হিন্দু-মুসলমান-কোড বিল

হিন্দু-মুসলমান-কোড বিল

শাস্ত্রে সব পাওয়া যায়– কোনওকিছুর অনটন নেই। সম্পত্তি বিলিয়ে দিতে চান, না বিলিয়ে দিতে চান; বিয়ে করতে চান, না করতে চান– একখানা কিংবা বিশখানা; পুজো-পাজা করতে চান কিংবা ব্যোম ভোলানাথ বলে বুঁদ হয়ে থাকতে চান, এমনকি মরার পর পরশুরামী স্বর্গে গিয়ে অপ্সরাদের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করতে চান কিংবা রবিঠাকুরী ‘কোণের প্রদীপ মিলায় যথা জ্যোতিঃ সমুদ্রেই’ হয়ে গিয়ে নিগুণ নির্বাণানন্দ লাভ করতে চান, তাবৎ মালই পাবেন।

তা না হলে সতীদাহ বন্ধ করার সময় উভয়পক্ষই শাস্ত্র কপচালেন কেন? বিধবা-বিবাহ আইন পাস করার সময় শারদা বিলের হাঙ্গামহুৰ্জ্জুতের সময় উভয়পক্ষই তো শাস্ত্রের দোহাই পেড়েছিলেন, একথা তো আর কেউ ভুলে যায়নি।

শুধু হিন্দু শাস্ত্র না, ইহুদি খ্রিস্টান মুসলিম সব শাস্ত্রেরই ওই গতি। শুধু হিন্দু শাস্ত্র এঁদের তুলনায় অনেক বেশি বনেদি বলে এর বাড়িতে দালানকোঠার গোলকধাঁধা ওঁদের তুলনায় অনেক বেশি, পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা পদে পদে। তাতে অবশ্য বিচলিত হওয়ার মতো কিছুই নেই, কারণ স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট নাকি বলেছেন, যেহোভার আপন বাড়িতে দালান-কোঠা বিস্তর।

তাই শাস্ত্রের প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা। তাতে ফয়দাও এন্তার। মুসলিম শাস্ত্রের কিঞ্চিৎ চর্চা করেছি বলেই মোল্লা-মৌলবিকে আমি বড্ড বেশি ডরাইনে। কুঁড়েমি করে জুম্মার নমাজে যাইনি, মোল্লাজি রাগত হয়ে প্রশ্ন শুধালেন, যাইনি কেন? চট করে শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করলুম, আমি যে জায়গায় আছি সেটাকে ঠিক শহর (মিস্র) বলা চলে না অতএব জুম্মার নমাজ অসিদ্ধ। ব্যস, হয়ে গেল। ঠিক তেমনি বিয়ে যখন করতে চাইনি, তখন আমি শাস্ত্রের দোহাই পেড়েছি আবার ওজীর সাহেব ফজলু ভায়া যখন পরিপকু বৃদ্ধ বয়সে তরুণী গ্রহণ করলেন, তখন তিনিও হদীস (স্মৃতি) কপচালেন।

গ্রামাঞ্চলে থাকতে হলে কুইনিনের মতো শাস্ত্র নিত্য সেব্য।

সে কথা থাক।

হিন্দু রমণী তালাক (লগ্নচ্ছেদ) দিয়ে নবীন পতি বরণ করতে পারবেন কি না, সে সম্বন্ধে শাস্ত্র কী বলেন তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনে। আমার শিরঃপীড়া, আমার গৃহিণী বেঁকে গিয়ে কিছু একটা করে ফেলবেন না তো! এ প্রশ্ন মনে উঠত না, কিন্তু হিন্দু কোড বিল আসর গরম করে তোলাতে মুসলমান ভায়াদের টনক নড়েছে। খুলে কই।

হঠাৎ এক গুণী খবরের কাগজে পত্রাঘাত করলেন তিনি হিন্দু না মুসলমান মনে নেই হিন্দু রমণী যদি লগ্নচ্ছেদ করবার অধিকার পায় তবে মুসলমান রমণীতেও সে অধিকার বর্তাবে কেন? ঠিকই তো! কিন্তু উত্তরে আর পাঁচজন মুসলমান বললেনকেউ খেঁকিয়ে, কেউ মুরুব্বির চালে, কেউ-বা হিন্দু ভায়াদের পিঠে আদরের থাবড়া দিয়ে মুসলমান শাস্ত্র নতুন কোড দিয়ে রদবদল করার কোনও প্রয়োজন নেই। মুসলমান রমণীর যে অধিকার আছে তাই নিয়ে তারা সন্তুষ্ট– ওসব মালের প্রয়োজন হিন্দুদের।

লক্ষ করলুম, কোনও মুসলমান রমণী খবরের কাগজে এ বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না।

তাই প্রশ্ন, লগ্নচ্ছেদ করার জন্য মুসলমান পুরুষ-রমণীর কতটুকু অধিকার? এ আলোচনায় মুসলমানদের কিছুটা লাভ হবে, হিন্দুদের কোনও ক্ষতি হবে না!

মৌলা বখশ মিঞা যে কোনও মুহূর্তে বেগম মৌলাকে তিনবার ‘তালাক, তালাক, তালাক’ বললেই তালাক হয়ে গেল– স্বয়ং শিবেরও সাধ্য নেই তিনি তখন সে তালাক ঠেকান, এস্থলে ‘শিব’ বলতে অবশ্য মোল্লা-মৌলবি বোঝায়।

বেগম মৌলা সতীসাধ্বী। আজীবন স্বামীর সেবা করেছেন। তাঁর তিনটি পুত্রকন্যা, সবচেয়ে ছোটটির বয়স দশ কিংবা বারো। তাঁর বাপের বাড়িতে কেউ নেই। তিনি বিগতযৌবনা– বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে অর্থাৎ তিনি পুনরায় বিয়ে করতে চাইলেও নতুন বর পাবেন না।

বেগম মৌলাকে তদ্দণ্ডেই পতিগৃহ ত্যাগ করতে হবে। কাচ্চাবাচ্চাদের ওপরও তার কোনও অধিকার নেই– নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য হলে অবশ্য আলাদা কথা।

‘তালাক, তালাক, তালাক’ বলার জন্য মৌলা সাহেবকে কোনও কারণ দর্শাতে হবে না, কেন তিনি গৃহিণীকে বর্জন করেছেন; তার কোনও অপরাধ আছে কি না, তিনি অসতী কিংবা চিররুগণা, কিংবা বদ্ধ উন্মাদ– এর কোনও কারণই দেখাবার জন্য কেউ তাকে বাধ্য করতে পারে না। এস্থলে নিরঙ্কুশ, চৌকশ ‘কর্তা’র ইচ্ছায় কর্ম।

(জানি মৌলা সাহেব হেড আপিসের বড়বাবুর মতো বড় শান্ত স্বভাব ধরেন। হঠাৎ তিনি ক্ষেপে গিয়ে এরকম ধারা কিছু একটা করবেন না, কিন্তু সে কথা অবান্তর। এখানে প্রশ্ন, মৌলার হক কতটুকু, বেগম মৌলারই-বা কতটুকু? তুলনা দিয়ে বলতে পারি, ভদ্র হিন্দু সচরাচর বিনা কুসুরে একমাত্র পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র করে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন না। কিন্তু কস্মিনকালেও করেন না একথা বললে সত্যের অপলাপ হয়।)

যাঁরা তালাক আইনের কোনও পরিবর্তন চান না, তারা উত্তরে বলবেন, আরে বাপু, তালাক দেওয়া কি এতই সোজা কর্ম? মহরের কথাটি কি বেবাক ভুলে গেলে? মৌলার মাইনে তিনশ টাকা ‘মহরে’র টাকা পাঁচ হাজার। অত টাকা পাবে কোথায় মৌলা সাহেব?

হিন্দু পাঠককে এই বেলা ‘মহর’ জিনিসটি কী সেটি বুঝিয়ে বলতে হয়। ‘মহর’ অর্থ মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে স্ত্রীধন। বিয়ের সময় মৌলাকে প্রতিজ্ঞা করতে হয়, তার বেগমকে তিনি কতটা স্ত্রীধন দেবেন। মৌলা বলেছিলেন, পাঁচ হাজার (অবস্থাভেদে পঞ্চাশ, একশ, এক হাজার বা পাঁচ লক্ষও হতে পারে) এবং এ প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন, নগদা-নগদি আড়াই হাজার ঢেলে দেবেন এবং বাকি আড়াই হাজার কিস্তিবন্দিতে শোধ দেবেন।

এসব শুধু মুখের কথা নয়। এ সমস্ত জিনিস বিয়ের রাতে দলিল লিখে তৈরি করা হয় ও পরে ‘মেরেজ রেজিস্ট্রারে’র আপিসে পাকাপোক্ত রেজিস্ট্রি করা হয়। মৌলা এ টাকাটা ফাঁকি দিতে পারবেন না, সেকথা সুনিশ্চিত।

উত্তরে নিবেদন :

মৌলার গাঠে পাঁচ হাজার টাকা থাক আর নাই থাক, তিনি যে স্ত্রীকে তালাক দিলেন, সেটা কিন্তু অসিদ্ধ নয়। টাকা না দিতে পারার জন্য শেষ-ত মৌলার সিভিল জেল হতে পারে, কিন্তু তালাক তালাকই থেকে গেল। অর্থাৎ একথা কেউ মৌলাকে বলতে পারবে না, তোমার যখন পাঁচ হাজার টাকা রেস্ত নেই, তাই তালাক বাতিল, বেগম মৌলা তোমার স্ত্রী এবং স্ত্রীর অধিকার তিনি উপভোগ করবেন।

মোদ্দা কথা, তালাক হয়ে গেল, টাকা থাক আর নাই থাক।

***

পুনরায় নিবেদন করি, শাস্ত্র কী বলেন সেকথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। কুরানশরিফ যা বলেছেন, তার যেসব টীকা-টিপ্পনী লেখা হয়েছে, তার ওপর যে বিরাট শাস্ত্র গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে দেশাচার-লোকাঁচার মিলে গিয়ে উপস্থিত যে পরিস্থিতি বিদ্যমান তাই নিয়ে আমাদের আলোচনা। সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী বিবাহিত স্ত্রী-পুরুষে একে অন্যের ওপর কতখানি অধিকার বিশেষ করে একে অন্যকে বর্জন করার অধিকার কার কতটুকু সেই নিয়ে আলোচনা।

পূর্বেই নিবেদন করেছি স্বামী যে কোনও মুহূর্তে স্ত্রীকে বর্জন করতে পারেন। তাঁকে তখন কোনও কারণ কিংবা অজুহাত দর্শাতে হয় না। তবে তিনি যে ‘মহর’ বা স্ত্রীধন দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সে অর্থ তাকে দিতে হবে। অবশ্য না দিতে পারলে যে তালাক মকুব হবে তা-ও নয়। স্ত্রী তার ভূতপূর্ব স্বামীর মাইনে ‘অ্যাটাচ’ করতে পারেন, আদালতের ডিক্রি নিয়ে সম্পত্তি ক্রোক করতে পারেন; এককথায় উত্তমর্ণ অধর্মণকে যতখানি নাস্তানাবুদ করতে পারেন ততখানি তিনিও করতে পারেন।

উত্তম প্রস্তাব! এখন প্রশ্ন স্ত্রী যদি স্বামীকে বর্জন করতে চান তবে তিনি পারেন কি না? যদি মনে করুন, স্ত্রী বলেন, ‘এই রইল তোমার স্ত্রীধন, আমাকে খালাস দাও,’ কিংবা যদি বলেন, ‘তুমি আমাকে যে স্ত্রীধন দেবে বলেছিলে সে স্ত্রীধনে আমার প্রয়োজন নেই, আমি। তোমাকে বর্জন করতে চাই’, তবু স্বামী সাফ ‘না’ বলতে পারেন। অবশ্য স্ত্রী স্বামীকে জ্বালাতন করার জন্য তার স্ত্রীধন তদ্দশ্যেই চাইতে পারেন– কারণ স্ত্রীধন তলব করার হক স্ত্রীর সবসময়ই আছে, স্বামী তালাক দিতে চাওয়া না-চাওয়ার ওপর সেটা নির্ভর করে না। স্বামী যদি সে ধন দিতে অক্ষম হন তা হলেও স্ত্রী তালাক পেলেন না। অর্থাৎ তিনি যদি পতিগৃহ ত্যাগ করে ভিন্ন বিবাহ করতে চান তবে সে বিবাহ অসিদ্ধ; শুধু তাই নয়, পুলিশ স্ত্রী এবং নবীন স্বামী দু জনের বিরুদ্ধে ‘বিগেমি’র মোকদ্দমা করতে পারবে।

পক্ষান্তরে আবার কোনও স্ত্রী যদি স্ত্রীধনটি ভ্যানটি-ব্যাগস্থ করে বাপের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকেন তবে স্বামীও তাকে জোর করে আপন বাড়িতে নিয়ে আসতে পারেন না। আইন স্বামীকে সে অধিকার দেয়, কিন্তু আনবার জন্য পুলিশের সাহায্য দিতে সম্পূর্ণ নারাজ। আপনি যদি জোর করে আনতে যান তবে শালী-শালাদের হস্তে উত্তমমধ্যমের সমূহ সম্ভাবনা।

তখন আপনি আর কী করতে পারেন? তাঁকে তালাক দিয়ে হৃদয় থেকে মুছে ফেলবার চেষ্টা করতে পারেন আর আপনি যদি প্রতিহিংসা-পরায়ণ হন তবে আপনি তালাক না দিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারেন। তাতে করে আর কিছু না হোক স্ত্রী অন্তত আরেকটা লোককে বিয়ে করতে পারবেন না।

খুব বেশি না হলেও কোনও কোনও সময় এরকম হয়ে থাকে। পরিস্থিতিটা দু রকমের হয়।

হয় স্বামী বদরাগী, কিংবা দুশ্চরিত্র। স্ত্রীকে খেতে-পরতে দেয় না, মারধোর করে। সহ্য করতে পেরে স্ত্রী বাপ কিংবা ভাইয়ের বাড়িতে পালাল (বাপ বেঁচে না থাকলে ভাইও আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়, কারণ ভাই যে সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে তাতে বোনেরও অংশ আছে)। সেখান থেকে সে স্ত্রীধনের তলব করে মোকদ্দমা লাগাল। স্বামীর কণ্ঠশ্বাস– অত টাকা যোগাড় করবে কোথা থেকে?

তখন সাধারণত মুরব্বিরা মধ্যিখানে পড়েন–বিশেষত সেইসব মুরব্বিরা যারা বিয়েটা ঠিক করে দিয়েছিলেন। তাঁরা পতিকে বোঝাবার চেষ্টা করেন, ‘তোমাতে-ওতে যখন মনের মিল হয়নি তখন কেন বাপু মেয়েটাকে ভোগাচ্ছ। তালাক দিয়ে ওকে নিষ্কৃতি দাও, ও বেচারি অন্য কোথাও বিয়ে করুক।’

বেয়াড়া বদমায়েশ স্বামী হলে বলে, ‘না, মরুকগে বেটি। আমি ওকে তালাক দেব না।’

মুরব্বিরা বলেন, ‘তবে ঢালো “মহরের” টাকা! না হলে বসতবাড়ি বিক্রি হবে, কিংবা মাইনে অ্যাটাচড় হবে। তখন বুঝবে ঠ্যালাটা।’

বিশ্বাস করবেন না, এরকম দুশমন ধরনের স্বামীও আছে যে বাড়ি বিক্রয় করে মহরের শেষ কপর্দক দেয় কিন্তু তালাক দিতে রাজি হয় না।

কিংবা সে শেষ পর্যন্ত রাজি হয় যে বিবি তাঁর স্ত্রীধন তলব করবেন না। আর সে-ও তাকে তালাক দিয়ে দেবে।

কিন্তু এটা হল আপোসে ফৈসালা। আইনের হক স্ত্রীলোকের নেই যে সে পতিকে বর্জন করতে পারে। তবু এস্থলে পুনরায় বলে রাখা ভালো, ‘মহরে’র টাকা দেবার ভয়ে অনেক স্বামী স্ত্রীর ওপর চোট-পাট করা থেকে নিরস্ত থাকেন।

এখন প্রশ্ন, স্বামীর যদি গলিত কুষ্ঠ হয়, কিংবা সে যদি বদ্ধ উন্মাদ বর্তায়, যদি তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, যদি সে বারবার কুৎসিত রোগ আহরণ করে স্ত্রীতে সংক্রামিত করে, যদি সে লম্পট বেশ্যাসক্ত হয় তবে কি স্ত্রী তাকে আইনত তালাক দিতে পারেন না?

শুনেছি, স্বামী যদি স্ত্রীকে বলে ‘তুমি আমার মায়ের মতো’ অর্থাৎ এই উক্তি দ্বারা সে তার ন্যায্য যৌনাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে তবে নাকি সে স্ত্রী মোকদ্দমা করে আদালতের পক্ষ থেকে তালাক পেতে পারে ॥