হিন্দোলসর্দারের কেল্লা – ৫

পাঁচ

জায়গা আছে। জঙ্গল পরিষ্কারের সময় দু’-একটা খরগোশ গর্তর ভেতর দিয়ে লাফিয়ে পালাল। একটা বিষাক্ত সাপ ফাটল থেকে বেরিয়ে ফোঁস করে উঠতেই হিংলাজসর্দারের গাঁইতির ঘায়ে শেষ হয়ে গেল সেটা।

সাধুবাবা বললেন, ভুল করলি বেটা। এমনিভাবে কোনও নিরীহ প্রাণীকে মারে না কেউ। ওকে কিছু না বললে ও এমনিই পালিয়ে যেত। যাক, এখন ওই পাথরের খাঁজে খাঁজে চাড় দে।

সবাই মিলে গাঁইতির চাড় দিতেই এক এক করে সাজানো পাথর খসে খসে পড়তে লাগল। শাবলের ঘা আর গাঁইতির চাড়। কিছু সময়ের মধ্যেই অপরিসর একটি মানুষপ্রমাণ পাহাড়ের খাঁজ ফাঁকা হয়ে গেল।

সাধু বললেন, জয় মা ভবানী। এবার চলো সব এক এক করে ঢুকে দেখি আমার মা কী অবস্থায় আছে। তবে এখুনি সবাই নয়। আগে আমি আর এই জ্যান্ত ভবানী ভেতরে ঢুকব।

শবনম সাধুবাবার হাত টেনে ধরে বলল, একটু অপেক্ষা করুন বাবা। এখুনি ঢুকবেন না।

ভয় কীরে পাগলি?

ভয় আছে বইকী। কুড়ি বছরের বদ্ধ গুহা আলো-বাতাসের সংস্পর্শে না থাকায় এর ভেতরে একটা বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে আছে। এখন যে ঢুকবে সেই মরবে। সাধুবাবা বললেন, তুই ঠিক বলেছিস তো। এই সহজ কথাটা আমার মাথায় আসেনি। অক্সিজেনের অভাবে এর ভেতরটা যে কী হয়ে আছে তা কে জানে? এই বদ্ধ গুহায় ঢুকলেই এখন মৃত্যু।

তার প্রমাণ অবশ্য হাতে হাতেই পাওয়া গেল।

গুহামুখ অর্গলমুক্ত হওয়ার ফলে গুহার ভেতর থেকে একটা গরম ভাপানি যেন ভক ভক করে বেরিয়ে আসতে লাগল। ভেতরটা যত অক্সিজেনে ভরতে লাগল, বাইরের শীতল বাতাস ততই ঢুকতে লাগল হু হু করে।

সাধুবাবা হিংলাজকে বলেন, কাছেই একটা ছোট্ট ঝরনা ছিল। সেটা শুকিয়ে গেছে কি?

না বাবা, ঝরনার মিঠা পানি খেয়েই তো আমরা বেঁচে আছি।

তা হলে যাও। তোমাদের বস্তি থেকে কয়েকটা বালতি নিয়ে একটু ঝরনার জল এনে জায়গাটা ধুয়েমুছে দাও। আর কাউকে পাঠিয়ে দাও কোথাও থেকে পাহাড়ি গাছ-গাছড়ার ফুল নিয়ে আসতে। কিছু বেলপাতাও নিয়ে এসো। এখানে অনেক বেলগাছ আমি বসিয়েছিলাম। সে সব গাছ এখনও আছে দেখছি। যাও দেরি কোরো না। মায়ের থান পরিষ্কার করতে হবে। মাকে ঝরনার জল দিয়ে স্নান করাতে হবে।

শবনম বলল, একটু আলোর ব্যবস্থাও তো করতে হবে। অনেকগুলো মশাল পড়ে আছে আশপাশে।

হিংলাজ বলল, সব ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি।

প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সবকিছুর ব্যবস্থা হয়ে গেল। পাহাড়ি ললনারা প্রচুর ফুল বেলপাতা সংগ্রহ করল। বেশির ভাগই আকন্দ, কলকে, করবী, জুঁই ও গুলঞ্চ। সাধুরই সযত্নে বসিয়ে যাওয়া গাছেরা বংশানুক্রমে ফুল দিয়ে যাচ্ছে। তবে এই ফুল এতদিন শুকিয়ে মাটিতে ঝরছিল। এখন মালা হয়ে দেবীর গলায় দুলবে।

মশাল হাতে নিয়ে সাধু শবনমের একটি হাত ধরে ভেতরে ঢুকলেন। লালচাঁদও ঢুকল ভেতরে। বাকিরা রইল প্রতীক্ষায়।

সাধু ভেতরে ঢুকেই দেখলেন মা ভবানী যেখানকার সেখানেই প্রতিষ্ঠিতা আছেন। শুধু চারদিক মাকড়সার জালে ভরে আছে।

সেটুকু পরিষ্কার করতে আর কতক্ষণ?

পাহাড়িরা বালতি বালতি জল এনে দিতে লাগল। সাধু শবনমকে বললেন, ঢাল বেটি দেবীর মাথায়।

কিন্তু বাবা !

আরে! আমি তো বলছি। আজই তোকে আমি দীক্ষা দেব। এমন ধর্মে দীক্ষা, যে ধর্মে কোনও হিন্দু-মুসলমানে ভেদাভেদ নেই। তুই মাকে স্নান করাবি, গা মুছিয়ে দিবি। তোর হাতে গাঁথা মালা যখন মা ভবানীর গলায় দুলবে তখন ত্রিলোক পর্যন্ত দুলে উঠবে। হিন্দু-মুসলমানের কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। জয় মা ভবানী। নে ঢাল দেবীর মাথায় জলের ধারা।

আনন্দের আবেগে শবনমের দু’চোখে যেন জল এসে গেল। আজ এই চরম সুখের মুহূর্তটিতে ওর বড় বেশি করে মনে পড়ল রঞ্জনের কথা। ওই সুস্থ সুন্দর সুদর্শন কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা ও এখনও ভুলতে পারছে না। আজ যদি রঞ্জন ওর পাশে থাকত। ওর বুক ভরে উঠত এক অনাস্বাদিত সুখে। ওর বাবা-মা জানেনও না তাদের অতি আদরের ছেলেটির এই নিঠুর নিয়তির কথা। ‘তার’ পেয়ে তাঁরা এখনও কত নিশ্চিন্তে আছেন। কিন্তু যখন দিনের পর দিন যাবে, অথচ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে না, তখন কী যে করবেন তাঁরা? তা কেই বা জানে? রঞ্জনের ঠিকানাও জানে না শবনম, যে খবর দেবে। কিন্তু কী খবরই বা দেবে? ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কি ওই নামের কোনও নিরুদ্দিষ্ট ছেলের বাবা-মা’র খোঁজ নিয়ে তাঁদের কাছে গিয়ে বলবে ‘আমি এক ভাগ্যহীনা কিশোরী, আমার জেদের বলি হয়ে আপনাদের ছেলেকে কিছু নরপিশাচের পৈশাচিক কর্মের জন্য অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে।’ রঞ্জনের কথা মনে হতেই হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল শবনম। সাধুবাবা বললেন, কী হল! হঠাৎ এত কান্না এল কেন?

আমি আর পারছি না বাবা। এখন আমার মৃত্যু হলেই ভাল হয়। মৃত্যু অমোঘ। তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। অযথা ওইসব ভেবে মন খারাপ করিস না।

কিন্তু রঞ্জনকে যে আমি ভুলতে পারছি না বাবা।

ভুলতেই হবে মা। এই জন্যে তোর চোখে জল? তাকা একবার আমার মুখের দিকে। মা’র ছেলে মা’র কাছে গেছে। এই জন্যে তুই কাঁদবি কেন?

ওকে যে আমার জন্যেই যেতে হল বাবা।

কেউ কারও জন্যেই যায় না। যে যার নিজের ভবিতব্যে যায়। আসলে তোর চোখ দেখে আমি বুঝতে পারছি তুই ওকে ঘিরে অন্য স্বপ্ন দেখেছিলি। কিন্তু মা ! তুই যে ভবানীর মেয়ে। তোকে যে তাঁর কাজ করতে হবে। ও সুখ তোর সইবে কেন? সেইজন্যেই একে একে তোর সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। মা গেছেন, বাবা গেছেন। তোর কিশোর বন্ধুটিও গেল। এই তো ভাল হল রে। কারও জন্যে আর চিন্তা-ভাবনা রইল না। এখন প্রাণ ভরে মাকে ডাক।

শবনম তবুও কান্না থামাতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলল।

ওরে এক কূল হারিয়ে তবে মানুষ আর এক কূল পায়। তোর তো একূল ওকূল দু’কূল যায়নি। এই দেখ তোর ওপার ভেসে গেছে, এপারে আমি আছি। আমরা আছি। সময়ের ব্যবধানে সব ভুলে যাবি। নে আর দেরি করিস না। জল ঢাল মায়ের মাথায়।

সাধুবাবা অতীতে ডাকাত হলেও এখন তো সাধু। তাই সাধুজনচিত ব্যবহার তাঁর। তা ছাড়া ডাকাত থাকার সময়েও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে মা ভবানীর পুজো করতেন। বললেন, ওরে মায়ের ওপর ভরসা রাখ। আমি ভরসা রেখেছিলাম বলেই না আজ আবার নতুন করে মাকে ফিরে পেলাম, সবাইকে ফিরে পেলাম।

শবনম চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়াল। তারপর দেবী ভবানীর মূর্তির মাথায় জল ঢালতে লাগল বালতি বালতি।

পাহাড়িরা দু’-একটা ঝাড়ু এনেছিল।

লালচাঁদ ও সাধুবাবা ঝাড়ু নিয়ে নিজেরাই লেগে পড়লেন ঝাঁটপাট দিতে। আসলে বাইরেটা বন্ধ থাকায় সামান্য একটু ধুলোর আস্তরণ ছাড়া আবর্জনা বিশেষ কিছু জমতে পারেনি। তবে কাঁকড়া বিছের একটা আড়ত হয়েছিল। ঝাঁটার খোঁচায় আর জলের ধারায় পালিয়ে গেল সব।

ধোয়ামোছা শেষ হবার পর সবাই চলল ঝরনার জলে স্নান করতে।

একে একে স্নান-পর্ব শেষ হতেই শুরু হল দেবীর আরাধনা। সাধুবাবা জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করে পূজা করতে লাগলেন। কাঁসর, ঘণ্টা, কোশাকুশি, কমণ্ডুলু, চন্দনপিড়ি, চন্দনকাঠ সবই ছিল, আর ছিল নৈবেদ্য রাখবার বড় বড় রুপোর থালা। ফল কাটবার জন্য বঁটি, কাটারি, কুড়ুনি সব। লোহার জিনিসগুলোয় তাদের ধর্মে জং ধরেছে। যাই হোক, গাছের পেঁপে, কলা, পেয়ারা আর কাঁচা পাকা বেল দিয়ে নৈবেদ্য সাজাল শবনম। সাধুবাবা খুঁজে পেতে তাঁর পরিচিত নির্দিষ্ট স্থান থেকে সরাল নামে একপ্রকার সুস্বাদু কন্দ তুলে নিয়ে এলেন। ব্যস শুরু হল ভোগের ব্যবস্থা।

সাধুর বজ্রগভীর অথচ সুললিত কণ্ঠস্বরের মন্ত্রধ্বনিতে ও ঘণ্টার শব্দে জায়গাটার পরিবেশই যেন পালটে গেল। সাধু মা ভবানীর কণ্ঠে বেশ মোটা করে গাঁথা জবার মালা, বেলপাতার মালা, লঞ্চের মালা ও কলকে ফুলের মালা পরিয়ে একটি গুলঞ্চের মালা শবনমের গলাতে পরিয়ে দিলেন। তারপর এক হাতে দেবীকে ও অপর হাতে শবনমকে পুজো করতে লাগলেন। শবনমের তপ্তকাঞ্চনবর্ণ কপাল রক্তচন্দনে রাঙিয়ে শিঙায় ফুঁ দিলেন। তারপর বললেন, ওরে হতভাগী! মায়ের পদতলে তোর ওই বন্দুকটা আগে রাখ। রেখে প্রণাম কর। তোর এখন পুনর্জন্ম হল। তুই এখন বিশ্বমাতার কন্যা হলি। আদিপুরুষের নাম ধর্ম নিরঞ্জন, ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর পুত্র তিনজন। সেই নিরঞ্জনই তোর পিতা-মাতা হল। তিনি হিন্দু-মুসলমান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। অলখ-নিরঞ্জন। তাঁর কোনও ভেদাভেদ নেই। তাঁর কোনও জাত নেই।

শবনমের দু’চোখে জলের ধারা। সাধুর কথায় বন্দুকটা দেবীর পদতলে রেখে প্রণাম করল।

সাধু বললেন, এই সেই অভিশপ্ত ও মন্ত্রঃপূত বন্দুক। দেবীর ইচ্ছায় তোর হাতে এসে পড়েছিল। এখন যার জিনিস তার কাছে ফিরিয়ে দে। এই বন্দুকের নলে যে শক্তির উৎস, তাকে ওরা অন্য কাজে লাগিয়েছিল। তাই সেই অস্ত্রে ওরাই মরল। এখন তুই বুঝছিস তো পাগলি, কীসের প্রভাবে তুই একটা সাধারণ মেয়ে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলি?

বুঝলাম।

এখন এই অস্ত্রে ওদের সব কটাকে নিধন করতে হবে। আগে মা ভবানীকে বল-

কী বলব?

কী বলবি? তাই তো রে! কী বলবি বল তো? হ্যাঁ হ্যাঁ। বল, মা আজ থেকে আমার কোনও জাত নেই, ধর্ম নেই। আমি ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে তোমারই হলাম। শবনম তাই বলল।

বল, যে ধর্ম মানুষকে মানুষ বলে বিচার করে আমি সেই ধর্মে আজ দীক্ষা নিলাম।

সাধুর কথার সঙ্গে সঙ্গে শবনমের ঠোঁটও নড়তে লাগল।

সাধু বললেন, আমি তোকে দেবী বলেই ডাকব। তুই আমাদের মা ভবানী। আর একটা কথা, এখন তো তোর নতুন জাত। তুই নতুন ধর্ম গ্রহণ করছিস। এখন থেকে আর তুই কখনও মাছ-মাংস খাবি না। যদিও আমাদের ধর্মে ও সব নিষিদ্ধ নয়, তবুও তুই একটু নতুন করে বেঁচে ওঠ দেখি?

শবনম বলল, আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব বাবা।

গুহার বাইরে তখন পাহাড়িরা আনন্দে নৃত্য শুরু করে দিয়েছে। শবনম নিজে

হাতে কাঁচা শালপাতায় করে মা ভবানীর প্রসাদ সকলকে বিতরণ করতে লাগল। কর্মক্লান্ত ক্ষুধার্ত মানুষগুলো গোগ্রাসে খেতে লাগল দেবীর প্রসাদ। নানারকম ফলের সঙ্গে সেই সুস্বাদু কন্দে সকলের ক্ষুধাতৃষ্ণা দূর হল। ক্ষুধাকে জয় করার এবং দীর্ঘ মেয়াদি পরিতৃপ্তির এক অত্যাশ্চর্য উপাদান আছে কন্দমূলে। শবনম নিজেও খেল। সাধুও খেলেন।

সাধু বললেন, আজ এইভাবেই শুরু হল। কাল থেকে মায়ের পুজো আরও বেশি করে জাঁকিয়ে হবে। বড় বড় কড়াইতে করে ভোগ রান্না হবে মায়ের। খিচুড়ি ভোগ। রাত্রিবেলা হালুয়া পুরি। সেই ভোগের প্রসাদ আমরা সবাই পেট ভরে এক পংক্তিতে বসে খাব। আর আমাদের এই মা ভবানী সবাইকে তা পরিবেশন করবে।

লালচাঁদ হেসে বললেন, কিন্তু কালকের মধ্যে অত সরঞ্জাম সংগ্রহ করে উঠতে পারবেন?

কেন পারব না লালচাঁদ? তুমি কি এখনও বিশ্বাস করতে পারছ না, আজ রাতের মধ্যেই আমরা আবার আমাদের কেল্লা দখল করব বলে?

লালচাঁদ হাসলেন। বললেন, ও হ্যাঁ। ভুলে গিয়েছিলাম। আজই তো আমরা কেল্লা দখল করছি। আর ওই কেল্লার ভেতর তো আমাদের সবকিছুই আছে। অবশ্য যদি ও সবকিছু রেখে থাকে।

রাখবে রাখবে। ওদের নিজেদের ব্যবহারের প্রয়োজনেই ওরা রাখবে বা রেখেছে। না রাখলে অত লোকের ভোজনপর্ব চলছে কী করে? সাধু বললেন, আজ রাতের অন্ধকারে শয়তান দুর্জন সিং ভূত দেখবে।

শবনম বলল, শুধু দুর্জন সিং নয়। ওই মংঘীরামকেও ভূত দেখাতে হবে। বিক্রমের কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে তো ওই মংঘীরামের জন্যই আমার আব্বাজানকে হারিয়েছি আমি। তা ছাড়া ও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

লালচাঁদ বললেন, সবই তো হল। কিন্তু ওই কেল্লায় আপনি প্রবেশ করবেন কী করে?

সাধু হাসলেন। বললেন, সেই গোপন পথের সন্ধান তোমরা কেউ জানতে না। আজ জানবে। ওই মহা শয়তান দুর্জনও জানে না। তোমার লোকেদের বলবে সামনের দিক দিয়ে দুম দাম গুলিগালা ছুড়ে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। আর সেই সুযোগে…।

সেই সুযোগে?

আমরা পিলপিল করে গোপন পথ দিয়ে ভেতরে ডুকব। আজ থেকেই ওই কেল্লায় আমাদের বিজয়পতাকা উড়বে। আজ রাত থেকে ওই কেল্লা আর দস্যুপুরী থাকবে না। আমরা ওর ভেতরে যেখানে যত বন্দি আছে সবাইকে মুক্তি দিয়ে দেব। আর কাল প্রভাতসূর্যের সঙ্গে সঙ্গে তোমরা তোমাদের ওইসব জঘন্য পোশাকপরিচ্ছদ ত্যাগ করে গেরুয়া পরবে।

আমরা কি তা হলে দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দেব সর্দার?

হ্যাঁ। কী হবে মানুষ খুন করে? এত খুনজখম তো করলে জীবনে, শান্তি পেলে কি? ওই কেল্লা দখল করতে পারলে আমাদের কোনও অভাব থাকবে না। তখন মা ভবানীর সেবা-পূজা করে সুখেশান্তিতে থাকতে পারব আমরা। এই কেল্লার নাম হবে ভবানী মন্দির।

লালচাঁদ বললেন, যা আপনি বলবেন তাই হবে সর্দার। তবে অদ্যই হোক আমাদের মানুষ মারার শেষ রজনী।

এমন সময় একজন লোক এসে লালচাঁদের কানে ফিস ফিস করে কী যেন বলতেই লালচাঁদ চোখ লাল করে দূরের দিকে তাকালেন। তারপর কাউকে কোনও কথা না বলে হন হন করে এগিয়ে গেলেন লোকটির সঙ্গে।

বেশ কিছু দূর যাবার পর এক নৃশংস দৃশ্য দেখতে পেলেন লালচাঁদ। সে দৃশ্য বড় মর্মান্তিক এবং রোমহর্ষক। দেখেন একজন লোকের দু’চোখ অন্ধ করে তাকে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখদুটো খুবলে বার করে নেওয়ায় রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। মুখ দেখে তাকে আর চেনবার উপায় নেই সে কে। লালচাঁদ বললেন, কে তুমি?

আমি যোগীন্দর।

যোগীন্দর! তোমার এই অবস্থা কে করল?

জানি না। আমি কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই কে যেন পিছন দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার চোখদুটো খুবলে বার করে নিল। তারপর এইভাবে বেঁধে রাখল আমাকে। আমি কত বললাম ওকে, এ শাস্তি আমার প্রাপ্য নয়। আমাকে একেবারে মেরে ফেলো। কিন্তু সে কথা ও কিছুতেই শুনল না।

তোমার পরিচয়?

এমন সময় ঝোপের আড়াল থেকে যে বেরিয়ে এল তাকে দেখেই চমকে উঠলেন লালচাঁদ, এ কী বিক্রম! তুমি এখানে?

এই শয়তানটার পরিচয় দেব বলে লুকিয়ে বসেছিলাম।

ওর এই দশা কে করেছে? তুমি?

হ্যাঁ। আমাকে হত্যা করবার জন্য এই লোকটাকে কাজে লাগিয়েছিল শয়তানটা। অবশ্য এতটা নির্দয় আমি হতাম না ওর ওপর, যদি না ও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করত।

কীরকম বিশ্বাসঘাতকতা?

আমি ওকে চিনে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই সাবধান করে দিই এবং বলি ওকেও আমার মতো দলত্যাগী হতে। ও প্রথমটা রাজি হয়নি। পরে অবশ্য অনেক বোঝাতে রাজি হয়। কিন্তু তখন বুঝিনি ওর এই রাজি হওয়াটা অভিনয় ছাড়া কিছু নয়। আমি ওকে বিশ্বাস করে সঙ্গে নিয়ে পথ চলছি এমন সময় দেখি পাহাড়ি বস্তির হিংলাজসর্দারের পোষা কুকুরটা ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ছুটতে ছুটতে কী একটা যেন মুখে নিয়ে বস্তির দিকে যাচ্ছে। আমি যেই সেদিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, অমনি শয়তানটা আমাকে পিছন দিক থেকে ধাক্কা মেরে পাহাড়ের খাদে ফেলে দেয়।

তারপর?

ভগবান রক্ষে যে পড়ে গিয়েও একটা শক্ত মোটা চিহড়লতাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে গেলাম। আমার চিৎকার শুনে এবং পড়ে যাওয়া দেখে ও ধরেই নিয়েছিল আমি খাদে পড়ে মরে গেছি। কিন্তু আমি যে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আবার ওকে ফলো করব, তা ও ভাবতেও পারেনি। এই শয়তানটা চিরকাল নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন করে তাদের চোখ খুবলে নিত। তাই আমিও ওর অস্তিমসময়ে আমার নিজস্ব আদালতের বিচারে ওকে ওই শাস্তিই দিলাম।

ঠিক করেছ।

লালচাঁদ এবার লোকটির কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর চুলের মুঠি ধরে বললেন, বিক্রম যা বলল তা ঠিক?

লোকটি নীরব।

তোমার নীরবতাই জানিয়ে দিচ্ছে ওর কথাই সত্য। যাক। তোমার উপযুক্ত শাস্তি তুমি পেয়েছ। এখন তোমার নিয়তিই তোমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেবে। এখন তুমি পাহাড় থেকে পড়ে মরবে কি পুলিশের গুলি খাবে সেটা নির্ভর করবে তোমার ভবিতব্যের ওপর। বলে একজনকে বললেন, দে, এর বাঁধনটা খুলে দে।

একজন লোক বাঁধন খুলে দিল।

বাঁধন খুলে দিতেই দু’হাতে চোখ ঢেকে সেখানেই বসে পড়ল লোকটি। লালচাঁদ, বিক্রমজিৎ এবং তাঁর অনুচরকে সঙ্গে নিয়ে আবার যথাস্থানে ফিরে এলেন।

হিংলাজসর্দারের পোষা কুকুরটা আসায় সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। সবচেয়ে বিস্ময়কর যেটা হল, তাতে সবাই একটা আশার আলো দেখতে পেল। ওই অগ্নিকাণ্ডর পর থেকে কুকুরটা নিখোঁজ হওয়ায় সবাই প্রায় ধরেই নিয়েছিল ওটা পুড়ে মরেছে। কিন্তু তার এই সুস্থ শরীরে ফিরে আসা এবং তার এই মুখের বস্তুটি চমক লাগিয়ে দিল সকলকে।

কুকুরটা ফিরে এসেই শবনমের পায়ের কাছে কী যেন একটা রেখে কুঁই কুঁই করে ছটফট করতে লাগল।

কী ওটা? কী রাখল?

শবনম সেটা কুড়িয়ে নিয়েই চেঁচিয়ে উঠল, কোথায়? কোথায় পেলি এটা? আমাকে তুই নিয়ে চল সেখানে। আমার বন্দুক! বন্দুকটা কেউ আমাকে এনে দাও। মা ভবানীর মন্ত্রপূত বন্দুক। যার নিশানা ব্যর্থ হবার নয়।

সাধু বললেন, কী হল মা! ওটা কী? কী পেয়ে তুই এমন উত্তেজিত হয়ে উঠলি? আমাকে বল?

সে মরেনি বাবা। সে নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। কেউ কোথাও লুকিয়ে রেখেছে তাকে। এই দেখুন তার রুমাল। এই রুমাল মুখে নিয়ে ও যখন আমার কাছে এসেছে, আর বারে বারে ছটফট করছে, তখন ও নিশ্চয়ই জানে সে কোথায় আছে। আমি এখনি তার খোঁজে যেতে চাই। আর দেরি করলে হয়তো তার আরও বিপদ হবে।

সাধু ডাকলেন, লালচাঁদ !

বলুন সর্দার।

একে মদত করো। তুমিও সঙ্গে যাও। পারলে সঙ্গে নাও আরও দু’-একজনকে। আমি এদিকটা দেখছি। তুমি ওদিকে দেখো। দেবীকে একা ছাড়া ঠিক হবে না।

লালচাঁদ তক্ষনি তাঁর দলের সবাইকে ডেকে নিলেন। দু’জন রইল দুর্গ পাহারায়। আর রইল পাহাড়িয়া মানুষগুলো। ওরা এমনভাবে দুর্গ ঘিরে রইল যাতে ওদিক থেকে কেউ গুলিগালা ছুড়লে এদিকের কারও গায়ে না লাগে, আবার ওদিকের দুর্গ থেকেও কেউ বেরোতে গেলে এদিকের গুলির মুখে পড়ে। এই অবরোধ এমনই যে দুর্গ থেকে বেরোতে না পারলে খাদ্য এবং পানীয় জলের অভাবে তিল তিল করে শুকিয়ে মরবে ওরা। ঘুঘুরা এখন নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই পড়েছে।

শবনম, লালচাঁদ, বিক্রমজিৎ তিনজনে তিনটে ঘোড়ায় চেপে বসল। বাকিরা চলশ পদব্রজে। সবার আগে চলল কুকুরটা। আর কুকুরের নির্দেশিত পথে ওরা সকলে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল এবং বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল।

পাহাড়ের ঢালু পথে নামতে নামতে ভীষণ জঙ্গল পার হয়ে একসময় ওরা এক প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।

দরোয়ান পাহারা দিচ্ছিল গেটে।

বিক্রম ওর কাছে গিয়ে বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে বলল, দরোয়াজা খুলো।

দরোয়ান বলল, হুকুম নেহি।

শবনম বলল, না খুললে বিপদ হবে। খোলো দরোয়াজা।

দরোয়ান বলল, শেঠজি হামকো নোকরি সে নিকাল দেগা।

লালচাঁদ বললেন, দরজা না খুললে আমরাও তোমাকে জিন্দগি থেকে নিকাল দেব।

দরোয়ানটি সঙ্গে সঙ্গে একটা কলিংবেলের সুইচ টিপে দিতেই চারদিক থেকে

বিপজ্জনক ঘণ্টি বাজতে শুরু করল।

বিক্রমের বন্দুক গর্জন করে উঠল ‘গুডুম’।

রক্তাক্ত কলেবরে লুটিয়ে পড়ল দরোয়ান।

ওরা এবার নিজেরাই দরোয়ানের পকেট থেকে চাবি নিয়ে গেট খুলে ফেলল।

তারপর হই হই করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। আর ঢোকা মাত্রই দেখল দশ-বারোজন যোদ্ধা স্টেনগান উঁচিয়ে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।

এরা ঢুকতেই ওরা বলল, জলদি বাহার নিকালো। নেহি তো…।

লালচাঁদ বললেন, ও লেড়কা কাঁহা হ্যায়?

শবনম বলল, কাঁহা হ্যায় ও লেড়কা?

কাঁহা হ্যায় দেখোগে? বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা গুলি চালানো শুরু করল।

বিক্রম, লালচাঁদ এবং শবনম তিনজনেই ছিটকে পড়ল গুলি খেয়ে। ঘোড়াগুলো প্রচণ্ড আর্তনাদ করে শূন্যে দু’পা তুলে লাফিয়ে উঠল একবার। আর সঙ্গে সঙ্গেই লালচাঁদের লোকেরা উঁচু পাঁচলের ওপর থেকে গুলির পর গুলি চালিয়ে সেই আক্রমণকারীদের সব কটাকে মাটিতে লুটিয়ে দিল। তারপর পাঁচিল থেকে লাফিয়ে পড়ে মেন গেটটা বন্ধ করে দিল একেবারে। লাফ দিয়ে ছুটে এসে বিক্রম, লালচাঁদ আর শবনমকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বারান্দার নীচে শোয়াল।

বিক্রমের বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ওর আর বাঁচার আশা নেই। ।

লালচাঁদও গুরুতর রকমের জখম হয়েছেন শবনমের বাঁ কাঁধে গুলি লেগেছে।

অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে সকলে।

শবনম এক হাতে ওর বাঁ কাঁধটা চেপে ধরেছে। ঝর ঝর করে লাল রক্ত ঝরে পড়ছে সেখান দিয়ে। যন্ত্রণা এত প্রবল যে মনে হচ্ছে এখুনি হার্টফেল করবে বুঝি। গায়ে যেন জ্বর আসছে। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়। এখুনি গুলি বার করতে না পারলে পরে ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে। তখন আর কোনও কিছু করাই সম্ভব হবে না।

একজন লোক লালচাঁদকে ঘোড়ায় তুলে সঙ্গে সঙ্গেই স্থান ত্যাগ করল। যদি কোনও ডাক্তারের কাছে গিয়ে অস্ত্রোপচার করে কোনওরকমে মানুষটাকে বাঁচানো যায়।

আর একজন শবনমকে বলল, চলুন দেবীজি। আপনারও গা থেকে ওই বুলেটগুলো বার করা দরকার। না হলে খারাপ হয়ে যাবে। কোনও ডাক্তারখানায় গিয়ে ওগুলো বার করে দু’–একটা সুইটুই নিয়ে নেবেন।

শবনম বলল, আগে যে কাজে এসেছি সেই কাজ করি। তোমরা সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে দেখো কোথায় লুকিয়েছে ওরা ছেলেটাকে।

এই ডামাডোলের মধ্যে ওরা কেউ নজরই দেয়নি কুকুরটার দিকে। কুকুরটা তখন উঠোনময় ছুটোছুটি করে এক জায়গায় গিয়ে প্রচণ্ড রকমের চিৎকার করতে লাগল। ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ–উ–উ–উ।

শবনম সেই অবস্থাতেই ছুটে গেল সেখানে। গিয়ে দেখল একটা আংটাওয়ালা কাঠের ডালা উঠোনের এক প্রান্তে নীচের একটি গর্তমুখে ঢাকা দেওয়া আছে। বলল, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনও গোপন ঘর বা ওই জাতীয় কিছু আছে। আমার মন বলছে এখানেই আছে রঞ্জন।

একজন লোক শবনমকে সরিয়ে এনে এক জায়গায় বসাল। বলল, আপনি আহত। বেশি পরিশ্রম করবেন না বা উত্তেজিত হবেন না। আমরা দেখছি ওর ভিতরে কী আছে না আছে।

শবনম বলল, আমিও নামব ওর ভেতরে।

তা হলে আমাে রক্ষা করবে কে? সবাই গেলে কি হয়? এই বলে দু’জন লোক সেই ডালা তুলে যেই না ভেতরে নামতে যাবে অমনি দোতলার বারান্দা থেকে দুটো বুলেট যেন হাওয়ায় ছিটকে এসে শেষ করে দিল দু’জনকে।

বাকি দু’জন তখন একটু নিরাপদ দূরত্ব থেকে সেই বারান্দা লক্ষ্য করে গুলি ছোটাতে লাগল।

একজন চেঁচিয়ে বলল, দেবীজি! তুম হঠ যাও হিয়াসে। ইয়ে আদমি বহুত খতরনক হ্যায়। তুম আভি কোঈ ডাক্তারকা পাশ চলা যাও। নেহি তো বহুত দের হো যায়গা।

শবনম একটু সময় কী যেন ভাবল। তারপর লাফিয়ে বসল একটা ঘোড়ার পিঠে।

ওদিক থেকে হঠাৎ একজন চিৎকার করে উঠল, ইধার মাত আও দেবীজি। ও শয়তানকা বাচ্চা উপর সে গোলি চালায়গা।

শবনম তখন আবার সেই আগের মতো প্রেতিনী হয়ে উঠল। বাঁ কাঁধের যন্ত্রণার কষ্ট ভুলে বন্দুকটা বাগিয়ে ধরে ঘোড়ায় চেপেই একেবারে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল।

ওর ওই রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে যে যেদিকে পারল পালাল। যে বাধা দিতে এল সেই পড়ল গুলির মুখে।

ঘোড়া তখন ঘরের ভেতর ঢুকে প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে একেবারে দোতলায় উঠে পড়ল।

দু’জন লোক তখন বারান্দার থামের আড়াল থেকে গুলির জবাব গুলিতে দিচ্ছে।

শবনম ঘোড়া থেকে না নেমেই পিছন দিক থেকে গুলি করল লোক দু’জনকে।

গুলি খেয়ে দু’জনে দু’দিকে ছিটকে পড়ল আর্তনাদ করে।

শবনম বারান্দায় এসে হাত নেড়ে ওদের জানাল আর কোনও ভয় নেই। এবার তোমরা বিপদমুক্ত।

লোকগুলো এবার নির্ভয়ে নীচের উঠোনে ঘোরাফেরা করতে লাগল।

দু’জন লোক সেই কুকুরের চিৎকারের সূত্র ধরে তরতর করে নীচে নেমে গেল। কিন্তু না। সেখানে তখন ফাঁকা ঘর। কেউ কোথাও নেই।

শবনম দু’জন লোককে ওপরে ডেকে প্রতি ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কিন্তু না। কেউ কোত্থাও নেই। একটি ঘরের দরজা শুধু ভেতর থেকে বন্ধ। ওরা আঘাতের পর আঘাত করেও যখন সে দরজা খুলতে পারল না, তখন একজন লোক নীচে নেমে একটা শাবল জোগাড় করে এসে তাইতে চাড় দিয়ে ভেঙে ফেলল দরজাটা।

সেই ঘরের ভেতরে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে শেঠ মংঘীরামজি থরথর করে কাঁপছিলেন।

শবনমকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন মংঘীরাম, নেহি নেহি নেহি। মুঝে মাত মারো দেবীজি। মুঝে মাত মারো।

শবনম বলল, বড্ড প্রাণের মায়া যে। শয়তান। লোকের সর্বনাশ করার সময়, ট্রেন ওলটানোর সময় এই প্রাণে খুব ফুর্তি হয় না? এখন তোর প্রাণ নিয়ে আমি ফুটবল খেলব।

ম্যায় গোড় পাকড়তি হুঁ দেবীজি! মুঝে মাফ করো।

আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলি কেন? কী বলে পালিয়ে এসেছিলি ওখান থেকে? কোন সাহসে আমার সঙ্গে বেইমানি করলি, বল?

মুঝে মাফ কর দো। মেরা গলতি হো গিয়া।

ফের ওই এক কথা?

মংঘীরামের বউ-ছেলেমেয়ে সবাই তখন ছুটে এসে শবনমের পাদুটো জড়িয়ে ধরল। বলল, উনকো মাত মারো দেবীজি। হাম সব অনাথ হো যাউঙ্গা।

শবনম বলল, এই কথা বলতে সরম লাগছে না তোমাদের? এই পাপীর পাপের পয়সা নিয়ে দিব্যি তো সুখভোগ করছিলে? এখন অনাথ হয়ে যাবার শোকে নাকিকান্না কাঁদছ? কেন তোমরা বাধা দাওনি ওকে ওইসব কাজ করতে?

মংঘীরামের বউ ডুকরে কেঁদে উঠল।

শবনম ওর গলার হারটা এক টানে ছিড়ে দিয়ে বলল, এ হার কার? মেরা।

তোমার? না ট্রেনডাকাতি করে পাওয়া লুটের মাল? সত্যি করে বলো? ও হার মেরা।

শবনম সেটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তোমরা একটু ওপাশের ঘরে যাও। এ শয়তানটার সঙ্গে আমার একটু বোঝাপড়া আছে।

নেহি। ম্যায় নেহি যাউঙ্গা] তুম উনকো মার ডালোগে।

শবনম ওর লোকেদের বলল, মংঘীরামের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে অন্য ঘরে সরিয়ে দিতে।

কিন্তু ওরা এমনভাবে কান্নাকাটি করতে লাগল যে তা আর সম্ভব হল না। অগত্যা ওরা মংঘীরামকেই টেনে বার করতে গেল হিড়হিড় করে।

মংঘীরাম ছুটে গিয়ে সিন্দুক খুলে গাদা গাদা নোটের বান্ডিল ছুড়ে দিতে লাগল শবনমের দিকে, ইয়ে লো। তুম মুছে এক লাখ দেনে কো লিয়ে বোলা থা, ইয়ে লো দশ লাখ রুপয়া। সোনাদানা যো কুছ হ্যায় লে লো। লেকিন মুঝে জিনে দো।

শবনম তখনও ঘোড়ার পিঠেই চেপে আছে। একবারও নামেনি। মংঘীরামের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বলল, ও মুঝে নেহি চাইয়ে মংঘীরাম।

তো ক্যা চাহিয়ে তুমকো? হামারা আব্বাজান কা জিন্দগি আউর রঞ্জনকো চাহিয়ে। ও লেড়কা মিল যায়ে গা। লেকিন আব্বাজান কি বারেমে ম্যায় কুছ নেহি জানতা।

তো লেড়কা কো আপস দে দো।

ও মিট্টিকা অন্দর হ্যায়।

জিন্দা না মুর্দা?

জিন্দা। আন্ডারগ্রাউন্ড মে হ্যায় ও।

চলো নিকালো।

মংঘীরাম ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বিয়ে নীচে নামল। শবনমও ঘোড়া নিয়ে নামতে লাগল নীচে। তারপর ওরা সেই কাঠের আংটাওয়ালা পাটাতনটার কাছে যেতেই শবনম বলল, ইসকো অন্দরমে কোঈ নেহি হ্যায়। হাম সব পহলেই দেখা

হ্যায়। লাস্ট স্টেপিং পর যানে কা বাদ এক সুইচ বোর্ড মিলেগা। হুঁয়া তিন নম্বরমে পুস করনে সে এক অলগ কামরা কা ওয়াল হট যায়েগা। রঞ্জনবাবু হুঁয়া পর হ্যায়।

ঠিক হ্যায়, লেকে আও।

মংঘীরাম বলল, আপ ভি আইয়ে।

শবনম ঘোড়া থেকে নেমে যেই না ভেতরে ঢুকতে গেল অমনি লোক দু’জন বাধা দিল ওকে। বলল, আপ মাত যাইয়ে দেবীজি। উনকো যানে দিজিয়ে। হাম দোনো যাউঙ্গা ও শয়তান কা সাথ।

এদিকে ‘জলদি আইয়ে’ বলে

মংঘীরাম সেই কাঠের পাটাতনের ডালা তুলে আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমেই ডালাটা ফেলে ভিতর থেকে লক করে দিল। শবনম এবং তার লোকেরা বারবার চেষ্টা করতে লাগল সেটাকে ভেঙে ফেলবার, কিন্তু পারল না।

বাইরে তখন সাইরেনের শব্দ।

শবনমের লোকেরা চেঁচিয়ে উঠল, পুলিশ! পুলিশ! জলদি ভাগো হিয়াসে। দেবীজি চলা আও। কিন্তু যাবে কোনদিকে?

একজন বলল, আমরা এর ভেতরে ঢুকেই বাইরে পালাবার রাস্তা দেখে এসেছি। ওই পিছন দিকে একটা তালাওয়ের পাড় দিয়ে রাস্তা। উধার সে ভাগো।

ওরা পিছনের দরজা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল।

মেন দরজায় তখন ঘন ঘন পুলিশের করাঘাত। পুলিশের একজন লোক তখন একটি গাছের ডালে উঠে পাঁচিল টপকে ঠিক যেভাবে লালচাঁদের লোকেরা এসেছিল সেইভাবে ভেতরে ঢুকল। তারপর এদিকের বন্ধ দরোজাটা খুলে দিতেই ভ্যান ভরতি পুলিশ হই হই করে ঢুকল ভেতরে।

পুলিশকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই মংঘীরামের বাড়ির চাকরবাকর সহযে যেখানে ছিল ছুটে এল। ওর বউ-ছেলেমেয়েরাও ছুটে এসে বলল, আপ লোগোনে ইতনা দেরি কিউ কিয়া? ও ডাকু আকে হামারা সর্বনাশ কর দিয়া।

পুলিশ অফিসার বললেন, থামুন। আপনারা যে কী চিজ আমি জানি। দিনের পর দিন হাজার হাজার লোকের সর্বনাশ করে বেড়াবেন আর আপনাদের সর্বনাশ কেউ করতে এলে চেঁচামেচি করবেন, এ কীরকম কথা?

মংঘীরামের স্ত্রী বললেন, দেখিয়ে তো কিতনা আদমি কো মার ডালা ও ডাকুনে।

এইসব লোক আপনাদের?

জি হাঁ।

আমি তো এদেরকেই ডাকাত মনে করেছিলাম। এত স্টেনগান বন্দুক এরা পেল কী করে?

মংঘীরামের স্ত্রী এবার চুপ করে রইলেন।

পুলিশ অফিসার বললেন, শুনুন, দুর্নীতির অভিযোগে এখানকার এস পি-কে বদলি করা হয়েছে। নতুন এস পি হুকুমত সিং অত্যন্ত কড়া লোক। আপনাদের রামরাজত্বের অবসান একেবারেই হয়ে গেছে ধরে নিতে পারেন। আর আমিও এখানে নতুন এসেছি। শুধু আগের এস পি সাহেবের জন্যে কিছু করতে পারছিলাম না। এখন বলুন শেঠজি কোথায়?

ডাকুরানি উসকো লেকে ভাগা।

ডাকুরানি?

হাঁ হাঁ। কাঁহাসে এক বদমাশ লেড়কি ফুলনদেবী বনকে আয়া। ও সবকো মারতা।

কোথায় থাকে সে?

ওই পাহাড় পর যো হিন্দোলগড় হ্যায়, হুঁয়াকা বস্তিমে।

হিন্দোলগড়! ও তো আর এক জায়গা। যতসব কুখ্যাত সমাজবিরোধীদের ঘাঁটি একটা। ওর ধারেকাছে গেলেই তো শুনেছি গুলি করে। আমি অনেকবার এস পি সাহেবকে বলেছিলাম ওই পুরনো কেল্লায় রেড করতে। কিন্তু ওনার কী যে স্বার্থ ছিল তা কে জানে, ওই কেল্লার কথা উঠলেই তেড়ে একটা ধমক দিতেন।

পুলিশের লোকেরা তখন ডেড বড়ির গাদা করেছে।

তরুণ অফিসার চারদিক ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সেই কাঠের ডালার কাছে এসে বললেন, এটা এখানে কী?

মংঘীরামের স্ত্রী বললেন, উধার কুছ নেহি। ও আন্ডারগ্রাউন্ড কা দরোয়াজা। তোড়ো। হাম দেখেঙ্গে। কনস্টেবল! তোড়ো ইস ডালে কো।

পুলিশের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে এর ডালা ভেঙে ফেলল। তারপর টর্চের আলো ফেলে ভেতরে ঢুকেই আর যাবার পথ পেল না।

পুলিশ অফিসার বললেন, ব্যস। এইটুকু নামার জন্যে এত কাণ্ড? মংঘীরামের স্ত্রী বললেন, হাম তো পহলেই আপকো বোলা ইসকো অন্দরমে কুছ হ্যায়ই নেহি। আপ তো শুনা নেহি মেরি বাত।

কিন্তু একটা কথা আমি ভেবে পাচ্ছি না, এর ভেতরে কিছু যদি না-ই থাকবে তা হলে এর ডালাটা ভেতর থেকে লক করেছিল কে?

মংঘীরামের স্ত্রী এবার জবাব দিতে পারলেন না।

পুলিশ অফিসার বললেন, শুনুন। এ যাত্রায় আপনাদের বাঁচবার কোনও রাস্তাই আমি দেখতে পাচ্ছি না। এখনও বলছি যদি নিজেদের মঙ্গল চান তো পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করুন।

হাম আপকো বহুত রুপিয়া দেঙ্গে। আপ হামারা পতিকো বাঁচাইয়ে।

পুলিশ অফিসার বললেন, একটা কথা জেনে রাখুন, পুলিশের মধ্যে অনেক খারাপ লোক যেমন আছে, তেমনি ভাল লোকও অনেক আছেন। আমি মধ্যবিত্ত বাঙালির ছেলে। এই বিদেশে পুলিশের চাকরি করতে এসেছি। আমার অনেক অভাব আছে। তাই বলে টাকার লোভে কোনও বর্ন ক্রিমিন্যালকে আমি প্রশ্রয় দেব না। আপনাদের ওই পাপের টাকায় হাত দেব না আমি। আমার সন্তান এই পবিত্র ভারতভূমির মাটিতে ঘুষের টাকায় পালিত হয়ে হাওয়াগাড়ি চেপে ঘুরে বেড়াবে এই নীচতা আমার রক্তে নেই। জনগণের আত্মসাৎ করা টাকা আমি সরকারের হাতেই তুলে দেব। কিন্তু এখন বলুন শেঠজি কোথায় বা এর ভেতরে ঢোকার সোজা পথ কোনদিকে?

কথা বলতে বলতেই সুইচ বোর্ডটা নজরে পড়ে গেল অফিসারের। তিনটে সুইচ। দুটো ফলস। একটা আসল। তৃতীয়টায় হাত পড়তেই দু’ফাঁক হয়ে গেল দেওয়ালটা।

পুলিশ অফিসারের নির্দেশে সকলে হই হই করে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

পরপর অনেকগুলি ঘর। প্রতিটি ঘরের দেওয়ালের পেরেকে চাবি আটকানো। সেই চাবি নিয়ে দরজা খুলতেই বিস্ময়ের পর বিস্ময় দেখা দিতে লাগল। একটি ঘরের ভেতর থেকে উদ্ধার হল গাঁজা-চরস ইত্যাদি কিছু মাদক দ্রব্য। আর একটি ঘর থেকে দশ-বারোজন সুন্দরী

মহিলাকে উদ্ধার করা হল। একটি ঘরে ছিল ট্রেনডাকাতি করে পাওয়া প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার।

আর একটি ঘরে একশো টাকার জাল নোটের হাজার হাজার বান্ডিল। শেষ ঘরটিতে ছিল হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক কিশোর।

পুলিশ অফিসার গিয়ে তার বাঁধন খুলে দিয়ে বললেন, বাঙালির বাচ্চা বলে মনে হচ্ছে! কী নাম তোমার?

আমার নাম রঞ্জন। আমি কোথায়?

তুমি এখন কুখ্যাত মংঘীরাম শেঠের গুপ্তকক্ষে আছ।

শবনম কোথায়? সে কেমন আছে? তার কোনও ক্ষতি হয়নি তো?

শবনম কে?

বলব বলব। সব বলব। আগে আমাকে একটু জল খেতে দিন।

পুলিশ অফিসার তাঁর সঙ্গের কনস্টেবলদের বললেন, যাও একে বাইরে বার করে নিয়ে যাও। শেঠের বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভাল জল খাইয়ে একটু সুস্থ হতে দাও। তারপর ওর কথা শোনা যাবে।

ওরা রঞ্জনকে বার করে নিয়ে গেলে পুলিশ অফিসার মংঘীরামের স্ত্রীকে বললেন, আপনার স্বামী কোথায়?

কৌন জানে ও কাঁহা হ্যায়।

ঠিক সে বোলিয়ে আপকা পতি মংঘীরাম কাঁহা হ্যায়? কিধার সে ভাগা ও শয়তান, মুঝে বাতাইয়ে।

মংঘীরামের স্ত্রী এবার রীতিমতো ভয় পেয়ে একটি দেওয়ালের নীচের দিকের সুইচ টিপতেই দেওয়ালটা ওপর দিকে উঠে গেল। আর তখনই দেখা গেল একটি ছোট্ট ঘরের মেঝেয় বসে মংঘীরামজি থর থর করে কাঁপছেন।

পুলিশ অফিসার বললেন, বাঃ শেঠজি। বেশ ভাল একটা নিরিবিলি তপস্যার জায়গা বেছে বার করে নিয়েছেন দেখছি। তা আর কেন? এবার বেরিয়ে আসুন ওর ভেতর থেকে।

হাম জানে নেহি সকতা স্যার। হামারা ব্লাড প্রেশার জায়দা হো গিয়া।

ও এক্ষুনি রুলের গুঁতোয় কমে যাবে। বেরিয়ে আসুন।

হাম আপকো বহুত রুপইয়া দেগা। হামকো ক্ষমা কর দিজিয়ে সাব। পুলিশ অফিসার বললেন, এই, এর হাতে হ্যান্ডকাপ লাগা তো কেউ! হ্যান্ডকাপের নামে তীব্র একটা আর্তনাদ করে উঠলেন মংঘীরাম।

নাউ, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। এখন বলুন আপনার এই ধর্মপুরীতে কোথায় কী লুকানো আছে?

কনস্টেবলরা সঙ্গে সঙ্গে মংঘীরামের হাতে হাতকড়া পরাল। তারপর সবাই মিলে টেনে হিঁচড়ে বাইরে বার করে আনল তাকে।

মংঘীরামের স্ত্রী যখন বুঝলেন কোনও প্রলোভনেই এই তরুণ বাঙালি পুলিশ অফিসারকে বশে আনানো যাবে না, তখন অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে দিলেন। অবশ্য তাতে লাভ হল না কিছুই। পুলিশ অফিসারের কড়া ধমক ছাড়া কিছুই জুটল না তাঁর বরাতে।

বাইরে এসে মংঘীরাম হঠাৎ নিজমূর্তি ধরলেন। বললেন, বাঙ্গালিবাবু! আপ নয়া অফিসার মালুম হচ্ছে। আপনি কিন্তু ভিমরুলের চাকে হাত দিয়ে ফেলেছেন। আমার নজরানা আপনি নিলেন না, লেকিন আপনার হয়তো জানা নেই যে, আপনার এস পি বাবা আমার জিগরি দোস্ত। কোনও হাজতেই আপনি আমাকে আটকে রাখতে পারবেন না। যে রুপিয়া আপনি আপনার অনেস্টি দেখাতে গিয়ে নিলেনই না, ওই রুপিয়া আমাকে ছাড়িয়ে আনবে, আর আপনাকে ট্রান্সফার করিয়ে দেবে অনেক দূরে। এখনও ভেবে দেখুন কী করবেন। আমি এখনও আপনার সঙ্গে দোস্তি করতে রাজি আছি।

তরুণ পুলিশ অফিসার তখন আর থাকতে না পেরে সবুট একটা লাথি দড়াম করে মেরে বসলেন মংঘীরামের পেটে।

মংঘীরাম লাথি খেয়ে একবার ‘ঘ্যাক্’ করে মুখ দিয়ে এক বিটকেল শব্দ বার করে বসে পড়লেন।

পুলিশ অফিসার বললেন, তোমার হয়তো জানা নেই বাবা নাদুসরাম, যে… জি ম্যায় নাদুসরাম নেহি। মংঘীরাম।

তুমি নাদুসরামই। তোমার হয়তো জানা নেই যে ওই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই এবং আরও অন্যান্য অনেকগুলি অভিযোগে এখানকার এস পি সাহেব হঠাৎ বদলি হয়ে গেছেন। তাঁর জায়গায় এখন এসেছেন হুকুমত সিং। তোমার সম্বন্ধে সব কিছুই তিনি শুনেছেন। এমন সময় টেলিফোনে চোরের ওপর বাটপাড়ি হচ্ছে খবর শুনে আমি লোকজন নিয়ে তৈরি হয়ে ছুটে এসেছি। এস পি সাহেবের আদেশ, আমি এখান থেকে ফিরে যাবার সময় যেন তোমার গায়ের চামড়াটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাই। সেটা কীভাবে নিলে তোমার সুবিধে হয় চট করে বলে ফেলো দেখি?

মংঘীরাম থরথর করে কাঁপতে লাগলেন।

তোমার গোডাউন কোথায়?

আমার কোত্থাও কিছু নেই স্যার। যা কুছু সব এইখানেই আছে।

মিথ্যে কথা।

হুজুর ! মংঘীরাম ধার্মিক লোক। মিথ্যা কোথা বোলে না, মিথ্যা কোথা বললে পাপ হয়।

পুলিশ অফিসার এবার মংঘীরামের পায়ের গাঁটে এক ঘা রুলের বাড়ি বসিয়ে দিতেই ‘ভ্যা ভ্যা’ করে চেঁচাতে লাগলেন মংঘীরাম। আর এক ঘা দেব?

নেহি। ম্যায় সব কুছ বাতাতা হুঁ। ও নদীকা কিনার মে হামারা এক টিম্বারকা গোডাউন হ্যায়। ব্যস। আউর কুছ নেহি।

পুলিশ অফিসার বললেন, ওখানেও রেড হবে আজ। তারপর এস পি সাহেবের নির্দেশমতো ব্যবস্থা হবে তোমার।

কনস্টেবলরা বলল, একে এখন কোথায় নিয়ে যাব স্যার?

কোত্থাও না। এইখানেই বেঁধে ফেলে রেখে দাও। আগে ওর বাড়ির ভেতরটা সার্চ করি, পরে ওর ব্যবস্থা হবে।

পুলিশ অফিসার এবার মংঘীরামের বাড়ির বউ-ছেলেমেয়ে চাকরবাকর প্রত্যেককেই পৃথক পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে সকলকে এক ঘরে পুলিশ পাহারায় রেখে বাড়ি সার্চ করতে লাগলেন লোকজন নিয়ে।

দোতলায় একটি ঘরের ভেতর মেঝেময় ছড়ানো একশো টাকার নোটের বান্ডিলগুলো দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। বললেন, এত টাকা। এগুলো জাল নোট নয় তো?

নোটগুলো বান্ডিল বেঁধে রেখে একতাড়া নোট স্যাম্পেল হিসেবে নিয়ে রঞ্জনের কাছে এলেন। বললেন, এবার বলো তো বাবা তুমি এখানে কীভাবে এলে?

রঞ্জন তখন ট্রেন দুর্ঘটনার রাতের ঘটনা থেকে এক এক করে সব কিছু খুলে বলল পুলিশকে। তারপর বলল, আপনারা যেভাবেই হোক রক্ষা করুন শবনমকে। ওই শয়তান দস্যুটাকে মেরে শবনমকে সুপথে ফিরিয়ে আনুন। না হলে মেয়েটা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। ওর দায়িত্ব আমি নেব। ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব।

তোমার কি ধারণা মেয়েটি এখনও বেঁচে আছে?

ওর মধ্যে এক অলৌকিক শক্তি ভর করেছে। ওর কোনও ক্ষতি কেউ করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবুও বিশ্বাস তো নেই।

তোমাকে ওরা এখানে নিয়ে এল কী করে?

ঠিক বুঝতে পারলাম না। ঝোপড়ির ঘরে শুয়ে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ দেখি চারিদিকে আগুন আগুন চিৎকার। আর তারই সঙ্গে দেখতে পাই ঘোড়ায় চড়া কয়েকটা ডাকাত চারদিকময় ছুটোছুটি করছে। তারপর?

আমি তখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম, কী যে করব, কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম এই সময় বোকার মতো এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে যদি ডাকাতদের নজরে পড়ে যাই তো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে ওরা। তাই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালাতে গেলাম। হিংলাজসর্দারের একটা কুকুর ছিল। সেটা আমার পাশেই শুয়েছিল। আমাকে পাহারা দেবে বলে। ওই কুকুরটাকে নিয়েই পালাতে গেলাম। হঠাৎ অন্ধকারে দু’তিনজন লোক আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে তুলে নিয়ে চলে এল।

এই লোকগুলো মংঘীরামের?

হ্যাঁ। আসলে মংঘীরামের নির্দেশমতো লোকগুলো আমাদের দু’জনের ওপর আক্রমণের জন্যই আসছিল। কেন না শবনমের জন্য ওর এতদিনের ঠগবাজির ব্যবসা নষ্ট হতে বসেছিল প্রায়। তাই ও চেয়েছিল আমাদের দু’জনকে ওর কয়েদখানায় পুরে পয়েজন করে মেরে ফেলতে। কিন্তু আমরা যে সদাসতর্ক ছিলাম, তা বুঝতে পেরেই ওরা প্রকাশ্য বিদ্রোহে না এসে অপেক্ষা করছিল গভীর রাতের অন্যমনস্কতার। এমন সময় লালচাঁদের আবির্ভাব, শবনমের কেল্লা অভিযান এবং ওই অকস্মাৎ অগ্নিকাণ্ড, তদুপরি আমার আত্মরক্ষার্থে পলায়ন ওদের কাছে একটা লোভনীয় সুযোগ হয়ে দেখা দেয়।

তোমাকে ওরা মারধোর করেনি?

না। শুধু বলেছিল শবনমকে নিয়ে আসার পর আমাদের দু’জনকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।

পুলিশ অফিসার দাঁতে দাঁত চেপে ভয়ংকর রেগে বললেন, তাই নাকি? হ্যাঁ।

ঠিক আছে। আজ তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চলো। ওখানে রাতটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে আরামে কাটাতে পারবে। তারপর কাল সকালে আমি এস পি সাহেবকে সঙ্গে নিয়েই ওই কেল্লা-পাহাড়ে অভিযান করব।

কিন্তু তাতে যে অনেক দেরি হয়ে

যাবে।

এছাড়া তো উপায় নেই বাবা।

কেন উপায় নেই?

এই রাতদুপুরে ঘন অন্ধকারে কেল্লা-পাহাড়ে উঠব কী করে? পথঘাট চিনি না কিছু।

আমি চিনিয়ে নিয়ে যাব।

তুমিও চিনতে পারবে না। এই অন্ধকারে এক হাত দূরের দৃশ্য দেখা যায় না। বাঃ রে। আপনাদের তো টর্চ আছে!

তা আছে। তবুও ওই পাহাড়ে যেতে গেলে এই ক’টা লোক নিয়ে হবে না। আরও অন্তত দু’ ব্যাটেলিয়ান লোক চাই। প্রয়োজন হলে ওই কেল্লাটাকে আমরা উড়িয়ে দেব।

কিন্তু ততক্ষণে শবনমকে কি উদ্ধার করা যাবে?

না। ওর ভেতরে সত্যিই যদি কোনও অলৌকিক কিছু ভর করে থাকে তা হলে ওর কোনও ক্ষতিই হবে না। যদি তা না হয়ে থাকে, তা হলে কেল্লায় পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই ও শেষ হয়ে গেছে। তা ছাড়া আমাদের এখুনি একবার হেড কোয়ার্টারে খবর দিয়ে মংঘীরামের গোডাউনটা রেড করা দরকার। এদিকে বিলম্ব করলে ওর লোকেরা তৎপর হয়ে মালপত্তর সব হাপিস করে দেবে। কিন্তু হিন্দোলকেল্লার গুপ্তধন নষ্ট হবে না বা ওর ভেতর বসবাসকারীরা নিজেরাও পালাতে অথবা মালপত্তর সরাতে পারবে না। তার কারণ ওখানে তোমার শবনম আছে। লালচাঁদ আছেন। তুমি অযথা ভয় পেয়ো না।

ভয় পাচ্ছি তো আমি অন্য কারণে। ওরা ওইভাবে হিন্দোলকেল্লা আক্রমণ করার পরই দস্যুরা এসে বস্তিতে আগুন ধরাল কী করে? তার মানে নিশ্চয়ই লালচাঁদ হার মেনেছেন। নিশ্চয়ই শবনমের ক্ষতি হয়েছে।

তোমার এই সন্দেহটা অবশ্য অমূলক নয়। ঠিক আছে। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি এস পি সাহেবের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে তাঁর মতামতটা নিচ্ছি। ততক্ষণ তুমি আমার বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম করো। যাও। বলে একজন লোককে বললেন, কোথাও থেকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে রঞ্জনকে ওনার বাসায় পৌঁছে দিতে।

লোকটি রঞ্জনের হাত ধরে বলল, এসো।

রঞ্জন বলল, আমার এখন কোথাও যেতে ভাল লাগছে না। আমি আপনাদের সঙ্গেই যাব। কেন না আমার মনে যে দুশ্চিন্তা রয়েছে তাতে কিছুতেই শুয়ে ঘুমোতে পারব না আমি।

তা হোক। তবু যাও।

অগত্যা যেতেই হল। কিছু দূর যাবার পর একটি বাড়িতে এসে পুলিশের লোকটি দরজায় নক করতেই একজন লোক বেরিয়ে এল, কী ব্যাপার! এত রাত্রে? আপনার বাইকটা একবার দেবেন? ওই ছেলেটাকে বড়বাবুর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব।

ঠিক আছে দাঁড়াও একটু। চাবিটা নিয়ে আসি। বলে লোকটি চাবি এনে দালানে রাখা বাইকটা বার করে বলল, ছেলেটাকে পেলে কোথায়? মংঘীরামের বাড়িতে।

ও আবার ছেলেচুরির কারবারেও নেমেছে নাকি?

ছেলেমেয়ে সবই চুরি করছে। তবে আজ ওর বাড়ি রেড করে একেবারে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছেন বড়বাবু।। কয়েক বস্তা জাল নোট পর্যন্ত পাওয়া গেছে।

বলো কী? কিন্তু ধরলে কী হবে? ধরে রাখতে পারবে ওকে? ও তো ঠিক টাকার বান্ডিল দিয়ে বেরিয়ে আসবে।

এবার আর ওটি হচ্ছে না। ওস্তাদের মার শেষরাতে জানেন তো? আগের এস পি হঠাৎ বদলি।

যাই হোক। রঞ্জনকে বাইকের পিছন দিকে বসিয়ে লোকটি রাতের অন্ধকারে অনেক দূর গিয়ে একটি বাড়ির কাছে এসে হর্ন বাজাল। তারপর বাইক থেকে নেমে দরজায় কলিং বেল টিপতেই ভেতর থেকে সুরেলা গলায় সাড়া এল।

কে?

আমি দুলাল। বড়বাবু একটি ছেলেকে পাঠিয়েছেন। ও আজকের রাতটা এখানে থাকবে।

সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। একজন সুন্দরী মহিলা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। তারপর রঞ্জনকে দেখে স্মিত হেসে বললেন, এসো ভাই, ভেতরে এসো।

রঞ্জন ভেতরে ঢুকলে, লোকটিও পুলিশ অফিসারের স্ত্রী সেই সুন্দরী মহিলা বললেন, কী নাম তোমার? আমার নাম রঞ্জন।

আবার চলে গেল বাইক নিয়ে।

বাড়ি কোথায় ?

কলকাতায়।

এই রাতদুপুরে কোত্থেকে এলে? কিছু খাওয়াদাওয়া হয়নি নিশ্চয়ই? না। সারাদিন কিছু খাইনি। বড্ড খিদে পেয়েছে। যদি কিছু থাকে তো দিতে পারেন।

মহিলা মধুর হেসে বললেন, দুষ্টু ছেলে। যদি কিছু থাকে মানে? যাও। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসো। আমি তোমার খাবার তৈরি করে দিচ্ছি।

রঞ্জন বাথরুমে গিয়ে মুখহাত ধুয়ে আসতেই দেখল মায়ের মতো স্নেহময়ী সেই মহিলা ততক্ষণে আটা মেখে গ্যাসের উনুনে পরোটা ভাজার আয়োজন করছেন। রঞ্জন আসতেই বললেন, কই বলো দেখি তোমার কথা, গল্পও শুনি কাজও করি।

রঞ্জন তখন এক এক করে সব বলল।

সব শুনে মহিলা বললেন, ওমা! কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড। জানি না বাবা পুলিশের ব্যাপার স্যাপার। কয়েকটি লোককে তোমার সঙ্গে দিয়ে আজ রাত্রেই তোমাকে ওখানে পাঠিয়ে দিতে পারত।

উনিও ইচ্ছে করলে যেতে পারতেন।

হয়তো অসুবিধে ছিল। তার কারণ ওই পাহাড়-জঙ্গলে গাড়ি তো ঢুকবে না। তা ছাড়া ডাকাতরা অতর্কিতে যদি আক্রমণ চালায় আর তাতে যদি কোনও ক্ষয়-ক্ষতি হয় বা প্রাণহানি ঘটে সে কৈফিয়ত দিতে হবে ওনাকেই। কেন না কেল্লা-অভিযানের কাজে উনি যাননি। উনি গেছেন মংঘীরামজির বাড়ি রেড করতে।

রঞ্জন বলল, এখন ধরুন মংঘীরামের বাড়িতে যে ডাকাতরা এসেছিল তাদেরই কারও পিছু নেবার দরকার হলে পুলিশকে তো জঙ্গলে ঢুকতেই হত।

তা হত বইকী। তবে পুলিশের চাকরির মজাটা এই যে পুলিশকে দুঃসাহসও যেমনি দেখাতে হয়, তেমনি ক্ষয়-ক্ষতির দিকেও নজর রাখতে হয়। হিন্দোলকেল্লার ডাকাতদের সঙ্গে লড়াইতে আরও শক্তিশালী পুলিশবাহিনীর দরকার। তা ছাড়া ওই ধরনের কাজের ঝুঁকি একা একা নিজের থেকেও নেওয়া যায় না। এস পি সাহেবের অনুমতির দরকার। এস পি সাহেব যদি বলেন তা হলে কি-বা দিন, কি-বা রাত। যখন ইচ্ছে যাওয়া যেতে পারে। যাক। আর একটু সময় অপেক্ষা করো। এখনই তো রাত বারোটা। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে যাবে।

রঞ্জনের ঘুম আসছে না। মনের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা। তবু শুনতেই হল। একে অন্ধকার রাত, তায় গভীর জঙ্গল। তাকে অতিক্রম করে পালিয়েও যেতে পারবে না ও। অবশ্য পালাবার সুযোগ পেলেও যাবে না। কেন না ওই শ্বাপদসংকুল অরণ্যে ওই কাজ করতে গেলে হয় বাঘের পেটে যেতে হবে, নয়তো ভালুকের আঁচড় খেয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে থাকতে হবে।

রঞ্জন তাই এই গভীর রাতের সুখশয্যায় শুয়ে নিদারুণ উৎকণ্ঠায় প্রহর গুণতে

লাগল। অবশ্য বেশিক্ষণ নয়। কিছু সময়ের মধ্যেই বড়বাবু ফিরে এলেন। দরজায় কলিংবেল বাজতেই সেই মাতৃপ্রতিম মহিলা গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।

রঞ্জনও উঠে গেল।

তরুণ পুলিশ অফিসার কয়েকজন কনস্টেবলকে নিয়ে ঘরে এসে এক গ্লাস জল খেয়ে বললেন, ভয় নেই রঞ্জনবাবু। তোমাকে অযথা আমি আটকে রাখব না। সকাল হলেই রওনা দেব লোকজন নিয়ে। কেল্লাটাকে যাতে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলা যায় সেই ব্যবস্থাই করতে যাচ্ছি।

মংঘীরামের গোডাউনে কিছু পেলেন?

না। আমি যা ভয় করেছিলাম তাই হয়েছে। অর্থাৎ আমরা যাবার আগেই ওর লোকজনেরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে চারদিক থেকে। মংঘীরামকে বেদম পিটিয়েছি। ওর বাড়ির ভেতরেই আমাদের একটা ছোটখাটো ক্যাম্প বসে গেছে। কিছু অপহৃতা মহিলা, জাল নোটের বস্তা, সোনাদানা সব রাখা আছে। আমি এখুনি হেড কোয়ার্টারে চলে যাচ্ছি। আমার ফিরে আসতে সকাল আটটা হয়ে যাবে। একটু অপেক্ষা করো। আরও পুলিশ, আরও গাড়ি অনেক কিছুরই প্রয়োজন। এস পি সাহেব নিজেও হয়তো যেতে পারেন। তুমি শুধু আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করো এখানে। কেমন? বলে যেমন এসেছিলেন তেমনি চলে গেলেন।

এরপরে আর কী ঘুম আসে?

ঘড়ির কাঁটায় টং করে রাত একটা বাজল। রঞ্জন বিছানায় শুয়ে আবার সেই নিঃসঙ্গ শয্যায় প্রহর গুণতে লাগল, আর ভাবতে লাগল শবনমের কথা। শুধু যে শবনমের কথা তা নয়। এবার ওর বাড়ির কথা মনে হতে লাগল। মনে হচ্ছে যেন কতদিন বিদেশে আছে ও। মা’র মুখখানি মনে পড়ল। বাবার জন্য মন কেমন করল। ওর সঙ্গে তো ট্রাঙ্ককলে কথা হয়েইছে। তাঁরা নিশ্চিন্তই আছেন। তাঁদের অত্যন্ত আদরের ছেলেটি যে এই অচেনা পরিবেশে ডাকাতপুরীতে পাহাড়-জঙ্গলের দেশে কী জালে জড়িয়েছে তা তাঁরা কল্পনাও করতে পারবেন না।

রক্তাক্ত শবনম রাতের অন্ধকারে ঘোড়ায় চেপে ছুটে চলেছে। রঞ্জনকে উদ্ধার না করেই শবনমের এইভাবে চলে যাবার ইচ্ছেটা ছিল না। কিন্তু ঘটনাটা এমনভাবে মোড় নিল যে না-পালানো ছাড়া উপায়ও ছিল না তখন। কেন না ঠিক সেই মুহূর্তে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে সবদিক কেঁচে যাবে। আগে তো প্রতিশোধ, তারপরে পুলিশ। বিশেষ করে একজনের ধরা পড়া মানেই দলকে দল ধরা পড়া। তা ছাড়া শবনম আরও একটা দিক চিন্তা করে দেখল পুলিশ যখন এসেছে, তখন এই শত্রুপুরীতে রঞ্জন যদিও থেকে থাকে, তা হলে ওর নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া যেতে পারে।

বিক্রমজিৎ ঘটনাস্থলেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে।

লালচাঁদ গুরুতর রকমের জখম হয়েছেন। ও নিজেও আহত হয়েছে বেশ ভালরকম। তাই কোনওরকমে মংঘীরামের প্রাসাদ থেকে পালিয়ে সুচিকিৎসার জন্য পাহাড়ের একটি খাদের কাছে আত্মগোপন করল। লালচাঁদও এখানেই যন্ত্রণায় ছটফট করছেন।

ওরা অতি নির্জন এবং নিরাপদ একটি স্থান দেখে সেখানে বসে ক্লান্তি দূর করতে লাগল। লালচাঁদের কয়েকজন লোক চলে গেল লোকালয়ের দিকে। যে ভাবেই হোক একজন ডাক্তারকে ডেকে এনে ওদের শরীর থেকে গুলিগুলো বার করাতে না পারলে, ফল এমনই খারাপ হবে যে, তখন আর কিছুতেই কিছু করা যাবে না।