প্ৰথম খণ্ড – প্রথম পরিচ্ছেদ – সেসন আদালত (দায়রা)
বহুবাজারের যজ্ঞেশ্বর মিত্র কলিকাতার একজন নামজাদা লোক। তিনি ধনী ও বিদ্বান্ সাহিত্যক্ষেত্রেও তাঁহার বেশ সুখ্যাতি আছে; কয়েকখানি পুস্তক প্রণয়ন করিয়া যথেষ্ট যশোলাভ করিয়াছেন। আজ তাঁহার মোকদ্দমা।
গত ২৬শে আষাঢ় তারিখে তিনি নিজের স্ত্রীকে হত্যা করিয়াছেন বলিয়া অভিযুক্ত হন। সেই পৰ্য্যন্ত তিনি কারাগারে আছেন। অনেকেই তাঁহার জন্য দুঃখ প্রকাশ করিতেছেন এবং তাঁহার দ্বারা ভীষণ হত্যাকাণ্ড ঘটিতে পারে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ করিতেছেন। করোণার্স কোর্ট এবং পুলিস কোর্টের বিচারে প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে যে, বিষপ্রয়োগে তাঁহার স্ত্রীকে হত্যা করা হইয়াছে। ঘটনাচক্রে যজ্ঞেশ্বরের বিরুদ্ধে এমন সব প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে যে, তিনিই যে প্রকৃত হত্যাকারী, সে বিষয়ে আর কাহারও কোন সন্দেহ নাই।
যজ্ঞেশ্বর পুলিসের মোকদ্দমায় “আমি নিৰ্দ্দোষ”, এ ছাড়া আর একটি কথাও বলেন নাই। উকীল কৌন্সিলীর জেরায় অন্য কোন উত্তর প্রদান করেন নাই। সেসন আদালতে দুইদিন মোকদ্দমা হইয়া গিয়াছে, আজ তৃতীয় দিবস। অদ্যকার মোকদ্দমায় সম্ভবতঃ বিচারপতি রায় দিবেন।
বিচারগৃহ লোকে-লোকারণ্য! সকলেরই ইচ্ছা, যজ্ঞেশ্বর বাবু নির্দোষ বলিয়া খালাস পান।
যজ্ঞেশ্বরের পিতা খৃষ্টীয়ান ধর্ম্ম অবলম্বন করিয়াছিলেন। সুতরাং যজ্ঞেশ্বর বাবুও খৃষ্টান। তাঁহার আচার-ব্যবহার সমস্তই সাহেবের ন্যায়। ইংরাজী ও বাঙ্গালা ভাষায় তিনি একজন অদ্বিতীয় পণ্ডিত বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।
যজ্ঞেশ্বর একজন নেটীব খৃষ্টীয়ানের দুহিতাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। তাঁহার সংক্ষিপ্ত ডাক নাম হেমাঙ্গিনী এবং পুরা নাম এলিস্ হেমাঙ্গিনী কেথারিন্। আমরা সুধু হেমাঙ্গিনীই বলিব।
সহরের সকল সংবাদপত্রেই এই হত্যাকাহিনী প্রকাশিত হইয়াছিল। ইংরাজ মহলে ও বাঙ্গালী মহলে সকল স্থানেই এই ঘটনা লইয়া একটা তুমুল আন্দোলন চলিতেছিল। বিদ্যালয়ের ছাত্র হইতে অশীতিপর বৃদ্ধ ব্যক্তিও যজ্ঞেশ্বর মিত্রের নাম শুনিয়াছেন। বিশেষ প্রমাণ-প্রয়োগসত্ত্বেও অনেকের ধারণা যে, তিনি নির্ব্বিঘ্নে কারামুক্ত হইবেন।
ব্যারিষ্টার নিকলাস্ সাহেব দণ্ডায়মান হইয়া বিচারপতিকে যথারীতি সম্বোধনপূর্ব্বক বলিলেন, “বোধ হয়, আপনার স্মরণ থাকিতে পারে, এই বন্দী মোকদ্দমার প্রথম দিন কৌন্সিলী নিযুক্ত করেন নাই। দ্বিতীয় দিনে বন্ধুবান্ধবগণের একান্ত অনুরোধে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে এই মোকদ্দমা চালাইবার ভারার্পণ করেন। আমার ধারণা ছিল, এ বিষয়ে তাঁহার মতের কোন পরিবর্ত্তন ঘটিবে না; কিন্তু আজ সহসা তাঁহার মতের পরিবর্তন দেখিয়া আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইতেছি। এখন ইনি কোনক্রমেই আমার দ্বারা মোকদ্দমা চালাইতে প্রস্তুত নহেন। আমার কার্যদক্ষতার উপরে বন্দীর যে কোন প্রকার সন্দেহ জন্মিয়াছে, তাহা নহে। ইনি প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, নিজেই নিজের মোকদ্দমা চালাইবেন; কাহাকেও ইঁহার সাপক্ষে কথা কহিতে দিবেন না। আমার বড় ইচ্ছা ছিল, ইঁহাকে আমি নির্দোষ প্রমাণিত করিবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিব; কিন্তু যখন দেখিতেছি, ইনি কিছুতেই তাহাতে সম্মত নহেন, তখন কাজেকাজেই আমাকে আদালতের শরণ লইতে হইতেছে—”
নিকলাস্ সাহেবের সমস্ত কথা সমাপ্ত হইতে-না-হইতেই বন্দী যজ্ঞেশ্বর বাবু নিজে বিচারপতিকে সম্বোধন করিলেন।
বিচারপতি তাঁহার কথায় বাধা দিয়া বলিলেন, “স্থির হও, তোমার সমস্ত কথা তোমার ব্যারিষ্টার নিকলাস্ সাহেবের মুখ হইতে আমি শুনিব। তোমার কথা কহিবার কোন আবশ্যকতা নাই।”
বন্দী। বিচারপতি! আজ আমার ব্যারিষ্টার কেহ নাই। আমি আমার নিজের কথা নিজে বলিব। আমার হইয়া কথা কহিবার জন্য লোকের কোন অধিকার নাই। আমি কাহাকেও সে ক্ষমতা প্রদান করিতে প্রস্তুত নহি।
বিচারপতি। বন্দী! আমায় বাধ্য হইয়া বলিতে হইতেছে, তুমি যাহা স্থির করিয়াছ, তাহা অন্যায় ও বিপজ্জনক
বন্দী। আমার নিজের ভাল-মন্দ বিচারের ক্ষমতা আমার আছে। কিসে আমার ভাল, কিসে আমার মন্দ হইবে, তাহা আমি অন্য লোক অপেক্ষা ভাল বুঝি। আমার ভাল-মন্দ আমারই উপরে নির্ভর করে। বিচারপতি। সকল সময়ে তাহা ঘটে না। তুমি একজন সদ্বিদ্বান্ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। বোধ হয়, তুমি একবাক্যে স্বীকার করিবে, যে বিষয় লইয়া যে চর্চ্চা করে, সে সেই বিষয়ে অন্য লোক অপেক্ষা অধিক দক্ষতা ও বিজ্ঞতা লাভ করে। আদালতের উকীল কৌন্সিলীরা আইন-কানুন লইয়াই জীবনাতিপাত করিয়া থাকেন। মোকদ্দমার বিষয়ে তাঁহারা নিশ্চয়ই তোমাপেক্ষা অধিক জ্ঞানী। যে সকল প্রমাণ প্রয়োগ করিতে পারিলে তুমি নিৰ্দ্দোষ প্রমাণীকৃত হইয়া কারাগার হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারিবে, যে উপায় হয় ত তুমি কখন কল্পনায় আনিতে পারিবে না, তোমার ব্যারিষ্টার হয় ত অনায়াসে সেই সকল সূত্র বাহির করিয়া তোমার রক্ষা করিতে পারিবেন। হয় ত তুমি আইনের তর্কে, সাক্ষীর জবানবন্দীর কোন প্রকার গলদে, সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম বিচারে এবং নিকলাস্ সাহেবের বুদ্ধিমত্ত ও বিচক্ষণতায় পরিত্রাণ পাইতে পার। আমার কথা বুঝিয়াছ?
বন্দী। ধর্ম্মাবতার! আমি আপনার সমস্ত কথাই বুঝিতে পারিতেছি এবং আপনার এই প্রকার অনুগ্রহ প্রকাশের জন্য আপনাকে শত শত ধন্যবাদ প্রদান করিতেছি; কিন্তু যদি আইনের সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম বিচারে ও ব্যারিষ্টারের তর্ক শক্তির জোরে আমায় রক্ষা পাইতে হয়, তাহা হইলে তদপেক্ষা মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাবাস আমি শ্রেয়ঃ বলিয়া বিবেচনা করি। নিজ উদারতা গুণে আপনি আমাকে জ্ঞানী, বিচক্ষণ সদ্বিদ্বান্ প্রভৃতি আখ্যায় অভিহিত করিয়াছেন; অতএব আপনার কথার উপরেই নির্ভর করিয়া আমি সম্পূর্ণ সাহসের সহিত নিজে নিজের মোকদ্দমা চালাইব। তা ছাড়া আইন-কানুনও আমার কিছু কিছু জানা আছে। নিকলাস্ সাহেব যে সকল কথা বলিয়াছেন, সে সমস্তই সত্য এবং বাস্তবিক; আমি অত্যন্ত অনিচ্ছার সহিতই তাঁহাকে আমার সাপক্ষে দণ্ডায়মান হইতে অনুমতি প্রদান করিয়াছিলাম। নিকলাস্ সাহেবের উপরে আমার বিশ্বাস অটুট এবং যদি আমার কোন ব্যারিষ্টার নিযুক্ত করিবার ইচ্ছা থাকিত, তাহা হইলে তাঁহার ন্যায় উপযুক্ত লোককে আমি কখনই পরিত্যাগ করিতে পারিতাম না। ধর্ম্মাবতার! আমি আমার নিজের ভাল-মন্দ বেশ বুঝিতে পারি। আশা করি, আপনি আমার ইচ্ছায় বাধা দিবেন না। আমি নিজেই নিজের মোকদ্দমা পরিচালনা করিব।
বন্দীর এই প্রকার কথা কাজেকাজেই বিচারপতি বাধ্য হইয়া মোকদ্দমা আরম্ভ করিলেন।
প্রথমেই খোদাবক্স কোচম্যানের ডাক হইল। কোম্পানীর তরফের ব্যারিষ্টার উঠিয়া তাহাকে জেরা করিতে আরম্ভ করিলেন।
খোদাবক্স কোম্যানের জবানবন্দী শুনিবার জন্য শত শত লোক উৎকর্ণ হইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। তাহার সাক্ষীতে এমন কথা প্রকাশ হইতে পারে যে, তাহাতে হয় যজ্ঞেশ্বর বাবুর মুক্তিলাভ, না হয় তাঁহার সর্ব্বনাশ হইতে পারে, এই কথা উকীল কৌন্সিলীমাত্রেই ভাবিতেছিলেন।
খোদাবক্স দেখিতে বেশ বলিষ্ঠ, বয়ঃক্রম ত্রিশ বত্রিশ, মুখে খুব ব্যগ্রতার ভাব, অন্তরে প্রভুর ইষ্ট চিন্তায় চিন্তিত। গবর্ণমেন্টের তরফ হইতে ব্যারিষ্টার উঠিয়া খোদাবক্সকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, সে নির্ভয়ে নিঃশঙ্কচিত্তে তাহার উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। আমরা প্রশ্নগুলি বাদ দিয়া কেবল উত্তরগুলি সংক্ষেপে এই স্থলে লিপিবদ্ধ করিলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – খোদাবক্সের এজেহার
আমার নাম খোদাবক্স। আমি প্রায় তিন বৎসর যজ্ঞেশ্বর বাবুর নিকটে চাকরী করিতেছি। প্রায় প্রতিদিনই আমি আমার মনিবের গাড়ী হাঁকাই। তাঁহার গলার শব্দ না পাইলেও দূরে বা অন্ধকারে আমি তাঁহাকে অনায়াসেই চিনিতে পারি। দিনে বা রাত্রে সকল সময়েই আমি তাঁহাকে লইয়া বেড়াইয়াছি। অন্ধকার রাত্রে দূর হইতে তাঁহাকে আসিতে দেখিলেও আমি চিনিতে পারিতাম। আমার চোখের কোন দোষ নাই। ২৫শে আষাঢ় তারিখের দিন ও রাত্রির সমস্ত কথাই আমার মনে আছে। সেদিনকার মত খাটুনি আমার অদৃষ্টে আর একদিনও ঘটে নাই। বেলা এগারটা হইতে রাত্রি সাড়ে বারটা পৰ্য্যন্ত, আমি সেদিন গাড়ী হাঁকাইয়াছি। সে গাড়ীতে আমার মনিব ছিলেন। সন্ধ্যা অবধি তিনি একাই ছিলেন। সমস্ত দিন যে ক্রমাগতই আমাকে গাড়ী চালাইতে হইয়াছিল, তাহা নয়। মাঝে মাঝে বিশ্রাম ছিল। আমার মনিব অন্য কোন দিন ঘোড়াকে এত কষ্ট দেন নাই, তিনি বড় দয়ালু। ঘোড়াকে তিনি পূর্ব্বে কখনও এত খাটান নাই। বেলা এগারটার সময় আমার প্রভু গাড়ীতে উঠেন। তখন তাঁহাকে বিশেষ চিন্তাযুক্ত দেখিয়াছিলাম। তিনি প্রথমে আমায় ভবানীপুরে যাইতে বলেন। কোন্ বাড়ীতে তিনি যাইবেন, তাহা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, ‘চৌরঙ্গীর বড় রাস্তা দিয়া চল, কোথায় থামিতে হইবে, তাহা আমি পরে বলিব।’
“যেখানে তিনি আমায় গাড়ী থামাইতে বলিলেন, সেখানে কোন লোকের বাড়ী ছিল না, কোন বাড়ীর দরজার সম্মুখে তিনি আমায় থামাইতে বলেন নাই; রাস্তার মাঝখানে গাড়ী থামাইয়া হাঁটিয়া তিনি একটা গলির ভিতরে চলিয়া যান। আমায় ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া রাখিতে বলেন। প্রায় আধঘন্টা পরে তিনি ফিরিয়া আসিলেন। যখন তিনি ফিরিয়া আসিলেন, তখন তাঁহাকে আমি বড় চিন্তাযুক্ত বলিয়া বোধ করিয়াছিলাম। এবারেও তিনি খানিকক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন, ‘খোদাবক্স! যে রাস্তা দিয়া আসিয়াছিলে, সেই রাস্তা দিয়া ফিরিয়া চল। বেশি জোরে গাড়ী হাঁকিও না। আস্তে আস্তে চল।’ ধৰ্ম্মতলার মোড় ছাড়িয়া খানিকটা দূরে আসিলে তিনি আবার আর একটা গলির মোড়ে গাড়ী থামাইতে বলেন। সেইখানে নামিয়া পড়িয়া একটা গলির ভিতরে চলিয়া যান। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞসা করি, তিনি কতক্ষণের মধ্যে ফিরিয়া আসিবেন। তিনি উত্তর করেন, ঘন্টাখানেক দেরী হইবে।
“এই রকম কথায় আর তাঁহার সেদিনকার ভাবগতিক দেখিয়া আমি গাড়ী ঘোড়া লইয়া গড়ের মাঠের দিকে চলিয়া যাই। সেখানে গিয়া ঘোড়া খুলিয়া দিয়া নিজেও একটু বিশ্রাম করি। ঘন্টাখানেক পরে ফিরিয়া আসিয়াও আমি সেই গলির মোড়ে আমার প্রভুকে দেখিতে পাই নাই। যখন তিনি ফিরিয়া আসেন, তখন প্রায় রাত্রি হইয়া আসিয়াছে। সে সময়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও পড়িতেছিল। আমার মনিব ফিরিয়া আসিয়া আমার গ্রেট ইষ্টার্ণ হোটেলে যাইতে বলেন। সেখানে পৌঁছিলে গাড়ী হইতে নামিয়া তিনি আমায় বলেন, ‘খোদাবক্স! এখানে আমার কত দেরী হইবে, তাহা ঠিক বলিতে পারি না। হয় ত দু-চার মিনিটের মধ্যে ফিরিয়া আসিতে পারি, কি দুই-এক ঘন্টা থাকিতেও পারি। তুমি গাড়ী নিয়া এইখানেই থাকিবে।’
“প্রায় রাত্রি সাড়ে নয়টার সময়ে তিনি হোটেল হইতে বাহির হইয়া আসেন। তাঁহার সঙ্গে আর একজন লোকও ছিল। সে লোকটির কত বয়স, বৃদ্ধ কি যুবা, দাড়ী ছিল কি না ছিল, এ সব আমি কিছুই দেখি নাই। আমি কেবল আমার প্রভুর প্রতিই বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়াছিলাম। আমার প্রভু ইংরাজী ধরনের পোষাক পরিতেন। চাল-চলনও সাহেবের মত। সেদিন তিনি যে লম্বা আষ্টার কোটটি পরিয়াছিলেন, সে রকম রঙের কোট বড়-একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। যে লোকটির সঙ্গে আমার প্রভু হোটেল হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিলেন, তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে তিনি কিছুদূর এগিয়ে যান। তাহার পর সে লোকটি তাঁহার কাছে বিদায় লইয়া হোটেলের দক্ষিণ দিকের গলির মধ্যে প্রবেশ করে, আর আমার মনিব ফিরিয়া আসিয়া গাড়ীতে চড়েন। যখন তাঁহারা দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছিলেন, তখন আমার বোধ হইয়াছিল, যেন আমার প্রভু সেই লোকটিকে কি বুঝাইতেছিলেন, আর সে উত্তেজিত হইয়া রুক্ষ্ম ভাবে তাঁহার কথার জবাব করিতেছিল।
“বাবু গাড়ীতে উঠিয়া আমায় পটলডাঙ্গা গোলদীঘীর সম্মুখে গাড়ী লইয়া যাইতে বলিলেন। সেখানে উপস্থিত হইলে তিনি গোলদিঘীর সামনে নামিয়া পড়িলেন, তখনই গোলদিঘীর ভিতরে ঢুকিয়া খুব দ্রুতপদে কোথায় চলিয়া গেলেন, তাহা আর আমি দেখিতে পাইলাম না। আমি গাড়ী লইয়া সেইখানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। দশ-পনের মিনিট পরে আমার প্রভু একটি স্ত্রীলোককে সঙ্গে লইয়া ফিরিয়া আসিলেন, আর নিজে গাড়ীর দরজা খুলিয়া সযত্নে তাঁহাকে সেই গাড়ীর ভিতরে উঠাইয়া, তাহার পরে নিজের গাড়ীতে উঠিলেন। যে স্ত্রীলোকটি তাঁহার সঙ্গে আসিয়াছিলেন, তাঁহার পরণে চওড়া কালাপেড়ে কাপড়, গায়ে জামা, পায়ে মোজা ও জুতা ছিল।
“সে সময়ে রাস্তায় বা গোলদীঘীর ভিতরে লোকজন বড়-একটা কেহই ছিল না। গাড়ীতে উঠিয়া আমার প্রভু আমায় ঠঠনে যাইতে বলিলেন। সেখানে তাঁহার একটি ভাড়াটিয়া বাড়ী ছিল। একজন বাঙ্গালী বাবু এই বাড়ীটিতে ইংরাজী ধরনে একটি হোটেল খুলিয়াছিলেন। শুনেছি, এই হোটেলে ছাগ ও ভেড়ার মাংস ছাড়া অন্য কোন মাংস রন্ধন হইত না। হোটেলটি খুব ভাল চলিত। যে লোকটি এই ব্যবসায় খুলিয়াছিলেন, তাঁহার বেশ দু পয়সা লাভ হইতেছিল। ইংরাজী ধরনে রন্ধন করিতে শিখাইবার জন্য এই হোটেলে একজন মুসলমান ছিল। সে পূর্ব্বে কোন ইংরাজের হোটেলে চাকরী করিত। তাহার সহিত আমার বেশ আলাপ ছিল। তাহার বাবুর জমিদারের কোচম্যান বলিয়া সে আমায় বড় খাতির যত্ন করিত। আহারাদিও কখনও কখনও ফাঁকি দিয়া আমার চলিয়া যাইত।
“আমার প্রভু এখানে প্রায় আসিতেন। তাঁহার জন্য একটি স্বতন্ত্র ঘর নির্দিষ্ট ছিল। তিনি যখন আসিতেন, তখন সেই ঘরেই বসিতেন, এবং ইচ্ছা হইলে খাওয়া-দাওয়াও করিতেন। সেদিন তিনি সেই স্ত্রীলোকটিকে লইয়া সেই ঘরে গিয়া বসিয়াছিলেন। আমিও সুযোগ বুঝিয়া আমার সেই জাতভায়ের সঙ্গে দেখা করিলাম। সেদিন হোটেলে লোকজন কিছু কম হওয়াতে অনেক জিনিষ পড়িয়াছিল। হোটেলের মালিক বাবুটিও তখন বাড়ী চলিয়া গিয়াছিলেন। কাজেকাজেই নির্ব্বিঘ্নে আমার জাতভাই আমার পরিতোষপূর্ব্বক মাংসাদি আহার করাইল। আমার প্রভু সে সময়ে উপরে কি করিতেছিলেন, তাহা বলিতে পারি না। তবে আমার সন্দেহ হইয়াছিল বটে যে, এ ব্যাপারের ভিতরে নিশ্চয়ই কোন কু-অভিসন্ধি আছে। এই ঘটনার পূর্ব্বে আমি আমার প্রভুকে কখন এরূপভাবে দেখি নাই। আর কখনও তাঁহার চরিত্রের উপরে আমার সন্দেহ হয় নাই, যখন তিনি হোটেল হইতে বাহিরে আসিলেন, তখন প্রায় রাত্রি বারটা হইবে।”
যজ্ঞেশ্বর বাবুর কোচম্যান এই পর্য্যন্ত বলিয়া নীরব হইল। গভর্ণমেন্টের পক্ষীয় ব্যারিষ্টার জিজ্ঞাসা করিলেন, “যখন তিনি হোটেল হইতে বাহিরে আসিলেন, তখনও কি তাঁহার সঙ্গে সেই স্ত্রীলোকটি ছিলেন?”
উত্তর। হাঁ।
প্রশ্ন। সে সময়ও কি বৃষ্টি পড়িতেছিল?
উত্তর। হাঁ সে সময় খুব জোরে বৃষ্টি হইতেছিল।
প্রশ্ন। তোমার প্রভুকে কি গাড়ীতে উঠিবার সময়ে বড় ব্যস্ত-সমস্ত ভাবে দেখিয়াছিলে?
উত্তর। হাঁ, তিনি খুব ব্যস্ত-সমস্ত ভাবেই গাড়ীতে উঠিয়াছিলেন। বোধ হয়, সে সময়ে খুব বৃষ্টি পড়িতেছিল বলিয়াই তিনি ওরূপভাবে তাড়াতাড়ি আসিয়াছিলেন।
প্রশ্ন। প্রথমে কে গাড়ীতে উঠিয়াছিলেন?
উত্তর। প্রথমে সেই স্ত্রীলোকটি, তাহার পর আমার প্রভু।
প্রশ্ন। তোমার প্রভু কি, মদ খান?
উত্তর। কখন কখন খান।
প্রশ্ন। যখন তিনি গাড়ীতে উঠিয়াছিলেন, তখন তিনি মদের ঝোঁকে ছিলেন, এরূপ বোধ হয় কি?
উত্তর। তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না।
প্রশ্ন। তিনি গাড়ীতে উঠিয়া কি বলিলেন?
উত্তর। বলিলনে, ‘ঘর চল।’
প্রশ্ন। তাঁহার গলার স্বর তখন কেমন?
উত্তর। স্বর ভারী—মাতালের মত।
প্রশ্ন। তখনও কি তাঁহার সেই লম্বা কোট পরা ছিল?
উত্তর। হাঁ!
প্রশ্ন। তুমি বাড়ীতে চলিয়া গেলে—তাহার পর কি হইল?
উত্তর। আমার প্রভু প্রথমে গাড়ী হইতে নামিলেন, তাহার পর হাত ধরিয়া সেই স্ত্রীলোকটিকে নামাইলেন এবং দুইজনেই বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেলেন।
প্রশ্ন। যখন তিনি গাড়ী হইতে নামিয়াছিলেন, তখন কি তিনি স্থিরভাবে ছিলেন, না মদের ঝোঁকে তাঁহার পা টলিতেছিল?
উত্তর। তা আমি ঠিক বলিতে পারি না। তবে এ কথা বলিতে পারি, তিনি সে সময়েও বড় ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া গাড়ী হইতে নামিয়া বাড়ীর দিকে গিয়াছিলেন!
প্রশ্ন। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বারংবার তোমার প্রভুর দিকে চাহিয়া দেখিতেছ কেন?
উত্তর। কে জানে কেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমার মনিবের মত মনিব আর আমি পাইব না। আমার ইচ্ছা নয় যে, উনি কোন রকমে আমার কথায় কষ্ট পান।
প্রশ্ন। তোমার প্রভু গাড়ী হইতে নামিয়া যাইবার সময়ে তোমায় কিছু বলিয়াছিলেন?
উত্তর। না, আমি সেদিনকার মত আমার কাজ শেষ হইয়াছে, ভাবিয়া গাড়ী খুলিয়া দিয়া আস্তাবলে ঘোড়া লইয়া যাই।
প্রশ্ন। যত দিন তুমি চাকরী করিতেছ, তাহার মধ্যে সেদিন ছাড়া পূর্ব্বে আর কখনও তোমার প্রভুকে এত রাত্রে এ রকম ভাবে কোন স্ত্রীলোককে লইয়া ঘুরিতে বা নিজের বাড়ীতে আসিতে দেখিয়াছ?
উত্তর। না, কখনও না।
প্রশ্ন। তাহা হইলে ঐদিনকার যতগুলি ঘটনা, সমস্তই তোমার অত্যন্ত আশ্চৰ্য্য বলিয়া মনে হইতেছিল?
উত্তর। হ্যাঁ।
প্রশ্ন। তুমি আর কখনও কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে অধিক রাত্রিতে তোমার প্রভুকে বাড়ী ফিরিয়া আসিতে দেখিয়াছ?
উত্তর। কখন কখন তাঁহার স্ত্রী, তাঁহার সঙ্গে থিয়েটার দেখিতে গিয়া অধিক রাত্রে তাঁহার সঙ্গেই ফিরিয়া আসিয়াছেন, দেখিয়াছি বটে; কিন্তু অন্য কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে প্রভুকে কখনও দেখি নাই।
প্রশ্ন। পঁচিশে আষাঢ় তারিখের রাত্রে সে স্ত্রীলোকটি ঠঠনের হোটেল হইতে তোমার প্রভুর সঙ্গে তাঁহার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, তিনি তোমার প্রভুপত্নী নহেন, এ কথা তুমি শপথ করে বলিতে পার?
উত্তর। আজ্ঞে হাঁ।
এই পৰ্য্যন্ত জিজ্ঞাসা করিয়া গভর্ণমেন্ট-তরফের ব্যারিষ্টার নিজের আসনে উপবিষ্ট হইলেন। বিচারপতি একবার বন্দী যজ্ঞেশ্বর বাবুর দিকে চাহিলেন। যজ্ঞেশ্বর বাবু সে চাহনীর উদ্দেশ্য বুঝিয়া খোদাবক্স কোম্যানের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া জেরা করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহা এত সংক্ষিপ্ত যে, আদালত সুদ্ধ লোকে তৎশ্রবণে বিস্মিত হইলেন।
সকলেই মনে করিয়াছিলেন যে, যখন যজ্ঞেশ্বর বাবু সকলের কথা অগ্রাহ্য করিয়া নিজের স্কন্ধে মোকদ্দমার সমস্ত ভার গ্রহণ করিয়াছেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই নিজে মোকদ্দমা চালাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন। তিনি বিদ্বান্ ও বিচক্ষণ, এ কথা সকলেই জানিতেন; কিন্তু আদালতে মোকদ্দমা চালাইবার ক্ষমতা তাঁহার ছিল কি না, এ কথা কেহই জানিতেন না। এমন কি অনেকের মনে এইরূপ ধারণা হইয়াছিল যে, নিজ বুদ্ধির দোষে তাঁহার সৰ্ব্বনাশ হইবে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – খোদাবক্সের এজেহার—ক্রমশঃ
বন্দী যজ্ঞেশ্বর জিজ্ঞাসা করিলেন, “খোদাবক্স! তুমি বলিতেছ, প্রায় রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময়ে আমি ঠঠনের হোটেল হইতে বাহির হইয়াছিলাম। আমার সঙ্গে একজন স্ত্রীলোক ছিলেন, আর সে সময়ে খুব বৃষ্টি হইতেছিল। এ সব কথা কি ঠিক? তুমি শপথ করিয়া বলিতেছ?”
খোদাবক্স। আজ্ঞে হাঁ।
বন্দী। আমি তোমায় ডাকিয়াছিলাম?
খোদাবক্স। না, আপনাকে হোটেল হইতে বাহিরে আসিতে দেখিয়া আমি তখনই গাড়ী লইয়া এগিয়ে যাই। আপনার ডাকিবার দরকার হয় নাই, আমি নিকটেই ছিলাম।
বন্দী। তুমি বলিতেছ যে, যখন আমি এবং সেই স্ত্রীলোক গাড়ীতে উঠি, সেই সময়ে আমি তোমায় বলিয়াছিলাম, ‘ঘর চল।’ আর তখন আমার কন্ঠস্বর ‘ভারী ও মাতালের মত’ এই রকম তোমার বোধ হইয়াছিল?
খোদাবক্স। আজ্ঞে হাঁ, হুজুর।
বন্দী। আচ্ছা, সে কন্ঠস্বর আমার কি অন্য লোকের, তুমি তাই কি একবারও ভাবিয়া দেখিয়াছিলে? তোমার কি মনে হয় যে, আমিই ‘ঘর চল’ বলিয়াছিলাম?
খোদাবক্স। আজ্ঞে হাঁ, আমার একবারও মনে হয় নাই যে, যে আওয়াজ অন্য লোকের।
বন্দী। আমি তখনও আমার সেই অলষ্টার কোট পরিয়াছিলাম?
খোদাবক্স। আজ্ঞে হাঁ।
বন্দী। তুমি বরাবর আমাদের উভয়কে বাড়ীতে লইয়া গিয়াছিলে, আর আমি সেই স্ত্রীলোকটিকে
সঙ্গে করিয়া বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেলাম, এ সব তুমি স্বচক্ষে দেখিয়াছিলে?
খোদাবক্স। আজ্ঞে হাঁ।
বন্দী। তখনও আমার গায়ে সেই কোট ছিল?
খোদাবক্স। আজ্ঞে হাঁ।
বন্দী। আমি তোমার দিকে একবারও মুখ ফিরাইয়াছিলাম কি? আমার মুখ তুমি তখন একবারও দেখিতে পাইয়াছিলে?
খোদাবক্স। না।
বন্দী। যদি আমি তখন তোমার দিকে মুখ ফিরাইতাম, তাহা হইলে সেই অন্ধকারে তুমি আমার চেহারা তখন ঠিক দেখিতে পাইতে কি?
খোদাবক্স। না, তাহা পাইতাম না।
বন্দী। তোমায় আর আমার বড় কিছু জিজ্ঞাস্য নাই। তুমি এতদিন বড় বিশ্বাস ও যোগ্যতার সহিত আমার কাজ করিয়া আসিয়াছ, তোমায় একটি শেষ কথা জিজ্ঞাসা করি, তুমি বিচারপতির সম্মুখে যে সমস্ত কথা বলিলে, তাহার একটিও মিথ্যা বল নাই? যেগুলি তুমি যথার্থ স্বচক্ষে দেখিয়াছিলে এবং স্বকর্ণে শুনিয়াছিলে, সেইগুলিই বলেছ—কেমন?
খোদাবক্স। আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর!
বন্দী আর কিছুই জিজ্ঞাসা করিলেন না। গভর্ণমেন্টের তরফের ব্যারিষ্টার পুনরায় জেরা করিতে লাগিলেন।
প্রশ্ন। তুমি কোন নেশা কর কি?
উত্তর। কখন কখন তাড়ী খাই বটে, অন্য নেশা কিছু করি না; কিন্তু সেদিন তাড়ীও খাই নাই।
প্রশ্ন। তোমার প্রভুকে তুমি প্রতিদিনই দেখিতে পাইতে, তোমার চোখের কোন দোষ নাই, এবং অন্ধকারে দেখিলেও তুমি দূর হইতে তোমার মনিবকে চিনিতে পার; সেদিন তুমি তাঁহাকে ভুল দেখিয়াছিলে কি না—অন্ততঃ তোমার কোন ভুল হওয়া সম্ভব কি না?
উত্তর। আল্লা জানেন, ভুল হইলেও হইতে পারে; কিন্তু আমার বিশ্বাস, আমার ভুল হয় নাই।
গভর্ণমেন্ট পক্ষীয় ব্যারিষ্টার খোদাবক্সকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া তাহাকে বিদায় দিলেন। দ্বিতীয় সাক্ষীর ডাক হইল, তাহার নাম হরিহর কর্ম্মকার। সে ঠঠনে হোটেলের একজন ভৃত্য।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – হরিহরের এজেহার
হরিহর কর্ম্মকার পূৰ্ব্বোক্ত ঠঠুনিয়া হোটেলে উপস্থিত ভদ্রলোকগণকে মাংসাদি যোগাইত। পূৰ্ব্বে সে হরিহর মুখোপাধ্যায় নামে পৈতাধারী ব্রাহ্মণ সাজিয়া কোন ভদ্রলোকের বাড়ীতে সূপকার ছিল। এখন সে এই হোটেলে চাকরী গ্রহণ করিয়াছে। মাংসাদি রন্ধন তাহার ভাল আসিত না বলিয়া সে মুসামলন সূপকারের কাছে তাহা শিক্ষা করিতেছিল। যে বাবুটি হোটেলের মালিক, হরিহর তাঁহার স্বদেশীয় লোক। কাজেকাজেই তাঁহার কাছে ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচয় দেওয়ার কোন উপায় ছিল না।
হরিহর খুব চালাক চতুর লোক। কোন বিশিষ্ট ভদ্রলোক বা কাপ্তেন বাবু ধরনের কোন অল্প বয়স্ক যুবা আসিলেই হোটেলের মালিক হরিহরকে সেই ঘরে আহারীয় যোগাইতে দিতেন। হরিহর সেই সকল লোকের সহিত এমনভাবে কথাবার্তা কহিত যে, তাঁহারা একবার আসিলে আরও পাঁচবার আসিতে বাধ্য হইতেন। এক কথায় হোটেলের খরিদ্দার ভদ্রলোকমাত্রেই হরিহরের যত্নে অভ্যর্থনায় ও চাহিবার পূৰ্ব্বেই আবশ্যক বস্তু হাতে হাতে পাওয়ায় এত সন্তুষ্ট হইতেন যে, অনেক পাশ্চাত্য শিক্ষাভিমানী ইংরাজী শিক্ষিত বাঙ্গালী বাবু সাহেবী হোটেল পরিত্যাগ করিয়া এই বাঙ্গালী হোটেলে খাতা খুলিয়াছিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই হোটেলটি বেশ জাঁকাল ধরনের হইয়া উঠিয়াছিল।
জমিদারের সম্মানের জন্য যজ্ঞেশ্বর বাবুর স্বতন্ত্র ঘর নির্দ্দিষ্ট ছিল। তিনি যখন আসিতেন, তখনই হরিহর যাইয়া তাঁহার আহারীয় যোগাইত এবং মিষ্ট ও সন্তোষজনক কথায় তাঁহাকে পুলকিত করিতে চেষ্টা করিত। হোটেলের স্বত্বাধিকারী বাবুটি যেদিন উপস্থিত থাকিতেন, সেদিন তিনিও আসিয়া যোগ দিতেন। এই দুইজনে পড়িয়া এমন চেষ্টা করিতেন যে, বাড়ীখানির মাসিক ভাড়া যাহাতে যজ্ঞেশ্বর বাবু কিছু না পান—মাংসাহারেই শোধ হয়। এমন কি কখন কখন মাসিক ভাড়ার উপরে যজ্ঞেশ্বর বাবুর নিকটে হোটেলের স্বত্বাধিকারীর পাওনা হইত। হরিহর কর্ম্মকারের এজেহার নিয়ে প্রকটিত হইল;
“পঁচিশে আষাঢ় তারিখে রাত্রি এগারটার সময়ে যজ্ঞেশ্বর বাবু একটি স্ত্রীলোককে সঙ্গে লইয়া আমাদের হোটেলে আসিয়াছিলেন, তাহা আমার বেশ স্মরণ আছে। আমি তাঁহাকে মাংসাদি আহারীয় ও বরফ লিমনেড স্যাম্পেন ইত্যাদি পানীয় আনিয়া দিয়াছিলাম।
“যজ্ঞেশ্বর বাবু যে স্ত্রীলোকটিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিয়াছিলেন, তাঁহাকে দেখিয়া নেটীব খৃষ্টীয়ান বলিয়া আমার বোধ হইয়াছিল। তাঁহার চালচলনে গণিকা বলিয়া আমার বোধ হয় নাই। মাংসের নানাবিধ খাদ্য প্রভৃতি যজ্ঞেশ্বর বাবুর হুকুম মত আমি আনিয়া দিয়াছিলাম। সকল রকমই একটু একটু যজ্ঞেশ্বর বাবু আহার করিয়াছিলেন।
“স্ত্রীলোকটি এক গেলাস বরফ-লিমমেড ছাড়া আর কিছুই পান বা আহার করেন নাই। তাঁহারা উভয়ে কি একটা বিষয় লইয়া অত্যন্ত উৎসাহের সহিত কথা কহিতেছিলেন। আমি যতবার তাঁহাদের আহার্য্য লইয়া তাঁহাদের ঘরের ভিতরে গিয়াছিলাম, ততবারই তাঁহাদের কথাবার্তা বন্ধ হইয়াছিল। তাঁহাদের কথাবার্ত্তার আমি কিছুই শুনি নাই, আর সে গুপ্তকথা শুনিবার আমার ইচ্ছাও ছিল না।
“আর মনিবের যত অধিক মাল কাট্তি হয়, সেইদিকেই আমার বিশেষ দৃষ্টি ছিল। আমি ‘আর কিছু চাই’ জিজ্ঞাসা করিলেই যজ্ঞেশ্বর বাবু একটার পর আর একটা জিনিষ আনিতে হুকুম করিতেছিলেন বটে, কিন্তু আহার অতি অল্পই করিতেছিলেন। স্ত্রীলোকটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলে পাছে তিনি অসন্তুষ্ট হন, সেইজন্য যতবার আমি সে ঘরে প্রবেশ করিয়াছিলাম, ততবারই কেবল যজ্ঞেশ্বর বাবুর দিকে চাহিয়া কথাবার্তা কহিয়াছিলাম। তাঁহারা যখন চলিয়া গিয়াছিলেন, তখন আমি তাঁহাদিগকে দেখি নাই। সে সময়ে অন্য আর একটি ঘরে আমি খাদ্য যোগাইতে গিয়াছিলাম।
“আমাদের হোটেলে ইংরাজ, বাঙ্গালী দুই জাতিই আসিত। তবে বাঙ্গালীর ভিড় কিছু বেশী হইত। দুই-চারিজন ইংরাজ আমাদের বাঁধা খদ্দের ছিলেন; তাঁহারা সাহেবী হোটেলের চর্বি দিয়া রান্নার পরিবর্তে আমাদের বাঙ্গালী প্রণালীর ঘৃত ও নানাবিধ মশলাসংযুক্ত রন্ধন বড় ভালবাসিতেন।
“সাহেবদের সঙ্গে বড় বেশী কথাবার্তা কহিবার আবশ্যক হইত না। তাঁহাদের সঙ্গিনী বিবিরা বিজ্ঞাপনের ছাপা কাগজ দেখিয়া যেগুলি আনিতে বলিতেন, তাহাই আনিয়া দিলেই আমার কার্য্য সম্পন্ন হইত।
“আমাদের হোটেলের হাব ভাব, জিনিষপত্র, ঘর দ্বার, টেবিল চেয়ার, লোকজনের পোষাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি সকলই ইংরাজী হোটেলের অনুকরণে প্রস্তুত হইয়াছিল। বিজ্ঞাপন পাঠ করিয়া বাঙ্গালীর এই কারখানা দেখিতে আমোদ করিয়াও অনেক ইংরাজ-দম্পতি আমাদের হোটেলে আসিতেন।
“যজ্ঞেশ্বর বাবু সেই রমণীর সঙ্গে তাঁহার নিজের নিভৃতকক্ষে বসিয়া কথা কহিতেছিলেন। অন্য ঘরেও লোকজন ছিল না, এমন নয়। একটি ঘরে একজন ইংরাজ ও একজন বিবি ছিলেন। তাঁহাদিগকে লইয়া সেদিন আমি কিছু ব্যস্ত ছিলাম।
“সেই অবকাশে যজ্ঞেশ্বর বাবু ও সেই স্ত্রীলোক চলিয়া গিয়াছিলেন। তখন প্রায় রাত্রি দ্বিপ্রহর হইবে। রাস্তায় তাঁহাদের জন্য গাড়ী ছিল কি না, আমি জানি না। তবে আমি জানি, যজ্ঞেশ্বর বাবু যখন আসিতেন, প্রায় গাড়ীতে আসিতেন।”
গভর্ণমেন্ট-পক্ষীয় ব্যারিষ্টারের জেরায় হরিহর যে যে কথা বলিয়াছিল, তাহার সারমর্ম্ম উপরে লিখিত হইয়াছে। এইবার বন্দী যজ্ঞেশ্বর মিত্র হরিহরকে যেরূপ জেরা করিয়া যাহা উত্তর প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা এইরূপ;-
প্রশ্ন। তুমি বলেছ, আমি পঁচিশে আষাঢ় তারিখে রাত্রি এগারটার সময়ে একজন স্ত্রীলোকের সঙ্গে তোমাদের হোটেলে উপস্থিত হইয়া আমার নিভৃতকক্ষে উপবেশন করি, কেমন?
উত্তর। আজ্ঞে হাঁ।
প্রশ্ন। সে ঘরে আর কাহারও যাইবার অধিকার ছিল না?
উত্তর। না।
প্রশ্ন। যে সময়ে তুমি আমার আহারাদি যোগাইতেছিলে, সে সময়ে অন্য ঘরেও তুমি তদারক করিতেছিলেন—কেমন?
উত্তর। আজ্ঞে হাঁ।
প্রশ্ন। এখন বল দেখি, আমি আমার সেই নিভৃত কক্ষে প্রবেশ করিবার পূর্ব্বে কি করিয়াছিলাম।
উত্তর। আপনি ঘরের বাহিরে, দেয়ালের গায়ে, আপনার আলষ্টার কোট রাখিয়া সেই স্ত্রীলোকের হাত ধরিয়া ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন।
প্রশ্ন। আমি যেখানে আমার কোটটি রাখিয়াছিলাম, সেখানে আর কিছু ছিল কি না?
উত্তর। পাশের কামরায় আর একজন সাহেবের আষ্টার কোটও সেইখানে ছিল।
প্রশ্ন। সে স্থানে বিশেষ রকম আলোর বন্দোবস্ত ছিল কি না?
উত্তর। না।
প্রশ্ন। আমি চলিয়া আসিবার পূর্ব্বে সেই আষ্টার কোট গায়ে দিয়াছিলাম কি না?
উত্তর। হাঁ।
বিচারপতি। কিয়ৎক্ষণ পূৰ্ব্বে তুমি বলিয়াছ, যজ্ঞেশ্বর মিত্র যখন হোটেল হইতে চলিয়া আসেন, তখন তোমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয় নাই।
উত্তর। কিন্তু আমি যখন ফিরিয়া আসি, তখন তাঁহাকেও দেখিতে পাই নাই, আর দেয়ালেও একটা বৈ দুইটা কোট ছিল না।
বন্দী। তাহা হইলে তুমি আমায় কোটটা গায়ে দিতে দেখ নাই।
উত্তর। না।
বন্দী বলিলেন, “আর তোমাকে আমার কিছু জিজ্ঞাসা করিবার নাই। বিচারপতির অনুমতি লইয়া তুমি বিদায় গ্রহণ করিতে পার।”
এই সময়ে জজ সাহেবের টিফিনের জন্য আদালত তলব হইল; কিন্তু এই মোকদ্দমায় আদালত সুদ্ধ লোকের এমন আগ্রহ জন্মিয়াছিল যে, বসিবার স্থান যাইবার ভয়ে কেহই নিজ আসন পরিত্যাগ করিলেন না।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – হরিদাস গোয়েন্দার এজেহার
আদালত পুনরায় সমবেত হইলে পার এবার প্রথমেই হরিদাস গোয়েন্দার ডাক হইল। সরকারী তরফের ব্যারিষ্টার তাঁহাকে প্রশ্ন করিলেন, “আপনি একজন ডিটেকটিভ ইনস্পেক্টর-আপনার নাম হরিদাস বাবু?”
উত্তর। হাঁ।
প্রশ্ন। পঁচিশে আষাঢ় তারিখে বেলা সাতটার সময়ে আপনি বন্দীর বাড়ীতে গিয়াছিলেন। তখন যজ্ঞেশ্বর বাবু বাড়ীতে ছিলেন কি?
উত্তর। গিয়াছিলাম। তিনি তখন বাড়ীতে ছিলেন না।
প্রশ্ন। আপনি কাহাদের এজেহার লইয়াছিলেন?
উত্তর। যজ্ঞেশ্বর বাবুর কোচম্যান—কমলিনী—আর বাড়ীর অন্যান্য চাকর লোকজনের কাছে তদন্ত আরম্ভ করিয়াছিলাম।
প্রশ্ন। অনুসন্ধানে আপনি কি কি কথা জানিতে পারিয়াছিলেন, তাহা ক্রমশঃ বিচারপতির সম্মুখে বলুন।
উত্তর। আমি অনুসন্ধানে এই পৰ্য্যন্ত জানিতে পারি যে, তাহার পূর্ব্বদিন রাত্রিতে যজ্ঞেশ্বর বাবু একজন অপরিচিত স্ত্রীলোককে সঙ্গে লইয়া প্রায় রাত্রি সাড়ে বারটার সময়ে বাড়ীতে ফিরিয়া আসেন। বাহিরের বৈঠকখানার চাবি তাঁহার নিকটেই ছিল; সেই চাবিতে হলঘরের দরজা খুলিয়া তিনি স্ত্রীলোককে লইয়া বৈঠকখানায় প্রবেশ করেন। তাহার পর রাত্রে আর তাঁহার কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় নাই। সকালে উঠিয়াও কেহ তাঁহাকে দেখিতে পায় নাই।
প্রশ্ন। চাবিটা কোথায় ছিল?
উত্তর। যজ্ঞেশ্বর বাবুর আষ্টার কোটের ভিতরে।
প্রশ্ন। আপনি গিয়া কোটটি কোথায় থাকিতে দেখিয়াছিলেন?
উত্তর। হলঘরের সম্মুখে কোট রাখিবার জায়গায়।
প্রশ্ন। কোটের পকেটে কোন জিনিষ ছিল?
উত্তর। হলঘরের দরজার চাবি, আর একখানা তাস তাঁহার কোটের পকেটে পাওয়া গিয়াছিল। কোম্পানীর তরফের ব্যারিষ্টার কোটটি চাবিটি ও একখানি তাস হাতে করিয়া তুলিয়া হরিদাস গোয়েন্দাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই সেই সব জিনিষ কি না দেখুন দেখি?”
হরিদাস গোয়েন্দা উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, “হাঁ, এই সকল জিনিষই আমি পুলিশে জমা দিয়াছিলাম বটে।”
প্রশ্ন। আপনার তদন্ত শেষ হইলে আপনার সঙ্গে যজ্ঞেশ্বর বাবুর দেখা হইয়াছিল কি না?
উত্তর। হইয়াছিল। আমি যে সময়ে ভৃত্যদের এজেহার লইতেছিলাম, সেই সময়ে হঠাৎ তিনি বাড়ীতে আসিয়া আমি কি উদ্দেশ্যে তথায় উপস্থিত হইয়াছিল, তাহাই জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি তাঁহাকে নিজের পরিচয় দিয়া সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলিলাম। তিনি আমার কথা শুনিবামাত্রই বলিলেন, ‘বলেন কি? —সৰ্ব্বনাশ!’ এই কথা বলিয়া দ্রুতবেগে অন্তঃপুরে প্রবেশ করেন। আমিও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে যাই। তিনি তাঁহার স্ত্রী মৃতদেহ দেখিয়া কম্পিত-কলেবরে পার্শ্বস্থিত একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়েন। আমার স্কন্ধে তাঁহার এই আষ্টার কোটটি ছিল। আমি তাঁহাকে বলি, এই কোটটি আমাকে লইয়া যাইতে হইবে। তিনি ঘাড় নাড়িয়া আমার কথায় সম্মতি দেন। কিয়ৎকক্ষণ পরেই তিনি আবার আমায় জিজ্ঞাসা করেন, আমি এই কোটটি কোথায় পাইয়াছি। আমি প্রকৃত উত্তর প্রদান করিলে তিনি বলেন, ‘অসম্ভব!’ তাহার পরেই আরও কি বলিতে যাইতেছিলেন, আমি তাহাতে বাধা দিয়া তাঁহাকে বলি যে, আমার সম্মুখে তিনি যে সকল কথা বলিবেন, তাহা যেন সাবধান হইয়া বলেন। কেন না, সেই সকল কথা আদালতে উঠিতে পারে এবং হয় ত তখন তাঁহার পক্ষে তাহা বিপজ্জনক ও অসুবিধাকর হইয়া দাঁড়াইতে পারে। আমার কথা শুনিয়া তিনি অবাক হইয়া কিয়ৎকাল আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন এবং শেষে বলিলেন, ‘আদালতে—আমার বিরুদ্ধে!’ আমি বলিলাম, আজ্ঞা হাঁ, আপনার বাড়ীতে খুন হইয়াছে।’ এই কথা শুনিয়া তিনি উন্মত্তের ন্যায় চীৎকার করিয়া উঠেন এবং আমার দিকে ফিরিয়া বলেন, ‘খুন! আমার বাড়ীতে! আমাকে লোকে সন্দেহ করেছে!’ আমি পুনরায় তাঁহাকে আদালতের কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়াতে তখন তিনি কথঞ্চিৎ স্থিরভাব ধারণ করেন এবং আমায় ধন্যবাদ দিয়া বিদায় করেন।
হরিদাস গোয়েন্দার কথা শেষ হইলে বিচারপতি বন্দীর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন; কিন্তু এবার যজ্ঞেশ্বর আর কিছু জেরা করা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন না। আদালতসুদ্ধ লোক সকলেই বিস্মিতের ন্যায় বন্দীর মুখ পানে চাহিয়া ছিলেন। আরও বিস্ময়ের কথা এই যে, যে সময়ে সরকারী ব্যারিষ্টার হরিদাস গোয়েন্দাকে বন্দীর আষ্টার কোটের পকেট হইতে প্রাপ্ত তাসখানি দেখাইতেছিলেন, সে সময়ে বন্দীর মুখ পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিয়াছিল এবং তিনি যেন অত্যন্ত বিস্মিত ও চমক্তি হইয়াছিলেন। যে তাসখানি আদালতে দেখান হইয়াছিল, সেখানি হরতনের নওলা।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কমলিনীর এজেহার
“আমার নাম কমলিনী। আমি হেমাঙ্গিনীর প্রতিবাসিনী। অকালে আমার পিতামাতা কালকবলিত হওয়ায় বাল্য-প্রণয়-বশতঃ হেমাঙ্গিনী আমায় আশ্রয় দান করেন। বালিকাকালে হেমাঙ্গিনীর সহিত আমার বড় ভাব ছিল। সেই ভালবাসার খাতিরে আমার দুরবস্থায়, তিনি আমায় সহচরীরূপে নিযুক্ত করেন। যে সময়ে হেমাঙ্গিনীর বিবাহ হয়, তখন তাহার পিতামাতা উভয়েই জীবিত ছিলেন।
হেমাঙ্গিনী বিবাহের পূর্ব্বে যজ্ঞেশ্বর বাবুকে বড় ভালবাসিতেন। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর বাবু—মৌখিক কিছু ত্রুটি না থাকিলেও আমার বিশ্বাস—অন্তরে হেমাঙ্গিনীকে ভালবাসিতেন না।
হেমাঙ্গিনী দেখিতে মন্দ ছিলেন না। তাঁহার মনের দৃঢ়তা কম থাকিলেও তিনি বড় একগুঁয়ে ছিলেন; যাহা একবার ধরিতেন, তাহা সহজে পরিত্যাগ করিতেন না। কথাবার্তায় হেমাঙ্গিনী বড় মিষ্টভাষিণী ছিলেন না। যজ্ঞেশ্বর মিত্রের সহিত যখন বিবাহ হয়, তখন হেমাঙ্গিনীর বসয় তেইশ বৎসর মাত্র। যজ্ঞেশ্বর বাবুর বয়স তখন আটাশ বৎসর। বিবাহের পূর্ব্বে তিনি প্রায় হেমাঙ্গিনীর পিত্রালয়ে যাইতেন সেই সূত্রে আলাপ পরিচয় হয়।
হেমাঙ্গিনীর পিতা ঘোড়দৌড়ের বাজী ধরিতেন। তিনি একজন বুক-মেকার ছিলেন। যজ্ঞেশ্বর বাবুরও ঘোড়দৌড় খেলার বাতিক ছিল। বাজী রাখিবার জন্যই তিনি হেমাঙ্গিনীর পিতার নিকটে আসিতেন। হেমাঙ্গিনীর পিতা রামসুন্দর বাবু ভদ্রসমাজে মিশিতেন না, কিন্তু তাঁহার যথেষ্ট অর্থ ছিল। সেই অর্থবলেই তিনি যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত আপনার কন্যার বিবাহ দিতে পারিয়াছিলেন। ঘোড়দৌড়ের বাজীতে যজ্ঞেশ্বর বাবু বিস্তর টাকা হারিয়া ঋণী হইয়া পড়িয়াছিলেন। এমন কি তাঁহার পৈতৃক ভদ্রাসন পৰ্য্যন্ত বিক্রীত হইয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছিল। সেই অবস্থায় তিনি রামসুন্দর বাবুর শরণাপন্ন হওয়াতে রামসুন্দর বাবু তাঁহার দেনা পরিশোধ করিয়া দিতে প্রতিশ্রুত হয়েন এবং নিজ কন্যাকে বিবাহ করিতে বলেন। যজ্ঞেশ্বর বাবু দেনার দায়ে অগত্যা অনিচ্ছাসত্বেও হেমাঙ্গিনীকে বিবাহ করিতে সম্মত হয়েন।
এই বিবাহ রামসুন্দর বাবু যজ্ঞেশ্বর বাবুর সমস্ত দেনা পরিশোধ করিয়াও তাঁহাকে বিশ হাজার এবং হেমাঙ্গিনীকে দশ হাজার টাকা ও একখানি বাড়ী যৌতুকস্বরূপ দান করেন। তাহার পর রামসুন্দর বাবুর ও তাঁহার স্ত্রী মৃত্যুর পর সমস্ত বিষয়-সম্পত্তিই হেমাঙ্গিনীই প্রাপ্ত হন। যজ্ঞেশ্বর বাবুর তাহাতে হস্তক্ষেপ করিবার কোন অধিকার ছিল না; তবে হেমাঙ্গিনীর মৃত্যু হইলে যজ্ঞেশ্বর বাবু সেই বিষয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইতে পারিবেন, এ কথা রামসুন্দর বাবুর উইলে লেখা ছিল।
হেমাঙ্গিনীর বিবাহ দিনে বরযাত্রী কেহ ছিলেন না। যজ্ঞেশ্বর বাবু ইতরশ্রেণীর লোকের কন্যাকে বিবাহ করিতেছেন ভাবিয়া, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন কাহাকেও নিমন্ত্রণ করেন নাই। বিবাহ একপ্রকার গোপনেই হইয়াছিল। বরযাত্রী কেহ উপস্থিত হন নাই বলিয়া রামসুন্দর বাবু বড় ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন এবং নিজেকে অপমানিত বোধ করিয়াছিলেন।
বিবাহের পর ক্রমে ক্রমে যজ্ঞেশ্বর বাবুর চরিত্রের বিকাশ হইতে লাগিল। তিনি প্রায়ই রজনীতে বাড়ীতে থাকিতেন না। কোনদিন অধিক রাত্রে বাড়ীতে আসিতেন; কিন্তু হয় ত তখন তাঁহার কথা কহিবারও সামর্থ্য থাকিত না। মদের নেশায় অজ্ঞানবৎ হইয়া গাড়ীতে করিয়া বাড়ীতে আসিতেন এবং যেখানে-সেখানে পড়িয়া রাত্রি কাটাইতেন। হেমাঙ্গিনী বা আমি কোনদিন তাঁহাকে সিঁড়ীতে, কোনদিন সদর দরজার কাছে, কোনদিন দাওয়ায়, কোনদিন ছাদে অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া থাকিতে দেখিতাম। চাকর লোকজন দিয়া ধরাধরি করিয়া তখন তাঁহাকে তাঁহার শয্যায় আনিয়া শয়ন করান হইত। যখন তাঁহার চৈতন্য হইত, তখন হেমাঙ্গিনী যৎপরোনাস্তি তিরস্কার ও গালি-গালাজ করিতেন। তাহাতে যজ্ঞেশ্বর বাবু একটি কথারও উত্তর প্রদান করিতেন না।
হেমাঙ্গিনী তাহাতে আরও জ্বলিয়া উঠিতেন—আরও অধিক গালি-গালাজ করিতেন। যখন একান্ত অসহ্য বোধ হইত, তখন কোন কোন দিন যজ্ঞেশ্বর বাবু বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যাইতেন এবং দুই-চারিদিন আর দেখা-সাক্ষাৎ করিতেন না। হেমাঙ্গিনী তাহাতে বড় অস্থির হইতেন। তিনি সারাদিন সারারাত আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া উপাধানে মুখ লুকাইয়া কাঁদিতেন। আমি বুঝাইতে গেলে বলিতেন, ‘কমলিনী! আর তিনি আসিবেন না। আমি তাঁহাকে অকথা কুকথা বলিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি। না জানি, তাহাতে তাঁহার মনে কত ক্লেশ হইয়াছে। তাহাই তিনি আমাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। হায়! আমার মত অভাগিনী, আমার মত পাপিষ্ঠা, বোধ হয়, জগতে আর কেহ নাই।’ কাহারও পদশব্দ পাইলেই অমনই হেমাঙ্গিনী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিতেন, ‘ঐ তিনি আসিয়াছেন—আর আমি তাঁহাকে তিরস্কার করিব না, আর কখনও তাঁহাকে কিছু বলিব না, আর তাঁহার মনে কষ্ট দিব না।’ রজনীতে সদর দরজায় কেহ ধাক্কা দিলে বা বাতাসের জোরে সেস প্রকার কোনরূপ শব্দ পাইলে অমনই হেমাঙ্গিনী দ্রুতবেগে নীচে নামিয়া আসিতেন; কিন্তু তাঁহার স্বামীকে দেখিতে না পাইলে সেইখানেই বসিয়া পড়িয়া হতাশভাবে চোখের জল ফেলিতেন। আমার ভয় হইত,পাছে, তিনি বায়ুরোগগ্রস্ত হন—পাছে তিনি পাগলিনীর ন্যায় বাড়ীর বাহির হইয়া যান।
যজ্ঞেশ্বর বাবু যখন যথার্থই ফিরিয়া আসিতেন, তখন হেমাঙ্গিনী দৌড়াইয়া গিয়া তাঁহার গলা জড়াইয়া ধরিতেন, বুকের ভিতরে মুখ লুকাইয়া আকুল হইয়া কাঁদিতেন, বারংবার স্বামীর পা ধরিয়া মার্জ্জনা ভিক্ষা করিতেন। ইহাতে যজ্ঞেশ্বর বাবু কখন কথা কহিতেন, কখন নীরব হইয়া থাকিতেন, কখনও বা বলিতেন, ‘যখন গালি দাও, তখন কি এ সব কিছুই মনে থাকে না? বিবেচনা করিয়া কথা বলিলে ভাল হয় না কি?” হায়! কি ভয়ানক কষ্টের জীবনই তাঁহারা উভয়ে অতিবাহিত করিতেন! কিন্তু আশ্চর্য্য, যজ্ঞেশ্বর বাবুর ক্ষমতা ও সহ্য গুণ! তিনি সকল সময়ে অভিমান করিয়া, কি রাগ করিয়া একটিও রূঢ় বাক্য প্রয়োগ করিতেন না। অন্তরে তিনি যতই বিরক্ত হউন না কেন, মুখে তাহার বিন্দুমাত্রও প্রকাশ পাইত না।
হেমাঙ্গিনী আমাকে বড় বিশ্বাস করিতেন। সুখ দুঃখের কথা, প্রাণের কথা, মনের কথা সকল কথাই তিনি আমায় বলিতেন। এমন কি কখন তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করিতেন, ‘আচ্ছা, বল দেখি, কমলিনী! আমার স্বামী আমায় ভালবাসেন কি না।’ আমি উত্তর দিতাম, ‘সে বিষয় তুমিই বলিতে পার, আমি কেমন করিয়া জানিব?” তাহাতে হেমাঙ্গিনী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিতেন, ‘আমার’ স্বামী আর কাহাকেও ভালবাসেন বা আমার সহিত বিবাহের পূর্ব্বে অপর কাহাকে ভালবাসিতেন, এরূপ বোধ হয় কি?’ পাছে তাঁহার কোমল হৃদয়ে ব্যথা লাগে, এইজন্য আমি বলিতাম, ‘না, তা কখন সম্ভব নয়।’ কিন্তু হেমাঙ্গিনী ইহাতেও কখন কখন বিরলে অশ্রুবর্ষণ করিয়া তাপিত প্রাণ কতকটা শীতল করিবার চেষ্টা করিতেন।
‘হেমাঙ্গিনীর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব্বে একদিন তিনি আমায় বলিয়াছিলেন, ‘কমলিনী! আমার স্বামী যে অপর একজন স্ত্রীলোককে ভাল বাসেন, তাহার প্রমাণ আমি পাইয়াছি।’ তখনই আমি বুঝিয়াছিলাম যে, হেমাঙ্গিনী আর অধিক দিন বাঁচিবেন না। একে তিনি দিবারাত্রি স্বামীর কথাই চিন্তা করিতেন, তাহার উপরে এই ঘটনা জানিতে পারিয়া কি পর্য্যন্ত ব্যথিত ও মম্মাহত হইয়াছিলেন, তাহা আমি কতকটা বুঝিতে পারিয়াছিলাম, আর সেই সর্বান্তর্যামী বিধাতাই বুঝিয়াছিলেন। হেমাঙ্গিনী নিজে কিন্তু বুঝিতে পারেন নাই যে, এইরূপ চিন্তায় ধীরে ধীরে তাঁহার আয়ুঃক্ষয় হইতেছে। যজ্ঞেশ্বর বাবুর প্রতি হেমাঙ্গিনীর ঐকান্তিক স্বামীভক্তি থাকাই সকল সর্ব্বনাশের মূল।
ব্যারিষ্টার। আচ্ছা, এখন বল দেখি, যজ্ঞেশ্বর বাবু ও হেমাঙ্গিনী কি এক ঘরে শয়ন করিতেন।
কমলিনী। না।
ব্যারিষ্টার। এরূপ ভাব কত দিন হইতে দেখিয়াছিলে?
কমলিনী। যত দিন তাঁহাদের এই প্রকার মনোমালিন্য হইয়াছিল, ততদিন তাঁহারা ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে শয়ন করিতেন।
ব্যারিষ্টার। এখন তুমি পঁচিশে আষাঢ় তারিখের প্রাতঃকাল হইতে ছাব্বিশে আষাঢ় তারিখের প্রাতঃ কাল পৰ্য্যন্ত যাহা কিছু দেখিয়াছিলে বা শুনিয়াছিলে, সে সমস্ত একে একে বর্ণন কর।
কমলিনী। পঁচিশে আষাঢ় সকালবেলা হেমাঙ্গিনী আমায় ডাকিয়া বলেন যে, গত রাত্রে তিনি ভয়ানক কুস্বপ্ন দেখিয়া বড় ভয় পাইয়াছেন। সে সকল স্বপ্নের কোন অর্থ ছিল না, অথচ তাঁহার মনে হইতেছিল, যেন কি একটা ভয়ানক অনর্থ ঘটিবে। তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করেন, তাঁহার স্বামী শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াছেন কি না? তাহাতে আমি উত্তর করি যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু অনেকক্ষণ শয্যাত্যাগ করিয়াছেন এবং সকাল সকাল আহারাদির আয়োজন করিতে হুকুম দিয়াছেন। তিনি আমায় বলিয়াছেন যে, বেলা দ্বিপ্রহরের মধ্যে যখন তাঁহার স্ত্রী সুবিধা বিবেচনা করিবেন, তখন যেন একবার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন, তাঁহার কি বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা আছে। হেমাঙ্গিনী তাহাতে উত্তর করেন, ‘তুমি তাঁহাকে বল যে, আহারের পর যেন তিনি আমার ঘরে আসেন।’ আমি সেই কথা বলিবার জন্য যখন যজ্ঞেশ্বর বাবুর ঘরে যাই, তখন তিনি চুপ করিয়া বসিয়া কি ভাবিতেছিলেন। তাঁহার সম্মুখে আহারীয় সমস্তই পড়িয়া শীতল হইয়া যাইতেছিল, অথচ সেদিকে যেন তাঁহার লক্ষ্য ছিল না। তাঁহার হাতে একখানি পত্রও ছিল। মাঝে মাঝে সেইখানির লেখা দেখিতেছিলেন ও একমনে কি ভাবিতেছিলেন। আমি তাঁহার ঘরে যাইয়া তাঁহার পিছনে প্রায় পনের মিনিটকাল দাঁড়াইয়া রহিলাম, তথাপি তাঁহার চৈতন্য হইল না। অবশেষে আমি তাঁহাকে যথারীতি সম্বোধন করিয়া হেমাঙ্গিনীর অভিপ্রায় জ্ঞাপন করাতে তিনি বলিলেন, ‘আচ্ছা, আহারাদি করিয়া তাঁহার নিকট যাইব।’ হেমাঙ্গিনীকে আমি এই সকল কথা বলাতে তিনি আমায় বলিলেন, ‘আচ্ছা, এখন তোমায় আমার বিশেষ কোন প্রয়োজন নাই। তুমি কেবল দেখিও, যেন তিনি ভুলিয়া বাহিরে চালিয়া না যান।’ আমি চলিয়া আসিলাম। অর্দ্ধঘন্টা পরে আমি উপরে হেমাঙ্গিনী ও যজ্ঞেশ্বর বাবুর উচ্চ কন্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। তাঁহারা কি একটা কথা লইয়া বিবাদ করিতেছিলেন। তখনই আমি উপরে উঠিলাম। দেখিলাম, যজ্ঞেশ্বর বাবু অত্যন্ত ক্রোধভরে হেমাঙ্গিনীর ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। আমি আর তাঁহার দিকে লক্ষ্য না করিয়া হেমাঙ্গিনীর কাছে গেলাম। তাঁহার চেহারা দেখিয়াই বোধ হইল, ঝগড়াটা কিছু গুরুতর রকমেই হইয়াছিল। কেন না তিনি তখনও রাগে ফুলিতেছিলেন, হাঁপাইবার মত তাঁহার ঘন ঘন শ্বাস বহিতেছিল। আর-
ব্যারিষ্টার। (বাধা দিয়া) চুপ কর। তুমি যখন উপরে উঠিতেছিলে, তখন তুমি তাহাদের কোন কথা শুনিতে পাইয়াছিলে?
কমলিনী। ঠিক স্পষ্ট ব্যাপারটা বুঝিতে পারি নাই, তবে তাঁহারা দুইজনেই খুব রাগের সহিত উচ্চস্বরে কথা কহিতেছিলেন। আমার বোধ হইয়াছিল, যেন যজ্ঞেশ্বর বাবু হেমাঙ্গিনীকে কোন বিষয় লইয়া শাসন করিতেছিলেন।
ব্যারিষ্টার। কোন কথা শুনিতে পাইয়াছিলেন?
কমলিনী। হাঁ, হেমাঙ্গিনী খুব ক্রোধভরে বলিতেছিলেন, ‘আমি বাঁচিয়া থাকিতে কখনও তাহা হইবে না। আমি মরিয়া গেলে তুমি বাঁচ, তোমার হাড় জুড়ায়, কেমন? কিন্তু আমি এত শীঘ্র মরিতেছি না—খুন না করিলে আমি সহজে তোমায় ছাড়িয়া যাইতেছি না—তুমি মনে করিয়াছ, নির্ব্বিঘ্নে আমার বাপের বিষয় ভোগ করিবে? তাহা তুমি মনেও স্থান দিও না।’
ব্যারিষ্টার। এই কথাগুলি তুমি স্পষ্ট শুনেছ? আচ্ছা, তাহাতে যজ্ঞেশ্বর বাবু কি উত্তর করিলেন?
কমলিনী। কিছুই না, তাহাতে হেমাঙ্গিনী আরও রাগিয়া উঠিয়া আরও উচ্চস্বরে গালিগালাজ করিতে লাগিলেন।
ব্যারিষ্টার। যজ্ঞেশ্বর বাবু ত তখন রাগিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গেলেন। সমস্ত দিনের মধ্যে তাঁহাকে আর ফিরিয়া আসিতে দেখিয়াছিলে?
কমলিনী। না।
ব্যারিষ্টার। হেমাঙ্গিনী তাহার পর তোমায় কিছু বলিয়াছিলেন?
কমলিনী। অনেক কথা বলিয়াছিলেন, সব কথা এখন আমার ঠিক স্মরণ নাই। তবে একটি কথা আমার বেশ মনে আছে যে, তিনি আমায় বলিয়াছিলেন, ‘আমি এখন আমার স্বামীর চক্ষুঃশূল হইয়াছি, আমি মরিয়া গেলেই তিনি এখন বাঁচেন, সুখে-স্বচ্ছন্দে আমার বিষয়-সম্পত্তি ভোগ-দখল করিতে পারেন; তাই আমায় এত অনাদর! তাই প্রতি কথায় এত অপমান! কেন আমি কি করিয়াছি? উনি জানেন না বুঝি যে, আমার জন্য উনি এখনও টিকিয়া আছেন, আমি মনে করিলে পথে বসাইতে পারি, জেল খাটাইতে পারি—সর্ব্বনাশ করিতে পারি।’
ব্যারিষ্টার। কেন তিনি এ সকল কথা বলিয়াছিলেন, তাহার তুমি কিছু কারণ জান?
কমলিনী। হাঁ, হেমাঙ্গিনী রাগের মাথায় সেদিন আমার কাছে অনেক কথাই বলিয়া ফেলিয়াছিলেন; কিন্তু সে সব কথা গোলমাল হইয়া গিয়াছে, সব মনে পড়ে না। সে কত টাকা-কড়ির কথা—কত হেণ্ডনোটে ধারের কথা—কত দলিল-দস্তাবেজের কথা—আমি স্ত্রীলোক, সব কি মনে রাখিতে পারি?
ব্যারিষ্টার। দুই-একটা কথাও মনে পড়ে না? একটু ভাবিয়া দেখ না? এত কথা হইয়াছিল, তাহার দু-একটাও মনে পড়িবে না?
কমলিনী। হেমাঙ্গিনী আরও বলেন, “উনি সেই সব কাগজপত্র ফাঁকী দিয়া আমার কাছ থেকে লইতে চান। আমি তেমনই নির্ব্বোধ কি না, যে উনি আমার সেই কাগজগুলি ঠকিয়ে বাহির করিয়া লইবেন। যদি আমার কথা শুনিয়া চলিতেন, আমায় কিছুমাত্র অযত্ন না করিতেন, তা হলেও যাহা হয়, আমি করিতাম। যখন এত অনাদর—এত অপমান—এত পায়ে ঠেলা—তখন কখনই আমি সে সব ছাড়িয়া দিব না।’
ব্যারিষ্টার। সেদিন তুমি বরাবর হেমাঙ্গিনীর কাছে ছিলে?
কমলিনী। হাঁ।
ব্যারিষ্টার। অন্য সময়ে ঝগড়া হইলে হেমাঙ্গিনী তারপর বড় অনুতাপ করিতেন, স্বামীর জন্য সারাদিন বড় ব্যাকুল হইয়া থাকিতেন, এ কথা তুমি পূৰ্ব্বে বলিয়াছ। আচ্ছা, এ দিনে হেমাঙ্গিনীর সে প্রকার কোন ভাব দেখিয়াছিলে?
কমলিনী। তাহা হইয়াছিল বৈকি! তবে এবার আর ততটা হয় নাই। সন্ধ্যার কিছু আগে হইতে রাত্রি দশটা পৰ্য্যন্ত হেমাঙ্গিনী প্রায় আট-দশবার আমাকে তাঁহার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, প্রায়ই আধঘন্টা অন্তর তিনি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়াছেন কি না, সে সংবাদ লইয়াছিলেন।
ব্যারিষ্টার। তোমরা সেদিন কখন নিদ্রা গিয়াছিলে?
কমলিনী। দশটার পর
ব্যারিষ্টার। যখন তুমি হেমাঙ্গিনীর ঘর হইতে আসিয়া নিজের ঘরে শুইতে যাও তখন ইহা কি লক্ষ্য করিয়াছিলে যে, হেমাঙ্গিনীর শোবার খাটের পাশে একটি টিপাই ছিল, আর সেই টিপাই এর উপরে কতকগুলি জিনিষও ছিল?
কমলিনী। সে ত রোজই তাঁহার থাকিত—টিপাইটা ত বিছানার কাছেই থাকে।
ব্যারিষ্টার। টিপাই এর উপরে কি ছিল, বল দেখি।
কমলিনী। একটি ছোট শ্বেত পাথরের কুঁজোয় এক কুঁজো জল, একটি বড় কাঁচের গ্লাস, আর একটা ঔষধের শিশি।
ব্যারিষ্টার। কি ঔষধ! তাহাতে কি লেখা ছিল, তাহা জান?
কমলিনী। তাহাতে ঔষধের নাম লেখা ছিল না, তবে ইংরাজীতে লেখা ছিল ‘বিষ’। হেমাঙ্গিনীর শিরঃপীড়া রোগ ছিল বলিয়া বিশেষ কষ্ট হইলে নিদ্রার জন্য তিনি এই ঔষধ সেবন করিতেন। শিরঃ পীড়ার কষ্ট অনুভব করিতে হইবে না বলিয়াই তিনি এই ঔষধ আনাইতেন।
ব্যারিষ্টার। শিশিতে কত দাগ ঔষধ ছিল, তাহা বলিতে পার?
কমলিনী। বোধ হয়, সাত দাগ ঔষধ ছিল। কেন না, আমি জানি, এই রকম শিশিতে আট দাগ করিয়া ঔষধ থাকিত। এক দাগের বেশি হেমাঙ্গিনী কখন খাইতেন না। এই ঔষধের শিশিটা তার পূর্ব্ব দিনে আনান হইয়াছিল।
ব্যারিষ্টার। ঐ ঔষধ কতটা সেবন করিলে একটা মানুষের জীবন নষ্ট হইতে পারে, তাহা হেমাঙ্গিনী জানিতেন?
কমলিনী। জানিতেন, তিনিই একদিন আমাকে বলিয়াছিলেন যে, এই ঔষধের চারি দাগ যদি কোন লোকে একেবারে খাইয়া ফেলে, তাহা হইলে সে এমন নিদ্রিত হইবে যে, আর কখন তাহাকে সেই নিদ্রা হইতে জাগিতে হইবে না।
ব্যারিষ্টার। জানিয়া-শুনিয়া তিনি এরকম বিষ কাছে রাখিতেন কেন?
কমলিনী। তাঁহার শিরঃপীড়া এত অধিক কষ্টদায়ক হইত যে, সে সময়ে অজ্ঞান-অচৈতন্য হইবার ঔষধ ভিন্ন আর কি ব্যবহার করিবেন? বিশেষতঃ হেমাঙ্গিনী বুদ্ধিমতী ছিলেন, জীবনে তাঁহার বড় মায়া ছিল—মৃত্যুকে তিনি বড় ভয় করিতেন।
ব্যারিষ্টার। টিপাই এর উপরে আর কোন দ্রব্য থাকিত?
কমলিনী। কালি কলম ও লিখিবার কাগজ থাকিত।
ব্যারিষ্টার। তোমার শয়ন করিবার ঘর একতলায় না দোতলায়?
কমলিনী। একতলায়।
ব্যারিষ্টার। বাহির হইতে যদি কোন লোক বাড়ীর ভিতরে আসিয়া উপরে উঠিত, তাহা হইলে তোমার তাহা টের পাইবার সম্ভাবনা ছিল :
কমলিনী। হাঁ।
ব্যারিষ্টার। রাত্রে তুমি কোন্ লোকের গলার শব্দ, পায়ের শব্দ বা অন্য কোন রকম শব্দ শুনিয়াছিলে?
কমলিনী। রাত্রি সাড়ে বারটা পর্যন্ত আমার ঘুম হয় নাই। আমি আমার ঘরে বসিয়া একখানি বই পড়িতেছিলাম। সেই সময়ে বাহিরে সদর দরজা খোলার শব্দ আমি শুনিতে পাই। একখানি গাড়ী দরজায় আসিয়া লাগিল এবং চলিয়া গেল, তাহাও আমি অনুভবে জানিতে পারি। আমার ঘরের দরজা একটু ফাঁক করিয়া আমি দেখিতে পাই যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু ফিরিয়া আসিলেন। তিনি আসিয়া প্রথমেই হলঘরে প্রবেশ করেন।
ব্যারিষ্টার। তুমি আর কিছু দেখ নাই?
কমলিনী। না।
ব্যারিষ্টার। আর কোন প্রকার শব্দ শুন নাই?
কমলিনী। শুনিয়াছিলাম। যজ্ঞেশ্বর বাবু এত রাত্রে কেন বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলেন, তিনি হলঘরে প্রবেশ করিয়া কি করিতেছেন, এই সকল জানিবার জন্য আমার বিশেষ কৌতূহল হওয়াতে আমি সিঁড়ীর পাশে অন্ধকারে লুকাইয়া দাঁড়াইয়া থাকি। অনেকক্ষণ ধরিয়া আমি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে সে ঘর হইতে বাহির হইতে দেখি নাই। তাহার পর আমি দেখিতে পাই যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু চোরের ন্যায় নিঃশব্দে উপরে উঠিতেছেন। তাঁহার তখনকার অবস্থা দেখিয়া আমার মনে সন্দেহ হয়। নিজের বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া দ্বিতলে উঠিতে, তিনি এত ভয়ে ভয়ে পা টিপিয়া নিঃশব্দে উপরে উঠিতেছেন দেখিয়া, আমার মনে হয় যে, নিশ্চয় তাঁহার মনে কোন দুরভিসন্ধি আছে; অথবা তিনি যে বাড়ী ফিরিয়া আসিয়াছেন, এ কথা যাহাতে কেহ জানিতে না পারে, ইহাই তাঁহার অভিলাষ ছিল। আমার মনে সেই সময়ে কত প্রকার সন্দেহের উদয় হইয়াছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না।
ব্যারিষ্টার। যাক্, তোমার সন্দেহের কথা ছাড়িয়া দাও। যজ্ঞেশ্বর বাবুর পশ্চাতে আর কাহারও পদশব্দ তুমি লক্ষ্য করিয়াছিলে?
কমলিনী। তাহা আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না। তাঁহার সঙ্গে যে অন্য কোন লোক উপরে উঠিবেন, এ কথা আমার মনে একবারও উদয় হয় নাই। তবে ভাবগতিক দেখিয়া আমার মনে কেমন এক প্রকার আতঙ্ক উপস্থিত হওয়াতে আমি তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের ভিতরে গিয়া দরজায় অর্গল বদ্ধ করি।
ব্যারিষ্টার। তারপর তুমি আর কিছু শুনিতে পাও?
কমলিনী। হাঁ, উপরের ঘরের দরজা খোলার শব্দ পাই। অনেকক্ষণ পরে আবার যেন কে সিঁড়ী দিয়া নীচে নামিয়া আসিতেছে, আমার এইরূপ অনুমান হয়। তাহার পরেই সদর দরজা খোলা এবং পুনরায় দেওয়ার শব্দ আমার কানে গেল। মনে তখন এত ভয় হইয়াছিল যে, ঘরের বাহির হইয়া দেখিবার সাহস আমার হয় নাই। সেই ভয়েই আমি নিদ্রিত বা অচৈতন্য হইয়া পড়ি। প্রায় রাত্রি চারিটার সময়ে আমার নিদ্রাভঙ্গ হয়। তখন চারিদিক অন্ধকার। বাড়ীতে কোন প্রকার সাড়া-শব্দ নাই। আমার মনে একটু সাহস হওয়াতে আমি তাড়াতাড়ি একটা বাতী জ্বালিয়া সদর দরজা খোলা আছে কি না দেখিতে যাই।
ব্যারিষ্টার। হলঘরের সম্মুখ দিয়া তুমি সদর দরজার দিকে গিয়াছিলে?
কমলিনী। হাঁ।
ব্যারিষ্টার। আষ্টার কোট, টুপি, ছড়ি, জুতা প্রভৃতি রাখিবার র্যাক্ হলঘরের বহির্দেশে কোন্দিকে অবস্থিত, তাহা তুমি বলিতে পার?
কমলিনী। হলঘর হইতে বাহির হইতে বামে এবং হলঘরে প্রবেশ করিতে দক্ষিণে।
ব্যারিষ্টার। সদর দরজার দিকে যাইবার সময়ে সেদিকে তোমার নজর পড়িয়াছিল?
কমলিনী। পড়িয়াছিল।
ব্যারিষ্টার। কি দেখিয়াছিলে?
কমলিনী। যজ্ঞেশ্বর বাবুর আষ্টার কোটটি সেই আনায় ঝুলান রহিয়াছে, দেখিতে পাইয়াছিলাম।
ব্যারিষ্টার। সে আষ্টার কোটটি এখন দেখিলে তুমি চিনিতে পার?
কমলিনী। পারি। সে রকম কাপড়ের কোট প্রায় অন্য কোন সাহেবের গায়ে দেখা যায় না। সে এক রকম নূতন রং এর চমৎকার বনাত।
ব্যারিষ্টার। তখন একটি আষ্টার কোট কমলিনীকে দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বল দেখি, এইটিই সেই কোট কি না।”
উত্তর। হাঁ, এইটিই বটে।
প্রশ্ন। টুপিটিও কি তুমি সেই সময়ে আনায় থাকিতে দেখিয়াছিলে?
উত্তর। না, টুপিটি সে সময়ে আনায় ছিল না।
প্রশ্ন। তুমি সদর দরজায় গিয়া কি দেখিলে?
উত্তর। যাহা অনুমান করিয়াছিলাম তাহাই। সদর দরজা অর্গলবদ্ধ ছিল না। যজ্ঞেশ্বর বাবু প্রতিদিনই অধিক রাত্রে বাড়ী ফিরিয়া আসিতেন, আর নিজে সদর দরজা অর্গলবদ্ধ করিয়া উপরে উঠিতেন। চাকরেরা তত রাত্রি পর্য্যন্ত কেহই জাগিয়া থাকিত না। সুতরাং তিনি যখন বাড়ী ফিরিয়া আসিতেন, তখনই তিনি নিজ হস্তে সদর দরজা অর্গলবদ্ধ করিতেন। আমি পূর্ব্বে যে সদর দরজা খোলা ও দেওয়ার শব্দ পাইয়াছিলাম, সেটা যে সত্য, তাহা আমার এতক্ষণ পরে স্থিরসিদ্ধান্ত হইল। আমি ভাবিলাম যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু তবে যথার্থই বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছেন।
ব্যারিষ্টার। তারপর তুমি যাহা কিছু দেখিয়াছিলে বা শুনিয়াছিলে, সব বলিতে থাক।
কমলিনী। আমার মনের সন্দেহ ঘুচাইবার জন্য তখন আমি সদর দরজা হইতে ফিরিয়া আসিয়া উপরে উঠিলাম। যজ্ঞেশ্বর বাবুর ঘরের দরজা বন্ধ ছিল না। আমি তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিলাম। সে ঘরে তখন কেহই ছিল না—যজ্ঞেশ্বর বাবুও ছিলেন না। শয্যার কাছে গিয়া ভাল করিয়া আলো ধরিয়া দেখিলাম, তাঁহার শয্যায় কেহ নাই। বিছানা যেমন পরিষ্কার, তেমনই রহিয়াছে; কেহ যে সে বিছানায় সে রাত্রে শয়ন করিয়াছিল, এরূপ কোন চিহ্ন দেখিলাম না। তখন সে ঘর হইতে বাহির হইয়া হেমাঙ্গিনীর ঘরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, তিনি শয্যায় মৃতবৎ পড়িয়া আছেন, তাঁহার নিশ্বাস-প্রশ্বাস রহিত হইয়াছে। মনে অত্যন্ত ভয় হইল। তাঁহাকে দুই-তিনবার ডাকিলাম, কোন উত্তর পাইলাম না। ধাক্কা মারিয়া দেখিলাম, তাহাতে তাঁহার চৈতন্য হইল না। তাঁহাকে উঠাইয়া শয্যায় বসাইতে চেষ্টা করিলাম, মৃতদেহের ন্যায় তাঁহার মাথা একপাশে হেলিয়া পড়িল। তাহার পরে যে কি কি ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহা আর আমি বলিতে পারি না। এই পর্য্যন্ত আমার মনে পড়ে যে, হেমাঙ্গিনীকে শয্যায় শয়ন করাইয়া দিয়া আমি চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠি; সেই চীৎকারে চাকর, লোকজন, দাস দাসী সকলেই জাগরিত হইয়া ছুটিয়া উপরে আসে এবং ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করাতে আমি তাহাদিগকে হেমাঙ্গিনীর মৃতদেহ দেখাইয়া দিই।
ব্যারিষ্টার। আচ্ছা, তোমার এমন কথা কিছু মনে পড়ে যে, যখন তুমি চীৎকার করিয়া কাঁদিতেছিল, তখন বলিয়াছিলে যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু হেমাঙ্গিনীকে খুন করিয়াছেন?
কমলিনী। না, মনে পড়ে না, তবে আমার মুখ থেকে এ রকম কথা বাহির হওয়াও কিছু বিচিত্র নয়। যজ্ঞেশ্বর বাবু হেমাঙ্গিনীকে কি চক্ষে দেখিতেন, তাহা আমি জানিতাম; সেইদিন যজ্ঞেশ্বর বাবুর সঙ্গে হেমাঙ্গিনীর কি প্রকার বিবাদ হইয়াছিল, তাহাও শুনিয়াছিলাম; যজ্ঞেশ্বর বাবু অধিক রাত্রে নিঃশব্দে পা টিপিয়া উপরে উঠিয়াছিলেন এবং পুনরায় বাড়ীর বাহির হইয়া গিয়াছিলেন। এ সকল দেখিয়া-শুনিয়া আমার প্রথমেই তাঁহার উপরে সন্দেহ হইয়াছিল; সুতরাং তিনিই যে খুন করিয়াছেন, এ কথা যদি আমি বলিয়া থাকি, তাহাও কিছু বিচিত্র নয়।
ব্যারিষ্টার। তার পর যজ্ঞেশ্বর বাবুর একজন চাকর ছুটিয়া পুলিসে যায় এবং কিয়ৎক্ষণ পরে হরিদাস গোয়েন্দা তথায় আসিয়া উপস্থিত হন। হেমাঙ্গিনীর মৃতদেহ দেখিয়া তিনি প্রথমেই কি প্ৰশ্ন করিয়াছিলেন?
কমলিনী। তখন আমি কতকটা সুস্থ হইয়াছি। তিনি আমাকেই প্রথমে জিজ্ঞাসা করেন, এ ঘরের যেখানে যে জিনিষটি ছিল, সেইখানে সেই জিনিষটি এখনও ঠিক আছে কি না দেখ! আমি তাঁহার কথায় ঘরের চারিদিকে চাহিয়া দেখি। তিনি আমার পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘ঘরের কোন জিনিষ নড়িয়াছে কি?’ আমি উত্তর করি, “না কোন জিনিষ নড়ে নাই।’
ব্যারিষ্টার। যখন তুমি উত্তর দিয়াছিলে, তখন টেবিলের দিকে কি তোমার লক্ষ্য ছিল?
কমলিনী। সব জিনিষই ছিল, কেবল শিশিতে ঔষধ ছিল না।
ব্যারিষ্টার। হরিদাস গোয়েন্দার কাছে তুমি এ কথার কিছু উল্লেখ করিয়াছিলে?
কমলিনী। বোধ হয়, করিয়াছিলাম।
ব্যারিষ্টার। আচ্ছা, পঁচিশে আষাঢ় তারিখের দিনের বেলায় হেমাঙ্গিনী তোমায় অনেক দলিল-দস্তাবেজ হ্যাণ্ডনোট প্রভৃতির কথা বলিয়াছিলেন। তুমি সে সম্বন্ধে আর কিছু জান?
কমলিনী। না।
ব্যারিষ্টার। তুমি বলিতে পার, হেমাঙ্গিনীর মৃত্যুর পর আজ পর্য্যন্ত কোন কাগজ-পত্র বেরিয়েছে কি না?
কমলিনী। তাহা আমি বলিতে পারি না।
ব্যারিষ্টার। যজ্ঞেশ্বর বাবু বাড়ী ফিরিয়া আসিলেন কখন?
কমলিনী। বেলা সাতটার সময়ে।
ব্যারিষ্টার। যখন তিনি ফিরিয়া আসিলেন, তখন তাঁহার গায়ে কোন ওভার কোট ছিল কি?
কমলিনী। না।
ব্যারিষ্টার। তখন তাঁহার চেহারা কি রকম ছিল?
কমলিনী। খুব খারাপ! সারা রাত্রি নেশা করিয়া জাগিয়া থাকিলে যে রকম চেহারা হয়, সেই রকম। চুল উস্কো-খুস্কো, অপরিষ্কার; চক্ষু দুটি লালবর্ণ, আর—
ব্যারিষ্টার বলিলেন, “থাক, আর কিছু বলিতে হইবে না, ইহাই যথেষ্ট হইবে, আর আমি কিছু জানিতে চাহি না।”
কোম্পানীর তরফের ব্যারিষ্টার বসিলে বিচারপতি বন্দী যজ্ঞেশ্বরের দিকে চাহিলেন। যজ্ঞেশ্বর নিজ পক্ষসমর্থনের জন্য পূর্ব্ব হইতে যে প্রকার ভাব অবলম্বন করিয়াছিলেন, এবারও সেই প্রকার ভাব দেখাইলেন। অতি সামান্য দু-একটি প্রশ্ন করিয়াই তিনি ক্ষান্ত হইলেন।
তিনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি বলিয়াছ যে, পঁচিশে আষাঢ় তারিখে আমার সহিত আমার স্ত্রী হেমাঙ্গিনীর একটা বিশেষ বিবাদ হয়। সে বিবাদে আমি তাঁহাকে শাসিয়ে শাসিয়ে ভয় দেখিয়ে যেন কোন কথা বলিয়াছিলাম। আচ্ছা, এ রকম ভাবে ভয় দেখান বা শাসান, আর পূর্ব্বে কথন শুনিয়াছিলে?”
কমলিনী। অনেকবার শুনিয়াছিলাম, কিন্তু এত উচ্চস্বরে আপনাদের উভয়কে কথা কহিতে আর কখনও আমি শুনি নাই।
যজ্ঞেশ্বর। তুমি জান, তোমার কথার উপরে আমার জীবন-মরণ নির্ভর করিতেছে?
কমলিনী। জানি।
যজ্ঞেশ্বর। আর তুমি যে রকম ভাবে এজেহার দিয়াছ, তাহাতে আমার ফাঁসী বা দ্বীপান্তর দণ্ড হইতে পারে?
কমলিনী। তাহা আমি অত-শত জানি না। আমি যাহা প্রকৃত ঘটনা তাহাই বলিয়াছি।
যজ্ঞেশ্বর। আচ্ছা, এমন কি হইতে পারে না যে, আমার উপরে তোমাদের উভয়ের বিষদৃষ্টি ছিল বলিয়া তুমি আমাকেই অকারণ হত্যাকারী বলিয়া সন্দেহ করিয়াছ?
কমলিনী। না, তাহা কিছুতেই হইতে পারে না। আমি আপনার বিপক্ষে সাজিয়ে কোন প্রকার মিথ্যাকথা বলি নাই। আপনার দণ্ড হয়, এমন ইচ্ছাও আমার নয়, তবে আদালতের সম্মুখে হলফ্ করিয়া আমি মিথ্যাকথা বলিতে পারি না বলিয়াই যাহা প্রকৃত ঘটনা, যাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি বা স্বকর্ণে শুনিয়াছি, সেইগুলিই যথাযথ বলিয়াছি।
যজ্ঞেশ্বর। আচ্ছা, আমি যখন রোষভরে হেমাঙ্গিনীর কক্ষ হইতে বাহির হইয়া আসি, তখন তিনি বলিয়াছিলেন, ‘আমি বাঁচিয়া থাকিতে কখনও তাহা হইবে না। আমি মরিয়া গেলে তুমি বাঁচ, আমি এত শীঘ্র মরিতেছি না! খুন না করিলে আমি সহজে তোমায় ছাড়িতেছি না! তুমি মনে করিতেছ, নির্ব্বিয়ে আমার বাপের বিষয় ভোগ করিবে, তাহা তুমি মনেও স্থান দিও না।’ এ সকল কথা তুমি স্পষ্ট শুনিয়াছিলে?
কমলিনী। হাঁ, এ সকল কথা আমি স্পষ্ট শুনিয়াছিলাম।
যজ্ঞেশ্বর। তুমি অনেক রাত্রে আমায় পা টিপিয়া টিপিয়া নিঃশব্দে চোরের মত বাড়ীর ভিতরে ঢুকিতে দেখিয়াছিলে, এ কথা কি সত্য?
কমলিনী। হাঁ।
যজ্ঞেশ্বর। তুমি নিশ্চয় বলিতে পার, সে লোক আমিই, আর তুমি আমাকে ভিন্ন অন্য লোককে দেখ নাই?
কমলিনী। হাঁ, আমি আপনাকে স্পষ্ট দেখিয়াছিলাম।
যজ্ঞেশ্বর বাবু যেন কতকটা ঘৃণার সহিত—যেন কতকটা বিরক্তভাবে বলিলেন, “তোমার জিজ্ঞাসা করিবার আর আমার কিছুই নাই।”
এই সময়ে আদালত ভঙ্গ হইল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – ইংরাজী দৈনিক সংবাদপত্র হইতে অনুদিত
“বিগত কল্যের মোকদ্দমার বিবরণী।” শীর্ষক যে বিস্তৃত প্রবন্ধ, পরদিন দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহা উদ্ধৃত হইল;–
“গত কল্য রাত্রি দশ ঘটিকার সময়ে স্ত্রী হত্যাপরাধে অপরাধী শ্রীযজ্ঞেশ্বর মিত্রের মোকদ্দমার অতি অন্যায় ও আশ্চর্য্যজনক নিষ্পত্তি হইয়া গিয়াছে। এই মোকদ্দমায় সাধারণের যে কত আগ্রহ হইয়াছিল, তাহা আদালতে বহু সংখ্যক লোকের জনতা দ্বারা বিশেষ প্রতীয়মান হইয়াছিল। শুনা যায়, স্থানাভাবে অনেক ভদ্রলোক পিয়াদাগণের দ্বারা বিতাড়িত হইয়া ক্ষুণ্নমনে গৃহে ফিরিয়াছিলেন।
“পরশ্বঃ দিবস সন্ধ্যার সময়ে আসামীর বিপক্ষের সমুদয় সাক্ষীর জবানবন্দী ও জেরা শেষ হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং গত কল্য সকলেই আসামীর সাফাই শুনিবার জন্য নিতান্ত উৎসুক হইয়াছিল।”
“বন্দী যজ্ঞেশ্বর মিত্র, জজ ও জুরিগণকে যথারীতি সম্বোধন করিয়া আত্মপক্ষসমর্থন করিতে দণ্ডায়মান হইলেন। আসামী পূৰ্ব্ব হইতে যে ভাব অবলম্বন করিয়াছিলেন ও যেরূপে তিনি আপনার পক্ষসমর্থন করিয়া আসিতেছিলেন, তাহাতে সকলেই বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়াছিলেন। বন্দি বিচারপতি ও জুরিগণকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন;
“আমার বিরুদ্ধে যাহারা সাক্ষ্য দিয়াছে, তাহারা সকলেই তাহাদের নিজের বিবেচনায় যথাযথ বিবরণ বিবৃত করিয়াছে। কেহই বিদ্বেষ বা ঈর্ষার বশীভূত হইয়া আমার বিরুদ্ধে অভিযোগকে গুরুতর করিতে প্রয়াস পায় নাই। তবে যাহাদের উক্তিতে দুই-একটি সত্যের অপলাপ হইয়াছে বা যাহা দুই-একটি অনৈক্য প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা ভ্রম বশতঃই হইয়াছে বলিতে হইবে। আর আমার স্ত্রী হেমাঙ্গিনীর সহচরী কমলিনী তো আমার বিপক্ষে বলিবেই। কারণ তাহাদের উভয়ের মধ্যে কেহই আমায় ভালচোখে দেখিত না। আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকিয়া বোধ হয়, কমলিনীরও এ বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, আমি অত্যন্ত দুর্বৃত্ত। কাজে কাজেই তাহার যেমন বিশ্বাস, সে তেমনই সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে।”
“মনুষ্য অবস্থার দাস। ঘটনাক্রমে অদৃষ্টচক্রে নানা বিভীষিকা দর্শন ও ভোগ করিতে হয়। তাহাই গ্রহবৈগুণ্যবশতঃ আমি আজ নিৰ্দ্দোষ হইয়াও দোষীরূপে সাধারণ্যে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হইতেছি; কিন্তু ইহা জগতের ইতিহাসে প্রথম বা অভিনব নয়। এইরূপ ঘটনা অনেক ঘটিয়াছে ও ভবিষ্যতে যে ঘটিবে না, তাহাও নহে।”
“উপস্থিত অভিযোগে আমার সম্ভ্রম ও আমার মর্য্যাদা এরূপভাবে বিজড়িত যে, আমার কোন উত্তর না দেওয়াই কৰ্ত্তব্য। আরও, আমার অধিক বলিবারই বা কি আছে? আমার বিরুদ্ধে প্রদত্ত সাক্ষ্যসমূহ আমাকে নিশ্চয়ই ভীষণ পাতকী বলিয়া সাব্যস্ত করিবে। তবে সেই সর্ব্বদ্রষ্টা ও শ্রেষ্ঠ বিচারক জগদীশ্বরের সমক্ষে আমি নিৰ্দ্দোষ। আমার বর্ত্তমান বিচারকগণকে আমি কেবলমাত্র ইহাই বলিব যে, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং আমার বিচারপতিগণের মত আমিও এই হত্যাসম্বন্ধে একেবারে অসম্পৃক্ত।”
“আমার সাপক্ষে আমি এইমাত্র বলিব যে, আমার চরিত্র ও আচার ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করিলে অনেকেই মুক্তকন্ঠে বলিবেন, এরূপ মহাপাপ আমার দ্বারা হয় নাই। শুনিয়াছি, দণ্ডলাঘবের জন্য অনেক সময়ে অপরাধীরা আপনাপন চরিত্রের সততা সপ্রমাণ করিতে সচেষ্ট হয়; আমার উদ্দেশ্য তাহা নহে। কারণ সেরূপ করিতে যাইলেই প্রমাণ হইল যে, আমি দোষী, নতুবা দণ্ডাহ হইব কেন? আমার বিচারকগণ আমার এই বাল-সুলভ যুক্তি, তর্ক শুনিয়া হাস্য করিতে পারেন; কিন্তু আমি ইহা ভিন্ন আর কি বলিব? বিধাতা আমার প্রতি বিষম বিমুখ।”
“আমি ও আমার স্ত্রী যে পরস্পর বিশেষ মনোমালিন্যের সহিত কালযাপন করিয়াছি, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই; কিন্তু আমি আমার এই জীবনের শেষ মুহূর্ত্তেও উচ্চকন্ঠে বলিব যে, আদালতে সাধারণ জনগণের সম্মুখে কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কুলকাহিনী প্রকাশ করা অতীব অন্যায়। আর উকীল ব্যারিষ্টারগণেরও এইরূপ কুলকাহিনী সম্বন্ধে প্রশ্ন করিবার ক্ষমতা আছে কি না, সে বিষয়েও আমার বিশেষ সন্দেহ আছে। বর্তমান বিপদ অপেক্ষা সহস্র গুণ অধিক বিপদগ্রস্ত হইলেও আমি এই মোকদ্দমার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বিচারাধীন করিব না, এবং তাঁহাদের বংশমর্য্যাদার হানিকর গুপ্ত কুলকাহিনী সাধারণ্যে উপস্থিত করিয়া তাঁহাদিগকে অপমানিত করিব না।
“আমার যে কি দণ্ডবিধান হইবে, তাহা আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছি। আপনাদিগকে নিন্দা করা অতিশয় নীচের কর্ম্ম। কারণ যদি আমি আজ বিচারপতি হইতাম ও আপনারা আমার ন্যায় আসামী বলিয়া গণ্য হইতেন, তাহা হইলে আমিও আপনাদের ন্যায় এইরূপই বিচার করিতাম; কিন্তু ইহাও স্থির জানিবেন যে, যদিও আপনারা আইনের চক্ষে দোষীর দণ্ড বিধান করিতেছেন—ঈশ্বরের চক্ষে আপনারা নিরপরাধের দণ্ড দিতেছেন। অধিক আর কিছু আমার বলিবার নাই। যদি আমার ন্যায় ক্ষুদ্র কীটের জীবননাশ করিলেই মঙ্গলময়ের সদিচ্ছা সুসাধিত হয়, তবে তাহাই হউক।”
“দায়রা আদালতে এরূপ নতুন ধরনের তর্ক-প্রণালী ইতিপূর্ব্বে আর কখন শ্রুত হয় নাই। আসামীর বিপক্ষের অভিযোগ অতি গুরুতর হইলেও তাঁহার আত্মপক্ষসমর্থনের যুক্তি অতি অকিঞ্চিৎকর; কিন্তু আসামীর এই কাতর অথচ নির্ভীক বক্তৃতায় অনেকের হৃদয়ের অন্তস্থলে সহানুভূতির স্রোত বেগে প্রবাহিত হইতেছিল। সুতরাং তাঁহার কথা শেষ হইলেই আদালত গৃহের সকলেই তাঁহার প্রতি সকরুণ দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন, এবং নানামতে তাঁহার অন্তরে আশা ও ভরসা সঞ্চারিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।”
“কিয়ৎকাল নিস্তব্ধতার পর কোম্পানী-পক্ষের ব্যারিষ্টার–আসামীর বিপক্ষে অভিযোগ বিশেষরূপে সপ্রমাণ করিবার জন্য উত্থিত হইলেন ইতিপূর্ব্বে আসামীর করুণোত্তিতে দর্শকগণের অন্তঃ করণে যে দয়ার উদ্রেক হইয়াছিল, বিচক্ষণ ব্যারিষ্টারের কুট যুক্তিস্রোতে তাহা ভাসিয়া গেল। ব্যারিষ্টারের বক্তৃতা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হইল; –”
“বৰ্ত্তমান মোকদ্দমায় আমার বক্তৃতা যে বিশেষ বিস্তৃত হইবে, তাহা বিবেচনা করিবেন না। আসামীর বিরুদ্ধের সাক্ষীগণের এজেহারেই তাঁহার পাপের বিশেষ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে; সুতরাং মোকদ্দমা আর জটিল নাই, অপেক্ষাকৃত সরল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমার কর্ত্তব্য, আমি যথারীতি পালন করিব, এবং পালন করিতে যাইয়া কাহারও প্রতি কঠিন বা অমানুষিক ব্যবহার করা আমার উদ্দেশ্য নয়।”
“সাক্ষিগণ সকলেই আসামীর অপরাধ-প্রমাণোপযোগী ঘটনা বিবৃত করিয়াছেন। আসামীও এই সাক্ষীর জবানবন্দীর বিরুদ্ধে দুই-এক স্থল ব্যতীত কোন কথা বলেন নাই; সুতরাং তাহাদের সাক্ষ্যে যে কোন অপ্রকৃত কথা নাই; তাহা সকলেই বুঝিতে পারিতেছেন। আসামী বক্তৃতায় অস্পষ্টভাবে আরও কতকগুলি লোকের প্রতি ইঙ্গিত করিয়াছেন; কিন্তু তাহাদের সম্বন্ধেও তিনি কোন কথা বলিতে বা আদালতকে কোনরূপ সাহায্য করিতে প্রস্তুত নহেন। আর তিনি বলিয়াছেন যে, সাক্ষিগণের জবানবন্দীরও কতকগুলি অংশ সম্বন্ধে সত্যের অপলাপ হইয়াছে, কিন্তু সে সকল স্থলের বিশেষ উল্লেখ করেন নাই।”
“আসামী সাক্ষিগণের সাক্ষ্যে যে সকল কথায় সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন; কিন্তু স্পষ্টরূপে যাহা অস্বীকার করেন নাই, সেই বিষয় আমি এখন জজ ও জুরিগণের বোধার্থ আদালতের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি।”
“প্রথমতঃ আষ্টার কোট সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, যেদিন আসামীর কোচম্যান খোদাবক্স তাঁহাকে গাড়ী করিয়া শহরের নানা স্থানে ঘুরাইয়া লইয়া বেড়াইয়াছিল, সেইদিন তিনিই ঐ আষ্টার পরিয়াছিলেন; এ কথা আসামী অস্বীকার করিতেছেন না। তিনি কোচম্যানের সাক্ষ্যের বিষয়ে এই প্ৰশ্ন করিতেছেন যে, যখন তিনি ঠঠনের হোটেল হইতে বাহির হইয়া গাড়ীতে উঠিলেন ও যখন রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময়ে গাড়ীতে পৌঁছিয়া গাড়ী হইতে নামিলেন, তখনও তাঁহার অঙ্গে সেই আষ্টার কোট ছিল কি না? কোচম্যানের সাক্ষ্যে এরূপ প্রশ্ন করিবার উদ্দেশ্য আমি বুঝিতে পারিলাম না, তবে আমার এইরূপ মনে হইতেছে যে, আসামী জজ ও জুরিগণকে এরূপ বিশ্বাস করাইতে চাহেন যে, বারটা বাজিতে দশ মিনিট পূর্ব্বে যে ব্যক্তি গাড়ীতে উঠিয়াছিল, সে অন্য কেহ হইবে এবং আসামীর সহিত তাহার কোন সংস্রব নাই। সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁহার বাড়ীর নিকটে গাড়ীতে নামিয়া বাড়ীর দরজা খুলিয়াছিল, তিনিও আমাদের সম্মুখের এই আসামী নহেন। আচ্ছা, তর্কের অনুরোধে স্বীকার করিলাম, আসামীর এইরূপ যুক্তি সত্যমূলক, তবে আসামী এখন বলুন দেখি, পঁচিশে আষাঢ় রাত্রি বারটা বাজিতে দশ মিনিট হইতে ছাব্বিশে আষাঢ় প্রাতঃকাল সাতটা পর্য্যন্ত তিনি কোথায় ছিলেন, আর কি করিয়াছিলেন? নিশ্চয় এই সময়ের মধ্যে কোন-না-কোন ব্যক্তির সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়া থাকিবে। যদি এরূপ কোন ব্যক্তিকে সাক্ষী স্বরূপে আদালতে উপস্থিত করিতে পারিতেন, তাহা হইলে তাঁহার কথা কতকটা সত্য বলিয়া বোধ হইত; এবং তিনি যে ঘটনাক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিলেন, তাহারাও কতকটা প্রমাণ পাওয়া যাইত। আমার মতে যদি এরূপ কোন ব্যক্তি আদালতে আসিয়া সাক্ষ্য দিত, তাহা হইলে কোন জজ এবং জুরী আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করিতে পারিতেন না। কারণ বস্তুতঃ তাহা হইলে ইহাই সপ্রমাণ হইত যে, পঁচিশে আষাঢ় বেলা এগারটার পর হইতে ছাব্বিশে আষাঢ় প্রাতঃকাল সাতটা পৰ্য্যন্ত আসামী ও তাঁহার স্ত্রীর পরস্পর সাক্ষাৎ হয় নাই এবং যখন এই সময়ের মধ্যে হতভাগিনী হেমাঙ্গিনীর মৃত্যু হইয়াছে, তখন আসামীর সে ক্ষেত্রে উপস্থিতি একরূপ অসম্ভব হইত। সুতরাং আসামীও নিরপরাধ সপ্রমাণ হইত। এরূপ সাক্ষী যথার্থ থাকিলে তাহা আদালতে উপস্থিত করা অতিমাত্র সহজ হইত; কিন্তু যাহার অস্তিত্ব নাই, তাহার আগমন কিরূপে সম্ভব হইতে পারে? সুতরাং তাহাকে উপস্থিত করিবার চেষ্টার কথা দূরে থাক্, আসামীর বক্তৃতায় তাহার উল্লেখ মাত্র নাই। ইহা হইতে বিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই বুঝিতে পারিতেছেন যে, আসামী এইরূপে কোচম্যানের সাক্ষ্য বিষয়ে প্রশ্ন করিয়া বৃথা সন্দেহ উত্থাপন করিতে যত্ন করিতেছিলেন। বিপদসাগরে বুদ্ধিভ্রংশ হওয়ায় তিনি তৃণ ধরিয়া ভাসিতে আয়াস পাইতেছিলেন, ইহা অস্বাভাবিক নহে।”
“সাক্ষীগণের অন্যান্য জবানবন্দী সম্বন্ধে সংক্ষেপে দুই-এক কথা বলিতেছি। এই সকল বিষয়ে আসামী নিজ বক্তৃতায় ইঙ্গিতে সন্দেহ প্রদর্শন করিয়াছেন মাত্র, কিন্তু স্পষ্ট কোন কথা বলেন নাই। উদাহরণস্বরূপ বলিতেছি;–আসামী গোলদীঘী হইতে একটি স্ত্রীলোককে সঙ্গে করিয়া লইয়া ঠনঠনের হোটেলে যান। এই স্ত্রীলোকটিকে তিনি তথায় আহারাদি করিতে অনুরোধ করেন; কিন্তু বস্তুতঃ উভয়েই ঐ আহারীয় সামগ্রীর এক রকম বিন্দু-বিসর্গও স্পর্শ করেন নাই। ইহা হইতে বেশ প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে যে, যদিও উভয়ে আহারের ভাণ করিয়াছিলেন, তথাপি তৎকালে তাঁহারা অন্য কোন বিষয়ে বিশেষ ব্যস্ত ছিলেন। এই স্ত্রীলোক সম্বন্ধে যে প্রমাণ ও সাক্ষ্য পাওয়া গিয়াছে, তাহা অকাট্য; এবং এই স্ত্রীলোকটির অস্তিত্ব বিষয়েও সন্দেহ করা নিতান্ত নির্ব্বোধের কার্য্য। ইহা কোনরূপ উপদেবতা বা কল্পিত প্রাণী নহে, রক্তমাংসনির্ম্মিত শরীরধারিণী। পুলিশ বিশেষ তদন্ত করিয়াও এই স্ত্রীলোকটির কোন সন্ধান করিতে পারেন নাই। ইহা হইতে এরূপ সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে যে, স্ত্রীলোকটি পাছে আসামীর সহিত ঘনিষ্ঠতা হেতু দণ্ডিত হয়, এই ভয়ে কোন স্থানে লুক্কায়িত আছে। আসামীও তাহার অস্তিত্ব বা তাহার সহিত কয়েক ঘন্টা একত্র অতিবাহিত করা বিষয়ে আপত্তি করেন নাই। আসামীই যদি প্রকৃত নিদোষই হইবেন, তবে এই স্ত্রীলোককে আদালতে আনিয়া তাঁহার দোষহীনতা সপ্রমাণ করিবার পক্ষে কি বিশেষ বাধা থাকিতে পারে? যদি সেই স্ত্রীলোকও নিদোষ হন, তবে আদালতে আসিয়া তাঁহার নিজের ও আসামীর নির্দোষতা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিলে কি ক্ষতি হইতে পারে?”
“আসামী তাঁহার সাফাইয়ে সম্ভ্রম ও মর্য্যাদার কথা বলিয়াছেন। এবং বোধ হয়, এই সম্ভ্রমবোধই তাঁহাকে তাঁহার পাপকর্ম্মের সাহায্যকারিণী স্ত্রীলোকটিকে বিচারাধীন না করিতে বলিয়া দিতেছে। এই সম্ভ্রমবোধেই তিনি তাঁহার সাফাইয়ে অভিনব ও নূতন তর্ক সমূহের অবতারণা করিয়াছেন; কিন্তু এই মর্য্যাদাবোধ যদি তাঁহার হতভাগিনী স্ত্রীর প্রতি তিনি প্রদর্শন করিতেন, তাহা হইলে বড়ই সুখের বিষয় হইত।”
“বিবাহের পর যজ্ঞেশ্বর বাবু ও তাঁহার স্ত্রী উভয়ের মধ্যে যে বিশেষ প্রণয় বর্ত্তমান ছিল না, তাহা ইতিপূৰ্ব্বেই কথিত হইয়াছে। এই ঘটনা হইতে সকলেই বেশ অনুমান করিয়াছেন যে, আসামীর অর্থলালসাই এই পরিণয়ের মূল অভিপ্রায় ছিল। স্ত্রীর মৃত্যুতে যে তিনি অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারী হইবেন, ইহাও তিনি জানিতেন; সুতরাং হেমাঙ্গিনীকে হত্যা করিবার উদ্দেশ্যও দেখা যাইতেছে। পাপের ইতিহাসে অর্থলোভে আপনারা স্ত্রীকে হত্যা করার যথেষ্ট উদাহরণও রহিয়াছে।”
“যজ্ঞেশ্বর বাবু একজন শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তিনি নিজের বর্তমান অবস্থা বিশেষরূপে অনুভব করিতে পারিতেছেন। বাহিরে তিনি যতই গাম্ভীৰ্য্য দেখান না কেন, তাঁহার হৃদয়ে যে বিষম অনুতাপানল প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।”
“আমার আর অধিক কিছু বলিবার নাই। তবে মহামান্য জুরিগণের প্রতি আমার এই বিনীত নিবেদন যে, যজ্ঞেশ্বর বাবুর করুণোক্তিতে তাঁহারা যেন ন্যায় ও কর্তব্যের পথ হইতে বিচলিত না হন। ন্যায় ও কৰ্ত্তব্য কঠিন হইলেও প্রতিপালন করা অতিশয় আবশ্যক। গৃহীত সাক্ষ্য দ্বারাই বিচারের ফলাফল নির্ণয় করা উচিত; সুতরাং এই মোকদ্দমায় সাক্ষিগণ যাহা বলিয়াছেন, তাহার উপর নির্ভর করিলে একটিমাত্র সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। সেই সিদ্ধান্তানুসারে যাহাতে অপরাধীর দণ্ডবিধান হয়, ইহাই আইন প্রার্থনা করে। আশা করি, ন্যায়বিধাতা জজ ও জুরিগণ আমার যুক্তির যথার্থ্য ও সাফল্য হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছেন।”
“কোম্পানীর পক্ষের ব্যারিষ্টারের বক্তৃতার পর জুরিদিগকে যথারীতি সম্বোধন করিয়া বিচারপতি বলিতে লাগিলেন, ‘মহাশয়গণ, উপস্থিত মোকদ্দমায় আপনারা বিশেষ বিবেচনাপূর্ব্বক রায় দিবেন। যে পর্যন্ত না আপনাদের মনে আসামীর অপরাধ বা অপরাধশূন্যতা বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস হয়, ততক্ষণ পৰ্য্যন্ত কোন মতামত প্রকাশ করিবেন না। সময়ে সময়ে সাক্ষ্য-বৈচিত্র্যে নির্দোষেরও দণ্ড হইতে দেখা গিয়াছে; কিন্তু এরূপ উদাহরণ অতি অল্প। আবার এই সাক্ষ্য-বৈচিত্র্য দ্বারা মহা মহা পাতকীও উপযুক্ত দণ্ডভোগ করিয়াছে। সুতরাং যে সকল মোকদ্দমায় এই সাক্ষ্য-বৈচিত্র্য উপস্থিত হয়, সে স্থলে বিশেষ গাম্ভীর্য্য ও ধৈর্য্যের সহিত কার্য্য করিতে হয়। উপস্থিত ক্ষেত্রে আপনারা এরূপ ভাবে বিচার করিবেন, যেন পরে অনুতাপানলে কাহাকেও দগ্ধ হইতে না হয়। কৰ্ত্তব্যজ্ঞান যেন আপনাদের সহায় হয়।”
“সাড়ে তিন ঘটিকার সময়ে জুরিগণ আপনাদের গৃহে প্রবেশ করিলেন। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের সকলেই মনে করিয়াছিলেন, আর এক ঘন্টার মধ্যেই মোকদ্দমার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি শুনিতে পাইবেন। যজ্ঞেশ্বরবাবু নতনেত্রে কাঠগড়ায় বসিয়াছিলেন, একবারও কোনদিকে চাহিয়া দেখেন নাই। বোধ হইতেছিল, যেন তিনি আপনার আশু বিপদের জন্য প্রস্তুত হইতেছেন।”
“ক্রমে চারিটা, পাঁচটা, ছয়টা বাজিয়া গেল। আদালতের ব্যক্তিমাত্রেই উৎকণ্ঠিত হইতে লাগিলেন। সকলেই বুঝিতে পারিলেন, জুরীদিগের মধ্যে মতের ঐক্য হইতেছে না। ছয়টা বাজিয়া বিশ মিনিট অতীত হইলে জুরিগণের অগ্রণী আদালতে আসিয়া জজ সাহেবকে জানাইলেন, জুরীদিগের মতে একতা হইতেছে না।”
“জজ। আইন সম্বন্ধে কোন কূটতর্ক উপস্থিত হওয়াতে কি আপনাদের মতের এইরূপ অনৈক্য হইতেছি?”
“জুরীর মুখপাত্র বলিলেন, ‘না, ধর্ম্মাবতার।”
“জজ। সাক্ষ্য-সম্বন্ধে কি মত-বিরোধ ঘটিয়াছে?”
“জুরী-মুখপাত্র। না, আমাদের মতের অনৈক্যের কোন বিশেষ কারণ নাই, কিন্তু তথাপি আমরা সকলে এক মত হইতে পারিতেছি না।”
“জজ। এই দীর্ঘ ও গুরুতর বিচারের পর আমি আপনাদিগকে সহজে আপনাদের কর্তব্য কার্য্য হইতে অব্যাহতি দিতে পারিতেছি না। আপনি পুনরায় আপনার সহকারিগণের সহিত এ বিষয়ে বিশিষ্টরূপে বিচার করুন। আপনাদের অভিমত জানিবার জন্য আদালত আজ না হয় বিলম্বে বন্ধ হইবে।”
“ক্রমে সাতটা, আটটা, নয়টা বাজিয়া গেল; তথাপি জুরীর মুখপাত্রের দেখা নাই। তখন বিচারপতি কথঞ্চিৎ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। রাত্রি সার্দ্ধ নয় ঘটিকার সময় জুরিগণের মুখপাত্র ফিরিয়া আসিলে, বিচারপতি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কি মহাশয়, এবার আপনাদের মতের মিল হইয়াছে?”
“জুরীর মুখপাত্র। না ধর্ম্মাবতার! রায় সম্বন্ধে আমাদের সকলের এক মত হইবার কোন সম্ভাবনা নাই।”
“জুরিগণের মধ্যে এইরূপ মতভেদ দেখিয়া স্বয়ং যজ্ঞেশ্বরবাবু সর্ব্বাপেক্ষা অধিক আশ্চৰ্য্যান্বিত ও বিস্মিত হইয়াছিলেন। এমন কি তিনি আদালত ভঙ্গ হইলে জুরিদিগের মুখ দেখিবার জন্য কাঠগড়া হইতে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছিলেন।”
“জজ সাহেব আদালত বন্ধ করিতে আজ্ঞা দিয়া জুরিগণকে বিদায় দিলেন। এই আশ্চৰ্য্য হত্যা মোকদ্দমার এই পর্য্যন্ত নিষ্পত্তি হইয়া রহিল, ফল জানিবার জন্য আমরা উদ্গ্রীব রহিলাম।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ – তারের খবর
মোকদ্দমার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইল না দেখিয়া ব্যারিষ্টার নিকলাস সাহেব হরিদাস গোয়েন্দাকে সেই রাত্রে তাঁহার বাটীতে নিমন্ত্রণ করেন। নিকলাস সাহেবের স্থির বিশ্বাস যে, যজ্ঞেশ্বরবাবুর দ্বারা কখনই এ হত্যাকাণ্ড সমাহিত হয় নাই। সেই বিশ্বাসবলেই তিনি আদালতে যজ্ঞেশ্বর মিত্রের পক্ষ সমর্থন করিয়াছিলেন। সেইদিন রাত্রি দশটার সময়ে নিকলাস সাহেব হরিদাস গোয়েন্দা ও নিকলাস সাহেবের একজন ডাক্তার বন্ধু অম্বিকাচরণ সান্যাল এই তিনজনে নিকলাস সাহেবের বাটীতে একত্র হইয়াছিলেন। নিকলাস সাহেবের ইচ্ছানুসারেই হরি দাস গোয়েন্দা সেদিন সেখানে আসিয়াছিলেন। নিকলাস সাহেব তাঁহার দ্বারাই যজ্ঞেশ্বর বাবুর স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করাইতে ইচ্ছা করেন; তাহাই আজ এই হত্যাকাণ্ডের কথাবার্তা কহিবার জন্য তিন জন একত্রে সমবেত হইয়াছিলেন।
অম্বিকা। দেখ, এই যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমাটা আগাগোড়াই রহস্যপূর্ণ। ইহার নিষ্পত্তি ও সেইভাবে হইয়াছে। আমার বোধ হয়, যখন এ মোকদ্দমা আবার উঠিবে, তখন আর জুরীদের মধ্যে মতভেদ থাকিবে না। আর তখন যজ্ঞেশ্বর বাবুর নিশ্চয়ই ফাঁসী বা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হইবে।
নিকলাস সাহেব এই কথা শুনিয়া একটু চিন্তান্বিত ভাবে বলিলেন, “সাক্ষী- সাবুদের যেরূপ অবস্থা, তাহাতে তোমার সিদ্ধান্ত ঠিকই হইয়াছে। ইহা ছাড়া যদি আর কিছু নতুন সাক্ষ্য আদালতে উপস্থিত না করা যায়, তাহা হইলে যজ্ঞেশ্বর বাবুর দণ্ডভোগ নিশ্চয়; কিন্তু তুমি যে বলিতেছ, এই মোকদ্দমায় একটা জটিল রহস্য আছে, আমারও বিশ্বাস সেইরূপ। সেই রহস্যটা যদি কোন রকমে ভেদ করা যায়, তাহা হইলে বোধ হয়, মোকদ্দমার ফল ও নিষ্পত্তি অন্যরূপ হইবে। রহস্য বড় সহজ নয়। এ রহস্য ভেদ করিতে চেষ্টা করিতে যাওয়া অনেকে পাগলামী বলিয়া মনে করিবে; কিন্তু এমন একটা সামান্য সূত্র হইতে ইহা প্রকাশিত হইয়া পড়িতে পারে যে, তখন সকলেই আশ্চৰ্য্য হইয়া যাইবে। যাহা হউক, যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমা আর এক মাসের মধ্যে আদালতে উঠিবে না। এই এক মাসের মধ্যে আমার ইচ্ছা ও একান্ত অনুরোধ যে, হরিদাস বাবু এমন কোন সূত্র বা সাক্ষ্য বাহির করেন, যাহাতে যজ্ঞেশ্বর বাবুর নিদোষতা সম্পূর্ণ সপ্রমাণ হয়।”
হরিদাস। আমারও বিশ্বাস যে, ইহাতে একটা গূঢ় রহস্য আছে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া যজ্ঞেশ্বর বাবুকে নিদোষ সপ্রমাণ করিতে যত্ন করিতেছি ও করিব। আমাকে বিশেষ করিয়া কিছু বলিতে হইবে না।
অম্বিকা। যজ্ঞেশ্বর বাবুর ভাবভঙ্গী দেখিয়া বোধ হয় যে, তিনি যেন মোকদ্দমার ফলাফলের জন্য বিশেষ উৎসুক বা আগ্রহান্বিত নন। ভাল হউক, আর মন্দই হউক, তিনি যেন তাহা গ্রাহ্য করিবেন না, বলিয়াই স্থির করিয়াছেন। তাঁহার এরূপ ভাবটা কেন হইল, বুঝিতে পারিতেছেন কি?
হরিদাস। আমার বোধ হয়, তিনি নিদোষ, তাই তাঁহার মনে শান্তি আছে। ঈশ্বরের উপরে নির্ভর করিয়া বসিয়া আছেন, অদৃষ্টে যাহা হয় হইবে।
নিকলাস। তিনি যে সম্পূর্ণ নিদোষ, সে বিষয়ে আমার মনে একটুও সন্দেহ নাই। আমার মনে হয়, তিনি ইচ্ছা করিলেই আপনাকে নির্দোষ সপ্রমাণ করিতে পারেন; কিন্তু তাহা করিতে হইলে তাঁহাকে হয়তো এমন কতকগুলি উপায় অবলম্বন করিতে হয় যে, সেগুলির সাহায্য লইতে তিনি কোন বিশেষ কারণ বশতঃ ইচ্ছুক নহেন। কেন আপনারা কি লক্ষ্য করেন নাই যে, মোকদ্দমা সম্বন্ধে কতকগুলি বিষয় যেন তিনি আগাগোড়া ঢাকিয়া রাখিতে চেষ্টা করিতেছিলেন? তাঁহার যেন ইচ্ছা নয় যে, সে সম্বন্ধে কোন কথা আদালতে উঠে।
অম্বিকা। হাঁ, তাহা আমি লক্ষ্য করিয়াছি; কি এমনও তো হইতে পারে যে, এই সকল কথা আদালতে উঠিলে তাঁহার দোষ সম্পূর্ণ সপ্রমাণ হইয়া পড়ে; এই ভয়েই হয়তো তিনি সেগুলি গুপ্তভাবে রাখিতে যত্ন করিতেছেন।
নিকলাস। না, তাহা কখনই নয়। কেমন হরিদাসবাবু! আপনার এ সম্বন্ধে মত কি?
হরিদাস। আমার বোধ হয়, যে সকল গুপ্তকাহিনী প্রকাশ করিতে যজ্ঞেশ্বরবাবু অনিচ্ছুক, তাহাতে এমন কিছু নাই, যাহাতে তাঁহার অপরাধ সপ্রমাণ হয়। আমার ইচ্ছা, আমি এই বিষয়টির বিশেষ তদন্ত করিয়া শেষ পর্য্যন্ত বেয়ে-চেয়ে দেখি। দুই-একটা সূত্রও আমি পাইয়াছি, তবে সম্পূর্ণ রহস্য ভেদ না করিয়া কিরূপে আদালতে সে সকল কথার অবতারণা করি?
নিকলাস। আমারও দুই-একটা বিষয়ে বিশেষ সন্দেহ আছে। আপনি কি কি সূত্র পাইয়াছেন বলুন দেখি, আমার সঙ্গে আপনার মিল হয় কি না দেখি।
হরিদাস গোয়েন্দা কিছুক্ষণ নিস্তব্ধভাবে থাকিয়া বলিলেন, “আমার দুইটি সূত্র আছে। তাহার মধ্যে একটি বড় অকিঞ্চিৎকর ও সামান্য। সেটিতে কোন কাজ হইবে বলিয়া আমার বোধ হয় না। অপরটি প্রধান ও প্রয়োজনীয়—যদি কিছু হয়, তবে সেইটির দ্বারাই এই বিষম রহস্যের গুপ্তকাহিনী সকল প্রকাশ হইয়া পড়িবে।”
কথাটা শেষ করিয়া হরিদাস পুনরায় চিন্তামগ্ন হইলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া বোধ হইল, যেন কোন একটা বিশেষ গুরুতর বিষয়ে তাঁহার চিত্ত আলোড়িত হইতেছে। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি পুনরায় বলিলেন, “কিন্তু এই প্রধান সূত্রের কোন মীমাংসা আমি এখনও করিতে পারি নাই। ইহার অর্থই বা কি, তাহা এখনও বুঝিতে পারি নাই।”
অম্বিকা। আপনার প্রধান সূত্রটি কি শুনি?
হরিদাস গোয়েন্দা চেয়ার হইতে উঠিয়া টেবিলের উপর হইতে এক জোড়া তাস লইলেন। তাহার পর উহাদের মধ্য হইতে একখানি বাছিয়া লইয়া অম্বিকাচরণের হস্তে প্রদান করিলেন।
অম্বিকাচরণ ও নিকলাস সাহেব উভয়েই প্রায় এক সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, “হরতনের নওলা”।
হরিদাস। হাঁ, এই হরতনের নওলা, যজ্ঞেশ্বর বাবুর আলষ্টার কোটের পকেটে ছিল, তাহা বোধ হয়, আপনাদের স্মরণ আছে।
অম্বিকা। এই কি আপনার প্রধান সূত্র নাকি?
হরিদাস বলিলেন, “হাঁ, ইহাই আমার প্রধান সূত্র। আর এই সূত্রের দ্বারাই আমি এই স্ত্রী হত্যা রহস্য ভেদ করিব স্থির করিয়াছি।”
অম্বিকা। আপনি রহস্যের উপর রহস্য যোগ করিতেছেন, দেখিতেছি। বিষয়টি আরও অধিকতর বিস্ময়কর হইয়া দাঁড়াইতেছে; কিন্তু সূত্র যে সামান্য, তাঁহাতে আমার বোধ হয়, কোন কাজই হইবে না।
নিকলাস। না হে অম্বিকা বাবু, তুমি বুঝিতে পার নাই। হরিদাসবাবুর মতের সহিত আমার ধারণার বেশ ঐক্য হইয়াছে। বোধ হয়, বিচারের সময়ে যখন এই ভাবের কথা হয়, তখন তুমি আদালতে উপস্থিত ছিলে না।
অম্বিকা। না, আমি তখন আদালতে ছিলাম না বটে।
নিকলাস। তবে যাহা বলি, বেশ করে কান পাতিয়া শুন দেখি, তোমারও মনে আর এক রকম বিশ্বাস হইবে। যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ীর বহির্দ্বারের চাবি ও এই তাসখানিই তাঁহার আলষ্টার কোটের পকেটে পাওয়া যায়। এই দুইটি জিনিষ ছাড়া তাহাতে আর কিছুই ছিল না। যখন এই দুইটি জিনিষের কথা আদালতে উঠিল, আর এই সম্বন্ধে সাক্ষ্যসাবুদ গ্রহণ করা হইল, তখন আমি একদৃষ্টে যজ্ঞেশ্বর বাবুর মুখের দিকে চাহিয়াছিলাম। তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া মনের ভাব স্থির করিব, মনে করিয়াছিলাম। এই দুইটি সর্ব্বনেশে জিনিষ যে, তাঁহার আলষ্টার কোটের পকেটে পাওয়া গিয়াছিল, এ কথা আমি জানিতাম, কিন্তু তিনি জানিতেন না। যখন দরজার চাবি তাঁহার নিকটে দেখান হইল, তিনি তখন কেবল একটু মুচকি হাসিলেন, কিন্তু বিস্মিত বা আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন না; কিন্তু যখন হরতনের নওলাখানি তাঁহাকে দেখান হইল, তখন তিনি অমনই চমকিতভাবে শিহরিয়া উঠিলেন। তাঁহার মুখে এক নূতন ভাবের আবির্ভাব হইল। পরক্ষণে তিনি যেন হতভম্ব হইয়া গেলেন। তখন তাঁহার মুখ দেখিয়া আমার বেশ বোধ হইয়াছিল যে, তাঁহার মনে বিষম ভয়ের সঞ্চার হইয়াছে। তাহাতেই আমার অনুমান হয় যে, তাসখানি সম্বন্ধে ইতিপূর্ব্বে তিনি কিছু জানিতেন। তাহাতেই বজ্রাহতের ন্যায় তিনি শিহরিয়া উঠিয়াছিলেন।
অম্বিকা। তাঁহার মুখে তুমি ভয়ের চিহ্ন দেখিয়াছিলে, বলিলে না?
নিকলাস। তখন তাঁহার মুখ দেখিয়া আমার মনে তাহাই হইয়াছিল; কিন্তু কেন যে তাঁহার মনে এইরূপ ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল, তাহার কারণ আমি কিছুই বুঝিতে পারি নাই; কিন্তু তাঁহার আশ্চর্যান্বিত ও বিস্মিত হইবার অবশ্যই কোন বিশেষ কারণ ছিল।
অম্বিকা। আচ্ছা, এই তাস সম্বন্ধে যজ্ঞেশ্বরবাবু আদালতে কি কোন প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছিলেন?
হরিদাস। এ বিষয়ে কেন, তিনি তো অন্য অনেক বিষয়েই প্রশ্ন করেন নাই। যে সকল বিষয়ে প্রশ্ন করিলে সাক্ষীদের অনেক গলদ বাহির হইয়া পড়িত, তাহাও তো তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করেন নাই। এখনও তিনি বুঝিতে পারিতেছ না যে, এই হরতনের নওলা তাসখানি উপস্থিত ঘটনাসূত্রের একটি প্রধান সূত্র।
অম্বিকা। আচ্ছা ধর, যেন মনে করিলাম, এই হরতনের নওলা সম্বন্ধে তোমরা যে সিদ্ধান্ত করিয়াছ, তাহাই ঠিক, অর্থাৎ ইহা যজ্ঞেশ্বর বাবুর অজ্ঞাতসারে তাঁহারই পকেটে ছিল, আর এ বিষয় ইতঃপূৰ্ব্বে তিনি কিছুই জানিতেন না। সহসা দেখিয়া তাই চমকে উঠিয়াছিলেন। একি হইতে পারে না, এ মিথ্যা কল্পনা?
হরিদাস। মিথ্যা! আমি সম্পূর্ণ সাহসের সহিত বলিতে পারি যে, এই সিদ্ধান্তই অভ্রান্ত। আর ইহাও আমি জোর করিয়া বলিতেছি যে, আদালতে তাসখানি বাহির করিবার পূর্ব্বে তাঁহার আলষ্টারের পকেটে ইহার অস্তিত্বের বিষয় যজ্ঞেশ্বর বাবু বিন্দুমাত্রও জানিতেন না, এ বিশ্বাস আমারও হইয়াছিল।
অম্বিকা। হয় তো কেউ তাসখানি তাঁহার পকেটে রাখিয়া দিয়াছিল।
নিকলাস। আমারও তাহাই বোধ হইতেছে। কিন্তু একখানা খেলিবার তাসের সঙ্গে, সে হরতনের নওলাই হউক, আর ইস্কাবনের টেক্কাই হউক, আর রুইতনের গোলামই হউক, একখানা সামান্য খেলিবার তাসের সঙ্গে এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের যে কি সূক্ষ্ম সম্বন্ধ আছে, তাহা নির্ণয় করা বড়ই দুরূহ, এমন কি অসাধ্য বলিলেও চলে।
টেবিলের উপরে সবলে চপেটাঘাত করিয়া হরিদাস গোয়েন্দা বলিলেন, “সেই সূক্ষ্মতত্ত্ব নির্দ্ধারণ করাই তো আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। তাহা নির্ণয় করিবার জন্যই তো আমি প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছি। অম্বিকা বাবু! আপনি জানেন না, কত সামান্য সূত্র থেকে কত ভয়ানক ভয়ানক রহস্য সকলের মীমাংসা হইয়া গিয়াছে।”
নিকলাস। হরিদাস বাবুর কথার মর্ম্ম অম্বিকা বাবুর চেয়ে আমি কতকটা বুঝিতে পারিব। কারণ আমাদের আইনাদিতেও কখন কখন সামান্য বিষয়ের দ্বারা কত গুরুতর বিষয়ের মীমাংসা হইয়া যায়। ফৌজদারী মোকদ্দমায় অতি অকিঞ্চিৎকর সাক্ষীর দ্বারা কত সময়ে কত লোককে আসন্ন মৃত্যুর মুখ হইতে রক্ষা করা গিয়াছে। সাধারণের চক্ষে মূল ঘটনার সহিত যে সকল ঘটনার সম্পর্ক অতি দূরতম বলিয়া বোধ হয়, সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তিরা আপনাদের সূক্ষ্ম বুদ্ধির সাহায্যে তাহাদের মধ্যে অতি ঘনিষ্ঠ ও নিকট সংশ্রব নির্ণয় করেন এবং এইরূপে কত শত অবশ্যম্ভাবী বিষয়ের সংঘটন প্রতিরোধ করেন।
অম্বিকাচরণ উপহাসচ্ছলে বলিলেন, “আর আপনারাও এই হরতনের নওলা থেকে এই হত্যাকাণ্ডের মীমাংসা করে সূক্ষ্মবুদ্ধির পরিচয় দিতে উদ্যত হইয়াছেন।”
তাঁহার কথা শুনিয়া বোধ হইল, তিনি নিকলাস সাহেব ও হরিদাস গোয়েন্দার কথা বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে করিতেছেন না।
হরিদাস গোয়েন্দা অম্বিকাচরণের কথা শুনিয়া একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “এই তাস হইতে আমি মোকদ্দমার গতি অন্যদিকে ফিরাইয়া দিব। আর এই তাস রহস্য আমি কোন-না-কোন রকমে ভেদ করিবই করিব।”
অম্বিকা। আপনি দুইটা সুত্রের কথা বলিলেন না? তাহার মধ্যে যে-টি আপনি খুব প্রয়োজনীয় বলিয়া বিবেচনা করেন, তাহার কথা তো হইয়া গেল। আচ্ছা, আপনি যে সূত্রটিকে বিশেষ আবশ্যক বলিয়া বিবেচনা করেন না, সেটি কি, বলুন দেখি।
হরিদাস। বলিতেছি শুনুন; জুরীরা একমত না হওয়াতে তাঁহাদের এ মোকদ্দমায় ছুটি দেওয়া হয়, ইহা তো আপনারা সকলেই বেশ বুঝিতে পারিতেছেন? যেমন সকল সংবাদই সংবাদপত্রে বাহির হইয়া পড়ে, তেমনই এ কথাও কিছু গোপন থাকিবে না। আপনারা দেখিবেন, দুই-একদিনের মধ্যেই সংবাদপত্রে নিশ্চয়ই এ খবর বাহির হইবে যে, কয়জন জুরী এ মোকদ্দমায় যজ্ঞেশ্বর বাবুর দিকে ছিলেন, আর কয়জন তাঁহাকে দোষী বলে সাব্যস্ত করিয়াছিলেন।
অম্বিকা। আমি অনেক গুজব শুনিয়াছি।
নিকলাস। কিন্তু আমি এ বিষয়ে ঠিক খবর দিতে পারি। বারজন জুরীর মধ্যে এগারজন যজ্ঞেশ্বর বাবুকে দোষী সাব্যস্ত করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, আর কেবল একজনমাত্র লোক তাঁহার স্বপক্ষে ছিলেন। তর্ক-বিতর্ক, আইনের যুক্তি, সাক্ষীর জবানবন্দী প্রভৃতি তাঁহাকে অনেক দেখান—অনেক বোঝান হইয়াছিল; তথাপি তাঁহার অটুট বিশ্বাস হইতে কেহ তাঁহাকে বিচলিত করিতে পারে নাই। এই একজন ব্যতীত আর সকলের চোখেই যজ্ঞেশ্বর বাবু দোষী প্রমাণিত হইয়াছিলেন। কোন রকমেই কেহ তাঁহাকে বুঝাইতে পারেন নাই—কিছুতেই তিনি আপনার গোঁ ছাড়েন নাই। তিনি নাকি এ পর্যন্তও বলিয়াছিলেন, ‘আপনারা আমায় বৃথা বুঝাইতে চেষ্টা করিতেছেন। আমার স্থির বিশ্বাস, যজ্ঞেশ্বর বাবু সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ বিশ্বাস, আমার কিছুতেই টলিবার নহে। আপনারা তাঁহাকে দোষী বলিতে হয়, বলুন; কিন্তু কিছুতেই আমি নিমিত্তের ভাগী হইতে পারিব না।’
অম্বিকা। ইহাতে কিছুদিন দেরী হইবে বটে, কিন্তু তা বলিয়া যে, বড় বিশেষ সুবিধা হইবে, এমন তো আমার বোধ হয় না।
নিকলাস। সুবিধা হইতেও পারে। এমন অনেক ঘটনা পূৰ্ব্বে ঘটিয়াছে, যাহাতে কালবিলম্বে বন্দীর পক্ষে অনেক সুবিধা হইয়া গিয়াছে। হয় তো শেষে সে ব্যক্তি নিৰ্দ্দোষ সপ্রমাণে মুক্তি পাইয়াছেন। একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে; সেটি প্রায় এই যজ্ঞেশ্বর বাবুর ঘটনার মত। অনেক দিন পূর্ব্বে এক মোকদ্দমায় ঠিক এই রকম ভাবে জুরীদিগের মতের মিল হয় নাই। বন্দীর অপরাধ সপ্রমাণ করিবার জন্য কোন প্রমাণ-প্রয়োগের অভাব ছিল না; কিন্তু সেবারেও এই রকম একজন জুরী কোন রকমেই বন্দীর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন নাই। কাজে কাজেই বন্দীর পুনরায় বিচার হয়—আর সেই দ্বিতীয় বারের বিচারে, সে বেকসুর খালাস পায়। প্রথম বারের বিচারের দিন হইতে দ্বিতীয়বার বিচারের দিন পৰ্য্যন্ত সে সময় অতিবাহিত হইয়াছিল, তাহারই মধ্যে এমন সব নূতন প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছিল যে, বন্দীকে নিৰ্দ্দো সপ্রমাণ করিতে আর কোন কষ্ট পাইতে হয় নাই। প্রথম দিনে যে জুরী বন্দীর স্বপক্ষে ছিলেন, পরে জানা যায় যে, তিনি বন্দীর একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু। যখন জুরিগণ নির্ব্বাচিত হন, তখন অবশ্য ঘুণাক্ষরেও কেহ জানিতে পারেন নাই যে, বন্দীর সাপক্ষীয় কোন লোক জুরীদিগের মধ্যে স্থান পাইয়াছেন; কেন না, তাহা জানিতে পারিলে তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে বাদ দেওয়া হইত। দ্বিতীয় দিনের বিচারের পর বন্দীর সেই বন্ধু সাধারণসমক্ষে প্রকাশ করেন যে, তিনি সাক্ষ্য-সাবুদ প্রভৃতি প্রমাণ প্রয়োগের প্রতি কিছুমাত্র দৃষ্টি না রাখিয়াই কেবল বন্ধুত্বের খাতিরে বন্দীকে নিৰ্দ্দোষ বলিয়াছিলেন।
অম্বিকা। তাহা হইলে তুমি বিবেচনা কর যে, যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমায়ও জুরিদিগের মধ্যে সেইরূপ একটা ঘটনা ঘটিয়াছে?
নিকলাস। তুমি যদি জুরীদিগের মধ্যে থাকিতে, তাহা হইলে তোমার বিচারে কি হইত?
অম্বিকা। দোষী।
নিকলাস। তুমি জান, যদি আমি জুরীতে থাকিতাম, তাহা হইলে আমিও তাঁহাকে দোষী ভিন্ন আর কিছুই বলিতে পারিতাম না। যদিও আমার মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, যজ্ঞেশ্বর বাবু অপরাধী নহেন; কিন্তু তথাপি এমন প্রমাণ প্রয়োগসত্ত্বেও আমি কোন ক্রমেই বলিতে পারিতাম না যে, তিনি নিৰ্দ্দোষ। যখন জুরীদিগের মুখপাত্র বিচারপতির সম্মুখে আসিয়া বলিয়াছিলেন যে, কোন ক্রমেই তাঁহারা একমত হইতে পারিতেছেন না, তখন যজ্ঞেশ্বর বাবুর মুখের দিকে কেহ চাহিয়া দেখিয়াছিলেন কি? তিনি নিজেই শুনিয়া যেন, আশ্চর্য্য হইলেন। জুরীরা যে তাঁহাকে দোষী সাব্যস্ত করিবেন, বহুপূৰ্ব্ব হইতে তাঁহার যে ধারণা জন্মিয়াছিল; কিন্তু তাঁহাদের মতের মিল হইল না, শুনিয়া তিনিও অবাক হইয়া গিয়াছিলেন। সাধারণতঃ আমরা কি দেখি? যে যথার্থ দোষী, সে যে রকম ভাবই প্রকাশ করুক না কেন, তাহার মুখে কেমন এক রকম চাঞ্চল্যের লক্ষণ প্রকাশ পায়। সে ঘন ঘন জুরীদিগের মুখের দিকে চায়, তাঁহাদের মনে কখন কি ভাব উদয় হইতেছে, মুখের ভাব দেখিয়া তাহা জানিবার চেষ্টা করে। জুরীদিগের মুখপাত্রের মুখ হইতে শেষ কথা শুনিবার জন্য অত্যন্ত ব্যগ্রভাব প্রকাশ করে; কিন্তু যজ্ঞেশ্বর বাবুর সে সব ভাব কিছু দেখিয়াছিলে কি? তিনি যেন পূর্ব্বাবধিই উদাসীন। জুরীদিগের নাম যখন পড়া হইল, তিনি তখনও যেরূপ ভাবে ছিলেন, পরেও সেই ভাবে তাঁহাকে দেখা গিয়াছিল। তিনি একবারও জুরীদিগের দিকে চেয়ে পৰ্য্যন্ত দেখেন নাই, সেদিকে লক্ষ্য করিয়াছিলে কি?
অম্বিকা। তা সেটা অন্য কারণেও হইতে পারে। যজ্ঞেশ্বর বাবু শুধু চোখে তো দূরে ভাল দেখিতে পান না—তাই বোধ হয়, জুরীদিগের দিকে চাহিয়া দেখেন নাই। কেননা, দেখিলেও তিনি তাহাদের কাহাকেও চিনিতে পারিতেন না।
নিকলাস। তা আমি জানি; কিন্তু তাঁহার চশমা তাঁহার গলাতেই ঝুলিতেছিল। দেখিবার ইচ্ছা হইলে তিনি অনায়াসেই দেখিতে পারিতেন; কিন্তু দেখিবার ইচ্ছা তাঁহার একবারও হয় নাই। তাহার পর এই জুরীর নামের তালিকাখানা দেখ, ইহাদের মধ্যে একজন ছাড়া আমি সকলকেই জানি, সকলকেই চিনি। আর এই সব জুরীদের মধ্যে কে যজ্ঞেশ্বর বাবুর পক্ষাবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহাও আমি বলিয়া দিতে পারি; কিন্তু যাঁহাকে উদ্দেশ্য করিয়া আমি এই সব কথা বলিতেছি, তাঁহার বিষয় আমি কিছু জানি না। ইনি কোথায় থাকেন, তাহাও আমি বলিতে পারি না।
অম্বিকা। তুমি যাঁহাকে উদ্দেশ্য করিয়া এই সব কথা বলিতেছ, তাঁহার নাম কি?
নিকলাস। রাধারমণ বাবু।
ঠিক এই সময় নিকলাস সাহেবের ভৃত্য সেই কক্ষে প্রবেশ করিয়া বলিল, “হুজুর! এইমাত্র একটা লোক এই টেলিগ্রামখানা নিয়ে এল। জবাবের জন্য সে দাঁড়িয়ে রয়েছে।”
ক্ষিপ্রহস্তে নিকলাস সাহেব তাঁহার চাকরের নিকট হইতে টেলিগ্রামখানি লইয়া পাঠ করিলেন। হরিদাস গোয়েন্দা এবং ডাক্তার অম্বিকাচরণ তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া অবাক হইলেন।
নিকলাস সাহেব টেলিগ্রামখানি টেবিলের উপরে রাখিয়া বলিলেন, “কি আশ্চর্য্য! এ রকম লোক তো আমি কখনও দেখি নাই। ইনি আগ্রা হইতে টেলিগ্রাম করিতেছেন। কি লিখিয়াছেন, আমি পড়ি, আপনারা উভয়ে শুনুন। মাননীয় ডগলাস সাহেব K. C. S. I. মহোদয়ের নিকট হইতে এ টেলিগ্রামখানা আসিতেছে। তিনি লিখিতেছেন—
“যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমার বিবরণী যথাসময়ে এখানে তারের খবর হইয়াছে। এখানকার সংবাদ-পত্র সমূহে এ কথা প্রকাশিত হইয়াছে। নিশ্চয়ই যজ্ঞেশ্বর বাবুর মোকদ্দমা পুনরায় উঠিবে। যদি ইহার মধ্যে আপনি যজ্ঞেশ্বর বাবুকে নির্দোষ সপ্রমাণ করিবার জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারেন, তাহা হইলে আমি আপনাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দিতে প্রতিশ্রুত রহিলাম। আপনি যদি এই কার্য্যের ভার গ্রহণ করেন, তাহা হইলে এখনই বেঙ্গল ব্যাঙ্ক হইতে দশ হাজার টাকা লইতে পারেন। আমি সেখানেও টেলিগ্রাফ করিলাম। এই দশ হাজার টাকার মধ্যে আপনার পাঁচ হাজার। আর পাঁচ হাজার টাকা লইয়া আপনি এই বিষয়ের খরচ-খরচা করিতে পারেন। এছাড়া আপনি, সাধারণের নিকটে আপনার পারিশ্রমিক হিসাবে যে রকম লইয়া থাকেন, তাহাও আপনি আমার নিকট হইতে পাইবেন। আপনার যদি আবশ্যক হয়, বেঙ্গল ব্যাঙ্ক হইতে আপনি আরও অধিক টাকা গ্রহণ করিতে পারেন। যেরূপে হউক, যজ্ঞেশ্বর বাবুকে নিদোষ সপ্রমাণ করিতেই হইবে। ইহাতে যত টাকা ব্যয় হয়, আমি দিব।
টাকার জন্য চেষ্টার যেন কোন ত্রুটি না হয়। এক লক্ষ টাকা ব্যয় করিলেও যদি তিনি অব্যাহতি পান, তাহা হইলে এক লক্ষ টাকা খরচ করিতেও আমি কুণ্ঠিত হইব না। প্রতিদিন আপনার নিকট হইতে আমি দুইখানি পত্রের প্রত্যাশায় থাকিব। কি করিতেছেন, কোথায় যাইতেছেন, কি রকম লোক নিযুক্ত করিতেছেন, কতটা সুবিধা হইতেছে, সব কথা আমি প্রতিদিন এখানে বসিয়া জানিতে ইচ্ছা করি। যজ্ঞেশ্বর বাবুকে বাঁচান সম্বন্ধে আপনি সম্পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করুন। ইহার উত্তর-প্রতীক্ষায় আমি বসিয়া রহিয়াছি, জানিবেন। টেলিগ্রামের এক শত শব্দের মূল্য অগ্রিম দিয়া দিলাম। এক শত টাকা পৰ্য্যন্ত আপনি উত্তর লিখিতে পারেন। যজ্ঞেশ্বর বাবু জানিতে না পারেন যে, আমি তাঁহার হইয়া এই সব করিতেছি। ইহা কেবল আপনি এবং আমি জানিব। আর যদি কেহ জানিতে পারেন বা অন্য কাহাকেও জানাইবার আবশ্যক হয়, তাহা হইলে তাঁহাকেও সাবধান করিয়া দিবেন, যেন তিনি ঘুণাক্ষরেও একথা প্রকাশ না করেন। আমি আপনাকে একখানি পত্রও লিখিলাম। তাহাতে অনেক বিস্তৃত বিবরণ জানিতে পারিবেন। রাধারমণ বাবুর নামে যে ব্যক্তি জুরীতে ছিলেন, তাঁহার কাছেও আপনি অনেক বিষয় সংগ্রহ করিতে পারেন। আমি তাঁহার ঠিকানা জানি না, কিন্তু ইহা আমি বেশ জানি যে, যজ্ঞেশ্বর বাবুর সহিত রাধারমণ বাবুর এক সময়ে বড় বন্ধুত্ব ছিল।”
টেলিগ্রামের কথা শুনিয়া হরিদাস গোয়েন্দা ও ডাক্তার অম্বিকাচরণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় বসিয়া রহিলেন। কোন কথা কহিতে পারিলেন না।
তাহার পর অম্বিকাচরণ বলিলেন, “আশ্চর্য্য বটে! এমন আশ্চর্য্য ব্যাপার আর কখন দেখি নাই, এ ডগলাস সাহেবটি কে? বোধ হয়, সেই যে দিন-কতক সোনা রূপার খনি, কয়লার খনি প্রভৃতি নিয়ে শহরে খুব হুলস্থূল বাঁধিয়েছিল—অজস্র পয়সা রোজগার করিয়াছিলেন—সেই নাকি? সে যদি হয়, তাহা হইলে এরূপ রাশি রাশি টাকা খরচ করা তাহার পক্ষে কিছু আশ্চর্য্য নয় বটে। তুমি ডগলাস সাহেবের বিষয় কিছু জান?”
ডাক্তার অম্বিকাচরণ যে সময় কথা কহিতেছিলেন, সেই সময় নিকলাস সাহেব তাড়াতাড়ি টেলিগ্রামের উত্তর লিখিতেছিলেন। তাঁহার উত্তর লেখা সমাপ্ত হইলে অম্বিকাচরণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন আপনি কি স্থির করেছেন?”
নিকলাস। যা স্থির করিয়াছি, তাহা এই উত্তরখানা দেখিলেই বুঝিতে পারিবে।
ডাক্তার অম্বিকাচরণ উত্তরখানি লইয়া পাঠ করিতে লাগিলেন—
“আপনার নিকট হইতে যে তারের খবর আসিয়াছিল, তাহা এই মাত্র পাইলাম এবং পাঠ করিলাম। আপনি যে কার্য্যে আমায় নিযুক্ত করিবার জন্য প্রস্তাব করিয়াছেন, অতি সানন্দচিত্তে আমি তাহা গ্রহণ করিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যজ্ঞেশ্বর বাবু সম্পূর্ণ নিদোষ এবং বোধ হয় আপনার প্রতিশ্রুত অর্থ-বলে আমি অনায়াসে তাহা সপ্রমাণ করিতে পারিব। এই কার্য্যের জন্য হরিদাস গোয়েন্দা নামক ডিটেকটিভ পুলিশের একজন সুদক্ষ কর্ম্মচারীকেও নিযুক্ত করিলাম। এই ঘটনার ভিতরে অনেক রহস্য আছে, সে রহস্যের মর্ম্মোদঘাটন করিতে হরিদাস গোয়েন্দা ভিন্ন অপর কোন লোক পারিবেন না। সেইজন্য অনেক বিবেচনার পর তাহাকেই নিযুক্ত করা আবশ্যক বিবেচনা করিলাম। আপনি যেরূপ আজ্ঞা করিয়াছেন, সেইরূপই করিব। প্রতিদিন আপনাকে দুইখানি করিয়া পত্র লিখিব, আবশ্যক হইলে অতিরিক্ত পত্রও পাইবেন।”
টেলিগ্রামের উত্তরখানি পাঠ শেষ হইলে, নিকলাস সাহেব ভৃত্যকে ডাকিয়া তাহার হাতে সেইখানি দিয়া বলিলেন, “যাও, যে লোকটি টেলিগ্রামের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করিতেছে, তাহাকে এইখানা দাও।”
নিকলাস। দেখুন হরিদাস বাবু! ইহাতে আমায় আরও আশ্চর্যান্বিত হইতে হইতেছে যে, ডগলাস সাহেবও আমায় সেই রাধারমণ বাবুর নিকটে খবর লইতে বলিতেছেন। আমি যাহাকে যজ্ঞেশ্বর বাবুর সাপক্ষীয় লোক বলে অনুমান করিয়াছি, ডগলাস সাহেব দূরে বসিয়া আভাসে তাহাই ইঙ্গিত করিতেছেন।”
হরিদাস। আশ্চর্য্যের কথা বটে—ইহার ভিতরে গূঢ় রহস্য আছে। তা যাক্, আপনি যদি আমাকে এ কার্য্যে নিযুক্তই করিলেন, তাহা হইলে আমার উপর কি কি কার্য্যভার প্রদান করিবেন, বলুন।
নিকলাস। আপনি এই রাধারমণ বাবুর বাসস্থান কোথায়, আগে সেইটি বাহির করুন।
হরিদাস। সে তো অতি সোজা কাজ। তাহাতে আর কত সময় লাগিবে? তাহার পরে কি করিতে হইবে, বলুন।
নিকলাস। তাহার পরে যাহা করিতে হইবে, তা আমি আপনাকে পরে বলিব –এখন আপাততঃ আর কিছু করিতে হইবে না।
হরিদাস গোয়েন্দাকে এই কথা বলিয়া নিকলাস সাহেব অম্বিকা চরণের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচ্ছা ডাক্তার বাবু, বিষাক্ত ঔষধ অধিক মাত্রায় সেবন করাতে হেমাঙ্গিনীর মৃত্যু হইয়াছে, এ কথা বিশেষরূপে প্রমাণিত হইয়াছে না? নিদ্রার জন্য তিনি এই ঔষধ ব্যবহার করিতেন, আর অধিক মাত্রায় সেবন করিলে বিপদ ঘটিতে পারে, তাহাও তিনি জানিতেন, কেমন? যে গেলাসে করিয়া ঔষধ সেবন করা হইয়াছিল, সে গেলাসটি তাঁহার বিছানার নিকটে পাওয়া যায় নাই—কিছু দূরে ছিল। ইহাতেই প্রমাণ হইতেছে যে, হেমাঙ্গিনী কখনও আত্মহত্যা করেন নাই—কারণ তাহা হইলে গেলাসটা নিশ্চয়ই তাঁহার বিছানার নিকটে পড়িয়া থাকিত। আমার মতে সমস্ত ঘটনাবলী রীতিমত পর্যালোচনা করিলে বেশ বুঝা যায় যে, যজ্ঞেশ্বর বাবুর দ্বারা এ হত্যাকাণ্ড কখনও ঘটে নাই।”
অম্বিকা। কই, আমি তো তোমার কথার ভাব কিছু বুঝিতে পারিলাম না।
নিকলাস। বুঝিতে পারিলেন না? কেন, ইহা তো অতি সহজ কথা! মনে করুন, আমি যেন যজ্ঞেশ্বর বাবু, আমি স্থির করিলাম যে, বিষপান করাইয়া আমার স্ত্রীকে ইহলোক হইতে অপসারিত করিব; অথচ মনে মনে এমন সকল ফন্দী আঁটিতে লাগিলাম যে, এই হত্যাকাণ্ডে যাহাতে আমার উপরে জনপ্রাণীর সন্দেহ করিতে না পারে, এমন উপায় অবলম্বন করিতে হইবে। রাত্রে আমি আমার স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করিলাম। দিনের বেলা যে ঝগড়া হইয়া গিয়াছে, তাহার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিলাম। আমার স্ত্রীও যেন আমার কথায় ভুলিলেন। তাহার পরে কথায় কথায় তিনি বলিলেন যে, তাঁহার নিদ্রা না হওয়াতে তিনি বড় ক্লেশ পাইতেছেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম, যদি কষ্ট হয়, তবে একটু ঔষধ সেবন কর না কেন? তিনি যেন তাহাতে আমায় ঔষধ ঢালিয়া দিতে বলিলেন; আমি সুবিধা পাইয়া এক দাগ ঔষধের পরিবর্তে সমস্ত ঔষধ গেলাসে ঢালিয়া ফেলিলাম। তিনি সমস্ত ঔষধটি পান করিয়া আমার হাতে গেলাসটি ফিরাইয়া দিলেন। তাহার পর তিনি যে নিদ্রায় নিদ্রিত হইলেন, তাহা হইতে আর উঠিলেন না। আমি আমার চক্ষের সম্মুখে তাঁহার মৃত্যু দেখিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলাম। প্রতিদিন যে বাদ-বিসম্বাদ লইয়া কাল কাটাইতাম, তাহা হইতে অব্যাহতি পাইলাম জানিয়া মনে আনন্দ হইল। খুন তো হইয়া গেল, তাহার পর আমি করিব কি? আমার সে অবস্থায় কি করা উচিত? মৃত্যুযন্ত্রণা—চীৎকার—ছটফট করা প্রভৃতি সকল প্রকার দায় হইতে তো নিষ্কৃতি পাইলাম, এখন করি কি? কেহ জানিবার বা আমার উপরে সন্দেহ করিবার তো কোন কারণ রহিল না। অতি সুকৌশলে এ হত্যাকাণ্ড সমাহিত হইল –আমি ভিন্ন এ জগতে আর কেহ এ কথা জানে না—বা ইহার প্রমাণ দিতে পারে না। আমি তখন কি করিলাম? জলের গেলাসটি, পাথরের কুঁজোটি, ঔষধের শিশিটি সমস্ত সরাইয়া অন্য স্থানে রাখিলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত করিলাম, ঐগুলি সরাইয়া রাখিলেই কেহ বুঝিতে পারিবে না, কিসে আমার স্ত্রীর মৃত্যু হইয়াছে। তাহার পরে আবার যেন আমার মনে হইল, জিনিষগুলি সরাইয়া রাখিলে হয়তো আত্মহত্যা বলিয়া প্রমাণিত না হইতে পারে। কাজে কাজেই অনেক দুশ্চিন্তার পর সেগুলি আবার আমার স্ত্রীর শয্যাপার্শ্বে টিপায়ের উপরে রাখিলাম। এখন আমার কথা বুঝিতে পারিলে?
অম্বিকা। কিছুই না। আমি যেন সমস্তই অন্ধকার দেখিতেছি। তোমার সকল কথাই যেন আমার আশ্চৰ্য্য বলিয়া বোধ হইতেছে।
নিকলাস। তবে এখন থাক—কাল আমি তোমাকে আরও ভাল করিয়া বুঝাইয়া দিব।