৪
চারদিকে শিক্ষার বড় অভাব দেখতে পায় ছাতুলাল৷ পেটে বিদ্যে না থাকলে কি কিছু হয়? মগজ খেলে না, দেখার চোখ তৈরি হয় না, শোনার কান গজায় না, কাজের উৎসাহ বা উদ্দীপনা থাকে না, হাতে পায়ে দক্ষতা বা সূক্ষ্মতা আসতে চায় না। অশিক্ষায় দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে দেখে ছাতুলালের ভারী দুঃখ হয়। শুধু শিক্ষা হলেই হবে না, সঙ্গে স্বাস্থ্যচর্চাও চাই। শরীর মজবুত, বুকে দম, পায়ে গতি, হাতে কেউটের ছোবলের মতো তৎপরতা, সহনশক্তি। কোনটা না হলে চলে? সঙ্গে চরিত্রও চাই। শুধু লোভ-লালসা থাকলে কি বড় হওয়া যায়? আজকালকার ছেলেছোকরাদের তো দেখছে ছাতুলাল। একদিন কিছু রোজগার হলে পরের দু’দিন ফুর্তি করে সব উড়িয়ে দেয়। ওরে বাপু, দূর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাজ না করলে কি দশজনের একজন হওয়া যায়? সংযম চাই, ধৈর্য চাই, ক্রমে-ক্রমে এগিয়ে, আরও এগিয়ে যাওয়া চাই।
আজ কালীতলাহাটে হাটবার। সকালে ছাতুলাল আজ হাটে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। যা দেখল তাতে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় তার। ছি ছি, কী সব মোটা দাগের কাজ! কারও কাজে কোনও শিল্প বা সৌন্দর্যের ছোঁয়া নেই, শিক্ষার প্রকাশ নেই! ওই যে দুলাল প্রতিহার নামে রোগাপ্যাংলা ছেলেটা। গায়ে ঝিনচাক লালজামা আর কালো প্যান্ট পরে চেকনাই দিয়ে ঘুরছিল, সে কাজটা কী করল? যোগেশবাবুর প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা তুলল কিন্তু এমন হ্যাঁচকা টান মারল যে যোগেশবাবু খপ করে পকেটে হাত চেপে “কে রে!” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ছোকরার কপাল ভাল যে, পাশেই এক হাওয়াই চপ্পলওয়ালার সারি-সারি ঝোলানোচপ্পলের পিছনে ঘাপটি মেরে বসে পড়েছিল। ছোকরার হয়তো লজ্জা নেই। কাণ্ড দেখে ছাতুলালের কান লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ফটিক ভুইয়ার কাণ্ডটাও এই পাপচোখে দেখতে হল ছাতুলালকে৷ শাড়ি কাপড়ের মহাজন বীরপ্রসাদের ট্যাক ফাঁক করতে এমন ভাবে ক্ষুর চালাল যেন মুরগি জবাই করছে। টাকার বান্ডিলটা সরাতে পারল বটে কিন্তু বড্ড মোটা দাগের কাজ। ক্ষুর ধরতেই জানে না ছোকরা! ক্ষুরের টানে বীরপ্রসাদের কোমরে ক্ষত হয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড। হাঁদু খটিকের ইদানীং খুব নামডাক শোনা যায়। খুব নাকি এলেমদার ছেলে, উঠতি প্রতিভা। তা তার কাজের যা ছিরি দেখল ছাতুলাল তাতে জীবনটাতেই ঘেন্না ধরে যায়৷ মগনলালের বন্ধকি কারবারের দোকানে খদ্দের সেজে ঢুকেছিল হাতসাফাই করে সোনাদানা সরাবে বলে। সরিয়ে ফেলেছিলও প্রায়। একটা বেশ দামি নেকলেস। কিন্তু এ কাজের জন্য হাতে ম্যাজিশিয়ানের মতো জাদু না থাকলে যা হয়। একটা বুড়ো কর্মচারী এসে খপ করে হাত চেপে ধরল। তারপর দুটো মুশকো দারোয়ান এসে গোটা কয়েক রদ্দা মেরে দোকান থেকে বের করে দিল। তারপরে হাঁদু যা করল তা আর কহতব্য নয়। বেরোবার সময় কার একজোড়া পুরনো জুতো হাপিশ করে পালিয়ে গেল। পর্বতের এই মূষিক প্রসব দেখে ছাতুলালের বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।
বটতলার ন্যাপার দোকানে বসে একটু হাঁফ ছাড়ছিল ছাতুলাল। ন্যাপা বলল, “চা দেব নাকি ছাতুদা?”
ছাতুলাল শ্বাস ফেলে দেশের দুরবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে ভারী আনমনে ভাঁড়ে করে ন্যাপার দেওয়া গরম চা খাচ্ছিল ছাতুলাল। ন্যাপা চা বানায় বড় ভাল। ঠিক এই সময়ে বেঞ্চিতে তার পাশে সন্তর্পণে একটা লোক এসে বসল। ছাতুলালের বহুদিনের প্র্যাকটিস আছে কারও দিকে সরাসরি না তাকিয়েও সে লোকটার আগাপাশতলা মেপেজুখে নিতে পারে। লোকটা বেশ লম্বা, শক্তপোক্ত শরীর, মাঝবয়সি, পরনে পাতলুন, গায়ে একটা ভুসো রঙ হাফহাতা শার্ট। বেশ তুঁড়ো গোঁফ আছে, মাথার চুল খুব ছোট করে ছাঁটা। লোকটা বসে মৃদু স্বরে রামপ্রসাদী গাইছে, “আমায় দে মা তবিলদারি, আমি নিমকহারাম নই শংকরী…”
বলল, “তার চেয়ে এক ভাঁড় বিষ দে।”
ছাতুলাল নির্বিকার ভাবে সামনের রাস্তাটার দিকে চেয়ে যেমন চা খাচ্ছিল তেমনই খেতে লাগল। লোকটি চেনা নয়, এ গাঁয়ের নয়, আশপাশের গাঁয়েরও নয়। বাইরে থেকে আমদানি হয়েছে।
লোকটা গান গাইতে গাইতেই ওই গানের সুরেই গলাটা খুব নামিয়ে বলে, “কিছু রোজগার করার ইচ্ছে আছে?”
ছাতুলাল যেমন সামনে তাকিয়ে ছিল তেমনই তাকিয়ে থেকেই প্রায় বিড়বিড় করে বলল, “কীসের রোজগার?”
রামপ্রসাদীর সুরেই ভেসে এল, “একটা কাজ আছে।”
পাকা মাছ শিকারি যেমন ফাতনার নড়াচড়া দেখেই টের পায় বড় মাছ না-ছোট মাছ, তেমনই ছাতুলাল এক লহমায় বুঝতে পারে খদ্দের মালদার না ফোতো কাপ্তেন। এ লোকটাকে মাপজোখ করে তার মনে হল এ কোনও রাঘববোয়ালের আড়কাঠি। তবে ছাতুলাল তেমন গরজ দেখাল না। চা শেষ করে ভাঁড়টা ছুড়ে ফেলে শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো নিচু গলায় বলল, “কাজকর্ম আমি ছেড়ে দিয়েছি হে। ছেলেছোকরাদের কাছে যাও।”
“ছেলেছোকরাদের দিয়ে কাজ হলে আর তোমার কাছে আসা কেন? পাঁচ বান্ডিল মজুরি।”
ছাতুলাল ভারী উদাস গলায় বাতাসকে শুনিয়ে বলে, “ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করা আমি বহুদিন ছেড়ে দিয়েছি।”
রামপ্রসাদী সুরেই ভেসে এল, “তা হলে দশ বান্ডিল। কত্তা তার বেশি উঠবেন না। রাজি?”
“কাজ বুঝে রাজি-অরাজি। কাজটা কী?”
“কাজ খুব সোজা। এক জায়গা থেকে একটা জিনিস সরাতে হবে।”
খুব সন্তর্পণে বাঁহাতটা একটু এগিয়ে রেখে ছাতুলাল বলে, “আগাম ছাড়া কথা কই না।”
বাঁহাতে এক বান্ডিল নোট গুঁজে দিয়ে লোকটা তেমনই রামপ্রসাদী সুরেই বলে, “পাঁচ হাজার আছে। গুণময় ঘোষের বাড়ি থেকে একটা পুতুল সরিয়ে আনতে হবে।”
ছাতুলাল অবাক হয়ে বলে, “গুণময় ঘোষ! পুতুল? ঠিক শুনছি তো, নাকি কানের দোষ দেখা দিয়েছে!” “ঠিকই শুনেছ।”
“একটা পুতুল হাতানোর জন্য ছাতুলালকে ডাকাডাকি! ব্যাপারটা কী বলো তো? পাঠশালায় পড়ানোর জন্য কি পিএইচ ডি লাগে নাকি, হালচাষ করতে হাতি ডাকতে হয়, নাকি মশলা পিষতে মুষল নিয়ে আসে লোকে।”
লোকটা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “কাজটা ছোট হলেও মজুরিটা তো ছোট নয় বাপু।”
ছাতুলাল সামনে একটা নারকোল গাছের আগার দিকে চেয়ে বলে, “তা বটে, তবে কি হালে গুণময় গুপ্তধন-টন পেয়েছে। নাকি লটারি মেরেছে! পুতুলের পেটের মধ্যে হিরেজহরত ভরে রাখেনি তো। মুণ্ডু খুলে ফেললেই হড়হড় করে বেরিয়ে পড়বে!”
“ওসব আমি জানি না বাপু, কত্তাবাবু জানেন। আমি হুকুম তামিল করছি বই তো নয়।”
“আমাদের লাইনে নামধাম জানতে চাওয়ার নিয়ম নেই। তাও বলছি বাপু, তোমার কত্তাবাবুটি গভীর জলের মাছ।”
“তা হবে। আমরা চুনোপুঁটি, রাঘববোয়ালদের গতিবিধি কি আমরা জানি।”
লোকটা যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনই নিঃশব্দে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল।
ছাতুলাল আরও এক ভাঁড় চা নিল। ভাবনাচিন্তার পক্ষে চা জিনিসটা ভারী উপকারী। ভারনাচিন্তা না করে কোনও কাজেই সে হাত দেয় না। আর বিষয়টাও ভাবনাচিন্তার বিষয়। কারণ, গুণময় ঘোষের তিন কুলে কেউ নেই। সে রুজিরোজগারের ধান্দায় বেরিয়ে গেলে বাড়িখানা সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। ওবাড়িতে চুরি করার জন্য চুরিবিদ্যের অ আ ক খ-ও শিখতে হয় না। নিতান্ত অগা চোরও পারে। দ্বিতীয় কথা, গুণময়ের বাড়িতে পুতুলের আমদানি হয় কী করে? আর সেই পুতুলের জন্য দশ হাজার টাকা কবুল করে ছাতুলালের মতো উঁচুদরের কারিগরকে কাজে লাগানোর মানে কী? না, ব্যাপারটা ছাতুলালের কাছে বেশ গোলমেলে ঠেকছে! খুবই গোলমেলে!
“কাজটা কি নিয়ে ফেললেন নাকি খুড়ো?”
ছাতুলাল খুব অবাক হয়ে চেয়ে দেখল সামনেই লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা বেঁটে মতো একটা ছোকরা দাঁড়িয়ে। মুখে একটা ফিচেল হাসি। ঠাহর করে দেখে চিনতে পারল ছাতুলাল, এ হল ছিনে বৈরাগী।
ছাতুলাল বলে, “কী বলছিস?”
> “বলি, কাজটা কি নিয়ে ফেললেন? আগামও হাতফেরতা হতে দেখলাম যেন।”
ছাতুলাল একটু সতর্ক হয়ে বলে, “তাতে হলটা কী?”
“না এই বলছিলাম কী, আপনাদের মতো গুরুজনদের কাছেই আমাদের কাজকর্ম শেখা কিনা। আপনাদের বিদ্যে ধার করেই তো করে খাচ্ছি। গুরু বলে মান্যগণ্যও করে থাকি।”
ছাতুলাল খুশি হয়ে বলে, “তা তোর মধ্যে একটু ভক্তিছেদ্দা আছে বটে। সামনে কখনও বিড়িটিড়ি খাস না, দেখা হলে বসা থেকে উঠে দাঁড়াস। গাল ভরে খুড়ো ডাকিস। উঠতি ছোকরাগুলো তো সহবতই জানে না। সেদিন দেখলুম গাবু ছোকরা টেরি বাগিয়ে পকেটমারি করতে বেরিয়েছে। দোষের মধ্যে ডেকে বলেছিলুম, ‘ওরে, চোর পকেটমারের চুল বড় রাখতে নেই, বড় চুল খপ করে ধরতে সুবিধে।’ তা তেরছা হয়ে বলল, “ওসব পুরনো নিয়ম ছাড়ুন তো, চুলে কে হাত দেয় দেখি।’ সেদিন ভবেনের মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন গিয়েছি, কী বলব, নাকের ডগায় সব উঠতি ছোকরারা সিগারেট ফুঁকছে। বয়স্কমানুষদের গেরাহ্যিই করছে না। কথাটা দুঃখ করে গনশাকে বলছিলুম, তা পাশ থেকে একটা ফচকে ছোকরা বলে উঠল, ‘তা আপনার সামনে লুচি, মাংস, পোলাও খেলেও কি আপনার মান যায়? তা হলে ধোঁয়া খেলে মান যাবে কেন?’ শোন কথা! লুচি, মাংস আর বিড়ি, সিগারেট কি এক হল?”
“তা তো ঠিক কথাই খুড়ো।”
“আমি যে একাদশীপিসির পুজোর আসন চুরি করেছিলাম, সেই গল্প তো জানিস। বগা চোরের সঙ্গে একশো টাকা বাজি ছিল।” ছিনে বৈরাগী অবাক হয়ে বলে, “আসন চুরি?”
“ওরে আসনটা তো বড় কথা নয়, চুরিটাই বড় কথা। কারণ আমি যখন আসনটা চুরি করি তখন তার উপরে বসেই একাদশীপিসি মালা টপকাচ্ছিল। কাজটা তো সহজ ছিল না। অনেক তপস্যা, অনেক মেহনত করে কায়দাটা শিখতে হয়েছিল। বুড়ো বয়সের দোষ কী জানিস তো? বেশি কথা কওয়া। তা সেদিন বটতলায় বসে সেই আসন চুরির গল্পটা সবাইকে বলছিলাম। হঠাৎ সেদিনের ছোকরা ছিনতাইবাজ নবকেষ্ট বলল, ‘এত শিখেপড়ে, এত মেহনত করে শেষ পর্যন্ত একটা চটের আসন নিয়ে এলেন মশাই! ছ্যাঃ ছ্যাঃ আপনাদের মতো বুড়োগুলোর নজর বড় নিচু।””
“এটা নবকেষ্টর ভারী বেয়াদপি হয়েছে খুড়ো।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাতুলাল বলে, “কী আর বলব বল, আজকাল আর আগ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলতে সাহস হয় না।’ “
ছিনে বৈরাগী ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলে, “আমরা এখনও তো আপনাকে গুরুতুল্যই দেখি। তবে কিনা খুড়ো, বদন হাওলাদারের কাছ থেকে আগাম নিয়ে কি ঠিক করলেন?”
“বদন? সে কে বল তো?”
‘ওই যে জাম্বুবানটা, একটু আগে আপনার পাশে বসে রামপ্রসাদী গাইছিল।”
“অ। তা বৃত্তান্তটা কী?”
ছিনে বলল, “কাজটা আরও দু’-একজনকে দিয়েছিল কিনা।” ছাতুলাল অবাক হয়ে বলল, “বটে!”
“হ্যাঁ খুড়ো। কেউ পেরে ওঠেনি।”
ছাতুলাল ভারী অবাক হয়ে বলে, “বলিস কী রে? একটা পুতুল চুরি, তাও গুণময় ঘোষের বাড়ি থেকে, সেটাও পেরে ওঠেনি! গুরু বলে মেনেছিস, তাই বলছি। তোরা কি শেষে আমাদের নাম ডোবাবি?”
ছিনে মাথা নিচু করে বলে, “আর লজ্জা দেবেন না খুড়ো।
আপনাদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার আস্পদ্দা যেন কখনও না হয়। তবে কিনা ছোট কাজের জন্য মোটা দক্ষিণা দেওয়ার পিছনেও তো কারণ আছে নাকি বলুন।”
“হুঁ, সেটা ভেবে দেখার মতো কথা বটে।”
“তাই বলছি। কাজটা শুনতে যত সোজা, হাসিল করা তত সোজা নয়। ওই ফুটু মস্তানের কথাই ধরুন। আপনাদের কাছে, সে নস্যি৷ কিন্তু আজকাল যত জনা উঠেছে তার মধ্যে ওর হাতই সবচেয়ে সাফ। ডাকাবুকো আছে, বুদ্ধিসুদ্ধি রাখে। আর সবাই জানে, গুণময়ের বাড়ি হল খোলা হাট। যে কেউ যখন তখন হাওয়া বাতাসের মতোই ঢুকে যেতে পারে। জলের মতো সোজা কাজ। গা ঘামাতে হবে না। তাই দুপুরবেলা তায়েবগঞ্জে ম্যাটিনি শোয়ে একটা হিন্দি ফিলিম দেখতে যাবে বলে টেরি বাগিয়ে বগলে সেন্ট মেখে একটা হিন্দি গান গুনগুন করতে করতে গুণময়ের বাড়িতে ঢুকতে গিয়েছিল। ভেবেছিল কাজটা সেরে ফিলিম দেখতে যাবে। বন্ধুরা সব অপেক্ষাও করছিল তেমাথার মোড়ে। কিন্তু সেই যে ঢুকল আর বেরোল না। বন্ধুরা যখন দেখল যে শোয়ের টাইম পার হয়ে যাচ্ছে, তখন খুঁজতে গিয়ে দেখে ফুটু গুণময়ের বাড়ির দরজার সামনে সটান উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সেই মূর্ছা ভাঙল তিনদিন বাদে। কী হয়েছিল, কিছু বলতে পারে না। এরপর বদুর পালা। বদুকে তো চেনেন। আগে চুরি-ছিনতাই করত। এখন ডাকাতিতে নাম লিখিয়েছে। লোভে পড়ে সেও মাঝরাত্তিরে গিয়ে গুণময়ের বাড়িতে হানা দেয়। সঙ্গে তিন তাগড়া সাগরেদ। তারপর তিনজনই হাওয়া হয়ে গেল। দু’দিন বাদে পালপাড়ার পুকুরের ধারে কচুবনে একজনকে পাওয়া যায়। নদীর ধারে কসার জঙ্গলে দু’জন আর বদু পড়েছিল ভুবনেশ্বরী কালীর থানের পিছনে। কেউ মরেনি। কিন্তু মরার অধিক। কেউ কোনও কথা কইতে পারছে না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকছে। শুধু একজন মাঝে-মাঝে বলে উঠছে, ওরে বাবারে হলুদ ভূত। তাই বলছিলুম খুড়ো, আপনি যদিও পাকা লোক, তবু একটু ভেবেচিন্তে কাজটায় হাত দেবেন।”
ছাতুলাল চোখ কুঁচকে বলে, “তুই কি বলতে চাস গুণময় ঘোষ বাড়িতে পাহারা বসিয়েছে?”
ছিনে মাথা নেড়ে বলে, “না খুড়ো, পাহারা বসালে আমাদের চোখে পড়ত৷ তবু কায়দা করে গুণময় ঘোষকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, গুণময়দা দিব্যি একজন জবরদস্ত দরোয়ান রেখেছেন দেখছি। গুণময়দা তো আকাশ থেকে পড়লেন, তোর কি মাথা খারাপ হল রে! দরোয়ান রাখতে যাব কোন দুঃখে! চোরে-ডাকাতে আমার নেবেটা কী?”
ছাতুলাল চিন্তিত মুখে বলল, “তাই তো! তুই তো দেখছি একটু চিন্তাতেই ফেলে দিলি বাপু! টাকা নিয়েছি কাজটা না করলেও নয়।”
“সেইটে চোখে পড়ে গেল বলেই বলছি খুড়ো, একটু চোখ কান খোলা রেখে এগোবেন।”
অনেকখানি ঘেরা জমির মাঝখানটায় একটা পুরনো একতলা বাড়ি৷ শ্রীছাঁদ বলতে বাড়িটার কিচ্ছুটি নেই। দেওয়ালে পলেস্তরা খসে শ্যাওলা ধরেছে, জানলা-দরজা নড়বড়ে। চারদিকের জমিতে মাথাসমান উঁচু আগাছার জঙ্গল। বড়-বড় গাছও বিস্তর। এই ভরদুপুরেও গাছপালায় চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। ঝিঁঝির ডাকে কান ঝালাপালা।
বাড়িতে ঢুকবার ফটকটা বহুকাল উধাও। সেই ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে ভাল করে বাড়িটা নিরীক্ষণ করছিল ছাতুলাল। সে হুঁশিয়ার লোক, আঁটঘাট না বেঁধে কাজে নামে না। এ বাজারে দশ হাজার টাকা তো ফ্যালনা জিনিস নয়। যে পাঁচ হাজার টাকা আগাম পেয়েছে তা থেকে সে আজ মাংস কিনে দুপুরে সাঁটিয়েছে খুব। তবে তার আগে খানিক ডনবৈঠক করেছে, কিছু স্তবস্তুতিও সেরে নিয়েছে। কয়েকটা প্রাণায়াম, বায়ুবন্ধন ইত্যাদি যোগপ্রক্রিয়া সেরে নিয়েছে, সাবধানের মার নেই। তার পরনে মালকোঁচা দেওয়া টাইট ধুতি, গায়ে গেঞ্জি। কোমরে একখানা দা গোঁজা, বিপদে কাজে লাগবে।
কিন্তু ভয়ভীতির কিছুই দেখতে পেল না ছাতুলাল। চারদিক শুনশান, জনমনিষ্যি নেই। দরজায় একটা পলকা তালা ঝুলছে।
ছাতুলাল চারদিক দেখে ফস করে বাড়ির এলাকায় ঢুকে পড়ল। সদর দরজা দিয়ে সহজেই ঢোকা যায় বটে, কিন্তু সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আগে চারদিকটা ভাল করে দেখে নেওয়া দরকার। গাছের ছায়ায়-ছায়ায় আর আগাছার জঙ্গলে দিব্যি গা ঢাকা দিয়ে এগোনো গেল। বাড়ির পিছন দিকটায় এসে ছাতুলাল দেখতে পেল ঘুণ ধরা, উইয়ে খাওয়া ঝুরঝুরে জানলাগুলোর মধ্যে একটার পাল্লা ভেঙে ঝুলে পড়েছে। জানলাগুলোর শিকগুলোয় মরচে পড়ে এমন অবস্থা যে টান দিলেই প্যাকাটির মতো ভেঙে পড়বে। সন্তর্পণে ভাঙা জানলাটার কাছে এসে ভিতরে উঁকি দিল ছাতুলাল। আগে চোখের জোর ছিল। অন্ধকারেও জিনিসপত্র ঠাহর পেত। আজকাল চোখে চালসে ধরায় একটু ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখে সে। তবু মনে হল গুণময়ের ঘরে জিনিসপত্র বিশেষ নেই। তাতে সুবিধে এই যে, বিশেষ খোঁজাখুঁজি করে হয়রান হতে হবে না।
পিঠে একটা শুঁয়োপোকা বাইছে নাকি রে বাবা? তা এ জঙ্গলে পোকামাকড়ের অভাব কী? পায়ের কাছে একটা চারা গাছের ডাল ভেঙে পিঠে ঝাপটা মেরে শুঁয়োপোকাটাকে তাড়াল সে। জানলা দিয়ে ভিতরে ঢোকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ভেবে সে জানলার শিকটার দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু কে যেন পিছন থেকে তার বগলে সুড়সুড়ি দিচ্ছে! হাতটা টেনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই তার মুখ হাঁ হয়ে গেল! পিছনেই লিকলিকে সরু হাত-পাওয়ালা একটা লোক, সর্বাঙ্গ হলুদবর্ণ, আর ন্যাড়া মাথায় কয়েকটা চুল খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। গোল-গোল দুটো চোখ, থ্যাবড়া নাক, বিকট মুখ। রাতবিরেতে চুরি করতে বেরিয়ে ভূত-প্রেত সে অনেক দেখেছে বটে, কিন্তু দিনেদুপুরে কখনও নয়।
প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও একটু সামলে নিয়ে সে বলল, “কর্তা, সব জিনিসেরই তো একটা নিয়মকানুন আছে নাকি? রাতবিরেতে দেখা দিন সে এক রকম কিন্তু দিনমানে ফস করে উদয় হলে যে কাজকারবারের বড়ই অসুবিধে!”
ভূতটা কিছু একটা বলল, শোনাল যেন, ‘ভকরম’?
“আজ্ঞে ভয় করি বই কী, খুব ভয় করি। কিন্তু পেটও তো চালাতে হবে!”
তারপর কী হল তা ছাতুলাল জানে না। সে চোখ উলটে পড়ে গেল।