স্প্যানিশ কবিতা: রূপের অনুসন্ধান
আমাদের এই আলোচনা ও অনুবাদের পরিধি বিংশ শতাব্দী। কিন্তু অনেক পাঠক। হয়তো আশ্চর্য বোধ করবেন যে, বিংশ শতাব্দীর স্প্যানিশ কবিতার অনুবাদে আমি রুবেন দারিয়ো-কে গ্রহণ করিনি। রুবেন দারিয়ো এ শতাব্দীর শুরুতে অন্তত কুড়ি বছর স্প্যানিশ কবিতায় সম্রাটত্ব করেছেন।
তাঁকে গ্রহণ করিনি, তার কারণ, এই শতাব্দীর শুরুতে প্রায় সব প্রধান ভাষাতেই কতকগুলি আধুনিক, জটিল ও গভীর মনোযোগযোগ্য সাহিত্য আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছে এবং বহু নবীন ও বলীয়ান কবির দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু স্প্যানিশ ভাষায় সেরকম কোনও সাহিত্য আন্দোলন দেখা যায়নি। স্পেনের সাহিত্য তখন প্রধানত ফরাসিদের ছত্রছায়ায় মুগ্ধ ছিল। রুবেন দারিয়ে নিজেই একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন, যার নাম মডার্নিজম, যা আসলে কিছুই এমন মডার্ন নয়। শুধু আধুনিকতা কথাটার কোনও মানে হয় না, পূর্ববর্তীদের তুলনায় আলাদা কোনও চিন্তা ও রীতির সৃষ্টি না হলে তা নিরর্থক। রুবেন দারিয়ো সেরকম কিছুই করেননি, পুরনো সৌন্দর্যতত্ত্ব ও রক্তমাংসের বর্ণনার সঙ্গে তিনি ফরাসি সিম্বলিস্টদের রীতি গ্রহণ করেছিলেন মাত্র। যদিও লেখক হিসেবে তিনি অসীম শক্তিশালী ছিলেন, সন্দেহ নেই। দারিয়োর জন্ম দক্ষিণ আমেরিকার নিকারাগুয়ায়, তরুণ বয়েসে নানা দেশ ঘুরে তিনি চিলিতে এসে কিছু সাহিত্যিকের সংস্পর্শে এসে ফরাসি সিম্বলিস্ট কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই প্রভাবে রচিত তার কয়েকটি গ্রন্থ তাকে প্রভূত জনপ্রিয়তা এনে দেয় এবং মূল স্প্যানিশ ভুখণ্ডেও তিনি অবিলম্বে প্রধান লেখকের স্বীকৃতি পান। তাঁর একটি ভক্তদল গড়ে ওঠে এবং মডার্নিজম কথাটির সূত্রপাত হয়। আসলে তার বিষয় ছিল বাস্তব থেকে পলায়ন, বিশুদ্ধ রূপের স্তুতি, বিদেশ বা অচেনা দেশের আঁকজমকপূর্ণ বর্ণনা এবং বাদলেয়ারের কাছ থেকে পাওয়া অবক্ষয় ও পাপের প্রতি কৌতূহল। ১৯১৬-তে রুবেন দারিয়োর মৃত্যুর অল্পদিনের মধ্যেই মডার্নিজমেরও মৃত্যু হয়। দারিয়োর রচনা এখন প্রায় ক্লাসিকাল পর্যায়ে পড়ে।
তবে, জাতিগতভাবেই স্প্যানিশরা অনেকখানি রূপাভিলাষী। সৌন্দর্যতত্ত্বে ও বিশুদ্ধরূপের অনুসন্ধান পরবর্তী খাঁটি আধুনিক স্প্যানিশ কবিদের মধ্যেও দেখা যায়। কিন্তু সে সৌন্দর্যজ্ঞান নিছক সময় বহির্ভূত এবং নিছক অভিভূত প্রকাশ নয়। হিমেনেথের অকিঞ্চিৎকর বর্ণনা বর্জনের প্রয়াস এবং লোরকার পল্লিগাথার প্রতি আকর্ষণও এক হিসেবে এই সৌন্দর্য পিপাসার ইঙ্গিতবহ। অন্যান্য দেশের সমসাময়িক কালের মতো নিষ্ঠুরতা, বীভৎস রসের প্রাধান্য, অলৌকিক কিংবা সুপ্ত মনের ভয়াবহতার প্রকাশ স্প্যানিশ কবিতায় বিশেষ দেখা যায় না। আনতোনিও মাচাদো দূরের দ্বীপে বসে তাঁর রচনাগুলিতে রুবেন দারিয়োর বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন। দারিয়োর বাইরের আড়ম্বর ও উচ্ছলতা পরিহার করে তিনি প্রবেশ করেছেন অন্তরে, তার ভাষা প্রায় গদ্যের কাছাকাছি সরল, কিন্তু তিনি নিজের আত্মার দিকে তাকিয়ে তবেই দেখতে চেয়েছেন প্রকৃতির রূপের প্রতিচ্ছবি, আবিষ্কার করতে চেয়েছেন ব্যক্তিগত ঈশ্বরকে। এখান থেকেই শুরু হয়েছে স্প্যানিশ কবিতায় নবীন সার্বজনীনত্ব, আমাদের আলোচনা এখান থেকেই শুরু করেছি। এই শতাব্দীর শুরুতে স্প্যানিশ ভাষায় আলাদাভাবে উচ্চারণ করার মতো প্রচার কোনও সাহিত্য আন্দোলন দেখা দেয়নি, কিন্তু বেশ কয়েকজন অসম্ভব শক্তিমান কবির রচনা উপহার পেয়েছেন এ পৃথিবী। ১৯৫৬ সালে হিমেনেথ যখন নোবেল পুরস্কার পান, তখন অনেক সমালোচক বলেছিলেন, এ পুরস্কার শুধু হিমেনেথের নয়, আসলে এ পুরস্কার মিলিতভাবে তিনজনের হিমেনেথ, মাচাদো এবং লোরকার, কেননা, শেষোক্ত দু’জন তখন বেঁচে ছিলেন না, নইলে তাদের পুরস্কার না দেওয়া নোবে পুরস্কারেরই অপবাদ।
মিগুয়েল দে উনামুনো
[এই শতাব্দীর স্প্যানিশ চিন্তা ও সংস্কৃতিতে উনামুনো এক বিশাল স্তম্ভস্বরূপ। সলোমাংকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে বসে তিনি যখন বন্ধু ও শিষ্যদের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন তখন তা শোনবার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে আসত লেখক ও দার্শনিকরা। তার কাছে গুণীজন আসতেন তীর্থদর্শনে। স্পেনের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় সলোমাংকা, সেখানে উনামুনো ছিলেন গ্রিক ভাষার অধ্যাপক, পরবর্তীকালে ওখানে রেকটর হয়েছিলেন। তার এই প্রকার আলাপচারি সক্রেটিসের কথা মনে পড়ায়, কিন্তু উনামুনোর দুর্ধর্ষ প্রতিভার খ্যাতি ছড়িয়েছিল তরুণ বয়সেই। জন্ম ১৮৬৪, এবং বিংশ শতাব্দী শুরু হবার মুখেই তিনি তরুণ বুদ্ধিজীবী সমাজের দলপতি।
পরবর্তীকালে দার্শনিক হিসেবে উনামুনো সর্বজনস্বীকৃতি পেলেও, তিনি ধর্মনেতা বা নৈতিক গুরুর ভূমিকা গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন আজীবন বিপ্লবী, উনামুনো কথাটিরই শব্দার্থ বিজয়ী। গোঁড়া ক্যাথলিকদের দেশেও তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য সম্প্রদায় সৃষ্টি করেন। গলায় টাই পরতেন না, শৌখিন শার্ট গায়ে দিতেন না, কালো গলাবন্ধ কোট পরা তার চেহারা ছিল সাধুর মতো, কিন্তু ধর্মের ক্রীতদাস না হয়ে। যেসময় রুবেন দারিয়ো স্প্যানিশ কবিতায় আধুনিকতা এনে হইহই করছেন, বলছেন রক্তমাংসই শ্রেষ্ঠ দেবতা, তখন উনামুনো প্রকাশ করলেন সমস্ত সীমানা ভাঙার নির্দেশ। স্প্যানিশ সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তিনি ইউরোপীয় তথা সর্ব জাগতিক হতে বললেন। মানুষ সম্পর্কেও তিনি বলেছেন, মানুষ তার জন্মভূমি থেকে লাফিয়ে সারা পৃথিবীর মধ্যে এসে পড়ুক।
উনামুনো কবিতা লিখতে শুরু করেন ৩০ বছর পেরিয়ে যাবার পর। তার কাছে কবিতা ছিল, ব্যক্তিগত জীবনের মুহূর্তকে অনন্ত করা। মুহূর্তকে তিনি আদেশ করেছেন, তুমি দাঁড়াও, আমার ছন্দ তোমাকে আবদ্ধ করেছে। এই কবিতাটি তার একটি অতি বিখ্যাত রচনা। বিষয় ও গভীরতায় কবিতাটি ভালেরির সমুদ্রের পাশে কবর-এর সঙ্গে তুলনীয়। কবিতাটিতে স্পষ্টত দুটি ভাগ, আমরা শুধু দ্বিতীয় ভাগটিই এখানে অনুবাদ করেছি। এই দ্বিতীয় অংশের যে বক্তব্য, তার অধিকাংশ রচনাও বহু বিতর্কমূলক বই দি ট্রাজিক সেন্স অব লাইফ-এরও বক্তব্য প্রায় এক। কবিতাটির প্রথম অংশে একটি কবরের বর্ণনা, সেখানে বৃষ্টি পড়ে, রোদ আসে, ভেড়ার পাল চরে বেড়ায়। দ্বিতীয় অংশে, কারখানার ক্রুশচিহ্ন মৃতদেহ পাহারা দেয়, আর জীবিত মানুষের জন্য কোনও ক্রুশ লাগে না কারণ ঈশ্বর স্বয়ং ব্যর্থ হয়ে মানুষের দিকে তাকিয়ে আছেন। নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যই ঈশ্বরের মানুষকে দরকার। তুলনীয় রবীন্দ্রনাথের: আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।]
ক্যাসটিলিয়ার এক গ্রাম্য কবরে
(অংশ)
তোমার পাশ দিয়ে গিয়েছে পথ, জীবিত মানুষের
তোমার মতো নয়, তোমার মতো নয়, দেয়াল ঘেরা
এ পথ দিয়ে তারা আসে ও যায়
কখনও হাসে আর কাঁদে।
কখনও কান্নার কখনও হাস্যের ধ্বনিতে ভেঙে যায়
তোমার পরিধির অমর স্তব্ধতা!
সূর্য ধীরভাবে মাটিতে নেমে এলে
ঊষর সমতল স্বর্গে উঠে যায়
এখন স্মরণের সময় মনে হয়
বেজেছে বিশ্রাম ও পূজার ঘণ্টা
রুক্ষ পাথরের স্থাপিত ক্রুশখানি
তোমার মাটি ঘেরা প্রাচীরে দাঁড়িয়ে
নিদ্রাহীন অভিভাবক যেরকম
একলা প্রহরায় গ্রামের গাঢ় ঘুম।
জীবিত সংসারে গির্জা ক্রুশহীন
এরই তো চারপাশে ঘুমোয় গ্রামখানি
ভক্ত কুকুরদের মতন কুশখানি রয়েছে প্রহরায়
স্বর্গে যারা আছে, মৃতের সেই ঘুম।
রাত্ৰিময় সেই স্বর্গ থেকে যিশু
রাখাল রাজা তিনি
সংখ্যাহীন তার চোখের ঝিকমিকি
ব্যস্ত গণনায় মেঘের ঝাঁকগুলি।
দেয়াল ঘেরা এই কবরে মৃতদল
একই তো মাটি গড়া দেয়াল এখানের
শান্ত নির্জন মাঠের মাঝখানে
একটি ক্রুশ শুধু ভাগ্যে তোমাদের।
.
আনতেনিও মাচাদো
[আমার হৃদয়ে বাসনার কাটা ফুটে ছিল। অনেক চেষ্টায় একদিন আমি সেই কাটাটা তুলে ফেললাম। তারপর থেকে আমি আমার হৃদয়ের অস্তিত্বই টের পাই না—এই রকম সরল ভাবে আনতোনিও মাচাদো কবিতার মূল সত্যগুলি ব্যক্ত করতে পেরেছেন। পৃথিবী ও মানুষের জীবন ক্রমশ অতি জটিল হয়ে আসছে এই যুক্তিতে আজকের পৃথিবীর কবিতাও যখন জটিল—তখন মাচাদো অতি সহজ ভাষায় আশ্চর্য সৌন্দর্য সাধনা করে গেছেন। কবিতাকে তিনি বলেছেন আত্মার হৃৎস্পন্দন, শব্দ নয়, বর্ণ নয়, রেখা নয়, অনুভূতি নয়, কবিতা শুধু আত্মার হৃৎস্পন্দন। এই নিবিড় ধ্যানময়তায় মাচাদো স্প্যানিশ ভাষায় এ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।
জন্ম ১৮৭৫, দক্ষিণ স্পেনের আন্দালুসিয়ায়, শৈশব কেটেছে মাদ্রিদে, যৌবন ক্যাসটিলিয়ায়। ক্যাসটিলিয়ার বোরিয়া শহরে তিনি ছিলেন ফরাসি ভাষার শিক্ষক, এখানকার ভাঙা দুর্গ, দিউয়ো নদী, অরণ্য, পূর্বপুরুষের গর্ব নিয়ে বেঁচে থাকা বঞ্চিত মানুষ এই সব নিয়েই তার কবিতা। বিকেলবেলা তিনি একা হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন বহু দূরে, ফুলের সমারোহ আর ঝরে পড়া পাতার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি কথা বলতেন নিজের সঙ্গে, প্রকৃতি তাকে মুগ্ধ করলেও তিনি প্রকৃতির স্তুতি পাঠক ছিলেন না, প্রকৃতি তাকে নিজের সঙ্গে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করত। এই রকম বেড়াতে বেড়াতেই বনের মধ্যে একদিন লিওনোর নামের একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়, সেই অপূর্ব রূপসীকে মনে হয় বনদেবী, জেগে ওঠে ভালোবাসা। পরবর্তী কালে তিনি সেখানেই থেকেছেন, এই অঞ্চলটির কথা তার সব সময় মনে থেকেছে, এখানকার পরিবেশ নিয়েই লিখেছেন। ১৯৩৯-এ ফরাসি দেশে তার মৃত্যু।
মাচাদো ধর্ম বিশ্বাসে ছিলেন অ্যাগনস্টিক বা নির্বিকার। তার অধিকাংশ কবিতারই নাম নেই, কারণ কবিতা যেহেতু আত্মিক উপলব্ধি—তাই তা রহস্যময় ও আখ্যার অতীত—এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। সূর্য, ফুল, স্বপ্ন, আয়না— এই বিষয়গুলি তাঁর কবিতায় বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। তাঁর কবিতার একটি প্রবল ত্রুটিও আছে, তার কবিতা বড় বেশি অর্থবহ, এত বেশি অর্থ যে অনেক সময় তা রূপকের পর্যায়ে চলে যায়। কবিতার প্রত্যেক লাইনে লাইনে গভীর। অর্থ থাকলে তা কবিতাকে ক্লান্ত করে। যেমন, উপরে উদ্ধৃত প্রথম লাইনে, আমার হৃদয়ে একটা কাঁটা ফুটে ছিল—এইটুকু বলাই যখন যথেষ্ট হতে পারত সেখানে মাচাদো সেই কাটাটাকে থর্ন অফ প্যাশান পর্যন্ত বলে দিতে চান।]
কাল রাতে ঘুমের ভিতরে
কাল রাতে ঘুমের ভিতরে
স্বপ্নে দেখি- দিব্য উদ্ভাসন
স্বচ্ছ এক ঝরনা বহে যায়
ঘুরে ঘুরে আমার হৃদয়ে।
বলল, কোন গুপ্ত গলি পথে
জল তুমি এলে মোর কাছে,
নতুন জন্মের ঝরনা তুমি
আমি যার পাইনি আস্বাদ?
কাল রাতে ঘুমের ভিতরে
স্বপ্নে দেখি— দিব্য উদ্ভাসন—
একখানি জীবিত মৌচাক
আমার হৃদয় জুড়ে আছে।
সোনালি রঙের মৌমাছিরা
কাজে ব্যস্ত হৃদয়ে আমার
খুঁড়ে খুঁড়ে পুরনো ব্যর্থতা
মোম আর মধু তৈরি করে।
কাল রাতে ঘুমের ভিতরে
স্বপ্নে দেখি— দিব্য উদ্ভাসন
একটি জ্বলন্ত সূর্য উঠে
জেগে আছে বুকের গভীরে।
সে ছিল জ্বলন্ত বিকিরণ
লাল উনুনের মতো তাপ
এবং সে সূর্য, তাই আলো,
সুর্য এসে আমায় কাঁদাল।
কাল রাতে ঘুমের ভিতরে
স্বপ্নে দেখি—দিব্য উদ্ভাসন—
সেই তো ঈশ্বর আমি যাকে
হাতের মুঠোয় ধরে আছি।
একটি বসন্তের ভোর আমায় ডেকে বলল
একটি বসন্তের ভোর আমায় ডেকে বলল
আমি তোমার শান্ত হৃদয়ে ফুল ফুটিয়েছি
বহু বছর আগে, তোমার মনে পড়ে পুরনো পথিক,
তুমি পথের পাশ থেকে ফুল ছেঁড়োনি
তোমার অন্ধকার হৃদয়, সে কি দৈবাৎ মনে রেখেছে
আমার সেই পুরনো দিনের লিলির সুগন্ধ?
আমার গোলাপেরা কি এখনও ঘ্রাণ মেখে দেয়
তোমার হিরের মতো উজ্জ্বল স্বপ্নের পরীর ভুরুতে?
আমি বসন্তের ভোরকে উত্তর দিলুম:
আমার স্বপ্নেরা শুধু কাচ
আমি আমার স্বপ্নের পরীকে চিনি না
আমি তো জানিনি, আমার হৃদয় ফুলের মধ্যে আছে!
তুমি যদি সেই পবিত্র ভোরের জন্য অপেক্ষা করো
যে এসে ভেঙে দেবে কাচের পাত্র
তবে হয়তো পরী তোমার গোলাপ ফিরিয়ে দেবে
আমার হৃদয় দেবে তোমায় লিলির গুচ্ছ।
.
হুয়ান র্যামোন হিমেনেথ
[হিমেনেথের জন্ম ১৮৮১, মৃত্যু ১৯৫। জন্ম মৃত্যুর মাঝখানে একমাত্র বড় ঘটনা নোবেল প্রাইজ পাওয়ায় তিনি সমস্ত বিশ্বে, এবং বাংলা দেশেও বহু আলোচিত হয়েছেন। বাহুল্যবোধে হিমেনেথ সংক্রান্ত বিবরণ পুনরোচ্চারণ না করে, আমরা হিমেনেথের শুধু দুটি কবিতা এখানে বাংলায় প্রকাশ করলুম। কবিতা দুটি তার জীবনের দুই প্রান্তের, প্রথমটি লিখেছিলেন যখন তিনি সদ্য-যুবা, আর দ্বিতীয়টি লেখেন বার্ধক্যে পৌঁছে, স্বদেশ থেকে দূরে সমুদ্রের অন্য পাড় আমেরিকায় যখন প্রবাসী। প্রথম কবিতাটি সংলাপের ভঙ্গিতে লেখা, এখানে দ্বিতীয় কণ্ঠস্বর কবির। প্রথম স্তবকে জল ও ফুল নামক স্পর্শসহ অস্তিত্বে ব্যক্তিত্ব আরোপ করে, দ্বিতীয় স্তবকে এনেছে হাওয়া ও মায়া। হিমেনেথের কবিতায় দণ্ডিত কামেলাইট, সেন্ট জন অব দি ক্রশ-ছাব্বিশটি কবিতার জন্য যিনি অমর হয়ে আছেন— তার যথেষ্ট প্রভাব আছে। হিমেনেথের বিখ্যাত কবিতাবলী, প্লাতেরো নামক একটি গাধার সঙ্গে কথাবার্তা, এই বিষয়টিও তিনি পেয়েছেন সেন্ট জন অব দি ক্রশের কাছ থেকে, সেন্ট। জন নিজের শরীরটাকেই বলতেন, মাই ব্রাদার অ্যাস। অর্থাৎ, এখানেও, নিজের সঙ্গেই কথাবার্তা।
তাঁর রচনা যতটা গভীর, ততটা অবশ্য গতিশীল নয়। আধুনিক স্প্যানিশ কবিতায় হিমেনেথের অনুকরণ তেমন নেই।]
কেউ না
—ওখানে কেউ না। জল।— কেউ না?
জল কি কেউ নয়?—ওখানে
কেউ না। ফুল।—ওখানে কেউ না?
তবু ফুল কি কেউ না?
—ওখানে কেউ না। হাওয়া।—কেউ না?
হাওয়া কি কেউ না?—কেউ
না। মায়া।–ওখানে কেউ না? আর
মায়া কি কেউ না?
পাখিরা গান গায়
সারা রাত জুড়ে
পাখিরা
আমাকে শোনালে তাদের রঙের গান।
এই রং নয়
সুর্যোদয়ের ঠান্ডা হাওয়ায়
তাদের ভোরের ডানার।
এই রং নয়
সূর্যাস্তের অগ্নিবর্ণে
তাদের সান্ধ্যবুকের।
এই রং নয়
রাত্তিরে নিবে যাওয়া
প্রত্যহ চেনা ঠোঁটের
যে রকম নেবে
ফুল ও পাতার
প্রত্যহ চেনা রং
অন্য বর্ণ
আদিম স্বর্গ
এ জীবনে যাকে হারিয়ে ফেলেছে মানুষ।
সেই যে স্বর্গ
ফুল ও পাখিরা
শুধু যাকে চেনে গভীর
ফুল ও পাখিরা
সুগন্ধে আসে যায়
সৌরজগতে ঘুরে ঘুরে তারা ওড়ে।
অন্য বর্ণ,
অবিনশ্বর স্বর্গ
মানুষ সেখানে স্বপ্নে ভ্রমণ করে।
সারা রাত জুড়ে
পাখিরা আমাকে শোনালে তাদের রঙের গান।
অন্য বর্ণ
শুধু রয়েছে তাদের অন্য জগতে
শুধু রাত্তিরে নিয়ে আসে তারা হাওয়ায়।
কয়েকটি রং
আমি তো দেখেছি অতি জাগ্রত
জানি আমি তারা কোথায়।
জানি আমি ঠিক কখন
পাখিরা আসবে
রাত্রে আমায় শোনাতে তাদের গান।
জানি আমি ঠিক কখন
পেরিয়ে বাতাস পেরিয়ে বন্যা
পাখিরা গাইবে গান।
.
লেয়ন ফেলিপ
[পৃথিবীর সব দেশেই এই শতাব্দীর কবিতা সম্পর্কে দুর্বোধ্যতার ক্রমাগত অভিযোগ আছে। স্প্যানিশ কবিতা সম্পর্কে সে অভিযোগ খুবই কম খাটে। এখন আমরা এমন একজন কবিকে উপস্থিত করছি, যিনি সরল, স্পষ্ট, কিছুটা গদ্যময় কবিতায় বিশ্বাসী। তার কবিতা বই পড়ার চেয়ে সভা-সমিতিতে আবৃত্তি শুনলে বেশি ভাল লাগে। এইরকম সর্বপ্রকাশ্য কবিতায় লেয়ন ফেলিপ অত্যন্ত জনপ্রিয়।
লেয়ন ফেলিপের পুরো নাম লেয়ন ফেলিপ কামিনো গালিথিয়া। জন্ম স্পেনে, ১৮৮৪। অন্যান্য অনেক স্প্যানিশ কবির মতোই, তিনিও গৃহযুদ্ধের সময় দেশ থেকে পলাতক হন। এখন মেক্সিকোয় স্থায়ী নিবাস।]
আমি নই গভীর সঞ্চারী
—’আমার গভীর সমুদ্র সঞ্চারী বন্ধু পাবলো নেরুদাকে’
আর, কালকেই এসে কেউ বলবে:
এই কবি তো কোনোদিন সমুদ্রের গভীরে আসেনি
এমনকী ছুঁচো বা নেউলের মতো মাটি খুঁড়ে যায়নি ভিতরে
এই কবি কোনোদিন দেখেনি সুড়ঙ্গের প্রদর্শনী
অথবা ভ্রমণ করেনি ঘোর তন্তুর অরণ্যে
সে ঢোকেনি মাংস ভেদ করে, খুঁড়ে দেখেনি হাড়
কখনো পৌঁছতে পারেনি অন্ত্র, পাকস্থলী পর্যন্ত
শিরায় শিরায় খালে-নদীতে সে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি,
রক্তের মধ্যে জীবাণুবাহী হয়ে পাল তুলে ভ্রমণ করতে করতে
সে পৌঁছয়নি মানুষের জমাট হৃদয়ে।
কিন্তু সে বৃক্ষ চূড়ায় দেখেছে কীট
গম্বুজের মাথায় দেখেছে পঙ্গপালের ঝড়
হীরকোজ্জ্বল জলকে দেখেছে লালচে আর পঙ্কিল হতে,
দেখেছে হলদে প্রার্থনা
দেখেছে মৃগী রুগি পাদরির পুরু ঠোঁটে সবুজ লালা
গোল ঘরের ছাদে সে দেখেছে চটপট প্রাণী
প্রার্থনার বেদিতে দেখেছে রাত-পোকা
গির্জার দরজায় দেখেছে উইয়ের বাসা
বিশপের শিরস্ত্রাণ দেখেছে ঘুণ…
সে মোহান্ত প্রভুর ধূর্ত পিটপিটে চোখ দেখে বলেছে:
ইদারার শুকনো ছায়ায় আলো মরে আসছে ক্রমে
এই আলো আমাদের বাঁচাতেই হবে, কান্নার বন্ধনে।
ভেলাথকোয়েথ অঙ্কিত ‘ভালেকা-র শিশু’ চিত্রের পরিচিতি
এখান থেকে কেউ যেতে পারবে না
যতদিন এই ভালেকার শিশুর বিকৃত মাথাটি থাকবে
কেউ চলে যাবে না ।
কেউ না
সন্ন্যাসী, না আত্মহত্যা।
প্রথমে চাই তার প্রতি অন্যায়ের প্রতিকার
প্রথমেই চাই তার সমস্যার সমাধান
আমরাই তার সমাধানের জন্য দায়ী
এর সমাধান চাই বিনা কাপুরুষতায়
পোশাকের ডানা মেলে বিনা পলায়নে
অথবা স্টেজের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে না গিয়ে—
এখান থেকে কেউ চলে যেতে পারবে না
কেউ না
সন্ন্যাসী, না আত্মহত্যা।
নিরর্থক
নিরর্থক সব পলায়ন
(ওপরে বা নীচে)
সকলকেই ফিরে আসতে হবে।
বারবার।
যতদিন না (এক সুদিনে)
ম্যামব্রিনোর হেলমেট
এখন আলোর বৃত্ত, হেলমেট বা গামলা নয়।
সাঞ্চোর মাথায় ঠিক খাপ খেয়ে যায়
এবং আমার ও তোমার মাথায়
ঠিক ঠিক, মাপে মাপে—
সেদিন আমরা সবাই চলে যাবো
ডানা মেলে
তুমি, আমি, সাঞ্চো
এবং সন্ন্যাসী ও আত্মহত্যা।
[ভেলাথকোয়েথ, বাংলায় যাকে আমরা বলি ভেলাস কুয়েজ, তার এই বিখ্যাত ছবিটি একটি বাচ্চা বামনকে নিয়ে আঁকা, যার সর্বাঙ্গ বিকৃত, মনও নির্বোধ ও জড়। রাজা চতুর্থ ফিলিপ এই ধরনের বাচ্চা বামনদের রাজসভায় এনে মজা উপভোগ করতেন। কবি এখানে ওই বামনটিকে সমস্ত মানব সমাজের নির্যাতন, অপমান ও দুঃখভোগের প্রতীক করেছেন।
ডন কুইক্সোট (আসল উচ্চারণ যাই হোক না কেন) এবং তারা অনুচর সাঞ্চোকে বাংলাতে আমরা বহুদিন চিনি। ডন কুইক্সোট একদিন একটা নাপিতের পেতলের গামলা কেড়ে নিয়ে মাথায় দিয়ে ভেবেছিলেন, তিনি মহাশক্তিমান দুর্ধর্ষ দৈত্য ম্যামব্রিনোর বিখ্যাত হেলমেটের অধিকারী হয়েছেন। দ্বিতীয় কবিতার শেষ অংশে কবি এর উল্লেখ করে বলছেন, ওই হেলমেট শক্তি ও সামর্থ্যের প্রতীক, ডন কুইক্সোটের মাথায় সেটা হয়ে ওঠে কবিত্ব ও কল্পনার আলোকমণ্ডল, কিন্তু পৃথিবীর সমস্যা দূর করতে গেলে, সাঞ্চোর মতন তীক্ষ্ণ বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মাথাতেই তার বেশি দরকার।]
.
সেজার ভায়েহো
[এক বৃহস্পতিবার, প্রবল বর্ষার দিনে প্যারিসে আমার মৃত্যু হবে—এই নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন সেজার ভায়েহো, তখন তার বয়েস ২৮, এবং আশ্চর্য, এর ১৫ বছর পর কবিতাটিতে বর্ণিত অবস্থায় প্যারিসেই তার মৃত্যু হয়। অনাহারে, প্রবল যন্ত্রণা ও অপমান সহ্য করে, প্যারিসের একটি ঘরে মরে পড়ে ছিলেন তিনি ১৯৩৮ সালে।
তার জন্ম ল্যাটিন আমেরিকার পেরুতে ১৮৯৫ সালে। ১৯১৮ সালে প্রথম কবিতার বই ছাপা হবার পর তাকে নির্যাতন, বিচার ও কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। পরবর্তী জীবনে প্রবল দারিদ্র ও উপবাসকে সঙ্গী করে স্পেন ও ফ্রান্সে ভ্রাম্যমাণ হয়ে কাটিয়েছেন। মৃত্যুর পর তার কবিতা ক্রমশ বিশ্বজনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
প্রথম কবিতাটির শিরোনামার অর্থ এই, তার দেশের প্রাচীন রীতি ছিল জীবনের কোনও শুভ ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন রাখা হত সাদা পাথরের ফলক লাগিয়ে, দুঃখের ঘটনায় কালো পাথর।]
একটি সাদা পাথরের ওপর কালো পাথর
প্রবল বর্ষার দিনে প্যারিসে আমার মৃত্যু হবে
সেই দিন,—আমার স্মৃতিতে গাঁথা আছে:
প্যারিসেই মরবো আমি—একথায় ভয় পাইনি কোনো
শরৎকালের এক বৃহস্পতিবার ঠিক আজকেরই মতো।
বৃহস্পতিবারই ঠিক, কারণ আজকের এই বৃহস্পতিবারে
আমার কবিতা লেখা গদ্যের মতন রুক্ষ হয়ে আসে
দু’হাতের হাড়ে খুব ব্যথা করে, যেরকম ব্যথা আমি কখনো বুঝিনি;
দীর্ঘ পথ ঘুরে এসে জীবনে কখনো আগে নিজেকে এমন
মনে হয়নি পরিত্যক্ত একা।
সেজার ভালেখা আজ মারা গেছে। সকলেই মেরেছিল তাকে
অথচ কারুর কোনো ক্ষতি সে করেনি।
তারা তাকে ডাণ্ডা দিয়ে মেরেছিল, কঠিন প্রহার
কখনো চাবুকে; তার সাক্ষী আছে
বৃহস্পতিবারগুলি, দু’হাতের ব্যথাময় হাড়
আর নির্জনতা, বৃষ্টি, দীর্ঘ পথ।
আমিই একমাত্র বিদায় নিয়ে
আমি একমাত্র, পিছনের সবকিছু ফেলে বিদায় নেবো:
আমি এই বেঞ্চি থেকে উঠে দুরে চলে যাচ্ছি
আমি আমার আন্ডারওয়্যার থেকে দূরে চলে যাচ্ছি
আমার কাজ, এই নির্দিষ্ট জগৎ থেকে আমি চলে যাচ্ছি
আমার ভেঙে ছিটকে পড়া বাড়ির নম্বর থেকে দুরে চলে যাচ্ছি
সব কিছু ফেলে আমিই একমাত্র বিদায় নিয়ে যাচ্ছি।
সাঁজেলিজে থেকে দূরে চলে যাচ্ছি আমি
চাঁদের পিঠে কোনো এক অদ্ভুত গলিপথে একবার বাঁক নিতে।
আমার মৃত্যুও আমার সঙ্গে যাচ্ছে, আমার বিছানা বিদায় নিয়েছে;
চারপাশে রিক্ত, স্বাধীন মানুষের দল নিয়ে
আমার শারীরিক দ্বিতীয় সত্তা বেড়াতে বেরিয়ে এক এক করে
বিদায় দিচ্ছে তার প্রেতগুলিকে।
আমি সব কিছু থেকে বিদায় নিতে পারি, কারণ
পিছনে সব কিছু পড়ে থাকবে সূত্র হিসেবে।
আমার জুতো, ফিতের গর্ত, কোণায় লেগে থাকা কাদা
পরিষ্কার ধপধপে শার্টের ভাঁজ—এরাও থাকবে।
[দ্বিতীয় কবিতায় উল্লেখিত সাঁজেলিজে হয়তো অনেকেরই পরিচিত, তবু বলি, সাঁজেলিজে হচ্ছে প্যারিসের একটি বিখ্যাত, সুরম্য রাজপথ, মূল বানান Champs Elysees]
.
ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা
[একদিন সকালবেলা, তখনও ভালো করে ঘুম ভাঙেনি, একদল ফ্যাসিস্ট সৈনিক এসে লোরকাকে ডাকল, এবং বাইরে নিয়ে গিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হল। তখন লোরকার বয়স মাত্র ৩৭, এবং এইভাবে স্প্যানিশ ভাষায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি এবং আধুনিক পৃথিবীর একজন বিশিষ্ট কবির মৃত্যু হয়। তখন ১৯৩৬ সাল, স্পেনে গৃহযুদ্ধ ঘনিয়ে এসেছে, বহু কবিই স্পেন থেকে পালিয়ে যান সেসময়, লোরকার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে এখন অনেকে বলেন যে, ফ্যাসিস্ট বাহিনীর কোনো সৈনিক ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকেই লোরকাকে খুন করে।
লোরকার জন্ম ১৮৯৯, ভালো ছাত্র ছিলেন, কবিতা, নাটক এবং ছবি আঁকার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় কৈশোরেই। ছাত্রাবস্থার শেষে নাটক লেখা ও পরিচালনা করাই ছিল তার নেশা ও জীবিকা। একসময় সালভাদোর দালির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে সুররিয়ালিজমের। প্রভাবে পড়েন কিন্তু গ্রাম্য গাথা, স্পেনের উপকথা ও জিপসিদের জীবন ও চরিত্র নিয়ে লেখাগুলিই তার শ্রেষ্ঠ। বিশেষত জিপসিদের নিয়ে লেখাগুলিই তাকে অমর করছে। অবশ্য, লোরকার এই শেষোক্ত কারণে খ্যাতি খুব পছন্দ ছিল না। একবার এক বন্ধুকে দুঃখ করে ছেলেমানুষের মতো লিখেছিলেন, জিপসি নিয়ে লিখি বলে লোকে ভাবে আমার বুঝি শিক্ষাদীক্ষা কিছুই নেই, আমি যেন একটা গ্রাম্য কবি! আমি মোটেই তা নই।
অনুদিত দ্বিতীয় কবিতাটি জিপসিদের নিয়ে লেখা কবিতাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। সেজন্যও লোরকার দুঃখ ছিল। কারণ, অনেকে এই কবিতাটির আদিম সৌন্দর্য বুঝতে না পেরে শুধু যৌন সম্ভোগচিত্রই উপভোগ করেছে!]
বিদায়
যদি মরে যাই
জানলা খুলে রেখো
শিশুটির মুখে কমলালেবু
(জানলা থেকে আমি দেখতে পাই)
গম পেষাই করছে এক চাষা
(জানলা থেকে শব্দ শুনতে পাই)
যদি মরে যাই
জানলা খুলে রেখো।
অবিশ্বাসিনী পত্নী
তখন তাকে নিয়ে এলাম নদীর ধারে
ভেবেছিলাম যে সে তখনো কুমারী মেয়ে
কিন্তু তার স্বামী ছিল।
সে রাত ছিল সন্ত জেমস উৎসবের
কিছুটা যেন বাধ্য হয়েই ঠিক তখন
পথের আলো ক্রমশ নিবে আঁধার হল
আলোর মতো জ্বলে উঠল ঝিঝি পোকার সমস্বর
শহর ছেড়ে নির্জনতায় এসে
ছুঁয়ে দিলাম তার ঘুমন্ত স্তন দুটি
তখুনি তারা আমার জন্য পাপড়ি মেলে ফুটে উঠল
কচুরিপানার মঞ্জরীর মতন।
তার বুকের ব্রেসিয়ারের শক্ত মাড়
খসখসিয়ে উঠল আমার কানের কাছে
যেন রেশমি এক টুকরো মসৃণতা
দশ ছুরিতে ছিন্নভিন্ন করল কেউ
পাতার ফাঁকে নেই রুপোলি আলোর রেখা
বৃক্ষগুলি দীর্ঘ হয় ক্রমশ
এক দিগন্ত ভরা অসংখ্য কুকুর পাল
ডেকে উঠল বহু দূরের নদীর প্রান্তে।
পেরিয়ে কালো জামের বন
রাঙচিতে আর কাঁটাগাছের ঝোপ ছাড়িয়ে
তার চুলের আড়ালে বসে বেলাভূমিতে
নরম কাদায় আমি একটা গর্ত খুঁড়ি।
আমার গলার টাই খুলেছি একটানে
সে খুলেছে তার ঘাগরা, কাঁচুলি
রিভলবার সুদ্ধ আমার কোমরবন্ধ খুলে রেখেছি
সে খুলেছে চার রকমের অন্তর্বাস।
মাধবীলতা, সাগর ঝিনুক পায়নি এত রূপ
এত মসৃণ, সুন্দর তার ত্বকের রং
স্ফটিকরঙা দিঘিতে চাঁদের আলোও নয়
তার শরীরে এমন উজ্জ্বলতা।
দু’খানি ঊরু পিছলে যায় ঊরুর নীচে
হঠাৎ ধরা মাছের মতন যেন অবাক
খানিকটা তার উষ্ণতা আর কিছুটা হিম
জঙ্ঘা ভরা শীত গ্রীষ্ম দুই ঋতু
সেই রাত্রে আমার অশ্ব ভ্রমণ হল
জগতের সব পথের মধ্যে সেরা পথে
হিরে-পান্না দিয়ে সাজানো তরুণী ঘোড়া
বল্গা নেই, রেকাব নেই, তবুও বাঁধা।
পুরুষ আমি, তাই কখনো বলতে চাই না
ফিসফিসিয়ে আমায় সে যা শুনিয়েছিল
জিপসিদের ছেলে আমি, এটুকু জানি
গোপন কথা গোপন রাখাই খাঁটি নিয়ম।
চুমোর আঠা, বালির মধ্যে মাখামাখি
নদীর তীর থেকে উঠিয়ে নিলাম তাকে,
অন্ধকারে বনতুলসীর ধারালো পাতা
হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধে মেতে ব্যস্ত তখন।
পুরুষ আমি, জানি পুরুষ-যোগ্য ব্যবহার
খাঁটি জিপসি সন্তানের মতন
একবাক্স রঙিন সুতো কিনে দিয়েছি তাকে
আড়াই গজ হলুদরঙা সাটিনও উপহার।
কিন্তু আমি প্রেমে পড়িনি সেই নারীর
আমি তো ঠিকই বুঝেছিলাম সে বিবাহিতা
তবুও কেন মিথ্যেমিথ্যি বলল আমায় কুমারী সে
যখন তাকে নিয়ে গেলাম নদীর ধারে?
[জিপসি ও অবিশ্বাসী নারী একসঙ্গে শুয়ে ভ্রমণ শুরু করল। বল্গাহীন অশ্বপৃষ্ঠে ভ্রমণ। লোরকার এই বিখ্যাত কবিতাটি নিয়ে এক সময় বিতর্কের ঝড় ওঠে। লোরকা এখানে একটি নৈতিক সিদ্ধান্তও করেছেন যে, সঙ্গমের পর মেয়েটিকে পরিত্যাগ করার সময় পুরুষটির কোনো গ্লানি নেই কারণ শুধু এই যে, সে জেনেছে মেয়েটি কুমারী নয় পুরুষটিকে নির্দোষ দেখাবার জন্য তোরকা এমন একটি কায়দা প্রয়োগ করেছেন, যা অনেক পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। কবিতার সব স্তবকগুলো চার লাইনের হলেও প্রথম স্তবকটি তিন লাইনের। অর্থাৎ একটি লাইন উহ্য আছে, সেখানে আন্দাজ করা যায়, মেয়েটিই প্রথম মিথ্যে কথা বলে পুরুষটিকে প্রলুব্ধ করেছিল।]
.
রাফায়েল আলবের্তি
(দেবদূত বিষয়ক কবিতাবলীই রাফায়েল আলবের্তির শ্রেষ্ঠ রচনা। যদিও সমুদ্র ও আন্দালুসিয়ার প্রকৃতি বিষয়ক কবিতার জন্য মাত্র ২৩ বছর বয়েসে তিনি সাহিত্যের জাতীয় পুরস্কার পান, হিমেনেথ প্রমুখ প্রবীণ কবিরা তাকে অভিনন্দন জানান, এবং সেই তরুণ। বয়সেই আলবের্তি প্রতিষ্ঠিত কবি। কিন্তু যেবিষয়ে লিখে সার্থক হয়েছেন—তাকে অবলীলায় পরিত্যাগ করে বিষয়ান্তরে যেতে কোনও কবিরই দ্বিধা হয় না। সমুদ্র ছেড়ে আলবের্তি এলেন স্থলভাগে। কোনও সমালোচক এই দ্বিতীয় স্তরের আলবের্তি সম্পর্কে বলেছেন, স্থলে ভ্রাম্যমাণ তরুণ ইউলিসিস। নিঃসঙ্গ দেবদুতের মতো তিনি অচেনা মানব সমষ্টির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন।
আলবের্তির জন্ম সাল ১৯০২। প্রথম যৌবন স্পেনের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং মাদ্রিদে কাটলেও পরবর্তী দীর্ঘ জীবন কাটে প্রবাসে, নির্বাসনে। শীতের সময় মানস সরোবর ছেড়ে আসা পাখিদের মতো, স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ফ্রাঙ্কোপন্থীদের বিজয়কালে, দলে দলে কবি দেশ ছেড়ে নির্বাসনে চলে যান, অনেকেই আর ফিরতে পারেননি। নিরাশা, অত্যাচার এবং কবি বন্ধুদের মৃত্যু দেখে (লোরকা ছিলেন আলবের্তির ঘনিষ্ঠ সুহৃদ) প্রথম দিকে খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, আর কবিতা লিখবেন না। পরে, দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার একমাত্র উপায় হিসেবে, দূর থেকে দীর্ঘশ্বাসের মতন কবিতা লিখে পাঠিয়েছেন স্পেনের উদ্দেশ্যে। মাতৃভাষার প্রতি স্প্যানিশ লেখকদের টান এত প্রবল যে প্যারিস বা লন্ডনে তারা নির্বাসন নেননি, অনেকেই গিয়েছিলেন দক্ষিণ আমেরিকা, কিংবা মেক্সিকোয় যেখানে স্প্যানিশ ভাষা চলে। দীর্ঘ পঁচিশ বছর বুয়েনস এয়ারিসে কাটাবার পর আলবের্তি এখন ইতালিতে আছে, মাতৃভূমির কাছাকাছি।
কবিতার বহিরঙ্গে প্রথাগত ফর্ম এবং প্রাচীন ছন্দের পুনরুদ্ধার করলেও আলবের্তি মনে প্রাণে একজন সুরলিয়ালিস্ট।]
সংখ্যার দেবদূত
কুমারীদের সঙ্গে টি স্কোয়ার,
কম্পাস, নজর রাখে।
অন্তরীক্ষের ব্ল্যাক বোর্ডে।
এবং সংখ্যার দেবদূত
ভাবুক, উড়ে যায়
১ থেকে ২, ২ থেকে
৩, ৩ থেকে ৪-এ।
ঠান্ডা চক এবং স্পঞ্জ
ঘষে দেয়, মুছে দেয়
মহাশূন্যের আলো।
না সূর্য চাঁদ, না তারা
না বজ্র বিদ্যুতের
আকস্মিক সবুজ,
না বাতাস, শুধু কুয়াশা।
কুমারীদের সঙ্গে টি স্কোয়ার নেই
কম্পাস নেই, কাঁদছে।
এবং মৃত ব্ল্যাক বোর্ডের ওপর
সংখ্যার দেবদূত
মৃত, ঢেকে শোয়ানো
১ এবং ২-এর ওপরে,
৩-এর ওপরে, ৪-এর ওপরে…
দেবদূতের প্রত্যাগমন
যাকে আমি চেয়েছিলাম, সে ফিরে এসেছে,
যাকে আমি ডেকেছিলাম।
সে নয়, যে মুছে নেয় নিরস্ত্র আকাশ
নিরাশ্রয় তারা,
দেশহীন চাঁদ,
তুষার
একটি হাত থেকে ঝরে পড়ে যে তুষার
একটি নাম
একটি স্বপ্ন
একটি কপাল
সে নয়, যার চুলের সঙ্গে
বাঁধা আছে মৃত্যু
আমি যাকে চেয়েছি
বাতাস ছিন্নভিন্ন না করে
পাতাদের আহত না করে, জানলার শার্সি না কঁপিয়ে
সে আসবে, যার চুলের সঙ্গে
বাঁধা আছে নিস্তব্ধতা
সে আমাকে আঘাত না দিয়ে খুঁড়ে তুলবে
আমার বুকের মধ্যে এক মিষ্টি আলোর ভাণ্ডার
এবং নৌবাহনযোগ্য করবে আমার আত্মাকে।
[প্রথম কবিতায়, এই বিশ্বের সুর সংগীত যে এলোমেলো ভাবে ভেঙে যাচ্ছে, তার তির্যক উল্লেখ। দ্বিতীয় কবিতায় মানুষকে শান্তি দিতে একজন দেবদুতের পুনরাগমন। যুদ্ধ, নিষ্ঠুরতা, লোভ, অন্ধকারের পরেও এক একজন দেবদূত আসে নিস্তব্ধতার বন্দনা শোনাতে। দেবদূত, অর্থাৎ কবি। কবিই ইচ্ছে করলে অন্ধকার জাগাতে পারে, আবার তারই হাতে উদ্ভাসনের অধিকার।]
.
পাবলো নেরুদা
সোনাটা
যদি আমায় প্রশ্ন করো, কোথায় আমি ছিলাম, তবে
আমি বলব, এই রকমই হয়ে থাকে ||||||||| ।
আমি তখন পাথর-ঢাকা মাটির কথা বলতে বাধ্য,
বলতে হবে নদীর কথা ধৈর্য যাকে ধ্বংস করে;
আমার জানা শুধুই যেসব পাখির ত্যক্ত
পিছনে ফেলা সাগর কিংবা এখন আমার বোনের কান্না
কেন রয়েছে এত জগৎ, কেন প্রতিটি দিনের সঙ্গে
অন্য দিন সুতোয় বাঁধা? কেন একটি আঁধার রাত্রি,
মুখের মধ্যে ভরে উঠেছে? কেন মৃত্যু?
যদি আমায় প্রশ্ন করো, কোথা থেকে যে এসেছি আমি—
আমাকে কথা বলতে হবে ভাঙা জিনিসের
বলতে হবে তিক্ত আসবাবের কথা
কথা বলব, কখনো পচা, বিশাল বিশাল প্রাণীর সঙ্গে
কথা বলব আমার কাতর বুকের কাছে
যা কিছু যায় হৃদয় ঘুরে সকলই নয় স্মৃতির ছায়া
বিস্মৃতিতে ঘুমোয় এক বাদামি পায়রা, সেও তো নয়,
কিন্তু কান্নাসিক্ত মুখ
গলার কাছে আঙুল
আর যা পাতা ঝরায়, তাদের ছায়া;
দিনের কালো মিলিয়ে যায়
আমাদের এই দুঃখী রক্তে প্রতিপালিত একটি দিন।
এখনও আছে মাধবীফুল, ইষ্টকুটুম পাখির ডাক
এসব দেখে ভালোই লাগে, এসব দেখি মিষ্টি শখের
ছবির কার্ডে
যেন সময় মধুরতার দু হাত ধরে ঘুরে বেড়ায়
এসব দাঁত ছাড়িয়ে আরও গভীরে যাওয়া ভালো না
নৈঃশব্দ্যের ঢাকনাটাকে কামড়ে ছেঁড়া ভালো না
কারণ আমি জানি না ঠিক কী উত্তর দেব:
এত মৃত্যু। চতুর্দিকে কত মৃত্যু
সমুদ্রের কত দেয়ালে চিড় ধরাল লাল সূর্যের আলো
কত না মাথা নৌকোর গায় ধাক্কা মারল
কত না হাত দু’হাত ভরা চুমু রেখেছে
কত কিছুই আমি এখন ভুলতে চাই।
এখন আমি লিখতে পারি
আজ রাতে আমি লিখে যেতে পারি দুঃখিততম কবিতা
ধরা যাক লিখি: “আকাশ তারায় সাজানো
তারা, নীল তারা, কাঁপে দূর মহাশূন্যে।“
রাত্রির হাওয়া ঘুরে ঘুরে আসে, মহাকাশে গান গায়।
আজ রাতে আমি লিখে যেতে পারি দুঃখিততম কবিতা
আমি তাকে খুব ভালোবাসতুম,
সেও কোনোদিন আমায় বেসেছে ভালো
এরকমই কোনো রাতে আমি তাকে।
দুই হাত ভরে জড়িয়ে রেখেছি।
আকাশের নীচে কত অসংখ্য চুম্বন করেছিলাম ওষ্ঠে।
সে আমায় খুব ভালোবেসেছিল,
কোনো কোনোদিন আমিও বেসেছি ভালো
আয়ত শান্ত তার দুই চোখ ভালো না বাসা কি সম্ভব?
আজ রাতে আমি লিখে যেতে পারি দুঃখিততম কবিতা
শুধু এই ভেবে, সে তো কাছে নেই, হারিয়েছি তাকে আমি।
কান পেতে শুনি বিশাল রাত্রি
তাকে ছাড়া আরও বিপুল বিশাল
কবিতা আমার বুকের ভিতরে ঝরে ঝরে পড়ে,
ঘাসের উপরে শিশিরের মতো।
আমার প্রণয় তাকে কাছে ধরে রাখতে পারেনি,
কিবা আসে যায়
রাত্রি এখন তারায় তারায়, সে আমার কাছে আজ নেই আর।
এই সব শেষ। দূর থেকে যেন গান গায় কেউ, খুব দূর থেকে
তার বিচ্ছেদে আমার হৃদয় একটুখানিকও পূর্ণ হয়নি।
যেন তাকে কাছে টেনে নিতে চাই,
আমার দৃষ্টি খুঁজে ফেরে তাকে
আমার হৃদয় খুঁজে পেরে তাকে,
সে আমার পাশে আজ আর নেই।
আমি তাকে ভালোবাসি না এখন,
একথা সত্যি, তবু কত ভালোবেসেছি তাকে
আমার কণ্ঠ বাতাস খুঁজেছে, তার শ্রবণের কাছে পৌঁছোতে।
অপরের। আজ সে তো অপরের। যেমন আমার চুম্বন নিত
তার স্বর, তার সরল শরীর, অনাদি চক্ষু সবই অপরের
আমি তাকে ভালোবাসি না এখন, হয়তো এখনো ভালোবাসতুম
ভালোবাসা কত সামান্য, আর বিস্মৃতি এর বিপুল দীর্ঘ
এরকমই কোনো রাতে আমি তাকে
দুই হাত ভরে জড়িয়ে রেখেছি
তার বিচ্ছেদে আমার হৃদয় একটুখানিকও পূর্ণ হয়নি।
এই শেষবার তার ব্যথা আমি হৃদয়ে পেলাম
আমার জীবনে তার উদ্দেশ্যে এই কবিতাই শেষবার লেখা।
[পাবলো নেরুদার জন্ম ১৯০৪-এ, দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে। স্বদেশপ্রেম ও মানবতা সম্পর্কে তার সরল ও জোরালো কবিতাবলীর জন্যই তিনি বিখ্যাত। বাংলায় তার কবিতা আগে অনেকগুলি অনূদিত হয়েছে। দ্বিতীয় কবিতাটি বিষয়ে জ্ঞাতব্য এই, একটি নারী যে কবিকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাকে উদ্দেশ করে লেখা ২০টি কবিতার সিরিজে এইটিই শেষ কবিতা।]
.
নিকোলাস গিয়্যেন
[আমেরিকায় সম্প্রতি যে নতুন করে নিগ্রো স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে নিকোলাস গিয়্যেন রচিত নিগ্রোদের বিষয়ে একটি মর্মান্তিক কবিতা এখানে অনুবাদ করা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
নিকোলাস গিয়্যেন-এর জন্ম ১৯০২ সালে, কিউবায়। কিউবার তিনি প্রখ্যাত কবি এবং সমগ্র স্প্যানিশ কবিতাতেও তার স্থান উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচনা অনেকটা চারণ কবিতাসুলভ, আন্তরিকতায় এবং ছন্দ ও ধ্বনি মাধুর্যে খুবই প্রফুল্ল। স্পেনের প্রখ্যাত দার্শনিক ও কবি উনামুনো এক সময় নিকোলাস গিয়্যেমকে লিখেছিলেন, আমি আপনার কবিত্ব প্রতিভায় এবং শব্দের উপরে অধিকার দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছি। আপনার কবিতা পড়েই আমি নিগ্রোদের কথায় সুর ও ছন্দ বুঝতে শুরু করেছি।
এই কবিতাটি যেসময়ে লেখা, তখনও কিউবা আমেরিকার মিত্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কমিউনিস্ট ঘেঁষা রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। আমেরিকার সঙ্গে কিউবার তখন ঘনিষ্ঠ যোগ থাকার ফলে, আমেরিকার নিগ্রোদের দুঃখের সঙ্গে কিউবার একাত্মবোধ ছিল। কবিতায় বর্ণিত নিগ্রোদের দুরবস্থার সঙ্গে এখনকার নিগ্রোদের অবস্থার বিশেষ কোনও তফাত নেই। তবে নিগ্রোরা এখন পেয়েছে আইন অনুযায়ী সমান অধিকার এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সমর্থন।]
নিগ্রো
একটি ব্লুজ পাঠিয়ে দিল ছন্দময় আর্তনাদ
চমৎকার ভোরের দিকে।
লিলি শুভ্র দক্ষিণ তার চাবুক নিয়ে বেরিয়ে এল,
ভাঙল তাকে।
কচি নিগ্রো ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে যায়, সঙ্গে তাদের
ঘিরে রয়েছে শিক্ষা বন্দুক।
যখন তারা ক্লাসের মধ্যে ঢুকবে এসে
তারা দেখবে জিম ক্রো স্বয়ং তাদের শিক্ষক
লিঞ্চ নামে সেই জজ সাহেবের ছেলেমেয়েরাই অন্য ছাত্র;
প্রত্যেকটি নিগ্রো শিশুর দেরাজে থাকবে
কালির বদলে তাজা রক্ত
পেন্সিল নয় জ্বলন্ত কাঠ।
এই তো দক্ষিণ, এখনে কখনো চাবুকের শিস থেমে থাকে না
সেই অত্যাচারিত জগতে
সেই কর্কশ, গ্যাংগ্রিন হওয়া অসহ্য আকাশের নীচে
নিগ্রো শিশুরা
সাদা শিশুদের পাশে বসে লেখাপড়া করতে পারবে না।
তারা তো শান্তভাবে বাড়িতে বসে থাকলেই পারে—
অথবা—অথবা আর কী পারে কে জানে—
তারা রাস্তা দিয়ে না হাঁটলেই পারে
অথবা তারা পারে চাবুকের তলায় আত্মসমর্পণ করতে
অথবা বেছে নিতে পারে বন্দুক অথবা থুতুর নীচে মৃত্যু;
তারা একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে শিস দিতে পারে
অথবা ভয় পেয়ে, চোখ নিচু করে বলতে পারে, হ্যাঁ,
মাথা নিচু করে, হ্যাঁ
এই স্বাধীন পৃথিবীতে—ডালেস যার ঘোষণা করছেন
বিমানবন্দর থেকে বন্দরে, হ্যাঁ,
আর, এই সময় একটা সাদা বল
লঘু ছন্দময় ছোট একটা সাদা বল
প্রেসিডেন্টের গলফ খেলার বল—সেই ক্ষুদ্র গ্রহ
গড়িয়ে যায় নিবিড় ঘাসের ওপর দিয়ে,
সবুজ, পবিত্র, নরম, মসৃণ ঘাস, হ্যাঁ।
তা হলে এবার,
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, তরুণ যুবতীরা,
শিশু
এবং বৃদ্ধ–টাক অথবা চুলো মাথা, এবার
ইন্ডিয়ান, নিগ্রো, মুলাটো, সঙ্কর, এবার
এবার একবার ভেবে দেখুন
যদি সমস্ত পৃথিবীটাই হত দক্ষিণ অঞ্চল
যদি সমস্ত পৃথিবীটাই হত চাবুক এবং রক্ত
যদি সমস্ত পৃথিবীটাই সাদা মানুষদের জন্য সাদা ইস্কুল
যদি সমস্ত পৃথিবীটাই হত পাথর আর খুদের দল
যদি সমস্ত পৃথিবীটাই হত ইয়াঙ্কি আর অত্যাচার
ভাবুন সেই মুহূর্ত একবার
অন্তত একবার তা কল্পনা করে দেখুন!
[এ কবিতায় দক্ষিণ বলতে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের চারটি প্রদেশ মিসিসিপি, জর্জিয়া, অ্যালাবামা ও ভার্জিনিয়া—এদের বোঝায়। নিগ্রোদের প্রতি অত্যাচার এখানেই সবচেয়ে প্রবল এবং অনবরত।
ব্লজ—নিগ্রোদের লোকগীতি। এর সুর হয় ঢিমে লয়ের জ্যাজ—এবং এ গানের কথা সব সময়েই খুব করুণ। জিম ক্রো—একটি প্রাচীন নিগ্রো গান। এখন এই একটি মাত্র শব্দে—নিগ্রোদের প্রতি সমস্ত অত্যাচার ও বৈষম্য বোঝায়।
লিঞ্চ কথাটার মানে কোনও লোককে বিনা বিচারেই জনতা কর্তৃক হত্যা। শব্দটি তৈরি হয়েছে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভার্জিনিয়ার দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট, কর্নেল চার্লস লিঞ্চ আর ক্যাপ্টেন উইলিয়াম লিঞ্চ এদের নাম থেকে। এই দু’জন বিচারক কোনও আইন না মেনেই অভিযুক্ত ব্যক্তিটিকে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিগ্রো) জনতার হাতে তুলে দিতেন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে মেরে ফেলার জন্য। বিমানবন্দরে ডালেসের ঘোষণা—এর মর্মার্থ, আমেরিকার বিমানবন্দরে, কোনও বিদেশি পদার্পণ করলেই তার হাতে একটি ছাপানো শুভেচ্ছাবাণী তুলে দেওয়া হয়, যার বক্তব্য, এই স্বাধীন দেশে সকল ধর্ম, বর্ণ ও জাতির সমান অধিকার। ইন্ডিয়ান—আমেরিকার আদিম অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের ডাকনাম।
মুলাটো— অর্থাৎ কোনও নিগ্রো আর ককেশিয়ান—অর্থৎ সাদা মানুষের মিলনের ফলে জাত সন্তান। অর্থাৎ যাদের গায়ের রং কিছুটা হালকা, প্রায় ফর্সা।]
.
অকতাভিও পাজ
[অকতাভিও পাজের জন্ম মেক্সিকোতে, ১৯১৪, শিক্ষা মেক্সিকো ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে। মেক্সিকোর সাহিত্য আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, আঁদ্রে ব্রেতো তাকে বলেছেন, দ্বিতীয় যুদ্ধের পরবর্তী সবচেয়ে খাঁটি কবি। তিনি এখন ভারতবর্ষে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত, দিল্লিতে থাকেন।]
নীল উপহার
যখন জেগে উঠলাম, ঘামে আমার সর্বাঙ্গ ভেজা। আমার ঘরের মেঝে সদ্য ঘোয়া, লাল ইট থেকে উঠে আসছে উষ্ণ কুয়াশা। একটা মথ বাবের চারপাশে ঘুরছে, আলোয় বিভ্রান্ত হয়ে। আমি খাট থেকে নেমে খালি পায়ে সাবধানে হেঁটে এলাম, যাতে না একটা কাকড়াবিছেকে মাড়িয়ে দিতে হয়। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আমি ঘুমন্ত প্রান্তর থেকে ভেসে আসা হাওয়ায় নিশ্বাস নিই। আমি শুনতে পাই রাত্রির গভীর, রমণী নিশ্বাস। তারপর আমি বাথরুমে গিয়ে বেসিনে জল ঢেলে তোয়ালেটা ভিজিয়ে নিলাম। ভিজে তোয়ালে দিয়ে আমি আমার বুক ও পা মুছে, খানিকটা শুকনো হয়ে, পোশাক পরতে শুরু করি, আগে দেখে নিই জামাকাপড়ের ভাঁজে ছারপোকাটোকা লুকিয়ে আছে কিনা। হালকা পায়ে সবুজ রং করা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে হোটেল ম্যানেজারের মুখোমুখি পড়ে যাই। লোকটির এক চোখ কানা, দুঃখী, স্বল্পভাষী মানুষ, সে একটা দড়ির চেয়ারে বসে সিগারেট টানছিল চোখ বুজে।
সে ভাল চোখটা খুলে আমার দিকে তাকাল। শুকনো গলায় প্রশ্ন করল, কোথায় যাচ্ছেন, সেনর?
—একটু বেড়িয়ে আসি। আমার ঘরের মধ্যে বড় গরম।
—কিন্তু এখন তো সব বন্ধ। আমাদের এখানে রাস্তায় আলো থাকে না। আপনার ঘরে থাকাই ভালো।
আমি কাঁধ ঝুঁকিয়ে নিম্নস্বরে বললুম, এখুনি ফিরে আসব। অন্ধকারে বেরিয়ে এলাম। প্রথমটায় আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। পাথর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে সোজা খানিকটা হেঁটে আমি সিগারেট ধরাবার জন্য দাঁড়ালাম। হঠাৎ একটা কালো মেঘের পেছন থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ, উদ্ভাসিত করে তুলল একটা জল-হাওয়া-জর্জর দেয়াল। সেই বিপুল সাদায় আমার প্রায় চোখ ঝলসে গিয়েছিল। ঝুরুঝুরু বাতাস দুলে উঠল, আমার নাকে ভেসে এল তেঁতুলগাছের গন্ধ। রাত্রির মধ্যে পাতার খসখসানি ও কীটের গুঞ্জন। চোখ তুলে তাকালাম উঁচুতে, এখন নক্ষত্রও ফুটে উঠছে। আমার মনে হল, এই বিশ্ব একটি বিশাল সংকেত প্রকল্প, বিশাল অস্তিত্বের কথোপকথন— আমার কান, ঝিঝির ডাক, তারার মিটমিটানি— এগুলি সবই আসলে সেই সংলাপের যতি, পর্ব, অসম তাল। আমি একটি মাত্র শব্দের একটি মাত্র সিলেবল। কিন্তু সেই শব্দটা কী? কে সেই শব্দ উচ্চারণ করছে? কাকে? আমি সিগারেটটা রাস্তার পাশে ছুড়ে দিলাম, সেটা জ্বলন্ত অর্ধবৃত্তে ধূমকেতুর ঘোট সংস্করণের মতো ঘুরে পড়ল। আমি অনেকক্ষণ ধরে হাঁটলাম। নিজেকে নিরাপদ এবং মুক্ত মনে হল, কারণ সেই বিশাল ওষ্ঠ আমাকে এমন স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করছে, এমন সুখে। রাত্রি একটি চক্ষুর উদ্যান।
যখন একটি রাস্তা পার হচ্ছিলাম, বুঝতে পারলুম, কেউ যেন একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। ফিরে তাকিয়ে কারুকে দেখতে পেলাম না। দ্রুত হাঁটতে শুরু করি। একটু পরেই পাথরের ফুটপাতে লোহা-পরানো জুতোর শব্দ। পিছন ফিরে তাকাইনি, যদিও অনুভব করছি একটা ছায়া আমার কাছাকাছি এগিয়ে আসছে। দৌড়ব ভেবেছিলাম, পারিনি। হঠাৎ আমি থেমে গেলাম। কেন জানি না। আমি আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম কিন্তু তক্ষুনি আমার পিঠে একটা ছুরির তীক্ষ্ণ ফলার স্পর্শ টের পেলাম। একটি চাপা কণ্ঠস্বর, নড়বেন না, সেনর, তা হলেই কিন্তু মৃত্যু।
মাথা না ঘুরিয়েই আমি বললাম, তুমি কী চাও?
আপনার চোখ, সেনর। লোকটির গলা অদ্ভুত রকমের ভদ্র, যেন কিছুটা অপ্রস্তুত।
আমার চোখ? আমার চোখ নিয়ে কী করবে? দেখো, আমার কাছে কিছু টাকা আছে, খুব বেশি নয় যদিও, তা সবই আমি তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে মেরো না।
না, না, সেনর, আমি আপনাকে খুন করতে চাই না, আমি শুধু আপনার চোখ দুটো চাই।
কেন?
আমার বান্ধবীর একটা শখ। সে এক গুচ্ছ নীল চোখের স্তবক চায়। বেশি লোকের তো ওরকম নেই।
তা হলে আমার দুটো দিয়েও কাজ হবে না। ও চোখ নীল নয়, ধূসর।
আমাকে ভোলাবার চেষ্টা করবেন না। আমি জানি আপনার নীল চোখ।
কিন্তু, আমরা খ্রিস্টান হে! তুমি হঠাৎ আমার চোখ দুটো তুলে নিতে পারো না। আমি আমার কাছে যা আছে সব দিচ্ছি।
শুধু শুধু গণ্ডগোল করবেন না, তার কণ্ঠ এবার কর্কশ, ফিরে দাঁড়ান।
আমি ফিরে দাঁড়ালাম। বেঁটে রোগা লোকটা, তালপাতার টুপিতে অর্ধেক মুখ ঢাকা। ডান হাতে একটা লম্বা ছুরি, চাঁদের আলোয় ঝকমক করছে।
মুখের সামনে একটা দেশলাই জ্বালুন।
আমি দেশলাইয়ের একটা কাঠি জ্বেলে মুখের সামনে ধরলাম। আলোর জন্য আমার চোখ বন্ধ হয়ে এল, কিন্তু সে আঙুল দিয়ে আমার চোখের পাতা খুলে দিল। সে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না, সে গোড়ালিতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে উঁকি মারল।
দেশলাইকাঠি পুড়ে শেষ হয়ে আসায় আঙুল জ্বালা করতেই ছুড়ে ফেলে দিলাম। সে একটুক্ষণ চুপ।
এখন দেখলে তো? আমার চোখ নীল নয়।
আপনি বড় চালাক, সেনর। আর একটা কাঠি জ্বালুন।
আমি আর একটা কাঠি জ্বেলে চোখের খুব কাছে ধরলাম। সে আমার জামা টেনে বলল, নিচু হয়ে বসুন।
আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সে আমার চুলের মুঠি ধরে মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিল। তারপর সে আমার ওপর ঝুঁকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে, ছুরিটা কাছে এগিয়ে এল, আরও কাছে, হেঁয়া লাগল আমার চোখের পাতায়। আমি চোখ বুজলাম।
চোখ খুলে তাকান! সে বলল, পুরোপুরি!
আমার চোখ চাইলাম। দেশলাইয়ের আগুনে পুড়ে গেল আমার চোখের পাতা। হঠাৎ আমায় ছেড়ে দিল।
নাঃ, নীল নয়! মাপ চাইছি আমি।দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে এই কথা বলে সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
.
মিলারেস ও দে লা সিলভা
[স্প্যানিশ কবিতা প্রসঙ্গে আমরা মূল স্পেন ভূখণ্ড ছাড়াও স্প্যানিশ-ভাষী কিউবা, মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশের কবিদের কথা আলোচনা করেছি। এবারে আমরা খুব ছোট দুটি দ্বীপ-দেশের কবিকে উপস্থিত করছি, যেখানকার ভাষাও স্প্যানিশ। এই কবিদ্বয় তাদের স্ব স্ব দেশের বাইরে তেমন পরিচিত নন, কিন্তু এঁদের রচনার সরলতা ও আবেগের তীব্রতা সর্বজনীন।
অগাস্টান মিলারেসের জন্ম ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে, ১৯১৭ সালে। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান ঠিক কোথায়, পাঠকের যদি এই মুহূর্তে মনে না পড়ে তবে জানাই, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলের কাছাকাছি দ্বীপ-সমষ্টি ক্যানারি, জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে পাঁচ লক্ষ।
সলোমন দে লা সিলভার জন্ম ১৮৯৩ সালে নিকারাগুয়ায়। নিকারাগুয়া মধ্য আমেরিকায় ক্যারিবিয়ান আর প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে ছোট্ট দেশ, লোকসংখ্যা এগারো লক্ষ। সলোমন দে লা সিলভা জীবনে অনেক কাজ করেছেন, উপন্যাস, কবিতা ও সাংবাদিকতা ছাড়াও যুদ্ধ করেছেন, শ্রমিক আন্দোলন গড়েছেন ও রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি প্যারিসে নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন, ওইখানেই ১৯৫৯ সালে তার মৃত্যু।]
অগাস্টান মিলারেস
শুভেচ্ছা
আমি, একজন কবি, ঘোষণা করছি যে কবিতা
শুধু মানুষের সত্য অস্তিত্বের প্রকাশ,
কবিতা শুধু সত্যের গান, তাকে জাগিয়ে তোলা
যে দৈত্য দিবা রাত্রি পাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে।
কবির কণ্ঠই একমাত্র পৃথিবীকে মুক্ত করতে পারে
সেই ঊষাকে ভেদ করে জেগে ওঠা প্রথম শিখর
সেই পাহাড়েই ধ্বনিত হয় সময়ের সংগীত
তার হৃদয়ই প্রথম ছিন্নভিন্ন হয় যেকোনো যুদ্ধে
প্রথম সারিতে তার স্থান কখনওই অস্বীকার করা যাবে না
স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের সঙ্গে তার আত্মীয়তা তাকে সেই স্থান দিয়েছে
একজন কবি সব সময়েই সেই মানুষের সঙ্গী
যারা যুদ্ধের সময় নির্ভীকভাবে ঝাঁপ দেয়
কবিই মৃত্যুবরাধকারী জনতার প্রতিনিধি
আকস্মিক রাত্রে যখন সব কিছুই বিস্মৃত
যখন কোথাও কোনো স্বাধীনতা নেই, কোনও জীবিত কবি নেই
তখন বাতাস না থাকায় পাখিরা ওড়ে না।
আমি, একজন কবি, ঘোষণা করছি আমার ক্রোধ
যখন শাসানি আসে স্বাধীনতার প্রতি, আমাদের উষ্ণকারী সূর্যের প্রতি।
পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে এলে কবিও উত্তাপহীন হয়ে যায়
পৃথিবীতে তখন হৃদয় নেই, সুবিচার নেই।
আমি, একজন কবি, ঘোষণা করছি আজকের দিনের
কর্কশ পথে একজন কবিকেই মানুষ তার ভাই বলে চিনবে।
আমি, একজন কবি, ঘোষণা করছি যে একজন কবিই সত্যিকারের মানুষ
যদিও কখনো কখনো সে আমাদের বোঝাতে যায় যে সে দেবতা।
সলোমন দে লা সিলভা
বুলেট
যে বুলেট আমাকে হত্যা করবে
সেই বুলেটেরও প্রাণ থাকবে
এই বুলেটের আত্মা হবে একটি গোলাপের মতো
যদি ফুল গান গাইতে পারে:
অথবা সে হবে হলদে মুক্তার সৌরভ
যদি রত্নেরও সৌরভ থাকে:
অথবা সে হবে সংগীতের শরীরের ত্বক
যদি আমাদের হাত দিয়ে
নগ্ন সংগীতকে স্পর্শ করা সম্ভব হত।
যদি সেই বুলেটটি এসে আমার মাথায় আঘাত করে
তবে সে বলবে, আমি দেখছিলাম তোমার ভাবনা কত গভীর।
যদি সে ঢুকে যায় আমার হৃৎপিণ্ডে
তবে সে বলবে, আমি শুধু তোমাকে দেখাতে চাই,
আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি।