১
বাড়িখানা দেখলেই ভক্তিশ্রদ্ধা হয়। যদিও আগেকার বাহার আর নেই। চারদিকের অনেকটা জমিতে আগে রংবাহার বাগান ছিল, এখন সব আগাছায় ভর্তি। বাড়ির দুটো মহলের কোনওটাই পুরোপুরি আস্ত নেই। দেওয়ালের চাপড়া খসে পড়েছে, দেওয়ালে গাছ গজাচ্ছে। শোনা যায় চৌধুরীবাড়িতে অগুন্তি ঘর। তা সব ঘরে বসবাস করার লোক নেই, ফলে বেশির ভাগ ঘরই তালাবন্ধ করে রাখা রয়েছে। ঝাঁটপাট দেওয়া, ঝুলঝাড়া ইত্যাদি বহুকাল বন্ধ। শোনা যায়, সন্ধের পর নাকি চৌধুরীবাড়িতে ভূতের মোচ্ছব লেগে যায়। মহীধর চৌধুরী অবশ্য এসব জনশ্রুতিতে মোটেই বিশ্বাস করেন না।
গাঁয়ে রটনা আছে যে, মহীধর চৌধুরীর টাকার কোনও লেখাজোখা নেই। কিন্তু লোকটা হাড়কেপ্পন। মহীধর চৌধুরী কিন্তু একথাটা অস্বীকার করেন না। তিনিও জানেন যে, তিনি বড়ই কৃপণ। মাঝে-মাঝে তিনি মহাদেব বা বাঞ্ছারামের কাছে কাতর ভাবে বলেও ফেলেন, “ওরে, আমাকে দানধ্যান করতে বলিস না! প্রাণে ধরে যে আমি কাউকে কিছু দিতে পারি না। দিতে গেলে আমার খুব বুক ধড়ফড় করে, হাতে-পায়ে কম্পন হয়, তেষ্টা পায়, উদগার উঠতে থাকে।”
মহাদেব আর বাঞ্ছারাম এ বাড়ির পুরনো কাজের লোক। ওদের বয়স হয়েছে, যাওয়ারও জায়গা নেই ফলে পড়ে আছে। মহাদেব একাধারে পাইক, বরকন্দাজ, দরোয়ান এবং ফাইফরমাশ খাটার লোক। আর বাঞ্ছারাম হল ঘরদোর সামলে রাখা, বাজার করা এবং হিসেবপত্র রাখার মানুষ। এছাড়া বাড়ির নিত্যপূজা করার জন্য পুরুতমশাইয়ের যাতায়াত আছে। এছাড়া আর সব কাজের লোককে মহীধর ছাড়িয়ে দিয়েছেন।
আজ সকালবেলায় সামনের বারান্দায় রোদে বসে আছেন মহীধর। পাশে একটা টুলে হিসেবের খাতা হাতে বাঞ্ছারাম। মহীধর চোখ বুজে খুব মন দিয়ে গত তিনদিনের দানধ্যানের হিসেব শুনছেন। বাঞ্ছারাম বলছিল, “আজ্ঞে, গত মহালয়ায় ভিখু ভিখারিকে একখানা বাসি রুটি আর গুড় দেওয়া হয়েছে। সেইদিনই হাবু ঝাড়ুদারকে গিন্নিমা আপনার একজোড়া পুরনো ছেঁড়া জুতো দিয়েছেন। বুধবার রাখিবোষ্টমীকে একটা আধুলি দেওয়া হয়েছে। আর পাড়ার দুর্গাপুজোর চাঁদা বাবদ প্রথমে দু’টাকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা চাঁদার টাকা ফেরত দিয়ে যায়। পরে বাড়িতে ঢিলপাটকেল পড়ায় পাঁচ টাকা দিতে হয়েছে। তা বাবু, এই চাঁদাকে কি দানের খাতে ধরতে হবে? নাকি চাঁদা?”
মহীধর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “চাঁদাও এক রকম দান বই কী!”
“তা হলে এক কাজ করি। চাঁদায় লিখে রাখি। তাতে চাঁদাও রইল, দানও রইল।”
অন্যমনস্ক মহীধর কথাটা শুনতে পেলেন না। চিড়বিড় করে বললেন, “পাঁচ টাকা চাঁদা! এর পর কি সোনা দিয়ে দুর্গামূর্তি গড়ে পুজো করতে হবে নাকি!”
বাঞ্ছারাম চাপা গলায় বলে, “পাঁচ টাকা তো নিয়েছে শুধু আপনি বলেই। আর সবাই তো পঞ্চাশ টাকা করে দিয়েছে।”
মহীধর শিহরিত হয়ে বললেন, “মরবে! মরবে! পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দুর্গোৎসব করার চেয়ে নাস্তিক হওয়া ভাল।”
“এবার বেস্পতিবারের হিসেবটা বলি বাবু। বেস্পতিবার পুরুতমশাই চন্দ্রকান্ত ভট্টাচার্যকে একটা পুরনো ছাতা দেওয়া হয়েছে। আর শ্রীধর কীর্তনীয়াকে এক পো চালের সিধে আর দুটো কাঁচকলা।”
“ওরে বাবা রে! এ তো দেখছি দধিকর্দমের ব্যবস্থা। এরকম চললে তো ভিক্ষের বাটি নিয়ে গিয়ে গাছতলায় বসতে হবে।”
বাঞ্ছারাম মাথা চুলকে বলল, “তা কী করবেন বাবু, এই বংশের একটা ধারাও তো আছে। আপনার বাপ, ঠাকুরদা, তস্য পিতা, পিতামহের একটা দানধ্যানের খ্যাতি তো ছিল। লোকে এখনও বলে, চৌধুরীবাড়ি থেকে কেউ কখনও খালি হাতে ফিরত না।”
“তোর একটা দোষ কী জানিস বাঞ্ছা, তুই কথায় কথায় বড্ড বিশেষণ ব্যবহার করিস। হিসেবের খাতায় অত বিশেষণ বসানো কি ভাল? কথায় আছে ‘শতং বদ, মা লিখ’। অর্থাৎ মুখে যা বলার বলতে পারো, কিন্তু খবরদার লিখতে যেয়ো না।”
“আর একটু খোলসা হন কর্তা হিসেবে কি কোনও ভুল কথা লিখেছি?”
“শোন, যখনই কিছু লিখবি তখন সেটা ইতিহাস হয়ে গেল। মুখের কথা হাওয়ায় উড়ে যায় কিন্তু লেখা জিনিস তো আর তা নয়। ওই হিসেবের খাতা যখন দশ বছর পর কেউ খুলে দেখবে, তখন আমার বদনাম করবে না?”
“আর একটু বুঝিয়ে বলুন কর্তা।”
“ওই বিশেষণের কথাই বলছিলুম আর কী। ওই যে লিখেছিস ভিখুভিখিরিকে একখানা বাসি রুটি আর গুড়, ওই ‘একখানা’ আর ‘বাসি’ এ দুটোই হল বিশেষণ এবং বাড়তি শব্দ। ও দুটো কেটে দে। শুধু লেখ ভিখুভিখিরিকে রুটি ও গুড়। তাতে শ্যামও রইল, কুলও গেল না বুঝলি?”
“যে আজ্ঞে।”
“আর হাবু ঝাড়ুদারকে পুরনো ছেঁড়া একজোড়া জুতো দেওয়ার কথাটা কি লেখা ঠিক হল? শুধু একজোড়া জুতো দেওয়া হয়েছে লিখলেই তো হয়। আর রাখিবোষ্টমীকে যত দেওয়া হয়েছে তার অত খতেনে যাওয়ার দরকার কি? লিখে রাখ কাঞ্চনমূল্য। আর চাঁদা কেটে ধর্মার্থে দান বলে লিখে রাখলেই তো হয়। ছাতার আগে পুরনো কথাটা কেটে দে। আর শ্রীধর কীৰ্তনীয়াকে চাল, কাঁচকলার পর একটা ইত্যাদি যোগ করে দে।”
“এই দিচ্ছি বাবু। আপনার কাছে বসলে অনেক শিক্ষে হয়।”
শুক্রবারের হিসেবটা শুরু করার মুখে একটা বাধা পড়ল। বাড়ির নেড়ি কুকুরটা ঘেউ-ঘেউ করে ফটকের দিকে ছুটে যেতেই মহীধরবাবু বললেন, “ওরে বাঞ্ছা, দেখ তো ফটকের বাইরে ওই লোকটা কোন মতলবে দাঁড়িয়ে আছে। ভিখিরি নাকি?”
বাঞ্ছা ভাল করে দেখে বলে, “না কর্তা ভিখিরি নয় বোধ হয়।” “তবে?”
“গরিব লোক বলেই মনে হচ্ছে, তবে ভিখিরি নয়। হাতে একটা ঝোলা আছে দেখছি।”
“ঝোলা! ওরে বাবা, ঝোলা বড় সর্বনেশে জিনিস! ঝোলা থেকে ছোরাছুরি, পিস্তল, বোমা বেরতে পারে, শীতলা মায়ের ছবি বেরতে পারে, বাতের তেল বা ইঁদুর মারার ওষুধ বেরতে পারে, চাঁদার খাতা বা ভানুমতীর খেল বেরতে পারে। যা, লোকটাকে বিদেয় করে আয়। বল এখানে কিছু হবে না।”
“তার আর দরকার নেই কর্তা। লোকটা ইদিকপানেই আসছে।” উটকো লোক দেখলেই মহীধরবাবুর অস্বস্তি হয়। কালোয়ার, জ্যোতিষী, সাধু, গেরুয়াধারী, অনাথ আশ্রমের লোক, বিমার দালাল, উৎপাতের কি শেষ আছে?
লোকটার বয়স বছর তিরিশেক হবে। পরনে একটা ময়লা খাকি পাতলুন, গায়ে একটা সবুজ রঙের জামা, লম্বা ছিপছিপে চেহারা। মুখটা দেখে গুন্ডা-বদমাশ, বদলোক বলে মনে হয় না। তবে মনে হওয়াকে তেমন বিশ্বাস করেন না মহীধর। লোকটার গায়ের রং বোধ হয় একসময় ফরসাই ছিল, এখন একটু তামাটে হয়ে গিয়েছে। মহীধর হেঁকে বললেন, “কে হে তুমি? কী মতলব?”
লোকটা বারান্দার সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে হাতজোড় করে বলল, “নমস্কার কর্তা, আজ্ঞে, আমি একজন মিস্তিরি।” মহীধর অবাক হয়ে বললেন, “মিস্তিরি! তা বাপু আমি কোনও মিস্তিরিকে ডাকিনি তো!”
লোকটা বলে, “আজ্ঞে না কর্তা আপনি ডাকেননি, আমি নিজে থেকেই এসেছি। যদি অনুমতি করেন দুটো কথা নিবেদন করি।”
“কী কথা বাপু? আমার বাড়িতে কোনও কলকবজা সারানোর নেই, এটা তোমায় বলে দিলুম। এবার এসো গিয়ে!”
“যে আজ্ঞে, আপনি যখন শুনতে চান না তখন আর বলে কী হবে? তবে কিনা শুনলে বোধ হয় আপনার ভালই হত কর্তা।”
বাঞ্ছারাম গলা খাঁকারি দিয়ে মহীধরের কানের কাছে মুখ নামিয়ে চাপা গলায় বলল, “আজ্ঞে কর্তা কারও কথা শুনতে তো পয়সা খরচ হচ্ছে না। কথাটা শোনাই বোধ হয় ভাল কাজ হবে।”
মহীধর মাথা নেড়ে বললেন, “তুই জানিস না, কথা কইলেই লোকেরা পেয়ে বসে। নানা কথার প্যাঁচপয়জারে শেষ পর্যন্ত খরচের ধাক্কায় নিয়ে ফেলে। সেই যে গত ফাল্গুনে একটা লোক এসে জল খেতে চাইল মনে নেই? তারপর ধানাই-পানাই কথা কইতে-কইতে শেষে সস্তায় বেগুন দেওয়ার নাম করে দুটো টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল?”
“কিন্তু কর্তা আমাদের এখন মিস্তিরির সত্যিই দরকার। বৈঠকখানার ঘরটা বহুকাল বন্ধ হয়ে পড়ে আছে বটে কিন্তু আপনি কি জানেন যে বৈঠকখানার বড় ঘড়িখানা তিন-চারদিন আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে?”
“কই, জানি না তো!”
“আপনি কি জানেন, ঘড়িটা বন্ধ হওয়াতে গিন্নিমা গত চারদিন ধরে ঘুমোতে পারছেন না? আর অনিদ্রার ফলে তাঁর অম্বল হয়েছে?” “অনিদ্রা হচ্ছে? কই আমি টের পাইনি তো?”
“কী করে পাবেন? গতমাসে দু’সের সর্ষের তেল খরচা হয়েছে শুনে গত মঙ্গলবার সকালে যে আপনি মূর্ছা গেলেন, তাতেই গিন্নিমার সঙ্গে আপনার রাগারাগি হওয়ায় গত পাঁচদিন তো আপনি ভাঁড়ার ঘরে মাদুর পেতে শুচ্ছেন।”
মহীধর গম্ভীর হয়ে বললেন, “ও হ্যাঁ, তা বটে।”
ঘণ্টায়—ঘণ্টায় ঘড়িটা ভারী সুরেলা মিঠে একটা আওয়াজ করত। সেইটে বন্ধ বলে গিন্নিমার অনিদ্রাই শুধু নয়, ছোট খুকি তো পুতুলখেলা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের কোণে বসে কেবল কাঁদে। বড় খুকি তো কেবল জানলায় দাঁড়িয়ে ছলছলে চোখে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে, মুখে কথা নেই। খোকাবাবুর সামনেই পরীক্ষা, কিন্তু লেখাপড়ায় মোটেই মন বসছে না। আর কাজের মেয়ে সর্বমঙ্গলা বলেছে, “ও বাবা! দেড়শো বছরের ঘড়ি যখন বন্ধ হয়েছে, তখন এ বাড়িতে নির্ঘাত কোনও অমঙ্গল ঘটবে। আমি আর এ বাড়িতে কাজ করতে পারব না বাপু।”
মহীধর বিরক্ত হয়ে বললেন, “তা ঘড়িটা যে বন্ধ হয়েছে সেটা আমাকে জানাসনি কেন?”
“ও বাবা! কে জানাবে? গতমাসে দু’সের সর্ষের তেল খরচ হয়েছে শুনে আপনি মূর্ছা গিয়েছিলেন, এখন ঘড়ি সারাইয়ের কথা শুনে যদি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে বিবাগী হয়ে যান বা হার্টফেল হয়, সেই ভয়েই কেউ কথাটা আপনার কানে তোলেনি।”
মহীধর তেতো মুখ করে বললেন, “আহা, ঘড়ি বন্ধ হয়েছে বলে সারাইকরই বা ডাকতে হবে কেন? পুরনো ঘড়ি, ও একটু নাড়া বা ঝাঁকুনি দিলেই হয়তো চলতে শুরু করবে। একটু তেলটেল দিয়েও দেখা যেতে পারে।”
“সাতফুট লম্বা, দেড়-দু’মন ওজনের ঘড়ি নাড়া বা ঝাঁকুনি দেওয়া তো সোজা কথা নয় কর্তা। আর তেল দেওয়ার কথা বলছেন, তেল দিতে হলেও তো ঘড়ি নামিয়ে তার পিছনের ঢাকা খুলতে হবে। সারাইকর ছাড়া কে করবে ওসব?”
“তোর সব কথাতেই কেবল মোচড়। পজিটিভ কিছু ভাবতে শিখলি না! তোর কি মনে হয় যে, বিদেশি দামি ঘড়িটা ওই গেঁয়ো সারাইকর বিনে পয়সায় সারিয়ে দিয়ে যাবে? ওই বিদেশি ঘড়ির কলকবজার ও কি জানে?”
“তা বটে কর্তা! তবে কিনা লোকটা আপনাকে কিছু একটা বলতে চাইছিল। একটু শুনলে তো পয়সা খরচ হত না।”
“তা না হয় ডাক লোকটাকে। কথা কয়ে দেখ। আমি কিন্তু লোকটার ভাল বুঝছি না।”
বাঞ্ছারাম হাতের ইশারায় ডাকতেই লোকটা ভারী জড়সড় হয়ে সংকোচের সঙ্গে উপরে উঠে এসে মেঝের উপর উবু হয়ে বসে একগাল হেসে বলল, “তা কর্তাবাবু, পেল্লায় বাড়িখানা আপনার, রাজা-জমিদারের বাড়ি বলেই মনে হয়। তবে কিনা বাড়িটার তেমন যত্ন হচ্ছে না।”
মহীধর গম্ভীর হয়ে বললেন, “বাজে কথা ছেড়ে কাজের কথায় এসো তো বাপু। কী যেন বলবে বলছিলে!”
“আজ্ঞে, বলার জন্যই তো আসা। তবে কথাটা আপনার ঠিক বিশ্বাস হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
“কেন হে, কথাটা বিশ্বাস হবে না কেন?”
“আজ্ঞে, কথাটা আমারই কেমন যেন বিশ্বাস হয় না। তবে কিনা কথাটা না বললেও নয়। কী বলব কর্তামশাই, সেই দোয়াপুর ছাড়িয়ে এগারো মাইল উত্তরে মিঠাপানি গাঁ থেকে এই কালীতলাহাটে এসেছি শুধু কথাটা আপনার শ্রীচরণে নিবেদন করব বলে।”
মহীধর একটু শঙ্কিত হয়ে চাপা গলায় বাঞ্ছারামকে বললেন, “কথার প্যাঁচটা ধরতে পারছিস? রাহাখরচ চাইবার মতলব নাকি?”
বাঞ্ছাও চাপা গলায় বলে, “আহা চাইলেই বা দিচ্ছে কে? আপনি তো টাকার খোলামকুচি ছড়াতে বসেননি।”
“তা তো বটেই। তবু যদি দেখিস আমাকে কথার প্যাঁচে কাবু করে ফেলেছে, তা হলে তুই হাল ধরিস বাবা।”
“আপনাকে কথার প্যাঁচে কাবু করে ফেলবে এমন সুপুত্তুর এখনও জন্মায়নি কর্তা।”
“কেন সেই মাদুলিবাবার কথা মনে নেই? এমন সব ভয়ংকর কথা বলে ভয় দেখাতে লাগল যে, তোদের গিন্নিমা মূর্ছা যায় আর কী! তার কান্নাকাটিতে শেষ পর্যন্ত একশো টাকার মাদুলি নিতে হয়েছিল।”
“আজ্ঞে কর্তা, একশো টাকার মাদুলি আপনি দরাদরি করে শেষে দেড় টাকায় কিনেছিলেন। মনে নেই?”
“ওই একই হল। দেড় টাকাই কম কিসে?”
লোকটা জুলজুল করে দু’জনের দিকে চেয়ে ছিল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আজ্ঞে কর্তা, আপনাদের কথাবার্তা হয়ে গেলে বলবেন। আমি না হয় একটু বসছি।”
মহীধর গম্ভীর হয়ে বললেন, “না হে বাপু, তোমার আর বসে থাকার দরকার নেই। মোদ্দা কথাটা বলেই কেটে পড়ো।”
লোকটা ভারী বিগলিত হাসি হেসে বলল, “জানি, আপনি ভারী কাজের মানুষ। তা অভয় দেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করি।” “কী কথা?”
“আপনি স্বপ্নাদেশে বিশ্বাস করেন?”
“না হে বাপু, স্বপ্নাদেশ, দৈববাণী, তাবিজ, মাদুলি, মারণ, উচাটন কোনও কিছুতেই আমার বিশ্বাস নেই।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে, মেমসাহেবও এই রকমই বলেছিল বটে।”
মহীধর অবাক হয়ে বলেন, “মেমসাহেব! এর মধ্যে মেমসাহেব আবার আসছে কোত্থেকে?”
লোকটা যেন ভারী আতান্তরে পড়ে বলে, “আজ্ঞে সেইটেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। জীবনে কখনও সাহেব-মেমই দেখিনি। আমাদের গাঁয়ের দু’-চারজন বুড়োমানুষ সাহেব-মেম দেখেছে বটে, বেজায় ফরসা, নীল চোখ, ক’টা চুল। সত্যি নাকি কর্তামশাই? ফরসা বলতে তো আমাদের গাঁয়ের ফটিক রায়। তা ধরুন, তার গায়ের রং অনেকটা চিনেবাদামের খোসার মতো। মতি ঝম্পাটিও আছে বটে, তবে তার গায়ের বর্ণ লেড়ে বিস্কুটের কাছাকাছি। আমাদের ফরসার দৌড় এর বেশি নয়। এই যে আপনাকে চোখের সামনে দেখছি, দিব্যি কার্তিক ঠাকুরের মতো ঢলঢলে চেহারা, তা আপনার বর্ণটিও ভারী খাসা। ফটিক রায় যদি চিনেবাদাম, তো আপনি হলেন পোস্তবাটা। একটু ইদিকসেদিক হতে পারে।”
“আহা, মেমসাহেবের কথাটা আগে শেষ করো।”
“আজ্ঞে, আমরা মুখ্যু মানুষ। ধানাইপানাই ছাড়া কথা কইতে পারি না কিনা। কথাটা হল, মেমসাহেব এতই ফরসা যে, ফটিক রায় বা মতি ঝম্পাটি কোথায় লাগে! তার পাশে দাঁড়াতেও পারে না। এমনকী আপনি যে-আপনি, আপনার বর্ণের উপরেও চুনকাম করে তার উপর আলতা ঢেলে দিলে যেমনটা হয় আর কী!”
বিরক্ত মহীধর বলেন, “তুমি যে বড্ড বাচাল হে! তা এই মেমসাহেবকে তুমি পেলে কোথায়?”
“আজ্ঞে সেইটে বলতে বড্ড বাধো বাধো ঠেকছে। শুনলে আপনার মোটেই বিশ্বাস হবে না। আমাদের মিঠাপানি গাঁয়ের উত্তরে যে মাঠখানা আছে, তাকে আপনার তেপান্তরের মাঠ বলেই মনে হবে। লম্বাও ধু ধু, চওড়াও ধু ধু। মাঝমধ্যিখানে একখানা জম্পেশ বট গাছ। সে কী গাছ মশাই! একা একখানা গাছই যেন জঙ্গল বানিয়ে বসে আছে। আর এমন রুজু-রুজু বটের ঝুরি নেমেছে যে, তার মধ্যে শ্যাল-কুকুরও সেঁধতে পারে না। বড্ড ভয়ের জায়গা মশাই। তা সে দুর্ভেদ্য বটের জঙ্গলের ভিতর থেকেই ইংরেজি কান্নাটা আসছিল।”
ইংরেজি হয় নাকি?” লোকটা খুব ভাবিত হয়ে মাথাটাথা চুলকে বলল, “এই তো ফ্যাসাদে ফেললেন কর্তা! আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কান্নার মারপ্যাঁচ কি আর অত বুঝি? তবে কান্না শুনে মনে হচ্ছিল আমাদের গাঁয়ের মেয়েছেলেরা যেমন কাঁদে, এ কান্নাটা তেমন নয়। কান্নার মধ্যে যেন ইংরেজি-ইংরেজি গন্ধ পাচ্ছিলাম।”
“ইংরেজি কান্না! কান্নারও আবার বাংলা-
“ঠিক আছে বাপু, তাই না হয় হল। কিন্তু মোদ্দা কথাটাই তো এখনও খোলসা হল না।”
“যে আজ্ঞে, সেই কথাতেই আসছি। কান্না শুনে, তাও মেয়েমানুষের কান্না বুঝলেন কিনা, আমি তো হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে সেই বট গাছের ঝুরির ফাঁক দিয়ে কোনও রকমে ভিতরে ঢুকলাম। যা দেখলাম তাতে আমার বাক্য হরে গেল, চোখ কপালে উঠল আর মুখ এমন হাঁ হয়ে রইল যে, তাতে তিমিমাছ ঢুকে যায়। দেখলুম এক বুড়ি, খুকিদের মতো ফ্রক পরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর রুমালে চোখ মুচছে আর বিড়বিড় করে মাঝে-মাঝে কী যেন কইছে। ঝুপসি অন্ধকারেও তার গায়ের রং দেখে আমার চোখ ট্যারা। মানুষের যে এমন ফরসা রং হয় তা তো চর্মচক্ষে দেখা ছিল না মশাই। তার কান্না দেখে আমার বড় দুঃখ হল মশাই। তাই জিজ্ঞেস করলুম, ‘ও বুড়িমা, কাঁদছ কেন গো, হয়েছেটা কী?’ জবাবে বুড়িমা শিঁউ-মিউ করে কীসব বলতে লাগল তার একবর্ণও বুঝতে পারিনি কর্তা। আর তখনই ঘুমটা পট করে ভেঙে গেল কিনা।”
“তাই বলো। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলে।”
“যে আজ্ঞে। তবে কিনা স্বপ্নটা এখানেই শেষ হয়নি। পরদিনই আবার রাতে সেই একই স্বপ্ন। আবার সেই বট গাছের তলায় সেই বুড়িমেম। ফ্যাচফ্যাচ করে সেই কান্না। আবারও শিঁউমিউ করে কী সব কথা, যার এক বর্ণও বুঝবার উপায় নেই। তবে এদিন মেমসাহেবের দুটো কথা একটু চেনা-চেনা ঠেকল। এক হল কালীতলাহাট আর মহীধর চৌধুরী। তা পরদিন সকালে গাঁয়ের মাতব্বরদের গিয়ে স্বপ্নের কথা বললাম। তারা ভেবেচিন্তে বলল, “ওরে এর মধ্যে একটা গুহ্য কথা আছে বলে মনে হচ্ছে। ভেবে দেখতে হবে। তবে তিনদিনের দিন যখন স্বপ্নে আবার সেই বুড়িকে দেখলাম, তখন আমারও মনে হল, এর মধ্যে একটা ব্যাপার না থেকেই যায় না। তবে এদিন বুড়িটা শিঁউমিউ ছেড়ে একেবারে দিশি ভাষায় বলল, “ওরে বাছা, তোদের ওই নিঘিন্নে ভাষায় কথা কইতেও ভারী ঘেন্না হয়। কিন্তু কী করব বল, দেড়শো বছর ধরে ওই চাকরবাকরদের বুলিই শুনে আসছি তো! অনিচ্ছে সত্ত্বেও ভাষাটা ভিতরে সেঁধিয়ে গিয়েছে। তা আমার ভাষাও তো তুই বুঝবি না। তাই এই নিঘিন্নে ভাষায় কথা কইতে হচ্ছে।’ তখন আমি বললুম, ‘আপনি কি মেমসাহেব নাকি বুড়িমা? আমি জন্মে কখনও সাহেব-মেম দেখিনি কিনা, তাই ঠিক বুঝতে পারছি না।’
“বুড়ি একগাল হেসে বলে, ‘মেম নয় তো কী? তোদের ওই শাড়িপরা, কালোকুচ্ছিত, ঝগড়ুটে, হিংসুটে মেয়েমানুষ নাকি আমি! আমার দেশ কোথায় জানিস? সুইটজ়ারল্যান্ড। কখনও নাম শুনেছিস?’
“আমি মাথা হেঁট করে বললাম, ‘না বুড়িমা, আমি মুখ্যুসুখ্য মানুষ। কিন্তু আপনি মেমসাহেব হয়ে এই মিঠাপানি গাঁয়ে এসে হাজির হলেন কী করে?’
“বুড়ি বলল, ‘দুঃখের কথা আর বলিসনি বাছা, আমি হলুম ঘড়িবুড়ি। দেড়শো বছর আগে কপালের দোষে একজন নেটিভের কাছে বিক্রি হই। সেই থেকে কালীতলাহাট নামে একটা অখদ্দে জায়গায়, একটা বিচ্ছিরি বাড়ির বৈঠকখানার দেওয়ালে ঝুলে আছি। মানমর্যাদা বলে আর কিছু রইল না। তবু দেড়শো বছর ধরে কাঁটায়কাঁটায় সময় দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু দুঃখ কী জানিস, ঘড়ির দিকে কেউ ভাল করে তাকাতেই চায় না। তাকাবেই বা কেন! সময়ের মূল্য বুঝলে তো তাকাবে! কুঁড়ের হদ্দ, নিষ্কর্মা মানুষ সব।””
মহীধর ফুঁসে উঠে বললেন, “বলল ওকথা! আচ্ছা বেয়াদপ বুড়ি তো!”
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে হাতজোড় করে বলে, “কর্তা, দয়া করে যেন আমার দোষ ধরবেন না। যা ঘটেছিল তাই বলছি। বলেন তো খানিক কাটছাঁট করে বলি।”
মহীধর গম্ভীর মুখে বলেন, “না-না, কাটছাঁট করার দরকার নেই। খোলসা করেই বলো দিকি।”
“যে আজ্ঞে, ভরসা দিলেন বলেই বলা। বুড়িমার দুঃখের কথা শুনে আমার ভারী মনখারাপ হল। বললুম, ‘তা বুড়িমা, আমি আপনার কী উপকার করতে পারি বলুন।’ তখন বুড়িমা বলল, ‘দেখ বাছা, ও বাড়ির পাঁচপুরুষের বিস্তর কীর্তিকলাপ তো দেখলুম।
ভারী অচ্ছেদ্দা আর অযত্নে পড়ে আছি। কিন্তু এই কয়েক বছর হল, বৈঠকখানা ঘরটা ওরা তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। কী অপমান বল তো, অন্ধকার ঘরে একা-একা থেকেও ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড দেখিয়ে যাচ্ছি। দেখার কেউ নেই। ওরা আমাকে বেবাক ভুলেই গিয়েছে। তা সেই দুঃখেই কিনা জানি না, তিন-চারদিন আগে হঠাৎ করে আমার বুকের ধুকপুকুনিটা বন্ধ হয়ে গেল।””
মহীধর বাঞ্ছারামের দিকে চেয়ে চাপা গলায় বললেন, “প্যাচটা ধরতে পারছিস? খবরটবর নিয়েই এসেছে কিন্তু।”
“আজ্ঞে কর্তা, সেরকমই মনে হচ্ছে।”
“আমি প্যাঁচটা ধরতে পারছি না। লক্ষ রাখিস। কথার প্যাঁচে যেন আমাকে বোকা না বানিয়ে বসে।” “যে আজ্ঞে।”
লোকটা অতিশয় শ্রদ্ধার সঙ্গে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, “এবার কি এগোব কর্তা?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এগোও। গল্পটা ভালই ফেঁদেছ। তবে ওতে ভবি ভুলবে না।”
লোকটা জিব কেটে বলে, “ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন কর্তা। এক ফোঁটা জল মেশাইনি। নির্যস স্বপ্নটার কথাই বলছি। বিশ্বাস করা, না-করা আপনার হাতে। তা বুড়িমার কথা শুনে আমি বললুম, ‘তা বুড়িমা, কলকবজা তো মাঝেমধ্যে খারাপ হতেই পারে, তা সারিয়েও নেওয়া যায়।’ তাতে বুড়িমা ফোঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ও কথা বলিসনি বাছা, আমি হলুম দেড়শো বছরের পুরনো ঘড়ি। ওর কোনও পার্টস এখন পাওয়া যায় না। যদি বা সুইটজারল্যান্ড থেকে সারাইকর আনানো যায়, তাতে লাখো টাকা খরচ হবে। তোর কি ধারণা, ওই মহীধর ছোঁড়া অত খরচ করে আমাকে সারাবে? সে বরং আমাকে পুরনো লোহার দরে বেচে দেবে৷ তাতে আমার মানমর্যাদা বলে আর কিছু থাকবে কি? যারা কিনবে, তারা আমার নাড়িভুঁড়ি বের করে ছয়ছত্রখান করে ছাড়বে। সেই ভয়েই তোর কাছে এসেছি বাবা। তুই বড্ড কলকবজা ভালবাসিস, আমি জানি, পুরনো লোহার দরে আমাকে বেচলে মহীধর ষাট-সত্তর টাকার বেশি পাবে না। তাতে আমারও মানসম্মান যাবে। তুই গিয়ে পাঁচশোটা টাকা ফেলে আমাকে নিয়ে আয়।”
মহীধর একটু থতমত খেয়ে গেলেন। কারণ, পুরনো ঘড়িটা খারাপ হয়েছে শুনে মনে-মনে পুরনো লোহার দরে বিক্রি করে দেবেন বলেই ভেবেছিলেন। প্রথম কথা অত পুরনো ঘড়ি সারাতে গেলে মেলা খরচ। তা ছাড়া, এ বাড়িতে ঘড়ির প্রয়োজনই বা কী? একটা টেবিলক্লক তো আছেই, আর গিন্নির এবং তাঁরও দু’-দুটো হাতঘড়ি আছে। তিনি ওই পঞ্চাশ-ষাট টাকা দরই আন্দাজ করে রেখেছিলেন। পাঁচশো টাকার কথায় বুকটা ধক করে উঠল। একটু নড়েচড়ে বসলেন। পট করে মনে পড়ে গেল। বছরখানেক আগে একটা দাড়িওয়ালা, লুঙ্গিপরা লোক একখানা বস্তা কাঁধে করে পুরনো জিনিস কিনতে এসেছিল। পুরনো চশমা, পুরনো শাড়ি, পুরনো পুতুল, কৌটোবাউটো কিনে নিয়েছিল। তখন ঘড়িটা দেখে বলেছিল, “বাবু, ওই ঘড়িটা যদি দেন তো পঞ্চাশটা টাকা দিতে পারি।” ভাগ্যিস রাজি হননি।
মহীধর বাঞ্ছারামের দিকে চেয়ে চাপা গলায় বললেন, “দরটা তো ভালই দিচ্ছে বলে মনে হয়, কী বলিস?”
বাঞ্ছারাম গম্ভীর হয়ে বলে, “তা হোক, আপনি কিন্তু গিন্নিমাকে না জানিয়ে কিছু করতে যাবেন না। পরে কিন্তু কুরুক্ষেত্র হবে।”
মহীধর ফুঁসে উঠে বললেন, “কেন, আমি কি বাড়ির কর্তা নই নাকি?”
“ঠিক আছে। যা খুশি করুন, আমি গিন্নিমাকে গিয়ে বলে দিচ্ছি।”
এ কথায় হঠাৎ চুপসে গিয়ে মহীধর বললেন, “আহা, তাঁকে আবার এসবের মধ্যে টানা কেন? মেয়েরা বিকিকিনির কিছু বোঝে কি?”
বাঞ্ছারাম গলাটা খুব নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “বেশি সাহস কি ভাল কর্তা? আপনার ঘাড়ে তো একটা বই মাথা নেই।”
মহীধর নিজের গলায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “তা হলে বরং জিজ্ঞেস করেই আয়। আমার সব কথাতেই তো উনি অমত করেন।”
“যে আজ্ঞে, ” বলে বাঞ্ছারাম চলে গেল ভিতরবাড়িতে। মিস্তিরি লোকটা পকেট থেকে একগোছা একশো টাকার নোট বের করে খুব মন দিয়ে গুনতে গুনতে বলল, “এতে আমার বড্ড লোকসান হবে কর্তা। পুরনো ঘড়ির দাম ভুসিমালের মতোই। তবে স্বপ্নাদেশ বলে কথা!” এই বলে লোকটা পাঁচখানা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই নিন কর্তা, গুনেগেঁথে নিন।”
মহীধরও হাত বাড়াতে যাচ্ছিলেন। ঠিক এই সময়ে বাঞ্ছারাম এসে মহীধরের কানে-কানে বলল, “গিন্নিমা বলেছেন এক্ষুনি লোকটাকে বিদেয় করে দিতে। আর যেন বাড়ির ত্রিসীমানায় লোকটাকে দেখা না যায়। গেলে তিনি পুলিশে খবর দেবেন। তিনি মহাদেবদাদাকেও খবর পাঠিয়েছেন। লোকটা যেতে না চাইলে যেন ঘাড় ধরে গাঁয়ের বাইরে বের করে দিয়ে আসে।”
মহাদেব এ বাড়ির পাইক এবং মস্ত পালোয়ান। বলতে কী, তার জন্যই এ বাড়িতে চোরডাকাতও ঢুকতে ভয় পায়।
মহীধর সট করে হাতটা টেনে নিয়ে বেজার মুখে বললেন, “না হে বাপু, ঘড়ি বিক্রিতে বাড়ির মত নেই। তুমি বরং এসো গিয়ে।”
লোকটা হাঁ করে চেয়ে বলল, “মত নেই! বলেন কী কর্তা? ওই ঝুরঝুরে ঘড়ির পাঁচশো টাকা দাম দিচ্ছি, তাও পছন্দ হল না! তাতে আমার সাড়ে চারশো টাকা লোকসান হচ্ছিল। তাও বুড়িমার মুখ চেয়ে মেনে নিলুম যে!”
বাঞ্ছারাম বলল, “যাক বাপু, তোমার লোকসানের টাকাটা এ যাত্রায় বেঁচে গেল। এবার মানে-মানে সরে পড়ো তো বাছা।”
লোকটা কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, “কিন্তু আজ রাতে ফের স্বপ্নে দেখা দিয়ে বুড়িমা যদি জিজ্ঞেস করে, ওরে বাপু গনশা, আমার কী ব্যবস্থা করলি? তখন আমি কী জবাব দেব?”
বাঞ্ছারাম জবাবে বলল, “বুড়িমাকে বোলো তোমাকে ঝুটমুট হয়রান না করে এ বাড়ির কর্তাবাবুকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে যেন দুঃখের কথা কবুল করেন। বুঝলে বাপু।”
লোকটা দোনোমোনো করে উঠতে গিয়েও ফের ধপাস করে বসে পড়ে বলল, “ঠিক আছে। আমি না হয় ওই সাড়ে পাঁচশোই দেব। গচ্চা যায়, তবু…’ “
বাঞ্ছারাম কড়া গলায় বলে, “গচ্চা দিতে হবে না হে। আরও পঞ্চাশ কেন, পাঁচশো বা হাজার দিলেও ওঘড়ি বিক্রি করা হবে না। বুঝেছ? এ হল হাইকোর্টের হুকুম, গিন্নিমার কথার উপরে এ বাড়িতে আর কারও কথা চলে না।”