পাঁচ
‘মোবার্টের স্বরগ্রামটা চুরি গেছে?’ ঠিক শুনেছে কিনা নিশ্চিত হতে পুনরাবৃত্তি করল রবিন।
‘হ্যাঁ,’ জানালেন মেরি হপকিন্স। বিড়বিড় করতে-করতে অন্যদিকে হেঁটে চলে গেলেন। ‘জানতাম। জানতাম এমনটা হবে।’
ছেলে-মেয়েদেরকে দেখে প্রায় ছুটে এলেন সিম্ফনি।
‘স্বরগ্রামটা চুরি হয়েছে কখন জানলেন?’ রবিনের প্রশ্ন।
কে চুরি করেছে জানতে পেরেছেন?’ ডন জানতে চাইল।
‘পুলিসকে জানিয়েছেন?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল।
সিম্ফনি এক হাত উঁচিয়ে চুপ করালেন ওদেরকে।
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও,’ বললেন। ‘স্বরগ্রাম চুরি গেছে কে বলল?’
‘মেরি হপকিন্স,’ রবিনের জবাব।
‘মহিলা এক লাফে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন,’ বললেন সিম্ফনি।
‘খাইছে, তারমানে ওটা চুরি যায়নি!’ মুসার কণ্ঠে স্বস্তি প্রকাশ পেল।
ডিসপ্লে কেসটির দিকে চাইল কিশোর। ফাঁকা ওটা।
‘স্কোরটা কেসে নেই,’ বলল। ‘চুরি না হয়ে থাকলে গেল কোথায়?’
শ্রাগ করলেন সিম্ফনি।
‘আমরা নিশ্চিত নই,’ বললেন। এবার ব্যাখ্যায় গেলেন। ‘পার্টির পর হেক্টর ওটা হোটেলে নিয়ে যান। তিনি ভেবেছিলেন ওটা ওখানে নিরাপদে থাকবে। এত মূল্যবান একটা জিনিস সারা রাত এখানে পড়ে থাকবে তা চাননি।’
ক্রিস গেইল এসময় সিম্ফনির পাশে এসে দাঁড়ালেন।
‘কপাল মন্দ, এখানকার কেউ মহান হেক্টর ক্রুসিয়ানিকে মনে করিয়ে দেয়নি ওটা যেন মিসপ্লেসড্ না হয়,’ বললেন।
মাথা ঝাঁকাল ডন।
‘উনি ভুলে গেছেন ওটা কোথায় রেখেছেন!’
‘আমার ধারণা সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে,’ বলল কিশোর। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সিম্ফনি।
‘একমাত্র হেক্টরই জানেন ওটা কোথায়, এবং তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন।’
‘খুঁজতে শুরু করলেই হয়তো মনে পড়বে,’ বাতলে দিল নথি। চাপা হাসলেন ক্রিস গেইল।
‘উঁহুঁ, হোটেলে ফিরতে-ফিরতেই উনি ভুলে যাবেন কেন ওখানে গেছেন,’ বললেন।
‘আমরা মিস্টার ক্রুসিয়ানির সাথে হোটেলে যাই?’ প্রস্তাব করল কিশোর।
‘ওঁর সাথে খোঁজার জন্যে,’ বাক্যটা সমাপ্ত করল মুসা। পরিকল্পনাটা বেজায় মনে ধরল ডনের।
‘দেখবেন আমরা স্বরগ্রামটা ঠিক খুঁজে পাব,’ আশ্বাস দিল সিম্ফনিকে। ‘আমরা খুব চালু গোয়েন্দা।’
মুচকি হাসলেন সিম্ফনি।
‘হেক্টরকে বলে দেখি,’ বললেন।
‘কিন্তু রিহার্সালের কী হবে?’ প্রশ্ন করলেন ক্রিস গেইল। ‘ওটা তো বাতিল করা যাবে না। লোকজন আসছে। আমরা তো তাদেরকে হতাশ করতে পারি না।’
সিম্ফনির হাসিটা ম্লান হয়ে গেল।
‘ঠিক কথা, ক্রিস। সপ্তাহের প্রথম ইভেন্টটাই যদি বাতিল হয়ে যায়…’ কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল ওঁর।
‘কাজেই স্বরগ্রাম নিয়ে পরে ভাবব আমরা,’ ক্রিস বললেন। ‘যাই, এখন আপাতত শিল্পীদের জড় করি।’ ব্যস্তসমস্ত হয়ে চলে গেলেন।
‘স্বরগ্রামটা খোঁজা গেলে ভাল হত,’ বললেন সিম্ফনি। ‘যত বেশিক্ষণ ওটা বেহাত থাকবে, ততই অমূল্য জিনিসটার ভুল লোকের হাতে পড়ার সম্ভাবনা বাড়বে।’
‘রিহার্সালটা অন্য কেউ কণ্ডাক্ট করতে পারেন না?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘তাই তো,’ বললেন সিম্ফনি। ‘এতটাই আপসেট হয়ে পড়েছিলাম, এটা মাথাতেই আসেনি। তোমরা হেক্টরের সাথে হোটেলে যাও, আমি রিহার্সালটা চালিয়ে নেব।’ শশব্যস্তে হেক্টরের কাছে গেলেন পরিকল্পনাটা জানাতে।
মনোযোগ দিয়ে শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন তিনি। এবার ছেলে-মেয়েদের দিকে এগিয়ে এলেন।
‘চলো দেখি আমরা খুঁজে পাই কিনা,’ বলে, ওদেরকে পেছনে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
হোটেলে পৌঁছে, সোজা তাঁর কামরায় গেল সবাই। কণ্ডাকটর ডোরনব ঘুরিয়ে দরজাটা টেনে খুললেন।
কিশোর রীতিমত বিস্মিত।
‘দরজাটা তো লক করা ছিল না,’ বলল।
হেক্টর ক্রুসিয়ানি পিছিয়ে এসে ওদেরকে ঢুকতে দিলেন। ‘লক করলে চাবি লাগে,’ বললেন। ‘তাতে ওটা হারানোর সম্ভাবনাও বাড়ে।’
‘কিন্তু তাহলে তো আপনার ঘরে যে কেউই ঢুকতে পারে, মিস্টার ক্রুসিয়ানি,’ বলল রবিন। ‘হয়তো-’
‘প্লিজ, আমাকে হেক্টর বোলো,’ বাধা দিলেন তিনি। কামরায় প্রবেশ করলেন। ‘আমাদের এখন দরকার শুধু মিউযিক!’ নাইটস্ট্যাণ্ডের টেপ রেকর্ডারটা চালু করলেন।
মুহূর্তে ভরপুর অর্কেস্ট্রার শব্দে ভরে উঠল গোটা কামরা। চোখ বুজে শুনছেন হেক্টর। ক’মুহূর্ত পরে, রীতিমত আবিষ্টের মতন দু’বাহু দুলিয়ে, অদৃশ্য যন্ত্রীদের পরিচালনা করতে লাগলেন কণ্ডাকটর।
অন্যরা ধৈর্য ধরে নীরবে অপেক্ষা করল। শেষমেশ ডন ফিসফিসিয়ে বলল, এখন বুঝতে পারছি শিল্পীরা কীভাবে প্র্যাকটিস করেন।’
হেক্টর বাহুজোড়া নামিয়ে ছেলে-মেয়েদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
‘অ্যাই, আমরা এখানে কীজন্যে যেন এসেছিলাম?’
‘স্বরগ্রামটা খুঁজতে,’ মনে করিয়ে দিল কিশোর।
মাথা ঝাঁকালেন হেক্টর।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা প্রথমে কোথায় খুঁজব?’
‘রিসেপশনের পরে এখানে ফিরে কী করেছিলেন ভাবার চেষ্টা করুন,’ পরামর্শ দিল নথি।
ওপরে-নিচে মাথা নাড়লেন হেক্টর।
‘এক মোযার্ট কনসার্টো শুনেছিলাম,’ বললেন। ‘তুলনাহীন।’
‘স্বরগ্রামটা তার আগে নাকি পরে লুকিয়েছিলেন?’ মুসা প্রশ্ন করল।
দীর্ঘশ্বাস পড়ল হেক্টরের।
‘মাথা ভর্তি বাজনা থাকলে কি আর অত কিছু মনে থাকে?!’ জবাব দিলেন।
হেক্টরের স্মরণশক্তির ওপর ভরসা রাখা যায় না বুঝে, দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নিল গোয়েন্দাপ্রধান।
‘কাজটা ভাগাভাগি করে ফেলা যাক,’ বাতলে দিল। ‘রবিন আর সু কি, তোমরা বাথরুমটা চেক করো। মুসা, তুমি হেক্টরের সাথে এঘরে খোঁজো। ডন আর আমি ক্লজিটে খুঁজে দেখি।’
সবাই ওরা কাজে লেগে পড়ল।
বাথরুমে কিছুই পেল না রবিন আর সু কি।
মুসা আর হেক্টর সবখানে খুঁজলেন-এমনকী ম্যাট্রেসের তলায়ও। নেই।
কিশোর আর ডন ক্লজিটের সব কটা তাক আর মি. ক্রুসিয়ানির পকেটগুলোয় তল্লাশী চালাল। পেল না। অবশেষে, ডন সুটকেসটা টেনে নিয়ে এল ঘরের ভেতর।
‘এখানে নেই তো?’ জিজ্ঞেস করল।
হেক্টর সুটকেস খুললেন। খালি ওটা।
‘আপনার কাপড়ের ব্যাগটা ক্লজিটে ঝুলছে,’ জানাল কিশোর। ‘আমরা ওটা খুলে দেখিনি।’
মাথা নাড়লেন হেক্টর।
‘ওটায় আমার ময়লা টাক্সেডোটা আছে শুধু। কনসার্ট শুরুর আগে মনে করে লন্ড্রিতে দিতে হবে।’ সহসাই মুখের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে।’
স্বরগ্রামটা কোথায় রেখেছেন মনে করতে পেরেছেন তিনি! ছেলে-মেয়েরা উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে।
তার বদলে, ভদ্রলোক বললেন, ‘স্মৃতি এক অদ্ভুত জিনিস। বড্ড ছলনাময়ী।’
‘কী যেন মনে পড়েছে বললেন?’ কিশোর বলল
‘গতরাতে, কনসার্টটা শুনে, হাঁটতে যাই আমি লম্বা সময়ের জন্যে,’ সাড়া দিলেন হেক্টর। ‘চমৎকার ছিল রাতটা। অনেক শৈশবস্মৃতি মনে পড়েছে।’
‘যাওয়ার আগে কি দরজা লক করেছিলেন?’ রবিন জিজ্ঞেস করল। জবাবটা জানাই ছিল ওর, আসলে সবারই জানা। হেক্টর ক্রুসিয়ানি দরজা লক করেননি। তাঁর অনুপস্থিতিতে কি কেউ এসে মোযার্টের স্বরগ্রামটা খুঁজে পায়? মেরি হপকিন্সই হয়তো ঠিক বলেছেন: চুরি গেছে ওটা!