হারানো সুর – ১৫

পনেরো

সবার নজর এখন ক্রিসের ওপর। এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছে সবাই, কারও মুখে কথা নেই। শেষমেশ, হেক্টর বললেন, ‘আমার আগেই মনে হয়েছিল আপনার কোন কুমতলব আছে।’ তাঁকে ব্যথিত আর হতাশ দেখাচ্ছে। ‘কিন্তু স্বরগ্রামটা আপনি পেলেন কোথায়? আমি নিজে লুকিয়ে রেখে যদি খুঁজে না পাই…’ কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গেল তাঁর।

ফাঁকা হাসলেন ক্রিস।

‘কাজটা সহজ ছিল না!’ উঠে দাঁড়ালেন। ‘আমি প্ল্যান করে কিছু করিনি,’ বলে পায়চারী শুরু করলেন। ‘আইডিয়াটা আপনিই আমাকে দিয়েছেন।’

গমগম করে উঠল হেক্টরের কণ্ঠস্বর।

‘আমি? হাসালেন!’

‘এতে হাসির কিছু নেই। বরং আপনি যখন স্কোরটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তখন মনে-মনে অনেক হেসেছি আমি। কেউ-এমনকী আপনিও কীভাবে এতটা ভুলোমনা হতে পারেন?

‘আমাকে অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়;’ আত্মপক্ষ সমর্থন করে অস্পষ্টস্বরে আওড়ালেন হেক্টর।

তাঁকে অগ্রাহ্য করলেন ক্রিস।

‘তখনই ঠিক করি আপনাকে একটা উচিত শিক্ষা দেব। স্বরগ্রামটা খুঁজে বের করে লুকিয়ে ফেলব।’

‘ওটাকে প্যারিসে পাচার করে?’ ডনের জিজ্ঞাসা।

‘ওই আইডিয়াটা পরে আসে। ভাবি ওটা বেচে দিলে ক্ষতি কী? আমার কাজ হচ্ছে সবাইকে সারাটাক্ষণ সার্ভিস দিয়ে যাওয়া। কেউ কল্পনাও করবে না আমি ওটা নিয়েছি। কেউ কখনও আমাকে ধন্যবাদটুকুও দেয় না, আর আমার খোঁজ-খবর রাখা তো দূরের কথা-যতক্ষণ না কোন সমস্যা হচ্ছে আরকী। তখন যত দোষ নন্দ ঘোষ।’

‘এসব কী বলছেন, ক্রিস,’ বললেন সিম্ফনি। ‘আপনাকে ছাড়া আমাদের চলে?’ হাত বাড়িয়ে ওঁর কাঁধ স্পর্শ করলেন, কিন্তু ভদ্রলোক ঝাঁকি দিয়ে সরে গেলেন।

‘আপনি না হয় স্বীকার করেন,’ সিম্ফনিকে বললেন, ‘কিন্তু অন্যরা? মহান হেক্টর ক্রুসিয়ানি তো আমাকে পাত্তাও দেন না।’

এক চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন হেক্টর।

‘এই অর্কেস্ট্রার জন্যে আপনার অবদান কতখানি জানি আমি,’ বিড়বিড়িয়ে বললেন, ‘শুধু বলতে ভুলে যাই।’

‘প্যারিসের এক ডিলারের সাথে কথা হয়েছে আমার,’ বলে চললেন ক্রিস। ‘সে আমাকে অনেক টাকা অফার করেছে। বড়লোক হয়ে যাব আমি! আর কোন কষ্ট থাকবে না। এত করেও যাদের মন পাওয়া যায় না, তাদের সাথে সব সম্পর্ক চুকেবুকে যাবে।’

‘স্বরগ্রামটা কোথায় খুঁজে পান আপনি?’ কিশোর জানতে চাইল।

‘পাইনি। প্রথমটায় আরকী। হেক্টরের কামরায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।’

‘তাই চিরকুট দুটো লেখেন,’ বলল রবিন।

‘একটা-হেক্টরকে। আমারটার ব্যাপারে মিথ্যে বলেছি।’

‘খাইছে, এবং আপনার রুমও কেউ তছনছ করেনি,’ সমাপ্তি টানল মুসা।

ওটাও অসত্য ছিল,’ বললেন ক্রিস। ‘তারপর, হেক্টর, আপনি আমাকে টাক্সেডোটা ধোলাইয়ে দিতে বললেন।’

হেক্টর মাথা ঝাঁকালেন।

‘হ্যাঁ, মনে আছে।‘

‘স্বরগ্রামটা ওটার ভেতরেই ছিল!’ কিশোর অনুমানে বলে উঠল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে,’ বলে উঠলেন হেক্টর। ‘ওটা ভেতরের পকেটে রেখেছিলাম।’

‘হুম! আমি ওটা ডিলারের কাছে মেইল করার কথা ভাবি। দেশ থেকে যত তাড়াতাড়ি ওটা বের করে দেয়া যায় আরকী। তারপর কাল আমিও চলে যেতাম।’ হেক্টরের পাশে এক চেয়ারে গা ডুবিয়ে দিলেন ক্রিস। ‘আপনারা সব বিখ্যাত, মেধাবী মিউযিশিয়ান,’ বললেন, ‘সবাই আপনাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর আমার গুণ একটাই-সব কিছু ম্যানেজ করা। কেউ ফিরেও তাকায় না, স্বীকৃতি দেয়া তো দূরের কথা।

‘কিন্তু কাজটা সাঙ্ঘাতিক জরুরী,’ হেক্টর বললেন তাঁকে। ক্রিস বিড়বিড়িয়ে বললেন, ‘এই অর্কেস্ট্রাই আমার জীবন।’

কপালে হাত রাখলেন। ‘আমি দুঃখিত।‘

টানটান উত্তেজনার পর সিম্ফনির দিকে মুখ তুলে চাইল ডন। ‘সিম্ফনি, একটা কথা বলবেন?’ বলল। ‘টাউন স্কয়্যারে আপনি যে লোকের সাথে দেখা করেছিলেন তিনি কে?’

আরক্তিম হয়ে গেল মহিলার মুখের চেহারা। হেক্টরের উদ্দেশে চকিতে চেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।

‘আমি-আমি—’ শব্দ হাতড়াচ্ছেন।

হেক্টর তাঁকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন।

‘আমি বোধহয় জানি। সিম্ফনিও ভাবছে এখানে ও উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছে না, এখানে অবহেলিত। ঠিক না, ডিয়ার?’

‘আসলে শিডিউল নিয়েই যত সমস্যা। এত ব্যস্ত শিডিউল এখানে…’ ব্যাখ্যা দিলেন সিম্ফনি। ‘আমি চিন্তা-ভাবনার সময়টুকুও পাই না। ভয় পাচ্ছিলাম এত চাপের ফলে আমার ক্যারিয়ার না ক্ষতিগ্রস্ত হয়!’

‘আপনি তো বাজনার দেবী, ডিয়ার, ওঁকে আশ্বস্ত করলেন হেক্টর। ‘আপনার মত বাজাতে ক’জন পারে?’

মৃদু হাসলেন সিম্ফনি।

‘ধন্যবাদ, হেক্টর। হয়তো নার্ভাসনেস থেকেই এমন ধারণা হয় আমার।’

‘কিন্তু সেই অচেনা ভদ্রলোকটি কে?’ ডন আবারও জিজ্ঞেস করল।

‘উনি আরেকটা অর্কেস্ট্রা কনডাক্ট করেন-ওটা অনেক কম টুর করে। তিনি আমাকে কাজের প্রস্তাব দেন,’ সিম্ফনি খুলে বললেন। ‘আমি ওঁর সাথে দেখা করে আমার রিজিউমি দিই। ভদ্রলোক আমাকে তাঁর অর্কেস্ট্রা সম্পর্কে জানান।’

‘ব্যস, এই?’ ডন বলল।

চাপা হাসলেন সিম্ফনি।

‘তুমি কী ভেবেছিলে, ডন? খামে স্বরগ্রামটা রয়েছে?

ডন একেবারে অপ্রস্তুত। ও যে সিম্ফনিকে চোর ভেবেছিল, এটা কিছুতেই জানাতে চায় না। মুখ খুলল, কিন্তু কোন শব্দ বেরোল না।

মুসা কথা বলল।

‘সু কি আর আমি কিন্তু কখনওই আপনাকে সন্দেহ করিনি, সিম্ফনি!’

‘মুসাভাই ঠিকই বলেছে,’ বলল সু কি। এবার প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি ওখানে চলে যাচ্ছেন?’

‘আজকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এটাই,’ বললেন হেক্টর। এক পা কাছিয়ে এলেন সিম্ফনির দিকে। ‘বুড়োমানুষটাকে অপেক্ষায় রাখবেন না। আপনার জবাব?’

হেসে উঠলেন সিম্ফনি।

‘জবাব তো আপনি জানেনই, হেক্টর। আমি এই অর্কেস্ট্রা ছেড়ে কোথায় যাব?’

‘আর বেশি-বেশি টুরের ব্যাপারটা?’ কিশোরের প্রশ্ন।

‘টুর না করলে কি এ শহরে আসা হত?’ বললেন সিম্ফনি। তোমাদের সাথে পরিচয় হত?!’

হেক্টর জড়িয়ে ধরলেন ওঁকে। আবেগে দু’জনেই একইসঙ্গে হাসছেন, কাঁদছেন। এরপর ওঁরা ছেলে-মেয়েদেরকে আলিঙ্গন করলেন। একটু পরেই, কান্না চলে গিয়ে রয়ে গেল শুধু হাসি।

আচমকা ডন খেয়াল করল ক্রিস গেইল এলিভেটরের দিকে গুটি-গুটি পায়ে চলেছেন।

‘ক্রিস চলে যাচ্ছেন!’ জরুরী কণ্ঠে বলে উঠল ও।

‘যেতে দাও,’ বললেন হেক্টর।

‘আপনি পুলিস ডাকবেন না?’

মাথা নাড়লেন হেক্টর।

‘ওর শাস্তি হয়ে গেছে। ও আর অর্কেস্ট্রার কেউ নয়।’

‘আর এসব খবর খুব দ্রুত রটে যায়,’ যোগ করলেন সিম্ফনি। ‘অন্য কোন অর্কেস্ট্রাও ক্রিসকে আর নেবে না।’

এসময়, জ্যাক নানা লবিতে ঢুকলেন। চওড়া হেসে, হেক্টর আর সিম্ফনির সঙ্গে হাত মেলালেন। নাতি-নাতনীদের উদ্দেশে বললেন, ‘সরি, আমার দেরি হয়ে গেল। মিলে কাজের খুব চাপ। তোমরা এখানে অপেক্ষায় থেকে বিরক্ত হওনি তো?’

ছেলে-মেয়েরা, হেক্টর আর সিম্ফনি পরস্পরের দিকে চেয়ে হাসলেন।

‘আমরা ব্যস্ত ছিলাম, বিরক্ত হওয়ার সময়ই পাইনি,’ বলল কিশোর।

‘ওরা একটা মিনিটও নষ্ট করে না,’ গর্বভরে বললেন জ্যাক নানা। ‘সারাক্ষণ কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখে নিজেদের।’ এবার সিম্ফনি আর হেক্টরকে তাঁদের সঙ্গে ডিনারের নিমন্ত্রণ দিলেন।

সানন্দে দাওয়াত কবুল করলেন হেক্টর।

‘খুব খিদে পেয়েছে আমার,’ বললেন তিনি।

‘খাইছে, আমারও,’ বলল মুসা। শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়ে ডাইনিং রুমের উদ্দেশে চলল।