দুই
সিভিক সেন্টারে মহা ব্যস্ততা দেখা গেল। লোকজন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে শেষ মুহূর্তের খুঁটিনাটি পরখ করে নিচ্ছে। রিসেপশন হল-এ লম্বা এক টেবিল বসানো হয়েছে, দু’বাহু ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে সেদিকে এগোল ছেলে-মেয়েরা।
‘অর্কেস্ট্রা হোটেলে এসেছে!’ কেউ একজন বলল।
‘জলদি করো!’ তাগিদ দিল ডন। ‘শীঘ্রিই ওরা এখানে এসে পড়বে!’
কিশোর আর রবিন টেবিলটির ওপর এক লম্বা, সাদা কাপড় বিছাল। এবার মুসা ওর সেন্টারপিসটা সেট করল। বড়-বড় দুটো পাত্রে নিজের তৈরি পাশ্ ঢালল কিশোর। সু কি আর ডন প্লেটে কুকি সাজিয়ে দিল। রবিন বাক্স থেকে বের করল স্যাণ্ডউইচগুলো।
ওদের কাজ শেষ হতে না হতেই, জ্যাক নানা হেঁটে এলেন এদিকে।
‘এসো, তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই,’ বললেন। পাশে দাঁড়ানো যুবতী মহিলাটির দিকে ফিরলেন। ‘ইনি অর্কেস্ট্রা মেম্বার সিম্ফনি মেলানি।’
নিঃশব্দে মহিলার নামটা উচ্চারণ করল ডন। চমৎকার এক ছন্দ রয়েছে নামটায়।
সিম্ফনির মাথায় লাল কোঁকড়া চুল, ঠোঁটে উষ্ণ হাসি আর পরনে গাঢ় নীল পোশাক।
‘ভাল লাগল তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে,’ বলে হাত বাড়ালেন।
‘সিম্ফনি?’ হাত ঝাঁকিয়ে দেয়ার সময় বলল ডন। ‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলেন তিনি।
‘মিউযিশিয়ানের জন্যে খাঁটি নাম,’ বলল ডন।
হেসে উঠলেন সিম্ফনি। এমনকী তাঁর হাসিটাও ভারী সুরেলা। ‘আমি গান-বাজনা পরিবারের মেয়ে,’ জানালেন। ‘আপনি কী বাজান?’ মুসার প্রশ্ন।
‘বেহালা।’
‘ফার্স্ট ভায়োলিন,’ জ্যাক নানা বলে দিলেন।
মুসার চোখ ছানাবড়া। অর্কেস্ট্রার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বেহালাবাদিকার সঙ্গে কথা বলছে ও!
‘মুসাভাইও বেহালা বাজায়,’ বলল ডন। ‘সু কিও শিখছে।’ সিম্ফনি চাইলেন মুসা আর সু কির দিকে।
‘তোমরা আমাকে বাজিয়ে শোনাবে, কেমন?’ বললেন মিষ্টি হেসে।
মাথা নাড়ল সু কি।
‘আমি তো সবে মাত্ৰ শিখছি।’
‘তাহলে পরেরবার,’ বললেন সিম্ফনি। ‘মুসা, তুমি?’
অপ্রস্তুত বোধ করল মুসা।
‘খাইছে, আমি—’
‘মুসাভাই ভাল বাজায়,’ জানাল ডন।
সিম্ফনি মাথা ঝাঁকিয়ে মৃদু হাসলেন।
‘তাহলে ওকথাই রইল,’ বলে চারপাশে চাইলেন। ‘হেক্টর
এখনও আসছেন না কেন?’
‘হেক্টর কে?’ সু কি জিজ্ঞেস করল।
‘হেক্টর ক্রুসিয়ানি, কণ্ডাকটর,’ মুসা বলল ওকে।
‘উনি কি হোটেলে ছিলেন?’ জ্যাক নানার প্রশ্ন।
‘উনি পরের ফ্লাইটটা ধরেছিলেন,’ বললেন সিম্ফনি। ‘কিন্তু তাঁর তো এতক্ষণে চলে আসার কথা।
এসময়, দশাসই চেহারার এক লোক সেন্টারে প্রবেশ করলেন। মাথার ধূসর, উষ্কখুষ্ক চুলগুলো দাঁড়িয়ে আছে বিচিত্র সব কোণে-কোণে। তাঁর পরনে কোঁচকানো সোয়েটার আর স্ল্যা, পায়ে পুরানো স্নিকার্স। দোরগোড়ার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে অনিশ্চিত দৃষ্টিতে ইতিউতি চাইছেন। এবং গুনগুন করছেন!
‘ওই যে, এসে গেছেন,’ বললেন সিম্ফনি, এগিয়ে গেলেন ভদ্রলোকের উদ্দেশে।
জ্যাক নানা স্বাগত কমিটির সদস্য হিসেবে তাঁকে অনুসরণ করলেন।
‘ইনিই সেই বিখ্যাত হেক্টর ক্রুসিয়ানি?’ চড়া কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর।
ওরা সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। ওদের কল্পনার সঙ্গে মোটেই মেলেনি ভদ্রলোকের সাজপোশাক। ওরা ধোপদুরস্ত কাউকে দেখবে আশা করেছিল।
‘খাইছে, উনি অমন মলিন কাপড়চোপড় পরে এসেছেন কেন?’ মুসা বলল।
অন্য সবার পরনে পরিপাটী বেশভূষা।
‘উনি হয়তো জানতেন না পার্টি হবে,’ বাতলে দিল রবিন। ‘কারণটা জানা দরকার,’ বলল ডন।
ওরা গেল অন্যদের সঙ্গে মিলিত হতে।
‘হেক্টর, আপনি এত দেরি করলেন যে!’ বললেন সিম্ফনি। ‘পার্টির কথা কি ভুলে গেছিলেন?’
‘ওহ,’ জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিলেন ভদ্রলোক। ‘মোযার্ট সিম্ফনির কথা ভাবছিলাম। কনসার্টের আগে লয় নিয়ে কাজ করা উচিত আমাদের।’
‘তারজন্যে তো অনেক সময় আছে,’ সিম্ফনি আশ্বস্ত করলেন তাঁকে। ‘কনসার্ট শুক্রবার বিকেলে-এখনও পাঁচ দিন বাকি।’
‘এতটাই মগ্ন হয়ে গেছিলাম যে সময়ের হিসেব ছিল না,’ জানালেন হেক্টর। ‘তারপর আরেক ঝামেলা… লাগেজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথাও।’
‘এয়ারপোর্ট থেকে এনেছেন তো?’ সিম্ফনি জিজ্ঞেস করল। চুল ভেদ করে দু’হাত চালালেন হেক্টর ক্রুসিয়ানি।
‘এনেছি? ভেবে দেখি।’
‘না, আপনি ভুলে গেছিলেন,’ বলে উঠল একটি কণ্ঠ। ‘কিন্তু আমি ভুলিনি।’ সুটকেস আর গার্মেন্ট ব্যাগ বয়ে এক লোক ওদের পাশে এসে থামলেন।
হেক্টর তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে, খাবার টেবিলের দিকে আনমনে হেঁটে গেলেন, গুনগুনিয়ে সুর ভাঁজছেন।
দীর্ঘশ্বাস পড়ল সিম্ফনির।
‘আপনি না থাকলে ওঁর চলবে কী করে, ক্রিস?’ প্রশ্ন করলেন।
হাফ গ্লাসের ওপর দিয়ে ওদের দিকে চেয়ে, লোকটি শ্রাগ করলেন।
‘ইনি ক্রিস গেইল,’ জ্যাক নানা আর ছেলে-মেয়েদেরকে বললেন সিম্ফনি।
ক্রিস গেইল বললেন, ‘হ্যালো।’ তারপর শশব্যস্তে চলে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘অডিটোরিয়ামটা চেক করতে হবে আমার।’
‘উনি কি মিউযিশিয়ান?’ মুসার প্রশ্ন।
‘না,’ জবাব দিলেন সিম্ফনি। ‘উনি আমাদের ম্যানেজার।’
‘ম্যানেজারের কাজ কী?’ সু কি জানতে চাইল।
‘সব!’ জবাব দিলেন সিম্ফনি। ‘আমাদের টুরের শিডিউল করা। আমরা যাতে ঠিকমত পৌঁছি সেটা দেখা এবং মালপত্র যেন ঠিকঠাকভাবে আসে তার ব্যবস্থা করা। মাঝেমধ্যে ঝগড়া-বিবাদ মিটমাট করা। ওঁকে ছাড়া অর্কেস্ট্রা অচল। বলতে পার তিনি সব কাজের কাজী।’
‘ইন্টারেস্টিং কাজ মনে হচ্ছে,’ বলল কিশোর।
‘খুব কঠিনও,’ বলল ডন। হেসে উঠলেন সিম্ফনি।
‘বলতে পার দুটোই।
‘মিস্টার গেইল কাজটা খুব একটা পছন্দ করেন মনে হলো না,’ সু কি বলল।
‘কাজের চাপে মাঝেসাঝে মেজাজ বিগড়ে যায় ওঁর,’ বললেন সিম্ফনি। ‘উনি হয়তো জানেন না আমরা আড়ালে ওঁর কত প্রশংসা করি।’
‘ওঁকে ছাড়া এ সপ্তাহে আমরা কিছুতেই শিডিউল করতে পারতাম না,’ জ্যাক নানা বললেন। ‘আমাদেরকে প্ল্যান-প্রোগ্রাম চূড়ান্ত করতে অনেক সহযোগিতা করেছেন তিনি।’
‘তোমাদেরকে আরেকটা জিনিস দেখাব, উনি যেটার প্ল্যানিঙে অসম্ভব হেল্প করেছেন,’ বলে, কামরার ওপ্রান্ত লক্ষ্য করে হাঁটা দিলেন সিম্ফনি। ‘সেজন্যেই এই টুরটা এক্সট্রা স্পেশাল।’
ওরা সবাই বিস্মিত হয়ে গেল। ওদের মনে হলো এই টুরের সব কিছুরই যেন বাড়তি আকর্ষণ আর বিশেষত্ব রয়েছে।