হাবু ভুঁইমালির পুতুল – ২

কালীতলাহাটের দক্ষিণে, একটু তফাতে বটেশ্বরের ভাঙা মন্দির। একসময়ে পুজোটুজো হত, এখন চারদিকে জঙ্গল আর সাপখোপের আড্ডা, জনমনিষ্যির যাতায়াত নেই বললেই হয়। এ গাঁয়ের এটাই সবচেয়ে ভয়ের জায়গা, কারণ গত একশো বছর ধরে এবং এখনও এখানে দিনেদুপুরেই বেত্তান্তবুড়িকে দেখা যায়। কাঁকালে ধামা নিয়ে বেত্তান্তবুড়ি কুঁজো হয়ে জঙ্গলে শাক তুলছে। গত একশো বছর ধরে কত লোক যে তাকে দেখেছে তার হিসেব নেই। রাখাল ছেলেরা, গোবরকুড়ুনি আর কাঠকুড়ুনিরা, সাধুফকিররা, চোরছ্যাচড়ারা, ভবঘুরেরা। লোকে বলে, সেই কবে পটল তুলেছে বেত্তান্তবুড়ি তারপর একশো বছর ধরে শাক তুলে যাচ্ছে। শুধু বেত্তান্তবুড়ি হলেও না হয় কথা ছিল। মাঝে-মাঝেই ফুস করে শূন্য থেকে একহাতে বল্লম আর অন্যহাতে ঢাল নিয়ে আবির্ভাব হয় হরিহর ডাকুর। বিশাল পাকানো গোঁফ, গালপাট্টা, ঝাঁকড়া চুল আর কপালে তেলসিঁদুরের তিলক নিয়ে তার সে কী ভয়ংকর চেহারা। সন্ধেবেলা রোগী দেখে ফেরার পথে বুড়ো নগেন কোবরেজ সেই চেহারা দেখে এমন ভিরমি খেলেন যে, তারপর সাতদিন নিজের নামটাও বেবাক ভুলে বসে রইলেন। একা নগেন কোবরেজই নন, পুরুতমশাই নিত্য ভটচায, হোমিয়োপ্যাথ বেচারাম এবং আরও অনেকেই দেখেছে। বটেশ্বরের জঙ্গলে রাতের বেলা যারা ঘুড়ি ওড়ায়, তা নিয়েও লোকের নানা প্রশ্ন আছে। বিধু পাল সাহসী লোক। তিনি ঘুটঘুটি অমাবস্যার রাতে আকাশে টর্চ মেরে দেখেছেন, রীতিমতো ঘুড়ির লড়াই হচ্ছে। এইসব অশৈলী কাণ্ডকারখানার জন্য বটেশ্বরবাবার থানকে সবাই এড়িয়ে চলে। নিতান্ত দায় না ঠেকলে দিনেদুপুরেও কেউ আসে না।

তা সেই বটেশ্বরবাবার মন্দিরের পাশেই জঙ্গলে ঘেরা খানিকটা পরিষ্কার ঘাসজমি আছে। দুপুরবেলায় সেখানে বসে দু’জন লোক নিবিষ্টমনে দাবা খেলছিল। একজন বেঁটে, রোগা, বড় কপাল, রং তামাটে, গায়ে একটা ফতুয়া, পরনে খাটো ধুতি। অন্যজন মুশকো চেহারার মানুষ। কালো, মাথায় ঘন চুল, পরনে প্যান্ট আর কালচে টি-শার্ট।

বেঁটে লোকটা ঘোড়ার একটা চাল দিয়ে মাথা নেড়ে আক্ষেপের সুরে বলল, “নারে, তোর সঙ্গে দাবা খেলে সুখ নেই রে গজা! এবার মাত্র তেরো চালে মাত হয়ে গেলি।”

হোঁতকা লোকটা একটু অবাক হয়ে দাবার ছকের দিকে চেয়ে হেসে বলল, “আমার কী মনে হয় জানেন পটলবাবু? আমার মনে হয়, আপনি বরাবর চোট্টামি করে জেতেন।”

পটলবাবু মোটেই রাগ করল না। ভারী মোলায়েম গলায় বলে, “চোট্টামি করে? তা চোট্টামিটা কোথায় হল বলবি তো!”

“আমার মনে হচ্ছে, আপনি ঘোড়াটাকে আড়াই ঘরের বদলে সাড়ে চার ঘর চেলেছেন।”

পটল ভারী আদরের গলায় বলে, “তাই যদি হবে রে পাগলা, তা হলে কি তুই এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলি? আমি চাল চুরি করলুম আর তুই তা দেখতে পেলি না! দাবা খেলুড়ের চোখ-কান-মাথা যদি জেগে না থাকে, তা হলে সে কেমন দাবাড়ু রে! ওইজন্যই অমন হোঁতকা শরীরটা নিয়ে তুই কিছুই পেরে উঠলি না।”

“আপনার দোষ কী জানেন পটলবাবু, সবসময়ে আমার শরীর নিয়ে খোঁটা দেন। বলি, এমন শরীর বাগাতেও মেহনত লাগে। আপনার মতো শুঁটকো নই বলে কি ফ্যালনা নাকি?”

পটল একটু মিষ্টি হেসে বলে, “আহা, ফ্যালনা কেন রে? শরীরেরও এলেম কম নয়। ভারী কাজে শরীরের দরকার হয়। হুটোপাটা করতে শরীর লাগে। তারপর ধর, কাজকর্ম করতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে হাটুরে মার খেতে হয়, তাতেও শরীরটা মজবুত হওয়া দরকার। রোগাপটকারা কি ওই পাইকারি মার সহ্য করতে পারবে?”

গজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বুঝেছি, আপনি সেই সীতেপুর হাটের ঘটনাটার কথাই সাঁটে বলছেন। কিন্তু মশাই, আপনাকে বাঁচাতে গিয়েই তো আমাকে মার খেতে হল। আপনি নৃপতি মণ্ডলের ট্যাঁক ফাঁক করে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে হাওয়া হলেন। নৃপতি মণ্ডল একটা খন্তা নিয়ে তাড়া করেছিল। আর আমি তার পথ আটকাতেই সবাই মিলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।”

“ওরে, মারধর খাওয়া যে খারাপ জিনিস একথা বলছি না। মার খেলে সহ্যশক্তি বাড়ে, অভিজ্ঞতা হয়, অনেক সময় বুদ্ধিও খুলে যায়। আয়, বরং আর এক দান খেলি।”

“দূর মশাই, আপনার কেবল আমার বুদ্ধি নিয়ে মশকরা, আপনার বুদ্ধি আছে মানছি। তবে সে কেবল দুষ্টুবুদ্ধি।”

পটল একগাল হেসে বলে, “এই তো বুঝেছিস। দুষ্টুমিই যদি করতে হয়, তা হলে তার সঙ্গে একটু বুদ্ধি মিশিয়ে নিলেই কাম ফতে। এই যেমন চায়ে চিনি, ডালে ফোড়ন, শিঙাড়ায় আলু। আয়, দাবা খেলায় কীভাবে চাল চুরি করতে হয়, আজ তোকে শিখিয়ে দিই।”

“না মশাই, ও শিখে আমার কাজ নেই। ওই বসা খেলায় আমার তেমন জুত হয় না। হাডুডু খেললে বরং গা একটু গরম হত।”

“কোথায় হাডুডু আর কোথায় দাবা! এরপর তুই তো কাশীর সঙ্গে তেলেঙ্গানা মিশিয়ে ফেলবি বাপ।”

গজা ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, “এইজন্যই তো আপনার সঙ্গ আমার মোটেই ভাল লাগে না। মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয়, চলেই যাই। নিতান্ত মায়ায় পড়ে আছি বই তো নয়। নইলে আপনার কাজের কায়দা আমার মোটেই পছন্দ নয়।”

পটল অবাক হয়ে বলে, “কেন রে, কাজের ভুল কী দেখলি?” “আপনি সোজা কাজকেও বড্ড প্যাঁচালো করে ফেলেন। এই যে চৌধুরীবাড়ির সাবেক ঘড়িটা বাগাতে গণেশকে শিখিয়ে-পড়িয়ে পাঠালেন। এটা কি ঠিক হল? গনশা গিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে একটা গল্প ফাঁদবে, তারপর পাঁচশো টাকায় ঘড়িটা কিনতে চাইবে। এসব তো কথকতা হয়ে গেল মশাই! তার চেয়ে দুটো রদ্দা মেরে, একটু চোখ রাঙিয়ে আর বন্দুক নাচিয়ে যে কাজটা অনেক সহজে

হয়ে যেত!” পটল কথাটা যেন একটু ভেবে দেখল, তারপর একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, “কথাটা বড় মন্দ বলিসনি। তুই যেভাবে বললি, সেভাবেও কাজ হয়। তবু একটু ভেবে দেখ দিকি বাপ। চৌধুরীবাড়ির মহাদেব মস্ত পালোয়ান। গোটা পরগনা তাকে মান্যিগণ্যি করে। সে যদি বাগড়া দেয়, তা হলে কি হুটোপাটা করে পারবি? তুই হোঁতকা আছিস বটে, কিন্তু মহাদেবের কাছে তুইও যা, আমিও তাই। শাল গাছের সঙ্গে প্যাকাটি। ধরলুম না হয় সেই বাধাটাও টপকানো গেল। কিন্তু দেড়-দু’মন ওজনের ওই পেল্লায় ঘড়ি কাঁধে করে কি দৌড়ে পালাতে পারবি? গাঁয়ের লোকজন, পাড়ার কুকুর কি ছেড়ে কথা কইবে? যদি তেড়ে এসে ধরে তা হলে যে আবার হাটুরে কিল হজম করতে হবে বাপু!”

গজা একটু গরম হয়ে বলল, “কেন মশাই, আমরা কি ভেডুয়া নাকি? বন্দুক-পিস্তল আছে কী করতে?”

পটল চোখ বড়-বড় করে বলল, “বাপ রে! খুনখারাপি, রক্তারক্তি করতে চাস নাকি?”

“তা মশাই, এই লাইনে ওসব তো আছেই।”

পটল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “পিছনে খুনের মামলা আর হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ালে কি জুত হয় রে? পাপ-পুণ্যি বলেও কী একটা কথা আছে যেন! কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, লালসাহেব হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, কোনও রকম মারপিট, রক্তারক্তি যেন না হয়। তাতে পাবলিসিটি হবে আর তা হলে ওই ঘড়ি যারা কিনতে চেয়েছে তারা পিছিয়ে যাবে। মাথাপিছু দশহাজার টাকার যে কড়ার ছিল, তাও যাবে ফুসমন্তর হয়ে। এখন বুঝে দেখ বাপ, নিজের বুদ্ধিতে চলতে চাস কি না।”

গজা পট করে যেন নিবে গেল। তারপর একটু নরম হয়ে বলল, “না পটলবাবু, নিজের বুদ্ধিতে মোটেই চলতে চাইছি না। রক্তারক্তি কাণ্ড আমারও পছন্দ নয়। তবে কিনা গনশাকে এ কাজের ভার না দিলেও পারতেন। সে যদিও যাত্রাপালায় নামে আর পার্টও ভালই করে, কিন্তু এ তো যাত্রাপালা নয়। অনেক গুরুতর ব্যাপার।”

পটল তেমনি মোলায়েম গলাতেই বলল, “ওরে, জীবনটাই তো একটা নাটক। যে যত ভাল প্লে করতে পারে, সে তত সুখে থাকে, বুঝলি?”

গজা খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, “যে আজ্ঞে।”

“এবার আয়, আর-একবার ঘুঁটি সাজাই। তোকে আজ চাল চুরি করা শেখাব।”

খেলাটা অবশ্য বেশিক্ষণ এগোল না। একটু বাদেই গনশা শুকনো মুখে এসে ধপাস করে ঘাসের উপর বসে বলল, “ওহ, একটুর জন্য সুযোগটা ফসকে গেল। টোপে ঠোক্কর পড়ল, তারপর টোপ গিলেও ফেলল। কিন্তু যেই টেনে তুলতে যাচ্ছি, অমনি সুতোটা ছিঁড়ে পালিয়ে গেল।”

পটল কোনও রকম উত্তেজনা দেখাল না। তাকালও না গনশার দিকে। ঠান্ডা গলায় বলল, “বুঝিয়ে বল।”

গজা তেড়েফুঁড়ে উঠে চড়া গলায় বলে, “বুঝিয়ে বলার কী আছে মশাই? এ তো জলের মতো বোঝা যাচ্ছে যে, গনশা হালে পানি পায়নি। আপনারও বলিহারি যাই, এমন একখানা গপ্পো ফাঁদলেন যে, যে-কেউ শুনলে বলবে আষাঢ়ে গপ্পো। একটা সোজা কাজ উদ্ধার করতে এত ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে যাওয়া হচ্ছে কেন সেটাই তো বুঝছি না!”

গজার ঝাঁপ দেখে পটল তেমন ঘাবড়াল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোলায়েম করেই বলল, “গত দু’মাস ধরে তোকে দাবাখেলা শেখাচ্ছিলুম কেন জানিস? তোকে একজন পাকা দাবাড়ু বানাব বলে তো নয়, দাবাটা শিখলে তুই চাল দেওয়ার ব্যাপারটাও বুঝতিস। তোর গায়ে যে জোর আছে সে তো সবাই জানে, বুকের পাটা আছে সেও জানা কথা। কিন্তু শরীরের সবচেয়ে দামি জায়গাটা হল মাথা। তোর মাথাটাই যে তেমন কাজ করতে চায় না। দাবা ছিল তোর মাথার দাওয়াই। দাবায় মাথায় শান পড়ে, বুদ্ধি বাড়ে, নানা রকম ফন্দিফিকির আসে। মাথার জোর যে গায়ের জোরের চেয়ে অনেক বেশি দামি রে পাগলা। আর সেইজন্যই তো দরোয়ানের চেয়ে কেরানির বেতন বেশি।”

গজা একটা ফুঁ দেওয়ার মতো তাচ্ছিল্যজ্ঞাপক শব্দ করে বলল, “আর কবেন না পটলবাবু। মাথার কেরদানি যা দেখালেন তাতে তো মাথাটাই চাটা গেল। ফলটা কী হল বলুন? মহীধর চৌধুরী টের পেয়ে গেল যে তার ঘড়িটার উপর কারও নজর পড়েছে। ফলে সে আরও হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। এখন কি ফের বসে-বসে মাথা খাটিয়ে রবিঠাকুর বা শরৎচন্দ্রের মতো আবার একটা গল্প ফাঁদবেন মশাই? আর তাতেই কি গল্পের ঘড়ি মহীধরের দেওয়াল থেকে নেমে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এসে আপনার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে।”

“তা তুই করতে চাস কী?” “আমার মশাই অত ঘোরপ্যাঁচ পছন্দ নয়। সোজাসাপটা কাজ, খবর নিয়ে দেখেছি, মহাদেব পাইক সন্ধের পর সিদ্ধির শরবত খেয়ে ঘুমোয়। আর কানের কাছে কালীপটকা না ফাটালে তার ঘুম ভাঙে না। বাঞ্ছারামের যে মাছধরার সাংঘাতিক নেশা আছে তা কাকপক্ষীও জানে না। দিনে ফুরসত হয় না বলে সে রাতের দিকে সবাই ঘুমোলে চুপিচুপি খিড়কির দরজায় তালা দিয়ে লন্ঠন আর ছিপ নিয়ে গিয়ে বৈরাগী পুকুরের ধারে মাছ ধরতে বসে যায়। ফিরতে ফিরতে সেই সকাল। যত দূর জানি মহীধরবাবু গিন্নির সঙ্গে ঝগড়া করে এখন ভাঁড়ার ঘরে ঘুমোন। সুতরাং রাস্তা পরিষ্কার। খিড়কির তালা খুলতে এক মিনিট, বৈঠকখানার তালা খুলতে বড়জোর দু’মিনিট। তা হলে মশাই এত ভ্যানতারার দরকারটা কী? আজ রাতেই কাজ উদ্ধার… “”

পটল ফের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

ঠিক এই সময়ে কে যেন বেরসিকের মতো ফিচিক করে একটা হাঁচি দিল। গজা অবাক হয়ে কথা থামিয়ে বলল, “ফন্দিটা কি আপনার পছন্দ হল না পটলবাবু? নইলে ওরকম বেমক্কা হাঁচিটা দিলেন কেন?”

পটল মাথা নেড়ে বলল, “আমি হাঁচিনি রে। বরং তোর প্ল্যানটা আমার পছন্দই হয়েছে।”

“তবে কি তুই হাঁচিটা দিলি গনশা?”

গণেশ মাথা নেড়ে বলে, “গত সাতদিনেও আমার কোনও হাঁচি-কাশি হয়নি।”

গজা লাফিয়ে উঠে বলল, “তা হলে হাঁচল কে? ভূত নাকি?”

পটল নির্বিকার গলায় বলে, “এ জায়গায় ভূতপ্রেতের অভাব কী? এখানে দিনে-দুপুরে ভূত দেখা যায়।”

“বড্ড অশৈলী জায়গা রে! এখানে বোধ হয় গাছপালাও হাঁচেকাশে।”

গজা বিরক্ত হয়ে বলে, “মশকরা বন্ধ করুন তো পটলবাবু।” “ওরে রাগ করিসনি। আমি যেন পষ্ট শুনলুম, এই বুনো করমচার

ঝোপটাই হাঁচিটা দিয়েছে। একটু আগু হয়ে দেখ তো বাপু।”

গজা ঝোপটার কাছে গিয়ে পিছনে উঁকি দিয়েই হাঁ হয়ে গেল। একটা রোগা সিড়িঙ্গে চেহারার লোক ঘাসের উপর আসনপিড়ি হয়ে বসে একটা ছোট খাতায় পেনসিল দিয়ে খুচখুচ করে কী যেন খুব মন দিয়ে লিখছে।

গজা গিয়ে ক্যাক করে লোকটার রোগা ঘাড়খানা তার বাঘা হাতে চেপে ধরতেই লোকটা কাঁইমাই করে বলে উঠল, “আহা! দাঁড়াও-দাঁড়াও। বাক্যটা এখনও শেষ হয়নি যে! এখন বাধা পড়লে যে শেষের কথাগুলো ভুলে যাব। বাক্যটা আগে শেষ করে একটা দাঁড়ি দিই, তবে না!”

লোকটা অবশ্য বাক্যটা শেষ করতে পারল না। গজা তার ঘাড় ধরে বিড়ালছানার মতো শূন্যে ঝুলিয়ে এনে ঘাসের উপর ফেলল, “কে তুই? কী মতলব তোর?”

লোকটার গায়ে একটা ময়লা শার্ট, পরনে হেঁটো ধুতি, চোখে সুতো দিয়ে বাঁধা ভাঙা ডাঁটির একটা চশমা। হাড়-হাভাতে, হাড়গিলে চেহারা। ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “একটা গুরুতর কাজের সময় এরকম হাঙ্গামা করতে আছে?”

“কী এত গুরুতর কাজ তোমার হে?”

“খুবই গুরুতর কাজ। তোমাদের যেসব কথাবার্তা হচ্ছিল সেগুলো হুবহু টুকে নিয়ে দানুবাবুকে দেখাতে হবে যে!”

“অ্যা!” বলে হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল গজা। তারপর ফুঁসে উঠে বলল, “তার মানে! তুমি কি স্পাই নাকি?”

“ওই দেখো, স্পাই হতে যাব কোন দুঃখে! আমি যে দানুবাবুর আড়কাঠি!”

“দানুবাবুর আড়কাঠি! তা এই দানুবাবুটা কে?”

লোকটা গম্ভীর মুখে বলে, “দাঁড়াও বাপু, শেষ বাক্যটা আগে লিখে দাঁড়িটা বসিয়ে নিই। আমার বড্ড ভুলো মন কিনা!”

খাতা খুলে লোকটা খুচখুচ করে কী যেন লিখে খাতাখানা জামার পকেটে ভরে বলল, “দুঃখ কী জানো বাপু, ভগবান আমাকে একটার বেশি মুখ দেননি। দানুবাবুর গুণের কথা কি একমুখে বলা যায়? শতমুখে বলেও শেষ হয় না।”

দাঁত কিড়মিড় করে গজা বলল, “বটে! খুব গুণের লোক বুঝি!”

“তা হলে আর বলছি কী! দানুবাবু হলেন গুণের সমুদ্দুর। একদিকে যেমন গরিবের মা-বাপ, তেমনি বড়লোকদের ঘরজামাই। আবার যদি চোর-ডাকাতদের মাসতুতোভাই তো খুনে-গুন্ডাদের ভায়রাভাই। এই তো পরশুদিন সকালবেলা আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি ইজ়িচেয়ারে ঘর আলো করে বসে পেটের ডানদিকে একটা ফুসকুড়ি চুলকোচ্ছেন। খুব মন দিয়েই চুলকোচ্ছিলেন। আরামে চোখ বুজে এসেছে। ও সময়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে নেই বলে আমি দাঁড়িয়ে ওঁর ফুসকুড়ি চুলকোনো দেখচ্ছিলুম।”

পটল ফস করে বলে উঠল, “এঃ, দানুবাবুর ফুসকুড়ি আছে নাকি? ফুসকুড়ি হওয়া তো মোটেই ভাল নয় হে বাপু!”

লোকটা সবিস্ময়ে পটলের দিকে চেয়ে বলে, “বলো কী হে! এ যে দানুবাবুর ফুসকুড়ি! দানুবাবুর ফুসকুড়ির দাম জানো?”

পটল বলে “তা উনি ফুসকুড়ি বেচেন নাকি?”

লোকটা নিজের মতো হেসে বলে, “ফুসকুড়ি বেচবার দরকারটা কী বলো তো দানুবাবুর? এমনিতেই তো ওঁর টাকার লেখাজোখা নেই। ওঁর আয়ের হিসেব রাখতে তিন-তিনজন ক্যাশিয়ারবাবু দিনরাত হিমশিম খাচ্ছেন। দানুবাবু তো মাঝে-মাঝেই বলেন, ‘ওরে এত টাকায় আমার যে দমবন্ধ হয়ে আসছে। তোরা গরিব-দুঃখীকে টাকাগুলো বিলিয়ে দে, বিলিয়ে দে।”

পটল ফের বলে, “তা দিলেন নাকি বিলিয়ে?”

“এখনও বিলোনো শুরু হয়নি বটে, তবে ঠাকুরমশাইকে দিয়ে পাঁজিতে দিনক্ষণ দেখানো হচ্ছে।”

গজা ধৈর্য হারিয়ে বলে উঠল, “ওহে বাজে কথা ছেড়ে আসল কথায় এসো। দানুবাবু তোমাকে আমাদের পিছনে আড়কাঠি হিসেবে লাগিয়েছেন কেন?”

“সেটাই তো বলছিলুম হে। ফুসকুড়ির কথায় আর পাঁচটা কথা এসে পড়ল। হ্যাঁ, যা বলছিলুম, দানুবাবু প্রায় মিনিটপাঁচেক ফুসকুড়ি চুলকোলেন। তারপর রুপোর বাটা থেকে একটা বেনারসি পাত্তির খিলিপান আর জর্দা মুখে পুরলেন। তারপর পোষা কুকুর ভুলোকে মাথায় হাত দিয়ে আদর করলেন। তারপর বিশু পিকদানি ধরার পর পিক ফেলে একটা ঢেঁকুর তুললেন।”

গজা ফুঁসে উঠে বলে, “একটা থাবড়া দেব নাকি?”

লোকটা একটু কুঁকড়ে গিয়ে বলে, “আহা, দানুবাবুর কথা তো তোমরাই শুনতে চাইলে।”

“আমাদের ল্যাজে খেলাচ্ছ বাপু? আসল কথাটা খোলসা করো। নইলে মুণ্ডু কিন্তু হাঁটুতে খসে পড়বে।”

“বলছি-বলছি বাপু, একটু হাঁফ ছাড়তে দেবে তো! আমার বড্ড নরম শরীর। হুড়যুদ্ধ মোটে সহ্য হয় না। হ্যাঁ, কী বলছিলাম যেন! ফুসকুড়ির কথা হল, পিক ফেলার কথাও হল, না? হ্যাঁ, তারপর দানুবাবু কয়েকটা হেঁচকি তুললেন। জর্দা খেলে দানুবাবুর হেঁচকি ওঠে, এটা রোজ দেখছি। তা হেঁচকি ওঠাতে দানুবাবু হরিপদকে জল দিতে বললেন। হরিপদ রুপোর গ্লাসে ঠান্ডা জল কুঁজো থেকে গড়িয়ে দিল। সাত চুমুক জল খাওয়ার পর দানুবাবুর হেঁচকি থামল। তারপর…”

ঠিক এই সময় গজার থাবড়াটা চটাস করে মাথায় পড়তেই লোকটা কেঁউ করে কঁকিয়ে উঠল। তারপর ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “দিলে তো কথাগুলো গুলিয়ে! আচ্ছা আহাম্মক তো তুমি বাপু! মানুষের মাথা কত দামি জিনিস জানো? যত ফন্দিফিকির, যত বুদ্ধি, যত মতলব সব কিছুর ভাঁড়ারঘর হল মাথা। সেখানে কেউ মারে? আমি তো সবাইকেই বলি, ওরে বাপু, একটুআধটু মারধর করিস ক্ষতি নেই। কিন্তু মাথাটা বাঁচিয়ে! তা তোমার থাবড়ার চোটে এখন তো আমার মাথায় সব জট পাকিয়ে গিয়েছে হে। নিজের নাম, বাপের কিছুই মনে পড়ছে না! এ তো ভারী মুশকিল হল! এখন বাড়িই বা ফিরব কী করে? কোথায় বাড়ি তাই তো মনে পড়ছে না!”

পটল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “এইজন্যই তো দাবা খেলতে বলি রে গজা! দাবা খেললে মানুষের ধৈর্য বাড়ে।”

গজা ফুঁসে উঠে বলল, “এ লোকটা যে আমাদের বোকা বানাতে চাইছে পটলবাবু!”

পটল শান্ত গলায় বলে, “বোকা আর বানাবে কী, বোকা তো আমরা বনেই আছি।”

এ কথা শুনে লোকটা হঠাৎ একটু উজ্জীবিত হয়ে বলে, “হ্যাঁহ্যাঁ, ঠিক কথা হে! দানুবাবু জল খাওয়ার পর হেঁচকি বন্ধ হল। তারপর দানুবাবু তাঁর পোষা কুকুর বাঘার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। করমচা গাছে একটা মাছরাঙা পাখি বসে ছিল। সেটার দিকে খুব মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর নাকের ডগা থেকে একটা ভনভনে মাছিকে হাতের ঝাপটা মেরে তাড়িয়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ওরে চরণদাস, তিনটে বোকা লোক কালীতলাহাটের চৌধুরীবাড়ির পুরনো দেওয়ালঘড়িটা হাতাতে চাইছে। এ খবরটা খুবই ভাল। আমাকে আর গা ঘামাতে হবে না। ঘড়িটা ওরাই চুরি করুক। তুই শুধু ওদের ফন্দিফিকিরটা আড়াল থেকে শুনে টুকে আনবি। যেই ওরা ঘড়িটা চুরি করে বেরবে, অমনি আমার লোকজন গিয়ে ওদের উপর চড়াও হয়ে ঘড়িটা বাগিয়ে আনবে।”

গজা চোখ বড়-বড় করে বলল, “সর্বনাশ! ঘড়ির খবরটা দানুবাবুও জানে!”

চরণদাস ক্যালক্যাল করে হেসে বলল, “গোটা পরগনার খবর দানুবাবুর নখদর্পণে। তোমাদের নামধামও জানেন। ওই রোগাপটকা খেঁকুরে লোকটা পটল, ওই মিটমিটে বদমাশটা গনশা আর তুমি হচ্ছ হোঁতকা গজা। ঠিক বলেছি?”

পটল হাসি হাসি মুখ করে বলে, “ঠিকই বলেছ বাপু চরণদাস! আমরা বোকাই বটে। তা হলে দানুবাবুও ওই দেড়শো বছরের পুরনো একখানা দেওয়ালঘড়ির জন্য হামলে পড়েছেন বলছ? কিন্তু ওই দেওয়ালঘড়ির মধ্যে এমন কী হাতি-ঘোড়া আছে বলো তো বাপু!”

চরণদাস সবেগে মাথা নেড়ে বলে, “ওসব আমার জানা নেই। জানা বারণ কিনা। দানুবাবু বলেন, বোকাদের বেশি জানতে নেই। তবে দানুবাবু বলেছেন, কাজটা উদ্ধার করতে পারলে তিনশো টাকা দেবেন। একশো আগামও পেয়েছি কিনা। দানুবাবুর বড্ড দরাজ হাত। গরিবের মা-বাপ বললেও হয়।”

গজা দাঁত কিড়মিড় করে উঠে চরণদাসকে হাঁটু দিয়ে একটা গুঁতো মেরে ফেলে দিল। চরণদাস “বাপ রে, মা রে” বলে চেঁচিয়ে কেমন যেন চোখ উলটে মূর্ছামতো গেল। গজা তার জামার পকেট থেকে ছোট খাতাটা বের করে উলটেপালটে দেখে বলল, “বুঝলেন পটলবাবু, খাতায় আমাদের কথাবার্তাগুলোই হুবহু টোকা আছে। দানুবাবুর হাতে এই খাতা গেলে আমাদের ঘড়িচুরির বারোটা বেজে গেল। আমি এক্ষুনি এটাকে পুড়িয়ে ফেলছি।”

এই বলে পকেট থেকে দেশলাই বের করে জ্বালাতে যাচ্ছিল গজা, হঠাৎ সামনের তেঁতুল গাছের ডালপালায় হুড়মুড় শব্দ করে একটা সাজোয়ান লোক লাফ দিয়ে থামল। তারপর “করো কী, করো কী?” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ধেয়ে এল গজার দিকে।

আচমকা ঘটনাটায় চমকে গিয়েছিল গজা। লোকটা কাছে এসে ফস করে খাতাটা কেড়ে নিয়ে বলে, “আর একটু হলেই যে সর্বনাশ হয়ে যেত হে! নীলকান্তবাবু কি তা হলে আমাকে আস্ত রাখতেন?”

গজা রুখে উঠে বলল, “তুমি আবার কে হে, আচমকা উদয় হয়ে হুজ্জত লাগিয়েছ! আস্পদ্দা তো বড় কম নয়!”

লোকটা চোখ পাকিয়ে বলল, “তোমার আক্কেলের বলিহারি যাই! এমন মূল্যবান খাতাটা পুড়িয়ে ফেলছিলে? খাতাখানার দাম জানো? এই খাতাখানার জন্য নীলকান্তবাবু পাঁচশো টাকা কবুল করেছেন। এটি তাঁর চরণে নিবেদন করলে নগদ কড়কড়ে পাঁচশো টাকা। বুঝলে? এই তো পরশুদিন সকালবেলায় আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওরে খাঁদু, কিছু রোজগার করতে চাস? তা হলে একটা সোজা কাজ করে দে বাবা। পাঁচশো টাকা পাবি৷ কাজটা হল, তিনজন উটকো লোক কালীতলাহাটের চৌধুরীবাড়ির পুরনো দেওয়ালঘড়িটা চুরি করার মতলব আঁটছে। আর চোরের উপর বাটপাড়ি করতে হুতোমপুরের দানুবাবু তার আড়কাঠি চরণদাসকে লাগিয়েছে ওদের ফন্দিফিকিরগুলো শুনে টুকে আনতে। তোর কাজ খুব সোজা। তুই চরণদাসের পিছু পিছু গিয়ে আবডালে লুকিয়ে থাকবি। পরপর চরণদাসের কাজ হয়ে গেলে খাতাখানা তার কাছ থেকে ছিনতাই করে সোজা আমাকে এনে দিবি। এই নে, পঞ্চাশ টাকা রাহাখরচ।”

শুনে তিনজনেই হাঁ হয়ে গেল।