ভাবুন তো!”

“নাম! আমি কি নিজের নাম নিজে রাখতে পারি? সেটা ঠিক হবে না। বরং আপনিই আমার একটা নাম দিন।”

রমেশ একটু ভেবে বলে, “এটা হল গিয়ে গোপাল জিউয়ের মন্দির। তা ভালই হল, আপনার নাম গোপাল রাখলে কেমন হয়?”

লোকটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, মুখে হাসি ধরে না, বলে, “উরেব্বাস রে, এ তো জব্বর নাম। এই নামটা আমাকে দিলেন? আমার যে এত ভাল একটা নাম হবে তা কে জানত! আহা, গোপাল যে বড্ড ভাল নাম! আপনার ভাল হোক, খুব ভাল হোক।”

রমেশ একটু হেসে বলে, “আচ্ছা গোপালবাবু, আপনি এখানে বসেই বিশ্রাম করুন, আমি বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আপনি রমেশ গুণের লোক।” “যে আজ্ঞে।”

রমেশ চলে যাওয়ার পর গোপাল ডগমগ হয়ে বসে রইল। নতুন নাম পেয়ে গোপালের এত আনন্দ হচ্ছে যে, সে একা একাই ফিচিক ফিচিক করে হেসে ফেলছে। নাম ছাড়া ভারী মুশকিলে পড়ে গিয়েছিল সে। ওহ, তোফা নাম হয়েছে বটে, গোপাল।

একটা কোলকুঁজো বুড়ি কাঁকালে একটা ঝুড়ি নিয়ে কাঠকুটো কুড়োচ্ছে। গোপাল তার আনন্দ চেপে রাখতে না-পেরে বলে উঠল, “ও বুড়িমা, আমার নাম হল গে গোপাল, বুঝলে! গোপাল।”

বুড়িমা খ্যাঁক করে উঠে খনখনে গলায় বলে, “তা তুই গোপাল না কপাল তা জেনে আমার কী হবে রে ড্যাকরা? যত হাড়হাভাতে এসে জোটে এই গাঁয়ে! কে তোর নামধাম জানতে চেয়েছে রে পাজি? পেছুতে লাগবি তো ঝ্যাঁটা মেরে ভূত ঝেড়ে দেব, এই বলে রাখলুম। এই মানি বষ্টুমিকে সবাই চেনে।”

গোপাল একটু মিইয়ে গেল। বুড়িকে ঘাঁটানো ঠিক হয়নি। চুপচাপ বসে আকাশপাতাল ভাবছিল সে। চটকাটা ভাঙল একটা মোলায়েম গলা শুনে।

“এই চাঁদবদনটি তো চেনা-চেনা লাগছে না বাপু! তা কোথা থেকে উদয় হলে বলো দিকিনি বাপ!”

গোপাল দেখে সামনে গোলগাল চেহারার একজন লোক, পরনে ধুতি, খুঁটটা গায়ে জড়ানো। মুখে পান এবং একটু বিচ্ছুর মতো দুষ্টু হাসি। গোপাল সভয়ে বলে, “আজ্ঞে আমি হলুম গে গোপাল।”

“বাহ বাহ! বেশ! তা ভায়া গোপাল, তোমার চেহারা দেখে তো ভদ্রলোকের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে! তা কোথা থেকে আগমন? সাকিন কোথায়?”

গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “আজ্ঞে সবাই ও কথা জিজ্ঞেস করলে কি চলে?”

“কেন বাপু, তুমি কি ফেরারি আসামি? খুনখারাপি করে পালিয়ে আসোনি তো? নাকি বড় মাপের ডাকাতি করে এসেছ?”

“আজ্ঞে সেসব আমি বলতে পারব না। আমার কিছু মনে পড়ছে না।”

লোকটা চোখ কপালে তুলে বলে, “বলো কী হে, এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে এলে আর বেমালুম সেটা ভুলে গেলে? এ তো ভাল কথস নয় বাপু! একটু ঝেড়ে কাশো তো গোপাল, তোমার মতলবটা কী? এই ভালমানুষদের গাঁয়ে পালিয়ে থাকতে এসেছ বুঝি? কী সব্বোনেশে লোক হে তুমি!”

গোপাল খুব ভাবিত হয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, “আজ্ঞে আমি পালিয়ে থাকতে আসিনি মশাই, আমি একটু জিরেন নিতে এসেছি। একটু বাদেই চলে যাব। আমি ভাল লোক না খারাপ লোক তাও বলতে পারি না। আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না। রমেশবাবু আমাকে এখানে বসে থাকতে বলে গিয়েছেন।”

লোকটা ভ্রু কুঁচকে বলে, “কে? কার কথা বলছ? রমেশ গুণ নাকি হে?

“আজ্ঞে তিনিই।”

“ও বাবা, তুমি তো দেখছি বড় গাছে নৌকো বেঁধেছ! তা রমেশ গুণকে পটালে কী করে? সে তো বিচক্ষণ লোক বলেই জানতুম!”

“উনি আমাকে মুড়ি-মুড়কি খাইয়েছেন, রসগোল্লা খাইয়েছেন, শুনছি নাকি ভাতও খাওয়াবেন। বড্ড ভাল লোক। আমার নামটাও ওঁরই দেওয়া কিনা।”

লোকটা অবাক হয়ে বলে, “নাম! তোমার নামও রমেশ গুণ দিয়েছে নাকি? তার মানে কী? তুমি কি গা ঢাকা দিতে ছদ্মনামও নিয়েছ নাকি হে? তা হলে তোমার আসল নাম কী?”

গোপাল ঠোঁট উলটে বলে, “কে জানে মশাই, সে আমার মনে নেই।”

লোকটা চোখ গোল্লা-গোল্লা করে তাকিয়ে রইল, মুখের বিচ্ছু হাসিটা আর নেই মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “না হে, লোকে আমার বুদ্ধি-বিবেচনার প্রশংসা করে বটে, কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, আমি কিছু বুঝতেই পারছি না। এ যেন কেউ আমাকে একটা শক্ত অ্যালজেব্রার সামনে বসিয়ে দিয়েছে। ওই অ্যালজেব্রার ভয়েই আমি লেখাপড়া ছেড়েছিলুম কিনা, নইলে ফার্স্ট ডিভিশন আমার বাঁধা ছিল, বুঝলে?”

“যে আজ্ঞে।”

লোকটা এবার চাতালটার উপর জুত করে বসে বলে, “নিজের নাম মনে নেই, এ তো বড় তাজ্জব কথা হে!”

গোপাল মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “ওটাই তো হয়েছে মুশকিল। আমার বাপ-মা আছে কিনা মনে নেই, আমার বাড়িঘর আছে কিনা মনে নেই, বউ-বাচ্চা আছে কিনা মনে নেই, এমনকী আমার নিজেকেই মনে নেই। আমি যে কে সেটাই বুঝতে পারছি না মশাই।”

“তোমার কি সন্ন্যাস নেওয়ার মতলব নাকি হে বাপু! এ তো সন্নিসির লক্ষণ দেখছি!”

“আজ্ঞে সেটাও তো বুঝতে পারছি না।”

লোকটা একটু ঠেস দিয়ে বলে, “তা হলে তুমি বলতে চাও যে, তোমার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে? কিন্তু বাপু, এটা লোকে বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। বরং আমার কাছে চুপিচুপি আসল মতলবটা ফাঁস করলেই পারতে। আমি পাঁচজনকে বুঝিয়েসুঝিয়ে তোমার সুবিধেই করে দিতে পারতুম। যাক গে, রমেশ গুণকে ঘাঁটানো ঠিক হবে না। সে যখন তোমার মুরুব্বি তখন সে-ই ঝক্কি সামলাবে। আমি উঠি।”

লোকটা চলে গেল। একটু বাদেই প্যাংলা চেহারার একটা লম্বাটে লোক লগবগ করে হাঁটতে-হাঁটতে এসে সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে মাথা চুলকোতে লাগল। মুখে দাড়ি, উড়োখুড়ো চুল, পরনে লুঙ্গি আর গায়ে ডোরাকাটা লাল একটা জামা। কিছুক্ষণ খুব মন দিয়ে তাকে দেখল। তারপর বড়-বড় দাঁত দেখিয়ে খ্যাঁক করে একটু হেসে বলল, “নতুন লোক মনে হচ্ছে! ঠিক ধরেছি কিনা, অ্যাঁ?”

গোপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ষে আজ্ঞে।”

লোকটা গম্ভীর হয়ে বলে, “এই গাঁয়ের লোকগুলো হাড়ে হাড়ে শয়তান, বুঝলেন! একটাও ভাল লোক খুঁজে পাবেন না। সব বদমাশ, কাউকে বিশ্বাস নেই। নতুন এসেছেন তো, বুঝবেন। তা কুড়িটা টাকা চট করে বের করুন তো!”

গোপাল মাথা নাড়া দিয়ে মলিন মুখে বলল, “আজ্ঞে আমার কাছে টাকাপয়সা কিছুই নেই।”

লোকটা হঠাৎ তেড়িয়া হয়ে বলে, “নেই মানে? নেই বললেই হবে? তা হলে আমার চলবে কী করে, অ্যাঁ!”

ভাবিত হয়ে গোপাল বলে, “তা বটে, তবে আমার কাছে তো কিছুই নেই। কী করা যায় বলুন তো!”

“চালাকি ছাড়ুন মশাই, যা আছে দিয়ে দিন। বিশ না থাকে তো দশেই কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে নেব।”

খুব দুঃখের সঙ্গেই গোপাল বলে, , “আমার সবই হারিয়ে গিয়েছে মশাই, আমি নিজেই হারিয়ে গিয়েছি। এ যে কী যন্ত্রণা তা

লোকটা ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, “দূর-দূর, যত হাড়হাভাতে আর ভুখা পার্টি এখানে এসে জোটে। সবাই নেই-নেই বললে কি হয়? লাইফটায় ঘেন্না ধরে গেল।”

যদি বুঝতেন!”

লোকটা লগবগ করতে করতে বিদায় হল। বিড়বিড় করে বোধ হয় গালাগাল দিচ্ছিল গোপালকে। তা দিক। তার এখন যা অবস্থা তাতে চামচিকের লাথিও হজম করতে হবে।

বসে আকাশপাতাল ভাবছিল সে। ভাবনারই বিষয়। এ যে কী বিপাকেই পড়া গেল! এখন কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, খাবেই বা কী, পয়সাই বা আসবে কোত্থেকে কিছুই বুঝতে পারছে না।

খুব চিন্তিত দেখছি যে! তা হাতের কাছে একজন মুশকিল আসান থাকতে চিন্তা কিসের? তা ভায়া, তোমার সমস্যাটা কী? একটু বেশ খোলতাই করে ফাঁদিয়ে বলো তো দেখি!”

“ভায়াকে

গোপাল চোখ তুলে যাকে দেখল সে একজন মাঝবয়সি লোক। বেঁটেখাট, মোটাসোটা, রক্তাম্বর পরা লোক। বাবরি চুল, কপালে একটা লাল তিলক গোছের। কালো দাড়ি আর তাগড়াই মোচ। গোপাল হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে ভক্তিভরে বলে, “পেন্নাম হই, বাবাজি। আমি গোপাল।”

“তাই বলো! ভাবছিলাম তোমাকে এত চেনা-চেনা লাগছে কেন! তাহলে তুমিই হলে গোপাল! বেশ-বেশ।”

গোপাল হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “আপনি কি আমাকে চেনেন বাবাজি?”

“আহা, তুমি কি আমার একজন্মের চেনা! তোমাকে যে জন্মজন্মান্তর ধরে চিনি হে!”

“ওহ, বাঁচালেন বাবাজি, দয়া করে যদি আমার নামধামটা বলে দেন তাহলে বড্ড ভাল হয়। আমি সব ভুলে মেরে দিয়েছি কিনা! স্মৃতিভ্রংশ হওয়ায় আমাকে ভারী হয়রান হতে হচ্ছে বাবাজি! রক্ষে করুন!”

বাৰাজি মোলায়েম গলায় বলে, “হবে, হবে, স্মৃতিটিতি সব ফিরে আসবে হুড়মুড় করে। কিন্তু তার জন্য যে একটা অগ্নিহোত্রী যজ্ঞ করতে হবে বাপু। সব কিছুরই একটা প্রক্রিয়া আছে তো! এখন পাঁচটি হাজার টাকা ফেলে দিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকো, কাল সন্ধে নাগাদ সব মনে পড়ে যাবে।”

বেকুবের মতো একটু চেয়ে থেকে গোপাল স্নানমুখে বলল, “টাকা? আমার কাছে যে টাকাপয়সা নেই বাবাজি!”

বাবাজি অবাক হয়ে বলে, “টাকাপয়সা নেই? তা আগে বলতে হয়। টাকাপয়সা না থাকলে স্মৃতি ফিরবেই বা কী করে?” “কিন্তু আপনি যে বললেন আমাকে চেনেন।”

“তা চিনি বই কী, হাড়ে হাড়ে চিনি হে, রগে রগে চিনি। চিনলেই বা বলতে গিয়েছি আর কী! ওসব কি আর বিনিমাগনা হয় হে! পয়সা লাগে। এক কিলো গাওয়া ঘিয়ের দাম জান? যজ্ঞে অমন পাঁচ কেজি ঘি তো লাগবেই। তারপর ষজ্ঞের মেহনতও তো কম নয়! না হে বাপু, অন্য মক্কেল ধরতে হচ্ছে।”

লোকটা বিদায় হলে গোপাল ফের আকাশপাতাল ভাবতে লাগল। “আরে! বগলাপতি না! হরেন ঘোষের জামাই?”

গোপাল চমকে উঠে বলে, “অ্যাঁ, কিছু বললেন?”

“তুমি তো হরেন ঘোষের জামাই বগলাপতি। তা তুমি এখানে বসে হাঁ করে কী ভাবছ?”

গোপাল ভারী খুশি হয়ে একগাল হেসে বলে, “আমি বগলাপতি! ওহ, বাঁচালেন মশাই। এই এতক্ষণ ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছিলাম। যাক, এতক্ষণে জানা গেল যে আমি বগলাপতি। আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব! আমার প্রাণ রক্ষে করলেন মশাই।”

লোকটা টুকটুকে চেহারার একজন বুড়োমানুষ, পরনে পরিপাটি ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে একখানা বাহারি লাঠি। পায়ে দামি চপ্পল। বেশ অভিজাত চেহারা। সাবেক জমিদারটমিদার হবেন বোধ হয়। একটু অবাক হয়ে বললেন, “বলো কী হে? তুমি যে বগলাপতি এতে কি তোমার নিজের কোনও সন্দেহ আছে নাকি? হরেন ঘোষের মতো মহাজন তোমার শ্বশুর, এ কি চাট্টিখানি কথা!”

“আজ্ঞে না, ওই একটু কেমন ভীমরতির মতো হয়েছিল। এখন সব ঠিকমতো বুঝতে পারছি। আমি হলুম গে বগলাপতি, হরেন ঘোষ আমার শ্বশুর। এখন সব জলের মতো পরিষ্কার। তা মেসোমশাই, হরেন ঘোষের বাড়িটা তো বোধ হয় এই ডান দিকের রাস্তাতেই হবে, না?”

“বলো কী হে, শ্বশুরবাড়ি কেউ ভুলে যায় জন্মেও শুনিনি বাপু! তোমাকে নিশ্চয়ই কানাওলায় ধরেছে। ও বড় পাজি ভূত, বেঘোরে ঘুরিয়ে মারে। আমাকেও কয়েকবার ধরেছিল কিনা! তা ওই ডান দিকে এগিয়ে যাও, বাঁ হাতে সিংদরজাওয়ালা বাড়ি। সবাই চেনে।”

“যে আজ্ঞে, আপনি বড্ড ভাল লোক, ” এই বলে গোপাল উঠে হনহন করে ডান দিকের রাস্তায় রওনা হল।

এমন সময়ে লোকটা পিছন থেকে হাঁক মারল, “ওহে বাপু, একটু শোনো, কথা আছে।”

গোপাল ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, “কিছু বললেন মেসোমশাই? ওদিকে আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছেন, আমি গেলে তবে সবাই খাবেন। জামাই না খেলে কেউ কি খেতে পারে?”

“তা বটে। তবে কোথায় যেন একটু ভুল হচ্ছে, বুঝলে? তুমি দাঁড়ানোর পর দেখছি তুমি বেশ লম্বা। কিন্তু বগলাপতি তো নাটা মানুষ, বেশ বেঁটেখাটই বলা যায়।”

“আজ্ঞে, হয়তো বেঁটেই ছিলুম, এখন একটু লম্বা হয়েছি বোধ হয়। কী বলেন? এমন তো হতেই পারে, তাই না?”

“দূর, আঠারো বছরের পরে লোকে আর লম্বা হয় না, বুঝলে! আরও একটু কথা আছে।”

গোপাল হতাশ হয়ে বলে, “আর কী কথা?”

“মনে পড়ল, বগলাপতি বেশ কালো, কিন্তু তুমি তো দিব্যি ফরসা মানুষ! না হে, তুমি বোধ হয় বগলাপতি নও!”

গোপাল প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “নই? তা হলে এখন কী হবে?” “ভালই হবে হে, উটকো লোক জামাই বলে হাজির হলে যে হেনস্থা হতে হত তা থেকে তো বেঁচে গেলে!”

“বাঁচলুম আর কোথায় মেসোমশাই, যে তিমিরে সেই তিমিরেই পড়ে রইলুম।”

“আহা, হরেন ঘোষ না হোক, কোথাও না-কোথাও কেউ না-কেউ তোমার একজন শ্বশুর ঠিকই আছে। কষ্ট করে একটু খুঁজে তো দেখো!”

“শ্বশুর খোঁজা কি চাট্টিখানি কথা, মেসোমশাই! শ্বশুর বলে চিনব কী করে? নাহ, যাও বা একটা জুটে গিয়েছিল সেটাও গেল ভেস্তে। হরেন ঘোষ নামটা শুনে বেশ শ্বশুর-শ্বশুর মনেও হচ্ছিল কিন্তু!”

“মনে হলেই তো হবে না, হরেন ঘোষের তোমাকে জামাই-জামাই

বলে তো নাও মনে হতে পারে! তখন কী হবে তা ভেবে দেখেছ?” “তাও তো বটে!”

“এবার তা হলে চলি হে, ” বলে লোকটা বিদেয় হলে গোপাল ভারাক্রান্ত মনে ফের দুশ্চিন্তা করতে বসল। এই ভরদুপুরেও সে যেন চোখে অন্ধকার দেখছে। ভাবতে ভাবতে একটু ঢুলুনি এসে গিয়েছিল। গোপালের। এমন সময় রমেশ গুণ এসে ডাকল, “ও গোপালবাবু, চলুন, আমার বউ ভাত বেড়ে বসে আছে যে!”

“ভাত!” বলে চটকা ভেঙে একগাল হাসল গোপাল, “না মশাই  আপনি ছদ্মবেশী ভগবানই হবেন বোধ হয়! এত দয়ামায়া কি মানুষের থাকে!”

রমেশ গুণের বেশ পাকা একতলা বাড়ি। ভারী সুন্দর একটু বাগান আছে সামনে। চওড়া বারান্দা। ঘরদোর খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। লক্ষ্মীশ্রী আছে। বাড়ির মা-টিও ভারী লক্ষ্মী মহিলা। রমেশ গুণ ভাগ্যবান লোক, নইলে এমন ভাল বউ জোটে? তিনি গোপালকে নতুন একটা গামছা দিলেন, বাটি করে একটু তেল, আর নতুন একটা সাবান। বললেন, “যান বাবা, কুয়োতলায় গিয়ে স্নান করে আসুন, এসে কাচা ধুতি পরবেন। আমি গুছিয়ে রেখেছি।”

শুনে গোপাল আর নিজেকে সামলাতে পারল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল।

রমেশের বউ ভারী বিব্রত হয়ে বলেন, “ও কী বাবা, কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে?”

“আজ্ঞে এই হাড়হাভাতের জন্য এত করছেন কেন মা? আমাকে উঠোনে বসিয়ে শালপাতায় দু’টি ভাত দিলেই তো হত!”

“তাই কি হয় বাবা? অতিথি নারায়ণ। তার উপর আপনার চেহারা দেখেই মনে হয় আপনি বড় ঘরের মানুষ। আতান্তরে পড়ে এই দুর্দশা! যান বাবা, স্নান সেরে নিন, নিশ্চয়ই আপনার খিদে পেয়েছে!”

গোপাল আরও কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদল। ভগবান, এদের যেন খুব ভাল হয়, যেন খুব মঙ্গল হয়!

বড়ই সম্মানের ব্যাপার, গৃহকর্তা রমেশের পাশেই পিঁড়ি পেতে তাকে খেতে দেওয়া হয়েছে। সঙ্কোচে সে একেবারে সিঁটিয়ে রইল। সে উটকো লোক, এত আপ্যায়ন কি তার পাওনা হয়? আর খাওয়ার আয়োজনও পেল্লায়। শুক্তো, মোচার ঘণ্ট, পোস্তর বড়া, ছোলার ডাল, আলুর দম, তেঁতুলের চাটনি আর টক দই। খেয়ে একেবারে হেউঢেউ হয়ে গেল গোপালের। বাড়ির মা বললেন, “আমাদের বাড়তি ঘর আছে বাবা, আপনি সেখানেই এখন কিছুদিন থাকুন। সব মনে পড়লে তারপর না হয় ফিরে যাবেন।”

গোপাল আঁতকে উঠে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, “না মা, না! আমি অজ্ঞাতকুলশীল, স্মৃতিভ্রংশ মানুষ, আমাকে এত প্রশ্রয় দেবেন না। কে জানে আমি কেমন লোক! এরকম লোককে আশ্রয় দিয়ে যে বিপদে পড়বেন মা!”

পাশ থেকে রমেশ বলে, “ওসব বলে লাভ নেই। টগরের যখন মনে হয়েছে যে আপনি ভাল লোক, তখন ওটাই ওর শেষ কথা। খুব জেদি মেয়ে মশাই।”

টগরও বলে, “আপনি খারাপ না ভাল তা কি আপনি বুঝতে পারবেন? আমি লোক চিনি। আপনি যে একজন সোজা-সরল, ধর্মভীরু মানুষ তা দেখলেই বোঝা যায়।”

ফের চোখে জল এল গোপালের। এসব কী হচ্ছে! কেন হচ্ছে! এত সুখ কি তার সইবে!

বাড়ির পিছন দিকে একটা একটেরে সুন্দর ঘরে তার জায়গা হল। টগর বলে, “এটা আমার শ্বশুরমশাইয়ের ঘর, এই দু’বছর হল স্বর্গবাস হয়েছে। তা আপনি এখানে দিব্যি থাকবেন। আমার দুই ছেলে আর এক মেয়ে, তারা কেউ এখানে থাকে না। শহরে মামাবাড়িতে থেকে ভাল স্কুলে পড়ে। বাড়ি একদম ফাঁকা, আপনি থাকলে বাড়িটা তবু একটু ভরা-ভরা লাগবে।”

আপ্লুত হয়ে ফের চোখে জল এল গোপালের। পেটে ভাত, মাথার উপর ছাদ, এত আদরযত্ন, বাবা বলে ডাক, এত সুখ সে কোথায় রাখবে! নাহ, সে বোধ হয় স্বপ্নটপ্ন দেখছে!