হারানো সুর – ১

এক

‘যাবে না?!’ প্রশ্ন করল ডন, কিচেনে নেচে বেড়াচ্ছে।

বাঘা ঘুম ভেঙে জেগে উঠে উত্তেজিত গলায় ডাকতে লাগল। রবিন ছোট-ছোট গোল স্যাণ্ডউইচ বানাচ্ছিল।

‘একটু ধৈর্য ধরো, ডন,’ বলল ও।

‘আমার আর তর সইছে না,’ জানাল ডন। ‘রোজ-রোজ তো

আর শহরে এমন নামকরা অর্কেস্ট্রা আসে না।’

‘তা ঠিক,’ বলল রবিন। ‘গ্রিনফিল্ড ছোট শহর। অর্কেস্ট্রা সাধারণত বড়-বড় শহরে টুর করে।’

ডন এটা আগে ভাবেনি।

‘তাহলে ওরা এখানে আসছে কেন?’ জিজ্ঞেস করল।

‘সিভিক সেন্টার ওদের জন্যে আদর্শ জায়গা,’ জানাল কিশোর। ‘ওখানে আশপাশের এলাকা থেকেও লোকজন আসতে পারবে বাজনা শুনতে।’

‘কিন্তু ওরা শুধু বাজাবেই না,’ ওকে মনে করাল রবিন। ‘মানুষকে মিউযিক শেখানোর জন্যে ওয়র্কশপও করছে।’

‘কণ্ডাকটর ছোটবেলায় এখানে থাকতেন,’ বলল মুসা। যন্ত্রসঙ্গীতে প্রচণ্ড আগ্রহ ওর। বেহালা বাজায় এবং অর্কেস্ট্রা সম্পর্কে যেখানে যা পাচ্ছে সবই পড়ে ফেলছে। ‘এই গ্রিনফিল্ডেই কণ্ডাকটর ভদ্রলোক মিউযিকে প্রথম উৎসাহী হন। তাই এখানকার মানুষজনের সাথে গান-বাজনার প্রতি ভালবাসাটা ভাগাভাগি করতে চান আরকী।’

এসব শুনে ডনের উত্তেজনা ধরে না।

‘একটু জলদি করো না,’ তাগিদ দিল বড় ভাইদেরকে। ‘দেরি হয়ে যাবে তো!’

গ্যালন জগে পাশ্ ঢালল কিশোর।

‘দেরি হবে না, ডন,— আশ্বস্ত করল। ‘তাছাড়া আমরা না গেলে রিসেপশন তো শুরুই হবে না-কারণ আমরা খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’

‘আর ডেকোরেশন,’ বলল মুসা। কিচেন টেবিল থেকে একটু পিছিয়ে গিয়ে ওর বানানো সেন্টারপিসটা এক ঝলক দেখে নিল। রঙবেরঙের বাসন্তী ফুল ঘিরে কার্ডবোর্ডের নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র। ‘এই তো, হয়ে গেছে,’ বলল।

‘দারুণ হয়েছে, মুসা!’ প্রশংসা ঝরল রবিনের কণ্ঠে।

‘আমি কয়েকটা যন্ত্র কেটে দিয়েছি,’ মনে করাতে ভুল হলো না ডনের।

‘হ্যাঁ, ডন অনেক সাহায্য করেছে,’ বলল মুসা।

‘তেমন বেশি একটা না,’ বলল ডন। ‘তাহলে তো আমরা এতক্ষণে রওনা হতে পারতাম।’

হেসে উঠল কিশোর।

‘তুমি এখন আমাকে হেল্প করতে পার,’ বলল।

কাউন্টারের কাছে এক টুল টেনে নিয়ে গিয়ে ওটার ওপর দাঁড়াল ডন।

‘কী করতে হবে বলো।’

‘জগগুলো ভরা হয়ে গেলে ঢাকনা লাগাবে,’ কিশোর বলে দিল।

ডন মাথা ঝাঁকিয়ে কাজে লেগে পড়ল। শেষ মুখটা লাগানোর পর এক লাফে টুল থেকে নামল।

‘এখন?’

’তোমাকে বাক্সে স্যাণ্ডউইচগুলো রাখতে বলব,’ মজা করে বলল রবিন। ‘মুসাকে বললে তো ও সব খেয়ে ফেলবে।’

শুনে নাক সিটকাল মুসা।

‘শসার স্যাণ্ডউইচ?’ এটা যদিও ওর প্রিয় নয়, তবুও এগিয়ে এসে একটা তুলে নিয়ে কামড় বসাল।

‘মুসাভাই, করো কী, করো কী,’ হাঁ-হাঁ করে উঠল ডন। ‘এখনই খেয়ে ফেললে তো রবিনভাইকে আরও বানাতে হবে, তাতে আরও দেরি হবে।’

‘এক ধরনেরই বানিয়েছ?’ মুসার প্রশ্ন।

‘না, অন্যরকমেরও আছে,’ জানাল রবিন। ‘কিন্তু ওগুলো সব প্যাক করা হয়ে গেছে।’

মুসা সব কটা বাক্সে উঁকি দিল। হরেক রকমের আর আকৃতির স্যাণ্ডউইচ ভেতরে থরে থরে সাজানো। সবগুলোই ছোট।

‘খাইছে, আমার বড় স্যাণ্ডউইচ পছন্দ,’ বলল ও।

বাক্সের ঢাকনা লাগাতে লাগল রবিন।

‘এগুলো টি স্যাণ্ডউইচ,’ বলল, ‘বিকেলের পার্টিতে সার্ভ করে।

‘প্লেটে রাখলে খুব সুন্দর লাগে,’ বলল ডন।

‘দেখতে কেমন তার চেয়ে বড় কথা হলো খেতে মজা কিনা,’ বলল পেটুক শিরোমণি মুসা।

হেসে উঠল সবাই। মুসা খেতে বড্ড ভালবাসে।

‘ব্যস, হয়েছে,’ বলে, শেষ বাক্সটার ঢাকনা লাগাল রবিন।

‘তাহলে আর দেরি কীসের?’ ডনের প্রশ্ন।

‘জ্যাক নানাকে ফিরতে দাও,’ বলল কিশোর।

জ্যাক হিগিন্স গেছেন সু কি-কে আনতে। সাত বছরের সু কি তাঁর প্রতিবেশী রবিনসন দম্পতির পালিতা মেয়ে, কোরিয়ার এক অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছেন তাঁরা ওকে।

ঠিক এমনিসময়, জ্যাক নানা ফিরলেন বাইরে থেকে। সু কি তাঁর সঙ্গে। জ্যাক নানা রবিনের মার আপন চাচা। কিশোর, মুসা, রবিন আর ডনকে খুব ভালবাসেন।

‘বাহ, তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে, সু কি,’ মেয়েটিকে বলল মুসা। ফিকে নীলরঙা পোশাক পরেছে ও বেগুনী স্যাশের সঙ্গে। ‘দারুণ মানিয়েছে!’

উজ্জ্বল হাসল সু কি।

‘ধন্যবাদ,’ বলল।

‘আমরা রেডি তো?’ জ্যাক নানা জিজ্ঞেস করলেন। ‘চাই না পৌঁছতে দেরি হোক।’

‘এক মিনিট, নানা, বলল ডন। ‘কুকি! সু কি, কুকিগুলো কোথায়?!’

আগের দিন বিকেলটা সু কির বাসায় বেক করে কাটিয়েছে ওরা। কুকির কথা ভোলেনি ডন।

‘গাড়িতে,’ সু কি জানাল।

‘আচ্ছা,’ দরজা খুলতে ছুটল ডন। ‘চলো সবাই,’ বলল। অন্যরা বাক্স আর জগগুলো নিয়ে বেরিয়ে এল। বাঘা ওদের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

‘আমরা শীঘ্রি ফিরব,’ রবিন আশ্বাস দিয়ে বলল ওকে।

লেজ নেড়ে নিজের গালিচায় শোয়ার জন্য ফিরল কুকুরটা। স্টেশন ওয়াগনটির পেছনে বাক্সগুলো রাখার পর, ওরা সবাই চেপে বসল ভেতরে।

‘সিভিক সেন্টার,’ গাড়িপথ থেকে বেরনোর সময় বললেন জ্যাক নানা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল. মুসা। যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে ও। বিশেষ করে বেহালাবাদকদের প্রতি ওর আগ্রহটা বেশি। মনের গহীনে আশা, তাঁরা কেউ হয়তো ওর বাজনা শুনতে চাইবেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করেছে ও সেজন্য।

‘খাইছে, খুব নার্ভাস লাগছে,’ বলল ও।

‘মনে করো তুমি উত্তেজিত, নার্ভাস নও,’ জ্যাক নানা বললেন।

হেসে ফেলল মুসা।

‘আচ্ছা, তাহলে আমি মহা উত্তেজিত,’ জানাল। ‘আমিও,’ সমস্বরে বলল অন্যরাও।