৫
সাতসকালেই মহীধর চৌধুরীর চেঁচামেচিতে গোটা বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙে গেল। গিন্নি আর বাচ্চারা উঠে এল, বাঞ্ছারাম, মহাদেব, কাজের লোক দু’-একজন প্রতিবেশী অবধি জুটে গিয়েছে।
মহীধর সপ্তমে গলা তুলে চেঁচাচ্ছিলেন, “বলি এটা কি অতিথিশালা, নাকি হোটেল, নাকি ধর্মশালা? যে যখন খুশি ঢুকে যেখানে সেখানে গামছা পেতে শুয়ে ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোবে, এটা কি মগের মুল্লুক? চেনা নেই, জানা নেই, অজ্ঞাতকুলশীলরা যদি এভাবে ঢুকে পড়তে শুরু করে তা হলে বাড়ি বেদখল হতে কি দেরি হবে?”
যাকে উপলক্ষ্য করে এই চেঁচামেচি তার অবশ্য হেলদোল নেই। বৈঠকখানা ঘরের পাশে দরদালানের মেঝেতে একটা গামছা পেতে শুয়ে সে দিব্যি ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। বেশ দশাসই চেহারা। পরনে ধুতি, গায়ে একটা জামা। তার মাথার পাশে একটা পুঁটুলিও রয়েছে।
প্রতিবেশী পঞ্চানন পালের দিকে চেয়ে মহীধর বললেন, “দেখুন মশাই, দেখুন, চোর ছ্যাঁচড়াদের আস্পদ্দা দেখুন। চুরি করে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। এটা কি মামাবাড়ি নাকি? দেশে সরকার নেই? পুলিশ নেই? গণপিটুনি নেই?”
পঞ্চানন চিন্তিত ভাবে বললেন, “ওহে মহীধর, উত্তেজিত হয়ো না। লোকটা চোর এটা এখনও সাব্যস্ত হয়নি। তা ছাড়া একটা ট্র্যাডিশনও তো আছে।”
“কীসের ট্র্যাডিশন মশাই?”
“আমরা চিরকাল শুনে এসেছি চোর চুরি করে পালিয়ে যায়, বোকার মতো গেরস্থবাড়িতে ঘুমোয় না।”
“কলিকালে কত কী হচ্ছে মশাই। এরপর হয়তো দেখব গেরস্থকে চোরের পাও টিপে দিতে হচ্ছে। ওরে বাঞ্ছা, যা গিয়ে থানায় একটা এত্তেলা দিয়ে আয়।”
লোকটা হঠাৎ চোখ পিটপিট করে চাইল। তারপর বেশ গড়িমসি করে আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে বলল, “দিলেন তো সকালবেলায় চিল্লামিল্লি করে কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে! কাঁচা ঘুম ভাঙলে সারাদিন আমার মনমেজাজ বড্ড খিঁচড়ে থাকে।”
মহীধর ফুঁসে উঠে বললেন, “তার মানে? এটা কি ঘুমোনোর জায়গা?”
লোকটা ফের একটা হাই তুলে বলল, “সারাবাড়িতে তো একটাও ভাল ঘুমোনোর জায়গা খুঁজে পেলাম না মশাই। জীবনে কখনও মেঝেতে শুইনি। তার উপর বালিশ নেই, পাশবালিশ নেই! ওঃ সারারাত কী কষ্ট! এপাশ ওপাশ করে শেষরাতের দিকে একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিল।”
“ইয়ার্কির আর জায়গা পাওনি! এবার থানার লকআপে গিয়ে আরামসে ঘুমোও। ওরে বাঞ্ছা, থানায় খবর দে বাবা। এসে ধরে নিয়ে যাক।”
লোকটা খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, “কোন আইনে ধরবে মশাই! ২৩৮ ধারায় পরিষ্কার বলা আছে অতিথিকে কখনওই ট্রেসপাসার বলে গণ্য করা যাবে না। ওই ধারারই ‘খ’ উপধারায় বলা আছে অতিথির ঠিকমতো যত্নআত্তি না হলে বা কোনও রকম অপমান ঘটলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।”
মহীধর একটু থতমত খেয়েও রুখে উঠে বললেন, “অতিথি! তুমি আবার অতিথি হলে কোন সুবাদে?”
“বাড়িতে বাংলা অভিধান নেই? খুলে দেখুন, পরিষ্কার লেখা আছে, যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা দিনমানে বা নিশাকালে, অসময়ে, তিথি না মানিয়া অন্যের আতিথ্য গ্রহণ করে সেই অতিথি।”
“তুমি যে চোর-ছ্যাঁচোড় নও তার কী প্রমাণ?”
“৩৮০ ধারাটা খুলে দেখুন না। ঘরে লোক ঢুকলেই তাকে চোর বলে ধরা যাবে না। দেখতে হবে তার উদ্দেশ্য কী, সত্যিই কোনও মালপত্র সরিয়েছে কিনা, সরিয়ে থাকলেও কী উদ্দেশ্যে সরিয়েছে এবং কোনও নিরপেক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে কিনা সেগুলো বিচার করতে হবে। ধরুন, আমি আপনার ঘড়িটা হাতে নিয়ে টাইম দেখছি, কিংবা গয়নার বাক্স থেকে একটা নেকলেস বের করে ডিজাইনটা পরীক্ষা করছি, কিংবা গিন্নিমার বেনারসি শাড়িটার বাহার দেখে একটু হাত বোলাচ্ছি আর অমনি আপনি এসে ক্যাক করে চোর বলে জাপটে ধরলেন, তা কিন্তু হবে না। আইনের অনেক সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ আছে মশাই।”
মহীধর স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলেন লোকটার দিকে। তাঁর বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছিল না। পঞ্চাননবাবু তাঁর কানের কাছে মুখ এনে নিচু গলায় বললেন, “মহীধর, লোকটা মনে হচ্ছে বাঘা উকিল। আইন একেবারে গুলে খেয়েছে। একে বেশি ঘাঁটানো ঠিক হবে না। উকিলদের সঙ্গে কি আমরা পারি?”
এ কথায় মহীধর চিড়বিড়িয়ে উঠে বললেন, “এসব আশকারা দেওয়া ঠিক নয় মশাই। আশকারা দিলে যে সব পয়মাল হয়ে যাবে। ওরে ও মহাদেব, আয় তো, লোকটাকে দুটো রদ্দা বসিয়ে ফটকের বাইরে বের করে দিয়ে আয় তো।”
মহাদেব হাতজোড় করে বলল, “উটি পেরে উঠব না কর্তাবাবু। এখনও আমার পুজোপাট হয়নি। পুজো না করে আমি কোনও হুজ্জোতে হাত দিই না। আপনারা আরও ঘণ্টাখানেক লোকটাকে আটকে রাখুন, আমি পুজো সেরে একটু ডনবৈঠক দিয়ে চারটে ছোলাভেজানো খেয়ে আসছি।”
মহীধর দাঁত কিড়মিড় করা ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারলেন না। লোকটা অবশ্য সবাইকে অগ্রাহ্য করে মহীধরের গিন্নি পটেশ্বরীর দিকে চেয়ে হাতজোড় করে বলল, “মাঠান, সকাল সাতটার মধ্যে চা না খেলে আমার বড্ড মাথার ব্যামো হয়। সে এমন ব্যামো যে আমি আর মানুষ থাকি না। এই হয়তো শিবঠাকুরের মতো প্রলয় নাচন শুরু করে দিলাম, নইলে পাগলা ষাঁড়ের মতো সবাইকে গুঁতো দিতে তেড়ে গেলাম, তা নয়তো হাতের কাছে যা পেলাম তাই চারদিকে ছুড়ে-ছুড়ে মারতে শুরু করলাম। তখন কিন্তু অপরাধ নেবেন না। ৪৬৫ ধারায় বলা আছে পাগলামির জন্য কোনও সাজা দেওয়া যাবে না কাউকে। তা দেখছি সাতটা বাজতে আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকি।”
পটেশ্বরী ভয় খেয়ে কেঁপে-ঝেঁপে বললেন, “হ্যা বাবা, চা দিচ্ছি। মাথার ব্যামোটা একটু চেপেচুপে রেখো বাবা, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘর করি তো।”
মহীধর এই আবদার শুনে অবাক হয়ে ফের বাক্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। সংবিত ফিরে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “খবরদার! লাই দিয়ো না! লাই দিলে মাথায় উঠবে!”
পটেশ্বরী চোখ পাকিয়ে বললেন, “তুমি চুপ করো তো! একটু চা খেতে চেয়েছে, তাতে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হল শুনি?”
লোকটা একটু হেঁকে বলল, “মাঠান, আমার চায়ে কড়া লিকার, ঘন দুধ আর চার চামচ চিনি।”
“তাই হবে বাবা। তুমি বসে থাকো, চা আসছে।”
মহীধর খানিকক্ষণ হাঁ করে থেকে বললেন, “চার চামচ চিনি? সেটা চা না চায়ের পায়েস? অ্যা! এসব হচ্ছেটা কী?”
মহীধরের চেঁচামেচিকে অগ্রাহ্য করে তার দিকে চেয়েই লোকটা বলল, “আচ্ছা মশাই, আজ বাজার করতে কে যাচ্ছে বলুন তো?”
মহীধর যথেষ্ট তেজের সঙ্গে বললেন, “সে খবরে তোমার ক দরকার?”
লোকটা ঠান্ডা গলাতেই বলল, “এ বাড়ির মেনু তো আমি জানি। কখনও ডুমুরের ঝোল, খেসারির ডাল আর ভাত। কখনও বা কুদরির ঘ্যাট আর বিউলির ডাল। এসব নিকৃষ্ট খাবার তো আমার গলা দিয়ে নামবে না মশাই।”
প্রতিবেশী শশধর নস্কর চাপা গলায় বলল, “মহীদা, আপনি কি ইনকাম ট্যাক্স দেন?”
“কেন রে, হঠাৎ আলটপকা এ প্রশ্ন কেন?”
“আমার সন্দেহ হচ্ছে এ লোকটা ইনকাম ট্যাক্সের ছদ্মবেশী অফিসার। আপনার অন্ধিসন্ধি জানতে এসেছে। করালীবাবুর বাড়িতে তো একবার ইনকাম ট্যাক্সের অফিসার সাধুবাবা সেজে ঢুকে পড়েছিল।”
“বলিস কী?”
“হাবভাবে তো সেরকমই মনে হচ্ছে। মাথা ঠান্ডা রাখুন নইলে সিচুয়েশন ট্যাকল করতে পারবেন না। শুনেছি ইনকাম ট্যাক্সে ধরলে মানুষের সর্বস্ব চলে যায়।”
পঞ্চানন খুব উদ্বিগ্ন হয়ে চুপিচুপি বললেন, “ভায়া, এ কিন্তু সি আই ডি-র লোক না হয়ে যায় না। ভাল করে ভেবে দেখো তো, এর মধ্যে কোনও খুনটুন করে বসোনি তো! নাকি উগ্রপন্থীদের দলে নাম লিখিয়েছ! হেরোইন-টেরোইনের কারবার খুলেছ নাকি? দেশের গুপ্ততথ্য চিনকে বেচে দাওনি তো! যাই করে থাকো বাপু, মেজাজ হারিয়ে ফেলো না। তাতে হিতে বিপরীত হবে। বরং চেয়ার পেতে বসতে দাও, বাজার থেকে দেখেশুনে ভাল মাছ নিয়ে এসো, বউমাকে পোলোয়া রাঁধতে বলে দাও।”
মহীধর মহা ফাঁপরে পড়লেন। বুঝতে পারলেন অত হম্বিতম্বি করাটা ঠিক হয়নি। লোকটা যখন ধরা পড়েও ঘাবড়ায়নি, বর উলটে চোখ রাঙাচ্ছে, তখন বুঝতে হবে এলেবেলে লোক নয়। কিন্তু এত আস্ফালনের পর এখন হঠাৎ সাষ্টাঙ্গ হওয়া কি সোজা কথা? সিরাজউদ-দৌল্লার পার্ট করতে করতে হঠাৎ তার খানসামার ভূমিকায় নামা কি চাট্টিখানি ব্যাপার? বাঘ থেকে হঠাৎ বিড়াল হতে চাইলেই তো হওয়া যাবে না!
বাঞ্ছারাম অতিভক্তির সঙ্গে চা আর বিস্কুট নিয়ে এসে লোকটার সামনে রেখে হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে, মাঠান জিজ্ঞেস করতে পাঠালেন সকালে লুচির সঙ্গে আলুর তরকারি আপনার চলবে কিনা।”
লোকটা চায়ে একটা পেল্লায় চুমুক দিয়ে বলল, “তা চলবে না কেন? তবে কিনা লুচি আর মোহনভোগ হল সোনায় সোহাগা।”
“আজ্ঞে তাই গিয়ে গিন্নিমাকে বলি। আপনি প্রাতঃকৃত্য সেরে খাবার ঘরে আসুন।”
মহীধরের শরীর রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠল। আত্মবিস্মৃত হয়ে হাতের মুঠো পাকিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কানের কাছে এবার শশধর বা পঞ্চাননবাবু নয়, তাঁর বিবেকই যেন বলে উঠল, ‘সামলে! সামলে! বরং ছাদে গিয়ে খোলা হাওয়ায় মাথা ঠান্ডা করে এসো হে।’
কিন্তু মহীধরের মাথা ঠান্ডা রাখা ক্রমশই মুশকিল হয়ে উঠছে। কারণ লোকটা নতুন গন্ধসাবান চেয়ে নিয়ে কলঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ স্নান করে এসে যে পরিমাণে লুচি আর হালুয়া সাঁটাল, তা দেখলে চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে থাকে, মাথার চুল খাড়া দাঁড়িয়ে পড়ে। মনে-মনে হিসেব করে দেখলেন এরকম চলতে থাকলে আর মাত্র সাড়ে তিনদিনের মধ্যেই তিনি ফতুর হয়ে যাবেন।
খাওয়া আর ভোজনের মধ্যে যে তফাত আছে সেটাও হাড়েহাড়ে টের পেলেন মহীধর, দুপুরের খাওয়ার পরে। অভিধানে যাই লেখা থাক, মহীধর ঠিকই টের পেলেন যে খাওয়া এক জিনিস আর ভোজন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। হিসেব করে দেখলেন, না সাড়ে তিনদিন না, তাঁর ফতুর হতে আর মোটে আড়াই দিন বাকি। কারণ, লোকটা দুপুরে একঢিপি পোলাওয়ের সঙ্গে এক জামবাটি খাসির মাংস, বারো টুকরো পোনা মাছ আর আধসের দই গস্ত করেছে। খেতে খেতে বলছিল, “বুঝলেন মাঠান, আমার নাম হচ্ছে ভজনলাল। তা আমাকে ভোজনলালও বলতে পারেন।”
“তা তুমি কে বাছা? কোথা থেকে আসছ?”
“কেউ ভাবে আমি ইনকাম ট্যাক্সের লোক, কারও ধারণা আমি সি আই ডি, কেউ ধরে নেয় আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, কেউ বলে আমি একজন ভবঘুরে। যে-কোনও একটা ধরে নিতে পারেন।”
“তা এ গাঁয়ে তুমি কী কাজে এসেছ বাছা?”
“গুরুতর কাজ মাঠান, গুরুতর কাজ।”
“হ্যাঁ বাছা, তা আমাদের কোনও বিপদআপদ হবে না তো?”
ভজনলাল একটা শ্বাস ফেলে বলল, “বিপদ? তা বিপদআপদের অভাব কী মাঠান! বেঁচে থাকতে গেলে তো পদে-পদেই বিপদ! কোথা থেকে কখন কোন বিপদ ছোবল তোলে তার কি ঠিক আছে মাঠান? এক বিপদের পিছু নিয়েই তো আমার এখানে আসা। আমি যেখানে, বিপদও সেখানে।”
“ওমা! কী সব্বোনেশে কথা! তা এত বিপদ সব একসঙ্গে হুড়মুড় করে ঘরদোরে ঢুকে পড়লে কী উপায় হবে বাবা?”
“ভাবছেন কেন মাঠান? এই যে সাতসকালে বলা নেই কওয়া নেই একটা উটকো জাম্বুবানের মতো লোক আপনাদের বাড়িতে উদয় হল, সে তো আর এমনি-এমনি নয়। গভীর কারণ আছে বলেই আমার আগমন। আর বিপদআপদ নিয়েই আমার কাজকারবার। বুঝলেন কিনা মাঠান, কুকুরছানা, বিড়ালছানা যেমন পায়ে-পায়ে ঘোরে বিপদআপদও তেমনই আমার পায়ে পায়ে ঘোরে। যেখানে বিপদ নেই সেখানে আপনি ভজনলালের টিকিটিও খুঁজে পাবেন না।”
“কেন বাছা, ওকথা বলছ কেন? তোমার কি ফাঁড়া আছে?”
“তা আর নেই! ফাঁড়ার কণ্টকশয্যায় শুয়ে আছি মাঠান। এই যে ফাঁসির খাওয়া খাচ্ছি তা কি এমনি-এমনি মাঠান? পিছনে কি কারণ নেই? গূঢ় কারণ আছে। এই যে দেখছেন এবেলা দিব্যি বেঁচেবর্তে আছি, ওবেলাই হয়তো দেখতে পাবেন আপনাদের আদরের ভজনলাল লাশ হয়ে চোখ উলটে পড়ে আছে। তখন কি আর পোলাও, কালিয়া রেঁধে ডেকে-ডেকেও ভজনলালকে পাবেন? সেই জন্যই তো ঠেসে খেয়ে নিচ্ছি যাতে ওবেলা আপনাকে আফসোস না করতে হয়।”
পটেশ্বরী ডুকরে উঠে বললেন, “ওমা গো! ও কী অলক্ষুনে কথা বাছা! তা হলে বাপু তুমি বরং আরও দুটো পোলাও নাও। সঙ্গে আর দু’টুকরো মাছ দিই বাবা?”
“দিচ্ছেন দিন। ওই জন্যই খাওয়ার সময় কথা কওয়া শাস্ত্রে নিষেধ করেছে। কথা কইলে পেটের বায়ু বেরিয়ে যায় কিনা, তাতে পেটের খানিকটা আবার ফাঁকা হয়ে পড়ে।”
এখন শরৎকাল। কালীতলাহাটে রীতিমতো ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে। সন্ধের পর উত্তুরে বাতাস দেয়। লোকে সন্ধের পর গায়ে ঢাকাচাপা না দিয়ে বেরোয় না। কিন্তু কে জানে কেন, মহীধর চৌধুরীর তপ্ত মাথাটা আর জ্বালা ধরা গা কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। সেই দুপুর থেকে মাথায় ভেজা গামছা চাপিয়ে বসে আছেন, এই সন্ধে অবধি জ্বালাপোড়া চলছে। মাঝেমধ্যে একটু আশার আলো যে দেখা যাচ্ছে না, তা নয়। আর সেই ক্ষীণ আশাটা হল যে, তিনি আসলে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছেন। বাস্তবিক তাঁর বাড়িতে ভজনলাল নামক কোনও নররাক্ষসের আবির্ভাব হয়নি এবং সে সকালে তিরিশটা লুচি আর মোহনভোগ সাঁটায়নি। দুপুরে পোলাও, মাংস, মাছের কালিয়া বা দই খায়নি এবং আগামী আড়াই বা দেড়দিনের মধ্যেই তিনি ফতুরও হয়ে যাচ্ছেন না। কিন্তু মুশকিল হল, দুঃস্বপ্নটা অনেকক্ষণ ধরে চলছে। কিছুতেই মহীধরের ঘুম ভাঙছে না। নিজের গায়ে চিমটি কেটেও ফল হয়নি।
ভাঁড়ার ঘরটা অন্ধকার। তাতে অবশ্য মহীধরের কোনও অসুবিধে হয় না। অন্ধকারে কোথায় কী আছে সবই তার মুখস্থ। তা ছাড়া অনেকদিনের অভ্যাসের ফলে তিনি অন্ধকারেই আবছা আবছা সবই দেখতে পান। তাতে আলো জ্বালবার খরচা বাঁচে। আর খরচ বাঁচিয়ে বাঁচিয়েই তো কোনও রকমে বেঁচে আছেন মহীধর। নইলে ফতুর হতে আর কতদিন লাগে! সত্যি বটে যে, নামে-বেনামে তাঁর প্রায় দেড়শো বিঘে জমিতে ধান, আলু, ছোলা, মটর ভালই হয়। শেয়ার বাজারেও তাঁর বেশ কয়েক লাখ টাকা খাটছে। বন্ধকি কারবার থেকেও ভালই হয়। কিন্তু তাতে কী? সব কিছু ফুস হয়ে যেতে কতক্ষণ?
কিন্তু দুঃস্বপ্নটা তো এখনও কাটছে না! বড্ড লম্বা স্বপ্ন যে! মহীধর নিজেই ফের একটা চিমটি দিলেন নিজের পেটে। কাজ হল না। তবে কি স্বপ্ন নয়? বাস্তবিকই ঘটনাটা ঘটেছে?
কিন্তু এই সময় অন্ধকারে কে যেন ঘরে ঢুকল। বাঞ্ছারামই হবে। ভাঁড়ার ঘর থেকে চালডাল নিতে এসেছে বোধ হয়।
মহীধর বললেন, “বাঞ্ছা নাকি রে? দেখ তো বাবা আমি ঘুমোচ্ছি না জেগে আছি! দে তো গায়ে একটা রামচিমটি!”
কিন্তু চিমটি নয়, হঠাৎ মেরুদণ্ডের পাশে পিঠে কে যেন একটা ছুঁচ প্যাট করে ফুটিয়ে দিল।
“বাপ রে!” বলে মহীধর লাফিয়ে উঠলেন। পিছনে তাকিয়ে তিনি হাঁ! অন্ধকারে আবছা যা দেখা যাচ্ছে তা তো মোটেই মানুষের মূর্তি নয়। লিকলিকে সরু হাত পা, বেঢপ বড় একটা মাথা, ড্যাবড্যাবে প্রকাণ্ড দুটো চোখ, ন্যাড়া মাথা! এরকম অদ্ভুত আকৃতির কিছু কখনও দেখেননি মহীধর। কিছুক্ষণ ভয়ে আতঙ্কে ‘আঁ আঁ’ করে হঠাৎ সংবিত ফিরে পেলেন তিনি। তাই তো! তিনি তো তা হলে দুঃস্বপ্নই দেখছেন। এ জিনিস তো বাস্তবে হতেই পারে না। তাই মুহূর্তের মধ্যে মহীধরের ভয়ডর কেটে গেল। যাক বাবা, তা হলে সত্যিই তাঁর বাড়িতে ভজনলাল বলে কেউ আসেনি, লুচি, মোহনভোগ খায়নি, পোলাও, মাংস, মাছ আর দইও সাঁটায়নি! তা দুঃস্বপ্ন যখন দেখছেন তখন আর পরোয়া কাকে! তিনি কিম্ভূত জীবটার দিকে চেয়ে বেশ বীরদর্পেই বললেন, “কে হে বাপু তুমি? কী মতলবে এ বাড়িতে ঢুকেছ?”
গম্ভীর গলায় জবাব এল, “ভকরম!”
‘ভকরম’ কথাটার মানে মহীধর জানেন না। তাই মাথা খাটিয়ে বললেন, “ভয় কয় রকম জানতে চাইছ নাকি হে? তা ভয়ের কি শেষ আছে বাপু? ভূতের ভয়, বাঘের ভয়, চোরের ভয়, ডাকাতের ভয়, খরচের ভয়…”
হঠাৎ কিম্ভূতটা ডানহাত বাড়িয়ে তার পেটে একটা খোঁচা দিল। সেই ছুঁচ ফোটানোর যন্ত্রণা। মহীধর আঁতকে উঠে বললেন, “হচ্ছেটা কী?”
গম্ভীর গলাটা ফের বলল, “ভকরম!”
মহীধর আতঙ্কিত হয়ে বুঝতে পারলেন অমন দু’-দুটো ছুঁচের খোঁচা খেয়েও যখন তাঁর ঘুম ভাঙেনি, তখন নিশ্চয়ই তিনি ঘুমোচ্ছেন না। আর না ঘুমোলে দুঃস্বপ্ন দেখার প্রশ্নও ওঠে না। তা হলে তাঁর সম্মুখে এ কে?
তিনি কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “ভূ-ভূত নাকি আপনি? অ্যা! ভূত নাকি? তা ভূতই যদি হবেন তা হলে আমাকে ভয় না দেখিয়ে ওই ভজনলালকে গিয়ে দেখান না!”
কিম্ভূত জীবটা হঠাৎ তাঁর ডান হাতটা বাড়িয়ে মহীধরের বাঁ হাতের কবজিটা চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে মহীধর যন্ত্রণায় লাফিয়ে উঠলেন। অমন প্যাকাটির মতো সরু হাতে কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো আঙুলে যে এরকম ভয়ংকর শক্তি থাকতে পারে তা কে আন্দাজ করেছিল! মহীধর কাতরস্বরে বললেন, “ওরে বাপু, আমার কবজিটা যে ভেঙে যাবে! ছাড়ো-ছাড়ো…’
মহীধর দু’-একবার ঝাঁকুনি দিয়ে হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলেন, তাতে হিতে বিপরীত হচ্ছে। হাতের সাঁড়াশি চাপ আরও বাড়ছে।
কিন্তূতটা এবার গম্ভীর গলায় পরিষ্কার বাংলায় বলল, “তোমার হাতটা চেপে না ধরে থাকলে তুমি আমার কথা বুঝতে পারবে না। আমার সঙ্গে এসো।” বলে কিম্ভূতটা তাঁকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে দরদালান পার হয়ে বৈঠকখানার দরজায় গিয়ে হাজির হল। দরজার তালাটা খোলা। সেটা দেখিয়ে কিম্ভূত বলল, “তালাটা কে খুলেছে? তুমি?”
মহীধর কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “আজ্ঞে না।”
“এসো, ” বলে দরজা ঠেলে অন্ধকার বৈঠকখানার ভিতরে ঢুকল কিম্ভূত, সঙ্গে মহীধর। হঠাৎ কিম্ভূতটার বাঁহাতে একটা ছোট টর্চের মতো কিছু একটা থেকে তীব্র চোখধাঁধানো আলো গিয়ে দেওয়ালে পড়ল। দেখা গেল, যেখানে দেওয়ালঘড়িটা ঝোলানো ছিল সেই জায়গাটা ফাঁকা। দেওয়ালঘড়ি উধাও, শুধু দেওয়ালে তার ছাপটা রয়ে গিয়েছে।”
“এখানে যে ঘড়িটা ছিল সেটা কোথায় গেল?”
মহীধর মাথা নেড়ে বললেন, “আমি জানি না সাহেব। ঘড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পুরনো জিনিসের দরে বেচে দেব বলে ভেবেছিলাম।”
“তুমি মূর্খ। এই ঘড়ি আমাদের সম্পত্তি। আমরাই ওটাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলাম। ওটি শুধু ঘড়ি নয়, একটি মহাযন্ত্র। ওই মহাযন্ত্র পৃথিবীর সব খবর আমাদের কাছে পাঠাত। ঘড়িটা যে খারাপ হয়েছে সেটা আমরা জানি। তার জন্য আমরা আমাদের কারিগরকেও নিয়ে এসেছি। এখন ভালয় ভালয় বলো ঘড়িটা কোথায়। তুমি কি ঘড়িটা কাউকে বিক্রি করে দিয়েছ?”
মহীধর মাথা নেড়ে বললেন, “না সাহেব, বিশ্বাস করুন, মাইরি বলছি আমি বেচিনি। নিশ্চয়ই চুরি হয়ে গিয়েছে।”
“আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। তোমাকে ঠিক বারো ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। তার মধ্যেই ওই ঘড়ি উদ্ধার করে নিয়ে এসো। ঘড়ি মেরামত করে আমরা দেশে ফিরে যাব। যদি আদেশ অমান্য করো তবে কঠিন শাস্তি পাবে। যাও দেরি কোরো না।” বলেই তাঁর হাত ছেড়ে দিয়ে কিম্ভূতটা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
স্তম্ভিত মহীধর কিছুক্ষণ বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর আচমকা আর্তনাদ করে উঠলেন, “ওরে মহাদেব! ও পঞ্চানন! ও গিন্নি! ঘড়িটা কোথায় গেল? অ্যা! ঘড়িটা কোথায় গেল?”
চেঁচামেচি শুনে সবাই এসে বৈঠকখানা ঘরে জমা হল।
পটেশ্বরী বললেন, “ওমা! তা অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিলে কেন? ওই ঘড়ির শব্দ না শুনলে আমার ভাল ঘুম হয় না বলে একজন ভাল সারাইকর খুঁজছিলাম। তা ভজনলাল বলল তার জানাশোনা একজন ভাল ঘড়ির কারিগর নাকি আছে। তাই ভজনলাল ওটা সারাতে নিয়ে গিয়েছে।”
“সর্বনাশ!” বলে মেঝেয় বসে পড়লেন মহীধর।
পটেশ্বরী বললেন, “আহা এতে সর্বনাশের কী হল? লোকটা নিজে থেকে ওই ভারী ঘড়ি ঘাড়ে বয়ে নিয়ে গেল, সেটা বুঝি কিছু নয়? তুমি তো খরচের ভয়ে ঘড়িটা সারাতেই চাইছিলে না। পাঁচশো টাকায় বেচে দেওয়ারও মতলব ছিল। তা এখন অত হাহাকার করার কী আছে?”
হাহাকার করার কী আছে তা বাড়ির লোককে মহীধর বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর ওই লিকলিকে ভূত আর ঘড়ির মহিমার কথা কেউই তেমন বিশ্বাস করল না। তাঁর গিন্নি পটেশ্বরী তো মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “পারোও বটে তুমি গাঁজাখুরি গপ্পো বানাতে।”
বাঞ্ছা বলল, “এ বাড়িতে মোট তিনটে ভূত আছে। আর তাদের সঙ্গে তো আমার মাঝেমধ্যেই দেখা হয়। তারা কেউই অমন রোগা লিকলিকে নয়।” মহাদেব কথা খুব কম কয়। সেও বলল, “কর্তাবাবুর এবার একটু কি দুধ-ঘি খাওয়া উচিত? রোগাপটকা লোকের কাছে হেরে যাওয়া তো কাজের কথা নয়।”
মহীধর বুঝতে পারলেন এদের বোঝানো বৃথা। ঘটনাটা কাউকে বিশ্বাস করানো কঠিন। কিন্তু কঠোর বাস্তব হল, হাতে মাত্র বারো ঘণ্টা সময় আছে। তার মধ্যে কিছু করা না গেলে কিম্ভূতটা কী করে বসবে তার ঠিক কী?
তিনি যে আর স্বপ্ন দেখছেন না, এটা নির্ফস বুঝতে পারছেন মহীধর। সুতরাং তিনি উঠেই পড়লেন এবং তাড়াতাড়ি সাজপোশাক পরে, হাতে একটা লাঠি আর টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। একটা দেড়-দু’মন ওজনের ঘড়ি কাঁধে নিয়ে ভজনলালের মতো গাঁট্টাগোঁট্টা লোকও বেশি দূর যেতে পেরেছে বলে মনে হয় না। সময় নষ্ট না করে এখনও তাকে পাকড়াও করা যেতে পারে।
কদমতলার মোড়টা সবে পেরিয়েছেন, ঠিক এমন সময় কে যেন পিছন থেকে বলল, “কর্তামশাই, ঘড়িটা শেষ অবধি বেচেই দিলেন? তা কত দর পেলেন বলুন তো?”
ঘড়ির কথায় থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে লোকটাকে দেখে বললেন, “তুমি আবার কে হে?”
“আজ্ঞে আমাকে বিস্মরণ হয়েছেন? আমি গনশা। সেই যে আপনার পুরনো দেওয়াল ঘড়িটা কিনতে গিয়েছিলুম৷ সেই যে মেমসাহেবের কান্নাকাটি…”
“অ। তা ঘড়িটা বেচে দিয়েছি কে বলল?”
‘এই তো নিজের চোখে দেখা। জাম্বুবানের মতো একটা লোক ঘড়ি কাঁধে নিয়ে বটেশ্বরবাবার থানের দিকে গেল!”
“বটে! ঠিক দেখেছ?”
“আজ্ঞে, নিৰ্যস!”