হাবু ভুঁইমালির পুতুল – ৩

হাবু ভুঁইমালি যে আধপাগল লোক এটা সবাই জানে। তার নাওয়াখাওয়ার ঠিক নেই। দিন-রাত্তিরের হুঁশ নেই। শীত-গ্রীষ্মের বোধ নেই। সারাদিন বিড়বিড় করে আর বাড়ির একখানা আলাদা একটেরে ঘরে নানা রকম যন্ত্রপাতি নিয়ে কীসব খুটখাট করে তা সে-ই জানে। হাবু ভুঁইমালির ঘরখানায় কেউ ঢুকলে আঁতকে উঠবে। সারা ঘরে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে হরেক রকমের পুরনো কলকবজা আর যন্ত্রপাতি। কী নেই ঘরে! পুরনো তালাচাবি, অচল পাম্পসেট, বিকল টিউবওয়েল, ভাঙা ক্যামেরা, বন্ধ হওয়া ঘড়ি, চাকাহীন সাইকেল, মরচে পড়া মোটরবাইক, শব্দহীন কলের গান, পুরনো রেডিয়ো। ফেলে দেওয়া সেলাইমেশিন, ঘাড় মটকানো কলের পুতুল। এমনকী, একটা মোটরগাড়ির ইঞ্জিন পর্যন্ত। হাবু যে এসব জিনিস কুড়িয়ে-বাড়িয়ে এনেছে তা নয়। আসলে একসময়ে কলকবজার সারাইকর হিসেবে তার বেশ নামডাক ছিল। যেকোনও জটিল মেশিনই হোক, হাবু ঠিক তা মেরামত করে দিত। তখনই দূরদূরান্ত থেকে লোকে নানা জিনিস হাবুর কাছে সারাতে দিয়ে যেত। তা সেইসব জিনিসেরই কিছু পড়ে আছে। অনেকে সারাতে দিয়ে তারপর ভুলে গিয়েছে। অনেকে পয়সা জোগাড় করতে পারেনি, ফলে নিতে আসেনি। কেউ-কেউ হয়তো গায়েব হয়ে গিয়েছে। হাবুও ভুলো মনের মানুষ। কে কোনটা সারাতে দিয়ে গিয়েছে তা তারও মনে নেই। একখানা খাতায় সব লিখে রাখত, তা সেটাও আজকাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আজকাল কেউ আর হাবু ভুঁইমালির খোঁজখবর তেমন করে না। হাবু একাবোকাই তার ঘরখানায় বসে নানা যন্ত্রপাতি ঘাঁটাঘাঁটি করে। মানুষের চেয়ে যন্ত্রের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব বেশি।

আজ সকালে হাবু খুব আপনমনে বসে একটা কাচের ছোট গ্লাসে ছোট-ছোট চুমুক দিচ্ছিল। কিন্তু চুমুক দিয়ে কী খাচ্ছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছিল না। জিনিসটা একটু তিতকুটে মতো, রংটা খয়েরি। জিনিসটা কী হতে পারে কে জানে। একটু আগে তার ছোট মেয়ে পাঁচি এই গ্লাসটা আর-একটা পিরিচে দুটো বিস্কুট রেখে গিয়েছে। বলে গিয়েছে, “বাবা, খেয়ো কিন্তু।” কথাটা তখন ঠিক মাথায় সেঁধোয়নি হাবুর। সে তখন একটা পুরনো তালা সারাই করছিল মন দিয়ে। তা সেই সময়ে একটা বজ্জাত কাক খোলা দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে এসে পিরিচ থেকে একখানা বিস্কুট ঠোঁটে তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। হাবুর তখন খেয়াল হল, তাই তো, পাঁচি যেন কী খেয়ে নিতে বলে গেল! হুশ হুশ করে কাকটাকে তাড়িয়ে দরজা বন্ধ করে হাবু এখন খাচ্ছে বটে, কিন্তু কী খাচ্ছে তা তেমন মালুম হচ্ছে না। লেড়ো বিস্কুটটাকে চিনতে তেমন অসুবিধে হয়নি, কিন্তু গ্লাসের জিনিসটাই তাকে ধন্দে ফেলেছে। এটা কি চা? না, চা হলে তো গরম হবে আর মিষ্টি-মিষ্টি লাগবে। এ তো ঠান্ডা আর তেতো! তা হলে কি চিরতার জল? তা চিরতার জলই বা খারাপ কী? চিরতার জল খেলে বায়ু-পিত্ত-কফ সব সাবুদ থাকে, কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়, হজমের শক্তি বেড়ে যায়। না বটে, কিন্তু গ্লাসটা গ্লাসটায় কী জিনিস ছিল তা সাব্যস্ত হল শেষ করে ভারী তৃপ্তি হল তার। সে একটা ঢেঁকুর তুলে বলল, “নাহ, চিরতার জল তো বেশ ভাল জিনিস”

ঠিক এই সময়ে পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “ছাই ভাল। চিরতার জল আবার কবে ভাল জিনিস ছিল হে! আর তুমি যেটা খেলে সেটা মোটেই চিরতার জল ছিল না। এটা ঠান্ডা মেরে যাওয়া লিকার চা। তোমার বউ সুরবালার আজ নথ হারিয়েছে বলে মন খারাপ, তাই চায়ে চিনি দিতে ভুলে গিয়েছে।”

গলাটা শুনে হাবু মোটেই চমকাল না। কিছুদিন যাবৎ সে টের পাচ্ছে, এই ঘরে আরও একটা লোক বাস করে। লোকটাকে কখনওই দেখা যায় না, কিন্তু মাঝেমধ্যেই লোকটার গলার স্বর শোনা যায়। অতি কুচুটে লোক। সর্বদাই ফুট কাটে, ভুল ধরে, গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়া মন্তব্য করে। এমনকী হাবুর সঙ্গে মাঝে-মাঝে লোকটার ঝগড়াও লেগে যায়। কিন্তু হাবু বেশি কথা জানে না বলে ঝগড়ায় হেরে যায়। আজ অবশ্য হাবুর ঝগড়া করার মেজাজ ছিল না, তাই শুধু তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “হুঁঃ, আমি যেন চা আর চিরতার ফারাক বুঝি না!”

“বোঝো! তা হলে উলটো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বসে আছ যে বড়!”

“কে বলল উলটো গেঞ্জি! কোথায় উলটো গেঞ্জি!”

ঠিক এই সময়ে দরজার কাছ থেকে একটা গলা খাঁকারির শব্দ পাওয়া গেল। কে যেন বেশ মোলায়েম গলাতেই বলল, “গেঞ্জিটা উলটো বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু।”

হাবু অবাক হয়ে দেখে ভেজানো দরজা ঠেলে একজন লোক খোলা দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে একখানা মোলায়েম হাসি।

হাবু লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি গেঞ্জিটা সোজা করে পরতে যাচ্ছিল। লোকটা বলল, “আহা, থাক না। উলটো গেঞ্জি পরাটা তেমন দোষের মধ্যে পড়ে না। আর তেমন-তেমন কেউকেটা হলে তো কথাই নেই। উলটো গেঞ্জি, উলটো জুতো, উলটো জামা সবই তাদের মানিয়ে যায়।”

কথার প্যাচটা ঠিক ধরতে না পেরে হাবু জুলজুল করে চেয়ে রইল। লোকটার চেহারা বেশ গোলগাল, চালাকচতুর মুখ, পরনে একখানা হাফশার্ট আর পাতলুন, পায়ে চপ্পল। বেশ অমায়িক গলাতেই বলল, “তা আপনিই হাবু ওস্তাদ নাকি? লোকে বলে আপনি হলেন যন্ত্রের জাদুকর।”

হাবু একটু সিঁটিয়ে গিয়ে বলে, না-না, আমি ওস্তাদটোস্তাদ নই। আমি হলুম গে হাবু মিস্তিরি। লোকের কথা ধরবেন না মশাই, আড়ালে লোকে আমাকে পাগলছাগলও বলে।”

“আহা, আমিও তো একজন পাগলকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি!” হাবু ভড়কে গিয়ে বলে, “অ্যা! বলেন কী! পাগল খুঁজতে বেরিয়েছেন?”

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আর কবেন না মশাই, গত পনেরোদিন ধরে পাগলের মতো কেবল পাগল খুঁজে বেড়াচ্ছি। পাগল খুঁজতে খুঁজতে পাগল হওয়ার জোগাড়। কিন্তু পাগলের মতো পাগল পাওয়া কি সোজা কথা? কোনওটা ভাবের পাগল, কোনওটা সেয়ানা পাগল, কোনওটা মতলবের পাগল তো কোনওটা গোঁয়ার পাগল, কেউ বদ্ধ পাগল তো কেউ গুন্ডা পাগল, মত্ত পাগল বা ভাল পাগল, দুষ্টু পাগল বা শিষ্ট পাগল, পাগলের লেখাজোখা নেই মশাই! দেশে যেন পাগলের হাট বসে গিয়েছে। কিন্তু পাগলের মতো পাগল খুঁজেই পেলুম না। এই আজ প্রাতঃকালে আপনার কাছে এসে মনে হচ্ছে আমার এতদিনের পরিশ্রম সার্থক। এত দৌড়ঝাঁপ, এত হয়রানি বৃথা যায়নি। এখানে এসে বেশ একটা পাগল পাগল গন্ধ পাচ্ছি। চারদিকে যেন একটা পাগল-পাগল ভাব ভেসে বেড়াচ্ছে!”

লোকটার কথার মারপ্যাঁচ হাবু মোটেই বুঝতে পারছে না। ভারী বিপদে পড়ে সে টালুমালু করে চারদিকে তাকাতে লাগল।

লোকটা নিজে থেকেই ফের বলল, “আহা, ঘাবড়ে গেলেন নাকি মশাই!”

হাবু মিনমিন করে বলে, “আমি বড় ভিতুসিতু লোক।”

“হ্যাঁ, লোকেও তাই বলে বটে। তারা বলাবলি করে যে, হাবু ভুঁইমালি এমনিতে খুবই ভিতুসিতু লোক, কিন্তু নিজের কাজের জায়গায় সে হল বাঘ। যে-কোনও বিকল হওয়া যন্ত্র তার সামনে ফেলে দাও, সে কয়েক লহমায় সেই যন্ত্রকে সচল করে ছেড়ে দেবে। সে হল যন্ত্রপাগল মানুষ।

হাবু এবার কথাগুলো দিব্যি বুঝতে পারল। একটু খুশিও হল। মাথাটাথা চুলকে বলল, “লোকে পাগলছাগল যাই বলুক, আমি আসলে কলকবজা, যন্ত্রপাতি বড্ড ভালবাসি। আর মানুষের বুদ্ধিরও বলিহারি। কত প্যাচালো, ঘোরালো কলই যে বানিয়েছে! উরেব্বাস রে, ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়।”

“আরে সেই কথা কইতেই তো এত কষ্ট করে, এত দূর ঠেঙিয়ে আসা মশাই। তবে কিনা কথাটথা কইতে গেলে একটু বসাও দরকার। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কথা কয়ে তেমন জুত হয় না কিনা।”

“তা তো বটেই, তা তো বটেই, ” বলে হাবু তাড়াতাড়ি সামনের একটা কাঠের চেয়ার নিজের গামছাখানা দিয়েই ঝেড়েমুছে বলল, “বস্তাজ্ঞে হোক, তবে আমার ঘরখানায় বড্ড ধুলোময়লা আর বেজায় তেলকালি। আপনার হয়তো একটু অসুবিধেই হবে!”

লোকটা চেয়ারটায় গ্যাঁট হয়ে বসে চারদিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে, “না-না, অসুবিধে কী? এ তো এক রকম তীর্থদর্শন। হাবুওস্তাদের জাদুই ঘর বলে কথা! আমার তো মনে হচ্ছে আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি।”

হাবু একটু কাতর গলায় বলে, “আমাকে ঠেলে বড্ড উপরে তুলছেন কর্তা! আমি তেমন কেউকেটা নই। সামান্য মুখ্যু একজন মিস্তিরি মাত্র।”

লোকটা চোখ বুজে যেন খানিকটা ধ্যানস্থ থেকে তারপর বলল, “তা আপনি যা-ই বলুন না কেন, লোকে কিন্তু অন্য কথা বলে। তারা বলে, হাবুওস্তাদ যন্ত্রপাতির বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পায়, যন্ত্রের সুখ-দুঃখ বুঝতে পারে, যন্ত্র যে কথা কয় তা হাবু ওস্তাদ দিব্যি শোনে আর তার জবাবও দেয়।”

হাবু ঘন-ঘন মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “না মশাই, ওসব বাজে কথায় কান দেবেন না। কে যে ওসব রটায় কে জানে!”

“আহা, রটানোর কী আছে মশাই? ফুল ফুটলে, ইঁদুর পচলে, ধূপ জ্বাললে কিংবা গ্যাঁদালপাতা বাটলে কি গন্ধ ছড়ায় না? এও সেই বৃত্তান্ত৷ গুণ কি আর চেপে রাখা যায় মশাই? ও হল আমাশার বেগ, বেরিয়ে পড়বেই। তা সে যাই হোক, একটা জব্বর ফ্যাসাদে পড়েই আপনার কাছে আসা। আপনি উদ্ধার না করলেই নয়।”

“আপনার সমস্যাটা কী?”

“বলছি। তার আগে বলি মশাই, যন্ত্রপাতি বা কলকবজার কি প্ৰাণ আছে?”

হাবু কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, “থাকার তো কথা নয় মশাই। তবে কিনা ওসব আমার ঠিক জানা নেই।”

“তার মানে আপনি কিছু চেপে যাচ্ছেন। বলি, কলকবজার কি ব্যথা-বেদনা বা সুখ-দুঃখ আছে?”

হাবু ভয় খেয়ে জুলজুল চোখে চেয়ে বলে, “অতশত জানি না কর্তা, তবে একবার একটা প্লায়ার দিয়ে একটা নাট টাইট দিচ্ছিলুম সেই সময় কে যেন বলে উঠেছিল, ‘উঃ লাগে!’ তবে সেটা মনের ভুলও হতে পারে। পাগল-ছাগলের কথা ধরবেন না।”

লোকটা উজ্জ্বল মুখে বলল, “আহা, আমি তো আপনার মতো একজন পাগলকেই খুঁজে মরছি। তারপর কী হল?”

হাবু মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “আমার কথা বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে না মশাই। লোকে যে বলে আমার মাথার দোষ আছে, সেটা ঠিকই বলে। আমি ভুল দেখি, ভুল শুনি, ভুল বুঝি, ভুল করি।”

“আহা, সে তো আমিও করি। শুধু আমি কেন, সবাই করে। কে না ভুল দেখছে, ভুল শুনছে, ভুল বুঝছে, ভুল করছে বলুন দিকি! এই তো সেদিন হলধরবাবু জলধরবাবুকে গদাধরবাবু বলে ভুল করলেন। মৃগাঙ্ক ঘোষের ঘরে গোখরো সাপ ঢুকেছিল। কোথায় লাঠি দিয়ে সাপটাকে মারবেন, না উনি সাপটাকে বাগিয়ে ধরে লাঠিটাকে মারতে তেড়ে গেলেন। তারপর কেষ্টবদ্যির কথাই ধরুন। রাত্রিবেলা বটতলায় ফিরিঙ্গি ভূতকে দেখে রামনাম করতে গিয়ে ভুল করে লক্ষ্মণ-লক্ষ্মণ বলে চেঁচামিচি জুড়ে দেন। তাতে বিরক্ত হয়ে ফিরিঙ্গিভূতই ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘দূর মশাই, লক্ষ্মণকে ডাকাডাকি করে কী হবে? রামকে ডাকুন।””

হাবু লোকটার কথার মারপ্যাঁচ মোটেই ধরতে পারছে না। তাই ভয় খেয়ে বলে, “যে আজ্ঞে!”

“তা হলে এবার পরিষ্কার বুঝতে পারছেন তো যে, আপনি একজন যেমন-তেমন লোক নন!”

“আপনার কথা শুনে এখন তাই মনে হচ্ছে বটে!”

লোকটা গম্ভীর মুখে বলল, “এই তো মাত্র তিন-চার মাইল তফাতে কালীতলাহাট, সেখানে যাকেই জিজ্ঞেস করবেন সে-ই বলবে, হ্যাঁ, গুণময় ঘোষ লোক চেনে বটে, কার ভিতরে কী আছে তা এক লহমায় টের পেয়ে যায়।”

“যে আজ্ঞে।”

“মুশকিল কী জানেন, আমি মানুষ চিনতে পারি বটে, কিন্তু কলকবজার ব্যাপারটা ভাল বুঝতে পারি না। সেইজন্যই আপনার কাছে আসা। কলকবজা নিয়ে একটা ভারী সমস্যা হচ্ছে মশাই!”

“তা কোন ধরনের কলকবজা কর্তা? ধানকল, তেলকল, আটাচাক্কি, পাম্পসেট নাকি সেলাইমেশিন?”

“আরে না। ওসব সারানোর মিস্তিরি তো আমাদের গাঁ কালীতলাহাটেও আছে। এ অন্য জিনিস। শুধু অন্য জিনিসই নয়, ভারী আজগুবি জিনিস। হাতখানেক লম্বা একটা পুতুল!”

“পুতুল!” বলে হাঁ হয়ে গেল হাবু।

“পুতুল বলে কি অচ্ছেদ্দা হচ্ছে নাকি মশাই? তা হলে বলি, সেই পুতুল দেখলে আপনার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে।”

হাবু একটু মাথা চুলকে বলে, “আজকাল নানা রকম পুতুল বেরিয়েছে বটে। আপনার পুতুলটায় কি দম দিতে হয়, না ব্যাটারিতে চলে?”

“আচ্ছা মশাই, এই যে আপনি চলে-ফিরে বেড়াচ্ছেন, এই যে আমি হাপরহাটি বকছি, আমাদের ভিতরে কি ব্যাটারি ভরা আছে, নাকি রোজ কেউ দম দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে!”

হাবু ফাঁপরে পড়ে বলে, “মানুষের নিয়ম তো পুতুলের মতো নয়।”

“আহা, সেইটেই তো বলছি, আমার পুতুলটা পুতুলের নিয়মে চলছে না বলেই তো সমস্যা। দম দিতে হয় না, ব্যাটারি নেই, কিন্তু সে দিব্যি চলে-ফিরে বেড়াতে পারে। আরও শুনবেন? সে চোখ পিটপিট করে, কথা কয়, বসে-বসে ভাবে, আমার কথা শুনতে পায়। আর তাজ্জবের ব্যাপার হল যে, ব্যথা পায় এবং ব্যথা পেলে ‘উঃ আঃ’ শব্দ করে। আরও অবাক কাণ্ড, পুতুলটা বড্ড ভিতু।”

হাবু হাঁ করে শুনছিল। বলল, “বটে! মানুষ এরকম আজব পুতুলও বানিয়েছে বুঝি! তা এরকম পুতুল আপনি পেলেন কোথায় কর্তা?”

গুণময় ঘোষ গলাটা একটু নামিয়ে বলে, “কথাটা পাঁচকান হবে না তো?”

হাবু মাথা নেড়ে বলে, “কান কোথায় দেখছেন? টানাটানি করেও এখন কোনও কান আনা যায় না মশাই! একাবোকা পড়ে থাকি। কেউ টেরই পায় না যে, আমি এখনও ধরাধামে টিকে আছি। কানের বড়ই অভাব যাচ্ছে মশাই।”

গুণময় একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে বলে, “কান মোটেই ভাল জিনিস নয় মশাই, কান থেকে মানুষের কত সর্বনাশ যে হয় তার লেখাজোখা নেই। কান যত কমিয়ে ফেলা যায় ততই ভাল। কান থেকেই যত কানাকানি, কান বড় সব্বোনেশে জিনিস।”

“যে আজ্ঞে, তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এখানে কানের বড়ই অনটন।”

“এ তো ভারী ভাল খবর। কিন্তু আমার আবার ওই কান নিয়েই একটু গণ্ডগোল। আচ্ছা, আপনি কানে কেমন শোনেন?”

“আজ্ঞে, ভালই শুনি। কেন বলুন তো?”

“আমিও ভালই শুনি।”

“তাতে গণ্ডগোলের কী আছে মশাই? লোকে কান দিয়ে শোনে, চোখ দিয়ে দেখে, নাক দিয়ে গন্ধ শোঁকে, সোজাসাপটা ব্যাপার।”

“সে তো বটেই। কিন্তু কোনও কিছুর বাড়াবাড়ি কি ভাল? আমি যে কানে বড্ড বেশি শুনি! কেমন জানেন? ওই উঠোনের ওপাশের ঘরে একজন মহিলা কাকে যেন বললেন, ‘ওরে পাঁচি, তোর বাপের ঘরে কে একটা মিনসে এসেছে দেখ তো, চোরছ্যাচড়া নয় তো?’ একজন বুড়োমানুষ বললেন, ‘হারু, বলি তামাক সাজা হল? সেই কখন থেকে তামাকের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছি।””

হাবু ভারী অবাক হয়ে বলে, “মনে হচ্ছে ঠিকই শুনেছেন। পাঁচি আর হারু আমারই ছেলে আর মেয়ে। আপনার তো খুব হুঁশিয়ার কান মশাই।”

“এই কানের জন্যেই আমার বাড়িতে চোরছ্যাঁচড়া আসে না। এই তো গতবছর আমার পাশের বাড়ির নগেন সামন্ত জলের দরে বাড়ি বিক্রি করে চলে গেল। তা যাবে না কেন, কর্তা-গিন্নি মিলে রাত্রিবেলা চুপিচুপি পাড়াপ্রতিবেশীদের নামে নিন্দে করত। পরদিন সকালেই আমি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে সবাইকে বলে দিতুম যে, নগেন সামন্ত আর তার বউ আপনাদের নিয়ে এইসব বলেছে। আর যাবে কোথা! তুমুল ঝগড়া লেগে পড়ত। আমি আবার ঝগড়া শুনতে ভীষণ ভালবাসি কিনা।”

মাথা চুলকে হাবু বলল, “কিন্তু মশাই, কথার ভিড়ে যে পুতুলটাই হারিয়ে গেল।”

“আরে না-না, পুতুলের কথাই হচ্ছে। তা কথাটা হল, আমার কান খুব সজাগ। দিনকুড়ি আগে নিশুতরাতে হঠাৎ আমার বাড়ির বাগানে একটা হুটোপাটির শব্দ শুনে টর্চ আর লাঠি নিয়ে বেরিয়ে দেখি, দুটো লোক হাতে ঠ্যাঙা নিয়ে কী যেন খুঁজছে। বললুম, ‘ওহে বাপু, তোমরা কারা, মতলবটাই বা কী?’ তাদের একজন বলল, ‘আজ্ঞে, একটা খরগোশকে তাড়া করে ঢুকে পড়েছি।’ অবাক হয়ে বললাম, ‘বাপু হে, কালীতলায় কস্মিনকালেও খরগোশ ছিল না। তোমরা ভুল দেখেছ।’ লোকটা বলল, ‘না কর্তা, ভুল নয়। নির্যস খরগোশই বটে। পালাবে কোথায়, যা একখান ঠ্যাঙার ঘা দিয়েছি ব্যাটার ঠ্যাং নিশ্চয়ই ভেঙেছে। নির্ঘাত ঝোপেঝাড়ে পড়ে থাকবে, কাল সকালে এসে খুঁজব।’ তারা চলে গেলে পর আমি ফের শুয়েছি, সবে তন্দ্রা এসেছে। এমন সময় শুনি, বাইরে খুব ক্ষীণ কণ্ঠে কে বলছে, ‘ভজং ভজং, লো পু টে’ কিছু বুঝলেন?”

হাবু সবেগে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে না।”

গুণময় বলে, “আমিও বুঝিনি। কিন্তু বিপদে পড়ে মানুষ যে ভাষাতেই চেঁচাক না কেন, লোকটা যে বিপদে পড়েছে তা যে বোঝা যায়, কী বলেন? আমার যেন মনে হল, কেউ বলতে চাইছে, ‘বাঁচাও বাঁচাও! আমার বড় বিপদ!’ তাই আমি ফের উঠে টর্চ নিয়ে দরজা খুললাম, কিন্তু কেউ কোথাও নেই। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল, চৌকাঠের পাশেই একটা পুতুল পড়ে আছে। ভারী অবাক হলুম। দরজার সামনে পুতুল ফেলে গেল কে? কৌতূহলবশে পুতুলটা তুলে দেখলুম, তার চোখ পিটপিট করছে, মুখে খুব ক্ষীণ গলায় ‘উঃ আঃ’ করছে। মাঝে-মাঝে নিজের ডান পা-টা দেখিয়ে বলছে, ‘ক্যম্বু, ক্যম্বু, পু টাউ, কিছু বুঝলেন?’

হাবু জোরসে মাথা নাড়া দিয়ে বলে, “কিছুমাত্র না।”

“আমিও বুঝিনি। তবে কেন মনে হল, ডানপায়ে খুব ব্যথার কথা বলছে। পুতুলের এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে আমি মশাই ব্যোমকে গেলুম। সত্যি কথা বলতে কী বেশ ভয়-ভয়ও করছিল। কী জানি, মন্ত্রঃপূত পুতুল কেউ ফেলে গিয়েছে কিনা, আমি মশাই একা মানুষ, বড় পৈতৃক বাড়িতে একাই থাকি। ভাবলাম, পাড়ার কাউকে ডেকে আনি। পুতুলটা আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই যেন বলল, ‘নামস, নামস।””

হাবু এবার তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, “আপনি জিজ্ঞেস করার আগেই বলছি মশাই, এ কথাটা আমি বোধ হয় বুঝতে পেরেছি। পুতুলটা আপনাকে লোক ডাকতে বারণ করল।”

“আপনার সঙ্গে আমার মনের ভারী মিল হচ্ছে মশাই! আমারও ঠিক তাই মনে হয়েছিল, তাই আমি আর লোক ডাকলাম না। পুতুলটাকে আমার শোয়ার ঘরে নিয়ে এলাম। কিন্তু টেবিল বা আলমারিতে রাখা গেল না। কারণ, ডান পা-টা এতই জখম যে, দাঁড় করাতে গেলেই ‘উঃ আঃ’ বলে আওয়াজ করে পড়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে তার জন্য আলাদা বিছানা করতে হল। একটা ঝুড়িতে বস্তা পেতে তার উপর তোয়ালে বিছিয়ে দিব্যি বিছানা। বিছানায় শুয়ে আরামে চোখ বুজে বলল, ‘ভুজলহং পো টে’, কিছু বুঝলেন?”

হাবু মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না। তবে মনে হচ্ছে, কোনও ভাল কথাই হবে।”

“ঠিক-ঠিক। আপনার সঙ্গে তো আমার দিব্যি বনিবনা হয়ে যাচ্ছে মশাই! গত পনেরোদিন ধরে পুতুলটার সঙ্গে আমিও কথা বলার নানা চেষ্টা করেছি। তেমন কাজ হয়েছে বলা যায় না। তবে পুতুলটার হাবভাব আর কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, সে কোনও জরুরি কাজে এসেছে। এই গতকাল ইশারা করে সে আমার কাছে কাগজপেনসিল চাইল। তারপরে কাগজে একটা ছবি এঁকে ফেলল পট করে। পাকা হাত মশাই! এই দেখুন ছবিখানা।”

গুণময় তার পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে ভাঁজ খুলে হাবুর হাতে দিয়ে বলল, “কিছু বুঝলেন?”

হাবু অবাক হয়ে দেখে কাগজে পেনসিল দিয়ে একটা দেওয়ালঘড়ি আঁকা। আর সত্যিই আঁকাটা বড্ড ভাল। সে বলল, “এ তো একটা দেওয়ালঘড়ি।”

“কিন্তু তা থেকে কি কিছু বোঝা গেল হাবুওস্তাদ?”

হাবু ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, “যত দূর মনে হচ্ছে, এটা পুরনো আমলের একটা দেওয়ালঘড়ি। বিদেশি জিনিস। আর দেখা যাচ্ছে ঘড়িতে সাতটা বেজে দশ মিনিট।”

“এ ব্যাপারেও আপনার সঙ্গে আমার মতের খুব মিল। আর কিছু বুঝলেন?”

“যে আজ্ঞে, কথাটা হল যাকে আপনি পুতুল ভাবছেন কর্তা, তিনি আসলে একজন ছোট সাইজের মানুষ নয় তো! পুতুল নিজে থেকে কথা কয়, ব্যথা পায়, ছবি আঁকে, এ তো শোনা যায়নি।”

“ওকথা আমারও মনে হয়েছে। কিন্তু মশাই, মানুষ হলে তার তো খিদে-তেষ্টা বলে কিছু থাকবে। নাকি? মলমূত্রাদি ত্যাগের ব্যাপারও আছে। তারপর ধরুন তার বুকে হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনিও হওয়ার কথা! এর তো সেসব বালাই-ই নেই! মানুষ হলে পনেরো দিনে তার চুল-দাড়ি বড় হবে, নখও বাড়বে। সেসব তো হচ্ছে না!”

“না মশাই, ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখতে হচ্ছে!”