হারানো সুর – ৭

সাত

লাঞ্চের সময়, অনুশীলন থামাল অর্কেস্ট্রা। বেশিরভাগ সদস্য ফিরলেন হোটেলে। ক্রিস গেইল প্রস্তাব করলেন তিনি আর হেক্টর শেষবারের মত স্বরগ্রামটা খুঁজবেন। ছেলে-মেয়েরা সিম্ফনিকে খুঁজল তাঁকে লাঞ্চের দাওয়াত দিতে, কিন্তু তিনি লাপাত্তা।

কাছের এক কফিশপে হেঁটে গেল ওরা।

অর্ডার দেয়ার পর, মুসা বলল, ‘হেক্টর যখন ভুল শুধরে দিলেন, সিম্ফনির মুখ তখন কালো হয়ে গেছিল, খেয়াল করেছ?’

‘বেহালার শব্দ দেরিতে আসছে সেই ব্যাপারটা?’ কিশোর প্রশ্ন করল।

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

‘সেজন্যেই হয়তো রিহার্সালের পর ওভাবে হাওয়া হয়ে গেছেন তিনি।’

‘কিন্তু হেক্টর তো সবারই ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন,’ সু কি বলল। ‘হ্যাঁ,’ সায় জানাল ডন। ‘সবাই মন খারাপ করলে তো অর্কেস্ট্রাই খালি হয়ে যেত, কেউ থাকত না।’

‘ডন ঠিকই বলেছে। সিম্ফনি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত,’ রবিন বলল। ‘কী সেটা জানতে পারলে হত।’

ঠিক এমনিসময় ওয়েটার ওদের লাঞ্চ নিয়ে এল। একপাশে পটেটো চিপ্‌স্‌ নিয়ে বড়-বড় স্যাণ্ডউইচ। মুসার স্যাণ্ডউইচটা যদিও সবারগুলোর চাইতে বড় ছিল, খাওয়ায় যথারীতি ও-ই প্রথম হলো।

‘যাবে না?’ চিবুক মুছে প্রশ্ন করল মুসা।

‘অনেক সময় আছে,’ কিশোর বলল ওকে। ‘ওয়র্কশপ শুরু হতে এখনও আধঘণ্টা বাকি।’

‘কিন্তু আগে না গেলে তো জায়গা পাব না,’ বলল ডন। কথাটা ফেলনা নয়। রিহার্সালের সময় অডিটোরিয়াম ভরে গিয়েছিল প্রায়।

ছেলে-মেয়েরা লাঞ্চ সেরে হন্তদন্ত হয়ে সিভিক সেন্টারে ফিরল।

পারকাশনিস্ট ইয়ান অ্যাণ্ডারসন, যাঁকে ওরা গতকাল দেখেছিল, নিজের যন্ত্র নিজে বানানোর ওয়র্কশপের দায়িত্বে রয়েছেন।

‘এতগুলো আগ্রহী মুখ দেখে খুব ভাল লাগছে,’ বললেন তিনি।

ঘরে তৈরি কটা যন্ত্র দেখালেন শিল্পী। চিরুনি আর মোম কাগজে বানানো এক হারমোনিকা, চুরুটের বাক্স দিয়ে তৈরি গিটার, পেপার প্লেটের খঞ্জনী আর পানির গ্লাসের ঘণ্টা রয়েছে তার মধ্যে।

‘এমনকী রাবার ব্যাণ্ড দিয়েও বাজনা বাজানো যায়,’ বলে একটা রাবার ব্যাণ্ডের ফাঁস পরালেন দু’আঙুলে। এবার আঙুল দুটোকে খানিকটা ছড়িয়ে, অন্য হাতের আঙুলগুলো দিয়ে বাজালেন ব্যাণ্ডটাকে।

‘ড্রাম বানানো যায়?’ ডনের কৌতূহলী প্রশ্ন। ‘ইস, আমি যদি ড্রাম বানাতে পারতাম!’

ইয়ান অ্যাণ্ডারসনকে সন্তুষ্ট দেখাল।

‘যা-যা লাগবে সবই এই টেবিলে পাবে,’ বললেন। ‘কাজে লেগে পড়ো। কল্পনাশক্তি খাটাও। তারপর নিজেই দেখো কী তৈরি হয়।

মুসা ওর উপকরণগুলো বাছাই করছে, এসময় কামরায় ঢুকলেন সিম্ফনি। উষ্ণ হাসি তাঁর মুখে, অপ্রস্তুত ভাবটা অদৃশ্য।

‘মুসা,’ বললেন, ‘তুমি আমার সাথে হোটেলে চলো। আমাকে বাজিয়ে শোনাবে।’

মুসা রীতিমত রোমাঞ্চিত। একইসঙ্গে নার্ভাসও। ও যদি আড়ষ্টতায় ভোগে, বাজাতে না পারে? সিম্ফনি যদি ভাবেন ও ভাল বাজিয়ে নয়?

‘আমি তো বেহালা সাথে আনিনি,’ বলল ও।

‘সে চিন্তা আমার,’ সিম্ফনি বললেন ওকে। ‘দেখি কী ব্যবস্থা করা যায়, তারপর তোমার সাথে লবিতে দেখা হবে, কেমন?’

মুসার আপত্তির কিছু নেই।

‘ঠিক আছে,’ বলল ও।

সিম্ফনি এবার সু কির দিকে ফিরলেন।

‘তুমি যাবে, সু কি?’ জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ, যাব,’ সু কি এক পায়ে খাড়া।

‘আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দাও,’ বলে, ঘর ছাড়লেন সিম্ফনি। ‘উনি ভাল মুডে আছেন,’ মন্তব্য করল রবিন।

‘খাইছে, উনি খুব ভাল,’ বলল মুসা। ‘সবসময়ই ভাল মুডে থাকেন।’

‘কিন্তু আজ সকালে আমরা যখন হোটেল থেকে ফিরলাম, উনি আমাদের সাথে তো ভাল করে কথাই বলেননি,’ বন্ধুকে মনে করিয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান।

‘উনি হেক্টরের ব্যাপারে আপসেট ছিলেন,’ বলল মুসা। ‘ও ব্যাপারে তো আমরা আগেই একমত হয়েছি।’

‘আমরা হয়তো ভুল ভেবেছি,’ বলল ডন। ‘উনিই হয়তো স্কোরটা নিয়েছেন, এখন ভালমানুষী করছেন আমরা যেন তাঁকে সন্দেহ না করি।’

‘অসম্ভব!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। তারপর সু কির হাত ধরে লবির উদ্দেশে ত্বরিত পা চালাল।

সাজসজ্জার যা পার্থক্য, এছাড়া সিম্ফনির হোটেল কামরা হেক্টরের মতই। মুসা আর সু কির অবশ্য এটাই বেশি পছন্দ হলো। বেগুনী রঙের শেড ব্যবহার করেছে এখানে।

‘এটা ট্রাই করে দেখো তো সাইয ঠিক আছে কিনা,’ বলে মুসার হাতে একটা বেহালা তুলে দিলেন সিম্ফনি।

যন্ত্রটা বাঁ কাঁধ আর চিবুকে ঠেকাল মুসা।

‘ঠিকই আছে,’ বলল।

‘চমৎকার মানিয়েছে তোমাকে।’ এবার মুসাকে ছড় দিলেন সিম্ফনি। ‘এখন বাজাও দেখি।’ সু কির পাশে ছোট্ট কৌচটায় বসলেন তিনি।

মুসা তারের ওপর বোলাল ছড়টা, বিশ্রীভাবে ককিয়ে উঠল বেহালাটা। ছড়টা তুলল ও।

‘খাইছে,’ বলল, ‘হচ্ছে না।’

‘আমি বাজালে অমন শব্দ হরদম হয়,’ বলল সু কি।

হেসে উঠলেন সিম্ফনি।

‘মন খারাপ কোরো না,’ বললেন। ‘পৃথিবীর সেরা বেহালাবাদকও কর্কশ শব্দের হাত থেকে রেহাই পান না।’

মুসা আবারও চেষ্টা করল। এবার আর কর্কশ শব্দ নয়, বরং বাজনা বেরোল। বাজানো শেষ হলে, সিম্ফনি এসে ওর পাশে দাঁড়ালেন। ছড়ে মুসার হাত ঠিকঠাক করে দিলেন।

‘কবজি শিথিল করো, মুসা, নির্দেশ দিলেন। ‘হ্যাঁ, এই তো। এখন আরেকটা পিস বাজাও—’

এসময় টেলিফোন বাজলে সিম্ফনি রিসিভার তুললেন।

‘হ্যালো,’ ক’মুহূর্ত পরে বললেন, ‘ওহ-আজ-হ্যাঁ, আপনি ফোন করায় ধন্যবাদ, কিন্তু-’ ছেলে-মেয়েদের দিকে পিঠ ফিরিয়ে গলা নামালেন। ‘আমি-আম-এখন কথা বলতে পারছি না…সকালে যেমনটা বলেছি…দেখা করব আমরা… তখন ও ব্যাপারে কথা হবে… হ্যাঁ…’

অস্বস্তি বোধ করছে মুসা। ওদের শোনা উচিত নয় জানে, কিন্তু কান তো আর বন্ধ রাখা যায় না। সু কিকে হাতছানি দিয়ে দূরের জানালাটির কাছে নিয়ে গেল ও, ওখানে দাঁড়িয়ে গ্রিনফিল্ডের প্রধান সড়কের দিকে চেয়ে রইল।

‘শুভস্য শীঘ্রম,’ সিম্ফনি বলছেন। ‘পুরো ব্যাপারটাই আমাকে নার্ভাস করে তুলেছে…কেউ যদি জেনে ফেলে?’

মুসার মনে দোলা দিয়ে গেল সন্দেহের ঢেউ। তাহলে কি ডন আর বন্ধুদের কথাই ঠিক? সিম্ফনিই কি চোর?

সিম্ফনি এখন ফিসফিস করছেন।

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। টাউন স্কয়্যার। কাল সকাল সাড়ে আটটায়…না, না, আমি আসব, চিন্তা করবেন না।’

সিম্ফনি রিসিভার রেখে ঘুরে দাঁড়ালেন। শ্বাস টানলেন বুক ভরে।

‘হ্যাঁ, তো আবার লেসন শুরু হোক আমাদের,’ বললেন।