দশ
সেদিন বিকেলে, অডিটোরিয়ামে ছেলে-মেয়েরা মিউযিক অ্যাপ্রিসিয়েশন ওয়র্কশপে যোগ দিল। সিটে বসতেই, হেক্টর মনোযোগ কাড়তে ব্যাটন ঠুকলেন। শ্রোতারা সব চুপ হয়ে গেল।
‘সঙ্গীতের সমঝদার হতে হলে আগে অর্কেস্ট্রা সম্পর্কে জানা থাকা ভাল,’ বললেন তিনি।
বিভিন্ন যন্ত্র সম্পর্কে শ্রোতাদের ধারণা দিলেন কণ্ডাকটর।
ছেলে-মেয়েরা এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েছিল, বাড়ি ফেরার আগে পর্যন্ত নিখোঁজ স্বরগ্রামটার কথা ওদের মনেই পড়ল না। হট ডগ আর বিন দিয়ে সাপার সেরে, আগুনের পাশে বসল ওরা।
বড় এক চেয়ারে গুটিসুটি মেরে বসে সু কি বলল, ‘গরম পানিতে মানে কী, কিশোরভাই?’ আগের আলোচনার রেশ টানল ও।
ডন মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল, দু’হাত গালে রাখল ও।
‘গরম পানিতে পড়ার মানে হচ্ছে, বলল, খানিক বিরতির পর কিশোরের দিকে চাইল। ‘তুমিই বলো না, কিশোরভাই।’
শব্দ করে হাসল কিশোর।
এর মানে হচ্ছে বিপদে পড়া।
রবিন বলল, ‘আমরা সিম্ফনিকে অচেনা লোকটার সাথে খাম অদল বদল করতে দেখেছি। তিনি যদি স্বরগ্রামটা চুরি করে বেচে থাকেন, তবে আমরা জেনে গেছি জানলে রেগে ব্যোম হয়ে যাবেন।’
মাথা ঝাঁকাল সু কি।
‘আর আমরা গরম পানিতে পড়ব!’
‘এই তো, বুঝেছ,’ বলল ডন।
সবাই নিশ্চুপ। ঘরে কেবল আগুনের কড়কড় শব্দ। দেয়াল আর ছাদে ছায়া-আবছায়া নাচছে। কিছুক্ষণ পরে, কিশোর সূত্রগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করল।
যা-যা জানে সব নিয়ে ওরা আলাপ করল। কোনটাই কোনটার সঙ্গে জোড়া লাগল না। হেক্টর স্বরগ্রামটা নিয়ে যান হোটেলে। কিন্তু ওটা কোথায় রেখেছেন সম্ভবত বলতে পারবেন না। সিম্ফনি এক আগন্তুকের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে কিছু একটা দিয়েছেন। তারপরও ওরা ভেবে পাচ্ছে না তিনি স্বরগ্রামটা হাতসাফাই করতে যাবেন কেন।
‘ধরে নেয়া যাক সিম্ফনি কিংবা হেক্টর দু’জনের কেউই চোর নন,’ সিদ্ধান্তে পৌঁছল রবিন। ‘তাহলে কে?’
ভারী শ্বাস ফেলল ডন।
‘এটা কঠিন রহস্য,’ বলল। ‘কখনওই সমাধান করতে পারব না আমরা।’
‘হাল ছেড়ো না, ডন,’ বলল কিশোর। ‘ঠিকই পারব।’ হাই উঠল ডনের।
‘পারলেও আজ রাতে নয়।’ আবারও হাই তুলল ও, তারপর বাহুজোড়ার ওপর মাথা রেখে ঘুমে ঢলে পড়ল।
কিশোর ডনকে কোলে করে ওপরতলায় নিয়ে গেল। অন্যরা ওকে অনুসরণ করল। সবাই ওরা প্রচণ্ড ক্লান্ত, আজ আর মাথা খাটানো সম্ভব নয়।
সকালে, আবারও বাসে চেপে হোটেলে গেল ছেলে-মেয়েরা। মুসা রীতিমত অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
‘ওহ, বড্ড খিদে পেয়েছে,’ বলল।
‘লবিতে রোস্ আর জুস থাকবে,’ মনে করিয়ে দিল ডন।
তার প্রয়োজন ছিল না।
‘জানি তো,’ বলল মুসা। ‘খাওয়ার চিন্তাতেই তো খিদে পেয়ে গেছে আমার।’
‘আমারও,’ একমত হলো সু কি।
ওরা হোটেলে ঢুকছে, এসময় বেরোতে দেখল মেরি হপকিন্সকে।
‘মিস হপকিন্স!’ বিস্ময় চাপতে পারল না রবিন। ‘আপনি এখানে এত সকালে?’
মেরি হপকিন্সের মুখের চেহারা লাল হয়ে গেল। ‘ওহ, আমি-উম…’ রীতিমত তোতলাচ্ছেন তিনি। ‘সুইট রোলের জন্যে এসেছিলেন?’ ডন প্রশ্ন করল। মহিলা গলা খাঁকরালেন নার্ভাস ভঙ্গিতে।
‘না, অটোগ্রাফ, জানালেন। ‘অটোগ্রাফের জন্যে।’ নির্জন লবিটির চারপাশে নজর বোলাল কিশোর। ‘পেয়েছেন কারওটা?’ প্রশ্ন করল।
মাথা নাড়লেন মেরি।
‘না, সিভিক সেন্টারে যাব ভাবছি। ওখানে হয়তো পাব কাউকে।’
‘পরে দেখা হবে,’ বলল ডন। তরতর করে চলে গেল ব্রেকফাস্ট বুফের কাছে।
পায়ে-পায়ে ওকে অনুগমন করল সু কি।
মেরি হপকিন্স ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ভাব দেখে মনে হলো কিছু একটা বলতে চান।
শেষমেশ কিশোর বলল, ‘কিছু বলবেন?’
‘ওহ, না,’ বললেন মেরি। ‘আমি আসলে-উম-স্কোরটার কথা ভাবছিলাম-কিছু কি জানা গেল?’
ওরা মাথা নাড়ল।
মেরি আরও কটা প্রশ্ন করলেন। জবাব জানা ছিল না কারও। এসময় সিম্ফনি এলিভেটর থেকে বেরোতেই, জড়ানো কণ্ঠে কী সব বলে দরজা দিয়ে লবি ছাড়লেন মেরি।
‘অদ্ভুত না?’ বলল কিশোর।
‘খাইছে, মহিলাকে সাঙ্ঘাতিক নার্ভাস দেখাচ্ছিল।’ বলল মুসা। ‘আচ্ছা, উনিই কি …..
বন্ধুর অসমাপ্ত বাক্যটা শেষ করল রবিন। ‘চোর? জানি না।’
সিম্ফনি, সু কি আর ডনের সঙ্গে টেবিলে যোগ দিল ওরা। মন ভরে খেল ছেলে-মেয়েরা।
সিম্ফনি কিছুই খেলেন না। একক পরিবেশন নিয়ে তিনি মহা চিন্তিত, ওদেরকে জানালেন।
‘আর হেক্টরের সাথেও কথা আছে আমার, কিন্তু ওঁকে খুঁজে পাচ্ছি না,’ আরও বললেন।
‘উনি হয়তো সেন্টারে,’ বাতলে দিল কিশোর।
‘আমাকে তো বলেছিলেন নিজের রুমে ব্রেকফাস্ট করবেন।’
‘হয়তো ভুলে গেছেন,’ বলল সু কি।
হেসে উঠলেন সিম্ফনি।
‘তা হতে পারে, সু কি।’
‘আপনি তাঁর জন্যে অপেক্ষা করতে চান?’ রবিন জিজ্ঞেস করল।
‘না,’ জবাবে বললেন সিম্ফনি। ‘যাই চলো, আমার প্র্যাকটিস করতে হবে।’
সিভিক সেন্টারের সামনে পায়চারী করছিলেন হেক্টর।
‘এই যে, সিম্ফনি!’ ওরা কাছিয়ে যেতেই বলে উঠলেন তিনি। ‘হেক্টর! আপনি এখানে কী করছেন?’ সিম্ফনি প্রশ্ন করলেন। হেক্টর কেমন হকচকিয়ে গেলেন।
‘আপনিই তো আমাকে বলেছিলেন এখানে দেখা করতে।’
‘সেটা তো আজ বিকেলে!’
‘বেচারা সত্যিই ভুলোমনা,’ কিশোরকে ফিসফিস করে বলল ডন। ‘এটা তাঁর অভিনয় নয়, আসলেই তিনি এমন।’
‘না, না!’ কোটের পকেট হাতড়াচ্ছেন হেক্টর। ‘আপনি আমাকে এই চিরকুটটা পাঠিয়েছিলেন।’ একটা কাগজ বের করে সিম্ফনিকে দিলেন। হোটেলের কেউ একজন আমার দরজার তলা দিয়ে এটা গুঁজে দেয়।’
‘হেক্টর, সকাল আটটায় আমার সঙ্গে সিভিক সেন্টারে দেখা করুন। জরুরী!’
সিম্ফনি সবাইকে শুনিয়ে পড়লেন। ‘আজকের তারিখ। সইটাও অনেকটা আমারই মত, কিন্তু এই চিরকুটটা আমি লিখিনি!’