দ্বিতীয় খণ্ড – প্রথম পরিচ্ছেদ
পরদিনেই নিকলাস সাহেব, ডগলাস সাহেবের নামে নিম্নলিখিত পত্রখানি প্রেরণ করে- “মহাশয়!
গত রজনীতে আমি আপনার টেলিগ্রাম পাইয়া তৎক্ষণাৎ তাহার উত্তর প্রদান করিয়াছি। নিশ্চয়ই তাহা আপনি পাইয়াছেন। তাহাতেই দেখিতে পাইবেন যে, আপনি আমায় যে কার্য্যভার প্রদান করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন, তাহা আমি গ্রহণ করিয়াছি। আজ বেলা এগারটার সময়ে আমি বেঙ্গল ব্যাঙ্কে উপস্থিত হইয়াছিলাম। তাহারা আমাকে তৎক্ষণাৎ ১০,০০০ দশ হাজার টাকা দিতে চাহিলেন। আমি আপনার টেলিগ্রামের লিখিত ১০,০০০ দশ হাজার টাকা লইলাম। তাঁহারা আমায় এ কথায় বলিলেন যে, যদি আমার বেশী টাকার আবশ্যক হয়, তাহাও আমি তাঁহাদের নিকটে আবেদন করিলে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রাপ্ত হইব। পরীক্ষার জন্য আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, যদি ৮০,০০০ আশী হাজার টাকা আবশ্যক হয়, তাহা হইলে আমি আবেদন করিবা মাত্রই তাঁহারা আমায় তাহা দিবেন কি না? তাঁহারা বলিলেন যে, আপনি সেই মৰ্ম্মেই তাঁহাদের প্রতি আদেশ প্রদান করিয়াছেন। এ কথা জিজ্ঞাসা করিবার কারণ, যদিও আমি তাঁহাদের কিছু বলি নাই কিন্তু আপনাকে বলা আবশ্যক বোধ করিতেছি। এমন অনেক ঘটনা ঘটিতে পারে, যাহাতে অর্থের দ্বারা গুপ্ত সংবাদ ক্রয় করিতে হইবে। অল্প বা অধিক পরিমাণে ঘুষ দিয়া হয় তো কাহারও কাহারও মুখ বন্ধ করিতে হইবে। আপাততঃ যদিও সেরূপ কোন আবশ্যক না হয়; কিন্তু এ সকল কাজে দরকার পড়িলেও পড়িতে পারে; সেইজন্য আপনাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিয়া আমি নিশ্চিন্ত হইতে ইচ্ছা করি। বেঙ্গল ব্যাঙ্কের সেক্রেটারীর কথা শুনিয়া সেইজন্য আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, কৌশলে হউক, অর্থবলে হউক, যেমন করিয়াই হউক, আমি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে এ খুনী-মোকদ্দমা হইতে রক্ষা করিতে চেষ্টা করিবই করিব। যাহাতে তিনি বেকসুর খালাস পান, সেজন্য আমি প্রাণপণে চেষ্টা করিব।
বোধ হয়, আপনি না জানিতে পারেন, কিন্তু বাস্তবিক ইহা প্রকৃত ঘটনা বলিয়া, আপনাকে জানাইয়া রাখা আবশ্যক যে, এই ঘটনায় যজ্ঞেশ্বর বাবুকে নিদোষ সপ্রমাণ করিবার জন্য আপনার যতটা ঝোঁক, আমার আবার তদপেক্ষাও অধিক। আপনি যদি আমাকে অর্থবলে বলীয়ান করিবার সাহস প্রদান না করিতেন, তাহা হইলেও আমার নিজ ক্ষমতায় যতদূর হইবার সম্ভাবনা থাকিত, তাহাও আমি করিতাম। সে পরিশ্রমের জন্য নিজ পারিশ্রমিক হিসাবে যদি আমি কিছু নাও পাইতাম, তাহা হইলেও নিশ্চয়ই আমি এ মোকদ্দমা ছাড়িতাম না।
যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত আমার বিশেষ বন্ধুত্ব আছে, জানিবেন। সময়ে সময়ে তাঁহার নিকটে আমি অনেক বিষয়ে উপকৃত হইয়াছি; সুতরাং সে সকল উপকারের প্রত্যুপকার করিবার জন্য আমার মন অত্যন্ত ব্যাকুল রহিয়াছে। তা’ ছাড়া যজ্ঞেশ্বর বাবু যে এ ঘটনায় সম্পূর্ণ নিৰ্দ্দোর্য, সে বিষয়ে আমার দৃঢ় ধারণা জন্মিয়াছে। আর সেই ধারণা বলেই আমি স্ব-ইচ্ছায় তাঁহার মোকদ্দমা গ্রহণ করিয়াছিলাম। যদি আমার মনে এই বিশ্বাস না থাকিত, তাহা হইলে এ কথা বলিলে বোধ হয়, আপনি ক্রুদ্ধ হইবেন না যে, আমি আপনার ন্যায় উদার প্রকৃতি লোকের অর্থ সাহায্য প্রাপ্ত হইয়াও এ কার্য্যে হস্ত প্রদান করিতাম না। মোকদ্দমায় আপনারও যতটা আগ্রহ, আমারও ততোধিক। স্বয়ং আমি এইরূপ বিপদে পড়িলে, আমার নিজ জীবন রক্ষা করিবার জন্য আমি যতটা চেষ্টা করিতাম, ইহাতেও সেইরূপ করিব, জানিবেন। সময় যদিও অতি সংক্ষেপ, তথাপি আপনি শুনিয়া সুখী হইবেন যে, ইহারই মধ্যে আমি এই ঘটনার একটি সূত্র পাইয়াছি। সেই সূত্র ধরিয়াই আপাততঃ আমি কার্য্যে অগ্রসর হইব। যদিও সে সূত্র অতি সামান্য, যদিও সে সূত্রের উপরে এখনও তাদৃশ বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিতেছি, না, কিন্তু তথাপি আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, তাহাতেই হয় তো এই গুপ্ত রহস্যের মর্ম্মোদঘাটন করিতে পারিব। আপনি যে প্রকার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন, আমি সেই মতই আপনাকে পত্র লিখিব। আমার প্রতি পত্রে ঠিক গল্পের ন্যায় সমস্ত ঘটনা বর্ণিত থাকিবে, দেখিতে পাইবেন। অর্থের বিন্দুমাত্র অসদ্ব্যবহার হইবে না; সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন। ‘
আপনার পত্রে যে স্থলে আপনি রাধারমণ বাবুর উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা পাঠ করিয়া আমি বিশেষ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছি। এই রাধারমণ বাবু সেদিন জুরীতে বসিয়াছিলেন। ইনি একজন খৃষ্টিয়ান এবং আচারে ব্যবহারে পূরা সাহেব। দ্বাদশ জন জুরীর মধ্যে কেবল ইনিই যজ্ঞেশ্বর বাবুকে নির্দোষ বলিয়াছিলেন, ইহা আমি কোন গুপ্ত উপায়ে জানিতে পারিয়াছি। কেবল ইহারই জন্য সেদিন যজ্ঞেশ্বর বাবু রক্ষা পাইয়াছেন।
আমার প্রথম কার্য্য ইঁহার বাসস্থান ঠিক করা। সে বিষয়ে আপনি কিছু বলিতে পারেন নাই। যাহা হউক, যে হরিদাস গোয়েন্দাকে আমি এই কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছি, তাঁহার অসাধ্য কিছুই নাই। তাঁহার ন্যায় তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালী ব্যক্তি বোধ হয়, ডিটেকটিভ-ডিপার্টমেন্টে আর কেহ আছেন কিনা সন্দেহ। তাঁহাকেই আমি এই কার্য্যের ভার প্রদান করিয়াছি। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অনুসন্ধানের দ্বারা বাহির করিয়াছেন যে, উক্ত রাধারমণ বাবু পার্ক ষ্ট্রীটে থাকেন। হরিদাস গোয়েন্দা আমাকে এই সংবাদ প্রদান করিবামাত্রই তৎক্ষণাৎ আমি পার্ক ষ্ট্রীটে রাধারমণ বাবুর বাটীতে উপস্থিত হই। তিনি বাটীতেই ছিলেন—আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।
আমি তাঁহাকে বলিলাম, “রাধারমণ বাবু! আমি আপনার সহিত বিশেষ কাৰ্য্যোপলক্ষে সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি। আপনি যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমায় একজন জুরী ছিলেন। আপনি হয়তো আমায় অনেক বিষয়ে এমন সংবাদ প্রদান করিতে পারেন, যাহাতে এ বিষয়ে বিশেষ সুবিধা হইতে পারে।”
রাধারমণ বাবুর বয়ঃক্রম প্রায় ষাট বৎসর হইবে। তাঁহার মুখ দেখিয়া তাঁহাকে দয়ালু লোক বলিয়া বোধ হয়। তাঁহার আকার-প্রকার দেখিয়াই আমার প্রথমে ধারণা হইয়াছিল যে, তাঁহার দ্বারা আমার বিশেষ উপকার হইবে।
তিনি প্রথমেই বলিলেন, “বড় দুঃখের বিষয় যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু নিজ পক্ষ-সমর্থনের জন্য একজন ব্যারিষ্টারও নিযুক্ত করিতে সম্মত হয়েন নাই। জুরীতে যে কয়জন লোক ছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই এই কাণ্ডকারখানা দেখিয়া অবাক হইয়াছিলেন। ব্যাপার কি, অনেকেই বুঝিতে পারেন নাই।”
আমি বলিলাম, “বাস্তবিকই এটি বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার! আমার বোধ হয়, আপনি এ ঘটনার কারণ কতকটা অনুমান করিতে পারেন। সেই সাহায্য প্রাপ্তির জন্যই আমি আপনার কাছে আসিয়াছি।”
আমার কথায় তিনি উত্তর দিলেন, “আমি আপনাকে কোন খবর দিতে পারি না—এ বিষয়ে আমি আপনাকে কোন প্রকার সাহায্য করিতে পারি না।”
আমি। একটি কথা আমি আপনাকে বিশ্বাস করিয়া বলিতে পারি কি?
রাধারমণ পারেন, কিন্তু আপনাকে বলিবার আমার কিছুই নাই জানিবেন। এ বিষয় লইয়া আমি কাহারও সহিত আলোচনা করিতে ইচ্ছা করি না। সুতরাং আমার সহিত এ বিষয়ে কথোপকথনে আপনার কোন ফলোদয় হইবে না। আমার কোন কথা বলিবার যো নাই।
যদিও তিনি আমাকে বার বার ঐরূপ ভাবে নিরুৎসাহ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন—বার বার আমাকে বলিতেছিলেন যে, এ মোকদ্দমা সম্বন্ধে তাহার বলিবার কিছুই নাই—তথাপি তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া স্পষ্টই বোধ হইতেছিল যে, তাঁহার বলিবার যথেষ্ট ছিল; কিন্তু তিনি কোন কথা বলিতে ইচ্ছা করিতেছিলেন না। হয়ত তিনি মনে করিলে অনেক কথা বলিতে পারিতেন।
যাহা হউক তিনি আমায় কোন বিষয়ে সাহায্য করিতে অস্বীকার হইলেও, আমি তাহাকে সহজে ছাড়িতে পারিলাম না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমার বোধ হয়, আপনি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে নিৰ্দ্দোষ বলিয়া বিবেচনা করেন?”
রাধারমণ বাবু যেন কতকটা বিরক্তির সহিত উত্তর করিলেন, “আমি আপনাকে এ বিষয় বলিতে বাধ্য নহি।”
এ কথায়ও আমি কোন প্রকার বিচলিত না হইয়া পুনরায় বলিলাম, “দেখুন, সকল কথা কিছু অপ্রকাশ থাকে না—বিশেষতঃ এরূপ বিষয়ের কথা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রকাশিত হইয়া পড়ে। হয় তো যে সকল কথা আপনি প্রকাশ করিবেন না ভাবিতেছেন, তাহা লইয়া এতক্ষণ সকল স্থানে আন্দোলন চলিতেছে। বোধ হয়, আপানি এ কথা অস্বীকার করিতে পারিবেন না যে, বারজন জুরীর মধ্যে এগার জন যজ্ঞেশ্বর বাবুকে দোষী এবং কেবল এক জন জুরী তাঁহাকে নির্দোষ বলিয়াছিলেন।” রাধারমণ বাবু বলিলেন, “এ কথা জানিবার সাধারণের কোন অধিকার নাই; আর ইহা যে কেহ জানিতে পারিবেন, তাহাও আমি বিশ্বাস করি না।”
আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম, “আপনি মনে করেন যে, এ কথা সাধারণে জানিতে পারিবে না, কিন্তু আমি আপনাকে সত্যকথা বলিতেছি, ইহার মধ্যেই এ কথা প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে যে, এই একজন জুরী—যিনি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে নির্দোষ বলিয়াছিলেন—তিনি আর কেহই নহেন, স্বয়ং আপনি।” রাধারমণ বাবু আমার কথা শুনিয়া যেন কতকটা বিস্মিতের ন্যায় উত্তর করিলেন, “এ সকল কথা সাধারণে প্রকাশিত হওয়া উচিত নহে।”
আমি বলিলাম, “তা না হইতে পারে; কিন্তু যে কথা প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে, তাহাই আমি আপনাকে বলিতেছি। যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমা লইয়া শহরে একটা হুলুস্থুলু পড়িয়া গিয়াছে। তিনি মোকদ্দমায় যেরূপ অসাধারণ ব্যবহার করিয়াছিলেন ও যে প্রকার অন্যায় ও আশ্চর্য্য উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহাতে জনসাধারণ যে বিশেষ বিচলিত হইবেন, তাহাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। এ মোকদ্দমা লইয়া দিন কয়েক যে বিশেষ আন্দোলন চলিবে, সে ধারণা আমার পূর্ব্বেই হইয়াছিল। যজ্ঞেশ্বর বাবু জীবন উপেক্ষা করিয়াও কোন বিষয় যে গুপ্ত রাখিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, এ কথা বোধ হয়, বুদ্ধিমান লোকমাত্রেই অনুমান করিয়াছেন।”
রাধারমণ বাবু উত্তর করিলেন, “তাহা হইলেও জুরীদিগের গুপ্ত পরামর্শ কি হইয়াছিল, সাধারণের সে বিষয়ে আন্দোলন করাই উচিত নহে।
আমি বলিলাম, “উচিত নহে, সে সকলেই জানে; কিন্তু এই মোকদ্দমায় সাধারণের এত বিশেষ আগ্রহ জন্মিয়াছে যে, তাহারা এই বিষয় আন্দোলন না করিয়া থাকিতে পারিতেছেন না। আমি একজন লোক—আমি অন্তরের সহিত বিশ্বাস করি, যজ্ঞেশ্বর বাবু নিদোর্ষ। এখন বলুন দেখি, আমার বিবেচনায় যে ব্যক্তি নির্দোষ, আমার চক্ষের সম্মুখে যদি তাহার প্রতি অন্যায় বিচার করা হয়, তাহা হইলে আমার মন বিচলিত হয় কি না?”
কথায় বাধা দিয়া রাধারমণ বাবু আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা বলুন দেখি, আপনি যদি জুরীতে বসিতেন, তাহা হইলে আপনি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে নিৰ্দ্দোষ বলিতেন কি না?”
তিনি যেরূপ ব্যগ্রতার সহিত আমাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন তাহাতে আমাকে বিশেষ ভাবিয়া-চিন্তিয়া উত্তর প্রদান করিতে হইল। আমি বলিলাম, “আমি জুরীতে বসিলে কি বলিতাম, তাহা এখন আপনাকে ঠিক করিয়া বলিতে পারি না। তাঁহার বিরুদ্ধে এই সকল অকাট্য প্রমাণ-প্রয়োগ দেখিয়াও আমি কি করিতাম, তাহা জানি না। এখন আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব। যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত আপনার কোন সময়ে কি বিশেষ আলাপ-পরিচয় ছিল?”
এই কথায় রাধারমণ বাবু বিশেষ বিচলিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে এ কথা বলে?”
আমি বলিলাম, “কেহ এ কথা বলেন কি না, তাহা আমি বলিতেছি না; আমি আপনাকে এ কথা শুধু জিজ্ঞাসা করিতেছি মাত্র। আর এ কথা জিজ্ঞাসা করিবার কারণও আমার আছে। মনে করুন, কোন কারণে কোন সময়ে যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত আপনার বিশেষ আলাপ পরিচয় ছিল, আর সেই অবধি আপনার ধারণা এই যে, তিনি একজন বড় ভাল লোক। সেই ধারণা-বলে, জুরীতে বসিয়া তাঁহার বিপক্ষে বিশেষ প্রমাণ প্রয়োগ-সত্ত্বেও আপনার তাঁহাকে নির্দোষ বলা কি সম্ভব?”
আমার কথায় রাধারমণ বাবু যেন কতকটা রাগান্বিত হইয়া বলিলেন, “আমি আপনার সহিত অভদ্রতা করিতে ইচ্ছা করি না। কিন্তু এ সম্বন্ধে আমার সহিত আপনার আর অধিক আলোচনা চলিতে পারে না।”
আমি উত্তর করিলাম, “সে কি কথা! একজন নিরপরাধ ব্যক্তির জীবন-মরণ আপনার কথার উপরে নির্ভর করিতেছে দেখিয়া আপনি নিস্তব্ধ থাকিবেন? আপনার শরীরে কি দয়া-মায়া নাই? আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না যে, আমি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে বাঁচাইবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছি? কি আশ্চর্য্য! আর আপনি কি না একজন উদারপ্রকৃতির লোক হইয়াও এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত নহেন? দেখুন, আমি একা যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমা লইয়া এত চেষ্টা করিতেছি না। এখান হইতে বহু দূরে বসিয়া কত উদার প্রকৃতির লোক এই বিষয় লইয়া আন্দোলন করিতেছেন—যজ্ঞেশ্বর বাবুর জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করিতেছেন ও বহু অর্থব্যয়ে এ বিষয়ে আমায় সাহায্য করিতে অগ্রসর হইয়াছেন। যিনি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে জানেন বা যাঁহার সহিত তাঁহার সামান্য পরিচয়ও ছিল, তিনিই বিশেষ আগ্ৰহ প্ৰকাশ করিতেছেন। আপনি আমার কথায় বিশ্বাস না করেন, এই একখানা টেলিগ্রাম দেখিলেই সমস্ত বুঝিতে পারিবেন।”
এই কথা বলিয়া আমি আপনার টেলিগ্রামখানি তাঁহাকে দেখাইলাম। তদ্দৃষ্টে তিনি যেন চমকিত হইয়া বলিলেন, “ডগ্গ্লাস সাহেব! কেন, ইনি আর যজ্ঞেশ্বর বাবু এক সময়ে—”
এই পৰ্য্যন্ত বলিয়াই তিনি চুপ করিয়া গেলেন—যেন কি একটা ভয়ানক গুপ্ত রহস্য প্রকাশ হইবে, এই ভয়ে তিনি আর কিছু বলিলেন না। আমি তাঁহার কথার ভাবে ইহা বুঝিতে পারিয়াছিলাম, সুতরাং তাঁহার অসম্পূর্ণ কথাগুলি সম্পূর্ণ করিয়া দিবার জন্য বলিলাম, “—এক সময়ে বিশেষ বন্ধু ছিলেন। পড়ুন, আপনি টেলিগ্রামখানি সমস্ত পড়িয়া দেখুন।”
প্রথমতঃ তিনি যেন তাহা পড়িতে ইচ্ছুক নহেন, এইরূপ ভাব প্রকাশ করিলেন; কিন্তু পরক্ষণেই আবার যেন কৌতূহল-পরবশ হইয়া তাহা পাঠ করিতে লাগিলেন। পাঠ শেষ হইলে, কোনরূপ মন্তব্য প্রকাশ না করিয়া আমার হাতে তাহা ফিরাইয়া দিলেন।
আমি তাঁহার ভাব-গতিক দেখিয়া প্রথমেই কথা কহিলাম, “ডগ্লাস সাহেবের নাম দেখিয়া আপনি চমকিত হইলেন কেন? বোধ হয়, আপনি তাঁহাকে বিশেষরূপ জানেন, আর হয় তো শুনিয়াও থাকিবে ন যে, এই ডগ্গ্লাস সাহেব পশ্চিম প্রদেশের মধ্যে এখন একজন খুব বড়লোক। এই টেলিগ্রামখানি দেখিলেই বেশ বুঝা যায় যে, ইনি একজন মস্ত ধনী। ইনি কেন আমায় আপনার কাছে সন্ধান লইতে বলিতেছেন, তা বলিতে পারেন কি? নিশ্চয়ই আপনি আমায় এ বিষয়ে বিশেষ সাহায্য করিতে পারেন।”
রাধারমণ বাবু বলিলেন, “ডগ্গ্লাস সাহেবকে আমি এক সময়ে চিনিতাম বটে। আমার সঙ্গে কখনও তাঁহার বন্ধুত্ব ছিল না। আপনার সঙ্গে আমি অনেকক্ষণ কথা কহিয়াছি—আর আমার কিছু বলিবার নাই। “ ‘এতক্ষণে বুঝিতে পারিলাম যে, আমি বড় শক্ত লোকের পাল্লায় পড়িয়াছি। এতক্ষণে আমার ধারণা হইল যে, তাহাই এগারজন জুরীতে মিলিয়াও কেন এই একজনকে কোন ক্রমে একমত করাইতে পারেন নাই। উঃ! কি ভয়ানক একগুঁয়ে লোক! যা ধরিয়াছেন, আগাগোড়া সেই চাল বজায় রাখিয়া যাইতেছেন। সেই যে গোড়ায় ধুয়া ধরিয়াছেন, ‘আপনাকে বলিবার আমার কিছুই নাই—’ শেষ পৰ্য্যন্ত সেই একই কথা! এরকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লোক তো আমি জীবনে কখনও দেখি নাই।
অবশেষে কোন উপায় না পাইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোন রকমেই আপনি আমায় সাহায্য করিবেন না? আপনি কিছুতেই কোন কথা প্রকাশ করিবেন না?”
স্থির অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞের ন্যায় তিনি স্পষ্ট কথায় তৎক্ষণাৎ উত্তর করিলেন, “না”।
আমি আরও অর্দ্ধঘন্টা ধরিয়া তাঁহাকে বুঝাইলাম, কত কাকুতি-মিনতি করিলাম, কিছুতেই তাঁহার কঠোর প্রতিজ্ঞা হইতে তাহাকে বিচলিত করিতে পারিলাম না। কত আশা করিয়া তাহার নিকটে গিয়াছিলাম—সব আশা নৈরাশ্যে পরিণত হইল। এই পৰ্য্যন্ত আমি বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি নিশ্চয়ই অনেক কথা জানেন, কিন্তু কিছুতেই কোন কথা প্রকাশ করিবেন না।
পরদিন সকালে আমি জেলে গিয়া যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমায় দেখিয়া বড় আনন্দিত হইলেন এবং বিনা খরচায় স্বতঃ-প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহার পক্ষ-সমর্থনের জন্য আমি যে আদালতে দণ্ডায়মান হইয়াছিলাম, তজ্জন্য আমায় অশেষ ধন্যবাদ প্রদান করিলেন। বড় সাবধান হইয়া তাঁহার সহিত আমায় কথা কহিতে হইল। একেবারেই আমি তাহাকে আমার উদ্দেশ্য বলিলাম। না। দুই-একটি কথা তাঁহার নিকট হইতে আমার জানিয়া লইবার অভিলাষ ছিল এবং সেইজন্যই আমি অতি সঙ্কুচিত ভাবে ধীরে ধীরে সেই প্রস্তাব করিবার আয়োজন করিতেছিলাম।
আমি প্রথমে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি জানেন কি, কয়জন জুরী আপনার সাপক্ষে আর কয়জন আপনার বিপক্ষে ছিলেন?”
মৃদু হাসি হাসিয়া তিনি উত্তর করিলেন, “জেলে বসিয়াও আমরা যে বাহিরের কোন কথা জানিতে পারি না, এমন মনে করিবেন না। আমি শুনিয়াছি, এগারজন জুরী আমার বিপক্ষে এবং একজনমাত্র আমার সাপক্ষে ছিলেন।”
আমি বলিলাম, “হাঁ, তাহা হইলে আপনি ঠিক কথা শুনিয়াছেন।”
যজ্ঞেশ্বর বাবু বলিলেন, “এবার আমার মোকদ্দমা উঠিলে বোধ হয়, আর একজনও আমার সাপক্ষে থাকিবেন না। আপনি আমার সঙ্গে এই জেলের ভিতরে দেখা করিতে আসিয়াছেন, সেজন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিই। বোধ হয়, আপনি ভাল উদ্দেশ্যেই আসিয়াছেন।”
আমি। হাঁ, আমি আপনার ভালর জন্যই আপনার সঙ্গে আসিয়াছি।
যজ্ঞেশ্বর। আপনাকে কি বিশ্বাস করাইয়া দিতে হইবে যে, আমি এই ভয়ানক খুনী মোকদ্দমায় সম্পূর্ণ নিৰ্দ্দোষ?”
আমি। না, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি, কিন্তু আপনি যেরূপ ভাবে আপনার নিজের সৰ্ব্বনাশ ডাকিয়া আনিতেছেন—তাহা আপনার পক্ষে সম্পূর্ণ বিপজ্জনক
যজ্ঞেশ্বর। হইলেও হইতে পারে, তজ্জন্য আমি ভীত বা সঙ্কুচিত নহি। গত কয়বারে আমি যেমন নিজে নিজে পক্ষসমর্থন করিয়াছি, এবারও তাহাই করিব, স্থির করিয়াছি। কোন ব্যারিষ্টারকে আমার পক্ষ-সমর্থনের জন্য নিযুক্ত করিব না। আপনি যে আমায় নিদোষ বলিয়া বিবেচনা করেন, ইহাতে আমার মনে কতকটা শান্তি হইল।
আমি দেখিলাম, তাঁহার চক্ষুদ্বয় হইতে অশ্রুবারি বিগলিত হইতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, “যে জুরী আপনার সাপক্ষে ছিলেন, আপনি তাঁহার নাম জানেন কি?”
যজ্ঞেশ্বর। না, আমি জুরীদের মধ্যে কাহারও নাম জানি না।
আমি। কেন বিচারের দিন সে সকল নাম তো ডাকা হইয়াছিল—আপনি কি তা’ শুনেন নাই?
যজ্ঞেশ্বর। না, আমি সেদিকে বড় কান দিই নাই। শুনিবার কোন ইচ্ছাও ছিল না—জানিবার কিছু আবশ্যকও বোধ করি নাই।
আমি। জুরীদিগের মধ্যে কি এমন একজনের নামও আপনার কানে ঠেকে নাই, যিনি আপনার পরিচিত?
যজ্ঞেশ্বর। না, তাঁহারা সকলেই আমার কাছে অপরিচিত।
আমি। যখন জুরীদিগের মুখপাত্র বিচারপতির সম্মুখে আসিয়া বলিলেন যে, তাঁহারা কোনক্রমেই একমত হইতে পারিতেছেন না, তখন আপনি অত্যন্ত বিস্মিত ও চমকিত হইয়াছিলেন।
যজ্ঞেশ্বর। আপনি কি সে সময়ে আমার প্রতি লক্ষ্য করিয়াছিলেন?
আমি। করিয়াছিলাম বৈকি! আমি কেন, সে সময়ে অনেকেই আপনার প্রতি বিশেষ আগ্রহের সহিত লক্ষ্য করিয়াছিলেন।
যজ্ঞেশ্বর। সম্ভব বটে। আমি যদি বন্দী না হইতাম, আর কাঠগড়ায় না দাঁড়াইয়া অন্য স্থানে দাঁড়াইয়া থাকিতাম, তাহা হইলে আমিও হয় তো বন্দীর মুখপানে চাহিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতাম। জুরীর মুখপাত্রের কথা শুনিয়া আমি অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিলাম বটে। আমি পূর্বাবধিই মনে করিয়াছিলাম যে, জুরীরা সকলেই আমায় দোষী সাব্যস্ত করিবেন।
আমি। আরও, হয়তো আপনার মনে না থাকিতে পারে যে, সেই সময়ে আপনি বিশেষ আগ্রহের সহিত ঝুঁকিয়া জুরীদিগের প্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে আপনি কাহাকেও চিনিতে পারিয়াছিলেন কি? কাহারও নাম আপনার পরিচিত বলিয়া বোধ হইয়াছিল কি?
যজ্ঞেশ্বর। না, সত্য কথা বলিতে কি, আমি চোখে ভাল দেখিতে পাই না— তাঁহাদের কাহাকেও চিনিতে পারি নাই।
আমি। কেন আপনার চশমা তো আপনার গলায়ই ঝুলিতেছিল, আপনি তাহা ব্যবহার করেন নাই কেন?
আমার কথা শুনিয়া যজ্ঞেশ্বর বাবু মৃদু হাস্য করিলেন। এ অবস্থায় তাঁহার মুখে হাসি দেখিয়া আমি অবাক হইলাম।
যজ্ঞেশ্বর বাবু বলিলেন, “আপনাদের কুটবুদ্ধির কাছে কোন কথা লুকাইয়া রাখিবার যো নাই। এত তীক্ষ্ণদৃষ্টি বোধ হয় সাধারণ লোকের হয় না। যাহাই হউক, এ জেলে আসিয়াও যদি আমায় আপনি এ রকম করিয়া জেরা করেন, তাহা হইলে বাধ্য হইয়া আমায় বলিতে হইবে যে, আপনি আর এখানে আসিবেন না।”
তাঁহার মুখে এইরূপ কথা শুনিয়া আমি অতি কষ্টে আত্মসংযম করিলাম। আদালতে তাঁহার আষ্টার কোটের পকেট হইতে যখন হরতনের নওলাখানি বাহির করা হয়, তখন তিনি এত আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন কেন, সে কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিবার আমার ইচ্ছা ছিল। রাধারমণ বাবুর সঙ্গে তাঁহার কোন আলাপ পরিচয় আছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহভঞ্জন করিবারও আমি আশা করিয়াছিলাম; কিন্তু তাঁহার এইরূপ মনের ভাব ও কোন কথা বলিতে অনিচ্ছা দেখিয়া আমি মনের কথা প্রকাশ করিতে পারিলাম না। তিনিও যেমন বন্ধুত্বের খাতিরে তাঁহাদের কোন কথা প্রকাশ করিলেন না, আমিও তেমনি তাঁহার সহিত বন্ধুভাবে কথাবার্তা কহিতেছিলাম বলিয়া, বিশেষ পীড়াপীড়িও করিতে পারিলাম না। তাঁহার সহিত মনোমালিন্য বা বিবাদ করা তো আমার উদ্দেশ্য ছিল না, সুতরাং আমায় চুপ করিয়া থাকিতে হইল। এইরূপ কিয়ৎক্ষণ চিন্তার পর আমি বলিলাম, “আচ্ছা, আমি খুব সাবধান হইয়াই আপনার সঙ্গে কথা কহিব। আমার এখানে আসা আপনি বন্ধ করিবেন না। এ সকল স্থানে আসা যদিও মানুষের সুখকর নয়, তথাপি আপনার কাছে আসা আমার এখন বিশেষ আবশ্যক বলিয়া বোধ হইতেছে। এ অবস্থার আমাপেক্ষা বন্ধু আপনার কেহ নাই জানিবেন। আমি আপনার জন্য যে কি পৰ্য্যন্ত দুঃখিত, তাহা বলিতে পারি না। অর্থের জন্য আমি এতদূর করিতেছি ভাবিবেন না। আমাকে অন্য চক্ষে দেখিবেন।”
যজ্ঞেশ্বর। আপনার কথা শুনিলে আমার মনে বড় আনন্দের উদয় হয়। হয়তো আমি আপনার সহিত অভদ্রোচিত ভাবে কথাবার্তা কহিতেছি; কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানিবেন, আমার মনের ভাব তাহা নয়। ঘটনাচক্রে জড়ীভূত হইয়া আমার এইরূপ করিতে হইতেছে। ইচ্ছা করিয়া, দায়ে পড়িয়া আমার এই অবস্থা হইয়াছে। আমার নিজের দোষেই এই অবস্থা ঘটিয়াছে বলিতে হইবে। এক মুহূর্তের মধ্যে বোধ হয়, আমি প্রমাণ করিতে পারি যে, এই খুনী মোকদ্দমায় আমি সম্পূর্ণ নিদোষ; কিন্তু তাহা হইলে কোন কোন লোকের অসম্মান করা হয়, কোন কোন লোকের মাথা হেঁট করা হয়, কোন ভদ্রকুলমহিলার চরিত্রে কলঙ্ক আরোপিত হয়। আমার তুচ্ছ জীবন আমি অনায়াসে ত্যাগ করিতে পারি, কিন্তু যাহাতে অপরের অনিষ্ট হয়, আমা দ্বারা তাহা কোন মতেই হইবে না। এক সময়ে আমাপেক্ষা সুখী বোধ হয় জগতে কেহ ছিল কি না সন্দেহ; কিন্তু কোথায় সে সকল সুখের দিন লুক্কায়িত হইল, তাহা কে বলিতে পারে? এক সময়ে আমি বোধ হয়, জগৎপিতা পরমেশ্বরের নিকটে সহস্র বৎসর পরমায়ু যাচ্ঞা করিতে পারিতাম, কিন্তু আজ যদি এই মুহূর্ত্তে আমার প্রাণত্যাগ হয়, তাহা হইলে পর মুহূর্ত্তের প্রত্যাশা করি না।
এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া যজ্ঞেশ্বর বাবু ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। আমি তাঁহাকে অনেক সান্ত্বনা করিলে পর, তিনি বলিলেন, “হাঁ, জুরিগণের মুখপাত্র যখন বিচারপতির সম্মুখে আসিয়া বলিয়াছিলেন যে, তাঁহারা কোন ক্রমেই একমত হইতে পারিতেছেন না, তখন আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইয়াছিলাম বটে। জুরীদিগের মধ্যে এমন একজন লোক ছিলেন, যিনি আমায় নিৰ্দ্দোষ ভিন্ন অন্য কিছু মনে করিতে পারেন না। আমার প্রতি তাঁহার এই বিশ্বাসের জন্য, উদ্দেশ্যে অন্তরের সহিত আমি তাঁহাকে শত সহস্র ধন্যবাদ প্রদান করিয়াছিলাম।”
এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া যজ্ঞেশ্বর বাবু আবার চুপ করিলেন। একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। যেন কেহ তাঁহাকে লক্ষ্য করিতেছে বা তাঁহার কথা শুনিতেছে কি না, আশে-পাশে কেহ লুক্কায়িত আছে কিনা, ইহাই জানিবার জন্য তিনি একবার দেখিয়া লইলেন। তার পর অতি মৃদুস্বরে চুপি চুপি আমায় বলিলেন, “এ সময়ে আমার একজন প্রকৃত হিতৈষী বন্ধুর প্রয়োজন।”
আমি তৎক্ষণাৎ ঠিক তাঁহার ন্যায় চুপি চুপি উত্তর করিলাম, “কেন? আমি তো রহিয়াছি। আমি আপনার হিতৈষী বন্ধুর অভাব পুরণ করিতে অভিলাষী। নিঃসন্দেহে আপনি আমার কাছে আপনার অভিলাষ ব্যক্ত করিতে পারেন।”
আবার চারিদিকে চাহিয়া যজ্ঞেশ্বর বাবু বলিলেন, “কাজ অতি সামান্য, কিন্তু কোন লোককে আমার বিশ্বাস হয় না। আমার কাছে একখানি পত্র আছে, সেইখানি ডাকে ফেলিয়া দিতে হইবে। এ পত্রে কাহারও কোন সম্পর্ক নাই—কাহারও কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। ইহাতে যে সকল কথা আছে, তাহা সম্পূর্ণ আমার নিজের; জগতের অন্য কোন লোকের সহিত ইহার সম্বন্ধ নাই।”
আমি বলিলাম, “আমি আপনার পত্র ডাকে ফেলিয়া দিব। ইহা তো অতি সামান্য কথা।”
যজ্ঞেশ্বর বাবু অনেকক্ষণ ধরিয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমার মনে কি আছে, তাহাই জানিবার জন্য যেন তিনি বিশেষরূপে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। তাহার পর বলিলেন, “আমি সাহস করিয়া আপনাকে বিশ্বাস করিতে পারি কি? নহিলে আর বিশ্বাসই বা করিব কাহাকে?
আমি বলিলাম, “আপনি নিঃসন্দেহে আমায় বিশ্বাস করিতে পারেন। আমি আপনার পত্র ডাকে ফেলিয়া দিতে কোন প্রকার বিশ্বাসঘাতকতা করিব না।”
যজ্ঞেশ্বর বাবু বলিলেন, “কাছে নয়—এ শহরের ভিতরে নয়—অন্ততঃ এখান হইতে দশ ক্রোশ দূরে—কোন গ্রাম্য পোষ্ট আফিসে ইহা ফেলিয়া দিতে হইবে।”
আমি। আচ্ছা, তাহাই হইবে। আপনি যাহা বলিতেছেন, আমি সেই মতই কাজ করিব।
যজ্ঞেশ্বর। আমি কি আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারি? আপনি আমার বিশ্বাসের মান রাখিতে পারিবেন কি? বলুন, আপনার দ্বারা বিন্দুমাত্র বিশ্বাসঘাতকতা হইবে না।
আমি। আপনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে পারন। কোন সন্দেহই করিবেন না— আমার দ্বারা আপনার বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র হানি হইবে না। জগতে মানুষ মানুষকে যতদূর বিশ্বাস করা সম্ভব হয়, আপনি আমায় তদপেক্ষা অধিক বিশ্বাস করিতে পারেন।
যজ্ঞেশ্বর বাবু ছল্ ছল্ নেত্রে বিনা বাক্যব্যয়ে তখন তাঁহার সেই অতুলনীয় বিশ্বাসের দ্রব্য সেই পত্রখানি আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি তাহা গ্রহণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমি আবার আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসিতে পারি?”
উদাসীন ভাবে তিনি উত্তর করিলেন, “আসিবেন। আপনার সঙ্গে কথা কহিয়া আমার আজিকার দিনের ক্লেশের অনেকটা লাঘব হইল।”
অনন্তর আমি তাঁহার নিকটে বিদায় লইয়া সেখান হইতে বহির্গত হইলাম। তথা হইতে একেবারে হাওড়া ষ্টেশনে উপস্থিত হইয়া বর্দ্ধমানের একখানি টিকিট ক্রয় করিলাম। যথা সময়ে বর্দ্ধমানে উপস্থিত হইয়া ডাকে পত্রখানি ফেলিয়া দিতে যাইতেছি, এমন সময়ে খামের উপরে লিখিত নাম ও ঠিকানার প্রতি আমার দৃষ্টি পড়িল;-
“মিস্ মনোরমা বসু
নং-পার্কস্ট্রীট কলিকাতা।”
একি! এই ঠিকানায়ই তো আমি রাধারমণ বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম। সৰ্ব্বনাশ! এ রাধারমণ বাবু তবে কে? এ মনোরমা তবে কে? আবার ভাবিলাম, যজ্ঞেশ্বর বাবুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হইল কি? কেন আমি তাঁহার পত্র দেখিলাম?
পত্রখানি তো ডাকে দেওয়া হইল। কিন্তু এ মনোরমা কে, এই ভাবনাতেই আমি পাগল হইলাম। তৎক্ষণাৎ ডগ্লাস সাহেবকে একখানি টেলিগ্রাম করিলাম;-
“মিস্ মনোরমা বসু কে, এবং তাঁহার সহিত রাধারমণ বাবুর কোন সম্পর্ক আছে কি না, ইহা আমি জানিতে চাহি। মনোরমার সহিত যজ্ঞেশ্বর বাবুর কোন প্রকার সম্বন্ধ আছে কি না, এ কথা জানাও আমার বিশেষ আবশ্যক। হরতনের নওলা সম্বন্ধীয় কোন ঘটনা আপনি জানেন কি না?”
.
যথাসময়ে টেলিগ্রামের উত্তর পাইলাম। তাহাতে ডগ্লাস সাহেব বলিতেছেন;-
“মিস মনোরমা বসু রাধারমণ বাবুর ভ্রাতুষ্পুত্রী। যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত এক সময়ে মনোরমার প্রণয় হয় এবং বিবাহের কথাবার্তা ঠিক হইয়া যায়। সহসা তাঁহারা নিজেই সে কথাবার্তা ভঙ্গ করেন। কেন এরূপ ঘটিয়াছিল, তাহা কেহ বলিতে পারে না। সকলেই জানিতেন, তাঁহারা উভয়ে উভয়কে প্রাণের সহিত ভালবাসেন। হরতনের নওলার কথা আপনি কি জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, তাহা আমি বুঝিতেই পারিলাম না।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
পরদিন ডগ্লাস সাহেবকে আমি নিম্নলিখিত পত্রখানি লিখিলাম;–”মহাশয়!
আপনি তারে আমাকে যে সংবাদ দিয়াছেন, তাহাতে আমার বিশেষ উপকার হইতে পারে। মিস্ মনোরমা বসু ও যজ্ঞেশ্বর মিত্র উভয়ে এক সময়ে বড় প্রণয় ছিল এবং তাঁহাদের বিবাহের কথা ঠিক হইয়া গিয়াছিল, এ কথা জানা আমার বিশেষ আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। আপনার পত্রে বোধ হয়, আপনি মনোরমা সম্বন্ধে আরও অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় লিখিবেন; কিন্তু ততক্ষণ অপেক্ষা করিতে পারি না। আমার পক্ষে এখন এক মুহূর্ত্ত অপব্যয় করা উচিত নহে। আমার সময় এখন বহুমূল্য। আমার মনে দৃঢ় ধারণা জন্মিয়াছে যে, আপনার পত্র-প্রাপ্তির পূর্ব্বেই আমি হরিদাস গোয়েন্দার সাহায্যে এমন কোন গুপ্ত রহস্য বাহির করিয়া ফেলিব যে, তাহাতে এই মোকদ্দমায় বিশেষ সাহায্য হইবে। এখন শয়নে, স্বপনে, জাগরণে, যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমাই যেন আমার জপমালা হইয়াছে।
হরতনের নওলা সম্বন্ধে যে, আমি আপনার নিকট জানিতে চাহিয়াছিলাম, তাহা আপনি বাজে কথা বলিয়া মনে করিবেন না। এই হরতনের নওলাখানি যজ্ঞেশ্বর বাবুর আষ্টার কোটের পকেটে পাওয়া গিয়াছিল। এখানি কেমন করিয়া তাঁহার পকেটে আসিল, তাহা তিনি নিজেই জানিতেন কি না সন্দেহ। আমার বিশ্বাস, এই হরতনের নওলা হইতেই সমস্ত ঘটনা বাহির হইয়া পড়িবে। আমি যেন দিব্যচক্ষে দেখিতে পাইতেছি যে, এই হরতনের নওলার সঙ্গে এই খুনের মোকদ্দমার বিশেষ সম্বন্ধ আছে।
হরিদাস গোয়েন্দা আমাকে এক গুপ্ত সংবাদ দিয়াছেন যে, মিস্ মনোরমা বসু রাধারমণ বাবুর বাড়ীতে থাকেন না। তবে কখন কখন আসেন বটে। রাথারমণ বাবুর এক কন্যা আছেন; তাঁহার সঙ্গে মনোরমার বড় ভাব। মনোরমার গুপ্ত পত্র সকল রাধারমণ বাবুর কন্যার কাছেই আসে; তিনি আবার তাহা গুপ্তভাবে মনোরমার নিকটে পাঠাইয়া দেন। মনোরমার পিতা বড়লোক, কিন্তু তিনি হয় তো কিছু কড়া। তাহাই বোধ হয়, পার্ক স্ট্রীটের ঠিকানায় মনোরমার পত্রাদি প্রেরিত হয়।
হরিদাস গোয়েন্দার সাহায্যে মনোরমার বাড়ীর ঠিকানা জানিতেও আমার বিশেষ কোন ক্লেশ পাইতে হয় নাই। মনোরমার পিতার বাড়ী গোলদিঘীর দক্ষিণদিকে মিরজাফর ষ্ট্রীটের উপরে। বাড়ীখানি প্রকাণ্ড, রাজ-রাজড়ার বাড়ীর ন্যায়। দেখিয়া অনুমান করা যায়, এ বাড়ীতে যাঁহারা বাস করেন, তাঁহাদের আয় মাসিক দশ হাজার টাকার কম নহে।
মনোরমার সহিত কেমন করিয়া সাক্ষাৎ করিব, এই চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে একটি আশ্চর্য্য সুযোগ মিলিল। ডাক্তার অম্বিকা চরণ বাবু আমার একজন বিশেষ বন্ধু। তিনি আমায় সংবাদ দিলেন, মনোরমার উৎকট পীড়া হইয়াছে। চিকিৎসার জন্য ঘটনাচক্রে মনোরমার পিতা অম্বিকাচরণ বাবুকেই ডাকাইয়াছিলেন। অম্বিকাচরণ বাবু এ খুনের মোকদ্দমার দৈনিক সংবাদ আমার নিকটে প্রাপ্ত হয়েন; সুতরাং যাহা যাহা ঘটিয়াছে ও ঘটিতেছে, সকল কথাই তিনি জানেন। মনোরমার চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে আহ্বান করাতে তিনি তৎক্ষণাৎ তথায় গমন করেন।
অম্বিকা বাবু বলেন যে, মনোরমার পিতামাতা, কন্যার এই অবস্থা দেখিয়া বড়ই উদ্বিগ্ন হইয়াছেন। অনেক বড় বড় ডাক্তারকে দেখাইয়াও তিনি কোন ফল প্রাপ্ত হয়েন নাই। প্রকৃতপক্ষে মনোরমার ব্যাধি কি, তাহা আজ পর্যন্ত কেহই নিরাকরণ করিতে পারেন নাই। কিন্তু অম্বিকাচরণ বাবু মনোরমার পিতামাতাকে স্পষ্টই বলিয়াছেন যে এ রোগ শারীরিক নয়—মানসিক। ছাব্বিশে আষাঢ় তারিখ হইতে মনোরমার এই ব্যাধি হইয়াছে।
মনোরমার পিতা বড় কড়া লোক—একগুঁয়ে, যা ধরেন, সহজে তা ছাড়েন না। কিন্তু মনোরমার মাতা বড় মিষ্টভাষিণী, দয়াবতী ও একমাত্র কন্যার সাংঘাতিক পীড়ায় সন্তপ্ত। মনোরমার পিতা অম্বিকাচরণ বাবুকে জিজ্ঞাসা করেন যে, কোন প্রকার ঔষধ সেবনে মনোরমার কিছু উপকার দর্শিতে পারে কি না? অম্বিকাচরণ বাবু তাহাতে এই উত্তর দিয়াছিলেন যে, মানসিক ব্যাধির কোন ঔষধ নাই। যতক্ষণ পর্য্যন্ত না সেই মানসিক ক্লেশের কারণটি অপসারিত করা যাইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মনোরমার ব্যাধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে। ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবু ও মনোরমার পিতামাতা যেরূপভাবে কথাবার্তা কহিয়াছিলেন, নিম্নে তাহার অল্পাংশ উদ্ধৃত হইল;-
মনোরমার পিতা ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি কোন প্রকার ঔষধ দিতে পারেন না?”
অম্বিকাচরণ বাবু উত্তর করেন, “অবশ্য আমি একটা ঔষধ দিতে পারি, কিন্তু তাহাতে রোগীর কোন উপকার হইবে, এমন বোধ হয় না। যে সকল ঔষধ এই ঘরে রহিয়াছে, সাধারণতঃ চিকিৎসকমাত্রেই এ প্রকার রোগে এই সকল ঔষধ ব্যবহার করিয়া থাকেন। এখন আপনারা বিবেচনা করুন।”
মনোরমার পিতা জিজ্ঞাসা করেন, “যদি এই ভাবে আর কিছুদিন থাকে, তাহা হইলে এ রোগীর কি হওয়া সম্ভব?”
অম্বিকা। মনোরমার শারীরিক বল ও জীবনী শক্তি দিন দিন কমিয়া আসিতেছে। এইরূপভাবে আর কিছুদিন থাকিলে রক্ষা পাওয়া শক্ত হইবে।
এই কথায় মনোরমার মাতা অত্যন্ত ক্রন্দন করিতে আরম্ভ করেন। মনোরমার পিতা বলেন, “অম্বিকাচরণ বাবু! আমরা শুনিয়াছি, আপনি অনেক উৎকট ও বিষম রোগ আরোগ্য করিয়া বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছেন। আপনার সুচিকিৎসার জন্য অনেক বড় বড় ডাক্তারও অনেক সময় বিস্মিত ও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছেন। আপনার যশঃ ও সুখ্যাতি শুনিয়াই আমরা আপনাকে আনিয়াছি।”
অম্বিকা। আমি অনেক সুচিকিৎসা রোগ আরোগ্য করিয়াছি বটে, কিন্তু মানসিক ব্যাধির চিকিৎসা আমি যত লোকের করিয়াছি, তাহাদের সকলেরই গুপ্তকথা আমাকে বলিতে হইয়াছে। কারণ রোগীর প্রতি ঔষধ সেবনের ব্যবস্থা করিবার পূর্ব্বে তাহার কি রোগ, তাহা জানা একান্ত আবশ্যক। এই সূত্ৰ না পাইলে কখনই রোগের প্রকৃত চিকিৎসা করা হয় না। আমি যে সকল রোগ আরোগ্য করিয়াছি, তাহাদিগের প্রত্যেকেরই আন্তরিক অবস্থা ও গুহ্যকারণ সমস্তই আমি জানিতাম।
মনোরমার মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি মনে করেন, কোন গুপ্ত বিষয় আপনার কাছে লুকাইয়া রাখা হইতেছে?”
অম্বিকা। সে কথা আপনারা বলিতে পারেন, আমি তার কিছুই জানি না। আমি কেবল এই পৰ্য্যন্ত বলিতে পারি যে, আপনার কন্যার রোগ মানসিক এবং ইহা সাংঘাতিক হইয়া উঠিয়াছে। যতক্ষণ পর্য্যন্ত আমি রোগের কারণ জানিতে না পারিতেছি, ততক্ষণ পর্য্যন্ত কোন চিকিৎসাই চলিতে পারে না।
মনোরমার পিতা বলিলেন, “আপনি কাল একবার অনুগ্রহপূর্ব্বক আসিবেন।”
অম্বিকা। আমি সন্ধ্যার সময়েই আর একবার আসিতে পারি। আপনি যদি ইচ্ছা করেন, আপনার কন্যা মনোরমাকে সে সময়ে একবার দেখিয়াও যাইতে পারি।
মনোরমার পিতা অম্বিকাচরণ বাবুকে ধন্যবাদ দিয়া বিদায় করিলেন।
এই পৰ্য্যন্ত কথা শুনিয়া আমি অম্বিকাচরণ বাবুকে বলিলাম, “ডাক্তার! আমি তোমার দুই-একটা কথা বলিতে পারি। এই মনোরমার সহিত এক সময়ে যজ্ঞেশ্বর বাবুর প্রণয় ছিল এবং উভয়ের বিবাহের কথাও ঠিক হইয়া গিয়াছিল। আমার বোধহয়. ইহাদিগের খুব ভালবাসাও জন্মিয়াছিল।”
অম্বিকাচরণ বাবু বিস্মিত হইয়া উত্তর করিলেন, “বল, কি! তুমি যে আমায় আশ্চৰ্য্য করিলে!” তাহার পর অম্বিকাচরণ বাবুর সহিত এ সম্বন্ধে আমার অনেক কথা হইল। তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়া গেলেন যে, সম্ভবতঃ তিনি এ গুপ্ত রহস্যের মম্মোদঘাটন করিতে পারিবেন। আমি এই পৰ্য্যন্ত বলিতে পারি যে, হয়তো এই সূত্র ধরিয়াই আমরা জটিল এ খুনী মোকদ্দমার যা হয়, একটা শেষ নিষ্পত্তি করিতে পারিব।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ডগলাস সাহেবকে টেলিগ্রাম করিলাম;-
“আপনি মনোরমা সম্বন্ধে কি জানেন, সত্বর লিখিবেন। তাহার বাপ মা, ভাই বোন যদি কেহ থাকেন, সকলের সম্বন্ধেই কিছু কিছু জানা আমার একান্ত আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে।”
যথাসময়ে উক্ত টেলিগ্রামের উত্তর পাইলাম;–
“মনোরমার ভগ্নী নাই। কিন্তু তাহার একটি ভাই আছে, তাহার নাম নবীনচন্দ্র। নবীন ও মনোরমা উভয়ে যমজ। নবীনকে মনোরমা অত্যন্ত ভালবাসে। মনোরমার পিতা একজন ভয়ানক একগুঁয়ে ও একরোখা লোক। তিনি বড় কাহারও কথা শুনিয়া কাজ করেন না। আমি নিজে এক সময়ে মনোরমাকে বিবাহ করিবার জন্য উন্মত্ত হইয়াছিলাম। তাহাতে মনোরমার পিতার খুব সহানুভূতি ছিল। এমন কি তিনি জোর করিয়া মনোরমার সহিত আমার বিবাহ দিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন; কিন্তু আমি যখন দেখিলাম, মনোরমা যজ্ঞেশ্বর বাবুকে প্রাণের সহিত ভালোবাসে এবং তাঁহার সহিত বিবাহেই মনোরমার সম্পূর্ণ ইচ্ছা, তখন আমি স্ব-ইচ্ছায় সে আশা পরিত্যাগ করিলাম। আমি এইরূপ করিয়াছিলাম বলিয়াই মনোরমা আমাকে ভাল চক্ষে দেখে এবং আমাকে শ্রদ্ধা করে। কেবল মনোরমার জন্যই আমি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে এ বিপদ হইতে রক্ষা করিতে চাহি। আমার বিশ্বাস, মনোরমা যজ্ঞেশ্বর বাবুকে এখনও প্রাণের সহিত ভালবাসে এবং তাঁহার এই বিপদের কথা শুনিয়া না জানি অভাগিনী কত ক্লেশই পাইতেছে। যদি যজ্ঞেশ্বর বাবুর কোন বিপদ ঘটে, তাহা হইলে মনোরমা বাঁচিবে কি না সন্দেহ। নবীনের কথা আমি বড় কিছু জানি না। আমি তাহাকে জীবনে একবারমাত্র দেখিয়াছি। মনোরমার মাতা মিষ্টভাষিণী ও দানশীলা। আমার ধারণা এই যে, তিনি তাঁহার স্বামীর ভয়ে কোন কথা প্রকাশ করিতে পারেন না।”
এই টেলিগ্রামখানি পাইয়া আমি ডগ্লাস সাহেবকে আবার একখানি পত্র লিখিলাম;-
“আপনার টেলিগ্রামখানি পাইয়া আমি বড় সন্তুষ্ট হইলাম। আপনি যে কি জন্য এত অৰ্থ ব্যয় করিয়াও যজ্ঞেশ্বর বাবুকে বাঁচাইতে চেষ্টা করিতেছেন, তাহা আমি এতক্ষণে বুঝিতে পারিলাম। আপনার ন্যায় উদার প্রকৃতির লোক আমি পূর্ব্বে কখনও দেখিয়াছি কি না সন্দেহ। যাঁহার সাহায্য করিতে আপনি অগ্রসর হইয়াছেন, অন্য লোক হইলে যাহাতে তাঁহার সর্ব্বনাশ হয়, সেই চেষ্টাই আগে করিত। এরূপ অবস্থায় প্রণয়ের বিরোধীজনের প্রতিহিংসা দ্বেষ থাকাই সম্পূর্ণ সম্ভব। যজ্ঞেশ্বর বাবুর প্রতি আপনার ঈর্ষাপরবশ হওয়া কিছু বিচিত্র বলিয়া বোধ হইত না; কিন্তু আপনি প্রণয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীকে জীবন দান করিবার জন্য যে উদারতা দেখাইয়াছেন, এ কালের লোকের এরূপ প্রবৃত্তি প্রায় দেখা যায় না। এখন হইতে আমি আপনাকে আরও ভক্তির চক্ষে দেখিব। এরূপ দেব প্রকৃতির লোকের সহিত কাজ করিয়াও সুখ আছে।
আমি স্বীকার করিতে বাধ্য যে, যদি অম্বিকাচরণ বাবু মাঝে না থাকিতেন, তাহা হইলে হরিদাস গোয়েন্দাকে আরও অধিক পরিশ্রম করিতে হইত, এই সামান্য বিষয় জানিবার জন্য হয়তো কত নতুন কৌশলজালের সৃষ্টি করিতে হইত। আপনার পত্রে হরিদাস গোয়েন্দার আশ্চর্য্য কূটবুদ্ধির জোরে ও অম্বিকাচরণ বাবুর সহায়তায় অতি শীঘ্র আমি এই হরতনের নওলার গুপ্ত রহস্যের মর্ম্মোদঘাটন করিতে সক্ষম হইব। আর আমার বোধ হয়, এই গুপ্ত রহস্যের কারণ নিরাকরণ করিতে পারিলেই নিশ্চয় এ মোকদ্দমায় আমাদের জয় হইবে। অম্বিকাচরণ বাবুকে হরিদাস গোয়েন্দা যেরূপ শিক্ষা প্ৰদান করিতেছেন, তিনি সেই মতই কার্য্য করিতেছেন। হরিদাস গোয়েন্দার কূটকৌশলজালপূর্ণ মন্ত্রণা সকল শুনিয়া তাঁহার ক্ষমতার উপর আমার অত্যন্ত আস্থা জন্মিয়াছে এবং আমার স্থির বিশ্বাস, তাহার সাহায্য বিনা আমরা কখনই এ কার্য্যে সফলকাম হইতে পারিতাম না।
ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবু এখন দুই বেলা মনোরমাকে দেখিতে যাইতেছেন। মনোরমা এখনও অত্যন্ত পীড়িত। তাহার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হইয়া দাঁড়াইতেছে। একদিন অম্বিকা বাবু নাড়ী পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, রোগিনীর জীবন সঙ্কটাপন্ন। মস্তিষ্কেরও দোষ জন্মিয়াছে। মনোরমা সর্ব্বদা শূন্যদৃষ্টি একদিকে চাহিয়া থাকে। বিকারের অবস্থায় সে আবোল-তাবোল অনেক বাজে কথা কহিতে আরম্ভ করিয়াছে। তিনি মনোরমাকে মাতাকে কন্যার ক্রমশঃ রোগ বৃদ্ধির কথা বলিলেন। শুনিয়া জননীর মুখ শুকাইল, অম্বিকাচরণ বাবু ডাক্তার—কূটবুদ্ধির বিশেষ কোন ধার ধারেন না। যদি আমি কোন ক্রমে সেখানে উপস্থিত থাকিতে পারিতাম, তাহা হইলে হয়তো মনোরমার অজ্ঞান অবস্থার কথা শুনিয়া এ রহস্যের অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিতাম।
মনোরমার পিতা ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবুর সহিত একদিন গুপ্ত পরামর্শ করিয়াছিলেন। অম্বিকা বাবু কিন্তু তাঁহাকে স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, এ ব্যাধি শারীরিক নয় এবং যতক্ষণ পর্য্যন্ত ইহার প্রকৃত কারণ তিনি জানিতে না পারিতেছেন, ততক্ষণ চিকিৎসায় কোন ফলোদয় হইবে না। আর এরূপভাবে মনোরমাকে অধিক দিন ফেলিয়া রাখিলে মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী।
এই গুপ্ত পরামর্শে প্রথমে মনোরমার মাতা উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু তাহার পর তিনি আসিয়াছিলেন। অম্বিকাচরণ বাবু এই সময়ে বেশ ভাল করিয়া মনোরমার মাতাপিতা উভয়কেই বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে, তাহাদিগের কন্যার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। মনোরমার মাতা অম্বিকাচরণ বাবুর কথায় অজস্রধারে অশ্রু বিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন; কিন্তু মনোরমার পিতার হৃদয় এমনই কঠিন যে, তিনি এ সকল কথা শুনিয়াও সম্পূর্ণ অবিচলিত রহিলেন।
অম্বিকাচরর বাবু আমাকে এই সকল কথা বলিতে বলিতে কহিলেন, “কিন্তু পিতার হৃদয় কঠিন হইলেও আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, অন্তরে অন্তরে তিনি অত্যন্ত কষ্টভোগ করিতেছিলেন। মনোরমাকে তিনি প্রাণের সহিত ভালোবাসেন।”
অম্বিকাচরণ বাবু যতই মনোরমার পিতামাতাকে তাঁহাদিগের কন্যার এইরূপ মানসিক বিকাশের কারণ জিজ্ঞাসা করেন, মনোরমার পিতা ততই তাহা উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করেন। মনোরমার মাতা ছলছলনেত্রে প্রতিদিন অম্বিকাচরণ বাবুকে বিদায় দিবার সময়ে পরদিন পুনরায় আসিবার জন্য বলিয়া দেন।
অম্বিকাচরণ বাবু দুই-চারিদিন এইরূপভাবে দুই বেলা আসা-যাওয়া করিয়াও যখন কোন গুপ্ত কারণের অনুসন্ধান করিতে পারিলেন না, তখন কাজে কাজেই বাধ্য হইয়া একদিন তিনি মনোরমার পিতাকে বলিলেন, “আমি প্রতিদিন এরূপভাবে আসা-যাওয়া করিলে তো আপনার কোন ফল হইবে না। আপনার কন্যার জীবন-সঙ্কটাবস্থায়ও যখন আপনি সে সকল গুপ্ত কারণ অপ্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেছেন, তখন আমি কাজেকাজেই বাধ্য হইয়া বলিতেছি যে, আপনি আপনার কন্যার জীবন লইয়া বালকের ন্যায় খেলা করিতেছেন।”
অম্বিকাচরণ বাবু একজন যে-সে ডাক্তার নহেন। তাঁহার খুব পশার—বেশ হাত-যশঃ। সুতরাং ডাক্তারী হিসাবে তিনি যে কথা বলিবেন, তাহা অবশ্য মূল্যবান। তাঁহার মুখে এইরুপ কড়া কথা শুনিয়া মনোরমার পিতা বড় ভীত হইলেন।
অম্বিকাচরণ বাবু তাঁহাকে আরও বলিলেন, “যদি আপনি বরাবর এইভাবে চলিতে ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আপনি অন্য ডাক্তার আনিতে পারেন, কিন্তু আমার ডাক্তারী জ্ঞান যতদূর, তাহার উপরে নির্ভর করিয়া আমি আপনাকে স্পষ্ট বলিতে পারি যে, এরূপ অবস্থায় ফেলিয়া রাখিলে দুই-একদিনের মধ্যেই আপনার কন্যার প্রাণবিয়োগ হইবে। আমার উপরে বিশ্বাস না হয়, আপনি আমাপেক্ষা ভালো ডাক্তার আনাইয়া আমার বর্তমানে বা অবর্তমানে পরামর্শ করিয়া দেখিবেন। আর আমি যে যে কথা বলিয়াছি, সে সকল কথা তাঁহাকে বলিবেন।”
মনোরমার পিতা তাহাতে উত্তর করেন, “আপনার চিকিৎসার ক্ষমতার উপরে আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে।”
অম্বিকা। কই, আপনি তো সে বিশ্বাসমত কাজ করিতেছেন না।
তাহার পর মনোরমার পিতা তাঁহাকে আর একবার আসিবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করেন। অম্বিকাচরণ বাবু যেন অনিচ্ছাসত্বে তাঁহাদের কথায় সম্মত হইয়া বলেন, “কিন্তু এবার আসিলেও যদি আপনি মনোরমার মানসিক কষ্টের গুপ্ত কারণ আমাকে না বলেন,তাহা হইলে নিশ্চয় জানিবেন যে, সেই আসাই আমার শেষ আসা হইবে। চিকিৎসা শাস্ত্রে আমার যেটুকু সুখ্যাতি আছে, তাহা আমি এরুপভাবে নষ্ট করিতে ইচ্ছা করি না।”
অম্বিকাচরণ বাবু যেরূপ বলিয়াছেন, সেই কথামতই আর একবার মনোরমাকে দেখিতে গেলেন। মনোরমার মাতার সহিতই প্রথমে অম্বিকাচরণ বাবুর সাক্ষাৎ হইল। তিনি বলিলেন, “ডাক্তার বাবু! আপনি বোধহয়, শুনিয়া সন্তুষ্ট হইবেন যে, আমার স্বামী আপনার নিকটে সেই গুপ্ত কারণ প্রকাশ করিতে সম্মত হইয়াছেন, এবং আমাকে সে কার্য্যের ভার দিয়াছেন। এখন আপনি আমায় যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি তাহার উত্তর প্রদান করিনে প্রস্তুত আছি।”
অম্বিকাচরণ বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি তাঁহাকে রাজী করিতে সমর্থ হইয়াছেন।”
মনোরমার মাতা বলিলেন, “আজ্ঞে হ্যাঁ, অনেক কষ্টে আমি তাঁহাকে সম্মত করিতে পারিয়াছি। এখন বোধ হয়, আপনি আমার কন্যার জীবন দান করিতে পারিবেন।”
অম্বিকাচরণ বলিলেন, “সে ভগবানের হাত, ঔষধে ও চিকিৎসায় যদি কোন উপকার হইবার সম্ভাবনা থকে, তাহা হইলে আমার দ্বারা সে চেষ্টার কোন ত্রুটি হইবে না,জানিবেন।”
মনোরমার মাতা বলিলেন, “আপনি আমার কাছে এখন কি জানিতে চাহেন?”
অম্বিকাচরণ বলিলেন, “আপনার কন্যার সম্বন্ধে সমস্ত কথাই আমায় বলুন। কি মানসিক চিন্তায় আপনার কন্যা এত উৎপীড়িত, আপনি নিশ্চয় জানেন। সে কথা আমার জানা আবশ্যক। কোন কথা অপ্রকাশ রাখিবার চেষ্টা করিবেন না। আপনার কন্যা—তাহার জন্য আপনার প্রাণ যত কাঁদিবে, অপরের তা দৃশ না হইতে পারে। ডাক্তারের কাছে কোন কথা লুকাইলে চলিবে না।”
মনোরমার মাতা বলিলেন, “ডাক্তার বাবু! আমার প্রাণের ভিতরে যে কি হইতেছে, তাহা আপনাকে বলিতে পারি না। মনোরমা যদি আমায় ছাড়িয়া চলিয়া যায়, তাহা হইলে আমি কখনই বাঁচিব না।”
এই বলিয়া মনোরমার মাতা মনোরমার কথা বিবৃত করিতে লাগিলেন;
“মনোরমা ও নবীন আমার যমজ সন্তান। ভ্রাতা ও ভগ্নীর অন্তরে পরস্পরের প্রতি প্রবল স্নেহস্রোত ছিল। মনোরমা নবীনকে এক দন্ড দেখিতে না পাইলে যেমন কাতর হইত—নবীনও মনোরমা তিলার্দ্ধ চক্ষের অন্তরাল হইলে সেইরূপ ব্যাকুল ও উৎকণ্ঠিত হইত। কিন্তু হাজার হউক, নবীন বেটা ছেলে, তাহার ভালোবাসা মনোরমা অপেক্ষা অপেক্ষাকৃত অল্প। তা বলে যে নবীন মনোরমাকে ভালোবাসিত না বা স্নেহ করিত না, এরূপ নহে। ভাই ভগ্নীতে দিন রাত একত্রে থাকিত, একত্র খেলা করিত, একত্র আহার করিত। এইরূপ আঠার বৎসর তারা এক সঙ্গে বাস করিয়াছিল।
“এই সময়ে নবীনকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করা হয়। ইতি পূর্ব্বে নবীন হেয়ার স্কুলে পড়িত। আমার স্বামী নবীনের লেখা পড়ার বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। তিনি তাঁহার সন্তান দুটিকে বিশেষ স্নেহ করিতেন, কিন্তু অপত্য-স্নেহ অপেক্ষা তাঁহার নিজের আত্মসম্ভ্রম বোধ অধিক ছিল।
“ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্ত্তি হইয়া নবীন কলেজেই থাকিত। সে প্রতি সপ্তাহে মনোরমাকে চারি-পাঁচখানি করিয়া চিঠি লিখিত; কিন্তু আমি বা আমার স্বামী .এই সকল পত্রের মর্ম্ম কিছুই সংগ্রহ করিতে পারিতাম না। চিঠি লিখিবার এক রকম নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করিয়াছিল। ছেলেবেলা হইতেই তাহারা এই রকমে চিঠি পত্র লেখালেখি করত। এই সকল চিঠি কেমন এক নতুন অসংবদ্ধ ধরনে লিখিত হইত যে, পত্রে কি লেখা থাকিত, তাহা তাহারা দুজন ভিন্ন অন্য লোকে কিছুই বুঝিতে পারিত না। এক-একদিন মনোরমা নবীনের চিঠি আনিয়া হাসিতে হাসিতে বলিত, ‘মা এই চিঠি খানা পড় দেখি?’ কিন্তু আমার কি সাধ্য যে, আমি সেই চিঠি পাঠ করি। আমার পক্ষে তাহা যেন গ্রীক বা ল্যাটীন ভাষায় লেখার মতো বোধ হইত। চিঠিতে কতকগুলি কথা ও কয়েকটি নম্বর একত্র তাল পাকাইয়া থাকিত। একটা কথার ধারে একটা নম্বর, আবার একটা নম্বরের গায়ে তিন -চারিটা কথা—এইরূপে চিঠি খানি পূর্ণ থাকিত; দেখিলেই আমার উহা গোলক-ধাঁধার মত বোধ হইত—আমি উহার কিছু বুঝিতে পারিতাম না; কিন্তু মনোরমা সেই সকল পত্র আমার সম্মুখে বসিয়া অনায়াসে পড়িয়া যাইত; কোথাও থামিও না বা কোন রূপ আকাইত না।
“আমার মনে আছে, মনোরমা একদিন বলিয়াছিল, ‘দেখ মা! আমাদের যদি কোন গুপ্ত কথা থাকে, তাহা আমরা অনায়াসে এইরূপ চিঠি-পত্র দ্বারা পরস্পর পরস্পরের নিকটে প্রকাশ করিতে পারি। আমরা কি লিখিয়াছি, কেহই পড়িতে পারিবে না। কারণ আমাদের এইরূপ চিঠি লেখিবার কৌশল কেহই জানে না।’ ডাক্তার বাবু! বলিতে কি তখন তাহার কথায় আমার বিন্দুমাত্রও সন্দেহ হয় নাই যে,উহার ভেতরে কত গুরুতর বিষয় লুক্কায়িত থাকিতে পারে।।
“কলেজেই নবীনের সর্বনাশ হয়। অসৎসঙ্গে পড়িয়া সে নিতান্ত দুশ্চরিত্র হইয়া পড়ে। তাহার আচার ব্যবহার, রীতি-নীতি একেবারেই বদ্লাইয়া যায়। লেখাপড়ার সময় সে জুয়াখেলায় ও অসৎসঙ্গে কাৰ্য্যে কাটাইত। কলেজে কলেজে তাহার কোন সুনাম বা সুখ্যাতি ছিল না। সেখানেই সকলে তাহাকে বখা-ছেলে মনে করিত। লেখাপড়ার ত কথাই নাই। সে দিনান্তে একবারও বই লইয়া বসিত কিনা সন্দেহ। আমার স্বামী আশা করিয়াছিলেন যে, নবীন সুখ্যাতির সহিত পাশ হইয়া কলেজ হইতে বাহির হইবে, কিন্তু হায়! দূরদৃষ্টিবশতঃ তাহার সকল আশায় ছাই পড়ল। কাজেকাজেই যখন তিনি কলেজে পুত্রের কুব্যবহার সকল জানিতে পারিলেন, তখন একবারে ভগ্নমনোরথ হইয়া পড়িলেন। তাঁহার মনোবাসনা পূর্ণ হইল না দেখিয়া তিনি বড়ই দুঃখিত ও নিরাশ হইলেন।
“যখন পুত্রের অসদাচরণের কথা তাঁহার কর্ণগোচর হয়, তখন নবীন উৎসন্নের পথে অনেক দুর অগ্রসর হইয়াছিল, এবং অনেক দুষ্কর্ম ইতিপূর্ব্বেই সাধন করিয়াছিল। তাহার পর হঠাৎ একদিন নবীন কলেজ হইতে বাড়ীতে ফিরিয়া আসিল, আর কোনক্রমেই কলেজে যাইতে স্বীকৃত হইল না। প্রাণান্তেও সেখানে আর যাইবে না, এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিল।
“ঠিক এই সময়েই মনোরমার জীবনস্রোতের অনেক পরিবর্তন ঘটিতে লাগিল। মনোরমা সুন্দরী, প্রতিভাশালিনী ও সদাচারসম্পন্না। তাহার স্বভাব-চরিত্র অতীব-বিনীত ও মধুর। এক কথায় তখন সে কোমলতা লাবণ্য ও বিনয়ের প্রতিমুর্ত্তিরূপিণী। এ সকল গুণসত্ত্বেও সে আবার সমাজে বিশেষ পরিচিত ও মান্যগণ্য ধনবানের কন্যা। সুতরাং অনেক সম্ভ্রান্ত যুবক মনোরমার পরিণয়ার্থী হইয়া তাহার সহিত বিবাহের প্রস্তাব করিতে লাগিল। দুইজন ব্যতীত অপর সকলকেই আমরা এক রূপ বিদায় করিয়াছিলাম। যে দুইজন মনোরমার করপ্রার্থী হইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে একজনের নাম যজ্ঞেশ্বর মিত্র ও আর একজনের নাম ডগ্লাস সাহেব।
“আমার স্বামীর ইচ্ছা, ডগ্গ্লাস সাহেবের সঙ্গে মনোরমার বিবাহ হয়; কিন্তু মনোরমার কাকা রাধারমণ বাবুর একান্ত ঝোঁক, যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত মনোরমার বিবাহ দেওয়া হয়। এমন কি নিজের জেদ বজায় রাখিবার জন্য মনোরমার কাকা রাধারমণ বাবু তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে ডগ্গ্লাস সাহেবের নিন্দা ও যজ্ঞেশ্বর বাবুর প্রশংসা সদা-সর্বদাই করিতেন। আমার স্বামী ডগ্লাস সাহেবকে স্নেহের চক্ষে দেখিয়াছিলেন, সুতরাং কেহ তাহার নিন্দা করিলে বড় বিরক্ত হইতেন। মনোরমা কিন্তু নিজের বিষয় নিজে সিদ্ধান্ত রাখিয়াছিল। সে যজ্ঞেশ্বর বাবুকে প্রাণের সহিত ভালোবাসিত, তাঁহাব প্রতিই প্রাণ, মন সমর্পণ করিয়াছিল।
এই সময় যজ্ঞেশ্বর বাবু ও ডগ্লাস সাহেব উভয়েই আমাদের বাড়ীতে সর্বদা যাতায়াত করিতেন। উভয়েই মনে করিতেন, মনোরমার প্রেমপাত্র হইবেন। মনোরমাকে বিবাহ করিবার আশা উভয়েই সমভাবে হৃদয়ে স্থান দিয়াছিলেন; কিন্তু এরূপে আর কতদিন চলিতে পারে? যজ্ঞেশ্বর বাবুর প্রতি মনোরমার অধিকতর ভালোবাসা—ক্রমে সকলেই বুঝিতে পারিলেন। তখন ডগ্লাস সাহেব অত্যন্ত ভগ্নমনোরথ হইয়া পড়িলেন। বহুকষ্টে তিনি মনের অনল মনে নির্ব্বাপিত করিয়া মনোরমার পাণিগ্রহণের আশায় জলাঞ্জলি দিলেন।
“ডগ্লাস সাহেবের পক্ষে আরও আক্ষেপের বিষয় এই যে, আমার স্বামী তাঁহার পক্ষ-সমর্থন করিলেও তিনি সফলকাম হইতে পারিলেন না। পরে যাহা ঘটিয়াছিল,তাহাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, ‘ডগ্লাস সাহেব মনোরমাকে আন্তরিক ভালোবাসিতেন। বিদায় গ্রহণের পূর্ব্বে তিনি মনোরমার সহিত একদিন নিৰ্জ্জনে সাক্ষাৎ করিয়া আপনার প্রাণের উচ্ছ্বাস পরিব্যক্ত করেন।
“ডগ্গ্লাস সাহেব যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিতও সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। মনোরমাকে বিবাহ করিতে আসিয়াই যে ইঁহাদের পরস্পরের আলাপ হইয়াছিল, তাহা নহে। অনেক দিন পূর্ব্ব হইতেই তাঁহারা বন্ধুত্ব-সূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। ডগ্গ্লাস সাহেব মনোরমাকে পাইলেন বলিয়া যে, যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত শত্রুতা করিবেন, তিনি সে স্বভাবের লোক নহেন। তাঁহাদের প্রণয় পূর্ব্বের ন্যায়ই অবিচলিত রহিল। এমন কি ডগ্গ্লাস সাহেব, যাহাতে মনোরমা ও যজ্ঞেশ্বর বাবুর পরিণয়ের পর, উভয়ে সুখে-সংসার-যাত্রা নির্ব্বাহ করিতে পারেন, সে বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন প্রতিশ্রুত হন। তিনি বলিয়াছিলেন যে, কোন সময়ে মনোরমা বা যজ্ঞেশ্বর বাবুর কোন উপকার করিতে পারিলে, তিনি আপনাকে কৃতার্থ জ্ঞান করিবেন। ডগ্লাস সাহেবের মহত্ত্বও উদারতা এই ঘটনা হইতেই বেশ বুঝা যায়।
“মনোরমার প্রণয়লাভে অসমর্থ হইয়া ডগ্গ্লাস সাহেব নিতান্ত কাতর হইয়া পড়েন। এমনকি তিনি কলিকাতা ত্যাগ করিয়া যাহাতে কৃতসঙ্কল্প হন। এই সময়ে তিনি আর আমাদের বাড়ীতে বড়-একটা যাতায়াত করিতেন না। একদিন আমার স্বামী তাঁহার লিখিত একখানি পত্র পাইলেন। এই পত্রে, ডগ্লাস সাহেব কলিকাতা ছাড়িয়া আগ্রায় বাস করিবার অভিমত আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন, এবং অতি বিনীতভাবে আমাদের কাছে বিদায় প্রার্থনা করিয়াছিলেন। অগ্রায় ডগ্গ্লাস সাহেবের ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্না হন। তিনি তথায় বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই আপনার প্রতিভা ও উদ্যমের সাহায্যে যথেষ্ট অর্থসঞ্চয় করেন।
“ডগ্লাস সাহেব চলিয়া গেলেন, মনোরমা ও যজ্ঞেশ্বর বাবুর বিবাহে আর বিশেষ কোন বাধা রহিল না। এ বিবাহে কিন্তু আমার স্বামীর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তাঁহার পূর্ব্বাপর ইচ্ছা ছিল, ডগ্লাস সাহেবের সহিত মনোরমার বিবাহ হয়; সে আশা পূর্ণ হইল না দেখিয়া তিনি কথঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়াছিলেন। কন্যা তাঁহার অভিলাষের বিরুদ্ধাচারিণী হইল বলিয়া তিনি তাঁহার উপরে কথঞ্চিৎ রুষ্ট হইয়াছিলেন। যজ্ঞেশ্বর বাবুকে তিনি পূর্ব্বে যে চক্ষে দেখিতেন এখন আর সেরূপ দেখিতেন না। আমি অনেক সাধ্যসাধনা করার পর এই বিবাহে তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্মতি প্রদান করিয়াছিলেন
“এই বিবাহে তাঁহার এইরূপ অনভিমত দেখিয়া, মনোরমা ও যজ্ঞেশ্বর বাবু উভয়েই কিছু ক্ষুণ্ন হইয়াছিল। আমার স্বামী অনেকবার আমাকে বলিয়াছিলেন, ‘দেখ এই বিবাহে আমার আদৌ মত নাই। তবে তোমার ও মনোরমার জেদে আমি এই কার্য্যে অগ্রসর হইতেছি। ভবিষ্যতে যদি কোনরূপ অশান্তি উপস্থিত হয়,আমি তাহার জন্য তিলমাত্রও দায়ী হইব না। আরও যজ্ঞেশ্বর বাবুর সচ্চরিত্রতা, ন্যায়পরায়ণতা, ও ভদ্র ব্যবহারে আমি অত্যন্ত পরিতুষ্ট। সেইজন্য এই পরিণয়ে আমি বিশেষ কোন বাধা উপস্থিত করিতেছি না। এরূপ সচ্চরিত্র ও ভদ্রলোকের সহিত আমার কন্যার বিবাহ হইলে আমাদের মুখোজ্জ্বল হইবে।’
“এইরূপে আমি আমার স্বামীর মতের বিরুদ্ধে ও মনোরমার সুখের জন্য যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত তাহার বিবাহের পক্ষপাতী হইয়াছিলাম। কি ভয়ানক বিপজ্জাল আমাদের মস্তকের উপর ক্রীড়া করিতেছিল, তাহা আমরা তখন আদৌ চিন্তা করি নাই। এই বিপত্তরঙ্গে মনোরমা ও যজ্ঞেশ্বর বাবুর সুখের আশা একবারে চূর্ণীকৃত হইয়া গেল। দুঃখের বিষয় এই যে, আমার পুত্র নবীনই মনোরমার এই অশান্তি ও বিপদের মূলীভূত কারণ হইয়া দাঁড়াইল। মনোরমা ও যজ্ঞেশ্বরের কোন অপরাধ নাই। নবীনই এই সর্বনাশের মূল
“নবীন যতদিন শিবপুরে ছিল, আমার স্বামী তাহাকে ততদিন বড় ঘৃণা করিতেন। কারণ সে সময়ে নবীনের চরিত্রে সকল প্রকার দোষ জন্মাইয়াছিল, উন্নতির আর কোন আশা ছিল না। তাহার পর নবীন লেখাপড়া ছাড়িয়া বাড়ীতে আসিয়া রহিল, কোন কাজ কর্ম্মের চেষ্টা করিল না। রাত্রিতে নবীন প্রায়ই বাড়ীতে থাকিত না, অথবা অধিক রাত্রিতে বাড়ীতে আসিত। আমার স্বামী নবীনকে এইরূপ ব্যবহারের জন্য কত তিরস্কার করিতেন, কত বুঝাইতেন, কত সদুপদেশ দিতেন, কিন্তু নবীন তাঁহার কোন কথারই উত্তর দিত না। কোথায় যাইত, কোথায় থাকিত, কি করিত, তাহা কেহই জানিত না। কখন কখন নবীন দুই-একটা কারণ নির্দ্দেশ করিত বটে; কিন্তু আমার স্বামী তাহা বিশ্বাস করিতেন না।
“নবীনের নিকট কোন কথা বাহির করিতে না পারিয়া মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করিতেন। কারণ আমার স্বামী জানিতেন, নবীন ও মনোরমা উভয়ের বড় সদ্ভাব। মনোরমা নবীনের বিষয় জানিতে পারে, এই ভাবিয়া আমার স্বামী মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। মনোরমা কোন কথাই প্রকাশ করিতে স্বীকৃত না হওয়াতে আমার স্বামী বড় বিরক্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার মনে এই ধারণা জন্মিয়াছিল যে, তাঁহার নিজগৃহেই তাঁহার বিরুদ্ধে নানাপ্রকার ষড়যন্ত্র হইয়াছে; সে ষড়যন্ত্রের প্রধান নেতা যজ্ঞেশ্বর বাবু, এবং তাঁহার পুত্র নবীন ও কন্যা মনোরমা যজ্ঞেশ্বর বাবুর কুহকে ভুলিয়া, এই ষড়যন্ত্রে সাহচর্য্য করিতেছে। এই বিশ্বাস জন্মিয়াছিল, বলিয়াই তিনি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে দেখিতে পারিতেন না এবং তাঁহার সহিত ভাল করিয়া কথা কহিতেন না। এমন কি যজ্ঞেশ্বর বাবু এ বাড়ীতে আসিলেও যেন তিনি বিরক্ত হইতেন।
“যদি সেই সময়ে আমার স্বামী নবীনের পশ্চাতে লোক লাগাইতেন, তাহা হইলে হয়তো তিনি বুঝিতে পারিতেন, নবীন কোথায় যায় বা কি করে। হয়তো তাহা হইলে এ সৰ্ব্বনাশ ঘটিত না; কিন্তু তিনি এত একরোখা ও একগুঁয়ে লোক যে, এরূপ উপায় অবলম্বন করিতে অপমান বোধ করিয়াছিলেন। কাজেকাজেই নবীনকে সর্ব্বনাশের পথ হইতে ফিরাইবার কোন উপায় ছিল না।”
“কখন কখন নবীন অনেকদিন ধরিয়া বাড়ী আসিত না। কোথায় থাকিত, তাহা কেহ বলিতে পারিত না—তাহার সন্ধান কেহ দিতে পারিত না; কিন্তু এই অনুপস্থিতির কালেও নবীন, মনোরমাকে প্রায় প্রতিদিন পত্র লিখিত। সেই সকল চিঠিপত্র আমার স্বামী কখন কখন মনোরমার নিকট চাহিতেন। মনোরমা বলিত, বাবা! আপনি এর কিছুই বুঝিতে পারিবেন না। আমরা সাধারণ লোকের মত পত্রাদি লিখি না। আমাদের পত্র লেখার ধরন অন্য প্রকার। আমরা দুইজন ছাড়া এ পত্র লিখিবার ধরন আর কেহ জানে না। আমাদের পত্র পড়িয়া কেহই বুঝিতে পারিবে না, পত্রে কি লেখা আছে।’
“আমার স্বামী মনোরমার কথা শুনিতেন না, পত্রগুলি দেখাইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতেন। মনোরমা পত্র দেখাইত; কিন্তু পড়িয়া শুনাইত না। হয়তো প্রতিপত্রেই এমন কোন কথা থাকিত, যাহা শুনিলে পিতা রাগ করিতে পারেন। এই ভয়ে মনোরমা তাহার ভাবার্থ বলিতেও অস্বীকার করিত; ইহাতে আমার স্বামী আরও রাগান্বিত হইয়া যজ্ঞেশ্বর বাবুর শরণাপন্ন হয়েন।”
“একদিন তিনি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে নিজ কক্ষে ডাকাইয়া নিভৃতে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি আমার কন্যার অতি বিশ্বাসের পাত্র, সে তোমায় সম্মান করে, এবং বোধ হয়, সকল কথা বলে। তুমি আমায় বলিতে পার, মনোরমা ও নবীন কি লেখালেখি করে, আর কেন তাহারা আমার কাছে সে সকল কথা প্রকাশ করো না?”
“যজ্ঞেশ্বর বাবু তাহাতে উত্তর করেন, ‘আমি এ বিষয় অনেক কথা জানি বটে, কিন্তু মনোরমার কাছে আমি বিশ্বাসঘাতক হইতে পারি না। সে সকল কথা আমি আপনাকে বলিব না।”
“আমার স্বামী যজ্ঞেশ্বর বাবুর এই কথায় অত্যন্ত অপমান বোধ করিলেও তখনকার মত ক্রোধ-সম্বরণ করিয়া জিজ্ঞাসা করেন, ‘নবীন আজ প্রায় মাসাবধিকাল বাড়ী হইতে নিরুদ্দেশ হইয়াছে, তুমি তাহাকে ইহার মধ্যে কোথাও দেখিয়াছ কি?”
“যজ্ঞেশ্বর বাবু উত্তর করেন, হাঁ দেখিয়াছি, একথা আমি স্বীকার করি; কিন্তু আর কোন কথা আমায় জিজ্ঞাসা করিবেন না। আর কোন কথার উত্তর আমি দিতে পারিব না।”
“যজ্ঞেশ্বর বাবুও বড় বিপদে পড়িয়াছিলেন। মনোরমা তাঁহাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করাইয়া তবে গুপ্তকথা প্রকাশ করিয়াছিল। কাজে কাজেই যজ্ঞেশ্বর বাবু কোন প্রকারে যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিতে পারেন নাই।”
“যজ্ঞেশ্বর বাবুর এই ব্যবহারে আমার স্বামী এত রাগান্বিত হইয়াছিলেন যে, তিনি ক্রোধ সম্বরণ করিতে না পারিয়া তাঁহাকে বলেন, ‘তুমি আজ হইতে আর আমার বাড়ীতে আসিও না। মনোরমার সহিত তোমার বিবাহে আমি যে সম্মতি প্রদান করিয়াছিলাম, তাহা আমার অসম্মতিতে পরিণত হইল জানিবে। আমার এই অনুজ্ঞার পর এখনও যদি তুমি আমার কন্যার সহিত কোন সম্বন্ধ রাখ, তাহা হইলে আমি তোমাকে অত্যন্ত ইতর বলিয়া বিবেচনা করিব। যদি তুমি আমার কথা অগ্রাহ্য করিয়া মনোরমার সহিত সম্প্রীতি রাখ, তাহা হইলে আমি মনোরমাকেও বাড়ী হইতে তাড়াইয়া দিব, আর আমার সে কঠোরতার জন্য কেবল তুমিই দায়ী হইবে। মনোরমাকে যদি পথের ভিখারিণী করিতে না চাও, তবে বিবেচনা করিয়া কার্য করিও। আমাকে তুমি অত্যন্ত কঠোর ও নিষ্ঠুর বলিয়া বিবেচনা করিতে পার, কিন্তু আমার কার্য্যকলাপ কিছুমাত্র অন্যায় নয়। যে সকল গুপ্তকথা তোমরা আমার নিকটে লুকাইয়া রাখিতেছ, আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই তাহার মধ্যে কোন জঘন্য ও ঘৃণিত বিষয় আছে। তাহা না হইলে তোমরা সে সকল কথা চাপিয়া রাখিবার জন্য চেষ্টা করিবে কেন? ভাল হইলে সে সকল কথা তোমরা স্বেচ্ছায় আমার নিকটে প্রকাশ করিতে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আমার শেষ কথা এই, তোমার যেন স্মরণ থাকে যে, তোমার নিজ বিবেচনার উপরে মনোরমার সুখ ও দুঃখ সমস্তই নির্ভর করিতেছে। শুধু মনোরমার নহে, মনোরমার মাতা এবং আমার নিজের মানসিক কষ্টও ইহার উপরে নির্ভর করিবে।”
“ইহা ভিন্ন যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত তাঁহার আরও অনেক কথা হইয়াছিল। আমার স্বামী ক্রোধের বশে অনেক রূঢ় কথাও তাঁহাকে বলিয়াছিলেন। যজ্ঞেশ্বর বাবু মনোরমার খাতিরে তাহার পিতাকে সৰ্ব্ববিষয়ে মার্জ্জনা করিয়াছিলেন, প্রত্যুত্তরে ভ্রমেও একটি রূঢ় বাক্য প্রয়োগ করেন নাই। যজ্ঞেশ্বর বাবু যেরূপ নীরবে আমার স্বামীর কটুকাটব্য সহ্য করিয়াছিলেন, তাহা মনে হইলে আজ পর্য্যন্ত আমার মনে অত্যন্ত দুঃখ হয়।
যখন যজ্ঞেশ্বর বাবু চলিয়া যান, তখন তিনি বাহিরে আসিয়া আমায় বলিয়াছিলেন, ‘মা! এ সব বাক্যবাণ আমায় সহ্য করিতে হইবে। যদি ইহার জন্য আমার জীবনের সমস্ত সুখ নষ্ট হয়, তাহা হইলেও আমি আপনার স্নেহের মনোরমাকে এক দণ্ডের জন্যও ভুলিব না, জানিবেন। মনোরমাকে এবং আপনাকে আমি প্রায়ই পত্রাদি লিখিব; কিন্তু সে সকল পত্র আর আপনাদের এ বাড়ীর ঠিকানায় আসিবে না। রাধারমণ বাবুর কন্যার সহিত মনোরমার বড় সদ্ভাব। মনোরমা চেষ্টা করিলে অবশ্য এ বিষয়ে এমন বন্দোবস্ত করিতে পারে যে, আমার চিঠিপত্র আপনাদের নামে অথচ তাহার ঠিকানায় পৌঁছিবে। সে আবার লোক মারফৎ তাহা গুপ্তভাবে আপনাদের কাছে পাঠাইয়া দিবে, আবার এ ক্ষুদ্র জীবন আমি মনোরমার পবিত্র স্মৃতির সহিত মিশ্রিত করিয়া রাখিলাম। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে তাহার দেবীমূর্ত্তি আমার হৃদয়মধ্যে অঙ্কিত থাকিবে। কি করিবে, আমার অদৃষ্ট নিতান্ত মন্দ। জগতে আসিয়াছি—অনেক সহ্য করিতে হইবে। মনোরমার জন্য আমি সকল অত্যাচার অক্ষুণ্ণ হৃদয়ে সহ্য করিতে পারিব। যে আপনার হিতাহিত বুঝিয়া এ মরজগতে আপনার কর্ত্তব্য পালন করে, সেই মানুষ। আপাততঃ আন্তরিক দুঃখের সহিত আমি আপনাদের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিতেছি।”
“সেইদিন হইতেই আর আমি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে দেখি নাই। তার পর একদিন সহসা শুনিলাম, তিনি এক নীচ-কুলোদ্ভবা রমণীকে বিবাহ করিয়াছেন। ভাবিলাম, যদি এই কথা মনোরমার কর্ণগোচর হয়, তাহা হইলে সে একেবারে মর্মাহত হইবে। আশ্চর্য্যের কথা এই যে, একদিন আমি মনোরমার জন্য কতকগুলি খাবার লইয়া তাহার ঘরে যাই, গিয়া দেখি, মনোরমা বিছানায় পড়িয়া দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া নীরবে অশ্রুবর্ষণ করিতেছে। আমি তাহাকে হাত ধরিয়া তুলিলাম। কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার পূর্ব্বেই সে নিজেই আমাকে বলিল, “মা! যজ্ঞেশ্বর বাবু আর একজন সৌভাগ্যশালিনী রমণীকে বিবাহ করিয়াছেন। এখন হইতে তাঁহার উপরে আমার আর কোন অধিকার নাই। এ জন্মে তাঁহার সহিত আমার মিলন হওয়া আর সম্ভবপর নয়। তথাপি আমি তাঁহাকে কোন দোষ দিতে পারি না। এ পৃথিবীতে তাঁহার ন্যায় প্রকৃতির লোক আর কেহ আছেন কি না সন্দেহ। যদিও তিনি এখন অপরের স্বামী, তথাপি আমি যতদিন জীবিত থাকিব, ততদিন তাঁহাকে অন্তরের সহিত ভালবাসিব। এক দুঃখ এই, এ জন্মে তাঁহার সেবা করিতে পারিলাম না।”
“অভাগিনী মনোরমা এই পৰ্য্যন্ত বলিয়া আকুলহৃদয়ে কাঁদিতে লাগিল। আমি তাহাকে অনেক বুঝাইলাম, অনেক সান্ত্বনার পর বলিলাম, ‘মা মনোরমা! তুমি বালিকা নও, তোমায় আর অধিক বুঝাইব কি—কাল হয়তো তোমার অধিকতর সুখ হইতে পারে। হয়তো তোমাদের উভয়ের মিলন ভগবানের অভিপ্রেত নয়—হয়তো তোমার কপালে আরও সুন্দর, আরও ধনবান ও গুণবান পতিলাভ বিধাতার নির্ব্বন্ধ— হয়তো ভবিষ্যতে তুমি আরও সুখিনী হইবে–”
“আমার কথায় বাধা দিয়া মনোরমা বলিল, মা! সে কি কখনও সম্ভব? আমার ভবিষ্যৎ দারুণ অন্ধকারাচ্ছন্ন। যজ্ঞেশ্বর বাবু ছাড়া আমি কি কখনও আর কাহারও পদে মনপ্রাণ সমর্পণ করিতে পারি? এ জীবনে আমি কি আর কাহাকেও পতিরূপে গ্রহণ করিতে পারি? মা! আমি তো আর কাহাকে বিবাহ করিব না।”
“আমি মনোরমাকে আর কিছু বলিলাম না। সে তখনকার মত আমার নিকট হইতে চলিয়া গেল। অল্প দিনের মধ্যেই আমি জানিতে পারিলাম যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু অন্য রমণীকে বিবাহ করিলেও মনোরমাকে পরিত্যাগ করেন নাই। তিনি বিবাহিত অবস্থায়ও অবিবাহিতা কুমারী মনোরমাকে প্রেমপত্র লিখিতে লাগিলেন। ইহাতে আমি অত্যন্ত রুষ্ট হইলাম।”
“মনোরমার সমবয়স্ক এক খুড়তুতো ভগ্নী আছে সে রাধারমণ বাবুর কন্যা। তাহারই ঠিকানায় যজ্ঞেশ্বর বাবু মনোরমাকে পত্র লিখিতেন। সে আবার সেই পত্র হয় নিজে আসিয়া মনোরমার হাতে দিত, নয় অতি গুপ্তভাবে লোক মারফৎ মনোরমাকে পাঠাইয়া দিত। সুতরাং ডাকে মনোরমার নামে কোন চিঠিপত্র আসিত না বলিয়া আমার স্বামী এ সকল কথা কিছুই জানিতে পারেন নাই।”
“একদিন আমি মনোরমাকে এ সম্বন্ধে আভাসে জিজ্ঞাসা করাতে সে আমাকে বলিয়াছিল, ‘আমরা উভয়ে এখনও চিঠি লেখালেখি করিয়া থাকি। যজ্ঞেশ্বর বাবুর নিকট হইতে আমার অনেক চিঠি-পত্ৰ আসিতে পারে; আমিও তাঁহাকে পত্রাদি লিখিতে পারি। তোমার হাতে যদি কোন চিঠি পড়ে, তাহলে তুমি তাহা বাবার কানে তুলিও না। যজ্ঞেশ্বর বাবু এখন অপরের স্বামী। তাঁহাকে আমার প্রত্রাদি লেখা অন্যায় মনে করিতে পার; কিন্তু বাস্তবিক এই লেখালেখিতে দোষের কিছুই নাই। হয়তো একদিন জানিতে পারিবে, আমি যাহা কিছু করিতেছি, সকলই ভালর জন্য।” প্রথমতঃ যদিও আমি বড় রাগান্বিত হইয়াছিলাম, কিন্তু মনোরমার কথায় আমি সমস্ত ভুলিয়া গেলাম। মনোরমাকে আমি বড় বিশ্বাস করিতাম। আমার দৃঢ় ধারণা ছিল যে, সে কখনই আমার কাছে মিথ্যাকথা কহিবে না। আমি তাহার অনুরোধে তাহার পিতাকে সেইজন্য এ সম্বন্ধে আর কিছু বলিলাম না। নির্বিঘ্নে মনোরমা ও যজ্ঞেশ্বর বাবুর পত্রাদি আসিতে-যাইতে লাগিল।
“এইরূপে দুই বৎসর অতীত হইল। এই দুই বৎসরের মধ্যে নবীনের অত্যাচার আরও বাড়িয়া উঠিয়াছিল। টাকার দরকার ভিন্ন সে প্রায়ই বাড়ীতে আসিত না। অনেকবার দেখিয়া যখন তাহার পিতা আর তাহার কোন ছলনায় ভুলিলেন না— কিছুতেই আর তাহার হাতে টাকাকড়ি দিতে চাহিলেন না, তখন নবীনের আসা-যাওয়া একেবারেই বন্ধ হইল; সে যেন একেবারেই আমাদের ভুলিয়া গেল। ক্রমে ক্রমে তাহার পাওনাদারগণ দেখা দিতে লাগিল। দুই শত, পাঁচ শত হইতে দশ হাজার টাকা পর্য্যন্ত হ্যাণ্ডনোটের দেনা বাহির হইয়া পড়িল। বিপদ দেখিয়া আমার স্বামী নবীনকে ত্যাজ্যপুত্র করিলেন।”
“আমাদের এ পরিবারের মধ্যে অনেক কথাই আমার স্বামীর নিকট হইতে লুকাইয়া রাখিতে হয়। তিনি যে রকম একগুঁয়ে ও এক রোখা লোক, তাহাতে তাঁহার নিকট সকল কথা প্রকাশ করাও বিপজ্জনক। নবীনকে তিনি ত্যাজ্যপুত্র করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু আমি তাহার মায়া-মমতা কাটাইতে পারি নাই। তিনি পুরুষ মানুষ, তাঁহার কঠোর প্রাণ, তিনি অনায়াসেই পুত্রের প্রতি মমতাহীন হইতে পারিয়াছিলেন, কিন্তু আমি তাহা পারি নাই। আমার স্বামীর অজ্ঞাতে আমি নবীনের সহিত দুই-চারিবার দেখা-সাক্ষাৎ করিয়াছিলাম।”
“মনোরমাকে তাহার পিতা অনেক বহুমূল্য জড়োয়ার গহনা কিনিয়া দিয়াছিলেন। একদিন এই বাড়ীতে একটা ভোজ উপলক্ষে আমার স্বামী মনোরমাকে সেই সকল হীরা-জহরতের গহনা পরিতে বলেন। বিশেষতঃ তাহার কিছুদিন পূর্ব্বে তিনি যে এক জোড়া হীরের বালা মনোরমাকে কিনিয়া দেন, সেদিন সেই বালা জোড়াটি পরিতে বার বার বলিয়া দিয়াছিলেন। মনোরমা কিন্তু ভোজের সময়ে সে বালা পরে নাই। নিমন্ত্ৰিত ব্যক্তিদিগের সম্মুখে যদিও তিনি মনোরমাকে কিছু বলেন নাই, কিন্তু মনোরমা তাঁহার কথা অমান্য করিয়াছিল বলিয়া পরে যথেষ্ট তিরস্কার করিয়াছিলেন। এমন কি মনোরমাকে অবিশ্বাস করিয়া তিনি সেই বালা দেখিতে চাহিয়াছিলেন এবং মনোরমা কেন তাঁহার কথা অমান্য করিয়াছিল, তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন। তাহাতে মনোরমা বলিল, ‘বাবা! আপনি রাগ করিবেন না। আমার সোনা, হীরা, জড়োয়ার এত গহনা আছে যে, সমস্তগুলি পরিয়া নড়িয়া বেড়ান দুষ্কর। সকল দিন সকল গহনা না-ই পারিলাম।”
“আমার স্বামী বলিলেন, ‘কিন্তু হীরের বালা জোড়াটি পরিতে আমি তোমায় বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছিলাম। সেটি কি ভাঙ্গিয়া গিয়াছে? যদি ভাঙ্গিয়া থাকে, তাহা হইলে আমায় বল নাই কেন? আমায় সে বালা জোড়াটি আনিয়া দেখাও।”
“আমি দেখিলাম, মনোরমা বড় বিপদে পড়িয়াছে। সে ক্রমাগত এ দায় হইতে এড়াইতে এবং তাহার পিতাকে অন্য কথায় ভুলাইবার চেষ্টা পাইতেছে; কিন্তু আমার স্বামী কিছুতেই ভুলিবার লোক নহেন, তিনি চিরকাল ভয়ানক একগুঁয়ে লোক, যাহা একবার ধরিবেন, তাহা সহজে ছাড়িবেন না। বালা জোড়াটি দেখিবার জন্য তিনি বড় পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিলেন। অনেক কথা কাটাকাটির পর বাধ্য হইয়া মনোরমা স্বীকার করিল যে, সে বালা জোড়াটি কোন কারণে হস্তান্তরিত হইয়াছে। অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া আমার স্বামী মনোরমাকে নানাপ্রকার প্রশ্ন করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোন কথাই বাহির করিতে পারিলেন না—মনোরমা সে বালা জোড়াটি কোথায় যে রাখিয়াছে বা কাহাকে দিয়াছে, তাহার কোন সূত্রই পাইলেন না। তাঁহার তখন বড় সন্দেহ হইল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার ক্যাস-বাক্সে কত টাকা আছে, আমি দেখিতে চাই। ক্যাস-বাক্সটি আমার কাছে লইয়া এস।’মনোরমা ক্যাস-বাক্স আনিলে পর তিনি দেখিলেন, তাহাতে তিনটি মাত্র টাকা পড়িয়া আছে।”
“তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এই তিনটি টাকা বৈ তোমার কাছে আর কিছুই নাই?”
মনোরমা বলিল, ‘না’।
“তিনি বলিলেন, “সে কি? কাল যে তুমি আমার কাছে দুই শত টাকা চাইলে, আমি তোমাকে দিলাম। সে সব টাকা এত শীঘ্র কোথায় গেল?”
“মনোরমা এ কথারও কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারিল না। আমার স্বামী তাহাতে অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন। তিনি বলিলেন, ‘আমি যেদিন শুনিলাম, যজ্ঞেশ্বর একটা ছোট ঘরের মেয়েকে বিবাহ করিয়াছে, তখন মনে হইয়াছিল যে, আমার পরিত্রাণ হইল—আমি বাঁচিলাম। কিন্তু এখন দেখিতেছি, তাহা হয় নাই। তুমি এখনও তাহার সহিত সম্পর্ক রাখিয়াছ। আমি দেখিতেছি, তোমরা আমায় অগ্রাহ্য কর—আমার মান অপমান, আমার ভাল মন্দ, সমস্তই অতি তুচ্ছ বলিয়া মনে কর। তোমরা সকলে মিলিয়া আমার বিপক্ষে যে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলে, এখনও সব ঠিক সেই রকম বজায় আছে। ধিক্! আমার ছেলে মেয়ে, একটাও আমার মনের মত হইল না। একটাও আমার মর্য্যাদা বুঝিলে না। আমি যে এত যত্ন করে, এত আদরে তোমাদের প্রতিপালন করিলাম, এখন বড় হইয়া তোমরা সে সব ভুলিয়া গেলে? যাও, মনোরমা, তুমি আমার চোখের সামনে থেকে সরিয়া যাও। তোমায় দেখিয়া আমার রাগ ক্রমাগতই বাড়িয়া উঠিতেছে। এই মাস শেষ হইবার পূর্ব্বে আমি সেই হীরের বালা জোড়াটি অবশ্যই দেখিতে চাই। দেখাইতে পার ভালই, নয় আমায় বলিতে হইবে, তুমি সে বালা কি করিয়াছ, কি কাহাকে দিয়াছ, যদি হারাইয়া থাক—খুঁজে দেখ।”
“সেই মাস শেষ হইবার পূর্ব্বেই মনোরমা তাহার পিতাকে হীরের বালা জোড়াটি দেখাইয়াছিল বটে, কিন্তু আমি জানিতাম যে, তৎপরিবর্তে মনোরমার অন্যান্য বহু মূল্যবান গহনা হস্তান্তরিত হইয়াছিল।”
ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবু যখন বুঝিতে পারিলেন যে, মনোরমার মাতা মনোরমা সম্বন্ধে যাহা বলিবার তাহা সমস্তই বলিয়াছেন, তখন তিনি হরিদাস গোয়েন্দা পূৰ্ব্বদিনে তাঁহাকে যে প্রকার শিখাইয়া দিয়াছিলেন, সেই ভাবে মনোরমার মাতাকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন।
অম্বিকাচরণ জিজ্ঞাসিলেন, “আপনার কন্যা মনোরমা ছাব্বিশ আষাঢ় তারিখ হইতে পীড়িতা হইয়াছেন, কেমন? সাহসা এরূপ পীড়াগ্রস্ত হইবার কারণ কি বলিতে পারেন?’
মনোরমার মাতা উত্তর করিলেন, “না, তাহা কিছু বলিতে পারি না। ছাব্বিশে আষাঢ় সকালে আমি তাহার ঘরে গিয়াছিলাম, তাহার ভয়ানক জ্বর হইয়াছে, সেই জ্বরে সে বেঁহুশ হইয়া পড়িয়া আছে।”
“অবশ্য তৎক্ষণাৎ আপনি ডাক্তার আনাইয়াছিলেন। ডাক্তার আসিয়া কি বলিয়াছিলেন?”
“ডাক্তার সাহেব আসিয়া বলিয়াছিলেন যে, ভিজে বস্ত্র অনেকক্ষণ পরিয়া থাকা বা অন্য কোন কারণে বিশেষ ঠাণ্ডা লাগিয়া এই জ্বর উপস্থিত করিয়াছে।”
“তাহা হইলে আমায় ধরিয়া লইতে হইতেছে যে, পঁচিশে আষাঢ় তারিখে মনোরমা ভিজে কাপড়ে ছিল বা অন্য কোন কারণে তাহার বিশেষ ঠাণ্ডা লাগিয়াছিল?”
“কই, সেদিন তো ভিজা কাপড় পরিয়াছিল বলিয়া আমার মনে হয় না।”
“আমার বেশ স্মরণ হইতেছে যে, পঁচিশে আষাঢ় তারিখে দিন রাত—কোন সময়ে গুঁড়ি গুঁড়ি কোন সময়ে বা মুষলধারে বৃষ্টি হইয়াছিল। যদি মনোরমাকে আপনি বাড়ীতে ভিজা কাপড়ে থাকিতে না দেখিয়া থাকেন, তাহা হইলে আপনি বলিতে পারেন কি, সেদিন কোন সময়ে মনোরমা বাড়ীর বাহির হইয়াছিল কি না?”
“হাঁ, আমার স্মরণ হইতেছে, মনোরমা পঁচিশে আষাঢ় তারিখে রাত্রি সাড়ে নয়টা কিম্বা দশটার পর বাড়ীর বাহির হইয়াছিল। রাত্রি একটার পূর্ব্বে সে ফিরিয়া আসে নাই। আমার স্বামী এ কথা জানিতে পারেন নাই বা আমি তাঁহাকে জানিতে দিই নাই। পাছে তিনি কন্যার উপরে কোন প্রকার ঘৃণিত সন্দেহ করেন, এই ভয়ে আমি সে কথা তাঁহার নিকটে প্রকাশ করি নাই। যখন মনোরমা ফিরিয়া আসে, তখন তাহার মলিন মুখ দেখিয়া আমি মনোরমাকে সেজন্য কোন তিরস্কার করি নাই বা কোন কথা বলি নাই। মনোরমা নিজ কক্ষে গিয়া শয়ন করে এবং পরদিন প্রাতে তাহার ঐরূপ কঠিন পীড়া দেখিতে পাই।”
“এই জ্বরের অবস্থায় মনোরমা একদিনও ইহার মধ্যে কোন সংবাদপত্র পাঠ করে নাই?”
“না। সে বরাবর অজ্ঞান অবস্থায় রহিয়াছে। সংবাদ-পত্র পড়িবে কি করিয়া?”
“তাহা হইলে যজ্ঞেশ্বর বাবুর এই মোকদ্দমা ও বিপদের কথা মনোরমা কিছু জানিতে পারে নাই?”
“না। এ সকল কথা তাহার জানা সম্ভব নয়।”
“জ্বরের অবস্থায় মনোরমার নামে কোন চিঠি-পত্র আসিয়াছিল কি?”
“হাঁ, দুইখানি পত্র আসিয়াছিল। একখানি যজ্ঞেশ্বর বাবুর ও আর একখানি নবীনের হস্তলিখিত।”
“সে পত্র দুইখানি আপনার কাছে আছে?”
“আছে।”
“আপনি সেগুলি খুলিয়াছিলেন?”
“না। আমি তাহার কোন চিঠি কখনও খুলিয়া পড়ি না।”
অম্বিকাচরণ বলিলেন, “কিন্তু এখন আপনার কন্যা জীবন সঙ্কটাবস্থায় পতিতা। এ সময়ে কোন জিনিষ এরূপভাবে ফেলিয়া রাখিলে চলিবে না। আমি সে পত্র দুইখানি দেখিতে চাই। আপনি পত্র খুলিয়া পাঠ করিতে যদি অন্যায় বিবেচনা করেন, আমি সে ভার নিজ মস্তকে বহন করিতে প্রস্তুত আছি। এ ছাড়া আপনাকে আর একটি কাজ করিতে হইবে। আপনার কন্যার গৃহে লিখিবার জন্য যে টেবিল আছে, আমি তাহার চাবি চাই। কেন আমি এ সকল গুপ্ত বিষয় জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিতেছি, তাহার কারণ আপনাকে এখন বলিতে পারি না। আপনার কন্যার মানসিক ব্যাধির কারণ না জানিতে পারিলে আমি কোন চিকিৎসাই করিতে পারিব না।”
মনোরমার মাতা দায়ে পড়িয়া ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবুকে মনোরমার কক্ষে লইয়া গেলেন। তথায় টেবিলের একটি টানার মধ্যে আরও দুইখানি পত্র পাওয়া গেল। সেগুলি নবীনের নিকট হইতে আসিয়াছে, হস্তাক্ষরে তাঁহার প্রমাণ পাওয়া গেল। পোষ্ট আফিসের ছাপে তাহার তারিখ ধরা পড়িল।
অম্বিকাচরণ বাবু চিঠি দুইখানি খুলিয়া কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। মনোরমার মাতাও তাঁহাকে পত্রপাঠ-সম্বন্ধে কোন সাহায্য করিতে পারিলেন না। তখন তিনি সে বিষয়ে নিরাশ হইয়া টেবিলের টানায় আর কিছু আছে কি না, অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তিনি তাহার মধ্যে আবশ্যক বস্তু আর কিছু পাইলেন না। কেবল তিনখানি হরতনের নওলা তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল। মনোরমার মাতাও তদ্দর্শনে বিস্মিত হইলেন বটে, কিন্তু সে বিষয়ে কোন কথা বলিতে পারিলেন না। অম্বিকাচরণ বাবু বলিলেন, “এই তাস কয়খানি আর এই পত্র কয়খানি আমি লইয়া যাইব।”
তাহাতে মনোরমার মাতা কোন আপত্তি উত্থাপন করিলেন না। তাহার পর অম্বিকা বাবু মনোরমার পীড়ার অবস্থা বিশেষ করিয়া দেখিয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিয়া চলিয়া আসিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ব্যারিষ্টার নিকলাস সাহেবের নিকট আসিয়া ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবু পূর্বোল্লিখিত ঘটনা সকল বর্ণন করিয়া বলিলেন, ‘আমি সেই চিঠিগুলি ও হরতনের নওলা তিনখানি লইয়া এখন তোমার কাছে আসিয়াছি। এখন যাহা করিবার হয়, তাহা তুমি কর বা হরিদাস গোয়েন্দার উপরে সম্পূর্ণ ভার দাও। তুমি বলিয়াছিলে, এই হরতনের নওলাই এই গুপ্ত রহস্যের মূল সূত্র এবং যদি হয়, ইহাতেই যজ্ঞেশ্বর বাবুর নির্দোষিতা সপ্রমাণ হইবে। যাহাই হউক, এ বড় আশ্চর্য্যের কথা যে, মনোরমায় টেবিলের ভিতরেও হরতনের নওলা আর যজ্ঞেশ্বর বাবুর আলষ্টার কোটের পকেটেও হরতনের নওলা! না জানি এ হরতনের নওলাতেই কি আছে?”
হরিদাস গোয়েন্দা সেইখানেই বসিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, “বড় সোজা কথা নয়! পঁচিশে আষাঢ় তারিখে রাত্রিকালে মনোরমা বাড়ীর বাহির হইয়াছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। সেইদিন রাত্রি দশটার পর গোলদিঘীর সম্মুখে যে রমণীর সহিত যজ্ঞেশ্বর ‘বাবু গাড়ীতে উঠিয়া ঠনঠনের হোটেলে গিয়াছিলেন, তিনি এই মনোরমা ভিন্ন আর কেহই নয়, একথা আমি জোর করিয়া বলিতে পারি। এখন আর বেশী কথা বলা উচিত নয়; কিন্তু এ রহস্যের মর্ম্মোদঘাটন করিতে যে, আমায় বিশেষ কোন ক্লেশ পাইতে হইবে না, এ কথা আমি আপনাদের সম্মুখে সাহসপূর্ব্বক বলিতে পারি।”
নিকলাস সাহেব বলিলেন, “আমারও বেশ বিশ্বাস হইতেছে যে, এখন আপনার কাজ সোজা হইয়া আসিল।”
ডাক্তার অম্বিকাচরণ বাবু হরিদাস গোয়েন্দার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “কাল আমি মনোরমাকে দেখিতে যাইবার পূর্ব্বে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব। হয়তো আপনি সে সময়ে আমাকে আপনার এতদিনের গোয়েন্দাগিরির অভিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পরিবেন।
হরিদাস। সে কথা এখন সাহস করিয়া বলিতে পারি না।
অম্বিকা। অন্ততঃ এরূপ আশা করিতে পারেন তো?
হরিদাস। পারি।
অম্বিকা। তাহা হইলেই যথেষ্ট। এখন আমি চলিলাম। বিশেষ কোন আবশ্যক আছে।
নিকলাস। ডাক্তারের বিশেষ আবশ্যক সকল সময়েই।
অম্বিকা। বিশেষতঃ যদি সঙ্কটাপন্ন, মুমূর্ষু কোন রোগী হাতে থাকে।
এই বলিয়া তিনি বিদায় গ্রহণ করিলেন। নিকলাস সাহেব হরিদাস গোয়েন্দাকে বলিলেন, “এখন আমি এ বিষয়ের সমস্ত ভার আপনার উপরে অর্পণ করিলাম। আশা করি, আপনি অতি সত্বরেই এ রহস্যের মম্মোদঘাটন করিতে পারিবেন।