চার
ওই ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর পুলিশও তো চুপ করে বসে থাকবে না। তারাও তন্ন তন্ন করে চারদিক থেকে লুঠের মাল উদ্ধারের চেষ্টা করবে। হয়তো ওরা সেই সূত্রেই এই গিরি-অরণ্যে অভিযান চালিয়েছে।
রঞ্জন শবনমের খুব কাছেই ছিল। বলল, কীভাবে কী করবে ঠিক করলে কিছু ? না।
তোমার কী মনে হয় ওরা সত্যিকারের পুলিশ? ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
তা হলে?
ওরা আর একটু কাছে আসুক।
আমার কিন্তু মন বলছে ওরা পুলিশের লোক নয়।
তোমার এইরকম মনে হওয়ার কারণ?
কেন না পুলিশের লোক হলে এই অন্ধকারে ওরা চুপি চুপি চোরের মতো আসত না। প্রকাশ্য দিবালোকেই আসত।
ঠিক। তবে এমনও তো হতে পারে, ওরা অতর্কিতে আক্রমণ করবে বলেই এইভাবে আসছে।
মানলাম। তা হলে হিন্দোলসর্দারের কেল্লা থেকে মশালের আলোর সংকেতে কাদের দৃষ্টি ওরা আকর্ষণ করছে?
সেটা আর একটু পরেই জানা যাবে। ওই শোনো বুটের শব্দ।
হ্যাঁ। সত্যিই তো। বেশ ভারী পায়ের মসমস শব্দ কাছের দিকে এগিয়ে আসছে ক্রমশ।
শবনম হঠাৎ রঞ্জনকে কিছু না বলেই ওর গুপ্তস্থান থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর একটি বড় পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে রাইফেল তাগ করে বলল, হল্ট।
পায়ের শব্দ থেমে গেল।
শবনম বলল, তুম সব কৌন হো?
হাম পুলিশকা আদমি। তুম?
ম্যায় ইস পাহাড়-জঙ্গলকা রানি হুঁ।
সমঝ গিয়া। তুম ডাকু সর্দারকা আদমি। আভি বন্দুক ফিক দো। নেহি তো মুশকিল হো যায়ে গা।
শবনম এবার আত্মপ্রকাশ করে বলল, আমি এই জঙ্গলের রানি। যদিও কোনও রাজা নেই। তবুও আমি রানি। এরা আমার প্রজা। এখানকার সব কিছুর ওপরই আধিপত্য আছে আমার। তবে হিন্দোলসর্দারের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। অবশ্য একেবারে যে নেই তা নয়। দুশমনির সম্পর্কটা আছে! তা আপনারা কি হিন্দোলসর্দারের খোঁজে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি তো বেশ ভাল বাংলা বলতে পার দেখছি। কী নাম তোমার? আমার নাম শবনম। আমি উর্দুতে পড়াশুনা করলেও, কলকাতার মেয়ে। বাংলা ভালই জানি। আপনি?
আমিও বাংলা জানি।
কিন্তু আপনি যে ডাকুসর্দারের খোঁজে চলেছেন আপনি কি জানেন ওই কেল্লার কাছাকাছি গেলেই অতর্কিতে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি কেল্লার ভেতর থেকে ছুটে আসে?
জানি।
তা হলে?
আমরা জেনেশুনেই এসেছি! আমাদের একজন লোক ছদ্মবেশে ওদের দলে আছে। সে-ই ডাকিয়েছে আমাদের। ওই দেখো আলোর সংকেত।
শবনম দেখল বেশ কিছু পুলিশের লোক রাইফেল-স্টেনগান ইত্যাদি নিয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে। অদূরে কেল্লার মাথা থেকে আলোর সংকেতও দেখা যাচ্ছে।
রঞ্জনও কখন যেন চুপি চুপি এসে দাঁড়িয়েছে ওদের পাশে। অন্যান্য পাহাড়িরাও ঘিরে আছে চারদিক।
শবনম বলল, আপনি নিশ্চয়ই ইনস্পেক্টর?
হ্যাঁ। আমিই ইনস্পেক্টর জেনারেল বলতে পারো। তবে আসল নয়। নকল। আর এরা আমার দলের লোক।
শবনম সবিস্ময়ে বলল, সে কী! তা হলে কে আপনি?
আমার নাম লালচাঁদ রায়। বাঙালি। চিরকাল মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডোয়াতে কাটিয়েছি। ওই ডাকাতসর্দার আমার সঙ্গে কোনও একটা ব্যাপারে বেইমানি করেছে। তাই সেই বেইমানির বদলা নিতেই এসেছি আমি। আমার একজন লোক ওদের দলে আছে। ওই আলোর সংকেত সেই দেখাচ্ছে।
শবনম উৎসাহিত হয়ে বলল, কী নাম বলুন তো?
তুমি চিনবে না! ওর নাম ভীমা গাড়োয়াল।
ওর ভরসায় আপনারা এমন ঝুঁকি নিয়ে এসেছেন? কিন্তু ও যদি আপনাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে?
গাড়োয়ালরা কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না।
কে বললে? ওই গাড়োয়াল হিন্দোলসর্দারের সঙ্গে তার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করছে না কি?
লালচাঁদ এবার চমকে উঠলেন। বললেন, কে তুমি! এই অল্প বয়সে এমন প্রখর বুদ্ধি রাখ।
আমি যে কে, তা আমিই জানি না। এখন আমি এই অরণ্যের দেবী। এই যে দেখছেন সহজ সরল পাহাড়িরা, ওই অত্যাচারীর অত্যাচারে ওরা জর্জরিত। ওই কেল্লাপাহাড়ে হিন্দোল আর নীচের অরণ্যে মংঘীরাম এই দুই অত্যাচারীর অত্যাচার ও শোষণে এরা আধমরা হয়ে আছে। এরা এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বহু মানুষের জীবনহানি ঘটিয়েছে। সেই দুর্ঘটনায় আমি আমার আব্বাজানকে হারিয়েছি! আরও কতজন কতজনকে যে হারিয়েছে তার ঠিক নেই। তাই আমিও চাইছি ওই শয়তানের কেল্লা দখল করে ওর মুণ্ডু হাতে নিয়ে মা কালীর মতো নাচতে।
লালচাঁদের চোখদুটো জ্বলে উঠল। বললেন, তোমার আর আমার পথ একই। কিন্তু এই জঙ্গলে হত্যার নেশায় মেতে ডাকাতরানি সেজে তুমি কতক্ষণ লড়বে? একমাত্র তোমার হাতে ছাড়া আর কারও হাতেই তো বন্দুক দেখছি না।
শবনম বলল, এই একটিমাত্র বন্দুকেই আমি এ পর্যন্ত অনেকগুলো প্রাণ ছিনিয়ে নিয়েছি। হিন্দোলসর্দারের দলের অনেক লোককে একা আমিই খতম করেছি এই বন্দুক দিয়ে।
তাই নাকি? কিন্তু এটা কী করে সম্ভব হল?
আমার আব্বাজান মিলিটারির লোক ছিলেন। উনি আমায় সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছেন।
লালচাঁদ দলের লোকেদের বললেন, এই মেয়েটিকে দেখে তোমরা শেখো প্রতিশোধ কী করে নিতে হয়। একে দিয়েই তোমরা অনুভব করো মানুষ মরিয়া হলে কী না করতে পারে। তারপর শবনমকে বললেন, তুমি যদি সত্যিই ওই দুরাত্মার প্রতিশোধ নিতে চাও তা হলে আমার সঙ্গে হাত মেলাতে পারো। আমি তোমাকে সব রকমের সাহায্য করব।
সত্যি বলছেন?
তোমাকে মিথ্যে বলে লাভ? তোমার চোখে যে আগুন আমি দেখেছি, তোমার মনের মধ্যে যে বারুদের স্তূপ আমি আবিষ্কার করেছি, তাতে বেশ বুঝতে পারছি আর এক নতুন পুতলিবাঈ জন্ম নিয়েছে এখানে। কাজেই আমার স্বার্থের জন্যে, দলের প্রয়োজনের জন্যে, তোমাকে আমার একান্তভাবে প্রয়োজন। আমি রাজি।
ওদিকে হিন্দোলকেল্লার মাথার ওপর আলোর সংকেত আবার দুলে উঠল। ওই দেখো! সুবর্ণ সুযোগ। আমি আমার বদলা নিতে চলেছি। তুমিও তোমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চলেছ। গো-অ্যাহেড।
শবনম এবার রঞ্জনের দুটি হাত শক্ত করে ধরে বলল, রঞ্জন! তুমি থাকো। আমি যাই। ওই কেল্লা বিজয় করে কাল সকালের আগেই আমি ফিরে আসব।
আমি না-আসা পর্যন্ত একটু একা থাকো। আমাদের পাতার ঘরে নির্ভয়ে বিশ্রাম করো তুমি।
হিংলাজসর্দার এবং তার দলের লোকেরা বলল, ওই কেল্লা যদি সত্যিই দখল হয় তা হলে চলো না কেন আমরাও সবাই মিলে দল বেঁধে যাই। শত্রুর শেষ একদিনেই হয়ে যাক।
লালচাঁদ বললেন, না। সবাই গেলে ওরা আমার চাতুরি ধরে ফেলবে। হিন্দোল আমার চিরশত্রু। আমি ছদ্মবেশে এসেছি। ছদ্মবেশেই ঢুকব। ওর অত্যাচারে ওর দলের অনেক লোকই দল ত্যাগ করেছে।
শবনম বলল, বাকি যারা ছিল তাদের ভেতর থেকেও কয়েকজনকে আমি খসিয়ে দিয়েছি।
বেশ করেছ। এখন আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট নয়। চলো সবাই সতর্ক হয়ে যাই।
রঞ্জনের এ ব্যাপারে খুব একটা সায় ছিল না। তাই বলল, শবনমের কি না গেলেই নয় ?
শবনম বলল, ভয় নেই, আমি আবার ফিরে আসব। হিন্দোলসর্দারের সাধ্য কী যে আমায় ধরে রাখে? তা ছাড়া এখন আমরা দলে অনেক ভারী।
রঞ্জনের চোখদুটি ছলছলিয়ে উঠল। বলল, খোদা মেহেরবান। তুমি জয়যুক্ত হয়ে ফিরে এসো শবনম।
সেই আলোর সংকেত ধরে ওরা সবাই পা টিপে টিপে দুর্গমপথে হিন্দোলকেল্লার দিকে এগোতে থাকল। আলোর সংকেত থেমে গেছে। তবু ওরা এগিয়ে চলল। এইভাবে ছলচাতুরি না করে ওই কেল্লায় ঢোকবার কোনও পথই তো জানা নেই।
যেতে যেতে লালচাঁদ বললেন, একবার শুধু ভেতরে ঢুকি। তারপর আজই রাতের অন্ধকারে তোমার বুক চিরে আমি রক্তপান করব ঘোড়েল শয়তান। তোমার বেইমানির বদলা আমি নেবই।
ওরা ধীরে ধীরে এগোতে থাকল।
বন্দুক উঁচিয়ে নিঃশব্দে কেল্লার কাছাকাছি যেই না গেছে ওরা অমনি হঠাৎ রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে শব্দ হল, ডিস্যুম, ডিস্যুম, ডিস্যুম। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি দুর্গ প্রাকার থেকে ছিটকে এসে ঝাঁঝরা করে দিল ওদের। এক লহমায় কয়েকটি তাজা প্রাণ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
কেল্লার মাথায় বুরুজের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভীমা গাড়োয়াল দাঁড়িয়েই রইল একভাবে। ওর হাত থেকে খসে পড়েছে মশালের আলোটা। ধড় থেকে মুণ্ডুটাও ছিটকে পড়েছে এক কোণে। ভীমার মাথাটা একজন এসে কুড়িয়ে নিয়ে বুরুজের লৌহ শলাকায় গেঁথে রাখল। আর যে অস্ত্রের ঘায়ে ওর ধড় থেকে বিচ্যুত হয়েছিল মুণ্ডুটা, সেই অস্ত্রের গায়ে লেগে থাকা রক্তের দাগ নিয়ে নিজের কপালে একটা টিপ্পা দিলেন সর্দার। সর্দারের রক্তচক্ষুতে তখন আগুন জ্বলছে। কেল্লার মাথা থেকেই চিৎকার করে উঠলেন সর্দার, আগ লাগা দো বস্তি মে। আউর ফুলনদেবী বননেবালী উস লেড়কিকো পাকড়কে লে আও। যাও। আভি চলা যাও সব।
চোখের পলকে পাঁচজন অশ্বারোহী মশাল ও বন্দুক নিয়ে সেই অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলল পাহাড়ি বস্তির দিকে। কিছুটা পথ যাবার পর পাঁচজন পাঁচদিক থেকে ঘিরে ফেলল বস্তিটাকে। কেন না সর্দারের হুকুম অমান্য করার সাহস ওদের নেই। অথচ সুন্দরী কিশোরী ডাকু শবনমের বেপরোয়া অব্যর্থ গুলি চালানোর কাহিনিও শোনা এবং জানা আছে। তাই সব দিক থেকে আক্রমণের জন্যই ওরা এই ব্যবস্থাটা নিল।
একেবারেই অতর্কিত আক্রমণ।
যুদ্ধ না করা সরল প্রাণ পাহাড়িরা তখন একেবারেই নিশ্চিন্ত ছিল। বরং হিন্দোলকেল্লার দিক থেকে ছুটে আসা গুলির শব্দকে ওরা নকল পুলিশবাহিনীর আক্রমণ ভেবে আনন্দে উল্লাস করছিল। এমন সময় হঠাৎ হতচকিত হয়ে ওরা দেখল রাতের অন্ধকারে ওদের পাতার ঘরগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে। কোনও কিছু ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই ওরা দেখল, ওদের ক্ষুদ্র বস্তিতে যেন বহ্ন্যুৎসব শুরু হয়ে গেছে। ওরা হতভম্ব হয়ে দেখতে লাগল কয়েকজন ডাকাত ঘোড়ার পিঠে চেপে এদিক সেদিকে ছুটোছুটি করছে।
তির, কাঁড়, টাঙি, বল্লম, শাবল, কুড়ুল নিয়ে যারা ওদের বাধা দিতে গেল, তারা মরল। যারা প্রাণের ভয়ে লুকোল, তারা বাঁচল।
ওদেরই ভেতর থেকে একজন ঘোড়ার পিঠে বসেই হঠাৎ চোখের সামনে হিংলাজসর্দারকে দেখতে পেয়ে তার বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে বলল, লেডকি কাঁহা হ্যায়?
হিংলাজসর্দার তখন ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেছে। সেই অবস্থাতেই তাকে উঠতে না দিয়ে ঘোড়ায় বসা লোকটি রক্তচক্ষুতে বলল, বোল জলদি ও লেড়কি কাঁহা হ্যায়?
অন্য ডাকাতরা তখন বন্দুক তাগ করে কয়েকজন পাহাড়িকে ধরে এনেছে সেখানে। তারা বলল, তুম সবকো সর্দারকা পাশ জানা হোগা।
পাহাড়িরা বলল, দোহাই। আমাদের প্রাণে মেরো না। গরিব মানুষ আমরা। এখন থেকে তোমরা যা বলবে তাই শুনব। আর কখনও বিদ্রোহী হব না। মারো চপ্পল বদমাশকো। জলদি চল সর্দারকে পাস।
আর এক ডাকাত পাহাড়ি বস্তির কয়েকজন রমণীকে জোর করে টেনে আনছে।
হিংলাজসর্দার মরিয়া হয়ে বন্দুকের নলটা শক্ত করে ধরে হেঁচকা টান দিল একটা। কিন্তু তাতে অবশ্য লাভ হল না কিছু। ডাকাতের গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। সে যেমন বসেছিল তেমনিই রইল। শুধু হিংলাজ তার বুকের ওপর থেকে কোনওরকমে নলটা নীচের মাটিতে নামাতে পারল।
ঘোড়সওয়ার ভয়ংকর রেগে আবার বলল, ও লেড়কি কাঁহা হ্যায়? নেহি বতাউঙ্গা।
তো ঠিক হ্যায়। আপনা ভগবান কো ইয়াদ করো। রাম-দো-তিন…। ডিস্যুম।
পাহাড় ও বনভূমি কাঁপিয়ে একটা বন্দুকের গুলির শব্দ। আর সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা ডাকাতের মাথাটা তুবড়ির মতো উড়ে গেল।
সবাই হতচকিত। এ কী জাদুরে বাবা। অন্যান্য ডাকাতরা তখন ভয়ে থর থর করে কাঁপছে।
এমন সময় সেই অন্ধকারে হঠাৎই শবনমের গলা শোনা গেল, বন্দুক ফিক দো শয়তান ডাকু।
ডাকুদের আর বন্দুক ফিকতে হল না। পাহাড়িরাই আবার তাদের নেত্রীর কণ্ঠস্বর শুনে ঝপাঝপ লাফ মেরে কেড়ে নিল বন্দুকগুলো। দিশেহারা ডাকাতরা তখন প্রাণভয়ে পালাতে গেল। কিন্তু সেই অন্ধকারে গাছের ডালে ধাক্কা খেয়ে জখম হয়ে দু’জন পড়ে গেল মাটিতে। আর বাকি দু’জন শবনমের গুলিতে নিহত হয়ে ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠ থেকে ঢিপ ঢাপ পড়ল।
হিংলাজসর্দার নিজেই পাকড়াল একজন ডাকাতকে।
অন্য একজনকে বাকিরা।
আর ঘোড়াগুলোর সব ক’টাই ধরে ফেলল সকলে মিলে।
ঘোড়াগুলোকে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ধৃত ডাকাত দুটিকে কবজা করল ওরা।
ভয়ে কথা বলতে পারছে না ডাকাতরা! কেন না ওরা বুঝতেই পারছে কী ভয়ংকর পরিণতিটাই না ঘটতে চলেছে এবার। এই কিশোরীডাকু ওদের সর্দারের চেয়েও মারাত্মক। ওরা ভয়ে ভয়ে দেখল একটা বাঘিনী যেন একটা ছুরি হাতে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। ছুরির ফলাটা ওদের চোখের দিকে তাগ করা।
বাঘিনী এগিয়ে আসছে। ওই অনন্ত সৌন্দর্যের মধ্যে এইটুকু একটা মেয়ের সে
কী ভয়ংকরী রূপ। ওরা চিৎকার করে উঠল, নেহি নেহি নেহি।
বল শয়তানরা এখানে তোরা কী করতে এসেছিলি? তোরা কি জানতিস না এই অরণ্যে আমি ডাকিনী মন্ত্র নিয়ে অরণ্যকে পাহারা দিচ্ছি? এর আগে তোদের অন্যান্য সঙ্গীদের আমি কী ভাবে হত্যা করেছি সে কথা কি ভুলে গেছিস? ভুলিনি দেবী।
তা হলে কোন সাহসে আবার এসেছিলি এখানে? কেন এদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিলি? কেন এখানকার মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছিলি? বল? কেন এ কাজ করতে এসেছিলি?
সর্দারের হুকুমে।
তোদের সর্দারের ওপর তো দেখছি দারুণ ভয় তোদের। কিন্তু আমাকে তোরা ভয় পাস না?
ওরা কাঁপতে কাঁপতে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ পাই।
তা হলে কোন সাহসে এসেছিলি আমার ঘরে আগুন দিতে? এক লহমায় কী ভয়ানক কাণ্ডটা করে ফেলেছিস তোরা তা জানিস? এত দুঃসাহস তোদের কী করে হল?
আমাদের এবারের মতো ক্ষমা করুন দেবী। আমরা কথা দিচ্ছি আর কখনও আপনার সঙ্গে লাগতে আসব না। আমরা দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দেব। আপনার গোলাম হয়ে থাকব আমরা।
এই রকম কথা তো আরও একজন দিয়েছিল। কিন্তু তাকে ক্ষমা করার পরও সে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
কে সে?
তার নাম মুখে আনতেও ঘৃণা হয়।
না বললে আমরা কী করে বুঝব বলুন?
ওর নাম ‘থুঃ’।
হিংলাজসর্দার বলল, ওই বিশ্বাসঘাতকের নাম বিক্রমজিৎ।
বিক্রমজিৎ! কিন্তু সে তো এখন আমাদের দলে নেই। সে তো ফেরার। দলত্যাগী।
তোমরা মিথ্যে কথা বলছ। সেই বিশ্বাসঘাতক এখান থেকে ছাড়া পেয়েই তোমাদের কেল্লায় ফিরে যায়। সে শঠ। প্রবঞ্চক।
হতে পারে। আপনাদের এখান থেকে ছাড়া পেয়ে সে পালিয়েছিল ঠিকই। তবে আমাদের দুর্গে সে ফিরে যায়নি। দুর্গের প্রহরীদের সে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, আমাদের অত্যাচার আর অনাচারের ফল নাকি আমরা হাতেনাতেই পাব এবার। আমরা যেন হিন্দোলকেল্লা ছেড়ে এখুনি পালাই। নয়তো শিগগির প্রাণে মরব। কেন না এক কিশোরীর শরীরে এখানকার জাগ্রতা অরণ্যদেবী ভর করেছেন। তিনি অতি নিষ্ঠুরা। এই বলে সে দ্রুত অন্য পথে পালিয়ে যায়। সর্দার তখন কেল্লায় ছিলেন না। তাই তাকে মৃত্যুদণ্ড আমরা দিতে পারিনি কেউ।
শবনম বলল, পালিয়ে সে কোথায় যেতে পারে? সে তো আমার কাছেই আসতে পারত?
পালিয়ে সে একটি জায়গাতেই যেতে পারে, সেটি হল শহরের পুলিশচৌকিতে।
কিন্তু সেখানে গেলে তো অ্যারেস্ট হয়ে যাবে সে।
হবে। তার চোখেমুখে আমরা তীব্র অনুশোচনা এবং কঠিন সংকল্প দেখেছি। আমরা বুঝেছি মরতে সে আর একটুও ভয় পায় না। সর্দার তাকে দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের একজন লোক সব সময় খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে।
লালচাঁদ ও তাঁর সাতজন যোদ্ধা শবনমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দুর্গের ভেতর থেকে গুলি ছিটকে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যারা ছোট বড় পাথরের আড়ালে কোনওরকমে লুকিয়ে পড়ে প্রাণট! বাঁচাতে পেরেছে একমাত্র তারাই ফিরে এসেছে এখানে। লালচাঁদ পাকা লোক। তবুও তিনি ভাবতে পারেননি এমন একটা কাণ্ড আচমকা ঘটে যাবে বলে। তবে শবনমের সতর্কবাণীর জন্য তিনি একটু সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন তাই রক্ষে। গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই শবনমকে জড়িয়ে ধরে বড় একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। তারপর আর না এগিয়ে ধীরে ধীরে এক-পা এক-পা করে পিছু হটতে থাকেন। দলের লোকেদের বলেন যারা বেঁচে আছ তারা লুকিয়ে থাকো। আর একদম এগিয়ো না। এগোলেই মরণ। কেন না ওরা দুর্গের আড়ালে আছে। আমরা আছি প্রকাশ্যে। আমরা গুলি ছুড়লে ওদের গায়ে লাগবে না। কিন্তু ওরা গুলি ছুড়লে আমরা সবাই মরব।
অতএব লালচাঁদ ব্যর্থ হয়েই ফিরে এসেছেন।
ধৃত লোকদুটির দিকে তাকিয়ে লালচাঁদ বললেন, আমাকে চিনতে পারো চেৎ সিং আর কালুরাম?
লালবাবু !
হ্যা। আমি মরিনি। আমি এখনও জিদা আছি। ওই শয়তান সর্দার আমার চরম সর্বনাশ করেছে। ওর বদলা নেব বলেই আমি এসেছি। ভীমা গাড়োয়াল বিক্রমকে দিয়েই আমার কাছে খবর পাঠায়। সে এখন আমারই এক গোপন ঘাঁটিতে লুকিয়ে আছে। তিনদিনের মধ্যে আমার দিক থেকে কোনও খবর না-গেলে সে ফোনে পুলিশকে জানাবে।
কিন্তু ভীমাকে তো সর্দার খতম করে দিয়েছে।
করছে? সর্দারের অজানা কিছু আছে কি? বাতাস ওর কানে কানে সব কথা বলে দেয়। যাক। এখন তোদের জন্যে আমরা কী শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারি বলো? আমাদের এবারের মতো ক্ষমা করো লালবাবু।
সর্দার টের পেল কী করে যে ভীমা আমার হয়ে কাজ তোদের ক্ষমা করব আমি? আমার সর্বনাশের সময় তোরা তো কেউ হাত গুটিয়ে বসে থাকিসনি। আমার চোখের সামনে আমার ছেলেকে তোরা গুলি করে মেরেছিস। আমার বউ, তাকে যে তোরা কোথায় নিয়ে গেছিস, তার খোঁজ আজও পাইনি। ওই হিন্দোলকেল্লার ভেতরে তাকে কি আমি আবার ফিরে পেতে পারি?
না। সর্দার তাকে গুলি করে মেরেছে।
তার অপরাধ?
কোনও অপরাধ নেই। তবে সর্দার বেশিদিন কাউকে বেঁচে থাকতে দেন না। তা হলে এর পরেও কি করে তোরা বলিস তোদের ক্ষমা করতে? তোদের শক্তিতেই তো ওর শক্তি। ডাক এবার তোদের ভগবানকে। এক— দুই— তিন। চিৎকার করে উঠল শবনম, না। আপনি ওদের মারবেন না। ওদের শাস্তি আমি দেব। এটা আমার এলাকা। ওরা যেমন এই পাহাড়ের বুক থেকে নিভৃত শান্তির ঘরগুলো পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। অসহায় শিশু, গোরু, ছাগল, যেমন অসহায়ভাবে পুড়ে মরেছে, তেমনি ওদেরকেও পুড়ে মরতে হবে তিল তিল করে। আমি ওদের জীবন্ত অগ্নিতে আহুতি দেব। রঞ্জন! তুমি ওদের চিতা সাজাও। হাত-পা বেঁধে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ওদের ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মারব আমি। রঞ্জন!
কিন্তু কোথায় রঞ্জন!
শবনম চিৎকার করে ডাকল, রঞ্জন!
কোনও সাড়া নেই। শব্দ নেই। ডাকের পর ডাক। তবু কোনও প্রত্যুত্তর নেই। শুধু ওর দীপ্ত কণ্ঠস্বর পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগল, রঞ্জন! রঞ্জন! রঞ্জন! তুমি কোথায়? কোথায়? কোথায় উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠল সকলে। তাই তো! গেল কোথায় ছেলেটা? খোঁজ খোঁজ। সবাই এতক্ষণ এই ধৃতদের নিয়ে আর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বেসামাল হয়ে পড়েছিল। কে কার খোঁজ রাখে তখন। বস্তির আগুনের হলকায় সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।
শবনমের হঠাৎই তখন মনে হল সেই ভয়ানক কথাটা। বলল, ও আমাদের পাতার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল না তো?
হিংলাজসর্দার বলল, হ্যাঁ মা! ওকে তো আমরা ওখানেই থাকতে দেখেছি।
হয়তো বেচারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেই পাতার ঘর? সে ঘর কি আস্ত আছে? কী জানি?
দু’জন লোককে ধৃতদের পাহারায় রেখে সবাই ছুটল সেই পাতার ঘরের দিকে। কিন্তু না। সেখানে ঘরের চিহ্নও কোথাও নেই। নিভু নিভু আগুনের ক্ষীণ স্ফুলিঙ্গ তখন ধিকি ধিকি জ্বলছে। তাই দেখে সেই কঠিন পাষাণের বুকে আছড়ে পড়ল শবনম, রঞ্জন! আমাকে ক্ষমা করো বন্ধু। তুমিই আমার জীবন দান করলে, অথচ আমারই জেদের জন্যে আজ তোমাকে এই ভাবে পুড়ে মরতে হল। তবে আল্লা কসম। আমি পবিত্র কোরান শরিফের নামে শপথ নিয়ে বলছি, আল্লার নামে শপথ নিয়ে বলছি, আমার প্রতিশোধ নেওয়ার পালা শেষ হলে আমিও জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে আমার আত্মাহুতি দেব। আমার জন্যে যে কষ্ট তুমি পেয়েছ সেই কষ্টের ভাগ আমিও সমানভাবে ভাগ করে নেব। তোমার এই মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।
সমস্ত পাহাড়িরা তখন শোকস্তব্ধ হয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে। অনেকেরই চোখে জল।
লালচাদের লোকেরা সেই অগ্নিকুণ্ডের ছাইভস্ম ঘেঁটে রঞ্জনের আধপোড়া শরীরটাকেও যদি পাওয়া যায় সেই চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু না। সেখানে শুধু মুঠো মুঠো ছাই ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
শবনম ভয়ংকরী মূর্তিতে সাপিনীর মতো ফুঁসে উঠে বলল, নিয়ে এসো ওই শয়তান দুটোকে।
পাহাড়িরা ধৃত ডাকাত দুটিকে নিয়ে এল।
এইখানে এই গাছটার সঙ্গে বাঁধো।
একটা আধমরা পলাশ গাছের গুঁড়িতে আষ্টেপিষ্ঠে বাঁধা হল দু’জনকে।
শয়তানদুটো তখনও নির্লজ্জের মতো প্রাণভয়ে ভীত হয়ে চেঁচাতে লাগল, একবার। শুধু একবার আমাদের ক্ষমা করো দেবী। আমরা কসম খাচ্ছি, আজ থেকেই এই দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দেব আমরা। আমরা ভাল হব।
শবনম বলল, ভাল তোমরা এমনিতেই হবে। কারণ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অগ্নিশুদ্ধি হয়ে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যাবে তোমরা। আবার নতুন করে মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়ে নতুন দেহ ধারণ করে পৃথিবীতে এসে সৎভাবে জীবন যাপন করবে। তখন ভাল হবার চেষ্টা কোরো। এ জনমে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আর ভাল হতে যেয়ো না।
কিন্তু দেবী, আমরা যে এ জন্মেই বেঁচে থেকে সৎভাবে জীবন যাপন করতে চাই। ভাল হতে চাই।
তা তো আর সম্ভব নয়। সময় পার হয়ে গেছে।
কোনও উপায়েই কি এই অসম্ভবকে সম্ভব করানো যায় না? একটু কৃপা করুন দেবী।
শবনম বলল, আমি এখনি তোমাদের মুক্তি দিতে পারি। কিন্তু একটি মাত্র শর্তে। শর্ত?
বলুন কী সে
আমার রঞ্জনকে ফিরিয়ে দিতে হবে! তোমাদের নৃশংস অত্যাচার ও অগ্নিকাণ্ডর ফলে এই পাহাড়িদের যে সব নিরীহ নারীপুরুষ যুবা বৃদ্ধ শিশু পুড়ে মরেছে, তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে। পারবে? যদি পার মুক্তি দেব। তা কী করে সম্ভব?
তা হলে তোমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। বলেই ভয়ংকরী নাদে চিৎকার করে উঠল শবনম, আগুন আগুন আগুন জ্বালাও। পুড়িয়ে ছারখার করে দাও এই পাপিষ্ঠদের।
প্রচুর শুকনো ডালপাতা এবং খড় এনে ওই ধৃত বন্দিদের গায়ের ওপর রাখা হল। তারপর একটা জ্বলন্ত মশাল এনে ধরিয়ে দিতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আর সেই অগ্নিশিখার লেলিহান জিহ্বার গ্রাসের ভেতর থেকে অত্যাচারীদের অন্তিম হাহাকার শোনা যেতে লাগল। ওরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে যত চিৎকার করতে লাগল, শবনম ততই হাসতে লাগল হো হো করে। সে কী ভয়ংকর পৈশাচিক হাসি। এ যেন স্বাভাবিক কোনও মানুষের নয়। সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ এক কিশোরীর অথবা ফুলনদেবী বা দুর্ধর্ষ পুতলিবাঈ-এর।
হাসতে হাসতেই এক সময় সংজ্ঞাহীন হয়ে লুটিয়ে পড়ল শবনম।
হিংলাজসর্দার তাকে ধরে পাঁজাকোলা করে বেশ বড় সড় একটা পাথরের ওপর শুইয়ে দিল। পাহাড়ি মেয়েরা এসে ওর চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগল। কিন্তু শবনমের জ্ঞান ফিরল না। সে নিথর নিষ্পন্দ হয়ে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে রইল যেন।
অবশেষে কালরাত্রির অবসান হল। গভীর অরণ্যানির মধ্যে ভোরের বারতা নিয়ে কলতান করে উঠল বনের পাখিরা। মানুষের সুখদুঃখের কথা ওরা কি বুঝতে পারে? বোধ হয় পারে না। তাই ওদের এই চঞ্চলতায় কোথাও কোনও মলিনতা নেই। জগতের আনন্দযজ্ঞে ওরা তাই সদানন্দময়। এ ডাল থেকে ও ডালে গান গেয়ে গেয়ে নেচে বেড়াচ্ছে সব। কেউ বা মহাশূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। শবনমকে
ঘিরে অনেকগুলি রাতজাগা মানুষ তখন উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে আছে। পাহাড়িয়া বস্তিতে তখন কান্নার রোল। সকলের সবক’টি ঝোপড়ি ভস্মীভূত হয়েছে। শিশু ও বৃদ্ধ সহ মোট পাঁচজন মারা গেছে আগুনে পুড়ে। সেই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখা যায় না।
পাহাড়িদের মধ্যে যারা একটু বলবান, তারা আবার শুরু করল তাদের কাজ। অর্থাৎ গাছের ডালপাতা কেটে নতুন নতুন ঝোপড়ি তৈরি করতে লেগে গেল! আবার নতুন করে বাঁচতে হবে তো।
হিংলাজসর্দারের পোষা কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না। সেটাও আগুনে পুড়ে মরল নাকি? কত হাঁস মুরগি গোরু ছাগল যে পুড়ে মরেছে তার শেষ নেই। কুকুরটা কোথায় গেল কে জানে?
ওরা যখন আবার নতুন করে বাঁচার কথা ভাবছে তখন সেই শান্ত প্রকৃতির বুকে পাহাড় ও বনভূমি ভেদ করেই যেন আবির্ভূত হলেন এক তেজোময় সন্ন্যাসী। কী দারুণ সৌম্য মূর্তি তাঁর। মাথায় জটা। গলায় রুদ্রাক্ষ, পরণে লাল চেলি। এক হাতে চিমটা অপর হাতে কমণ্ডুলু। সন্ন্যাসী খালি পায়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে এগিয়ে এলেন, অসতো মা সদ্গময়ো তমসো মা জ্যোতির্গময়ো…। তারপর এই ধ্বসংস্তূপের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, আহারে! এমন সাজানো সংসার ছারখার করে দিল কে?
হিংলাজসর্দার লুটিয়ে পড়ল সন্ন্যাসীর পায়ে। বলল, কে আপনি প্রভু? সাধু মহাত্মা! এই গরিবের দেশে পায়ের ধুলো দিলেন? এর আগে আর তো কখনও আপনাকে দেখিনি এখানে?
সন্ন্যাসী হাসলেন। বললেন, আমাকে তোরা দেখবি কী করে? আমি তো এখানকার লোক নই। দীর্ঘ কুড়ি বছর আগে আমি এই জায়গা ছেড়ে চলে গেছি। এখন ওঙ্কার তীর্থ থেকে আসছি। পায়ে হেঁটে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে শুধু পথ চলেছি, পথই চলেছি।
হিংলাজ বলল, এই পথ চলার শেষ হবে কোথায়?
তা তো জানি না। শুধু পথের রেখা ধরে যে দিকে দু’চোখ যায় সেদিকে চলে যাব। দু’দিন বিশ্রাম করব। ভাল লাগলে সেখানে কিছুদিন থাকব। না লাগলে একদিনও না থেকে চলে যাব।
বাঃ। বেশ মজার ব্যাপার তো। কী সুখের জীবন আপনার। কিন্তু বাবা! আপনি কি কোনও কারণেই স্থায়ী ভাবে ডেরা পাতবেন না কোথাও?
কেন পাতব না? তবে স্থায়ী ভাবে ডেরা পাতবার মতো কোনও সুযোগ সুবিধা যদি কখনও আসে বা সেরকম পরিবেশ পাই, তা হলে নিশ্চয়ই থেকে যাব। কিন্তু তোমাদের এই সুখের স্বর্গ শ্মশান হল কী করে?
অন্যান্য পাহাড়িরাও তখন ঘিরে ধরেছে সন্ন্যাসীকে। এই সন্ন্যাসীকে দেখলে বেশ বুদ্ধিমান, জ্ঞানবান, বিবেচক এবং সাধক বলেই মনে হয়। সকলে একে একে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করে বলল, আমরা এক সন্ত্রাসের রাজত্বে বাস করছি সাধুবাবা। কী রকম!
হিন্দোলসর্দার নামে এক কুখ্যাত দস্যু আমাদের ওপর যখন তখন অত্যাচার করে। তার নৃশংস অত্যাচারের বলি কয়েকটি তাজা প্রাণ আর আমাদের এই পাতার ঘরগুলোর ভষ্মাবশেষ।
তোমরা প্রতিরোধ করতে পারনি?
আমরা নিরস্ত্র। তার ওপর ওরা অতর্কিতে আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এই কাণ্ড করেছে।
সন্ন্যাসীর দু’চোখে ক্রোধের আগুন। বললেন, তাই নাকি?
হ্যাঁ বাবা। দৈবক্রমে একটি কিশোরী হঠাৎ কোথা থেকে এখানে এসে পড়ে বন্দুক চালিয়ে ওদের বদলা নেয় বা আমাদের জীবন রক্ষা করে। ওর এক সঙ্গী কিশোরও এই অগ্নিকাণ্ডে মারা যায়। তাই কাল রাত থেকে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
বলো কী! কে সেই মেয়ে? কোথায় সে?
সে যে কে তা ঈশ্বরই জানেন। মানবী কি দেবী না কোনও মন্ত্রসিদ্ধ যক্ষিণী তা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। চোদ্দো-পনেরো বছরের মেয়ে। জাতিতে মুসলমান। সঙ্গে এক কিশোর। সে হল হিন্দু। একটা ট্রেন দুর্ঘটনার পর ভীষণ প্রতিজ্ঞা নিয়ে দুর্ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের বদলা নেবার উদ্দেশে এখানে এসে হাজির হয়। মজার কথা ওই কিশোরী মেয়েটি যেন হঠাৎই এক দৈবশক্তির প্রভাবে ভয়ংকরী হয়ে ওঠে। সে একাই ওই দুর্ধর্ষ ডাকাতদের প্রায় নির্মূল করে এনেছে। কৌশলে ডাকাত মেরে তাদের বন্দুক ছিনতাই করে ডাকাতদের মধ্যে মড়ক সৃষ্টি করে দিয়েছে। সে যেন এক কিশোরী ফুলনদেবী। আমরা তাকে দেবী বলি।
সন্ন্যাসী লাফিয়ে উঠলেন, জয় মা! জয় মা! এসেছে। এসেছে। এতদিন আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।
কে এসেছে বাবা?
সে তোমরা বুঝবে না। কিন্তু আমি জানি সে কে। আমার ডাকে সাড়া দিয়ে সে এসেছে। তাকে আসতেই হবে। না হলে আমার এতদিনের সাধনা বিফল হয়ে যাবে যে।
আমরা আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি তোমাদের বুঝিয়ে দেব। ওই যে মেয়েটি ভয়ংকরী মূর্তিতে তোমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে, ও তো মানবী নয়। দেবী। মা ভবানী। এই পাহাড়ের এক গোপন স্থানে মা ভবানী দীর্ঘ কুড়ি বছর উপবাসী আছেন। তাই মা তাঁর রক্ত পিপাসা মেটাতে আবির্ভূতা হয়েছেন ওই কিশোরীর রূপে।
কিন্তু বাবা, আমরা হিন্দু। মা ভবানী আমাদের দেবী। ও যে মুসলমানের মেয়ে।
ওরে নির্বোধ। আমরা সবাই মায়ের সন্তান। আমাদের কি জাত আছে? না আমাদের কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম আছে? আমাদের জাত একটাই। আমরা মানুষ। গোরু নয়, বাঁদরও নয়। তবে আমাদের অনেকের প্রকৃতির মধ্যে অবশ্য অনেক হিংস্র জানোয়ারের মিল আছে।
কিন্তু ওরা তো গোরু খায়।
ওরা তো জলও খায়! তোরা জল খাস না? সূর্যের কিরণ ওরা গায়ে মাখে। তোরা মাখিস না? যে বাতাসে ওরা শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় সেই বাতাস তোরাও তো নিস? তার বেলা? মা যে কবে তোদের সুমতি দেবে! তা চল দেখি কোথায় তোদের সেই দেবী। আমাকে এখুনি নিয়ে চল তার কাছে।
সবাই তখন সব কাজ ফেলে সেই মহাপুরুষকে নিয়ে চলল শবনমের কাছে। সন্ন্যাসী ঠাকুর যেন এই মানুষগুলোর আশার প্রদীপ।
লালচাঁদ ও তার দলের লোকেরা এবং কয়েকজন পাহাড়ি মেয়েপুরুষ গাছতলায় বড় একটি পাথরের বুকে শায়িতা শবনমকে ঘিরে ছিল।
সন্ন্যাসীকে দেখেই সসম্ভ্রমে সরে বসল সকলে। সন্ন্যাসী তাঁর দীর্ঘ শরীর নিয়ে
বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ছোট একটি পাথরে পা দিয়ে উঠে পড়লেন পাথরের চটানে! শবনমের তখন জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু সে বড় ক্লান্ত। বন্দুকটা ওর পাশেই শোয়ানো আছে। ও ধীরে ধীরে চোখ মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল।
সন্ন্যাসী কাছে গিয়ে কমণ্ডুলু থেকে খানিকটা জল নিয়ে ওর চোখেমুখে ঝাপটা দিয়ে বললেন, এখন কেমন আছিস মা?
শবনমের ঠোঁটদুটি বারেকের তরে একবার কেঁপে উঠল। কী যেন বলতে গেল সে কিন্তু পারল না।
সন্ন্যাসী বললেন, তোর কথা আমি সব শুনেছি। একটু সুস্থ হ তুই। আমি নিজে হাতে ফুল এনে তোর পুজো করব। মালা গেঁথে তোকে পরাব। নিজে হাতে তোকে পেট ভরে খাওয়াব। তুই যে দীর্ঘদিন উপবাসী আছিস। আজ কুড়ি বছর কেউ তোকে ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো করেনি। আজ তোর নতুন করে অভিষেক হবে মা।
বিস্মিত শবনম ধীরে ধীরে উঠে বসল। বলল, হে যোগীরাজ! কে আপনি?
কাকে কী বলছেন? আপনি কি জানেন আমি যবনকন্যা?
তুই কি জানিস অসুর নিধনের জন্যে মা ভবানীকেও একদিন কালী হতে হয়েছিল? আমি সন্ন্যাসী। আমার যেমন জাত নেই, তুই তেমনি দেবী। তোরও কোনও জাত নেই। কী নাম তোর?
আমার নাম শবনম।
সন্ন্যাসী গগন কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন।
আপনি হাসছেন কেন বাবা?
ওরে পাগলি। তোর নামই যে বলে দিচ্ছে তোর কোনও জাত নেই। আমার নামই বলে দিচ্ছে আমার কোনও জাত নেই?
হ্যাঁ। তোর নামের মধ্যেই যে তোর পরিচয় লুকিয়ে আছে। তোর প্রকাশ যে তোর নামেই।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
পারবি না তো। আসলে নিজেকে বোঝবার চেষ্টা কেউ করে না। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘সর্ব ধর্মাণ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।’ অর্থাৎ হে ব্রজবাসীগণ তোমরা ধর্ম ধর্ম করে অযথা হানাহানি না করে সর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে আমাকে অর্থাৎ ‘আমি কৃষ্ণকে’ শরণ করো। বা নিজেকে চিন্তা করো।
তা হলে কি বলতে চান ধর্ম বলে কিছু নেই?
আছে বইকী। মানুষের কর্মই ধর্ম। তোর নাম শবনম। শবনম মানে শিশির। কিন্তু অন্য অর্থে ‘শব’ কাকে বলে জানিস?
মরা মানুষকে।
মড়ার জাত আছে?
নেই।
‘নম’ মানে?
নমো।
তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে? তুই শব অর্থাৎ তোর কোনও জাত নেই। আর নেই বলেই তোকে নমো করছি। পুজো করব বলে।
শবনম সন্ন্যাসীর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল। বলল, বাবা! আজ থেকে আমি আপনার মেয়ে। আমাকে আপনার চরণে আশ্রয় দিন বাবা।
ওরে পাগলি! তোর যে এখন অনেক কাজ বাকি। অসুরনিধন করবি না? ওহে ও লালচাঁদ ! এ বেটিকে একটু বুঝিয়ে দাও। এত সহজে আশ্রয় নিলে নদী যে মজে যাবে। আরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছ কী? মেয়েটাকে কিছু খেতেটেতে দাও। আর তুমি বাবু তোমার ওই পুলিশি পোশাক ছাড়ো। ওই পোশাকে তোমাকে মানায় না। যদি পারো তো, একটু দুধ গরম করে খাওয়াও মেয়েটাকে।
হিংলাজসর্দার বলল, দুধ তো এখানে পাওয়া যাবে না। আমাদের গবাদি পশুগুলো অর্ধেক মরেছে, অর্ধেক ছাড়া পেয়ে পালিয়েছে।
সে যাই হোক। এখনই ওর কিছু খাদ্যের প্রয়োজন। ও বড় দুর্বল। আমার এক শিষ্যকে আমি অন্য কাজে লাগিয়েছি। সে একাই চেষ্টা করছে মা ভবানীর মূর্তিটাকে জঙ্গলের ভেতর থেকে উদ্ধার করতে। জঙ্গল সেখানে এত গভীর যে একা পেরে উঠবে না সে। মূর্তিটা আশা করি ওখানেই থাকবে। কেন না পাহাড়ের গুহার ভেতরে বড় পাথর কুঁদে তৈরি মূর্তি। কেউ নিয়ে যেতে পারবে না। আমি যাবার আগে ওই ছোট্ট গুহামুখ পাথর দিয়ে এঁটে গিয়েছিলাম। সেখানটা তো চেনাই যায় না। লোকটা একা আছে। আমি এসেছিলাম আরও কিছু লোকজন সংগ্রহের আশায়। এমন সময় এখানে এসে দেখি এই কাণ্ড। সত্যি! এই দীর্ঘ কুড়ি বছরে কত পরিবর্তন না হয়েছে। তুমিও অনেক পালটে গেছ লালচাঁদ। মোটা হয়েছ। কিন্তু এই বেশে এখানে যে তোমাকে আমি দেখব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আসলে ব্যাপার কী জানো, পাপের ভারা পূর্ণ না হলে পাপীর পতন হয় না। রাবণ বংশ একদিনে ধ্বংস হয়নি। তেমনি, সময় না হলে হাজার চেষ্টা করলেও যার সঙ্গে দেখা হবার নয়, তার দেখা পাওয়া যাবে না। তবু ভাল। দেবী আমার ডাক শুনেছেন। আজ গুহামন্দির সংস্কার করে এসো আমরা সবাই মিলে মা ভবানীর অভিষেক করি। তাড়াতাড়ি চলো সবাই।
লালচাঁদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন সন্ন্যাসীর দিকে। সে দৃষ্টিতে যে কী
প্রচণ্ড বিস্ময় তা বলে বোঝানো যাবে না। লালচাঁদ বললেন আ-আ আপনি—! মনে করে দেখো। দীর্ঘ কুড়িটা বছর পিছিয়ে যাও লালচাঁদ। খোংগসারার জঙ্গলে ওই বিশ্বাসঘাতকের বিশ্বাসঘাতকতার বলি হয়েছিলাম আমরা। বিনা অপরাধে আমার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। তোমারই সহযোগিতায় জেল-হাজত থেকে পালাতে পেরেছিলাম আমি। তুমি তোমার একমাত্র পুত্রকে হারিয়েছিলে।
আমার স্ত্রীকেও ওই শয়তানের চরেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
তারপর থেকে কত খুঁজেছি তোমাকে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা করেছি। এমন সময় এক সদ্গুরুর সন্ধান পাই। তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসজীবন যাপন করছি। বেশ আছি। ছিলাম নর্মদার তীরে ওস্কার তীর্থে। হঠাৎ একদিন স্বপ্ন দেখলাম মা ভবানীকে। দেখলাম মা’র চোখে জল। মা যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমার এক চ্যালাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম এখানে। এসে দেখি এই সব কাণ্ড।
লালচাঁদ লাফিয়ে উঠলেন, জয় মা ভবানী। জয় জগদম্বে। কিন্তু আপনি যে এখনও বেঁচে আছেন, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি সর্দার। আপনি ওষ্কার তীর্থে, আমি খাণ্ডোয়ায়। কত কাছাকাছি। অথচ কেউ কাউকে দেখিনি এতদিন!
ওঙ্কারতীর্থে আমি কিছুদিন আগে এসেছিলাম। সেখানে থেকে তোমার সমস্ত খোঁজখবরই রাখতাম আমি। তার আগে দীর্ঘদিন ছিলাম কর্ণাটকে তুঙ্গভদ্রার তীরে।
ঠিক আছে। ওই শয়তানের কেল্লা দখল করে আপনার কেল্লা আপনারই হাতে তুলে দেব সর্দার। হিন্দোলকেল্লা হিন্দোলসর্দারেরই থাকবে। জয় হিন্দোলসর্দারের জয়। জয় মা ভবানীর জয়।
শবনম বলল, আপনিই হিন্দোলসর্দার!
হ্যাঁ মা, যে মানুষ ডাকাত ছিল, কিন্তু কখনও কোনও নিরীহ প্রাণীকে অকারণে হত্যা করেনি, আমিই সেই। ডাকাত হলেও আমি মা ভবানীর উপাসক ছিলাম। তাই বুঝি মা আমার প্রাণহানিটা ঘটতে দেননি।
তা হলে ওই লোকটা কে?
ওর নাম দুর্জন সিং। আমার দলে ছিল। ভেতরে ভেতরে ওর দলের কিছু লোককে আমার দলে ঢুকিয়ে আমার লোকেদের সরিয়ে দিয়ে আমাদের দু’জনের ওপর চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে ওই কেল্লায় সর্দার হয়ে বসে। সবাই জানে ওটা হিন্দোলসর্দারের কেল্লা। কিন্তু শয়তান দুর্জন সিং-এর কথা কেউ জানে না। আর জানে না ওর বিশ্বাসঘাতকতার কথা। নতুন যুগের মানুষরা ওই অত্যাচারীটাকেই হিন্দোলসর্দার বলে জানে। আমার নামকে কলঙ্কিত করেছে ওই শয়তানটা। পাছে কেউ চিনে ফেলে তাই মুখে কাপড় বেঁধে ডাকাতি করতে যায়। নানারকম নোংরামি করে দিনের পর দিন আমার নামে চালিয়ে যায়। সমস্ত কুকর্মের দায় আমার ঘাড়ে পড়ে। এখন ও নিজেকেই হিন্দোলসর্দার বলে প্রচার করছে।
শবনম বলল, তাতে ওর লাভ?
আমি পলাতক। আইনের চোখে আমি মারাত্মক অপরাধী। তাই সব রকমের কুকর্মের দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া তো খুব সোজা। ওর পাপ আমার খাতায় দিনের পর দিন জমা হয়। আর আমি ধরা পড়বার ভয়ে সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে স্রোতের ধারার মতো গড়িয়ে বেড়াই। না পারি দল গঠন করতে, না পারি ওকে আক্রমণ করতে। শুধু জানতে পারি আমার কেল্লা দখল করে ও দারুণ মজা লুটছে।
শবনম বলল, এর কি কোনও প্রতিকার নেই?
থাকবে না কেন? তবে এখন আমি সাধনমার্গে আসার পর আমার মনের অবস্থা এমনই যে, ওই তুচ্ছ ভোগ দখলের ব্যাপারটা বা প্রতিশোধ নেবার ব্যাপারটা মন থেকে দূর হয়েছে! তবে একেবারে যে আসক্তিহীন তাও নয়।
বিশেষ করে মা ভবানীর সেবা পূজা করবার জন্যে মনটা আমার বড়ই উন্মুখ হয়ে আছে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এখানে কোনও মানুষের বসতি ছিল না। সেই দুর্ভেদ্য অরণ্যে দিনের আলো প্রবেশ করত না। শিবাজির পুণা দুর্গের মতো আমার কেল্লাও ছিল অপ্রতিরোধ্য। অবশ্য এখনও তাই। আসলে এখানকার প্রাকৃতিক অবস্থান সব কিছুকেই দুর্ভেদ্য করে রেখেছে।
শবনম বলল, আপনি কি পারেন না আবার স্বরূপে এখানে প্রতিষ্ঠিত হতে? কেন পারব না? সকলের সহযোগিতা পেলে নিশ্চয়ই পারব। তবে মা, আগের মতো ভোগবাসনা এখন আর নেই আমার। কিন্তু প্রতিশোধ একটা নেওয়া দরকার। তা ছাড়া ওই দুরাত্মার অত্যাচার এখুনি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। যে নারীকে আমি চিরকাল মায়ের মর্যাদা দিয়ে এসেছি, ওই পাপাত্মা তাকেও কলঙ্কিত করেছে। আমি আজকে সাধু হলেও একসময় ডাকাত ছিলাম। এখন রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হলেও তখন আমার মধ্যে প্রচণ্ড বদ বুদ্ধি ছিল। অনেক বড় বড় ডাকাতি করেছি। আমার চিঠি নিয়ে লোক যেত। আমার চাহিদার কথা জানিয়ে দিত। পাওনা পেলে চলে আসতাম। বাধা পেলে লড়াই জমত।
কিন্তু কেন আপনি এসব করতেন বাবা?
ওরে পাগলি! কৈশোর বয়সে মা-বাবাকে হারিয়ে যে ছেলে পথে পথে ঘোরে, আর সামান্য একটু পেট ভরাবার তাগিদে মানুষের কাছ থেকে যে দুর্ব্যবহার পায় সে যদি কখনও বদলা নেবার সুযোগ পায়, তা হলে কেন সে বিপথগামী হবে না? তোর ফুলনদেবী আর পুতলিবাঈ কি এমনি ডাকাতনী হয়েছিল?
আপনি কী করে ডাকাতদের দলে ভিড়েছিলেন?
সে অনেক কথা। বলতে পারিস মা ভবানীর কৃপায়। এই যে তুই একটা ভাল ঘরের মেয়ে। তুই কেন খুনের নেশায় মেতে উঠেছিস? এমনিই অবস্থার ফেরে মানুষ আর মানুষ থাকে না। তবে দুর্জন সিংটা বিশ্বাসঘাতক। না হলে এই লালচাঁদও তো আমার হাতে গড়া। কই ও-তো কখনও বেইমানি করেনি। বরং আমার ফাঁসির আদেশ হবার পর ও দলবল নিয়ে এমনভাবে আমাকে পালাবার সুযোগ করে দেয় যে, ওর ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না। ওই কাজ করতে গিয়ে ও এবং দু’-একজন ছাড়া সবাই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এদিকে দুর্জন সিং তার লোকেদের নিয়ে কেল্লা এমনভাবে দখল করে যে তার ধারেকাছে কারও যাবার উপায় থাকে না। তা যাক। ওসব আলোচনা এখন না করাই ভাল। এখন আর বৃথা সময় নষ্ট না করে চলো সবাই মা ভবানীর গুহামন্দির সংস্কারের কাজে যাই।
সবাই তখন ‘জয় হিন্দোল সর্দারের জয়’ বলে কোদাল, কুণ্ডুল, গাঁইতি নিয়ে সন্ন্যাসীর সঙ্গে এগিয়ে চলল।
লালচাঁদ তাঁর কয়েকজন লোককে হিন্দোলকেল্লার দিকে নজর রাখতে বলে দু’জনের কানে কানে ফিস ফিস করে কী যেন বলতেই তারা চলে গেল সম্পূর্ণ অন্যদিকে।
পাহাড়িদের মনে এখন দারুণ আনন্দের জোয়ার। তাদের একঘেয়ে কর্মময় ক্রীতদাসের মতো যাপন করা জীবনে যেন নবসূর্যোদয়। ওরা হই হই করে এক জায়গায় গিয়ে দেখল সাধুবাবার একজন লোক জঙ্গলের গভীরে পাহাড়ের ত্রিকোণাকৃতি একটি অংশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
সাধু বললেন, ওই সেই স্থান। যেখানে আছে ছোট্ট একটি গুহামুখ। সংকীর্ণ একটু অংশের মধ্য দিয়ে মাত্র দু’ ফুট ফাঁক। সেটিকে অতিক্রম করতে পারলে মা ভবানীর গুহায় প্রবেশ করা যাবে।
হিংলাজসর্দার বলল, কিন্তু বাবা, গুহার মুখ কোনখানে? আমরা তো বুঝতেই পারছি না।
কী করে পারবি? সে মুখ আমি বুজিয়ে দিয়ে গেছি। তোদের কাছে গেলাম তবে কী জন্যে? ওই মুখ আজ এখুনি খুলব। নে, এখন তোরা এই জায়গাটার জঙ্গল সাফ কর।
সবাই একবার তাকিয়ে দেখল শবনমের দিকে।
শবনম বলল, দেখবার কিছু নেই। কাটো। প্রয়োজনে অনেক কিছুই করবে! কিন্তু অপ্রয়োজনে কিছুই করবে না। তবে এক কাজ করো। সামনের দিকটা জঙ্গল রেখে একেবারে গুহামুখের দিক থেকে চার হাত মাপ করে কাটো।
এগুলো অবশ্য ভাল গাছের জঙ্গল নয়। বড় বড় চিহড়লতায় ঘনান্ধকার করে ঢাকা। আগাছা, কাঁটাবন ও বনতুলসির ঝাড়।
সাধুবাবা বললেন, জঙ্গলের গাছপালার ওপর তোর খুব মমতা দেখছি। হ্যাঁ বাবা। একটা গাছের ডাল কাটলে আমার মনে হয় কেউ যেন আমার একটা হাতই কেটে নিচ্ছে।
কোদাল, কুড়ুল, গাঁইতির ব্যবহারে মিনিট কয়েকের মধ্যেই বুনো ঝোপগুলো সাফ হয়ে গেল। ওগুলোকে এমনভাবে কাটা হল যাতে করে হঠাৎ কেউ এসে পড়লে বাইরের জঙ্গল দেখেই বুঝতে পারবে না এর ভেতরে এমন পরিষ্কার