ছয়
একজন প্রবীন ডাক্তার এসে শবনমের ক্ষতস্থান দেখলেন। তারপর অভ্যস্থ হতে শুরু করলেন কাজ। দুটি গুলির টুকরো বিঁধেছিল ভেতরে। সেগুলো বার করে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে একটা ইঞ্জেকশান দিলেন। তারপর লালচাঁদের বুক থেকে বুলেট বার করতে গিয়েই থমকে গেলেন।
শবনম বলল, কী হল?
এনার তো একেবারেই শেষ অবস্থা।
তা হলে?
তা হলে আর কী? দেখি চেষ্টা করে। তবে মনে হয় বাঁচাতে পারব না।
লালচাঁদ বললেন, আমাকে বাঁচতেই হবে ডাক্তার। যে ভাবেই হোক বাঁচান। এখনও আমার অনেক কাজ বাকি।
কী করে বাঁচাব? এসব কাজ কি এইভাবে যেখানেসেখানে হয়? নেহাত তোমাদের ডাকাতের প্রাণ তাই। অন্য কেউ হলে মরেই যেত এতক্ষণ। মরতে আমিও চাই ডাক্তার। শুধু আজ রাতটুকুর মতো তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দাও।
মরলে তুমি এখুনি মরবে। রাত কাটলে আর তোমাকে মারে কে? দেখি চেষ্টা করে কতদূর কী করতে পারি।
ডাক্তারের কাজ শেষ হলে শবনম বলল, আমরা এই মুহূর্তে আপনার পারিশ্রমিক দিতে পারলাম না। তবে আপনার কার্ডটা রেখে যান। আমাদের লোক যথাসময়ে গিয়ে আপনার টাকা পৌঁছে দিয়ে আসবে।
ডাক্তারবাবু বললেন, টাকাই কী জীবনের সব মা? এসব কাজ পুলিশকে লুকিয়ে আমাদের প্রায়ই করতে হয়। তবে একটাই অনুরোধ, কখনও কোনও বিপদে যদি পড়ি, তখন তোমাদের সাহায্য চাইলে একটু পাশে এসে দাঁড়িয়ো।
শবনম বলল, যদি বেঁচে থাকি আর ওইরকম দিন যদি সত্যিই কখনও আসে, তা হলে নিশ্চয়ই আপনার পাশে গিয়ে দাঁড়াব আমরা।
ডাক্তারবাবু চলে গেলন।
লালচাঁদকে বহু কষ্টে ঘোড়ায় বসিয়ে সবাই আবার সেই ঘনান্ধকারে কেল্লা-পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগল।
সাধু ওদের জন্য হানটান করছিলেন এতক্ষণ।
বিক্রমের মৃত্যুর কথা এবং লালচাঁদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা শুনে, একদিকে যেমন দুঃখ পেলেন, অপর দিকে তেমনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। এই ক্রোধ অবশ্যই ওই শয়তান দুর্জন সিং-এর ওপর। মংঘীরামের ওপর।
যাই হোক। লালচাঁদকে পাহাড়িদের জিম্মায় রেখে সাধু বললেন, আর দেরি নয়। এই হচ্ছে প্রকৃত শুভক্ষণ। এইবার আমরা গোপন পথে কেল্লার ভেতরে ঢুকব।
হিংলাজসর্দার বলল, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব বাবা। ওই শয়তানের শয়তানির উপযুক্ত জবাব আমিও দিতে চাই।
বাইরে তা হলে নেতৃত্ব দেবে কে?
লালচাঁদ অতিকষ্টে বললেন, বাইরেটা আমিই দেখতে পারব সর্দার। আপনি ভেতরে ঢুকুন। কেল্লা দখল হয়ে গেলেই আলোর সংকেত দেবেন। আমরাও তখন ভেতরে ঢুকব। কিন্তু যতক্ষণ তা না হয় ততক্ষণ যে ওই কেল্লার ভেতর থেকে বেরোতে যাবে তাকেই গুলি করে মারব। অতএব সাবধান। সংকেত না দিয়ে কেউ যেন সামনের ফটক দিয়ে বেরোতে যাবেন না।
সাধু শবনমের একটি হাত ধরে টান দিলেন, আয় মা। দেবীর চরণস্পর্শ করানো এই বন্দুক আর একবার দেবীর পদতলে রেখে চল ওই দুষ্টুকে দমন করতে।
সাধুবাবা, শবনম, হিংলাজ এবং লালচাঁদের দলের আরও জনা-চারেক যোদ্ধাকে সঙ্গে নিলেন। এদিকে পাহাড়ি বস্তির সবাই প্রায় তির, কাঁড়, টাঙি, বল্লম, কুণ্ডুল নিয়ে তৈরি। সবাই যেতে চায় সাধুর সঙ্গে ওই কেল্লার ভেতরে।
সাধু একটু কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, সবাই আয়। তবে এই গোপন পথের সন্ধান কাউকে দিবি না। বিশেষ করে পুলিশকে। আজ রাতেই হোক, আর কাল সকালেই হোক পুলিশ এখানে আসবেই। পুলিশ না যাওয়া পর্যন্ত আমি এই গুহার জঠরে লুকিয়ে থাকব। যদিও পুলিশ আমাকে চিনবে না। কেন না এখনকার নতুন নতুন পুলিশ আমার চেহারাটাই দেখেনি কখনও। তা ছাড়া আমি একজন তান্ত্রিক সাধু, এই হবে আমার পরিচয়। ভয় শুধু লালচাঁদকে নিয়ে।
লালচাঁদ বললেন, ভয় নেই। পুলিশ এলে আমিও গা ঢাকা দেব। আমার লোকেরাও সরে পড়বে। তারপর পুলিশ চলে গেলে সাধারণ মানুষের মতো আমরা আবার এসে জুটে যাব ঠিক। তা ছাড়া আপনার আশীর্বাদে, মা ভবানীর কৃপায়, আমার দুর্বলতা একটু একটু করে কাটছে। মনে হচ্ছে এ যাত্রা হয়তো আমি বেঁচেও যেতে পারি।
মা ভবানী তোমার ভাল করুন। কেল্লাটা দখল করতে পারলে ওর ভেতরে পেট ভরে একটু খাওয়াদাওয়া করতে পারবে। আরামে ঘুমোতে পারবে। প্রয়োজন হলে শহরের হাসপাতাল থেকে কাল সকালে যে কোনও ডাক্তারকে ডেকে এনে তোমার আরও ভাল চিকিৎসা করাতে পারব। ওষুধ-ইঞ্জেকশান দেওয়াতে পারব।
ঠিক আছে সর্দার। এখন মায়ের নাম নিয়ে ঢুকে পড়ুন। আর দেরি করবেন না। রাত বাড়ছে। দেরি হয়ে আসছে ক্রমশ।
সাধু হাত তুলে ইঙ্গিত দিলেন, জয় ভবানী। সবাই বলল, জয় ভবানী। ভবানী কসম।
শবনম বলল, আল্লা কসম।
সাধুর হাতে জ্বলন্ত মশাল।
সেই মশালের আলোয় পথ দেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সকলে। ভবানী মূর্তির পিছন দিকের একটি ত্রিকোণাকৃতি অংশের কাছে গিয়ে সাধু কয়েকজনকে বললেন, এইখানে একটু শাবলের চাড় দে তো।
একজন খুব জোরে শাবলের চাড় দিতেই একটা আলকাতরা মাখানো কালো কাঠের দেওয়াল সরে গেল। পাটাতনের ওপাশে কিছু ভারী পাথর থাকে থাকে সাজানো। এবার সবাই মিলে সেই পাথরগুলো এক এক করে নামাতেই একটি অপরিসর সুড়ঙ্গমুখ নজরে এল।
সাধু একজনের হাতে মশালটা দিয়ে সঙ্গে আনা রাইফেলটা উঁচিয়ে ধরলেন। তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। এক জায়গায় গিয়ে হাতের ইঙ্গিতে সকলকে থামতে বললেন। তারপর নিঃশব্দে পাথরের দেওয়ালে গা ঘেঁষে একটু একটু করে এগোতে লাগলেন। কিছুটা পথ যাবার পরই পৌঁছে গেলেন সঠিক জায়গায়। দু’জন লোক যেখানে বসে দুর্গের বাইরের দিকে নজরদারি করছিল এবং ধারে কাছে কেউ এলে তাকে গুলি করবার জন্য অপেক্ষা করছিল, ঠিক সেইখানে।
এমন নিঃশব্দ পদসঞ্চারণ যে, লোকদুটি টেরই পেল না কী চতুর পদক্ষেপে মর্মান্তিক মৃত্যু ধীরে ধীরে তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
সাধুর দু’চোখে এখন প্রতিহিংসার আগুন। এই গুহার জঠরে পা দেওয়া মাত্রই তাঁর পূর্ব স্মৃতি যেন আবার ফিরে এল। সেই দস্যুসর্দারের মেজাজ আচ্ছন্ন করে ফেলল তাঁর দেহমনকে। তিনি আবার সেই বিশ বছর আগের হিন্দোলসর্দার হয়ে উঠলেন। বন্দুকটা উঁচিয়ে ধরে একবার শুধু বলে উঠলেন, জয় ভবানী।
ডাকাত দুটি নিদারুণ ভয়ে চমকে উঠে ফিরে তাকাতেই সুনিপুণভাবে ট্রিগার টিপলেন, ডিস্যুম, ডিস্যুম।
দু’দুটো প্ৰাণ লুটিয়ে পড়ে কবুতরের মতন ছটফট করতে লাগল।
ওদের বুকের রক্তে তিলক কেটে ইঙ্গিতে সবাইকে চলে আসতে বললেন।
বিনা যুদ্ধে আসল জায়গাটাই কবজা হয়ে গেছে। কেল্লা এখন হাতের মুঠোয়। সাধুর ডাক শুনে হই হই করে ছুটে এল সবাই।
একজনের হাত থেকে মশালটা টেনে নিয়েই একেবারে বুরুজের মাথায় উঠে গেলেন সাধু। তারপর ঘন ঘন মশাল আন্দোলন করে চেঁচাতে লাগলেন, এসো,
এসো, সবাই চলে এসো ভেতরে। এবার শুধু দেখো আর মারো।
সাধুর ইঙ্গিত পেয়েই লালচাঁদ তার দলবল নিয়ে কেল্লার মুখে ছুটে এলেন। বিশাল তোরণ ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তাই ঘন ঘন দরজায় লাথি আর ধাক্কা দিতে লাগল।
সাধু ওপর থেেেক নেমে এসে ফটকের দরজাটা খুলে দিতে বললেন সকলকে।
হিংলাজসর্দার নিজে গেলেন দরজা খুলতে। কিন্তু দরজার মুখেই বাধা। যমের মতন দু’জন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল হিংলাজের ওপর।
সাধু চেঁচিয়ে উঠলেন, খবরদার। যানে দো উসকো।
লোকদুটি সাধুর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল। একজন বলল, আপ— কৌন হ্যায়? তোদের বাবা। এই কণ্ঠস্বর তোরা অনেকদিন শুনতে পাসনি নারে? স—স —–সর্দার! আপ জিন্দা হ্যায়?
হ্যা। আমি জিন্দা আছি। কিন্তু তোমরা এবার মরবার জন্য তৈরি হও। শবনম বন্দুক উঁচিয়েছিল।
সাধু বললেন, না। ওভাবে নয়। টাঙ্গি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে কেটে ফেলো ওদের। কেউ গিয়ে দরজাটা খুলে দাও। লালচাঁদ ভেতরে ঢুকুক। ওর লোকজন বাইরে অপেক্ষা করছে।
নির্দেশ পাওয়া মাত্রই হিংলাজের লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই লোকদুটির ওপর। টাঙ্গির কোপে কচুকাটা করে ফেলল আক্রমণকারীদের। ফটকের দরজায় খিল খুলে দিতেই লালচাঁদ তাঁর দলবল নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। তারপর হই হই করে ছুটে চললেন সামনের দিকে।
লালচাঁদের এসবই তো পরিচিত। হিন্দোলসর্দারের সবচেয়ে প্রিয় পাত্র ছিলেন তিনি। কিন্তু ভবিতব্য এবং দুর্জনের বিশ্বাসঘাতকতায় দীর্ঘ কুড়িটা বছর এই কেল্লার মসনদ থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল। লালচাঁদ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চললেন। তিনি যে আহত। তাঁর এখন বিশ্রামের প্রয়োজন তা তিনি মনেই করলেন না।
ওরা দলবল সমেত যেই কেল্লার মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে পৌঁচেছে অমনি দেখল চারদিক থেকে দুর্জন সিং-এর লোকেরা ঘিরে ফেলল ওদের।
লালচাদের লোকেরাও তো নিরস্ত্র নয়। তাই বন্দুক উঁচিয়ে রুখে দাঁড়াল। শত্রুপক্ষের হাতেহাতে মেশিনগান। তারা এমনই মরিয়া যে লালচাঁদের লোকেদের আক্রমণ করবার কোনওরকম সুযোগ না দিয়েই শুরু করে দিলট্রা-রা-রা-রা-রা।
লালচাঁদ মাঝামাঝি জায়গায় ছিলেন। তাই কোনওরকমে বসে পড়ে প্রাণ বাঁচালেন। কিন্তু তাঁর দলের লোকেদের দু’-তিনজন একেবারে চিরনিদ্রায় শুয়ে পড়ল।
শত্রুপক্ষের লোকও মরল বইকী।
একজন ছাড়া প্রায় সবাই শেষ।
যে একজন বেঁচে ছিল, শবনমের গুলিতেও সেও লুটিয়ে পড়ল।
কিন্তু আসল মাল কোথায়? সেই দুর্জন সিং?
সাধু চিৎকার করে উঠলেন, কোথায় গেল সেই শয়তান কুত্তাটা। বেরিয়ে আয় আমার সামনে। বেরো বলছি।
কারও কোনও সাড়াশব্দ নেই।
সাধু বললেন, শোনো তোমরা! এই কেল্লার ভেতরে যেদিকে এতটুকু ফাঁক পাবে সে দিকেই ঢুকে পড়ো সবাই। চারদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখো কে কোথায় আছে। বুরুজের মাথায় উঠে যাও কয়েকজন। এখনও নিশ্চিন্ত হবার কোনও কারণ নেই। ওই শয়তান দুর্জন সিং আড়াল থেকে লুকিয়েও আক্রমণ করতে পারে।
এমন সময় হিংলাজসর্দার ছুটে এসে বলল, সাধুজি! একটা জেলখানার মতো ঘরে কতকগুলো মেয়েকে আটকে রেখেছে ওরা। আমার মেয়েটাকেও বোধহয় ওইখানেই রেখেছিল।
বার করে আনো।
কিন্তু লোহার গরাদে তালা দেওয়া।
ভাঙতে পারলে না? ভাঙো।
আমার লোকেরা তালা ভাঙার কাজে লেগে গেছে বাবা। আর একজন ছুটে এসে বলল, আমরা এইমাত্র দুটো ছেলেকে মুক্ত করে আনলাম।
ওদের তোমাদের জিম্মায় রাখো। আর তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখো দুর্জন সিং লুকল কোথায়? ওকে খুঁজে বার করতেই হবে।
যে ঘরে বন্দিনী মেয়েদের আটকে রেখেছিল দুর্জন সিং-এর লোকেরা, শবনম সেই ঘরের দিকে গেল।
মেয়েরা ভেতর থেকে চিৎকার করছে, আমাদের মুক্তি দিন। আমাদের বাঁচান।
শবনম বলল, আমার মা-ভগিনীরা। আপনাদের কোনও ভয় নেই। এই কেল্লা আমরা দখল করেছি। এখন আপনারা মুক্ত। আমরা আপনাদের প্রত্যেককে যার যার ঠিকানায় পৌঁছে দেব।
বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় তালা ভাঙা হতেই মেয়েরা বেরিয়ে পড়ল।
এমন সময় হঠাৎ এক পৈশাচিক উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল হিংলাজসর্দার, পেয়েছি পেয়েছি। শয়তানের বাচ্চাটাকে পেয়েছি। সাধুবাবা ছুটে এলেন, কাকে পেয়েছ হিংলাজ?
এই দেখুন!
বিশ্বাসঘাতক কোথায় লুকিয়েছিল এতক্ষণ?
হিংলাজ বলল, এই চৌবাচ্চাটার ভেতর। আমি চারদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ দেখি চৌবাচ্চার মাথায় একটা কাঠের তক্তা ঢাকা দেওয়া আছে। দেখেই সন্দেহ হল। যেই না ঢাকাটা সরিয়েছি অমনি শয়তানটা বন্দুক উঠিয়েছে। মারলুম মুখে এক ঘুসি।
আর মেরো না। ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও।
না। ওর জন্যে আমার মেয়েটা আত্মঘাতী
আমি নিজের হাতে ওর গলার টুটি ছিঁড়ব।
ও কাজটা আমাকে করতে দাও হিংলাজ।
হয়েছে। ওকে আমি ছাড়ব না।
দুর্জন সিং ভয়ে থর থর করে কাঁপছে তখন। তার আর পালাবার পথ নেই। চারদিক থেকে সবাই ছেঁকে ধরেছে ওকে।
সাধু বজ্র নির্ঘোষে বললেন, মাথার ওপর হাত ওঠাও দুর্জন। অদ্যই তোমার শেষ রজনী। কিছুক্ষণ সময় দিচ্ছি শুধু নিজের প্রিয় মুখগুলিকে একবার চিন্তা করে নাও। তারপর তোমাকে আমি একটু একটু করে মৃত্যুর দরজায় ঠেলে দেব। তার আগে একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখ আমায় তুমি চিনতে পারো কি না?
দুর্জন একবার তাকিয়ে দেখেই বলল, সর্দার তুম!
হ্যাঁ আমি।
তুম আভি তক জিন্দা হ্যায়?
না। আমি মরে গেছি। এটা আমার প্রেতাত্মা। তোমার সঙ্গে জীবনের শেষ দেখা করতে এসেছি আমি ছোরা, টাঙ্গি আর বন্দুকের গুলি নিয়ে। বলো এর মধ্যে কোনটা তোমার পছন্দ?
দুর্জন কাঁপতে কাঁপতে বলল, এর কোনওটাই আমার পছন্দ নয়। তুমি আমাকে আর একবার জীবনের শেষবার, তোমার সঙ্গে দোস্তি করবার সুযোগ দাও সর্দার। –
লালচাঁদও তখন দুর্জনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, তোমার সঙ্গে দোস্তি করলে আমি আমার বউ-ছেলেকে ফিরে পাব?
দুর্জন শিউরে উঠল লালচাঁদকে দেখে।
লালচাঁদ দুটো পেরেক দু’হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলেন ওর হিংস্র চোখদুটোর দিকে।
দুর্জন চিৎকার করে উঠল, নেহি। নেহি। নেহি।
বল শয়তান, কীসের লোভে আমার ছেলেটাকে গুলি করে মারলি? কেন আমাদের অমন সর্বনাশ করলি? আমার বউকে খুঁজে পেলাম না কেন? কেন তুই সর্দারের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করলি? বল, বল, কেন করতে গেলি ওইরকম বেইমানি?
ম্যায় তুমহারা গোড় পাকড়তি হুঁ। মুঝে মাফ করো লালচাঁদ। এ সাজা মুঝে মাত দো।
সাধু তখন সাধু নয়। আবার হিন্দোলসর্দার। বহুদিনের অভ্যস্ত পায়ে এক লাথি মারলেন দুর্জনকে। সে লাথি হজম করার শক্তি দুর্জন সিং-এর নেই। তাই দশ হাত দূরে ছিটকে পড়ল।
ততক্ষণে হিংলাজসর্দার আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুর্জনের ওপর।
ওদিক থেকে শবনমও ছুটে এসেছে তখন, ওকে ছেড়ে দাও, ওকে ছেড়ে দাও সর্দার। আমি যে ভীষণ প্রতিজ্ঞা নিয়েছি ওকে কুকুরের মতো গুলি করে মারবার। সাধু সাবধান করলেন। লালচাঁদও বাধা দিলেন।
সেই সুযোগে শয়তান আবার নিজমূর্তি ধরল। হঠাৎ লাফিয়ে উঠেই এলোপাথাড়ি গুলি করতে লাগল চারদিকে। দু’-চারজন পাহাড়িয়া গুলি খেয়ে ছটফট করতে লাগল। তারপরই সব শেষ! গুলিও শেষ। আর যেই না শেষ হওয়া, অমনি প্রাণভয়ে ফটকের দিকে দৌড়ল দুর্জন।
শবনম ওকে ভয়ংকরভাবে তাড়া করে চলল, পালাবি কোথায় শয়তান? আজ আমার হাতেই তোর মরণ। জয় মা ভবানী।
দুর্জন তখন কেল্লার বাইরে। শবনমও বেরিয়ে এসেছে। কেল্লার ভেতরে থাকায় বুঝতেই পারেনি কেউ, কখন যে এক সময় ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। শবনমকে একা পেয়ে রুখে দাঁড়াল দুর্জন।
আর শবনম তখন সেই অভিশপ্ত বন্দুকের গুলিতে ঝাঁজরা করে দিল দুর্জনের দেহটা। গুলির পর গুলির আঘাতে দুর্জনের দেহটা ছিটকে পড়ল পাথরের বুকে। একবার শুধু থর থর করে কেঁপে উঠল দেহটা। তারপর একেবারে স্থির হয়ে গেল।
ক্লান্ত শবনম তখন সেইখানেই বসে পড়েছে। আঃ কী দারুণ শান্তি। ভোরের বার্তা নিয়ে প্রকৃতি ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে তার আপন বৈচিত্র্যে।
সাধু এসে শবনমের মাথায় হাত রাখলেন।
শবনম ডাকল, বাবা!
মা!
আপনি এবার আত্মগোপন করুন।
কেন রে পাগলি? আমি চোর না ডাকাত? এখন আমি মা ভবানীর উপাসক। আমার অতীতও নেই। ভবিষ্যৎও নেই। আছে শুধু বর্তমান। আমার আসল পরিচয়টা কাউকে দিস না। তা হলেই হবে।
সাধু ও শবনমের কাছে লালচাঁদও এসে
দাঁড়ালেন।
সাধু বললেন, ওদিককার কাজ কতদূর?
হিংলাজের লোকেরা ধোয়ামোছার কাজে লেগে গেছে। ডেড বডিগুলোকেও বুরুজের মাথা থেকে ফেলে দিচ্ছে নীচের খাদে।
বারুদ বন্দুক বা অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র যা কিছু আছে, কেল্লার বাইরে দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে সব লুকিয়ে ফেলো।
লালচাঁদ চলে গেলেন।
এমন সময় বহু দূর থেকে সেই পরিচিত কণ্ঠস্বরটি আবার শোনা গেল শ ব—ন—ম!
কে! কে ডাকে! রঞ্জন! রঞ্জন তুমি কোথায়?
এই তো আমি এখানে।
কী আশ্চর্য! তুমি ওখানে গেলে কী করে?
আমি পথ ভুল করেছি শবনম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছি। আমার সামনে গভীর খাদ।
তুমি ওইখানেই থাকো। যেন লাফিয়ে আসতে যেয়ো না। পড়ে যাবে। আমি হিংলাজসর্দারকে পাঠাচ্ছি। তোমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসবে। একটু অপেক্ষা করো তুমি।
রঞ্জন বলল, মায়ের নাম নিয়ে একটা লাফ দেব?
শবনম তখন খাদের কাছাকাছি চলে গেছে। বলল, খবরদার ওই কাজ করতে যেয়ো না। অযথা জীবনের ঝুঁকি কেন নেবে?
কিন্তু দুরন্ত দুর্বার দামাল কিশোর কি পিছিয়ে থাকতে পারে? হঠাৎ একটু পিছিয়ে গিয়ে ছুটে এসে মারল এক লাফ।
শবনম কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরল রঞ্জনকে। ওর গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুমি ভাল আছ তো?
আমি ভাল আছি। তোমার কাঁধে ব্যান্ডেজ কেন?
ও কিছু নয়। একটা গুলি লেগেছিল। কিন্তু এই বিপজ্জনক পথে একা তুমি কীভাবে এলে?
সে অনেক কথা। পরে বলব খন। এক অফিসারের ঘরে রাত্রিতে ছিলাম! শেষরাতে তোমার কথা ভেবে ভেবে আর থাকতে পারলাম না! কাউকে কিছু না জানিয়েই পালিয়ে এসেছি।
এটা তুমি খুবই অন্যায় করেছ রঞ্জন। কী ভাববেন বল তো তাঁরা। তা ছাড়া এই বন্দুক তুমি পেলে কোথায়?
পথে আসতে আসতে কুড়িয়ে পেয়েছি।
বন্দুক কী করে চালাতে হয় তাই জানো না, অথচ বন্দুক ঘাড়ে নিয়েছ দুষ্টু কোথাকার।
রঞ্জনকে দেখে সাধুবাবাও এগিয়ে এলেন।
শবনম বলল, বাবা এই সেই। আমার রঞ্জন।
বাঃ ভারী সুন্দর। তোমরা যে দেখছি একেবারে মাণিক-জোড়! ওকে যে আবার ফিরে পাব তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি বাবা।
রঞ্জন বলল, আমাদের কেল্লাঅভিযান হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। যার নামে এই কেল্লা ইনিই তিনি। হিন্দোলসর্দার। সে কী! ইনি তো একজন সাধুবাবা।
এঁর পরিচয় পরে দেব তোমাকে। পুলিশের ঝামেলাটা আগে চুকে যাক। তবে
একটু জেনে রেখো আসল শয়তানকে আমি নিজেহাতে গুলি করে মেরেছি। এমন সময় হিংলাজসর্দার এসে রঞ্জনকে দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠল, এই তো খোকাবাবু এসে গেছেন দেখছি। আসুন ভেতরে আসুন। মুখহাত ধুয়ে গরম গরম হালুয়া-পুরি খেয়ে শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করে নিন।
সাধু বললেন, ঠিক বলেছ। এইবার শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করার দরকার। চলো ভেতরে চলো।
ওরা যখন কেল্লার ভেতরে ঢুকল তখন পুবের পাহাড়গুলোর চূড়া ডিঙিয়ে সোনার বরণ তরুণ তপন রাঙামুখে উদয় হচ্ছে।
ভবানী মন্দিরে আজ জোর পুজোর আয়োজন। আজকের এই পরিবেশ দেখলে কেউ ধারণাই করতে পারবে না যে এখানে একটা ডাকাতের ঘাঁটি ছিল বা এরাও মোস্ট ডেঞ্জারাস বলে। চারদিকে শুধুই পুজো পুজো গন্ধ। বন্দিনী মেয়েরা সবাই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে শবনমের সাথে এক যোগে কাজে লেগেছে। সাধু একজন লোককে নীচে পাঠিয়ে কিছু নতুন বস্ত্র কিনে আনিয়েছেন। শবনমও ওর ডাকাতরানির পোশাক ত্যাগ করেছে। সাবান মেখে ঝরনার জলে স্নান করে রঙিন একটি ডুরে শাড়ি পরে প্রজাপতির মতো যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। ওর চেয়ে সুখী বোধহয় আর কেউ নেই।
রঞ্জনও শবনমের পরিবর্তনে অভিভূত। এই না হলে মেয়ে। কী ভাল যে লাগছে শবনমকে। এমন সুন্দর মেয়েটি কোথাও কিছু নেই হঠাৎ ফুলনদেবী হয়ে বসে রইল। এর চোখে গভীর প্রশান্তির কোলে ওই হত্যার ঝিলিক একেবারেই অসহ্য।
আজ শুধু দেবীর গলায় নয়। সবার গলাতেই ফুলের মালা। রক্তচন্দনের টিপ। ভবানীমন্দিরের গুহার জঠরে শুধু ধূপধুনোর গন্ধ। কাটা ফলের সুবাস। হিন্দোলকেল্লার চূড়ায় আজ পত পত করে উড়ছে হলুদে ছোবানো পতাকা। কেল্লার ভেতর থেকে বড় বড় হাঁড়ি-কড়া ইত্যাদি এনে বাইরে ভিয়েন বসানো
হয়েছে। বড় বড় কড়াইতে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে।
এরই মধ্যে সাধুর নির্দেশে কেল্লার ভেতরে গুপ্তকক্ষগুলিতে যাবার পথগুলো পাথর সাজিয়ে রুদ্ধ করে দিয়েছে সকলে। হিংলাজসর্দারের লোকেরা লালচাঁদের লোকেদের নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে এই কাজ করেছে। লালচাঁদের লোক অবশ্য দু’-চার জন। ওদের লোকই বেশি। এমনভাবে পথ রোধ করেছে যাতে অচেনা কেউ এর ভেতরে ঢুকলে ওদিকে যে যাবার রাস্তা আছে তা বুঝতে না পারে।
বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ পুলিশ এল।
তরুণ পুলিশ অফিসার এসেই রঞ্জনকে বকাবকি করলেন, কী হে ছোকরা! তুমি যে ওইভাবে পালিয়ে এলে, তোমার সাহস তো কম নয়? আর একটু তর সইল না তোমার? এই জঙ্গলের পথে একা একা চলে এলে ভয় করল না? আমি তো ভাবলাম নিয়তি তোমাকে ডেকেছে। নির্ঘাত তুমি বাঘের পেটে গেছ।
রঞ্জন বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কিছুতেই থাকতে পারছিলাম না। জানি খুবই অন্যায় করেছি। তা আমাদের এস পি সাহেব কোথায়? তাঁকে দেখছি না কেন? ওঁর তো আসবার কথা ছিল।
উনি হঠাৎ একটা অন্য কাজে আটকে পড়েছেন। তবে ওনার ইচ্ছে যে আমি তোমাদের দু’জনকে নিয়ে একবার ওনার বাসাতে যাই। বলে তাঁর লোকেদের বললেন, এই হাঁ করে সব দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কেল্লাটাকে ঘিরে ফেল।
এই কথা শুনে এক ডিশ পুজোর প্রসাদ নিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে
শবনম বলল, তার আর প্রয়োজন হবে না। এখন এগুলো খেয়ে নিন দেখি। তরুণ অফিসার মুগ্ধ হয়ে গেলেন শবনমকে দেখে। বললেন, তুমি কে মা? নিশ্চয়ই আমাদের নতুন ডাকাতরানি শবনমদেবী?
সাধু নিজে এবার এগিয়ে এসে বললেন, না। শুধু দেবী।
তরুণ অফিসার এগিয়ে এসে সাধুকে দেখে ভক্তিভরে প্রণাম করে বললেন, আপনি কে বাবা?
আমি এক ভবঘুরে সন্ন্যাসী। ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে দেখি হঠাৎ এক কাণ্ড। তা এই সব পাহাড়ি লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে বহু কষ্টে মেরেধরে তাড়িয়েছি দুর্বৃত্তগুলোকে। কেল্লা এখন শত্রুমুক্ত। এইসব আদিবাসীরা আশ্রয়হীন হয়ে বড় কষ্ট পাচ্ছিল। আমি ওদের সবাইকেই ঢুকিয়ে দিয়েছি ওই কেল্লার ভেতর। এখানে এক জায়গায় মা ভবানীর একটি মূর্তিও রয়েছে দেখছি। তাঁরই আরাধনা করছিলাম এতক্ষণ।
আপনার নেতৃত্বই এদের প্রেরণা জুগিয়েছে বাবা। আপনি তা হলে এক কাজ করুন না, এখানেই থেকে যান না বরাবরের জন্য।
এরাও তাই বলছে। আমিও ভাবছি। আমরা দলবদ্ধ হয়ে এখানে বসবাস করলে এই কেল্লা চিরকাল শত্রুমুক্ত থাকবে।
শুধু তাই নয়, এইসব লোকজনগুলোও মানুষ হয়ে যাবে। আপনি থেকে যান। আমিও এই বিদেশে একঘেয়ে দিন কাটাচ্ছি। মাঝেমধ্যে আপনার বউমাকে নিয়ে এখানে বেড়িয়েও যাব। চাই কী কেল্লার ভেতরে থেকেও যাব দু’-একটা দিন।
সাধু বললেন, ভালই হবে।
যাক। পুলিশের দায়িত্ব আপনারাই অনেকটা পালন করে দিয়েছেন। আপনাদের কখনও কোনও অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন। আমি সব রকমের সাহায্য করব। হ্যাঁ, একটা কথা। ওদের ঘাঁটি থেকে কোনও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র কিছু পাননি?
সাধু জানতেন পুলিশ একথা জানতে চাইবে। তাই কিছু অস্ত্র পুলিশকে দেবার জন্য হাতের কাছেই রেখেছিলেন।
পুলিশের লোকেরা সেগুলো গ্রহণ করল।
সাধু বললেন, অনেক অসহায় মেয়ে এখানে বন্দিজীবন কাটাচ্ছিল। তাদের যার যার বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থাটা একটু তাড়াতাড়ি করে দিতে হবে কিন্তু।
মেয়েরা সবাই বলল, না। আজ আমরা কোথাও যাব না। যা হবে কাল। আজ আমরা এখানে মাতৃ-আরাধনা করব।
সাধু বললেন, শবনম তুমি কী করবে?
রঞ্জন?
রঞ্জন বলল, এখন এখান থেকে চলে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আরও দু’–একটা দিন থাকতেই হবে এখানে।
শবনম বলল, না বাবা। ওকে যেতেই হবে। না হলে ওর মা-বাবা চিন্তা করবে খুব। আমি কিন্তু আপনাকে ছেড়ে যাব না। এই কেল্লা, ওই পাহাড়, এই অরণ্য এর চেয়ে মধুময় আমার কাছে আর কিছুই নেই। তা ছাড়া আমি চলে গেলে মা ভবানীর সেবা পুজোর জোগাড় করে দেবে কে?
রঞ্জন বলল, কী পাগলের মতো বকছ যা তা! তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। লেখাপড়া করবে। বড় হবে। যেতেই হবে তোমাকে। আমি তোমাকে নিয়ে যাব।
সাধু বললন, ও ঠিকই বলেছে মা। এই বনবাস তোমার সাজে না। তা ছাড়া এখন তো আর তোমার জাতপাত নেই। তুমি এখন দেবী। তুমি আমার মেয়ে। মা ভবানীর মেয়ে।
তবু আমি এখানেই থাকব। এই ভবানী মন্দিরে দেবদাসী হয়ে বেঁচে থাকব সারাজীবন। আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। রঞ্জনকে যেতেই হবে। ও যাক। বরং আমাদের বন্ধুত্বকে স্মরণীয় করে রাখতে মাঝেমধ্যে ও চলে আসবে এখানে। পারলে ওর মা-বাবাকেও নিয়ে আসবে।
রঞ্জনের চোখে যেন জল এসে গেল। বলল, তুমি যাবে না শবনম?
শবনম স্মিত হেসে ঘাড় নাড়ল, না।
পুলিশ অফিসার বিদায় নিলেন। পাহাড়িয়া মানুষগুলো আবার নতুন করে কাজে মেতে উঠল। শবনম রঞ্জনের হাত ধরে টানতে টানতে কেল্লার বুরুজের মাথায় উঠে গেল। অভিমানে রঞ্জনের বুক তখন ভরে উঠেছে।
শবনম বলল, তোমার ভালর জন্যই আমি যাচ্ছি না। তুমি বড় হও। নিজের পায়ে দাঁড়াও। তারপরও যদি আমার কথা মনে থাকে তা হলে আমাকে এসে নিয়ে যেয়ো, আমি যাব। এই মুহূর্তে যদি তোমার মা-বাবা অরাজি হন আমি তা হলে যাব কোথায়? ওই পার্ল স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে আমি আর ফিরছি না। তুমি আমাকে ভুল বুঝ না রঞ্জন। এখানে আমি সুখেই থাকব।
রঞ্জন বুরুজের খাঁজে মাথা রেখে কাঁদছিল।
শবনম আলতো করে পিঠে হাত রেখে ডাকল, রাজা।
উঁ।
জলভরা চোখে রঞ্জন তাকাল শবনমের দিকে। শবনম ওর আঁচলের খুট দিয়ে রঞ্জনের চোখের জল মুছিয়ে দিল।
রঞ্জন বলল, আমি ফিরে গেলে তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো?
আল্লার কসম। মা ভবানীর দিব্যি। আমার এই বন্ধু রাজাকে আমি কি ভুলতে পারি? তুমি ফিরে যাও। মাঝে মাঝে তোমার মা-বাবাকে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসো। আমি তোমার স্মৃতি বুকে নিয়ে এখানে সুখে থাকি। রাজ্যপাট চালাই। তারপর যখন আমরা আরও বড় হব, তখন যা হয় হবে।
হিন্দোলকেল্লার বুরুজের মাথায় ওরা দু’জনে হাতে হাত রেখে গঙ্গা-যমুনার ধারার মতো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বইতে লাগল। চারদিকের পাহাড় ও বনভূমিতে উজ্জ্বল দিন এবং আকাশের নীলিমায় সাদা মেঘের নিরুদ্দেশ যাত্রা উদাস করে দিল মনকে। নীচে ভবানী মন্দিরে ভোগারতির ঘণ্টা বাজল বুঝি। এক ঝাঁক রঙিন টিয়া, রঙের বাহার নিয়ে হারিয়ে গেল সুদূর বনরেখায়। এই বন, এই পাহাড়, সবই যেন কাব্যময় হয়ে উঠল।