দুই
শবনম বলল, চমৎকার জায়গা। এই গভীর জঙ্গলে গুহার আশ্রয়ের কাছে ধর্মশালার ওই ঘর কোথায় লাগে। এখন এসো সর্বাগ্রে দু’জনে মিলে এর ভেতরটা পরিষ্কার করে ফেলি।
রঞ্জন তক্ষুনি গুহার বাইরে গিয়ে কয়েকটি আগাছা উপড়ে এনে ঝাঁট দিতে শুরু করল। সে কাজে শবনমও হাত লাগাল বইকী। তারপরে দু’জনে ঘাসপাতা ইত্যাদি নিয়ে এসে মেঝের পাথরের ওপর বিছাল। কেন না একেবারে কঠিন পাষাণের বুকে তো শোয়া যায় না।
এরপর দু’জনে আশপাশে ঘুরে হঠাৎ এক জায়গায় ছোট্ট একটি ঝরনা আবিষ্কার করল।
রঞ্জন উল্লসিত হয়ে উঠল ঝরনা দেখে। বলল, এখানে স্নান এবং খাবার জলের সমস্যাটা মিটে গেল।
শবনম বলল, তাই তো। দাঁড়াও, কিছুটা জল ওই শূন্য বোতল গুলোয় ভরে রাখি। বলে গুহার ভেতর থেকে দুটি বোতল এনে জল ভরল। তারপর সেগুলো রেখে এসে বলল, একটু স্নান করতে পারলে শরীরটা ঝরঝরে হত। কিন্তু গা মুছব কীসে?
রঞ্জন বলল, একটু পরেই তো আমরা খেতে যাব। অমনি দুটো গামছা কিনে আনব। আর এই ঘাসপাতায় বিছোবার জন্যে একটা শতরঞ্জি।
শবনম বলল, সেই সঙ্গে দেশলাই, মোমবাতি সম্ভব হলে একটা কেরোসিনের কুপি অথবা হ্যারিকেনও নেওয়া যেতে পারে। টর্চ তো আছেই সঙ্গে। আর তার সঙ্গে রাতের খাবার। ঠিক বলেছ।
শুধু তাই নয়, কালকের জন্যেও কিছু দোকান বাজার করে আনব। সম্ভব হলে এই জঙ্গলেই পিকনিকের মতো নিজেরা রেঁধে খাব আমরা। দি আইডিয়া।
তারপর বেলাবেলি ফিরে এসে গুহার মুখটাকে বন্ধ করবার চেষ্টা করব। করতেই হবে। না হলে নির্ঘাত বাঘের পেটে যাব। কাছেই যখন ঝরনা, তখন বুনো জন্তুর দল ওখানে জল খেতে আসবেই। সেই সময় মানুষের গন্ধ পেয়ে যদি কেউ ঢোকে তো ব্যস। কেল্লা ফতে করে ছেড়ে দেবে।
ওরা আবার বনভূমির পথ ধরে নদী পার হয়ে এপারে এল। তারপর প্রথমেই ওরা নিকটবর্তী পোস্ট অফিসে গিয়ে ট্রাঙ্ককল করল শবনমের বাড়িতে।
শবনমের চাচাজি বললেন, এইমাত্র রেডিয়ো সংবাদটা শুনেছেন তিনি। শবনমকে একটু সাবধানে থাকতে বললেন, ডেড বডি আনার ব্যাপারে ঝামেলা অনেক। কেন না এখন তিনি ইচ্ছে করলেও ঘটনাস্থলে যেতে পারবেন না। তবে যদি কোনও উপায়ে কিছু করা সম্ভব হয় তো তিনি তা করবেনই। রিসিভার নামিয়ে রেখে শবনম ছলছল চোখে রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন আমার জীবনে একমাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ নেই রঞ্জন।
রঞ্জন ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। আল্লার মরজি। এই পোস্ট অফিস থেকেই রঞ্জন ওর বাড়িতে এবং দিদির বাড়ি সম্বলপুরে দুটো টেলিগ্রাম করে ওর কুশলবার্তা জানিয়ে দিল।
এবার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্তর যা যা দরকার সব কিছু একটা ঝোলা ব্যাগ কিনে তাতে রাখল। তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে ফেরার সময় একটা বেশ ধারালো কাটারিও কিনল রঞ্জন।
শবনম অবাক হয়ে বলল, এটা দিয়ে তুমি কী করবে?
এটা আমাদের আত্মরক্ষার হাতিয়ার। তা ছাড়া বনের কাঠ কাটতে এরকম একটা কিছুর তো খুবই দরকার। তাই নিলাম।
ওরা যেন একটা নতুন পরিবেশে থাকবার আনন্দে বিভোর হয়ে সেই গুহার দিকে এগিয়ে চলল।
এই অল্প সময়ের মধ্যেই শবনম নিজের মনকে খুব শক্ত করে বেঁধে নিল। আব্বাজানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ওর সমস্ত স্নেহমমতা এবং মায়াবন্ধনের দরজা রুদ্ধ হয়েছে। এখন ৩.। মনে হচ্ছে আর শহরে নয়, এই ঘন অরণ্যের বুকে গুহাবাসী হয়ে ওর এই কিশোর সঙ্গীটিকে নিয়ে যদি দিনের পর দিন কাটাতে হয়, তাতেও সে রাজি! চাচা-চাচির নিষ্ঠুরতার বলি সে হতে চায় না। অবশ্য আল্লার দোয়ায় এমনিতেই কারও মুখাপেক্ষী তাকে হতে হবে না। আব্বাজান যা রেখে গেছেন ওর জন্যে, তাতে সারা জীবন কোনও কিছু না করলেও খাবার অভাব হবে না ওর। কিন্তু মনে মনে স্বপ্ন দেখলেও বরাবরের জন্য তো এই অরণ্যবাস সম্ভব নয়। শবনম তার সব কিছু হারালেও রঞ্জনের তো সবাই আছে। ঘরের ছেলে ও ঘরে। তো ফিরতেই হবে ওকে।
যাই হোক। কিছু সময়ের মধ্যেই জঙ্গলের গভীরে সেই গুহার কাছে চলে এল ওরা।
গুহার ভেতরটা অন্ধকার। ছোট্ট একটা চিমনি জ্বেলে সেই অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর ব্যবস্থা করা হল। শবনম রঞ্জনের কাঁধ থেকে ঝোলা ব্যাগটা নিয়ে একপাশে রেখে, পুরু করে পেতে রাখা সেই ঘাসপাতার ওপর শতরঞ্জিটা বিছিয়ে, টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল একবার।
রঞ্জন বলল, কী ব্যাপার! শরীর খারাপ করছে নাকি?
না। বড় ক্লান্ত। ঘুম পাচ্ছে।
ঠিক আছে। তুমি বিশ্রাম করো। আমি ততক্ষণে একটু চেষ্টা করে দেখি কীভাবে এই গুহার মুখটাকে আটকানো যায়।
শবনম শুয়ে থেকেই বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে লাফিয়ে উঠল, ওঃ হো। এখন তো বিশ্রামের সময় নয়। তুমি একা কেন, এসো আমরা দু’জনে মিলেই হাত লাগাই।
রঞ্জন বলল, এসো তবে।
প্রথমেই ওরা শুকনো কাঠকুটো যা কিছু পারল সব এনে জড়ো করল গুহার ভেতর। তারপর বয়ে আনা যায় এমন বড় বড় পাথর জড়ো করে গুহার মুখটাকে সংকীর্ণ করে ফেলল। এবার জঙ্গলের শক্ত মোটা গাছের ডাল এনে সেগুলো গুহামুখে আটকে এমন একটা ঘর সৃষ্টি করল যে, একমাত্র সাপ আর ইঁদুর ছাড়া কারও সাধ্য নেই এর ভেতরে ঢোকে।
দু’জনের অক্লান্ত পরিশ্রম সন্ধের মধ্যেই হয়ে গেল সব কিছু। এবার গুহার ভেতরে বসে দীর্ঘরাত্রির অবসানের প্রতীক্ষা করা।
চিমনি লণ্ঠনের আলোটা উসকে দিয়ে ওরা নিজের জিনিসগুলো গোছগাছ করতে লাগল।
রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেই এনেছে ওরা। পাঁউরুটি, কলা, বিস্কুট, মিষ্টি সব কিছুই আছে। খাবারের জন্য জলও আছে দু’বোতল ভরতি।
গুহার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে শবনম পাদুটো লম্বালম্বি ভাবে ছড়িয়ে উদাস হয়ে বসে রইল। রঞ্জনও ঠিক ওই একইভাবে বসে রইল ক্লান্ত দেহ নিয়ে। দুই শহরবাসী কিশোর কিশোরীর দৈব দুর্ঘটনায় এই অরণ্যবাস অভূতপূর্ব। রঞ্জন বলল, তুমি নিয়তি মানো শবনম?
মানি বইকী।
একদিন আগেও আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না।
এখন তো চিনেছি।
তোমার ভয় করছে না তো?
উ হুঁ। ভয় করবে কেন? আসলে আমাদের জীবনে
ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনা নাঘটলে এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা কি হত আমাদের? এই ঘন অরণ্যের গভীরে একটি গুহার ভেতরে পরম নিশ্চিন্তে এইভাবে বসে থাকা কি কখনও সম্ভব হত?
না। তা অবশ্য হত না।
এই উদাহরণ তোমার কাছে কেমন লাগছে রঞ্জন?
অপূর্ব। আমার কী মনে হচ্ছে জানো?
কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে আমার কোনও অতীত বলে কখনও কিছু ছিল না, মনে হচ্ছে আমি যেন প্রকৃতই এই গুহারই বাসিন্দা।
আশ্চর্য! ঠিক ওইকথাই আমারও বার বার মনে হচ্ছে। আরও কী মনে হচ্ছে জানো? কী?
মনে হচ্ছে এই গুহা ছেড়ে কখনও আর শহরের চার দেওয়ালের ঘরে যেন ফিরে না যাই। আমার তো সর্বস্ব গেছে। আর একাও থাকতে পারব না। তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকতে রঞ্জন, তা হলে সারা জীবন আমি এই জঙ্গলে গুহার ভেতরে কাটিয়ে দিতে পারতাম। প্রকৃতির বুকে এমন নিবিড় শান্তির স্বর্গ যে রচনা করা যায়, তা এখানে না-এলে অনুভবই করতে পারতাম না।
রঞ্জন কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, আচ্ছা শবনম, একটা কাজ করলে হয় না? আমরা যদি ইচ্ছে করেই কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাই, তা হলে কেমন হয়?
শবনমের চোখদুটো চকচকিয়ে উঠল।
রঞ্জন বলল, নতুন করে আবার কখনও আসা হয়তো হয়ে উঠবে না। কিন্তু এসে যখন পড়েছি, এই গুহার ভেতরে নিজেদের ঘর নিজেরাই যখন তৈরি করে নিয়েছি, তখন থেকেই যাই না কিছুদিন।
শবনম বলল, আমি রাজি। যে বাড়িতে আমার আব্বাজান নেই, সে বাড়িতে ফিরতে আমার মন একটুও চাইছে না রঞ্জন। এখানে তবু তুমি আছ বলে বহু কষ্টে আমার বুকটাকে বেঁধেছি। কিন্তু কলকাতায় ফিরে গেলে আমি পাগল হয়ে যাব।
রঞ্জন বলল, তবু ফিরতে তো হবেই।
জানি। কিন্তু তাড়াতাড়ি নয়। তুমি আমার জীবন রক্ষা করেছ। আমার এত বড় বিপদে আমার পাশে আছ। নিজের স্বার্থত্যাগ করেও আমাকে নিয়ে এই গুহায় এসে কত কষ্ট করছ। এখন তুমিই আমার সব। তাই তুমি থাকলে আমি থাকব। তুমি গেলে আমাকেও যেতে হবে। একা তো এই বনের ভেতরে থাকা যায় না। তাই, যদি পার তো কিছুদিন থেকেই যাও এখানে।
রঞ্জন হেসে বলল, থাকব। তা ছাড়া সত্যি বলতে কী, আমার কোনও বোন বা বান্ধবী নেই। আর তোমার মতন এত ফর্সা, এত স্মার্ট মেয়েও আমি কখনও দেখিনি। এই সারাদিনে তোমার ওপর আমার অনেক মায়া পড়ে গেছে। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না শবনম, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার মন কেমন করবে।
শবনমের চোখদুটি জলে ভরে এল। বলল, সত্যি বলছ?
রঞ্জন ওর কাঁধের ওপর হাত বলল, তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। তারপর বলল, আমি এখনও স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করিনি। সামনের বছর ফাইনাল দেব। আমি যদি বড় হতাম নিজের পায়ে দাঁড়াতাম, তা হলে তোমার সব দায়িত্ব আমি নিয়ে নিতাম। হিন্দু-মুসলমানের কোনও ভেদাভেদ আমার মধ্যে নেই। কিন্তু আমার মা-বাবা আছেন। তাঁরা কীভাবে নেবেন তোমাকে? তুমি যদি মুসলমান না হতে, তা হলে তোমাকে আর পার্ল স্ট্রিটের বাড়িতে তোমার চাচা-চাচির সঙ্গে থাকতে যেতে হত না। আমি ঠিক তোমাকে নিয়ে হাজির হতাম আমাদের বাড়িতে। এখন থেকে তুমি আমার কাছেই থাকতে পারতে। কিন্তু তা যে হবার নয়। আমি সংস্কারমুক্ত হলেও তাঁরা হবেন কেন?
শবনম রঞ্জনের একটি হাত স্নেহভরে ওর বুকে নিয়ে বলল, আচ্ছা রঞ্জন, আমি যদি হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে হিন্দু হয়ে যাই? তা হলে তোমার মা-বাবা পারবেন না আমাকে তোমার কাছে থাকতে দিতে?
রঞ্জন বলল, কিন্তু আমাদের ধর্মের যে গোঁড়ামি অনেক। হিন্দু থেকে মুসলমান হওয়া যায়, কিন্তু মুসলমান থেকে হিন্দু হওয়া যায় কি না আমি জানি না। কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেল। দু’জনে রাতের খাওয়া সেরে আলো নিভিয়ে সেই গদির মতো তৃণশয্যায় রেখে শুয়ে পড়ল চুপচাপ।
রাত তখন কত তা কে জানে? শবনমের ঠ্যালা পেয়ে ঘুম ভাঙল রঞ্জনের। আর ঘুম ভাঙতেই শুনতে পেল বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ। মশালের আলোর আভাও সংকীর্ণ গুহামুখ দিয়ে ফুটে উঠল।
রঞ্জন বলল, নিশ্চয়ই কোনও দুষ্কৃতীর দল এসে জুটেছে এখানে।
আমার ভয় করছে রঞ্জন।
রঞ্জনের মুখও ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বোকার মতো এখানে আশ্রয় নেওয়াটা খুবই কাঁচা কাজ হয়েছে। চোরডাকাত প্রভৃতি দুষ্কৃতকারীদের আড্ডার জায়গাই হল এই সব পরিত্যক্ত গুহা। এখন ওরা যদি ওদের ঘাঁটি দখল করতে আসে? তা হলে সমূহ বিপদ। রঞ্জন নিজের জন্য চিন্তা করছে না। ভয় ওর শবনমকে নিয়ে। ওর সুন্দর মুখশ্রী এবং গায়ের রং সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এখন ওরা এই রাতে যদি গুহা দখল করে, তা হলে শবনমকে রক্ষা করা দুষ্কর হয়ে পড়বে ওর পক্ষে।
শবনম ভয়ে ভয়ে বলল, কী হবে রঞ্জন?
রঞ্জন কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। বলল, ভেঙে পড়ো না। দেখাই যাক না ওরা কী করে। তুমি এক কাজ করো, গুহামুখের দেওয়ালের কোণে একেবারে লেপটে থাকো। যদি ওরা ঢোকে তা হলে আমি আগে মোকাবিলা করব ওদের। বলেই ঘাসপাতার বিছানা থেকে শতরঞ্জিটা তুলে ওর হাতে দিয়ে বলল, তুমি এটা মুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকো। যাও।
তুমি?
আমি এখানেই থাকব। এমন ভান দেখাব যেন আমায় জোর করে কেউ এখানে আটকে রেখে গেছে।
রঞ্জনের কথামতো তাই করল শবনম। শতরঞ্জিটা সর্বাঙ্গে মুড়ি দিয়ে গুহামুখের একপাশে অন্ধকার কোণে লুকিয়ে রইল।
একটু পরেই ওরা যা আশঙ্কা করেছিল তাই হল। বাইরে থেকে গম্ভীর গলায় একটা হাঁক শোনা গেল, অন্দরমে কৌন হ্যায় রে। জলদি বাহার নিকালো। রঞ্জন কোনও সাড়া শব্দ না দিয়ে চুপ চাপ বসে রইল।
ওদিক থেকে তখন কাঠের আটকান ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে।
রঞ্জনও এক-পা দু’-পা করে পিছু হটতে লাগল। আর পথ নেই। দেয়ালের শেষপ্রান্তে ঠেস দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে। কাটারিটা এই অন্ধকারে কোথায় রয়েছে কে জানে? সঙ্গে থাকলে ভাল হত। কেউ আক্রমণ করলে সমুচিত শিক্ষা দিত তাকে।
কাঠের আগল ভেঙে দু’-এক ধাপ পাথর সরাতেই একজন লোকের গলে ঢোকার মতো পথ হয়ে গেল।
রঞ্জন সবিস্ময়ে দেখল মাথায় পাগড়ি, অর্ধেক মুখ কাপড়ঢাকা বন্দুকধারী একজন ভেতরে ঢোকার জন্য মাথা গলাল। শরীরের অর্ধেক ঢুকেছে কি নাঢুকেছে হঠাৎ দেখা গেল মাথাটি তার খসে পড়ল ধর থেকে। রঞ্জন শিউরে উঠল। এ কী করল শবনম ! এমন কাঁচা কাজ কেউ করে? বাইরে ওরা কতজন আছে-না-আছে তা কে জানে? যদি ওরা টের পায়? রঞ্জন ছুটে এসে লোকটার হাতদুটো ধরে হিড় হিড় করে টানতেই পুরো দেহটা ভেতরে চলে এল। কয়েকটি পাথরও ধসে পড়ল দুড়দাড় করে। তার পর দেহটা এক ধারে সরিয়ে রেখে বন্দুকটা ছিনিয়ে নিল সর্বাগ্রে।
শবনম বলল, তুমি বন্দুক ছুড়তে পার?
না।
তা হলে ওটা নিয়ে কী করবে?
ওদের ভয় দেখাব।
শবনম হেসে বলল, তা হলেই হয়েছে। দাও ওটা আমাকে দাও। আর বন্দুক চালানো কাকে বলে চেয়ে দেখো।
তুমি পার রাইফেল শুটিং করতে?
পারি বলেই তো মুণ্ডুটা ওর নামিয়ে
কিন্তু মৌচাকে ঢিল ছুড়লে তো?
দিলাম।
তা ছুড়লাম। যাক, তুমি কি কাটারিটা নেবে?
নেব! আমি ভেবেই পাচ্ছি না কোন ফাঁকে কাটারিটা তুমি নিলে।
বাইরে থেকে তখন হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে, আরে এ শম্ভু ভেইয়া। কা ভৈল? খানিক বাদেই মস মস জুতোর শব্দ। এ লোকটিও আগের লোকটির মতো মাথা গলাতেই রঞ্জনের কাটারির ঘা পড়ল তার ঘাড়ের ওপর। অনভ্যস্ত হাত। তাই এক কোপে বিচ্ছিন্ন হল না। লোকটি যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল।
রঞ্জন ওই অবস্থাতেই লোকটিকে ঢোকাল ভেতরে। সেই যন্ত্রণার দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। শবনম একটুও দেরি না করে ওর বুকের বাঁদিকে একটা গুলি করল।
বাইরে থেকে একজনকে বলতে শোনা গেল, আরে বাঃ। এ জাদু গুল্ফা হো গিয়া ক্যা। যো অন্দর মে ঘুসতা ও বাহার নেহি নিকাল তা।
আর একজন কে বলল, চোপ রহো বুরবাক কাহাকা। অন্দরমে গোলি কা শব্দ শুনা?
আর একজন বলল, হাঁ হুঁ৷ শুনা। আভি চলো, ভাগো হিয়াসে। জরুর কুছ গড়বড় হো গিয়া হোগা।
কিন্তু ভাগবে কী? গুহার ভেতর থেকে শবনমের বন্দুক তখন গর্জে উঠেছে ‘ডিস্যুম ডিস্যুম’।
দু’-দুটো তাজা প্রাণ লুটিয়ে পড়ল মাটির বুকে। ঘোড়াগুলো চিঁহি-হি-হি শব্দ করে ঊর্ধ্বপদ হয়ে লাফিয়ে উঠল একবার। কয়েকজন অশ্বারোহীর পলায়নের শব্দও শোনা গেল।
শবনমের কীর্তি দেখে রঞ্জন স্তব্ধ হয়ে গেল। এমন সুন্দর কান্তি যার, যার মুখের দিকে তাকালে স্বর্গের সুষমা অনুভব করা যায়, তার হাতে এমন মৃত্যুমাদল কী করে বেজে উঠল? তাই ভয়ে ভয়ে বলল, এবার আমরা কী করব?
শবনমের চেহারাটাই তখন অন্যরকম হয়ে গেছে। কী দারুণ তেজ ওর শরীরে। কে বলবে ও একটি সদ্য পিতৃহারা কিশোরী মেয়ে। ওর দিকে চোখ মেলে তাকাতেও এখন ভয় করল রঞ্জনের।
শবনম একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল, এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় কিছু নেই যদিও, তবুও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
এই ডেড বডি দুটোর কী হবে?
দুটো তো ভেতরে। বাইরে আরও দুটো আছে। এখন এই রাতে যে যেখানে আছে সে সেখানেই থাকুক।
কিন্তু ওরা যদি একটু পরে দলবল নিয়ে আবার ফিরে আসে?
শবনম একটু চিন্তা করে বলল, তোমার ধারণাটা অবশ্য অমূলক নয়। এবং তা যদি হয় তা হলে সকাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। আর সেই যুদ্ধে মরবে ওরাই। আমাদের গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না।
কেন?
আমরা গুহার ভেতর থেকে পাথরের খাঁজ দিয়ে ওদের লক্ষ করতে পারব। কিন্তু ওরা বাইরে থেকে তা পারবে না। কোনওরকমে রাত্রিটা কাটাতে পারলে দিনের আলোয় পালাবে ওরা। আমরা তখন বেরোতে পারব।
কিন্তু সারারাত লড়াই করার মতো গুলি কি দুটো বন্দুকে আছে? বন্দুকে না থাকলেও ওদের কাছে আছে। তা ছাড়া বাইরে যে দু’জন ঘুমিয়ে আছে তাদের কাছ থেকেও নিয়ে আসতে হবে বন্দুকদুটো।
রঞ্জন ভয় পেয়ে বলল, না না। বাইরে যাবার দরকার নেই। এই দুটোতেই কাজ চলুক।
শবনম বলল, ও দুটো আনতেই হবে রঞ্জন। লড়াই যখন শুরু করেছি, তখন শেষ না, হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাব।
তা হলে নিয়েই আসি ও দুটো?
উঁহু। তুমি নয়, আমি।
কেন আমিই যাই না?
তুমি ভয় পেয়েছ রঞ্জন। তা ছাড়া যদি কোনও বিপদ আসে সেটা আমার ওপর দিয়েই আসুক। বিপদ এলে বন্দুক নিয়ে আমি লড়তে পারব। তুমি পারবে না।
শবনম বেরোতে যাচ্ছে, রঞ্জন ওর একটি হাত ধরে টান দিল। বলল, তার চেয়ে বলি কী, এখুনি এই গুহা ছেড়ে আমরা কোথাও পালিয়ে যাই চলো।
কোথায় যাব? এই জঙ্গলে রাতদুপুরে চিতার পেটে যাব যে। এখান থেকে সকালের আগে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। হাত ছাড়ো।
শবনম বন্দুক নিয়ে সেই সংকীর্ণ গুহামুখে পাথরের আটকানের ফাঁক দিয়ে বাইরে গেল।
রঞ্জন ভেতর থেকেই দেখতে পেল, চারপাশ একবার ভালভাবে দেখে নিয়ে ডাকাতদের মশালের আলোয় কী দ্রুত গতিতে কাজ সারল শবনম। চটপট বন্দুকগুলো কেড়ে নিয়েই রঞ্জনের দিকে এগিয়ে দিল। তারপর ওদের পকেট হাতড়ে দোনলা রিভলভার বার করল দুটো। সেই সঙ্গে কয়েকটি কার্তুজ। আর তারপরই যা করল তা একেবারে অভাবনীয়। সেই লোকদুটোর একজনের পোশাকপরে মাথায় ফেত্তি বেঁধে মিলিটারি মেজাজে আবার গুহার ভেতরে এসে ঢুকল। ওদের ফেলে যাওয়া মশালও একটা নিয়ে আসতে ভুলল না।
ওর ওই রণচণ্ডীমূর্তি দেখে রঞ্জন ভয় পেয়ে গেল খুব। বলল, না না। এই পোশাকে তোমাকে মানায় না।
শবনম ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল হো হো করে। বলল, তুমি ভয় পেয়েছ রঞ্জন?
হ্যাঁ হ্যাঁ পেয়েছি। সত্যিই ভয় পেয়েছি আমি। মায়ের মুখে দশমহাবিদ্যার গল্প শুনেছিলাম। সতী পিতৃগৃহে যাবার জন্যে শিবকে যে রূপ দেখিয়েছিলেন তোমার মধ্যেও আমি এই গুহার ভেতর সেই রূপ দেখতে পাচ্ছি। তুমিই সেই ছিন্নমস্তা, বগলা, ধূমাবতী। তুমিই সব। না না শবনম, আবার তুমি আবেগের মতো হয়ে যাও। তোমাকে দেখে আমার বুকের ভেতরে কীরকম যেন হচ্ছে।
আমারও। বলে রঞ্জনের কাঁধে একটা হাত রেখে শবনম বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি হঠাৎ কী করে যেন আমি বদলে গেছি। আসলে এই বন্দুকের নলে আমি যেন মহাশক্তির উৎস খুঁজে পেয়েছি। না-হলে এই বন্দুক হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অমন ভয়ংকর দস্যুদের চার-চারজন প্রাণ হারাল কী করে? আসলে কোনও এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে দিয়ে কোনও কাজ করাতে চায়। না হলে এ রকম দুর্ঘটনাই বা ঘটবে কেন, আর আমরাই বা এখানে আসব কেন? আমি আমার পথ খুঁজে পেয়েছি রঞ্জন। এই বন্দুকের নল দিয়েই আমি আমার আব্বাজানের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের মৃত্যুর কোলে শুইয়ে দেব।
রঞ্জন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তুমি কি ফুলনদেবী হতে চাও?
হতে চাই কেন? হয়েছি। এই পোশাক যখন পরেছি, এই বন্দুক ও রিভলভার যখন হাতে নিয়েছি তখন আর আমি এখান থেকে যাচ্ছি না। আমি খুঁজে বার করব এই দস্যুর দলকে। ওদের সঙ্গে হাত মেলাব। তারপর তাদের অস্ত্রে তাদেরকেই এক এক করে সমুচিত শিক্ষা দেব আমি।
তারপর?
তারপর! জঙ্গলের আরও গভীরে এই রকমই একটি পরিত্যক্ত গুহা বেছে নিয়ে সেখানে একাকী রাজত্ব করব। আমি নিজেও একটা দল গড়ে তুলব এখানে। অত্যাচারীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমার বন্দুকের নল গর্জে উঠবে।
পারবে তুমি নিরন্নের মুখে অন্ন দিতে?
পারব।
এখানকার অনুন্নত সম্প্রদায়কে বহিরাগত, শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে?
পারব।
পারবে আরণ্যকদের অরণ্যের অধিকার ফিরিয়ে দিতে? পারব।
যদি না পার?
এই রিভলভারের শেষ গুলিটি খরচা করব আমি আমার নিজের জন্য।
এই তোমার শেষ কথা?
হ্যাঁ। এই আমার শেষ কথা। আমি মরে গেছি। এই বন্দুকের গুলির শব্দ আমার পুনর্জন্ম ঘোষণা করেছে।
তোমাকে ভূতে পেয়েছে। তাই এত আবোল তাবোল বকছ।
আমি আবোল তাবোল বকছি? তা হলে এই যে প্রাণহীন দেহগুলো এখানে পড়ে আছে এগুলোও কি মিথ্যে? আমি ফুলনদেবী নই রঞ্জন। এমনকী শবনমও নই। এখন আর আমার কোনও জাত নেই। আমি নইকো হিন্দু, নই মুসলমান, নইকো বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান।
তা হলে তুমি কী?
গুহামুখের সংকীর্ণ ফাঁকটুকুর ভেতর দিয়ে ‘গুডুম গুড্ম’ শব্দে দু’বার গুলি করে শবনম বলল, আজ থেকে আমি এই অরণ্যের দেবী। আমাকে অরণ্যদেবী বলতে পারো। লোকে ভয়ে ভক্তি করবে আমাকে। অবশ্যই দুষ্ট লোকে। ভাল লোকেদের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক থাকবে। খারাপ লোকেদের সঙ্গে সম্পর্ক হবে সাপ আর নেউলের। তাদের কাছে আমি হব ভয়ংকরী। দেবী ভয়ংকরী হবে আমার নাম।
শবনমের দুটি চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন ঝিমঝিমিয়ে উঠল রঞ্জনের মাথাটা। তারপর হঠাৎই একসময় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল সে। অবশ্য মেঝেতে পড়ার আগেই শবনম তাকে ধরে ফেলল। তারপর ওকে শুইয়ে দিল ওদেরই সৃষ্ট সেই তৃণশয্যায়। ওর বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল কান্নার মতো হয়ে। মুখে অস্ফুট উচ্চারণ করল, ‘ছেলেমানুষ’।
খুব ভোরে যখন হুঁশ ফিরল বা ঘুম ভাঙল রঞ্জনের, তখন ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। দেখল ওর পায়ের কাছে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে শবনম। এই নাকি অরণ্যদেবী! দেবী ভয়ংকরী। পাগলি আর কাকে বলে।
রঞ্জন উঠে দাঁড়িয়ে যেই না গুহার বাইরের অবস্থাটা দেখতে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে অমনি বাধা পেল। আরে! করছে কী মেয়েটা! ওর পায়ের সঙ্গে একটা দড়ি বেঁধে নিজের পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। সেই টান পেয়ে শবনমও উঠে বসল। বলল, কী ব্যাপার! একা একা কোথায় যাচ্ছ? আমাকে ফেলে রেখে পালাচ্ছ বুঝি?
না না। তা কেন? আসলে কাল অনেক রাত অব্দি জেগে তুমি ঘুমচ্ছ তাই ডাকিনি।
শবনম হেসে বলল, দেখলে তো কেমন বুদ্ধি? তুমি যে চুপি চুপি পালাবে সে উপায় রাখিনি।
রঞ্জন বলল, হ্যাঁ, বুদ্ধির তোমার প্রশংসা করি। কিন্তু বাইরে দুটো, ভেতরে দুটো ডেড বডি রেখে তুমি যে এমন নিশ্চিন্তে নিদ্রা খাচ্ছিলে তা সেই সুযোগে যদি কোনও বাঘটাঘ এসে ঢুকত?
তা ঢুকতে পারত। তবে সারারাত জেগে ভোরের দিকেই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। এখন চলো দেখি ঝরনার জলে গিয়ে মুখহাতগুলো ধুয়ে আসি। সত্যি, যা গেল কাল।
ওরা গুহামুখের পাথর সরিয়ে পথ প্রশস্ত করে বাইরে এল। দুটি ডেড বড়ির একটিও তখন বাইরে নেই। না থাক! ওরা ঘন অরণ্যানির মধ্যে দিয়ে সেই ঝরনাতলায় গিয়ে মুখহাত ধুয়ে পরিষ্কার হল।
শবনম বলল, এই সময় একটু চা-টোস্ট পেলে কেমন হত রঞ্জন?
মন্দ হত না। কিন্তু ওসব যে খেতে যাব সে উপায়ও তো রাখনি তুমি। যে পোশাক চড়িয়েছ অঙ্গে এই পোশাকে কি শহরে যাওয়া যায়? মাথার ভূত যদি ছেড়ে গিয়ে থাকে তা হলে এখুনি পোশাকটা ছেড়ে আগের মতো ভাল হয়ে এসো। না হলে এই পোশাক দেখলে নির্ঘাত পুলিশে ধরবে।
রঞ্জনের কথায় হোঃ হোঃ করে গগনফাটিয়ে হেসে উঠল শবনম। বলল, ওটি হচ্ছে না। আমার আব্বাজান মিলিটারির লোক ছিলেন। ঘোড়ায় চড়া থেকে কার ড্রাইভিং এবং বন্দুক চালানো থেকে পর্বতারোহণ সবই আব্বাজান আমাকে শিখিয়ে গেছেন। এই যন্ত্র হাতে যখন পেয়েছি, তখন লড়ে যাব একবার। যাও, বাকি বন্দুক রিভলভার যা আছে তা গুছিয়ে গাছিয়ে রেখে এসো। প্রয়োজনে পরে এসে নিয়ে যাব।
রঞ্জন ইতস্তত করতে লাগল দেখে শবনম আবার বলল, যাও। চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকো না। ভয় নেই, নিজের স্বার্থের জন্য তোমার জীবন নষ্ট করব না। তোমার দয়ায় এই প্রাণ আমি ফিরে পেয়েছি। আমার উপযুক্ত একটা জায়গা পেয়ে গেলেই আমি তোমাকে ছেড়ে দেব। তুমি তোমার মা-বাবার কাছে ফিরে যাবে।
রঞ্জন একান্ত বাধ্য অনুগতর মতো আবার গুহার ভেতরে ঢুকে সব কিছু চাপা চুপি দিয়ে রেখে এল। তারপর শবনমের নির্দেশ মতো বনপথ ধরে চলতে শুরু করল ওরা।
পাহাড়টা এবার ক্রমশ চালু হয়ে গভীরতর জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে মিশেছে। সেই ঢালু পথে হঠাৎ একটি তেজস্বী ঘোড়াকে ঘাস খেতে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠল শবনম। বলল, পেয়েছি। পেয়েছি।
কী পেয়েছ?
আমার নতুন বন্ধুকে।
ঘোড়াটা তোমার বন্ধু?
নিশ্চয়ই। কাল যারা ডাকাতি করতে এসেছিল এ তাদেরই ঘোড়া। কী করে বুঝলে?
দেখছ না ঘোড়ার পিঠে বসার জায়গায় জিন লাগানো আছে। বুনো ঘোড়া হলে এসব থাকত না। তা ছাড়া বুনো ঘোড়ার চেহারায় এত চাকচিক্য থাকে না। এ বাইরের দেশের ঘোড়া। হয়তো অস্ট্রেলিয়ার।
রঞ্জন মনে মনে শবনমের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না।
শবনম ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ঘোড়াটার কাছে। তারপর ওর লাগাম ধরে টান দিয়ে ওকে কাছে এনে এমন অদ্ভুত কায়দায় ওর ঘাড়েগলায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল যে ঘোড়াটা একটুও ছটফট করল না, বা বিরক্ত হল না। বরং একদৃষ্টে কিছুক্ষণ শবনমের দিকে চেয়ে থেকে ওর গা শুঁকতে লাগল।
এই সুযোগে শবনম চড়ে বসল ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়াটা বাধা দিল না। বরং টান হয়ে গলা উঁচিয়ে আদেশের প্রতীক্ষা করল।
রঞ্জন অবাকবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল শবনমের দিকে। পুরুষের পোশাকপরা, মাথায় ফেত্তি বাঁধা কাঁধে বন্দুক আর এক হাতে রিভলভার ধরা এই মেয়েটি যে এক দস্যুনেত্রী নয়, তা কে বলবে? ওকে দেখে ওর রীতিমতো ভয় করতে লাগল।
শবনম বলল, তুমিও এসে বসো না আমার পিছনে।
আমি উঠতে পারব না। তা ছাড়া সত্যি বলতে কী, আমার খুব ভয় করছে। তাই বলি, তুমি বরং ঘোড়ায় চেপেই চলো। আমি হেঁটে যাই।
শবনম হেসে বলল, আমাকে দেখেও তোমার ভয় কাটছে না রঞ্জন? তুমি না ছেলে? এসো। উঠে এসো। হাত ধরো আমার। বলে, একটা হাত বাড়িয়ে দিল শবনম।
রঞ্জন তবুও উঠল না। ঘোড়ার লাগাম ধরে হেঁটে হেঁটেই পথ চলল। শবনম ধীরে ধীরে অশ্বচালনা করল। পাহাড়ের সেই ঢালু পথবেয়ে ঘোড়াটা ওদের দু’জনকে পিঠে নিয়ে এগিয়ে চলল।
খানিকটা পথ যাবার পর এক জায়গায় ওরা ‘ঠক ঠক’ করে একটানা একটা শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল শবনম। তারপর রঞ্জনকে নিয়ে নেমে পড়ল ঘোড়ার পিঠ থেকে। পাশেরই একটি গাছের শুঁড়ির সঙ্গে ঘোড়াটাকে বেঁধে, ওরা সেই শব্দ শুনে এগিয়ে চলল। কিছু দূর যাবার পরই দেখতে পেল, এক জায়গায় কিছু অনুন্নত শ্রেণীর পাহাড়িয়া লোকজন নির্মম কুঠারের আঘাতে বড় বড় গাছপালার ডাল কেটে ফাঁকা করে দিচ্ছে।
শবনম বাঘিনীর মতো হুংকার দিয়ে উঠল, হুঁশিয়ার।
সবাই চুপ। ঠুক ঠাক শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল। সকলেরই চোখেমুখে বিস্ময়,
আবার কে রে বাবা!
শবনম বলল, এ তোমরা কী করছ?
আমরা গরিব মানুষ মা। দুটি ভাত-রুটির জন্য গাছ কাটছি।
কার হুকুমে?
আজ্ঞে শেঠ মংঘীরামজির হুকুমে।
কত টাকা পাও তোমরা?
গাছ প্রতি বিশ টাকা।
শবনম গম্ভীর মেজাজে এদিক থেকে সেদিকে পায়চারি করতে করতে বলল, মাত্র বিশ টাকা! তোমরা কী জানো এই পাহাড়ে এমন গাছও আছে যার দাম বিশহাজার টাকা থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত।
না মা।
তোমরা কোথায় থাক?
আজ্ঞে এই পাহাড়েই।
সামান্য ক’টা টাকার লোভে তোমরা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছ ! জান, এই সবুজ বনবীথির মধ্যেও প্রাণ আছে। প্রতিটি কুঠারাঘাতের সঙ্গে বাতাসের হু হু শব্দে ওদের বুকফাটা কান্না তোমাদের অভিশাপ দেয়। এইভাবে গাছ কাটতে কাটতে এই অরণ্য যেদিন নির্মূল হয়ে যাবে, সেদিন কোনও শেঠজিই আর টাকার থলি নিয়ে এগিয়ে আসবে না তোমাদের কাছে। সেদিন কী হবে একবার ভেবে দেখেছ? সেদিন এই শ্রীহীন প্রান্তরে তোমরা শুকিয়ে মরবে। ঝরনার পানি শুকিয়ে যাবে। শীতে শীত পড়বে না। গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন চারদিক জ্বলেপুড়ে খার হয়ে যাবে, তখন বৃষ্টির পানি দিতে আকাশে ঘন কালো মেঘ আসবে না। চারদিক খরায় জ্বলবে। ফসল ফলবে না।
তা হলে এখন আমরা কী করব?
অরণ্যকে রক্ষা করে অরণ্যের অধিকার নেবে! তোমাদের এই অরণ্যজগতে বাইরের কোনও মানুষকে সহসা ঢুকতে দেবে না। অবশ্য অরণ্যকে ভালবেসে কোনও অরণ্য-প্রেমিক যদি কখনও এখানে এসে উপস্থিত হয়, তা হলে তাকেই শুধু উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে বরণ করে নিয়ো। এই অরণ্যের ফুলফল সব কিছু শুধু তোমরাই ভোগ করবে।
এক বৃদ্ধ পাহাড়ি এগিয়ে এসে বলল, সবই তো বুঝলুম মা। কিন্তু এখন যে আমরা না খেয়ে মরব তা হলে।
সে ব্যবস্থা আমি করে দেব।
কিন্তু মা! তোমার বয়স কম। কে তুমি, কোথা থেকে এলে জানি না তাও। এই অরণ্যে যেমন বাঘ-ভালুক আছে তেমনি আছে চোরডাকাত এবং নানা ধরনের হিংস্র মানুষের দল। তারা যে আমাদের সুস্থভাবে খেয়েপরে বাঁচতে দেবে না।
তাদের শায়েস্তা করার জন্য আমি আছি। তোমাদের প্রধান কে? আমি মা।
নাম কী তোমার?
হিংলাজ পাটসানি। ওড়িশার ঢেনকানালের কাছে দারুথাং-এ আমাদের পূর্বনিবাস। আমরা বুনো। বনে বনেই ঘুরে বেড়াই।
এই বনে তোমরা কত দিন আছ?
তা মা কম করেও বছরবারো তো আছি।
ওই শেঠজির সঙ্গে তোমাদের যোগাযোগ কী ভাবে হল?
হঠাৎই হয়ে গেল। ওই শেঠজিই একদিন সরকারের লোকেদের নজর এড়িয়ে আমাদের কাছে এসে লুকিয়ে কাঠ কাটার মতলব দিলে। আমরা টাকার লোভে, ওর কথা মতো কাজ শুরু করলাম।
ঠিক আছে। যা করেছ করেছ, আর ও কাজ কোরো না।
তা হলে আমরা কী করে বাঁচব মা?
এই কাজ করার আগে যে ভাবে বেঁচেছিলে সেই ভাবে বাঁচবে। এখন তোমরা আমাদের দু’জনকে তোমাদের গ্রামে নিয়ে চলো। তারপর তোমাদের নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করা যাবে।
বেশ তো চলো।
শবনম ওদের একটু অপেক্ষা করতে বলে, একাই চলে গেল গাছের গুঁড়িতে বেঁধে রাখা ঘোড়াটকে খুলে আনতে। কিন্তু কী আশ্চর্য! কোথায় গেল ঘোড়াটা? ওর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে কে খুলে নিয়ে গেল ওটাকে?
শবনম ফিরে এসে বলল, আমার ঘোড়াকে একটা গাছের ডালে বেঁধে রেখে এসেছিলাম। এখন দেখছি সে সেখানে বাঁধা নেই। এটা কী করে সম্ভব! কার এত সাহস?
হিংলাজ হাতজোড় বলল, তুমি কে মা তা জানি না। তবে তোমাকে দেখে কোনও দেবী অথবা দস্যুকন্যা বলে মনে হচ্ছে। এই পাহাড়ের পশ্চিম দিকে একটি উচ্চ চূড়ায় মস্ত একটি গুহা আছে, সেই গুহার ভেতরে হিন্দোলসর্দার নামে এক কুখ্যাত ডাকাত বাস করে। আমার মনে হয় এ কাজ তারই। আমি ওই দস্যুসর্দারের সন্ধান চাই।
কিন্তু মা। ও বড় নৃশংস। খুন জখম ডাকাতি রাহাজানি সব কিছুরই নায়ক ও।
ব্যাঙ্ক ডাকাতি, ট্রেনডাকাতি কী না করে ও। আমরা সবাই ওকে যমের মতো ভয় করি। দূর থেকে ওকে দেখতে পেলে লুকিয়ে পড়ি আমরা। তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমি যে ওই লোককেই খুঁজে বেড়াচ্ছি হিংলাজ। আমাকে একবার ওর কাছে নিয়ে যাবে?
বলার সঙ্গে সঙ্গেই পিছন থেকে কে বা কারা যেন বলে উঠল, আমরা তোমাকে আমাদের সর্দারের কাছে নিয়ে যাবার জন্যই এখানে এসেছি দেবী।
যারা এসেছে তাদের দিকে তাকিয়ে ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল রঞ্জনের। কী ভয়ানক চেহারা তাদের। যেন এক একটি জ্যান্ত নরখাদক।
শবনম বলল, তোমরা কারা?
আমরা হিন্দোলসর্দারের লোক।
পাহাড়ি লোকগুলোও ভয় পেয়ে গেল এই লোকগুলোকে দেখে।
শবনম কিন্তু একটুও ভয় পেল না। বলল, ঠিক আছে চলো। দেখি তোমাদের সর্দার কী রকম। যদি বুঝি তো তোমাদের দলেই ভিড়ে যাব আমি। তবে তোমরা খুব ভীতু আর অকর্মণ্য। না হলে কাল রাতে তোমাদের চার-চারজনকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম, অথচ তোমরা আমাদের কিছুমাত্র করতে পারলে না।
বেশি বাজে কথা না বলে আমাদের সঙ্গে এসো।
আমার ঘোড়া কই?
ও ঘোড়া তোমার কেন হবে? আমাদের ঘোড়া আমরা খুলে নিয়ে গেছি। এখন আমাদের বন্দুকটা ভালয় ভালয় দিয়ে দাও দেখি।
শবনম বলল, বন্দুক নিয়ে কী করবে? কাক মারবে! এ বন্দুক তোমাদের হাতে শোভা পায় না। যারা চার-চারজন সঙ্গীর মরণদশা দেখেও বিনা যুদ্ধে পালিয়ে যায়, তাদের হাতে বন্দুকের বদলে একটা করে ছাতার বাঁট ধরিয়ে দেওয়াই উচিত।
এই কথা শুনে একজন হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল শবনমের ওপর। তারপর গায়ের জ়োরে ওর হাত থেকে কেড়ে নিল বন্দুকটা। বলল, শখ মন্দ নয়। ফুলনদেবী হবে। যা ভাগ।
কিন্তু শবনমের মধ্যে যে প্রেতিনী ভর করেছে, তার ব্যাপারে ওরা সচেতন ছিল না বলেই এই ভুলটা করে বসল। নাই বা থাকল বন্দুক। শবনম রিভলভারটাই কাজে লাগাল এবার। কোমর থেকে সেটা টেনে নিয়েই ছুটিয়ে দিল ‘দড়াদ্দুম’। ঢিপ ঢাপ করে কলাগাছ পড়ার মতন পড়ে গেল দু’-তিনজন। বাকি একজন বন্দুক ওঠাবার চেষ্টা করতেই হঠাৎ একটা পাথর এসে লাগল তার মুখে। লোকটি আর্তনাদ করে পড়ে গেল।
কে ছুড়ল পাথর!
রঞ্জন বলল, আমি।
শবনম ওর পিঠ চাপড়ে বলল, শাবাশ দোস্ত। এই তো হাত খুলে গেছে তোমার। এসো তোমাকেই আমি এই পাহাড় বনের রাজা করে দিই। তারপর দখল করি হিন্দোলসর্দারের কেল্লা। আল্লার দোয়া যদি হয় তো ওকে আমি প্রাণে মারব না রঞ্জন। ওর দুটো হাত কেটে নিয়ে তোমাদের কালীঠাকুরের মতো আমার কোমরে বেঁধে নৃত্য করব।
কিন্তু আমরা দু’জনে কি পারব এ কাজ করতে?
কে বললে আমরা দু’জন? এই তো আমাদের বন্ধুরা সব দলে দলে রয়েছে এখানে। পারবে না তোমরা আমাদের সাহায্য করতে?
হিংলাজসর্দার ছুটে এসে শবনমের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসল। বলল, পারব মা। নিশ্চয়ই পারব। ওই হিন্দোলসর্দার বড় অত্যাচারী। ও বা ওর দলের লোকেরা মা-বোনেদেরও মর্যাদা দেয় না। ওর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমার একমাত্র মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।
শবনম চিৎকার করে উঠল, আর তুমি বদলা না-নিয়ে চুপচাপ বসে আছ?
কী করব মাগো, আমরা যে গরিব লোক। মংঘীরামের মতো লোকেরা তাদের সুবিধার জন্য আমাদের ডাকে। কিন্তু আমাদের বিপদে আমাদের ডাকে কেউ এসে পাশে দাঁড়ায় না। তা ছাড়া আমরা দুর্বল। কুণ্ডুল দিয়ে গাছ কাটতে পারি। শুধু হাতে দুশমনের সঙ্গে লড়ে যেতে পারি, কিন্তু বন্দুকের সামনে তো রুখে দাঁড়াতে পারি না।
কেন পার না? মরবার ভয়ে? কই তোমার মেয়েটা তো গলায় ফাঁস দিয়ে লটকাবার সময় মরবার ভয় করল না। তা হলে তুমি কেন মরবার ভয় করছ?
তুমি ঠিক বলেছ তো মা। এই কথাটা তো আমি কখনও ভাবিনি। আজ এই মুহূর্তে আমি আমার মরা মেয়ের নামে শপথ করে বলছি, আমি আমার লোকজন নিয়ে এখন থেকেই তোমার দাস হয়ে গেলাম।
কতজন আছ তোমরা?
আমরা উনিশজন আছি। তা ছাড়া আমাদের বউবাচ্চা সব আছে। তোমাদের বসতি কতদূরে?
কাছেই।
-পা বেঁধে নিয়ে চলো। ওর পেট থেকে কিছু কথা আদায় করতে হবে।
আমাদের নিয়ে চলো সেখানে। আর এই আহত লোকটিকেও হাত হিংলাজ গর্জে উঠল, এই। বাঁধো ইসকো। লে চলো ঝোপড়ি পর।
শবনম বলল, আমাদের খুব খিদে পেয়েছে। তোমরা তোমাদের ডেরায় নিয়ে গিয়ে আগে আমাদের কিছু খাবার ব্যবস্থা করে দাও। তারপর আমরা দলবদ্ধ ভাবে মোকাবিলা করব হিন্দোলসর্দারের।
হিংলাজ বলল, এসো মা। গরিবের কুঁড়েতে পায়ের ধুলো দেবে এসো। ওরা হিংলাজকে অনুসরণ করল।