হাসির গল্প

আমাদের পোস্টাপিসের বড়বাবুর বেজায় গল্প করিবার সখ। যেখানে সেখানে সভায় আসরে নিমন্ত্রণে, তিনি তাঁহার গল্পের ভাণ্ডার খুলিয়া বসেন। দুঃখের বিষয়, তাঁর ভাণ্ডার অতি সামান্য— কতগুলি বাঁধা গল্প, তাহাই তিনি ঘুরিয়া ফিরিয়া সব জায়গায় চালাইয়া দেন। কিন্তু একই গল্প বারবার শুনিতে লোকের ভাল লাগিতে কেন? বড়বাবুর গল্প শুনিয়া আর লোকের হাসি পায় না। কিন্তু তবু বড়বাবুর উৎসাহও তাহাতে কিছুমাত্র কমে না।
সেদিন হঠাৎ তিনি কোথা হইতে একটা নূতন গল্প সংগ্রহ করিয়া, মুখুজ্জেদের মজ্‌লিসে শুনাইয়া দিলেন। গল্পটা অতি সামান্য কিন্তু তবু বড়বাবুকে খাতির করিয়া সকলেই হাসিল। বড়বাবু তাহা বুঝিলেন না, তিনি ভাবিলেন গল্পটা খুব লাগসই হইয়াছে। সুতরাং, তার দুদিন বাদে যদু মল্লিকের বাড়ি নিমন্ত্রণে বসিয়া, তিনি খুব আড়ম্বর করিয়া আবার সেই গল্প শুনাইলেন। দু-একজন যাহারা আগে শোনে নাই, তাহারা শুনিয়া বেশ একটু হাসিল। বড়বাবু ভাবিলেন গল্পটা জমিয়াছে ভাল।
তারপর ডাক্তারবাবুর ছেলের ভাতে তিনি আবার সে গল্পই খুব উৎসাহ করিয়া শুনাইলেন। এবারে ডাক্তারবাবু ছাড়া আর কেহ গল্প শুনিয়া হাসিল, না, কিন্তু বড়বাবু নিজেই হাসিয়া কুটি কুটি। তারপরেও যখন তিনি আরও দু তিন জায়গায় সেই একই গল্প চালাইয়াদিলেন, তখন আমাদের মধ্যে কেহ কেহ বিষম চটিয়া গেল। বিশু বলিল, “না হে, আর ত সহ্য হয় না। বড়বাবু ব’লে আমরা এতদিন সয়ে আছি— কিন্তু ওঁর গল্পের উৎসাহটা একটু না কমালে চলছে না।”
দুদিন বাদে, আমরা দশবারোজন বসিয়া গল্প করিতেছি, এমন সময় বড়বাবুর নাদুস্‌নুদুস্‌ মূর্তিখানা দেখা দিল। আমরা বলিলাম, “আজ খবরদার! ওঁর গল্প শুনে কেউ হাসতে পাবে না! দেখি উনি কি করেন।” বড়বাবু বসিতেই বিশু বলিয়া উঠিল, “নাঃ, বড়বাবু আজকাল যেন কেমন হ’য়ে গেছেন। আগে কেমন মজার মজার সব গল্প বলতেন। আজকাল, কৈ? কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন।” বড়বাবু একথায় ভারি ক্ষুণ্ণ হইলেন। তাঁর গল্প আর আগের মত জমে না, একথাটি তাঁহার একটুও ভাল লাগিল না। তিনি বলিলেন, “বটে? আচ্ছা রোস। আজ তোমাদের এমন গল্প শোনাব, হাস্‌তে হাস্‌তে তোমাদের নাড়ি ছিঁড়ে যাবে।” এই বলিয়া তিনি তাঁহার সেই মামুলি পুঁজি হইতে একটা গল্প আরম্ভ করিলেন। কিন্তু গল্প বলিলে কি হইবে? আমরা কেহ হাসিতে রাজি নহি— সকলেই কাঠ হইয়া বসিয়া রহিলাম। বিশু বলিল, “নাঃ, এ গল্পটা জুৎসই হল না।” তখন বড়বাবু তাহার সেই পুঁজি হইতে একে একে পাঁচ সাতটি গল্প শুনাইয়া দিলেন। কিন্তু তাহাতে সকলের মুখ পেঁচার মত আরও গম্ভীর হইয়া উঠিল! তখন বড়বাবু ক্ষেপিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন, “যাও যাও! তোমরা হাস্‌তে জান না— গল্পের কদর বোঝ না— আবার গল্প শুনতে চাও! এই গল্প শুনে সেদিন ইন্‌স্পেক্টার সাহেব পর্যন্ত হেসে গড়াগড়ি— তোমরা এসব বুঝবে কি?” তখন আমাদের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিল, “সে কি বড়বাবু? আমরা হাস্‌তে জানিনে? বলেন কি! আপনার গল্প শুনে কতবার কত হেসেছি, ভেবে দেখুন ত’। আজকাল আপনার গল্পগুলো তেমন খোলে না— তা হাস্‌ব কোত্থেকে? এই ত, বিশুদা যখন গল্প বলে তখন কি আমরা হাসিনে? কি বলেন?”
বড়বাবু হাসিয়া বলিলেন, “বিশু? ও আবার গল্প জানে নাকি? আরে, এক সঙ্গে দুটো কথা বলতে ওর মুখে আট্‌কায়, ও আবার গল্প বলবে কি?” বিশু বলিল, “বিলক্ষণ! আমার গল্প শোনেন নি বুঝি?” আমরা সকলে উৎসাহ করিয়া বলিলাম— “হাঁ, হাঁ, একটা শুনিয়ে দাও ত।” বিশু তখন গম্ভীর হইয়া বলিল, “এক ছিল রাজা”— শুনিয়া আমাদের চার পাঁচজন হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল, “আরে রাজার গল্প রে রাজার গল্প!— হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।”
বিশু বলিল, “রাজার তিনটা ধাড়ি ধাড়ি ছেলে”—
শুনিবামাত্র আমরা একসঙ্গে প্রাণপণে এমন সশব্দে হাসিয়া উঠিলাম যে, বিশু নিজেই চম্‌কাইয়া উঠিল। সকলে হাসিতে হাসিতে, এ উহার গায়ে গড়াইয়া পড়িতে লাগিলাম— কেহ বলিল, “দোহাই বিশুদা, আর হাসিও না”— কেহ বলিল, “বিশুবাবু রক্ষে করুন, ঢের হয়েছে।” কেহ কেহ এমন ভাব দেখাইল, যেন হাসিতে হাসিতে তাহাদের পেটে খিল ধরিয়া গিয়াছে।
বড়বাবু কিন্তু বিষম চটিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন, “এসব ঐ বিশুর কারসাজি। ওই আগে থেকে সব শিখিয়ে এনেছে। নইলে, ও যা বললে তাতে হাস্‌বার মত কি আছে বাপু?” এই বলিয়া তিনি রাগে গজ্‌গজ্‌ করিতে করিতে উঠিয়া গেলেন।
সেই সময় হইতে বড়বাবুর গল্প বলার সখটা বেশ একটু কমিয়াছে। এখন আর তিনি যখন তখন কথায় কথায় হাসির গল্প ফাঁদিয়া বসেন না।