এক ছিল দুষ্টু মেয়ে— বেজায় হিংসুটে , আর বেজায় ঝগড়াটি। তার নাম বলতে গেলেই তো মুশকিল, কারণ ঐ নামে শান্ত লক্ষ্মী পাঠিকা যদি কেউ থাকেন, তাঁরা তো আমার উপর চটে যাবেন।
হিংসুটির দিদি বড় লক্ষ্মী মেয়ে— যেমন কাজে কর্মে, তেমনি লেখাপড়ায়। হিংসুটির বয়েস সাত বছর হ’য়ে গেল, এখনও তার প্রথম ভাগই শেষ হল না— আর তার দিদি তার চাইতে মোটে এক বছরের বড়, সে এখনই “বোধোদয়” আর “ছেলেদের রামায়ণ” পড়ে ফেলেছে, ইংরিজি ফার্স্টবুক তার কবে শেষ হয়ে গেছে। হিংসুটি কিনা সবাইকে হিংসে করে, সে তো দিদিকেও হিংসে করত। দিদি স্কুলে যায়, প্রাইজ পায়— হিংসুটি খালি বকুনি খায় আর শাস্তি পায়।
দিদি যেবার ছবির বই প্রাইজ পেলে আর হিংসুটি কিচ্ছু পেলে না, তখন যদি তার অভিমান দেখতে! সে সারাটি দিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে গাল ফুলিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে ব’সে রইল— কারও সঙ্গে কথাই বলল না। তারপর রাত্রিবেলায় দিদির অমন সুন্দর বইখানাকে কালি ঢেলে, মলাট ছিঁড়ে, কাদায় ফেলে নষ্ট করে দিল। এমন দুষ্টু হিংসুটে মেয়ে।
হিংসুটির মামা এসেছেন, তিনি মিঠাই এনে দু’বোনকেই আদর ক’রে খেতে দিয়েছেন। হিংসুটি খানিকক্ষণ তার দিদির খাবারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভ্যাঁ ক’রে কেঁদে ফেলল। মাম ব্যস্ত হয়ে বললেন, “কি রে, কী হ’ল? জিভে কামড় লাগল নাকি?” হিংসুটির মুখে আর কথা নেই, সে কেবলই কাঁদছে। তখন তার মা এক ধমক দিয়ে বললেন, “কী হয়েছে বল্ না!” তখন হিংসুটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দিদির ঐ রসমুণ্ডিটা তাকে আমারটার চাইতেও বড়।” তাই শুনে দিদি তাড়াতাড়ি নিজের রসমুণ্ডিটা তাকে দিয়ে দিল। অথচ হিংসুটি নিজে যা খাবার পেয়েছিল তার অর্ধেক সে খেতে পারল না— নষ্ট ক’রে ফেলে দিল। দিদির জন্মদিনে দিদির নতুন জামা, নতুন কাপড় আস্লে হিংসুটি তাই নিয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে।
একদিন হিংসুটি তার মায়ের আলমারি খুলে দেখে কি— লাল জামা গায়ে, লাল জুতা পায়ে, টুক্টুকে রাঙা পুতুল বাক্সের মধ্যে শুয়ে আছে। হিংসুটি বলল, “দেখেছ! দিদি কি দুষ্টু! নিশ্চয়ই মামার কাছ থেকে পুতুল আদায় করেছে— আবার আমায় না দেখিয়ে মায়ের কাছে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।” তখন তার ভয়ানক রাগ হল। সে ভাবল, “আমি তো ছোট বোন, আমারই তো পুতুল পাওয়া উচিত। দিদি কেন মিছিমিছি পুতুল পানে?” এই ভেবে সে পুতুলটাকে উঠিয়ে নিল।
কি সুন্দর পুতুল! কেমন মিট্মিটে চোখ, আর ফুট্ফুটে মুখ, কেমন কচি কচি হাত পা, আর টুক্টুকে জামা কাপড়! যত সব ভালো ভালো জিনিস সব কিনা দিদি পাবে! হিংসুটির চোখ ফেটে জল এল। সে রেগে পুতুলটাকে আছড়িয়ে মাটিতে ফেলে দিল। তাতেও তার রাগ গেল না; সে একটা ডাণ্ডা নিয়ে ধাঁই ধাঁই ক’রে পুতুলটাকে মারতে লাগল। মারতে মারতে তার নাক মুখ হাত পা ভেঙে, তার জামা কাপড় ছিঁড়ে— আবার তাকে বাক্সের মধ্যে ঠেসে সে রাগে গরগর করতে করতে চলে গেল।
বিকেলবেলা মামা এসে তাকে ডাকতে লাগলেন আর বললেন, “তোর জন্য কি এনেছি দেখিস্নি?” শুনে হিংসুটি দৌড়ে এল, “কই মামা, কী এনেছ দাও না।”
মামা বললেন, “মার কাছে দেখ্ গিয়ে কেমন সুন্দর পুতুল এনেছি।” হিংসুটি উৎসাহে নাচতে লাগল, মাকে বলল, “কোথায় রেখেছ মা?” মা বললেন, “আলমারিতে আছে।” শুনে ভয়ে হিংসুটির বুকের মধ্যে ধড়াস্ ধড়াস্ করে উঠল। সে কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, “সেটার কি লাল জামা আর লাল জুতো পরান— মাথায় কালো কালো কোঁকড়ানো চুল ছিল?” মা বললেন, “হ্যাঁ, তুই দেখেছিস্ নাকি?”
হিংসুটির মুখে আর কথা নেই! সে খানিকক্ষণ ফ্যাল্ফ্যাল্ ক’রে তাকিয়ে তারপর একেবারে ভ্যাঁ ক’রে কেঁদে এক দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেল।
এর পরে যদি তার হিংসে আর দুষ্টুমি না কমে, তবে আর কী ক’রে কমবে?