এক
কোনও কিছু টের পাবার আগেই যা ঘটবার তা ঘটে গেল। সে রাতে জ্যোৎস্না ছিল অঢেল। আকাশের গোল চাঁদটাও যেন ট্রেনের গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ছুটেছিল। ছায়া ছায়া কালো কালো দূরের পাহাড়গুলো স্বপ্নের দেশের মতো মনে হচ্ছিল তখন। রঞ্জন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছিল তাই। দ্রুতগামী ট্রেনের চলার ছন্দে হঠাৎই যতিভঙ্গ হল। অনেকটা হোঁচট খাওয়ার মতোই একবার শূন্যে লাফিয়ে উঠল ট্রেনটা। তারপর সব স্থির। সব অন্ধকার।
অনেক পরে যখন জ্ঞান ফিরল, তখনও উদ্ধারকার্য শুরু হয়নি। চারদিকে হতাহত মানুষের দেহ খেলাঘরের পুতুলের মতো ছড়ানো। যন্ত্রণাকাতর মানুষগুলোর সে কী করুণ আর্তনাদ।
রঞ্জন ধীরে ধীরে উঠে বসল। সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল সে। মাথাটা এখনও ঝিম ঝিম করছে। আঘাত কি খুবই গুরুতর? না। হাত, পা, ধড়, মুণ্ডু সবই যথাস্থানে ঠিকঠাক আছে। মাথার কাছে সুটকেসটা রাখা ছিল। হাত বাড়িয়ে নিতে গেল সেটা। কিন্তু পেল না। কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে?
ওর সামনের বার্থে মি. গোমেশ নামে এক ভদ্রলোক শুয়েছিলেন। বার্থের নীচে ভারী ভারী ট্রাঙ্কগুলো রাখা ছিল তাঁর। সেগুলো যে কোনদিকে কোনটা ছিটকে পড়েছে তা বোঝা গেল না। শুধু মি. গোমেশ তাঁর প্রাণহীন দেহটা নিয়ে বার্থের লোহার চেনে ঝুলছেন। কী ভয়াবহ পরিণতি। আর এক ভদ্রলোক, সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুখে গোঁ গোঁ শব্দ। মাথার খুলি ফেটে—।
এ দৃশ্য দেখা যায় না।
রঞ্জন কোনওরকমে এর ওর গায়ে পা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎই জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখল বাইরেটা। একদল লোক মশাল আর টর্চ নিয়ে ছুটোছুটি করছে। নিশ্চয়ই খবর পেয়ে রিলিফ ভ্যান নিয়ে উদ্ধারকারীরা এসে গেছে। কিন্তু এ কী! ওদের হাতে স্ট্রেচারে শোয়ানো হতাহত মানুষের বদলে মালপত্তর কেন? তবে কি ডাকাতির জন্যই এই দুর্ঘটনা? কালো কালো বলিষ্ঠ চেহারার মানুষগুলোর মাথায় নীল কাপড়ের ফেত্তি বাঁধা। হাতে রক্ত মাখা ধারালো অস্ত্র। উঃ কী ভয়ংকর। রঞ্জন একবার হিপ পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল ওর ওগুলো যথাস্থানেই আছে কি না, দেখে আশ্বস্ত হল। একশো টাকার দশখানি নোট খুবই যত্ন সহকারে গোঁজা ছিল সেখানে। সেগুলো যথাস্থানেই আছে। আসলে দুষ্কৃতীরা ছেলেমানুষ ভেবেই হয়তো হাত দিয়ে দেখেনি ওখানে। অথবা বুঝে উঠতে পারিনি এই ধ্বংসস্তূপের এক কোণে একটি তাজা প্রাণ এখনও অবশিষ্ট আছে বলে।
ভোরের আলো ফোটেনি এখনও। শুরু হয়নি পাখিদের কলরব। শুধু চারদিক থেকেই শোনা যাচ্ছে মানুষের অস্তিম আর্তনাদের সুর। আবছা অন্ধকারে ভরে আছে ভেতরটা। বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। বন-পাহাড় চারদিকে। তবু এই মৃত্যুপুরীর ভেতর থেকে উদ্ধার পাবার জন্য টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল রঞ্জন। ভেতরে কত যাত্রী যে হতাহত হয়ে রয়েছে তার হিসেব কে রাখে? হাতড়ে হুতড়ে কোনওরকমে দরজার কাছে যেতে গিয়েই হঠাৎ ওর কানে এল, পানি— পানি—থোড়া পানি দিজিয়ে।
মেয়েলি গলার করুণ প্রার্থনা।
এই সময় শত বিপদেও, অসুবিধা সত্ত্বেও এই অন্তিম প্রার্থনাকে উপেক্ষা করে কি চলে যাওয়া যায়? কিন্তু জল এখানে পাবে কোথায়? তা ছাড়া চারদিক থেকেই তো ওই একই প্রার্থনা, জল দাও – পানি দাও—প্লিজ গিভ মি এ ড্রপ অফ ওয়াটার। কত লোকের মুখে জল দেবে ও? হঠাৎ একটা কীসের ওপর যেন পা পড়ল। দেখল একটা টর্চ গড়াগড়ি খাচ্ছে সেখানে। এই চরম বিপদের মুহূর্তে এই টর্চটা খুবই কাজে লাগবে।
রঞ্জন ঝুঁকে পড়ে টর্চটা কুড়িয়ে নিয়ে চারদিকে ফেলতে লাগল। হঠাৎই নজরে পড়ল কম্পার্টমেন্টের ভেতরে জানালার পাশের হুকে ঝোলানো ওয়াটার বটলগুলোর দিকে। তারই একটা নিয়ে এসে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল ও।
কাছে গিয়ে দেখল একটি ওরই বয়সি মেয়ে এক পাশে মেঝেয় পড়ে কাতরাচ্ছে, পানি—থোড়া পানি দিজিয়ে।
রঞ্জন টর্চ রেখে ওয়াটার বটল থেকে জল নিয়ে মেয়েটির চোখেমুখে ঝাপটা দিল প্রথমে। ওর নাক দিয়ে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মূল্যবান চুড়িদারটা রক্তে ভিজে সপ সপ করছে। দু’-একবার ঝাপটা দেবার পর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল মেয়েটি। তারপর বলল, ম্যায় কাঁহা হুঁ? থোড়া পানি—।
রঞ্জন কোনও উত্তর না দিয়ে মেয়েটির ঘাড়ের কাছে হাত রেখে মাথাটা একটু তুলে ওয়াটার বটলটা ওর মুখের কাছে ধরল। এক নিশ্বাসে সমস্ত জলটুকু পান করে মেয়েটি যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তারপর রঞ্জনের একটা হাত ধরে উঠে বসবার চেষ্টা করে বলল, তুম কৌন হো?
রঞ্জন বলল, আমিও তোমারই মতো এই ট্রেনের একজন যাত্রী ছিলাম।
মাঝরাত্তিরে ট্রেনটি ভয়ংকর এক দুর্ঘটনায় পড়ে। নেহাত মিডল বার্থে শুয়েছিলাম, তাই প্রাণে মরিনি। লোহার চেনে আটকে বেঁচে গেছি। আমি লোয়ার বার্থে ছিলাম।
তার ওপর বিপরীতমুখী হওয়ায় ছিটকে পড়েছ তুমি। নিশ্চয়ই খুব লেগেছে তোমার?
মেয়েটি ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
এই অভিশপ্ত ট্রেনের অনেক যাত্রীই বেঁচে নেই। আহত হয়েছেন বহু লোক। আমাদের উদ্ধার করবার জন্য এখনও পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি। কিছু লোক অবশ্য এসেছে লুঠপাট করতে, কিন্তু তারা আমাদের কোনওরকম সাহায্য করবে না।
মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার আব্বাজান?
কোথায় তিনি?
আপার বার্থে শুয়েছিলেন।
রঞ্জন টর্চ নিয়ে চারদিকে ঘোরাতে লাগল। কিন্তু না। কোনও বার্থেই কেউ নেই।
মেয়েটিও উঠে দাঁড়াল এবার। তারপর আলো ধরে খুঁজতে খুঁজতে দেখতে পেল ওর আব্বাজানকে। সুন্দর স্বাস্থ্যবান এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক ঘাড়গুঁজে পড়ে আছেন একদিকে। তাঁর বুকের ওপর একটি ট্রাঙ্ক চাপা। সেই দৃশ্য দেখে মেয়েটি অধীর হয়ে উঠল। রঞ্জনের সাহায্যে কোনওরকমে ট্রাঙ্কটি সরিয়ে তার আব্বাজানের বুকে হাত রাখতেই বুঝল তিনি মৃত। রঞ্জনও স্পর্শ করে দেখল ভদ্রলোকের হিমশীতল অঙ্গ বাস্তবিকই তাঁর মৃত্যু ঘোষণা করছে। মেয়েটি ওর আব্বাজানের বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল।
প্রিয়জন হারানোর বিচ্ছেদ যে কত মর্মান্তিক, তা অনুভব করল রঞ্জন। ভাগ্যে ও একা এসেছিল। মেয়েটির কান্না আর থামে না। জোয়ারের গঙ্গার মতো ফুলেফুলে কাঁদছে মেয়েটি। ওর কান্না থামে না দেখে রঞ্জন বলল, শোনো, এইভাবে কেঁদে কোনও লাভ হবে না। চলো, আমরা বরং ট্রেন থেকে নেমে কাছেপিঠে কোনও লোকালয় থাকলে সেখানে খবর দিই। তারা নিশ্চয়ই এই রকম দুর্ঘটনার সংবাদ পেলে ছুটে আসবে।
মেয়েটির কিছুতেই তার বাবাকে ছেড়ে যাবার ইচ্ছা হল না। অথচ না-গিয়ে উপায়ই বা কী? রঞ্জন আর একটুও দেরি করতে রাজি নয়। কেন না আর্ত মানুষের এই অন্তিম হাহাকার কান পেতে শোনা যায় না।
রঞ্জনের বহু অনুরোধে মেয়েটি যখন শেষবারের মতো ওর আব্বাজানের ললাট চুম্বন করে উঠে দাঁড়াল, তখন দেখল আর একজন কে যেন বহু কষ্টে ওদের দিকে এগিয়ে আসছেন। ভদ্রলোক প্রবীণ। বললেন, তোমরা কি তোমাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছ?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ।
আমিও হারিয়েছি। আমার একমাত্র সন্তান এই দুর্ঘটনায় আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তোমরা যদি সুস্থ থাক তো এই মুহূর্তে পালিয়ে যাও এখান থেকে। চারদিকে লুঠপাট শুরু হয়ে গেছে। তা ছাড়া এই চক্করের বাইরে গিয়ে রেলের কাছ থেকে ডেড বডি আদায় করো। এখন কোনও মতেই এখানে থেক না। হয়তো বিপদে পড়ে যাবে।
রঞ্জন বললে, কেন?
যা বলছি তাই করো। একেবারে অপারগ না হলে থেক না। থাকতে নেই। তোমাদের রক্ষা করার দায়িত্ব এখন তোমাদেরই। আর কারও নয়। আমার একটা পা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। তবুও আমি চলে যাচ্ছি। হাতের কাছে নিজেদের জিনিসপত্তর যদি কিছু পাও তো নিয়ে নাও। ফেলে রেখে যেয়ো না।
মেয়েটি হয়তো বুঝল ব্যাপারটা। তাই কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবার পাঞ্জাবির সোনার বোতাম, রিস্টওয়াচ আর পকেটের টাকাগুলো বার করে নিল। তারপর বহু কষ্টে দরজার হাতল ধরে ওপরে উঠে লাফিয়ে নামল পাশের লাইনে।
এখানে চারদিকেই শুধু জঙ্গল আর পাহাড়। নিশ্চয়ই কেউ ফিস প্লেট সরিয়ে এই অপকর্মটা ঘটিয়েছে। ওদের মতো আহত, অল্প আহত, অক্ষত আরও অনেকেই নেমেছে দেখা গেল। কিন্তু মজার ব্যাপার সামান্য কিছু লোক ছাড়া বেশির ভাগ লোকই জঙ্গলের পথ ধরে পালাচ্ছে। কেন? কেন পালাচ্ছে ওরা? মেয়েটির হাতধরে রঞ্জনও এগোতে শুরু করল।
রঞ্জনের ছোটা অভ্যাস আছে। কিন্তু মেয়েটির? ও কি পারবে ওর সঙ্গে ছুটতে অথবা দ্রুত পা চালাতে? অবশ্য সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা এবং আঘাতের অবসাদ নিয়ে দ্রুত পথ চলা খুবই কষ্টকর। তবু ওরা চলতে লাগল।
কিছুটা পথ যাবার পরই হাঁপিয়ে উঠল ওরা। দু’জনেরই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মেয়েটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। একে সদ্য পিতৃ-বিয়োগে দারুণভাবে ভেঙে পড়েছে মেয়েটি, তার ওপর ব্যথা-বেদনার শরীর নিয়ে পথচলা একেবারেই অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে এই পাহাড়-জঙ্গলের দেশে।
ওদের সম্মুখের পথটা ক্রমশ উঁচু দিকে উঠে গেছে। অর্থাৎ ওরা মালভূমির মতো অংশে একটা বড়সড় টিলার দিকে এগোচ্ছে। তারই খাড়াই পথের আকর্ষণ হাঁফ ধরাচ্ছে ওদের। এখানে শুধু শিমুল ও মহুয়ার বন। মাঝেমধ্যে দু’-একটা ঘন পাতার সেগুন গাছও দেখতে পাচ্ছে ওরা। রঞ্জন মেয়েটির একটি হাত শক্ত করে ধরে আছে।
যেতে যেতে এক সময় মেয়েটি বলল, আর কতদূর যেতে হবে আমাদের? আর যে পারছি না।
রঞ্জনও কি পারছে? ওরও পাদুটো যেন ভারী অসুখ থেকে উঠলে যেমন হয়, সেই রকম ভেরিয়ে পড়ছে। না হলে এই ফুলের মতো মেয়েটিকে পিঠে নিয়েই চা-বাগানের কুলির মতো উঠে যেত ঠিক। রঞ্জন তো আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। রীতিমতো শরীর চর্চা করে। ওর হাতের একটা চড় অথবা ঘুসি হজম করা অনেক শক্তিমান লোকের পক্ষেও অসম্ভব। তবুও এই দুর্ঘটনার পর কী যে হয়ে গেল। সবসময় যেন মাথাটা ঝিমঝিম করছে। হাত খুব বেশি জোরে মুঠো করতে পারছে না। পা কাঁপছে। এক এক সময় মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই ও বেঁচে আছে তো? এই চাঁদনি রাতের জ্যোৎস্নালোকে শিমুল-মহুয়ার বনে টিলা পাহাড়ে এক অনাত্মীয় কিশোরীর হাতধরে পথচলা এ তো স্বপ্নময়।
মেয়েটি বলল, আর যে পারছি না। উঃ কী কষ্ট।
আর একটু। এই টিলাটার ওপরে উঠে একটু বিশ্রাম নেব আমরা। ।
আমি আর পারছি না
আমিও পারছি না। তবু এসো। একটু কষ্ট করে চলে এসো এটুকু পথ।
রঞ্জন মেয়েটির দেহের ভার অনেকটা নিজের ওপর নিয়ে নিল। মেয়েটির চুল এলিয়ে পড়েছে। সে ওর মাথাটা রঞ্জনের কাঁধের ওপর কাত করে রেখে টলতে টলতে উঠতে শুরু করল বাকি পথটুকু।
পথ শেষ হল এক সময়।
তারায় ভরা আকাশের নীচে লাল টিলার মাথার ওপর বন-জ্যোৎস্না গায়ে মেখে ধুপ ধাপ বসে পড়ল দু’জনে। আঃ কী নিবিড় শান্তি এখানে। মেয়েটি বসে পড়েই একটি পাথরের বুকে ‘হায় আল্লা’ বলে লুটিয়ে পড়ল।
রঞ্জনের কিশোরমন এই অনাত্মীয় কিশোরীর বিয়োগবেদনা দেখে ব্যথিত হল। ওর চোখদুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠল এবার। ওর মা-বাবা সঙ্গে থাকলে আজ তাদের ভাগ্যেও এই রকম করুণ পরিণতি জুটত কি না কে জানে? প্রত্যেক যাত্রায় প্রতিটি মানুষের নিয়তি নির্ধারণ করা থাকে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মানুষ নিয়তির দাস। এই কিশোরী কোথায় যাচ্ছিল কে জানে, ট্রেন-ভ্রমণের আনন্দময় অভিযানের আগে স্বপ্নেও কি ভেবেছিল, যে নিঠুর নিয়তি এই মায়াভরা জ্যোৎস্নারাতে এই বনে-পাহাড়ে তার মায়৷কাঠি দিয়ে ওর আব্বাজানকে ওর বুক থেকে ছিনিয়ে নেবে বলে?
এতক্ষণ মনে উত্তেজনা থাকায় মেয়েটির দিকে ভাল করে নজর দিতে পারেনি রঞ্জন। এখন রাত্রি শেষের জ্যোৎস্নালোকে খুব ভাল করে দেখল ওকে। মনে হল যেন এই বাসন্তী পূর্ণিমার রাতে শিলাখণ্ডের ওপর লুটিয়ে পড়া ওই কিশোরী মেয়ে নয়। শরতের একরাশ শুভ্র শেফালি। সাদা কাগজের মতো গায়ের রং। যেন একটা শ্বেতকবুতর কিশোরীর শরীর পেয়ে এই বন-জ্যোৎস্নায় ফুট ফুট করছে। এত ফর্সাও কেউ হয়? এর ওপর জ্যোৎস্নার আলো পড়ে মেয়েটি যেন দুধসাগরে ভাসছে। কতই বা বয়স হবে? খুব জোর বছর পনেরো। রঞ্জনেরই সমবয়সি। দেখে মনে হয় অবস্থাপন্ন ঘরেরই মেয়ে। ওর রক্তেভেজা চুড়িদার সস্তা কাপড়ের নয়। পায়ে জুতো নেই। খুলে রেখে শুয়েছিল হয়তো। কোথায় ছিটকে গেছে কে জানে? রঞ্জনও খালি পা। ওই অন্ধকারে আর ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর জুতো খোঁজার ব্যাপারটা ওরও মনের কোণে উদয় হয়নি।
রঞ্জন কিশোরীর খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে সস্নেহে ওর মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, এই শোনো। এভাবে কেঁদ না। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। এটাকে এভাবেই মেনে নাও। যা হবার, তা বেশ হয়ে গেছে। এখন একটু বিশ্রাম নিয়ে চলো আমরা শহরের দিকে যাই।
মেয়েটি এক হাতে ওর কপালের ওপর লুটিয়ে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর সেও পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল তার উদ্ধারকর্তা এই বন্ধুটিকে। এক সময় শান্ত গলায় বলল, না। আর কাঁদব না। আমার সব কান্নার শেষ হয়ে গেছে। তোমায় ধন্যবাদ। তুমি আমায় ওই নরক থেকে মুক্ত করে এনেছ। তুমি না থাকলে হয়তো ওই প্রেতপুরীতে আমিও মরে পড়ে থাকতাম। এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে নিজের রক্তভেজা পোশাকের দিকে তাকাল।
রঞ্জন বলল, কাল সকালেই শহরে গিয়ে আগে তোমার জন্য একটা নতুন স্কার্ট বা চুড়িদার কিনব। যেটা পরে আছো সেটা পরে তো পথচলা যাবে না। মেয়েটি বলল, তুমি কোনও আঘাত পাওনি তো?
পেয়েছি। সামান্য। মাথায় খুব জোর লেগেছে।
তা হলে তোমার জামার ওই রক্ত!
ও তোমারই। আমরা এক সঙ্গে আসছিলাম, তাই লেগে গেছে।
এখানে কোথাও কি জল পাওয়া যাবে? তা হলে আপাতত একটু ধুয়ে নিতাম। এমন সময় কাছেরই একটি গাছের ডাল থেকে কুহু কুহু করে একটা কোকিল ডেকে উঠল। তারপর একটি দুটি করে পাখি। তার মানে ভোর হয়ে আসছে।
রঞ্জন বলল, পূবের আকাশে সামান্য একটু লালাভা দেখা দিচ্ছে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। রাতের শেষ। দিনের শুরু। চলো আমরা নীচে নামি। টিলার ওপারে নীচের দিকে একটা পাহাড়িয়া নদী আছে মনে হচ্ছে। আমরা ওখানেই যাই। মুখহাত ধুয়ে নিই। জামা থেকে রক্তের দাগ তুলি। তারপর বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা যাবে। ট্রেন তো চলবে না। অন্য কিছু যদি ম্যানেজ করা যায় তো সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
মেয়েটি বলল, তাই চলো। দূরের ওই নদীর জলে আমরা একটু পরিষ্কার হয়ে নিই। তারপর কাছেপিঠে কোনও শহরে গিয়ে বাড়িতে একটা তার করব। রঞ্জন বলল, সেই ভাল।
মেয়েটি উঠে দাঁড়াতে গেল, কিন্তু পারল না। খানিক উঠেই ধপ করে বসে পড়ল। বলল, পায়ে বড় ব্যথা। খালি পায়ে হাঁটা অভ্যেস নেই। কী করে যে যাব তা জানি না।
রঞ্জন ওর হাতধরে টেনে তুলল। বলল, আস্তে আস্তে এসো। কোথাও ওষুধের দোকান থাকলে দু’-চারটে ট্যাবলেট খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
মেয়েটি ওর হাত ধরে ধীরে ধীরে পথ চলতে লাগল। রঞ্জন বলল, যদি কিছু মনে না কর, একটা কথা বলি? কী কথা বলো।
আমরা দু’জনে এতক্ষণ আছি, কিন্তু কেউ কারও নাম জানি না। এটা কি ঠিক? মেয়েটি মরা চাঁদের মতো ম্লান হেসে বলল, না। মোটেই ঠিক নয়। কী নাম তোমার?
আমার নাম রঞ্জন।
তুমি হিন্দু। আমার নাম শবনম। আমি মুসলমান। আমি কলকাতায় পার্ক সার্কাসের কাছে পার্ল স্ট্রিটে থাকি।
আমি থাকি বালিগঞ্জে ম্যান্ডেভিলা গার্ডেনে।
ওখানে আমার এক বান্ধবী থাকে।
আমার কিন্তু কোনও বান্ধবী কোথাও থাকে না।
সে কী! তোমার বান্ধবী তো এখন তোমার পাশেই আছে। মুসলমানের মেয়ে বলে আমি কি পারি না কোনও হিন্দু ছেলের বান্ধবী হতে?
কেন পার না? আমাদের ঈশ্বর বা তোমাদের আল্লার কাছে সত্যিই কি কোনও ভেদাভেদ আছে? সবার রক্তের রংই তো লাল। এই দেখ না তোমার রক্ত আমার গায়ে, আমার জামায় লেগে আছে।
তুমি বড় ভাল।
তুমি ও। তোমার মতো মেয়ে আমি কখনও দেখিনি। ঈশ্বর করুন তোমার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ যেন কখনও না হয়। বাড়িতে তোমার কে কে আছে শবনম?
আমার কেউ নেই। মা মারা গেছেন ছেলেবেলায়। আব্বাজান আর আমি।
আমার দাদা ছিল। সে মাফিয়া দলের সঙ্গে মিশে উচ্ছন্নে গেছে। আব্বা তার মুখ দেখেন না। চাচা-চাচি আছেন। লোক সুবিধের নয় তাঁরা।
আমিও আমার বাবার একমাত্র সন্তান বলতে পার। আমার বড় দিদি ছিলেন। তিনি মারা গেছেন গত বছর। আমার দিদির ছেলেরা খুব ছোট। একজনের বয়স ছ’বছর। একজনের চার। আমি সম্বলপুরে তাদের কাছেই যাচ্ছিলাম।
আমি আব্বার সঙ্গে যাচ্ছিলাম হীরাকুদে।
এমন সময় গাছপালার আড়াল থেকে জনাচারেক লোক বেরিয়ে এসে বলল, তা তো যাচ্ছিলে। কিন্তু তোমার হাতে ওগুলো কী বাবা?
ওরা দু’জনেই চমকে উঠল এই নির্জন টিলায় ওই গুন্ডাকৃতি আগন্তুকদের দেখে।
শবনমের হাতে ওর আব্বাজানের ঘড়ি, বোতাম আর মানিব্যাগটা ছিল। একজন এসে ছিনিয়ে নিল সেটা।
আর একজন বলল, বেশ জায়গাটি বেছে নিয়েছ বাছাধনরা। ভেবেছ এখানে এসে গা ঢাকা দিলে কেউ আর দেখতে পাবে না তোমাদের। কিন্তু এটাই যে আমাদের স্বর্গরাজ্য। তা বুঝি জানতে না?
রঞ্জন বুঝল লোকগুলোর মুখ দিয়ে বিশ্রী গন্ধ ছাড়ছে। তার মানে নেশা করেছে ওরা। চারজনের মধ্যে দু’জন খুবই অপ্রকৃতিস্থ
রঞ্জন বলল, এটা স্বর্গই হোক আর নরকই হোক। যেগুলো নিয়েছ সেগুলো ফেরত দাও।
চুপ কর বদমাশ কোথাকার। মেরে মুখ ভেঙে দেব। এক ফোঁটা ছেলেমেয়ে এই বয়সেই চরতে শিখেছ? রাতের অন্ধকারে বনে-জঙ্গলে ঘুরতে এসে শুরু করেছ ছিনতাইবাজি?
রঞ্জন বলল, আমরা ছিনতাইবাজি করতে এসেছি, না তোমরাই লুটপাট করবার জন্যে রাতের অন্ধকারে ফিস প্লেট সরিয়ে নিয়েছিলে লাইন থেকে?
লোকগুলো এবার গম্ভীর মুখে পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল।
তারপর একজন এগিয়ে এসে বলল, তুই কী ম্যানেজ করেছিস দেখি? রঞ্জন বলল, এই দেখ। বলেই সে সজোরে লোকটার তলপেটে একটা ঘুসি মারল।
মারার সঙ্গে সঙ্গেই মুখটা বিকৃত হয়ে জিভটা ঝুলে পড়ল লোকটির। ঠোঁটের কষ বেয়ে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল।
একটি কিশোর বয়স্ক ছেলের হাতে একজন সঙ্গীর ওই রকম দুর্দশা দেখে বাকি তিনজন থতিয়ে গেল প্রথমে। ওদেরই একজন পিছন দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল রঞ্জনের ওপর। কিন্তু এই কিশোরের শারীরিক শক্তি এবং জুজুৎসুর প্যাঁচের নমুনা জানা ছিল না বাছাধনদের। তাই নিমেষে লোকদুটোকে ধরাশায়ী করে আবার রুখে দাঁড়াতেই একজনের লাথির ঘায়ে ছিটকে পড়ল ও। সেই সময়টুকুর মধ্যেই বাকি দু’জন ওর পকেট হাতড়ে যা যেখানে ছিল সব কিছু সাফ করে নিল। রঞ্জন বাধা দেবার আর কোনওরকম সুযোগই পেল না। উপরন্তু একজন দু’হাতে সজোরে ওর গলাটাকে টিপে ধরল।
এই আকস্মিক বিপদে হতভম্ব হয়ে শবনম বেচারা বোবার মতো দাঁড়িয়ে ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে রঞ্জনের অবস্থা দেখে শিউরে উঠল ও। ওদের অন্য মনস্কতার সুযোগ নিয়ে একটা বড় পাথর কুড়িয়ে যে লোকটা রঞ্জনের গলা টিপে ধরেছিল তার মাথার ওপর সজোরে বসিয়ে দিল। এক ঘা-ই যথেষ্ট। ভারী পাথরের আঘাতে মাথাটা গুঁড়িয়ে গেল একেবারে।
বাকি রইল আর দু’জন। ক্রুদ্ধ কুকুরের মতন এগিয়ে এল তারা শবনমের দিকে। বলল, তবে রে শয়তান মেয়ে।
একজন বলল, আয় তোকে পাহাড় থেকে ছুড়ে ফেলে দিই।
আর একজন বলল, না। ওকে মেরে ফেললে চলবে না। ওর গায়ের রং মুখশ্রী দেখেছিস? বড় হলে ও নূরজাহান হবে। আমাদের সঙ্গেই ওকে নিয়ে চলে যাই চল।
শবনম বলল, খবরদার এক পাও এগোবে না বলছি আমার দিকে। খুব সাবধান। আমি কিন্তু জ্যান্ত গোখরো সাপ। এমন ছোবল দেব যে তা ভাবতেও পারবে না।
কিন্তু চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি। যাদের বলা হল, তারা কর্ণপাতও করল না শবনমের কথায়। একজন এসে জোর করে কাঁধে উঠিয়ে নিল শবনমকে।
শবনম চিৎকার করতে লাগল, ছাড়ো ছাড়ো। ছাড়ো বলছি আমাকে। ছেড়ে দাও। রঞ্জন!
রঞ্জন তখন অতি কষ্টে আবার উঠে বসতে যাচ্ছে। কিন্তু যতবার উঠতে যাচ্ছে ততবারই পড়ে যাচ্ছে ও।
শবনম তখনও চিৎকার করছে, আমাকে বাঁচাও ! রঞ্জন! এরা আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
যে লোকটি ওকে কাঁধে নিয়েছিল সে বলল, তোমার বন্ধু এখন হাজার চেষ্টা করলেও তোমাকে বাঁচাতে আসবে না খুকুমণি। এখন চলো তুমি আমাদের গুহাতীর্থে বন্দিনী হবে বলে।
শবনম বলল, এখনও বলছি তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। না হলে তুমি মরবে। কে মারবে আমাকে! তোমার ওই হিরো?
ও নয়। আমিই মারব তোমাকে। বলার সঙ্গে সঙ্গে যা করবার তা করে ফেলল শবনম।
লোকটি যেন সাপের ছোবল খেয়ে চিৎকার করে উঠল। দেখা গেল নিজের গুপ্তস্থান থেকে ছোট্ট একটি পেনসিল কাটা ছুরি দিয়ে লোকটার গলার নালি দু’ফাঁক করে দিয়েছে শবনম।
ততক্ষণে রঞ্জনও উঠে দাঁড়িয়েছে। ওরও নাকেমুখে রক্ত। কপালের একটা পাশ কেটে গেছে।
আক্রমণকারী দলের বাকি একজন দারুশ বিপাকে পড়ে গেল এবার! দুটি কিশোর কিশোরীর হাতে ওর তিন সঙ্গীর ওই দুর্দশা দেখে আর এগোতে সাহস করল না সে। এবার এক-পা এক-পা করে পিছু হটতে লাগল তাই।
ছোট্ট ছুরির তীক্ষ্ণ ফলাটা হাতে নিয়ে শবনমও কেউটে সাপের মতো হিল হিল করে এগোতে লাগল ওর দিকে, আয় না। কাছে আয়। পালিয়ে যাচ্ছিস কেন? লোকটি এবার পিছু হটতে হটতে প্রাণের দায়ে দৌড়তে লাগল।
আকাশের পট থেকে শেষরাতের সমস্ত গ্লানি মুছে গেছে তখন। জ্যোৎস্নারাতের যদিও গ্লানি থাকে না, তবুও দুধফিকে অস্পষ্টতা যেটুকু ছিল সেটুকুও পরিষ্কার হয়ে গেল।
কী অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানকার। চারদিকে পাহাড়ের ঢেউ। সবুজ বনানী। তীরে শিমুল-পলাশে রাঙ্গ গহন বনরাজি। গাছে পাখির ডাক। কী চমৎকার।
রঞ্জন টলতে টলতে এসে শবনমের একটা হাত ধরল। ওর চোখের কোলে চিক চিক করছে মুক্তোর মতো জল।
শবনম বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, রঞ্জন?
হ্যাঁ। প্রচণ্ড মার দিয়েছে ওরা। গলাটা এত জোরে টিপে ধরেছিল যে এখনও কেড়ে নিয়েছে।
লাগছে। তা ছাড়া ওরা আমার সব টাকাগুলো আমারও। এখন কী করি বল তো?
কী আর করবে? আপাতত লোকালয়ে যাই চলো।
ওরা উঁচু টিলার ঢাল বেয়ে নীচে নামতে লাগল। হঠাৎই কী মনে পড়ে যেতে শবনম বলল, রঞ্জন, আমার মনে হয় ওই লোকগুলোর পকেট হাতড়ালে হয়তো আমাদের খোয়া যাওয়া জিনিসপত্তরগুলো পাওয়া যেতে পারে।
রঞ্জন বলল, ঠিক বলেছ তো। চলো চলো। ওদের চারজনের তিনজনকেই আমরা শেষ করে দিয়েছি। বাকি একজন কি সব নিয়ে পালাতে পেরেছে?
শবনম রঞ্জনকে বলল, তুমি একটু ধীরে ধীরে এসো। আমি ততক্ষণ দেখছি।
রঞ্জন বলল, তাই যাও। যা করবার তাড়াতাড়ি কোরো। না হলে লোকজন এসে পড়বে এখুনি। ভোর হয়েছে। সকাল হতেও বেশি দেরি নেই। কেউ আসার আগেই কেটে পড়তে হবে আমাদের। না হলে খুনের দায়ে ধরা পড়ব আমরা।
শবনম অত্যন্ত চতুরা। এই কৈশোর বয়সেই তার বুদ্ধি, সাহস এবং কর্মতৎপরতা সত্যিই প্রশংসা করবার মতো। সে ক্ষিপ্রগতিতে তিনজনের দেহ উলটে পালটে পকেট হাতড়ে অনেক কিছুই বার করে ফেলল।
রঞ্জন এসে উদ্ধার করল শবনমের আব্বাজানের সোনার বোতামটা। পাওয়া গেল না শুধু ঘড়ি আর মানি ব্যাগ। রঞ্জনের টাকাগুলো যে হাতিয়েছিল তার মাথা তো গুঁড়িয়ে দিয়েছিল শবনম। কাজেই সেগুলো উদ্ধার করতে খুব একটা কষ্ট হল না।
এমন সময় ওরা বহু দূর থেকে দুম দাম শব্দ শুনতে পেল।
শবনম বলল, ও কীসের শব্দ?
মনে হয় গুলির। ব্লাঙ্ক ফায়ার করে রেলপুলিশ নিশ্চয়ই দুর্ঘটনাস্থল থেকে লোকজন সরাচ্ছে।
তার মানে রেসকিউ পার্টির লোকেরা এসে গেছে?
মনে হয়।
রঞ্জন! আমার আব্বাজান?
দুঃখ কোরো না শবনম! এই পাহাড়-জঙ্গলের দেশ থেকে কলকাতার পথে আপাতত আমরা পাড়ি দিতে পারব না। বরং চলো কোথাও থেকে তার করে যে যার বাড়িতে আমাদের অবস্থার কথা জানাই। তোমার আব্বাজানকে পেলেই বা এখন তুমি কী করবে? তুমি আমি দু’জনে কি পারব তাঁর মৃতদেহ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে?
শবনম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এসো। টিলার নীচে ওই নদীতে গিয়ে বরং আমরা আগে একটু পরিষ্কার হই।
রঞ্জন নিজের টাকা শবনমের আব্বাজানের বোতাম ছাড়াও ওদের পকেট হাতড়ে যা কিছু পেয়েছিল সব নিজের কাছে রেখে দিল। বলল, বলা যায় না, এই কাগজপত্রের ভেতর দিয়েই হয়তো ওদের পরিচয় এবং অনেক গোপন তথ্য পেয়ে যাব। আর সেগুলো পুলিশের হাতে তুলে দিলে নিশ্চয়ই দুষ্কৃতীরা দলকে দল ধরা পড়বে।
ঠিক বলেছ তুমি। আল্লা করেন যেন তাই হয়। দলকে দল ধরা পড়ে ওরা। আমরা তো তিনজনের বদলা নিয়েইছি।
ওরা আর একটুও বিলম্ব না করে সেই ঘন গাছপালায় ভরা উচ্চ টিলার ওপর থেকে নীচে নেমে এল। একেবারে নীচে নেমে আসার পর দেখল ছোট্ট একটি গিরিনদী এঁকেবেঁকে পাহাড়ের খাঁজেখাঁজে অশান্ত গতিতে বয়ে চলেছে।
শবনম বলল, তুমি এইখানে একটু আড়ালে বসে থাক। আমি ততক্ষণ এগুলো পরিষ্কার করে নিই।
রঞ্জন বসে রইল।
সামান্য কিছু সময়ের মধ্যেই মুখহাত ধুয়ে পোশাকে লেগে থাকা রক্তের দাগ মুছে উঠে এল শবনম। বলল, এবার আমি বসি, তুমি যাও।
রঞ্জন বলল, তা তো যাব। কিন্তু এই সাতসকালে একেবারে সব যে ভিজিয়ে ফেললে তুমি। এখন উপায়?
উপায় আর কী বল? আমি তো তোমার মতো ছেলে নই। না হলে খালি গায়ে থাকতাম। গায়ে জল বসুক আর যাই হোক ভিজে জামাই পড়ে থাকতে হবে। সত্যিই তো। উপায় কী?
রঞ্জন নিজেও এবার নদীতে নেমে মুখহাত ধুয়ে পরিষ্কার হল। ওর জামাতেও যে সব জায়গায় রক্তের দাগ লেগেছিল, সেগুলো পরিষ্কার করল। পরিষ্কার করতে গিয়ে নিজের জামাও ভিজিয়ে ফেলল রঞ্জন। তারপর ভিজে জামা গায়ে দিয়েই উপরে উঠে এল।
ঠিক এই সময়ই পাহাড়ের ঘন শাল বনের ভেতর থেকে প্রভাতসূর্যের আলোর ছটা ওদের গায়ে এসে পড়ল। গাছের সবুজ পাতায় লাল আলো কী অপরূপ।
ইতিমধ্যেই চারদিকে লোকজনের চলাচল শুরু হয়েছে। তবে তা নেহাতই দেহাতি লোকজনের। ওরা সেই পথে যেতে যেতে বনের ভেতর হঠাৎ একটা মন্দির দেখতে পেল।
রঞ্জন বলল, যাক বাবা, বাঁচা গেছে। ওইখানে উঠে ওদের আশ্রমে যে ভাবেই হোক একটু থাকার ব্যবস্থা করে নেব। তারপর স্থানীয় কোনও সরকারি-বেসরকারি অফিস অথবা পোস্ট অফিস থেকে ট্রাঙ্ককল করব বাড়িতে। শবনম বলল, হ্যাঁ। না হলে আজকের কাগজে এই দুর্ঘটনার কথা যদি ছাপা হয়ে থাকে তা হলে সবাই খুব চিন্তা করবে। আর চাচাজিকে খবর না দিতে
পারলে আমার আব্বাজানের ডেড বডিও বেপাত্তা হয়ে যাবে।
আমার সন্দেহ হচ্ছে কী জান শবনম, হয়তো শেষ পর্যন্ত তোমার আব্বাজানের ডেড বডি পাওয়াই যাবে না।
পাওয়া যাবে না! কেন?
তা জানি না। তবে শুনেছি রেল দুর্ঘটনায় এই রকমই নাকি হয়।
কথা বলতে বলতে ওরা সেই মন্দিরের কাছে এসে পড়ল। মন্দিরের বাইরের গেটে লেখা আছে গোবিন্দজির মন্দির। বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে মন্দিরটা। কয়েকটি তালাবন্ধ ঘরও রয়েছে।
রঞ্জন বলল, এইখানেই আমরা আজকের মতো আশ্রয় নেব। তারপর এদের সাহায্য নিয়ে যা করবার করব।
মন্দিরের সেবায়েত গিরিধারীজি ওদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। যদিও অবাঙালি, তবুও পরিষ্কার বাংলায় বললেন, এসো এসো। ভেতরে এসো। শবনম ও রঞ্জন ভেতরে ঢুকল।
গিরিধারীজি বললেন, এ কী! তোমাদের এই রকম অবস্থা কেন? এই সাতসকালে ভিজে কাপড়ে ব্যাপারটা কী?
রঞ্জন বলল, পূজারিজি, আমরা মাত্র একদিনের জন্য আপনার এখানে আশ্রয় চাই। আজ আপনার মন্দিরে আমাদের দু’জনের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থাও করতে হবে। যা লাগে দেব আমরা। খুব বিপদ আমাদের।
গিরিধারীজি সস্নেহে বললেন এবার, প্রসাদ জরুর মিলেগা। লেকিন তুম দোনো কৌন হো? কাঁহাসে আ রহে হো তুম! কীসের বিপদ তোমাদের? রঞ্জন বলল, কাল রাত্রে ওই টিলার ওপরে যে বন, সেইখানে এক গুরুতর রেল দুর্ঘটনা হয়েছে।
হাঁ হাঁ শুনা। বহুত আদমিকা নিধন হো চুকা।
আমরাও ওই রেলের যাত্রী ছিলাম। ওই দুর্ঘটনার পর ভয়ে পালিয়ে এসেছি আমরা।
আঃ হা। বঢ়ি আপশোশ কী বাত। ঠিক হ্যায়। মাত ডরো। হিয়া ঘর ভি মিলেগা, খানা ভি মিলেগা। এ লেড়কি তুমহারা কৌন হ্যায়? বহিনকা মাফিক।
বহিন কা মাফিক? বহিন নেহি? বলেই ডাকলেন, জানকি বেটি? এ জানকি বেটি?
ভেতর থেকে উত্তর এল, যাতে হেঁ।
গিরিধারীজি বললেন, জলদি আ যাও। তারপর রঞ্জনকে বললেন, খুব জোর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে শুনলুম। কোনও আদমিকে ওখানে যেতে দিচ্ছে না পুলিশ?
রঞ্জন বলল, না। তারপর বলল, একটু বেলায় এখানে কোথাও থেকে বাড়িতে একটা ট্রাঙ্কল করা যাবে?
হাঁ হাঁ। নিশ্চয়ই করা যাবে।
এমন সময় মধ্যবয়সি এক মহিলা সম্ভবত জানকি বিটিয়া এসে দাঁড়ালেন সেখানে। তারপর ওদের দেখে কতকটা নিজের মনেই যেন আস্তে করে বললেন, দোনো কাঁহাসে আ গিয়া?
গিরিধারীজি বললেন, দুর্ঘটনা সে ফাঁস গয়া বেচারা। যাও কুছ খানা লে আও। জানকি বিটিয়া একটু সময়ের মধ্যেই দুটো প্লেটে দুটো করে মুগের লাড্ডু ভাল ঘিয়ের হালুয়া নিয়ে এলেন।
গিরিধারীজি বললেন, তোমরা কলকাতা থেকে আসছ নিশ্চয়ই? পাথুরেঘাটার দুনিচাঁদবাবুকে চেনো?
রঞ্জন বলল, না।
জানকি বিটিয়া বললেন, ইয়ে মন্দির উনহোনে বনায়া।
গিরিধারীজি বললেন, যাও, ও বগলবালা ঘর ও লেড়কাকো দে দো। আউর লেড়কিকো সাথ রাখো তুমহারা। আচ্ছা সে দেখভাল করো।
রঞ্জন বলল, ওর সব কিছু ভিজে আছে। দয়া করে ওকে একটা শুকনো কিছু পরবার জন্য দিন।
গিরিধারীজি বললেন, চিন্তা মাত করো বেটা। এটা দেবস্থান। গোবিন্দজির মন্দিরে যখন এসে পড়েছ তখন সব কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে তোমাদের। দরকার হলে আমিই তোমাদের বাড়িতে খবর পাঠাব। ভাবনা কোরো না। তারপর বললেন, ক্যা নাম হ্যায় তুমহারা।
আমার নাম রঞ্জন রায়।
আর উস লেড়কি কো?
শবনম।
বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত হয়ে গেল। লাফিয়ে উঠলেন গিরিধারীজি, কেয়া নাম বতায়া? শবনম?
শবনম বলল, হ্যাঁ।
মহামেডান!
জি হ্যাঁ?
নিকালো, নিকালো, আভি নিকালো হিয়াসে। এটা গোবিন্দজির মন্দির। বাবু জানতে পারলে আমার নোকরি থাকবে না। হিন্দুর মন্দিরে মুসলমানের কোনও স্থান নেই। অন্য কোথাও রাস্তা দেখ তোমরা।
খাওয়া অর্ধপথেই রইল। রঞ্জন মুখের গ্রাস নামিয়ে বলল, সে কী পূজারিজি! এই অচেনা জায়গায় আমরা কোথায় রাস্তা দেখব? শুধু মুসলমান হওয়ার অপরাধে এই ফুলের মতো মেয়েটা হিন্দুর মন্দিরে আশ্রয় পাবে না?
না পাবে না। বলেই শবনমকে বললেন, তুমি এখুনি মন্দিরের বাইরে চলে যাও।
শবনমের দু’চোখে জল এল।
রঞ্জন দুঃখ করে বলল, পূজারিজি, আপনি যে গোবিন্দজির সেবা করছেন সেই গোবিন্দজিরই উপাসক চৈতন্যমহাপ্রভু, যবন হরিদাসকে তাঁর বুকের মাঝে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আর আপনি? ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
আরে থামো। ফালতু বকোয়াস মাত করো ছোকরা। ভাগো হিয়াসে।
রঞ্জন না-খেয়েই উঠে দাঁড়াল। তারপর থুঃ করে একটা থুতু ফেলে চলে এল মন্দির থেকে। শবনম কাঁদছিল।
রঞ্জন বলল, কেঁদো না। আমাদের পুরোহিত-ব্রাহ্মণরা এই রকমই। আমাদের সংস্কারও এই রকম। এখন চলো যেদিকে লোকবসতি আছে সেই দিকে যাই। শবনম বলল, আমার জন্যে তুমিও আশ্রয়হীন হলে। তার চেয়ে তুমি থাকো, আমি যাই।
ছিঃ শবনম। তুমি আমাকে এত হীন ভাবলে? মন্দির আর মসজিদের মহিমা ওরা কী বুঝবে? তা যদি বুঝত তা হলে কি এত কষ্ট থাকত মানুষের? যিনি খ্রিস্ট তিনি কৃষ্ণ তিনিই আল্লা এই সরল সত্যকে যুগে যুগে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের মনীষীরা। তবুও আমাদের মাঝে এর এত ভেদাভেদ। তুমি কিছু মনে কোরো না। আমিও তো হিন্দুর ছেলে। একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ তোমাকে প্রত্যাখ্যান করলেও, আর এক হিন্দু ভাই যে তোমাকে গ্রহণ করতে চায়, তার বেলা?
শবনমের মুখে এবার একটু হাসি ফুটল। বলল, চলো, চলে যাই। কাল রাত্রি থেকে কী যে হচ্ছে। কিছু বুঝতে পারছি না। আমার খুব খিদে পাচ্ছে। তোমারও পাচ্ছে নিশ্চয়ই?
ওরা দু’জনে ধীরে ধীরে বনপথ-রেখা ধরে এগিয়ে চলল। বেশ কিছুদূর যাবার পর লোকজনের দেখা মিলল। এরা সব লাইন দিয়ে জঙ্গলের কাঠ কাটতে চলেছে। ওদের প্রত্যেকেরই মুখে গত রাতের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার কথা।
রঞ্জন ওদেরই একজনকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ভাই, এখানে কাছেপিঠে কোথাও কোনও দোকানটোকান আছে?
হাঁ হাঁ। সিধা চলা যাইয়ে! দুকান মিলেগা। সবজি মণ্ডি মিলেগা। সব কুছ হ্যায় হুঁয়া পর।
ওরা আশান্বিত হয়ে সেই দিকেই এগিয়ে চলল।
খানিক যাবার পর দু’-একটা করে ঘরবাড়ি চোখে পড়ল ওদের। অবশেষে ছোট্ট একটি বাজারের কাছে এসে পড়ল ওরা। একটি দোকানে গরম গরম কচুরি আর জিলিপি ভাজা হচ্ছিল। দোকানের বাইরে পেতে রাখা একটা নড়বড়ে বেঞ্চিতে এসে বসল দু’জনে।
ওদের ভিজে পোশাকপরা চেহারার দিকে তাকিয়ে দোকানদার বলল, তুম দোনো কাঁহা সে আ রহে ভাই?
রঞ্জন বলল, কাল রাত্রে যে ট্রেন দুর্ঘটনা হয়েছে আমরা তারই যাত্রী ছিলাম।
এখন তোমাদের দেশে এসেছি। যে ভাবেই হোক আমাদের কলকাতায় ফিরে যাবার একটা পথ বলে দাও।
ক্যায়সে যাওগে? সব রাস্তা বন্ধ।
তা হলে?
তা হলে কেয়া? কুছ না কুছ হোগা। আভি বতাইয়ে ক্যা চাহিয়ে।
আপাতত চারটে করে কচুরি আর একশো গ্রাম করে জিলিপি দাও। আমাদের কাছুে টাকা-পয়সা আছে। দাম দিতে পারব।
দোকানদার একটু জিভ কেটে বলল, হায় রাম। হাম এতনা বুঢ়া আদমি নেহি। তুমহারা পাশ পইসা নেহি রহনে সে ভি খিলায়াগা তুমকো। আও, অন্দর চলা আও।
রঞ্জন বলল, কেন, বেশ তো বাইরে আছি।
আরে খোকাবাবু! ও তো স্রেফ দেহাতি লোগোকে লিয়ে। তুম দোনো অন্দরমে আ যাও।
কিন্তু আমি হিন্দু, আর ও মুসলমান। ভেতরে ঢুকলে দোকানের জাত যাবে না তো?
দোকানদার ফিক করে একটু হেসে বলল, নেহি। হোটেল রেস্টুরেন্ট মে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান সবকো একই নজর সে দেখা যাতি হ্যায়। তুম ডরো মাত।
ওরা দু’জনে দোকানের ভেতরে ঢুকে পেটভরে কচুরি আর জিলিপি খেল। শবনম বলল, আমি চা খাব না। তুমি খাও তো খেতে পারো।
রঞ্জন নিজের জন্য একটা চা বলল।
চা খেতে খেতে রঞ্জন দোকানদারকে বলল, ভাই সাব, হিয়া ঠারনেকে লিয়ে হোটেল মিলেগা?
নেহি ভাই। লেকিন একঠে। ধরমশালা হ্যায় নদীকা কিনারা মে। হুঁয়া চলা যাও।
ওরা দু’জনে খাবারের দাম মিটিয়ে বাইরে এসে বাজারের কাছে একটি দোকান থেকে দু’জোড়া চটি ও শবনমের জন্য একটা স্কার্ট কিনে ধর্মশালার দিকে চলল। ধর্মশালাটি যদিও মাড়োয়াড়ির, তবুও দেখাশোনার জন্য একজন বাঙালি ভদ্রলোক ছিলেন। রঞ্জনের মুখে সব শুনে বললেন, ঘর আমাদের আছে। কিন্তু শত বিপদেও এই ধর্মশালায় কোনও মুসলমানকে ঘর দেবার হুকুম নেই।
রঞ্জন বলল, তা হলে আমরা কোথায় যাব?
তা তো বলতে পারব না। শুধু এইটুকু বলতে পারি এই ধর্মশালায় তোমাদের স্থান হচ্ছে না।
রঞ্জন আর এক মুহূর্ত রইল না সেখানে। শবনমের হাত ধরে চলে এল সেখান থেকে। তারপর নদীর ধারে পাথরের একটি খাঁজের কাছে এসে বলল, তুমি একটু আড়ালে গিয়ে পোশাকটা পালটে নাও শবনম। আর সভ্যতার আলোয় নয়, দেবস্থানে ধর্মশালাতেও নয়, চলো আমরা জঙ্গলে যাই। সেখানে কোনও অরণ্যবাসীর গৃহে আশ্রয় নেব, নয়তো গাছের ডালে বসে রাত কাটাব। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আমার।
বাড়িতে ফোন করার তা হলে কী হবে?
সে ব্যাপারে তোমার কোনও চিন্তা নেই। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আগে একটা থাকার জায়গা ঠিক করি। তারপর সব কিছুর ব্যবস্থা করব। ওরা ধীরে ধীরে জঙ্গলমুখো হল।
গভীর জঙ্গলে ঢোকার মুখে আবার পড়ল সেই নদীটা। তবে এখানে নদী পারাপারের জন্য একটা শক্ত মোটা গাছের গুঁড়ি রাখা আছে। তার মানে এখান দিয়ে লোকজন যাওয়া আসা করে। ওরা খুব সাবধানে সেই গুঁড়ির ওপর পা রেখে নদী পার হল। ছোট্ট নদী। বড় বড় পাথরের ওপর পা দিয়েও পারাপার হওয়া যায়।
নদী পার হয়ে কিছু দূর যাবার পরই এক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে একটি গুহা দেখতে পেল। ওরা আশান্বিত হয়ে সেই গুহার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল।
রঞ্জন বলল, এই আমাদের উপযুক্ত জায়গা। এখানে কেউ আমাদের জাত জানতে চাইবে না। কেউ বিরক্ত করবে না, খুব শান্তিতে থাকতে পারব আমরা। শবনম বলল, তা না হয় হল। কিন্তু রাত্তিরে যদি বাঘ-ভালুক এসে ঢোকে?
রঞ্জন বলল, সে ব্যবস্থাও করব বইকী। জঙ্গলে গাছের ডাল ভেঙে এনে পাথর সাজিয়ে মুখটাকে ছোট করে দেব। দিব্যি আরামে থাকব আমরা। দু’-একদিন থাকলেই যথেষ্ট। রাস্তা খুলে যাবে। এখন এখানটা পরিষ্কার করে চলো একটু বেলায় স্নান করে আবার শহরে যাই। সেখানে খেয়েদেয়ে সন্ধের আগেই এখানে ফিরে আসব।
শবনম খুশি মনে রঞ্জনের হাত ধরে গুহায় ঢুকল।
গুহার ভেতরটা খুবই অপরিষ্কার। দু’-একটি শূন্য বোতল বা বিড়ির টুকরোও পাওয়া গেল সেখানে। তার মানে এখানে কেউ আসে। ওরা বেশ ভাল ভাবে গুহার ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। খুব যে একটা বড়সড় গুহা তা নয়। তবে দু’-দশজন লোক অনায়াসে দিনের পর দিন থাকতে পারে এখানে।