তিন
পাহাড়িদের সঙ্গে পায়ে পায়ে ওরা যখন একটু নিচুতে এক অপূর্ব পাহাড়িয়া গাঁওতে এসে হাজির হল তখন নয়নমন ভরে গেল। ওরা যাওয়া মাত্রই এখানকার আঞ্চলিক দেশীয় প্রথায় শিঙা আর ডুগডুগি বাজিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হল ওদের।
শবনম বলল, এখন থেকে আমরা দু’জন তোমাদের গ্রামেই থাকব। তোমরা আমাদের জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করো।
কিছু লোক সঙ্গে সঙ্গে বাঁশ কঞ্চি তালপাতা ইত্যাদি নিয়ে লেগে গেল ঘর তৈরির কাজে। এই অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে পাহাড়ের একটি ঢালের গায়ে ওরাই দেখিয়ে দিল ওদের উপযুক্ত স্থান। এখান থেকে নীচেকার দৃশ্য অতি মনোরম। বহু দূরে আরও উচ্চস্থানে ঘন অরণ্যের মধ্যে একটি মোচাকৃতি পাহাড়ের চূড়ায় একটি গুহা নজরে পড়ল।
হিংলাজ বলল, ওই হল হিন্দোলসর্দারের কেল্লা। ওই অরণ্যদুর্গে এক সময় এক চোখো এক অসুর বাস করত। শোনা যায় সেই অসুর ছিল এই অঞ্চলের রাজা। ওই গুহায় সে অনেক ধনরত্ন সঞ্চিত রেখে একবার এক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াই করতে যায়। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। আর ফেরে না। ওই গুহার জঠরে কোথায় যে তার ধনসম্পদ সে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে তা কেউ জানে না। এসব হল পুরনো দিনের কথা। কয়েক বছর আগেও এখানে আমরা সুখেশান্তিতে ছিলাম। এখন নিত্যনতুন উপদ্রবে আমরা সদ্য শঙ্কিত থাকি।
এইসব কথা শুনতে শুনতে শবনমের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরোতে লাগল। শুধু বলল, তোমাদের মা কালী আর দেবী দুর্গা যখন অসুরনিধন করেন তখন তাদেরই মধ্যে থেকে কয়েকটা ছিটকে ছাটকে পাতালেটাতালে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছিল। এখন তারাই এসে তোমাদের জ্বালিয়ে মারছে। আমি মা কালী আর দেবী দুর্গার কৃপায় নবশক্তিতে নবরূপে ভয়ংকর মূর্তিতে এখানে এসে হাজির হয়েছি। শুধু তোমরা আমার সঙ্গে থেকো। ওই কেল্লা দখল করে আমি থাকব ওখানে। আমি অতন্দ্রপ্রহরীর মতো সদা সতর্ক হয়ে পাহারা দেব তোমাদের। আমি সর্বহারা হয়ে এখানে এসেছি। তোমরা আমাকে দেখো। আমি তোমাদের দেখব।
শবনমের রুদ্রমূর্তি, রক্তচক্ষু এবং ওই ডাকাতরানির মতো পোশাক দেখে ওর কথাটা যে নেহাতই ফাঁকা বুলি তা বলে কেউ মনে করল না। সবাই বিশ্বাস করল, হ্যাঁ এবার সত্যিকারের এমন একজন ওদের মাঝে এসেছে যে কিনা ওদের হয়ে লড়তে পারবে।
শবনম বলল, শোনো, শুধুহাতে ওই দুর্ধর্ষ ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই করা যায় না। তাই আমি তোমাদেরকেও বন্দুকবাজি শেখাব। ওরা দলে কত জন আছে জান?
তা পনেরো-কুড়িজন তো বটেই।
তার মধ্যে কয়েকজনকে আমি একাই মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দিয়েছি। বাকিগুলোকে আমরা সবাই মিলে বলি দেব। ওদের একটা লোক তো আমাদের হাতে বন্দি হয়েছে।
হ্যাঁ।
লোকটাকে কড়া পাহারায় রাখো। ওকে মোচড় দিয়েই ওদের গুপ্তকথা আমি টেনে বার করব।
একজন বলল, একটা শিরীষ গাছের গুঁড়ির সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রেখেছি ওকে।
ঠিক আছে। তোমাদের কিছু লোক এই এলাকাটা পাহারা দাও এবার। যাতে ওরা আচমকা এখানে এসে উপদ্রব করতে বা ওই লোকটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে না পারে। আর ওদের বন্দুকগুলো আমার জিম্মায় রেখে লাশগুলো ফেলে দাও পাহাড়ের খাদে।
সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শবনমের কথা শুনে গেল। রঞ্জন ওর মায়ের মুখে শুনেছে ঠাকুর দেবতার ‘ভড়’ হওয়ার কথা। ‘ভড়’ যদি ভণ্ডামি বা ভড়ং না হয় তা হলে নাকি ওই অবস্থায় সে যাকে যা বলে তাই ফলে, শবনমের মধ্যেও কি ওই রকম কোনও শক্তি ‘ভড়’ করল? না হলে চোদ্দো-পনেরো বছরের একটি মেয়ের মধ্যে এত বিক্রম এল কী করে? এই সামান্য সময়ের মধ্যে এতগুলো দুর্ধর্ষ মানুষের জীবনান্ত যেন রূপকথার গল্পের মতো ঘটে গেল। এই কিশোরীর ব্যক্তিত্বর কাছে এই পাহাড়ি মানুষগুলো যেন হুকুমের চাকর হয়ে উঠল। এর রহস্য কী? কোন শক্তির প্রভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হল!
হিংলাজসর্দারের মাটির দাওয়ায় ওদের জলখাবারের ব্যবস্থা হল! আলু ভাজা, মুড়ি আর ভেলিগুড়ের হালুয়া।
একটি সাত-আট বছরের বালিকা এসে ডেকে নিয়ে গেল ওদের। কালো কষ্টিপাথরের মতো ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটি।
ওরা মুখ, হাত-পা ধুয়ে দাওয়ায় পাতা চাটাইতে বসে জলযোগ করতে লাগল। এর সঙ্গে এল মশলা দেওয়া চা। ভারী চমৎকার। খেয়ে মুখ ছেড়ে গেল যেন।
একটা কুকুর অনেকক্ষণ থেকে ছোঁক ছোঁক করছিল।
শবনম সামান্য দুটি মুড়ি ছড়িয়ে একটু হালুয়া দিতেই কুকুরটার আনন্দের আর অবধি রইল না। সে ঘন ঘন লেজ নেড়ে তার আনুগত্য প্রকাশ করতে লাগল।
রঞ্জনের খুব ভাল লেগে গেল এখানকার আরণ্যক পরিবেশ। হিংলাজ পাটসানির দাওয়ায় বসেই অরণ্যের গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। এ বাড়ির চৌহদ্দির বাইরেই ধানের গোছার মতো বড় বড় সাবাই ঘাসের সবুজ শোভা মনকে মোহিত করে দেয়।
ওরা পেট ভরে জলখাবার খেয়ে দাওয়ায় নেমে পায়চারি করতে লাগল। আর কুকুরটা ঘুরতে লাগল ওদের পায়ে পায়ে। শবনম ওর মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে ওকে আরও আপন করে নিল।
রঞ্জন বলল, একবার ওই লোকটার কাছে আমাদের গেলে হত না? কোন লোকটার কাছে?
যাকে শিরীষ গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে।
শবনম হাসল। হেসে বলল, হ্যাঁ, যেতে তো হবেই। কিছু কথা ওর পেট থেকে বার করতে না-পারলে হিন্দোল সর্দারের কেল্লায় ঢোকা যাবে না।
ওরা হিংলাজকে সঙ্গে নিয়ে সেই লোকটির কাছে গিয়ে হাজির হল। রঞ্জনের পাথরের আঘাতে লোকটির নাককেটে রক্ত ঝরছে। সেই অবস্থাতেই একটি বড় গাছের সঙ্গে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। দু’জন লোক সমানে পাহারা দিচ্ছে লোকটাকে।
শবনম ভয়ংকরী মূর্তিতে লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রঞ্জন রইল একপাশে।
শবনম লোকটিকে বলল, কী নাম তোর? বলব না।
হিন্দোলসর্দারের দলে কতদিন আছিস?
বলব না।
দলে তোরা কতজন?
বলব না।
লোকটির জেদ দেখে রঞ্জনের মাথায় যেন খুন চেপে গেল। আসলে রক্ত ঝরানোর নেশাটাই একটা উন্মাদনা এনে দেয়। বিশেষ করে এ সব ক্ষেত্রে প্রতিহিংসা প্রবল হয় অতি। কেন না ওদের এই কষ্টের, আজকের এই বনবাসের মূলেই তো এরা। রঞ্জন বলল, এখনও বলছি যা জিজ্ঞেস করব ভালভাবে তার উত্তর দিবি। না হলে কিন্তু জীবন সংশয় হবে তোর।
লোকটি রক্তচক্ষুতে রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে থুঃ করে একটু থুতু ছেটাল।
অমনি রঞ্জন একটা শক্ত মোটা গাছের ডাল ভেঙে বেধড়ক পেটাতে লাগল লোকটাকে। সে কী প্রচণ্ড মার। সারা গায়ে কালশিটে পড়ে গেল। লোকটি তবুও জেদের সঙ্গে বলল, বলব না।
এমন সময় রঙ্গমঞ্চে একজনের আবির্ভাব হল।
এক বিশাল শরীর ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়াটিকে একটি গাছের ডালে বেঁধে সদর্পে এগিয়ে এসে বলল, এ এ ক্যা তামাশা হো রহা হ্যয়া? তুম সব কাম পর নেহি গিয়া কিউ?
পাহাড়িরা নীরব। সবাই শবনমের দিকে তাকাল।
শবনম বন্দির দিক থেকে নজর সরিয়ে আগন্তুকের দিকে তাকাল। তারপর বলল, কৌন হো তুম?
আগন্তুক বলল, তুম কৌন হো?
আমি এই অরণ্যের দেবী।
দেবী? হিয়া দেবীটেবী কুছ হ্যায়ই নেহি। বলে পাহাড়িদের বলল, চলো, তুম সব কাম পর চলো। তারপর বেঁধে রাখ৷ লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, এ আদমি কৌন?
শবনম বলল, আমার শিকার।
শিকার? মেরা সমঝমে তো কুছ নেহি আতা।
শবনম এবার পরিষ্কার করে বলল, তুমিই বুঝিঝ শেঠ মংঘীরামজি ?
এ মাত পুছো। বলে পাহাড়িদের বলল, চলো চলো, কাম পর চলো।
শবনম বলল, না। আজ থেকে ওরা আর কেউ তোমার কাজে যাবে না। তোমার বাত ভি শুনবে না। আমি এই পাহাড় বনের রানি। এখানকার দেবী। আমি যা বলব, তাই শুনবে ওরা।
মংঘীরাম চিৎকার করে উঠল, নেহি। ও লোগ হামারা বাত শুনেগা। কাম করনেহি পড়েগা সবকো।
না করলে?
জিন্দা মার ডালুঙ্গা।
শবনম বলল, মংঘীরামজি, এতদিনে তোমার পালা শেষ। গাছ প্রতি বিশ রুপিয়া হাতে গুঁজে দিয়ে অনেক ফায়দা লুটেছ তুমি। এখন তার খেসারত দাও।
কুড়ি টাকার গাছ লক্ষ টাকায় বেচেছ। অসহায় মানুষগুলোর রক্তচুষে তুমি হয়েছ শেঠ। কিন্তু আর তো তা হচ্ছে না।
মংঘীরাম চেঁচিয়ে উঠল, তুম সব খাড়ে হোকর ক্যা দেখতে হো? এ লেড়কি তুমহারা রোটি মারনে মাংতা। পাকড়ো ইসকো। বলেই ডাকল, আগারাম, বাগারাম ইধার আ যাও তো।
বলার সঙ্গে সঙ্গে দু’জন তাগড়াই চেহারার ভোজপুরী এসে দাঁড়াল সেখানে। শবনম বলল, খবরদার! আগে মাত বাড়ো। বলেই পাহাড়িদের বলল, তোমরা মংঘীরামকে ধরে রাখো। ওর সঙ্গে একটু বেশি রকম বোঝাপড়া করতে হবে আমাকে।
পাহাড়ি লোকগুলো তখন ঝাঁপিয়ে পড়ল মংঘীরামের ওপর। তারপর ওকেও বেশ শক্ত করে বেঁধে ফেলল একটা গাছের সঙ্গে।
ভোজপুরী দুটো মংঘীরামকে উদ্ধার করবার জন্য আসছিল। কিন্তু শবনমের বন্দুক ও পাহাড়িদের বিরুদ্ধ আচরণ দেখে ভয় পেয়ে গেল ওরা। তা ছাড়াও শবনমের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরটার মতিগতি ওদের সুবিধের মনে হল না। কুকুরটা কেমন যেন ক্রুদ্ধ চোখে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাকাচ্ছে।
মংঘীরাম বাঁধা পড়ে ছটফট করতে লাগল।
শবনম ওর বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে বলল, শোনো মংঘীরামজি এখন থেকে আমি এই জঙ্গলের দেখাশোনা করব। এখানকার মানুষজন আমার প্রজা। তাই এদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। তুমি এদের ঠকিয়ে আসল প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে অনেক অর্থ রোজকার করেছ। তার এক মুঠো আমার এক্ষুনি প্রয়োজন। আশা করি আমার ক্ষমতা সম্বন্ধে এতক্ষণে তোমার একটা ধারণা জন্মে গেছে। তুমি অবিলম্বে লাখ খানেক টাকা আমাকে পাঠিয়ে দেবে।
মংঘীরাম চেঁচিয়ে বলল, নেহি, হাম পুলিশকো বুলায়গা।
মংঘীরামের কথা শুনে আকাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠল শবনম। বলল, যাও। আভি যাকে বোলাও। বলে বলল, তুমি জঙ্গলের কাঠ চোরাইপথে চালান দাও। তুমি যাবে পুলিশের কাছে? ওসব ভয় অন্য লোককে দেখাবে। খুব শিগগির আমি হিন্দোলসর্দারের কেল্লা দখল করব। তখন আর আমার কোনও অভাব থাকবে না। কিন্তু যতক্ষণ না তা করি ততক্ষণ তুমি আমাকে টাকার জোগান দেবে।
ঠিক হ্যায়। রুপিয়া মিল যায়ে গা, লেকিন—
লেকিনটেক্নি কিছু নেই। আমার টাকার দরকার। টাকা চাই। তোমার সঙ্গে আমার শত্রুতার নয়, বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠুক এই আমি চাই।
মংঘীরাম এবার যেন বুকে বল ফিরে পেল। বলল, তব তো রুপিয়া জরুর মিলেগা। তো তুম এক কাম করো। হামারা সাথি হো যাও। দোস্তি করো। আউর তুমহারা আদমি কো বোলো জঙ্গল কাটনে কে লিয়ে।
না। জঙ্গল কাটা চলবে না। তুমি অন্য কোনও বিজনেসের ধান্দা করো মংঘীরামজি। এখন এদের ঠকিয়ে যে পয়সা কামিয়েছ, তা একটু একটু করে ফেরত দাও। আমি জানি তুমি পুলিশের কাছে যাবে না। গেলে বিপদে পড়বে। তাই বলি ভালয় ভালয় নোট ছাড়ো। না হলে কিন্তু তোমার বাড়িতে গিয়েও চড়াও হব আমরা। হিন্দোলসর্দারকে তুমি কত করে টাকা দাও?
আমি কাউকে কিছু দিই না।
মিথ্যে কথা। হিন্দোলসর্দার এই পাহাড় বনের সন্ত্রাস। সে এক কুখ্যাত দস্যু। তার এলাকায় এসে তুমি লাখ লাখ টাকার সম্পদ কেটে নিয়ে যাবে, আর সে দিনের পর দিন মুখ বুজে তাই দেখবে, এ কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো? বলো কত করে দাও তাকে?
মংঘীরামজি মাথা হেঁট করে বলল, তাকে যা দিই তোমাকেও যে তাই দেব, সে আশা তুমি কোরো না খুকি।
শবনম চমকে উঠল, খুকি কী? দেবী বলো।
হাঁ হাঁ দেবীজি। তবে একটা বাত আমার বলবার আছে। হিন্দোলসর্দারের সঙ্গে লড়বার আগে নিজের ক্ষমতাটা একটু বাজিয়ে দেখো। আমাদের বিমে তুমি খাড়া হলে তুমি আর জিন্দা থাকবে না। তোমার লোক ভি মরবে। তুমি ভি মরবে।
শবনম বলল, শোনো। তোমার সামনে ওই যে লোকটা বাঁধা রয়েছে দেখছ ও হিন্দোলসর্দারের লোক। ওদের দলের বেশ কয়েকজনকে আমি শেষ করেছি। এবার ওকেও করব। আমি তোমাকে মারব না। কেন না আমার অর্থের এবং অন্যান্য প্রয়োজনে কই মাছের মতো জিইয়ে রাখব তোমাকে। যতক্ষণ কথা শুনবে ততক্ষণ ঠিক থাকবে। অন্যমতি হলেই ‘ডিস্যুম’। কী বুঝলে? আর হ্যাঁ, এখন থেকে হিন্দোলসর্দারের পাওনাটা আমিই নেব। আজ থেকেই ওর টাকা বন্ধ করে দাও তুমি।
হিন্দোলসর্দারের সঙ্গে দুশমনি করলে ও আমাকে প্রাণে মারবে।
আমার কথা না-শুনলে আমিও তোমাকে প্রাণে মারব। এখন তোমাকে আমি মুক্তি দেব। আজ সন্ধ্যার মধ্যে তুমি আমাকে এক লাখ টাকা পৌঁছে দেবে। আর কিছু বন্দুক ও কার্তুজ কয়েক দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দেবে এখানে। এই পাহাড়িদের আমি যুদ্ধ করা শেখাব। না হলে এরা চিরকাল পড়ে পড়ে মার খাবে।
কিন্তু জঙ্গল কা লকড়ি নেহি মিলনে সে হাম তো মর যাউঙ্গা দেবীজি। শবনম বলল, তোমার মতন লোকের কখনও শুধু একটা লকড়ির ব্যবসা থাকতে পারে না। তোমার আরও অনেক ব্যবসা নিশ্চয়ই আছে। তুমি সেই দিকে নজর দাও। যাও! এখুনি গিয়ে টাকার ব্যবস্থা করো।
মংঘারামজি একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ঠিক হ্যায়। ছোড় দিজিয়ে।
শবনম পাহাড়িদের বলল, মংঘীরামকে ছেড়ে দিতে।
মংঘীরামজি ছাড়া পেল। ছাড়া পেয়ে চলেও গেল।
শবনম আবার তাকাল বন্দির দিকে। বলল, এই তোমাকে শেষ সুযোগ দিলাম বলবার। কিছু বলবে?
না।
শবনম বলল, এই লোকটাকে তোমরা পিছমোড়া করে বেঁধে গলা পর্যন্ত পুঁতে রাখো। আর ওর মুখের কাছে রেখে দাও কয়েকটা শুকনো রুটি এবং এক গেলাস জল।
পাহাড়িরা এখন রীতিমতো খেপে উঠেছে। যে মংঘীরামকে ওরা বাঘের মতো ভয় করত, সেই মংঘীরামকে এই এক রত্তি মেয়েটা কী ভয়ংকর ভাবেই না শাসিয়েছে। আর ওই হিন্দোলসর্দার! ফণাওয়ালা গোখরো সাপ একটা। তারও বিরুদ্ধে যে কঠিন সংগ্রাম করেছে মেয়েটি, তা রীতিমতো দুঃসাহসিক। এ মেয়ে তো মেয়ে নয়, যেন এক দেবকন্যা। দৈবশক্তি না থাকলে এই অসম্ভব কী করে সম্ভব হয়?
শবনমের কথায় ওরা ধৃত লোকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। তারপর সত্যি সত্যিই কোদাল গাঁইতি নিয়ে এই কঠিন শিলাস্তরের বুকে যেখানে একটু মাটি আছে সেখানে গর্ত খুঁড়তে লাগল।
এতক্ষণে ভয় পেল লোকটি। বলল, ম্যায় সব কুছ বতাতা হুঁ। লেকিন। লেকিন? লেকিন কী?
লেকিন। আমার কথা শেষ হলেই তোমরা আমাকে গুলি করে মারবে।
রঞ্জন বলল, শুধু শুধু মারব কেন?
লোকটি বলল, তোমরা যদি না মারো হিন্দোলসর্দার মারবে। তবে সে মৃত্যু হবে অতি নৃশংস। হাত-পা কেটে, চোখ উপড়ে, জিভ টেনে বার করে মারবে। বেশ। তাই করব। এখন বলো ওই গুহা দুর্গে যাবার উপায় কী? শুনেছি ওর ধারেকাছে নাকি যাওয়া যায় না।
না। ওই দুর্গের মধ্যে বেশ কয়েকটি গুপ্তকক্ষ আছে। কেউ ভুল করেও তার পাঁচশো গজের মধ্যে গিয়ে পড়লে সেই গুপ্তকক্ষের ভেতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে। যদি কোনওরকমে সেই আসন্ন মৃত্যুকে আড়াল করে গুহাতে পৌঁছানো যায়। তা হলেও কিন্তু রহস্য ভেদ হবে না। তার কারণ ওই গুহার গোলকধাঁধায় অনেক সময় আমরাও ধাঁধিয়ে যাই।
বেশ, এখন প্রশ্ন, ওই গুহার পিছন দিকে আর কোনও গুপ্তপথ আছে কি না? বলতে পারব না। তবে মনে হয় নেই। কেন না গুহাটি প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে এমনভাবে সৃষ্ট হয়েছে যে, এই গুহায় প্রবেশ করে পাতালপুরীর মতো ক্রমশ অনেকটা পথ নামবার পর দেখা যাবে গুহাটা প্রশস্ত হয়েছে। আসলে ওইটি একটি ফাঁপা পর্বত বলা যেতে পারে।
হুঁ। দলে তোমরা কতজন আছ?
এখনও পর্যন্ত জীবিত আছি এগারোজন।
পরশু মধ্যরাতে যে ভয়ংকর ট্রেন দুর্ঘটনাটি ঘটে ওটিতে তোমরা কারা অংশ নিয়েছিলে?
ওটি নেহাতই দুর্ঘটনা। ওতে আমাদের কোনও হাত ছিল না।
রঞ্জন তখন সজোরে একটা ঘুসি মেরে দিয়েছে লোকটির মুখে! সেই ঘুসির আঘাতে ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত নেমে এল। রঞ্জন বলল, আমরা স্বচক্ষে দেখেছি কিছু লোক যাত্রীদের জিনিসপত্তর লুণ্ঠন করছিল। এই অঞ্চলে তোমরা ছাড়া কারা করবে ওই সব কাজ?
মংঘীরামজিও সাধুপুরুষ নন। তাঁর লোকজন অথবা অন্য দলও এ কাজ করতে পারে।
মংঘীরামের দলের লোক কত?
তা বিশ-পঁচিশজন হবে।
লুঠের মালপত্তর ওরা রাখে কোথায় ?
মংখীরামজির গোডাউনে।
ঠিক বলছ?
মিথ্যে বলে লাভ?
মংঘীরামজির গোডাউন কোথায়?
এই পাহাড়ের নীচে যে নদীটা আছে, সেই নদীর ওপারে হনুমান মন্দিরের পিছনে।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে জায়গাটা কত দূর?
তা এক কিলোমাটির তো হবে।
শবনম বলল, দুর্ঘটনা যখন ঘটে তখন কি তুমি সেখানে ছিলে? লোকটি নীরব।
বলো ছিলে কি না?
ছিলাম।
এই কাজ করার আগে বিবেকে একবার বাধল না? লুঠের মাল তো মংঘীরাম আর হিন্দোলসর্দার ভাগাভাগি করে নেবে। কিন্তু তোমরা কোন স্বার্থে এই কাজ করতে গেলে? তুমি কি জান, এই দুর্ঘটনায় আমি আমার আব্বাজানকে হারিয়েছি! অনেক বাবা-মা তাদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছে। কত নিরীহ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। সে খবর রাখ?
লোকটির চোখদুটি এবার জলে ভরে এল।
রঞ্জন বলল, এ জল তোমার চোখে মানায় না ভাই।
লোকটি বলল, তা হলে শোনো, তোমাদের বন্দুক থেকে মাত্র একটা গুলি তোমরা আমার জন্যে খরচ করো। না হলে যতদিন বাঁচব ততদিন এই দুর্ঘটনার কথাটা আমি ভুলতে পারব না। আসলে এই দুর্ঘটনার মূলে ওই মংঘীরামজি। কী রকম!
সর্দার আমাদের বলেছিলেন ডাউন লাইনের ফিসপ্লেট সরিয়ে দিতে। কারণ একটি মালগাড়িকে ফেলে দিয়ে লুঠপাট করবার মতলব ছিল আমাদের। ঘটনাস্থলে হঠাৎ ওই মংঘীরাম গিয়ে সব গোলমাল করে দেয়। সে বার বার বলতে থাকে, সর্দার নাকি বলেছেন ডাউন নয় আপ লাইনেই খুলতে হবে ফিস প্লেট। আমরা ওর কথামতো কাজ করতে গিয়েই এই অবস্থা হয়। আসলে যাত্রীবাহী ট্রেন ওলটানোর কোনও পরিকল্পনাই ছিল না আমাদের। পরে দুর্ঘটনার পর যখন সর্দারকে গিয়ে খবর দিই সর্দার তখন একটা মোটা দাঁও হাতছাড়া হওয়ার ক্ষোভে বোমার মতো ফেটে পড়েন। এতে আমাদের লাভ কিছুই হয় না। মাঝখান থেকে ছিঁচকে চোরের দল সব কিছু লুটেপুটে খায়।
শবনম কিছুক্ষণ লোকটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কাঁদছ কেন? তোমার তো অনুশোচনা করবার কিছু নেই। কুখ্যাত দস্যুর দলে রয়েছ তুমি। খুন-জখম-লুণ্ঠন এ সব তো তোমাদের পেশা। তা হলে?
লোকটি বলল, হ্যা ঠিকই। তবে তোমার মতন মেয়ে আমি কখনও দেখিনি। তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তুমি কোনও ভদ্র ঘরের মেয়ে। কত কম বয়স তোমার। অথচ এই বয়সে যেন ভোজবাজির মতো হঠাৎ একটা ভেলকি লাগিয়ে দিলে। আমি বুঝতে পারছি তোমার হাতেই আমাদের নিয়তি। নারীশক্তির কাছে অসুরকেও হার মানতে হয়। তাই তোমার কাছেও আমাদের হার মানতে হবে। অত্যাচারী হিন্দোলসর্দার তোমার শক্তিতেই বধ হবেন।
শবনম বলল, তোমার নাম?
আমার নাম বিক্রমজিৎ।
তুমি কতদিন এই দলে আছ?
তা কম করেও দশ বছর।
তুমি পারবে ওই দল ছেড়ে আমার দলে চলে আসতে?
পারব। না পারা ছাড়া উপায় নেই। না হলে এখান থেকে শুধু হাতে ফিরে গেলে সর্দার আমাকে ছিঁড়ে খাবে। আমি তোমার দলেই থাকব।
তা হলে অবশ্য আমার সুবিধে হয়। তবে হ্যাঁ, আমি নিরীহ মানুষদের ওপর কোনও অত্যাচার করব না। কিন্তু মংঘীরাম ও হিন্দোলসর্দারকে আমি কাঁচা খাব। ওদের দু’জনকে শেষ করেই সাঙ্গ করব আমার হত্যালীলা। তারপর ওই অরণ্যদুর্গে হিন্দোলকেল্লা লুণ্ঠন করে ওই গুম্ফার কাছে আমি মন্দির-মসজিদ বানিয়ে আমার জীবন উৎসর্গ করব। একদিকে আমার এই তরুণ বন্ধুটি দেবী দুর্গার স্তোত্র পড়বে। অপর দিকে আমি পাঠ করব পবিত্র কোরান শরিফ। আর ও যদি থাকতে না চায়, তা হলে কোনও সাধুসন্ন্যাসীকে এনে আশ্রম করতে বলব এখানে। ব্যস। আমার কাজ শেষ। তোমরা যারা আমার কাছে থাকবে তাদের সঙ্গেই আমি হাতে হাত মিলিয়ে রক্ষা করব এই বনভূমিকে। আমরা কেউ না থাকলে এই অরণ্য আবার সমাজবিরোধীদের ঘাঁটি হয়ে উঠবে।
শবনমের নির্দেশে বিক্রমজিৎকে ছেড়ে দেওয়া হল।
পাহাড়িরা বিক্রমজিৎকে ওদের ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিকভাবে একটু শুশ্রূষা করল। তারপর ক্ষতস্থানগুলোতে দেশীয় প্রথায় কিছু গাছগাছড়ার রস লাগিয়ে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে একটু বেঁধেছেদে দিল। এরপর হিংলাজসর্দারের দাওয়ায় বসিয়ে পেট ভরে গুড় মুড়ি খাওয়ানো হল ওকে।
বিক্রমজিৎ এখানকার সকলেরই অত্যন্ত পরিচিত। কেন না এই পাহাড়জঙ্গলে হিন্দোলসর্দারের লোক হিসাবে অবাধ গতিবিধি ছিল ওদের। ওকদিন এই লোকের চেহারা দেখলেই গ্রামবাসীরা ভয়ে পালাত। আর আজ এমন ভাবে কালের চাকা ঘুরে গেল যে, সেই লোকই দাওয়ায় বসে অতিথি হয়ে ক্ষুধার খাদ্য গ্রহণ করছে।
খেয়েদেয়ে বিক্রমজিৎ আবার শবনমের কাছে এল। শবনম তখন ওর ঘর তৈরি দেখছে।
রঞ্জন তদারক করছে।
অন্যান্য পাহাড়িরা দলবদ্ধ হয়ে কেউ কাজ করছে, কেউ বা নজর রাখছে দুর্গের দিকে। হঠাৎ যদি সেদিক থেকে কোনও আক্রমণ আসে তাই।
বিক্রমজিৎ শবনমকে বলল, দেবী!
শবনম বলল, কিছু বলবে?
তোমার ঘোড়াকে আমিই খুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাইরে একটু দূরে একট বড় গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে এসেছি। নিয়ে আসব সেটাকে?
নিশ্চয়ই। ঘোড়ায় না চেপে আমার পক্ষে শুধু পায়ে হেঁটে দূর দূরান্তরে যাওয়া অসম্ভব। তুমি নিশ্চয়ই যাবে। শুধু ওই ঘোড়াটা নয় অন্যগুলোকেও যদি দেখতে পাও ধরে নিয়ে এসো।
অন্যগুলো ছাড়া পেয়ে ওদের ডেরাতেই ফিরে গেছে। ওই ঘোড়াটা বাঁধা ছিল। তাই ওটাকেই আমরা ফিরে পাব।
রঞ্জন বলল, ইতিমধ্যে ওই ঘোড়াটাকে কেউ খুলে নিয়ে যায়নি তো?
কে নিয়ে যাবে? আমরা যারা এখানে এসেছিলাম তাদের মধ্যে একমাত্র আমিই তো জীবিত আছি।
শবনম বলল, ঠিক আছে দাও।
বিক্রমজিৎ ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলল। তারপর আঁকাবাঁকা পার্বত্যপথে কিছুদূর গিয়ে একটি বড় পাথরের আড়ালে সেগুন গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে রাখা সেই সাদা ঘোড়াটাকে বাঁধন মুক্ত করেই লাফিয়ে তার পিঠে চড়ল। ঘোড়াও আর বিলম্ব করল না। বিক্রমকে পিঠে নিয়ে খটাখট শব্দ তুলে এগিয়ে চলল হিন্দোলকেল্লার দিকে।
পাহাড়িদের এই ছোট্ট বস্তিতে মুরগির অভাব ছিল না। কাজেই গরম ভাত আর মুরগির মাংস দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা দমভোর খেয়ে নিল ওরা। খাওয়া-দাওয়ার পর একটু বিশ্রামের জন্য ওদের নতুন পর্ণকুটিরে এল ওরা। খড় বিছিয়ে চাটাই পেতে সুন্দর বিছানা হয়েছে দুটো।
শবনম ও রঞ্জন দু’জনেই দু’পাশে শুয়ে পড়ল।
রঞ্জন বলল, মানুষকে বিশ্বাস করার ফল দেখলে তো? কেমন চমৎকারভাবে নিজেকে স্যারেন্ডার করিয়ে আবার ব্লাফ মেরে পালাল লোকটা।
শবনম বলল, ও যে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে তা কিন্তু ভাবতেই পারিনি। ওই জন্যেই এই ধরনের ক্রিমিন্যালদের বাঁচিয়ে রাখতে নেই। শত্রুকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দেবার ফল কী ভয়ংকর।
তবে আমার মনে হয় আমাদের শত্রুপক্ষ যে কোনও কারণেই হোক খুব ভয় পেয়ে গেছে।
কী করে বুঝলে?
প্রথমত, কাল রাতের ওই আঘাত ওদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আজ সকালে সশস্ত্র কিছু লোককে আমাদের সন্ধানে পাঠিয়েও ওরা পরাস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে এলাকার পাহাড়িরা ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বলে। যে মানুষগুলো একদিন ওদের দেখলে বাঘের মতো ভয় পেত, সেই মানুষগুলিই আজ সব ভয়ভীতি ভুলে এমনভাবে মারমুখী হয়েছে যে আর কখনও এদের কবজা করা ওদের পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হয়েছে। এইবার এই এতগুলি মারমুখী মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ওদের ঘাঁটি আগলানো প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো।
তা হলে?
তা হলে আর কী। ওরা প্রকাশ্য দিবালোকে তো আসবে না। গভীর রাতের অন্ধকারে আচমকা ওদের মেশিনগান বা রাইফেল ব্যবহার করে পুরো বস্তিটার ওপর হামলা চালাবে। তারপর ওই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর এলাকা ছেড়ে চলে যাবে কিছু দিনের জন্য। প্রাচীনকালের সেই অসুরও যেমন ওই গুহার জঠরে তার সর্বস্ব জমা রেখে বরাবরের জন্য চলে গিয়েছিল, এদেরও সেই অবস্থাই হবে।
কিন্তু তোমার কথাই যদি সত্যি হয়, তা হলে তো রীতিমতো ভয়ের ব্যাপার। আমাদের উসকানিতে মেতে ওঠার ফলে এই সব অসহায় মানুষগুলোর মৃত্যুর জন্য আমরাই তো দায়ী হব।
এইটাই আমার ভয়। তা ছাড়া আমাদের এখন উভয় শত্রু। একদিকে মংঘীরাম, অপর দিকে হিন্দোলসর্দার। এই উভয় প্রতিপক্ষকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে আমাদের।
কিন্তু কীভাবে?
রঞ্জন! তুমি একটু জেগে থাকতে পারবে? আমার বড় ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমব। দুপুরটা গড়িয়ে গেলেই আমাকে ডেকে দেবে কিন্তু। আমি চুপি চুপি একটা বড় গাছের ডালে বসে সারা রাত জেগে বন্দুক নিয়ে পাহারা দেব এদের।
রঞ্জন বলল, ঠিক বলেছ। না হলে যে কোনও মুহূর্তে একটা বিপদ ঘটে যেতে পারে। তুমি ঘুমোও। আমি জাগছি। ইতিমধ্যে মংঘীরামের কাছ থেকে কেউ যদি আসে তোমাকে ডাকব কি?
মংঘীরামের কাছ থেকে কেউ কোনওদিনই আসবে না রঞ্জন। ওদের টাকা এত সস্তা নয় যে আমি চাইলেই দিয়ে দেবে ওরা। মংঘীরামের কাছ থেকে টাকা চেয়ে পাব না। জোর করে আদায় করতে হবে।
রঞ্জন অবাক চোখে চেয়ে রইল শবনমের মুখের দিকে। কী সুন্দর ফুলের মতো মেয়েটি। কিন্তু ওর এই সৌন্দর্যের মধ্যেও অমন খুনের নেশা কোথায় কোন গোপনে ঘুমিয়েছিল? তা ছাড়া এমন প্রখর বুদ্ধি, এমন ভয়ানক দুঃসাহস ওর কী করে হল?
রঞ্জন বলল, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও শবনম। আমি তো আছি। তুমি ঠিকই বলেছ, আমাদের রাত জেগেই পাহারা দিতে হবে।
শবনম সেই খড়ের শয্যায় হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। শোয়ামাত্রই ঘুম ঘুম ঘুম।
রঞ্জন নিদ্রিত শবনমের মুখের দিকে অপলকে চেয়ে রইল। শবনমকে এই মহারণ্যে ফেলে রেখে ও কী করে ফিরে যাবে নিজের দেশে? শবনম ফুলনদেবী হবে, পাহাড়-বনের রানি হবে। কিন্তু তার সঙ্গে ওর যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, সেটাকে সে কাটিয়ে উঠবে কেমন করে? তাই আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে যে ভাবেই হোক বুঝিয়েবাঝিয়ে ভুলিয়েভালিয়ে শবনমকে প্রকৃতিস্থ করে আবার শহর-সভ্যতার সংস্পর্শে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার।
রঞ্জন অনেকক্ষণ ধরে নিজের মনের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করে ঠিক করল কাল সকালেই ওরা ফিরে যাবে এখান থেকে। রঞ্জন শবনমকে নিয়ে ওদের বাড়িতেই গিয়ে উঠবে। শবনমের আপত্তি না থাকলে সে থাকবে ওদেরই কাছে। যেই না মনে হওয়া অমনি আনন্দে উত্তেজনায় বুক ভরে উঠল রঞ্জনের। এত সহজে যে জিনিসের মীমাংসা হয়ে যায় তার জন্য এত ভাবনাচিন্তার কোনও প্রয়োজন ছিল কি? রঞ্জন একবার ঝুঁকে পড়ে দেখল শবনমকে। তারপর খুব আলতো করে ওর কপালে একটু হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ মেলল শবনম। একবার ঝেড়ে উঠে বসেই বলল, কী হল রঞ্জন! ভয় পেলে? না।
তাই ভাল। তারপর মৃদু হেসে বলল, হঠাৎ এত আদরের ব্যাপার কী? আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি।
কী সিদ্ধান্ত বলো?
ভাবছি এইসব ঝামেলায় আর নিজেদের না জড়িয়ে কাল সকালেই চলে যাই চলো।
কোথায়?
যেখান থেকে এসেছি সেখানেই।
শবনম হঠাৎ কীরকম দপ করে জ্বলে উঠল। বলল, তুমি কী করে ভাবলে যে আমি আমার আব্বাজানের হত্যাকারীদের বদলা না নিয়ে ফিরে যাব? তা ছাড়া এই মুহূর্তে আমরা আমাদের আদর্শচ্যুত হয়ে চলে গেলে এই পাহাড়িদের অবস্থাটা কী হবে তা একবার ভেবে দেখেছ? মংঘীরাম আর হিন্দোলসর্দারের লোকেরা বিদ্রোহী হওয়ার অপরাধে এদের পিঠের চামড়া ছাড়িয়ে নেবে। এই সহজ সরল নির্বোধ মানুষগুলোকে অসহায় ভাবে শত্রুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা চলে যাব? তুমি যাও রঞ্জন। কাল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই এই এলাকা ছেড়ে চলে যাও তুমি। আমার কাজ আমাকে করতে দাও।
রঞ্জনের চোখদুটো ছল ছলিয়ে উঠল। বলল, তুমি আমায় ভুল বুঝলে শবনম। তোমাকে ছেড়ে যাবার হলে আমি কি এতটা সময় থাকতাম তোমার কাছে? আমি কি পারতাম না সেই গোবিন্দজির মন্দিরে আমার নিজের ব্যবস্থাটা করে নিতে? শুধু তোমার অসহায়তার কথা ভেবেই তো আমি আমার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে গুহাবাসী হলাম। আর তুমিই কি না আমাকে চলে যেতে বলছ? ঠিক আছে, বদলা নিয়েই না হয় যাব আমরা। শবনম! জেনে রেখো, আমি এক সদ্বংশজাত ভদ্র পরিবারের ছেলে। এবং নেহাত বালকও নই! সত্যের জন্যে, ধর্মের জন্যে এবং তোমার জন্যে আমি জীবনও দিতে পারি।
শবনম মাথা নত করে বলল, তুমি আমাকে ক্ষমা করো রঞ্জন। আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। তবু তুমি নিজেই একবার ভেবে দেখো, যে কথাটা তুমি বললে সেটা নিছক স্বার্থপরের মতো কি না?
কতকটা তাই। তবে এই বদলা নেওয়ার কাজটা পুলিশকে দিয়েও করানো যেত।
যেত না। কিছু কিছু কাজের জন্য জনসাধারণকেও এগিয়ে আসতে হয়। পুলিশকে দিয়ে সব কাজ যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যেত, তা হলে এদেশে এত কড়াকড়ির মধ্যেও মংঘীরাম ও হিন্দোলসর্দারের অত্যাচার প্রাধান্য পেত না। এখানকার এই দুই প্রধান শত্রুর মোকাবিলা না করে আমরা ফিরতে পারি না রঞ্জন। এতে পাহাড়িদের প্রতি আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।
রঞ্জন বলল, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছ। আমি আমাদের দিকটাই চিন্তা করেছিলাম, কিন্তু এদের কথাটা ভাবিনি।
এমন সময় কয়েকজন পাহাড়ি ছুটে এসে বলল, দেবীজি! পাহাড়ের নীচের দিক থেকে কিছু লোক আমাদের এই দিকে আসছে। ওদের হাতে বন্দুক ভি আছে।
ওরা কারা?
মালুম নেহি। তবে মনে হচ্ছে পুলিশের লোক।
ওরা কতজন আছে বলতে পারো?
তা বিশ-পঁচিশজন তো হবেই।
রঞ্জন আর শবনম পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।
রঞ্জনের বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল ভয়ে। কিন্তু শবনম বেপরোয়া। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে বলল, বুঝেছি। মংঘীরাম আমার সঙ্গে দোস্তি নয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসছে। তবে আমিও খোদাতালার নাম নিয়ে বলছি ওদের একটাকেও আমি ফিরে যেতে দেব না। আমি জানি ওরা কারা। ওরা কখনওই পুলিশের লোক নয়।
পাহাড়িরা বলল, কিন্তু দেবী। একা আপনি লড়বেন কী করে ওদের সঙ্গে? ওরা বিশ-পঁচিশ জন। আপনি একা। আমরা কেউ যুদ্ধ জানি না। বন্দুকের চেহারা দেখেছি। কিন্তু বন্দুক চালাবার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।
শবনম তখন রুখে দাঁড়িয়েছে।
আবার যেন এক প্রেতিনী ভর করল তার ওপর। বজ্রমুষ্ঠিতে বন্দুক ধরে বলল, ঠিক আছে। তোমরা একটু বালবাচ্চা নিয়ে সাবধানে থেকো। পারো তো কাছেপিঠে কোনও গুহাটুহা থাকলে লুকিয়ে পড়ো সেখানে। সন্ধে হয়ে আসছে। আর দেরি কোরো না। যাও। রঞ্জন তুমিও যাও ওদের সঙ্গে।
রঞ্জন শবনমের একটা হাত শক্ত করে টিপে ধরে বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে শবনম? একা তুমি অতগুলো লোকের সঙ্গে লড়বে কী করে? চলে এসো। ওরা এখুনি মেরে ফেলবে তোমাকে।
শবনম বন্দুকে টোটা পুরে বলল, রঞ্জন! আমার জন্যে চিন্তা কোরো না। শুধু জেনে রেখো, যে মানুষ মরতে চায় তার মরণ হয় না। তাকে মারতে কেউ পারে না। মরে তারাই যাঁরা বাঁচবার জন্যে হাঁকপাঁক করে। তবে হ্যাঁ, এ কাজে ঝুঁকি আছে। তাই তোমাকে সঙ্গে নিচ্ছি না। তুমি ওদের সঙ্গে যাও।
না। তোমাকে আমি ছাড়ব না। মরলে দু’জনেই একসঙ্গে মরব।
এমন সময় হিংলাজসর্দার এগিয়ে এসে বলল, এ লড়াই বাঁচার লড়াই। আমরাও তোমাদের একা ছাড়ব না। তোমাদের এই দুই নাবালক ছেলেমেয়েকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা কি চুপচাপ বসে থাকব ভেবেছ? তোমরা যদি আমাদের জন্য জীবন বিপন্ন করতে পার, তা হলে আমরাই বা নিজেদের জন্যে লড়তে পিছব কেন? শুধু ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়ে এসো আমরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
আর একজন বলল, ঠিক। সর্দার যা বলেছে তা ঠিক। অনেক মার খেয়েছি আমরা। আর মার খাওয়া নয়। এবার আমরা পালটা মার দেব। কেউ পালাব না এখান থেকে। মরলে সবাই মরব একসঙ্গে। আজ রাতের অন্ধকারে হয় ওরা মরবে, নয়তো আমরা শেষ হয়ে যাব। আমরা জানি ওরা কী করবে। ওরা আমাদের ঘরে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেবে। দিক। আমাদের একজনও যদি বাঁচি তা হলে ওই আগুনকে দাবানল করে ছড়িয়ে দেব চারদিকে।
কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তির, কাঁড়া, বল্লম, কুডুল হাতে হাতে চলে এসো সব।
শবনম বন্দুকের নল শূন্যে উঁচিয়ে একটা শব্দ করল। আর সেই শব্দের সঙ্গে হই হই করে উঠল আরণ্যকরা।
সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, জয় দেবী ভয়ংকরীর জয়। আমাদের অরণ্যদেবী অমর রহে।
রঞ্জন বন্দুক চালাতে না পারলেও সঙ্গে নিয়েছে একটা।
অদূরে হিন্দোলকেল্লার মাথায় একটা মশালও জ্বলতে দেখা গেল। সেই মশাল নেড়ে কে যেন কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে কি বন্দুকধারী ওই যোদ্ধারা মংঘীরামের লোক নয়? এরা কি হিন্দোলসর্দারেরই সৈন্যবাহিনী? সব যেন কীরকম জট পাকিয়েছে যাচ্ছে।
পাহাড়ের নীচে আর পাহাড়ের চূড়ায় এই দুই ঘোড়েল শয়তানকে জব্দ করা বড়ই কঠিন ব্যাপার। তবুও সাহসে বুকবেঁধে ওরা এগিয়ে চলল সন্তর্পণে। পা টিপে টিপে। বাঘিনী যেভাবে তার শিকারের দিকে এগোয় ঠিক সেইভাবে শবনমও এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে।
এক জায়গায় বড় একটি পাথরের আড়ালে এসে থামল শবনম।
ওই তো দূরে পাহাড়ের ঢালে দেখা যাচ্ছে লোকগুলোকে। দেখে মনে হচ্ছে ওরা পুলিশেরই লোক। কিন্তু মংঘীরাম এত তাড়াতাড়ি পুলিশকে ফিল্ডে নামাবে কী করে? এরা নকল-পুলিশ নয় তো? তা ছাড়া হিন্দোলকেল্লার মাথায় ওই মশালের আলো কীসের বার্তা বহন করছে? কোনও কিছুই বোঝা যাচ্ছে না এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে।
শবনম সকলকে বলল, তোমরা যে যার সুবিধামতো বড় বড় গাছের ডালপালায় লুকিয়ে থাকো। ওদিক থেকে বাধা না পেলে বা আমি না বললে কাউকে আক্রমণ করো না।
নীচের লোকগুলি বন্দুক উঁচিয়ে এমনভাবে এগিয়ে আসছে যে, মনে হচ্ছে রাতের অন্ধকার না হলে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে না।
কিন্তু মুশকিলটা হল এই যে, এই সন্ধ্যার ধূসর যবনিকায় ওরা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে। ওদের ছায়া ছায়া কালো কালো মূর্তিগুলো এক সময় আর দেখাই গেল না। তবে এটুকু বেশ বুঝতে পারা গেল যে ওরা আসছে— আসছে— আসছে।
ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে শিকারি বাঘের মতো থাবা উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে ওরা।
শবনম কিছুতেই ভেবে পেল না, এই মুহূর্তে তার করণীয় কী? এদিকে পাহাড়িরাও আসন্ন যুদ্ধের মোকাবিলা করবার জন্য দারুণভাবে মরিয়া। আসলে সুপ্ত চেতনা জাগরিত হলে যা হয় আর কী? তবে ওরা শুধু আদেশের অপেক্ষায় আছে। কতক্ষণে ওদের দেবী একবার শুধু বলবে ‘মারো’। কিন্তু শবনম তো এখনি সে কথা বলতে পারে না। কেন না যদি এরা সত্যিই পুলিশের লোক হয়।