হারানো সুর – ৪

চার

পরে, বাসায় ফিরে ওরা কিচেন টেবিল ঘিরে বসল হট চকোলেট পান করতে। সু কি রাতে থাকছে, সে-ও রয়েছে ওদের সঙ্গে।

‘পার্টিটা দারুণ জমেছিল,’ বলল রবিন।

‘খাইছে, খাবারগুলোর তুলনা হয় না,’ বলল মুসা। ‘বিশেষ করে জেলি স্যাণ্ডউইচটা। একটাও বাঁচেনি, নইলে নিয়ে আসতাম।’

‘শিল্পীদের সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লেগেছে,’ বলল ডন। ‘বিশেষ করে সিম্ফনি।’

‘মহিলা খুব ভাল,’ বলল সু কি। ‘ওঁর বেহালা শোনার জন্যে অস্থির লাগছে আমার।’

‘বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না তোমার, সু কি,’ বলল কিশোর। ‘কাল সকালেই তো আমরা অর্কেস্ট্রার রিহার্সালে যাচ্ছি।’

‘একটা ব্যাপার বুঝলাম না,’ বলল ডন। ‘সিম্ফনি বলছিলেন ওঁর প্র্যাকটিস করতে হবে।’

‘প্র্যাকটিস মানেই রিহার্সাল,’ বুঝিয়ে বলল কিশোর।

‘শিল্পীরা চর্চা করেন নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে,’ জানাল মুসা। ‘কণ্ঠশিল্পীরা যেমন গলা সাধেন, রেওয়াজ করেন।’

‘আর তাতে কাজও হয়,’ বলল রবিন। ‘মুসাই তার খাঁটি উদাহরণ।’

‘আহা, আমি যদি মুসাভাইয়ের মত বাজাতে পারতাম!’ বলল সু কি।

‘পারবে,’ ওকে আশ্বস্ত করল রবিন। ‘একটু সময় দিতে হবে।’

‘আর অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে,’ বলল ডন। নিজের জন্য আরও খানিকটা হট চকোলেট ঢালল। ‘আরেকটা প্রশ্ন আছে আমার। হেক্টর ক্রুসিয়ানি কীভাবে প্র্যাকটিস করেন?’

ওরা সবাই ভাবনায় পড়ে গেল।

শেষমেশ মুসা বলল, ‘কণ্ডাকটররা বাজনা শুনে ওটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেন। এভাবেই তাঁদের চর্চা হয়ে যায়।’

‘আর মোযার্ট?’ সু কির প্রশ্ন। ‘তিনি কীভাবে প্র্যাকটিস করতেন?’

‘ওঁর বাবা ছিলেন সঙ্গীত শিক্ষক,’ মুসা বলল ওকে। ‘ফলে, তিনি ছোটবেলাতেই বাজাতে শিখে যান।

‘কিন্তু মিউযিক লেখা আর বাজানো তো এক নয়,’ বলল ডন।

‘এটা অনেকটা ভাষার মত,’ ব্যাখ্যা করল কিশোর। ‘প্রথমে শোনো। তারপর বলতে শেখো। শেষমেশ, লিখতে পারো, আর যত লিখবে ততই আরও উন্নতি করবে।’

সু কি এটা ভালই বুঝল। ওর প্রথম ভাষা ছিল কোরিয়ান। এতিমখানায় ইংরেজি বলতে শিখেছে। এখন শিখছে কীভাবে ভালমত লেখা যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও।

‘সব কিছুতেই চর্চা লাগে, বলল।

এসময় বাঘা এসে এক থাবা তুলে দিল রবিনের কোলে। ওর দিকে চোখ তুলে চেয়ে মিহিস্বরে কুঁই-কুঁই করছে।

‘মনে হয় সাপারের সময় হয়ে গেছে,’ বলে, দেয়ালঘড়ি দেখল রবিন, ‘হ্যাঁ, প্রায় ছটা বাজে। যাই, স্প্যাগেটির জন্যে পানি গরম করিগে।’

জ্যাক নানার হাউসকিপার মিসেস ম্যাকলিন ছুটিতে, তাই ওরা নিজেরাই রান্নাবান্না করছে।

গুঙিয়ে উঠল কিশোর।

‘এতসব খাবার খেয়ে এলাম, আবার খাওয়া?’

মুসা এক লাফে উঠে দাঁড়াল।

‘খাইছে, আমার পেট কখনওই ভঁরে না!’ বলল।

‘মুসাভাই এত বড় খাদক কীভাবে এখন বুঝতে পারছি,’ বলল ডন। ‘সে খাওয়ার অনেক প্র্যাকটিস করে, তাই এত খেতে পারে!’

পরদিন সকালে, সু কি আর ডন সবার আগে বাড়ি ছেড়ে বেরোল। অর্কেস্ট্রার মহড়া শুনতে সিভিক সেন্টারে যেতে উদ্‌গ্রীব ওরা। যন্ত্রশিল্পীদের ক’জনকে এখন চেনে যেহেতু, সামনে বসে শোনার আগ্রহটাও বেড়েছে।

কোনায় পৌঁছে, ডন দেখল বাস আসছে। অন্যদের উদ্দেশে হাতছানি দিয়ে তাড়া লাগল।

হাঁটার গতি বাড়িয়ে, বাসটা থেমে দাঁড়াতেই পৌঁছে গেল সবাই। এবার পাঁচজনে উঠে পড়ল একে-একে।

‘প্র্যাকটিসের পর ওয়র্কশপ শুরু হবে,’ রবিন মনে করিয়ে দিল ওদের, যে যার আসনে বসার পর।

‘আমি নিজের যন্ত্র নিজে বানাও লেসনটা নেব,’ বলল ডন। ‘আমি নেব মিউযিক অ্যাপ্রিসিয়েশন,’ জানাল সু কি। ‘আমি সব কটা রিহার্সালেই যাব,’ বলল রবিন।

‘আমরা সব কটা ওয়র্কশপে গেলেও রিহার্সালগুলো শুনতে পারব,’ কিশোর বলল ওকে। ‘প্রতিটাই আলাদা-আলাদা সময়ে।’

মুসা নিশ্চুপ, সামনের দিনগুলোর কথা ভাবছে। শনিবার বিকেলে, ছোটদের জন্য বিশেষ পারফর্মেন্সের আয়োজন করা হয়েছে। ও বেহালাবাদক হিসেবে সুযোগ পেতে চায়, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছিল না লজ্জায়। ব্যাপারটাকে ওর এক অসম্ভব স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। তারপরও ভেবেছে এটা সত্যিও তো হতে পারে। ও আশা করছিল, কোন না কোন যন্ত্রশিল্পী ওকে বাজাতে বলবেন। এবং তা-ই হয়েছে। সিম্ফনির জন্য কখন বাজানোর সুযোগ আসবে ভাবছে ও।

‘সিভিক সেন্টার,’ একটু পরে বাসচালক জানাল।

ধন্যবাদ জানিয়ে রাস থেকে টপাটপ লাফিয়ে নেমে পড়ল ছেলে-মেয়েরা। পাল্লা দিয়ে দৌড়ে সেন্টারের মস্ত বড় মূল গেটটির কাছে পৌঁছল।

লবিতে লোকজন গিজগিজ করছে। সবার মধ্যেই কেমন যেন এক চাপা আতঙ্ক। অর্কেস্ট্রার সদস্যরা ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে কথাবার্তা বলছেন। হেক্টর ক্রুসিয়ানি আপনমনে বিড়বিড় আর পায়চারী করছেন। তাঁর ক’পা পেছনে অনুসরণ করছেন সিম্ফনি। হেক্টরকে তিনি কী বলছেন শোনা যাচ্ছে না, তবে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ভদ্রমহিলা ভয়ানক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

মেরি হপকিন্স ওদের কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিলেন।

‘আমি ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম,’ বললেন।

‘কী হয়েছে?’ অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল নথি।

‘মোযার্টের স্বরগ্রামটা,’ জবাবে বললেন মহিলা, ‘চুরি গেছে!’