তৃতীয় খণ্ড – প্রথম পরিচ্ছেদ – হরিদাসের কথা
ব্যারিষ্টার নিকলাস সাহেবের বুদ্ধিতে আর কুলাইল না। তিনি আমার উপরে সমস্ত ভার অর্পণ করিলেন।
আমি সৰ্ব্বপ্রথমেই পত্র কয়খানির মর্ম্ম অবগত হইবার জন্য বিশেষ চেষ্টিত হইলাম। একখানি পত্রে যজ্ঞেশ্বর বাবুর হস্তাক্ষর ও পোষ্টাফিসের তারিখ দেখিয়া আমি অনুভবে স্থির করিলাম যে, সেইখানিই ডাকে ফেলিয়া দিবার জন্য যজ্ঞেশ্বর বাবু প্রদান করিয়াছিলেন। বর্দ্ধমানে গিয়া নিকলাস সাহেব তাহা ডাকে ফেলিয়া দেন। মনোরমার টেবিলের টানার মধ্যে যে দুইখানি পত্র পাওয়া গিয়াছিল, সেই দুইখানি ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবু খুলিয়াছিলেন, কিন্তু পত্রপাঠ করিয়া কিছুই বুঝিতে পারেন নাই। কাজেকাজেই আর দুইখানি পত্র—যাহা তিনি মনোরমার মাতার নিকটে পাইয়াছিলেন, তাহা উন্মোচন করেন নাই। তাহারই মধ্যে যজ্ঞেশ্বর বাবুর সেই পত্রখানিও ছিল।
যে দুইখানি পত্র অম্বিকাচরণ বাবু খুলিয়াছিলেন; তাহারই মধ্যে পোষ্টাফিসের তারিখ দেখিয়া একখানি লইয়া আমি পাঠ করিতে যে দুইখানি পত্র অম্বিকাচরণ বাবু খুলিয়াছিলেন, তাহারই মধ্যে পোষ্টাফিসের তারিখ দেখিয়া একখানি লইয়া আমি পাঠ করিতে বসিলাম। অনেকক্ষণ চেষ্টা করিয়াও তাহার বিন্দুবিসর্গ বুঝিতে পারিলাম না। পাঠকগণের বিদিতার্থে নিম্নে সেই পত্রের অবিকল নকল দিলাম।
আমি প্রথমেই ভাবিতে লাগিলাম যে, পত্রখানির চারিধারে বর্ণ ও নম্বর সাজান বর্ডারের সহিত পত্রের আসল কথাগুলির কোন সম্পর্ক আছে কি না। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর স্থির করিলাম যে, শুধু বাহারের জন্য এত যত্ন করিয়া বর্ণ ও নম্বর কখনই সাজান হয় নাই। তবে এমন হইতে পারে যে, অন্য কেহ এ পত্র দেখিয়া, যাহাতে আরও ভ্রমাত্মক পথে চালিত হয়েন, সেই উদ্দেশ্যে হয়তো এইরূপভাবে পত্রখানির চারিধার সাজান হইয়াছে।
যাহা হউক, আসল পত্রখানি নষ্ট হইবার ভয়ে, আমি সেই পত্রের দুইখানি অবিকল নকল করিলাম। বর্ডারটি মানাইবার জন্য একগাছি রুল অনুসন্ধান করিলাম—টেবিলের উপর খুঁজিয়া পাইলাম না। অথচ পত্রখানি ছাড়িয়া রুল অনুসন্ধানে উঠিতেও ইচ্ছা হইল না। ডাক্তার ‘অম্বিকাচরণ বাবু মনোরমার টেবিলের মধ্য হইতে যে তিনখানি তাস লইয়া আসিয়াছিলেন, তাহারই মধ্যে একখানি তুলিয়া লইয়া রুলের কার্য্য সারিলাম অর্থাৎ তাসখানি সোজা করিয়া কাগজের উপর রাখিয়া পত্রখানির চতুর্দিকে ডবল লাইন টানিয়া লইয়া, তাহার ভিতর বর্ণ ও নম্বর পাশাপাশি, অবিকল মূল পত্রের অনুকরণে লিখিয়া লইলাম।
অনেকক্ষণ ধরিয়া পত্রখানি দেখিতে দেখিতে দুইটি আবশ্যক কথা আমার চোখে পড়িল। একটি তৃতীয় লাইনের দ্বিতীয় অক্ষর “হীরের”—অপরটি সপ্তম অথবা শেষ লাইনের দ্বিতীয় কথা “বালা”।
দুইটি কথা একত্রে যোগ করিলে “হীরের বালা” হয়। মনে বড় আনন্দ হইল। ভাবিলাম, তবে তো সূত্র পাইয়াছি। হয় তো এই বালা ভোজের দিন মনোরমা পরে নাই বলিয়া, পিতার নিকট তিরস্কৃতা হইয়াছিল। সূত্র পাইলাম বটে, কিন্তু অৰ্দ্ধঘন্টা চেষ্টা করিয়াও “হীরের বালা” এই কথার সহিত অন্য কথাগুলি যোগ করিয়া, পত্রখানি পূর্ণাবয়বে খাড়া করিতে পারিলাম না।
তাহার পর সহসা আমার মনে একটা কথার উদয় হইল। সে কথা যে আমি কেন পূর্ব্বে ভাবি নাই, বলিতে পারি না। চক্ষের উপরে যে দ্রব্য রহিয়াছে, তাহার আবশ্যকতা সম্বন্ধে অনুসন্ধান না করিয়া, আমি এতক্ষণ যে আকাশ-পাতাল ভাবিতেছিলাম, তাহার জন্য আমার আপনা আপনি, যেন কেমন এক রকম লজ্জা বোধ হইতে লাগিল। এতক্ষণ সময় বৃথা নষ্ট করিয়াছিল বলিয়া আক্ষেপ জন্মিল। যে হরতনের নওলা লইয়া পূৰ্ব্বে এত কথা হইয়া গিয়াছে, সেই হরতনের নওলা আমার সম্মুখে পড়িয়া থাকিলেও, তাহার সহিত পত্রের কোন প্রকার সম্পর্ক আছে কি না দেখা আমার পূর্ব্বেই উচিত ছিল।
আমি তখন একখানি হরতনের নওলা পত্রের উপর রাখিলাম। তাহাতে মূল পত্রখানি সমস্তই লুক্কায়িত হইয়া, কেবল চতুর্দিকের বর্ডার ও তন্মধ্যস্থিত বর্ণমালা ও নম্বরগুলি দেখা যাইতে লাগিল। সেইরূপভাবে পত্রখানি চাপা দিয়া আরও কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিলাম। মনে হইল যে, হরতনের নওলার ফোঁটা কয়টি যদি আমি কাটিয়া ফেলি, তাহা হইলে হয়তো কতকগুলি কথা দেখা যাইতে পারে। সেই কথাগুলির সাহায্যে যদি পত্রের ভাব অনুমান বুঝিয়া লইতে পারি, তাহা হইলেও যথেষ্ট লাভ। অন্ততঃ নয়টি কথাও যদি তাহাতে বাহির হয়, তাহা হইলে সে কয়টি কথা যেরূপভাবেই থাকুক না কেন, কোন-না-কোন প্রকারে অর্থসংগ্রহ করিবার মত সাজাইয়া লওয়া যাইতে পারে।
মনোরমার তাসখানি আমি নষ্ট করিলাম না। আমারও সেই রকম তাস একজোড়া ছিল, তাহা হইতেই বাছিয়া হরতনের নওলাখানি বাহির করিয়া লইয়া ফোঁটা কয়টি কাটিয়া ফেলিলাম। টেবিলের উপরে ফেলিয়া ফোঁটা কয়টি কাটিতে গিয়া, আমার টেবিল স্থানে স্থানে নষ্ট হইয়া গেল। সেদিকে তখন আমার কিছুমাত্র দৃষ্টি পড়িল না। নবীনের সেই চিঠিখানিতে আমার তখন এত অধিক আগ্রহ জন্মিয়াছিল যে, যখন জানিতে পারিলাম, আমার টেবিলটি খারাপ হইয়া গিয়াছে, তখনও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করিবার ইচ্ছা হইল না।
হরতনের নওলাখানির নয়টি ফোঁটা কাটিয়া ফেলাতে যে নয়টি রন্ধ্র হইয়াছিল, তাহার ভিতর দিয়া মূল পত্রের নয়টি কথা দেখিতে পাওয়া গেল। যথা—
“নাই—জুয়া—সব—হাতে—একটিও—
রজনীতে—টাকা—হারিয়াছি—খেলায়—”
প্রায় বিংশতি বার ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে কথাগুলি সাজাইয়া শেষে যাহা দাঁড়াইল, তাহা এই;
“হাতে একটিও টাকা নাই। জুয়া খেলায় সব হারিয়াছি। রজনীতে—”
তীক্ষ্ণদৃষ্টি, প্রত্যুৎপন্নমতি ও পর্যবেক্ষণ শক্তির জন্য অন্তরে অন্তরে আপনাকে আপনি যথেষ্ট প্রশংসা করিয়া শেষে স্থির করিলাম যে, হয়তো নবীন বাড়ী হইতে বিতাড়িত হওয়াতে ও পিতার নিকট হইতে নিজ অসচ্চরিত্রতার দোষে কোন প্রকারে অর্থ সংগ্রহ করিতে না পারাতে, সহোদরা মনোরমার ভক্তি, শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালবাসার উপর নির্ভর করিয়াছিল। অর্থের আবশ্যক হইলেই বোধ হয়, নবীন মনোরমাকে পত্র লিখিত। মনোরমা নবীনকে প্রাণের সহিত ভালবাসে; সুতরাং সে তাহার সহোদরকে যথাসাধ্য সাহায্য করিতে ত্রুটি করিত না।
নবীনের চরিত্রের দোষে তাহার পিতা তাহাকে ত্যাজ্যপুত্র করিতে বিন্দুমাত্র ক্লেশ বোধ করেন নাই। প্রবল স্নেহের বশে, মনোরমা সেই সহোদরকে গুপ্তভাবে সাহায্য করিত, ইহাই যদি ধরিয়া লওয়া যায়, তাহা হইলে মনোরমার চরিত্র, আদর্শ চরিত্র বটে।
যাহাই-হউক, আপাততঃ সে ভাবনা ত্যাগ করিয়া বর্ডারের বর্ণমালা ও নম্বরগুলির সহিত পরের কথাগুলির কোন সম্বন্ধ আছে কি না জানিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। পাছে দেখিবার কোন প্রকার গোল হয়, এইজন্য হরতনের নওলার নয়টি বিবরের ভিতর দিয়া যে নয়টি কথা দেখা যাইতেছিল, সেই নয়টি কথা ঠিক সেইরূপভাবে আর একখানি কাগজে তুলিয়া লইলাম। তাহার চারিধারে পূর্ব্বের ন্যায় রুল কাটিয়া বর্ণমালা ও নম্বর অবিকল মূল পত্র হইতে নকল করিলাম। তাহাতে এইরূপ দাঁড়াইল; —
ভাবিলাম, নম্বর এবং বর্ণমালা লইয়াই যখন এত সাজান-গোজান, তখন নিশ্চয়ই এই নম্বরে কিম্বা বর্ণমালায় পত্রখানি পাঠ করিবার উপায় ও সঙ্কেত আছে। যেমন এই কথা আমার মনোমধ্যে উদিত হইল, অমনি তৎক্ষণাৎ আমি সেই নয়টি কথার নীচে এক, দুই, তিন, চারি হইতে নয় পর্য্যন্ত নম্বর দিলাম। নম্বর বসাইয়াই বর্ডারের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, “ক” এর গায়ে ৪ নম্বর লিখিত আছে। আমারও ৪ নম্বর পড়িয়াছে “হাতে” এই কথার উপর। আমার যে কি পৰ্য্যন্ত আনন্দ হইল, তাহা এক মুখে বলিয়া শেষ করা যায় না। কারণ, নয়টি কথা প্রথমে যাহা “হরতনের নওলার” নয়টি ছিদ্র দিয়া বাহির হইয়াছিল, তাহা এই;-
“নাই—জুয়া—সব—হাতে—একটিও
(১) (2) (৩) (8) (৫)
রজনীতে—টাকা—হারিয়াছি।—খেলায়—”
(৬) (৭) (৮) (৯)
অনেক কষ্টে, আন্দাজে, আমি উপরোক্ত নয়টি কথা সাজাইয়াছিলাম এইরূপ;—
(১) (২) (৩) (8) (৫)
“হাতে একটিও টাকা নাই। জুয়া
(৪) (৫) (৭) (১) (২)
(৬) (৭) (৮) (৯)
খেলায় সব হারিয়াছি। রজনীতে —”
(৯) (৩) (৮) (৬)
পাঠকগণের সুবিধার্থ, আমি অসম্বন্ধ নয়টি কথা লইয়া, আন্দাজে তাহা কেমন করিয়া সাজাইয়াছিলাম, তাহা পুনরায় মিলাইবার জন্য উপরে দেওয়া হইল। অসম্বন্ধ নয়টি কথায় এক হইতে নয় পর্য্যন্ত নম্বর দেওয়া হইয়াছে। সেই সেই নম্বরের কথাগুলি সাজাইয়া কিরূপ দাড়াইয়াছে, দেখুন;
নম্বর ৪ এর কথাটি (অর্থাৎ “ হাতে”) হইয়াছে নম্বর ১
নম্বর ৫ এর কথাটি (অর্থাৎ “একটিও”) হইয়াছে নম্বর ২
নম্বর ৭ এর কথাটি (অর্থাৎ “টাকা”) হইয়াছে নম্বর ৩
নম্বর ১ এর কথাটি (অর্থাৎ “নাই।”) হইয়াছে নম্বর ৪
নম্বর ২ এর কথাটি (অর্থাৎ “জুয়া”) হইয়াছে নম্বর ৫
নম্বর ৯ এর কথাটি (অর্থাৎ “খেলায়”) হইয়াছে নম্বর ৬
নম্বর ৩ এর কথাটি (অর্থাৎ “সব”) হইয়াছে নম্বর ৭
নম্বর ৮ এর কথাটি (অর্থাৎ “হারিয়াছি।”) হইয়াছে নম্বর ৮
নম্বর ৬ এর কথাটি (অর্থাৎ “রজনীতে”) হইয়াছে নম্বর ৯
এখন বুঝিলাম ৪, ৫, ৭, ২, ৯, ৩, ৮, ৬, এই নম্বর অনুসারে পড়া যদি আমার জানা থাকিত, তাহা হইলে আমিও অল্প সময়ের মধ্যেই পত্রখানি পাঠ করিতে পারিতাম। তবে আমার বিশ্বাস, এইরূপ বাঁধা নিয়মে, বাঁধা নম্বর অনুসারে বোধ হয় মনোরমা ও নবীন কখনই পত্রাদি লেখালেখি করিত না। হয়তো কার পরে কোন্ নম্বরের কথাটি পড়িতে হইবে, সে বিষয়ে প্রত্যেক বারেই নতুন নতুন সঙ্কেত থাকিত। এই বিশ্বাস দৃঢ়তর করিবার জন্য আমি নবীনের আর একখানি পত্র মিলাইলাম। বাস্তবিক দেখিলাম, যা ভাবিয়াছিলাম তাই। প্রত্যেক পত্রে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের পার্শ্বদেশে ভিন্ন ভিন্ন নম্বর। দ্বিতীয় পত্রখানি আর ৪, ৫, ৭, ১, ২, ৯, ৩, ৮, ৬, এই নম্বর ধরিয়া পাঠ করিতে পারা গেল না।
তখন অনন্যোপায় হইয়া আমি বর্ডারের নম্বরগুলি প্রত্যেক বর্ণের পাশে সাজানোর কোন প্রকার সূত্র বা নিয়ম আছে কি না, তাহাই জানিবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিতে লাগিলাম। দেখিলাম;–
ক (৪) খ (৫) গ (৭) ঘ (১) ঙ (২) চ (৯) ছ (৩) জ (৮) ঝ (৬)
এইরূপ প্রথায়, প্রত্যেক বর্ণের পার্শ্বে প্রত্যেক নম্বর যেরূপভাবে সাজান হইয়াছে, তাহা হইতেও আমি দেখিতে পাইলাম ৪, ৫, ৭, ১, ২, ৯, ৩, ৮, ৬।
তখন আর আমার বুঝিতে বাকী রহিল না যে, কিরূপ প্রথায় বর্ডারের বর্ণমালা ও নম্বরগুলি ধরিয়া পত্রের কথাগুলি পড়িতে হয়।
আমি বুঝিলাম, মনোরমা ও নবীন, “হরতনের নওলা” সামনে রাখিয়া পত্রাদি লিখিত। তাসের নয়টি ফোঁটার নয়টি অক্ষর লইয়াই পত্র আরম্ভ হয়। সে নয়টি অক্ষরও আবার এমন উলটা পাল্টা ভাবে সাজান থাকে যে, তাহাই বুঝিবার জন্য সঙ্কেতের সৃষ্টি হইয়াছে। সে সঙ্কেতের সৃষ্টি বর্ণমালা ধরিয়া অর্থাৎ ‘ক’ এর গায়ে যে নম্বরটি থাকিবে উক্ত নয়টি কথার মধ্যে সেই নম্বরের কথাটি হইবে প্ৰথম। ‘খ’ এর গায়ে যে নম্বর থাকিবে, সেই নম্বরের কথাটি হইবে দ্বিতীয় ইত্যাদি ইত্যাদি, “অর্থাৎ বর্ণমালা ধরিয়া পত্র পাঠ করাই নিয়ম।
যাহা হউক, নয়টি কথা লইয়াই তো প্রায় ঘন্টা দুই-চার সময় অতিবাহিত করিলাম; কিন্তু বাকী কথাগুলির উপায় কি! বিশেষতঃ হীরের বালার কথা তো একেবারে ভুলিয়াই গিয়াছিলাম।
“হাতে একটিও টাকা নাই। জুয়া খেলায় সব হারিয়াছি। রজনীতে —”
এই কয়টি কথার পর “হীরের বালা” কথাটি দেখিয়াই, আন্দাজে আমি পত্রের ভাব বুঝিতে পারিলাম বটে, কিন্তু মূলপত্রের বাকী কথাগুলি কি প্রকারে পাঠ করিব, তাহাই আবার চিন্তা করিতে লাগিলাম।
আবার মূলপত্রের আগাগোড়া, এক দুই তিন করিয়া প্রত্যেক কথায় নম্বর দিলাম; কিন্তু এবার আর মিলিল না।
ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবুর মুখে আমি শুনিয়াছিলাম যে, মনোরমার পিতৃভবনে ৮ই পৌষ তারিখে পূর্বোক্ত ভোজ হয়। সেই তারিখেই মনোরমার পিতা তাহাকে হীরার বালা জোড়াটি পরিতে বলিয়াছিলেন; কিন্তু মনোরমার নিকটে তখন সে বালাজোড়াটি ছিল না বলিয়া, সে তাহা পরিতে পারে নাই।
পোষ্টাফিসের ছাপ দেখিয়া ধরিলাম যে, নবীন মনোরমাকে ১৭ই অগ্রহায়ণ তারিখে পত্র লিখিয়াছিল। সুতরাং ধরিয়া লইলাম যে, ১৭ই অগ্রহায়ণ তারিখ হইতে ৮ই পৌষের মধ্যে মনোরমার হীরের বালা হস্তান্তরিত হইয়াছিল।
মনোরমার পিতা ৯ই পৌষ তারিখে, মনোরমাকে বলিয়াছিলেন—”এই মাসকাবার হ’তে না হতেই আমি সেই হীরের বালা জোড়াটি দেখিতে চাই। দেখাইতে পার ভালই, নয় আমায় বলিতে হইবে, তুমি সে বালা কি করেছ বা কাহাকে দিয়াছ। যদি হারাইয়া থাক খুঁজিয়া দেখ।” এ মাস্কাবার কোন্ মাস নিশ্চয়ই পৌষ মাস।
সেই মাস্কাবার হইবার পূর্ব্বেই মনোরমা তাহার পিতাকে হীরের বালা জোড়াটি দেখাইয়াছিল বটে, কিন্ত তৎপরিবর্তে তাহার মূল্যবান অন্যান্য জড়োয়ার গহনা হস্তান্তরিত হইয়াছিল।
এই সকল বিষয় জানিতাম বলিয়া আমি অনুমানে ধরিয়া লইলাম যে, হয়তো নবীন দেনার দায়ে ও জেলে যাইবার ভয়ে, মনোরমার হীরের বালা চাহিয়া লইয়া বন্ধক দিয়াছিল। তাহার পর পিতার পীড়াপীড়িতে, অন্য অলঙ্কার বন্ধক রাখিয়া হীরের বালা জোড়াটি ফিরাইয়া আনিয়াছিল।
অনুমানে একপ্রকার সিদ্ধান্ত হইল বটে, কিন্তু পত্রের বাকী অংশটুকু কেমন করিয়া পাঠ করিব, তাহাই ভাবিয়া পাগল হইলাম। অনেক চেষ্টা করিলাম, তথাপি পাঠ করিতে পারিলাম না। তখন আমার মনে যে আনন্দটুকু হইয়াছিল, তাহাও নিরানন্দে পরিণত হইল। আমি ভাবিলাম, হয়তো প্ৰকৃত সূত্ৰ আমি এখনও বাহির করিতে পারি নাই।
আবার সেই পত্রখানি লইয়া দেখিতে লাগিলাম। বাকী বাইশটি কথা কিছুতেই সাজাইতে পারিলাম না। প্রথমবারে নয়টি মাত্র কথা, যেমন-তেমন করিয়া হউক, একপ্রকার সাজাইয়া লইয়াছিলাম। কিন্তু বাইশটি কথা সাজান, বড় দুষ্কর বলিয়া বোধ হইল। যে উপায়ে প্রথম লাইনটি বাহির করিয়াছিলাম, সেই উপায় অবলম্বনে, কোন ফল হয় কি না, দেখিবার জন্য, পত্রের কথাগুলি আলাহিদা কাগজে লিখিলাম।
“নাই — আত্মহত্যা — জোড়াটি —জুয়া আর — পাখী — কেমন — বেড়ায় — উপায় -সব—হীরের — আছ —হাতে — গুলি—ভাল—একটিও—স্বাধীন— বেশ—রজনীতে –তুমি—কোন —টাকা—উড়িয়া—করিব— পাঠাবে— দেখিনা—নচেৎ-হারিয়াছি – বালা-তারা—খেলায়”
আবার সেইরূপ তাসের দ্বারা রুল কাটিয়া একটি চতুষ্কোণ ঘর করিলাম। তাহার চতুর্দ্দিকে সেইরূপ বর্ডার করিলাম। সেই বর্ডারের ভিতর নম্বর ও বর্ণমালা সাজাইলাম। এবার স্থির করিলাম, মূলপত্রের যে নয়টি কথা, “হরতনের নওলার” নয়টি ছিদ্রদেশ হইতে দেখা গিয়াছিল, নয়টি কথা বাদ দিয়া মিল হয় কি না, দেখিতে হইবে। সেই নয়টি কথা বাদ দিয়া বাকী বাইশটি কথা সাজাইতে এইরূপ দাঁড়াইল;–
বর্ডারের বর্ণমালা ও নম্বর দেখিয়া পত্রের একটি কথাও পাঠ করা গেল না। বড়ই বিপদে পড়িলাম! এতদূর করিয়া শেষে হাল ছাড়িব? কখনই নয়! কখনই নয়!
তারপর বাইশটি কথার উপরে এক হইতে বাইশ পর্য্যন্ত নম্বর দিলাম। “ক” হইতে “ঝ” পৰ্য্যন্ত পূৰ্ব্বলিখিত নয়টি কথায় চুকিয়া গিয়াছে। বর্ণমালা ধরিয়া মূল পত্রের বাকী বাইশটি কথা একে একে পাঠ করিতে লাগিলাম। বর্ডারে দেখিলাম, “ঞ” এই বর্ণের গায়ে “৮” নম্বর দেওয়া আছে। পত্রে “৮” নম্বরের কথাটি কি, সেইদিকে লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম, “৮” নম্বরের কথাটি “হীরের” আর একখানি কাগজে “হীরের” এই কথাটি লিখিলাম।
তারপর দেখিলাম, “ট” বর্ণের গায়ে, “২১” নম্বর দেওয়া আছে। সুতরাং “২১” নম্বরের কথাটি কি, তাহা খুঁজিয়া “বালা” এই কথাটি পাইলাম। পূর্ব্বে “হীরের” কথাটি পাইয়া একখানি কাগজে তাহা লিখিয়াছিলাম। এবার বালা কথাটিও তাহার নীচে লিখিলাম। দুইটি হইল।
এইরূপে পরে পরে এক-একটি কথা বাহির করিয়া, বাইশটি কথায় যেরূপ দাঁড়াইল, তাহা এই;-
ঞ (৮) হীরের
ট (২১) বালা
ঠ (২) জোড়াটি
ড (১৮) পাঠাবে
ঢ (২০) নচেৎ
ণ (১) আত্মহত্যা
ত (১৭) করিব
থ (৩) আর
দ (১৫) কোন
প (৪) পাখী
ফ (১০) গুলি
ব (১৩) বেশ
ভ (১৬) উড়িয়া
ম (৬) বেড়ায়
য (২২) তারা
র (৫) কেমন
ল (১২) স্বাধীন
শ (১৪) তুমি
ষ (১১) ভাল
ধ (৭) উপায়
ন (১৯) দেখিনা
স (৯) আছ
দেখিলাম, বর্ণমালার মধ্যে দুইবার “ব” এই বর্ণের ব্যবহার থাকিলেও, নবীন তাহা ব্যবহার করে নাই। তাহাতে গোলযোগ ঘটিতে পারে বলিয়াই বোধ হয় “প” বর্গের তৃতীয় বর্ণ “ব” গ্রহণ করিয়া আর একটি “ব” পরিত্যাগ করিয়াছে।
প্রথমকার নয়টি কথা এবং উপরের বাইশটি কথা, এখন একত্রে সাজাইয়া পূরা পত্রখানি পাঠ করিলাম;—
“হাতে একটিও টাকা নাই। জুয়া খেলায় সব হারিয়াছি; রজনীতে হীরের বালা জোড়াটি পাঠাইবে। নচেৎ আত্মহত্যা করিব। আর কোন উপায় দেখি না। পাখীগুলি বেশ উড়িয়া বেড়ায়। তারা কেমন স্বাধীন! তুমি ভাল আছ?”
“পাখীগুলি বেশ উড়িয়া বেড়ায়। তারা কেমন স্বাধীন,” এ কথাগুলি লিখিবার কারণ কি? স্থির করিলাম, আসল কথার মধ্যে এই বাজে কথাগুলি সাজান থাকিলে, আর কেহ সহজে আন্দাজে লাইন সাজাইয়া লইতে পারিবে না বলিয়াই, নবীন এইরূপ করিয়াছে।
একখানি পত্রপাঠে এতটা সময় অতিবাহিত হইবে, তাহা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই। আমার ঘাড় পিঠ টন্ টন্ করিতেছিল, বিশ্রাম গ্রহণের জন্য শয়ন করিবামাত্রাই ঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইলাম।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অম্বিকাচরণ বাবু যখন আমার বাসায় আসিলেন, তখন আমি কাপড় বদলাইয়া জামা গায়ে দিতেছি। তিনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিলেন, “হরিদাস বাবু! চিঠি ক’খানার কিছু করিতে পারিয়াছেন কি?” আমি। একখানি চিঠিতেই, কাল রাত কাবার হইয়াছে। দ্বিতীয়খানিতে বড় হাত দিতে হয় নাই। সারারাত্রি জাগরণ হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত নাই। কারণ, আপনি শুনিয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত হইবেন যে, আমি নবীন ও মনোরমার পত্রাদি লিখন-প্রণালীর সঙ্কেত ও চিহ্ন সমস্তই ঠিক করিতে পারিয়াছি। এখন এ রকম যত চিঠি আছে, নিয়ে আসুন, আমি বিনা ক্লেশে পড়িয়া দিতেছি।
অম্বিকা। তাহা হইলে আপনি হরতনের নওলার গুপ্ত রহস্যও ভেদ করিয়াছেন বলুন।
হরিদাস। হাঁ, মনোরমার টেবিলের ভিতর যে হরতনের নওলা ক’খানি পাওয়া গিয়াছিল, তার গুপ্ত রহস্য ভেদ করিয়াছি বটে; কিন্তু যজ্ঞেশ্বর বাবুর আলষ্টার কোটের পকেটে যে হরতনের নওলা পাওয়া গিয়াছিল, সে বিষয়ে এখনও আমি কিছু স্থির করিতে পারি নাই। আমি বড়ই ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছি।
আমি সারারাত্রি জাগিয়া কি করিয়াছি, অম্বিকাচরণ বাবু দেখিতে চাহিলেন। আমি তাঁহাকে দেখাইলাম ও সমস্ত বুঝাইয়া দিলাম। তিনি আমার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন এবং শত শত বার ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। তারপর হঠাৎ কি ভাবিয়া আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিন্তু একটি কথা আছে। ইহাতে মনোরমার কোন অনিষ্ট হইবে না তো?”
আমি। না হওয়াই সম্ভব, কিন্তু যদি হয়, তাহলেও আমাদের ছাড়া উচিত নয়। যজ্ঞেশ্বর বাবু সকল বিষয়ে নির্দোষী—তাঁহাকে আদালতেও নির্দোষ সপ্রমাণ করা আবশ্যক হইতেছে।
অম্বিকা। যদি যজ্ঞেশ্বরবাবু নিদোষ হয়েন, তাহলে মিস্ মনোরমাও দোষশূন্যা বলিয়া প্রমাণিত হওয়া উচিত।
আমি সম্পূর্ণ সাহসের সহিত উত্তর দিলাম, “তার আর ভুল আছে?”
অম্বিকা। এখন আপনি কি করিবেন?
আমি। করিবার আর বড় কিছু নাই, সবই প্রায় শেষ করিয়া আনিয়াছি। এখন নিকলাস সাহেবের বাড়ী যাওয়া যাক্, চলুন। দরজায় আপনার গাড়ী আছে তো?
অম্বিকা। আছে।
আমি। তবে আর কি, চলুন।
এইরূপ কথাবার্তার পর, আমরা উভয়েই বহির্দ্বারে গিয়া গাড়ীতে উঠিলাম এবং যথাসময়ে নিকলাস সাহেবের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। তিনি আমাদের উভয়ের হর্ষোৎফুল্ল নয়ন, মুখের ভাব-ভঙ্গী ও চাল-চলন দেখিয়াই, হয়তো মনে মনে এক প্রকার সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, আমরা যা হয় একটা হেস্ত-নেস্ত করিয়া ফেলিয়াছি। অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে সেইজন্য তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “বোধ হয়, আপনি হরতনের নওলার রহস্য বুঝিতে পারিয়াছেন।”
আমি তখন নিকলাস সাহেবকে আগাগোড়া সমস্ত কথা বলিলাম, এবং হরতনের নওলার রহস্য বুঝাইয়া দিলাম।
তিনি যখন সমস্ত বুঝিতে পারিলেন, তখন অত্যন্ত আহ্লাদিত চিত্তে আমায় বারংবার ধন্যবাদ দিয়া বলিলেন, “তবে আর এবার আমার ভাবনা কি? ২৫শে আষাঢ় তারিখে যজ্ঞেশ্বর বাবুর সঙ্গে মনোরমাই যে গোলদিঘীর কাছ থেকে গাড়ীতে উঠিয়াছিলেন, সে বিষয় প্রমাণ করা কিছু শক্ত হইবে না। অম্বিকা বাবু! আপনি মনে করিবেন না যে, মিস্ মনোরমাকে কোন বিপদে ফেলিব। যজ্ঞেশ্বর বাবু যদি নিৰ্দ্দোষ প্রমাণিত হয়েন, তাহা হইলে মনোরমাও নিরাপরাধা বলিয়া প্রমাণিত হইবেন। এখন বেশ বুঝা যাইতেছে, কেন যজ্ঞেশ্বর বাবু মোকদ্দমায় কোন ব্যারিষ্টারের সাহায্য গ্রহণ করিতে অস্বীকার হইয়াছিলেন। পাকা ব্যারিষ্টারের জেরায় পাছে মনোরমার নাম প্রকাশ হইয়া পড়ে, এই ভয়ে অভাগিনী কুমারীর মান বাঁচাইবার জন্য তিনি অত্মোৎসর্গ করিতে বিন্দুমাত্র ভীত বা কুণ্ঠিত হয়েন নাই। কিন্তু এরূপভাবে অকারণে নির্দোষ ব্যক্তির কোন প্রকার সাজা হওয়া, আমি কখনই দেখিতে পারিব না, আমি নিশ্চয়ই ইহাতে বাধা দিব। মিস্ মনোরমা এখনও রোগ-শয্যায় শায়িতা। আজ পর্যন্ত তাঁহার চৈতন্য হয় নাই। বাহিরের কোথায় কি হইতেছে তাহা তিনি কিছুই জানেন না। যজ্ঞেশ্বর বাবু কি ভয়ানক বিপদে পড়িয়াছেন, অভাগিনী কুমারী তাহার বিন্দুবিসর্গও অবগত নহেন। মনে করুন, যজ্ঞেশ্বর বাবুর দ্বিতীয়বার মোকদ্দমা হওয়ার দিন পর্য্যন্ত তিনি এইরূপ অজ্ঞান অচৈতন্য ভাবেই রহিলেন। এদিকে খুনী মোকদ্দমায় স্ত্রীহত্যার অপরাধে বিনাদোষে যজ্ঞেশ্বর বাবুর ফাঁসী হইয়া গেল। বলুন দেখি, যখন মনোরমা আরোগ্য লাভ করিয়া এই সকল কথা শুনিবেন, তখন কি তিনি উন্মাদিনী হইবেন না? আর কি তাঁহার বাঁচিবার কোন আশা থাকিবে? ডাক্তার বাবু! আপনি কোন চিন্তা করছেন? কর্তব্যকর্ম্মে বিমুখ হওয়া কোন ক্রমেই আমাদের উচিত নয়। মিস্ মনোরমাকে যাহাতে আপনি ত্বরায় রোগমুক্ত করিতে পারেন, তাহার চেষ্টা করুন। যজ্ঞেশ্বর বাবুকে কারামুক্ত করিতে যে যে প্রমাণ আবশ্যক হইবে, এই কয়দিনের মধ্যে সেই সমস্ত যদি আমি সংগ্রহ করিতে না পারি, তাহা হইলে মনোরমাই আমাদের একমাত্র সহায় হইবেন। তিনি এ কথা শুনিলে যজ্ঞেশ্বর বাবুকে রক্ষা করিবার জন্য নিশ্চয়ই স্ব-ইচ্ছায় নিজমুখে সকল কথা স্বীকার করিবেন।”
অম্বিকাচরণ বাবু-ক্ষুণ্নমনে বলিলেন, “কিন্তু মিস্ মনোরমা এখন অত্যন্ত পীড়িতা-আরোগ্য লাভ করা বড়ই দুরূহ—’
নিকলাস। আপনার কি বিশ্বাস, এই পীড়াতেই মনোরমার মৃত্যু হইতে পারে?
অম্বিকা। খুব সম্ভব।
নিকলাস। বোধ হয়, এখন নয়।
অম্বিকা। না।
নিকলাস। আরোগ্য লাভ করিলেও করিতে পারেন?
অম্বিকা। সে আশা অতি সামান্য।
হরিদাস। যদি তাঁহার মৃত্যুর সম্ভাবনাই এত অধিক, তাহা হইলে আপনি বলিতে পারেন, অন্ততঃ পক্ষে মৃত্যুর পূর্ব্বে তাঁহার একবার জ্ঞান সঞ্চার হইতে পারে কি না?
অম্বিকা। জ্ঞান একবার হইবেই হইবে।
হরিদাস। তাহা হইলে অন্ততঃ সেই সময়েও তাঁহাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিয়া লওয়া উচিত।
হরিদাস। পঁচিশে আষাঢ় তারিখে রাত্রি সাড়ে বারোটার সময়ে যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ীতে তিনি যজ্ঞেশ্বর বাবুর সঙ্গে গাড়ী হইতে নামিয়াছিলেন কি না?
অম্বিকা। সে কথা তো খোদাবক্স কোম্যানের জবানবন্দীতেই প্রকাশ হইয়াছে। সে তো বলিয়াছে যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু সেই রমণীকে লইয়া রাত সাড়ে বারোটার সময়ে ঠঠনের হোটেল হইতে বাহির হইয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।
নিকলাস সাহেব হাসিয়া বলিলেন, “ডাক্তার! এ নাড়ীটেপা নয়। এতে কিছু ব্যারিষ্টারী বুদ্ধির দরকার করে। খোদাবক্স কোচম্যান বলিলেই তো আর হইল না; তারও প্রমাণ চাই—সাক্ষী-সাবুদ চাই। নইলে ঐ একটা কথাতেই কত গোলযোগ হইতে পারে। হরিদাস বাবু যাহা ধরিয়াছেন তাহা ঠিক। আমারও বিশ্বাস এই যে, যে পুরুষ ও স্ত্রী সেই রাত্রে যজ্ঞেশ্বর বাবুর গাড়ীতে চড়িয়া ঠঠনের হোটেল হইতে যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ীতে আসিয়া নামিয়াছিলেন, তাঁহারা উভয়েই সব স্ত্রী-পুরুষ। যজ্ঞেশ্বর বাবু বা মনোরমা উভয়ের কেহই নয়।”
হরিদাস গোয়েন্দা বলিলেন, “খোদাবক্স কোচম্যানের জবানবন্দীর সেই অংশটুকু স্মরণ করুন। সে বলে যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু প্রায় রাত বারোটার সময় ঠনঠনের হোটেল হইতে বাহির হইয়া আসেন। তখনও তাঁহার সঙ্গে সেই স্ত্রীলোকটি ছিলেন। তিনি বড় ব্যস্ত-সমস্তভাবে গাড়ীতে উঠিয়াছিলেন। ভাবগতিক দেখিয়া কোচম্যানের বোধ হইয়াছিল যে, তাহার প্রভু মদের ঝোঁকে আছেন। তাহার পর গাড়ীতে উঠিয়া যখন তিনি বলিয়াছিলেন, ‘ঘর চল’ তখন তাঁহার স্বর ভারী-মাতালের মত’ বোধ হইয়াছিল; কিন্ত হরিহর কর্ম্মকারের এজেহারে প্রকাশ যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু মাংসাদি আহারীয় ও লেমনেড স্যাম্পেন প্রভৃতি পানীয় আনিতে হুকুম করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাহার যৎসামান্য পান ও আহার করিয়াছিলেন। সুতরাং এইখানেই খোদাবক্স কোচম্যানের জবানবন্দী কাটিয়া যাইতেছে। তাহার পর দেখুন যজ্ঞেশ্বর বাবু যখন তাঁহার কোচম্যানকে জেরা করেন, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “তুমি বলিতেছ যে, যখন আমি এবং সেই রমণী গাড়ীতে উঠি, সেই সময় আমি তোমায় বলিয়াছিলাম, ‘ঘর চলো’ আমার কন্ঠস্বর তখন ভারী ও মাতালের মত—এই রকম তোমার বোধ হইয়াছিল। আচ্ছা, সে কন্ঠস্বর আমার কি অন্য লোকের তাহা কি তুমি একবারও ভাবিয়া দেখিয়াছিলে? তোমার কি মনে হয় যে, আমিই ‘ঘর চলো’ বলিয়াছিলাম?” এই প্রশ্নের উত্তরে খোদাবক্স বলে “আজ্ঞে হাঁ। আমি একবারের জন্যও ভাবি নাই যে, সে আওয়াজ অপর কারুর।” যজ্ঞেশ্বর বাবুর এইরূপ বিস্ময়কর প্রথার জেরায় আমার মনে হয় যে, ঠঠনের হোটেল হইতে বাহির হইয়া তিনি এবং মিস্ মনোরমা কখনই সে গাড়ীতে চড়েন নাই।
অম্বিকা। কিন্তু তাঁহার গায়ে সেই আষ্টার কোটটি তো ছিল?
হরিদাস। তারও বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে। হরিহর কর্ম্মকারের এজেহারে প্রকাশ যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু ঘরের বাহিরে, দেয়ালের গায়ে, তাঁহার আষ্টার কোটটি রাখিয়া রমণীর হাত ধরিয়া গৃহে প্রবেশ করেন। আর একজনের আষ্টার কোটও সেইখানে ছিল। সে স্থানে বিশেষ রকম আলোর বন্দোবস্তও ছিল না। যজ্ঞেশ্বর বাবু চলিয়া আসিবার সময় হরিহরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নাই। হরিহর যজ্ঞেশ্বর বাবুকে আষ্টার কোট গায়ে দিতেও দেখে নাই।
নিকলাস। ডাক্তার, এখনও তুমি বুঝিতে পারিতেছ না—এখনও তোমার সন্দেহ রহিয়াছে।
অম্বিকা। না, এইবার আমি কতকটা বুঝিতে পারিয়াছি। আমি কেবল এই ভাবিতেছি, হরিদাস গোয়েন্দা এ কাজে হাত না দিলে আমরা কি করিতাম? হয়তো বিনা দোষে যজ্ঞেশ্বর বাবুর ফাঁসীর হুকুম হইয়া যাইত। আমি এখন চলিলাম, তোমরা এখন আইন-কানুন ও প্রমাণ-প্রয়োগাদি লইয়া তর্ক-বিতর্ক কর। তাহার পর যাহা সিদ্ধান্ত হয়, আমি আসিয়া শুনিব।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ডাক্তার অম্বিকাচরণ চলিয়া গেলে, আমি এবং নিকলাস সাহেব আবার আর একখানি পত্ৰ লইয়া পড়িলাম। পত্রখানি এইরূপ;-
এই পত্রখানিও পূর্ব পত্রের ন্যায় নবীন মনোরমাকে লিখিতেছে। পত্র পাঠ করিবার উপায় সঙ্কেত ও চিহ্নাদি আমি জানিতাম, নিকলাস সাহেবও বুঝিয়া লইয়াছিলেন। পত্র আরম্ভ করিতে হইলে বর্ডারের ক অক্ষর ও তাহার পরবর্ত্তী নম্বর অনুসারে পড়িতে হয়। সেই সঙ্কেতানুসারে আমি এই পত্রও পাঠ করিতে চেষ্টা করিলাম। এবার ক অক্ষরের নম্বর ৪ নহে ২। সমুদয় বর্ণে এবার অন্য রকম নম্বর পড়িয়াছে। যাহা হউক বুঝিলাম, প্রত্যেকবার ভিন্ন নম্বরে পত্র আরম্ভ হইলেও অক্ষরগুলি পরস্পর ঠিক থাকে—এবারেও ‘ক’ বর্ণে আরম্ভ। এবার হরতনের নওলার ছিদ্রপথে যে ৯টা অক্ষর পাওয়া গেল, তাহাতে ক হইতে ঝ পর্য্যন্ত এইরূপ নম্বর পড়িল—২, ৪, ৩, ১, ৫, ৯, ৮, ৬, ৭। এই নয়টি শব্দ ঐ নম্বর অনুসারে সাজাইয়া পদ হইল;
“ঘোড়া—দৌড়ে—অনেক—টাকা—জিতিয়াছি—জিতের—টাকা—গুলি— সমস্ত—”
তাহার পর এই নয়টি শব্দ বাদ দিয়া বাকী শব্দগুলিতে পূর্ব্ব পত্রের ন্যায় ক্রমান্বয়ে নম্বর দিয়া সৰ্ব্বশুদ্ধ বাইশটি শব্দ পাইলাম। সেই বাইশটি শব্দ বর্ডারের অক্ষরের নম্বরের সহিত মিলাইয়া পরে পরে সাজাইতে লাগিলাম; এবার ঢ বর্ণে। বুঝিলাম, ঢ বর্ণে কোন শব্দ নাই। যাহা হউক, সাজাইতে এইরূপ হইল;—
“দিলে —এবং –তোমার —আর —কিছু —অলঙ্কার —বাঁধা—রাখিলে —হীরের – বালা– জোড়াটি —উদ্ধার —হইতে — পারে —তুমি—কি—বল— নদীর – স্রোতে– সুন্দর—জ্যোৎস্না—ভাসিতেছে।
সম্পূর্ণ পত্রখানি এইরূপ দাঁড়াইল;-
“ঘোড়াদৌড়ে অনেক টাকা জিতিয়াছি, জিতের টাকাগুলি সমস্ত দিলেও এবং তোমার আর কিছু অলঙ্কার বাঁধা রাখিলে হীরের বালা জোড়াটি উদ্ধার হইতে পারে। তুমি কি বল? নদীর স্রোতে সুন্দর জ্যোৎস্না ভাসিতেছে।
এই পত্রে আমি বুঝিতে পারিলাম যে, পিতার পীড়াপীড়িতে মনোরমা হীরার বালা জোড়াটি উদ্ধার করিবার জন্য বড় ব্যস্ত হইয়াছিল। অর্থাভাবে নবীন তাহা বন্ধক দিয়াছিল বটে, কিন্তু পাছে সহোদরার কোনরূপ কলঙ্ক রটে, এই ভয়ে তদুদ্ধারে সে-ও বিশেষ চেষ্টিত হইয়াছিল। সৌভাগ্যবশতঃ নবীন সেই সময়ে ঘোড়-দৌড়ের খেলায় অনেক টাকা জিতিয়াছিল। কিন্তু হীরার বালা জোড়াটি বাঁধা রাখিয়া সে পূৰ্ব্বে যে টাকা লইয়াছিল, বাজীর জিতের সমস্ত টাকা দিলেও সে ঋণ পরিশোধ হইবে না দেখিয়া, সহোদরার নিকট অন্য অলঙ্কার বাঁধা রাখিবার প্রস্তাব করিয়াছিল। সহোদরা মনোরমাও যে এই প্রস্তাবে সম্মত হইয়া তাহা কার্য্যে পরিণত করিয়াছিল, তাহারও প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। মনোরমার মাতা ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবুর সম্মুখেই বলিয়াছিলেন, ‘সেই মাসকাবার হইবার পূর্ব্বেই মনোরমা তাহার পিতাকে হীরার বালা জোড়াটি দেখাইয়াছিল বটে; কিন্তু আমি জানিতাম যে, তৎপরিবর্তে মনোরমার অন্য জড়োয়ার গহনা হস্তান্তরিত হইয়াছিল।’
নিকলাস সাহেব বলিলেন, “বুঝা গিয়াছে। আপনি আর একখানি পত্র পড়িয়া দেখুন।”
আমি তাঁহার কথামত আর একখানি পত্র পাঠ করিলাম;–
“জলের বাজী ও আফিং-এর চিঠিতে অনেক টাকা লোকসান হইয়াছে। কমলিনীর জন্য আমি বোধ হয়, শীঘ্রই ভয়ানক বিপজ্জালে জড়িত হইব। হয় তো বিনা অপরাধে আমার ফাঁসী বা দ্বীপান্তর হইতে পারে। আমি কোন অপরাধে অপরাধী নই—সম্পূর্ণ নিৰ্দ্দোষ! তুমি ভিন্ন জগতে আমার আপনার বলিতে কেহ নাই, তাই তোমায় বলিয়া রাখিলাম। যদি আমার বিপক্ষে কোন বিষম মোকদ্দমা উপস্থিত হয় এবং আদালতের বিচারে যদি আমি শাস্তিভোগ করি, তাহা হইলে তুমি দুঃখিত হইও না। কমলিনীকে আমি প্রাণাপেক্ষা ভালবাসি। আমি জান না, সে আমায় কি গুণ করিয়াছে! আমি তাহার জন্য সকল প্রকার শাস্তি অনায়াসে সহ্য করিতে পারিব। আজ রাত্রি নয়টার পর গোলদীঘীতে সেইখানে সাক্ষাৎ হইবে।” উক্ত পত্র একবারে একখানি হরতনের নওলার ছকে কুলায় নাই। তিনবার করিয়া লিখিতে হইয়াছে। বাজে কথা বাদ দিয়া তাহার সারাংশমাত্র উপরে উদ্ধৃত করা হইল।
পত্রখানি পাঠ করিয়া নিকলাস সাহেব এবং আমি উভয়েই বিস্মিত ও চমকিত হইলাম।
নিকলাস সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কোন্ কমলিনী?”
আমি। এ নিশ্চয় সেই হেমাঙ্গিনীর প্রতিবেশী কন্যা; মাতাপিতা অকালে কাল-কবলিত হওয়াতে হেমাঙ্গিনী যাহাকে আশ্রয়দান করিয়াছিলেন—যে কালসাপিনী যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমায় সাক্ষ্য প্রদান করিয়া নিরপরাধ ব্যক্তির সর্ব্বনাশ সাধন করিয়াছে—এ সেই কমলিনী। দেখুন, আমার সম্মুখে যেন অহোরাত্র চারিটি মূর্ত্তি ক্রীড়া করিয়া বেড়াইতেছে। একদিকে দুইজন পুরুষ—তাহার একজন বদমায়েস নেশাখোর, জুয়াচোর ও পাজী; অপর একজন দধিচারী ন্যায় স্বার্থত্যাগী, বহুগুণসম্পন্ন অমায়িক, শিবতুল্য লোক। অপর দিকে দুইজন স্ত্রীলোক—তাহার একজন কালসাপিনী, সর্ব্বনাশী; অপরজন সীতা সাবিত্রী দময়ন্তীর ন্যায় সতী-সাবিত্রী, ভগ্নহৃদয়ে তনুত্যাগেও কাতরা নয়। এই ভাল দুইজনকে বাঁচাইতেই হইবে। আমি প্রাণ মন দেহ সমর্পণ করিয়াছি—এবার গোয়েন্দাগিরির চূড়ান্ত করিয়া ছাড়িয়া দিব। আপনিও আপনার সমস্ত উৎসাহ, সমস্ত বিদ্যাবল ও বাগ্মীতা সহায়ে ব্যারিষ্টারীর পরাকাষ্ঠা তেজোময়ী বক্তৃতায় প্রকাশ করিবেন। ধর্ম্মের জয়, অধর্ম্মের পতন, নিশ্চয়ই হইবে।
নিকলাস। ক্রমশঃ আমাদের যেরূপ প্রমাণ সংগ্রহ হইতেছে, তাহাতে যজ্ঞেশ্বর বাবু যদি যথার্থ পক্ষে দোষীও হইতেন, তাহা হইলেও আইনের তর্কে ও যুক্তিবলে তাঁহাকে অনায়াসে উদ্ধার করা সম্ভব হইত। আর দুইদিন যদি আপনি এইরূপ অনবরত পরিশ্রম করেন, তাহা হইলে নিশ্চয় আমরা জয়ী হইব।
আমি। এখন আর ঘরে বসিয়া পরিশ্রম করিবার কিছুই নাই। বাহিরে কাজ করা আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। আমার প্রথম এবং প্রধান কার্য্য, কমলিনী ও নবীনের বাসস্থান কোথা, অনুসন্ধান করিয়া তাহা বাহির করা। দ্বিতীয়তঃ তাহাদের সন্ধান পাইলে যাহাতে তাহারা এক মুহূর্ত্তও চোখের অন্তরাল হইতে না পারে, তদুপযুক্ত লোকজন নিযুক্ত করা।
নিকলাস। আপনার উপরে আমি সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়াছি। আপনার গোয়েন্দাগিরি ও তীক্ষ্ণদৃষ্টির প্রতি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। এ মোকদ্দমায় আপনি যত টাকা ইচ্ছা, অবশ্য খরচ-পত্র করিতে পারেন। টাকার অভাব নাই। এখন বাকী চিঠিখানি পাঠ করুন।
আমি বলিলাম, “হাঁ, ওখানির কথা একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিলাম।”
এই কথা বলিয়াই আর একখানি পত্রের আবরণ উন্মুক্ত করিলাম। সেইখানিই যজ্ঞেশ্বর, বাবু কারাগারে নিকলাস সাহেবের হাতে দিয়াছিলেন, তাহা বেশ বুঝা গেল। পত্রখানি অতি ছোট। তাহাতে এই লেখা ছিল;—
“মনোরমে!
আমি ভাল আছি, তুমি আমার জন্য চিন্তিত হইও না। আপাততঃ যতদিন পর্য্যন্ত আমার নিকট হইতে পত্রাদি না পাও, ততদিন আমায় চিঠি লিখিও না। কারণ আছে, পরে বলিব।
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী
শ্রীযজ্ঞেশ্বর মিত্র।”
নিকলাস সাহেব বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! যজ্ঞেশ্বর বাবু কারাগারে বসিয়াও এইরূপভাবে পত্র লিখিয়াছিলেন। এমন দেবচরিত্র, এত স্বার্থত্যাগ, আজকালের কালে তো কোন লোকের দেখা যায় না। যাহাকে ভালবাসেন, তাহার পবিত্র-নামে যাহাতে কোন প্রকারে কলঙ্ক না স্পর্শে, তাহার জন্য এরূপ জ্বলন্ত স্বার্থত্যাগের উদাহরণ তো প্রায় দেখা যায় না। ধন্য নিঃস্বার্থ প্রেম! ধন্য ভালবাসা!! একটি মহজ্জীবনের মূল্য কি এতই তুচ্ছ যে, ভালবাসা ও প্রেমের সহিত তুলাদণ্ডে তাহা তিল পরিমাণে পরিগণিত হয়!”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
তিনদিন ক্রমাগত অনুসন্ধান করিলাম। কলিকাতা তোলপাড় করিয়া ফেলিলাম, তথাপি নবীন ও কমলিনীর কোন সন্ধান করিতে পারিলাম না। যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমার পর সে যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহার কোন সন্ধান পাইলাম না। দশজন গোয়েন্দা এই কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাঁহারাও কিছু করিয়া উঠিতে পারিলেন না। চতুর্থ দিনে বহু ক্লেশের পর জানিলাম যে, ভবানীপুরের দক্ষিণ-পূৰ্ব্ব দিকে মালা রেলওয়ে লাইনে বালিগঞ্জ রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকটবর্ত্তী স্থানে একটি অসচ্চরিত্রা ইংরাজ বারবিলাসিনীর আবাস- মন্দিরের অর্দ্ধাংশ ভাড়া করিয়া নবীন ও কমলিনী নাম ভাঁড়াইয়া বাস করিতেছে।
আমি যথাসময়ে ছদ্মবেশে তথায় উপস্থিত হইলাম। নবীন যে নামে তথায় বাস করিতেছে, সেই নাম ধরিয়া, আমি তাঁহার একজন বিশেষ বন্ধু বলিয়া পরিচয় দিয়া তথায় প্রবেশলাভ করিলাম। শুনিলাম, নবীন অত্যন্ত অসুস্থ শরীরে তথায় অবস্থান করিতেছে। আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলাম, কিন্তু যাহার বাড়ী, সে তাহাতে বিশেষ আপত্তি উত্থাপন করিল। সে বলিল, “কোন লোকের সহিত তিনি এখন সাক্ষাৎ করিতে প্রস্তুত নহেন। তিনি এ বিষয়ে বিশেষ করিয়া নিষেধ করিয়াছেন। সুতরাং আমি আপনাকে তথায় লইয়া যাইতে পারি না।”
আমি। তিনি কোন্ ঘরে আছেন?
বাড়ীওয়ালী আমার উদ্দেশ্য বুঝিতে না পারিয়া ইঙ্গিতে আমায় নবীনের ঘর দেখাইয়া দিল। আমি আর কোন কথা না কহিয়া তৎক্ষণাৎ সেইদিকে অগ্রসর হইলাম।
বাড়ীওয়ালী কহিল, “আমি আপনাকে নিষেধ করিলাম, তথাপি আপনি জোর করিয়া ও ঘরের দিকে যাইতেছেন, তাহা হইলে আমার কোন দোষ নাই।”
আমি তাহার দিকে ফিরিয়া বলিলাম, “তোমার কোন ভয় নাই, উনি আমার পরম বন্ধু, আমাকে দেখিলে রুষ্ট হওয়া দুরে থাক, বরং তুষ্ট হইবেন।”
আমার কথা শুনিয়া সে অবাক্ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আমি নবীনের কক্ষমধ্যে প্রবিষ্ট হইলাম।
নবীনকে আমি পূর্ব্বে কখনও দেখি নাই। তবে ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবু মনোরমার মাতার নিকট হইতে নবীনের একখানি ফটোগ্রাফ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সেইখানি আমি ভাল করিয়া দেখিয়াছিলাম। তাহাতেই তাহার আকার-প্রকার সম্বন্ধে আমার যে ধারণা ছিল, সেই ধারণা বলেই যতদূর সম্ভব, অনুমান করিয়া লইলাম।
নবীন একখানি পালঙ্কের উপরে শয়ন করিয়াছিল। হঠাৎ আমি গৃহপ্রবিষ্ট হইবামাত্র সে চমকিত হইল, ভয়ে তাহার মুখ পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল। অপরিচিত ব্যক্তিকে বিনানুমতিতে গৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়া সে শয্যায় উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কে তুমি? কি চাও?”
আমি নবীনের কথায় কোন উত্তর প্রদান না করিয়া ভিতর হইতে গৃহের দ্বার রুদ্ধ করিলাম। নবীন ভীত ও বিস্মিত হইয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কে আপনি? দরজা বন্ধ করিতেছেন কেন?”
আমি। ব্যস্ত কেন, এখনই জানিতে পারিবেন। আমি আপনার সঙ্গে দুই-চার মিনিট কথা কহিতে চাই। আপনাকে কি এখন মিষ্টার রিচার্ড বলেই সম্বোধন করিতে হইবে?
নবীন। আজ্ঞা হাঁ, আমার নামই তাই।
আমি। যদি বন্ধুভাবে আপনার কাছে না আসিতাম, তাহা হইলে ঐ নাম লইয়া ঝগড়া করিবার আমার কারণ ছিল। এখনও যে নামের কথায় আপত্তি উত্থাপন করা অনুচিত, তাহা নয়। আপনার নাম নবীন-
আমার মুখের এই কথা শুনিবামাত্র নবীনের মুখমণ্ডল আরও বিশুষ্ক হইয়া গেল। সে কম্পিতকলেবরে পালঙ্কের উপরে পতিত হইল। রুদ্ধকন্ঠে, ভগ্নস্বরে নবীন তখন বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ সব কথার মানে কি? আপনি কেন এখানে আসিয়াছেন?”
আমি। তাহা বলিতেছি—তবে ক্রমশঃ কোন কথা গোপন রাখিবার আর প্রয়োজন নাই—আপনারা সহোদরা-
বাধা দিয়া নবীন বলিল, “আমার সহোদরা! আমি আপনার কথা বুঝিতে পারিতেছি না।”
আমি। আপনি বেশ বুঝিতে পারিতেছেন। আপনার এক যমজ সহোদরা আছেন, তাঁহার নাম মনোরমা। তিনি এখন মৃত্যুশয্যায় শায়িতা—আপনিই তাঁহার এ দুরবস্থা করিয়াছেন—আপনিই তাঁহার সর্ব্বনাশের মূল কারণ—
নবীন দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া ফেলিল। আমি বুঝিতে পারিলাম, সংসর্গদোষ দুর্ভাগ্য যুবকের এরূপ অধোগতি হইয়াছে; কিন্তু সহোদরার প্রতি তাহার স্নেহ-ভালবাসা এখনও অটুটভাবে রহিয়াছে।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি মনোরমার এ অবস্থার কথা কিছু জানিতেন?”
নবীন। না। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা কি সত্য?
আমি। হাঁ, আমার কথা সত্য। আমি আপনার কাছে মিথ্যা কথা কহিতে আসি নাই। এখন আপনার হাতেই তাঁহার জীবন-মরণ নির্ভর করিতেছে—আপনার জন্যই অভাগিনী নিজ জীবনের সর্ব্বসুখ বিসর্জ্জন দিয়া অপার্থিব স্বার্থত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। আপনার জন্য অভাগিনী কি না করিয়াছেন? এখন তিনি মৃত্যুমুখে পতিতা—
নবীন। বলেন কি? বলেন কি? কি সৰ্ব্বনাশ!
আমি। আমি কি আপনার সঙ্গে বিদ্রূপ করিতে আসিয়াছি? হেমাঙ্গিনীর হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে আপনি যদি নিদোষ হন, তাহা হইলেই অভাগিনীর জীবন রক্ষা হইতে পারে।
নবীন। আমি নিদোষী! ভগবান্ জানেন, আমি সম্পূর্ণ নিরাপরাধ!
আমি। শপথ করিয়া বলিতে পারেন?
নবীন। পারি।
আমি। আপনি নিদোষ হইয়াও তবে কেন চোরের মত লুকাইয়া রহিয়াছেন? আর আপনার লুকাইয়া থাকার জন্য আর একজন নিরপরাধ ব্যক্তি খুনের দায়ে কারাগারে যন্ত্রণা ভোগ করিতেছেন, অথচ সে খুন আপনিও করেন নাই, তিনিও করেন নাই। নির্দোষ হইয়াও আপনি অনায়াসে আর একজনের ফাঁসী হইয়া যাওয়া পর্য্যন্ত, এই রকমে লুকাইয়া থাকিতে পারিতেন, আশ্চৰ্য্য! আপনি আপনার ভগ্নীর বিপদের কথা না জানিতে পারেন, এ কথা আমি বিশ্বাস করিতেও পারি; কিন্তু যজ্ঞেশ্বর বাবুর বিপদের কথা নিশ্চয় আপনি শুনিয়াছেন, নিশ্চয় আপনি সে কথা জানেন। এ কথা আপনি কিছুতেই অস্বীকার করিতে পারেন না। মনে রাখিবেন, আর আপনার লুকাইয়া থাকিলে চলিতেছে না—আর আপনি এ সকল কথা অপ্রকাশ রাখিতে পারিতেছেন না।
নবীন। না, যজ্ঞেশ্বর বাবুর বিপদের কথা আমি শুনি নাই বা জানি না, এ কথা বলিতে পারি না—এ কথা আমি অস্বীকার করিতে পারি না। আমি তাঁহার মোকদ্দমার কথা জানি।
আমি ঘৃণার সহিত বলিলাম, “তবে আপনি সাহসী যুবার ন্যায় সত্যপরায়ণতা দেখাইতে কুণ্ঠিত হইয়াছিলেন কেন? কেন আপনি মোকদ্দমার দিনে নিজে স্ব ইচ্ছায় আদালতে উপস্থিত হইয়া এ কথা বলেন নাই যে, পঁচিশে আষাঢ় তারিখের রজনীতে, যজ্ঞেশ্বর বাবু এবং আপনার ভগ্নী ঠঠনের হোটেলে যে কক্ষে বসিয়াছিলেন, তাহার পাশের ঘরে সাহেববিবি সাজে আপনি এবং কমলিনী উপবিষ্ট ছিলেন? কেন স্বীকার করেন নাই যে, পাপিনীর পাপ-মন্ত্রণায় আপনি যজ্ঞেশ্বর বাবুর আষ্টার কোটটি চুরি করিয়া যে গাড়ীতে আপনার ভগ্নী যজ্ঞেশ্বর বাবুর সঙ্গে আসিয়াছিলেন, সেই গাড়ীতে আপনার প্রণয়িনীর সঙ্গে চলিয়া গিয়াছিলেন? আমার কথার উত্তর দিন, কেন আপনি জানিয়া-শুনিয়া একজন নিরপরাধ ব্যক্তির ফাঁসী দেখিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিলেন? যজ্ঞেশ্বর বাবু খুন করেন নাই, জানিয়াও কেমন করিয়া আপনি নীরব হইয়া আছেন?”
নবীন চীৎকার করিয়া বলিল, “সে খুন নয়! খুন নয়! হেমাঙ্গিনী নিজের হাতে নিজের জীবন নাশ করিয়াছে, সে আত্মহত্যা করিয়াছে!”
সহসা এই কথা শুনিয়া আমার চমক ভাঙ্গিল। এতক্ষণে যে ঘটনা আমি খুন বলিয়া মনে করিতেছিলাম, এখন আমার ধারণা হইল যে, তাহা খুন নহে— আত্মহত্যা! আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “হেমাঙ্গিনী নিজহস্তে নিজের প্রাণনাশ করিয়াছেন? হেমাঙ্গিন আত্মহত্যা করিয়াছেন?”
নবীন। হাঁ, আত্মহত্যা করিয়াছেন। বিছানার পাশে টিপায়ের উপরে তাঁহার স্ব-হস্তলিখিত একখানি পত্রে তাহার প্রমাণ ছিল।
আমি। সেটি আপনি সরাইয়াছিলেন—কেমন?
নবীন। না—না—আমি নয়—আমি নয়—সেখানি কমলিনী লইয়াছিল।
সত্যকথা বলিতে কি এই কথা শুনিয়া আমার সর্বশরীর শিহরিত হইল, অন্তর আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিল, কিয়ৎক্ষণ আমি আর একটিও কথা কহিতে পারিলাম না। ক্ষণকাল নতমুখে চিন্তার পর আমি নবীনের দিকে ফিরিয়া বলিলাম, “আপনার যেন মনে থাকে যে, আপনি এমন একজন লোকের সম্মুখে কথা কহিতেছেন, যে, নির্দোষ ব্যক্তির জীবন রক্ষার জন্য প্রাণ, মন, দেহ উৎসর্গ করিয়াছে। স্মরণ রাখিবেন, আপনার সঙ্গে যে কথা কহিতেছে, সে “ধর্ম্মের জয়— অধর্ম্মের ক্ষয়” রাজদ্বারে প্রকৃত প্ৰমাণ প্রয়োগে সপ্রমাণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। নিশ্চয় জানিবেন, আপনার ভাগ্যের ফলাফল এখন আমার উপরে নির্ভর করিতেছে। আমি আপনার সর্ব্বনাশ করিতে পারি। যদি আপনি আমার সহিত বিন্দুমাত্র চাতুরী খেলিতে চেষ্টা করেন, তাহা হইলে আপনার সেই সামান্য প্রবঞ্চনার জন্যও আপনার সর্ব্বনাশ হইতে পারে। আপনার জীবনস্রোতের এই এক ভয়ানক আবৰ্ত্তন! এই তরঙ্গায়িত স্রোতে আপনার জীবনের গতি ফিরিবে। আপনার সত্যপরায়ণতার উপরে আপনার অদৃষ্ট নির্ভর করিতেছে। প্রাণ মন খুলিয়া আমার কাছে সমস্ত সত্যকথা বলুন—কোন কথা গোপন করিবেন না। আপনার উৎসন্নে যাইবার সূত্রপাতের দিবস হইতে আজ পর্য্যন্ত আপনার জীবনে কি কি ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা আমি শুনিতে চাই।”
বিদগ্ধ-হৃদয় নবীন তখন আত্মজীবনী বর্ণন করিতে আরম্ভ করিল। আমি অত্যন্ত আগ্রহের সহিত তাহা শ্রবণ করিতে লাগিলাম। মাঝে মাঝে তাহাকে প্রবোধবাক্যে উৎসাহিত করিতেও হইল। নবীনের সে নিরাশাপূর্ণ ভগ্নহৃদয়ের কাহিনী শ্রবণ করিয়া আমার বড় দুঃখ হইল।
কলিকাতার হেয়ার সাহেবের স্কুল হইতে এন্ট্রান্স পাশ হইয়া নবীন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্ত্তি হয়। যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতার সহিত শিবপুরে তাহার আলাপ হয়। যদিও তিনি নবীন অপেক্ষা অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ, তথাপি নবীনের সহিত তাঁহার সৌহৃদ্য জন্মে। যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতার অনেক দোষ ছিল। তিনি অনেকের সর্ব্বনাশ করিয়া অর্থসঞ্চয় করিয়াছিলেন। এমন কোন প্রকার জুয়াখেলা নাই যে, যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতা তাহাতে অপরিপক্ক ছিলেন। এই সকল কারণে উদারহৃদয় যজ্ঞেশ্বর বাবু পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। পিতার সহিত যজ্ঞেশ্বর বাবুর সাংসারিক কোন সম্পর্কই ছিল না।
যজ্ঞেশ্বর বাবু স্বকৃত উপার্জ্জনে কলিকাতায় বাটী নির্ম্মাণ করিয়া স্বতন্ত্রভাবে বাস করিতেছিলেন।
যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতারও কলিকাতায় পাঁচ-সাতখানি বাড়ী ছিল, কিন্তু তিনি কলিকাতায় থাকিতেন না। তাঁহার বাড়ীতে প্রতিদিনই প্রেমারা খেলার আড্ডা বসিত। কলিকাতায় দুই-তিনবার ধরা পড়িয়া তাঁহার জরিমানা হয়। সেইজন্য তিনি কলিকাতার বসত-বাটী পর্য্যন্ত ভাড়া দিয়া শিবপুরে তাঁহার বাগান-বাটীতে বাস করিতেছিলেন। অনেক ধনি-সন্তান নানাবিধ জুয়াখেলা খেলিতে এই শিবপুরের বাগানে উপস্থিত হইতেন। যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতা জুয়াখেলায় সর্বনাশসাধন করিবার জন্য ধনি-সন্তানগণকে যোগাড় করিতেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তাঁহারই কুহকে পড়িয়া নবীনের সৰ্ব্বনাশ হইয়াছিল।
যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতা এখন পরলোক গমন করিয়াছেন, সুতরাং তৎসম্বন্ধে অধিক আলোচনা করা অন্যায় বলিয়া বিবেচনা করি। তবে এই ঘটনা সপ্রমাণ করিবার জন্য যে সকল বিষয় অত্যাবশ্যক, তাহাই অতি সংক্ষেপে নিম্নে লিখিত হইল।
যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতা নবীনকে অংশীদার স্বরূপে গ্রহণ করিয়া ব্যবসা করেন। সাংসারিক জ্ঞানহীন অপরিণত বয়স্ক যুবা নবীন, তাঁহার বিষম চাতুরী অনুধাবন করিতে না পারিয়া বার বার প্রবঞ্চিত হয়।
যজ্ঞেশ্বর বাবু প্রথমে এ সকল কিছুই জানিতেন না। পিতার সহিত স্বতন্ত্রভাবে থাকিলেও পুত্রের কর্তব্য কার্য্যে তিনি কখনই অবহেলা করেন নাই। প্রায়ই তিনি পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিতেন এবং কোন বৈষয়িক কার্য্যে বিশেষ পরামর্শের আবশ্যক হইলে তিনি সৰ্ব্বপ্রথমেই তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন।
যজ্ঞেশ্বর বাবু স্বতন্ত্রভাবে থাকিতেন বলিয়া তাঁহার পিতা তাঁহার উপরে অসন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি জানিতেন যে, তাঁহার পুত্র তাঁহার কার্য্যকলাপে তাঁহার উপর ঘৃণা প্রকাশ করিবেন। তদপেক্ষা স্বতন্ত্রভাবে থাকাতে আপত্তি কি? বিশেষতঃ যজ্ঞেশ্বর বাবুর স্বতন্ত্রভাবে থাকিবার ব্যয়ভার তাঁহাকে বহন করিতে হয় নাই বলিয়া তিনি এরূপ স্বতন্ত্রতার অপক্ষপাতী হয়েন নাই।
মিস্ মনোরমার মুখ চাহিয়া তাঁহার সহোদর নবীনকে অধঃপাতের পথ হইতে ফিরাইবার জন্য যজ্ঞেশ্বর বাবু অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কখনই তাহাতে কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই।
যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতা এবং নবীন উভয়েই ঘোড়দৌড়ের বাজী খেলিতেন। উভয়েই তাহাতে বহু সহস্র মুদ্রা হারিয়াছিলেন।
হেমাঙ্গিনীর পিতা বাজী গ্রহণ করিতেন; তাহা পূৰ্ব্বেই উক্ত হইয়াছে। নবীন এবং যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতা তাঁহারই নিকটে বাজী রাখিতেন। ক্রমে ক্রমে তাঁহার নিকটে ইহাদের অপৰ্য্যাপ্ত ঋণও হইয়া পড়িয়াছিল। সে ঋণ পরিশোধ করিবার জন্য হেমাঙ্গিনীর পিতা বিশেষ পীড়াপীড়ি করাতে নবীন ও যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতা উভয়ে উভয়ের সমস্ত ঋণ স্বীকার করিয়া হেণ্ডনোট লিখিয়া দেন।
ঋণ যতই বাড়িতে লাগিল, যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতা ও নবীনের অর্থোপার্জ্জনের লালসা ততই প্রবল হইতে লাগিল। ততই তাঁহারা অধিকতর চাতুরী-জালপূর্ণ জুয়াখেলায় মন দিতে লাগিলেন। শেষে তাহাতেও সাম্লাইতে না পারিয়া জাল জুয়াচুরি আরম্ভ করিলেন। সেই সকল জালজালিয়াতীপূর্ণ কাগজ-পত্র হেমাঙ্গিনীর পিতার হস্তগত হওয়াতেই বিষবৃক্ষ রোপিত হইল। সেইখান হইতেই সর্বনাশের সূত্রপাত হইল।
এই ঘটনাটির মীমাংসার জন্য দায়ে পড়িয়া যজ্ঞেশ্বর বাবুকে হেমাঙ্গিনীর পিতার নিকট যাইতে হয়। মিস্ মনোরমা যজ্ঞেশ্বর বাবুকে পত্রের দ্বারা জ্ঞাত করেন যে, তাহার ভ্রাতা নবীন বড় বিপদে পড়িয়াছে এবং বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করিয়া অনুরোধও করেন যে, নবীনকে যে কোন প্রকারে হউক, উদ্ধার করিতেই হইবে। কেন না, হেমাঙ্গিনীর পিতা নবীনের নামে নালিশ করিবেন বলিয়া ভয় দেখাইয়াছেন। যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতার সহিত নবীনের কি প্রকার সম্বন্ধ, তাহা বোধ হয়, মিস্ মনোরমা সে সময়ে জানিতেন না।
হেমাঙ্গিনী, যজ্ঞেশ্বর বাবুকে দেখিয়া তাঁহার প্রণয়াকাঙ্ক্ষিণী হয়েন। তাঁহার পিতা যে প্রকার ধরণের লোকই হউক না কেন, তিনি একমাত্র কন্যা হেমাঙ্গিনীকে প্রাণাপেক্ষা ভালবাসিতেন এবং কেবল তাহার কথায় যজ্ঞেশ্বর বাবুর পিতা ও নবীনকে বিপদগ্রস্ত হইতে হয় নাই। যজ্ঞেশ্বর বাবুকে তিনি বলিয়াছিলেন, “যদি আপনি আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করেন, তাহা হইলে আমি সেই সকল কাগজ-পত্র ও হেণ্ডনোট আপনাকে ফিরাইয়া দিতে পারি—নচেৎ নয়।”
এইরূপ ভয়ানক অবস্থায় পড়িয়া মনোরমার একান্ত অনুরোধে মনোরমাকে বিবাহ করিবার আশা যজ্ঞেশ্বর বাবুকে পরিত্যাগ করিতে হইয়াছিল। তিনি জানিতেন, হেমাঙ্গিনীকে বিবাহ করিলে আর তিনি মনোরমাকে পাইবেন না। এদিকে নবীনকে বাঁচাইতে না পারিলে মনোরমাও বাঁচিবেন না। এই উভয় সঙ্কটে পড়িয়া নিজ জন্মদাতাকে রক্ষা করিবার জন্য ও মনোরমার ভ্রাতাকে উদ্ধার করিবার আশায় তিনি বাধ্য হইয়া নিজ জীবনের সর্ব্বসুখ বিসর্জ্জন দিয়াছিলেন— যাহাকে এক তিল ভালবাসিতেন না, তাহারই পাণিগ্রহণে সম্মত হইয়াছিলেন।
ভালবাসা, মান সম্ভ্রম ও জীবনের সর্ব্বসুখ বিসর্জ্জন দিয়া খঙ্গাগ্রে আপন জীবন উৎসর্গ করিয়া যজ্ঞেশ্বর বাবু নিঃস্বার্থ পরোপকার ও আশ্চর্য্য উদারতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছিলেন। যাঁহাদিগের রক্ষার জন্য তিনি হেমাঙ্গিনীর পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের সর্ব্বনাশের মূল সূত্রস্বরূপ সেই সকল কাগজ-পত্র তিনি সমস্তই ফিরাইয়া পাইবেন, এই কথাই হইয়াছিল। কিন্তু হেমাঙ্গিনীর পিতা যজ্ঞেশ্বর বাবুকে সেই সকল কাগজ-পত্র ফিরাইয়া দিবার সময় তিনখানি লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন। যজ্ঞেশ্বর বাবু বিবাহের কিছুদিন পরে সে কথা জানিতে পারিয়াছিলেন।
যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ীতেই কমলিনীর সহিত নবীনের আলাপ-পরিচয় হয়। মায়াবিনী কৌশলজাল বিস্তারপূর্ব্বক দুর্ভাগা নবীনকে মোহিত করিয়াছিল। এমন কি তাহার হাত হইতে নবীনের উদ্ধারের আর কোন উপায় ছিল না। সে সকল চক্রান্তের কথা এখানে বর্ণন করিবার কোন আবশ্যকতা নাই বলিয়া তাহা পরিত্যাগ করিলাম। কমলিনী নবীনকে এমন মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল যে, সে তাহাকে যে দিকে ফিরাইত, নবীন সেইদিকে ফিরিত; যে কথা বলিত, সে তাহাই শুনিত। কিন্তু এতদূর মুগ্ধ হইয়াও নবীনের নিজ বংশমর্য্যাদা ও পৈত্রিক মান-সম্ভ্রম কখন কখন স্মরণ হইত।
কমলিনী, নবীনের কাছে নিজ বিবাহের প্রস্তাব করিলে নবীন বলিয়াছিল, ‘হেমাঙ্গিনীর পিতা যে তিনখানি কাগজ যজ্ঞেশ্বর বাবুকে ফিরাইয়া দেন নাই, সেই তিনখানি কাগজ কোন উপায়ে কৌশলক্রমে যদি তুমি আমার হাতে দিতে পার, তবে আমি তোমায় বিবাহ করিতে পারি।’
কমলিনী জিজ্ঞাসা করে, ‘সে তিনখানি কাগজ কাহার কাছে আছে?’
নবীন তাহাতে উত্তর করে, ‘হেমাঙ্গিনীর কাছে’।
নবীনকে বিবাহ করিবার জন্য কমলিনী উন্মত্তপ্রায় হইয়াছিল বটে কিন্তু হেমাঙ্গিনীর হাত হইতে সে তিনখানি কাগজ বাহির করা বড় শক্ত কাজ! যজ্ঞেশ্বর বাবু হেমাঙ্গিনীকে ভালবাসিতেন না বলিয়া সেই তিনখানি কাগজ হেমাঙ্গিনী বড় যত্নের সহিত রাখিয়াছিল এবং ভয় দেখাইবার প্রয়োজন হইলেই স্বামীর কাছে হেমাঙ্গিনী সেই কাগজপত্রের উল্লেখ করিত। কাজেকাজেই অতি মূল্যবান হীরা- জহরতের গহনা অপেক্ষা, হেমাঙ্গিনীর নিকট সেই কাগজ কয়খানির অধিক আদর ছিল।
ঠঠুনিয়ার হোটেলে পঁচিশে আষাঢ় তারিখে রজনীতে কমলিনী, নবীনের সহিত সংগোপনে প্রেমালাপনের জন্য গিয়াছিল। যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ী হইতে রজনীযোগে কমলিনী এরূপভাবে প্রায়স বাহির হইত। নবীনকে না দেখিলে সে থাকিতে পারিত না। সে রজনীতেও তাহাই ঘটিয়াছিল। ঘটনাক্রমে যজ্ঞেশ্বর বাবুও মিস মনোরমাকে লইয়া সেই সময়ে তথায় উপস্থিত হন। কমলিনী যজ্ঞেশ্বর বাবুকে আষ্টার কোট খুলিয়া দেয়ালের গায়ে রাখিয়া গৃহপ্রবেশ করিতে দেখিয়াছিল। পাপিনীর মনে পাপ-চিন্তা সদাই প্রবলা! যজ্ঞেশ্বর বাবুর উপস্থিতিতে তাহার মনে পাপ চিন্তার উদয় হইল। সে নবীনকে বলিল, “দেখ, এ এক উত্তম সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে। যে গাড়ীতে যজ্ঞেশ্বর বাবু ও মিস্ মনোরমা আসিয়াছেন, চল সেই গাড়ী করিয়া আমরা প্রস্থান করি। তুমি যেখানে তোমার আষ্টার কোটটি রাখিয়াছ, যজ্ঞেশ্বর বাবুও সেইখানে তাঁহার কোটটি রাখিয়া ঘরে ঢুকিয়াছেন, আমি দেখিয়াছি। যজ্ঞেশ্বর বাবুর আষ্টার কোটটির মত কোট প্রায় দেখা যায় না। ঐটি গায়ে দিয়া যদি তুমি বেরিয়ে পড়তে পার, তাহা হইলেই তোমাকে গাড়ীতে উঠিতে দেখিয়া কোচম্যান অত সন্দেহ করিতে পারিবে না। আমিও তোমার পিছনে পিছনে গিয়া গাড়ীতে ঠিক উঠিয়া বসিব। আমরা যদি তাড়াতাড়ি গিয়া গাড়ীতে উঠি, তাহা হইলে কোচম্যান অত নজর করিয়া দেখিবে না। বিশেষতঃ এখন বড় বৃষ্টি হইতেছে। জলের ছাটে ঘোড়া দুইটি পাছে ক্ষেপিয়া উঠে, এই জন্য খোদাবক্সকে সেইদিকেই লক্ষ্য রাখিতে হইয়াছে। আমরা গিয়া যদি তাড়াতাড়ি গাড়ীতে উঠিয়া পড়িয়া বলি, “ঘর চল, তাহা হইলেও সে-ও আল্লার নাম করিয়া দুই হাত তুলিয়া আশীর্ব্বাদ করে।”
নবীন জিজ্ঞাসা করে, “কেন এ রকম করিয়া কি হইবে? যজ্ঞেশ্বর বাবু যদি কখন জানিতে পারেন, তাহা হইলে তিনি কি মনে করিবেন? আমার ভগ্নীই বা কি মনে করিবে?”
কমলিনী। তোমার মাথায় এ সব বুদ্ধি আসিবে কেন? কেন আমি তোমায় এ কাজ করিতে বলিয়াছি, তাহাই যদি তুমি বুঝিতে পারিবে, তাহা হইলে তোমার এমন দুর্দ্দশা হইবে কেন, বল। দেখিতেছ, এখন যজ্ঞেশ্বর বাবু বাড়ী-ছাড়া— হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে যে রকম ঝগড়া হইয়াছে, তাহাতে আজ বাড়ী ফিরিয়া যান কি না সন্দেহ। এ অবস্থায় যদি আমরা যজ্ঞেশ্বর বাবুর গাড়ী চড়িয়া তাহার বাড়ীতে ঢুকিতে পারি, তাহা হইলে আমাদের কেহ সন্দেহ করিতে পারিবে না। হেমাঙ্গিনী এতক্ষণ অঘোর ঘুমে অচেতন! যদি সেই জালীয়াতী পূর্ণ কাগজ তিনখানি এই সুযোগে হস্তগত করিতে পারে, তাহা হইলে তোমার ভাল হয়না মন্দ হয়?
নবীন এতক্ষণে কমলিনীর কথা হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইল। অন্য সকল কথা ভুলিয়া গিয়া তখন তাহার সেই চিন্তাই প্রবল হইল। যে কাগজ তিনখানি পাইবার জন্য পূর্ব্বে সে অশেষবিধ চেষ্টা করিয়াছে আজ যদি তাহা অনায়াসলভ্য হয়, তবে কেন সে সুযোগ পরিত্যাগ করিবে। “লোভেই পাপ! পাপেই মৃত্যু!” নবীন কমলিনীর কথায় মরিল। যজ্ঞেশ্বর বাবুর আলষ্টার কোটটি চুরি করিয়া যজ্ঞেশ্বর বাবু ও মিস্ মনোরমা যে গাড়ীতে আসিয়াছিলেন, সেই গাড়ীতে চড়িয়া প্রস্থান করিতে সম্মত হইল।
কমলিনী জানিত যে, হেমাঙ্গিনী সেই তিনখানি কাগজ যজ্ঞেশ্বর বাবুকে ভয় দেখাইবার ব্রহ্মাস্ত্র জ্ঞানে সৰ্ব্বদাই অতি সাবধানে ও সযত্নে রক্ষা করিতেন। এমন কি নিদ্রিতাবস্থায়ও নিজের মাথার বালিশের নীচে তাহা লুকাইয়া রাখিয়া নিদ্রা যাইতেন।
নবীন যে অবধি কমলিনীকে বলিয়াছিল, “হেমাঙ্গিনীর পিতা যে তিনখানি কাগজ যজ্ঞেশ্বর বাবুকে ফিরাইয়া দেন নাই, সেই তিনখানি কাগজ কোন উপায়ে কৌশলক্রমে যদি তুমি আমার হাতে দিতে পার, তবে আমি তোমায় বিবাহ করিতে পারি।” সেই পর্য্যন্ত কমলিনী তাহা হস্তগত করিবার কত চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারে নাই—অথচ নবীনকে পাইবার আশা পরিত্যাগ করাও তাহার পক্ষে সহজ নয়। কাজেকাজেই এই পাপচিন্তা তাহার মনে উদয় হইবে, তাহা আর বিচিত্র কি? কমলিনী নবীনকে বলিল, “এমন সুযোগ আর মিলিবে না। হেমাঙ্গিনী এখন নিদ্রিতা। এই নিদ্রিতাবস্থাতেই তাঁহার বালিশের তলদেশ হইতে আমি সেই কাগজ কয়খানি চুরি করিব। যদি তিনি জাগিয়া উঠিয়া আমাদের কার্য্যে বাধা দিতে চেষ্টা করেন, তাহা হইলে তুমি তৎক্ষণাৎ বলপ্রয়োগ করিতে পারিবে। যজ্ঞেশ্বর বাবু বাড়ীতে নাই, সুতরাং বাধা দিবার অন্য লোকও দেখি না।”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
যজ্ঞেশ্বর বাবু সম্বন্ধে এই স্থলে দুই-একটি কথা বলা উচিত। পঁচিশে আষাঢ় তারিখে সকালে তিনি মিস্ মনোরমার নিকট হইতে একখানি পত্র প্রাপ্ত হয়েন, তাহাতে এইরূপ লিখিত ছিল;
“প্রিয়তম যজ্ঞেশ্বর বাবু!
দাদার জন্য আমি বড় ভাবিত হইয়াছি। তিনি ঘোড়দৌড়ের বাজীতে, জলের খেলায়, আফিং-এর চিঠি ও কোম্পানীর কাগজ কেনাবেচায় এত অধিক লোকসান দিয়াছেন যে, আর তাঁহার উদ্ধারের কোন উপায় নাই। আপনি জীবনের সর্ব্বসুখে জলাঞ্জলি দিয়া একমাত্র আমায় সুখী করিবার জন্য নীচ লোকের কন্যাকে বিবাহ করিয়া একবার দাদাকে বাঁচাইয়াছেন, কিন্তু এবার তিনি লোকলজ্জাভয়ে ও মানসম্ভ্রমের দায়ে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করিবেন। আমরা উভয়ে পরস্পর কিরূপ স্নেহ-পরবশ তাহা আপনাকে বুঝাইয়া বলা বাহুল্য মাত্র। বহু বার বহু বিষয়ে আপনি দেখিয়াছেন, আমি দাদার জন্য প্রাণ পৰ্য্যন্ত দিতে কাতর নহি। আর একবার আপনি তাঁহাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করুণ অধিনীর এই শেষ অনুরোধ ভুলিবেন না। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, সত্বর এ সংবাদ না পাইলে আমার জীবনধারণ করা ভার হইবে। আমি অত্যন্ত অস্থির হইয়া পড়িয়াছি। আজ রাত্রি দশটার পর গোলদীঘীতে সেই স্থানে আমার সাক্ষাৎ পাইবেন। দাদার সংবাদ পাইবার জন্য আমি তথায় আপনার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করিব। কত টাকা পাইলে তাহার ঋণ পরিশোধ হয়, জিজ্ঞাসা করিবেন। তিনি বড় অভিমানী —তাঁহাকে কোন প্রকার তিরস্কার করিবেন না। দুই-একবার বুঝাইয়া দেখিবার চেষ্টা করিতে পারেন, কিন্তু কড়া কথা একটিও বলিবেন না। জিজ্ঞাসা করিবেন, কেন তিনি বার বার এরূপ করিয়া ঋণগ্রস্ত হইয়া আমায় কষ্ট দিতেছেন? না—না—তাহাও জিজ্ঞাসা করিয়া কাজ নাই। তিনি হয়তো মনে করিতে পারেন, আমার অলঙ্কার প্রভৃতি বন্ধক পড়াতে আমি স্বার্থের বশে এই কথা আপনাকে দিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছি। কাজ নাই, তাহাকে কোন কথা বলিয়া কাজ নাই। আপনি কেবল সন্ধান করুন, তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কি করিতেছেন? মনের কথা আপনাকে অধিক কি বলিব? আমার মনোবেদনা আপনার নিকট কিছুই অবিদিত নয়। পরজন্মে যেন আপনাকে স্বামীরূপে প্রাপ্ত হই। আপনি দেবতা—অধিনী মানবী। আপনি দধিচীর ন্যায় পুণ্যবান। আপনার স্বার্থত্যাগ, উদারতা, মহানুভবতা জগতের আদর্শস্থল। যদি পৃথিবীতে আপনার ন্যায় মনুষ্য এক চতুর্থাংশ থাকিত, তাহা হইলে এই পৃথিবীই কি স্বর্গে পরিণত হইত না? আপনার সম্মুখে আপনার প্রশংসা করা এ অধিনীর উদ্দেশ্য নয়। মনের আবেগে যে কয়ছ লিখিলাম, তাহা অন্তস্থল হইতে বাহির হইয়াছে, জানিবেন।
ভগ্নহৃদয়া বিনীত-নিবেদিকা,
শ্রীমতী মনোরমা।”
উপরোক্ত পত্রখানিই পঁচিশে-আষাঢ় তারিখে প্রাতঃকালে যজ্ঞেশ্বর বাবু নিজ কক্ষে বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করিতেছিলেন। কমলিনীর এজেহারে এ কথা প্রকাশ হইয়াছে। তারপর সেইদিনই যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত হেমাঙ্গিনীর বিষম কলহ উপস্থিত হওয়াতে তিনি মনের দুঃখে ঘৃণায় ও অভিমানে বাড়ী হইতে চলিয়া যান
বাড়ী হইতে বাহির হইয়াও তিনি মনোরমার পত্রের কথা বিস্মৃত হইতে পারেন নাই। বেলা এগারটা হইতে আরম্ভ করিয়া রাত্রি নয়টা পর্য্যন্ত তিনি কত জায়গায় কত লোকের নিকট নবীনের সন্ধান করিয়াছিলেন, তাহা বলা যায় না। তাহার পর রাত্রি দশটার সময় কেমন করিয়া যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত মিস্ মনোরমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল ও তাহার পর কি কি ঘটনা ঘটিয়াছিল, পাঠকবর্গ তাহা অবগত আছেন।
কমলিনী ও নবীন যে প্রকার ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, তাহার অধিকাংশ সফল হইয়াছিল। তাহারা উভয়ে যজ্ঞেশ্বর বাবুর গাড়ীতে চড়িয়া তাঁহার বাড়ীতে প্রবেশ করা পর্য্যন্ত, কেহ তাহাদিগকে সন্দেহ করে নাই। মনোরমা ও নবীন হরতনের নওলায় পত্রাদি লেখালেখি করিত। কমলিনীর সহিত ঠনঠনিয়ার হোটেল হইতে বাটি ফিরিয়া যাইবার সময় নবীন আপনার পকেট হইতে একখানি হরতনের নওলা বাহির করিয়া ভ্রমক্রমে তাহা যজ্ঞেশ্বর বাবুর আষ্টাব কোটের পকেটে রাখিয়াছিল।
নবীন ও কমলিনী যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া দেখিল যে, মনের দুঃখে, রাগে, ঘৃণায় ও অভিমানে হেমাঙ্গিনী শিরঃপীড়ার সেই বিষাক্ত ঔষধ এক শিশি খাইয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন। নিজ শয্যাপার্শ্বদেশে টিপায়ের উপর স্বহস্তলিখিত একখানি পত্রে তাহা স্বীকার করিয়া গিয়াছেন;
মনের দারুণ ঘৃণায় আমি বিষপানে আত্মহত্যা করিলাম। আমি বুঝিতে পারিয়াছি, আমি জীবিত থাকিতে আমার স্বামী কখন সুখী হইতে পারিবেন না। ক্রোধের বশে তাঁহাকে সময়ে সময়ে অনেক অকথা-কুকথা বলিয়াছি, তিনি যেন ক্ষমা করেন। তাঁহার সুখের জন্য আমি প্রাণত্যাগ করিলাম। জীবনদানেও পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইবে না কি?
অভাগিনী হেমাঙ্গিনী।”
হেমাঙ্গিনী বিষাক্ত ঔষধ সেবন করিয়া যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় অস্থির হইয়া পড়ে, সম্ভবতঃ সেই সময় উপরোক্ত পত্রখানি লিখিয়া আত্মহত্যা স্বীকার করে।
কমলিনী সেই পত্রখানি হস্তগত করে। নবীন সে কথা সাধারণে প্রকাশ করিতে সাহস করে নাই। কারণ, কমলিনী তাহাকে বুঝাইয়া দিয়াছিল যে, সে কথা প্রকাশ করিলে তাহাদের উভয়েরই ফাঁসী হইবে। দুর্ব্বলহৃদয় নবীন তাহাই তাহা প্রকাশ করিতে সাহস করে নাই। যে তিনখানি কাগজ হস্তগত করিবার অভিলাষে কমলিনী ও নবীন ষড়যন্ত্র করিয়া ঠঠুনিয়ার হোটেল হইতে বাহির হইয়াছিল, তাহাও হস্তগত করিতে কমলিনী বিস্মৃত হয় নাই।
নবীনের নিকট এই সকল কথা শুনিয়া আমি দুই-একটি বিষয়ে সন্দেহ- বিমোচনের প্রশ্ন করিব, মনে করিতেছি, এমন সময়ে বহিৰ্দ্দেশ হইতে কক্ষদ্বারে কে মৃদুভাবে আঘাত করিতে লাগিল।
নবীন ভয়াকুলচিত্তে বলিল, “ওই কমলিনী আসিয়াছে!”
আমি বলিলাম, “বলেন কি? তবে তো ভালই হইয়াছে। এই আম্মারীর পাশে আমি লুকাই—আপনি দরজা খুলিয়া দিন।”
এই বলিয়া আমি আম্মারীর পশ্চাতে লুক্কায়িত হইলাম। নবীন দরজা খুলিয়া দিল। বিবিয়ানা—বেশধারিণী কমলিনী গৃহপ্রবিষ্টা হইল।
কমলিনী নবীনকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিল, নবীন একটি কথারও উত্তর দিতে পারিল না। রাগিয়া চোখ-মুখ লাল করিয়া কমলিনী নবীনের নিকটে আসিয়া রুক্ষ্মস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “বোবা হইয়া গিয়াছি না কি? কথার জবাব দিচ্ছ না যে?”
চীৎকার করিয়া উচ্চৈঃস্বরে নবীন বলিল, “কালসাপিনী! তুই আমার সর্বনাশ করলি! কেন তুই এ কাজে আমাকে জড়িয়েছিলি?
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
কিছুদিন পরে নিকলাস্ সাহেব ডগলাস্ সাহেবকে পত্র লিখিলেন;-
“আমি আপনাকে এ পর্য্যন্ত যে কয়খানি পত্র লিখিয়াছি, তাহাতেই আপনি সমস্ত বিবরণ এক প্রকার জানিতে পারিয়াছেন। যজ্ঞেশ্বর বাবু সম্মানের সহিত মুক্তি পাইয়াছেন। সহরের সকল সংবাদ-পত্রেই এখন খুব লেখালেখি চলিতেছে। কেবল একজন জুরীর জন্য এত বড় একজন উদারপ্রকৃতি, নিঃস্বার্থ পরোপকারী, স্বর্গীয় ভাবপূর্ণ নিৰ্দ্দোষ ব্যক্তি প্রাণ দান পাইলেন, দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা এখন হরিদাস গোয়েন্দা ও সেই একজন জুরাকে ধন্য ধন্য করিতেছে। হায়! এরূপ ঘটনা নিত্য ঘটিয়া থাকে, কিন্তু একজন লোকে পরের জন্য এত অর্থ ব্যয় করিতে অগ্রসর হয়? আপনার ন্যায় নিঃস্বার্থ পরোপকার কয়জন করিতে পারে? এরূপ অকাতরে অর্থব্যয় করিতে কয়জন সাহস করে?
যজ্ঞেশ্বর বাবু এখন মনোরমার পিতামাতার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হইয়াছেন। অতি অল্প দিনের মধ্যেই মনোরমার সহিত তাঁহার বিবাহ হইবে। মনোরমা, যজ্ঞেশ্বর বাবু, মনোরমার পিতা, মাতা ও খুল্লতাত যিনি জুরীতে বসিয়াছিলেন এবং কেবল একমাত্র যাঁহার জন্য যজ্ঞেশ্বর বাবুর জীবন রক্ষা হইয়াছে এবং নবীন যতদুর সম্ভব সচ্চরিত্র হইয়া পিতার নিকট ক্ষমাপ্রাপ্ত হইয়া দেশ ভ্রমণোদ্দেশে পশ্চিম যাত্ৰা করিয়াছে, পত্রের দ্বারা প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন অসম্ভব বিবেচনায় ইহারা সপরিবারে আপনাকে ধন্যবাদ দিবার জন্য আগ্রায় উপস্থিত হইবেন।
হরিদাস গোয়েন্দাকে আপনার প্রেরিত পারিতোষিক প্রদান করিলাম। মনোরমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, খুল্লতাত, যজ্ঞেশ্বর বাবু এবং আমি, হরিদাস গোয়েন্দাকে যথাসাধ্য পুরষ্কৃত করিয়াছি। সৰ্ব্বশুদ্ধ তিনি তেইশ হাজার টাকা পাইয়াছেন।
আমি হরতনের নওলার একখানি বৃহদাকার অয়েল পেন্টিং আঁকাইয়া তাহার উপর যজ্ঞেশ্বর—মনোরমা এবং নীচে ডগলাস—হরিদাস লিখাইয়া লইয়া আবার নিজ বাটীর হলঘরের সম্মুখেই দেয়ালের গায়ে টাঙ্গাইয়া রাখিব। যখনি কেহ তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিবেন, তখনই আমায় এই সত্য ঘটনা বর্ণনা করিতে হইবে। তাহা হইলেই ইহার প্রতি ঘটনা, প্রতি কথা, আজীবন আমার চিত্তে অঙ্কিত থাকিবে। হরতনের নওলা কাহিনী যার তার কাছে গল্প করিয়া আমি ধর্মের জয় অধর্ম্মের ক্ষয়! এবং নিঃস্বার্থপ্রেমের জ্বলন্ত আদর্শ জনসাধারণে প্রচার করিতে পারিব। এজীবনে ইহাই আমার সূর্য—ইহাই আমার আনন্দ। আপনার নিঃস্বার্থ পরোপকার এ জীবনে কখনও ভুলিতে পারিব না।”