স্বর্গাদপি গরীয়সী ১ – তৃতীয় পর্যায়

তৃতীয় পর্যায়

গিরিবালা জীবনে কোথাও অনাদর পান নাই, কিন্তু এটাও ঠিক যে কাত্যায়নী দেবীর মতো অমন হৃদয়ের সমস্ত মধু-ঢালা আদরও কোথাও পান নাই। তাই তাঁহার স্মৃতি গিরিবালার মনে একটা সম্পূর্ণ আলাদা স্থান অধিকার করিয়া ছিল। আর অন্য কারণ থাকিলেও কাত্যায়নী দেবীকে ঘিরিয়াই সমস্ত সিমুরটা বলিয়া সিমুরের কথা বোধ হয় গিরিবালার কত প্রিয় ছিল। কাত্যায়নী দেবীর প্রসঙ্গে মা যেন একেবারেই রূপান্তরিত হইয়া যাইতেন। এবং সেই জন্যেই শৈলেনও কৃত্রিম করিয়া প্রসঙ্গটাই তুলিত বেশি। গল্প শুনিতে শুনিতে শৈলেনের মনে হইত না যে একজন প্রৌঢ়া কাহিনী বলিতেছেন, মনে হইত একজন কিশোরী জীবনের প্রভাতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।—তাহার চারদিকে প্রীতি আর বাৎসল্য ছড়ানো,—বৃক্ষ-বল্লরীচ্যুত পুষ্পের মতোই সে সেগুলা কুড়াইয়া ফিরিতেছে।… গল্পের দিকে শৈলেনের কান থাকিত না;—সে মুগ্ধ বিস্ময়ে চাহিয়া থাকিত এই মায়ের মধ্যেই বিকশিত সেই তাহার কিশোরী জননীর পানে। আনন্দমাখা এক অদ্ভুত রহস্য শুধু তাহাদের দেহকে নয়, যেন মনটাকে পর্যন্ত রোমাঞ্চিত করিয়া তুলিত। ঐ মা তাহার এই মা-ই!…গল্প শুনিবে কি এরই সূত্র ধরিয়া জীবন তাহার সহস্র বিস্ময় লইয়া তাহার সামনে উপনীত হইত। ছেলেমানুষের প্রশ্নের মতোই কতকগুলা বোধহীন প্রশ্ন ভাসিয়া ভাসিয়া উঠিত,—মা যখন কিশোরী, শৈলেন তখন কোথায় ছিল?—সে—শুধু সেই কেন—তাহারা সব ভাইবোনে কি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোন আকারে, –অচিন্তনীয়, একেবারেই অব্যক্ত কোন ধারণামাত্র রূপে ঐ ত্রয়োদশী কিশোরী জননীর মধ্যে লুপ্ত ছিল?— নবজাতা লতার মধ্যে ভাবী লতাসন্ততি যেমন থাকে—মাত্র এক সম্ভাবনার আকারে? না, তাহারা তখন সম্পূর্ণই আলাদা শুধু এই মহিমময়ীকে মা বলিয়া পাইবার জন্য কোন কঠিন তপস্যায় নিরত?…শিশুর মতো প্রশ্ন সব, কিন্তু বড় ভালো লাগিত; মুখের পানে চাহিয়া থাকিত। শিশু এক এক সময় যেমন হঠাৎ সব কিছু ছাড়িয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া তাহাকে বুঝিবার চেষ্টা করে, নির্ণীত করিবার চেষ্টা করে, এই মানুষটিই সব চেয়ে এত আলাদা, সব চেয়ে এত কাছে কেন—সেই রকমের কি একটা ব্যাপার ঘটিতে থাকিত।…গিরিবালা এক-একবার হাসিয়া শৈলেনের পানে চাহিয়া বলিতেন— “তুই এত অন্যমনস্ক হয়ে যাস শৈলেন, মেজমাসির গল্প শুনতে শুনতে—অথচ শোনাও চাই বসে বসে। কী অত ভাবিস?”

শৈলেন চুপ করিয়াই থাকিত একটু বোধ হয় অপ্রতিভ হাসি হাসিয়া; তবে একদিন দিয়া ফেলিয়াছিল উত্তর, সেদিন বোধ হয় আরও বেশি অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল—হাসিয়াই বলিল— “তুমিই অন্যমনস্ক হয়ে আমায় অন্যমনস্ক করে তোল মা। কাতুদিদিমা তোমায় যেন যাদু করে রেখেছেন—তুমি যেন স্পষ্টই আবার তার ছোট বোনঝিটি হয়ে যাও; আমি যেন দেখতে পাই।”

গিরিবালা হাসিয়া বলিয়াছিলেন— “কেন, বাবা-জেঠামশাইদের কথাও তো বলি, সে সময় তো হোস না এত অন্যমনস্ক।”

শৈলেন উত্তর দিয়াছিল, হাসিয়াই,— “তাহলে বলি মা?—রাগ করবে না তো?—ওঁদের কথায় তুমি যেন কেমন গিন্নিবান্নি হয়ে যাও—ছোট একটি মা হয়ে যেন বুড়ো ছেলেদের সামলে বেড়াচ্ছ। কাতুদিদিমার গল্পে তোমার যেমন আদর খাওয়া ছোট মেয়ের রূপটা খোলে, তেমন আর অন্য কারুর বেলাতেই খোলে না।”

দুজনের হাসিই একটু বেশি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার পরই গিরিবালা একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিয়াছিলেন— “তা বোধ হয় মিছে বলিসনি, কী যে আদর পেয়েছিলাম তাঁর কাছে সে সময়!…মনে হয় আবার সেই বয়সে ফিরে গিয়ে আর একবার খেয়ে আসি।”

***

পরদিন সকলে রসিকলাল প্রথমেই পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ি গেলেন। বেঞ্চের পিছনটায়, বাড়ি আর রাস্তার মাঝখানে একফালি জমির উপর একটা ফুলের বাগান। বাগানের ও-প্রান্তে পণ্ডিতমশাই বেড়ার একটা বাতায় গেরো দিতেছিলেন, নামাবলী গায়ে খড়ম পায়ে সমবয়সী কে একজন যাইতে যাইতে রহস্য করিয়া বলিলেন— “বাগানের বেড়া দেওয়া হচ্ছে, সোমেশ্বর?— -রামপ্রসাদের মতো বেড়া বাঁধতে পার তবে তো?”

পণ্ডিতমশাই হাসিয়া বলিলেন— “সেই চেষ্টাতেই আছি, দেখি যদি আনতে পারি ফাঁকি দিয়ে বেটিকে। এলে কিছু চোখা চোখা সওয়াল আছে।”

“বলে ফেললে, আর সে আসবে?—ওই সওয়ালের ভয়েই তো আসতে চায় না। কত বড় ধড়িবাজ মেয়ে!”

দুইজনে হাসিয়া উঠিলেন, এমন সময় বেঞ্চের সামনে রাস্তায় রসিকলালের ঘুড়িটা উপস্থিতির সাড়া দিয়া উঠিল, পণ্ডিতমশাই ফিরিয়া দেখিয়া কতকটা যেন চিন্তিতভাবেই তাড়াতাড়ি চলিয়া আসিয়া বেঞ্চটা ঘুরিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াইলেন। রসিকলাল ঘুড়ি থেকে নামিয়া রাশটা হারাণের হাতে তুলিয়া দিলেন, তাহার পর পণ্ডিতমশাইকে প্রণাম করিয়া উৎফুল্ল বদনে তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন, চোখ দুইটি হালকা দুই বিন্দু জলে চকচক করিতেছে। পণ্ডিতমশাইয়ের মুখে একটা উগ্র উৎকণ্ঠা লাগিয়া রহিয়াছে—যা আঘাতটা পাইয়াছে রসিক যেন সব কিছুই হইতে পারে।

রসিকলাল সংবাদটা নানারকম ভাষায় মণ্ডিত করিতে করিতে আসিতেছিলেন, যেন সব ভুলিয়া গিয়াছেন। শেষে একটু চাহিয়া থাকিয়া অপেক্ষাকৃত চাপা কণ্ঠেই বলিলেন— “আপনার আশীর্বাদ ফলে গেল পণ্ডিতমশাই…আমার কিন্তু বরাবরই আশা ছিল ফলবেই…কেটে গেছে গিরির এ ফাঁড়াটা।”

পণ্ডিতমশাই চক্ষু দুইটি বিস্ফারিত করিয়া “অ্যা!” করিয়া কতকটা অশোভন উচ্চৈঃস্বরেই চীৎকার করিয়া উঠিলেন। রসিকলালের দক্ষিণ বাহুটা ধরিয়া দুইজনে আসিয়া বেঞ্চটাতে বসিয়া বলিলেন— “কি ব্যাপার বল সবিস্তারে, সত্যিই আমি ধৈর্য রাখতে পারছি না রসিক—কি যে অবস্থা যাচ্ছে!”

রসিকলাল আস্তে আস্তে সাধ্যমত নিজের মন্তব্য সহকারে কাল সন্ধ্যায় কাহিনীটা বিবৃত করিয়া গেলেন। শুনিতে শুনিতে পণ্ডিতমশাইয়ের চিরন্তন শান্তিটি আবার পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হইয়া উঠিল। শেষ হইলে রসিকলালের পিঠে হাত দিয়া বলিলেন— “চলো ঘরে গিয়ে বসি রসিক, তাতটা বেড়ে উঠছে।…ওখানে খুট খুট কিসের শব্দ ওটা!..ও! তোমার সেই পাখোয়াজি সহিস বুঝি?”

হাসিতে হাসিতে দুইজনে ঘরের ভিতর একটি মাদুর-পাতা তক্তাপোশের উপর গিয়া বসিলেন। পণ্ডিতমশাই বলিলেন— “পা তুলে গুছিয়ে বসো রসিক, গোটাকতক কথা আছে।”

একটু থামিয়া বলিলেন— “আমার মনটাও কাল থেকে বড় খারাপ হয়ে আছে রসিক, অবশ্য তুমি বাপ, তোমার কথাই আলাদা, তবুও কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। সকালে একটু অন্যমনস্ক থাকবার জন্যেই কাদম্বরীটা নিয়ে বসলাম—কিছুতেই অভিনিবেশ হল না, ঐ দেখো না, পড়ে আছে, তোলাও হয়নি। শেষকালে কাতাটা নিয়ে বাগানে গিয়ে নেমেছি, তুমি এলে।…এ হতেই হবে রসিক, এত বড় অন্যায় কখনও হয় না। আমার গণনায় কিঞ্চিন্মাত্রও ভ্রম ছিল না। ও-কন্যার যেখানে বিবাহ সেখানে স্থির হয়েই আছে; নড়চড় হবার জো নেই। সঙ্কটের কথা তো তোমায় বলেছিলাম— সাবিত্রীর পাঁচ জায়গায় সম্বন্ধ করতে হয়েছিল, দময়ন্তীর বিবাহেও সঙ্কট উদয় হয়েছিল, এসব সঙ্কট কিন্তু কপূরের মতো উবে যেতে বাধ্য।…কাল সব কথা শুনে গিন্নী বললেন— “চার পো কলি, এখন সত্য ত্রেতা যুগের কথা ধরে বসে থাকলে চলবে কেন?”… মেয়েছেলে, তাদের সঙ্গে তর্ক করাই অবিধেয়, জানই তো—স্ত্ৰীয়াহি নাম খন্দ্বেতা নিসর্গাদেব পণ্ডিতাঃ—অর্থাৎ স্ত্রীজাতি আপনা-আপনিই পণ্ডিত—অন্তত তাই মনে করে নিজেদের। তবে আমার যতটুকু আত্মলব্ধ জ্ঞান তাতে মনে হয় চার পো সত্য যুগ বলেও কোন যুগ কখনও ছিল না, চার পো কলি বলেও কোন যুগ কখনও হবে না। পাপ যদি কোন কালে বেশি গাঢ় হয়ে ওঠে—কালধর্মে, তো পুণ্যও হয়ে উঠবে সেই অনুপাতেই উজ্জ্বল। এই সৌর সংসার সূর্যের আলো-ছায়ার নিয়মেই চলে আসছে; সেই নিয়মেই চলবে… ছায়া যত নিবিড়, আলো ততই প্রদীপ্ত।…তোমার শ্যালীর এই আত্মজয়টা পুরাণের কোন্ আত্মজয় থেকে ন্যূন আমায় বলো না? হয়তো বলবে তিনি লুব্ধ হয়েছিলেন। অত্যন্ত স্বাভাবিক—গিরিবালার মতো মেয়েকে আত্মসাৎ করতে চাইবে—বিশেষ করে তাঁর মতো এক বাল-বিধবা এ চারিকালটা বঞ্চিতই হইল সংসারে—এ অত্যন্ত প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার। তা না হলে গিরিবালাকে শ্রী আর স্বভাবে অমন মধুর সৃষ্টি করে পাঠাবার কোন সার্থকতাই থাকত না বিধাতার পক্ষে। কিন্তু ঐ লোভের রূপই কি তোমার শ্যালীর আসল রূপ?—তিনি যে সেই লোভকেই মাড়িয়ে এই স্বমহিমায় উঠে দাঁড়িয়েছেন—এই তাঁর প্রকৃত রূপ না দেখতে পেলে কি ওঁর চেয়ে আমাদের দুর্ভাগ্যই বেশি নয় রসিক?”

প্রত্যেক কথাটি রসিকলালের মনে অনুরূপ ধ্বনি তুলিতেছিল, স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলিলেন— “আমি ওঁকে ভালো করেই জানি পণ্ডিতমশাই, আমার মত এক মুহূর্তের জন্য বদলায়নি, তবে একথা ঠিক যে একটু আশ্চর্য হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু নানা লোকে নানা কথা—”

পণ্ডিতমশাই কথাটা শেষ হইতে দিলেন না, অধরোষ্ঠে অল্প যেন চাপ দিতে দিতে বলিলেন– “নানান লোকে নানা কথা!…লোক!—আপামর সাধারণ—তারা অন্তঃসত্ত্বা জানকীকেও অরণ্যে পাঠিয়েছিল রসিক!—ভুললে চলবে না সে কথা।”

দুইজনেই খানিকক্ষণ নির্বাক হইয়া রহিলেন, যেন মহিমার সঙ্গে বেদনায় মণ্ডিত যে প্রসঙ্গটি উঠিয়াছে দুইজনেই সর্বান্তঃকরণ দিয়া সেটাকে অনুভব করিতেছেন। একটু পরে কতকটা যেন আচমকাই মুখটা তুলিয়া পণ্ডিতমশাই বলিলেন— “হ্যাঁ, যার জন্যে তোমায় ভেতরে ডেকে আনা, রসিক, পাত্রের সন্ধান আমি পেয়েছি।”

অদ্ভুত কথা। যে-প্রসঙ্গের মধ্যে আর মনের যে অবস্থায় শোনা, আরও যেন অদ্ভুত ঠেকিল কানে; রসিকলাল মুখটা ঈষৎ হাঁ করিয়া পণ্ডিতমশাইয়ের পানে চাহিয়া রহিলেন, পণ্ডিতমশাই বলিতে লাগিলেন— “পাত্রের সন্ধান পেয়েছি। কাল নিজেই আমি সংবাদটা নিয়ে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু তার আগেই তুমি এলে, আর এমন উল্টো এক সংবাদ নিয়ে এলে যে কথাটাই আর তোলবার অবসর পেলাম না আমি। পূর্বেই বলেছি, তুমি বাপ, তোমার কথা আলাদা, কিন্তু সন্ধানটা পাওয়ার অব্যবহিত পরেই অমন আঘাতটা পেয়ে আমারও যে কি করে কেটেছে তা অন্তর্যামীই জানেন রসিক। স্নেহে আঘাতের চেয়ে বিশ্বাসে আঘাত যে কোন অংশেই কম নয়, সেইটেই আমি উপলব্ধি করছি কাল থেকে।

রসিকলাল বলিলেন— “আপনার স্নেহ কি আমার চেয়ে কম পণ্ডিতমশাই?—আমি তো বুঝি।”

পণ্ডিতমশাই সস্নেহে শিষ্যের পিঠে হাত দিলেন, স্মিত হাস্যের সহিত কহিলেন— “নিজের গভীরত্বেই সমুদ্রতল অন্ধকার, তাই সে দেখতে পায় না সে কত গভীর। তবে একটা কথা তোমায় আবার বলব রসিক—বিশ্বাস আমার আঘাত পেয়েছিল বটে, তবে টলেনি। সমস্ত বেদনার মধ্যে আমি বুঝতে পারছিলাম—এটা দৈবের ‘রহস্য মাত্র, পাত্র–সে স্বস্থানেই আছে, সময়েই আসবে।…এক-একটা ঘটনাকে উপলক্ষ করে একটু জটিলতা সৃষ্টি করে বিধাতা মানবচরিত্রের এক-একটা দিক আমাদের সামনে প্রকাশ করে ধরেন—ভালোর দিক, আবার মন্দের দিকও হতে পারে,—এ তাই রয়েছে। যাক্ আসল কথাটা বলি : তোমায় বলেছিলাম দুরদৃষ্টবশতঃ আমার এক সময় উজ্জয়িনী প্রবাস ঘটেছিল, মনে আছে বোধ হয়। প্রথম যখন যাই তখন গাড়িতে আমার একটি ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়। বাড়ি সাঁতরায়, তবে আমারই মত ঘর-ছাড়া ভাই—একটা কুঠিতে কাজ নিয়ে মিথিলায় বসবাস করছেন। সুরসিক এবং সুপণ্ডিত মানুষ আর সুপুরুষ। বরং শুধু সুপুরুষ বললে তাঁর বর্ণনাটা সম্পূর্ণ হয় না, একে সুন্দর তায় বরাবর পশ্চিমে সুখ-প্রতিপত্তির মধ্যে কাটিয়েছেন—অমন কান্তিমান পুরুষ আমাদের মধ্যে দেখাই যায় খুব কম। বহুদূর পর্যন্ত একসঙ্গে আর খুব আনন্দে গিয়েছিলাম আমরা; তারপর পাটনার কাছাকাছি কোন একটা ইস্টিশনে নেমে তিনি গঙ্গা পেরিয়ে কর্মস্থলের অভিমুখে চলে গেলেন।

“প্রায় পনেরো বৎসর পরে হঠাৎ পরশু তাঁর সঙ্গে দেখা। নবদ্বীপ গিয়েছিলাম জানই, ফেরবার সময় ত্রিবেণী পর্যন্ত নৌকায় এসে রেল ধরলাম। এমনি বিধির নির্বন্ধ, যে-গাড়িতে উঠলাম ভদ্রলোকও সেই গাড়িতে বসে আছেন। বহুদিন পরে দেখা হলেও সামান্য একটু খটকা কাটিয়েই উভয়ে উভয়কে চিনতে পারলাম। তার পর যতক্ষণ গাড়িটিতে ছিলেন, দুজনে মুখোমুখি হয়ে আলাপ করে কাটানো গেল। বললেন বড় ছেলেটি দেশেই আছে, বিবাহের সম্বন্ধ ঠিক করে এবং সম্ভব হলে একেবারে বিবাহ দিয়েই কর্মস্থলে এইবার নিয়ে যাবেন। নিজের বয়স হয়ে এসেছে, এবার ছেলেটিকে কাজে নিয়োজিত করে দেওয়া দরকার। কতদিনের পরিচিতের মত অন্তরঙ্গভাবে কথাবার্তা। যদি বিবাহের যোগাযোগ হয় তো আমায় পূর্বেই নিমন্ত্রণ দিয়ে রাখলেন, বললেন সময়ে আবার জানাবেন। গাড়িতে আলাপের একটু অসুবিধে এই যে প্রায় প্রতি ইস্টিশনেই নূতন লোকের সমাগম হতে থাকায় প্রতি ইস্টিশনে কথাবার্তার মোড় ঘুরে যায়। তার সময় অল্প আর বলবার কথা অনেক। বিচ্ছিন্নভাবে অনেক রকম কথা হল। গাড়ি যখন অনেকটা এগিয়ে এসেছে। বিদ্যুৎঙ্কুরণের মতো একটি কথা আমার মনে উদয় হল—হিমালয়ের পাদমূলে সুদূর মিথিলায় এই তো বর! আমরা যাকে খুঁজছি সে তো এই; একে দেখিনি, কিন্তু এই রকমই পিতার সন্তান হয়ে, দেবদুর্লভ রূপ নিয়ে, এই রকমই কুলশীলের অধিকারী হয়ে তো তার জন্ম নেওয়ার কথা। আমরা নবদ্বীপ যাওয়া, অকস্মাৎ এই দেখা হওয়া, এমনি কি পনেরো বৎসর পূর্বেকার সেই প্রথম সাক্ষাৎ—সবই যেন দৈব-নির্দিষ্ট বলে মনে হল আমার। আমার হাতেও একটি অতি সুলক্ষণা পাত্রী আছে।’—বলে প্রস্তাবটা তুলব— একেবারে ঠোঁটে এসেছে, এমন সময় তাঁর যেন হঠাৎ চাঁক হল। অন্য কি একটা প্রসঙ্গ চলছিল, হঠাৎ বিরতি দিয়ে বলে উঠলেন—দেখুন! এত সুযোগ পেয়েও ভুলে যাচ্ছিলাম!-আপনি তো পণ্ডিত মানুষ বহু জায়গায় গতায়াত আছে,—আপনার সন্ধানে কোন পাত্রী যদি থাকে। যৌতুক সম্বন্ধে আমার কোনই লোভ নেই, তবে কন্যাটি সুশ্রী এবং সুলক্ষণা হওয়া দরকার’।”

পণ্ডিতমশাই রসিকলালের পানে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া অর্থপূর্ণ হাস্যের সহিত বলিলেন— “সুলক্ষণা’ কথাটি লক্ষ্য করবে রসিক। ঠিক এই কথাটি আমার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছিল!…বললেন- ‘কন্যাটি সুশ্রী আর সুলক্ষণা হওয়া চাই, আর সৎ বংশের, ব্যস, এর চেয়ে বেশি আমার দেখবার দরকার নেই, গরীব কি বড়লোকের মেয়ে, শহুরে কি পাড়াগেঁয়ে আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না’, আমি গিরিবালার কথা স্রেফ চেপে গেলাম।”

পণ্ডিতমশাই থামিয়া গিয়া রসিকলালের পানে চাহিয়া মিটিমিটি একটু হাসিয়া তেজের সহিত বলিলেন— “আগেই অমনি হামড়ে পড়তে যাব কেন হ্যা? মেয়ে আমাদের ফেলনা নাকি? ওঁর সুশ্রী সুলক্ষণা মেয়ে চাই, আমাদের বুঝি কানা খোঁড়া যা হোক একটা পাত্র হলেই হল—ইস্!…আরে কে আসছে তা তো জানিই, তবে দাপট ছাড়ি কেন? নিচু হই কেন?”…বললাম—’আছে একটি মেয়ে, তবে সে মেয়ে হওয়া দুরূহ’…

“বলতেই তো তিনি সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসলেন— “কেন, দুরূহ কেন, পণ্ডিতমশাই?”

“আমি যেন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বললাম—দুরূহ। আরও দুটি মেয়ে আছে হাতে, তবে একটু নিরেশ, তা আপনার বোধ হয় চলে যাবে।”

পণ্ডিতমশাইয়ের মুখের হাসিটা আরও বিস্তৃত হইয়া পড়িল, বলিলেন— “তোমরা ভাব পণ্ডিতমশাই শুধু কাব্যচর্চা করেই জীবনটা কাটিয়ে দিলে—ষাঁড়ের গোবর। ঘটকালি যা আরম্ভ করলাম দেবর্ষি নারদ খানিকটা শিখে যেতে পারতেন! তোমার বেহাই (বিবাহ স্থিরনিশ্চয় রসিক, এ তুমি লিখে রেখে দাও)—তোমার বেহাই একেবারে জিদ ধরে বললেন—না পণ্ডিতমশাই, আমার ঐ মেয়েই চাই, দুরূহ কেন বলুন খুলে, দুরূহ বলে যদি আমি সরে দাঁড়াতাম তো সতেরো বছর বয়সে একবস্ত্রে সাড়ে তিনশো মাইল পাড়ি দিয়ে বিদেশে গিয়ে চাকরি করতে পারতাম না। বলতেই হবে আমাকে।’…আর একটু ন্যাজে খেলালাম তোমার বেহাইকে, তারপর বললাম—’আপনি মাত্ৰ সুশ্রী আর সুলক্ষণা পাত্রী চান, পাত্রীর পিতা চায় একেবারে দেবকান্তি পাত্র, লক্ষণ আর কুলশীলের কথা তো ছেড়েই দিন—সামান্য একটুও খুঁৎ থাকলে পেছিয়ে পড়বে।…অনেক সম্বন্ধই এল গেল— দু-একটা এত বাঞ্ছনীয় যে আমরা চারিদিক থেকে চেপে ধরলাম; কিন্তু উঁহুঃ, নিজের কোট ছেড়ে সে একচুল নড়বার পাত্রই নয়, এ বিষয়ে জনকরাজা ওর চেয়ে ঢের সুবিবেচক ছিলেন মশাই। বড্ড রাশভারি কড়া লোক। তাই বলছিলাম আপনি ওটার আশা ছেড়ে বরং অপর দুটিকে দেখতে বলেন তো চেষ্টা দেখি।”

“যা প্যাঁচ দিয়েছি, ছাড়তে পারে কখনও রসিক?— “আপনি এখুনি নেমে আমার ছেলেকে দেখে নেবেন চলুন পণ্ডিতমশাই; নিজের ছেলের বড়াই করতে নেই, তবে যদি বলেন যে, সেরকম ছেলে আপনাদের নজরে পড়েছে এর পূর্বে তো আমি আর একটুও অনুরোধ করব না।”

নিজের কূট ঘটকালি নীতিতে আর রসিকলালের বেহাইয়ের দুরবস্থায় পণ্ডিতমশাই বেশ প্রাণ খুলিয়া একটু হাসিয়া লইলেন; তারপর গম্ভীর হইয়া বলিলেন…”আরে আমার তো অজানা নেই ছেলের সম্বন্ধে, সে যে কী ছেলে হবে সে তো বহুদিন পূর্বেই তোমায় বলে দিয়েছি হে, তবে ঐ যে বললাম—দাপট ছাড়ি কেন? আর অমন নাতনীর বিয়েতে যদি প্রাণ খুলে খানিকটা ঘটকালি না করতে পারলাম…”

পণ্ডিতমশাই আবার হাসিয়া উঠিলেন। রসিকলাল নীরবে শুনিয়া যাইতেছেন, তাঁহার বদনে কখনও সাফল্যের, কখনও গৌরবের, কখন মাত্র কৌতুকের আলোক খেলিয়া যাইতেছে। এক- একবার কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু পণ্ডিতমহাশয়ের আত্মগরিমা আজ এতই মুখর যে অবসর মিলিতেছে না। কন্যাকে কেন্দ্র করিয়া গুরু খানিকটা নির্দোষ মিথ্যাচরণে ডুবিয়া গেছেন, প্ৰসন্ন গৌরবে শিষ্য সেটা উপভোগ করিতেছেন—এমন অদ্ভুত যোগাযোগ পূর্বে কখনও আর হয় নাই। হাসি থামাইয়া পণ্ডিতমশাই বলিলেন— “তাড়াহুড়া করে ছেলে দেখতে যেতে আমার বয়ে গেছে, নাতনীর হাত আগে না দেখে থাকতাম তো একটা কথা ছিল বরং, তার চেয়ে শিগগির তোমায় খবরটা দেওয়ার বেশি তাড়া ছিল; মনে হচ্ছিল গাড়ির বেগ নেই, লাফিয়ে পড়ে ছুটি তেজপুর পানে। আবার হরিপুরে যাবার কথা শুনে গেছলাম কিনা,… ধড়ফড়ানি লেগে রইল। তোমার বেহাইকে বললাম,— “এই মুহূর্তেই নামা আমার সম্ভব হল না; তা ভিন্ন, আমি তো আপনার কথায় অবিশ্বাস করছি না; যার অবিশ্বাস করা একটা বাই দাঁড়িয়ে গেছে, আর যার অবিশ্বাসে আটকাবে, খোদ তাকেই গিয়ে আমি পাঠিয়ে দেবো।”

“নাও, ঠিকানা-টিকানা ভালো করে নিয়ে এসেছি, তোমার বেহাইকে যা-ই বলে আসি না কেন, তুমি সব কাজ ফেলে কালক্ষেপ না করে একবার হয়ে এসো দিকিন। আমি যেতাম সঙ্গে, কিন্তু এসেই বেহাইয়ের এক নিমন্ত্রণ পত্র পেয়েছি; তাঁর কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহ। যেতেই হবে, বড্ড ব্যাদড়া লোক। পিষ্যের বেহাইয়ের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবার ক্ষমতা রাখি বটে, কিন্তু আমার নিজের নাকে আমার নিজের বেহাইয়ের দড়ি।”

আবার হাসিয়া উঠিলেন, হাসি থামিলে বলিলেন— “আমি একবার যাব, বিয়ের আগে একবার দেখে আসব বৈকি, তবে তার আগে তুমি একবার বুড়ি ছুঁয়ে এসো, কথাবার্তা শুরু হয়ে যাক। বরং গিরিবালার কুষ্টিটাও পকেটে করে নিয়ে যেও; চান, তাঁদের দিয়ে এসো। অন্নদাচরণকে একবার বলবে?—বলতে তো হবেই, সে-ই তো কর্মকর্তা, তবে তার আগে তুমি চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে এসো।—না, তুমিই দেখে এসো আগে, কবি-দৃষ্টি এক আলাদা বস্তু হে, যে যতই বলুক, ওখানে আমরা কারুর কাছেই হার মানতে নারাজ।”

রসিকলাল আর বিলম্ব করিলেন না। একটা চিকিৎসার জন্য একটু পরামর্শ করিতে কলিকাতা যাইবার নাম করিয়া সাঁতরা যাত্রা করিলেন। খুব প্রতৃষ্যেই যাত্রা করিয়াছিলেন—পণ্ডিতমশাইয়ের কাছেই লগ্ন ঠিক করিয়া লইয়া। রেল থেকে যখন নামিলেন তখন সাতটা। রেলের ধারে ধারে একটা রাস্তা ধরিয়া অনেকটা যাইতে হয়। তাহার পর রেলের একটা চরখি পড়ে—রেলপথটা পারাপার করিবার জন্য। সেইখানে আসিয়া রসিকলাল একজন ভদ্রলোককে সামনে পাইয়া প্রশ্ন করিলেন— “ভটচার্য্যি পাড়া কোন্ দিকটায় যাব মশাই?”

ভদ্রলোক গঙ্গাস্নান করিয়া ফিরিতেছেন। বয়স অনুমান পঞ্চাশ উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, গৌরকান্তি, সুপুরুষ, হাতে একটি বড় তামার ঘটিতে এক ঘটি জল। অনুচ্চস্বরে একটি স্তোত্র পাঠ করিতে করিতে ক্ষিপ্রগতিতে আসিতেছেন। সমস্ত শরীরটি শুচিতায় দীপ্ত হইলেও মুখের ভাবটা যে খুব প্রসন্ন, এমন কথা বলা যায় না, দৃষ্টিও বেশ চঞ্চল। রসিকলালের প্রশ্নে দাঁড়াইয়া পড়িলেন। মুখে যেন একটা ব্যঙ্গ হাস্যের ভাব ফুটিয়া উঠিল, বলিলেন,–”এসে পড়েছেন ভটচার্য্যি পাড়ায়, এইখান থেকেই আরম্ভ হ’ল! কার বাড়ি যাবেন?”

“ভগবতীচরণ মুখোপাধ্যায় মশাইয়ের বাড়ি।”

ভদ্রলোক ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া প্রশ্ন করিলেন— “কোথা থেকে আগমন হচ্ছে আপনার?”

“বেলে-তেজপুর থেকে।”

ভদ্রলোক আবার একটু ভ্রুকুঞ্চিত করিলেন, বলিলেন— “কি কাজ?…থাক, কাজের কথা পরেই হবে; আসুন, আমারই নাম ভগবতীচরণ মুখোপাধ্যায়।”

দুইজনে আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন—ভগবতীচরণ মাঝে মাঝে স্তোত্রের খুঁটটুকু ধরিয়া আরম্ভ করিতেছেন, আবার যেন অন্যমনস্ক হইয়া চুপ করিয়া যাইতেছেন। রসিকলাল কথা কহিবার সাহস পাইতেছেন না। সঙ্গীর ভাবভঙ্গীতে নিজেকে কেমন যেন বিপন্ন বলিয়া মনে হইতেছে। খানিকটা গিয়া ভগবতীচরণ মুখ খুলিলেন, তাঁহাকে কিছু বলা নয়—একটা বাড়ির সামনে রকে বসিয়া প্রায় সমবয়সী একটি ভদ্রলোক তামাক সেবন করিতেছিলেন, ভগবতীচরণ দাঁড়াইয়া পড়িয়া তাঁহাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন— “আজ ভদ্রলোকের কাছে বড় অপদস্থ হলাম হে রমেশ।”

রসিকলাল যেন ভয়ে সঙ্কোচে এতটুকু হইয়া গেলেন। রমেশ একবার তাঁহাকে দেখিয়া লইয়া, ভগবতীচরণের পানে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন— “ব্যাপারখানা কি?—নতুন লোক দেখছি যেন?”

ভগবতীচরণ আবার ব্যঙ্গের হাসি হাসিলেন, বলিলেন, “জানাশোনা হলে তো কোন কথাই ছিল না, জানতেনই ভটচার্য্যি পাড়ার এই রূপ হয়েছে আজকাল। জানে না বলেই না, পাড়ার মাঝে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে হল— “ভটচার্যি পাড়া কোথায় বলতে পারেন?’…অথচ শুনেছ বোধ হয় রমেশ, কর্তাদের আমলে সাঁতরায় এসে কাউকে পরিচয় নিয়ে ভটচার্য্যি পাড়ায় ঢুকতে হত না।”

কথার ভাবে বোধ হইতেছে দোষটা রসিকলালের তত বেশি নয়, তবুও একেবারে নিঃসন্দেহ হইতে না পারায় তিনি নির্লিপ্তভাবে মুখ ফিরাইয়া রহিলেন করছ।

রমেশ বলিলেন— “একটু স্লেচ্ছভাবাপন্ন হয়েছে বৈকি; তবু তুমি রয়েছ, অষ্টপ্রহর খিটখিট

“আর খিটখিট!”…বলিয়া ভগবতীচরণ অগ্রসর হইলেন। কতকটা নিজের মনেই এবং কতকটা বোধ হয় রসিকলালকে শুনাইয়া শুনাইয়া বলিতে লাগিলেন— “খিটখিট করি কি সাধে? ভটচাৰ্য্যি পাড়ায় এসে মানুষে জিগ্যেস করবে, কোন্ পাড়ায় এলাম, তবে তো ব্রাহ্মণকেও শূদ্র বলে ভ্রম হবে এবার! তা হবেও, যা কাল এসেছে। ভগবতীচরণ খিটখিট করে বলে, এটুকুও বজায় আছে এখনও, যেদিন চোখ বুজবে, সেইদিনই মুন্সি পালিত ঢুকে যদি উচ্ছন্ন না দেয় পাড়া তো…”

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া আবার স্তোত্র পাঠ শুরু করিলেন; কিন্তু একঠায় পড়িয়া যাওয়া অসম্ভব হইয়া পড়িতেছে।—পথে কোথায় একটু বোধ হয় ছাই কি গোময় পড়িয়া আছে, কোথায় ঝাঁট দেওয়ার মধ্যে একটু ত্রুটি,—ভগবতীচরণের শ্লোকের সূত্র ছিন্ন হইয়া যাইতেছে। কখনও পাশের বাড়ির কাহাকেও ডাকিয়া কখনও বা আলগোছেই তিরস্কার করিয়া উঠিতেছেন। সে তিরস্কার যেমন স্পষ্ট তেমনি তীক্ষ্ণ, অল্প একটুও ক্ষমার প্রশ্রয় নাই। কখনও দাঁড়াইয়া আবার সহৃদয় প্রশ্নাদিও করিতেছেন— “তোর মেয়েটি আজ কি রকম আছে সারদা? … ছেলেটি যে পালিয়েছিল, কালকে নাকি ফিরে এসেছে রাঙাখুড়ি?…আছে বাড়িতে?…আচ্ছা এখন থাক, এখনই গিয়ে পুজোয় বসতে হবে, মেজাজটা বিগড়ে থাকবে। বৈকালে পাঠিয়ে দেবে একবার… অর্বাচীন কোথাকার!”

চলিতে চলিতে পাশের বাড়ি হইতে কখনও কখনও শোনা যাইতেছে— “ওরে ভগবতীচরণ- কাকার নেয়ে ফেরবার সময় হল, দেখ বেরিয়ে একবার, বাইরেটা ঠিক মতো ঝাঁট দিয়েছে কিনা!”

“ওরে, গোয়ালের দিকে কেউ এখনো যাসনি বুঝি? দেখ শিগগির; পস্কের করে দে দুটো কিছু ধরে গরুটার মুখে; ভগবতীচরণ-দাদার ফেরবার সময় হয়েছে।”

অপর কণ্ঠে অনুযোগ উঠিতেছে— “ক’দিক যে সামলাবে গেরস্ত একসঙ্গে!”

আরও অপরার কণ্ঠে, সম্ভবত ঝিয়ের— “আর ও-আবাগী গরুও যেন টের পায় বাপু, নালিশ মুখে করেই আছে।”

ভগবতীচরণ রসিকলালকে বলিতেছেন— “মিলিয়ে যাবেন।…কিচ্ছু বলব না তো! দুদিন পরে যা হবে তা আজই হোক, ভগবতী-দাদার বেঁচে থাকতে থাকতেই।—রাস্তায় ঘাটে ঝাঁট পড়বে না, দোরে পড়বে না, গোয়ালঘরে ঢুকবে শুধু কেঁড়েভরে দুইবার সময় —সমস্ত অনাচার যদি একসঙ্গে না এসে পড়ে!—এসে পড়ে কি, পড়েছে এসে…”

কণ্ঠস্বর যেমন চড়াইয়া দিয়াছেন, বেশ বোঝা যায় শুধু রসিকলালকে সাক্ষী মানাই উদ্দেশ্য নয়।…বাড়িটার সমস্ত শব্দ একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেছে, গরুটার ‘নালিশ’ পর্যন্ত। মনে হয় যেন তিনজনেই সব কাজ ফেলিয়া তাঁহার তদারক লইয়া পড়িয়াছে।

বড় কৌতুক বোধ হইতেছে রসিকলালের। রেলের চরখির নিকট হইতে পাড়ায় প্রবেশ করিয়া তিনি যেন একটি নূতন জগতে আসিয়া পড়িয়াছেন। ভগবতীচরণ যাহাই বলুন, রসিকলাল পাড়ার অনেকখানি তো অতিক্রান্ত করিয়া আসিলেন—রাস্তা, ঘাট, বাগান, এমনকি মুক্ত দ্বার দিয়া অনেক বাড়ির ভিতরেও তাঁহার যেটুকু নজর গেল, কোথাও এতটুকু আবর্জনা চোখে পড়িল না। সব তকতকে ঝকঝকে করিয়া পরিষ্কৃত। শুধু তাহাই নয়—সব বাড়িতেই পুজোর আয়োজন আছে বলিয়া বোধ হইল; ক্বচিৎ ঘণ্টির আওয়াজের সঙ্গে সমস্ত পাড়াটির হাওয়া ধূপ ধুনা আর মৃদু পুষ্পসৌরভে বোঝাই হইয়া আছে। কোন বাড়ির পাশ দিয়া যাইতে যাইতে মন্ত্রপাঠের শব্দ কানে আসিতে লাগিল। শুচিতায়, সৌন্দর্য্যে, পবিত্রতায় রসিকলালের কবিমন জায়গাটাকে যেন একটা স্বপ্নালোক বলিয়া মনে হইতেছিল। না পরিচয় লইয়া ভটচার্য্যি পাড়ায় পৌঁছিয়া যাওয়ার অর্থটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতেছেন,—ভগবতীচরণের ধ্যানে এরই একটা পূর্ণতর রূপ আছে নিশ্চয়। সে-পরিকল্পনা যে কী তাহা জানিবার উপায় নাই, তবে সামনে যাহা কিছু দেখিতেছেন শুনিতেছেন, সমস্ত যেন একসূত্রে গাঁথা;—রাস্তা চলিতে চলিতে মনে হয় না একটা পাড়ার মধ্য দিয়া চলিয়াছি,—মনে হয় একখানি বাড়িরই বিভিন্ন অংশ, গৃহকর্তা উঠান বাহিয়া, সব কিছুর সন্ধান লইয়া লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।…ভগবতীচরণ আসিতেছেন, স্নান করিয়া ফিরিবার সময় হইয়া গিয়াছে— চারিদিকেই একটা সন্ত্রস্ত ভাব; কিন্তু বেশ বোঝা যায় সেই সন্ত্রাসের সঙ্গে আছে একটি অপরিসীম শ্রদ্ধা, একটা পরম নির্ভরশীলতা, প্রাণঢালা দরদ না পাইলে যা সম্ভব হয় না।…এমন পাড়াও দেখেন নাই, আর সমস্ত পাড়ার উপর এমন আধিপত্যও দেখেন নাই। রসিকলালের মনটিও বিস্ময়, সম্ভ্রম আর শ্রদ্ধায় ভরিয়া আসিতে লাগিল।

কিন্তু তবু একটা অস্বস্তি লাগিয়াই রহিল কোথায় যেন। বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

খুব যে বড় বাড়ি এমন নয়, তবে বেশ খানিকটা জায়গা লইয়া। প্রথমেই সবুজ ঘাসে ভরা খানিকটা উঠান। তাহার পর একটি পাকা বৈঠকখানা, সামনে খানিকটা রক, তাহারই একপাশ দিয়া ভিতর বাড়ির রাস্তা চলিয়া গিয়াছে। ভিতর বাড়ি, বৈঠকখানা, মায় সামনের উঠানটি পর্যন্ত একটা টানা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ওদিকে পাড়ার লোকদের সন্ত্রস্ত বলিয়া মনে হইতেছিল, এখানে আসিয়া মনে হইল সমস্ত বাড়িটাই যেন নিজেকে সূক্ষ্মতম আবিলতা হইতে বাঁচাইয়া তটস্থ হইয়া আছে।— ভগবতীচরণ স্নান করিয়া ফিরিতেছেন।

দুইজনেই গিয়া রকের উপর উঠিলেন।—ভগবতীচরণ বলিলেন— “আপনি গিয়ে বসুন, আমি ততক্ষণ পুজোটা ঝট করে সেরে আসি।—আর পুজো! —যা বিঘ্ন পদে পদে! মধুও এক্ষুনি এসে পড়বে, এই সময় পাড়ায় একটু দেখাসাক্ষাৎ করতে বেরোয়, ডাকতেও পাঠাচ্ছি।”

নিজে আর ঘরে প্রবেশ করিলেন না, রক থেকে নামিয়া ভিতরের দিকে চলিয়া গেলেন।

বোধ হয় দুয়ারের নিকট হইতেই প্রশ্ন করিলেন,–-“কৈ রে, হ’ল পুজোয় জো’টা?”

বেশ একটি ঝঙ্কৃতকণ্ঠে উত্তর হইল— “নাঃ, হয়ে আর কাজ কি? তুমি পাড়া তদারক করে বেড়াও, মেজাজও আগুন হয়ে উঠতে থাকুক, ঠাকুরও শুকোতে থাকুক।…আজ খুব বেশি বেলা করে ফেলেছ।”

যাহারই কণ্ঠস্বর হোক, সে যেন উন্মুখ হইয়া ছিল। রসিকলাল উৎকর্ণ হইয়া উঠিলেন,– বাড়িতে কলহ অশান্তি আছে নাকি? আর কিন্তু কোন তরফেই কোন কথা শোনা গেল না।

বৈঠকখানায় একটা বড় তক্তপোষের উপর টানা ফরাস বিছানো, গোটাকতক তাকিয়া ধারে ধারে বসানো আছে। তক্তপোষের পাশেই একটি লম্বা কাঠের বৈঠকে গোটাকতক হুকা বসানো, কোনটাতে একটা কড়িবাঁধা, কোনটাতে দুইটা, কোনটাতে বা তিনটা; গোটাদুই নিরাভরণ। পাশেই একটা আলাদা বৈঠকে একটি সুদৃশ্য আলবোলা। একধারে সায়েববাড়ি থেকে কেনা গদি-আঁটা চারখানা ভাল ভাল কেদারা, একটা সাধারণ কাঠের সীট দেওয়া চেয়ার, একটা ভাল আলমারি। দুইখানি তাকে বই,—পদ্মপুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, চৈতন্যচরিতামৃত, মেঘনাদবধ কাব্য, এন্ট্রেন্স ক্লাসের কতকগুলি পাঠ্যপুস্তক, একখানি টেনিসনের বাঁধানো ভ্যলুম। বাকি দুইটি তাকের মধ্যে একটিতে পিতল কাঁসার কয়েকখানি সুদৃশ্য বাসন—দুইখানি রূপারও। একটিতে কিছু কাচকড়া আর মাটির পুতুল। দেয়ালে খানকতক দেবদেবীর ছবি আর দুইখানি বিলাতি ল্যান্ডস্কেপ্।

পরিবারটি পুরাতনপন্থী, ভগবতীচরণই তাহার সাক্ষী, তবুও রসিকলালের মনে হইল কোন্ দিক দিয়া নূতন হাওয়াও যেন একটু প্রবেশ করিয়াছে। রসিকলাল নিজে যে কোন্ দিকে বলা শক্ত, তাঁর জীবনের মধ্যে ডাক্তার বেশে নিজেও আছেন—নূতনের প্রতীক, আবার পণ্ডিতমশাইও আছেন। আসল কথা তাঁর কবি-মন অভিনবত্ব খোঁজে, নূতনে-পুরাতনে যেখানেই পায়—সঙ্গে সঙ্গে কল্পনাপ্রবণ হইয়া পড়ে।…বেশ লাগিতেছে বাড়িটি, পাড়াটি, নুতন সুরে ভরা আজিকার সমস্ত প্রভাতটিই চমৎকার বোধ হইতেছে।…ওই দুয়ার দিয়া, ওই সবুজ দূর্বাদলের ঘাসের উপর কচি পা ফেলিয়া চেলি-পরা বধূ-বেশিনী গিরিবালা প্রবেশ করিল…এই তার বাড়ি—তেজপুরের মেটে ঘরে এতদিন মানুষ হইয়া ওঠা তাঁহাদের সেই গিরিবালা…কেমন দেখায় তাহাকে এখানে?… প্রতিদিনই দেখিতে না পাওয়ার জন্য অথচ নূতন জীবনে প্রতিদিনই বদলাইয়া যাইতেছে বলিয়া কতকটা যেন অপরিচিত, অথচ কত নিজের! শত যোজন দূরে থাকিলেও, শত যুগের অদর্শন ঘটিলেও গিরিবালা কি এতটুকু আলাদা হইবার? আশ্চর্য!…গিরিবালার হয়তো একদিন এই সামনের আলমারিটা খোলার দরকার হইবে…খানিকটা বড় হইয়াছে, চাবির থোলোটা হাতে লইয়া চাবিটা বাছিয়া লইল… গিরিবালার নিজের আলমারি, শখ হইয়াছে একটা নূতন কি পুতুল রাখিবে, কিংবা প্রয়োজন হইয়াছে—শৌখিন একটা রেকাবি বাহির করিতে হইবে…

একটা চাকর আসিয়া প্রবেশ করিল। পশ্চিমা চাকর। ভাঙা বাংলায় প্রশ্ন করিল— “বাবু তামাক সাজিয়ে আনবো?”

রসিকলাল সম্মতি দিতে গড়গড়া, একটা কলিকা আর একটা ডিবার মধ্য হইতে একটু তামাক ও খান দু-এক টিকা লইয়া ভিতরে চলিয়া গেল।…ব্যাঘাত পাইয়া কল্পনার সূত্র ছিন্ন হইয়া গেল, তাহার জায়গায় আসিয়া পড়িল একটু দুশ্চিন্তা,—ভগবতীচরণ লোকটি কি রকম?—একটু বোধ হয় কোপনস্বভাব,…একটু নয় বিলক্ষণই। এই অল্পটুকু আসিতেই যতটা দেখা গেল, বেশ উৎসাহ মনে হয় না। আর, এ শুধু রাস্তা দিয়া আসা অনাত্মীয়দের কোথায় কি ত্রুটি হইয়াছে তাহার খোঁজ লইতে লইতে; নিজের বাড়িতে, পরিপূর্ণতার মধ্যে কি স্বরূপ ভগবতীচরণের? ভগবতীচরণকে অতিক্রম করিয়া গিরিবালাকে এ-বাড়িতে আনিয়া ফেলা যাইবে কি? সেও পরের কথা, আপাতত তিনি এমন কোপনস্বভাব লোকের সঙ্গে কথাবার্তাই বা চালাইবেন কি করিয়া? একে এমনই শক্ত, তাহার উপর আবার দেখাইতে হইবে তিনি রাশভারি, তিনিও কম কড়া লোক নহেন।—পণ্ডিতমশাই যে রাস্তা একেবারে বাঁধিয়া দিয়াছেন!

একদিকে লোভ, আশা আর একদিকে ভয়; ভগবতীচরণের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো যদি নেহাতই অসম্ভব না হয় তো খুব শক্ত তো নিশ্চয়ই, সমস্ত রাস্তায়, একটু কথা বলিবার সাহস হয় নাই। এদিকটা যতই ভাবিতেছেন, মনটা ততই অস্বস্তিতে ভরিয়া আসিতেছে। শুধু যে মনে হইতেছে পণ্ডিতমশাই আসিলে ছিল ভাল এইটুকুই নয়, নিরুপায় মনটা পণ্ডিতমশাইয়ের উপর এক-একবার বিরূপ হইয়া উঠিতেছে,—নিজে আসিতে পারিলেন না অথচ রাশভারি বলিয়া রসিকলালের পরিচয় দিয়া এক ফ্যাসাদ বাধাইয়া বসিলেন!…

আবার সব ঠেলিয়া গিরিবালা আসিয়া উপস্থিত হইতেছে। সে যে আসিবেই, এ যে তাহারই বাড়ি,—পণ্ডিতমশাইয়ের গণনা তো মিথ্যা হইবার নয়; কাতুদিদির ওখানকার ফাঁড়াটা কাটিয়া গেল কি করিয়া?—শরতের মেঘের মতো দেখিতে দেখিতে আকাশে যেন মিলাইয়া গেল!

আর ভগবতীচরণ লোকটা ভালোই, শুদ্ধাচারী, পরহিতব্রতী।…’পরহিতব্রতী!’…মনে ওঠামাত্র এই কথাটিকে যেন দশ অঙ্গুলি দিয়া আঁকড়াইয়া ধরিলেন। গিরিবালা লইয়া পণ্ডিতমশাই যতই জোরের কথা বলুন না কেন, আসলে রসিকলাল কন্যাদায়গ্রস্তই তো? পরহিতব্রতী লোকেরই তো দরকার তাঁহার।

এই সমস্যা যদি বা মিটিল আর একটা সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়া উঠে। ভগবতীচরণের কথার উত্তরে যে ঝঙ্কার দিয়া উঠিল সে কে? গিরিবালার শাশুড়ি নয় নিশ্চয়, তবে? …

চিন্তায় তাহার বাধা পড়িল। সদর দরজা দিয়া আর এক ব্যক্তি প্রবেশ করিলেন। ভগবতীচরণের মতই চেহারা, তবে শরীরটা আরও বলিষ্ঠ, রংটা আরও মাজা। পাত্রের পিতা, আর সন্দেহ নাই। উদ্বেগে রসিকলালের সমস্ত অন্তরাত্মা যেন কণ্ঠে আসিয়া জড়ো হইয়াছে।

ভিতরেই যাইতেছিলেন, বৈঠকখানার দিকে নজর পড়ায় দাঁড়াইয়া পড়িলেন, তাহার পর ধীরে ধীরে উঠিয়া আসিয়া প্রশ্ন করিলেন— “কোথা থেকে আগমন হচ্ছে মশাইয়ের?”

রসিকলাল উত্তর করিলেন— “বেলে-তেজপুর থেকে।”

কথাটা যেন আগন্তুককে সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরে আকর্ষণ করিয়া লইল, ফরাসে উপবেশন করিতে করিতে বলিলেন— “বেলে-তেজপুর থেকে? পণ্ডিতমশাই পাঠিয়েছেন?”

আগ্রহটা দেখিয়া অকূলে কূল পাইলেন, উত্তর করিলেন— “আজ্ঞে হ্যাঁ, পণ্ডিতমশাই পাঠিয়েছেন।”

“নমস্কার। তবে তো…কখন এলেন আপনি?”—ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন।

রসিকলাল প্রতি-নমস্কার করিলেন, বলিলেন— “মিনিট পনের-কুড়ি হবে। আপনি মধুসূদন মুখোপাধ্যায় মশাই?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছে?”

“হয়েছে, তিনি নেয়ে ফিরছিলেন, একসঙ্গেই এলাম।”

মধুসূদনের মুখটি এক মুহূর্তেই শুকাইয়া গেল। ঐ রকম জেদি, কড়া-প্রকৃতির লোক, তাহার উপর গোড়াতেই দাদা তাঁহাকে একলা বসাইয়া গেলেন, অভ্যর্থনায় এত বড় একটা ত্রুটি হইয়া গেল! কয়েক মুহূর্ত কী যে বলিবেন ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলেন না; তাহার পর দাদার বিলম্বের জবাবদিহি হিসাবে কহিলেন— “দাদা আসবে এখুনি। আসল কথা, নাওয়ার পরই তাঁর পুজোটা সেরে নেওয়া চাই-ই, মনটা যাতে কোন রকমে চঞ্চল হয়ে না উঠতে পারে আর কি।”

একটু হালকাভাবে হাস্য করিয়া বলিলেন— “সামান্যতে একটু চটে যান কিনা, রাস্তায় আসতে আসতেই সেটা টের পেয়েছেন নিশ্চয়?”

টের যথেষ্ট পাইয়াছেন; রসিকলাল মধুসূদনের পানে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। হাস্যে যোগদান তো করিতেই পারিলেন না, অস্বস্তির ভাবটা যেন ভিতরে ভিতরে বাড়িয়া গেল। বলিলেন— “আমি ওবেলা আসব’খন একটু ঠাণ্ডা পড়লেই। কাছেই দু-একজন আত্মীয়-স্বজন আছেন।…নিশ্চয়ই, পুজোটা আগে সেরে নেবেন বৈ কি,—মনস্থির করে…”

মধুসুদনের মুখের ভাবটা এমন হইল যেন যেটি আশঙ্কা করিয়াছেন, ঠিক সেইটি ফলিয়া গেছে। বলিলেন— “উঠিলেন? না; সে কি হয়? এতক্ষণ যখন দায় করে বসেছেন…এসে যদি আবার দেখেন আপনি নেই তাহলে আমার ওপর যে…পুজোর পরেও এক-একদিন মেজাজটা বিগড়ে থাকে কিনা…”

পুজোর পরেও!…দাদার পূর্ণ পরিচয় রসিকলাল তাহলে এতক্ষণ পান নাই,—ভিতরের আতঙ্কে একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন— “ওঠা..মানে, ওবেলা তো আসছিই…বাড়িটা দেখা রইলই…”

একটা অসহ্য অবস্থায় দাঁড়াইয়াছে, থাকা একেবারেই চলে না; অথচ ভাল একটা ছুতোও যোগাইতেছে না, মনের এরকম গোলমেলে অবস্থায়।

মধুসূদন নিজেও দাঁড়াইয়া উঠিলেন— “না; সে কোন মতেই হতে পারে না; একটু তামাকও খেলেন না; দাদা আমার আর কিছু বাকি রাখবেন না; ভয়ানক বদরাগী লোক, আপনি জানেন না। তায় আসতে আসতে আজ আবার আরও বেশি চটে রয়েছে…”

তাহার কারণটাও রসিকলাল কতকটা নিজে!— “জো নেই থাকবার মশাই; বাড়িটা একবার শুধু দেখে নিতে এসেছিলাম—সেটা হয়ে রইল, আবার আসছিই তো বিকেলে”—বলিয়া আবার একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া পা বাড়াইয়াছেন, – বেয়াড়া রকম রাগী আর একবগ্গা লোককে লইয়া মধুসূদনের অবস্থা বর্ণনার বাহিরেই—এমন সময় এক হাতে গোটাকতক গোলাপ আর গন্ধরাজের চারা লইয়া ও অন্য হাতে একটি মেয়েকে ধরিয়া একটি যুবক সদর দরজা দিয়া প্রবেশ করিল। মধুসূদন ক্ষণমাত্র কি চিন্তা করিয়া লইয়া ডাক দিলেন— “বিপিন এদিকে এসো একবার, গাছগুলো ঐখানেই রেখে দাও।”

রসিকলাল আর এক পা বাড়াইয়া ছিলেন, যুবকের পানে নজর পড়িতেই থামিয়া গেলেন। উঠান বাহিয়া আসিতে যতটুকু সময় লাগিল ঠায় চাহিয়া রহিলেন। ঐটুকু সময়ের মধ্যে বিস্ময় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কী একটা অনির্বচনীয় ভাবে তাঁহার মুখটা দীপ্ত হইয়া উঠিল। মধুসূদন চকিতে একবার দেখিয়া লইলেন।

যুবক দুয়ারের কাছে আসিয়া প্রশ্ন করিল— “কি বাবা?”

মধুসূদন বলিলেন— “একে প্রণাম কর।”

যুবক একটু কুতূহলী দৃষ্টিতে ক্ষণমাত্র রসিকলালের পানে চাহিয়া দেখিল, তাহার পর প্রণাম করিয়া দাঁড়াইয়া মধুসূদনকে প্রশ্ন করিল— “ডাকছেন আমায়?”

“তোমার জেঠামশাইয়ের পুজো হল কিনা দেখো একবার।”

যুবক চলিয়া গেলে রসিকলালের মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন— “এইটিই আমার বড় ছেলে।”

দরকার ছিল না, তবুও রসিকলালের পক্ষে ফিরিয়া আবার বসাটা সহজ করিয়া দিবার জন্যই বলিলেন— “না, একটু বসে যেতেই হবে আপনাকে।

বেশ ভাল করিয়া গড়গড়া প্রভৃতি ধুইয়া পশ্চিমা চাকরটা তামাক আনিয়া হাজির করিল।

দুই বৈবাহিকের প্রথম সাক্ষাৎ দুই পরিবারের মধ্যে একটি স্মরণীয় ঘটনা, এই বৈঠকখানাকেই কতবার হাস্যমুখরিত করিয়া তুলিয়াছে।

মধুসুদন বলেন— “আরে, আমার কাছে পণ্ডিতমশাই গেয়ে রেখেছেন, মস্ত বড় জিদে, রাগী, রাশভারী লোক, দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছে অথচ একলাটি বসিয়ে দাদা পুজো করতে লেগে গেছেন, পনের-কুড়ি মিনিট হয়ে গেছে…আমার তো আক্কেল গুড়ুম। মুখের দিকে চেয়ে দেখি মুখ একেবারে বর্ষার মেঘের মতো থমথম করছে। হবে না? একে মানী লোক, এমনি তটস্থ হয়ে থাকতে হয়, তার ওপর এই অভ্যর্থনা!…আমি কি করে জানব, বেহাই এদিকে দাদার গতিক—গাতাক দেখে একেবারে থ মেরে গেছেন?… দেখছি—মানী লোকের যতই মান ভাঙাবার চেষ্টা করি, সে ততই ভেতরে ভেতরে ওঠে ক্ষেপে—বেহাই যে ওদিকে দাদা আসবার আগেই পিঠ বাঁচিয়ে পিঠটান দিতে চান…”

হাসির হররা ওঠে…

রসিকলাল লজ্জিতভাবে হাসিতে হাসিতে বলেন— “আমি তো ছিলাম সামলে-সুমলে একরকম,—’রাগী, বদরাগী, আজ আবার বেশি চটে আছেন’—এইসব বলেই তো বেহাই আমায় আরও ঘাবড়িয়ে দিলেন।… সাত্ত্বিক মানুষ, নেয়ে মনটি শুদ্ধ করে পুজোয় বসবার জন্যে আসছেন, আর হবি তো হ’ আমিই ভটচার্য্যি-পাড়ার কথা জিগ্যেস করে দিয়েছি খিঁচড়ে মনটা! হয় সাহস আর বসে থাকতে?…বেহাইয়ের পিঠ শক্ত, অমন দাদা থাকলে হয়ই শক্ত, সবার তো আর তা নয়…’

হাস্যের তরঙ্গ আবার উচ্ছ্বসিত হইয়া ওঠে।

.

ভগবতীচরণ যখন প্রবেশ করিলেন, দেখিলেন দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। রসিকলাল গড়গড়া সেবন করিতেছিলেন, সদ্যত্যক্ত নলটার মুখ দিয়া ধোঁয়ার একটা ক্ষীণ রেখা বাহির হইতেছে, মধুসুদন মাথাটা নিচু করিয়া ফরাসের উপর নখ দিয়া ধীরে ধীরে আঁক কাটিতেছেন।… ভিতরকার কথাটা এই যে মধুসূদন আর ঘাঁটাইতে সাহস পাইতেছেন না, ওদিকে ছেলেটিকে চোখে দেখা পর্যন্ত রসিকলালের সমস্যা আরও ঘোরালো হইয়া উঠিয়াছে—ছাড়িয়া যাওয়াও অসম্ভব, বসিয়া থাকাও দুষ্কর।

ভগবতীচরণ আসিয়া সম্পূর্ণ কাঠের যে চেয়ারটি তাহার উপর উপবেশন করিলেন। পায়ে খড়ম, গায়ে একখানি রেশমের নামাবলী। মুখের পানে চাহিয়া রসিকলাল একটু বিস্মিত হইলেন। পূজার পূর্বের সেই একটা বিরক্তির ছাপ, দৃষ্টির সেই চাঞ্চল্য আর ক্রমাগতই ছিদ্রান্বেষণের কৌতূহল—সেসব যেন একেবারেই নাই, তাহার জায়গায় বেশ একটি স্থির প্রসন্ন ভাব।…সাঁতরার লোকেরা ভগবতীচরণের এই দু’ধরনের রূপের সঙ্গে খুব পরিচিত; বলে,—ভগবতীঠাকুর গঙ্গা থেকে শুদু দেহটাকে স্নান করাইয়া আনেন, পূজায় করান আত্মার স্নান, তখন তাঁর পূর্ণরূপ ফুটিয়া ওঠে। মধুসুদন রসিকলালকে যে বলিয়াছিলেন,— দাদার মেজাজ এক-একদিন পূজার পরও বিগড়াইয়া থাকে সেটা সম্পূর্ণ বানাইয়া বলিয়াছিলেন, নিজের গঞ্জনার কথা বলিয়া রসিকলালকে আটকাইয়া রাখিবার জন্য।

ভগবতীচরণ মধুসূদনের দিকে চাহিয়া বলিলেন— “মধু নিশ্চয় শুনেছ, ইনি বেলে-তেজপুর থেকে আসছেন?”

মধুসূদন যেন একটা জড়তা কাটাইয়া উঠিলেন, বলিলেন— “হ্যাঁ, আলাপ পরিচয় হ’ল। ইনিই মেয়ের বাপ!”

“বাঃ, বড় আনন্দের কথা।”

একটু হাসিয়া বলিলেন— “কিন্তু আলাপে একটু বেশি মেতেছিলে বলে বোধ হচ্ছে। ওঁর এখনও জামাজোড়া খোলা হয়নি, হাত-পা ধোওয়া হয়নি। প্রজাপতি যদি যোগাযোগ ঘটান তো অভ্যর্থনা-সৎকার সম্বন্ধে বৈবাহিককে একটু নিরাশই হতে হবে দেখছি।”

বেশ পণ্ডিতী চালের ঘর-কাঁপানো একটি হাসি হাসিয়া উঠিলেন। তাহাতেই ঘরের গুমোট ভাবটা একেবারে কাটিয়া গেল। রসিকলাল, মধুসুদন—এঁরা দুজনেও কতকটা লজ্জিতভাবে হাসিতে যোগদান করিলেন। চাকরটাকে ডাকিবার জন্য মধুসূদন উঠিলে ভগবতীচরণ বলিলেন— “আর আহারও উনি এখানেই করবেন,—সাঁতরা আর বেলে-তেজপুর এপাড়া ওপাড়া নয়।”

বৈঠকখানা হইতে ভিতরে যাইবার একটা দুয়ার আছে; সেইটা খুলিয়া মধুসূদন চাকরকে ডাক দিলেন, আহারের কথা শুনিয়া নিজেই ভিতরে যাইতেছিলেন। ভগবতীচরণ বলিলেন— “সে সব আমি বলে এসেছি, তুমি বসো এসে।”

পশ্চিমা চাকরটা আসিয়া, জুতা খুলিয়া খড়মে পা বসাইয়া, জামা উড়ানি আলনায় টাঙাইয়া রাখিয়া স্নানাদির সরঞ্জাম করিয়া দিল এবং তাহার পর বেশ পরিপাটিভাবে তৈলমর্দন শুরু করিয়া দিল। এই সবেরই ফাঁকে ফাঁকে উভয় পক্ষের খানিকটা বংশ পরিচয় হইয়া গেল, খানিকটা পারিবারিক পরিচয়ও। যদিও আসল কথাটা পাড়া হইল না, তবুও সমস্তই বেশ অনুকূল বলিয়া বোধ হইতেছে, একটি প্রীতি আর আত্মীয়তার ভাব সংলাপকে স্নিগ্ধ করিয়া তুলিতেছে। তেলমাখা শেষ হইয়া আসিলে ভগবতীচরণ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন— “আপনি তাহলে এবার স্নানাহ্নিক সেরে নিয়ে একটু জলযোগ করে নিন।” তাহার পর নিজের পেটে হাতটা একবার বুলাইয়া বলিলেন— “আমারও জঠরাগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছেন, তাঁকে ঠাণ্ডা না করলে অব্যাহতি নেই। আসছি আমি এক্ষুনি।”

সেই ধরনেরই অপেক্ষাকৃত মৃদু হাস্য করিতে করিতে ভিতরে চলিয়া গেলেন। তখনই আবার ফিরিয়া আসিয়া দুয়ারটা একটু খুলিয়া মধুসূদনকে বলিলেন— “একটু দেখো মধু ওঁকে, কুটুম্বিতার পূর্বেই কুটুম্বিতার ত্রাস জন্মে দিও না যেন।”

হাসিতে হাসিতে দুয়ার ভেজাইয়া চলিয়া গেলেন।

একটা অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে খানিকক্ষণ কাটাইতে হইয়াছিল বলিয়াই পরস্পরে মনের প্রকৃত পরিচয় পাইয়া দুই বেহাইয়ের আলাপ, আর সেই আলাপের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা বেশ জমিয়া উঠিল। মধুসূদনের আশ্চর্য বোধ হইতেছে, পণ্ডিতমশাই যে লোকের পরিচয় দিয়াছিলেন তাঁহার কাছে সে লোক কই? এ তো যতই দেখিতেছেন, যতই শুনিতেছেন, ততই নিতান্ত একটি শিশুর মত সরল প্রকৃতি তাঁহার সামনে উদ্ঘাটিত হইয়া উঠিতেছে। মধুসূদন নিজে সতর্ক লোক, একটা গোটা নীলকুঠির প্রায় হর্তা-কর্তা-বিধাতা,–একদিকে সাহেব আর অন্য দিকে আমলা প্রজা থেকে সামান্য মজুরটির পর্যন্ত মেজাজ, গতিবিধি আর চরিত্রের হিসাব রাখিয়া চলিতে হয়; তবুও এই অনাড়ম্বর মনের সংস্পর্শে আসিয়া তিনি বিবাহ লইয়া তাঁহার আগ্রহের কথা তো প্রকাশ করিয়া ফেলিলেনই, তাহা ভিন্ন অন্য বিষয়েও কিছু রাখিয়া ঢাকিয়া বলিতে পারিলেন না। নিজের ঘটনাবহুল জীবনের অনেক কথাই এই নব-পরিচিতের নিকট ব্যক্ত করিয়া ধরিলেন। তাহাতে এও প্রকাশ হইয়া পড়িল যে দূর বিদেশে, নিতান্ত এক পাড়াগাঁয়ে বাঙালী বলিতে সপরিবারে এক তিনিই, অনেক সুবিধার সঙ্গে অসুবিধাও বিস্তর, পথও বেশ সুগম নয়;—আরও অনেক কথা, বৈষয়িক হিসাবে যা সব লুকাইয়াই রাখা সঙ্গত ছিল,—বিবাহ যেখানে নির্বাসনেরই নামান্তর, কে আর জানিয়া শুনিয়া সেখানে অগ্রসর হয়? এক ঝোঁকে সমস্ত বলিয়া গিয়া বোধ হয় একটু ভয়ও হইল, পাকা বিষয়ী মনই তো? একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই রসিকলালের মুখের পান দু-একবার চাহিলেন….কোন ভাবান্তর উপস্থিত হইল কিনা লক্ষ্য করিবার জন্য। পণ্ডিতমশাইয়ের পরামর্শ মতো এইখানে একটু ‘রাশভারী’ হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল রসিকলালের, বলার রাস্তা ছিল—’তাই তো মশাই, একটু ভাবিয়ে তুললেন যেন…দেখতে হচ্ছে ভেবে-চিন্তে একটু…এতটা যে তা তো জানতাম না’…অন্তত—’পণ্ডিতমশাইকে একবার জিগ্যেস করে দেখি, বিচক্ষণ লোক তিনি…’

সে ধরনের তো কিছু বলিলেনই না, বরং মনের আনন্দে একেবারে উল্টা কথা বলিয়া দিলেন; ঈষৎ হাস্যের সহিত মধুসূদনের মুখে সমস্তটা শুনিয়া গিয়া বলিলেন— “আমি তাই মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছিলাম—পণ্ডিতমশাই বললেন কিনা— ‘রসিক, মেয়ের সবই ভাল—পিতৃকুল, শ্বশুরকুল উভয়কুলই সমুজ্জ্বল করবে, তবে ঐ এক কথা— মেয়ের বিবাহ বহুদুরে, হুট করে যে চাইবে একবার দেখে আসি মেয়েকে সেটি হবার জো নেই’….আচ্ছা কাছে-পিঠে হিমালয়ের কোন অংশ পড়ে কিনা বলতে পারেন কি?”

রসিকলাল স্মিত হাস্যের সহিত চাহিয়া আছেন,—মধুসূদন মনে মনে একটু হিসাব করিতে করিতে বলিলেন— “দাঁড়ান, তা কাছেই বলতে হবে বৈকি, শীতকালে আকাশ একটু পরিষ্কার থাকলেই আমরা বরফঢাকা চূড়াগুলো দেখতে পাই; একটু বৃষ্টি হয়ে গেলে যেদিন আকাশ বেশি পরিষ্কার থাকে, ঝলমল করতে থাকে।”

রসিকলাল উল্লসিত হইয়া উঠিলেন, কহিলেন,— “বললাম না?—অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে; বললেন, ‘হিমচক্রের মধ্যে তোমার গিরির বিয়ে হবে…মেয়ের নাম হল গিরিবালা – হিমচক্র হ’ল হিমালয়ের পঞ্চাশ ক্রোশ পর্যন্ত জায়গা, এর পরেও মেয়ে আমার দূরদেশে পড়ল বলে দুঃখু করা চলে? আপনিই বলুন না?”

পণ্ডিতমশাইয়ের একটা কথা মধুসূদনের মনে পড়িয়া গেল— “সামান্য একটু খুঁত থাকলে পিছিয়ে পড়বে…ওর চেয়ে জনকরাজা ঢের সুবিবেচক ছিলেন মশাই।”

আগ্রহ সহকারে প্রশ্ন করিলেন— “তাহলে আপনার আর অমত নেই ধরে নিতে পারি তো?”

রসিকলাল পণ্ডিতমশাইকে একেবারেই ভুলিয়া গেলেন, হাসিয়া খুব বিজ্ঞের মতো বলিলেন— “অমত! এখন ভালোয় ভালোয় আপনাদের জিনিস আপনাদের দিয়ে নিশ্চিন্দি হতে পারলে বাঁচি মশাই; এ যেন পরের বোঝা মাথায় করে রয়েছি।”

স্নান-আহ্নিকের পর জলযোগ করিতে করিতে কথাটা আরও এক ধাপ অগ্রসর হইল। প্রসঙ্গটা উঠিল ঘিয়ের কথা লইয়া। মধুসূদন বলিলেন— “হালুয়া, লুচি, নিমকি ওসবই ওখানকার ঘিয়ে ভাজা, স্বাদটা একটু লক্ষ্য করে দেখবেন।”

রসিকলাল লুচিতে মুড়িয়া খানিকটা হালুয়া মুখে তুলিতেছিলেন, বিস্মিত আনন্দে বলিয়া উঠিলেন— “তাই নাকি! বাঃ, এ তো চমৎকার যোগাযোগ! গিরিকে গিয়েই বলতে হবে, গিরি, তোর আসল শ্বশুরবাড়ির ঘি খেয়ে এলাম…সাঁতরা যদিও মূল, তবু সেই তো এখন কার্যত ওর আসল শ্বশুরবাড়ি? কি বলেন?”

এমন সরল প্রকৃতির মানুষকে পণ্ডিতমশাই-এত উগ্র বলিয়া পরিচিত দেওয়ায় মধুসূদনের মনে মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন না জাগিতেছিল এমন নয়। আপত্তি করিবেন কি, – রসিকলালই তো বরং কথাটা আগাইয়া লইয়া যাইতেছেন। পণ্ডিতমশাই তাহা হইলে অমনভাবে বলিলেন কেন?—হয়তো রসিকলালকে বেশি অন্তরঙ্গভাবে জানেন না, নয়তো যে অত কড়া তার একটু উগ্রত্বেরও তো পরিচয় পাওয়া যাইত। কথাবার্তার মধ্যে এইটুকুও এক সময় পরিষ্কার হইয়া গেল। রসিকলাল বলিলেন— “আর কি করে যে আমি কাটান্ দিয়ে আসছি তা পণ্ডিতমশাই নিশ্চয়ই বলে থাকবেন আপনাকে। ভাল ভাল সব সম্বন্ধ এসেছে। ঝুলোঝুলি, রসিক ঠিক তার গোঁ ধরে বসে আছে। এই তো দু’দিন হয়নি—আমার শালি—নিজের শালি আমার, তার বৈমাত্র দেওরপোর জন্যে বাড়ি এসে সে হত্যে দেবার মতো; মেয়ের গর্ভধারিণীকে, জেঠাইকে, এমন কি আমার দাদাকে পর্যন্ত হাত করে নিলে—মেয়েমানুষ এসব বিষয়ে কিরকম পোক্ত জানেনই তো; আমি সেই নিজের কোট ধরে বসে আছি। দাদা আমায় বাইরের ঘরে ডেকে পাঠালেন, একলা, জানেনই বড্ড একবগ্‌গা লোক আমি, বললেন— ‘গিরির বিয়ের ঠিক করে ফেলেছি আমি, কাতুর দেওরপোর সঙ্গে।’

“ভয়ঙ্কর রোখা লোক দাদা, অস্বীকার করব না, আমিও এখন পর্যন্ত সবসময় মুখ তুলে কথা কইতে ভরসা পাই না,..স্পষ্ট বললাম—‘ওখানে গিরির বিয়ে দাদা! তোমরা যে অবাক করলে—!’…‘কেন, আপত্তিটা শুনি? তোর মেয়ে বলে তোর জোর?’

“ভয়ানক একরোখা লোক, একবার যা ঠিক করে ফেলেছেন সে-সম্বন্ধ নড়-চড় করে কার সাধ্যি। তা আমিও তো কম যাই না, বললাম—’জোরের কথা হচ্ছে না, তুমি থাকতে আর আমার কিসের জোর? তবে গিরির কুষ্টিটা একবার দেখো, ওখানে কি ওর…’”

দুয়ার খুলিয়া ভগবতীচরণ প্রবেশ করিলেন, প্রশ্ন করিলেন— “জলযোগ হল আপনার একটু?… কুষ্টির কথা হচ্ছিল?”

কল্পনার দাদার সঙ্গে স্পষ্টভাবে কথা বলিতে পারায় রসিকলালের মনটা আরও স্ফূর্ত হইয়া উঠিয়াছে, মধুসুদনের পানে চাহিয়া হাসিয়া বলিলেন…“তা বলতে গেলে একরকম কোষ্ঠীবিচারটুকুই শুধু বাকি আছে…”

মধুসূদন বলিলেন— “আমি তোমায় বলছিলাম না দাদা? যদি সুবিধে হয় তো বিয়েটা একেবারে দিয়েই যাব। দিন পনের তো এখনও হাতে আছে ছুটির, একটা আটুই একটা তেরোই দিন আছে বলছিলে না তুমি? আজ ছউই হ’ল, আটুইটা তো হতেই পারে না, যদি সম্ভব হয় তো তেরোই…”

ভগবতীচরণ হাসিয়া উঠিলেন, অনেক বিবাহ দেওয়াইয়াছেন, তাঁর অত ত্বরিত আর অত অসতর্ক হইলে চলে না, বলিলেন— “তুমি যে শিশুর মতো কথা কইছ মধু। আমাদের হিন্দুর বিবাহ, এ তো বর কনে কোন রকমে গির্জায় একবার গিয়ে উঠতে পারলেই হল না। উভয় পক্ষের ভালো রকম করে পরিচয় নিতে হবে, ছেলে দেখা আছে, মেয়ে দেখা আছে, ভালো করে কোষ্ঠীবিচার আছে, আশীর্বাদ আছে…যেগুনো করণীয় সব করতে হবে তো?”

প্রবল আবেগের মধ্যে উপদেশের আকারে প্রায় এই ভর্ৎসনাটুকুতে উভয়েই যেন ভিতরে ভিতরে একটু অপ্রতিভ হইয়া পড়িলেন; রসিকলাল, ভগবতীচরণ আসিয়াই কোষ্ঠীর উল্লেখ করায় কোষ্ঠীটা প্রায় বাহির করিয়া দিতে যাইতেছিলেন, চাপিয়া গেলেন।

ভগবতীচরণ রসিকলালকে প্রশ্ন করিলেন— “কি বলেন? এগুনো সব তো রপ্ত করতেই হবে?”

রসিকলাল সঙ্গে সঙ্গে খুব ভারিক্কে হইয়া উঠিলেন, বলিলেন— “তা করতে হবে বৈকি, হিন্দুর ঘর! তা করতে হবে না? বাঃ!”

মধুসূদন বলিলেন— “না, আমি বলছিলাম, যেগুনো দরকারী সেগুনো সেরে যদি দেখা যায় যে যোগাযোগ হচ্ছে তো এই ঝোঁকেই কাজটা সেরে যেতাম একেবারে, আবার সেই চার শ মাইল ঠেলে আসা সহজ নয় তো? না আটুই হল, তেরোই রয়েছে, না—তেরোই, আরও না হয় হপ্তাখানেক ছুটি বাড়িয়ে নিলাম।”

ভগবতীচরণ বলিলেন— “তাতে আপত্তি করছি না, সম্ভবের মধ্যে যতটা তাড়াতাড়ি পারো করো না তুমি। ছেলে উনি দেখে যাচ্ছেন, তুমি একদিন গিয়ে মেয়ে দেখে এসো। ইতিমধ্যে কোষ্ঠীবিচার হোক, কোষ্ঠীটা কি এনেছেন উনি সঙ্গে করে? না হয় গিয়েই পাঠিয়ে দেবেন।”

রসিকলাল একটু যেন স্মরণ করিবার ভঙ্গীতে বলিলেন— “কোষ্ঠীটা কি দিয়েছে সঙ্গে? আনলেই হতো তবে, আমি আবার বারণ করে দিলাম, বললাম—’দাঁড়াও, আগে দেখাশুনা হোক, পরিচয়াদি হোক, তাড়াতাড়ি তো কোষ্ঠী নিয়ে বসলেই চলবে না।’…দাঁড়ান্ দেখি, দিয়ে দিয়েছে কি না ভুল করে?”

উঠিয়া যে পকেটগুলায় না থাকিবার কথা সেইগুলায় প্রথমে দেখিলেন, তাহার পর কোটের বুক পকেট থেকে কতকটা নির্লিপ্তভাবেই কোষ্ঠীটা বাহির করিয়া ভগবতীচরণের হাতে দিয়া বলিলেন— “যাক, দিয়েই দিয়েছে দেখছি।”

ভগবতীচরণ কোষ্ঠীটা মনে মনে পাঠ করিতে লাগিলেন, ইহারা দুইজনে মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। ভগবতীচরণের মুখে এক-একটি সূক্ষ্ম রেখা ফুটিয়া তখনই মিলাইয়া যাইতেছে। রসিকলাল বিশেষ কিছু বুঝিলেন না, তবে মধুসূদন দাদাকে চেনেন, তাঁহার আর সন্দেহ রহিল না যে কোষ্ঠীটায় খুবই অসাধারণ কিছু একটা আছে, মুখে বিস্ময়, প্রশংসা আর আনন্দের ভাব উঠিতে না উঠিতেই জ্যেষ্ঠ সংবৃত করিয়া লইতেছেন। শেষ করিয়া অনুচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলিলেন— “কোষ্ঠীটি বেশ ভালই দেখছি। কে তোয়ের করেছেন?”

রসিকলাল নাম বলিলেন।

“বেশ পণ্ডিত লোক। এইবার একবার বিপিনের কোষ্ঠীর সঙ্গে দেখতে হবে। আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি, তোমরা ততক্ষণ গল্প-সল্প করো।”

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে ভগবতীচরণ আবার প্রবেশ করিলেন।

ভগবতীচরণ অভ্যর্থনা-আতিথ্যে যতই মুক্তচিত্ত, আর কৌতুকপ্রবণ হন, বিষয়-সম্পর্কীয় কথায় খুব সংযত; এটাও ভুলিবার লোক নন যে তাঁহারা বরপক্ষীয়। যখন প্রবেশ করিলেন, মধুসুদন লক্ষ্য করিলেন খুব যেন একটা বড় আনন্দ আর আবেগকে চাপিবার চেষ্টায় মুখটা রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, ভগবতীচরণ যেন একটু কাঁপিতেছেন। চেয়ারে আসিয়া বসিতে মধুসুদন প্রশ্ন করিলেন— “কেমন দেখলেন দাদা?”

“উ?” বলিয়া ভগবতীচরণ মাথা নিচু করিয়া একটু চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার পর মুখ তুলিয়া বলিলেন— “তোমার যদি এতই তাড়া থাকে তো একটা শ্রম আমি লাঘব করে দিতে পারি।”

দুজনে উৎসুক নেত্রে তাঁহার পানে চাহিলেন। ভগবতীচরণ আর বরপক্ষীয়ের গাম্ভীর্যটা রক্ষা করিতে পারিলেন না; নিজের মনের আনন্দটাকে যেন পূর্ণ মুক্তি দিয়াই রসিকলালের পানেই চাহিয়া বলিলেন— “আমাদের আর মেয়ে দেখবার প্রয়োজন হবে না, একেবারেই গিয়ে আশীর্বাদ করব।”

দুজনে বিস্মিতভাবে চাহিতে বলিলেন— “অদ্ভুত যোগাযোগ, প্রায় শতাধিক বিবাহ আমি নিজের হাতে দিয়েছি, এমনটি চোখে পড়েনি।”

বিস্মিত-প্রফুল্ল দৃষ্টিতে খানিকটা মধুসূদনের মুখের পানে, খানিকটা রসিকলালের মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন, তাহার পর রসিকলালকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন— “এখন আমার একটা অনুরোধ আছে আপনার কাছে।”

কথাবার্তার এরকম আকস্মিক পরিবর্তনে, রসিকলালের মনটাও যেন হঠাৎ চড়া সুরে বাঁধিয়া দিয়াছে, ব্যগ্রকণ্ঠে বলিলেন— “সে কি, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, অনুরোধ করবেন!”

ভগবতীচরণ বলিলেন— “তাতে দোষ নেই, সম্বন্ধটা একবার দাঁড়িয়ে গেলে তো হুকুমই করব—যেমন মধুকে করি।…মিলিয়ে দেখলাম, এদের যেমন রাশিচক্র তাতে গ্রহ-সংস্থানে সামনের এই আট তারিখের দিনটাই প্রশস্ত। বড় সুন্দর যোগাযোগ, আমার আর একটুও খুঁত রাখবার ইচ্ছে নেই। তাই বলছিলাম যদি বিশেষ আপত্তি না থাকে তো আপনি ছেলেকে আজই আশীর্বাদ করে যান—দুটো থেকে চারটের মধ্যে একটি লগ্ন আছে ভাল।”

একটু থামিয়া রসিকলালের মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন— “তার মানে পরশু একদিনেই মেয়ে আশীর্বাদ, গায়ে হলুদ, বিবাহ,—তাও দুপুর থেকে নিয়ে রাত্রি একটার মধ্যে।”

এতবড় একটা কাজ একটিবার মাত্র আসিয়া একেবারে সম্পন্ন করিয়া যাইতেছেন— রসিকলালের জীবনে ইতিপূর্বে কখনও এমন ঘটে নাই; বাড়ি গিয়া জাঁক করিয়া বলিবার কথা। এতটা উত্তেজিত হইয়া গিয়াছেন ভিতরে ভিতরে যে বন্দোবস্তটার মধ্যে যে কতটা অসঙ্গতি-অসুবিধা আছে একবার ভাবিয়া দেখিতে পারিলেন না। আগ্রহ সহকারে বলিলেন— “এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। যোগাযোগ ভাল থাকে একদিনই সব সেরে নিতে হবে।”

ভগবতীচরণ বলিলেন— “অসুবিধে হবে বেশ একটু, তবে কি জানেন?—আমরা হলাম ঋষির বংশধর মশাই, কাজের মধ্যে লগ্ন আর মন্ত্রটা ঠিক থাকলেই হ’ল, আড়ম্বর যতটা হ’ল, হ’ল;—যা হয়ে উঠল না, তার জন্যে আপশোস কিসের?”

কয়েক বৎসর পূর্বেকার কথা, এক সময় নিতান্ত অজ্ঞাতসারেই গিরিবালার মন খেলাঘরের পুতুলের সংসার থেকে গুটাইয়া আসিল। সে কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাটে হইতে পারিল না, দেখিল দুইটি শিশু তাহার জন্য যেন অপেক্ষা করিয়াই বাহিরে দাঁড়াইয়া আছে, বাপ আর জেঠামশাই।…মা ছোট ভাইটির কল্যাণে ‘মঙ্গলবার’ ব্রত করে—অর্ধোপবাস, মুখটি বাৎসল্যের বেদনায় যেন শুকাইয়া থাকে সমস্ত দিন। মনে হয় মা যেন আরও বেশি করিয়া মা হইয়া ওঠেন।…গিরিবালা একদিন জেঠাইমাকে একান্তে পাইয়া কোলে মুখ গুঁজিয়া আবদারের সুরে বলিল-”আমিও মঙ্গলবার করব জেঠাইমা।” জেঠাইমা আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিলেন— “সে কি রে, তুই কার জন্যে মঙ্গলবার করতে যাবি?” গিরিবালা আরও মাথাটা গুঁজিয়া বলিল— “জেঠামশাইয়ের জন্যে।” সবার হাসিতে অপ্রতিভ হইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া ফেলিল, জেঠামশাইয়ের আদরে অনেকক্ষণ পরে চুপ করিল।

অনেকদিন পূর্বেকার কথা! তাহার পর কবে এক সময় গিরিবালার অন্তরের মা’টি কুণ্ঠিত চরণে এ দুই আধার থেকেও সরিয়া আসিল। সেবা উদ্বেগ সবই রহিল, কিন্তু সেই জিনিসটি রহিল না যাহার জন্যে ‘মঙ্গলবার’ করিবার আগ্রহ জাগিতে পারে। এই সময় একটি অসহায় বিড়ালশিশু কোথা থেকে আসিয়া জুটিয়া গিরিবালাকে আবার প্রায় পুতুলখেলার যুগে টানিয়া লইয়া গেল। বাবা জেঠামশাইয়ের মতো সে স্পষ্ট ‘মা’.বলিয়া ডাকিয়া সঙ্কোচ জাগাইতে পারে না বটে, তবে নিজের দৈন্যে, অসহায়তায় গিরিবালার মধ্যেকার মাতৃত্বকে নানাভাবে উদৃক্ত করিয়া আসিতেছে। সম্প্রতি আবার সে নিজেই পাঁচ-ছয়টি শিশুর জননী।

গিরিবালা পা ছড়াইয়া রাঙিকে কোলে লইয়া আদর করিতেছে, তাহার সন্তানগুলি লাঙ্গুলের পতাকা উড়াইয়া চারিদিকে লাফালাফি করিয়া বেড়াইতেছে, এমন সময় রসিকলাল ~ “গিরি কোথায় গো?”…বলিয়া উঠানে আসিয়া দাঁড়াইলেন। কন্যার দিকে নজর পড়িতে হাসিয়া বিড়াল-পরিবারকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন— “হ্যাঁ, খেয়ে নে আদর যত পারিস, আর ক’টা দিনই বা? বৌদিদি কোথায় রে গিরি?”

অন্নদাচরণ নিজের ঘরে ছিলেন, ডাকিলেন— “রসিক এলে? একবার এদিকে এসো।”

রসিকলাল গিয়া সম্মুখে দাঁড়াইতে প্রশ্ন করিলেন— “তুমি কার মুখে শুনলে?”

রসিকলাল কিছু বুঝিতে না পারিয়া বিমুঢ়ভাবে মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। অন্নদাচরণ বলিলেন— “ও! ঐ কথাটা বললে কিনা গিরিকে, আমি ভাবলাম বুঝি শুনেছ তাহলে।…ইয়ে, গিরির কথাবার্তা ঠিক করে ফেললাম, হরিপুরে; পরশু দেখতে আসবে।”

সমস্ত ব্যাপারটি নিম্নরূপ—

রসিকলাল প্রত্যুষে সাঁতরা যাত্রা করিলেন, বেলা প্রায় নয়টায় সময় নিকুঞ্জলাল অন্নদাচরণকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। নিজে তিনি পূর্বদিন সন্ধ্যার পর হরিপুর হইতে ফিরিয়াছেন।

দৃশ্য প্রায় পূর্ববৎই, বাঁ হাতে হুঁকা লইয়া তামাক খাইতেছেন, পাশে মকদ্দমায় কতকগুলি নথিপত্র জড়ো করা; আপাতত সামনে বেশ দীর্ঘ একটি কোষ্ঠীর উপর ঝুঁকিয়া তদ্‌গতচিত্তে কি অনুধাবন করিতেছেন। অন্নদাচরণ আসিতে একটু চোখ তুলিয়া দেখিয়া লইয়া বলিলেন— “বস।”

আবার সেইভাবেই ঝুঁকিয়া রহিলেন।

একটু পরে সোজা হইয়া বসিয়া আত্মগতভাবেই বলিলেন— “বাবাঃ, রাজা-রাজড়ার কুষ্টিই হল পঞ্চাশ হাত!”

অন্নদাচরণের পানে চাহিয়া একটু হাসিয়া বলিলেন— “তা দোষই বা দিই কেমন করে?— কলসী দিয়ে তো আর সমুদ্র মাপা যায় না।… কৈ দাও।”

—ডান হাতটা বাড়াইয়া দিলেন।

অন্নদাচরণ একটু বিস্মিতভাবেই প্রশ্ন করিলেন — “কি দাদা?”

নিকুঞ্জলাল বলিলেন— “কুষ্টিটা আনতে বলে পাঠালাম যে; নন্তীটা বুঝি ভুলে গেল বলতে? ওটা ঐ রকম।”

অন্নদাচরণ আগ্রহভরে প্রশ্ন করিলেন— “পারলেন ঠিক করতে কোনখানে দাদা?”

নিকুঞ্জলাল গম্ভীরভাবে বলিলেন— “যে কোনখানে ঠিক করলেই যদি নিকুঞ্জলালের মনস্তুষ্টি হত তো এতদিন কবে হয়ে যেত অন্নদা, কিন্তু তোমরা বিশ্বাস কর আর নাই কর, নম্ভীর চেয়ে গিরিকে বরং বেশি করেই দেখেছি; কখনও কম করে দেখিনি। আর যতদিন নিজের মনেও সামান্য খুঁতখুঁতুনি ছিল, তোমায় বরাবর জিগ্যেস করে গেছি—’ওহে অন্নদা পাত্রটি এই রকম, দেখ যদি পছন্দ হয়;—কিন্তু কৈ, এবারে তোমায় তো জিগ্যেস করতেও গেলাম না…

অন্নদাচরণ নিকুঞ্জলাল দ্বারা এদিকে বরাবরই উপকৃত হইয়া আসিয়াছেন, সামনে যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তাহাও নিকুঞ্জলালেরই হাতে, একটু লজ্জিতভাবে কতকটা খোসামোদের ভাষাতেই বলিলেন…”সে কি কথা দাদা, আপনি থাকতে আমরা কে?—জিগ্যেস করছেন সে ছোট ভাইয়ের পরামর্শ নেওয়া হিসাবে; আমি রসিককে জিগ্যেস করি না? তাই বলে সব পরামর্শই নিতে হবে এমন কোন কথা আছে?”

নিকুঞ্জলাল হুঁকায় মুখ বসাইয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন, বলিলেন— “তুলনাটা খুব সঙ্গত হ’ল না;—তোমার রসিকের সঙ্গে পরামর্শ করা আর আমার তোমার সঙ্গে পরামর্শ করায় অনেক তফাত,—তুমি হলে একজন—যাক, জিগ্যেস করিনি, আর করতে গেলে হাতছাড়াও হয়ে যেত, তোমায় একটা আভাস দিয়েছিলাম এর পূর্বে।”

আবার হুঁকায় মুখ দিয়া আড়চোখে চাহিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। অন্নদাচরণ বিমূঢ়ভাবে চাহিয়া থাকায় একটু স্পষ্টভাবেই হাসিয়া বলিলেন— “ঐ দেখো, ভোলানাথ ভাই আমার ভুলে বসে আছেন;—কেন, সেবারে হরিপুরের রাজার প্রসঙ্গে বললাম না—আরও একটা বড় মতলব ঠাউরে আছি?”

“কে?…কার সম্বন্ধে দাদা?”

অন্নদাচরণের প্রশ্ন করিতেও স্বরটা কাঁপিয়া গেল।

নিকুঞ্জলাল অবিচলিত কণ্ঠেই বলিলেন— “শোন কথা অন্নদার! খোদ পরেশ ছাড়া আর কার সম্বন্ধে মাথাব্যথা আমার?…বছর খানেক হ’ল রাণী মারা গেলেন…”

অন্নদাচরণ বাদ্ধ হইয়া চাহিয়া রহিলেন, দৃষ্টিও যেন ভাবলেশহীন।

নিকুঞ্জলাল ভান করিয়াই হোক আর প্রকৃতই হোক একটু আতঙ্কের সহিত প্রশ্ন করিলেন— “ভুল করলাম নাকি অন্নদা? আমি তো মনে করলাম ভাল একটা…”

অন্নদাচরণ সেইভাবেই বলিলেন— “না…ভুল…মানে, কথাটা কখনও ভেবে দেখিনি দাদা।”

প্রৌঢ় চল্লিশ বৎসরের…হয়তো আরও ঢের বেশি… বিপত্নীক–হয়তো বহুপত্নীকই—কে জানে অত ভিতরের কথা?…এ দিকে রাজা!…হরিপুরের রাজবাড়ি!…

অন্নদাচরণের চিন্তাটা কোন একটা জায়গায় স্থির হইয়া দাঁড়াইতে পারিতেছে না…অত্যন্ত আকস্মিক, কখনও যদি কল্পনার মধ্যেও আনিতেন তো যা হোক একটা মতামত লইয়া যৎসামান্যও প্রস্তুত থাকিতেন।…বলিলেন— “একটু ভেবে দেখি দাদা।”

নিকুঞ্জলাল গভীরভাবে, বেশ ক্ষুণ্ণ হইয়াই বলিলেন— “বেশ দেখ।”

কিন্তু পাকা খেলোয়াড় লোক, এ সমস্তই তাঁহার পূর্ব হইতে গণনা করিয়া রাখা। বেশি এবং নিরুপদ্রবে ভাবিয়া দেখিতে অবসর দিবার পাত্র নন তিনি। অল্প একটু বিরতি দিয়াই বলিলেন— “কিন্তু সেখানে যে রাজ্যে তার সমারোহ পড়ে গেছে—বড্ড ভুল করলাম তো।”

অন্নদাচরণের মনে ঝঞ্ঝা উঠিয়া মনটাকে তোলপাড় করিয়া দিতেছে; যদিও বাহিরে তাহার মাত্র এইটুকুই প্রকাশ যে দৃষ্টিটা কোনখানেই নিবদ্ধ করিতে পারিতেছেন না।…রাজ্যে সমারোহ। রাজ্যে সমারোহ!—রাজ্যে! —কথাটার মানে নেয় একপ্রকার ধরিতে পারিতেছেন—ঝঞ্ঝার মধ্যে ক্ষণিক বিদ্যুৎঝলকে।…তাঁদের গিরিবালা—এখন পর্যন্ত গায়ে একখানি ভালো গহনা ওঠে নাই। যে দিন কানের ওই হালকা দুল জোড়াটি পরিল—কী খুশী!—জেঠামশাই যেন সর্বাঙ্গ সোনা দিয়া মুড়িয়া দিয়াছে।…একখানা ভাল কাপড়ই কি দিতে পারিয়াছেন? স্মৃতি মথিত করিয়া হঠাৎ একটা ছবি ফুটিয়া উঠিল অন্নদাচরণের মনে,—এই এইবারেই সিংহবাহিনী পূজার সময়; নন্তীতে আর গিরিবালাতে একসঙ্গে সিংহবাহিনী তলা থেকে ফিরিতেছে;—দুই সখী, কত অন্তরঙ্গ, কিন্তু কত তফাৎ সাজসজ্জায়!….গিরিবালা নন্তীর কাপড়ের আঁচলটা তুলিয়া ধরিয়া কি বলিতে বলিতে আসিতেছে—দুর থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না, তবু যেন মনে হয় মুখে একটু লজ্জা, একটু মেয়েমানুষের লোভ…

দুপুর বেলা মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল— “নন্তীর কাপড়টার দাম সতেরো টাকা…বাবাঃ, সতেরো টাকা দাম!”

খানিকক্ষণ পরে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল— “জামাটা কিন্তু চার টাকাতেই হয়েছে… জেঠামশাই, ঘুমলে?”

অন্নদাচরণ আর বলিতে পারিলেন না—জাগিয়া আছেন।

নিকুঞ্জলালের হুঁকার একটানা আওয়াজ হইতেছে, মাঝে মাঝে এক-একটা টান দীর্ঘতর। সময় যেন আপন মনে নির্বিকারভাবে বহিয়া চলিয়াছে—কে নিজের কাজ গুছাইতে পারিল, কে পারিল না—এতটুকু ভ্রূক্ষেপ নাই।

অন্নদাচরণের চিন্তাটা একটু যেন দানা বাঁধিতেছে, তবে ঐদিক ঘেঁষিয়া,—কবে গিরি বঞ্চিত হইয়াছে, অভাবের সংসারে কবে মেয়ের মুখের পানে চাহিয়া তাঁহার ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাস পড়িয়াছে—এই সব। ওরই সূত্র ধরিয়া একটা বিশেষ দিকে চলিল,—দ্বিতীয় পক্ষের কথাটা তো তিনি এর পূর্বে ভাবিয়া দেখিয়াছেন, হ্যাঁ, এবার মনে পড়িতেছে,—ভাবিয়া দেখিয়াছেন ও সম্ভাবনার কথাটা মনে পড়িতেছে ভাবিয়া এই সিদ্ধান্তে পঁহুছিয়াছিলেন যে স্ত্রী সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া, আর, একটিকে হারাইয়া দ্বিতীয় পক্ষের পাত্ররা একটু বিবেচনাপ্রবণ, একটু মমতাপ্রবণ হয়—কন্যা একেবারে গৃহিণী হইয়া প্রবেশ করে বলিয়া, বিশেষ করিয়া যদি এক-আধটা সন্তান থাকে তো একেবারেই জননী হইয়া প্রবেশ করে বলিয়া সোজাসুজি খানিকটা প্রতিপত্তি, খানিকটা মর্যাদার মধ্য গিয়া দাঁড়ায়! মন্দ কি?…তারপর এই রাজত্ব, পুরাদস্তুর রাজত্ব না-ই হোক, একটা জমিদারি তো বটেই…

নিকুঞ্জলাল হুঁকা হইতে মুখ তুলিয়া বলিলেন— “পরেশ আমার সঙ্গেই একজন গোমস্তা পাঠিয়ে দিয়েছে, কুষ্টি-ঠিকুজি মিলিয়ে কি ফলাফল হল বলে পাঠাবার জন্যে। অবশ্য মেলানো আমার বহু পূর্বেই হয়ে গেছে, নইলে এগুতাম না—গিরিবালার কুষ্টি আমার মুখস্থ…দেখ ভেবে, নয় শুধু এটা ফেরত দিয়ে দিই।”

হুঁকার শব্দ আবার আরম্ভ হইল।

স্বপ্নশ্রুত কথার মতো নিকুঞ্জলালের কথাগুলা কানে কি একটা মোহ বিস্তার করিতেছে। ‘গোমস্তা!’—জমিদারির সঙ্গে আর কোন নাম বোধ হয় এত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়ানো নয়—অর্থে, প্রতিপত্তিতে জমজমে একটা গোটা জমিদারির রূপ যেন সামনে দাঁড় করাইয়া দেয় ..অন্নদাচরণ অনুভব করিতেছেন—লোকটাকে একবার দেখিবার ইচ্ছা মনে বলবতী হইয়া উঠিতেছে, তিনি মাত্র একবার ‘হ্যাঁ’ বলিলেই যে গোমস্তা গিরিবালার সামনে মাথা নত করিয়া দাঁড়ায়।

অন্নদাচরণের মনের ঝড় শান্ত হইয়া আসিতেছে। নিকুঞ্জলালের হুঁকার টান নিশ্চিন্ত আর মন্থর হইয়া আসিয়াছে,—মাছ ক্লান্ত হইয়া আসিলে ছিপের ঘূর্ণির পাকটা যেমন শ্লথ, নিশ্চিন্ত আর মন্থর হইয়া আসে। তবু পাকা খেলোয়াড়—ডাঙায় না ভিড়াইয়া একেবারে নিশ্চিন্ত হইবার লোক নয়; বলিলেন— “না; অমত হয় তাও বলে দাও, মনসাতলার রাজবাড়ির একটি মেয়ে নিয়ে এখন কথা চলছে—চুলটা একটু কটা বলে মনে খুঁৎ ধরিয়ে আটকে রেখেছি, সেইটেই ঠিক করুক। গোমস্তা চলে যাক এখুনি। না, মনে একটা খুঁতখুঁতুনি রেখে তোমায় আমিও মত দিতে বলব না। আমি একটু খাটো হলাম পরেশের কাছে—বেশ একটু, তা…”

অন্নদাচরণ এতক্ষণে কথা কহিলেন, বলিলেন— “একবার বাড়িতে বলে দেখি দাদা, মানে … “ নিকুঞ্জলাল মুখ থেকে হুঁকাটা বেশ খানিকটা সরাইয়া লইলেন, স্বরটা বেশ রুক্ষ করিয়াই বলিলেন— “এবার আমায় রাগতে হল অন্নদা। তুমি আমায় দাঁড়িয়ে অপমান করতে বসেছ, করাও, লোকের উপকার করবার প্রবৃত্তিটা আমার এইখানেই শেষ হোক, কিন্তু এর মধ্যে মেয়েছেলে ডেকে এনে আমার অপমানটা বাড়িও না। আমি জানি তোমার ভাইঝি, তোমার জোর আছে। তুমি হ্যাঁ, না—যা বলবে সেইটেই শেষ কথা; সেই ভরসাতেই আমি এ বোঝা ঘাড়ে করেছিলাম। তোমার নিজের মতিস্থির না থাকে, স্পষ্ট বলে দাও, বুঝব …”

অন্নদাচরণ মিনতির কণ্ঠে বলিলেন— “দাদা, আপনি রাগ করলেন; আমার সত্যি মতিস্থির নেই; আমায় জিগ্যেস করাই আপনার ভুল হয়েছিল। আপনি নিজের মতেই কাজ করুন।”

অনেকক্ষণ একেবারেই চুপচাপ গেল। নন্তী আদেশ অনুযায়ী আর এক ছিলিম তামাক দিয়া গেল, নিকুঞ্জলাল কখনও দ্রুত, কখনও মৃদু লয়ে টানিয়া যাইতে লাগিল, অন্নদাচরণ নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন। এত পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন যে পাছে স্ত্রীর পরামর্শ লইতেছেন বলিয়া নিকুঞ্জলালের সন্দেহ হয়, নিজে না গিয়া নন্তীকেই কুষ্টিটা আনিতে পাঠাইয়া দিলেন।

নন্তী চলিয়া গেলে নিকুঞ্জলাল একবার উঠিয়া বাড়ির ভিতর গেলেন। মুখটা একটু ভার-ভার রহিয়াছে। ভিতর থেকে যখন ফিরিলেন, হাতে একটি ছোট বান্ডিল। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলিলেন— “গোড়াতেই মনটা খিঁচড়ে দিলে ভাই, সব কথা আনন্দ করে বলবারই অবসর পেলাম না। তোমাদের জন্যেই করে মরি, আমার আর কি স্বার্থ বল? এই ধরো, একশ টাকার করে পাঁচখানা নোট আছে। হাত গুটিও না, ধরো, এর মধ্যে এতটুকু অপমানের কিছু নেই। আমি তোমায় জানি না—যে অপমানের টাকা হাতে তুলে দোব? আর তোমার যে-টাকায় অপমান সে-টাকায় কি আমারই মান বাড়বে? আড়াইটি হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল, স্পষ্ট বললাম—’তুমি তাকে চেন না পরেশ, তোমার একটি পয়সায় সে হাত দেবে না। সে হলদে রঙে কাপড় চুবিয়ে, নো-শাঁখা দিয়ে মেয়েকে বিদেয় করবে। এর অতিরিক্ত তার ক্ষমতাও নেই, সে করবেও না, বড় খাড়া লোক।’ তখন হার মেনে বললে—’বেশ, একটা রফা করুন, লোক খাওয়ানো,—এই সবে তাঁর সাধ্যমত তিনি খরচ করবেন, কিন্তু আমার একটা মর্যাদা আছে তো? — বরযাত্রী সেইরকম নিয়ে যেতে হবে—আমার মর্যাদা রক্ষার জন্যে গ্রামেও তাঁকে সেইভাবে নেমন্তন্ন করতে হবে, তা ভিন্ন আশীর্বাদের একটা বড় হাঙ্গামা আছে—এ সবের জন্যে যে অতিরিক্ত খরচটা, সেটা তিনি ঘাড়ে করতে যাবেন কেন?’ অনেক তর্ক, পাকা লোক, একেবারে পরাস্ত করতে পারি কখনও?—শেষে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এই ক’টা টাকায় এনে ঠেকাতে পারলাম। নাও, সে তো ভুলও বলে নি কিছু—সত্যি তার মর্যাদাটুকুও রক্ষা হওয়া চাই, আর তার জন্যে তুমিই বা দণ্ড সইবে কেন?”

নন্তী ফিরিয়া আসিল, বলিল— “আসল কুষ্টিটা পাওয়া যাচ্ছে না। বড় কাকী বললেন -বোধ হয় সিমুরে পড়ে আছে। এই একটা ছিল, দিলেন।”

রাশিচক্রটার নকল, নিকুঞ্জলাল হাতে লইয়া বলিলেন— “দেখি, এইটেতেই এখন কাজ চলবে—তুমি ওটা আনিয়ে রেখো সিমুর থেকে। আর, ও কিছু দেখতে হবে না, গিরির কুষ্টি-ঠিকুজি আমার কণ্ঠস্থ, আমি গণনা ঠিক করে তবে কথা পেড়েছি। তবুও আপাতত এই দুটোই পাঠিয়ে দিই, যেখান থেকে পারুক সন্দেহ মিটিয়ে নিক।”

কয়েকবার হুঁকা টানিয়া যেন হঠাৎ মনে পড়িয়া গিয়াছে এইভাবে বলিলেন— “হ্যাঁ, ঠিক কথা, পরশু আশীর্বাদ করতে আসছে সব। এটা আমি নিজেই জোর করে বললাম, একটা পাকা কথা তো হয়ে থাক,—রাজারাজড়ার মন, বিশ্বাস কি?”

দাদার মুখে সংবাদটা শুনিয়া রসিকলাল শূন্য দৃষ্টিতে তাঁহার পানে চাহিয়া রহিলেন, একটু পরে প্রশ্ন করিলেন— “পরশু আশীর্বাদ করতে আসবে,—পরশুই?”

অন্নদাচরণ কিছু বিস্মিত হইলেন না; আর সব প্রয়োজনীয় প্রশ্ন ছাড়িয়া আশীর্বাদের সময়ের কথাটাই যে বড় হইবে ভাইয়ের কাছে ইহাতে একটু হাসি পাইলেও আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। বলিলেন— “বস রসিক, ঐখানটায়। বুঝেছি আশীর্বাদটা একটু তাড়াহুড়োর মধ্যে হচ্ছে, কিন্তু যাতে সেটা সামলে যায়, তার ব্যবস্থা হয়েছে। সব ভেবেটেবে দেখলাম রসিক, সামান্য একটু দোজপক্ষের আর একটু বয়েস হয়েছে বলে এমন সুবিধেটা পায়ে ঠেলা যুক্তিযুক্ত নয়। একটি বছর সাতেকের ছেলে আর একটি বছর তিনেকের মেয়ে, প্রথম পক্ষের এই আছে। কী আর এমন বল? মেলা নয়, তবে এক-আধটা ছেলেপুলে থাকাই ভাল বলে যেন আমার মনে হয়—একেবারে মা হয়ে ঢুকলে কদর বাড়ে খানিকটা। বয়েস—তা হয়েছে, তবে যতটা বয়েস তার চেয়ে একটু বেশি বড়ই দেখায়। ভেবে দেখলাম নিকুঞ্জদাদা যা বললে সেটা নিতান্ত অগ্রাহ্যির কথা নয়,—ভোগে আছে, শরীরের বাড়বাড়ন্ত আছে, বয়সের তুলনায় একটু বড় দেখতে হবেই। নিকুঞ্জদাদা নিজেকে দেখিয়েই বললে- ‘দেখ না, নিত্যি পেটের অসুখ, তার ওপর আবার সেই পেটের চিন্তাতেই দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো, চিকিৎসা নেই, শরীরের একটু তোয়াজ নেই—চুয়াল্লিশ বছরের মানুষটা চব্বিশ বছরের ছোকরা হয়ে রয়েছি।’…তা দেখলাম মিছে বলেননি নিকুঞ্জদাদা, আমরা কি পাই বাড়তে যে বড় দেখাবে?… তারপর দেখ বাড়িটা একেবারে ছিমছাম; একটি বুড়ো বোন আছে, তীর্থে-তীর্থেই ঘুরে বেড়ায়….”

রসিকলালের মনে হইতেছে বহুদূর হইতে যেন একটু গুনগুনানি ভাসিয়া আসিতেছে—মাঝে মাঝে তাহার এক-একটা কথা হইয়া উঠিতেছে স্পষ্ট—’সামান্য একটু দোজপক্ষের…বয়েস—তা হয়েছে…পেটের চিন্তাতেই…বুড়ো বোন…’

—এলোমেলো, কোন একটা মানে ধরা যায় না, মানে ধরিবার উৎসাহও নাই মনের যেন।

অন্নদাচরণ বলিয়া যাইতেছেন— “তবু মন খুঁতখুত যে একটু না করে এমন নয়, কিন্তু সেই সঙ্গে আবার অন্য দিকটাও দেখতে হবে তো?—অবশ্য ঐ যে রাজা রাজা হাঁক পড়ে গেছে ওটা কিছু নয়। ও কথাটা তোমার কাছে এযাবৎ ভাঙিনি, আজ ভাঙছি। রাজা—নিজের জমিদারিতে সবাই রাজা, সেই হিসাবে। আমিও ঐ কথাটাই ধরেছিলাম—দেখছি একটা লোক অযাচিতভাবে অনুগ্রহ করে যাচ্ছে, তাকে ছোট করতে যাই কেন? আর, আগে যাই করুক, এখন নিজের জেনেই এতটা করছে, নিকুঞ্জদাদাকেই বা আমার খেলো করবার কি দরকার? রক্তের সম্বন্ধ না হোক, পুরুষানুক্রম একটা সখ্যও তো রয়েছে ওঁদের সঙ্গে? উনি যদি গেয়ে বেড়ান উনি রাজগুরু তো পারতপক্ষে যোগান দেওয়াও দরকার আমাদের নয় কি? বিষয়ী লোককে আবার সব দিক বজায় রেখে চলতে হবে তো?…কিন্তু ভেতরকার কথা তা নয়। এবার গিয়ে আমি কতক কতক খবর নিয়ে এলাম তো? ভাগাভাগি হয়ে এখন পরেশের ভাগে হাজার পনের দাঁড়ায়; লাটের দেনা, খরচ-খরচা বাদ দিয়ে সাত-আট হাজার টাকা বাঁচে বছরে। এই; কিন্তু এও কি সোজা হল?…বংশটা বোনেদী—এক সময় বোধ হয় কেউ ছিল রাজা, তাই সব শরিকেই রাজা…

একটা উত্তর পাইবার জন্য থামিলেন। না পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— “কি বল তুমি?”

রসিকলাল শূন্য দৃষ্টিতেই উত্তর করিলেন— “অ্যাঁ!”

অন্নদাচরণ ভাইয়ের মুখের পানে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন— “বলছিলাম যতটা খবর পেলাম খরচ-খরচা বাদ দিয়ে বছরে নিট্ হাজার সাত-আট বাঁচে—সেও তো কম হ’ল না?”

রসিকলাল বলিলেন— “না, কম কি করে?…বলছিলাম আশীৰ্বাদটা কিছুদিন পিছিয়ে দিলে হত না?”

অন্নদাচরণ বুঝিলেন এতদূর তাতিয়া পুড়িয়া আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভাইয়ের কাছে এতবড় গুরুতর কথাটা পাড়া ঠিক হয় নাই, একে চঞ্চল মনই। হাতে যা টাকা রহিয়াছে তাহাতে একটা পাকা দেখা মেটানোর পক্ষে দুইটা ঘণ্টাই যথেষ্ট, কিন্তু সে কথা আর তুলিলেন না। বলিলেন— “সে তোমায় ভাবতে হবে না, তবে কালকের দিনটা আর বেরিয়ে কাজ নেই; দরকারও আছে, পরামর্শও আছে। এখন তুমি হাত পা ধুয়ে একটু ঠাণ্ডা হও গে। হল, যা করতে গিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ, হয়েছে।”—শুষ্ককণ্ঠে কোনরকমে জবাবটা দিয়া রসিকলাল চলিয়া গেলেন।

ভয়ে তাঁহার হাত পা কাঁপিতেছে। সন্ধ্যা হইয়া গেছে, বিড়াল ছাড়িয়া গিরিবালা বিছানা গুছাইতে আরম্ভ করিয়াছে। রসিকলাল ঘরে প্রবেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— “বৌদি কোথায় রে গিরি—ও কোথায়?”

হরিচরণ একটা পড়ার বই লইতে আসিয়াছিল, বলিল— “তাঁরা দুজনেই নিকুঞ্জজেঠার বাড়ি গেছেন বাবা, ডেকে আনব?”

“ডেকে আনবি?…আচ্ছা যা…শিগগির একছিলিম তামাক সেজে আন তো মা গিরি।”

বিছানায় চাদরটা ফেলিয়া দুইটা হাত পিছনে দিয়া বিছানার উপরই বসিয়া পড়িলেন।

গিরিবালা একটু আড়চোখে বিস্মিতভাবে চাহিল, তাহার পর কলিকা লইয়া তামাক সাজিতে যাইবে, রসিকলাল হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন— “কি করি এখন বল দিকিন গিরি?”

সঙ্গে সঙ্গেই উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন— “থাক তামাক, এক্ষুনি আসছি আমি। বৌদিকে তোর কিছু বলে কাজ নেই।”

দাদা আওয়াজটা যাহাতে না টের পান এইভাবে নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেলেন।

পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে যাইতেছেন, তাঁহার কথা যে এতক্ষণ কেন মনে পড়ে নাই। কবিতার মিল নির্ণয় থেকে সংসারের খুঁটিনাটি পর্যন্ত সব সমস্যার সমাধান পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে।…আর তিনিই না বলিয়াছিলেন যে সঙ্কট আসিবেই; দময়ন্তীর বিবাহেও আসিয়াছিল, কিন্তু কাটিয়া যাইবে।…সত্যই তো বিবাহ যেথায় হইবার পাকা হইয়া গেছে, ওদিক দিয়া আর ভয় কি?…এখন এই সময়টুকু কাটাইয়া উঠিতে পারিলেই হয়, পণ্ডিতমশাই আছেন।…মনটা অনেক শান্ত হইল।

পথে মনে পড়িয়া গেল পণ্ডিতমশাইয়ের তো আজই দশটার গাড়িতে কৃষ্ণনগরে যাইবার কথা ছিল। তবুও অগ্রসর হইলেন, যদি কোন কারণে আটকাইয়া গিয়া থাকেন—নিতান্ত যদি কোন কারণে। আসিবার সময় ঘুরিয়া চিনিবাসের দোকান হইয়া আসিলেন, নহিলে তো দেখাই করিয়া আসিতেন পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে।

পণ্ডিতমশাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হইল। কণ্ঠস্বরকে সংযত করিবার চেষ্টা করিয়া প্রশ্ন করিলেন— “আজ সকালের গাড়িতে চলে গেছেন পণ্ডিতমশাই, মা?”

“কৈ আর যেতে পারলেন বাবা?”

বিশ্বের যত আশা একটি মুহূর্তের মধ্যে যেন আসিয়া জড়ো হইয়াছে। প্রশ্ন করিতে সাহস হইতেছে না; পণ্ডিতমশাইয়ের স্ত্রী একটু বিরতি দিয়াই অনুযোগের কণ্ঠে টানিয়া টানিয়া বলিতে লাগিলেন…”সকালের গাড়িতে আর কৈ যেতে পারলেন? একজন শিষ্যি এসে পড়ল। এই বিকেলের একটু আগে বেরুলেন, সমস্ত রাত যারপরনেই নিগ্রহ—নৈলে নাকি সময়ে পৌঁছন…ওকি, তোমার শরীরটা খারাপ নাকি রসিক?”

রসিকলাল অবসন্নভাবে শানের একটা বেঞ্চে বসিয়া পড়িয়াছেন, বলিলেন— “না মা, অনেকটা হেঁটে এলাম কিনা, একগ্লাস জল দিন তো।”

একটু মিষ্টি সংগ্রহ করিয়া জল আনিতে একটু বিলম্ব হইল, পণ্ডিতমশাইয়ের স্ত্রী আসিয়া দেখিলেন রসিকলাল চলিয়া গেছেন।

রসিকলালের নিকুঞ্জদাদার কথা মনে পড়িয়া গেছে। এমনি লোকটাকে এড়াইয়া চলেন, বিশেষ যে কোন কারণ আছে তা নয়, শুধু খুব বুদ্ধিমান লোকদের সঙ্গ কেমন অস্বস্তিকর বলিয়া মনে হয়। দেখা হইলে নিকুঞ্জলাল ভাল উপদেশই দেন। সেইজন্য আরও ভয় হয়। কিন্তু মনে পড়িল এ সমস্যায় আপাতত নিকুঞ্জলালই একমাত্র লোক যে বাঁচাইতে পারে। অবশ্য বাঁচানো মানে আশীৰ্বাদটা পিছাইয়া দেওয়া। আর আশীর্বাদটা কাল একজন লোক পাঠাইয়া পিছাইয়া দিলেই তো বিপদটা কাটিয়া যায়, কেননা পরশু সাঁতরা থেকে ওঁরা আসিলেই—রসিকলাল সামনে থাকিতে পারুন বা নাই পারুন ওখানকার আশীর্বাদের কথা, আরও সব কথা, আপনি প্রকাশ হইয়া পড়িবে। অবশ্য যে কোন অবস্থাতেই প্রকাশ হইয়া পড়িবে, তবে হরিপুরের লোকেরা আসিয়া পড়লে যে দৃশ্যটা দাঁড়াইবে তাহা কল্পনা করিতেও রসিকলালের হৃৎকম্প উপস্থিত হয়।

নিকুঞ্জলাল স্থায়ী পেটের দুর্বলতার জন্য সকাল সকাল আহার করিয়া শয়ন করেন, বিলম্ব হইয়া যাইতে পারে বলিয়া রসিকলাল আর অপেক্ষা করিলেন না।

নিকুঞ্জলাল বাহিরেই ছিলেন, এবং একলাই ছিলেন। খুব আদর করিয়া বসাইলেন, বাছা বাছা উপদেশ দিলেন।—সংসারটা কি, এখানে কবিতারই বা কি মূল্য, টাকারই বা কি মূল্য, এইবার একটু সুবিধা ভগবান করিয়া দিলেন—নিকুঞ্জলাল তো নিমিত্তমাত্র—একটা বড় সহায় হইল, এইবার নিজের কাজ গুছাইয়া লওয়া। একটি ভাইঝি তো বিবাহের উপযোগী হইয়া উঠিল—মামার বাড়ি থাকে বলিয়া মামারা তো সব ভার উঠাইয়া লইবে না, তা ভিন্ন আবার কন্যা হইবে, তাহাদেরও বিবাহ দিতে হইবে, ভগবান তো রোজই সুবিধা করিয়া দিতেছেন না—পুরুষকারও চাই—ভগবান গীতায় কত জায়গায় সে কথা কতভাবে বলিয়া গিয়াছেন…

রসিকলাল মাথা নিচু করিয়া সব শুনিয়া গেলেন, শেষকালে প্রশ্ন করিলেন— “বলছিলাম আশীর্বাদটা কিছুদিন পেছিয়ে দেওয়া যায় না?”

হুঁকা নিকুঞ্জলালের হাতে ছিল, খুব দ্রুত বোল তুলিতে লাগিলেন, ওরই মধ্যে কয়েকবার আড়চোখে রসিলালের পান চাহিয়া রহিলেন, তাহার পর কহিলেন— “হয়, তবে তোমার দাদার পরামর্শে পরশুই ঠিক করেছি। অবশ্য তুমিই হচ্ছ মেয়ের বাপ, এখানে তোমার মতের সামনে দাদার মত কিছু না, তা বল তো না হয়…”

রসিকলাল বলিলেন— “না, তাহলে থাক। দাদা যখন বলেছেন…”

চলিয়া গেলে নিকুঞ্জলাল দুয়ারের পানে মুখটা ঘুরাইয়া মৃদু হাস্যের সহিত বলিলেন— “সাতগেঁয়ের কাছে মামদোবাজি! এখুনি হাঁড়ি আলাদা করিয়ে দিতে পারি জানেন না!”

রসিকলাল বাগান পারাইয়া রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। মনের অবস্থা একেবারে উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়াইয়াছে। বেশ রাত হইয়া গেছে, কিন্তু বাড়ি ঢুকিতে সাহস হইতেছে না। যেভাবে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে, গেলেই একটা জবাবদিহির মধ্যে পড়িয়া যাইতে হইবে। অথচ মনটা পরশুকার ব্যাপার লইয়া এমন ব্যাপৃত রহিয়াছে যে একটা জবাবদিহি গড়া হইয়া উঠিতেছে না। কেমন যেন একটা জিদও ধরিয়া গিয়াছে, একটা উপায় না করিয়া ফিরিবেন না—নহিলে পরশু যে সৰ্বনাশ!

একবার একটা কথা মনে পড়িয়া মনটা যেন উল্লসিত হইয়া উঠিল—একটা চিঠি পাঠাইয়া দিলে কেমন হয়?—নিকুঞ্জদাদা লিখিতেছেন…লেখা চেনা?―না হয়, বড় ব্যস্ত, অন্যকে দিয়া লিখাইতেছেন— “হঠাৎ কোন কারণে আশীর্বাদটা কয়েকদিন বন্ধ রাখিতে হইল, পরে তারিখ জানাইতেছি…” চিঠির চেয়ে টেলিগ্রাম?—সেই ভাল—সঙ্গে সঙ্গে পঁহুছিবে, আর—আর হাতের লেখার হাঙ্গামা নাই!—ঠিখ, একটা টেলিগ্রাম— “আশীর্বাদ স্থগিত রহিল, পত্রে সব জানাইতেছি।”—পরশু তো এই করিয়া কাটুক….

সঙ্গে সঙ্গেই মনটা অবসন্ন হইয়া পড়িল—না, চলবে না ওসব—কোনমতেই চলিবে না- নিকুঞ্জদাদার কাজ—এ সামান্য সম্ভাবনার কথা আর আন্দাজ করে নাই সে?…চলিবে না…চলিবে না—শুধু ধরা পড়িয়া একটা কেলেঙ্কারি…

ভাংচি?—না, নিকুঞ্জদাদা জানে রসিক এ-সবই করিবে, আটঘাট বাঁধা আছে।…যে দিকেই দৃষ্টি যায় নিকুঞ্জদাদা দাঁড়াইয়া—হুঁকা হাতে, মুখে ক্রুর হাসি…পদে পদেই ঠোক্কর খাইয়া রসিকলাল যেন ক্রমেই দিশাহারা হইয়া উঠিতেছেন।

নিশিতে পাওয়ার মতো পথ ঘুরিয়ে ঘুরিতে এক সময় হঠাৎ হারাণের কথা মনে পড়িয়া গেল।

.

রাত্রি বারোটার কম নয়, সমস্ত গ্রাম নিষুপ্ত, রসিকলাল হারাণের বাড়ির সামনে গিয়া দাঁড়াইলেন। সমস্ত দিনের মেহনতে, উদ্বেগে শরীর একেবারে অবসন্ন। দুইবার ডাকিতে গিয়া কথা বাহির হইল না, গলা একেবারে শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেছে, তৃতীয়বারে যখন শব্দটা বাহির হইল তখন নিজেই যেন চমকিয়া উঠিলেন। হারাণের ছেলে আর মা বাহির হইয়া আসিল। এত আশ্চর্য তাহারা জীবনে কখনও হয় নাই। প্রয়োজন শুনিয়া উত্তর করিল—হারাণে তো তাঁহাদের বাড়িই গেছে, সাতু আর নিকুঞ্জলালের ঝি আসিয়া ডাকিয়া লইয়া গেছে। রসিকলাল বলিলেন— “ও, তাহলে গেছে? আমিই ডেকে পাঠিয়েছিলাম, ডেকে অন্য জায়গায় চলে গেছলাম।”

এ উপস্থিত বুদ্ধিটুকু যে কোথা থেকে যোগাইল, নিজেই বিস্মিত হইয়া গেলেন, চিন্তা করিবার ক্ষমতা তখন আর একেবারেই নাই। বোধ হয় খুব চরমে আসিলে বুদ্ধির এই একটা ঝলক খেলিয়া যায়।

“বেশ, তোরা শুগে যা,” – বলিয়া ফিরিয়া একটু অগ্রসর হইয়াছেন, হারাণের সঙ্গে দেখা। হারাণ যেন ভূত দেখিয়াছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটু চাহিয়া রহিল, তাহার পর কথা কহিল ‘ছোট বাবাঠাকুর! আমি সমস্ত গাঁ ঘুরে বেইরেছি, কোথায় ছেলে? বাড়িতে যে ভেবে সারা হচ্ছে সবাই!”

রসিকলালের ভাবটা ঠিক উল্টা—হারাণকে দেখিয়াই অর্ধেক ভাবনা যেন চলিয়া গেছে, অনেকটা শান্ত কণ্ঠে বলিলেন— “সে হচ্ছে, আগে তোর সদর ঘরটা খোল দিকিন একটু; এক গেলাস জল, আর একটু তামাকের ব্যবস্থা কর। তোর মা ছেলে সব জেগে আছে, যেন টের না পায়।”

ঘরটা বেশ খানিকটা তফাতে; হারাণ খুলিয়া দিয়া কুলুঙ্গিতে একটা টেমি জ্বালিয়া দিল, ক্ষীণ আলোয় ঘরটা উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতেই রসিকলাল একটা স্মিত হাস্যের সহিত চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া লইলেন, বলিলেন— “ঠিক সেই রকম আছে দেখছি।”

হারাণ বলিল— “এদানি পুবদিকে একটা জানালা ফোটালাম, আর সব সেই রকম‍ই আছে।…দাঁড়াও বাবাঠাকুর, তোমার সেই মোড়াটা বের করে দিই।”

চৌকির নিচে হইতে একটা মোড়া বাহির করিয়া ঝাড়িয়া-ঝুড়িয়া সামনে পাতিয়া দিল। বলিল— “তোমার সেই মোড়াটা বাবাঠাকুর।…শুধু জল খাবে?”

রসিকলাল মোড়াটার উপর ধীরে ধীরে হাত বুলাইতেছিলেন, বলিলেন— “কি আছে?…আজ কতদিন পরে এলাম বল দিকিন এ ঘরে?”

হারাণ বলিল— “তা হ’ল বৈকি, সেই কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে যাবার আগে এসেছ, তারপরে এই।…তা আছে, আজ রামীর শ্বশুরবাড়ি থেকে তত্ত্ব এয়েছেল, কিন্তু সে-সব মার ঘরে, জানাজানি হয়ে যাবে। আমার ঘরে বোধ হয় মুকুন্দ-মোয়া আছে, রামীর ছেলেটা রেত-বিরেতে বায়না ধরে কিনা, ওর দিদিমা যুগিয়ে রাখে।”

“তাই আন। গোল করিসনি কিন্তু।”

বহুদিন পূর্বের সেই স্কুল-জীবন, আর স্কুল-ছাড়া নিরুদ্বেগ জীবনের একটা দিন এই নিষুতি রাতে কেমন করিয়া আসিয়া গিয়াছে।—একেবারে হারাণের মাকে লুকাইয়া খাবার সংগ্রহ করা পর্যন্ত। হারাণ তখন ছিল নিত্যসঙ্গী, প্রণয়-সুহৃদ্—বনবাদাড়, সুদূর পল্লী ঘুরিয়া আসিয়া এই ঘরটা ছিল আশ্রয়।…কত কথা মনে পড়ে, এমন সব কথা যা আজিকার দিনের সমস্ত ঘটনা, এই নিদারুণ উদ্দেশ্য লইয়া মধ্যরাত্রের অভিযান—সব যেন হালকা করিয়া দিয়াছে! হারাণ তাঁহার অশ্বপাল, কিন্তু আজ দারুণ সমস্যায় পড়িয়া তিনি সেই নিত্যসঙ্গী সুহৃদ্ হারাণের কাছে আসিয়াছেন…..কেমন একটা ভরসা হইয়া গিয়াছে তাহাকে দেখিয়া পর্যন্ত—মনে হইতেছে একটা বিহিত হইবেই।…অদ্ভুত ধরনের একটা নিশ্চিন্ততার ভাব আসিয়া গেছে মনে। গোটা চারেক মোয়া খাইয়া বড় পেঁপে-ঘটি থেকে ঢকঢক করিয়া একঘটি জল খাইলেন। হুঁকাটা হাতে লইয়া বলিলেন— “নে, এইবার বোস এইখানটায় চ্যাচাতে পারব না তো। বড় যে পরামাণিকের মাথা বলে গুমোর করিস কথায় কথায়—একটা হদিস বাতলা দিকিন, কেমন পারিস…”

সাঁতরা থেকে লইয়া হরিপুর পর্যন্ত ব্যাপার এক-একটি করিয়া বলিয়া গেলেন হারাণের কাছে, মায় নিজের আশা, আশঙ্কা, টীকা-টিপ্পনী সমেত।

হারাণের মনে একটা অন্তঃশীলা বহিতেছিল,—বাবাঠাকুর এতদিন পরে তাহার বাড়িতে আসিয়াছে, একটু পায়ের ধুলা লইবার প্রবল ইচ্ছা হইতেছিল—নিশ্চয় উচিত লওয়া। কিন্তু আড়ম্বর করিয়া কিছু করিবার স্বভাব নয় বলিয়া কেমন একটা লজ্জা করিতেছিল, সবটা শুনিয়া একটা অছিলা পাইয়া পায়ে মাথা ঠেকাইয়া ধূলি লইয়া বলিল— “পায়ের ধূলো দেও বাবাঠাকুর, গিরিদিদিমণির তাহলে, অন্য জায়গায় ঠিক করে এলে?…আজ সমস্ত দিনটা যে কিভাবে কেটেছে তা…”

রসিকলাল একটু রুক্ষভাবে বলিলেন— “এই দেখ, তু’বেটার তো ঐ দোষ। আগে পরশু দিনটা সামলাতে পারবি কিনা তাই বল, দেখছিস কি একটা বেতর সমস্যা মাথায় করে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছি।”

হারাণও বেশ মৃদুভাবে জবাব দিল না, বলিল— “সমিস্যে সমিস্যে তোমার একটা বাই; তা হক কথা বলব,—এগুনে য্যাখন ছড়া নিকতে, চিলের সঙ্গে ঢিল মিলবে কি কিল মিলবে ভেবে ভেবে সারাদিন এপাড়া ওপাড়া ছুটোছুটি করে বেড়াতে।…তারা এসলে, তবে তো সমিস্যে? …নাও, বামুনকে বাড়িতে ‘ওঠ’ বলতে নেই, তবে বাড়িতে তানারা সবাই যে কী করে কাটাচ্ছে!…”

সমস্যার কি সমাধান তা অবশ্য বলিল না, তবে অন্যান্য গল্প করিতে করিতে মনিবকে বাড়ি পর্যন্ত আগাইয়া দিয়া গেল।

কাজের বাড়ি; মাত্র পাকা দেখা হইলেও অন্নদাচরণ বেশ ভালোভাবেই নিমন্ত্রণ করা স্থির করিয়াছেন, যাহাতে পয়সা বাঁচানো লইয়া নূতন কুটুমের কাছে একটা বদনাম না ওঠে। কিন্তু সমস্ত উৎসব- চাঞ্চল্যের মধ্যেও বাড়িটা যেন থমথমে হইয়া আছে। স্বামী কর্মঠ হইয়াও একরূপ অকর্মণ্য, বরদাসুন্দরীকে সাধ্যমত মনের ভাব গোপন করিয়া চলিতে হয়। মুখে বেশ একটা হাসি ধরিয়া রাখিয়াছেন, প্রকৃতও হইতে পারে—গিরিবালার এতটা সুখ, এ তো কল্পনাতীত তাঁহার পক্ষে; যদি কৃত্রিমই হয় হাসিটা তো এমনভাবে ফুটাইয়া রাখিয়াছেন যে তাহার অন্তরালে যে কী আছে বোঝা অসম্ভব। অশ্রু লইয়াও একবার ধরা পড়িয়াছেন। দামিনী সর্বেসর্বা হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহার দাদারই কীর্তি তো? একবার কাজেই হ’ক, অকাজেই হ’ক, খোঁজ লইতে গিয়া দেখিলেন ভাঁড়ার ঘরের একটি কোণে একটা হাঁড়ির সরা উঠাইয়া বরদাসুন্দরী আঁচলে অশ্রুমোচন করিতেছেন। দামিনী রাগিয়া উঠিলেন— “দেখো কাণ্ড! হ্যালা ছোট বউ, সবে পাকা দেখা, তাও শেষ হয়নি এখনও, আর তুই কিনা মেয়ের জন্যে কাঁদতে বসলি?”

বরদাসুন্দরী আর একটু উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনের সহিতই বলিলেন— “না, মনটা কেমন একবার উৎলে উঠল তাই…নৈলে বড় ঠাকুরের আশীর্বাদ আজ তো আমার হাসবারই দিন ঠাকুরঝি।”

বসন্তকুমারীর প্রকৃতিটাই অন্যরূপ, মনের ভাবও ভাল করিয়া চাপিতে জানেন না, রাখিয়া- ঢাকিয়া কথাও বলিতে পারেন না। যেদিন প্রথম অন্নদাচরণ প্রণামীর টাকা ঘরে আনেন সেইদিনই তাঁহার ভ্রু কুঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল;—এই একটি মানুষ নিকুঞ্জলালের সম্বন্ধে যাঁহার মত কখনও পরিবর্তিত হয় নাই। তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছেন একটা ভীষণ চক্রান্ত চলিতেছে, শুধু যতটা দেখিতে পাইতেছেন তাহার চেয়েও সেটা ভীষণ সেটুকু বুঝিতে পারিতেছেন না। ব্যর্থ ক্ষোভে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন, একটু পড়িয়া বেড়াইয়া, একটু বা দেখাশুনা করিয়া; মুখে একটা হাসি তাঁহারও আছে, কিন্তু সে হাসিকে হাসিকে বলিয়াই যে লোকে মানিয়া লইবে এমন তাঁহার উদ্দেশ্যও নয়, আশাও নয়।

একবার পাঁচ-সাতজনের জমায়েতের মধ্যেই কে একজন বলিল— “যা হোক নিকুঞ্জদাদা একটা কাজের মতন কাজ করলেন।”

বসন্তকুমারী পায়েসের জন্য কিসমিস বাছিতেছিলেন, মুখ না তুলিয়াই কহিলেন— “তা আর একবার বলতে?—কুঁড়েঘর থেকে টেনে নিয়ে রাজসিংহাসনে বসতে চললেন। কাঙ্গালকে যে দিনই শাকের খেত দেখিয়েছিলেন সেই দিনই বুঝেছিলাম একটা বড় সৌভাগ্যি কপালে নাচছে।”

সবাই একটা না একটা কাজ লইয়া ছিল, নিম্ন দৃষ্টিতেও একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি হইল, স্মিতহাস্যও কয়েকটা মুখে ফুটিল নানা অর্থে, কেননা নানা অর্থ করিবার লোক ছিল।

দামিনীও ছিলেন। হাঁটবার পাত্রী নহেন, একটা ছুতা করিয়া বসন্তকুমারী উঠিয়া গেলে মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিলেন— “অনেক কিছুই দেখতে হ’ল!…কেন যে দাদার থাকা পরের কথায়। … তাও বলি,—গিরি যদি তোমার পেটেই জন্মাত, শাকের খেত তো নুকিয়ে রাখত না দাদা তোমাদের কাছ থেকেও।”

অন্নদাচরণ কাজের মধ্যে নিজেকে ঢালিয়া দিয়াছেন। জিনিসপত্র আনা, লোকজন যোগাড় করিয়া বাড়ি, উঠান পরিষ্কার করানো, ভিতরে আসিয়া একটু-আধটু খোঁজ লওয়া, হঠাৎ মনে পড়িয়া গেলে কোন জিনিসের ফরমাশ দিয়া আসা; যখন কিছুই হাতে থাকিতেছে না, গিয়া নিকুঞ্জলালের কাছে বসিতেছেন—পরামর্শ হইতেছে, শুধু কালকের কাজ লইয়া নয়, আসল কাজ লইয়া—তাহারই বা আর ক’টা দিন হাতে আছে?

অন্নদাচরণ নিজেকে কোন মতেই খালি থাকিতে দিতেছেন না, খালি থাকিলে যে চিন্তাটা মনে উঁকি মারিতেছে তাহার সম্মুখীন হইতে পারিতেছে না। কাহার সঙ্গে যেন বোঝাপড়া করিতে করিতে ওঁর কেমন এমনই একটা জিদ দাঁড়াইয়া গেছে—উনি গিরিবালার ভাল করিবেনই; নানা বাধা, নানা দুর্বলতা আছে—সবকেই কাটাইয়া উঠিতে হইবে। বেশ বুঝিতেছেন, কাটাইয়া উঠিতেছেনও।

শুধু কাল কথাটা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে গিরিবালার মুখের পানে ভাল করিয়া চাহিতে পারিতেছেন না।

বিকেলবেলা বসন্তকুমারী হরুকে দিয়া অন্নদাচরণকে নিকুঞ্জলালের বাড়ি হইতে ডাকিয়া আনাইলেন, প্রশ্ন করিলেন— “ভয়ঙ্কর ব্যস্ত আছ বলে এতক্ষণ জিগ্যেস করিনি, ঠাকুরপো যে সকাল থেকে বাড়ি নেই সেটা জানো?”

কণ্ঠস্বর নিতান্ত শান্ত, শুধু দু-একটা কথায় একটু যেন ব্যঙ্গের ঝোঁক পড়িল। অন্নদাচরণ বসন্তকুমারীকে সাধ্যমত এড়াইয়াই আসিতেছেন সমস্ত দিন, অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া বলিলেন— “বাড়ি নেই! কাল যে আমি তাকে বাড়ি থেকে বেরুতেই বারণ করলাম!”

সেইরকম মসৃণ অল্প ব্যঙ্গের কণ্ঠেই উত্তর হইল— “অবাধ্য তো আছেই, নইলে দাদা পাঁচটা বিচক্ষণ লোকের পরামর্শে যা করছে তাতে অমত করতে যায়? কিন্তু সে কথা থাক, এখন…”

অন্নদাচরণ হুলের বিধুনিটা অনুভব করিতেছিলেন, তবুও রাগটা চাপিয়াই বলিলেন— “অমত! তাকে জিগ্যেস করিনি? সে রাজী হয়নি?”

বসন্তকুমারী এতক্ষণ পর্যন্ত দুটো কথা বলিবার সুযোগ পান নাই, জ্বালাটা আরম্ভ হইয়াছে বুঝিয়াও ক্ষান্ত হইলেন না, একটু হাসিয়া বলিলেন – “ইঃ, কথা বলছ যেন তার রাজী অরাজীর কথা জানো না তুমি,—’না’ বলে একটা ধমক খেয়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছে, ‘হ্যাঁ’ বলে ধমক খেয়ে তক্ষুনি সেটাকে ‘না’ করেছে, এই তো দেখে আসছি আজ এই ষোল বছর ধরে…”

অন্নদাচরণ রাগিয়া উঠিলেন; বলিলেন— “বাজে কথা রাখো; তোমার বাজে কথা কইবার ফুরসত আছে, আমার নেই। ঘুড়িটা আছে কিনা খোঁজ নিয়েছ?”

বসন্তকুমারী বলিলেন— “নেই।”

অন্নদাচরণ আর নিজেকে সংযত করিতে পারিলেন না, বেশ উচ্চ কণ্ঠেই বলিয়া উঠিলেন— “বোঝ, বোঝ একবার কাণ্ডটা! ধুম পড়ে গেল আজই তার রুগী দেখবার…হবে না তাকে আসতে, আমি একাই…”

বসন্তকুমারী মুখের কাছে হাতটা লইয়া গিয়া চাপা গলায় বলিলেন— “চুপ করো; আর শত্রু হাসিয়ে কাজ নেই, এতে তো কে যে শত্রু আর কে যে বন্ধু চেনা দায় হয়ে উঠেছে; যা করছ করগে, অদিষ্টে যা হবার হবে।”

কথাটা চাপা দেবার চেষ্টা সত্ত্বেও অল্প অল্প করিয়া প্রকাশ হইয়া পড়িল। নিকুঞ্জলালকে অন্নদাচরণ নিজেই বলিলেন—নিকুঞ্জলাল হুঁকা হইতে মুখ সরাইয়া বিস্মিতভাবে বলিলেন— “তাই নাকি! তুমি অবাক করলে যে! দেখো, দেখো খোঁজ নাও!”

অন্নদাচরণ ফিরিয়া যাইতে নিকুঞ্জলালের একটু যেন কিরকম ঠেকিল; কথায় আতঙ্কের সুরটা যেন তত প্ৰবল নয়। মনের সন্দেহ ভাবিয়া আর ও লইয়া মাথা ঘামাইলেন না।

রাত্রি হইয়া গেলেও যখন রসিকলাল আসিলেন না তখন সকলের আলাদা করিয়া হারাণের কথা মনে পড়িল। সাতকড়ি আর হরু হারাণের বাড়ি গিয়া খবর আনিল হারাণও আজ সকাল হইতে বাড়ি নাই, বলিয়া গেছে, বিশেষ কাজে শ্বশুরবাড়ি যাইতেছে; কাল ফিরিয়া আসিবে।

অন্নদাচরণ ঘরে শুইয়াছিলেন, শুনিয়া ‘হু’ করিয়া শব্দ করিলেন।

যতই রাত্রি বাড়িতে লাগিল, উৎসবের আনন্দ ধীরে ধীরে মুছিয়া গিয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন পুরী একটা আসন্ন বিপদের প্রতীক্ষায় থরহরি কম্প হইয়া রহিল।

বিপদটা সকালে দেখা দিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে—

পরদিন আটটা থেকে দশটার মধ্যে আশীর্বাদের লগ্ন, হরিপুর থেকে সকলের ভোরেই আসিবার কথা। ব্যবস্থা হইয়াছে—সন্ধ্যার পর গাড়ি থেকে নামিয়া ডুমজুড়েই কাটাইয়া অল্প রাত থাকিতে যাত্রা করিবেন, যাহাতে সূর্যোদয়ের পরেই বেলে-তেজপুরে পহুছাইয়া যান। এদিক থেকে কয়েকজন মাইল দুয়েক দূরে সাতনলায় গিয়া বসিয়া আছে, সেখান হইতে অভ্যর্থনা করিয়া লইয়া আসিবে।

সূর্যোদয় হইল, বেলা বাড়িয়া চলিল, কাহারও দেখা নাই। এক-একজন করিয়া জনচারেককে সাতনলায় ছুটাইয়া দেওয়া হইল, সেখান থেকেও জনদুয়েক আরও অগ্রসর হইয়া সন্ধান লইতে গেল। কোনও খবরই নাই।

আটটা বাজিয়া গেল, নয়টা, দশটা। অন্নদাচরণ পাগলের মতো হইয়া গেছেন। গ্রামের প্রত্যেক ভদ্র গৃহস্থের কর্তাকেই নিমন্ত্রণ করা হইয়াছে। অবশ্য পাড়াগাঁয়ে মধ্যাহ্ন-নিমন্ত্রণ মানে বেলা চারটের ব্যাপার, তবু আশীর্বাদ সভায় উপস্থিত থাকিবার জন্য সকলে আসিয়া গিয়াছে। গোলমালের কথা শুনিয়া আরও সব জুটিয়া আরও গোলমাল বাড়াইয়া দিতেছে। অন্নদাচরণ প্রবীণদের একবার এর হাতে ধরিতেছেন, একবার ওর পায়ে ধরিতেছেন— “আমি কি করি?… রসিক কোথায় গেল?…একি—কি হ’ল?”

সামনে সান্ত্বনা পাইতেছেন তবে পিছনে নানারকমের টীকা-টিপ্পনী চলিতেছে— “বামন হয়ে চাঁদে হাত! ওহে, বিদ্যাসাগরের কাকপক্ষী আর ময়ূরপুচ্ছের কথাটা পড়েছ তো? হ্যাঃ—হ্যাঃ- হ্যাঃ…”

ঘোষাল মশাই-ই পরিবারটিকে আন্তরিক স্নেহ করেন। প্রথমেই বেগতিক দেখিয়া একবার আড়ালে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন— “বলেছিলাম বাপু, নিকের পাল্লায় পড়ো না; দেখলে তো? আমি আশঙ্কাই করছিলাম পুরনো ঝাল ও মোক্ষমভাবেই মেটাবে। দেখছি নিকেই সর্বেসর্বা, আমার আমল পাচ্ছি না তাই বলিনি, নৈলে যতটুকু খোঁজ পেয়েছি, তাতে তো দেখছি অনেক গলদ ভেতরে। যাক; আপাতত নেমন্তন্নটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দুটোর সময় একটা লগ্ন আছে। নেমন্তন্নটাকে রাত্তিরে ঠেলে দেওয়া যাক, হরিপুর থেকে লোক আসে ভালই, না আসে এমন অবস্থাতেও রাত্তিরে যারা খেতে আসবে তাদের খাইয়ে দিলেই হবে।…দুঃখ করে আর করবে কি? হয়ে পড়ল একটা কেলেঙ্কারি সামলাতে হবে তো?…মেয়েটার খবর কি?”

অন্নদাচরণ ঘোষাল মশাইয়ের হাতটা ধরিয়া ঝর-ঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন, বলিলেন— “কাকা, পরশু থেকে আমি তার মুখের দিকে চাইতে পারিনি।”

ঘোষাল মশাই স্নেহভরে পিঠে হাত দিয়া বলিলেন— “বিপদের সময় উতলা হয়ো না অন্নদা। আমি সাধন আর শিবুকে টিপে দিয়েছি, তারা রান্নার হাঙ্গামাটা সামলে রাখবে। আমি নেমন্তন্নটা সামলে নিচ্ছি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, তোমার ওদিকে যাওয়াটাও ঠিক হবে না। তুমি একটু ভেতরে চলে যাও, মেয়েদেরও একটু দেখা দরকার।…নিকে হারামজাদাকে দেখছি না যে? কাঁচা মাথাটা ধড় থেকে ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে, উঃ!”

অন্নদাচরণ বলিলেন— “নিকুঞ্জদাদা সাতনলায় ওদের এগিয়ে আনতে গেছেন, রাজগুরুও সঙ্গে আসবেন, তাই…”

ঘোষালমশাই দাঁতে দাঁত পিষিয়ে বলিয়া উঠিলেন— “রাজগুরু! রাজগুরু! রাজা!—এখনও তোমার মোহ যায়নি অন্নদা!”

অন্নদাচরণ বলিলেন— “কি করি কাকা, আমি যে কীভাবে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছি! – আজ আমায় অপমান হতে হল, এটা ফাউ, যদি এইটুকুর ওপর দিয়েই আমার প্রায়শ্চিত্ত হত কাকা, দুঃখ ছিল না, কিন্তু গিরিকে আমরা জলাঞ্জলি…”

এমন সময় সাতনলায় যাহারা গিয়াছিল তাহাদের কয়েকজন ফিরিয়া আসিল। খবর দিল নিকুঞ্জলাল একটা পালকি করিয়া স্বয়ং ডুমজুড়ে গেছেন। বলিয়া গিয়াছেন দুইটার সময় একটা ‘দিন’ আছে, আশীর্বাদের বন্দোবস্ত যেন ভাঙিয়া দেওয়া না হয়।

ভিতরের অবস্থাও খুব জটিল, টীকা-টিপ্পনীতে অনেক নথে বিদ্যুৎস্ফুরণ হইতেছে, ধারালো ঠোটে পানজর্দার ঘন ঘন শান পড়িতেছে; দুই তরফেই, কেননা ঘোষাল গিন্নির মতো মানুষও আছেন, বলিতেছেন— “টাকার শ্রাদ্ধ! তাও যদি মেয়েটা পরিত্রাণ পায় তো বুঝব বাপ-জেঠার লোভের প্রাচিত্তির অল্পর ওপর দিয়েই হ’ল।”

দামিনী গমগম করিয়া ফিরিতেছেন। ঘোষাল গিন্নিকে ভয় করেন, সরিয়া যাইতে যাইতে বলিতেছেন— “প্রাশ্চিত্তির হচ্ছে তার, যে গায়ে পড়ে পরের উবগার না করে থাকতে পারে না।… এর মধ্যে কারচুপি আছে অনেক, বহু দিন থেকেই আঁচ পাচ্ছি। দুটোর সময়ও যদি তারা না এসে পড়ে তো বুঝব, সেই বিটলে বামন গিয়ে ভেঙে দিয়েছে। ঐ রসিক, — ভয় করে বলছি না তো!”

বেশ স্পষ্ট ঝগড়া বাধিবার কথা, কিন্তু বাধিতেছে না। বরদাসুন্দরী ওদিক দিয়া যানই না, ক্রমাগত আড়াল খুঁজিয়া খুঁজিয়া চোখের জল মুছিতেছেন।

বসন্তকুমারী মাথার ব্যথা লইয়া নিজের ঘরে গিয়া শুইয়াছেন। সত্য না ভানমাত্র বলা দুষ্কর।

গিরিবালা শুষ্কমুখে ক্রমাগত নিজেকেই সবার চক্ষু হইতে আড়াল করিয়া ফিরিবার চেষ্টা করিতেছে, ভালমন্দ বুঝাটা অনেকটা তাহার সাধ্যাতীত, তবে তাহাকে ঘিরিয়াই যে এতটা বিক্ষোভ এইটেতেই তাহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। আড়াল চায় কিন্তু এত লোকে ভরা উৎসববাড়িতে সেটা সম্ভব নয়—বিশেষ করিয়া সে-ই যখন উৎসবের কেন্দ্র। নিরিবিলি ভাবিয়া জেঠাইমার ঘরে প্রবেশ করিতে যাইতেছিল, দেখিল জেঠাইমা শুইয়া। এই লোকটিকে সে সবচেয়ে বেশি এড়াইয়া আসিতেছে; তাড়াতাড়ি ফিরিয়া আসিবে, জেঠাইমা ডাকিলেন— “কে গিরি? শোন্।”

গিরিবালা পাশে গিয়া দাঁড়াইলে বলিলেন— “উঠে বস।”

গিরিবালা উঠিয়া পায়ের কাছে বসিল, সঙ্গে সঙ্গেই কোথা দিয়া কি হইল তাঁহার গায়ের উপর লুটাইয়া পড়িয়া কোলে মুখ ঢাকিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

বসন্তকুমারী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া শুধু গিরিবালার মাথার উপর দিয়া, পিঠের উপর দিয়া দক্ষিণ হস্তটা ধীরে ধীরে টানিয়া যাইতে লাগিলেন, তাহার পর বলিলেন— “তোকে শেষ করলে গিরি—দু’জনে মিলে—আমি মেয়েমানুষ কিছুই করতে পারলাম না।” অশ্রু নাই, কোনরকম আবেগও নাই।

.

এই সময় বাহিরের কলরবে একটা যেন জোয়ার আসিল, একেবারে অন্য ধরনেরই গুলতান— “এসেছে।…এসে গেছে।…বর এসেছে!”

সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা যেন নূতন ভাবে সজীব হইয়া উঠিল—কৌতূহলভাবে ছুটাছুটি, ত্রস্ত প্রসন্ন, অস্পষ্ট উত্তর; কতকগুলা ছেলেমেয়ে জোয়ারের কুটাকাটার মতই হুহু করিয়া বাড়িতে ঢুকিয়া পড়িয়া তাহাদের কাকলিতে বাড়িটা ভরিয়া দিল— “দেখেছি…কি সুন্দর বর!…কি সুন্দর পুরুত! খোট্টা চাকর!…”

বসন্তকুমারী শুইয়াছিলেন উঠিয়া বসিলেন, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা কণ্ঠে বিস্মিত শব্দ উঠিল— “ওমা, কাতু যে!”

কাত্যায়নীর কণ্ঠেই উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন— “বড়দি কোথায়?”

তাঁহার পিছনে পিছনে একটি ছোট দল বসন্তকুমারীর ঘরের সামনে আসিল; চৌকাঠ ডিঙাইতে যাইয়াই কিন্তু সকলে থমকিয়া দাঁড়াইল, কাত্যায়নী পর্যন্ত।—

বসন্তকুমারী একেবারে সিধা হইয়া বসিয়া আছেন। মুখটা রাঙা টকটকে, চোখ দিয়া যেন আগুন ছুটিতেছে, কোলের উপর উবু হইয়া শুইয়া গিরিবালা; বসন্তকুমারীর একখান হাত তাহার উপর,—আলগাভাবে রাখা নয়, কতকটা যেন খামচাইয়া ধরিয়া আছেন। দৃষ্টি হইতে পায়ের নখ পর্যন্ত অচঞ্চল।

অদ্ভুত সাদৃশ্যে কাত্যায়নীর ধাঁ করিয়া একটা ছবির কথা মনে পড়িয়া গেল, বিকাশ কবে একবার দেখাইয়াছিল,—একটি সিংহী থাবার নিচে নিজের শাবককে চাপিয়া জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সামনে চাহিয়া আছে।

তিনদিনের চাপা কণ্ঠস্বরকে মুক্তি দিয়া বসন্তকুমারী কাত্যায়নীকে লক্ষ্য করিয়া গর্জাইয়া উঠিলেন— “নিজে গিলতে পারলিনি, দেখতে এসেছিস অন্য কোন্ রাক্ষসের পেটে গেল?—হবে না তোদের মনস্কামনা পূর্ণ। ডাক, কে আমার কাছ থেকে গিরিকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাকে!”

এমন সময়’ওগো শুনছ—কোথায় গেলে?’—বলিতে বলিতে অন্নদাচরণ আসিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিলেন। ঘরের কাছে একটু বেশি ভিড় দেখিয়া কাছে আসিয়া বলিলেন— “তোরা একটু সর তো…ওগো শুনছ—রাজপুত্তুর এনেছে রসিক—রসিক নিজে—আজই বিয়ে…’

ভিড়কে, বাড়ির মধ্যে আরও সবাইকে এবং স্ত্রীকে শুনাইতে শুনাইতে দরজার সামনে আসিয়া তিনিও হতভম্ব হইয়া গেলেন, দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিলেন— “এ কি!”

স্বামী-স্ত্রীকে একত্র দেখিয়া বড়রা সরিয়া গেল, বসন্তকুমারীও মাথার কাপড়টা তুলিয়া দিলেন। একটা ধাক্কা খাইয়াছেন, কিন্তু আবেগটা সহজে যাইবার নয়, অন্নদাচরণ বলিয়া চলিলেন— “রসিক ঠিক করলে….বাপ যে, আমার গুমর করলেই চলবে না তো।… বর দেখবার জন্যে এতবড় কাজের বাড়িটা খালি হয়ে গেছে—ঘোষালকাকার বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম…আশীর্বাদ পর্যন্ত সেরে এসেছে রসিক।…’ খুব শক্ত করিয়া বাঁধা তার হঠাৎ আলগা হইয়া গেলে যেমন হয় অনেকটা সেইরকম হইল, কিছু শুনিবার বুঝিবার ক্ষমতা হারাইয়া বসন্তকুমারী অবশভাবেই আবার ধীরে ধীরে শুইয়া পড়িলেন। “দেখো, গুলো। যার বাড়িতে আজই কাজ সে আরাম করে…কাতু তুই এসে দেখ দিদি; আমার আর এখন মান ভাঙাবার…’

শেষ করিবার পূর্বেই হুঁশ হইল। “বৌমা কোথায়? পুতী, বৌমা কোথায় রে?—একবার বল্ তো মা দোরের পাশে এসে দাঁড়াতে…”

বলিতে বলিতেই ঘরের বাহির হইয়া গেলেন।

কয়েকদিন পরে পণ্ডিতমশাই ফিরিয়া আসিয়া যখন রসিকলালের কাছে সব বিবরণ শুনিলেন, উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া বলিয়াছিলেন— “শিবের বিয়েতেও নানা উৎপাত হয়েছিল, দুঃখ রয়ে গেল আমার দেখা হল না, এমন আটক পড়ে গেলাম!”

এদিককার গোলমালটা একটু থিতাইয়া আসিলে টের পাওয়া গেল রসিকলালের আবার দেখা পাওয়া যাইতেছে না। খোঁজাখুঁজি ছুটাছুটির আর একটা হৈ-চৈ পড়িয়া গেল। হারাণও আসে নাই এখনও, সে ফিরিয়াছে কিনা দেখিবার জন্য সাতকড়ি তাহার বাড়িতে ছুটিল।

গিয়া দেখিল কাকা হারাণের সদর ঘরে বসিয়া হুঁকা টানিতেছে; সামনে, নিজের হাঁটু দুইটা জড়াইয়া ধরিয়া হারাণ ঊর্ধ্বমুখে বসিয়া। সাতকড়ি কাহাকেও দেখিতে পাইবে মোটেই আশা করে নাই, আর কেহ দেখিয়া পাছে খবরটা আগে দিয়া ফেলে, এই ভয়ে ফিরিয়াই ছুট দিয়াছে, রসিকলাল ডাকিলেন— “সাতু, শোন্!”

সাতকড়ি হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া দাঁড়াইলে জিজ্ঞাসা করিলেন— “দাদা খুব বকাবকি করছে?”

সাতকড়ি কাকার স্বভাবটা অনেকখানি বুঝিতে পারে এখন, বলিল— “না তো, খুব সুখ্যেত করে বেড়াচ্ছেন বরং, তুমি যাবে না?”

“বলবি হারাণের বাড়িতে একটা অসুখের খবর পেলাম, দেখেই চলে আসছি।”

হারাণ হাতটা একটু ঘুরাইয়া বলিল— “সে তুমি রামীর মার নিমোনিয়া হয়েছে বল না; গিরিদিদিমণির এমন বিয়ে হচ্ছে, হারাণ আর তোয়াক্কা রাখে না।”

রামীর মা হারাণের স্ত্রী। বারণ করিয়া রসিকলাল অন্য একটা কিছু বলিবার পূর্বেই সাতকড়ি একছুটে গলির বাঁকে অদৃশ্য হইয়া গেল।

সাতকড়ি চলিয়া গেলে হারাণ আবার গুছাইয়া বসিয়া বলিতে লাগিল— “ডুমজুড়ের সেই বৈকুণ্ঠ পরামানিকের ওখানে গেনু। আমার খুড়শ্বশুর হয়, দেখতেই জিগুলে~’কুটুম এত ভোরে যে? বাড়ির খবর সব ভাল তো?”

“বললাম—’বাড়ির খবর একরকম ভালোই আপনার ছিচরণের আশীর্বাদে, তবে এক অন্য বিপদে পড়া গেছে হঠাৎ।’

“তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব বললাম—হরিপুরের ওনার আর নিকুঞ্জঠাকুরের য্যাতো সয়তানির কথা জানতুম তার ওপর দুপোঁচ রং চড়িয়ে। শেষে বললাম— উদিকে কাল বিয়ে, সাঁতরা থেকে বরযাত্রী এসতেছে, ইদিকে হরিপুরের এনাদের কাল সকালেই আশীর্বাদ, আজ সন্দের গাড়িতে এইখেনে নেমে তানারা নিশ্চয় রাত কাটাবে, একটা ব্যবস্থা তোমায় করতে হবে, নৈলে গরীব বামন দুটো দলের চাপে পিষে মারা যায়। ও দলেরা আবার পশ্চিমে থাকেন, একটু বদরাগী, আর কি যে বলে—বেশ, শক্ত-সমখ।’

“শুনে খুড়শ্বশুর বললে—’এই তুশু কথা? ‘

“তা, তানার বলবার হক আছে কিনা বাবাঠাকুর—ডুমজুড়ে পাঁচটি দোকান আছে, পাঁচটিই নরহরি ভটচায্যির। ভটচাযিমশাই থাকেন হাবড়ায়, পাঁচটি দোকানই শ্বশুরমশাইয়ের তদারকে। অবিস্যি লোকে জানে পাঁচটি দোকান পাঁচজন ভেন্ন ভেন্ন লোকের; কিন্তু ভেতরের গোপনীয় কথাটা এই।…এখন ধরুন আমতার আদালতে মোকদ্দমা, গাড়ি থেকে চারজন সাক্ষী নামল। ওপক্ষের লোক এসে ধরলে— “বৈকুণ্ঠ, এই যৎসামান্যি নাও, সাক্ষী ক’টিকে একটু আটকে রাখতে হবে বাপু। … সে সাক্ষী আর সেদিন আদালতের মুখ দেখতে পাবে নাকি বাবাঠাকুর?…এইরকম দশজনের উবগার করে করে শ্বশুরমশাইয়ের হাত পেকে গেছে।…আমার কাছে সব শুনে বললে— ‘এই তুশ্ৰু কথা?’

“তারপর দু-একবার গুড়ুক টেনে বললে—’তবে সেখান থেকে ক’জন আসছে, কে কে আসছে, কার কি রকম ভাল-মন্দ অব্যেস একটু জানলে সুবিধে হতো; তা আমার তো নড়বার উপায় নেই, এক্ষুনি একটা গাড়ি আছে, দোকানের খদ্দের নামবে, তুমি হরিপুরে চলে যাও কুটুম, দেখ কতটা খবর যোগাড় করে আনতে পারো।’

“আর দুজনেরই ফুরসুত কম, তা ভেন্ন মনটাও ঐদিকে পড়ে রয়েছে, খুব সাটে বলে যাই বাবাঠাকুর, আর একদিন খুঁটিয়ে শোনাবখন। শ্বশুরের পরামর্শেই জাতব্যবসার সরঞ্জাম নিয়ে সেই গাড়িতেই হরিপুর গেলাম; তিনিই যোগাড় করে দিলে, বললে— ‘কুটুম, আমাদের বাপ-পিতামোর অনেক বুদ্ধি খরচ করেই আর সব ব্যবসা ছেড়ে এই খেউরির ব্যবসাটি বেছে নিয়েছিল—দাড়িতে ক্ষুর ঠেকালেই মানষের আঁতে সুড়সুড়ি লাগে, আপনি থেকেই “গল্প করি গল্প করি” বাই চাগে, পেটে কথা রাখতে পারে না।’

“নিভল কথা বাবাঠাকুর, ঘাঁঘি লোক কিনা, ভুল বলবার পাত্তর নয়, আপনি বরং মিলিয়ে দেখবেন। মোট কথা, আমি সেই গাড়িতেই হরিপুরে গেনু, আর এর মুখে তার মুখে সব খবর নিয়ে ওদেরই সঙ্গে সন্দের গাড়িতে ফিরে এনু, অবিশ্যি ওদের দলে নয়, গা লুকিয়ে লুকিয়ে। আগেভাগেই নেমে আড়াল থেকে শ্বশুরমশাইকে সব চিনিয়ে দিন। খুব মোটামুটি একটা পরচেও দিয়ে দিনু ‘দাড়ির ডগায় গেরো বাঁধা উটি কুলগুরু, উটি পুরুত, পাকানো চাদর গায়ে উটি আর পক্ষের সুমুন্দি নীলমণিবাবু, পাশেই উটি সুমুন্দির ছোট সুমুন্দি, তেলের কুপোর মতো উটি দাওয়ানজি, তার সঙ্গে পিপের মতন যে লোকটি কথা কইছে সে হল বাবুর পিসেমশাই—কত্তা হয়ে এসেছে…”

“খুড়শ্বশুর একবার তাক্যে দেখে বললেন—’কত্তামি ভাঙচি। নেশাটেশা কার কি অব্যেস খোঁজ নিয়েছ? তাতে কাজের সুবিধে হয়।’

“বন্নু—’না, যারা ওদিকের তাদের যে আসতেই দিলে না, কম হারামজাদা! এদের একটু আপনি হল, একটু সিদ্ধি হল, কি, কারুর একটু বড় তামাক—এই পৰ্য্যস্ত।’

“ত্যাতক্ষণে সেকেন কেলাস থেকে নেমে সবাই এগ্যে এয়েছে, সামনে পিসে। শ্বশুরমশাই গিয়ে খুব নিচু হয়ে গড় করে বললে-’প্রাতপ্রণাম হই, ঘরটর চাই হুজুরদের রেতে থাকবার জন্যে?’ “পিসেমশাই গোঁফজোড়া ফুলিয়ে বললে-’নরহরি হারামজাদার দোকান নয় তো?’

“শ্বশুর আর একটা গড় করে হেসে বললে — ‘নরহরি ঠাকুরের দোকানের নোক হলে ভদ্দর নোকের সামনে এসে দাঁড়াতে পারতুম? মনে সে দম্মবল পেতুম? —এইটেই ভেবে দেখুন না কেন ‘হুজুর?’

“পিসে বললে’তাহলে চল, এগো।’

“সামনের দোকানটাতে না তুলে, আর একটু এগিয়ে গিয়ে একবারে চার নম্বরটাতে তুললে, আমিও একটু ঘুরে গিয়ে খদ্দর হয়ে উঠন।

“ওপরে একখানা ঘর, নিচে দু’খানা। সামনে দোকান।

“সবাই এসে উঠলে খুড়শ্বশুর জিজ্ঞেস করলে—ওপরে আপনারা কে কে থাকবেন?”

“গোল বাধাবার জন্যেই প্রত্যেক দোকানে একটি করে ওপরে ঘর আছে, পরে খুড়শ্বশুরের মুখে শুনলাম কিনা। কথাটা খুব সোজা বাবাঠাকুর,… যে ওপরে ঠাঁই পাবে না সে-ই মনে করবে মানহানি হল, চটে গিয়ে কাজ পণ্ড করবার চেষ্টা করবে।…সবাই একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলে। পিসে বললে- ‘আর ওপরে ঘর নেই?’

“খুড়শ্বশুর বললে— ‘আর একটি আছে, তবে আপনাদের যুগ্যি নয় হুজুর। চিলেকোঠার সঙ্গে একটা ছোট খুবরি আছে।’

পিসে বললে— ‘আমরা চারজন চিলেকোঠায় সেঁধুচ্ছি নীলমণিবাবু আর ওনার সুমুন্দি ভার ঘরটা দখল করুন।

অবিশ্যি ওর মানে হয় উল্টো। নীলমণিবাবু মুখটা একটু বেঁকিয়ে বলল—তা কি হয়? আপনি হলেন কত্তা, উনি দাওয়ানজি, উনি কুলগুরু, উনি পুরুত। আমাদের চিলেকোঠারও দরকার নেই। আমরা নগণ্য মনিষ্যি নিচেই বেশ থাকব।

খুড়শ্বশুর আমায় পরে বললে— ‘বাবাঠাকুর কুটুম যখন শুনলাম পিসেও আছে আবার সুমুন্দিও আছে তখনই জেনে গেছি বাজি মাৎ’…কথাটা বুঝতে পারলেন না—বাবাঠাকুর? পিসে আর সুমুন্দিতে কখনও বনে না,—বনতে পারেই না। —সুমুন্দি মনে করে—আমি খোদ সুমুন্দি, আমার কাছে দাঁড়ায় কেটা? পিসে ভাবে—আরে গেল! তুই যার সুমুন্দি বলে মাটিতে পা দিচ্ছিস না, খোদ তার বাপ যে আমার সুমুন্দি! কাজেই গোলমাল বেধে যায় বাবাঠাকুর।’

এদিকে পিসে আবার বাড়িতে একটু মুরুব্বীর মতন থাকতে চায় বলে দাওয়ানজির সঙ্গে খাতির থাকতে পায় না। দাওয়ানজি বললে’আমিও নিচে যাই, কর্মচারী মানুষ, ওপরে থাকাটা শোভা পায় না।’

থাকবার বিলিব্যবস্থা করে দিয়ে, আহারাদির বিলি করে, থাকাথাকি নিয়ে বেশ একটা মনকষাকষি বাধিয়ে খুড়শ্বশুর জিগ্যেস করলে—’কোথায় যাওয়া হবে হুজুরদের?— গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করব কি পালকির?’

পিসে বললে- আমাদের যা হয় হবে; আগে ওদের জন্যে একটা পালকির ব্যবস্থা কর, নইলে মান ভাঙবে না।—যেতে হবে বেলে-তেজপুর।’

খুড়শ্বশুর এই ধরনের কথাবার্তাই খুঁজছিল, নেমে এসে নিচের ঘরে ঢুকে একপাশে হাঁটু মুড়ে বসে বললে– ‘মশাইদের জন্যে শওয়ারির কি ব্যবস্থা করা যায়?’

সুমুন্দি মুখ গোঁজ করে জিগ্যেস করলে- ‘কত্তাদের কি ব্যবস্থা হল? তাঞ্জাম?’

খুড়শ্বশুর একটু মুচকি হাসলে, বললে- ‘ওপরের ওনারা যে ময্যেদার নোক দেখছি তাতে তাঞ্জাম হলেই হতো ভাল। দুখানা বাছা-বাছা পালকির হুকুম দিলেন।’

সুমুন্দির সুমুন্দি মুখটা কুঁচকে জিগ্যেস করলে– ‘আর আমাদের জন্যে?’

খুড়শ্বশুর হাত জোড় করে বললে — হুজুর, গোলাম গরীব নোক, একটি এই দোকানের উপর নিভর করে কোনরকমে চলে যায়। বড়নোকেদের সেবা করি, কিন্তু কথায় থাকি না, বিশেষ করে ওনাদের ভাবটা একটু যেন কেমন কেমন বুঝছি কিনা।’

সুমুন্দিও ছাড়বে না, খুড়শ্বশুরও বলবে না। শেষকালে কাঁচুমাচু করে বললে— ‘ওনারা কিছু বললেন না, তাই আমি পেরথমটা ভাবলাম বুঝি আপনারা নিজের ব্যবস্থা নিজে করবেন। তারপর আবার ভাবলাম একটু জিগ্যেস করেই নিই, ইনিই যেন কত্তা দেখছি। তাইতে আপনাদেরই জিগ্যেস করতে হুকুম করলেন। বললেন- ‘জিগ্যেস করগে লবাব বাহাদুরদের পালকি চাই কি গোরুর গাড়ি হলেই হবে।’…যা শুনলুম তাই বলুম হুজুর, গরীব নোক, অত ভালমন্দ বোঝবার খ্যামতা নেই।’

সবটা খুঁটিয়ে বলবার ফুরসত নেই বাবাঠাকুর, মোট কথা একদিকে খুড়শ্বশুর আর একদিকে পাওয়ানজি — দুই জনায় মিলে এমন গরম করে তুললে যে সুমুন্দি দিব্যি গেলে বসল – ‘আমি যদি এ আশীর্বাদে যাই তো আমার অতি বড় কোটি দিব্যি রইল।’

তানার সুমুন্দি যাত্রার দলের দুর্ব্বাসা মুনির মতন পৈতেটা বের করে বললে– ‘আমি যদি আর

এক দণ্ড ওদের সাথে এ দোকানে থাকি তো আমার নাম গজু চাটুজ্জেই নয়।’

—হবেই কিনা বাবাঠাকুর, নৈলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় আর বলেছে কেন শাস্ত্রে?-–ও আবার তোস্য সুমুন্দি কিনা।

খুড়শ্বশুর সুমুন্দিকে বললে—’আমার একজন খদ্দের গেল বলে নয়, কিন্তু কাজটা কি ওনার ভাল হবে?—আর যে রকম রোকা নোক দেখছি শোনবেনও না। তা, অন্তত আপনি বাবু চোখ কান বুঝে সয়ে যান। মানী নোক ওনারা, আপনি সুদ্দু চলে গেলে ওঁদের অপমানের আর হিসেব থাকবে না।’

সুমুন্দি পৈতেটা ছিঁড়েই দিব্যি করতে যাচ্ছিল, —নিজের শালার কাছে তো খাটো হতে পারে না বাবাঠাকুর,—দাওয়ানজি তাড়াতাড়ি ধরে ফেললে। খুড়শ্বশুরকে বললে— যদি ফিরে যেতেই চান এঁরা তো যেতে দাও হে বাপু, শেষে একটা অনখ হবে? ইনি আবার ভয়ানক অভিমানী, তুমি বাইরের নোক, জান না তো।’

সবই তো নিজেদেরই দোকান, খুড়শ্বশুর তাড়াতাড়ি দুজনাকে অন্য দোকানে সরিয়ে ফেললে। ফিরে এসে আমায় বললে— ‘কুটুম, পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মতন সংসারটা বড় পাজি জায়গা, এখুনি বোধহয় দুজনার মত বদলে যাবে, আমার এতটা মেহনতই সার হবে। এই নাও, তুমি বেশ মিহি করে এই সিদ্ধিটুকু পিষে ফেলো দিকিন, খানকতক চুরি করে খাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দিগে, জেদটা আঁকড়ে বসে থাকবে’খন। ভোরের একটা ট্রেন আছে, চাপ্যে বাড়িমুখো করবার যোগাড় করে দিয়ে আসি গে।’

ওদিককার ব্যবস্থা পাকা করে খুড়শ্বশুর এ-চারজনকে নিয়ে পড়ল। কচুরিটা সুমুন্দিদের ভাল লেগেছিল বলে মাত্তোর দুখানা বেঁচেছিল, খুড়শ্বশুর দাওয়ানজির ঘাড় দিয়ে চালিয়ে দিলে। একে মেটে দুখানি, তায় দাওয়ানজি কর্মচারী মানুষ, একটা ভয় আছে, ভাঙানো গেল না। খুড়শ্বশুর বললে—চলুক চারজনেই তাহলে, আর ভাবতেও পারি না মেলা, মানুষের শরীল তো?”

খাওয়া-দাওয়ায় রাত কাটিয়ে দেছল, ওনাদের উঠতে একটু বিলম্বই হয়ে গেল বাবাঠাকুর। মানে, এনারা য্যাখন পালকিতে চড়ল ত্যাখন সুমুন্দি জোড়া সিদ্ধির ঝোঁকে ঝিমুতে ঝিমুতে ওদিকে দুটো ইস্টিশান পেইরে গেছে। পিসে খুব একচোট চটল, দাওয়ানজি বললে—’খোদ কত্তা ওনাদের আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় চড়াচ্ছেন, আপনি আর কি করবেন? ‘

আট-আট বেয়ারার দুখানা পালকি, একটাতে চড়ল পিসেমশাই আর গুরুঠাকুর, একটাতে চড়ল দাওয়ানজি আর পুরুত। পালকি য্যাখন আধ পোটাক রাস্তা এগ্যে গেছে, আমি দুগ্‌গাসসিহরি বলে খুড়শ্বশুরের পায়ের ধুলো নিয়ে বেইরে পড়ন। খুড়শ্বশুর বলে দিলে— ‘কুটুম, তুমি এইরম তফাতে তফাতেই থেকো। পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বেস নেই, শেষে তোমাকেও এই ব্যাপারের মধ্যে ফাঁসিয়ে দেবে,—নিরীহ মানুষ মাঝে পড়ে খানিকটে নাকাল হবে।’

মনে মনেই বললুম—হারাণ পরামাণিককে নাকাল করবে সে এখনও মায়ের পেটে।…ওনাকে অবিশ্যি বললুম—’না; কিসের মাথাব্যথা কন্ না আমার ওনাদের সঙ্গে থাকবার?’

সুতুনীর খালের ধারে য্যাখন পৌঁছুল, সবে সুয্যি উঠেছে। বড় নদীর লতুন জল নেমেছে, বেয়ারারা পালকি নাব্যে কেনারায় থুলো। ওদের মুখপাত ছেল চরণ বেয়ারা; জিগ্যেস করলে, ‘হুজুরেরা পালকিসুদ্ধু পার হবেন, কি পুল দিয়ে পেইরে যাবেন, কি হেঁটেই এইটুকু সেরে নেবেন?— আমরা তো বলি—হেঁটে গেলেই ছেল ভাল, জল এক কোমরের বেশি হবে না।’

আমি ত্যাতক্ষণে এসে একটা ঝোঁপের আড়ালে বসেছি। পিসে তো এক কোমর জল ভেঙে পার হবার কথায় চরণদাসকে শুধু মারতে বাকি রাখলো—অসম্মানের কথা কিনা বাবাঠাকুর। দাওয়ানজি পালকিতে পেরুতে রাজী হ’ল নি, পুল পেইরে যাবে ঠিক করলে। পিসে, গুরুঠাকুর আর পুরুত পালকিসুদ্ধু পেরুবে; চারজন চারজন করে আটজন বেয়ারা এগুনে পিসে আর কুলগুরুঠাকুরকে পার করে এসে অন্য পালকিতে পুরুতমশাইকে নিয়ে যাবে। পিসে বললে— ‘পালকিতে যদি একটুও জল লাগে তো তোদের এক-একটাকে আমি আস্ত পুতব নদীর মধ্যে হারামজাদারা।…ভয়ঙ্কর রোখা লোক বাবাঠাকুর, নৈলে জমিদারের পিসে হতে পারে?

পুল না হাতি, বোধ হয় দেখেইছ তুমি বাবাঠাকুর! এপার থেকে ওপার পর্যন্ত একসারি বাঁশের খুঁটি পোতা আছে, তার সঙ্গে দুসারি বাঁশ ওপর নিচে করে এমড়ো ওমুড়ো বাঁধা, একটা ওপরে পা দিয়ে একটা ধরে পার হও—বৈতরণী বলে আমি পদে আছি। সে-পুল দিয়ে দাওয়ানজি পার হতে চাইত না বাবাঠাকুর; মোটা মানুষ, তায় এ-সবে অব্যেস নেই তো?–আমার যা আন্দাজ, কণ্ডার সুমুন্দিদের নিয়ে খুড়শ্বশুরের কেরামতিটা দেখে ওনার একটু খটকা নেগে গেছল বোধ হয়; জমিদার সেরেস্তার দাওয়ান, ঝানু নোক তো বাবাঠাকুর? কত দেখেছে কত শুনেছে। অবিশ্যি তিনি খুড়শ্বশুরের সাথে একরকম একজোট হয়েই সুমুন্দিদের সরালে, তবুও কয়েকবার আড়চোখে তানার দিকে ফিরে ফিরে দেখলে যেন।

পা টিপে টিপে দাওয়ানজি য্যাখন, পুলটার আদ্ধেকের কাছাকাছি গেছে, পুরুতমশাই কেনারা থেকে জিগ্যেস করলে—’আমিও তাহলে আসব নাকি?”

.

বেচারী বুড়ো হয়ে এসেছে, অতটা ঠাওর করতে পারে নি, দাওয়ানজির ত্যাখন পা বেশ একটু একটু কাঁপতে নেগেছে। তিনি বাঁশটা বুক দিয়ে জড়িয়ে ধরে, ঘুরে না দেখেই বললে— ‘আসুন না, এ তো নেতান্তই কিছু নয়, যেন মনে হচ্ছে ছাতের ওপর হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছি।’

হ্যাঁ, হাত সাফাই বলতে হবে বাবাঠাকুর! খুড়শ্বশুর বললে কিনা, কুটুম মানুষের অদেষ্ট না বালির বাঁধ।—এদেরই বাপ-পিতেমোরা এক সময় ডাকাতি করে খেতো, কপাল ভেঙেছে, আজকাল ডুলী বেয়ারাগিরি করে কোনরকমে দিন গুজরান করছে।…দাওয়ানজি পুলের ঠিক আধা-আধি পৌঁছে পুরুতঠাকুর কতটা এগুলো দাঁইড়ে সাড়া নিচ্ছে, এমন সময় পিসের পালকি মাথায় করে এরা নদীর কোলে পৌঁছল! ঠিক নিচে পৌঁছেই সামনের একজন বলে উঠল— সামলে, পেছল ‘…চরণদাস বলে উঠল—’বাঁশের খুঁটি ধরে ফেল্ সবাই, ওপরে আপনারা একটু কষে ধরবেন:…দাওয়ানজি বললে- ‘খবরদার, বাঁশ ধরবি নে, নড়ছে।’—পিসে আর কুলগুরুঠাকুর পালকির ভেতর থেকে চেঁচ্যে বললে-’বাঁশ কষে ধর, খবরদার, পালকি দুলছে…জোয়ান জোয়ান আটজনের নাড়া খেয়ে পুল তখন বেশ দুলতে নেগেছে বাবাঠাকুর। দাওয়ানজি ত্যাখন দুটো হাত আর গলা দিয়ে বাঁশটাকে আঁকড়ে ধরে নাগরদোলার দোল খাচ্ছে আর পরিত্তাহি চেঁচাচ্ছে—’বাঁশ ছাড় হারামজাদারা; শিগগির বাঁশ ছেড়ে দে!’…এদিকে—’পেছল, সামাল! পেছল, সামাল!’—করে পালকিকে রীতিমত ঝাঁকানি লাগ্যেছে। ভেতর থেকে পিসে বলছে—’খোঁটা বাগ্যে ধরিস, গুরুঠাকুর রয়েছেন।’ ওপরে পুরুতঠাকুর চেঁচাচ্ছে, আমায় ফিরে যেতে দে, পালকিতেই পেরুব ধীরে-সুস্থে … দাওয়ানজি বলছে, ‘ছাড় খোঁটা আমি বুকে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পাচ্ছি না আর:’…সবারই গলা চিরে যাচ্ছে বাবাঠাকুর, এমন সময় খুব জোরে—’সামাল! সামাল!’—বলে এমন একটি রামঝাঁকানি দিলে বাবাঠাকুর, দাওয়ানজি গুলতি দিয়ে পাড়া পাকা আমটির মতন পুলের ওপর থেকে এক্কেবারে পালকির মাঝখানটিতে,—সঙ্গে সঙ্গে পালকির ছাদ ভেঙে ওঁদের দুজনসুদ্ধ এককোমর জলে…’

রসিকলাল শুনিতে শুনিতে শেষের দিকে উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছিলেন, প্রশ্ন করিলেন— “মারা গেল নাকি রে!”

হারাণ বলিল— “খুড়শ্বশুর ছাপোষা মানুষ, পাঁচটা কাচ্ছাবাচ্ছা নিয়ে ঘর করে, ব্রেহ্ম-হত্যে করে কি পাপের ভাগী হতে পারে? কিছু একটা হলে তো তানারই পাপ লাগতো? বেয়ারা সবাই তো নিরীহ মানুষ; সাতেও থাকে না, পাঁচেও থাকে না কারুর, যেমন বলেছে করে গেছে। তবে পালকি যখন টেনে তুললে—উরি মধ্যে একটু আন্দাজ করেই তুললে বাবাঠাকুর—ত্যাখন তিনজনেই বেশ খানিকটা করে ঘোলা জল খেয়ে কপালে চোখ তুলেছে, দাওয়ানজি ছাদ ফুঁড়ে, ওনাদের দুজনার মাঝখানটিতে যেয়ে সভা করে বসেছিল কিনা।…হ্যাঁ, নেশানা বটে বাবাঠাকুর! গল্পই শুনে এসেছি অ্যাদ্দিন, গিরি দিদিমণির কল্যেণে স্বচক্ষে পেত্তক্ষ কর!

ওদিকে পুরুতঠাকুর হালকা মানুষ, ছিটকে তিনপাক খেয়ে একটা কেয়াবনের ঝোঁপের মধ্যে প’ড়ে…”

এমন সময় সাতকড়ি, হরু এবং আর কয়েকজন ছেলে হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া বলিল— “শিগগির ডাকছেন তোমাদের!…”

হারাণ বলিল— “কেন, রামীর মার নিমুনিয়ার কথা বল নি?”

সাতকড়ি বলিল— “সে তো সেখানে আলপনার পিটুলি বাটছে, শুনে বললে— যে বলেছে তারেই ডবল নিমুনিয়া ধরুক আগে।”

বড়দিদিমাকে শৈলেনের বেশ মনে পড়ে। আঁটোসাঁটো গড়নের মানুষটি, নাকে রাঙা-পাথর বসানো একটি নথ। খুব রহস্যপ্রিয় ছিলেন; সোনা, পান্না আর হাসিতে মুখখানি সদাই ঝলমল করিত। এদিকে সংসারের সঙ্গে তাঁহার সম্বন্ধটা ছিল ছাড়াছাড়া। ঠিক অবহেলা নয়, আসলে সমস্ত গ্রামটা ছিল তাঁহার সংসার,—কাহার অসুখ, কাহার প্রসববেদনা উঠিয়াছে, কাহার বাড়িতে আনন্দের ভোজ, কাহার বাড়িতে অভাবের অনশন—এই সামলাইতেই বড়-দিদিমার দিন কাটিয়া যাইত; কখন কখনও রাত্রিও। তবে নিজের সংসার সম্বন্ধে একটা শক্তি তাঁহার খুব প্রবল ছিল,–কোথাও একটু সূক্ষ্মতম ত্রুটি হইলেও তাঁহার চোখটা সেখানে গিয়া পড়িত, সেটুকু সংশোধন করিতে বড় কড়া হইয়া উঠিতেন, দরকার পড়িলে স্বামীও বাদ পড়িতেন না। তাহার পর আবার সেই ঔদাসীন্য। সংসারটা চালাইতেছেন ছোটদিদিমা,—শ্যামাঙ্গী, খুব টানাটানা চোখ, কর্মঠ, স্বল্পবাক। রাগিতেন শুধু স্বামীর ঢিলেপনা লইয়া, সে রাগও হাসিয়া নষ্ট করিয়া ফেলিতেন।…এই রাগটুকুও মেয়ের মধ্যে আসিয়া একেবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছিল,—শৈলেন মাকে কখনও রাগিতে দেখে নাই, উনি আবার প্রায় রাগিবার আগেই হাসিয়া ফেলিতেন।

বড়দিদিমার সংসারে একটু টান হইত যখন শৈলেনরা মামার বাড়ি যাইত। নাতিদের দেখা- শোনা, ধোওয়ানো-মোছানো, একটা বড় থালায় ভাত লইয়া নিজের হাতে খাওয়াইয়া দেওয়া,—সঙ্গে সঙ্গে চলিত নাতিদের লইয়া সেকালের দিদিমাদের ঠাট্টা।…’কি জ্বালা, গিরি, তোর মেজ-ছেলেটা যে কোনমতেই আমার আঁচল ছাড়তে চায় না! আমায় নিয়ে দাদামশাইয়ের সঙ্গে শেষে শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই বাধাবে নাকি…দুদিনের জন্যে এসে এ কি মায়ায় আবদ্ধ করা বল্ দিকিন?”

আসল কথা বড়দিদিমাকে তো এমনিই ভাল লাগিত শৈলেনের, তাহার উপর ছিল তাঁহার গল্প, রূপকথা, আবার রূপকথার চেয়েও আশ্চর্য কথা সব।—

“তোর বাবা যখন উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে, তখনও আমি বিছানায় শুয়ে। মাথাটা ছেড়েছে, কিন্তু লজ্জায় আর আপসোসে আমি মুখ তুলতে পারছি না। মনে একটা আগ্রহ রয়েছে, অথচ ভাবছি—কাতুর মতন মানুষকে ওরকম করে বললাম, আর তার সামনে মুখ তুলব কি করে? ওদিকে বরণ আমায়ই করতে হবে, তোর দুই দাদামশাই বাইরে তাগাদা লাগিয়েছে, কাতু আমার গলা জড়িয়ে বলছে—তুমি ওঠ দিদি; আমি তোমায় না চিনতাম, রাগ করতাম। তুমি বলেছ, না পাঁচভূতে বলিয়েছে, জানি ভেতরের সব কথা তো সব….”

মাথার দিব্য দিয়ে একরকম টেনেই তুললে আমায়। দাওয়ায় এসে দেখি তোর বাপ সমস্ত উঠোনটা যেন আলো করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সে কী ভিড়! বর দেখবার জন্যে মেয়ে-পুরুষে এত লোক জুটে গেছে যেন তিল ফেলবার ঠাঁই নেই উঠোনে। বড্ড মনটা দমে গেছল, তার পরেই এই দেবকুমারের মতন রূপ ছেলের, বেশ মনে পড়ে প্রথমটা আমি কী রকম হয়ে গেলাম একেবারে। একবার মনে হ’ল স্বপ্ন দেখছি না তো? একবার মনে হ’ল ও-বাড়ির বড়ঠাকুরের একটা কিছু সাজানো ব্যাপার, এখুনি যেন এ ভাবটা মিলিয়ে গিয়ে অন্য একটা কি হয়ে যাবে। আহ্লাদে ভয়ে কি রকম যে হয়ে গেছি, কাপড় ছাড়বার জন্যে কাতু, তোর ছোটদিদিমা, আরও সবাই তাগাদা দিচ্ছে, শুনছি, কিন্তু যেন হুঁশ নেই। তোর বড়দাদু ভিড় ঠেলে ঠেলে যেন চরকি ঘুরে বেড়াচ্ছে নেমন্তন্ন থেকে নিয়ে বিয়ের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি সদ্য সদ্য ঠিক করা—সোজা কথা নয় তো। একবার কতকগুলো কাপড়-চোপড় হাতে করে—’উঠল বড়বৌ?” বলতে বলতে আমার ঘরের দিকে আসতে আসতে আমায় দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, – খাটুনিতে, আহ্লাদে, এদিকে আবার দুর্ভাবনার যেন কি রকম হয়ে গেছে, আমার দিকে চেয়েই চোখ ছলছলিয়ে উঠল, বললে— ‘যাও শিগির, তুমিই না বলতে ওর বাপের বিশ্বাস ফলবেই, গৌরীকে নিয়ে যেতে আসতেই হবে তাঁকে একদিন…’

বড়দিদিমার গল্প বলার কথা এখনও প্রায়ই মনে হয় শৈলেনের। তাহারা এপাশে ক’জন, ওপাশে ক’জন, মাঝখানে দিদিম শুইয়া, কুলঙ্গির মধ্যে পিতলের প্রদীপের আলোর শিখা কাঁপিয়া ঘরের ছায়াগুলো যেন সজীব করিয়া তুলিয়াছে। রান্নাঘর থেকে মাঝে মাঝে ছোটদিদিমা কিংবা হয়তো মায়েরই আওয়াজ আসিতেছে—’তোরা যেন ঘুমিয়ে পড়িস নি, আর দেরি নেই বেশি।’ ঘরে কোথায় মুড়ি রাখা আছে, দেশের মুড়ির বিশিষ্ট সোঁদা-সোঁদা গন্ধটা মাঝে মাঝে নাকে আসিতেছে। গল্পের মধ্যে দিদিমার স্বরটা এক-একবার আবেগে গাঢ় হইয়া আসিতেছে।

শৈলেনের বড় অদ্ভুত ঠেকিতেছে। এক প্রকারের নূতন অনুভূতিতে মনটা ভরিয়া যাইতেছে, সেটাকে বোধ হয় বংশানুভূতি বলিয়া অভিহিত করা চলে—মনে হয় মাকে লইয়া যাওয়ার মধ্যে সেও যেন কোথায় উপস্থিত রহিয়াছে। এই মাকে দিদিমার গল্পে নূতন রূপে দেখিয়া তাহার বিস্ময় লাগে। একটু যেন দূর বলিয়াও মনে হয়,—মামার বাড়ির সবাইকে লইয়া মা যেন আলাদা। তাহার পর কবে কোথায় তপস্বিনী উমাকে যেমন কৈলাসে লইয়া যাওয়া হইয়াছিল, সেইরকম একটা ব্যাপারের মধ্যে দিয়া মা ক্রমে ক্রমে হইয়া পড়িলেন সাঁতরার ওদের। শৈলেনরা যেন সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কোথায় কিভাবে আছে। সেই দূরের মা-ই আজ আবার সমস্ত মামার বাড়িসুদ্ধ কাছে হইয়া গেছেন, আপনা হইয়া গেছেন নিবিড় ভাবে। এদিকে গল্প চলিতে থাকে, ওদিকে শৈলেনের নিজের জগৎ ওঠে রেখায় রেখায় পূর্ণ হইয়া। যাঁহারা দেবমূর্তিতে পূজা পান তাঁহারাই যেন মানবমূর্তিতে রূপান্তরিত হইয়া গেছেন।—কখন, আর কি করিয়া বোঝা যায় না, তবে মনে হয় যেন ঠাকুরমার সকালবেলাকার শ্লোকের, অজানা অর্থের ‘রজতগিরিনিভ’ শঙ্কর উঠানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, পাশে বধূবেশিনী উমা-পার্বতী… এমন সহজভাবে, কোন কিছুর গণ্ডি না ডিঙাইয়া হয় ব্যাপারটা যে, শৈলেনের মনে একটু প্রশ্ন উদয় হয় না, বিশ্বাসে এতটুকু বাধে না, দৃষ্টিতে এতটুকু কুহেলি স্পর্শ করে না। বাঙালীর ঠাকুরদেবতা ঘরের লোক, মানুষের নিত্য সুখ-দুঃখে, মানুষের মতোই হাসি আর অশ্রু লইয়া মানুষের সঙ্গে মিশাইয়া আছেন,—মা কখন পার্বতী-উমা হইয়া যান, পার্বতী-উমা কখন মায়ের মধ্যে কানায় কানায় ভরিয়া ওঠেন বোঝা যায় না, তবে দিদিমার গল্পে নিত্যই যেন এই খেলাই হইয়া চলিয়াছে।…শৈলেনের কান থাকে গল্পে, দৃষ্টি থাকে তাহার নিজের গড়া এই কল্পলোকে। এক এক সময় কল্পলোকই এত বাস্তব হইয়া ওঠে, গল্প আর কানেই আসে না, ‘হুঁ’ দেওয়া বন্ধ হইয়া যায়। দিদিমা বলেন— “মেজকত্তা ঘুমুলে নাকি?…গিরি তোদের হল গা? তোরা যেন যজ্ঞির রান্না রাঁধছিস বাছা, পারে কখনও কচ্ছেলেরা জেগে থাকতে এতক্ষণ?’

শৈলেন বলে— “তুমি বলো না দিদিমা, ঘুমোব কেন?”

গল্প চলে : “প্রথম যখন ছেলে-কোলে এল গিরি, আমার বেশ মনে আছে, থাকবেই কিনা—কেমন আশ্চর্য রকমে এসে পড়ল—একেবারে হঠাৎ! — চারিদিকে ষষ্ঠীর বোধনের আওয়াজ উটেছে। সিংহবাহিনীর তলায় যাত্রার দল নেমেছে, তাতে রামীর মার দূর সম্পক্কের এক ভাই গান গায়। রামীর মা তাকে নিয়ে এসেছে, উঠোনে বসে আমরা গান শুনছি। এই বিকেল বেলাকার দিকটা আর কি, বেটাছেলেরা সব সিংহবাহিনীর তলায় গেছে। আশপাশের ক’বাড়ির মেয়েরা একত্তর হয়েছে, ছোঁড়াটা গান করছে। গানটা মনে নেই সমস্ত, তবে প্রথম দিকটা একটু একটু মনে আছে, কানে বড্ড লেগে গেছল কিনা—’মা, গা তোল গা তোল, বাঁধো মা কুন্তল, ঐ এল পাষাণী তোর ঈশানী। লয়ে যুগল শিশু কোলে, মা কৈ মা কৈ বলে…’ আর মনে পড়ছে না। একে ছোঁড়াটার গলা খুব মিষ্টি, তাতে প্রায় বছর তিনেক দেখি নি মেয়েটাকে, প্রাণটা যেন আইঢাই করে উঠল। চোখের জল না সামলাতে পেরে তোর ছোটদিদিমা আর আমি দুজনেই আঁচল তুলেছি এমন সময়—’জেঠাইমা কৈ গো?—মা কোথায়?” বলতে বলতে দোর টপকে একেবারে গিরি!—কোলে এই ইনি—বড় কর্তা…”

দিদিমা দাদার পানে মুখ ফিরাইয়া মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে হাসিয়া বলিলেন— “এখন বড় কর্তা হয়েছেন, মুরুব্বী হয়েছেন; তখন এত্তোটুকুটি—ফুটফুট করছে রং, মাথায় একমাথা কালো কুচকুচে চুল…’ওমা, কে গো?—গিরি! তুই আমাদের মন থেকে বেরিয়ে মাটিতে পা দিলি নাকি গো?’…সঙ্গে সঙ্গেই তোর ছোটদাদুর সঙ্গে গল্প করতে করতে জামাই এসে গড় করলেন….”

অত্যন্ত আশ্চর্য বোধ হয় শৈলেনের, একটু উঠিয়া ঘাড় ফিরাইয়া দেখে, কি ভাবিয়া হাসিয়া বলে— “দাদা!” দাদাও একটু হাসিয়া বলে— “যাঃ”—দুজনেই বোধ হয় ভাবে মস্ত বড় একটা গৌরবের কাজ হইয়া গেছে—যাহাতে গৌরবের জন্যই লজ্জিত হইয়া পড়িবার কথা।

গল্প এগোয়, শৈলেনের আবার ভাঙাগড়া চলিতে থাকে। মনটা যেন স্বপ্নের ঘোরে কোন্ বিস্ময়কর জগতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে থাকে, সেদিনকার মা, কাপড়ে, গয়নায়, আলোয় ঝলমল—তখন তাহারা কেহই ছিল না—তাহার পর ঐ মা–দাদা কোলে,—মনে পড়িয়া গেল পাঁজিতে কবে একটা ছবি দেখিয়াছিল—গণেশকে কোলে লইয়া দুর্গা আসিয়াছেন বাপের বাড়ি, পিছনে মহাদেবের কোলে কার্তিক, পাশে লক্ষ্মী-সরস্বতী, আরও পিছনে একটা মোট কাঁধে নন্দী কি ভৃঙ্গী; সামনে চণ্ডীমণ্ডপের মতো একটা বাড়ি থেকে নামিয়া একটি স্ত্রীলোক আগাইয়া যাইতেছে— বোধ হয় মেনকা। ছবির নীচে লেখা আছে—’শ্রীশ্রীদুর্গা পূজা’…ঐ মা’র পরে আবার আজকের এই মা…শৈলেন একটু আগে একবার রান্নাঘর গিয়াছিল,—মা ছোটদিদিমার সঙ্গে গল্প করিতে করিতে রাঁধিতেছেন, আগুনের আলোয় মুখটা রাঙা হইয়া উঠিয়াছে; কপালে, ওপর ঠোটে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমিয়া উঠিয়াছে, সিঁথির সিঁদুর একটু যেন ভিজিয়া চিকচিক করিতেছে, গল্পচ্ছলে কি একটা বোধ হয় কৌতুকের কথা হইয়াছে, মা’র মুখে হাসির জের লাগিয়া আছে এখনও; অত্যন্ত ব্যস্ত….

শৈলেন প্রশ্ন করে— “হ্যাঁ বড়দিদিমণি, উমাই তো শেষকালে অন্নপূর্ণা হয়েছিলেন বড়দিদিমণি?”

দিদিমা হাসিয়া বলেন— “শোন কথা মেজকর্তার! অন্নপূর্ণা যেন আর একজন কেউ!”

.

সব গল্প একদিনেই শোনা নয়, এমন কি বোধ হয় একবারেও নয়, তবে বড়দিদিমার মুখেই প্রায় সব শোনা। ছোটদিদিমণির আদরটা রূপ ধরিত বেশিরভাগ খাওয়ানোয়, গল্প বলিবার মতো তাঁহার বড় একটা ফুরসুতও থাকিত না, তাহা ভিন্ন বড় জায়ের নিকট হইতে নাতিদের পাওয়াও সম্ভব ছিল না গল্প শুনাইবার নিমিত্ত।…বড়দিদিমা বলিতেছেন :

“সমাজ আছে বৈকি, সমাজ নেই তো মানুষের চলছে কি করে?—দায় আছে ধৰ্ম্ম আছে মানুষের, সমাজই তো দেখে।…তোদের বড়দাদু তো পাগলের মতন হয়ে উঠল—চরখি বাজির মতন ঘুরপাক খাচ্ছে—এটা সামলে, ওটা ঠিক করে, আর মাঝে মাঝে ঐ এক কথা—’মা আমার তো সব সামলে নিলে নিজের তপিস্যের জোরে, কিন্তু নিকুঞ্জদাদার হাত থেকে কি করে পরিত্রাণ পাই?—সে যে এসেই ঝগড়া লাগাবে, কি করে কাটবে রাতটা?…হে ভগবান, হে বাবা তারকেশ্বর, আজকের রাতটা কাটিয়ে দাও…হে মা সিংহবাহিনী’…

“শেষকালে কথাটা ঘোষালঠাকুরের কানে উঠল। তিনি ওদিকের ব্যাপারটা সামলাচ্ছিলেন, এসে এ উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চীৎকার করতে লাগলেন—বলি, তুমি যে মেয়েমানুষেরও বাড়া হলে হে?—বেলে-তেজপুরের সমাজে কি মানুষ নেই,—সব ভেড়ার দল? এই জোর গলা করে বলছি—দিক দিকিন বাগড়া, কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে দেখি! নরু ঘোষাল মরে গেছে? ওই কেমন করে বেলে-তেজপুরে বাস করে দেখব? ওই আগে সমাজের কাছে জবাবদিহি দিক—টাকা খেয়ে তঞ্চকতা করে ও একটা নিরীহ লোকের কেন এভাবে সর্বনাশ করতে যাচ্ছিল,—একটা তেজপুরে আটচল্লিশ বছরের দেউলেমারা জোচ্চোরের সঙ্গে সাজোস করে! তার নাড়ি নক্ষত্রের খোঁজ নিই নি আমি? নেহাত আমল দিচ্ছিলে না, কি করব?…রাজা!—সে হারামজাদা রাজার লোকেরা পৌঁছচ্ছে না কেন এসে? আমি তাদের দেখে নোব, দেখে নোব কেমন করে তারা আস্ত শরীরে বেলে-তেজপুর থেকে ফিরে যেতে পারে…আর, তুমি কি ভেবেছ হতে দিতাম আমরা ও বিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের চোখের সামনে?”

—ভয়ঙ্কর রাগী লোক, সে কি থামতে চান?

“চারিদিকে ছি-ছিক্কার পড়ে গেল। যাই হোক সে রাত্তিরে আর ফিরে আসতে পারলেন না ও- বাড়ির বড়ঠাকুর, ওদিকে আবার এই বিটকেল ব্যাপার কিনা,—যারা আসছিল তারা সব পুল ভেঙে সুতুনির খালের মধ্যে পড়ে মরণাপন্ন। বলে যে ধম্মের কল বাতাসে নড়ে—সে তো মিথ্যে নয়।…অত গোলমালের মধ্যে, অত তাড়াহুড়োর মধ্যে খুবই সুচরংকুলে কেটে গেল রাতটা। খানিকটা যোগাড়যন্ত্র ছিলই, তোর দাদামশাই গ্রামের সমস্ত মেয়েপুরুষ বলে এল। যখন লোক এসে পড়তে লাগল, হুঁশ হল বসাবে কোথায়? আমার তো চিরকালই দুষ্টু বুদ্ধি?—বললাম—’কেন ও-বাড়ির বড়ঠাকুরের অত বড় বাড়িটা রয়েছে কি করতে?”

“দামিনী ঠাকুরঝি মাথাব্যথার নাম করে বাড়ি গিয়ে শুয়েছিল, উমেশ লাহিড়ী, তোদের বড়দাদু, আরও কয়েকজন গেছেন। আমিও খিড়কির দিক দিয়ে পৌছুলাম। আগেই পৌঁছে— যেমন বলি—ইনিয়ে-বিনিয়ে আপনাত্ব দেখিয়ে বললাম—নিজের বাড়িতে কাজ, আর তুমি কিনা ঠাকুরঝি শয্যে আশ্রয় করে পড়লে?—আমি জেঠাই, একটু পড়েছিলাম তাইতেই সবাই ত গঞ্জনা দিচ্ছে, তুমি আবার হলে বাপের বোন পিসি!…”

“মিষ্টি চিপটেন কাটছি, এমন সময় এঁরা এদিক থেকে সব গিয়ে পড়লেন! তোর বড়দাদু বললে— “দিদি, দেখতেই তো পাচ্ছ, কি আতান্তরে পড়েছি, বাড়ির খানিকটা একটু ছেড়ে দিতে হবে সবার বসবার জন্যে, নৈলে মান-সম্ভ্রম থাকে না।”

দিদিমা নিজের কূটবুদ্ধির স্মরণে হাসিয়া উঠিতেছিলেন মাঝে মাঝে, বলিতেছেন— “আমি ঘরের মধ্যে ঐ-জন্যেই আগাম গিয়ে জুটেছি, একবার পিত্তিরক্ষে গোছের করে খাটের কাছে গিয়ে বললাম—’শুনছ ঠাকুরঝি, কি বলছেন ওঁরা?’…তারপর কি উত্তর দেয় না শুনেই দোরের কাছে এগিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে বাইরের সবাইকে শুনিয়ে বললাম— ঠাকুরঝি বলছেন, এ-বাড়ি আর ও- বাড়ি কি আলাদা যে ওঁরা আমায় জিগ্যেস করতে এসেছেন, না, গিরি আমার পর?’…উস্‌, সেই একটি দিনে অতদিনকার গায়ের জ্বালা সব মিটিয়ে নিয়েছিলাম। ও আবাগী ওদিকে গায়ের চিড়বিড়িনিতে আড়ামোড়া ভাঙছে বিছানায়, কিছু মুখ ফুটে বলতেও পারে না…এদিকে ওঁরা একটা কথা বলছেন আর আমি খাটের কাছে গিয়ে ধৰ্ম্মের ডাক ডেকে, দোরের কাছে এসে বানিয়ে বানিয়ে বলছি—হাসিতে পেট ওদিকে গুরু-গুর করে উঠছে…”

দিদিমা যেন সদ্যই উপভোগ করিতেছেন এইভাবে উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া ওঠেন। বলেন—’তার পরদিনও নয়, তার পরের দিন—মেয়ে জামাই যখন চলে গেছে, সন্ধ্যে হয়ে গেছে, বড়ঠাকুর এল। ট্যা-ফোঁ—কিচ্ছু নয়, বাড়ি ঢুকল যেন চোরের মতনটি হয়ে। সব খবর তো পেয়েছিলই, তা ভিন্ন টেরও পেয়েছিল যে সমস্ত বেলে-তেজপুর বেঁকে দাঁড়িয়েছে ওর ওপর।

“সকালবেলা ঘোষালঠাকুর, রমাই চাটুজ্জে, কেদার চৌধুরী, উমেশ লাহিড়ী—আরও দু-তিনজন কাকে সাক্ষী করে নিয়ে—সেই আগেকার পনের টাকা, তারপরের একশ’ টাকা, তার পরের পাঁচশ’ টাকা—সব ফিরিয়ে দিয়ে তোমার দাদু একখানা রসিদ লিখিয়ে নিলে।… কম ভোগান ভুগিয়েছে আমাদের ওরা?”

.

মুখে শোনা শৈলেনের।

সবচেয়ে বেশী কাঁদিয়াছিলেন কাত্যায়নী দেবী; অত কান্না বড়দিদিমা পর্যন্ত নাকি কাঁদেন নাই। উল্লেখ করিতে গেলেই মায়ের চোখ ছলছল করিয়া উঠিত, বলিতেন— “মেজমাসিমার কথাগুনো যেন দাগ কেটে বসে রয়েছে বুকে—গিরি, তোকে ভালবেসে আমি কলঙ্ক নিলাম। তুই মা আমায় কিন্তু কখনও ভুল বুঝিস নি—বিশ্বাস করিস, যা ভুল করতে যাচ্ছিলাম, তা ভালোবাসারই ভুল। বল্ বিশ্বাস করলি—বল্, মনে কিছু নেই, বল্ গিরি।”

মায়ের সমস্ত চিত্তটা যেন স্মৃতির আলোড়নে মথিত হইয়া উঠিত, একটি দীর্ঘশ্বাসের সহিত অসীম প্রীতি আর শ্রদ্ধায় বলিতেন— “কী মানুষই ছিলেন, অমনটি আর দেখলাম না!”

–স্বর্গাদপি গরীয়সী প্রথম খণ্ড সমাপ্ত–