ছয়
বিছানার কিনারায় ধপ করে বসে পড়লেন হেক্টর ক্রুসিয়ানি।
‘হায়, ঈশ্বর,’ বলে উঠলেন, চুলে দু’হাত চালালেন। ‘তোমরা বলছ কেউ এসে স্কোরটা চুরি করে নিয়ে গেছে?’
‘আমরা সবখানে খুঁজেছি,’ বলল রবিন। ‘ওটা এখানে আছে বলে মনে হলো না।’
‘কী সাঙ্ঘাতিক কথা,’ রীতিমত হায়-হায় করে উঠলেন হেক্টর। ‘কিন্তু কে চুরি করবে অমন একটা জিনিস?’
‘স্বরগ্রামটা অনেক দামি,’ বলল কিশোর। ‘চোরের অভাব হবে না।’
নিজের পায়ে তড়াক করে সিধে হয়ে দাঁড়ালেন হেক্টর।
‘যে কোন মহান ব্যক্তির সৃষ্টি সারা দুনিয়ার সম্পদ,’ বললেন। ‘এ হতে পারে না! আমি এটা সহ্য করব না!’ রুম ছেড়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।
ছেলে-মেয়েরা পায়ে-পায়ে তাঁকে অনুসরণ করে, হোটেল ছাড়ল।
সিভিক সেন্টারে ফেরার পথে ডন বলল, ‘চিন্তা করবেন না। আমরা আপনাকে স্কোরটা খুঁজে দেব।’
কিন্তু আপনভোলা সঙ্গীতজ্ঞ হেক্টর ক্রুসিয়ানি এখন সব ভুলে গুনগুনাচ্ছেন। কোন কিছু তাঁর কানে গেছে বলে মনে হলো না।
ওদিকে, সিভিক সেন্টারে, সিম্ফনি তখন লবির টেলিফোনে কথা বলছিলেন। ছেলে-মেয়েদেরকে দেখে, কেমন থতমত খেয়ে গিয়ে, চুপ মেরে গেলেন মহিলা। ওরা কাছিয়ে আসতেই ঝট করে রিসিভার রেখে ত্রস্ত পায়ে এদিকে এলেন। ওদের মনে হলো তিনি কোন অন্যায় কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছেন বুঝি।
‘ও, তোমরা,’ বললেন। ‘আমি একটু—’
‘বাজনা বন্ধ কেন?’ কৈফিয়ত চাইলেন হেক্টর। ‘আমরা রিহার্সাল করব না?!’
সিম্ফনির মুখের চেহারা প্রায় তাঁর চুলের মতই লাল টকটকে হয়ে গেল।
‘একটু ব্রেক নিয়েছি,’ জানালেন। ‘আপনি যেহেতু এসে পড়েছেন, আপনিই দায়িত্ব নিন।’ তাঁর কণ্ঠস্বর শাণিত শোনাল।
বিনাবাক্যব্যয়ে, অডিটোরিয়াম অভিমুখে পা বাড়ালেন হেক্টর। সিম্ফনি তড়িঘড়ি তাঁর পিছু নিলেন।
‘হোটেলে কী হলো শুনবেন না?’ ডন প্রশ্ন ছুঁড়ল তাঁকে।
থমকে দাঁড়ালেন সিম্ফনি।
‘অবশ্যই শুনব,’ বললেন। ‘স্বরগ্রামটা পেয়েছ?’
‘সবখানে খুঁজেছি,’ বলল নথি। ‘কিন্তু কোত্থাও পেলাম না।’
‘হেক্টর দরজা লক করেন না,’ তাঁকে জানাল কিশোর। ‘যে
কেউই ওটা নিয়ে হাসতে হাসতে চলে যেতে পারে।’
‘ও নিয়ে আমার এখন মাথা ঘামানোর সময় নেই,’ বললেন সিম্ফনি। রিহার্স করতে হবে!’ দুপদাপ পা ফেলে চলে গেলেন।
‘মহিলার আচরণ কেমন অদ্ভুত লাগছে,’ মন্তব্য করল কিশোর।
‘খাইছে, উনি হয়তো হারানো স্বরগ্রামটা নিয়ে চিন্তিত,’ তাঁর পক্ষ হয়ে সাফাই পেশ করল মুসা।
‘তা কী করে হয়!’ বলল ডন। ‘উনি তো এমনকী আমাদেরকে ওটার কথা জিজ্ঞেসও করেননি।’
‘তাহলে কি ওটা উনিই নিয়েছেন ভাবছ?’ বলল মুসা। ‘কেন নিতে যাবেন?’
এর জবাব কারও জানা নেই।
‘আচ্ছা, ফোন কলের ব্যাপারটা কী বলো তো,’ বলল রবিন। ‘ভাবসাব দেখে তো মনে হলো গোপন কোন কাজ করতে গিয়ে মাঝপথে ধরা খেয়েছেন।’
‘সিম্ফনি হয়তো হোটেলে ফোন করে আমাদের খবরই নিচ্ছিলেন,’ বাতলে দিল মুসা।
মাথা ঝাঁকাল সু কি।
‘এর অর্থ উনি স্কোরটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।’
‘সে আর বলতে,’ বলল মুসা। ‘সেজন্যেই উনি ফোন করেছিলেন, আমরা ওটা পেয়েছি কিনা জানতে।’
‘অথচ মজার ব্যাপার হলো, আমরা যখন ফিরলাম উনি কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না,’ বলল রবিন।
‘হেক্টর ওঁকে তো কোন কথা বলার সুযোগই দেননি,’ ওকে মনে করাল কিশোর।
এসময় লবিতে সুরলহরী ভেসে এল।
এ নিয়ে পরে কথা বলা যাবে,’ বলল রবিন। ‘আমি রিহার্সাল শুনতে চাই।’
অডিটোরিয়ামে ঢুকল ছেলে-মেয়েরা।
মঞ্চে হেক্টরকে দেখল ওরা।
‘এটা আরেকবার চেষ্টা করি, আসুন,’ বললেন তিনি। ব্যাটন তুলে নিলেন। ‘মনে রাখবেন, এই প্যাসেজটা যেন মিষ্টি-মধুর হয়, এতে অন্তর ঢেলে দিতে হবে।’ সবাই তৈরি হওয়া অবধি অপেক্ষা করলেন। তারপর নিচের দিকে বাতাসে ব্যাটনটা আঘাত করে, বাজনাটা আরম্ভ করলেন আবারও।
ছেলে-মেয়েরা নিঃশব্দে বসে রইল। সুরের মূর্ছনায় অন্য এক জগতে চলে গেল ওরা। শিল্পীরা যেন ফুল ফোটাচ্ছেন, আনন্দলোকে বিচরণ করাচ্ছেন ওদেরকে।
মঞ্চে ব্যাটন ঠুকলেন হেক্টর।
‘না! না!’ বলে উঠলেন। ‘হচ্ছে না। স্ট্রিংগুলো দেরিতে আসছে। মিস মেলানি, আপনি কোথায় হারিয়ে গেছেন বলুন তো?’
সিম্ফনি অস্পষ্ট স্বরে ক্ষমা চাইলেন।
‘আমার কাছে তো শুনে ভালই লাগল,’ বলল ডন।
‘কিন্তু হেক্টর অভিজ্ঞ লোক,’ বলল মুসা। ‘তাঁর কানে লেগেছে। তিনি যা বোঝের তা তো আর আমরা বুঝি না।’
‘হারানো স্বরগ্রামটার’ চিন্তা মাথায় নিয়ে উনি কণ্ডাক্ট করছেন কীভাবে কে জানে,’ বলল নথি।
‘হয়তো ভুলেই গেছেন ওটার কথা,’ বলল কিশোর। রবিন অতটা নিশ্চিত নয়।
‘হোটেলে তো ওঁকে সাঙ্ঘাতিক আপসেট দেখলাম। এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন?’
‘সব বাজনা মনে আছে তাঁর,’ সু কি বলল।
‘এবং মোযার্টের লম্বা নামটা পর্যন্ত,’ বলল ডন। ‘কিন্তু আর কিছু না।’
‘খাইছে, তাহলে কি…?’ মুসা শুরু করেছিল।
‘না,’ জোর গলায় জবাবটা দিল কিশোর। ‘হেক্টর স্কোরটা চুরি করেননি। আমাদের এটা চিন্তা করাও অনুচিত।’
‘কেউ তাঁকে চোর ভাববে না,’ বলল রবিন। ‘এবং তিনি হয়তো সেটা জানেনও
‘ঠিক,’ ফস করে বলে বসল ডন। ‘তিনি হয়তো ইচ্ছে করেই ভুলোমনা সাজেন, সবার সন্দেহের বাইরে থাকতে।’
‘আমার ধারণা উনি আসলেই আত্মভোলা,’ তর্ক জুড়ল কিশোর। ‘হেক্টর কী বলেছিলেন মনে নেই: ‘মাথা ভর্তি বাজনা থাকলে কি আর অত কিছু মনে থাকে?!’’‘
‘দুষ্প্রাপ্য, দামি কোন মিউযিক কি নিছকই ক’খানা কাগজ?’ সু কি জানতে চাইল।
কেউ, এমনকী হেক্টর ক্রুসিয়ানিও এর জবাবে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারবেন না।
বাজনা আবারও শুরু হলে চুপ হয়ে গেল ওরা। তবে ওদের মাথায় গিজগিজ করছে রাজ্যের প্রশ্ন।