হানা দেবালয়ের জীবন্ত পাথর

হানা দেবালয়ের জীবন্ত পাথর

মানিকের অনুমানও ব্যর্থ হয়নি, তার ফন্দিও ব্যর্থ হল না!

মিনিট পাঁচেক পরেই দেখা গেল, ওধারের বনের ভিতর থেকে কারা যেন বেরিয়ে আসছে৷ দূর হতে তাদের দেখাচ্ছে খুব ছোটো ছোটো!

সুন্দরবাবু দূরবিনটা তাড়াতাড়ি চোখে লাগিয়ে সোৎসাহে বললেন, ‘এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ! হুম, বেটাদের দলে দশ জন লোক আছে৷ ওরা হনহন করে এইদিকেই আসছে৷ হুঁ-হুঁ বাবা, ঘুঘুই দেখেছ ফাঁদ তো দেখনি! চলে আয়-চলে আয়, চই চই চই৷ ওরে বাপরে! ওটা আবার কে রে! কী লম্বা! কী জোয়ান! যেন ঘটোৎকচের বাচ্ছা! ওর পাশে পাশে আসছে এক বেটা গুড়গুড়ে বেঁটেরাম সর্দার, পায়ে হেঁটে চলছে, না ফুটবলের মতো মাটির উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে?’

-‘কই, দেখি দেখি,’ বলে সাগ্রহে অমলবাবু দূরবিনটা সুন্দরবাবুর হাত থেকে প্রায় একরকম কেড়েই নিলেন এবং নিজের চোখে লাগিয়েই বলে উঠলেন, ‘ওই তো চ্যান! ওই তো ইন! সাতঘাটের জল ঘেঁটে এতদিন পরে স্বচক্ষে আবার প্রভুদের দেখা পেলুম! ওরে ও পাপিষ্ঠ, ওরে ও পিশাচ! সুরেনবাবু আর জয়ন্তবাবু তোদের হাতেই প্রাণ দিয়েছেন! তোরা গোপীনাথকে খুন করেছিস, আমাকেও বধ করতে এসেছিলি! অ্যাঁ: ! চ্যানের বাঁ-হাতে যে ব্যান্ডেজ বাঁধা! তাহলে পরশু রাতে মানিকবাবুকেও ওরা মারতে এসেছিল! হাতি সিং, বন্দুক ছোড়ো! বন্দুক ছোড়ো! হতভাগাদের পাগলা কুকুরের মতো মেরে ফেলো!’

প্রভুর হুকুম পালন করবার জন্যে হাতি সিং তখনি বন্দুক তুললে, কিন্তু মানিক তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললে, ‘বন্দুক নামাও হাতি সিং, আমি যখন বলব তখন ছুড়বে! অমলবাবু, আপনি বড়োই উত্তেজিত হয়েছেন, শান্ত হোন! ওদের আরও কাছে আসতে দিন!’

অমলবাবু চেঁচিয়ে বললেন, ‘উত্তেজিত হব না-বলেন কী? যমদূতদের দেখলে কি শান্ত হয়ে থাকা যায়?’

সুন্দরবাবু প্রমাদ গুণে বললেন, ‘অমলবাবুই সব পণ্ড করবেন দেখছি৷ অত চ্যাঁচালে ওরা কি আর কাছে আসবে?’

তখন অমলবাবু লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘মাপ করুন, আর আমি কথা কইব না!’

 ততক্ষণ মাঠের লোকগুলো অনেকটা এগিয়ে এসেছে, তাদের চেহারাও মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল৷ তারা সবাই হয় বর্মি, নয় শ্যামদেশের লোক এবং তাদের ভিতরে সর্বাগ্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করে চ্যানের দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ দেহ! এবং তাকে দেখেই বেশ বোঝা যায় যে, কাটা আঙুলের যন্ত্রণায় তার অবস্থা বিলক্ষণ কাহিল!

মানিক বললে, ‘আসুন, এইবারে বন্দুক নিয়ে আমরা প্রস্তুত থাকি৷ পায়ের দিকে গুলি করে ওদের অকর্মণ্য করতে পারলেই আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে, নরহত্যায় দরকার নেই-কী বলেন সুন্দরবাবু?’

-‘বেশ, তাই সই৷’

এইবারে শত্রুরা বন্দুকের নাগালের ভিতরে এসে পড়ল৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ওরা যে কেন এতক্ষণ দল বেঁধে আমাদের আক্রমণ করেনি, এইবারে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে! ওদের কাছে আছে মোটে একটা বন্দুক!’

মানিক বললে, ‘এইবারে আমাদের চারটে বন্দুক গর্জন করতে পারে,-ওদের আর এগুতে দেওয়া উচিত নয়!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ওয়ান, টু, থ্রি!’

একসঙ্গে চারটে বন্দুক অগ্নি-উদগার করলে,-সঙ্গেসঙ্গে মাঠের উপরে সর্বপ্রথমে ধরাশায়ী হল ইনের বাঁটকুল দেহ! বাকি সকলে মহা ভয়ে আর্তনাদ করে যেদিক থেকে আসছিল আবার সেইদিকে দৌড়োতে আরম্ভ করলে!

এদিক থেকে দ্বিতীয় বার গুলিবৃষ্টি করা হল৷ এবারে লোকগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে পাগলের মতো মাঠের নানাদিকে ছুটতে লাগল, আর একজন আহত হয়ে মাটির উপরে আছাড় খেয়েও আবার কোনোরকমে উঠে ভোঁ দৌড় মারলে! কিন্তু দৌড়োতে পারছিল না কেবল ইন, সে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আর ভয়ে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে কোনোরকমে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল! তার দুর্দশা দেখে চ্যান আবার ফিরে এল এবং একহাতে ইনের দেহকে সে ঠিক শিশুর দেহের মতোই নিজের কাঁধের উপরে তুলে নিয়ে আবার দৌড়োতে আরম্ভ করলে!

অমলবাবু চ্যানকে টিপ করে বন্দুক ছুড়লেন, কিন্তু গুলি তার গায়ে লাগল না৷

আরও দু-একবার গুলিবৃষ্টির পর মানিক বললে, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর টোটা নষ্ট করে লাভ নেই! ওরা নানাদিকে দৌড় মেরেছে, আবার বনবাদাড় ভেঙে একসঙ্গে মিলতে ওদের অনেকক্ষণ লাগবে৷ তার পরেও আজ ওরা আমাদের পিছু নিতে সাহস করবে বলে মনে হয় না৷’

সুন্দরবাবু মানিকের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, বেটারা যত বড়ো গুলিখোরই হোক, আবার গুলি খাবার জন্যে ওরা শীঘ্র ব্যস্ত হবে বলে মনে হচ্ছে না-জয় মানিকের বুদ্ধির জয়!’

পথ চলতে চলতে মানিক জিজ্ঞাসা করলে, ‘আচ্ছা অমলবাবু, এই পদ্মরাগ বুদ্ধের কোনো ইতিহাস জানেন!’

অমলবাবু বললেন, ‘ঠিক পদ্মরাগ বুদ্ধের ইতিহাস জানি না বটে, তবে ওঙ্কারধামের ইতিহাসে এরই মতো এক মরকত বুদ্ধের কথা শোনা যায়৷ ওঙ্কারধাম সাম্রাজ্যের রাজধানী যশোধরপুরে এই মরকত বুদ্ধের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল৷*

‘মরকত বুদ্ধ নিয়ে তর্ক চলছে৷ কেউ বলেন, এখন এই মূর্তি জাপানে আছে৷ কেউ বলেন, ফর্মোজা দ্বীপে আছে, কেউ বলেন, জাভায় আছে৷ ওঙ্কারধামের পতন হয়, শ্যামদেশের দ্বারা৷ ওদেশের লোক বলে, তাদের রাজধানী ব্যাংকক শহরের মন্দিরে যে সবুজাভ পাথরে গড়া বুদ্ধমূর্তি আছে, সেইটিই হচ্ছে প্রবাদ-প্রসিদ্ধ মরকত বুদ্ধ৷ কেবল মরকত বুদ্ধ নয়, ওঙ্কারধামে নাকি একটি স্বর্ণময় বিরাট শিবলিঙ্গ ছিল৷ ওঙ্কারধামের বাসিন্দারা থেইস নামে একটি জাতিকে অত্যন্ত ঘৃণা করত৷ এই থেইসরা বাস করত বর্তমান শ্যামদেশে৷ এখনও যারা ওখানে বাস করে তারা ওই থেইসদেরই বংশধর৷ বারংবার পরাজয়ের পর থেইসরা অবশেষে বিশেষ আয়োজন করে ওঙ্কারধামকে হঠাৎ আক্রমণ করে৷ একটা বড়ো যুদ্ধে তারা জয়ী হয়৷ জনৈক ভগ্নদূত সেই খবর নিয়ে ফিরে এল৷ ওঙ্কারধামের সেনাপতি বললেন, তোমার খবর মিথ্যা হলে তোমার প্রাণদণ্ড হবে৷ আর তোমার খবর সত্য হলেও তোমার প্রাণদণ্ড হবে৷ কারণ সবাই যখন বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছে, তখন তুমি কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছ! ভগ্নদূতের প্রাণদণ্ড হল, কিন্তু ওঙ্কারধাম রক্ষা পেল না৷ পুরোহিতেরা নগর রক্ষা অসম্ভব দেখে মরকত বুদ্ধ, স্বর্ণ শিবলিঙ্গ, অন্য অন্য মূল্যবান বিগ্রহ আর রাশি রাশি হিরে-মণি-মুক্তা তখনি সরিয়ে ফেলে গুপ্তস্থানে লুকিয়ে রাখলেন৷ অনেকেরই দৃঢ়বিশ্বাস, বিজয়ী থেইসরা সেসব গুপ্তধন খুঁজে পায়নি৷ ওঙ্কারধামের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আজও কত লোক সেই গুপ্তধন খুঁজে বেড়ায়! কিন্তু আজও কেউ তার ঠিকানা আবিষ্কার করতে পারেনি! আমাদের এই পদ্মরাগ বুদ্ধ সেই গুপ্তধনেরই অংশবিশেষ কি না, কে তা বলতে পারে?’

বৈকাল অতীত হয়ে গেছে, সূর্যালোক তখন অরণ্যের মাথার উপরে গিয়ে উঠেছে৷ দিনের আলোয় চতুর্দিক সমুজ্জ্বল বটে, কিন্তু এমন নির্জন ও নিস্তব্ধ যে, রাত্রির স্তব্ধতার সঙ্গে তুলনা করা চলে! আরও মাইল খানেক পথ পেরিয়ে অমলবাবু উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘ওই সেই সপ্ত তাল গাছ!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘সপ্ত তাল গাছ আবার কী?’

-‘ওই হচ্ছে আমাদের পথের শেষ নিশানা৷ পাশাপাশি ওই যে সাতটা তাল গাছ দেখছেন, ওর পরেই সেই ভাঙা মন্দিরের প্রকাণ্ড বাঁধানো চত্বর-অর্থাৎ আমাদের পথের শেষ!’

কিন্তু পথের শেষে এসে মানিকের মনে জয়ন্তের শোক আরও বেশি করে জেগে উঠল৷ জয়ন্তের জন্যেই এদেশে আসা, পদ্মরাগ বুদ্ধের জন্যে তার আগ্রহ ছিল অফুরন্ত৷ জয়ন্ত নেই তবু যে সে এখানে এসেছে, এ কেবল বন্ধুর ব্রত উদযাপন করবার জন্যে! সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলে, ‘যদি তাদের চেষ্টা সফল হয়, তবে অমলবাবুর হাতে পদ্মরাগ বুদ্ধকে সমর্পণ করে সে সর্বাগ্রে চ্যান আর ইনকে গ্রেপ্তার করবে৷ যতদিন এই প্রতিজ্ঞা পালন করতে পারবে না, ততদিন সে স্বদেশে ফেরবার কথা মনেও আনবে না৷’

তারা সপ্ত তালের তলায় এসে দাঁড়াল৷ তারপর একটা বাঁশ বনের প্রাচীর পার হয়েই সকলে সবিস্ময়ে দেখলে, তাদের চোখের সামনেই রয়েছে, চারিদিকে প্রায় দুই মাইল বিস্তৃত একটা মাঠ৷ সেই মাঠের মাঝখানে পাথরে বাঁধানো একটি প্রকাণ্ড চত্বর এবং চত্বরের মাঝখানে একটি পুষ্করিণী৷ পুষ্করিণীর এক কোণ দিয়ে যে রাস্তাটি পশ্চিম মুখে চলে গিয়েছে, তারই প্রান্তে দেখা যাচ্ছে মস্ত একটি পাথরের মন্দিরের কতক অংশ! মন্দিরের বাকি অংশ গাছপালার ভিতরে ঢাকা পড়েছে৷

সকলে যখন পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়াল, সুন্দরবাবু বললেন, ‘এইবার পদ্মরাগ বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে হবে৷ হুম, বার করো তো মানিক, তোমার সেই সোনার চাকতিখানা!’

মানিক পকেট থেকে চাকতি বার করে সুন্দরবাবুর হাতে দিয়ে বললে, ‘আপনিই তাহলে নকশার পাঠোদ্ধার করে আমাদের বাহবা লাভ করুন!’

সুন্দরবাবু অবহেলা ভরে বললেন, ‘পুলিশে চাকরি নিয়ে ঢের ঢের হেঁয়ালি জলের মতো পড়ে ফেলেছি, এ তো সামান্য নকশা মাত্র!

‘হুম! নকশায় এই তো রয়েছে পুকুরটা, চারিদিকে এই তো চারটে ঘাটের সিঁড়ি! কিন্তু নকশায় পুকুরের পশ্চিম কোণে এই যে তিনকোনা চিহ্নিত জায়গাটা রয়েছে, আসল পুকুরের পশ্চিম কোণে তেমন ধারা কিছুই তো দেখছি না!’

মানিক হাসতে হাসতে বললে, ‘ওকী সুন্দরবাবু, এরই মধ্যে মাথা চুলকোচ্ছেন কেন?’

-‘মাথা চুলকোচ্ছি কি সাধে? এ নকশাখানা কেউ ঠাট্টা করে আঁকেনি তো?’

-‘বোধ হয় না৷ আচ্ছা, দিনের আলো থাকতে থাকতে আগে মন্দিরের ভেতর চলুন৷ সেখানে গেলে হয়তো কোনো হদিস পাওয়া যাবে!’

-‘ঠিক বলেছ৷ তাই চলো৷’

দিনের আলো তখন নিবুনিবু হবার সময় এসেছে৷ পাখিরা বিদায়ী গান গাইতে গাইতে বাসার দিকে ফিরতে শুরু করেছে৷ সূর্যের কিরণ আর দেখা যাচ্ছে না-যদিও অন্ধকারের ঘুম এখনও ভাঙেনি৷

মাঝখানে প্রকাণ্ড এক মন্দির, তার উপর দিকটা ভেঙে পড়েছে৷ দেখলেই বোঝা যায়, সম্পূর্ণ অবস্থায় এ মন্দিরটা অন্তত এক-শো ফুটের কম উঁচু ছিল না৷ মন্দিরের আগাগোড়া কারুকার্যে আর ছোটো-বড়ো মূর্তিতে ভরা৷ কিন্তু তার অধিকাংশই ভেঙে বা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে মহাকালের নির্দয়তায়৷ বড়ো মন্দিরের চার পাশে যে চারিটি ছোটো মন্দির ছিল, এখন তাদের সামান্য চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট আছে৷ এখানে যেদিকেই তাকানো যায়, কেবলই ধ্বংসের লীলা স্তম্ভিত হয়ে আছে মৃত্যু-স্তব্ধতার কোলে৷ মন নেতিয়ে পড়ে, প্রাণ হা-হা করে, চোখে বিষণ্ণতা জাগে৷

সকলে ধীরে ধীরে মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করল৷ মন্দিরের ভিতরে তখন আলো-আঁধারের খেলা আরম্ভ হয়েছে, সহজে দূরের জিনিস স্পষ্ট চোখে পড়ে না৷

চূড়া ভেঙে পড়েছে বলে উপর পানে তাকিয়ে দেখা গেল, পশ্চিমের আরক্ত রাগে রঞ্জিত নীলাকাশকে৷

মন্দিরগর্ভ খুব প্রশস্ত, তার মধ্যে বড়ো বড়ো অনেকগুলো, হলঘরের ঠাঁই হতে পারে৷ ভিতরের চারিকোণে চারিটি মানুষের চেয়েও ডবল বড়ো অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের দণ্ডায়মান মূর্তি৷ একটি মূর্তি কতকটা অটুট আছে, বাকি মূর্তি তিনটির কারুর দেহের উপরিভাগ নেই, কারুর পদযুগল নেই, কারুর মুণ্ড নেই৷ দেওয়ালেও খোদিত ভাস্কর্য কাজ আছে, কিন্তু অস্পষ্ট আলোতে ভালো করে দেখা যায় না৷

মন্দিরের পশ্চিম দেওয়ালের সামনে প্রকাণ্ড একটি মূর্তিশূন্য বেদি রয়েছে কালো পাথরে গড়া৷ সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে অমলবাবু বললেন, ‘ওরই উপরে আমরা সেই ছোট্ট বুদ্ধ মূর্তিটি পেয়েছিলুম৷’

মানিক একটু আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘অতটুকু একটি মূর্তির জন্যে এত বড়ো একটা মন্দিরের এত বড়ো কালো পাথরের বেদি গড়া হয়েছিল! সে মূর্তি কখনো এমন মন্দিরের প্রধান দেবতা হতে পারে না!’

অমলবাবু বললেন, ‘আমারও সেই সন্দেহ হয়৷ বিশেষ, মন্দিরের অপ্রধান মূর্তিগুলিই যখন এমন প্রকাণ্ড! আমার বিশ্বাস, বেদির উপর থেকে প্রধান মূর্তিটিকে হয়তো কোনো কারণে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল৷ পরে পূজার বেদিতে দেবতার অভাব কতকটা দূর করবার জন্যে কোনো ভক্ত এই মূর্তিটিকে স্থাপন করেছিল৷’

-‘খুব সম্ভব, তাই৷’

সুন্দরববাবু এতক্ষণ নির্বাক ও হতভম্বের মতো নকশার সঙ্গে বেদিটি মিলিয়ে দেখবার চেষ্টা করছিলেন৷

অমলবাবু তাঁর অবস্থা দেখে হেসে বললেন, ‘কী সুন্দরবাবু নকশা দেখে কিছুই বুঝতে পারছেন না তো? আমিও পারিনি!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, এ হচ্ছে একখানা বাজে নকশা! কোনো ধাপ্পাবাজের আঁকা! আমরা সবাই হচ্ছি মহা হাঁদা-গঙ্গারাম, একটুকরো হিজিবিজি দেখে যমালয়ের রাস্তায় ছুটে এসেছি! পদ্মরাগ বুদ্ধ! সোনার পাথরবাটি! যা নয় তাই!’

মানিক চাকতিখানা সুন্দরবাবুর হাত থেকে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল৷

মন্দিরগর্ভে অন্ধকার তখন আলোকের শেষ আভাটুকুও নিবিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল৷ সেই মহানির্জনতার স্বদেশে, সেই মান্ধাতার আমলের মন্দিরের প্রাচীন স্তব্ধতা যেন ঘনায়মান ও হিংস্র অন্ধকারের মূর্তি ধরে সকলের প্রাণ মনের উপরে চেপে বসতে চাইছিল! উপরদিকে হঠাৎ ঝটপট ঝটপট শব্দ হল-নিরবচ্ছিন্ন নীরবতার মাঝখানে সেই শব্দগুলোকে শোনাল যেন বন্দুকের আওয়াজের মতো! চমকে এবং দোদুল ভুঁড়ি নাচিয়ে লাফিয়ে উঠে সুন্দরবাবু সভয়ে ঊর্ধ্বমুখে দেখলেন, ভাঙা মন্দিরের ফাঁকে তখনও উজ্জ্বল আকাশপটে কালো কালো চলন্ত দাগ কেটে কী কতকগুলো উড়ে গেল৷

অমলবাবু বললেন, ‘বাদুড়!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘না, অন্ধকারের কালো বাচ্ছা!’

মানিক নিজের মনেই বললে, ‘নকশায় বেদির গায়ে সিঁড়ি আঁকা রয়েছে৷ কিন্তু এখানে কোথায় সিঁড়ি?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘প্রতিধ্বনিও বলবে-কোথায় সিঁড়ি? ও সিঁড়ি-ফিড়ি কিছুই পাওয়া যাবে না, আমাদের কাদা ঘেঁটে মরাই সার হল, জয়ন্ত বেচারা বেঘোরে প্রাণ দিলে, এখান থেকে পালাই চলো মানিক৷’

-‘পালাব কেন?’

-‘এ জায়গাটা ভালো নয়! আমার বুক ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করছে! হুম, আমার বুক অকারণে ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে না, এটা নিশ্চয়ই হানা মন্দির!’

মানিক হেসে উঠল-তার হাস্যধ্বনি মন্দিরের অন্ধকার ভরা কোণে কোণে প্রতিধ্বনি তুললে, শোনাল ঠিক অন্ধকারের হাসির মতো!

সুন্দরবাবু অস্বস্তিপূর্ণকন্ঠে বললেন, ‘তুমি হেসো না মানিক৷ এমন অস্বাভাবিক স্তব্ধতা তুমি কখনো অনুভব করেছ? এক মাইল দূরে একটা আলপিন পড়লেও যেন শোনা যায়! এ স্তব্ধতা যেন নিরেট, হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়! এ স্তব্ধতা যেন ওজনে ভারী-বুকে জাঁতাকলের মতো চেপে বসে! এ যেন স্তব্ধতার মহাসাগর,-আমাদের কথাগুলো যেন মুখ থেকে বেরিয়েই এই স্তব্ধতার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে!’

মানিক কোনো কথায় কান না পেতে মন্দিরের বেদির উপরে হাত বুলোতে লাগল৷ তারপর ফিরে বললে, ‘অমলবাবু, এ বেদির গায়ে কখনো যে কোনো সিঁড়ি ছিল, তার চিহ্নটুকুও দেখছি না! অথচ নকশায় সিঁড়ি আঁকা রয়েছে! এর মানে কী?’

-‘আমার বোধ হয় এ নকশাখানা অন্য কোনো জায়গার!’

-‘অসম্ভব! নকশার সঙ্গে এখানকার বাকি সমস্তই হুবহু মিলে যাচ্ছে! এই সিঁড়ির হয়তো কোনো গুপ্ত অর্থ আছে৷’

-‘থাকতে পারে৷ কিন্তু আমরা কেউ তা জানি না৷ সুতরাং আমাদের পক্ষে ও গুপ্ত অর্থ থাকা-না-থাকা দুই-ই সমান৷’

হঠাৎ সুন্দরবাবু আঁতকে বলে উঠলেন, ‘মানিক, মানিক! কে যেন এখানে চাপা হাসি হাসছে!’

মানিক বললে, ‘কই?’

-‘হাসি আবার থেমে গেল!’

-‘ও আপনার মনের ভুল৷ আমি কোনো হাসি শুনিনি৷’

-‘অমলবাবু, আপনিও শোনেননি?’

-‘না৷ কে আবার হাসবে, এখানে আমরা তিন জন ছাড়া আর কেউ নেই৷’

-‘হুম, শুনিনি বললেই হল? আমি স্পষ্ট শুনেছি! কে যেন লুকিয়ে লুকিয়ে হাসি চেপে রাখবার চেষ্টা করেও পারলে না!’

-‘তাহলে আপনার পিছনে ওই যে বুদ্ধদেব দাঁড়িয়ে আছেন, ওঁকে জাগ্রত বলে মানতে হয়! আপনার ভয় দেখে উনিই হেসে ফেলেছেন!’

সুন্দরবাবু তাড়াতাড়ি দু-পা পিছিয়ে এসে ফিরে তাকালেন৷

আসন্ন সন্ধ্যায় আবছায়া মেঘে প্রকাণ্ড অবলোকিতেশ্বর দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর প্রস্তরচক্ষুর প্রশান্ত দৃষ্টি যেন সুন্দরবাবু মুখের পানেই তাকিয়ে আছে এবং তাঁর ওষ্ঠাধর স্নিগ্ধহাস্যে বিকশিত!

সুন্দরবাবু বিস্ফারিত আড়ষ্ট চোখে দেখলেন, আচম্বিতে বুদ্ধমূর্তি জ্যান্ত হয়ে টলমলিয়ে নড়ে উঠল! ‘হুম, বাপ!’ বলে সুন্দরবাবু সুদীর্ঘ এক লাফ মেরে একেবারে মানিকের ঘাড়ের উপরে এসে পড়লেন!

অমলবাবু উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘বুদ্ধদেব নড়ে উঠেছেন মানিক! আমি স্বচক্ষে দেখেছি!’

মানিক বিস্মিতভাবে তাকিয়ে দেখলে, মূর্তি যেমন স্থির ছিল তেমনই রয়েছে! সে ভর্ৎসনার স্বরে বললে, ‘আপনারা দু-জনেই পাগল হলেন নাকি?’

সুন্দরবাবু ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘পাগল এখনও হইনি মানিক, কিন্তু পাগল হতে আর বেশি বিলম্বও নেই! পাথরের মূর্তি হাসে, পাথরের মূর্তি নড়ে, এমন ব্যাপার কেউ কখনো দেখেছে?’

মানিক এগিয়ে বুদ্ধমূর্তির গায়ে হাত রেখে বললে, ‘এই দেখুন, আমি মূর্তির গায়ে হাত দিয়েছি! একেবারে জড়পাথর, এর মধ্যে কোনো প্রাণ নেই!’

হঠাৎ সেই প্রস্তরমূর্তি একখানা জীবন্ত ও বলিষ্ঠ বাহু বাড়িয়ে সবলে মানিকের হাত চেপে ধরল!

আকস্মিক আতঙ্কে আচ্ছন্ন হয়ে মানিক প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সুন্দরবাবু! অমলবাবু৷’

—–

* ‘And in Yasodharpura, which is the Great Capital of the Khmer people and the finest city in all of Asia, there is a statue of the Lord Buddha sitting upon the coiled cobra which is the emblem of that race. And this statue was fashioned out of emeralds so cunningly matched and cemented together that the whole work sums as one solid emerald and shines with a green light so intense that none but faith may look upon it.’