দ্বিতীয় পর্যায়
১
নন্তীদের বাড়ির একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। নন্তীদের পূর্ব-পুরুষেরা বাহিরের কোথা থেকে উঠিয়া আসিয়া এই গ্রামে বসতি করেন। অবস্থা ভালো ছিল না, গ্রামের এক প্রান্তে সস্তা দেখিয়া একটু জমি লইয়া দুইখানি চালা তোলেন। বেশ কিছুদিন যায়, গিরিবালাদের সে-সময়ের পরিবারের সঙ্গে কি করিয়া সৌহার্দ্য হয় এবং তাঁহাদেরই চেষ্টায় গিরিবালাদের বাড়ির নিকটে, সদর রাস্তাটুকুর ব্যবধান দিয়া একফালি জমি লইয়া ইঁহারা গ্রামের মধ্যে বসবাস আরম্ভ করেন। বহুদিনের কথা সে, একেবারে গোড়ার ইতিহাস। তাহার পর কয়েক পুরুষ কাটিয়া গিয়াছে। এক্ষেত্রে যেমন হইয়া থাকে,—কোন পুরুষে থাকে সদ্ভাব, কোন পুরুষে থাকে অসদ্ভাব, কোন পুরুষে হয়তো ঔদাসীন্য;- তবে বর্তমানের, অর্থাৎ এই পুরুষের সম্বন্ধটাকে একটা নাম দিয়া ব্যক্ত করা শক্ত। হয়তো চলেও একটা সংজ্ঞা দেওয়া, কিন্তু সেটা যখন আপনি প্রকাশ হইয়া পড়িবে তখন আর মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই। বরং গৌরচন্দ্রিকা হিসাবে গিরিবালাদের ফিরিবার পরদিনের কথাবার্তা হইতে উদ্ধৃত করিয়া আরম্ভ করা যাইতে পারে—
পরের দিন সকালবেলাই নন্তীর পিসিমা দামিনী পুকুরের ওদিককার ঘাট হইতে মুখ তুলিয়া বলিলেন— “কি গো গিরি, মামার বাড়ি থেকে কি সব নিয়ে এলি গো মোট বেঁধে?”
গিরিবালা হাসিয়া বলিল— “অনেক জিনিস পিসিমা, এসো না, দেখবে।”
“মুয়ে আগুন আমার! যাব বললেই যদি যেতে পারতাম, তবে তো আগে পারে যাবারই ব্যবস্থা করতাম। নেপটে পড়ে আছি।…তা যাব’খন দুপুরে, সব যেন খেয়ে ফেলিসনি, পিসির জন্যেও রাখিস দুটি। জেঠাই কি করছে?”
তখনই কি কাজে হঠাৎ উঠিয়া গেলেন বলিয়া গিরিবালার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হইল না।
দুপুরবেলা আসিলেন, নন্তীকে লইয়া। নন্তীর হাতে একটা নূতন পুতুল, যেন গিরিবালাকে নবৈশ্বর্যশালিনী ধরিয়া লইয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তৈয়ার হইয়া আসিয়াছেন।
জা কোথায় বাহিরে গিয়াছিলেন, বরদাসুন্দরী ঘুমন্ত শিশুকে পাশে শোওয়াইয়া একটা কাঁথায় ফুল তুলিতেছিলেন। গিরিবালা, সাতকড়ি আর হরিচরণ বর্ধিত সরঞ্জাম লইয়া শিউলিতলার খেলাঘর গোছাইতেছিল।
পিসি আসিয়া ডাকিতে গিরিবালা কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বরদাসুন্দরী বলিলেন— “পিসিমাকে পেন্নাম কর, এতদিন পরে এলি; কী যে হচ্ছেন মেয়ে, খেলা নিয়ে উন্মত্ত!”
“থাক, হয়েছে”–বলিয়া দামিনী তাহাকে ধরিয়া পাশটিতে বসাইলেন, মুখের দিকে একবার চাহিয়া বরদাসুন্দরীকে বলিলেন— “বলি, হ্যাঁগা বৌ, তোরা সব কী, মেয়েটাকে একবার ঘুরে দেখিস না?—কটা দিনই বা মামার বাড়িতে ছিল?—কিন্তু বলতে নেই, এরই মধ্যে ছিরি হয়েছে দেখ দিকিন মেয়ের! তারা তো হাতি-ঘোড়াও খাওয়ায়নি, দুধেও নাওয়ায়নি।”
“দুধে নাওয়াবে কি, তাদের নিজেদেরই কোনরকমে জোটে একটু প্রাণধারণের জন্যে। একটু আদর-যত্ন পেয়েছে কটা দিন,—মেজদিদি আর বৌদি, গিরির নাম নিতে অজ্ঞান একেবারে! এখানে, কোন্ দিকটা সামলাই, কাকে দেখি ঠাকুরঝি… দেখতেই তো পাও; মরবার ফুরসত থাকে না।”
দামিনীর মুখে একটা কথা আসিয়াছিল, যেন তুলিয়া রাখিলেন। গিরিবালাকে প্রশ্ন করিলেন— “তা কি কি নিয়ে এলি মামার বাড়ি থেকে?”
বড় ধামায় করিয়া সঙ্গে যাহা আনিয়াছিল সব কিছুরই নমুনা একটু একটু করিয়া বাড়িতে গেছে, কথার ভয়ে বরদাসুন্দরী নিজে দেখিয়া পাঠাইয়া দিয়াছেন। গিরিবালা তালিকা দিতে যাইলে বলিলেন— “ওসব আমি পেয়েছি লো, তোকে আর ফিরিস্তি গুনতে হবে না। তোকে কি দিলে তাই বল।” একটু হাসিয়া বলিলেন— “ওসব না পেলে তোর মার কিছু আর বাকি রাখতাম নাকি? তোকে কি কি দিলে?”
গিরিবালা উৎসাহের সঙ্গে তাড়াতাড়ি খেলার ঘরে গিয়া, মামার বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা জিনিস সব কোঁচড়ে করিয়া হাজির হইল। বরদাসুন্দরী যেন কাঠ হইয়া ঠায় একদৃষ্টে নিচুদিকে চাহিয়া ফুল তুলিতে লাগিলেন। গিরিবালা সম্পত্তিগুলা দাওয়ায় মেলিয়া ধরিলে দামিনী একটি হাসি মুখে পিষিয়া লইয়া একটু মুখটা ফিরাইয়া লইলেন। একটু থামিয়া বলিলেন— “আর যা দিয়েছে না হয় দিয়েছে, অন্ততঃ একটা পুতুল তো দিতে পারতো ভালো দেখে ছেলেমানুষের হাতে?…তা তোর মায়ের সামনেই বললাম বাছা, আমি আবার বড় ক্যাটকেঁটি…যা, খেলগে যা।”
বরদাসুন্দরী ঘাড় নিচু করিয়াই বলিলেন— “দুজনের হাতে দুটি টাকা দিয়েছে পুতুলটুতুল কেনবার জন্যে।”
সূচের একটা ফোঁড়ের সঙ্গে সঙ্গে মুখটা তুলিয়া বলিলেন— “আর, পাবেই বা কোথায় ঠাকুরঝি, তুমিই বলো না? সংসারটি তো একেবারে ছোট না, উপার্জন করতে ঐ তো একলা দাদা।”
দামিনী বলিলেন— “দেখো গেরো, বউ ভাবলে আমি বুঝি সত্যি বললাম কথাটা! মনে একটা কথা এল, ঠাট্টার সম্পর্ক, বলে ফেললাম, তুই রাগ করবি জানলে…”
বরদাসুন্দরী তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন— “না, না, রাগ করব কেন ঠাকুরঝি—রাগের কি বলেছ? আর, যদি তুমি একটা কথা নেয্য ভাবে বলেই থাক, হুট কবে রাগ করে বসব?—কথা উঠল, তাই বললাম অবস্থাটা, তোমাকে বলায় তো দোষ নেই?”
এর পরে অনেকক্ষণ ধরিয়া একথা সেকথা হইল। দামিনী একবার নন্তীকে বলিলেন— “যা না, খেলগে যা না; বড়রা একটু বসে কি দুটো সুখ-দুঃখের কথা কইছে, হাঁ করে শুনতে হবে? ঠিক মায়ের অব্যেসটি পেয়েছেন মেয়ে!
নন্তী চলিয়া গেলে আরও দু-একটা এদিক-ওদিকের কথা তুলিয়া দামিনী বলিলেন— “বৌ, বলব? কু-ভাবে নিবি না তো?…না বাছা, পরের কথায় থাকি না, জিগ্যেস করেই বলা ভালো।”
বরদাসুন্দরী এসব বাঁধা গৎ-এর অভ্যস্ত, জিজ্ঞাসা করিলেন— “কি কথা ঠাকুরঝি? বলবে বৈকি, তুমি বলবে তার আর…”
“না; নেহাৎ তোর মুখ দিয়ে ফুরসতের কথাটা বেরুল, প্রাণে গিয়ে বিঁধল, তাই বলছি; আর বেরুতে দোষই বা কি? নিজের সন্তানের দিকে একবার ফিরে দেখতে পাচ্ছি না, আর দুটো সংসারের পাট সারতে সারতে নাজেহাল হচ্ছি—এতে কোন্ মায়ের মনেই না আক্ষেপ হয় বল না—মায়েরই প্রাণ তো? একটা গাইও বিয়োলে বাছুরটাকে চেটেপুটে একটু সেঁহ-আত্তিস্য দেখায় যে। বলি, গিন্নি নিজে গেছেন কোথায় টহল দিতে?”
বরদাসুন্দরী মুখটা নিচু করিয়া আস্তে আস্তে ফোঁড় দিয়া চলিলেন।
দামিনী একটু থামিয়া বলিলেন— “কেন, আজকাল তো রসিক দু’পয়সা আনছে।”
বরদাসুন্দরী সেইভাবেই বলিলেন— “কৈ, দেখি না তো ঠাকুরঝি।
নেহাৎ একতরফায় সুবিধা হইতেছিল না, দামিনী একটু উৎসাহ পাইলেন। বলিলেন— “দেখবে কোথা থেকে বোন? বাড়ির দরজা না পেরুতে মা-লক্ষ্মী যে দাদার বাক্সয় গিয়ে ওঠেন। খবর রাখি তো একটু একটু। লক্ষ্ণণভাইয়ের অনেক ভোগান্তি বোন, গোড়াতেই একটু সাবধান হওয়া ভালো।”
বরদাসুন্দরী এবারে আর কিছু বলিলেন না। সেইভাবেই কাজ করিয়া চলিলেন।
দামিনী একটু থামিয়া বলিলেন— “রসিক তাহলে তোকেও কিছু জানায় না দেখছি?”
দামিনী মুখে একটা “চ্যু” করিয়া শব্দ করিলেন, বলিলেন— “বলিহারি শাসন ভাই আর ভাজের!”
বরদাসুন্দরী এ কথার উপরে কিছু বলিলেন না।
কথা অগ্রসর হইবার বেশ রসদ পাইতেছে না দেখিয়া দামিনী একটু একথা-সেকথা করিয়া উঠিয়া পড়িলেন, বলিলেন— “আসি এখন বৌ, আবার ছিষ্টির পাট পড়ে রয়েছে।”
বরদাসুন্দরী একটা মৌখিক প্রশ্ন করিলেন— “বসবে না ঠাকুরঝি আর একটু?”
“না, এখন আসি বৌ। বসবার কি জো আছে বেশিক্ষণ? মনে করলাম—গিরিটা কতদিন পরে এল, যাই একবার চট করে দেখে আসি।”
দরজা টপকাইয়া নিজের মনে বিড়বিড় করিয়া বলিলেন— “বসবে না ঠাকুরঝি?—ঠাকুরঝির বকে বকে মুখের ফেকো উঠুক, উনি চুপটি করে কাঁথার ফোঁড় তুলে যান। মুয়ে আগুন গোমড়ামুখী!”
.
এ-পুরুষে এক তরফের মনের ভাবটার একটা নিদর্শন দেওয়া গেল। এরূপ ক্ষেত্রে হয়তো ভাইয়ে ভাইয়ে আলাদা হইয়া উভয় পরিবারেই শুভার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার আবির্ভাব হয়, নয় তো বা শুভার্থীদেরই সঙ্গে মুখ-দেখাদেখি বন্ধ হয়;—এক্ষেত্রে দুইয়ের মধ্যে একটাও হইতেছে না। তাহারও একটু কারণ আছে এবং নিচের ব্যাপারটুকু থেকে সে সম্বন্ধে কতকটা আন্দাজ পাওয়া যাইবে।—
বসন্তকুমারী যেইখানেই থাকুন, খোকার দুধ খাওয়াইবার সময়টিতে ঠিক আসিয়া উপস্থিত হন বাড়িতে। কি কারণে ঠিক বলা যায় না, এ কাজটুকু নিজের হাতেই রাখিয়াছেন, বলেন— “তোর হাত বড় কড়া ছোটবৌ, কোনদিন কি করে বসবি! তোর আর ও উবগারটুকু করে কাজ নেই। মা-গিরি ফলাবার ঢের সময় পাওয়া যাবে এর পর।”
সময় হইয়াছে, বরদাসুন্দরী দাওয়ায় নারিকেল পাতা জ্বলিয়া দুধ জ্বাল দিতেছিলেন,–”কৈ রে ছোটবৌ, বলি খোকার দুধ খাওয়ার যে সময় হলো, সে হুঁশ আছে?”—বলিয়া বসন্তকুমারী বাড়িতে প্রবেশ করিলেন, এবং জায়ের যে সে হুঁশ একটু বেশি আছে তাহার প্রমাণ পাইয়া লজ্জিতভাবে বলিলেন— “কৈ খোকা?—আমারই বরং ঘোষ গিন্নির ওখানে একটু দেরি হয়ে গেল। যা গল্পে মানুষ!”
বরদাসুন্দরী একটু চাপা গলায় ডাকিলেন— “দিদি শোন; উঠে এসো না ওপরে।”
“কি লো?”—বলিয়া বসন্তকুমারী উপরে উঠিয়া আসিলেন।
“আজ দামু ঠাকুরঝি এসেছিল, এই খানিকক্ষণ আগে।”
“আসছে তো রোজই, নৈলে ভাত হজম হবে? তা নতুন কিছু বললে নাকি?”
“নতুন নয়, কিন্তু পুরনোও তো হয় না বলে বলে।—দুটো সংসারের পাট করতে নিজের সন্তানদের দেখে উঠতে পারিস না’…ওর নাম করে—তার তো আজকাল বেশ পশার হয়েছে—সব টাকা দাদার বাক্সয় ওঠে তো আর দেখবি কি করে?’…উত্তর দিচ্ছি না, তবু পাশে বসে গজর গজর। ছেলেপুলেগুলোকে তো সব্বদাই ধোওয়াচ্ছি মোছাচ্ছি দিদি, আর ক্রমাগতই খিট খিট করছি, মাখবে ধুলোমাটি তো কত সামলাবো বলো? আর এই এক ছাইয়ের ডাক্তারি হয়েছে—যা এক আধ পয়সা হাতে আসবে দাতব্য করে আসবে—শত্রুদের চোখ টাটিয়ে শুধু ফ্যাসাদ ডেকে আনা!…কী দুজ্জন মনিষ্যি দিদি!—কবে যে কী ঘটবে!…”
বসন্তকুমারী বলিলেন— “তুই কিছু বলিসনি তো?”
“দিব্যি দিয়ে রেখেছ তো বলব আর কি করে? তুলে নাও তো মুখ ছাড়ি একবার, গায়ে যেন বিষ ছড়িয়ে দেয় তাই বা করি কি করে ঝগড়া?—বড়ঠাকুর, উনি ভাববেন—দেখেছ? –বৌ-মানুষ হয়ে…”
“দিব্যি আমি কখনও তুলব না বোন, চুপ করেই শুনে যাস। তুই যে সংসারে আছিস সেখানে ও কিছুই করতে পারবে না। সেদিক দিয়ে আমি নিশ্চিন্দি আছি। হাজার ধুলেও কয়লার ময়লা কখনও ঘোচে না; স্বভাব, কি করবি বল?”
একটু হাসিয়া বলিলেন— “আর তোরও যেন কি হয়েছে। —রাগ করিসই বা কেন, আর অত ভয় করাই বা কিসের? আমার তো বেশ লাগে,—যাত্রায় না গিয়ে, বাড়িতে বসেই জটিলে -কুটিলের ভ্যানভ্যানানি শুনি—খরচ নেই, রাত-জাগা নেই। আমি হলে তো আরও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বাড়িয়ে তুলতাম।…চমৎকার লাগে আমার।… ‘হ্যালা ছোটবৌ, তিনি রাজ-রাণী নিত্যি টহল দিয়ে বেড়াবেন, আর তোর বরাতে বুঝি দুবেলা হাঁড়ি ঠেলা?…ছোটবৌয়ের হাতের রান্না না হলে বড় ঠাকুরের মুখে ওঠে না!…বলে নেকি বুদ্ধির ঢেঁকি!… সব ঐ বড় আবাগির কারচুপি, কবে বুঝবি?”
দামিনীর ভঙ্গি নকল করিয়া কথাগুলো টানিয়া টানিয়া বলিতে বলিতে বসন্তকুমারী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বরদাসুন্দরীও না হাসিয়া পারিলেন না। বড়ঠাকুরের তাঁহার হাতের রান্না- প্রিয়তার কথায় চোখের কোণে একটু অশ্রুও চকচক করিয়া উঠিল।
বসন্তকুমারীর রঙ্গ করিবার ঝোঁক চাপিলে সহজে ছাড়ে না। হঠাৎ দীপ্ত মুখে বলিয়া উঠিলেন— “ঠিক হয়েছে রে ছোটবৌ, আজ রাত্তিরে যাব’খন গতরখাকির ওখানে। তুই উত্তর দিসনি, নিশ্চয় চটে আছে। গেলে নিশ্চয় বলবে—(আবার দামিনীর নিজস্ব ভঙ্গিমা অনুকরণ করিয়া)-
‘ওমা, বড়গিন্নি যে! কী ভাগ্যি আমার! কোন্ দিকে আজ সূয্যি উঠেছে?’
আমি ভালো মানুষের মতন বলব—’বলে নাও ঠাকুরঝি জো পেয়ে। পাট সেরে এই দু’পা এসেছি, বলি ঠাকুরঝিকে কদ্দিন দেখিনি, একবার দেখে আসি—এইতেই ছোটরাণীর মুখে কত কথা উঠবে দেখে নিও। দেখতেই—দুই জায়ে আছে দিব্যিটি, কিন্তু কি সুখে যে আছি অন্তজ্জামীই জানেন।’
(আবার দামিনীর ভঙ্গী সহকারে)-
‘তা যদি বললি বড়বৌ তো বলতে হোল।–আজ দুপুরে পাট-সার্ট সেরে একবার মনে হোল—বড়বৌকে দেখে আসি। ছোটরাণীকে জিগ্যেস করলাম—কৈ গো, আমাদের বড়বৌকে দেখি না যে?…তা, বানিয়ে বানিয়ে এই তো কথা—বড়-রাণী রাজ্য তদারকে গেছেন। এই দেখো না ঠাকুরঝি, দুবেলা হাঁড়ি ঠেলা; রাজ্যের ঝঞ্ঝাট, একটু ফুরসত নেই যে, নিজের পেটের সন্তানগুলোকেও একবার কাছে ডেকে—”
পূর্বের চেয়ে আরও জোরে বসন্তকুমারী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। তাহার পর সামলাইয়া লইয়া ভাবভঙ্গী সব বদলাইয়া বলিলেন,–”দে, তোর হোল? দাঁড়া, খোকাটাকে নিয়ে আসি।—মুখে আগুন পোড়াকপালির, নাম করলেই হাতের কাজ পর্যন্ত ভুলে বসে থাকতে হয়। অতএব রোগটা হোল, মোলোও না তো?—যমেরও অরুচি!”
.
এইখানে আর একটি মানুষের কথা বলিয়া রাখি, তাহা হইলেই নন্তীদের বাড়ির আসল পরিচয়টা দেওয়া হইয়া যায়। স্বয়ং কর্তার কথা।
নিকুঞ্জলাল লোকটি অত্যন্ত মৃদু স্বভাবের। আস্তে আস্তে খুব স্পষ্ট স্পষ্ট করিয়া কথা বলেন, বেশ থিতিয়া-জিরাইয়া ভাবিয়া-চিন্তিয়া, আর মানুষ যতটা পারে মিষ্টি করিয়া। একসঙ্গে গড়-গড় করিয়া যে বেশি কথা বলিয়া যাওয়া তাহাও নাই। হাতে প্রায় সর্বদাই একটি হুঁকা থাকে, খানিকটা বলিয়া হুঁকাটা ফর্ ফর্ করিয়া একটু টানিয়া লন, আবার বলেন; কি বলিয়া গেলেন, ফল কি হইতে পারে যেন সঙ্গে সঙ্গে হিসাব করিয়া লন, কি বলিবেন তাহাও একবার ভাবিয়া লন—এই মনে মনে ভাঁজা আর পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়া নিকুঞ্জলালের বক্তব্য চলিতে থাকে।
গৃহিণীকে দুয়ারের পাশে না দাঁড় করাইয়া বিচক্ষণ বরের বাপ যেমন কোন কাজের কথা পাড়েন না, হুঁকা হাতে না করিয়া নিকুঞ্জলালও তেমনি কোন আলোচনা কি মন্তব্যে অগ্রসর হন না; না থাকিলে ত্বরায় আনাইয়া লন। লোকে বলে—নিকুঞ্জলালের হুঁকাটা সজীব, ফরফরানির মধ্য দিয়া নিয়তই কানে মন্ত্রণা ঢালে।
নিকুঞ্জলালের বৃত্তি ঘটকালি। এটা হইল বংশগত বৃত্তি; নিজের বুদ্ধি-বৃত্তি দিয়া আরও অনেকগুলি দাঁড় করাইয়াছেন। আইন-কানুনে একজন হুঁশিয়ার লোক, জেলার বড় বড় উকিল- মোক্তারের নাক কাটেন; প্রায়ই লোকের দরকার হয় তাঁহাকে, আদালত মাড়ান না এমন দিন খুব কমই যায়। এমন বুক পাতিয়া জেরার ধাক্কা সামলাইতে খুব কম লোকেই পারে।
মন্ত্রণা ভিন্ন মন্ত্র দেওয়াও আছে। দূরে দূরে—অনেকগুলি যজমান গড়িয়াছেন, স্বকৃতই। আরও কি কি সব আছে, অনুসন্ধিৎসু লোকে এখনও জানিয়া উঠিতে পারে নাই।
ভদ্রাসনটি পৈতৃক। কোঠাটা নিজেই তুলিয়াছেন। সরিকদারের মধ্যে একটি কনিষ্ঠ ভাই ছিল। রোদ-ছায়ার নিয়মানুসারেই এমন-এমন দাদার ভাইয়েদের অনেক সময় একটু ধর্মের দিকে টান হয়। নিকুঞ্জলালের কনিষ্ঠেরও একটু ছিল—জপ, সাধুসঙ্গ, তীর্থ প্রভৃতির সুবিধা করিয়া দিয়া ভাইয়ের প্রবৃত্তিকে বাড়াইয়া বাড়াইয়া নিকুঞ্জ তাহাকে কায়েমী ভাবে বিবাগী করিয়া দিয়াছেন। এখন একছত্র মালিক; বয়োজ্যেষ্ঠ কেহ আসিলে কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিয়া বলেন— “আশীর্বাদ করো মতি-গতি ফিরুক, ফিরে আসুক সে।”
গভীর জলের মানুষ—নূতন লোকের পক্ষে চিনিতে সময় লাগে। নিকুঞ্জলালের চরিত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ওঁর সম্মোহনী শক্তি। চিনিয়াও আবার লোককে ওঁর কাছে আসিতে হয়;—দায়ে পড়িয়াও, আবার মোহের বশেও।
পরিবারের মধ্যে ঐ বিধবা বড় ভগ্নী—দামিনী, একটি কন্যা,—নন্তী, আর স্ত্রী,—রাইমণি।
স্ত্রীটি ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। অত্যন্ত ভয়প্রবণ, নিরীহ, ভালোমানুষ; কথাবার্তা নিকুঞ্জলালের চেয়েও মৃদু এবং মন্থর, তফাৎ এই যে রাইমণির এটা ভয়ে;—সর্বদাই একটা আতঙ্ক, কি বুঝি বেফাঁস বলিয়া ফেলিলেন, কি বুঝি একটা অঘটন ঘটিল!
—অমন স্বামী আর অমন ননদের চাপে যেমনটি হওয়া সম্ভব আর কি। চাপটা অবশ্য ননদেরই বেশি; ননদের আওতায় পড়া বধুর সম্বন্ধে একটা কথাই চলিয়া গেছে গ্রামে—’রায়বাঘিনীর রাইমণি’।
২
বেলে-তেজপুরের দিনগুলি শান্তগতিতে গড়াইয়া চলিয়াছে, কানানদীর মতো। যখন কালেভদ্রে দামোদরের জল নামে, কানানদী একটু জাগিয়া ওঠে, দু-পাঁচদিন তীরের আগাছাগুলো একটু নাড়া খায়; দু-পাশের শিশুমহলে একটু স্নানের হুড়াহুড়ি পড়ে, দু-কুল ব্যাপিয়া একটু যেন প্রাণের সঞ্চার হয়। তাহার পর আবার নদী খাদে নামিয়া যায়, স্রোত হইয়া আসে মন্থর; ক্রমে অতি মন্থর— স্রোতের প্রায় কোন চিহ্নই থাকে না; নিতান্ত তলায় একটা অচঞ্চল স্বচ্ছ জলের ফালি পড়িয়া থাকে— কানানদীর প্রতিদিনের আসল রূপ।
বেলে-তেজপুরেরও এই ইতিহাস। সিংহবাহিনী কি বারোয়ারি তলায় একটা পূজা, কিংবা চৌধুরীদের বাড়িতে একটি বড় কাজ হইলে—গাঁয়ের মধ্যে ঘটনাটিকে কেন্দ্র করিয়া কিছুদিন পরে পর্যন্ত একটা স্পন্দন জাগিয়া উঠে, খানিকটা ছুটাছুটি, খানিকটা দলাদলি, খানিকটা বকাবকি; তাহার পর জীবন আবার খাদের বীচিহীন স্বচ্ছ ধরাটিতে নামিয়া আসে,—নাকে চশমা দিয়া আর বাঁহাতে হুঁকা লইয়া নিকুঞ্জলাল মকদ্দমার খাতাপত্র, কি পাত্র-পাত্রীর কোষ্ঠী-ঠিকুজি বিচারে নিজের বাহিরের ঘরে লীন হইয়া থাকেন; ভগ্নী দামিনী এবাড়ি-সেবাড়ি ঘুরিয়া ভাঙনের মন্ত্র পড়িয়া বেড়ান; অনুগত হারাণের মাথায় ঔষধের বাক্স চাপাইয়া ফকরে ঘুড়ির পিঠে চাপিয়া রসিকলাল একের বাড়িতে যাহা উপার্জন করেন অন্যের বাড়িতে তাহা বিলাইয়া বেড়ান; দুলালের বৌ ‘বামুন ডাক্তার’-এর পথ চাহিয়া একটি-না-একটি শিশুকে বুকে লইয়া দুঃখ, দারিদ্র্য আর মাতৃত্বের শ্রীতে কুটির দ্বারে দাঁড়াইয়া থাকে। রসিকলালের প্রত্যাশায় থাকেন আরও একজন, কিছু কম আগ্রহের সঙ্গে নয়;—পণ্ডিতমশাই রাস্তার ধারেই সিমেন্টের বেঞ্চিটিতে বসিয়া থাকেন; পাশে এক-আধটা খাতা, দু’একখানা বই। খাতার মধ্যে একটা হয়তো রসিকলালের পদ্যের খাতা। পণ্ডিতমশাইকে সংশোধনের জন্য দিয়া গিয়াছেন রসিক, সেই সূত্রে কোন্ লাইনে কি অপূৰ্ব্ব অর্থগৌরব বা ব্যঞ্জনা আবিষ্কার করিয়াছেন পণ্ডিতমশাই বলিবার জন্য উদগ্রীব হইয়া থাকেন। আসিলেই দু’জনের মুখেই এমন একটা আলো খেলিয়া যায় যাহার সন্ধান দিবসের কোন মুহূর্তেই অন্য কোন ব্যাপারের মধ্যেই পাওয়া যায় না। রসিকলাল ঘুড়ির পিঠ হইতে নামিয়া আসেন, এমন হালকা হইয়া যান মনে হয় শুধু যে বাহনটিরই ভার লাঘব করিলেন এমন নয়, নিজেও যেন মস্ত বড় একটা বোঝা পিছনে ফেলিয়া দিয়া আসিলেন। পণ্ডিতমশাই বলেন— “গিন্নির কথা—’রসিক এলেই তোমার নাওয়া-খাওয়া যায় উল্টে, কি যে হয় দু’জনে বসে!’…বলি ‘ঐ সময়টুকু আমাদের প্রতিদিনের জীবনের বানপ্রস্থ,—নিজের কথাও মনে থাকে না, তোমাদের কথাও মনে থাকে না।’…হাঃ—হাহা…”
রসিকলাল মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু তাঁহার লঘু মন ঠিক ঐ কথাটিতেই সায় দেয়- প্রতিদিনের বানপ্রস্থ—প্রতিদিনের বানপ্রস্থ—সংসারমুক্ত কয়েকটি নির্মল, সৌম্য মুহূর্ত—বানপ্রস্থ যে স্বর্গের কাছাকাছি।
আরম্ভ হয় কবিতার আলোচনা— “তুমি যে কি ক্ষতিটি করেছ লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে! এইসব ভাব কি সচরাচর চোখে পড়ে আজকাল? এগুলো প্রতিভার ক্ষণিক স্ফুরণ—বিদ্যুতের এক- একটা ক্ষণিক বিকাশ—বুঝতে হবে পিছনে একটা মস্ত বড় শক্তি আছে; তা তুমি নিজেও চিনলে না নিজেকে, কেউ চিনিয়েও দিলে না। এই যে পেয়েছি শোন…”
বেড়ার পাশে ঔষধের বাক্সের পিঠে হারাণের তবলার বোল মৃদু হইতে স্পষ্টতর হইয়া উঠিতে থাকে। তন্ময় হইয়া মাথা নাড়িয়া একলাই চালাইতেছে। প্রভুর চেয়ে আরও সৌভাগ্যশালী—তাহার বানপ্রস্থ একেবারে হাতধরা; বাক্সটা লইয়া একটু তফাতে বসিতে পারিলেই হইল।
বেলে-তেজপুরে জীবনের স্রোতে এই সব রেখার পাশে আরও অনেক রেখা ফোটে, সব এমনই মন্দগতি অচপল।
কাব্যের সঙ্গে গিরিবালারও আলোচনা হয়। পণ্ডিতমশাই প্রশ্ন করেন— “শিবপুজোটা তো করে যাচ্ছে নাতনী? না, লক্ষ্য রেখো।”
আলোচনাটুকুতে একটা বেদনার সুর থাকে। গৌরীদান হয় নাই, হইবার সম্ভাবনাও নাই আর। পণ্ডিতমশাইকে সঙ্কল্পটা জানাইবার পর বহুদিন চলিয়া গেছে। তখন গিরিবালার বয়স ছিল আট বছরের মাস দুয়েক বাকি, এখন নয় বৎসরের প্রায় অতটাই কাছাকাছি আসিয়া গেছে। মজার কথা এই যে, এ সম্বন্ধে আলোচনা প্রায় রোজই চলিলেও, যখন প্রকৃতই দু-একটা পাত্রেরই সন্ধান পাওয়া গেল, তখন দেখা গেল গৌরীর বয়সের সঙ্গে ‘অষ্টবর্ষে’-র আর বিশেষ কোন সম্বন্ধই নাই।
এখন গিরিবালার বিবাহের উল্লেখ মাত্রেই একটি নৈরাশ্যের সুর থাকে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যেদিন এই তথ্যটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়, প্রথম আঘাতের স্তব্ধতার পরেই দুজনেই হঠাৎ বেশিরকম মুখর হইয়া উঠিয়াছিলেন—যেন কি একটা দুর্ভাবনা নামিয়া গেল। পণ্ডিতমশাই সান্ত্বনা হিসাবে বলিয়াছিলেন— “এর জন্যে তুমি খেদ রেখো না রসিক। ভেবে দেখো না, আজকালকার একটা আট বছরের মেয়ের সঙ্গে আগেকার আট বছরের মেয়ের তুলনা চলে? যুগটা কি যাচ্ছে দেখতে হবে তো? না, এইবার এসো, একটু কোমর বেঁধে লাগা যাক; ও তোমার এক-আধ বছরের এদিক ওদিকে কিছু যাচ্ছে আসছে না; যুগটা দেখতে হবে যে গো।”
রসিকলাল উৎসাহের সঙ্গেই বলিয়াছিলেন— “হ্যাঁ, আমরাও চেষ্টা করি, ওদিকে দাদাও নিকুঞ্জদাকে বলে রেখেছেন।”
নিকুঞ্জলালের নামে পণ্ডিতমশাইয়ের মুখটা একটু শুকাইয়া গিয়াছিল, প্রশ্ন করিলেন- “নিকুঞ্জের পরামর্শ তোমার দাদা নেন নাকি বেশি?”
তখনই সে-ভাবটা সামলাইয়া লইয়া বলেন— “তা ভালোই তো, নিকুঞ্জ হল যাকে বলে জাত ঘটক। দেখুক না। তবে কি জান? —আত্মচেষ্টার মতো কিছুই নেই দাঁড়াও, তোমাদের হেডমাস্টারমশাই যে কি ইংরিজিটা বলতেন—হ্যাঁ—মাই গুড় রাইঠ্যাং…ঠ্যাং না কি বলতেন আমার ঠিক মনে নেই বাপু, তখন করে নিয়েছিলাম মুখস্থ।”
গৌরীদানের বয়স পারাইয়া যাওয়ায় মনটা প্রসন্ন ছিল বলিয়া নিকুঞ্জঘটিত ব্যাপারটাকে সেদিন বেশি আমল দেন নাই।
গিরিবালার শিবপূজার একটু ইতিহাস আছে। সেবার সিমুর থেকে ফিরিয়া শিবপূজা আরম্ভ করিয়াছিল; আত্মচেতনার সঙ্গে এবং তাহারই পাশে পাশে একটা বৃহত্তর জগতের সহিত পরিচয়ের সঙ্গে, এক ধরনের উচ্চাশা জাগিয়াছিল মনে,—হওয়ার মধ্যে দিয়া, পাওয়ার মধ্যে দিয়া- আত্মোপলব্ধির একটা কৈশোর বাসনা। কি হওয়া, কি পাওয়া ঠিক বোঝা যায় না—চিত্রের রেখা খুবই অস্পষ্ট কিন্তু অস্পষ্ট বলিয়াই আরও মোহন।—শিবঠাকুর সব দেন, বেশ ঘরোয়া ঠাকুরটি, পূজারও বিশেষ কোন হাঙ্গাম নাই। মাটির ছোট তালটিকে মাঝখানে একটু টিপিয়া-টুপিয়া মাথায় ছোট একটি গুলি বসাইয়া দেওয়া। তাহার পর এক মুঠা বিন্নপত্র আর গোটাকতক ধুতুরার ফুল, ব্যস্। বরাৎগুণে কোন দিন যদি একটু গঙ্গাজল জুটিল তো মনে হয় ঠাকুর যেন সমস্ত পৃথিবীটা হাতে তুলিয়া দিতে পারেন। চমৎকার ঠাকুর; গিরিবালা তো গল্প শোনে জেঠাইমার কাছে—ভক্তকে রাজা করিয়া বেড়ান অথচ এদিকে নিজে ভিখারি! এমন আত্মভোলা ঠাকুরের উপর দয়াও হয় খানিকটা। দুইটা ধুতুরা বিশ্বপত্র না দিলে মন কেমন করে যেন।
গিরিবালা এদিকে বরাবর পূজা করিয়া যাইতেছিল, তারপর গেল একবার মামার বাড়ি। সেকালের মেয়েরা প্রায় এই বয়সে করিত ঐ পূজাটা, কেহ আশ্চর্য হইল না। মামী জিজ্ঞাসা করিলেন,— “হ্যালা, পুজো করিস, তা মন্তর টন্তর কিছু জানিস? না, শুধু—আমি ঠাকুর হাবলা গোবলা, ফুল খাও খাবলা খাবলা?”
গিরিবালা জেঠাইমার কাছে শেখা মন্ত্রটা যথা- অশুদ্ধি বলিয়া গেল—
ধ্যায় নৃত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্র বতাংসং
রত্নকল্পো জলং ঘং পরশুমৃগবরা ভীতিস্তং…
মাসি বলিলেন— “বেশ, এই তো দিব্যি শিখেছিস। পুজোর পর বর চাস তো?—মানে, পুজোর শেষে বলিস তো—ঠাকুর আমায় অমুক জিনিসটা দাও, আমি এইটে চাই, আমি ঐটে চাই?…কি বলিস শুনি তো?”
গিরিবালা দুই হাতের আঙুলে এটা মুদ্রা সৃজন করিয়া বলিল— “ ‘নমঃ ফট্’ বলে এমনি করে ধরে শুইয়ে দিই।”
কাত্যায়নী বিস্মিতভাবে বলিলেন— “ব্যাস্!” তারপর খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন— “ও পিসিমা, শোন সে তোমার নাতনীকে শিবঠাকুর কিরকম ঠকিয়ে রোজ পুজো আদায় করে যাচ্ছেন। ফুল বিথিপত্তোর নিয়ে ‘নমঃ ফট্’ বলে শুয়ে পড়েন, না হয় বর দিতে, না হয় কিছু একি বাপু—ছেলেমানুষকে ওমনি-ওমনি খাটিয়ে নেওয়া।”
গিরিবালার রাঙাদিদিমাও শুনিলেন, হাসিয়া বলিলেন— “পুজো, মন্তর ঠিকই আছে, ওর জেঠাইমা কি ভুল শেখাবে? তবে, আইবুড়ো মেয়ের পুজো আর একটু জুড়ে দিতে হয়।…বলবি, শিবের তুলি বর দাও, নারায়ণের ঘর দাও।”
পিসি চলিয়া গেলে কাত্যায়নী গিরিবালাকে বুকে জড়াইয়া, যেন নিজের বুকে সঞ্চিত সব তৃষ্ণা ঢালিয়া বলিলেন— “শুনলি? সব চাইবি, আরও চাইবি, ছেলে দাও, মেয়ে দাও, নাতি দাও, নাতকুড় দাও। চাইবি বুড়োর কাছে, তোর মতন মেয়েকে দেবে না তো কার জন্যে রেখেছে সব?…সবাই কি কাতি আবাগি?”
শিবপূজার এই গূঢ় উদ্দেশ্যটি বোঝা পর্যন্ত, গিরিবালা লজ্জার বশে পূজা পর্যন্ত ছাড়িয়া দিয়াছে। মা জেঠাইমা মাঝে মাঝে ঝোঁক হইলে তাগাদা দেন, রসিকলালও বলেন। গিরিবালা কর্মের অজুহাতে এড়াইয়া চলে।
এক বৎসরের পূর্বের গিরিবালার চেয়ে এক বৎসরের পরের গিরিবালা একটু আলাদা হইয়া পড়িয়াছে নানা দিক দিয়াই। শৈশব আর কৈশোরের সেতুরূপে খেলাঘরটা ছিল, সেটাও গিরিবালার জীবন থেকে ধীরে ধীরে সরিয়া যাইতেছে। এ বিচ্ছেদটা ভালো করিয়া ঘটাইল হরিচরণ। ঘটনাটি কিছুদিন পূর্বের এবং বেশ একটু কৌতুকপ্রদ।
সেই হাতভাঙা পুতুলটির হাজার খোঁজ করিয়াও সন্ধান মেলে নাই। তবে পুতুল-সম্পদে গিরিবালা এখন বেশ সম্পন্ন। যদিও রমেশের দোকানের মোমের পুতুলটি বাপ আর মেয়ের জল্পনার মধ্যেই রহিয়াছে, তবু মামার বাড়ি থেকে অনেকগুলি সংগ্রহ হইয়াছে, এদিক-ওদিক থেকে আরও কয়েকটা আসিয়া পড়িয়াছে, এখন ছেলে-মেয়ে বৌ-জামাইয়ে বাড়িটি গমগমে।…হরিচরণও একটু মানুষের মতো হইয়া আসিতেছে, মামা ছাড়া অন্য দু-একটা ভূমিকাও করে মাঝে মাঝে…কখনও গুরুমশাই হইয়া একটু দুরে কৃষ্ণচূড়ার তলে পাঠশালা খুলিয়া বসে—গিরিবালার বাড়ির, নন্তীর বাড়ির ছেলে-মেয়ে লইয়া বেত আছড়ায়। কখনও হয় ডাক্তার, কখনও বা আর কিছু। আজকাল আসল সংসারে গিরিবালার একটু বেশি খাটিতে হয়; তবু ফুরসত পাইলে যখন খেলাঘর পাতে তখন জমে ভালো।
একদিন নন্তীর মেয়ের সঙ্গে গিরিবালার ছেলের বিবাহের যোগাড়-যন্ত্র চলিতেছে। পুতী মামার বাড়ি হইতে বেড়াইতে আসিয়াছে; তাহার আসাটা এই বিবাহ উপলক্ষ করিয়াই এইরূপ ধরিয়া লওয়ায় খেলাটা একটু বেশ করিয়াই জমিয়াছে। পুতীর মামার বাড়ি শহরে, মামারাও বেশ অবস্থাপন্ন, এই সব কারণে সমবয়সীদের মধ্যে সে একটু খাতির পায়ও বেশি, আর মাঝে মাঝে দু-একটা নূতন ধরনের কথা বলিয়া খাতির আদায়ও করিতে জানে বেশ।
সব ঠিক, বর বাহির হইবে; হরু পুরুত, পূজার ঘর থেকে কিছু উপচার সরানো যায় কিনা দেখিতে গিয়াছে, এমন সময় নন্তী কাঁদ-কাঁদ হইয়া আসিয়া বলিল— “গিরিদিদি ভাই, সব্বনাশ হয়েছে, খোকা মেয়ের কি করেছে দেখোসে!”
খোকা হরিচরণের ছোটটি; দুলিয়া দুলিয়া হাঁটিতে শিখিয়াছে, সুযোগ পাইলে অনিষ্ট-সাধনে বেশ তৎপর।
গিয়া দেখা গেল পুতুলের মুণ্ডুটি তাহার হাতে। নন্তী সব ঠিক করিয়া কৌতূহলবশে একটু বরের বাড়ির সরঞ্জাম দেখিতে আসিয়াছিল, ফিরিয়া গিয়া দেখে—এই কাণ্ড। দিদি যাইতেই খোকা জবাবদিহি হিসাবে বলিল— “ছাছি!’ অর্থাৎ শাশুড়ী।
“রাক্কুসে ছেলে!” বলিয়া গিরিবালা একটু মৃদু তিরস্কার করিল বটে, কিন্তু ক্ষতিটা সহিয়া যাইতে হইল, কেননা খোকাকে কাঁদাইলে জেঠাইমা খেলা বন্ধ করিয়া দিবেন। এক-পয়সানে মাটির পুতুল মাঝে মাঝে অমন একটা যায়ই, তাহা ভিন্ন শেষ মুহূর্তটিতে অমন একটা দুর্ঘটনা ঘটাইয়া খেলাটাকে প্রায় সত্যের কাছাকাছি আনিয়া দিয়াছে খোকা, একদিক দিয়া লাভই।
গিরিবালা অতঃপর কি করা যায় চিন্তা করিতেছিল, পুতী মুখটা গম্ভীর করিয়া নম্ভীকে বলিল— “তোমার ঘরের কথা বুঝি না ভাই, আমাদের এককাঁড়ি খরচ হয়ে গেছে, এখন পাবই বা কোথায় মেয়ে আমরা?”
পুতীরই পরামর্শে নন্তী বরের মার বিস্তর হাতে পায়ে ধরিল এবং তাহারই পরামর্শে শেষ পর্যন্ত একটা রফাও হইল;—নন্তীর মেয়ের সঙ্গে যে ঝি আসিবার কথা ছিল, তাহাকে কনে সাজাইয়াই আপাতত বিবাহ দেওয়া স্থির হইল। পুতী বলিল— “নৈলে যে দাঁড়িয়ে অপমান হই আমরা সমাজের কাছে ভাই; এ পাড়াগাঁ নয়, শহরের সমাজ, জান না তো তোমরা!”
গিরিবালা কৃতজ্ঞচিত্তে বলিল— “ভাগ্যিস বোন-পো ভেবে এসেছিলি পুতী, একটা সমিস্যে মিটিয়ে দিলি, আমার তো মাথা গুলিয়ে গেছল একেবারে!”
বিবাহ আরম্ভ হইয়া গেলে গিরিবালা হরুকে বলিল— “তুই পুরুতের কাজটা সেরে নিয়ে ডাক্তার হবি; মেয়েটার চিকিচ্ছে করতে হবে তো?”
পুতী আবার মুখটা গম্ভীর করিয়া বলিল— “তা করতে হবে না? একে বিয়ে হোল না, তায় মুণ্ডু গেল—একসঙ্গে দুটো চোট সইতে পারে ছেলেমানুষ?”
খেলা ভাঙিবার পর ভাঙা পুতুলটা হরিচরণের জিম্বা করিয়া দেওয়া হইল।
.
হরু ছেলেটি বেশ চালাক। ছোট হইলেও তাহার সব কাজেই মৌলিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। দিদির খেলাঘরের ডাক্তার পদের গৌরব লাভ করিবার সুযোগ অনেকবার হইয়াছে বটে, কিন্তু কখনও এত বড় সার্জারির কেস হাতে পড়ে নাই। সমস্ত দিন সে বড় অন্যমনস্ক হইয়া রহিল, গতিবিধিটাও যেন একটু ছমছমে। তাহার পরদিন যখন আবার খেলা আরম্ভ হইল, হরুর ডাক্তারি দেখিয়া সবার, এমন কি শহরবাসিনী পুতীরও তাক লাগিয়া গেল। পুতুলের গলাটি ধড়ের সঙ্গে পরিপাটি করিয়া জেয়ল-আঠা দিয়া জুড়িয়া এমনভাবে ব্যান্ডেজ করিয়াছে যে মনে হয় যেন হারাণের হাতের কাজ। আগে তো উহারা বিশ্বাসই করিল না; যখন হরু শপথ খাইল এবং হারাণের কাছে ভজাইয়া দিবার জন্য লইয়া যাইতে চাহিল, তিনজনে পরম বিস্ময়ে পরস্পরের মুখের পানে চাহিল। পুতী বলিল— “শহরে এক সায়েব-ডাক্তারের কথা শুনেছি, হরু দেখছি…”
শেষ করিতে না দিয়াই নম্তী আগ্রহের সহিত বলিয়া উঠিল— “গিরি দিদি, এবার থেকে হরুকে সায়েব-ডাক্তার করতে হবে, কি বলিস?”
গিরিবালা বলিল— “নিজের ভাই বলেই বলছি না, সায়েব-ডাক্তারেও এমন করে পারে না। এক খালি যে গণেশের গলায় হাতির মুণ্ডু বসিয়েছিল। সে-ই পেরেছিল—রাঙাদিদিমার কাছে গল্প শোনা,—কি নামটা ভুলে যাচ্ছি যে…। জেঠামশাইকে বলব’খন—তোকে ডাক্তারি পড়াতে হরু!”
নন্তী বলিল— “রসিক কাকার চেয়ে বড় ডাক্তার হবে হরু,
উঃ!” গিরিবালা বলিল— “বাপ হন, ও-কথা বলতে আছে?”
পুতী বলিল— “বাপ যে আবার গুরুজন রে!”
নত্তী প্রশ্ন করিল— “পটিটা যখন খুলবি তখন জোড়াটা আলগা হয়ে খুলে যাবে না তো রে হরু?”
হরিচরণ একহাতে পুতুলটি লইয়া, একহাত কোমরে দিয়া দর্পিতভাবে তিনজনের কথা শুনিতেছিল, ঈষৎ হাস্যের সহিত বলিল-”কি রকম বোকা! খুলে গেলেই হোল? খালি পটি বেঁধেছি নাকি?”
গিরিবালা বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করিল— “আর কি করেছিস রে?”
নন্তী প্রশ্ন করিল— “আটার কথা বলছিস বুঝি?”
হরু একটা ঢোক গিলিয়া বলিল— “হ্যাঁ।”
গিরিবালা প্রশ্ন করিল— “কিছু মিশিয়েছিস বুঝি আটার সঙ্গে?”
পুতুলের গলার কাছে নাকটা লইয়া গিয়া আঘ্রাণ লইয়া বলিল— “হ্যাঁ রে পাথরকুচির পাতা বেটে দিয়েছিসনা? -গন্ধ পাচ্ছি।”
তাহার পর পুতী আর নন্তীর পানে চাহিয়া বলিল— “হরুটা জানে সব রে! হাড় জোড়ার অমন ওষুধ আর নেই কিনা।”
হরিচরণ আরও দর্পিতভাবে স্মিত হাস্য ঠোঁটে করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
খেলাটা খুব জমিল সেদিন। এমন বিচক্ষণ ডাক্তার হাতে পাইয়া পুতী আর গিরিবালার ঘরে পাঁচটি ও নন্তীর ঘরে তিনটি ঝপাঝপ অসুখে পড়িয়া গেল; কাজের বাড়িতে এমন কিছু আশ্চর্য ব্যাপারও নয়। তবে এপিডেমিকের একঘেয়েমি নয়, রকমারি অসুখ। পটির লোভে পুতী নিজের একটা কাচের পুতুলের একটা পা পর্যন্ত ভাঙিয়া দিল, ডাক্তার-ভাইয়ের ব্যান্ডেজসুদ্ধ মামার বাড়ি লইয়া যাইবে, সবাইকে দেখাইবে; সেখানে আবার বাপের বাড়ির বড়াই শোনাইবার লোক আছে তো?
.
দুপুরের অনেক আগেই রসিকলাল বাড়ি ফিরিলেন এবং প্রবেশ করিয়াই হৈ-হৈ লাগাইয়া দিলেন— “আমি আর ও-ব্যাটা নাপিতের পোকে কখনও রাখব না। এই প্রথম বার নয়, কয়েক বারই হয়েছে, যতই সয়ে যাচ্ছি, ততই বাড়াবাড়ি হচ্ছে, যতই সয়ে যাচ্ছি, ততই…”
বসন্তকুমারী বাহির হইয়া আসিলেন, বিস্মিতভাবে কহিলেন— “বলি ব্যাপারখানা কি? আজ আবার এ মূর্তি কেন?”
রসিকলাল বলিলেন— “আমি বলে দিচ্ছি, ও-বেটা ঠিক আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে প্র্যাকটিস লাগিয়েছে। নরুন চালাতে জানে বলে ও নিজেকে ভাবেই একটা মস্ত বড় সার্জেন, এবার আমার পুঁজি ভেঙে তলায় তলায় ওষুধেও হাত পাকাচ্ছে।—তাই তো বলি—হারাণকম্পুন্ডারের এত খাতির বেড়ে যায় কোথা থেকে দিন দিন!—যখনই দেখ, একপাল লোক চারিদিকে….”
বসন্তকুমারী বলিলেন— “ব্যাপারখানা কি আগে তাই বলো না।…হারাণে!”
হারাণ ঘুড়িটার গলায় ছোলার থোলেটা বাঁধিয়া দিয়া ‘হিস্ হিস্’ করিয়া ডলাই-মলাই করিতেছিল, কতকটা নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর করিল— “এসছি বড়মা, ঘুড়িটাকে একটু ঠাণ্ডা করে; অবলা জীব, মনে মনে শাপমণ্যি দিলি সইবে না; বামুন না হোক, এর শাপমন্যিগুলো সত্যিকারের শাপমনি হবে কিনা।”
রসিকলাল আরও জ্বলিয়া উঠিলেন, ভাজকে সাক্ষী রাখিয়া বলিলেন— “শুনে নাও হারামজাদার কথাগুলো—আমি মিথ্যে বলছি, সত্যিবাদী হোল ঐ একটা ফকরে ঘুড়ি! দাদা কিছু বলবেন না, হয়ে উঠেছে ওর কথাগুলো ঐরকম চ্যাটাং-চ্যাটাং আজকাল।…মিথ্যে কথা বলছি আমি!—তাবৎ ওষুধের নাম ওর মুখস্থ, না ঘাঁটাঘাঁটি করলে হয় কি করে? তক্কে তক্কে থেকে আজ অ্যাদ্দিন পরে হদিস পেলাম,—দাঁয়ের বৌকে ওষুধ দিতে গিয়ে দেখি শিশি খালি! নরেনের ছেলেটাকে ওষুধ দিতে গিয়ে দেখি শিশি খালি! স্বরূপের বৌটাকে ওষুধ দিতে গিয়ে দেখি শিশি আদ্দেকটা খালি! তখন বাক্সটা আরও ভালো করে মিলিয়ে দেখি আর তিন-চারখানা শিশির ঐ দশা, কোনটা একেবারে খালি, কোনটা আদ্দেক! রোগী দেখে বেড়াব কি, রাগে আমার আপাদমস্তক জ্বলে গেল। দাদা একে ওকে আগে বিদেয় করুন, নৈলে আমার দ্বারা আর…”
এমন সময় বরদাসুন্দরী ঘোমটা টানিয়া লঘু পদে রান্নাঘর থেকে নামিয়া আসিলেন, বসন্তকুমারী কানের কাছে মুখ হইয়া গিয়া ফিস্ ফিস্ করিয়া বলিলেন— “দিদি, রান্নাঘরে দেখোসে কি কাণ্ড!”
“বেড়ালে সব মাছ নিয়ে গেল তো?…তোর যেমন … “
“দেখোইসে না।” বলিয়া বরদাসুন্দরী তাঁহাকে একরকম টানিয়াই লইয়া চলিলেন।
“যেমন দেবা তেমনি দেবী! খুলে বল, তা নয়…” বলিতে বলিতে বসন্তকুমারী অগ্রসর হইলেন।
সেই কবন্ধ পুতুলটি, যেটিকে হরিচরণের চিকিৎসাধীনে রাখা হইয়াছিল, আবার ধড় আলাদা আর মুণ্ডু আলাদা হইয়া পড়িয়াছে। ঘাড়ের দিকটা গলার নিচেই পুতুলের বুক আর পেট লইয়া বেশ একটা বড় গর্ত;—গর্তটির সমস্তটা হোমিওপ্যাথির সাদা সাদা ক্ষুদ্রাকার চিনির গুলিতে ভরা!
বরদাসুন্দরী হাসিতে হাসিতে বলিলেন— “ভাইয়ের ডাক্তারীর কথা গিরি ফলাও করে বলতে এসেছিল—ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে। অত কি জানি দিদি? ভাবলাম সত্যি বুঝি তেমনি কোন আটা দিয়ে জুড়ে দিয়েছে—দেখি তো। হরু ‘হাঁ-হাঁ’ করতে করতেই একটা টান দিয়ে ফেলেছি, দেখি এ কি কাণ্ড!”
চাপা হাসিতে দুই জায়ে লুটোপুটি খাইবার দাখিল। বসন্তকুমারী সামলাইয়া লইয়া প্রশ্ন করিলেন— “কোথায় গেল দুটোতে?”
“আর থাকে?” বলিয়া বরদাসুন্দরী কহিলেন— “বলে দেবে না কি দিদি? কিন্তু না বললেও যে ওদিকে নিরীহ হারাণেটা বকুনি খেয়ে সারা হয়; বড়ঠাকুর এসে বোধ হয় ছাড়িয়েও দেবেন।”
“বোস”—বলিয়া বসন্তকুমারী পুতুলের খণ্ড দুইটি কাপড়ের ভিতর লইয়া উঠানে নামিয়া আসিলেন, গম্ভীরভাবে দেবরকে বলিলেন— “তোমার দ্বারা না হয় ছেড়ে দাও, তার জন্যে আর অত চোখরাঙানি কেন? ডাক্তারী করবার ঢের ভালো লোক আছে।”
হঠাৎ এই পরিবর্তিত ভাব দেখিয়া রসিকলাল একটু বিমূঢ়ভাবে চাহিলেন, তাহার পর বলিলেন— “ব্যাপার কি বল দিকিন?”
“ঐ তো বললাম।”
রসিকলাল রাগিয়া উঠিলেন— “বলো বলছি বৌদি, একে আমার মাথার ঠিক নেই…”
“তবে চুপ করতে হ’ল—মাথা না ঠিক হওয়া পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়।”
“আঃ, বৌদি বলো বলছি।”
“তার আগে কথা দিতে হবে, শুনে মাথা ঠিক রাখবে, কোন গোলমাল করতে পারবে না।”
তাহার পর পুতুলের ভিতরকার গ্লোবিউলগুলা হাতে ঢালিতে ঢালিতে কপট গাম্ভীর্যের সহিত বলিলেন— “হরু বেঁচে থাক, কে তোমার আর তোয়াক্কা রাখে গা? কি পাকা কাজ,—ব্যান্ডেজ, তার ওপর এক পেট ওষুধ!” —বলিতে বলিতেই খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।
“আমি ওকে আর আস্ত রাখব না, কোথায় সে?”—রসিকলাল অগ্রসর হইতেছিল, বসন্তকুমারী বলিলেন— “কথা দিয়েছ, কিছু বলবে না। আমার মাথা খাও।”
হারাণ আসিয়া উঠানের দরজার নিচে দাঁড়াইয়াছিল, বলিল— “হারাণে তো যাচ্ছেই। এ মিছে গঞ্জনার চেয়ে না খেতে পেয়ে মরাও ভালো। তবে যাবার আগে একটা হক্ কথা বলে যাই, বলি— কি অন্যায়টাই বা হয়েছে যে মার খেতে যাবে হরু ঠাকুর? ওষুধগুলো কোনো রোগীর পেটে গেলেই বা কী রাজা করে দিতো? রোজ তো কাঁড়ি কাঁড়ি যাচ্ছেই, বাড়ি ঢোকার সময় পকেট যে ঢন্ঢন্ সেই ঢন্ঢন্।”
৩
মাসের পিঠে মাস, ঋতুর পিঠে ঋতু, এই করিয়া দিন বহিয়া যাইতেছে।
গিরিবালা দশ ছাড়িয়া এগারোর পানে পা বাড়াইয়াছে, এবং নিজের অজ্ঞাতসারেই ধীরে ধীরে খেলার ঘর ছাড়িয়া আসল ঘরগুলিকে পূর্ণ করিয়া তুলিতেছে।
একটি যেন পবিত্র, নির্মল চন্দ্রোদয়,—চন্দ্ৰমা ধীরসঞ্চারে নিজেকে স্পষ্টতরভাবে উপলব্ধি করিতেছেন, আর স্নিগ্ধ আলো চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে।
জেঠামশাইয়ের সমস্ত সেবার ভার এখন গিরিবালার হাতে, একটির পর একটি করিয়া কেমন করিয়া যে চলিয়া আসিয়াছে কেহই জানে না। বাবার সেবার হাঙ্গাম নাই বড় একটা, একে আত্মভোলা মানুষ তায় বাহিরেই বেশি থাকেন এবং অভাবও কম, তবু উহারই মধ্যে গিরিবালার বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রসিকলালের জীবনে যেন একটু শৃঙ্খলা আসিয়াছে। দুপুরের আহারের সময়টা অনেকটা নিয়মাধীন হইয়াছে। বারোটা বাজিলেই মনে পড়ে তেল গামছা ঠিক করিয়া একটি কচি মেয়ে প্রতীক্ষায় বসিয়া আছে, যতই বিলম্ব হইতেছে ততই গোছানো জিনিস আবার ঝাড়িয়া গোছাইতেছে—পাটকরা গামছা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া পাট করিতেছে, কোচানো কাপড় আবার খুলিয়া কোঁচাইতেছে—প্রয়াসের সঙ্গে মুখখানি এদিক ওদিক হেলিয়া পড়িতেছে; জেঠামশাই ছোট ছোট দুইটি মাকড়ি গড়াইয়া দিয়াছেন,—চাঞ্চল্যে ঝিকমিক করিতেছে; দিন তপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখখানি রাঙা হইয়া উঠিতেছে, বাহিরে আসিয়া পথের খবর লওয়া তো প্রায় মিনিটে মিনিটে।…দুপুরের পর আর দেরি করেন না রসিকলাল—চিকিৎসায় ক্রমাগতই ভুল হইয়া পড়ে।
দুই ভাইয়ে একসঙ্গে খাইতে বসাটা আজকাল আর তত বিরল ঘটনা নয়। গিরিবালাও সঙ্গে সঙ্গে বসে, একটু দেরি হইলে জেঠামশাই হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকেন, ডাক দেন,–”আয় গিরি, ভাতের সামনে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।”
গলা নামাইয়া বলেন— “যাবে কিনা, আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াচ্ছে।”
বসন্তকুমারী কথার সূত্রটা তুলিয়া লন, কখনও কখনও সূত্র না থাকিলেও নিজে পাড়েন কথাটা— “বলি, হ্যাঁগা, এখন দুই ভাই রয়েছ, বলি, চলবে এরকম নাকে তেল দিয়ে শুয়ে থাকলে?…বলি?, হ্যাঁ ঠাকুরপো?”
জ্যেষ্ঠ সুযোগ বুঝিয়া বোঝাটা কনিষ্ঠের উপর চাপাইয়া দিয়া নিজের গা বাঁচাইবার চেষ্টা করেন; কালক্ষেপ না করিয়া বধুকে সাক্ষী রাখিয়াই বলেন— “তা বুঝি জান না?—মেয়ে ওঁর গৌরী, মহাদেব আপনি এসে…”
বসন্তকুমারী সঙ্গে সঙ্গেই নাক নাড়া দিয়া ওঠেন, বলেন— “তুমি বড় আর ও গিয়ে নিজের মেয়ের জন্যে পাত্তোর খুঁজে বেড়াবে!—কি করে বের করলে কথাটা মুখ দিয়ে? বলিহারি!”
অন্নদাচরণ ঝামটাটা খাইয়া অপ্রস্তুত হইয়া যান, ভারিক্কে হইবার চেষ্টা করিয়া বলেন- “আমি! আমি বসে আছি নাকি? হুঁ, জিগ্যেস করগে গিয়ে নিকুঞ্জদাকে, এমন দিনটি যায় না, যে দিন না…’
গিরিবালা আসিয়া না পড়িলে পরিত্রাণ পাইবার জন্য তাগাদা দেন— “কৈ গো গিরি, কতক্ষণ আর…”
কথাটা একেবারে সত্য না হইলেও নিতান্ত মিথ্যাও নয়। নিকুঞ্জলালকে ওদিকে দু-একবার বলিয়াছিলেন—এখন উল্টা তাগাদা ঠেকাইতে ঠেকাইতে প্রাণান্ত হইতেছে। নিকুঞ্জ প্রায়ই পাত্রের সন্ধান দেন— “পঁচিশ বিঘে জমি, এক গোয়াল গরু…একটু বয়েস হয়েছে ছেলের …তা ছেলের আবার বয়েস, তুমিও যেমন! হ্যাঁ, পারতে খরচপত্র করতে তো আলাদা কথা…কি বল?”
অন্নদাচরণ বলেন— “বেশ তো দাদা।”
নিকুঞ্জলাল আবার সন্ধান আনেন— “নাও, আজকাল ‘পাস-পাস’ এক ঢো হয়েছে। পাওয়া গেছে তোমার পাস করা ছেলে।…দোজবরে, এই কয়দিন হল বউ মারা গেছে, বিশেষ কিছু নয়,…একটি বছর আষ্টেকের ছেলে, একটি কোলের মেয়ে। গ্রামে বিষয়-আশয় যথেষ্ট… সনাতন তো ঝুলোঝুলি করছে, বলে দিয়েছি—অন্নদাকে কথা দিয়ে ফেলেছি…আগে নিজের লোক, তার পর অন্যের কথা।…কি বল? – দেখি?”
অন্নদাচরণ একটা টোক গিলিয়া বলেন— “বেশ তো দাদা, দেখবে বৈকি, এ তো খাসা ছেলে।”
বাঞ্ছনীয় পাত্রেরও আসে সন্ধান দু-একটা। অন্নদাচরণ বলেন— “বেশ তো দাদা, এ তো অতি উত্তম পাত্র।”
যত ভালো পাত্র, বিদায়ের সম্ভাবনা যত বেশি হইয়া ওঠে, মনটা ততই যেন কি রকম হইয়া পড়ে। বাড়িতে আসিয়া কৌশলে এদিক ওদিক দু-একটা কথা পাড়িয়া বলেন— “হ্যাঁগা, গিরিটার বয়স হল কত?”
বসন্তকুমারী বিস্মিত হইয়া বলেন— “সব সইতে পারি, ন্যাকামিটা সয় না; জান না, না দেখতে পাচ্ছ না?”
অন্নদাচরণ তাড়াতাড়ি বলেন— “আঃ, তোমাদের সঙ্গে কথা কওয়াও এক ফ্যাসাদ! মাস দিন ধরে ঠিকুজির বয়সের কথা বলছি।…ঠিকুজিটা বের করে দাও না হয়, একটি ছেলে পাওয়া গেছে, পাকা করে ফেলি। কারুর যেন গা নেই!
বসন্তকুমারী রাগিয়া যান, বলেন— “তার জন্যে ঠিকুজি-কুষ্টির দরকার হয় না, চৌঠা আশ্বিন জন্মেছিল, আশ্বিনে দশ বছর গেছে,—কাত্তিক, অঘ্রাণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চোত, এই ছ’মাস।…মেয়েছেলের বাড়তে দেরি হয়?”
গর-গর করিতে করিতেই বাক্সর মধ্য হইতে ঠিকুজিটা বাহির করিয়া স্বামীর কোলে ফেলিয়া দেন, বলেন— “এইটুকু বা বাকি থাকে কেন, নিয়ে যাও; দেখাও, কি করবে করো। আসল কথা, গা নেই; না আছে নিজের, না আছে ভাইয়ের। সরি দিদি বিধবা মানুষ, দু-দুটো মেয়ে বিদায় করলে- দুটো বছর না ঘুরতে ঘুরতে। এক কথার ঢং হয়েছে—কুষ্টি বের করে দাও!”
অন্নদাচরণ অত্যন্ত মনোযোগের সহিত কোষ্ঠীর উপর দৃষ্টি ফেলিয়া বসিয়া থাকেন।…দশ বছর ছ’মাস,—কিসের তাড়া এত? মাসখানেক একটু উঠিয়া পড়িয়া লাগিলে বিবাহ হইয়া যাইবে, ভারি তো একটা মেয়ের বিবাহ…তাও কানা হইত, খোঁড়া হইত, একটা ভাবনা ছিল।—গিরিবালা নাই এমন অবস্থায় বাড়িটি কল্পনা করিবার চেষ্টা করেন; মনটা হাঁপাইয়া উঠে। শুধু কি তাই?—কোথায় পড়িবে, কেমন শাশুড়ী কেমন ননদ?…এই তো চোখের সামনেই রহিয়াছে নিকুঞ্জদাদার স্ত্রী, সর্বদাই সশঙ্ক। মাত্র একটি ননদ, তাহাতেই এত!…ভাবা যায়?—এই গিরিবালা, এত মুক্ত, সবার আদর মাখিয়া মাখিয়া কাজের মধ্যে, সেবার মধ্যে প্রতিনিয়তই বাড়িটাকে জীয়ন্ত করিয়া রাখিয়াছে, সে কোথায় এতটুকু বয়সেই ঘোমটা টানিয়া শাশুড়ীর বিরাগ, ননদের গঞ্জনা বাঁচাইয়া অতি সন্তর্পণে, অতি ধীরগতিতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। ভাবা যায়?…রায়দের বউটি বিষ খাইয়া মারা গেল সেদিন। একটি লক্ষ্মীপ্রতিমা। অন্নদাচরণ গিয়াছিলেন দেখিতে,—বাড়ির কাহারও মুখে শোক দূরের কথা, নিজেদের জিনিস গেল বলিয়া যে একটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভাব তাহা পর্যন্ত যেন নাই। অবশ্য স্বামী ছিল না বাড়িতে, কিন্তু সে তো আর সবারটিও হইয়াছিল সংসারের মধ্যে।…অন্নদাচরণ এ চিত্র থেকে মনটাকে জোর করিয়া সরাইয়া লন, না, না, সবাই কি রায়েদের বউই হয়? সবাই কি গঞ্জনাই খায়? আদর আছে বৈ কি, গিরি আদরই পাইবে, ওর কোষ্ঠীতে লেখা আছে সেকথা; কোন্খানটায় যে লেখা আছে, সেদিন নিকুঞ্জদাদা পড়িয়া বেশ বুঝাইয়া দিলেন। অন্নদাচরণ যে সংস্কৃত বোঝেন না, নইলে এখনই বাহির করিয়া ফেলিতে পারিতেন 1
তবে এটা ঠিক যে মেলা শাশুড়ী আর গুষ্টিখানেক ননদের সংসারে মেয়ে দিবেন না অন্নদাচরণ, দিতে হইবে ছিমছাম দেখিয়া—শাশুড়ী, এক-আধটা ননদ—তাহাও, বিবাহ হইয়া গেছে, নিজের নিজের লইয়া শ্বশুরবাড়ি থাকে, ক্বচিৎ কখনও আসে এইরকম দেখিয়া।…ও হাঙ্গাম যত দূরে দূরে থাকে ততই ভালো।
ছেলেটি একটু দেখিয়া দিতে হইবে।…নিকুঞ্জদাদা শুধুই দ্বিতীয় পক্ষের পাত্র টানিয়া তুলিতেছেন।…এইখানটায় আসিয়া অন্নদাচরণ একটু বেশি অন্যমনস্ক হইয়া যান—চিন্তা যেন একটা কেন্দ্রের চারিদিকে পাক খাইতে থাকে…দ্বিতীয় পক্ষ…দোষেরই বা কি এত? দ্বিতীয় পক্ষের পাত্রের কাছে একটু আদর হয় বেশি, খানিকটা ভুগিয়া তাহারা একটু কর্তাগোছের হইয়া পড়ে কিনা। এদিকে একটি বউকে নিঃশেষ করিয়া শাশুড়ীও একটু ঠাণ্ডা হইয়া পড়ে—যদি নেহাৎই থাকে শাশুড়ী।…যদি থাকিলই ও-পক্ষের দু-একটা সন্তান—ক্ষতি কি? গিরি একেবারে গিয়াই মা হইয়া বসিবে। সে-খাতিরেও সংসারে ওর একটা মর্যাদা থাকিবে।…মোটের উপর যেখানে ভেজালের সম্ভাবনা— সেদিকে ঘেঁষা হইবে না। বিনি বা অল্প খরচে এইরকম দোজবরে হয়, তাহাই সই; একটু খরচ করিয়া বেশ একটি ছোটখাটো সংসারের একটি ভালো ছেলে হয় তো কথাই নাই।…তাহা হইলে আর সময় কই?
অন্নদাচরণ ঈষৎ চটিয়া ওঠেন, বলেন— “বিয়ে অমনি হয় না, চাই এক কাঁড়ি টাকা আজকাল তা দেখছে কেউ সেদিকে একটু চাড় ওর বাপের? কি করছে ও? ওর চেয়ে যে মাঠে গিয়ে লাঙল ঠেললে গেরস্তর ঢের উবগার হত। চোখের সামনে একটা মেয়ে হু-হু করে বেড়ে উঠছে, পণ্ডিতমশাইয়ের ওখানে গিয়ে কাব্যি করবার ওর এই সময়? ও ঠাউরেছে কি আমায় বলতে পারো! যেখানেই যাও—’শুনছ হে, রসিকের তোমার হাতটা খুলেছে খুব’….আরে, তাতে রসিকেরই বা কি? আর দাদারই বা কি?—বাড়িতে তো সেই ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না।…হাত খুলেছে, ভারি কেতাত্ত করেছে! আগে দানের হাতটা বন্ধ হোক দিকিন দাতাকর্ণের, তবে বুঝব, হ্যাঁ।…তোর ঘাড়ে একটা অত বড় মেয়ে, তুই নিজের কড়াগণ্ডা বুঝে নিবিনি? হালদারের নাতনীটাকে আমতার গুপি ডাক্তার এলে দিয়ে চলে গেল…করকরে আটটি টাকা পকেটে নিয়ে। শেষে চাঙ্গা করলে তো ওই? ভেতরে একটা বস্তু আছে বলেই তো? কিন্তু কি পেলে একবার জিগ্যেস করো তো,—দুটি টাকা। তার একটি দাতব্য করে একটি এনে দাদার হাতে তুলে দিলেন—তাতে তেল আনবে, কি ডাল আনবে, কি…”
ওদিককার ঘর থেকে বসন্তকুমারী চিৎকার করিয়া উঠিলেন— “বলি, গিরি, কানের মাথা খেয়েছিস? তামাক দিয়ে মুখ বন্ধ কর, অকেজো মনিষ্যির গরগরানি আমার ভালো লাগে না। সে তেতেপুড়ে ফিরবে এই সময়টা, ওঁর সুর উঠল!…এই নাক কান মলছি, আর যদি কখনও বিয়ের কথা তুলি। থাক্ মেয়ে আইবুড়ো থুবড়ি হয়ে ঘরে বসে। অদিষ্টে থাকে হবে বিয়ে, না থাকে বাপের দ্বারাও কিছু হবে না, জেঠার দ্বারাও কিছু হবে না।”
সুবিধা পাইয়া, অর্থাৎ জা ভাসুর থেকে কতকটা দূরে থাকায় বরদাসুন্দরী তাঁহার কাছে আসিয়া চাপা গলায় বলিলেন— “কি অন্যায়টা বলছেন দিদি? বলতে দাও, এসে শুনুন। ভয় নেই, হাজার তেতেপুড়ে এলেও সে মানুষের গায়ে আঁচ লাগবে না—তা যদি লাগত…”
বসন্তকুমারী আরও জোরে ঝঙ্কার করিয়া ওঠেন— “তুই চুপ কর ছোট বউ, তোকে আর ভাসুরের হয়ে ওকালতি করতে হবে না, বসন্তবামনি সবাইকেই চেনে।…ও না হয় ওই ধরনের মানুষ—বোকাই বলো, আপন ভোলাই বলো—লোকে ঠকিয়ে নেয়, মুখ ফুটে বলতে পারে না। পাপটা তো ও করে না? ভগবান ওকে ঐ রকম গড়েছেন, কি করবে? তুমি তো বড় ভাই—তুমি কোন্ তাদের বলে নিজেদের পাওনা-গণ্ডা আদায় করে আন? বাড়ি বসে বসে শুধু…”
হুঁকা লইয়া অন্নদাচরণ বহিরে গিয়া বসেন।
৪
বরুদাসুন্দরীও সুযোগ খুঁজিতে থাকেন, তবে তাঁহার ভাগ্যে সুযোগ ঘটা বড় অল্প কথা নয়, অর্থাৎ ভাসুর এবং জা উভয়েই বাহিরে থাকা চাই, বেশ কিছুক্ষণের জন্য, এবং স্বামী বাড়ি থাকা চাই। এ যোগাযোগ দুর্লভ, তবে হইলে বরদাসুন্দরী ফস্কাইয়া যাইতে দেন না।
বর্ষার প্রথম বারিপাত—আকাশ বেশ ঘোর করিয়াই নামিয়াছে। মেঘের সরঞ্জাম দেখিয়াই অন্নদাচরণ সকালেই মুনিষ ঠিক করিবার জন্য বাহির হইয়া গেছেন, সেখান থেকে মাঠে যাইবেন, বীজ ছড়ানোর ব্যবস্থা করিতে হইবে। বসন্তকুমারী গেছেন সরি-দিদির বাড়ি, সরি-দিদির প্রথম মেয়েটি আসন্নপ্রসবা। এসব ব্যাপারে বসন্তকুমারীই গ্রামের লেডি-ডাক্তার, কখন আসিবেন ঠিক নাই, হয়তো নাও আসিতে পারেন আজ।
রসিকলাল বাড়িতেই আছেন। একবার হালদারের ওখানে যাইবার দরকার ছিল; সকাল থেকেই সঞ্চীয়মান মেঘের স্তূপ তাঁহাকে কেমন আজ অন্যমনস্ক করিয়া দিয়াছে—যাই যাই করিয়া দেরি হইয়া গেল; তাহার পর হঠাৎ একটা শীতল বায়ু আর গোটাকতক বিদ্যুৎঝলকের পর বৃষ্টি নামিয়া পড়িল,–কে যেন সমস্ত আকাশটার গায়ে একবার যাদুঅস্থি বুলাইয়া দিয়া কোথা থেকে কি একটা বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটাইয়া বসিল।
বরদাসুন্দরী রান্নাঘরে পাক করিতেছেন। গিরিবালাও তাঁহারই কাছে। এ-ঘরের দাওয়ায় সাতকড়ি, হরু আর খোকা। সাতকড়ি ইস্কুলে বাহির হইতেছিল, বৃষ্টি নামিতে বইশ্লেট ঘরে রাখিয়া দিয়া ভাই দুইটিকে লইয়া একটা খেলার মতলব আঁটিল, সে ঘোড়া, খোকা কাকা—অর্থাৎ ডাক্তার এবং হরু হারাণ। হরিচরণ “আয় বৃষ্টি হেনে” বলিয়া ডাইনে বাঁয়ে দুলিয়া বর্ষার গান ধরিতেছিল, সাতকড়ি ধমক দিয়া থামাইয়া দিল, বলিল— “তুই না হারাণে হরু? ভুলে যাস কেন?”
হারাণ ঘুড়ির পিঠে দিবার জন্য ভিতরে কম্বল লইতে আসিয়াছিল, আটকাইয়া গেছে; দাওয়ার একদিকে কিনারাটিতে উবু হইয়া বসিয়া বর্ষা দেখিতেছে, মাঝে মাঝে ডান হাতটা যেন নিজে হইতেই এদিক-ওদিক চলিয়া যাইতেছে;—হারাণ অন্যমনস্ক ভাবে তবলা খুঁজিতেছে।
কিসের একটা যেন ঘোরে রসিকলাল দাওয়ায় একটু পায়চারি করিলেন। নীরব; অনন্তের কী একটা অনাবিল আনন্দে মুখে একটা স্মিত হাস্য ফুটিয়া উঠিয়াছে—সরসীর রসপুষ্ট পদ্মকলিটির মতো। আবিষ্টভাবে একটু ঘুরিলেন, তাহার পর হারাণকে বলিলেন— “নাঃ, আজ আর বেরুনো হবে না হারাণে। এক রকম বাধা! জ্বালাতন করে তুলেছে।”
হারাণ নিষ্প্রয়োজন কথার উত্তর দেয় না। চুপ করিয়া যেমন ছিল সেইরূপই বসিয়া রহিল। রসিকলাল সিঁড়ির একটা ধাপ নামিয়া ডাকিলেন— “গিরি, একবার আসতে পারবি এ ঘরে? দেখিস যেন ভিজিসনি, নতুন জল, টোকাটা মাথায় দিয়ে আসবি।”
ভিতরে গেলেন এবং একটা পেটিকার মধ্য হইতে একটা খাতা আর কতকগুলা আলগা কাগজ লইয়া একটা মোড়ার উপর বসিয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিলেন।
গিরিবালা আসিল, এইটুকু আসিতেই টোকা সত্ত্বেও একটু একটু ভিজিয়া গিয়াছে। তবে লাগিয়াছে ভালো, পাড়ের কাছে কাপড়ের ধারটুকু একটু নিংড়াইয়া লইয়া, সমস্ত শরীরটিতে একটা আহ্লাদের শিহরণ তুলিয়া বলিল— “উঃ, কী তোড় বাবা, দু-পা না আসতে আসতেই ভিজিয়ে দিলে!…আজ আমি বাবা নাইব বিষ্টিতে —হ্যাঁ।”
রসিকলাল বলিলেন— “তোর গর্ভধারিণীকে জিগ্যেস করিস, বকাবকি করবে।”
একটু মুখ তুলিয়া হাসিয়া বলিলেন— “আমি তো নাইবই।”
গিরিবালা বোধ হয় উঠানে স্নানরত পিতাকে ভালো করিয়া কল্পনা করিয়া লইবার জন্য একবার বাহিরের দিকে চাহিয়া দীপ্ত মুখে বলিল— “কী চমৎকার বাবা, না?”
কন্যার মনেও অনুরূপ স্পন্দনের সংবাদ পাইয়া রসিকলাল মুগ্ধদৃষ্টিতে খানিকটা তাহার পানে চাহিয়া বলিলেন, যেন নিজেই উহার মধ্যে মুকুরিত হইয়া গেছেন। তাহার পর কতকটা আবিষ্টভাবেই বলিলেন— “প্রথম বর্ষা কিনা, লাগবেই ভালো। এমন বর্ষা-জিনিসটাই চমৎকার কিনা…”
“কেন ডাকছ বাবা?”
“তোকে ডেকেছি, না?…কেন যে ডাকছিলাম।…কাজ করছিলি?”
“না, বসেছিলাম মার কাছে। বলো না তুমি কি করতে হবে?”
রসিকলাল কথার মধ্যেই কাগজগুলো ওটকাইতেছিলেন। বলিলেন— “তোকে ডেকেছি—তুই কবে যেন একবার বলেছিলি না—’তোমার পদ্যগুলো একবার শুনব বাবা’—? তা, ফুরসতই হয় না…”
ওটকাইতেই লাগিলেন।
গিরিবালার মনে পড়িল না, এমন আবদার কখনও করিয়াছে বাপের কাছে। মনে করিবার বিশেষ কোন চেষ্টা না করিয়াই বলিল— “বলেছিলাম বৈকি সেদিন—হ্যাঁ বাবা পড়ো না…”
“বোস্, অত উতলা হলে হয়?…তোর বাবাই যেন এক পদ্য লিখতে পারে, আর তো কেউ পারে না!…এই পেয়েছি, এইটেই শোনাই আগে।”
উঠানে জল দাঁড়াইয়া বর্ষার জলতরঙ্গ আরও জাগিয়া উঠিয়াছে, ঘাটের ঢালুতে স্রোতের কলতান উঠিল, ভেকের দল কণ্ঠসঙ্গীত তুলিল।…হাতের কাছের টোকাটা টানিয়া লইয়া হারাণের অঙ্গুলি তবলার বোলে মাতিয়া উঠিয়াছে।…প্রভাত হইয়া পড়িল সন্ধ্যা, আর এই অকাল-সন্ধ্যার মলিন আলোয় গোটাকতক ঝিঁঝি জাগিয়া উঠিয়া একটা একটানা সুরের সূত্র দিয়া বর্ষাদিনের বিচিত্র সঙ্গীতগুলাকে গাঁথিয়া তুলিতে লাগিল। রসিকলাল আত্মহারা হইয়া পদ্য পড়িয়া যাইতেছেন। গিরিবালা বাপের হাঁটু দুইটা জড়াইয়া মুখ তুলিয়া না-বোঝার পরম বিস্ময়ে শুনিয়া যাইতেছে। বরদাসুন্দরী দুই তিনবার ডাকিলেন, দুইবার— “যাই মা” বলিয়া উত্তর দিল, একবার বিরক্তভাবে বাপকেই বলিল— “কী যেন মা, আমি একটু পদ্য শুনছি, তা!…”
রসিকলাল একেবারে আবিষ্ট হইয়া গেছেন। একটা পদ্য শেষ করিয়া নূতন একটা ধরার মুখে একটা-আধটা কথা বলিতেছেন— “এইটে স্কুলের সময়ের লেখা—পণ্ডিতমশাই সংশোধন করে দিয়েছিলেন, তাঁর নিজের হাতের লেখা, এই দেখ না কেমন মুক্তোর মতন অক্ষর গিরি! আজ পণ্ডিতমশাই নিশ্চয় মেঘদূত আরম্ভ করেছেন, খেয়েদেয়ে যাবই কোন রকমে… আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানু বপ্রক্রীড়া পরিণতগজ প্রেক্ষণীয়ং দদর্শ।”…এটা পণ্ডিতমশাইয়ের বিদায়ের দিনে লেখা—যেদিন বর্ধমানে চাকরি নিয়ে গেলেন না?…এই পেয়েছি এইটে শোন্ গিরি—পদ্যটার নাম হচ্ছে—’নবীন বর্ষা’…আজ যেমন নতুন বর্ষা নেমেছে না?—এই রকম একটা দিনে লিখেছিলাম; আজও একটা লিখব, দেখি নতুন কিছু ভাব আসে কিনা কলমের ডগায়। শোন্—
অম্বর ঘিরি একি গম্ভীরে বাজে আজি,
শাখে শাখে কদম্ব শিহরে
শঙ্কর হর বুঝি ডম্বরু করে লয়ে
ভূতসাথে সদম্ভে বিহরে!
“কেমন ছন্দটা বল দিকিন গিরি? বর্ষার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক মিলে যাচ্ছে না?”
একবর্ণও না বুঝিলেও ছন্দের দোল লাগে মনে। করতলে চিবুকটা রাখিয়া গিরিবালা একটু দুলিয়া বসিয়া বলে— “চমৎকার বাবা! পড়ো, আরও আছে তো?”
“অনেকখানি এটা, শোন্ না!”
ও-ঘরের দাওয়া থেকে আবার ডাক পড়ে— “যাই” বলিয়া গিরিবালা মুখটা আবার ঘুরাইয়া লয়, বলে— “মা যেন কী!”
রসিকলাল বলেন— “শোন্–
তাণ্ডবে ক্ষিতিতল টলমল টলমল
তরুদল মূর্ছিয়া পড়ে যে,
লক্ষ-অযুতে কারা লক্ষিয়া বসুধরা
প্রলয়ের গর্জনে নামিছে।
চঞ্চল ফণিদল শঙ্কর জটা ছাড়ি
নামে বুঝি মন্থিয়া আকাশে?
শঙ্কা নাহিরে, তারা ঊর্ধ্বেই আছে দেখ–
চিক্কুর-গর্জনে বিকাশে।
লঙ্ঘিয়া কতদেশে…”
এমন সময় অতি রুক্ষ কণ্ঠে “কী হচ্ছে শুনি?”—বলিয়া বরদাসুন্দরী ঘরের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইলেন এবং বাপ ও মেয়ে উভয়েই তাঁহার দিকে চাহিয়া নিশ্চল হইয়া গেলেন।
বরদাসুন্দরী ভিজিয়া একশা হইয়া গেছেন, সমস্ত শরীর বাহিয়া জলের ধারা নামিয়া পায়ের চারিদিকে জমা হইয়াছে। কাঁপিতেছেন—রাগে কি ঠাণ্ডায় বলা যায় না, তবে বেশ স্পষ্টই কাঁপিতেছেন। ইহারা চাহিতেই গিরিবালাকে লক্ষ্য করিয়া ঝঙ্কার দিয়া উঠিলেন— “কী হচ্ছে?- বলি, হচ্ছে কি শুনি?—তখন থেকে একটা মানুষ চেঁচিয়ে যে গলা ফাটিয়ে ফেললে, তা কানে যাচ্ছে না একটা কথা?…কাজের কথা তো যাবে না কানে, তেমন মানুষ যে জন্মই দেয়নি!— নৈলে যার ঘরে একটা আইবুড়ো মেয়ে- -সে মানুষ বসে বসে রাশি রাশি ছড়া নিকে যেতে পারে? হায়া ঘেন্না বলে একটা জিনিস থাকে মানুষের—তা কিছু কি দেননি ভগবান? ওঠ, ওঠ বলছি গিরি, নৈলে তোরই একদিন কি আমারই একদিন—কচি খুকি, অদর কাড়িয়ে বাপের কাছে ছড়া শুনতে এসেছেন। যা, ভিজতে ভিজতে হাঁড়ি ঠেলগে যা। আমি পারব না; আমি পারব না, পারব না, পারব না—এ বাড়ির কোন কাজে, কোন কথায় যদি আর থাকি তো আমার অতি- বড়-কোটি দিব্যি রইল।”
গিরিবালা বাপের হাঁটু ছাড়িয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া দাঁড়াইল। ভাবের ঘোরে এ ধরনের উগ্র ভর্ৎসনা খাইয়া বাপ-মেয়ে উভয়েরই অবস্থা অবর্ণনীয়; কেহ কাহারও মুখের দিকে চাহিতে পারিতেছে না। গিরিবালা দুয়ারের দিকে পা বাড়াইতেই বরদাসুন্দরী চিৎকার করিয়া উঠিলেন— “কোথায় চলেছিস ঠ্যাকার করে শুনি?—তোর না এই ক’দিন আগে জ্বর হয়েছিল—ঠ্যাকার!— তেজ!— গটগটিয়ে চললেন মেয়ে এই পাহাড়ে-বিষ্টি মাথায় করে!…যাঁর শিক্ষা তিনি নিজে কেন বসে রইলেন?—যান, বিষ্টি মাথায় করে রোজগার করতে। হবে যেতে—যার ঘাড়ের ওপর বারো বছরের আইবুড়ো মেয়ে তার আবার রোদ-বিষ্টি কি?…হারাণে—কোথায় গেল সে?…”
ঘরের দুর্যোগ আরম্ভ হইতেই হারাণ তবলার বোল ভুলিয়া দাওয়ার যে কিনারায় ছিল সেই কিনারা হইতেই উঠানে নামিয়া পড়িয়া সিদা বাহির হইয়া গিয়াছিল, তাহার কোন সাড়া পাওয়া গেল না।
বরদাসুন্দরী যেমন অকস্মাৎ আসিয়াছিলেন, সমস্ত তিরস্কার, মন্তব্য অসমাপ্ত রাখিয়া তেমনি ভাবেই অবারিত মস্তকে উঠান বাহিয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেলেন।
মা চলিয়া যাইতে গিরিবালা সেইভাবেই দাঁড়াইয়া অঞ্জলিতে মুখ চাপিয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। রসিকলাল উঠিয়া দুয়ারের দিকে অগ্রসর হইলন, গিরিবালার কাছে আসিয়া দ্বিধাজড়িত পদে ক্ষণমাত্র দাঁড়াইয়া বলিলেন— “চুপ কর গিরি।”—ঐটুকু দাঁড়াইতে আর ঐটুকু সান্ত্বনা দিতেও যেন ভয়—রান্নাঘরের দাওয়া থেকে বরদাসুন্দরী বুঝি টের পাইয়া গেলেন।
তাহার পর টোকাটা মাথায় দিয়া তিনিও বাহির হইয়া গেলেন।
ঘণ্টা দুয়েক বৃষ্টি রহিল এবং এই ঘণ্টা দুয়েক বাড়িটা থম থম করিতে লাগিল। হৃদয়াবেগটা প্রশমিত হইলে গিরিবালা পদ্য-লেখা কাগজপত্রগুলা পেটিকাতে তুলিয়া রাখিয়া, হাঁটুতে মুখ গুঁজিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া নীরবে বসিয়া রহিল। এক-একবার মনটা আলোড়িত করিয়া চোখে জল ঠেলিয়া আসিতেছে, হাত দিয়া মুছিয়া লইতেছে। ছেলে তিনটি খেলা ভুলিয়া দাওয়ার এক কোণে জড়সড় হইয়া বসিয়া আছে। খোকা এক-একবার সাহস করিয়া দাদাদের আবার খেলায় নামাইবার চেষ্টা করিতেছে, বিফলমনোরথ হইয়া আবার রান্নাঘরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া ম্রিয়মাণ হইয়া পাশটিতে গুটাইয়া সুটাইয়া বসিতেছে।
বরদাসুন্দরী আবার এ-ঘরে আসিলেন। গরগর করিতেছেন, তবে অনেক নরম গলায়—শেষ বর্ষণের বৃষ্টিধারার মতোই।—
“ওঠ, খেয়ে নিবি চল।…চিরকেলে অব্যেস মানুষের—পারে কখনও ছাড়তে? তবে অব্যেসটাই খারাপ, তাই বকতে হয়,—চিরকালটা কি কাব্যি নিয়ে থাকলেই চলে? দেখিস্, কাগোজগুনো যেন ছড়িয়ে না পড়ে—রেখেছিস তুলে? ছেলেগুনোকেও খাইয়ে দে গিরি, আমার শরীরটে যেন ভালো নেই, একটু শুইগে,—কোথায় যে গেল মানুষটা এই দুজ্জয় বিষ্টি মাথায় করে!…”
হারাণ প্রবেশ করিল। হারাণকে দেখিয়াই বরদাসুন্দরীর বকুনিটা একটু বাড়িয়া গেল— “হ্যাঁরে, আমি না হয় ঝোঁকের মাথায় বকলাম, তোর তো আক্কেল করতে হয়। লোকটা যে এই পাহাড়ে-বিষ্টি মাথায় করে রাগের ঝোঁকে রুগী দেখতে বেরিয়ে গেল, তুই কোন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বারণ করলি?”
হারাণ বিস্মিতভাবে বরদাসুন্দরীর মুখের পানে চাহিয়া বলিল— “শোন কথা ছোট মায়ের! উনি তো এখানথে’ বেইরে ওধি এক পহর ধরে ছড়া শুনিয়ে শুনিয়ে আমায় ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। একটা মানুষ অমন দাবড়ানিটা খেয়ে বেইরে এয়েছে, বলতেও পারি না কিছু; — বসে বসে নরকযন্ত্রণায় ভুগছি।…বারণ!—যাবার জন্যে পা পাড়ালে তো বারণ করব? আর তাও বারণই বা করবো কাকে কও দিকিন?—মণ্ডলের মায়ের পেটে ফিক ব্যথা উঠেছে, ডাকতে এল, গেলে ডবল বিজিট কবলালে, তা নড়লেন এক পা?…দাও, তেল চেয়ে পাটেচে… বলে— ‘তুই কোন্ বারণ করলি’!…”
বরদাসুন্দরী হাসিটা চাপিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু পারিলেন না। হাসির সঙ্গেই একটু দুঃখের ভার মিশাইয়া বলিলেন— “ওই শোন গিরি, তোরা বলিস মা বকে কিসের জন্যে; — মেয়ের কাছে যুৎ হ’ল না, চাকরের কাছে ছড়া কাটছে। মরিঃ, কারেই বা বলা! মানুষ হয় তবে তো;—উনি বিষ্টি মাথায় করে রোজগারে বেরুবেন! আমি আবার মন খারাপ করে ছেলেগুনোকে পর্যন্ত শুকিয়ে রেখেছি, পোড়া কপাল!…তা আদিখ্যেতা কেন? ভেতরেই আসতে বল্গে।”
৫
সিমুরের চৌধুরীদের বাড়িতে রাসের মতো শ্রাবণ মাসে ঝুলনটাও খুব ঘটা করিয়া হয়। রসিকলাল একদিন গিয়া গিরিবালা সাতকড়ি আর হরিচরণকে রাখিয়া আসিয়াছেন। জায়গাটা বড়, তা ভিন্ন অনেক বাড়িতেই ঝুলন উপলক্ষে কুটুম্ব সাক্ষাতের আমদানি হয় বলিয়া এই সময়টা অনেক লোকজন হয়; মেয়ে দেখাইয়া বিবাহের সম্বন্ধ করিবার মস্ত একটা সুযোগ। গিরিবালারা সমস্ত ঝুলনটা ওখানেই কাটাইবে।
নিকুঞ্জলাল একটা দিন-মজুরের সঙ্গে পাওনা লইয়া কথাবার্তা কহিতেছেন। মজুর রাখায় নিকুঞ্জলাল একটা বিশিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করেন।—প্রথমত, নিতান্ত দায়ে না ঠেকিলে কখনও কাছে-পিঠের লোককে নিয়োগ করেন না; তেমনি আবার সুস্থ-সবল লোককেও নিয়োগ করেন না। বলেন— “আহা, দুর্বল, কেউ ডাকে না, তবুও দুটো পয়সা যা পায়। লোক দেখিয়ে যে দান- ধ্যান করব সে অদেষ্ট তো করে আসিনি, এই করেই গরিব-দুঃখীদের ঘরে যা দুটো পয়সা পৌঁছে দিতে পারি।”
অবশ্য এরূপ দয়ার পাত্র যে একবার কাজ লয়, সে আর দ্বিতীয়বার এ পথ মাড়ায় না, তবুও একবার ধরা পড়িবার মতো হতভাগ্যও চারিদিকে বহুৎ, নিকুঞ্জলালের কাজ চলিয়াই যায়।
মজুরটা কাতরভাবে বলিতেছে— “একে তো আধা মজুরিতে কাজ কর বাবাঠাকুর, তায় এই ক’টা পয়সার জন্যে চার কোশ থেকে তিনবার হেঁটে আসতে হল। আর পারি না; শরীল কখনো বয়—আপনিই কন্ না?”
নিকুঞ্জলাল বলিতেছেন— “এই জন্যেই বলে, তোদের ছোটলোকদের ভালো করতে নেই কখনও। ঐ শরীরে তুই কত কাজ করবি যে তোকে পুরো মজুরি দিতে হবে বল? রেট খারাপ করে তো গেরস্তদের শাপমণ্যি কুড়োতে পারিনে? তোকে পুরো দিলে যারা সক্ষম তারা ডবল চাইবে না গেরস্তদের কাছে?—তখন?”
মজুরটা বলিতেছে— “যা জোরে পারিনি তা বেশি খেটে হাঁসিল করে দিয়েছি বাবাঠাকুর। যারা সক্ষম, যারা কাছের, তারা খেতে বাড়ি যেতেই কতটা পুষিয়ে নেয় কন্ না কেন? একমুঠো ভাজাভুজি মুখে দিয়ে নাগাড়ে তো খেটে গেছি, নইলে চারটে দিনে অতটা জঙ্গল পস্কের করা যায়? সক্ষম দুটো নোকেও পারত না; আপনি কাউকেই ডেকে জিগুন না কেন।”
নিকুঞ্জলাল বলিতেছেন— “ঘাট হয়েছে বাপু, ভেবেছিলাম মজুর, এখন দেখছি এক তর্কপঞ্চাননের পাল্লায় পড়েছিলাম। তা বেশ, তিনবার হেঁটে এসেছিস, খালি হাতে তো ফিরে যেতে হয়নি? বারো আনা থেকে কুল্যে পাঁচ আনায় ঠেকেছে,—নিয়ে যাবি, তার আর কি? গেরস্তর হাতে তো সব সময় থাকে না পয়সা…”
মজুরটা পায়ের কাছে বসিয়া কাতরাইতেছে— “না বাবু, আপনি রাজা, এই ক’টা পয়সার জন্যে গরীবকে ঘোরাবেন না। বাদল নামল, পথের কষ্ট, তার ওপর আবার জ্বর নেগেছে, দেন চুকিয়ে; শরীল আর বয় না বাবাঠাকুর।”
নিকুঞ্জলাল বলিতেছেন— “হ্যাঁ, তাগাদা বলতে হয়তো একে! চার কোশ দূরে থাকিস, বলছিস শরীর বইছে না, তার ওপর তো তাগাদার চোটে ভিটের মাটি তুলে ফেলছিস, কাছে পিঠে থাকলে যে কি করতিস! বলছি নিয়ে যাস, বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে না তো মানুষে? সক্কালবেলা থেকে দিয়ে- থুয়ে হাতে ছ’টি পয়সা ঠেকেছে; তুই আগে আসতিস তোকেই চুকিয়ে দিতুম।”
মজুরটা বলিতেছে— “চার কোপ পথ হেঁটে এর আগে আসা যায়!—আপনিই কন্ বাবাঠাকুর? দেন চুকিয়ে, দোহাই।”
নিকুঞ্জলাল অসহায়ভাবে বলিতেছেন— “এমন বিপদেও মানুষে পড়ে! তা নিয়ে যা ঐ ছ’টা পয়সা, কি আর করব? মেছুনি এলে বুঝিয়ে বলব। হোক মেয়েমানুষ, সে বরং বুঝবে।”
মজুরটা পা জড়াইয়া ধরিয়াছে, বলিতেছে— “তাহলে আর ছ’টা পয়সা দিয়ে বিদেয় করে দেন বাবাঠাকুর, আর এসবোনি। মনে করব…’
এমন সময় হুই-হাঁই শব্দ করিতে করিতে সামনের রাস্তায় কয়েকজন ঢুলি একটা পালকি নামাইল। পালকির দোরটা একটু টানা বলিয়া ভেতরটা দেখা যায় না। সঙ্গে একজন পাইক- বরকন্দাজ গোছের লোক আছে। দুই-একজন ব্যক্তি জড়ো হইলে সে প্রশ্ন করিল— “এখানে নিকুঞ্জ ঘটক ঠাকুরের বাড়িটা কোথায় বলতে পার?”
নিকুঞ্জলাল ফতুয়ার পকেট থেকে আড়াইগণ্ডা পয়সা বাহির করিয়া ফেলিয়া দিয়া বলিলেন -”নে তাহলে, আর এক আনা পয়সা ছেলেদের মুড়ির জন্যে রেখেছিলাম, তুই-ই নিয়ে যা; কিন্তু খবরদার আর এ-মুখো হসনি—ভদ্রলোকের বাড়িতে খাটবার যুগ্যি নোস্।…কে আবার এল দেখিগে।”
মাঝখানে একটা বাগান পড়ে, সেটা পারাইয়া আসিতে আসিতেই নিকুঞ্জ বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন— “আরে, পরেশ যে!—তুমি হঠাৎ কোথা থেকে?”
পা চালাইয়া গিয়া পালকির সামনে উপস্থিত হইলেন। পালকির আরোহী লোকটি বাহির হইয়া নিকুঞ্জলালের পদধূলি গ্রহণ করিল, তাহার পর ইষৎ লজ্জিতভাবে মুখটা অল্প নিচু করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল— “অনেকদিন পায়ের ধুলো দেননি, মনে করলাম একবার নিজেই গিয়ে নিয়ে আসি।”
চেষ্টা করিয়াই হোক, অথবা স্বভাবসিদ্ধই হোক—কথাটাতেও একটু ছেলেমানুষি আবদারের ভাব আছে।
বর্ণটা কালোই, তবে মাজাঘষা; মাথায় টাক, চুল গোটাকতক যা আছে তাহাতে বোধ হয় পাক ধরিয়াছে, একটু লক্ষ্য করিয়া দেখিলে মাঝে মাঝে কলপের কটাশে রংটা চোখে পড়ে, মোটা গোঁফ জোড়াটিরও সেই অবস্থা।
মাথায় একটু খর্বই; এদিকে আড়ে বেশ ফাঁদাল। বয়স পঁয়তাল্লিশের এদিকে ওদিকে একটা কিছু হওয়া সম্ভব,—অর্থাৎ আধ আধ কথা বলিবার মতো নয়, লজ্জা করিবার মতোও নয়, এমন কি নিকুঞ্জলালকে প্রণাম করিবার মতোও নয়, কেন না নিকুঞ্জলালের বয়স পঁয়তাল্লিশের নিচেই।
আগন্তুকের গায়ে দামী সাটিনের চীনে কোট, গলায় পাট-করা একটি দামী রেশমের চাদর, পরনে গিলে-করা ফরেশডাঙার কালোপেড়ে ধুতি, পায়ে সিল্কের মোজা এবং গিল্ট সোনার ফুলকাটা বকলস্ বসানো চীনেবাড়ির দামী পম্পশ্য।…এসবের উপর আবার সঙ্গে একজন পাইক; বেশ লোক জড়ো হইয়া গেল।
পদধূলি গ্রহণ করিতে নিকুঞ্জলাল মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন— “বেশ করেছ, খুব ভালো করেছ। আমার মনটাও ক’দিন থেকে বড় উতলা হয়েছিল—হবেই কি-না, সম্বন্ধটা তো সোজা নয়;–শাস্ত্রে বলে গুরু-শিষ্যের সম্বন্ধটা হল পিতা-পুত্রের সম্বন্ধ—মনটা টানবেই কিনা। হাতের গোটাকতক কাজ সেরেই যাচ্ছিলাম, তা এসে ভালোই করেছ।…চলো, এসো; আর বাবাজি, যা গুরুর বাড়ি; একটা কুঁড়ে বললেই হয়, এই কি আর তোমাদের থাকবার যুগ্যি?”
দলটি পিছনে পিছনে চলিয়াছে। নিকুঞ্জলাল আলাপচ্ছলে যে পরিচয়টুকু দিয়া যাইতেছেন সেইটুকু লইয়াই বিস্মিত আন্দাজ-আলোচনা আরম্ভ হইয়া গেছে। উহারা দুইজনে ঘরে প্রবেশ করিতে দলটি দুয়ার এবং জানালার বাহিরে চারাইয়া পড়িল। গুমট গরম পড়িয়াছে, নিকুঞ্জলাল থাকিয়া থাকিয়া সরাইয়া দিতেছেন, যাহাতে ঘরে একটু হাওয়া আসে। দলটা সরিয়া গিয়া আবার বর্ধিত কৌতূহলে আসিয়া জড়ো হইতেছে! কিন্তু নিকুঞ্জলাল অত কাঁচা নন যে একেবারে সব পরিচয়টা দিয়া ব্যাপারটাকে হালকা করিয়া দিবেন। কুশল প্রশ্নাদি প্রাথমিক কথাবার্তার মধ্যেই পাখার হাওয়া খাইয়া খানিকটা জিরাইয়া আগন্তুক জামা জুতা খুলিয়া তাকিয়া আশ্রয় করিল। স্থূল শরীর ঢাকিয়া বুকে-পিঠে রাশীকৃত চুলও আছে—দলের লোকেরা এর অধিক পরিচয় যখন আপাতত কোনমতেই পাইল না, তখন অল্পে অল্পে পাতলা হইতে লাগিল।
আরও খানিকক্ষণ গেল। মিছরির সরবৎ, ফলমূল, কিছু মিষ্টান্ন সেবন করিয়া আগন্তুক ঠাণ্ডা হইল, তাহার পর কৌতূহলীদের যখন আর কেহই বাকি নাই সেই সময় আসল কথা আরম্ভ হইল। গুমট করিয়াছিল, একটু পরে বর্ষা নামিল, বিশ্রম্ভালাপে সুবিধাও হইল।
নিকুঞ্জলাল বলিলেন— “একটু দেরি করে ফেললে পরেশ, মেয়েটি পরশু মামার বাড়ি চলে গেছে। আমি আকুলি-বিকুলি করে মরছি পরেশ এখনও আসে না কেন। পষ্ট বলতে তো পারি না, তবুও ছুতোনাতা করে ওর বাপকে দুটো দিন রেখেছিলাম, আর পারা গেল না, শ্বশুরবাড়ির টান, বোঝই তো বাবাজি—হি-হি-হি….তা ঐ যে বললাম মেয়ে দেখতে হবে না, সাক্ষাৎ লক্ষ্মী ঠাকরুণটি।”
পরেশনাথ শিষ্যোচিত লজ্জা ও বিনয়ের সহিত বলিল— “মেয়ে দেখবার তো আমার কোন দরকার নেই, আপনি নিজেই যখন রয়েছেন তখন আর কথা কি? তবে বিলম্বটা আর ঠিক হচ্ছে না, তাই ভাবলাম নিজে গিয়েই গুরুদেবকে বলি, বার বার তাঁকে ডেকে আনানো ঠিক নয়—অবিশ্যি পায়ের ধুলো পড়লেই আমার ভাগ্যি…তাহলেও নিজেই যাই একবার। গুরুগৃহের মতন তীর্থ তো আর নেই; অনেক দিন থেকে একটা সাধ আছে।…থাকত মেয়ে, দেখে যেতাম, সে আলাদা কথা। আসল দরকার একটু তাড়াতাড়ি যাতে…”
নিকুঞ্জলাল বলিলেন— “আমার চেষ্টার বিরাম নেই বাবাজি, তবে বেশি তাড়াহুড়ো করতে গেলে আবার এসব ব্যাপার ভেস্তে যায়। বুঝতেই তো পার? বড়টিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অনেকটা হাতে এনেছি। দোজপক্ষের জন্যে তার আর তেমন আপত্তি নেই। অবিশ্যি কে ছেলে, কত বয়স কি বৃত্তান্ত—সেটা সইয়ে সইয়ে ভাঙতে হবে। তবে তাকে করবই রাজী—এ তুমি অবধারিত জেনো বাবাজি, বড়কে রাজী করব। মুস্কিল হয়েছে ছোটকে, অর্থাৎ মেয়ের বাপকে নিয়ে। সে এক আধ- পাগলা মানুষ—মাথায় কে ঢুকিয়ে দিয়েছে, মেয়ে ওর পার্বতী, শিব এসে তাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। দিনকতক তো ‘গৌরীদান করব, গৌরীদান করব’ বলে খুব খেপলো, সে ফাঁড়া কাটিয়ে মেয়ে তো এখন তেরোতে পড়েছে, এখন মাথায় বসে গেছে শিব নিজে মানুষের বেশে এসে ওর মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।…এ পাগলামিও ঘুচবে, তবে নেহাত বাপ, শেষ পর্যন্ত না আবার উল্টে বসে, তাই একটু সাবধানে পা টিপে টিপে এগুনো…
আগন্তুক বলিল— “আপনি যা ভাল বুঝবেন তার ওপর আমার আর কি বলবার আছে? তবে খুব দেরি যাতে না হয়…মানে সংসারটা ভেসে যাচ্ছে কি-না…বছর খানেকের বেশি যাতে না যায়…”
নিকুঞ্জলাল বলিলেন— “এই আসছে মাঘ-ফাল্গুন, তার বেশি এগুতে দোব না, নিশ্চিন্ত থাকো।…হ্যাঁ, তুমি যখন এসেইছ, তখন কাজ খানিকটা এগিয়ে ফেলা যাক। বড়কে ডেকে তোমার সঙ্গে আলাপটা করিয়ে দিই। ওসব কথা এখন স্রেফ কিছু নয়, শুধু একটু চেনা-শোনা আলাপ-পরিচয় হয়ে থাকা, পরে আমার কথাবার্তা পাড়তে সুবিধে হবে। খুব সাবধানে চালিয়ে যেও তুমি বরং একটা পরামর্শ করে ফেলি এস।…তাহলে কিন্তু তোমার আর সন্ধ্যের গাড়িতে ফেরা হয় না।”
অনেকক্ষণ ধরিয়া দুইজনে সলা-পরামর্শ হইল। পাইকটাকে বলিয়া রাখা হইল—দরকারী মকদ্দমার কথাবার্তা হইতেছে, কেহ আসিতে থাকিলে সে যেন পূর্বাহ্ণেই সঙ্কেত করিয়া দেয়।
বৃষ্টিটা ঘণ্টাখানেক পরে ধরিলে নিকুঞ্জলাল নন্তীকে পাঠাইয়া দিলেন অন্নদাচরণকে ডাকিয়া আনিতে। আগন্তুক আবার জামা মোজা পরিয়া মোটা সোনার ঘড়ির চেনটা বুকে দুলাইয়া ভব্যসব্য হইয়া বসিল।
অন্নদাচরণ আসিলে নিকুঞ্জলাল বলিয়া উঠিলেন – “এসো, এসো অন্নদা। পরেশ বলে- বেলে-তেজপুরে এলাম, এখানে সমাজে যাঁরা বিশিষ্ট তাঁদের সঙ্গে একটু দেখা-সাক্ষাৎ আলাপ- পরিচয় না করে গেলে মনটা খুঁৎ খুঁৎ করবে।…আমি বললাম—বিশিষ্ট লোক—মানে, একটা ন্যায্য কথা বললে বোঝে, পাঁচটা ভালো কথা নিয়ে চর্চা করে—মানে, চারিদিক দিয়ে আলাপ করবার মতন আমি তো অন্নদাকেই দেখি, আর লোক আছে কে বেলে-তেজপুরে?…অবিশ্যি থাকবে না কেন, রায়েরা রয়েছে, সাহারা দুই ভাই রয়েছে—টাকার আণ্ডিল, কেবল বড় বড় কথা, সেদিক দিয়ে খুব বড়, খুব বিশিষ্ট…পরেশ হেসে বলে—না, টাকায় বড় ঢের দেখেছি, রোজই দেখছি; যাঁর সঙ্গে দুটো ভালো আলাপ করে আরাম পাব, এমন লোকের সঙ্গই চাই দুদণ্ড। তাই তোমায় ডেকে পাঠালুম, কাজের ক্ষতি করে আসতে হ’ল নাকি?”
অন্নদাচরণ কতকটা অভ্যর্থনা এবং পরিচয়ের ভঙ্গিতে, কতকটা আগন্তুকের সাঙ্গোপাঙ্গ এবং বেশভূষার জাঁকে এবং সর্বোপরি বয়োজ্যেষ্ঠ হইলেও তাহার সম্বন্ধে নিকুঞ্জলালের কনিষ্ঠের উপযোগী ভাষা প্রয়োগে বেশ একটু হকচকিয়া গিয়াছিলেন; একটু জড়িতভাবে চৌকির একটা কোণে বসিয়া নবলব্ধ বিশিষ্টতা অনুযায়ী কি একটা মানানসই প্রশ্ন করিবেন ভাবিতেছেন, এমন সময় আরও একটা বিস্ময়ের ব্যাপার ঘটিল।—আগন্তুক স্থুল বপুটি দুইধারে একটু দুলাইয়া উঠিয়া পড়িল এবং পকেট হইতে পাঁচটি টাকা বাহির করিয়া অন্নদাচরণের সামনে রাখিয়া ভূমিস্পর্শ করিয়া প্রণাম করিল।
“ওকি করেন, ওকি করেন, বয়োজ্যেষ্ঠ আপনি।”—বলিয়া অন্নদাচরণ তাহাকে ধরিয়া ফেলিতে যাইতেছিলেন, নিকুঞ্জলাল জোরেই হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন— “আমি জানতাম তুমিও ঐ ভুল করবে অন্নদা। ওর অধিকার আছে প্রণামের, করুক; বয়োজ্যেষ্ঠ-টেষ্টো নয়, ছেলেবেলা থেকে চেহারাটা একটু ভারী-ভারী—সবাইকেই ঐ ভুল করতে হয়—হাঃ হা-হা। …কিন্তু তুমি আবার ওকি করলে পরেশ! আবার টাকা কেন বাপু?”
আগন্তুক হাতটা অন্নদাচরণের দুই পায়ে ঠেকাইয়া বুক এবং মাথা স্পর্শ করিয়া সেই অল্প আধ- আধ স্বরে বলিল— “সে কি কথা গুরুদেব! আপনার ভাই, কত সৌভাগ্যে পায়ের ধুলো পেলাম, দুটো টাকা প্রণামী দোব বৈকি, এতে বারণ করলে শুনব কেন?”
সলজ্জ গতিতে গিয়া নিজের জায়গায় বসিলে নিকুঞ্জলাল অন্নদাচরণকে বলিলেন— “নাও তুলে, ও ঐ রকম একগুঁয়ে, ছাড়বে না। অবিশ্যি ওর অধিকার যে আছে এ কথাও স্বীকার করতে হবে বৈকি, আমার শিষ্যি হলে তোমার সঙ্গে সেই সম্বন্ধই দাঁড়াল কিনা।…পরেশ হল হরিপুরের গাঙ্গুলীদের ছ-আনি শরিক–এখনকার বড় তরফ আর কি। বংশমর্যাদার বলো, প্রতিপত্তিতে বলো, অর্থে বলো, অত বড় জমিদার আর ও-অঞ্চলে…
পরেশ গাঙ্গুলী বিনয়ে একটু হেলিয়া গেল, বলিল— “অর্থ কোথায় গুরুদেব? আশ মিটিয়ে যে আপনাদের সেবা করব এমন সামর্থ্যটুকু পর্যন্ত নেই; কত কথাই যে মনে হয়!…তবে হ্যাঁ, গুরুবল আছে, চলে যায়—অভাব-অপ্রতুলটা আর ভোগ করতে হয় না…’
অন্নদাচরণের দিকে চাহিয়া বলিল— “এইটুকুই কি যথেষ্ট নয়? এইটুকুতেই কি আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়?”
হরিপুর এখান থেকে বহুদুর হইলেও গাঙ্গুলীদের নাম-ডাকের পরিচয় মাঝে মাঝে কানে আসে, সেখানকারই ছ-আনি তরফের মালিককে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে এত কাছে দেখিয়া অন্নদাচরণ সত্যই অভিভূত হইয়াছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে নিকুঞ্জলালের উপরও কোথা দিয়া একটা শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়া উঠিতেছিল। একটা কথা বলিবার সুযোগ পাইয়া বলিলেন— “এ তো অতি মহতের মতন কথা, আপনার উপযুক্তই কথা…”
পরেশ গাঙ্গুলী ঈষৎ কুণ্ঠার সহিত অল্প একটু হাসিয়া,—মাথাটা নিচু করিয়া বলিল— “আমায় ‘আপনি’ বলেই ডাকতে থাকবেন?”
নিকুঞ্জলাল বললেন— “ওটা ক্রমেই শুধরে যাবে, ওর জন্য তুমি খেদ করো না। আর অন্নদার চেয়ে তুমি খুব ছোট তো নও, বছর দুয়েকের হদ্দ হবে, বোধ হয় তাও নয়। আলাপ-পরিচয় বাড়বার সঙ্গে ওটুকু কেটে যাবে।…ভুলছ কেন গো?—নতুন নতুন তো আমিও তোমায় আপনি ছাড়া বলতে পারতাম না।”
অন্নদাচরণ বিজ্ঞ এবং বিশিষ্ট লোকের মতো একটা কথা বলিবার সুযোগ পাইলেন, বললেন— “তুমি ওর কুলগুরু, আমার দাদা—আমাদের উভয়েরই নমস্য, তোমার সব মানায়; কিন্তু তাই বলে যে আমারও ওঁকে উপযুক্ত সম্ভাষণ করলে দোষ হবে—একথা মানবো কেন দাদা?— দেশের রাজা, বয়সে কনিষ্ঠ হলেও সে সমাজের শীর্ষস্থানীয়। রাজা বিনয়ী হন, তাঁর গুণ, তাঁর দয়া; তাতে তো তিনি ছোট হন না, বরং আরও বড়ই হয়ে পড়েন; তাঁর সঙ্গে আলাপে আমাদের এ সোজা কথাটুকু ভুললে চলবে কেন?”
নিকুঞ্জলাল হুঁকা অবলম্বন করিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছিলেন, অন্নদাচরণ শেষ করিলে—মুখ তুলিয়া পরেশ গাঙ্গুলীর পানে চাহিয়া হাসিয়া বলিলেন— “শুনলে তো? এখন দাও উত্তুর।…না, বেফাঁস তো কিছু বলেনি অন্নদা, বলেছে খাঁটি কথাই, ওর উপযুক্ত কথাই। আর বলবেই কিনা, নৈলে তুমি ভালো লোকের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলে, সবাইকে ফেলে আমি নিজের ছোট ভাইটিকে ডাকিয়ে আনাই কেন? না, দিতে হবে উত্তুর তোমায়, উঁহু….’
পরেশ গাঙ্গুলী মাথা নিচু করিয়া মৃদু হাস্যের সহিত উভয়ের কথাই শুনিয়া যাইতেছিল, মাথাটা ডাইনে বাঁয়ে দুলাইয়া বলিল— “এর উত্তুর আমার কাছে নেই, হার মানলাম গুরুদেব। তবে এও বলি, যদি মেনে নিতেই হয়—রাজা, তো সে আর সবার কাছে, আপনার কাছে নয়, ওনার কাছেও নয়; আপনাদের কাছে স্নেহই আশা করি, আর যদি দেখি সামান্য একটি সম্ভাষণের মধ্যেও সে স্নেহ ছাড়া অন্য ভাব আসছে তো আপত্তি করতেও ছাড়ব না।”
উত্তর দেওয়ায় অক্ষম বলিয়া জানাইলেও বেশ ভালো উত্তরই দেওয়া হইল। শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে পরেশ গাঙ্গুলী বেশ ভালো ভাবেই হাসিয়া উঠিল। নিকুঞ্জলাল আবার হুঁকায় মুখ লাগাইয়া মৃদু মদু হাসিতে লাগিলেন, একবার আড়চোখে যেন শিষ্যগৌরবে অন্নদাচরণের পানে চাহিলেন। অন্নদাচরণ বলিলেন— “সাধু সাধু!—নৈলে আর রাজার সৌজন্য বলেছে কেন? …বাঃ, পরিচয় পেয়ে, আলাপ করে ধন্য হলাম।…সাধু!”
অনেকক্ষণ পর্যন্ত কথাবার্তা হইল, খুব হৃদ্যতা জমিয়া উঠিল। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে আকাশ পরিষ্কার হইয়া গেল, পরেশ গাঙ্গুলী বরকন্দাজকে ডাকিয়া পালকি ঠিক করিতে হুকুম দিল, তাহার পর নিকুঞ্জলালের পানে চাহিয়া বলিল— “এরকম মহাশয় পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গ ছেড়ে যেতে মন সইছে না গুরুদেব, থেকেই যেতাম রাতটা, আমার তীর্থধামই তো, কিন্তু জানেনই তো কি রকম হাঙ্গামে পড়ে আছি কটা ব্যাপার নিয়ে?”
নিকুঞ্জলাল বলিলেন— “তা জানি বৈকি। শুনতেই রাজা, রাজত্ব করাটা যে কী তা দেখছিই।…অন্নদার সঙ্গে মাত্র ঘণ্টা দু’একের আলাপে তৃপ্তি তো হয়ই না। তা তোমার বক্তব্যটা কি?”
পরেশ গাঙ্গুলী কুণ্ঠিতভাবে বলিল— “বলতে সাহস হয় না। গুরু বা গুরুবংশীয় কাউকে হুট করে আহ্বান করলেই হল না তো; তবুও যদি দিতেন পায়ের ধুলো একবার উনি…”
শেষের দিকটায় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে অন্নদার পানে চাহিল। অপ্রত্যাশিত এত বড় একটা নিমন্ত্রণে তিনি একটু সঙ্কুচিত দৃষ্টিতেই নিকুঞ্জলালের পানে চাহিলেন। নিকুঞ্জলাল ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন— “বুঝি, তোমারও অনেক কাজ হাতে! কিন্তু যেতে হবে একবার। পরেশ বলছে অত করে, কি আর করবে?”
পালকিতে উঠিয়া পরেশনাথ আবার পকেট থেকে দশটি টাকা বাহির করিয়া নিকুঞ্জলালের হাতে দিল, বলিল— “দু’বাড়ির ছেলেপুলেদের মিষ্টি খাবার জন্যে এটা রাখুন, ভুলেই যাচ্ছিলাম কথায় কথায়।”
নিকুঞ্জলাল সঙ্গে সঙ্গেই অন্নদাচরণের দক্ষিণ হস্তটা টানিয়া লইয়া একরকম জোর করিয়া টাকা কয়টা গুঁজিয়া দিলেন, বলিলেন— “আমার বাড়ির ছেলেপুলে বলতে তো এক ঐ নন্তী। তুমি মিষ্টি- টিষ্টি কিনে দুটো কিছু পাঠিয়ে দিও অন্নদা।”
বাড়িতে আসিতে আসিতে অন্নদাচরণের মনে হইল পৃথিবীতে যখন এমন সরল আর উদার প্রকৃতির জমিদার থাকা সম্ভব, তখন নিশ্চয় এটাও সম্ভব যে নিকুঞ্জলালের সম্বন্ধে তিনি একটা ভুল ধারণাই পোষণ করিয়া আসিয়াছেন এতদিন। যতক্ষণ জাগিয়া রহিলেন মনটা একটা প্রীতি আর ক্ষমার রসে পরিপূর্ণ হইয়া রহিল।
.
পরদিন সকালে নন্তী গিয়া আবার অন্নদাচরণকে ডাকিয়া আনিল। নিকুঞ্জলাল একটা কিসের দলিল লইয়া হুঁকাহাতে মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করিতেছিলেন, একবার অন্নদাচরণকে দেখিয়া লইয়া বলিলেন— “বসো।”
একটু পরে দলিলটা মুড়িয়া পাশে রাখিয়া দিয়া বলিলেন— “কাল রাত্তিরেই ডেকে পাঠাব ভেবেছিলাম, তা শরীরটা কেমন করতে লাগল, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। জমিদার-শিষ্যি ও শুনতেই ভালো, এলে মস্ত বড় ধুকপুকুনি লেগে থাকে কিনা—কি ত্রুটি হল, কি খেলাপ হল, তোমার কাছে তো নুকুনো নেই; ভালোয় ভালোয় যেন বিদেয় হলেই ভালো।”
অন্তরের গোপনীয় কথাটি বলার সঙ্গে একটু হাস্য করিলেন। অন্নদাচরণ বলিলেন— “তা বৈকি।”
নিকুঞ্জলাল তামাক টানিতে লাগিলেন। একটু পরে সেই ভাবেই—শুধু একটি তির্যক দৃষ্টিতে অন্নদাচরণের মুখের পানে চাহিয়া লইয়া প্রশ্ন করিলেন— “কেমন বোধ হল লোকটিকে বলো দিকিন?”
প্রশ্নটা করার ভঙ্গিতে অন্নদাচরণ একটু সন্দিগ্ধ কণ্ঠেই বলিলেন— “কেন, আমার তো বেশ ভালই বোধ হল দাদা। কেন বলুন তো?”
নিকুঞ্জলাল তামাকটা একটু টানিয়া হুঁকাটা পিতলের বৈঠকে বসাইয়া দিলেন। তাহার পর কলিকাটা আবার সাজিয়া দিবার জন্য নন্তীকে একটা হাঁক দিয়া বলিলেন— “না, ভালোই। কতকগুলো বড়মানষি খামখেয়ালিপনা আছে—যেমন ধরো এই বয়স কমিয়ে বলা,—তা সে অত ধরা চলে না—অমন পায়ের ওপর পা দিয়ে খাবার সংস্থান থাকলে তোমার-আমারও হত…”
অন্নদাচরণ বলিলেন— “হ্যাঁ, বয়েসটা যেন একটু বেশিই মনে হল।”
নিকুঞ্জলাল মাথাটা একটু হেলাইয়া বলিলেন— “মনে হওয়া-হওয়ি নয়, বেশিই; আমার কাছে তো নুকুনো নেই—কুষ্টি-ঠিকুজি পর্যন্ত তোয়ের করে দিতে হয়েছে। তবে হ্যাঁ, আমার চেয়ে ছোটই; তবে তোমার চেয়ে বড়ই; তোমার কত যাচ্ছে?”
অন্নদাচরণ বলিলেন— “আমার এই চোতে একচল্লিশ গেল।”
নিকুঞ্জলাল কপালে তর্জনীটা চাপিয়া একটু ভাবিয়া লইয়া বলিলেন— “দাঁড়াও, তাহলে একটু ভুল হয়েছে—পরেশ তাহলে তোমার চেয়েও একটু ছোটই হয়; পরেশের হল…মানে, এই গেল মাঘে আটত্রিশে পড়েছে, ঠিকুজির বয়েস বলছি। তাহলে হল না তোমার চেয়ে বছর দু-একের ছোট?”
একটু চুপ করিয়া বলিলেন— “চুলোয় যাক, বাজে কথা বেড়ে যাচ্ছে। তোমায় যার জন্যে ডাকা,—তোমার উপর হঠাৎ যেন একটু নেকনজর বলে বোধ হল—আমি লক্ষ্য করে দেখছিলাম কিনা কাল…খপ্ করে নেমন্তন্ন পর্যন্ত করে বসলো…”
অন্নদাচরণ একটু কুণ্ঠিতভাবে বলিলেন— “হ্যাঁ, অতি সজ্জন…কিন্তু সেই কথা ভাবছিলাম দাদা—যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আমাদের মতো লোক—ওঁদের দেউড়ি মাড়াবার যুগ্যি নই…”
নিকুঞ্জলাল অন্নদাচরণের হাঁটুর উপর চারটি আঙুল চাপিয়া তাঁহাকে থামাইয়া বলিলেন— শোন অন্নদা, ঐ জন্যেই তোমায় ডাকা। নিকুঞ্জদাদাকে কি মনে করবে জানি না, তবে নিকুঞ্জ দাদা যে-পরামর্শটা ভালো মনে করেছে, চিরকাল দিয়েও এসেছে, দেবেও। তোমায় যেতে হবে, আর টাটকা-টাটকি, আর ‘তুমি’ বললেই ও সন্তুষ্ট হয়, ‘তুমিই বলতে হবে।”
অন্নদাচরণ একটু বিস্মিতভাবে চাহিয়া রহিলেন। নিকুঞ্জলাল বলিলেন— “অবিশ্যি ঐ যে বললে সজ্জন, তা খুবই সজ্জন পরেশ; তবে আমরা হচ্ছি গেরস্ত মানুষ, রাজরাজড়ারা সজ্জন কি দুজ্জন অত বুঝি না, আমাদের কাজ হাসিল হলেই হবে। তা হলে সব কথাটা তোমায় খুলেই বলি, – মানুষটা সজ্জন বলেই, ওর স্বভাব জানি বলেই, আর সবাইকে ছেড়ে তোমাকেই কাল ডাকিয়ে আনলাম, ভাবলাম যদি একটু সুনজরে পড়ে যায় অন্নদা তো একটা আখের হয়ে যাবে। তা দেখলাম, দেখামাত্রই তোমার ওপর কেমন একটা ভালো ধারণা জন্মে গেল—অবিশ্যি আমিও আগে থাকতে জমি ঠিক করে রেখেছিলাম, আর তোমার কথাবার্তাগুলিও খুব বিবেচকের মতোই হয়েছিল। তবে কি জান রে ভাই?—যতই বল, যতই কও, রাজরাজড়ার মন। ও টাটকা-টাটকি যতটা হয় কাজ আদায় করে নেওয়াই হুঁশিয়ারের কর্ম। তাই বলছিলাম,—বলে গেছে একবার দেরি না করে গিয়ে পড়ো, নিজে সেধে তো যাচ্ছ না যে লজ্জা আর কুণ্ঠা। একটু দহরম-মহরম তো হোক, তারপর আমি আছি। অন্তত একটা মোটা বিদেয় দেয় তো নিয়ে এসো আপাতত!”
নন্তী কলিকাটা সাজিয়া হুঁকায় বসাইয়া বাপের হাতে হুঁকাটা তুলিয়া দিয়া গেল। নিকুঞ্জলাল দুইটা টান দিয়া হুঁকামুখেই অন্নদাচরণের পানে চাহিয়া মিটিমিটি হাসিতে লাগিলেন, পরে বলিলেন- “অন্নদা ভাবছে, নিকুঞ্জদাদা আচ্ছা মতলববাজ মানুষ তো! তা একটু মতলব খাটাচ্ছি বৈকি, তোমাদের যদি পর বলে ভাবতাম, গা করতাম না। এই সময় রসিকেরও একটু নামডাক হচ্ছে, একটা অমন জমিদারবাড়িতে, বেশি না, যদি মাসে একটা করেও ডাক পায় তো…রাবণের তো গুষ্টি লেগেই রয়েছে একটা না একটা অসুখ বিসুখ…”
পূর্বসম্বন্ধের ইতিহাসে যা কিছু গলদ আছে সমস্ত ভুলিয়া অন্নদাচরণের মনটা ভিতরে ভিতরে কৃতজ্ঞতায় ভরিয়া উঠিতেছিল; বলিলেন— “একটু কুণ্ঠিত হচ্ছিলাম দাদা, না হচ্ছিলাম যে এমন নয়; তবে ভেবে দেখছি আপনার পরামর্শই ঠিক। মেয়েটা ওদিকে তরতর করে বেড়ে উঠছে, একটা বেশ বাঁধা গোছের উপার্জন নেই—আমার হাত খালি, ওর বাপেরও ওদিকে ছাড় নেই…এই সময় ভগবান যদি নিজে একটু যোগাযোগ করে দিলেন তো ছাড়া কোনমতেই উচিত নয়।”
শেষের কথাগুলো নিকুঞ্জলাল তীক্ষ্ণ ঔৎসুক্যে শুনিয়া যাইতেছিলেন; অভীপ্সিত সুযোগটাকে আপনা হইতেই এত কাছে আসিয়া পড়িতে দেখিয়া প্রায় সংযম হারাইয়াছিলেন; কোন রকমে নিজেকে সামলাইয়া লইলেন এবং অত্যন্ত ঘন-ঘন হুঁকা টানিতে লাগিলেন। তবু মনটা খুব তোলপাড় করিতে লাগিল। আরও অনেকক্ষণ কথাবার্তা হইল, আরও অনেক সৎপরামর্শ; এই পরিচয়টাকে কত রকমে কামধেনু করিয়া লওয়া যায় এবং উচিত—এই সব নানারকমের হিতৈষণার কথা। সবশেষে, প্রস্তাবটা একেবারে পুরোপুরি না আনিয়া ফেলিলেও সামান্য, অতি সূক্ষ্ম একটি ইঙ্গিত দিয়াই রাখিলেন নিকুঞ্জলাল, কথাটা একসময় পাড়িবার সুবিধা হইবে। খুব চটুল একটি হাসি হাসিয়া কহিলেন— “আরও একটা জাঁদরেল মতলব ঠাউরে আছি হে অন্নদা, নেহাৎ বসে নেই তোমার নিকুঞ্জদাদা।”
অন্নদাচরণের আন্দাজটা অত বেশি উঠিতে পারিল না, তবু একটু আশান্বিত ভাবেই প্রশ্ন করিলেন— “কি মতলব দাদা?”
নিকুঞ্জলাল বলিলেন— “দেখবে, দেখবে; তখন বলো…”
আরও সূক্ষ্ম একটি হাসি ঠোঁটে জাগিয়াই মৃদু মৃদু তামাক টানিতে টানিতে আড়চোখে অন্নদাচরণের মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন।
.
যাওয়াই স্থির হইল, তবে বর্ষার সময়টা চাষবাসের হাঙ্গামাটা একটু লাগিয়াই থাকে, যাই যাই করিয়াও দেরি হইতে লাগিল। ইতিমধ্যে নিকুঞ্জলালের কাছে দুইখানি চিঠি আসিল— “ছোট গুরুঠাকুর”-এর পায়ের ধুলা না পড়ার জন্যে অনেক দুঃখ-অভিমান করিয়া লেখা। —পরেশনাথ কি এতই অযোগ্য? প্রথম সাক্ষাতে আলাপ-পরিচয়ে কি কোন অপরাধ হইয়া পড়িয়াছিল? হইলেও যে শিষ্যস্থানীয়, সন্তানস্থানীয়—তাহার জন্য কি ক্ষমা নাই?…এইরকম অনেক করিয়া লেখা। নিকুঞ্জলাল দ্বিতীয় চিঠিটা হাতে দিয়া একটু ক্ষুণ্ণভাবেই মুখটা গম্ভীর করিয়া বলিলেন— “দেখো হে, উত্তরটা তুমিই না হয় দিয়ে দাও যা হয় একটা, একদিকে জমিদার-শিষ্য, একদিকে ভাই, আমি মাঝখান থেকে কথাটা দিয়ে বড়ই অন্যায় করেছিলাম, এখন বুঝছি। এদিকে আমারও একবার যাওয়া দরকার, বাড়ি বয়ে এল অত বড় লোকটা;— কিন্তু মুস্কিল হয়েছে, তুমি একবার হয়ে না এলে আমি কোনমতেই তার সামনে হতে পারছি না…”
কাজের সঙ্গে সত্যই একটু কুণ্ঠাও লাগিয়াছিল, অলক্ষ্যে হইলেও গড়িমসি করিবার সেইটেই বোধ হয় বিশেষ কারণ; কি আর ঠেলিয়া রাখা গেল না। ভাদ্রের মাঝামাঝি অন্নদাচরণ দ্বিধাসঙ্কোচ লঙ্ঘন করিয়া যাত্রা করিলেন। নিকুঞ্জলালের পরামর্শ মতোই কথাটা গ্রামে এবং বাড়িতেও গোপন রাখা হইল। নিকুঞ্জলাল বলিলেন— “লোকের নজর বড় খারাপ হে, সেদিন ক’টা টাকা প্রণামী দিয়ে গেল, তাইতেই অনেকের চোখ করকর করছে। থাক না, লক্ষ্মীর যদি হয় কৃপাদৃষ্টি—মা যদি আসেনই আলো করে তো কারুর জানতে তো বাকি থাকবে না। বাড়িতেও এখন কাজ নেই জানিয়ে- মেয়েদের পেটে থাকেই না কথা, আর ভাইটি তো দেখতেই পাচ্ছ—বোধ হয় পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে বসে এই নিয়ে এক মহাকাব্যই লিখে সাতখানা গ্রামে ঢেঁটরা পিটিয়ে বেড়াবেন!”
ঢেঁটরা পিটাইলেন অন্নদাচরণ নিজে। শ্বশুরবাড়ির নাম করিয়া দিনপাঁচেক পরে হরিপুর হইতে ফিরিয়া মাসাধিক তাঁহার মুখে আর অন্য কথাই রহিল না একরকম।
বাড়ি যখন ফিরিলেন তখন বৈকাল। বসন্তকুমারীর এ সময়টা পাড়ায় টহল দেওয়ার জন্য আলাদা করিয়া রাখা; জানা থাকিলেও একবার খোঁজ করিলেন, না পাইয়া রসিকলালের খোঁজ করিলেন। হারাণ খিড়কির পুকুরের ধারে বেড়াটাতে গোটাকতক নূতন বাঁধন দিতেছিল, আসিয়া গড় করিয়া দাঁড়াইল। অন্নদাচরণ তাহার পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন— “এই যে! তা আজ বেরোসনি যে?”
হারাণ বলিল— “সেই কথাই তো এতক্ষণ ছোট মাকে কইছিলুম—বলি, বেরষোর দাগা ষাঁড়ের মতন কাঁধে বাক্সটা চাপ্যে একা টহল দিয়ে বেড়ালে যদি চলতো না হয় একাই…”
অন্নদাচরণ রাগিয়া উঠিলেন, বলিলেন— “ও! আর তিনি বুঝি কাব্যি করে বেড়াচ্ছেন? সংসারের এই অবস্থা, ঘাড়ে আইবুড়ো মেয়ে! দাদা আছে, কিসের তোয়াক্কা?…তা বলে দিবি, দাদাও তোয়াক্কা রাখে না কারুর,—কারুর তোয়াক্কা রাখে না। ঘুড়ি-টুড়ি বেচে ফেলে ও ওর ছড়া লেখা নিয়েই থাক, ঘুরে দেখবার কিছু দরকার নেই, যাঁর দেখবার তিনিই দেখছেন। বলে দিবি দেখে নিতে—একা, কারুর একটি কানাকড়িও স্পর্শ না করে যদি আমি গিরির বিয়ে না দিতে পারি তো…
এমন সময় সদর দরজা দিয়া মন্থর গতিতে বসন্তকুমারী প্রবেশ করিলেন, বলিলেন— “এসেই আরম্ভ হয়েছে? শ্বশুরবাড়ি হপ্তাকে হপ্তা কাটিয়ে এসেই মুখসাপট, তা না হলে পুরুষমানুষ কিসের!”
অন্নদাচরণের ঠিক রাগের মেজাজ ছিল না, পুরুষকারের জন্য দম্ভটাই ছদ্মরূপে বাহির হইতেছিল; বসন্তকুমারীর উপস্থিতিতেই ঠাণ্ডা হইয়া গেলেন। একটু হাসিয়া ঠাট্টার ভাবে কহিলেন- “এই যে, এসেছ, তাই তো বলি—টহলদার না হলে টহলদারের জন্য ওকালতি করে কে? এদিকে একটা মানুষ যে দশ কোশ পথ বেয়ে…”
অন্নদাচরণের মেজাজ ভালো থাকুক, কিন্তু বসন্তকুমারীর ছিল না, না থাকিবারই কথা। একটু বেশ খোঁচা দিয়াই বলিলেন— “দশ কোশ পথ বেয়ে যে আবার আসবে, শ্বশুরবাড়ির আদর ছেড়ে যে আবার নিজের কুঁড়ের কথা মনে পড়বে, এ ভরসা ছিল না। থামো বাপু, আমায় খেপিয়ে তুলো না, দুই ভায়ের আক্কেল দেখে দেখে…”
অন্নদাচরণ রহস্যচ্ছলেই বলিলেন— “অথচ নিজেই বে-আক্কেলের মতো কথা বলছ, শ্বশুরবাড়িতে শুকনো আদর নিয়ে থাকা চলে কখনও? শ্বশুরবাড়ির যা সারবস্তু তা তো এখানেই…”
রান্নাঘরের দোরের অন্তরালে ভ্রাতৃবধূর কুতূহলী ঘোমটার পাড়টায় নজর পড়ায় থামিয়া গেলেন। হারাণ তামাক সাজিয়া দিয়া গেল, হুঁকাটা হাতে করিয়া একটা টুলে বসিয়া কয়েকটা টান দিলেন। কিভাবে যে আরম্ভ করিবেন যেন বুঝিতে পারিতেছেন না, শেষে কোটের পকেট থেকে মনিব্যাগটা বাহির করিয়া বলিলেন— “নাও, এইটে আগে তুলে রাখ এক্কেবারে আলাদা করে।”
ব্যাগটাকে এত স্ফীতোদর খুব কমই দেখা গিয়াছে। বিশেষ করিয়া পাঁচটা দিনের প্রবাসের পর উদরটা খালি থাকিবারই কথা; বসন্তকুমারী উপরে-উপরেই একবার টিপিয়া একটু বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করিলেন— “অনেকগুলো টাকা যেন মনে হচ্ছে; কার গা?”
“খুব জিজ্ঞেস কর তো!—অন্য কার টাকা তোমার বাক্সয় তুলতে বলব? পাঁচদিন শ্বশুরবাড়ির আদর খেয়ে আমার মাথা এতটা খারাপ হয়নি।”
“রঙ্গ রাখো; কত টাকা আছে?—ধার করলে নাকি?”
প্রথাটা প্রকাশ করিয়া ফেলিবার জন্য অন্নদাচরণের জিব নিস্-পিস্ করিতেছিল, বলিলেন— “নাঃ, তোমাদের কাছ থেকে পার পাবার জো নেই। যদি বলি ধার নয়, তখন,—’কোথা থেকে এল তাহলে?—কি বৃত্তান্ত?’…বলব একদিন, শুনো’খন, তাড়াতাড়ি কিসের?”
স্ত্রী অভিমানভরে মুখ ভার করিয়া বলিলেন— “ঘাট হয়েছে, এত কথা উঠবে যদি জানতাম…”
ঘরের পানে পা বাড়াইতে অন্নদাচরণ বলিল— “এতে আর রাগের কি হয়েছে? শুনবে শোন, নুকোবার কি আছে? চুরি করেও আনা নয়, চামারি করেও আনা নয়।…লক্ষ্মণ দেওরটিকে বললে গায়ে লাগে, কিন্তু সংসার করতে হলে, শুধু পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে কাব্যচর্চা নিয়ে থাকলেই চলে না, পাঁচটা লোকের সঙ্গে মিশতে হয়, দুটো ভালমন্দ কথা বলতে শিখতে হয়, সমাজের মধ্যে যাকে বলে বিশিষ্ট—তাই একজন হতে হয়।”
গিরিবালা জেঠাইমার সঙ্গে বেড়াইতে গিয়া নিকুঞ্জলালের বাড়ি একটু আটকাইয়া পড়িয়াছিল, আসিয়া উপস্থিত হইয়াই বিস্মিতভাবে বলিল— “ওমা, জেঠামশাই কখন এলে?”
আজকাল আর ছুটিয়া চলে না, বিশেষ যদি মা বা জেঠাই কাছে-পিঠে থাকে; তবুও কয়েকদিন পরে জেঠাইমাকে পাইয়া যেন বর্তাইয়া গেছে, ওরই মধ্যে একটু অসংযত গতিতে কাছে আসিয়া বলিল— “কখন এলে জেঠামশাই? ওমা, এখনও জামা জুতো পর্যন্ত খোলোনি।…
জামার বোতাম খুলিতে আরম্ভ করিয়াছিল। অন্নদাচরণ কন্যার পিঠে হাত বুলাইতে বুলাইতে হাসিয়া বলিলেন— “তাই তো বলি, মায়ে আর অন্যজনে তফাৎ আছে বৈকি। একজনের কাছে বাড়িতে ঢোকবামাত্রই তাড়া…নাঃ, চটিয়ে কাজ নেই; মায়ের আদর আর কদ্দিনই বা খাব?”
বিদায় দেওয়ার সুযোগে আনন্দও হয়, এদিকে আবার কথাটা মুখে আনিলেই গলাটা ভারী হইয়া আসে। গাঢ় প্রীতিভরে পিঠে আরও গোটাকতক টান দিয়া একটু চুপ করিয়া তামাক খাইলেন, তাহার পর বলিলেন— “হ্যাঁ, যা বলছিলাম, পাতুলে যাইনি, শ্বশুরবাড়ির যাবার ভারী ফুরসৎ!”
বসন্তকুমারী অতিমাত্র আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিয়া বলিলেন— “তবে?”
অন্নদাচরণ বলিলেন— “সেই সেবারে নিকুঞ্জদার ওখানে হরিপুরের রাজা এসেছিলেন, মনে আছে?”
বসন্তকুমারী বলিলেন— “ওমা, মনে থাকবে না? অতগুলো টাকা পেন্নামি দিয়ে গেল…”
“নিজে হতে দেয় না, আদায় করতে জানতে হয়।…তারপর গিয়ে অবধি চিঠির উপর চিঠি, কি নজরে যে দেখে ফেলেছিল। তা ফুরসৎ হলে তবে তো যাবে মানুষে?—শেষে আর ঠেকানো ভালো দেখায় না দেখে দুর্গা শ্রীহরি বলে…’
রাজা বলিয়া পরিচয় দিয়া কথাগুলো এমন অবহেলার সহিত বলিয়া যাইতেছিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে অনাড়ম্বর ভাবে নিজেকেও এমন একটি মর্যাদা দিয়া যাইতেছিলেন যে বসন্তকুমারী বিস্ময়ের আর কূল পাইতেছিলেন না; খানিকক্ষণ অবাক হইয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন— “হ্যাঁগা, দামুদিদি বলছিল তারা সত্যিই মস্ত বড় মানুষ….পারলে চিনতে? যত্নআত্যি…”
“চিনতে পারার কথা কি? কোথায় রাখবে, কি করবে ভেবে পায় না। বড় মানুষ কি আমিও দেখিনি?—দেখেছি; বাড়িতে একটা মহল বাড়ল, কি একতলার উপর খানকতক ঘর উঠল তো মাটিতে পা পড়ে না।…তিন মহলের দেউড়িবাড়ি, সদর দরজায় ভোজপুরী দারোয়ান মোতায়েন, জুড়ি গাড়ি; লোকজন, আমলাপাইক গিজগিজ করছে; কিন্তু একবার মনে হবে যে এই লোক এইসবের মালিক? —আর ‘ছোট গুরুঠাকুর’ বলতে তো অজ্ঞান। ক’টা দিন রইলাম, একটু চোখের আড়াল করা নয়, সর্বদা কাছে বসিয়ে আলাপ-আলোচনা সলা-পরামর্শ; কেউ এল তো—আর লোকজন আসা তো লেগেই রয়েছে—অমন পরিচয় করিয়ে দেওয়া, – তেজপুরের অমুক বাঁড়ুজ্জে— আমরা বড়ঠাকুরের ভাই, মহা বিচক্ষণ ব্যক্তি। হেন-তেন, অত কি মনেও আছে? ভেবেছিলাম—গিয়ে একটা দিন কোনরকমে কাটিয়ে চলে আসব, রাজবাড়িতে থাকা আমাদের ধাতে পোষায়? তা আসতে দিলে তো! আজকাল, আজকাল করে শেষে আসবার সময় প্রণাম করে দশ টাকার ঐ দশখানি নোট, তাও কত যেন ‘কিন্তু’, –’বুঝছি, আপনার উপযুক্ত হল না… সামনে পুজোর খরচটা রয়েছে, নইলে’ …”
সকলে স্তম্ভিত হইয়া শুনিতেছে—চিত্রার্পিতের মতো, আওয়াজ যাহাতে রান্নাঘরে ভ্রাতৃবধূ পর্যন্ত পৌঁছায় অন্নদাচরণ গলাটা তদুপযোগী বড় করিয়া লইয়াছেন ক্রমে। হারাণকে একবার সতর্ক করিয়া দিলেন— “শুনছিস শোন, বাড়ির চাকর ক্ষতি নেই, তবে খবরদার—বাইরে লোক জড়ো করে ঢাক পিটোবিনি, তোর আবার সে-রোগটি আছে। মানুষের কুনজর পড়তে দেরি হয় না, আর যা সব শুভাকাঙ্ক্ষী চারিদিকে!”
বসন্তকুমারী বলিলেন— “হ্যাঁগা, সত্যি সব তা মিথ্যেই বা কেন বলবে বাপু? আর ঐ তো টাকাও রয়েছে। কিন্তু কেমন-কেমন একটু যেন ঠেকছে বাপু।…তাই বা কেন গো? ভগবান যেন মন্দ গড়েছেন, তেমনি আবার ভালো লোকও কি গড়েননি?”
একটু চিন্তান্বিতই রহিয়াছেন যেন, কোথায় বেশ পরিষ্কার হইতেছে না যেন ব্যাপারটা। অন্নদাচরণ আবার এক চোট আরম্ভ করিবার জন্য হুঁকা টানিয়া দম সংগ্রহ করিতে লাগিলেন; চাপা আবেগে মুখটা রাঙা হইয়া উঠিয়াছে। হারাণ আবার বেড়ায় বাঁধন দিতে আরম্ভ করিয়াছে। গিরিবালা ঔৎসুক্যবশে, কি একটা প্রশ্ন করিয়া যাইতেছিল, এমন সময় বসন্তকুমারী যেন কতকটা নিজের মনেই বলিলেন— “ভালোই,—ভগবান একটু মুখ তুলে যদি চান…”
অন্নদাচরণ বলিলেন— “চাইবেন। তবে দেওরটিকে একটু গা করতে বলো। একটু মানুষ হতে বলো। নিকুঞ্জদাদা অভিভাবকের মতো রয়েছেন, আমিও একবার হয়ে এলাম, এই সময় পশার টশার হচ্ছে,—মাসে একবার করেও যদি হরিপুরে ডাক হয় তো টাকা কামিয়ে এলে যাবে। তুলেও এসেছি কথাটা একটু, তবে দুচারবার হাঁটাহাঁটি করতে হবে,—তা ও যাবে?…আর যায়ই যদি তো কথাবার্তায় দিব্যি একটা বিচক্ষণ মানুষের মতো…”
বসন্তকুমারী বলিলেন— “হাবা নয়, বোকা নয়, পারবে না কেন? আর হবে পারতে, ভগবান যখন দিচ্ছেন একটু সুবিধে করে…”
.
নিকুঞ্জলাল গ্রামে ছিলেন না। সন্ধ্যার সময় অন্নদাচরণ ঘোষালের বাড়ি, মিত্তিরদের বাড়ি, এবং গতায়াত আছে এমন আরও দু-একটা বাড়ি চক্কর দিতে গেলেন। যেখানেই গেলেন হরিপুরের রাজবাড়ির পরিচয়ের টুকরা-টাকরা একটু ছাড়িয়া আসিলেন, অবশ্য, খুব অনাসক্তভাবে। – “হ্যাঁ, নামডাক যা শুনেছিলাম, তা মিছে নয়। অবিশ্যি, তাই বলে যে বলতে হবে জনাইয়ের মুকুজ্জে কি মনসাতলার রায়েদের মতন কিছু-একটা তা নয়, তবে আমাদের বেলেদক্ষিণপাড়ার চৌধুরীরা…নাঃ, কিসে আর কিসে!…তা হোক গে, টাকা কিছু সবার সমান হয় না, তবে মেজাজ! —হ্যাঁ, সে একটা দেখবার জিনিস বটে—কি দরাজ হাত! দান ধ্যান সদাব্রত—সে এক এলাহি কাণ্ড, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।”
বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া যেটুকু সময় রহিল, ফিরিবার পথে ধর্মতলার চাতালে কাটিল, জায়গাটা পাড়ার আড্ডা, অনেকেই সন্ধ্যার পর সমবেত হয়। জমিদারবাড়ি লইয়াই আলোচনা চলিতেছিল- চৌধুরীদের ভাগাভাগি হইয়াছে, এইবার পূজা হইবে দুইটা, রেষারেষির মধ্যে ঘটাটাও এবার অন্যবারের চেয়ে হইবে বেশি করিয়াই…
অন্নদাচরণ উপস্থিত হইলেন। তর্কালঙ্কার বলিলেন— “এই যে অন্নদা, ক’টা দিন ছিলে কোথায় হে? রসিক বললে— শ্বশুরবাড়ি’। জিজ্ঞাসা করলাম—এতদিন শ্বশুরালয়! নূতন বিবাহ করলে নাকি দাদা তোমার?…হাঃ হাঃ হাঃ…তারপর?…”
অন্নদাচরণ হাত বাড়াইয়া বলিলেন— “শ্বশুরবাড়ি। ভায়া খুবই ফুরসৎ দেখছেন দাদার! দাও।”
তর্কালঙ্কারের হাত হইতে নস্যের ডিবাটা লইয়া বলিলেন— “একটু বাইরে বরাত ছিল।… রেষারেষির কথা কি হচ্ছে?”
“এবারে চৌধুরীরা পৃথক হল কিনা, প্রতিমাও দুটো হবে। অনাথ বলছে—পুজো কাকে বলে এবার দেখিয়ে দোব। অনন্ত আবার একটু কৃপণ কিনা…”
অন্নদাচরণ নস্য লইয়া ডিবাটা ফেরত দিলেন; হাতটা ঝাড়িতে ঝাড়িতে বলিলেন— “খুড়োর ওপর যদি এতই টেক্কা দেবার ইচ্ছে অনাথের তো এইবেলা লোক পাঠিয়ে নিক না, হরিপুরে কেষ্টনগরের কুমোরেরা এসেছে, কজনকে নিয়ে আসুক…’
ওদিক থেকে একজন প্রশ্ন করিল— “হরিপুরের রাজাদের বাড়ি?”
অন্নদাচরণ বলিলেন— “রাজা না হাতি; জমিদারই, তবে হ্যাঁ, জমিদারেরই যা বোলবোলাও দেখে এলাম, তাতে অনেক রাজরাজড়াকেও মাথা হেঁট করতে হয়…”
পরদিন সন্ধ্যার পর নিকুঞ্জলাল ফিরিলেন; উচ্ছ্বসিত বিবরণ, মায় প্রণামীর কথাটা পর্যন্ত তামাক টানার মধ্যে অল্প অল্প মাথা দুলাইয়া শুনিয়া বলিলেন— “হল তো? অথচ তুমি ভয় পাচ্ছিলে যেন তোমায় বাঘের মুখেই পাঠাচ্ছে, কি সিংগীর মুখেই পাঠাচ্ছে নিকুঞ্জদাদা!…তবে নিকুঞ্জদাদার ঐ এক কথা সর্বদাই মনে রাখবে রে ভাই;—ওরা রাজা, আমরা গেরস্ত; টাটকা-টাটকি নিজের কাজটুকু গুছিয়ে নেওয়া…”
পরের দিনটা আর পারিলেন না, তাহার পরের দিন নিজেই হরিপুর যাত্রা করিলেন।
৬
রসিকলালের শরীরটা একটু অসুস্থ ছিল, পরদিন সকালে আর বাহির হইলেন না। কয়েক জায়গায় প্রয়োজনীয় ঔষধ বিলি করিয়া প্রায় দুপুরের কাছাকাছি হারাণ গরগর করিতে করিতে বাটীতে প্রবেশ করিল— “হারাণে বলে বেড়াবে!—বলে বেড়াবে কি, সওয়ালের জবাব দিতে দিতে হারাণের পথচলা দায় হয়ে উঠেছে; বেলে-তেজপুরে বোধ হয় হেন একটি লোক নেই, যে হরিপুরের বাবুদের কথা না জানে। প্রাণের দায়ে রাস্তা ছেড়ে বনবাদাড় ধরে এসব—সেখানেও—কিরে হারাণ, তোর বড়কর্তা নাকি হরিপুরে গিয়ে…”
“দাদা তো?”—বলিয়া রসিকলাল বাহিরে আসিয়া এই সুযোগে অগ্রজের চরিত্রের এই হালকা দিকটা লইয়া একটা সুমিষ্ট মন্তব্য করিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়— “কৈ গো দিদি!” বলিয়া কাত্যায়নী সদরের দুয়ার ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন, সঙ্গে একটি পোঁটলা হাতে করিয়া বিকাশ।
“কাতু দিদি যে!”—বলিয়া রসিকলাল দাওয়া হইতে নামিতে নামিতে কহিলেন— “কি সৌভাগ্য! পথ ভুলে নাকি?…অ বৌদি, কে এসেছে বেরিয়ে দেখলে। বিকাশও এসেছে? বাঃ, বেশ!” বসন্তকুমারী ওদিককার ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন।— “কে, আমাদের কাতু? ওমা, তাই বলি সকাল থেকে বাঁ চোখ নাচে কেন! বিকাশও এসেছিস যে! অনেকদিন পরে; আমি এই সেদিন ছোট বউকে বলছিলাম—বলি—’হ্যাঁরে, বিকাশ এদিকে প্রায় বছরখানেক হল আসেনি, তেজপুরের বড়পিসিকে ভুলে গেল নাকি?…’ থাক্, থাক্ হয়েছে বাবা, দীর্ঘজীবী হও, বংশের মুখ উজ্জ্বল করো…”
কাত্যায়নী বলিলেন— “তোমাদের আশীর্বাদে তারই যেন একটু রাস্তা হয়েছে দিদি। আর বছর তো অসুখে অসুখেই গেল। এ বছর সুভালাভালি পাসটা দিলে; কবে সিংহবাহিনীর তলায় নাকি মানত করে গেছল তাই দিতে…’
বসন্তকুমারী দেবরের পানে চাহিয়া বলিলেন— “পাসের খবর তো ঠাকুরপো অনেকদিন হল দিয়েছিলে…”
কাত্যায়নী খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন— “ওমা, তা জান না বুঝি? ভাইপো তোমাদের সেয়ানা কত!…”
বিকাশ লজ্জিতভাবে মুখটা ঘুরাইয়া লইয়া তাড়াতাড়ি ছোটপিসির ঘরের দিকে চলিয়া গেল।
কাত্যায়নী এবার তাহার পানে চাহিয়া লইয়া বলিতে লাগিলেন— “পাস করার খবর পাওয়া অবধি ক্রমাগত খ্যাচকাচ্ছি—’ওরে বিকাশ চ’, ঠাকুর-দেবতার নামে মানত, পুজোটা চুকিয়ে আসি।’…কোনমতে গা করে না, কোনমতে গা করে না; শেষে একদিন খিঁচিয়ে-মিচিয়ে বললে, হ্যাঁ, আমায় তেমনি বোকা পেয়েছেন কিনা,—ঘরের পয়সা বের করে পুজো দোব! পাস করার খবর পাওয়ার দিনই মনে মনে বলে দিয়েছি—জলপানি না পেলে…,”
তিনজনেই উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিলেন। বসন্তকুমারী হাস্যজনিত অশ্রু মুছিতে মুছিতে বলিলেন…”কি জ্বালা, ঠাকুর-দেবতার সঙ্গে এ কি তঞ্চকতা বল্ দিকিন!—চল্, আয়; উঠোনেই দাঁড়িয়ে আছি।”
ঘরের দিকে যাইতে যাইতে কাত্যায়নী কাহিনীর জেরটা ধরিয়া— “তা অমন না হলে জব্দও হন না ঠাকুর, দিদি। …জলপানির খবরটিও পাওয়া গেল, প্রথম টাকা হাতে আসতে এই ধরে নিয়ে এসেছি।…বরু কোথায়? গিরি, ছেলেরা? …পুতী মামার বাড়িতেই আছে তো?…কতদিন যে দেখিনি!”
রসিকলাল বলিলেন— “এ পুজোও ঠিক যে সিংহবাহিনীর পাওনা বলব, তা বলব না,— বিকাশ যে জলপানি পাবেই এ তো ধরা কথা। আজকের পুজোর জোরে ওকে যদি বড় একজন নেতা, কি বড় একজন কবি…”
ভাজ বক্র দৃষ্টিতে দেবরের পানে চাহিয়া শুনিয়া যাইতেছিলেন, বাধা দিয়া বলিলেন- “ক্ষ্যামা দাও বাবু, সিংহবাহিনীর মানত করেই বুঝি নিজে কবি হয়েছ?—উঠতে বসতে দাদার মুখনাড়া, উঠতে বসতে…”
আবার খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। হাসি থামিলে বলিলেন— “গুণধর পিসে- শালাপোর কথায় হাসব কি তোর কথার জবাব দোব?…ছেলেরা ইস্কুলে, ছোটবৌ গিরিকে নিয়ে ঘোষালদের বাড়ি সাধের নেমন্তন্ন খেতে গেছে। নে, হাত-মুখ ধো কাতু।”
বিকাশ একটু একলা পড়িয়া গিয়া ঘরের মধ্যে চুপ করিয়া বসিয়াছিল, বসন্তকুমারী প্রবেশ করিয়া দেখিয়াই বলিলেন— “ওমা, চুপ করে বসে রইলি যে বিকাশ!নে, হাত-পা ধুয়ে নিয়ে একটু ঠাণ্ডা হ’…এ যেন মনে হচ্ছে আবার সিংহবাহিনীকে কি করে ফাঁকি দিবি মনে মনে তার মতলব আঁটছিস?”
আবার হাসি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। ঐ রকম হাস্যোচ্ছল প্রসন্ন আলাপের মধ্যে দিয়া অভ্যাগতদের তত্ত্বাবধান চলিল।
.
হারাণকে এসব বলিয়া দিতে হয় না, নিজেই গিয়া ঘোষালবাড়িতে বরদাসুন্দরীকে সে খবরটা দিয়া আসিল। তাড়াতাড়ি আহার সারিয়া দুপুরের একটু পরেই গিরিবালাকে লইয়া তিনি চলিয়া আসিলেন। বেটাছেলেদের আহার হইয়া গিয়াছিল। বসন্তকুমারী আর কাত্যায়নী রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া নিশ্চিন্তভাবে গল্প করিতে করিতে আহার করিতেছিলেন, এমন সময় কন্যাকে লইয়া ত্বরিতপদেই বরদাসুন্দরী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শয়নকক্ষের দিকে নজর ছিল, কাত্যায়নী বলিলেন— “এদিকে।….দিব্যি মা যাহোক, মেয়ে সাতকোশ থেকে এসে হা-পিত্তেস করে বসে, আর মা ওদিকে নেমন্তন্ন খাওয়ায়…”
গিরিবালা পরিবর্ধমান বয়সের গাম্ভীর্য এক নিমেষে ভুলিয়া গেল, একরকম ছুটিয়াই গিয়া মাসিকে জড়াইয়া তাঁহার কোলে মাথাটা গুঁজিয়া দিয়া প্রশ্নে প্রশ্নে তাঁহাকে অস্থির করিয়া তুলিল।
বরদাসুন্দরী বলিলেন— “সে কথা বলতে পারবে না দিদি। হারাণের মুখে শুনে ওবধি কি আর ওর তর সইছিল একটু? কেবলই ‘মা চলো’, কেবলই ‘মা চলো’।…যত গা টিপে বলি—রোস, এসেছিস একটা বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে….”
কাত্যায়নী হাসিয়া উঠিলেন, বসন্তকুমারীকে সাক্ষী মানিয়া বলিলেন— “শুনে যেও দিদি, বলে ধর্ম্মের কল বাতাসে নড়ে,—মা আর বোনে তফাত নেই? অ্যাদ্দিন পরে দিদি এত দূর থেকে এল, নেমন্তন্নের লোভে বোন…”
ভগ্নী রাগের অভিনয় করিয়া বলিলেন— “দেখো তো কথার ঢং! আমি তাই বললাম নাকি? তুমিই বল দিদি—পাঁচটা মানুষ একত্তর হয়েছে—পারা যায় সেখানে তাড়াহুড়ো লাগিয়ে গেরস্তকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে?…তবুও দিদির আসার কথা শুনে আমার মনটা আনচান করছিল, ওদের সেজবউকে বলে-কয়ে ওপরঘরে আলাদা জায়গা করিয়ে খেয়েদেয়ে আসছি। তাতেও কি তাড়া মেয়ের!—আদ্দেকটা নাকে-মুখে গুঁজে…”
কাত্যায়নী বোনঝিকে বাঁ হাতে জড়াইয়া বুকের কাছে চাপিয়া ধরিলেন, বলিলেন— “বেশ করেছে আদ্দেক খেয়ে উঠে এসেছে, বাকি ক্ষিদেটুকু আমার পাতে মেটারে, না হলে আমারও মনে একটা খুঁতখুঁতুনি থেকে যেতো। সিমুরে আমার পাতে খাওয়া গিরির একটা নিত্যকর্ম ছিল কিনা।”
বসন্তকুমারী একটু বেদনা-স্তিমিত কণ্ঠে বলিলেন— “নে খাইয়ে সাধ করে যটা দিন পারিস, আর তো হয়ে এল।”
“ইস্, তাই নাকি?…” কি একটা বলিতে গিয়াই কাত্যায়নী সঙ্গে সঙ্গে থামিয়া গেলেন। হঠাৎ যে একটু অন্যমনস্ক হইয়া গেছেন সেটা কেহ বুঝিবার আগেই গিরিবালাকে বুকের আর একটা চাপ দিয়া হাতটা গুটাইয়া লইলেন, থালাটা তাহার সামনে ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন— “নে, খেয়ে নে।”
বসন্তকুমারী আর বরদাসুন্দরী দুজনেই বলিয়া উঠিলেন— “দেখো কাণ্ড! ওকি খাওয়া হল?”
কাত্যায়নী বলিলেন— “পথ চলে নাকি ক্ষিদে থাকে? আমার তো কমে যায় বাপু, কেমন উল্টোধাত। তোর আবার বিকাশদাদা এসেছে, ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়, নইলে এতক্ষণ তো কবার খোঁজ করলে।”
হারাণ ঝি’র মারফৎ সংবাদ পৌঁছাইয়া দিয়াছিল; সে বিকাশের কথাটা—ভুলিয়াই হোক অথবা অপ্রয়োজন মনে করিয়াই হোক—আর বলে নাই। গিরিবালা পুলকিত হইয়া বলিল—
“বিকাশদাদা?—কৈ, সেকথা তো বলেনি! বলেছিল মা?”
বরদাসুন্দরী বিস্মিত এবং পুলকিত হইয়া বলিলেন— “কৈ না, সেও এসেছে নাকি?”
বসন্তকুমারী বলিলেন— “ঘুমুচ্ছে নিশ্চয়; থাক একটু, হাক্লান্ত হয়ে এসেছে।” গিরিবালা নিমন্ত্রণ খাওয়ার মতই তাড়াহুড়া করিয়া আরম্ভ করিয়া দিল, বলিল— “হ্যাঁ, ঘুমোতে দিলে তো? এবার এতদিন গিয়ে রইলাম, একদিনের তরেও এলেন না কলেজ ছেড়ে…”
কাত্যায়নী বলিলেন— “তা যাক্, তুলুকগে; আর সত্যিই তো,—দুটো দিনের জন্যে এসে যদি ঘুমিয়েই কাটাবে তো ভাই-বোনদের সঙ্গে একটু মিশবে কখন? ওদের জন্যে কলকাতা থেকে কি সব বই কিনে নিয়ে এসেছে, দেবে। কি ভালোটাই যে বাসে ওদের। বিশেষ করে গিরিকে,—গিরির কথা যদি উঠল তো কি বলে যে প্রশংসা করবে ভাই, যেন ভেবে পায় না।”
বসন্তকুমারী একটু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলিলেন— “নিজের তো আর বোন দিলেন না ভগবান এ পর্যন্ত একটি, সাধ হয় তো?”
কাত্যায়নী বলিলেন— “ওমা, তা বুঝি শোননি ছেলের কথা?”
দুই জায়ে জিজ্ঞাসুনেত্রে চাহিলেন, কাত্যায়নী বলিলেন— “একদিন হুট করে বলে বসল ‘আমার কি মনে হয় জানো মেজপিসিমা?—মনে হয় আমার যেন মা’র পেটের বোন আর না হয়… ‘সে কিরে? বিয়ের ভাবনা নাকি?’… ‘না, বিয়ের ভাবনা কেন?—তার দিকেই তা হলে বেশি টান হবে; অন্তত গিরি ভাববে নিজের বোনকেই বুঝি বেশি ভালোবাসি’।”
কথাটার মধ্যে হাসির যে কিছু ছিল না এমন নয়, তবে সেই সঙ্গে একটি স্নিগ্ধ মাধুর্য ছিল, দুই জায়ে স্মিত বদনে একটু চুপ করিয়া রহিলেন। কাত্যায়নী বলিতে লাগিলেন— “বলে, ওকে বই থেকে যখন বড় বড় মেয়ে-ছেলেদের কথা বড়ে শোনাই মাসিমা—সীতা হলেন, সাবিত্রী হলেন, দময়ন্তী হলেন, অন্য অন্য দেশেরও মেয়েরা হলেন—এত মন দিয়ে শোনে গিরি!—দেখে নিও, ও-ও একসময় ওঁদের মতন হবে।”
কাত্যায়নী একটু হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন— “সে দৈবজ্ঞির মতন মুখ গম্ভীর করে বলবার যদি ধরন দেখ! একলা মনে মনে আর কত হাসবো!”
তাহার পর গিরিবালার পিঠে আদরভরে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন— “বলি, তা হবে বৈকি, হবে না?—অমন চমৎকার স্বভাব, যেখানেই যাক্, যার কাছেই যাক, শুধু আশীর্ব্বাদ কুড়িয়েই বেড়াচ্ছে, ও হবে না তো হবে কে?”
গিরিবালা এদিকে মুস্কিলে পড়িয়া গিয়াছে। প্রশংসার চোটে সে ক্রমেই সঙ্কুচিত হইয়া পড়িতেছিল। পলাইতে পারিলে বাঁচে, বিকাশদাদার ওখানে মনটাও পড়িয়া আছে, কিন্তু এই সব প্রশংসার মূল উৎস বলিয়াই আপাতত তাহার কাছে যাওয়া অসম্ভব হইয়াছে। তাড়াতাড়ি আহার আরম্ভ করিয়াছিল, হাতটা ক্রমে মন্থর হইয়া আসিল, পলাইতে পারিলেই বাঁচে, কিন্তু প্রশংসাটা না থামিলে যেন ওঠাই অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে, সময় পাইবার জন্যই পাতের সব কটি খুঁটিয়া খুঁটিয়া আহার করিতে লাগিল। চাঁচিয়া পুঁছিয়া যখন প্রায় শেষ গ্রাসটি তুলিয়াছে, গল্পের মধ্যেই কাত্যায়নীর নজর পড়িল,—বলিলেন— “দেখলে?—খিদে রেখে এইরকম করে উঠে আসে মানুষে?”
.
বিকাশ উঠিল বিকাল করিয়া—সাতু এবং হরু স্কুল থেকে আসিয়া যখন হুডুদ্দুম করিয়া তাহাকে ঠেলিয়া তুলিল। এদিক ওদিক করিয়া গিরিবালারও ততক্ষণে প্রশংসাজনিত লজ্জার ভাবটা কাটিয়া গেছে, বিকাশ উঠিতে সেও আসিয়া উপস্থিত হইল। বরদাসুন্দরী কি একটা কাজে ঘরেই ছিলেন, বিকাশ অতিমাত্র বিস্মিত তাঁহার পানে চাহিয়া বলিল— “একি! দেখেছ ছোটপিসিমা? গিরিটা কত বড় হয়ে গেছে!”
বিকাশের রকমই ঐ; হাসিবার খোরাক রাখিয়া হঠাৎ এমন অসমঞ্জস ভাবের কথা বলিয়া বসে এক-একবার! তাহার কারণ বিস্ময়ই হইয়া পড়ে ওর প্রধান, যুক্তি একেবারে আড়ালে পড়িয়া যায়।
বরদাসুন্দরী হাসিয়া বলিলেন— “না, ছোটপিসিমা কি আর দেখেছে?—বলে, দেখে দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। তুই আজ প্রায় দেড় বছর পরে দেখছিস, বড় মনে হবে না তোর? তুই নিজেই কতটা বড় হয়েছিস ভেবে দেখ না।”
বিস্ময়ের ঘোরটা কাটে নাই বিকাশের, বলিল— “আমি বড় হয়েছি…মানে…’
রহস্যটা যেন ঠিক ধরিয়া উঠিতে পারিতেছে না, বলিল— “মানে…আমার তো বয়েসও হয়েছে, পিসিমা…ইস্কুল ছেড়ে কলেজেও গেছি…”
সদ্যোখিতের জড়তাটা তখনও লাগিয়া আছে মুখে-চোখে, তাহার উপর এই বোকার মত কথা; বরদাসুন্দরী হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন— “অ দিদি, শোনসে বিকাশের কথা!…হ্যাঁরে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঠাঁইনাড়া করে বেড়ালেই বয়স হয়, নইলে হয় না?—কি জ্বালা বাপু! তুই না জলপানি নিয়ে পাস করেছিস বিকাশ!—হ্যাঁরে?”
আসলে বিকাশ যে বিস্মিতই হইয়াছে তাহা নয়, সঙ্গে সঙ্গে একটা আঘাতও পাইয়াছে। বিকাশ নিরাশ হইয়াছে। ক্লাসে ওঠা, পাস দেওয়া, কলেজে প্রবেশ করিয়া একটা নূতন জগতে পদার্পণ—এই সবের ভিতর দিয়া নিজের বয়োবৃদ্ধি বরাবরই উপলব্ধি করিয়া গিয়াছে, কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে, কাছে থাকিলেই যে সর্বক্ষণ তাহার শরীরটিকে বেষ্টন করিয়া থাকিত, এবং দূরে থাকিলে ঠিক তেমনি ভাবেই যে মনটিকে জড়াইয়া থাকিত, সেই গিরিও যে লুপ্ত হইয়া এই অপেক্ষাকৃত গাম্ভীর্যময়ী কিশোরীতে পরিণত হইয়াছে, তাহা ভাবিবার অবসর পায় নাই। এ বিস্ময়টা হইত না যদি এর মাঝে আরও দু-একবার সে দেখিত গিরিবালাকে; কিন্তু প্রায় দেড় বৎসরেরও অধিক ধরিয়া এমনি হইয়াছে, পাসের পড়া, পাস করা, কলেজ ইত্যাদির হিড়িকে সেও তেজপুরে আসিতে পারে নাই; ওদিকে গিরিবালাও যখন সিমুরে গিয়াছে, সে থাকিয়াছে অনুপস্থিত।…
বিকাশ বেশ একটু নিরাশ হইল। আধার যত নিচু, স্নেহের তত বেগ, সেই আকুল বেগে হঠাৎ যেন একটা সম্ভ্রমের ভাব মিশিয়া বেগটাকে মন্থর করিয়া দিল। ব্যাপারটা সব সংসারেরই ভাই-বোনের মধ্যে নিত্যই হইতেছে, এমন কি পিতা-পুত্রীর মধ্যেও।—কিশোরীর কন্যার মধ্যে বাপ কোলের শিশুটিকে হারাইতেছে, যুবতী কন্যার মধ্যে হারাইতেছে বক্ষলগ্ন কিশোরীটিকে—কিন্তু এটা হইতেছে ধীর-নিঃসাড়ে প্রতিদিনের অলক্ষ্য তিল তিল পরিবর্তনের মধ্যেও। বহুদিন অদর্শনের পর হঠাৎ এটার উপর দৃষ্টি পড়িলেই বুকে ধক করিয়া একটা ধাক্কা লাগে।
বিকাশের মনে হইল— “যাঃ, সে গিরি কোথায়?’ কতকগুলা অসংলগ্ন যুক্তির মধ্যে আঘাতের হেতুটাকে হাতড়াইয়া ফিরিতে লাগিল।
ঠিক এই আকারেই যে জিনিসটা কায়েমী হইয়া রহিল এমন নয়। মেলামেশার মধ্যে আবার এ-গিরিবালাও অনেকটা অভ্যাস হইয়া আসিল। গল্প, ফরমাইশ, উপদেশ; সকালে এবং বিকালে একটু ঠাণ্ডা পড়িয়া গেলে চার-ভাইবোনে কাছাকাছি একটু ঘুরিয়া-ফিরিয়া বেড়ানো,—মধ্যে মধ্যে তাহার কলিকাতার নূতন জীবনেরও গল্প চলে। গিরিবালা যেমন একটু দূরে চলিয়া গেছে, তেমনি শ্রোতা হিসাবে সাতকড়ি এবং হরু আবার বেশী উপযোগী হইয়া উঠিয়াছে। গিরিবালাকে মূল ইস্কুল জিনিসটাই কি তাহা বুঝাইতে বেগ পাইতে হইত, সাতু এবং হরুকে, বিশেষ করিয়া সাতুকে কলেজ জিনিসটা যে কি ব্যাপার তাহার একটা আন্দাজ দিতে অপেক্ষাকৃত কম বেগ পাইতে হয়। সাতু ফোর্থক্লাসে পড়িতেছে, যদিও এখনও প্রায় সব বিষয়ে চরম মতামতের জন্য দিদির প্রতিধ্বনি করার অভ্যাসটি অনেকাংশেই আছে, তবু বড় হইয়াছে, ইস্কুলের বড় সংস্করণ কলেজ যে কি হওয়া সম্ভব— বুঝিতে বিশেষ কষ্ট হয় না।
বিকাশের গল্প বলার মধ্যে অপেক্ষাকৃত গাম্ভীর্য আসিয়াছে নিশ্চয়, কিন্তু তবু পুরনো মন্দির বা পরিত্যক্ত বাড়ির চারিদিকে একটা কল্পনার কুহেলী বিস্তার করার ঝোঁকটা যায় নাই। একবার বেড়াইতে বেড়াইতে ধর্মতলার বটবিদীর্ণ ধর্মঠাকুরের মন্দিরে একটা ছাপমারা ইষ্টকখণ্ড তুলিয়া খুব গভীরভাবে অনেকক্ষণ পরীক্ষা করিয়া বলিল— “নাঃ ভাবিয়ে তুললে!”
গিরিবালা আর সাতু নিরতিশয় কুতূহলী হইয়া প্রশ্ন করিল— “কেন বিকাশদা?”
বিকাশ গম্ভীরভাবে উত্তর করিল— “এর এক-একটা ভাঙা অক্ষরের পেছনে যে কত বড় এক- একটা ইতিহাস আছে, কত বড় কীর্তি সব!…যদি কখনও মিউজিয়ামে যাস তো বুঝবি।”… টুকরাটা পকেটস্থ করিল।
গিরিবালা কিছু বুঝিল না, শুধু একবার বটগাছটা আপাদশীর্ষ দেখিয়া বলিল— “ওরে বাব্বা!”
সাতকড়ি ইতিহাস কথাটা বুঝিল। যথানিয়ম দিদির মতো একবার— “ওরে বাব্বা!” বলিয়া স্বীয় পাণ্ডিত্যের প্রমাণ হিসাবে ইতিহাসের খুব একটা জবরদস্ত নাম আনিয়া হাজির করিল— “তৈমুরলঙ্গের কীর্তি বিকাশদাদা?”
বিকাশ তাহার পানে চাহিয়া বলিল— “কোথায় বেলে-তেজপুর আর কোথায় তৈমুরলঙ্গ! তুই একটু মন দিয়ে পড়াশুনা করবি সাতু।”
৭
সিংহবাহিনীর মন্দিরে বিকাশের মানসিক পূরণ করাই কাত্যায়নীর বেলে-তেজপুরে আসিবার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না; আরও একটা ছিল, যেদিন আসিলেন সেইদিনই সন্ধ্যার পর কাত্যায়নী সেই কথাটা পাড়িলেন।
আকাশ পরিষ্কার, বেশ ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠিয়াছে, গাছের খণ্ডিত ছায়া দোল খাইয়া খাইয়া সেটাকে করিয়া তুলিয়াছে সচল, কে যেন আঙুল লতাইয়া উঠানটায় লক্ষ্মীপূজার আলপনা দিয়া চলিয়াছে। বরদাসুন্দরী রান্নাঘরে; খুন্তিনাড়ার শব্দের সঙ্গে মসলার গন্ধ ভাসিয়া আসিতেছে, তাহারই সঙ্গে বিকাশের গলার আওয়াজ। মাঝে মাঝে গড়গড়ার সমস্ত জিনিসটা উপযুক্ত পুত্রের সঙ্গে পিতার পরামর্শের মতো শান্ত গম্ভীর। রসিকলালের ঘরের দাওয়ায় সাতকড়ি আর হরু খোকাকে লইয়া কি একটা হুড়াহুড়ি খেলা করিতেছে, মাঝে মাঝে হঠাৎ তাহাদের কণ্ঠস্বর হাস্যে কলরবে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে। গিরিবালা আছে ঘরের মধ্যে, বোধ হয় শয্যারচনা করিতেছে, থাকিয়া থাকিয়া ভাইদের বারণ করিতেছে— “ওরে থাম, দেখছিস বাবার শরীরটা খারাপ!”
রসিকলাল বলিলেন— “আমায় একছিলিম তামাক আগে সেজে দে মা গিরি।”
—একখানি আদর্শ সংসারের চিত্র,—শান্ত, তৃপ্ত, আপনাতেই আপনি পরিপূর্ণ। উঠানের মাঝখানে একটি শানের চাতালে কাত্যায়নী একলা বসিয়া বসন্তকুমারীর প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। ক্রমে ধীরে ধীরে চক্ষু দুইটি জলে ভরিয়া উঠিল। খানিকক্ষণ যেন একটা স্রোতের মধ্যে শরীরটাকে আলগা করিয়া দিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন, ক্রমেই কোথায় যেন তলাইয়া যাইতেছেন, তৃপ্তিতে অতৃপ্তিতে মেশানো কোন্ এক অতলে।
একসময় চোখ দুইটা মুছিয়া উঠিয়া পড়িলেন, একলাই একটু এদিক-ওদিক করিয়া মনটাকে প্রকৃতিস্থ করিয়া লইলেন। নিকুঞ্জলালের স্ত্রী অসুস্থা, বসন্তকুমারী একবার দেখিয়া আসিতে গেছেন, এখনই আসিয়া পড়িবেন।
তিনি আসিলে দুজনে আবার চাতালটায় আসিয়া বসিলেন। খানিকটা একথা-সেকথার পর কাত্যায়নী বলিলেন— “গিরির সম্বন্ধর কিছু হল দিদি?”
বসন্তকুমারী উত্তর করিলেন— “কৈ, এখনও কিছু তো হল না ভাই। মুখে তো ভাত ওঠে না আমার। কত্তারা যে বসে আছে নিশ্চিন্দি হয়ে এমন বলতে পারি না, তবে খুব যে গা আছে, তাই বা কৈ? বাপের অবস্থা তো দেখছই—আপনভোলা মানুষ, কোন্ কথাটাতেই বা আছে সংসারের? জেঠাকে যদি বললে…”
বসন্তকুমারী গরগর করিয়া যাইতেছেন, কাত্যায়নী মাথা নীচু করিয়া নীরবে শুনিয়া যাইতেছেন, একসময় মুখটা তুলিয়া প্রশ্ন করিলেন— “আমি একটা কথা বলব দিদি?”
বসন্তকুমারী জিজ্ঞাসুনেত্রে চাহিয়া বলিলেন— “কি কথা বল না।”
“গিরিকে আমায় দাও।”
বসন্তকুমারী মুখের পানে চাহিয়া বিস্মিতভাবে বলিলেন— “বুঝলাম না!”
একবার কথাটা পাড়িয়া ফেলিয়া কাত্যায়নী আর কোনখানে আটকাইলেন না, বাকি কথাগুলা এক নিঃশ্বাসে বলিয়া গেলেন— “আমার একটি বৈমাত্র দেওর আছে জানো বোধহয় দিদি, তার একটি ছেলে আছে।…ঐ একটি মাত্র ছেলে, বাপের সমস্ত সম্পত্তি যা কিছু সব ওতেই বর্তাবে, নেহাত কিছু মন্দও নয়;—পঁচিশ-ত্রিশ ঘর যজমান আছে… তা ভিন্ন জোৎজমি, বাগান-পুকুর; একটা গেরস্তর খুব ভালোভাবে চলে যাবে। তারপর আমার ভাগের যা আছে সব গিরিরই হবে; একটা কানাকড়িও রাখব না দিদি। দিদিকে আর আমায় বাবা গয়নাপত্তর কম দেননি, বরুর বেলায়ই না হয় অবস্থাটা একটু পড়ে এসেছিল,—আমি একটি একটি করে গিরির গায়ে সাজিয়ে দোব। —বলবে, জায়গাটা একটু একটেরেয়। কিন্তু সমাজ জায়গা, গিরি বনবাদাড়ে পড়বে না। তোমার কাছে মনের কথা নুকোব না দিদি, আমার বরাবরই সাধ ছিল। এবার গিরি যেতে আমি দেওরকে ডাকিয়ে আনিয়ে দেখিয়ে দিয়ে পাড়লাম কথাটা। সে তো খুব রাজী, একটি পয়সা কামড় হবে না। এদিকে সম্বন্ধও মোটেই আটকায় না, সে সব আমি, একজন না, কয়েকজন ঘটক-পুরুতকে দিয়ে বিচার করিয়ে দেখেছি, কিছু আপত্তির নেই…”
কাত্যায়নী সামান্য একটু থামিলেন, তাহার পর দুই হাতে বসন্তকুমারীর ডান হাতটা চাপিয়া ধরিয়া কণ্ঠে অশেষ আকুতি ঢালিয়া বলিলেন,–”তুমি দাও আমায় গিরিকে দিদি, আবার আমি একটু সংসার পাতি, মুখ তুলে চাও ছোট বোনের ওপর।”
তাঁহার চোখ দুইটি ছলছল করিয়া উঠিয়াছে।
প্রস্তাবটা অত্যন্ত আকস্মিক, আর কাত্যায়নীর বাক্যস্রোতে অভিভূত হইয়া বসন্তকুমারী ভাবিবার অবসর পাইতেছেন, না, কতকটা বিমূঢ় ভাবে মুখের পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন–“ছোট বউকে বলেছিস?”
এতক্ষণ প্রার্থনা ছিল, কাত্যায়নী এবার তাহার সঙ্গে খোসামোদ জুড়িয়া দিলেন, বলিলেন “হ্যাঁ, বরুকে আমি বলতে গেলাম! তুমি থাকতে বরু কে তা তো বুঝি না।”
বসন্তকুমারী চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিলেন; বিলম্বে সুর কাটিয়া যাইতেছে দেখিয়া ক্যাত্যায়নী বলিলেন— “দিদি, দাও কথা, পায়ে ধরি তোমার।”
বসন্তকুমারী বলিলেন— “এতে আর পায়ে ধরার কি আছে কাতু?—তুই তো মন্দ কিছু বলছিস না যে, ছেলেটি কেমন?”
কাত্যায়নী ক্ষণমাত্র নিরুত্তর রহিলেন, কথাটা যেন গলায় কোথায় আটকাইয়া গেল, একটু ঢোক গিলিয়া বলিলেন— “ছেলে—যেমন গেরস্তর ছেলে হয়—জমিটমি আছে, বাপ এখনও সবল, সে-ই দেখাশুনা করে—তা বলে ছেলে যে ঘুরেও দেখে না এমন নয়…”
একটু যে ছন্দপতন হইলই বসন্তকুমারীর সেটুকু কান এড়াইল না। তবে তিনি সেদিকে খুব খেয়াল করিলেন না। পাড়াগাঁয়ের ছেলে, বোধ হয় একটু বেশী সঙ্গীপ্রিয়,—ও ধর্তব্যের মধ্যেই নয় এক ছেলে, একটু আদুরে হইবেই।
বসন্তকুমারীর দৃষ্টিটা সুবিধাগুলির দিকেই আবদ্ধ হইয়া রহিল; জোৎ-জমি, যজমান, গয়না- সব দিক দিয়া যে একটি প্রাচুর্যের ছবি তাহারই উপর। এর অতিরিক্ত কাত্যায়নী যদি নিজে গিয়া সংসার পাতে—আর পাতবেই, নারীর মন দিয়া কাত্যায়নীর ক্ষুধাটা স্পষ্টই বুঝিতে পান—তাহা হইলে গিরিবালার আর কিছুই দুঃখ থাকিবে না।…সচ্ছল সংসার—কাত্যায়নী তার বুকের সঞ্চিত মধু সমস্তটুকু উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিতেছেন, আর কি চাই?
কল্পনার মাঝেই বসন্তকুমারী বলিলেন— “বেটাছেলেদের বলে দেখব কাতু।”
কাত্যায়নী আবার হাতটা চাপিয়া ধরিলেন— “তোমায় কথা দিতে হবে দিদি, আমি তোমার সামনে বেটাছেলেদের অত বুঝি না।”
চরমের কাছাকাছি আসিয়া তিনি যেন আর নিজেকে সামলাইতে পারিতেছে না।
বসন্তকুমারী ঈষৎ হাসিয়া কাত্যায়নীর পিঠে বাঁহাতটা বুলাইয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিলেন— “তুই ছেলেমানুষই রয়ে গেলি কাতু, কথা কি মেয়েমানুষ হয়ে আমি দিতে পারি? তবে এইটুকু তোকে বলতে পারি যে আমরা সম্পূর্ণ মত আছে। অমতের মতন তো কিছুই দেখছি না।”
সেই রাত্রেই কথাটা স্বামীর কাছে পাড়িলেন। অন্নদাচরণ খুব বেশি ভাবিয়া দেখিলেন বলিয়াও মনে হইল না; বলিলেন— “এ তো অতি উত্তম কথা, আজ হয় তো কাল নয়। তোমরা মেয়েছেলে, চোখে দেখলেও বুঝতে পার না,—দেখতে পাচ্ছ না ভগবানের উদ্দেশ্যটা?—ঠিক এই সময়টিতে হরিপুরের বাবুদের সঙ্গেও দহরম-মহরম হতে চলল, হাতে কিছু এলও, আর যেমন বুঝছি, আরও আসবে। সে কি কথা!—ওঁদের কামড় নেই বলে গিরিকে আমি শুধু শাঁখা পরিয়ে বিদেয় করব নাকি? শুনি?”
অন্নদাচরণের প্রায় নিয়মেই হইয়া গেছে গিরিবালার বিবাহের কথার শেষ পর্যন্ত খানিকটা রাগ রসিকলালের উপর গিয়া পড়িবেই; পড়িলও। বলিলেন— “কথাটা ওঁকেই তুলতে হল! কেন, রসিক কি খোঁজ রাখতে পারতো না?—বয়ে গেছে তার এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে! ততক্ষণ পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে বসে ছড়া আওড়ালে কাজ দেবে।”
তবুও মেয়ের বাপই, মনস্থির করিয়া ফেলিলেও অন্নদাচরণ সকালে ভ্রাতাকে বাহিরের ঘরে লইয়া গিয়া একান্তে কথাটা বলিলেন। শুনিয়াই রসিকলাল বিমূঢ় হইয়া ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিলেন,–”ওখানে গিরির বিয়ে!”
অন্নদাচরণ একটু রাগিলেন, প্রশ্ন করিলেন— “আপত্তিটা কি শুনি? কোথাও ঠিক করেছ?”
আপত্তি!…কে বুঝিবে মনের কী যে গোপন আকাঙ্ক্ষা, কি যে গভীর বিশ্বাস?… পার্বতী- উমার জন্য শিব আসিবেন নিজে—বাপের অন্তরের অভিলাষ বাতুলের বিশ্বাসের রূপ ধরিয়াছে, —মুখ ফুটিয়া বলিলেই যে প্রলাপ!…আর, হে দেব, বিশ্বাস সম্বলটুকুও যে সত্যই ধরিয়া রাখা যায় না…গৌরীদান!—সে স্বপ্ন গেল, এখন আনন্দের পুত্তলি হইয়া উঠিয়াছে নিদ্রা-জাগরণের দুশ্চিন্তা…
রসিকলাল যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব থেকে জাগিয়া উঠিয়া আমতা-আমতা করিয়া বলিলেন— “ঠিক?—কৈ, নাঃ…বলছিলাম—বলছিলাম ওখানে বিয়ে দিলে তো খুবই সুবিধে হয়।”
ভ্রাতৃবধুকেও অন্নদাচরণ নিজের মুখেই শুনাইলেন কথাটা। বরদাসুন্দরী বসন্তকুমারীর মুখেও শুনিয়াছিলেন, সাতুকে দিয়া জানাইলেন—তাঁহারা যাহা করিবেন তাহাই হইবে, আর এ তো সব দিক দিয়াই আনন্দের কথা
সেই দিন সংবাদটা বেশ ভাল করিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। বৈকাল বেলায় দামিনী পান চিবাইতে চিবাইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, দুয়ার টপকাইয়া হাঁক দিলেন— “কৈ গো, আমাদের হবু-বেয়ান কোথায়? বড়গিন্নি কৈ গো?”
বরদাসুন্দরী বাহির হইয়া আসিলেন, দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া দিয়া বলিলেন— “বোস, ঠাকুরঝি, দিদিরা এই যে বেরুলেন কোথায়।”
দামিনীর সেটা অজ্ঞাত নয়, ওঁর নিয়মই হইতেছে আগে হইতে খোঁজ লইয়া তবে আসেন, দুই জা বাড়িতে থাকিলে আসেন না, আসিয়া কোন কাজ হয় না।
দামিনী উপবেশন করিলে বরদাসুন্দরী একটু হাসিয়া প্রশ্ন করিলেন— “শুনেছ বোধ হয় ঠাকুরঝি?”
“ওমা শুনব না? বলে, কাক-কোকিলের মুখে উড়ছে কথা!”
সামনে হাতটা চাপিয়া বলিলেন— “বোস, ছোটবউ। একটা কথা শুনলাম তাই ছুটে এলাম। তোরা জিগ্যেস করিস না-করিস, ঠাকুরঝির মনটা রসিক আর ছোটবউয়ের কাছে পড়ে আছে অষ্টপহর—আহা, দুটোই হয়েছে সমান, সংসারের ভালোমন্দ কিছুই বোঝে না।…বলি, হ্যালা, এ দুম্মতি হ’ল কেন—বোনে-বোনে বেয়ানের সুবাদ?”
বরদাসুন্দরী একটু ভীত হইয়া বলিলেন— “কেন ঠাকুরঝি, অন্যায় হয়েছে? দিদির বৈমাত্র দেওরপো, সম্বন্ধে তো…”
দামিনী বলিলেন— “নৈলে আর হাঁদা বলি কেন? শুধু যে অন্যায় হয়নি তাই নয়, এমন, সম্বন্ধ লাখে একটা হয় না,…ভাল ঘর, তায় জানা ঘর…এমনি যা-তা সম্বন্ধ যে তুমি করবে না তা আমি জানি; কিন্তু একজনের মুখ বন্ধ করবে কি করে?—আর যে-সে একজন নয় তো?”
কথার ঢোটা নূতন না হইলেও বরদাসুন্দরী একটু ভীত হইয়া উঠিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘কে ‘একজন’ ঠাকুরঝি?”
“ঐটি ঠাকুরঝিকে জিগ্যেস করো না বোন; আন্দাজে বুঝতে পার ভালই, সাবধান হবে না পার, সেও মন্দ নয়।…কত কথা সে!’এইবার দুই বোনে একজোট হলেন, আর কি আমরা থৈ পাব ঠাকুরঝি?’…এই দেখ বেরিয়ে গেল নামটা মুখ দিয়ে… আর কি আমরা থৈ পাব ঠাকুরঝি? ও শুনতেই ভাই-ভাদ্দোরবউ-কোকিল-ছাঁয়ের মতন পুষে মরো, ডানা গজালেই নিজের পথ দেখবে’…সে ইনিয়ে-বিনিয়ে কত কথা!—শুধু তোর নামে হলে তো বাঁচতাম, শুনে শুনে, সয়ে সয়ে তোর ঘাটা পড়ে গেছে; চিরকালটা এখনও হবেও শুনতে; কিন্তু ঐ একটা বিধবা, তায় কুটুম মানুষ, তার ওপর আবার নতুন কুটুম হতে চলল, —ওর নামেও এই এতগুলো—’দেখো ঠাকুরঝি, বলে রাখছি—ছোট বোন তো কি, বড়টি আবার যা সেয়ানা! — বছর না ঘুরতে যদি হাঁড়ি আলাদা না করিয়ে দেয় তো…”
.
সন্ধ্যা উরাইয়া গেলে কাত্যায়নীকে লইয়া বসন্তকুমারী বাড়িতে প্রবেশ করিলেন। মনটা খুবই প্রফুল্ল, বেশ জোর গলায়ই কি একটা গল্প করিতে করিতে আসিতেছেন, উঠানে আসিয়া ডাকিলেন,–”ছোটবৌ কৈ গো?”
“এই যে” বলিয়া বরদাসুন্দরী রান্নাঘরের দাওয়ার নীচে নামিয়া আসিলেন।
বোঝা গেল কর্তাদের কেহই বাড়ি নাই। বসন্তকুমারী জিজ্ঞাসা করিলেন— “হ্যাঁরে, দামু- ঠাকুরঝি এসেছিল?”
বরদাসুন্দরী বলিলেন— “এসেছিল বৈকি।”
বসন্তকুমারী হাসিয়া কাত্যায়নীর পানে চাহিয়া বলিলেন— “দেখলি?—না এলে ওর ভাত হজম হবে না।”
জাকে প্রশ্ন করিলেন— “কিছু বললে?”
বরদাসুন্দরী একবার কুণ্ঠিত দৃষ্টিতে কাত্যায়নীর পানে চাহিলেন।
বসন্তকুমারী হাসিয়া বলিলেন— “আ গেল যা! কাতু জানে, সব শুনেছে আমার কাছে। তোকে কি বলে গেল তাই বল্ না।”
জায়ের অপেক্ষায় না থাকিয়া বসন্তকুমারী নিজেই মুখটা গম্ভীর করিয়া লইয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া বলিতে লাগিলেন— “এইবার দুই বোনে একজোট হলেন, আর কি আমরা থৈ পাবো ঠাকুরঝি?…দেইজি-বালাই, কোকিল-ছা’য়ের মতন, পুষেই মর…বলে, একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর—ছোট তো কি, বড় বোনটি আবার যা সেয়ানা!’…বল্ না, হাঁ করে রইলি কেন?”
কাত্যায়নীর মুখে কাপড় দিয়া দম আটকাইয়া যাইবার মতো হইয়াছে, বরদাসুন্দরী অত্যন্ত ভীত এবং বিস্মিত হইয়া একবার তাঁহার দিকে একবার জায়ের মুখের দিকে, চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন — “তুমি কি করে জানলে দিদি? ঠিক এই সব কথাই তো ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে গেল!”
বসন্তকুমারী হাসিতে হাসিতে বলিলেন— “আ মর!—আমিই বাড়ি বয়ে গিয়ে গুছিয়ে গুছিয়ে সব বললাম, আর জানব না?”
বরদাসুন্দরী আরও বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন— “সত্যি বললে?”
“ও মা, বলব না?—আজ আমায় কত আহ্লাদের দিন, ও উনুন-মুখীকে ক্ষেপিয়ে পাড়ায় একটা গুলতান তুলব না?…আমার কত দরদ দেখিয়ে বললে—’ও যেমন হাঁড়ি তেমনি সরা বোন; শুধু ছোট বউকেই চিনেছে, ছোট কত্তাকে এখনও চিনতে বাকিই আছে। দামু ঠাকুরঝি বরাবরই বলে এসেছে, কিন্তু সময়ে তো হলে না সাবধান, এখন…”
কর্তারা নাই, দামিনীর নকল করিয়া বসন্তকুমারী তিনজনের চাপা হাসিতে বাড়িটা মুখরিত করিয়া তুলিলেন।
৮
আশ্চর্যের বিষয় এই হইল যে সবচেয়ে উৎফুল্ল হইয়া উঠিলেন রসিকলাল নিজে, আর হঠাৎ। অনেক রাত্রি পর্যন্ত বিকাশের সঙ্গে কাব্য আলোচনা করিলেন, ওদের যেসব কাব্য কলেজে পড়ানো হয়, গ্রের এলিজি, কোলরিজের দি রাইম্ অব্ দি এনশিয়েন্ট্ মেরিনার—আরও সব অন্যান্য কবিদের ছাড়া ছাড়া কবিতা। ইংরেজি সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি খুব অধিক নয়, বহুদিনের অপরিচয়ও, তবু নিজের কবি-মন, খুব উৎসাহভরেই আলোচনায় যোগদান করিলেন। নিজের কবিতাও বিকাশকে পড়িয়া শোনাইলেন…বিয়ের কথাও উঠিল, অন্তত সপ্তাহখানেক পূর্বে তো বিকাশকে ছুটি লইয়া আসিতে হইবে, সেই এখন বাড়ির বড় ছেলে বলিতে গেলে।… বিকাশ তো বড় হইয়াছে, স্বাধীন মতামত হইয়াছে একটা—গিরির সম্বন্ধটা বিষয়ে তাহার মত কি?
কাব্যের আলোচনা বিকাশের যে উৎসাহটি শিখায়িত হইয়া উঠিয়াছিল, হঠাৎ একটু যেন স্তিমিত হইয়া গেল, প্রশ্ন করিল— “ছেলেটি দেখেছেন?”
রসিকলালের মুখটা প্রসন্নতায় দীপ্ত হইয়া উঠিল— “কাতু দিদির দেওরপো, দাদা সব শুনে- টুনে চারিদিক ভেবেটেবে কথা দিয়েছেন, এ যে দেখার চেয়েও বেশি হল বিকাশ। তা ভিন্ন নীলমণিদাকে যে অনেকবার দেখেছি—আরে তাঁরই ছেলে তো? না…”
হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, যেন ভাবী বেহাই-এর সাক্ষাতেই তাঁহাকে লইয়া ঠাট্টা করিতেছেন।
সকালে শরীরটা বেশ ভাল ছিল না, তবু ঘুড়ি কশাইয়া বাহির হইয়া গেলেন। দূরে, বেলের ওদিকে ঝিনের রায়েদের বাড়ি একটা পুরনো কেস আছে, আগে সেইখানেই গেলেন। পথে হারাণের সঙ্গে কথাবার্তা হইতে লাগিল—
“দেহটা খুব যে ভালো আজও এমন নয়, তবে সামনে একটা অতবড় খরচ, আর বসে থাকা চলে রোজগার ছেড়ে? বেরুলেই কোন্ না দু-তিনটা টাকা আসছে আজকাল? দাদা যাই বলুক, তুই তো দেখেছিস? ঝিনেতেই যাচ্ছি আজ, ক’টা ভিজিটের টাকা বাকি পড়ে গেছে, এবার আদায় করতে হবে…”
রসিকলাল একটু রাগিয়া উঠিলেন, যেন ক্রোশ দেড়েক দূরে রায়েদের শুনাইয়া শুনাইয়া বলিতে লাগিলেন— “করতে হবে না আদায়? ভিক্ষে তো চাইছি না, নিজের হক্কের টাকা। দু-কোশ পথ ভেঙে রোগী দেখতে যাচ্ছি, আর টাকার বেলায়… তুলবি কথাটা, আমি তুলতাম, কিন্তু…তা আমার সামনেই তুলবি, ভয়টা কিসের? না হয় তুলবই আমি নিজে; মেয়ের বিয়ে রয়েছে, আর কত খাতির করব?”
হারাণ বলিল— “তোমায় দিয়ে হবে নি বাবাঠাকুর, বড্ড মরা রাশ তোমার; আমি নিজেই তুলবখন।”
রসিকলালের উৎসাহটা নিবিয়া গেল, ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তি অনুভব করিয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার পর বলিলেন— “আমার সামনে তুলতে তোর কোন রকম ইয়ে হয়, না হয় একলা বিকেলেই আসিস একবার তাগাদা দিতে।”
আর একটু চুপচাপ থাকিয়া বলিলেন— “সেই ভাল, বিকেলেই আসিস’খন, শরীরটার জুত নেই, ওবেলা তো আর বেরুতে পারব না, বসে বসে কি করবি?”
রায়েদের বাড়ি ষোলটি টাকা ভিজিট পাওয়া গেল। হাতে টাকা আসিয়াছিল, রোগীটিও বেশ সারিয়া উঠিতেছে। একেবারে আজ পর্যন্ত চুকাইয়া দিল।
রসিকলালের মনে যে কী হইতেছিল, প্রকাশ করিবার ভাষা পাইতেছিলেন না বলিয়া অনেকটা পথ নীরবেই চলিলেন। এক সময়ে বলিলেন— “লক্ষণটা মিলিয়ে দেখছিস হারাণে? পাব না কেন?—পেয়েছি, একসঙ্গে চার টাকা ছ’টাকা ওবধি পেয়েছি। যেই বিয়ের কথাটি উঠল একেবারে ষোল-ষোলটা টাকা—একটা সিভিল সার্জনের ভিজিট! লক্ষণটা মিলিয়ে দেখ একবার!”
কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে মনটা যেন আরো ভরাট হয়ে গেল, আবার চুপ করিয়া গেলেন। টাকাগুলো খুব একটা বড় কাজের জন্য পকেটে যেন ছটফট করিতেছে। খানিকটা গিয়া বলিয়া উঠিলেন— “ভাল কথা মনে পড়ে গেল, একবার চিনিবাসের দোকানে যেতে হবে না? বিয়ের যা গয়না তা তো দাদা ঠিকঠাক করবে, বাপ হয়ে আমার একটা আলাদা না দিলে কি ভাল দেখায়? তুই-ই বল্ না হারাণে?”
চিনিবাস স্বর্ণকারের দোকানের পথ বাগ্দীপাড়ার ভিতর দিয়া। মোড় ফিরিয়া দুলালের বাড়িটা নজরে পড়িতেই দেখা গেল দুলালের বউ একটি শিশু-কোলে হা-প্রত্যাশা করিয়া কাহার পথ চাহিয়া দাঁড়াইয়া আছে। রসিকলাল কয়েক পা অগ্রসর হইবার পূর্বেই তাড়াতাড়ি ভিতরে চলিয়া গেল ঝালরের মতো শতচ্ছিন্ন যে ময়লা কাপড়টা পরিয়াছিল যেন সেইটাকেই আড়াল করিয়া ফেলিবার জন্য।
রসিকলাল বাড়ির সামনেটা একটু ছাড়াইয়া গেছেন, দুলালের একটা ছেলে ছুটিয়া আসিয়া বলিল— “বামুনডাক্তার গো, বাবা আবার অসুখে পড়েলো।”
রসিকলাল ঘুড়িটা দাঁড় করাইয়া বলিলেন— “কবে থেকে? বেশ তো ভাল হয়ে গেছল।”
এই দুঃস্থতম পরিবারটি সব দিক দিয়া তাঁহাকে বেশি দোহন করে বলিয়া রসিকলাল হারাণের কাছেও একটু ‘কিন্তু’ হইয়া থাকেন। তাহার পানেই চাহিয়া বিরক্তির সহিত বলিলেন— “ভাল একটু পথ্যি করবে না, আমি ওষুধ দিয়ে দিয়ে মরি! আমার ওষুধের তো দাম নেই!”
জ্বরটা খুব বেশি, দুলাল বাহিরে উঠিয়া আসিতে পারিল না, রসিকলালকেই ঘরে গিয়া দেখিতে হইল।
পরশু থেকে জ্বর হইয়াছে, ওর স্ত্রী কাল গিয়াছিল বামুনডাক্তারকে জানাইয়া ঔষধ লইয়া আসিতে, পথেই শুনিল তাঁহার শরীরটা খারাপ, আর যায় নাই। আর কেনই যে তাহার জন্য ঔষধ- পত্র করা, সে আর বাঁচিবে না। এত করিয়া বারণ করিল—কাজ নেই দা’ঠাকুরকে ডাকিয়া — তা রাস্তা থেকে তাঁহাকে এই নরককুণ্ডুতে ডাকিয়া আনা—যাইবার সময় বামুনের শাপমন্যি কুড়ানো।
দুলালই শ্বাস টানিয়া টানিয়া বলিয়া যাইতেছিল, অন্যবার তাহার স্ত্রী থাকিয়া ঘোমটার আড়াল হইতে বিবরণগুলো দেয়, এবারে সে একেবারেই আড়ালে রহিল, তাহার চাপা কান্নার ধ্বনি আর মাঝে মাঝে জ্বরের এক-একটা লক্ষণের কথা শোনা যাইতে লাগিল।
অন্য অন্য বারে রসিকলাল একটু-আধটু ধমক দেন, আজ আর দিলেন না। ঔষধ দিয়া পথ্যের কথা বলিয়া পকেট থেকে একটি টাকা বাহির করিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাহার পর হঠাৎ যেন মনে পড়িয়া গেল এই ভাবে বলিলেন— “আর একটা কথা শুনিসনি বুঝি?—গিরির আমাদের যে বিয়ে!”
খুব যেন অন্তরঙ্গ কাহাকে খবরটা দিলেন এইভাবে স্মিতবদনে দুলালের পানে চাহিয়া রহিলেন। দুলাল ক্লিষ্টস্বরে যতটা আনন্দ সম্ভব আনিয়া বলিল— “হবে; আর খুব ভালই হবে দা’ঠাকুর; ধৰ্ম্মঠাকুর জাগ্গত দেবতা, নক্ষ্মীর মা আর আমি যেতে এসতে নিত্যি মাথা ঠুকি; আমাদের পাখোনা যে শুনতে হবেই দা’ঠাকুর তানাকে…”
দুয়ারের নিকট হইতে রসিকলাল আবার ফিরিয়া আসিলেন। পকেট থেকে আস্তে আস্তে পাঁচটি টাকা বাহির করিয়া দুলালের শিয়রের কাছে রাখিয়া বলিলেন— “আর এই এক-আধখানা কাপড় সবাইয়ের জন্য কিনে নিবি দুলু—সবাইকে গিয়ে ক’দিন কাজের বাড়িতে খাটতে হবে তো?”
কি যে একটা প্রবাহ নামিয়াছে মনে, শুধু ইচ্ছা হইতেছে বন্যার নদীর মতো চারিদিকে ছড়াইয়া দিই নিজেকে।
চিনিবাসের দোকানে একটা হারের কথা ঠিকঠাক করিয়া ফিরিতে ফিরিতে রসিকলাল কয়েকবার পকেটে হাত দিয়া আবার খালি হাতটা বাহির করিয়া লইলেন, তাহার পর একবার কুণ্ঠা কাটাইয়া দুইটা টাকা বাহির করিয়া বলিলেন— “এই দুটো টাকা তুই আজ রাখ হারাণে, প্র্যাকটিস্ আরম্ভ করেছি পর্যন্ত কখনও তো মুখ ফুটে চাইলিনি একবার! অনেকবারই ভেবেছি, না চাক, আমারই হাত তুলে দেওয়া উচিত; তা হয়েই ওঠে না, দেখছিস তো খরচের হিড়িকটা?…নে ধর গোটা পাঁচেক দোব পুরিয়ে; আজ আপাতত এই দুটো রাখ, দাদাকে আর বলে কাজ নাই, ভারী তো দিচ্ছি তার আবার…”
হারাণ বলিল— “তা দাও বাবাঠাকুর। এমনি তো খাচ্ছি পরছি তোমাদেরই, তবুও সবাই ছুতোনাতা করে টেনে নিচ্ছে, হারাণেরই কি সাধ হয় না বাবাঠাকুর আশীর্ব্বাদ বলে হাত তুলে দেয়? বলিনি…দেখছি এসছে আর বেইরে যাচ্ছে, এসছে আর বেইরে যাচ্ছে।…দাও, এ দুটা নক্ষ্মীর পেতে তুলে রাখব।”
টাকা দুইটি কপালে ঠেকাইয়া পিরানের পকেটে রাখিয়া দিল।
একবার হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন— “এই দেখ, আসল কথাটাই ভুলে যাচ্ছিলাম। কদ্দিন থেকে গিরি রমেশের দোকানের সেই পুতুলটার কথা বলে আসছে! চল, একবার ওদিক হয়েই যাই।”
রমেশ বর্ণনা শুনিয়া এবং ইতিহাস শুনিয়া একটু হাসিল, বলিল— “সে কবে বিকিয়ে গেছে, অ্যাদ্দিন থাকে কখনও?”
কয়েকটা অন্য পুতুল দেখাইল।
রসিকলালের বুকে একটা বড় আঘাত লাগিল, ছেলেবেলায় পুতুলটার দিকে লুব্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া গিরিবালা বলিতেছে— “বাবা, ঐটে..।” কচিমুখে অসম্ভব আবদারের লজ্জা এবং আশঙ্কা লাগিয়া আছে;—ছবিটা স্মৃতির বিদ্যুৎস্ফুরণে জ্বলজ্বল করিয়া উঠিল একবার।… সে-গিরিবালা আবদার বুকে করিয়াই মিলাইয়া গেছে, এ-গিরিবালাও যাইতে বসিল।
কিন্তু আজ আঘাতের ব্যথাটুকু আর স্থায়ী হইতে পারিতেছে না। পকেট থেকে দুইটা টাকা বাহির করিয়া রসিকলাল টেবিলের ওপর রাখিয়া বলিলেন – “না, তুমি সেই রকম একটা পুতুল নিয়ে আসবে রমেশ, যাওয়া-আসা তো আছেই কলকাতায়।”
ষোল টাকার মধ্যে ছয়টি টাকা অন্নদাচরণের হাতে উঠিল। এত বড় একটা অভাবনীয় ব্যাপার, রসিকলাল একদিনে একসঙ্গে ছয়-ছয়টা টাকা দিয়াছেন, জ্যেষ্ঠের মনে পড়ে না। প্রীতিভরে ভাইকে খুব উপদেশ দিয়া বলিলেন— “গিরিটার বিয়েটুকু হয়ে যাক তারপর তুই থাক না নিজের খেয়াল- খুশি নিয়ে রসিক, বলতে যাব কিছু? আমারই মাথার ওপর একটা দাদা থাকলে আমি এই জোয়াল ঘাড়ে করতাম নাকি? রাম বলো।”
সন্ধ্যার দিকেও শরীরটা ভাল ছিল না; না থাকিবারই কথা, তবু রসিকলাল একবার পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ি গেলেন।—সমস্ত দিনের সেই আবেগের জোয়ারটা যেন ঠেলিয়া লইয়া গেল বলা চলে। যখন পৌঁছিলেন সন্ধ্যাবন্দন সারিয়া পণ্ডিতমশাই বাড়ির সামনের শানের বেঞ্চটিতে আসিয়া বসিয়াছেন। বেঞ্চের উপর একটা ছোট মাচায় থরে থরে মালতী ফুল ফুটিয়াছে—কতকগুলা শানে, কতকগুলা নিচের জমির উপর ঝরিয়া পড়িয়াছে— জ্যোৎস্নার গায়ে সাদা সাদা বুটির মতো। অন্য স্থানেও জ্যোৎস্না ওঠে, ফুল ফোটে, তাহার গন্ধ ছড়ায়,—কিন্তু এখানে এই সদা প্রফুল্ল, আত্মসমাহিত ব্রাহ্মণকে ঘিরিয়া তাহারা একটা অন্য লোকের সৃষ্টি করে।
দূর থেকেই পণ্ডিতমশাইকে বাহিরে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া রসিকলালের মুখে হাসি ফুটিল। পণ্ডিতমশাইও দুর থেকেই প্রশ্ন করিলেন— “কি, রসিক নাকি? এসো, এসো।”
রসিকলাল পায়ের ধূলি লইয়া সামনের বেঞ্চটায় বসিলেন, হাসিয়া প্রশ্ন করিলেন— “শুনেছেন বোধ হয়?”
পণ্ডিতমশাই বলিলেন— “সমস্ত দিনটা বাড়িতে ছিলাম না, ব্যাপার কি? তোমার মুখ দেখে বোধ হচ্ছে যেন ভাল খবর এনেছ কি একটা?”
“খুব ভালো খবর”–আনন্দের আতিশয্যে কথাটা কণ্ঠে আটকাইয়া গেল। পণ্ডিতমশাই প্ৰসন্ন উৎসুক দৃষ্টিতে শিষ্যের মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন।
রসিকলালের মুখটা যেন আরও উজ্জ্বল হইয়া উঠিল,—একটি রাঙা গোলাপ যেন শেষ পাপড়িটি পর্যন্ত মেলিয়া ধরিয়াছে।— “খুবই ভালো খবর পণ্ডিতমশাই, আপনারা গিরির…”
সঙ্গে সঙ্গেই দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বেঞ্চের পিঠে মাথা দিয়া শিশুর মতোই হু হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন— “উঃ, আমার সব স্বপ্ন ভেঙে গেল পণ্ডিতমশাই।…”
.
বাড়ির মধ্যে আরও একটি চিত্তে এই রকম প্রবাহ নামিয়াছিল—যদিও এইরকম আনন্দের ছদ্ম মূর্তিতে নয়।
অনেক সময় দেখা যায় চাওয়ার ঔৎসুক্যের মধ্যে এবং পাওয়ার প্রতীক্ষার মধ্যে কী যে চাহিতেছি তাহার স্বরূপটি একেবারে লুপ্ত হইয়া যায়। সেটা ধরা পড়ে। যখন এত প্রাণ মন দিয়া যাহা আকাঙ্ক্ষা করিয়াছি, সেটা হাতে আসিয়া পড়ে, তখন নিজের আকাঙ্ক্ষার সর্বগ্রাসী রূপ দেখিয়া নিজেকেই শিহরিয়া উঠিতে হয়। যতক্ষণ চাওয়ার মেয়াদ, ততক্ষণ না পাওয়ার আশঙ্কার সঙ্গে পাওয়ার সম্ভাবনার একটা সুদৃঢ় আনন্দ মিলিয়া সমস্ত মনকে একটি মাত্র মিশ্র চেতনায় আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। মনের আর বিচার করিবার অবসর থাকে না, সে শুধুই ছোটে তার প্রেয়ের পানে— যতই ছোটে, ছোটার উন্মাদনায় ততই তৃষ্ণাটা বাড়িয়া যায়। ক্রমে সেই তৃষ্ণাটাই হইয়া পড়ে মূল অনুভূতি।
তাহার পর তপস্যার শেষে হয় বর লাভ। উন্মাদনা গিয়া স্নিগ্ধ শান্তি আর অবসাদের মধ্যে মনটা যেন নিজে থেকে আলাদা হইয়াই বিচারে বসে, যাচাই করে—যাহা পাইলাম সেটিকেও, আর যে পাইল তাহাকেও, অর্থাৎ নিজেকেও।
প্রথম দিনটা সাফল্যের উল্লাসে, বিশেষ করিয়া বসন্তকুমারী সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়ানোয়, আলাপ- আলোচনায় ক্বচিৎ নুতন কুটুম্বিতার হাসি-ঠাট্টায় কাত্যায়নী অতটা বুঝিতে পারিলেন না, শুধু সব কিছুর মাঝে মাঝে মনটা যেন অহেতুকভাবেই ক্ষণিকের জন্য বিষণ্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল। পরের দিন সকাল হইতেই এই ক্ষণিক বিষণ্ণতা যেন একটি স্পষ্ট বেদনায় রূপ ধরিয়া উঠিতে লাগিল।…কাল ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে একটা একেবারে নূতন ধরনের চৈতন্যে মনটা ভরিয়া উঠিয়াছিল—সকালটি হইয়াছিল ঠিক একটি নূতন জগতের তোরণদ্বার—তার মধ্যে দিয়া দেখা যায় দূর—সুদুর পর্যন্ত বিস্তৃত, সুখে, তৃপ্তিতে হাসিতে ভরা একটি সংসার।—সংসার! জীবনের অপরাহু পর্যন্ত কাত্যায়নী যাহার সন্ধান পান না।…কাল সুখের অলসতায় কাত্যায়নী অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিছানায় পড়িয়া ছিলেন—কল্পনার তুলি দিয়া শুধুই রং ফলাইয়া গিয়াছিলেন। আজ কিন্তু ঘুম ভাঙার পর বিছানাটা—শুধু শুইয়া থাকাটা যেন অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। কাত্যায়নী উঠিয়া বাহিরে আসিলেন।
দাওয়ায় আসিয়াই প্রথমে দেখিলেন গিরিবালাকে। গিরিবালা ওঠেই সবার আগে; আজ যেন আরও সকালে উঠিয়াছে। খিড়কির পুকুরে মুখ ধুইতে নামিয়াছিল, ঘাটের ঢালু বাহিয়া অর্ধেকটা উঠিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে; বস্ত্রাঞ্চলে মুখটা মুছিল, তাহার পর বোধ হয় সামনের গাছে কিছু একটা দেখিয়া স্থির কুতূহলী দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। নবোদিত সূর্যের রশ্মি আসিয়া গায়ের উপর, মুখের উপর ছড়াইয়া পড়িয়াছে, চারিদিকের সবুজ আবেষ্টনীর মধ্যে দেহনিবদ্ধ সূর্যরশ্মিতে একটা নূতন ধরনের আভা ফুটিয়াছে। ভোরের স্নিগ্ধ মৌন দৃষ্টির নীচে, এই অদ্ভুত গোলাপী আভায় মণ্ডিত গিরিবালাকে যেন নূতন কোন এক লোকের জীব বলিয়া মনে হয়। এখানকার নয়; আলোর পথ বহিয়া ও যেন এই সদ্য নামিয়া আসিয়াছে, হালকা চরণ দুটি এখনও মাটিতে পড়ে নাই। এ যেন এ-মাটির নয়, এ- মাটির বেদনায় নয়, পৃথিবী তাহার নিজের মলিন সুখদুঃখ লইয়া ভালো করিয়া জাগিয়া উঠিবার পূর্বেই, স্পর্শাতীত হইয়া উষার মতোই ও আবার আলোর জগতে মিলাইয়া যাইবে।
কাত্যায়নী একটু আড়ালে ছিলেন, দেখিয়া দেখিয়া তাঁহার চক্ষু দুইটি অশ্রুতে ছল ছল করিয়া উঠিল—বেদনাটা খুব স্পষ্ট নয়, তবে মনে হইল সত্যই যেন ও এইবার মিলাইয়া যাইবে। এতদিন ছিল তাঁহার বুকের মধ্যে—তাঁহার নিতান্ত নিজেরটি হইয়া।—তবে ছিল একটা হালকা মুক্তির মধ্যে; এইবার তৃষ্ণার আর্তিতে দুই বাহু দিয়া জড়াইতে গিয়া কাত্যায়নী যেন তাহাকে হারাইতে বসিয়াছেন। এ কী সর্বনাশ করিলেন তিনি!…
আবার দিন অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা কাজের চঞ্চলতার মধ্যে গিরিবালার নিত্যকার রূপটি ফুটিয়া উঠিতে লাগিল, সেই গিরিবালা – যাহাকে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সংসার পাতিবার জন্য চাওয়া যায়, পাওয়া চলে। কাত্যায়নী আবার তাহাকে আদর-যত্নের তন্তু দিয়া বুকের সঙ্গে জড়াইতে লাগিলেন। অবশ্য তন্তুতে মাঝে মাঝে টান পড়িতে লাগিল—মন যেন হঠাৎ নিজের থেকে সরিয়া দাঁড়াইয়া এক-একটা প্রশ্ন করিতে লাগিল—দৃঢ়ভাবে উত্তর চাহিতে লাগিল—সত্যই কি গিরিবালা তাঁহার সংসার পাতিবার মতো?…শাশুড়ীর কথা কাত্যায়নী লুকাইলেন কেন? – ছেলের কথা উঠিতেও কেন এড়াইয়া গেলেন?… তাঁহার অমন নির্মল ভালোবাসায় খাদ মিশিল কোথা থেকে?—কেন দিলেন তিনি মিশিতে? …
প্রশ্ন থেকে কাত্যায়নী যেন পলাইয়া পলাইয়া বেড়াইতে লাগিলেন। বসন্তকুমারীর সঙ্গে, ভগ্নীর সঙ্গে, আগামী কাজের যোগাড়যন্ত্রের আলোচনায়, আর গিরিবালার ভবিষ্যৎ জীবনের চিত্রটাকে রঙে রঙে বোঝাই করিয়া মাতিয়া রহিলেন; আজই যে যাইবেন, আর সময় আছে?—সব ঠিক করিয়া লইবেন না?
এই সব-কিছুর মধ্যে কিন্তু সেই এক প্রশ্ন,—কত আকারে!—উত্তর চাই। —এক ঝাঁক মৌমাছিতে যেন তাঁহাকে খেদাইয়া ফিরিতেছে, জলে ডুব দিয়া আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতেছেন; কিন্তু সেখানেও যে সেই মৃত্যুরই যন্ত্রণা!
দুপুরের একটু আগে বিকাশকে লইয়া সিংহবাহিনীতলায় পূজা দিতে গেলেন। পূজা সাঙ্গ হইলে প্রণাম করিতে গিয়া যেন গোলমাল হইয়া গেল—’আমায় দাও, আমায় দাও মা, কী আর বেশি চাইছি তোমার কাছে?…আমার বড় তেষ্টা, বড় যন্ত্রণা, বড় জ্বালা—নিজের জ্বালায় বুঝি আমি সব জ্বালিয়ে দিতে বসলাম — বাঁচাও আমায়—তুমি তোমার পদ্মহস্ত বুলিয়ে আমার এ-জ্বালা মিটিয়ে দাও…শেষের কটা দিন আর আমায় এই তেষ্টা নিয়ে যেন না দগ্ধাতে হয়…’
দিন যত অগ্রসর হইতে লাগিল কাত্যায়নী তত যেন সাধ মিটাইয়া দিনের সমস্ত মধুটিকে নিংড়াইয়া নিংড়াইয়া পান করিতে লাগিলেন—
“কোথায় গেল বাঁড়ুজ্জে?… সেটি হচ্ছে না, বাপের কাছ থেকে আমি গুনে গুনে গয়না আদায় করব, তেমন কুটুম নয়, পালিয়ে পালিয়ে বেড়ালে ছাড়ছে কে?…দাদাকে একবার বলে কয়ে পাঠিয়ে দেবে বউদি, আমার ওখানের মোটামুটি ব্যবস্থাটা তাঁকেই গিয়ে একবার করে দিয়ে আসতে হবে, দেওর তো আনাড়ি মানুষ এক…আয় গিরি; তোর চুলটা আমি বেঁধে দিই আজ…নিজের দিকে একটু চাইবি—গিন্নিত্ব করতে করতে কী যে মেয়ের ছিরি হয়েছে!”
সন্ধ্যার সময় যাত্রা, ঘণ্টাখানেক আগে কাত্যায়নী প্রস্তুত হইলেন। উঠানের মাঝখানে একত্র হইয়া প্রণাম-আশীর্বাদের পালা চলিল। ভিতরে যেন একটা ঝড় উঠিয়াছে, মাঝে মাঝে মুখ ফিরাইয়া নিজের ঠোঁটটাকে নির্দয়ভাবে কামড়াইয়া ধরিতেছেন।…তরী প্রায় ঘাটে ভিড়াইয়াছেন, আর একটু সময়, তাহা হইলেই সব রক্ষা হয়। বিদায়ের ক’টা মুহূর্ত যেন প্রাণপণে হালটাকে চাপিয়া আছেন।
গিরিবালা দুই তিন দিন থেকে একটু দূরে দূরে থাকিতেছে; আসিয়া কাত্যায়নীকে প্রণাম করিল। কাত্যায়নী তাহার মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিয়া দক্ষিণ হস্তে মুখটা তুলিয়া ধরিয়া একটু চাহিয়া রহিলেন, তাহার পর মাথাটা গাঢ় আবেগে নিজের পাঁজরার কাছে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন— “গিরি…”
উপরি উপরি দুই-তিনবার নিজের ঠোঁটটা কামড়াইয়া ধরিলেন, কিন্তু বাধা মানিল না; দরদর করিয়া দুই গাল বাহিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল। বসন্তকুমারী অতটা বুঝিলেন না; বড় সুখের আলোড়নের পর বিদায়ের সময় হয় ওরকম। তবু বলার খাতিরেই বলিলেন— “ওকি কাতু, আহ্লাদ বুকে করে যাওয়ার সময়…”
কাত্যায়নী আর পারিলেন না, বসিয়া পড়িয়া বসন্তকুমারীর পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়া উঠিলেন— “ও দিদি, এ যে কী সর্বনেশে আহ্লাদ—তোমাদের জানতে দিইনি…আমায় ক্ষমা করো— আমার এ লোভের কি প্রাশ্চিত্তির বলে দাও আমায়…আমি গঙ্গাপুজোর ফুল এঁটোকুড়ে ফেলতে নিয়ে যাচ্ছিলাম দিদি—বলো বলো, আমার কি উপায় হবে?…”
.
পাড়ায় কথাটা যখন ছড়াইল, কত লোক কত ভাবে কত বলিল, কত ভঙ্গীতে হাসিল। দামিনী নন্তীকে দিয়া খোঁজ লইয়া যখন জানিলেন বরদাসুন্দরী বাড়ি নাই, আসিয়া বসন্তকুমারীকে বলিলেন— “আমি আগেই জানতাম বড়-বৌ—বলে মার চেয়ে যার টান বেশি তাকে বলে ডাইন! নেহাৎ মা সিংহবাহিনীর চোখের নিচে এমন একটা অঘটন নাকি ঘটতে পারে না, তাই, নৈলে…
জীবনে বোধহয় এই প্রথম বসন্তকুমারী লঘু কৌতুকে দামিনীর সুরে সুর মিশাইলেন না। বেশ দৃঢ় এবং কতকটা রুক্ষ স্বরেই বলিলেন— “অমন কথা বলো না ঠাকুরঝি, অধম্ম হবে। কাতু যে কী রত্ন মুঠোর মধ্যে পেয়েও নিজের ইচ্ছেয় ছেড়ে দিলে তা আর কেউ না বুঝুক, আমি বুঝেছি; শুধু, মনটা কত বড় হলে এমন ছাড়া ছাড়তে পারে লোকে সেইটেই বুঝে উঠতে পারছি না।”