হাবু ভুঁইমালির পুতুল – ৬

আমি যন্তরতন্তর একটু-আধটু চিনি, মানুষও একটু-আধটু চিনি, কিন্তু যন্তর আর মানুষের এমন মিলমিশ কখনও দেখিনি বাপু!

একটা ঝুড়ির মধ্যে কাঁথাকানির বিছানায় শোয়া পুতুলটা পিটপিট করে তার দিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ তাঁর ঠোঁট নড়ল আর বলে উঠল, “টারকোম বারকোম ফুলিলা টিকলিক রমসম অলদম বতসী তাকধিক।”

হাবু ভুঁইমালি কথাগুলো কিছুই বুঝল না, গুণময় ঘোষ পাশেই দাঁড়ানো। বলল, কথা বেশি কয় না, যখন কয় তখন এরকমই সব কথা বেরোয়। কিছু বুঝলেন?

“আজ্ঞে না।”

“আমিও না।”

হঠাৎ পুতুলটা তার ডান হাতটা হাবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নবক।”

হাবু কথাটা বুঝল না কিন্তু ভাবটা বুঝল। অনেক সময়ে কথার দরকারও হয় না। ছোট্ট পুতুলটার দিকে চেয়ে মায়ায় তার চোখে জল আসছিল। এমন সুন্দর পুতুল-মানুষ সে জীবনে দেখেনি। বাড়ানো হাতটার দিকে নিজের ডান হাতের একটা আঙুল এগিয়ে দিল সে। পুতুলটা আঙুলটাকে খুব জোরে চেপে ধরল। কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তার দিকে। তারপর বাংলা ভাষায় বলে উঠল, “তুমি একজন যন্ত্রবিদ! তুমি একজন ভালমানুষ। তুমি সবকিছুকেই ভালবাসো, যন্ত্রের কথাও তুমি বুঝতে পারো, তোমার মনে হয় যন্ত্রেরও ব্যথাবেদনা আছে।”

হাবুর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছিল। সে ধরা গলায় বলল, “হ্যাঁ বাবা, আমার মনটা বড় নরম। আমার বড় মায়া! কিন্তু তুমি কে বাবা, মানুষ না পুতুল?”

“আমি যন্ত্র। আমি কলের পুতুল। কিন্তু প্রাণবান যন্ত্র, এ জিনিসের ধারণা তোমাদের নেই।”

“যন্ত্রের মধ্যে প্রাণ! সে কি হয় বাবা ”

“হয়, পুরনো ধ্যানধারণা দিয়ে এই তত্ত্ব বোঝা যাবে না। তবে তুমি হয়তো খানিকটা বুঝলেও বুঝতে পারো।”

হাবু মাথা নেড়ে বলল, “খানিক ধারণা হচ্ছে বাবা! বলো বাবা, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?”

“আমার বাঁ পা-টা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তুমি আমাকে মেরামত করতে এসেছ আমি তা জানি। কিন্তু মেরামত করার জন্য যেসব যন্ত্রপাতির দরকার তা তোমার কাছে নেই। আমি তোমার মতোই একজন যন্ত্রবিদ। আমি বহু দূর থেকে, আকাশের আর-এক প্রান্ত থেকে এসেছি একটা ঘড়ি সারাব বলে। দেড়শো বছর একটানা চলার পর ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর সেটাই বিপদের কথা। কারণ ঘড়িটা শুধু ঘড়িই নয়, এক মহাযন্ত্র। সে এই গ্রহের সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যতদিন চালু ছিল ততদিন পৃথিবীর সময়ের সঙ্গেই সে চলেছে। কিন্তু সেই ঘড়ি যদি উলটোদিকে চলতে শুরু করে তা হলেই সর্বনাশ।”

“তা হলে কী হবে বাবা?”

“পৃথিবীর সময়ও উলটোদিকে চলতে শুরু করবে। কারণ ওই মহাযন্ত্র সময়ের শাসক, সময়ের প্রভু। সে উলটোদিকে চললে তোমাদের সময়ও উলটো চলতে থাকবে।”

“সে যে সব্বোনেশে কথা বাবা!”

“হ্যা। তুমি একজন যন্ত্রবিদ, তাই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। ধরো, এখন এই বিকেল পাঁচটায় ঘড়িটা যদি উলটোদিকে চলতে শুরু করে তা হলে সূর্য পশ্চিম থেকে উদয় হয়ে বিকেল আস্তে-আস্তে দুপুর হয়ে যাবে। আর সকালবেলায় সূর্য পূর্বদিকে অস্ত যাবে। গতকাল হয়ে যাবে আজ। মানুষ, গোরু, ছাগল সব উলটোদিকে হাঁটতে থাকবে এবং ফিরতে থাকবে অতীতের দিকে। নদী উজানে বইতে থাকবে। মৃত মানুষেরা বেঁচে উঠবে, যারা এখন বেঁচে আছে তারা ছোট হতে হতে মায়ের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। ঠিক যেমন ফিল্ম রিওয়াইন্ড করলে হয়।”

হাবু বড় বড় চোখ করে বলে, “উরেব্বাস! তা হলে এখন উপায় কী হবে বাবা?”

“উপায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘড়ির উলটোগতি বন্ধ করা, ঠিক কবে সেই বিপরীত গতি শুরু হবে তা আমি জানি না, ঘড়ি এখন চুপ করে আছে বটে, কিন্তু যে-কোনও সময় ওই মহাযন্ত্র পিছু হাঁটতে শুরু করবে।”

“ঘড়ি কোথায় আছে বাবা? কী করে সারাতে হয়?”

পুতুল ম্লান হেসে বলে, “ঘড়ি যেখানে থাকার কথা এখন সেখানে নেই। চুরি হয়ে গিয়েছে।” “সর্বনাশ!”

“ওই ঘড়ির মধ্যে ঠিক আমার মতোই একটা পুতুল রয়েছে। ওই ঘড়ির প্রাণশক্তি হচ্ছে ওই পুতুল। দেড়শো বছর ধরে শক্তির জোগান দিয়ে এখন পুতুলটার দম ফুরিয়ে গিয়েছে। যদি ঠিক এই সময়ে তাকে ঘড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা না যায় তা হলে নিজেকে রিচার্জ করার জন্য সে সময়কে উলটে দেবে। তাই নিয়ম হল, দেড়শো বছর পর-পর পুরনো পুতুলের বদলে নতুন পুতুল বসিয়ে দিতে হয়। আমিই সেই নতুন পুতুল, পুরনো পুতুলের জায়গা নিতে এসেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার পা ভেঙে দিয়েছে। আমার সিস্টেম নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি আর পুরনো পুতুলটার জায়গা নিতে পারব না।”

“তা হলে কী করতে হবে বাবা?”

পুতুলটা ম্লান হেসে বলল, “যন্ত্রবিদ, ঘড়িটা খুঁজে বের করো, পুতুলটাকে সরিয়ে ফেলো। নইলে সর্বনাশ।”

এটুকু বলেই পুতুলটা যেন ক্লান্ত হয়ে চোখ বুজল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।

এতক্ষণ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে সব শুনছিল গুণময় ঘোষ। এবার হাবুর দিকে চেয়ে বলল, “কিছু বুঝলেন?”

হাবু শুকনো মুখে বলে, “মাথাটা সব গুলিয়ে যাচ্ছে কর্তা। স্বপন দেখছি কিনা বুঝতে পারছি না।”

“আমারও তাই মনে হচ্ছে ওস্তাদ। কিন্তু যদি স্বপন না হয় তা হলে তো বড় ফ্যাসাদ হবে মশাই। পশ্চিমে সূর্যোদয়, উলটোবাগে হাঁটা, মরা মানুষের জ্যান্ত হওয়া, এসব না-হয় ধরছি না, কিন্তু কী ঘেন্নার কথা বলুন তো খাওয়া জিনিস উগরে ফেলতে হবে, ফেলে দেওয়া থুথু ফের মুখে ফেরত আসবে, মলমূত্রাদি যা ত্যাগ করা হয়েছে, তাও ফেরত নিতে হবে। সেটা বেজায় অরাজকতা হবে মশাই!”

“তাই তো মনে হচ্ছে কর্তা!”

“তা হলে এক্ষুনি ঘড়ি খুঁজতে বেরিয়ে পড়া দরকার। ঠিক কিনা?”

“বটেই তো!”

এ কথা ঠিক বটে যে, এক সময়ে এক আঁটি শাক আর এক মন লোহার মধ্যে ভজনলাল বিশেষ তফাত টের পেত না। দেড়মনি চালের বস্তা পিঠে ফেলে দিব্যি গুনগুন করে কেত্তন গাইতে গাইতে বা শিস দিতে দিতে দেড়-দুই ক্রোশ হেঁটে মেরে দিত। এখনও যে পারে না তা নয় কিন্তু বয়সও তো আর বটতলার চাতালে গামছা পেতে ঘুমোচ্ছে না। বয়স বাড়ছে। বেশ বাড়ছে। আর সেটা আজকাল খেতে বসে তিনবারের বার ভাত নেওয়ার সময় টের পায়। প্রায়ই মনে হয়, তিনবারেরটা না নিলেও হত। দুশো ডন, তিনশো বৈঠক, আড়াইশো বার মুগুর ঘোরানো, এসবই এখনও চালিয়ে যাচ্ছে সে, কিন্তু এটাও টের পাচ্ছে যে, কখনও জানলা দিয়ে, কখনও ঘুলঘুলি দিয়ে, কখনও দরজার আড়াল থেকে বয়সও উঁকিঝুঁকি মারছে, যেন বলতে চাইছে, ‘ওহে বাপু, এত কেরদানি আর ক’দিন?’ এই যে কাঁধের উপর গন্ধমাদন ঘড়িটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে, এর ওজন মনদেড়েক হবে বোধ হয়। তা সে এমন একটা বেশি কিছু ওজন নয়। একসময়ে হেসেখেলে টেনেছে সে। এখনও পারছে বটে, কিন্তু সেরকম হেসেখেলে পারছে না। মাঝে মাঝে একটু যেন হাঁফ ধরছে, গায়ে ঘাম হচ্ছে। এসবই বয়সের লক্ষণ।

পিরের দরগার কাছাকাছি হঠাৎ অন্ধকারে একটা ভুঁইফোঁড় লোক সামনে উদয় হয়ে ফ্যাক করে হেসে বলল, “কততে রফা হল বাপু?”

ভজন খ্যাঁক করে উঠল, “সে খবরে তোমার দরকার কী?”

“আমরা পাঁচশো টাকা দর দিয়েছিলুম, রাজি হয়নি। তোমার সঙ্গে কততে রফা হল?”

“হয়েছে কিছু একটা দরে।”

“কততে ছাড়বে?”

“তার মানে?”

“আহা, আমরাও তো এসব করেই খাই। ও জগদ্দল তো তুমি আর বাড়ি নিয়ে যাবে না। আমাদের সঙ্গে রফায় এলে ঠকবে না।”

“না হে বাপু, খদ্দের ঠিক হয়ে আছে।”

“ভেবে দেখো হে বাপু, আমরা দর খারাপ দেব না।”

“না হে, উপায় নেই, কেটে পড়ো।”

দোলমঞ্চ ছাড়িয়ে একটা গাছতলায় দাঁড়াতে হল ভজনকে। বেশ হাঁফ ধরেছে তার। গামছা দিয়ে কপাল আর ঘাড়ের ঘাম মুছল সে। চারদিকটা চেয়ে দেখে নিল। যদিও ব্যাপারটা ঠিক চুরি বলে গণ্য হওয়ার নয়, কারণ সে গিন্নিমার হুকুমেই ঘড়িটা সারাবে বলে বের করে এনেছে, তবু বলা তো যায় না, ঘড়িটার উপর অনেকেরই নজর আছে বলে শুনেছে সে।

গামছা ঘুরিয়ে মুখে একটু হাওয়া দিচ্ছিল ভজন, এমন সময় হঠাৎ একটা কাতরানির শব্দ কানে এল। কে যেন ‘উঃ আঃ’ জাতীয় শব্দ করছে। ভজন চারদিকটা ভাল করে দেখল। কেউ কোথাও নেই কিন্তু ঘড়িটার কাছে এসে দাঁড়াতেই আবার সেই শব্দ। একটা অদ্ভুত খটমটে ভাষায় কে যেন কীসব বলে যাচ্ছে। কেউ কি মন্তরটন্তর পড়ছে নাকি? কিন্তু কেউ ধারে-কাছে আছে বলে মনে হচ্ছে না!

তবুও চারদিক আরও একবার আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখল ভজন। তারপর হঠাৎ খেয়াল করল, শব্দটা আসছে ঘড়ির ভিতর থেকে।

ভজন হাঁ হয়ে গেল। ঘড়ির ভিতর কি কোনও মানুষকে পুরে রাখা হয়েছে?

সর্বনাশ! ভিতরে মানুষ থাকলে তো ঘোর বিপদ! যদি দমবন্ধ হয়ে মরে যায় তা হলে তো তাকেই খুনের দায়ে পড়তে হবে! সে লোক ভাল নয় বটে, কিন্তু খুনখারাপি তার ধাতে নেই। সে ঘড়িটার গায়ে কান লাগিয়ে শুনতে পেল, হ্যাঁ সত্যিই বটে ঘড়ির ভিতরে খুব ক্ষীণ মরা গলায় কে যেন কথাবার্তা কইছে। কিন্তু কথাগুলো বুঝবার উপায় নেই। তামিল, তেলেগু যদি নাও হয় তবে চিন বা জাপানের ভাষা হবে। সে ঘড়ির গায়ে টোকা দিয়ে বলল, “ও মশাই, শুনতে পাচ্ছেন?”

কেউ কোনও জবাব দিল না। কিন্তু কথাবার্তা চলতেই থাকল।

“আরে, ও মশাই, ভিতরে যে ভেপসে দমবন্ধ হয়ে মারা পড়বেন! বেরোনোর কোনও ফাঁকফোকর নেই? তা হলে বেরিয়ে আসুন না! এমন সরু জায়গায় ঢুকতে আছে?”

হঠাৎ ভিতর থেকে পরিষ্কার বাংলা ভাষায় জবাব এল, “বিরক্ত কোরো না। আমি কাজ করছি।”

শুনে ভজনলাল তাজ্জব। তা হলে ঘড়ি সারাতে কোথাও মিস্তিরি এসে ঘড়ির মধ্যে ঢুকে সারাইয়ের কাজ করছে নাকি? আর সে কিনা না-বুঝেসুঝে ভিতরে একটা জ্যান্ত মিস্তিরি সমেত ঘড়িটা নিয়ে পালিয়ে এল? সেইজন্য বোধ হয় ঘড়িটা এত ভারী ভারী লাগছিল। এঃ, এ তো বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে! ঘড়ি থেকে একটা আস্ত মিস্তিরি বেরিয়ে এলে কাতুবাবুই কি খুশি হবেন? চাই কি চুক্তির বাকি টাকাটা আটকেও দিতে পারেন।

সে ঘড়ির গায়ে ঘনঘন টোকা দিয়ে বললে, “ও মিস্তিরিমশাই। বলি ও মিস্তিরিসাহেব।”

ভিতর থেকে গম্ভীর গলায় জবাব এল, “একটু পরেই সময়ের গতি উলটে যাবে। বিরক্ত কোরো না। আমি ব্যস্ত রয়েছি।”

কথাগুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না ভজনলাল। হাবভাবে বুঝতে পারছে, মিস্তিরিটার বেরিয়ে আসার ইচ্ছে নেই। তা বলে ভজন তো আর বসে থাকতে পারে না। যা থাকে কপালে, মিস্তিরিসমেত ঘড়ি ঘাড়ে করেই তাকে কাতুবাবুর কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

ভজন সুতরাং মনে মনে মিস্তিরিটার মুন্ডুপাত করতে করতে ঘড়িটা ফের কাঁধে তুলল। তারপর বটেশ্বরের মন্দিরের দিকে হাঁটা দিল।

পিছন থেকে জোরকদমে কেউ একটা আসছে সেটা টের পেল ভজন। কিন্তু পিছু ফিরে দেখার উপায় নেই। সে তখন হনুমানের মতো কাঁধে গন্ধমাদন নিয়ে চলেছে। পিছনের লোকটা প্রায় পাশাপাশি চলে এসেছে।

“ও মশাই?”

ভজন আড়চোখে দেখার চেষ্টা করল। একটা বড়সড় চেহারার ছোকরা। ভজন বলল, “কী চাই?”

“এতবড় জিনিসটা ঘাড়ে করে বয়ে নিতে আপনার যে কষ্ট হচ্ছে!”

“তা আর কী করা?”

“আহা, দিন না, আমি খানিকদূর বয়ে দিই।”

“তুমি কে হে বাপু! জানা নেই, চেনা নেই, হঠাৎ দরদ দেখাতে এসে উদয় হয়েছ!”

“পরের উপকার করাটা আমার একটা নেশা, বুঝলেন!”

“উপকার করতে চাও বুঝি! বেশ কথা, আমার এখন সবচেয়ে বেশি উপকার হবে যদি তুমি কেটে পড়ো।”

লোকটা ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলে, “তা বললে কি চলে? দেখতে পাচ্ছি আপনি হাঁফসে পড়েছেন, কপালে ঘাম হচ্ছে! না মশাই এ কাজটা আপনার ঠিক হচ্ছে না।”

ফস করে কোথা থেকে আর-একটা রোগাভোগা বেঁটেমতো মানুষ ভজনের ডানপাশে উদয় হয়ে বলে, “আহা, এতে লজ্জার কী আছে মশাই, কথায় আছে ‘দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’। আগ বাড়িয়ে কেউ যদি আপনার বোঝাটা টেনে নিয়ে যেতে চায় তা হলে সংকোচ করার কী আছে? না হয় মজুরি হিসেবে দুটো টাকাই ফেলে দেবেন!”

এ কথায় বাঁদিকের লোকটা একটু রাগের গলায় বলল, “আপনার নজর বড্ড নিচু পটলবাবু, দু’টাকায় আজকাল কী হয় বলুন তো? একগাল মুড়িও দু’টাকায় কিনতে পারবেন না। অন্তত কুড়িটা টাকা না হলে…, “”

ডানদিকের জন ঠান্ডা গলায় বলে, “দেখ গজা, তোর বড্ড লোভ। পরের উপকার করতে বেরিয়ে মজুরি চাইছিস। তোর লজ্জা করল না? উপকার কি বিক্রির জিনিস রে? তা ছাড়া লালসাহেব টাকা কি কিছু কম দিচ্ছে?”

গজা বলল, “তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু দু’টাকা দরটা আমার পক্ষে অপমানের ব্যাপার হল না? শুধু আপনিই আমার দাম দিলেন না পটলবাবু!”

ভজনলাল বুঝতে পারল, এদের মতলব খারাপ। সে পালোয়ান লোক, এদের পাল্লা নিতে তার কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু মুশকিল হল, একটা গন্ধমাদন ঘড়ি এতটা টেনে আনার ফলে সে বড্ড হাঁফসে পড়েছে, শুধু ঘড়ি হলে এক কথা। ঘড়ির মধ্যে একজন আখাম্বা মিস্তিরিও সেঁধিয়ে রয়েছে। ফলে এই হা-ক্লান্ত শরীরে হাঙ্গামা-হুজ্জুতে যাওয়া কি ঠিক হবে? কিন্তু উপায়ও নেই। এদের ঢিট করতে না পারলে জিনিসটা রক্ষে হবে না। আর কয়েক পা হাঁটলেই ডানদিকে বটেশ্বরবাবার মন্দিরের চুড়ো চোখে পড়বে। এসেই গিয়েছে প্রায়। তীরে এসে তরী ডুবলে বড় আফসোসের কথা হবে। সে তাই হাঁটা থামিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “ঠিকই বলেছ বাপু, মালটা এতটা বয়ে এনে আমার দম একটু ফুরিয়েছে বটে।” এই বলে ঘড়িটা নামিয়ে সে রাস্তার পাশে একটা গাছে ঠেসান দিয়ে দাঁড় করাল।

গজা ভারী খুশির গলায় বলল, “আজ সারাটা দিন কারও উপকার করতে পারিনি বলে বড্ড লাতন হয়ে পড়েছিলাম মশাই। উপকার করতে না পারলে আমার ঘুম হয় না, অরুচি হতে লাগে, রসগোল্লা মুখে দিলেও মনে হয় নিম-বেগুন খাচ্ছি। যাক বাবা সারাদিনের পর এই প্রথম একটা উপকার করার সুযোগ পেলাম।”

পটল বলল, “উপকার বলতে উপকার! ভদ্রলোক কেমন হয়রান হয়ে পড়েছেন দেখছিস না! মুখখানা দেখলে পাষণ্ডেরও মায়া হবে।”

“তা আর বলতে! তবে দুঃখের কথা কী জানেন পটলবাবু, আমাদের যে দয়ার শরীর তা মানুষ কেন যেন বুঝতে চায় না।”

ভজনলালের কিল এক সময়ে খুবই বিখ্যাত ছিল। এক কিলে ঝুনো নারকেল ফট। থান ইট দু’-আধখানা। পাথরে পাঁচ কিল তো পাথর পাঁচ টুকরো। তা বয়সকালে এখন কিলের সেই জোর কি আর আছে?

অত জোর না থাকলেও, গজা যখন ঘড়িটা তুলবে বলে ঝুঁকেছে, তখনই মাথার উপর কিলটা বসাল ভজন। বসিয়েই দেখল, না এখনও তার কিলে বেশ কাজ হচ্ছে। গজা “বাপ রে” বলে একটা

ডাক ছেড়ে একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে চিতপাত হল। আর তাই দেখে পটল এত অবাক যে বাক্যহারা হয়ে চেয়ে ছিল গজার দিকে। তাই রদ্দাটা তেমন খেয়াল করেনি। কিন্তু যখন খেয়াল হল, তখন তারও কিছু করার ছিল না। ভজনের রদ্দাটা খেয়ে একেবারে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ল।

ভজন আর দেরি করল না। এরপর আবার কোন ব্যাটা এসে দাঁত কেলিয়ে সামনে দাঁড়ায় তার ঠিক কী? সে ঘড়িখানা কাঁধে ফেলে পড়ি কি মরি করে এক রকম দৌড়তেই লাগল।

হঠাৎ অন্ধকার থেকে একটা সিড়িঙ্গে চেহারার ল্যাকপ্যাকে লোক তার পাশে দৌড়তে দৌড়তে হেঁকে বলল, “সামলে! সামলে! করো কী হে? অমন হুড়োহুড়ি করতে হয়? পড়ে গিয়ে যদি ঘড়িটায় চোট হয় তা হলে কি দানুবাবু আমাকে আস্ত রাখবেন? বড় দামি জিনিস হে!”

ভজন ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, “তুমি আবার কে বাপু?”

“আমি হলুম চরণদাস। দানুবাবুর আড়কাঠি, বুঝলে? এবার একটু হুঁশিয়ার হয়ে এসো বাপু। এই যে আমি পথ দেখাচ্ছি। ডানধারে ওই যে নাবাল এখেনে সাবধানে পা ফেলো হে। তুমি-আমি পড়ে মাজা ভাঙলে তো ক্ষতি নেই, কিন্তু দানুবাবুর জিনিসে চোট হলে সর্বনাশ।”

এসব কী হচ্ছে তা ভজন ভাল বুঝতে পারছিল না। বটেশ্বরবাবার ভাঙা মন্দিরের সামনে ফাঁকা মাঠটায় পা দিতে না-দিতেই সামনে থেকে কে যেন কাকে বলল, “হ্যাঁরে খাঁদু, ঘড়িটা কি নিজেই ইদিকে হেঁটে আসছে?”

জবাবে কে যেন বলল, “আরে না, একজন বয়ে আনছে। আমাদের আর মেহনত করতে হল না। নীলকান্তবাবু বড্ড খুশি হবেন ঘড়িটা পেলে। চ, কাজে নেমে পড়া যাক।”

এখানে গাছগাছালির অভাব নেই। ভজন ঘড়িটা ফের একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে গামছায় মুখের আর ঘাড়ের ঘাম মুছল। পরিস্থিতিটা ভাল করে বুঝতে হলে একটু দম নেওয়া দরকার।

চরণদাস বলল, “তোমার বড্ড খাটুনি হল ভায়া। তা আর চিন্তা নেই। এবার তুমি বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে একটু জিরিয়ে নিয়ে চা-মুড়ি খেতে পারো। বাকি কাজটা দানুবাবুর লোকেরাই করবে। তারা এল বলে।”

চরণদাসকে কিল মারা ঠিক হবে না। রোগাভোগা মানুষ। ভজনের কিল খেলে অক্কা পেতে পারে। তাই ভজন তাকে হালকা ওজনের একটা থাবড়া মারার জন্য হাতটা তুলেছিল। কিন্তু থাবড়াটা বসানোর আগেই কে একটা লোক একহাতে টর্চ আর অন্যহাতে একটা লাঠি নিয়ে তারস্বরে “চোর! চোর!” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ধেয়ে এল।

আবছা অন্ধকারেও লোকটাকে চিনতে ভুল হল না ভজনের। এ হল মহীধর চৌধুরীমশাই। কিন্তু কাজটা কি ন্যায্য হচ্ছে চৌধুরী মশাইয়ের? সে তো ঘড়িটা সারাবে বলে গিন্নিমার হুকুমেই জিনিসটা সরিয়েছে। চুরি বলে তো এখনও সাব্যস্ত হয়নি!

টর্চের জোরালো আলোটা ভজনলালের মুখে পড়তেই মহীধর লাফিয়ে উঠে, “এই যে চোর! এই যে চোর!” বলে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসতেই ভজনলাল টক করে লাঠিটা ধরে ফেলে বলল, “কর্তামশাই, মানহানির মামলায় পড়ে যাবেন যে! সাক্ষীসাবুদের সামনে সর্বসমক্ষে কাউকে চোর বললে দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে।”

মহীধরবাবু ফুঁসে উঠে বললেন, “তুমি চোর নও? আমার ঘড়িটা তুমি চুরি করোনি?”

“চুরি! বলেন কী মশাই! আপনার বাড়ির লক্ষ্মীমন্ত মাঠান স্বয়ং সাক্ষী দেবেন যে, তিনিই আমাকে ঘড়িটা মেরামত করার ভার দিয়ে পাঠিয়েছেন। না জেনে, বিনা সাক্ষ্যপ্রমাণে কাউকে চোর বলা যে সাংঘাতিক অপরাধ! সামান্য একটা ভুলে যে আপনার দশ-দশ লাখ টাকা খসে গেল মশাই।”

মহীধর একটু থতমত খেয়ে গেলেন। কথাবার্তার ফাঁকেই বেশ একটা ভিড় জমে গেল চারপাশে। দানুবাবুর দলবল, খাঁদুর দলবল, পটল, গনশা আর গজা, চরণদাস। তাদের দিকে চেয়ে মহীধর কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “দেখুন, এই দেওয়ালঘড়িটা আমার। এই লোকটা…”

হঠাৎ চারদিক থেকে নানা কণ্ঠে প্রতিবাদ শোনা যেতে লাগল, “কে বলেছে এ ঘড়ি আপনার? এ হল লালসাহেবের ঘড়ি।”

মুখ সামলে! মুখ সামলে! এ ঘড়ির মালিক এখন দানুবাবু। আর কেউ নয়।” …

“…বললেই হল? এ ঘড়ি এখান থেকে সোজা নীলকান্তবাবুর বাড়ি যাবে। ফালতু লোক যে ক’টা জুটেছ, তারা মানে-মানে কেটে পড়ো।”

এইভাবে একটা বিশাল ঝগড়া আর চেঁচামেচি শুরু হল। একটু বাদেই মুখের জায়গা নিল হাত। তারপরই মাঠ জুড়ে তুমুল মারপিট লেগে গেল। অন্ধকারে ভাল করে বোঝা যাচ্ছিল না কে কার মাথার চুল উপড়ে নিচ্ছে, কে কার নাকে আঙুল ঢুকিয়ে নাক ছিঁড়ে ফেলছে, কার ঘুসিতে কার দাঁত খসে পড়ে গেল, কার লাথিতে কার কোমর ভাঙল, কে কার কান কামড়ে দিল, কার নখের আঁচড়ে কার গাল ফালাফালা হয়ে গেল। শুধু শোনা যেতে লাগল, “মেরে পুঁতে ফেল…মুন্ডু উড়িয়ে দেব…মার শালাকে…গলা টিপে শেষ করে দে ওটাকে…আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন…”

যত দূর জানা যায় গুণময় ঘোষের মৃগী রোগ নেই এবং সে যখন-তখন ভিরমিও খায় না। তবু যে আজ সন্ধের মুখে গুণময় মূর্ছা গেল তার গভীর কারণ আছে।

ব্যাপারটা হল, হাবু ভুঁইমালি আর গুণময় ঘোষ, দু’জনে পৃথিবীর সময়ের উলটো গতি নিবারণের জন্য তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে, দু’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নেমে হঠাৎ গুণময় ঘোষ হাবুর ডান হাতটা চেপে ধরে বলল, “কিছু বুঝতে পারছেন?”

হাবু অবাক হয়ে বলে, “কী বুঝব মশাই?”

“আমি যা দেখছি আপনিও কি তাই দেখছেন?”

“আজ্ঞে কী দেখার কথা বলছেন?”

“তা হলে কি আমি ভুল দেখছি! না ভূত দেখছি?

মাথা চুলকে হাবু বলে, “এ তো বড্ড গণ্ডগোলের কথা!”

“ওই যে…ওই যে…লেবু গাছটার আড়ালে…”

হাবুও এবার দেখতে পেল। বাঁদিকে লেবু ঝোপটার আড়াল থেকে একটা মুন্ডুর মতো কিছু বেরিয়ে আছে। কিন্তু কীসের বা কার মুন্ডু তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আলো ঝুঁঝকো হয়ে এসেছে। তাই স্পষ্ট কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে হলদে রঙের একটা বেশ বড়সড় মুন্ডু, তাতে দুটো পেল্লায় গোল-গোল চোখ, ন্যাড়া মাথায় খাড়া খাড়া সজারুর কাঁটার মতো চুল।

গুণময় ঘোষ প্রথমে বলল, “বাপরে!” তারপর বলল, “আঁ-আঁ-আঁ-আঁ” তারপরেই ধড়াম করে চোখ উলটে মাটিতে পড়ে গেল।

হাবু ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করে। ভূত সম্পর্কে তার বেশ আগ্রহই আছে। এই যেমন মানুষও আসলে একটা যন্ত্র। গাছপালা পশুপাখিও তেমনই নানা রকম যন্ত্র, কিন্তু ভূত কী বস্তুতে তৈরি, তা এখনও জানা হয়নি। ভূতও কি যন্ত্র, নাকি অন্য কিছু?

আস্ত একটা ভূত দেখে হাবু তাই এক পা এগিয়ে গিয়ে হাতজোড় করে বলল, “পেন্নাম হই কর্তা।”

গাছের আড়াল থেকে লিকলিকে রোগা, কাঠিসার চেহারার ভূতটা বেরিয়ে এগিয়ে এল। হাবুর বুকটা একটু ধড়ফড় করছিল বটে, তবে সে মূর্ছা গেল না। ভূতটা এগিয়ে এসে ডান হাতটা বাড়িয়ে হাবুর বাঁ কবজিটা সাঁড়াশির মতো জোরে চেপে ধরল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, “যন্ত্রবিদ, ভয় পেয়ো না। আমি তোমার মতোই একজন। তবে মানুষ নই। মানুষের চেয়ে ঢের বুদ্ধিমান এক প্রাণী। আমি অজর।”

হাবু কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে খানিকটা হাওয়া গিলে বলল, “আজ্ঞা করুন।”

“যন্ত্রবিদ, তুমি যে খুব জ্ঞানী মানুষ নও, তা আমরা জানি। তুমি যে কাজটা করতে চলেছ তা কঠিন। বিদ্যা দিয়ে বা বুদ্ধি দিয়ে কাজটা করা সম্ভব নয়। তবে তোমার একটা বিরল গুণ আছে। তা হল ভালবাসা। তুমি সব কিছুকেই ভালবাসো। পশুপাখি, জীবজন্তু, এমনকী যন্ত্রকেও। আমাদের পুতুল তাই তোমাকে কাজটার ভার দিয়েছে। বিদ্যা বা বুদ্ধি দিয়ে নয়, ভালবেসে যদি করো তা হলে যন্ত্রও তার প্রতিদান দেবে। আমার সঙ্গে এসো। আমি তোমাকে সেই মহাযন্ত্রের কাছে নিয়ে যাব।”

“আমি কি পারব অজরকর্তা? আমি যে সামান্য মিস্তিরি।”

“মনকে অস্তির দিকে রাখো। না পারলে ময় পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে।”

“ময়! ময় কে কর্তা?”

“ময় এক মহাবিদ্যাধর। সময়কে উলটোগতিতে চালালে কী হয় সেটাই তার গবেষণার বিষয়। সে ওই মহাযন্ত্রটি দখল করতে চায়। সে দেখতে চায় পৃথিবীর সময় উলটে দিলে কী-কী হয় বা হতে পারে। তারপর সেই কুৎকৗশল সে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের উপর প্রয়োগ করবে। সে উলটোগতিতে গিয়ে সৃষ্টির আদিবিন্দুতে উপস্থিত হতে চাইছে। সে ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। তাই তোমাদের এই সামান্য একটি গ্রহকে তছনছ করে দিতে তার কোনও অনুকম্পাও নেই। তাই নানা কৌশলে সে ওই মহাযন্ত্রটি কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছে। সে অনেকটাই সফল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবীর সময়ের প্রবাহ বিপরীতমুখী হয়ে যাবে। এসো যন্ত্রবিদ, তোমার ভিতরে যত ভালবাসা আছে সব উজাড় করে দাও।”

“আজ্ঞে আমি তো শুধু সেটুকুই পারি অজর কর্তা। সেটুকুই পারি।”

দুর্ভোগে না পড়লে মানুষ কি কিছু শেখে, না কিছু জানে? বিপদ আপদই তো মানুষকে শিখিয়েছে কী করে বিপদ টপকাতে হয়। আর ওইভাবেই তো মানুষ বানাল নৌকা, জাহাজ, কলের গাড়ি, এরোপ্লেন। কত যন্ত্র বানিয়ে ফেলল মাথা খাটিয়ে। পশুপাখিরা দৈবের উপর বেঁচে থাকে বটে, মানুষ তো নয়। আর এই যে অজর কর্তা, ইনিও মানুষই বটে। তবে এগিয়ে যাওয়া মানুষই হবেন বোধ হয়। নইলে তাঁর হাত ধরে বনবাদাড়, আঘাটা ভেঙে লহমায় তাঁকে এনে বটেশ্বরের মন্দিরের মাঠে হাজির করতেন না।

“কিন্তু এ কী? চারদিকে যে মেলা লাশ পড়ে রয়েছে!”

“যন্ত্রবিদ, আতঙ্কিত হয়ো না। এরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে জখম হয়ে পড়ে আছে। ময় এক ধুরন্ধর মস্তিষ্কের আধার। সে-ই নানা রকম লোভের টোপ ফেলে এদের ঘড়িটা দখল করতে নিয়োগ করেছিল। এসো, আর বেশি সময় নেই।”

“কিন্তু অজর বাবা, এখানে যে আলো নেই!”

“আলোর অভাব হবে না।”

ঘড়িটা একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে। হাবু খুব করে ঘড়িটাকে জড়িয়ে ধরে খুব সাবধানে উপুড় করে ঘাসের উপর শুইয়ে দিল। অজরের হাতের একটা ছোট্ট যন্ত্র থেকে হঠাৎ বিচ্ছুরিত হল তীব্র আলো। উবু হয়ে বসে ঘড়ির পিছনের ঢাকনাটা ভাল করে দেখল হাবু। কোমরে বাঁধা থলি থেকে সে যন্ত্রপাতি বের করল। প্যানেলটায় কোনও স্ক্রু নেই, রিপিট নেই।

অজর পিছন থেকে বলল, “ম্যাগনেট।”

থলি থেকে চুম্বকের ভারী চাকতিটা বের করে লাগাতেই সেটা সেঁটে গেল৷ চাপ দিতেই অনায়াসে খুলে এল ঢাকনাটা। সে পিছু ফিরে অজরের দিকে চেয়ে বলল, “অজর বাবা, আপনি তো অনেক জানেন। তাও আমার মতো সামান্য মিস্তিরিকে দিয়ে এ কাজ করাচ্ছেন কেন?”

“যন্ত্রবিদ, আমরা সময়ের অনুবর্তী নই। সময় আমাদের উপর কোনও ক্রিয়া করে না। সেইজন্যই আমরা অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারি। কিন্তু আমরা অতীত বা ভবিষ্যতের কোনও ঘটনার অংশীদার হতে পারি না। ধরো, যদি আমি এখন একটা ঢেলা তুলে ছুড়ে মারি তা হলেও কার্যকারণ পরম্পরায় এই ছোট্ট অর্থহীন ঘটনার ফলে ভবিষ্যতে এক বিরাট অঘটন ঘটে যেতে পারে। কেননা, কারণ-শৃঙ্খল অনন্ত। একটা ছোট্ট তাৎপর্যহীন ঘটনাও অনেক সময় বিশাল বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে। তাই আমি কোনও ঘটনার অংশীদার হতে পারি না। বুঝতে পারছ?”

“এসব বড় উঁচু কথা বাবা। আমার বুঝবার কথা নয়। তবু কীভাবে জানি আমি একটু-একটু বুঝতে পারছি।”

ঘড়ির ভিতরে উঁকি দিয়ে হাবুর চক্ষু চড়কগাছ। এ তো মোটেই কোনও ঘড়ির যন্ত্র নয়। নানান সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা যেন একটা মাকড়সার জাল। আর এতটাই জটিল যে মাথামুন্ডু বুঝবার উপায় নেই।

“যন্ত্রবিদ, মাথা খাটাতে যেয়ো না। তুমি যন্ত্রের সঙ্গে যেমন রোজ কথা বলো, তেমনই এই মহাযন্ত্রের সঙ্গেও কথা বলতে থাকো। মহাযন্ত্রই তোমাকে পথ দেখাবে, উপায় বলে দেবে।”

আবেগে হাবুর চোখে জল এল। চোখ মুছে সে হাতজোড় করে ঘড়িকে বলল, “ঘড়িবাবা, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, বিজ্ঞান জানি না। ভুলচুক যেন ঘটে না যায় বাবা দেখো।”

খুব সাবধানে ঘড়ির অভ্যন্তরে উঁকি দিল হাবু ভুঁইমালি। আর উঁকি দিয়েই আশ্চর্য হয়ে গেল। ভিতরে যেন এই ব্রহ্মাণ্ডেরই ছায়া। আকাশ দেখতে পাচ্ছে সে। থরে থরে আঙুর ফলের মতো ঝুলে আছে নক্ষত্রপুঞ্জ। বিশাল সড়কের মতো ছায়াপথ। পাক খাওয়া স্প্রিংয়ের মতো নীহারিকা। ঘূর্ণিঝড়ের মতো বৃত্তাকার নক্ষত্রের আশ্চর্য সংসার। ঘড়ির এই আশ্চর্য অভ্যন্তর যেন তাকে ভিতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মহাযন্ত্র তার উপর সদয় হয়েছে। তাকে দয়া করেছে। জন্মের শোধ ব্রহ্মাণ্ডকে পাপচোখে প্রত্যক্ষ করেছে সে। আহা, কী বাহার! কী আশ্চর্য ওই আলো অন্ধকারের সংসার! গভীর-গভীর অভ্যন্তরে হঠাৎ কে যেন গম্ভীর গলায় বলল, “আমাকে বিরক্ত কোরো না। আমি সময়ের গতি বিপরীতমুখে ঘুরিয়ে দিচ্ছি। আমার এখন কোনও সময় নেই।”

হাবু কাতর ভাবেই বলে, “বেঁধে বাবা বেঁধে। একটু দয়া করো বাবা, আমরা নশ্বর মানুষ। বড় আলটপকা আমরা ফুরিয়ে যাই। আমাদের এই সামান্য জীবন, যৎসামান্য আয়ুটুকু নিয়ে নেবে কেন? ভিক্ষা দাও বাবা, ভিক্ষা দাও।”

পুতুলটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল সে। যেন নিরালম্ব একজন মানুষ আকাশের অন্ধকার মাঝমধ্যিখানে দু’হাত ছড়িয়ে ঝুলে আছে। পুতুল বলছে, “এ বড় ভীষণ সময়! এ বড় ভয়ংকর সময়! আমাকে বিরক্ত কোরো না কেউ। সময়ের গতি উলটে গিয়েছে। টের পাচ্ছ না? তোমার চারদিকে একবার চেয়ে দেখো!”

স্বপ্নোখিতের মতো মাথা তুলে হাবু অবাক হয়ে দেখল, মাটিতে পড়ে থাকা লোকগুলো আবার চটপট উঠে দাঁড়িয়েছে আর তাদের মধ্যে ধুন্ধুমার মারপিট হচ্ছে… “মার শালাকে…লাশ ফেলে দে…গলা টিপে ধর…আজ তোর একদিন কি আমারই একদিন… মারপিট হতে হতে হঠাৎ লোকগুলো পিছু হটে হটে কে কোথায় চলে গেল যেন।

হাবু আবার ঘড়ির মধ্যে ডুব দিল।

পুতুলটা তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “কী চাও? সময়ের অলঙ্ঘ্য আদেশ কি অমান্য করবে তুমি?”

“না বাবা, আমি অত বড় মানুষ নই। শুধু বলি, তুমি তো শুধু যন্ত্র নও। তোমার যে প্রাণ আছে। আর প্রাণের যে বড় মায়া! কেন সময় উলটে দেবে বাবা? সময় তো ভগবানের লীলা। তাকে কি উলটে দিতে হয়? এসো বাবা, আমার কাছে চলে এসো। এই যে আমার আঙুল ধরো বাবা।”

“যন্ত্রবিদ, চোখ তুলে দেখো। এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পাবে। পশ্চিমে সূর্যোদয়। দেখো, ভাল করে দেখে নাও।”

হাবু মুখ তুলে স্তম্ভিত হয়ে দেখল, সত্যিই যে সূৰ্য অন্তত দু’ঘণ্টা আগে পাটে বসেছে, সে ওই দিগন্তে হোলির রং মেখে ফের উঠে এসেছে। পৃথিবী পিছিয়ে যাচ্ছে, সময় উলটে গিয়েছে।

হাবুর চোখ দিয়ে দরদর ধারে জল পড়ছিল। সে আবার ঘড়ির মধ্যে ডুব দিয়ে বলল, “সংবরণ করো বাবা, সংবরণ করো। আমি তুচ্ছ মানুষ বটে, কিন্তু আমি যে তোমাকে বড় ভালবেসে ফেলেছি বাবা। তোমার কত ক্ষমতা! কত শক্তি! তোমাকে নমস্কার করি! আমার এই আঙুল তুমি ধরবে না বাবা?”

“আমার আর শক্তি নেই, দম নেই। হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য আমাকে উলটোগতিতে চলতে হচ্ছে। উপায় নেই।” “আছে বাবা, আছে। হাবু ভুঁইমালি ভালবাসা দিয়ে তোমার ক্ষমতা ফিরিয়ে আনবে।”

পুতুল একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে বলল, “ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। যা ঘটছে তা ঘটতে দাও। বাধা দিয়ো না।”

হাবু কান্নাভেজা গলায় বলে, “ও কথা বলতে নেই বাবা। উলটোগতি কখনওই ভাল নয়। উঠে এসো। ওই চক্করের বাইরে এসে দুনিয়াটাকে একবার দেখো। পাখি দেখো, ফুল দেখো। মেঘের উড়ে যাওয়া দেখবে না? বৃষ্টির কদম ফুল! আমাদের গাঁয়ের নদীর ধারে বসে জলের বয়ে যাওয়া দেখবে বাবা? এই আঙুল ধরো বাবা। উঠে এসো।”

যন্ত্রের জটিল ধাঁধা থেকে অতি সাবধানে পুতুলটাকে তুলে আনতে পারল হাবু। মুখে শিশুর মতো হাসি।

“অজর বাবা এই যে আপনার পুতুল।”

“তুমি ওকে অনেক মিথ্যে স্তোক দিয়েছ যন্ত্রবিদ। পাখি, ফুল, নদী বা বৃষ্টি দেখতে হলে ওকে পৃথিবীতেই থেকে যেতে হয়।”

হাবু ভয় পেয়ে বলল, “কী করব বাবা, আমার যে ও কথাগুলোই মাথায় এল!”

অজর তার দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে বলে, “কাজটা ভাল করোনি। ও তো শুধু যন্ত্র নয়, ওর প্রাণও আছে।”

“বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা। আমাকে মাপ করে দিন।”

“তুমি একজন ভালমানুষ বলে মাপ করলাম। ওই ঘড়ির মধ্যে একটা সাধারণ দেওয়ালঘড়ির কলও রয়েছে। সেটাকে চালু করে দাও।”

“এই যে, দিই বাবা, ” বলে হাবু ঘড়ির ভিতর উঁকি দিয়ে খুঁজেপেতে কলটাকে বের করল। শক্ত কাজ কিছু নয়। দমের স্প্রিংটা চালু করে দিতেই ঘড়িটা চলতে লাগল।

হাবু ঘড়িটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে শুকনো মুখে বলল, “এবার কী হবে বাবা? পৃথিবী যে দু’ ঘণ্টা পিছিয়ে গেল। মানুষ উলটো বাগে হাঁটল। মরা মানুষ জ্যান্ত হয়ে গেল। ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু মাতৃগর্ভে ফেরত গেল, গরাসের ভাত আবার পাতে ফেরত এল, নদী উজানে বইল। এ নিয়ে দুনিয়াতে যে বড় হইহই পড়ে যাবে বাবা। কাগজে লেখালেখি হবে। দু’ঘণ্টায় দুনিয়ায় যে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে।”

“শোনো যন্ত্রবিদ, অতীতের স্মৃতি থাকে। কিন্তু ভবিষ্যতের কি কোনও স্মৃতি হয়?”

“না, তা কী করে হবে?”

“পৃথিবী দু’ঘণ্টা পিছিয়ে গিয়েছে। এখন বিকেল পাঁচটা। সন্ধে সাতটার সময় কী ঘটবে তা কি মানুষ জানে? যা এখনও ঘটেনি তার স্মৃতিও থাকা সম্ভব নয়। গত দু’ঘণ্টা এখন আগামী দু’ঘণ্টা৷ “

“কিন্তু আমি তো জানি।”

“একমাত্র তুমিই জানো। মহাযন্ত্রকে স্পর্শ করে ছিলে বলে সময় তোমার উপর কোনও কাজ করেনি। তা বলে গত দু’ ঘণ্টার কথা মানুষের কাছে গল্প করতে যেয়ো না। তা হলে সবাই তোমাকে পাগল ভাববে।”

“তা হলে কি এত সব কাণ্ড মানুষ টের পেল না?”

“তা কেন? ঘটনার সময় তারা সবই টের পেয়েছে, কিন্তু অতীতে ফেরত যাওয়ার সময় তাদের মাথা থেকে ঘটনাগুলোর সব রেশ মুছে গিয়েছে। সময়ের নিয়ম মেনেই। বুঝেছ? ঘটনাটা ঘটেছিল সাতটার সময়। কিন্তু সাতটা এখনও বাজেনি।”

“বড় কঠিন তত্ত্ব বাবা। তবে একটু একটু বুঝেছি। এখন এই ঘড়িটার কী গতি হবে বাবা?”

“ঘড়িটা তুমি স্পর্শ করে আছ। তুমি হাত সরিয়ে নিলেই ঘড়ি অদৃশ্য হয়ে যাবে। বিকেল পাঁচটায় তার যেখানে থাকার কথা ছিল, ঠিক সেখানেই চলে যাবে।”

“তা হলে যে ঘটনাগুলো এতক্ষণ ঘটছিল, তা কি আবার ঘটবে?”

“না, কারণ ঘড়িটা চালু হয়ে গেলে সম্ভবত ঘটনার গতি অন্য রকম হবে। তবে ওই ঘড়ি আর মহাযন্ত্র নয়। সাধারণ একটা দেওয়ালঘড়ি, দম দিতে হবে, মাঝে-মাঝে তেল দিতে হবে, মেরামত করতে হবে।”

“তা হলে এবার আমি কী করব বাবা? বাড়ি ফিরে যাব?” “যাও যন্ত্রবিদ।”

হাবু ভুঁইমালি একটা নমস্কার করে পিছু ফিরে হাঁটা দিল। কয়েক পা যেতেই অজর ডাকল, “শোনো যন্ত্রবিদ, পুতুলটা তোমাকে কিছু বলতে চায়।”

হাবু ফিরে দাঁড়িয়ে সবিস্ময়ে দেখল, অজরের হাতে ধরা পুতুলটা তার দিকে করুণ চোখে চেয়ে আছে। সে কাছে এগিয়ে যেতেই ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে না? পাখি, ফুল, বৃষ্টি, মেঘ আর নদী দেখাবে না আমাকে?”

হাবু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, “তা কি আর আমার ভাগ্যে হবে?”

অজর বলল, “হবে, এই নাও তোমার পুতুল। যত্ন করে রেখো।” হাবু ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, “আমাকে দেবেন বাবা? সত্যিই দেবেন?”

“তুমি একজন ভাল লোক যন্ত্রবিদ, নাও।”

তার ঘরে যে কুচুটে লোকটা অদৃশ্য হয়ে বাস করে সে আজকাল প্রায়ই গায়ে জ্বালা-ধরানো ফুট কাটে, “ওঃ, বুড়ো বয়সের আদিখ্যেতা দেখে মরে যাই। এই বয়সে কেউ বাচ্চা মেয়েদের মতো পুতুল খেলে নাকি?”

হাবু ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, “বেশ করব, পুতুল খেলব। তাতে তোমার কী হে?”

“মানুষ যে তোমাকে পাগল বলে সে তো আর এমনিতে নয় বাপু! তুমি বেশ পাগল আছ কিন্তু। নিজের জামা-জুতোর ঠিক নেই, ওদিকে দেখছি পুতুলের জন্য নিত্যি নতুন-নতুন জামা আর প্যান্ট আসছে!”

হাবু রাগ করে বলে, “মেলা ফ্যাচ-ফ্যাচ কোরো না তো! এরকম জ্যান্ত পুতুল কোথাও দেখেছ?”

এইসব শুনে তার পুতুলটা খুব হাসে। বলে, “ও তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ বলো তো?”

“শুনলে না? একটা কুচুটে লোক এ ঘরে ঢুকে বসে আছে?”

পুতুলটা হেসে গড়িয়ে পড়ে বলে, “ও তো তোমারই গলা।” হাবু অবাক হয়ে বলে, “আমার গলা? বলো কী?”

“হ্যাঁ, ও তোমারই গলা। নিজের সঙ্গে নিজেই ঝগড়া করো বুঝি? তুমি তো বেশ মজার লোক।”

হাবু আমতা-আমতা করে বলে, “তা হবে বাবা। মাথাটা আমার বরাবরই গোলমেলে।”

“তা হোক, তবু তুমি এক বেশ লোক।”

তা পুতুলকে নিয়ে মাঝে-মাঝে নদীর ধারে যায় হাবু। জানলার পাশে বসে দু’জনে বৃষ্টি দেখে। শরৎকালের মেঘ দেখলে পুতুল ভারী খুশি হয়। কত কী দেখার আছে চারদিকে। ফুল ফোটা, পাখির ছানার উড়তে শেখা, পিঁপড়ের চলা, বাতাসে প্রজাপতির আলপনা এঁকে যাওয়া। দু’জনে কথাও হয় কত! ভুঁইমালির সময়টা বড্ড ভাল কাটছে।

লোকে অবশ্য বলে, হাবু ভুঁইমালির মাথাটা আরও বিগড়েছে। তবে মিস্তিরি বড় সরেস। যাই সারাতে দাও, লহমায় সারিয়ে দেয়।

(সমাপ্ত)