স্মৃতিকথা

স্মৃতিকথা

নয়নচাঁদ পাইনের ঘড়ির দোকান আছে, নানারকম শখও আছে। তিনি শাস্ত্র পড়েন, পাখোয়াজ বাজান, মাছ ধরেন, সাহিত্যের খবরও রাখেন। প্রবীণ লোক, পাড়ার সকলেই খাতির করে। সকালবেলা আমার কাছে এসে বললেন, এই নাও তোমার ঘড়ি। হেয়ারস্প্রিং বদলে দিয়েছি, পনরো টাকা দিও, তুমি পাড়ার ছেলে, অয়েলিং—এর চার্জ আর তোমার কাছে নেব না।

টাকা নিয়ে নয়নচাঁদ বললেন, ও কি লেখা হচ্ছে?

উত্তর দিলুম, একটা স্মৃতিকথা লিখছি।

—বেশ বেশ, গল্পের চাইতে ঢের ভাল। কিন্তু বেশী মিছে কথা লিখো না, যা রয় সয় তাই লিখবে। কলেরা থেকে উঠেই ফুটবল ম্যাচ খেলেছ, দেশের জন্যে দশ বছর জেল খেটেছ, তিনটে মেয়ে তোমাকে প্রেমপত্র লিখেছিল, রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে তোমার পিঠ চাপড়েছিলেন, এসব লিখতে যেয়ো না। আর একটি কাজ তোমাদের করা উচিত, কিছু লেখবার আগে এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নেবে, ডাক্তার উকিল প্রফেসর ব্যবসাদার এইসব লোকের। তা হলে আর মারাত্মক ভুল করে বসবে না।

পাইন মশায়ের উপদেশ মনে লাগল। যা লেখবার আগেই স্থির করে ফেলেছি, তবে বিশেষজ্ঞদের মত এখনও নেওয়া যেতে পারে।

প্রথমেই গেলুম ডাক্তার নির্মল মুখুজ্যের কাছে। তিনি বললেন, কি খবর, কোমরের বেদনাটা আবার বেড়েছে নাকি?

—না না, ওসব কিছু নয়। আচ্ছা ডাক্তার, আমি যদি কোনও লোকের দুই কাঁধে হাত দিয়ে খুব চাপ দিই তা হলে তার শিরদাঁড়া ভাঙতে পারে?

—কতখানি চাপ?

—এই ধর দু—আড়াই মন।

অর্থাৎ এক শ কিলোগ্রামেরও কম। তাতে লোকটা কাবু হতে পারে, স্ক্যাপিউলা ফ্র্যাকচার হতে পারে, কিন্তু তিন চার মন চাপের কমে শিরদাঁড়া ভাঙবে মনে হয় না। ও কাজ করতে যেয়ো না, ফৌজদারিতে পড়বে।

ডাক্তারকে থ্যাংকস দিয়ে উকিল নগেন সেনের কাছে গেলুম। তিনি বললেন, ওহে, আমার একটা বিল এখনও শোধ কর নি, টাকাটা কালকের মধ্যে পাঠিয়ে দিও।

—যে আজ্ঞে। একটা কথা জানতে এসেছি।—একটি মেয়ে যদি জুলুম ক’রে একজন পুরুষকে বিবাহে রাজী করায় এবং পুরুষটি পরে অস্বীকার করে, তা হলে ব্রীচ অভ প্রমিস মকদ্দমা চলতে পারে?

—যদি প্রমাণ হয় যে জবরদস্তির ফলে পুরুষটি রাজী হয়েছিল তা হলে কেস টিকবে না।

—আচ্ছা, যদি প্রমাণ হয় যে জবরদস্তির পরেও পুরুষটি খোশ—মেজাজে মেয়েটিকে প্রিয়ে বলেছিল?

—তাই বলেছিলে নাকি হে? আচ্ছা বোকা তুমি। নাঃ, তা হলে আর নিস্তার নেই। তোমার এ কুবুদ্ধি হল কেন?

—আজ্ঞে আমি নই। আচ্ছা চললুম, নমস্কার।

তার পর গেলুম দাশু মল্লিকের কাছে। লোকটি বিখ্যাত মাতাল, তবে মেজাজ ভাল। আমাকে দেখেই বললেন, আরে তোমাকেই খুঁজছিলুম, একটা দরকারী কথা জানতে চাই। তুমি তো কেমিস্ট্রি পড়েছিলে?

—সে বহুকাল আগে, এখন সব ভুলে গেছি।

—একটু তো মনে আছে, তাতেই কাজ চলবে। দেখ ভাই, বড়ই মুশকিলে পড়েছি, কান্ট্রি আমার সয় না, অথচ বিলিতী একবারে আগুন, শুনছি সবরকম মদই বন্ধ করা হবে, যত সব গো মুখখু আইন তৈরী করছে। আচ্ছা, মিষ্টি জিনিস গেঁজে উঠলেই তো মদ হয়?

—তা হয়। কিন্তু বাড়িতে ওসব করতে যাবেন না, ফ্যাসাদে পড়বেন।

—আরে না না। আমি একটা মতলব ঠাউরেছি, আবগারির বাবার সাধ্য নেই যে ধরে। মনে কর আমি এক পো চিনি কিংবা গুড় খেলুম, সেই সঙ্গে একটু ঈস্ট বা পাঁউরুটিওয়ালাদের খামি খেলুম। তাতে পেটের মধ্যে বুঁদি কেটে স্পিরিট হবে না?

—আজ্ঞে না, আপনার পেটটি তো ভাঁটি নয়। গেঁজে উঠবার আগেই হজম হয়ে যাবে, না হয় প্রস্রাবের সঙ্গে বেরুবে।

—তবেই তো মুশকিল। যাক তোমার কি দরকার বল।

—আচ্ছা মল্লিক মশায়, যদি মদ খাওয়ার অভ্যাস না থাকে তবে কতটা খেলে নেশা হবে?

—বেশ বেশ, ওদিকে তোমার মতি হয়েছে জেনে খুশী হলুম। ট্রাই করেই দেখ না, এক আউন্স রম বা জিন থেকে শুরু করতে পার।

—আজ্ঞে আমি নই, আমার স্মৃতিকথার একটি লোককে খাওয়াতে চাই।

—আরে দূর দূর। তা আউন্স চারেক খাওয়াতে পার, গল্পের নেশায় তো দাম লাগবে না।

দাশু মল্লিককে নমস্কার করে বিদায় নিলুম। এখনও অনেক এক্সপার্ট বাকী, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী, প্রত্নবিশারদ, পুরাণজ্ঞ, আরও কত কি। অত অভিমত নেবার সময় নেই, একটু না হয় ভুলই হবে। এখন স্মৃতিকথা আরম্ভ করা যাক।—

রাজনন্দিনী পুষ্কলা বললেন, পিসীমা, এই দেখ দু শ খিলি পান সেজেছি। মুক্তোপোড়া চুন, কেরল দেশের কেয়াখয়ের, ঘিএ ভাজা সুপুরি আর তুমি যেসব মশলা ভালবাস—এলাচ লবঙ্গ দারচিনি জাফরান কর্পূর হিং রসুন বিটনুন ইত্যাদি তেত্রিশ রকম সব দিয়েছি। তোমার পানের বাটা ভরতি হয়ে গেছে। এইবারে স্মৃতিকথা বলতে হবে কিন্তু।

রাজভগিনী শূর্পনখা খুশী হয়ে বললেন, লক্ষ্মী মেয়ে তুই। আশীর্বাদ করি রূপে গুণে নিখুঁত একটি বরের সঙ্গে তোর বিয়ে হয়ে যাক, তা হলেই আমরা নিশ্চিন্ত হই।

—বর এখন থাকুক, তুমি স্মৃতিকথা বল।

—সে সব দুঃখের কাহিনী শুনে কি হবে? ওঃ, অযোধ্যার সেই বজ্জাতদের কথা মনে পড়লেই আমার মাথা বিগড়ে যায়, দাঁত কিড়মিড় করে, রক্ত টগবগিয়ে ফোটে, শোক উথলে ওঠে।

—তা হ’ক, তুমি বল।

বিকাল বেলা দোতলার বারান্দায় বাঘের চামড়ার উপর বসে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে শূর্পনখা সমুদ্রবায়ু সেবন করছিলেন, পুষ্কলা পানের বাটা এনে তাঁর পাশে বসলেন।

রাবণবধের পর দু বৎসর কেটে গেছে। বিভীষণ রাজা হয়েই লঙ্কার প্রাসাদ মন্দির উপবন প্রভৃতি মেরামত করিয়েছেন। হনুমান যে ভীষণ ক্ষতি করেছিলেন তার চিহ্ন এখন বেশী দেখা যায় না। বিভীষণ তাঁর ছোটবোনকে একটি আলাদা মহল দিয়েছেন, শূর্পনখা তাঁর চেড়ীদের সঙ্গে সেখানে বাস করেন। বিভীষণ আর সরমার উপর মনে মনে প্রচণ্ড আক্রোশ থাকলেও তাঁদের কিশোরী কন্যা পুষ্কলাকে তিনি স্নেহ করেন।

রাক্ষস ছলৎকারু, খুব ভাল কারিগর, যুদ্ধের সময় ইন্দ্রজিতের আজ্ঞায় সে মায়াসীতা গড়েছিল। ইন্দ্রজিৎ তাঁর রথের উপরে সেই মূর্তি কেটে ফেলে হনুমানকে উদভ্রান্ত করেছিলেন। শূর্পনখা এখন যে সুঁদরী কাঠের নাসাকর্ণ ধারণ করেন তাও ওই ছলৎকারুর রচনা। দেখতে প্রায় স্বাভাবিক, সহজে ধরা যায় না, কিন্তু শূর্পনখার কথার নাকী সুর দূর হয় নি।

পঁচিশ খিলি পান একসঙ্গে মুখগহ্বরে নিক্ষেপ করে শূর্পনখা তাঁর স্মৃতিকথা বলতে লাগলেন। —জানিস কলা, লঙ্কার এই রাজবংশ যেমন মহান তেমনি বিপুল। আমাদের মাতামহ ছিলেন প্রবল—প্রতাপ সুমালী, বিষ্ণুর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে তিনি লঙ্কা ত্যাগ করে রসাতলে আশ্রয় নেন। তখন যক্ষদের রাজা কুবের লঙ্কা অধিকার করল। সুমালীর কন্যা কৈকসী (যাঁর অন্য নাম নিকষা) মহামুনি বিশ্রবার ঔরসে তিন পুত্র আর এক কন্যা লাভ করেন। বড় ছেলে রাবণ, মেজো কুম্ভকর্ণ, ছোট তোর বাপ বিভীষণ, আর তাঁদের ছোট আমি। বিশ্রবার প্রথম পক্ষে এক ছেলে ছিল, সেই হল কুবের। রাবণ ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠলেন, তখন বিশ্রবা মুনির উপদেশে কুবের লঙ্কা ছেড়ে হিমালয়ের ওপারে পালিয়ে গেল, লঙ্কা আবার আমাদের দখলে এল।

পুষ্কলা বললেন, ওসব ইতিহাস তো আমার জানা আছে, তুমি নিজের কথা বল। তোমার একবার বিয়ে হয়েছিল না?

আরও পঁচিশ খিলি পান মুখে পুরে শূর্পনখা বললেন, বিয়ে তো একবার হয়েছিল। দানবরাজ বিদ্যুৎজ্জিহ্ব আমার স্বামী ছিলেন, অতি সুপুরুষ আর আমার খুব বাধ্য। কিন্তু বড়দার তো কাণ্ডজ্ঞান ছিল না, কালকেয় দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময় নিজের ভগিনীপতিকেই মেরে ফেললেন। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে লঙ্কেশ্বরকে যাচ্ছেতাই গালাগালি দিলুম। তিনি বললেন, চেঁচাস নি বোন, একটা স্বামী মরেছে তো হয়েছে কি? যুদ্ধের সময় আমি প্রমত্ত হয়ে শরক্ষেপণ করি, তোর স্বামীকে চিনতে না পেরে বধ করে ফেলেছি। যা হবার তাই হয়ে গেছে, এখন শোক সংবরণ কর, তোর জন্যে আমি ভাল ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমাদের মাসতুতো ভাই খর চোদ্দ হাজার সৈন্য নিয়ে দণ্ডকারণ্যে যাচ্ছে, তুই এর সঙ্গে সেখানে যা। খর তোর সমস্ত আজ্ঞা পালন করবে। দণ্ডকারণ্য খাসা জায়গা, বিস্তর ঋষি সেখানে তপস্যা করেন, অনেক ক্ষত্রিয় রাজাও মৃগয়া করতে যান। সেখানে তুই অনায়াসে আর একটি স্বামী জুটিয়ে নিতে পারবি।

খর—দাদার সঙ্গে দণ্ডকারণ্যে গেলুম। সত্যিই ভাল জায়গা, বিশেষ করে জনস্থান অঞ্চল, সেখানে আমরা বসতি করলুম। কিন্তু বড়দার সব কথা সত্যি নয়, ক্ষত্রিয় সেখানে কেউ আসত না, ঋষিও খুব কম, রাক্ষসের ভয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে তপস্যা করত। তবে খাবার জিনিসের অভাব নেই, বিস্তর আম কাঁঠাল কলা নারকেল, মধুও প্রচুর। নানা জাতের হরিণও পাওয়া যায়।

পুষ্কলা প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা পিসীমা, তুমি ঋষি খেয়েছ?

মুখে আবার পঁচিশ খিলি পান পুরে শূর্পনখা বললেন, আমাদের বাপ মহামুনি বিশ্রবা ঋষি—খাওয়া পছন্দ করতেন না। ছোটলোক রাক্ষসরা নরমাংস ভালবাসে, কিন্তু আমরা রাজবংশের মেয়েপুরুষ বড় একটা খেতুম না। তবে কোনও মানুষের উপর বেশী চটে গেলে তাকে ভক্ষণ করতুম আর পূজো—পার্বণে নিকুম্ভিলা দেবীস্থানে নরবলি দিয়ে সেই পবিত্র মাংস খেতুম। আমি বার পাঁচেক ঋষি খেয়েছি, ছিবড়ে বড় বেশী, কিন্তু ক্ষত্রিয় রাজা আর রাজপুত্রদের মাংস ভাল, কচি পাঁঠার মতন। সে—সব দিন আর নেই রে পুষ্কলা, তোর বাপের কি যে মতিচ্ছন্ন হল, সব বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর শোন—দণ্ডকারণ্যে বেশ ফুর্তিতেই ছিলুম, কিন্তু দিন কতক পরে বড় ফাঁকা ফাঁকা ঠেকতে লাগল, মনটা উদাস হয়ে পড়ল। বড় ঘরানার দানব বা রাক্ষস সে অঞ্চলে কেউ নেই, অগত্যা ঋষির সন্ধান করতে লাগলুম। বেশীর ভাগই বুড়ো হাবড়া, মাথায় জটা, এক মুখ দাড়িগোঁফ, তাদের সঙ্গে প্রেম হতে পারে না।

দণ্ডকারণ্যে আমার একটা সঙ্গিনী জুটেছিল, জম্ভলা রাক্ষসী, গোদাবরীতীরে থাকত। সে আমাকে বলল, সখী, তুমি ভেবো না, আমি একটি সুন্দর তরুণ ঋষি যোগাড় করে দেব। জম্ভলা খুব চালাক আর কাজের মেয়ে, চারদিকে ঘুরে সন্ধান নিতে লাগল। তার পর একদিন বলল, চমৎকার একটি ছোকরা ঋষি পেয়েছি দিদিরানী, আমাকে মুক্তোর হার বকশিশ দিতে হবে কিন্তু। জম্ভলা যে খবর দিল তাতে জানলুম, মুদগল নামে একটি সুন্দর তরুণ ঋষি সম্প্রতি জনস্থানে এসেছেন, গোদাবরী নদীর ধারে কুটীর বানিয়ে তপস্যা করছেন। সেই দিনই বিকেলে তাঁকে দেখতে গেলুম।

পুষ্কলা প্রশ্ন করলেন, খুব সেজেগুজে গিয়েছিলে তো?

আরও পঁচিশ খিলি পান মুখে পুরে শূর্পনখা বললেন, তা আর তোকে বলতে হবে না। চোখে কাজল, কপালে তেলাপোকার টীপ, গালের রং যেন দুধে—আলতা, ঠোঁটে পাকা তেলাকুচো, খোঁপায় শিমুল ফুল, কানে ঝুমকো—জবা, গলায় সাতনরী মুক্তোর মালা, পরনে নীল শাড়ি, বুকে সোনালী কাঁচুলি, আর এক গা গহনা। দেখলে পুরুষের মুণ্ডু ঘুরে যায়। মুদগল ঋষির আশ্রমে যখন পৌঁছলুম, তখন তিনি বেদপাঠ করছিলেন। তাঁকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলুম, আমার আগেকার স্বামীর চাইতে ঢের ভাল দেখতে। আমি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলে তিনি বললেন, ভদ্রে, তুমি কে? কি প্রয়োজনে এসেছ? আমি উত্তর দিলুম, তপোধন, আমি রাজকন্যা শুক্তিনখা—

পুষ্কলা বললেন, ও নাম আবার কোথা থেকে পেলে?

—আসল নামটা ভদ্রলোকের কাছে বলতে ইচ্ছে হল না। বাবা বিশ্রবার যেমন বুদ্ধি, তাই একটা বিশ্রী নাম রেখেছেন। শুক্তিনখা—কিনা ঝিনুকের মতন যার নখ। তার পর আমি বললুম, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আমি কাছেই থাকি। তিন মাস ধরে বিভীতক ব্রত পালন করছি, অহোরাত্রে শুধু একটি বিভীতক ফল অর্থাৎ বয়ড়া আহার করি। কাল আমার ব্রতের পারণ হবে, সেজন্যে একটি ব্রাহ্মণভোজন করাতে চাই। আপনি কৃপা করে কাল মধাহ্নে এই দাসীর কুটীরে পদধূলি দেবেন।

—আচ্ছা পিসীমা, সেই কচি ঋষিটিকে দেখে তোমার নোলা সপসপিয়ে উঠল না?

—তুই কিছুই বুঝিস না। যার প্রতি অনুরাগ হয় তাকে উদরসাৎ করা চলে না। মানুষটাকে যদি খেয়েই ফেলি তবে প্রেমের আর রইল কি? তার পর শোন। —মৃদগল ঋষি বললেন, সুন্দরী, তোমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলুম, কাল মধ্যাহ্নে তোমার ওখানেই ভোজন হবে।

পরদিন মুদগল এলে তাঁকে খুব খাওয়ালুম, নানা রকম ফল, মৃগমাংস আর পায়সান্ন। তাঁর ভোজন শেষ হলে বললুম, তপোধন, এক ঘটি এক মাধ্বীক পান করে দেখুন, অতি স্নিগ্ধ পানীয়, বনজাত পুষ্প থেকে মধুকর যে মধু আহরণ করে তাই দিয়ে আমি নিজে এই মাধ্বীক তৈরি করেছি। মুদগল বললেন, খেলে মত্ততা আসবে না তো? বললুম, না না, মাদক দ্রব্য কি আপনাকে দিতে পারি? খেলে মন প্রফুল্ল হবে, একটু পুলক আসবে। আপনি নির্ভয়ে পান করুন।

মুদগল চেখে চেখে সবটা খেলেন। বললেন, হুঁ, খুব ভালই তৈরি করেছ, বেশ ঝাঁজ। আর আছে? বললুম, আছে বইকি। মুদগল চোঁ চোঁ করে আর এক ঘটি খেলেন, তারপর আরও পাঁচ ঘটি। দেখলুম তাঁর চোখ বেশ ড্যাবডেবে হয়েছে, নাকের ডগায় গোলাপী রং ধরেছে, ঠোঁটে একটু বোকা—বোকা হাসি ফুটেছে, হাত একটু কাঁপছে। এইবারে এঁকে বলা যায়।

বললুম, মুনিবর, আপনাকে দেখে আমি মোহিত হয়েছি, আপনিই আমার প্রাণেশ্বর। আমাকে গন্ধর্ব মতে বিবাহ করুন।

মুদগল কিন্তু তখনও বাগে আসেন নি। বললেন, সুন্দরী, তোমার কুল শীল কিছুই জানি না, পাণিগ্রহণ করব কী করে? তা ছাড়া শাস্ত্রে বলে, স্ত্রীজাতি স্বাতন্ত্র্যের যোগ্য নয়। তুমি অবলা নারী, পিতা—মাতার অধীন, তাঁরাই তোমাকে পাত্রস্থ করবেন।

আমি বললুম, আমার পিতা—মাতা না থাকারই মধ্যে তাঁরা আমার খোঁজ নেন না। আমার আসল পরিচয় শুনুন, আমি হচ্ছি লঙ্কেশ্বর রাবণের ভগিনী।

চমকে উঠে ঋষি বললেন, অ্যাঁ, তুমিই শূর্পনখা। যতই রূপবতী হও রাক্ষসীকে আমি বিবাহ করতে পারি না। শুনেছি শূর্পনখা অতি ভয়ংকরী, নিশ্চয় তুমি মায়ারূপ ধারণ করে এসেছ।

আমি বললুম, ওহে মুদগল, রূপ তো নিতান্তই বাহ্য। আমি যদি মায়াবলে আমার বাহ্য রূপ বর্ধিত করি তাতে অন্যায়টা কি? তোমার ভয় নেই, এই মনোহর রূপেই আমি সর্বদা তোমাকে দর্শন দেব, কেবল রাত্রিতে শয়নকালে রূপসজ্জা বর্জন করব, নইলে আমার ঘুম হবে না। প্রদীপ নিবিয়ে অন্ধকারে আমি তোমার পাশে শোব।

—তোমাকে বিশ্বাস কী? যদি রাত্রিতে তোমার ক্ষুধার উদ্রেক হয় তবে হয়তো আমাকে ভক্ষণ করে ফেলবে।

—ভয় নেই, যাকে তাকে আমি খাই না, আর পতি তো নিতান্ত অভক্ষ্য। শোন মুদগল, আমাকে বিবাহ করলে অতুল ঐশ্বর্য পাবে, দশানন রাবণ, যাঁর ভয়ে ত্রিভুবন কম্পমান, মহাকায় মহাবল কুম্ভকর্ণ, আর সুবুদ্ধি ধর্মপ্রাণ বিভীষণ—এই তিনজকে শ্যালকরূপে পেয়ে ধন্য হবে।

মুদগল ঋষি দেখতে বোকার মতন হলেও অত্যন্ত একগুঁয়ে, কিছুতেই বশে এলেন না। আমার রাগ হল, বললুম, আমাকে অবলা ললনা ঠাউরেছ, নয়? দেখ আমার বল।

মুদগলের দুই কাঁধে হাত দিয়ে চেপে বললুম, লাগছে?

—ছাড় ছাড়।

—এই এক মন চাপ দিলুম, লাগছে?

—উঃ, ছাড় ছাড়।

—এই দু মন চাপ দিলুম, বিয়ে করতে রাজী আছ?

মুদগল যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলেন, মাধ্বীক যা খেয়েছিলেন, মুখ দিয়ে সব হড়হড় করে বেরিয়ে গেল। আমি বললাম, এই তিন মন চাপ দিলুম, আর একটু দিলেই তোমার মেরুদণ্ড মচকে ভেঙে যাবে। বল, প্রাণেশ্বর হতে রাজী আছ?

আর্তনাদ করে মুদগল বললেন, আছি আছি।

—আকাশে দিবাকর, আমার চতুর্দিকে এই চেড়ীবৃন্দ, আর সম্মুখে ওই উচ্ছিষ্ট লোভী কুকুর, সবাই সাক্ষী রইল। আবার বল, রাজী আছ?

—ওরে বাপ রে! আছি আছি। রাক্ষসী, তুমিই আমার প্রাণেশ্বরী।

তখন হাত তুলে নিয়ে আমি বললুম, আজই রাত্রির প্রথম লগ্নে বিবাহ।

কাতর হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মুদগল বললেন, প্রিয়ে, একটি দিন অপেক্ষা কর, আমার গায়ের ব্যথা মরুক, পিঠ সোজা হক। কাল আমার গুরুদেব মহর্ষি কুলত্থ আসবেন, তাঁর অনুমতি আর আশীর্বাদ নিয়ে তোমাকে পত্নীত্বে বরণ করব।

আমি বললুম, বেশ তাই হবে। কিন্তু খবরদার, যদি সত্যভ্রষ্ট হও তবে আমার জঠরে যাবে, সেখান থেকে সোজা নরকে।

একদিন পরে মুদগলের আশ্রমে গিয়ে দেখলুম, তার গুরু মহর্ষি কুলত্থ এসেছেন। আমি প্রণিপাত করলে তিনি প্রসন্ন হাস্য করে বললেন, রাক্ষসনন্দিনী, তোমাদের প্রণয়ব্যাপার শুনে আমি অতীব প্রীত হয়েছি। আশীর্বাদ করি, তোমাদের দাম্পত্যজীবন মধুময় হক। দেখি তোমার হাতখানা।

আমার কররেখা অনেকক্ষণ ধরে দেখে কুলত্থ বললেন, হুঁ, ভালই দেখছি, তোমার ভাগ্যে অদ্বিতীয় রূপবান পতিলাভ আছে। তা আমার এই শিষ্যটি কিঞ্চিৎ খর্বকায় আর দুর্বল হলেও রূপবান বটে।

আমি বললুম, ভগবান, ওই রূপেই আমি তুষ্ট। আপনি শিষ্যের কররেখা দেখেছেন?

মহর্ষি বললেন, দেখেছি বইকি। এক অদ্বিতীয়া সুন্দরীকে মুদগল পত্নীরূপে লাভ করবে।

হৃষ্ট হয়ে আমি বললুম, মহর্ষি, আপনার গণনা একেবারে নির্ভুল, রূপের জন্য আমি লঙ্কাশ্রী উপাধি পেয়েছি। সমগ্র জম্বুদ্বীপেও আমার তুল্য সুন্দরী পাবেন না।

কুলত্থ বললেন, তাই নাকি? তবে তোমাকে আমি জম্বুশ্রী উপাধি দিলুম। কিন্তু রাক্ষসনন্দিনী, তোমার কিঞ্চিৎ ন্যূনতা আছে। সম্প্রতি দশরথপুত্র রাম—লক্ষ্মণ বনবাসে এসেছেন, নিকটেই পঞ্চবটীতে কুটীর নির্মাণ করে বাস করছেন। রামের ভার্যা জনকতনয়া সীতাও তাঁদের সঙ্গে আছেন। তিনি তোমার চাইতে একটু বেশী সুন্দরী।

আমি রেগে গিয়ে বললুম, আমার চাইতে সুন্দরী এই তল্লাটে কেউ থাকবে না, সীতাকে আমি ভক্ষণ করে ফেলব। তার কাছে নিয়ে চলুন আমাকে।

মহর্ষি বললেন, তোমার সংকল্প অতি সাধু। এস আমার সঙ্গে।

কুলত্থ আর মুদগলের সঙ্গে তখনই পঞ্চবটীতে গেলুম। একটু দূরে বনের আড়ালে লুকিয়ে থেকে দেখলুম, কুটীরের দাওয়ায় বসে সীতা তরকারি কুটছে। পুরুষ জাতটাই অন্ধ, বলে কিনা আমার চাইতে সুন্দরী! বড়দা পর্যন্ত সীতার জন্যে খেপেছিলেন। তারপর দেখলুম, দুর্বাদলশ্যাম ধনুর্ধর এক যুবা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করল, তার পিছনে আর একটি যুবা এক ঝুড়ি ফল মাথায় করে নিয়ে এল। বুঝলুম এরাই রাম—লক্ষ্মণ।

পুষ্কলা বললেন, দেখেই তোমার মুণ্ডু ঘুরে গেল তো?

—ওঃ কি রূপ, কি রূপ! মানুষ অত সুন্দর হয় আমার জানা ছিল না। নিমেষের মধ্যে আমার মনোরথ বদলে গেল। কুলত্থকে বললুম, মহর্ষি, আমি ওই সীতাকে এখনই ভক্ষণ করছি, কিন্তু আপনার শিষ্য মুদগলকে আমার আর প্রয়োজন নেই, অদ্বিতীয় রূপবান ওই রামই আমার বিধিনির্দিষ্ট পতি, ওঁকেই আমি বরণ করব, ওঁর কাছে আপনার শিষ্য মর্কট মাত্র।

মহর্ষি বললেন, ছি রাক্ষসী, ও কথা বলতে নেই, তুমি যে বাগদত্তা।

উত্তর দিলুম, কথা আমি দিই নি, আপনার শিষ্যই দিয়েছিল, তাও স্বেচ্ছায় নয়, তিন মন চাপে কাবু হয়ে প্রাণেশ্বরী বলেছিল। ওকে আমি মুক্তি দিলুম। আমি এখনই রামের সঙ্গে মিলিত হব, আপনারা এখানে থেকে কি করবেন, চলে যান।

আমার কথা শেষ হতে না হতে মুদগলের হাত ধরে মহর্ষি কুলত্থ বেগে প্রস্থান করলেন।

শূর্পনখা অন্যমনস্ক হলেন দেখে পুষ্কলা বললেন, থামলে কেন পিসীমা, তার পর কি হল?

—ন্যাকামি করিস নি, কি হল তুই জানিস না নাকি?

হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে শূর্পনখা চিৎকার করে উঠলেন—ওরে রেমো সর্বনেশে, কি করলি রে! তারপর ছটফট করে হাত পা ছুঁড়তে লাগলেন, তাঁর কাঠের নাক—কান খসে পড়ল, মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে লাগল, দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল, চোখ কপালে উঠল।

পুষ্কলা চেঁচিয়ে বললেন, এই চেড়ীরা, শিগগির আয়, পিসীমা ভিরমি গেছেন। মুখে জলের ছিটে দে, জোরে বাতাস কর, লংকা পুড়িয়ে নাকের ফুটোয় ধোঁয়া দে।

১৩৬২ (১৯৫৫)