স্ক্রিন সেভার
শিরীন ডাইনিং টেবিলে বসে কাজ করছিল। মাথা তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অসহিষ্ণু গলায় তপুকে উদ্দেশ করে গলা উচিয়ে বলল, তপু, কয়টা বেজেছে দেখেছিস?
তপু তার ঘর থেকে চিৎকার করে বলল, আর এক মিনিট আম্মু।
এক মিনিট এক মিনিট করে কয় মিনিট হয়েছে খেয়াল আছে?
এই তো আম্মু
প্রত্যেক দিনই একই ব্যাপার। ঘুমুতে দেরি করিস আর সকালে বিছানা থেকে টেনে তোলা যায় না।
এই তো আম্মু হয়ে গেছে।
শিরীন হাতের কাগজগুলো ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে তপুর ঘরে দেখতে গেল সে কী নিয়ে এত ব্যস্ত। যা অনুমান করেছিল ঠিক তাই। কম্পিউটারের কী–বোর্ডে দ্রুত কিছু একটা টাইপ করছে, মনিটরে উজ্জ্বল রঙের কিছু–একটা ছবি যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই। শিরীন জোরে একটা ধমক লাগাতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তপু উজ্জ্বল চোখে বলল, দেখেছ আম্মু? একটা নতুন স্ক্রিন সেভার। তুমি এটাকে গেম হিসেবে ব্যবহার করতে পার। যখন তুমি টাইপ করবে তখন লেভেল পাল্টাবে। যদি ঠিক ঠিক ম্যাচ করে তখন নতুন একটা রং বের হয়।
তপু ঠিক কী বলছে শিরীন ধরতে পারল না কিন্তু সে এত উৎসাহ নিয়ে বলল যে তাকে আর বকতে মন সরল না। বারো বছরের ছেলের নিজস্ব একটা জগৎ আছে সেটা সে দেখতে পায় কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। কাজেই সম্পূর্ণ অর্থহীন এই ব্যাপারটিতে খানিকটা উৎসাহ দেখানোর জন্যে জিজ্ঞেস করল, কোথায় পেয়েছিস এই স্ক্রিন সেভার?
আমার ই–মেইলে এসেছে।
কে পাঠিয়েছে?
আমি জানি না।
নাম নেই ঠিকানা নেই মানুষেরা কীভাবে অন্যদের সময় নষ্ট করার জন্যে এসব পাঠায় ব্যাপারটা শিরীন ভালো করে বুঝতে পারল না, কিন্তু সে বোঝার চেষ্টাও করল না। বলল, ঠিক আছে। অনেক হয়েছে, এখন শুতে যা।
তপু কম্পিউটারটা বন্ধ করতে করতে বলল, তুমি বিশ্বাস করবে না আম্মু, এই স্ক্রিন সেভারটা কী মজার। একই সাথে গেম আর স্ক্রিন সেভার। অন্য গেমের মতো না। এটা খেলতে মনোযোগ দিতে হয়। কত তাড়াতাড়ি তুমি উত্তর দাও তার ওপর সবকিছু নির্ভর করে। রংটা এমনভাবে পাল্টায় যে মনে হয় তোমার সাথে কথা বলছে। মনে হয়–
ব্যস, অনেক হয়েছে। শিরীন মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন দুধ খেয়ে দাঁত ব্রাশ করে ঘুমা।
দুধ খাবার কথা শুনে তপু আহারে জাতীয় একটা কাতর শব্দ করল কিন্তু তাতে শিরীনের হৃদয় দ্রবীভূত হল না।
একটু পরেই শিরীন তপুর বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে দেখল যে–মানুষটিকে রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করে বিছানায় পাঠানো হয়েছে, বালিশে মাথা রাখা মাত্রই সে ঘুমিয়ে একেবারে কাদা হয়ে গেছে। তার নিজের ঘুম নিয়ে সমস্যা হয় মাঝে মাঝে, চোখে ঘুম আসতে চায় না, তখন ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঝিম মেরে পড়ে থেকে একটা অন্য ধরনের ঘুমের মাঝে ডুবে থাকতে হয়। শিরীন তপুর দিকে তাকাল। ছেলেটি দেখতে তার বাবার মতো হয়েছে, উঁচু কপাল, খাড়া নাক, ঘন কালো চুল, টকটকে ফরসা রং। শিরীনের সাজ্জাদের কথা মনে পড়ল, যার এরকম একটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে সে কেমন করে স্ত্রী–পুত্রকে ছেড়ে চলে যেতে পারে? কেমন আছে এখন সাজ্জাদ? যাদের জীবনের ছোট ছোট জিনিসে তৃপ্তি নেই তারা কি কখনো কোথাও শান্তি খুঁজে পায়?
শিরীন আবার তার টেবিলে ফিরে এসে কাগজপত্রগুলো নিজের কাছে টেনে নিল। অফিসের কাজ খুব বেড়ে গেছে, প্রতিদিনই সে অফিসের কিছু ফাইল বাসায় নিয়ে আসে। সেগুলো দেখে নোট লিখে রেডি করতে করতে ঘুমুতে দেরি হয়ে যায়। শিরীনের অবিশ্যি সেটা নিয়ে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। এতদিনে সে শিখে গেছে পৃথিবী খুব কঠিন জায়গা, মেয়েদের জন্যে আরো অনেক বেশি কঠিন। সময়মতো এই চাকরিটা পেয়ে গেছে বলে সে ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তা না হলে সাজ্জাদ চলে যাবার পর ছেলেটিকে নিয়ে সে কোথায় যেত কে জানে!
সকালে তপুকে নাস্তা করতে তাড়া দিতে দিতে শিরীন খবরের কাগজটিতে চোখ বুলিয়ে নেয়, পুরো কাগজে পড়ার মতো কোনো খবর নেই। সারা পৃথিবীতেই কোনো মানুষের মনে যেন কোনো শান্তি নেই। কলারাডোতে একজন মানুষ বাচ্চাদের স্কুলে এসে সাতটা বাচ্চাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দেয় নি বলে মাগুরাতে একজন মানুষ তার স্ত্রীর মুখে এসিড ছুঁড়ে মেরেছে। ঢাকায় বারো বছরের একটা বাচ্চা তার ছোটবোনকে কুপিয়ে খুন করে ফেলেছে। শিরীন বিশ্বাস করতে পারে না তপুর বয়সী একটা ছেলে কেমন করে কুপিয়ে নিজের বোনকে মেরে ফেলতে পারে। শিরীন অবাক হয়ে ভাবল, পৃথিবীটা কী হয়ে যাচ্ছে!
অফিসে নিজের টেবিলে যাবার সময় শিরীন দেখল একাউন্টেন্ট কামাল সাহেবের টেবিলের সামনে ছোটখাটো একটা ভিড়। তিনি হাতপা নেড়ে কিছু–একটা বর্ণনা করছেন, অন্যেরা আগ্রহ নিয়ে শুনছে। শিরীন শুনল কামাল সাহেব বলছেন, দেখে বোঝার উপায় নেই। শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলে, পড়াশোনায় ভালো, কোনো সমস্যা নেই। হঠাৎ করে খেপে উঠল। রাত দুইটার সময় রান্নাঘর থেকে এই বড় একটা চাকু নিয়ে এইভাবে কুপিয়ে —
কামাল সাহেব তখন কুপিয়ে খুন করার দৃশ্যটি অভিনয় করে দেখালেন। দেখে শিরীনের কেমন জানি গা গুলিয়ে উঠল। সে জিজ্ঞেস করেছে, কার কথা বলছেন?
আরে! আপনি আজকের পত্রিকা পড়েন নাই? এটা তো এখন টক অব দা টাউন। সোনালী ব্যাংকের ডি. জি. এমের ছেলের। বারো বছর বয়স। আমাদের ফ্ল্যাটে তার ভায়রা থাকে। ছেলেটা ছোটবোনকে খুন করে ফেলেছে। পড়েন নাই পত্রিকায়?
পড়েছি। শিরীন দুর্বল গলায় বলল, ভেরি স্যাড।
কামাল সাহেব মাথা নেড়ে প্রবল হতাশার ভঙ্গি করে বললেন, এই দেশে কোনো আইন নেই, কোনো সিস্টেম নেই। আমেরিকা হলে ব্যাপারটা স্টাডি করে বের করে ফেলত। আমার ছোট শালা নিউজার্সি থাকে। একবার তার অফিসে–
শিরীন নিজের টেবিলে যেতে যেতে শুনতে পেল কামাল সাহেব একটি অত্যন্ত বীভৎস খুনের বর্ণনা দিচ্ছেন, ঘুঁটিনাটিগুলো এমনভাবে বলছেন যে শুনে মনে হয় খুনটি তার চোখের সামনে হয়েছে। শুনে শিরীনের গা গুলিয়ে উঠতে লাগল।
.
ডাইনিং টেবিলে তপু চোখ বড় বড় করে বলল, আম্মু, জান কী হয়েছে?
কী হয়েছে?
আমাদের স্কুলে ক্লাস নাইনে একটা মেয়ে পড়ে, তার নাম রাফিয়া। তার একজন কাজিন আছে, মডেল স্কুলে পড়ে। সে তার ছোটবোনকে মেরে ফেলেছে। এত বড় চাকু দিয়ে–।
শিরীন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে একটা বিষম খেল, আজকের দিনে এই ঘটনাটা তিনবার শুনতে হল। একটা ভালো ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ছড়ায় না, কিন্তু ভয়ংকর নিষ্ঠুর আর বীভৎস ঘটনা সবার মুখে মুখে থাকে।
খুন করার আগে রাফিয়াকে একটা ই–মেইল পাঠিয়েছে। লিখেছে আই হ্যাঁভ টু ডু ইট। আমাকে এটা করতে হবে। তপু চোখ বড় বড় করে বলল, কীভাবে খুন করেছে জান?
শিরীন মাথা নেড়ে বলল, না, জানি না। কিন্তু জানার কোনো ইচ্ছেও নেই। এইসব খুন–জখমের ব্যাপারে তোদের এত ইন্টারেস্ট কেন?
রগরগে খুনের বর্ণনাটা দিতে না–পেরে তপু একটু নিরুৎসাহিত হয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেল, এখন ছেলেটার কী হবে আম্মু? ফাঁসি হবে?
এত ছোট ছেলের ফাঁসি হয় না।
তাহলে কী হবে?
আমি ঠিক জানি না। বাচ্চা একটা ছেলে তো আর এমনি–এমনি খুন করে ফেলে না, নিশ্চয়ই পিছনে অন্য কোনো ব্যাপার আছে। সেটা খুঁজে বের করে তার চিকিৎসা করতে হবে।
কী চিকিৎসা?
সাইকোলজিস্টরা বলতে পারবে। আমি তো আর সাইকোলজিস্ট না–আমি এত কিছু জানি না।আলোচনাটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে বলল, হোমওয়ার্ক সব শেষ করেছিস?
তপু দাঁত বের করে হেসে বলল, করে ফেলেছি। আজকে অঙ্ক মিস আসে নাই, তাই কোনো হোমওয়ার্কও নাই!
শিরীন হেসে বলল, খুব মজা, না?
তপু মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ!
.
পড়াশোনা শেষ করে তপু খানিকক্ষণ টিভি দেখে, টিভিতে ভালো প্রোগ্রাম না থাকলে কম্পিউটার নিয়ে খেলে। সবার কাছে কম্পিউটার কম্পিউটার শুনে শিরীন ছেলেকে একটা কিনে দিয়েছে– অনেকগুলো টাকা লেগেছে কিন্তু তবুও তপুর শখ মিটিয়ে দিয়েছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, সেমিনার, বক্তৃতা শুনে মনে হয়েছিল ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দিলেই সে হয়তো হাতি ঘোড়া অনেকরকম সৃর্জনশীল কাজ করে দেবে কিন্তু সেরকম কিছু দেখা যায় নি। বন্ধুবান্ধবের সাথে গেম বিনিময় করে, ইন্টারনেট থেকে মাঝে মাঝে কোনো ছবি বা গান ডাউনলোড করে, মোটামুটি তাড়াতাড়ি টাইপ করে কিছু–একটা লিখতে পারে এর চাইতে বেশি কিছু হয়নি। এতগুলো টাকা শুধুশুধু অপচয় করল কিনা সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে শিরীনের সন্দেহ হয়।
ঘুমানোর আগে প্রায় প্রতিদিনই তপু কম্পিউটার গেম খেলে, তখন তপুর ঘর থেকে গোলাগুলি, মহাকাশযানের গর্জন কিংবা মহাকাশের প্রাণীর চিৎকার শোনা যায়। আজকে ঘরে কোনো শব্দ নেই, শিরীন খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে নিঃশব্দে ছেলের ঘরে হাজির হল। গিয়ে দেখে তপু কেমন জানি সম্মোহিতের মতো কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। সামনে মনিটরের স্ক্রিনে একটি অত্যন্ত বিচিত্র নকশার মতো ছবি, খুব ধীরে ধীরে সেটি নড়ছে। কান পেতে থাকলে কম্পিউটারের স্পিকার থেকে খুব মৃদু একটি অতিপ্রাকৃত সংগীতের মতো কিছু একটা ভেসে আসতে শোনা যায়। শিরীন কিছুক্ষণ তপুর দিকে তাকিয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে ডাকল, তপু।
তপু চমকে উঠে শিরীনের দিকে তাকাল। শিরীন অবাক হয়ে দেখল, তপুর দৃষ্টি কেমন জানি অপ্রকৃতিস্থর মতো। ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোর?
তপু বলল, কিছু হয় নাই।
স্ক্রিনের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
এমনি। তপু এমনভাবে মাথা নিচু করল যে দেখে শিরীনের মনে হল সে একটা কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে।
শিরীন বলল, এমনি এমনি কেউ এভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকায়?
না। মানে এই যে স্ক্রিন সেভারটা আছে সেটার দিকে তাকালে মাঝে মাঝে অন্য জিনিস দেখা যায়।
অন্য জিনিস? শিরীন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, অন্য কী জিনিস?
তপু ঠিক বোঝাতে পারল না, ঘাড় নেড়ে বলল, মনে হয় কেউ কথা বলছে।
কথা বলছে? কী কথা বলছে?
জানি না।
দেখি আমি। শিরীন তপুর পাশে বসে দেখার চেষ্টা করল, অবাক হয়ে লক্ষ করল মনিটরের নকশাটি এমনভাবে ধীরে ধীরে নড়ছে যে মনে হয় সে বুঝি আদিগন্ত শূন্যতার মাঝে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। শিরীন চোখ সরিয়ে তপুর দিকে তাকিয়ে বলল, কী সব উল্টাপাল্টা জিনিস দেখে সময় নষ্ট করছিস? বসে বসে প্রোগ্রামিং করতে পারিস না?
তপু যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল, বড় মানুষদের নিয়ে এটাই হচ্ছে সমস্যা, কোনো জিনিসের মাঝে আনন্দ রাখতে চায় না–সবসময়েই শুধু কাজ আর কাজ। বড় হয়ে সে প্রোগ্রামিঙের অনেক সুযোগ পাবে, এখন কয়দিন একটু মজা করে নিলে ক্ষতি কী? শিরীন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাতে যা।
শিরীন ভেবেছিল তপু আপত্তি করে খানিকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করবে, কিন্তু সে আপত্তি করল না, সাথে সাথেই দুধ খেয়ে দাঁত ব্রাশ করে শুতে গেল। ডাইনিং টেবিলে কাগজপত্র ছড়িয়ে কাজ করতে করতে শিরীন শুনতে পেল তপু বিছানায় নড়াচড়া করছে। সাধারণত সে মোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে যায়, আজকে কোনো একটি কারণে তার চোখে ঘুম আসছে না।
রাত্রে ঘুমানোর আগে শিরীন কিছুক্ষণের জন্যে টিভিতে খবর শুনল। দেশ–বিদেশের খবর শেষ করে বলল, তের–চৌদ্দ বছরের একটা ছেলে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করার আগে সে ইন্টারনেটে কয়েকজনের সাথে লিখে লিখে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদেরকে বলেছে এখন তার আত্মহত্যা করতে হবে। সবাই ভেবেছিল ঠাট্টা করছে কিন্তু দেখা গেল ঠাট্টা নয়।
খবরটা শুনে শিরীনের মনটা খারাপ হয়ে যায়। বয়োসন্ধির সময়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি কিশোর–কিশোরী আত্মহত্যা করে। কিন্তু যারা আত্মহত্যা করে তারা তো হঠাৎ করে সিদ্ধান্তটি নেয় না, দীর্ঘদিনে ধীরে ধীরে একটা প্রস্তুতি নেয়। ছেলেটির পরিবারের কেউ কি ছিল না যে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে পারত? সবার সাথেই কি একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল? তপু যখন আরেকটু বড় হয়ে বয়োসন্ধিতে পৌঁছাবে তখন কি তার সাথেও এরকম একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাবে? শিরীন তপুর ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, ছেলেটির চেহারায় এমনিতেই একটি নির্দোষ সারল্যের ভাব আছে, যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সেটা আরো এক শ গুণ বেড়ে যায়। শিরীন নিচু হয়ে তপুর গালে একটা চুমু খেয়ে মশারিটা ভালো করে গুঁজে দিয়ে লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে বের হয়ে এল।
অফিসে যাবার আগে তপুর সাথে নাস্তা খাওয়ার সময় খবরের কাগজে চোখ বুলাতে গিয়ে শিরীনের আবার মন খারাপ হয়ে গেল। গতকাল যে–ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে তার ছবি ছাপা হয়েছে। ফুটফুটে বুদ্ধিদীপ্ত একটা কিশোর। পাশে আরেকটা ছবি, ছেলের মৃতদেহের উপর মা আকুল হয়ে কাঁদছে। খবরের কাগজের মানুষগুলো কেমন করে এরকম ছবিগুলো ছাপায়? তাদের বুকের ভিতরে কি কোনো অনুভূতি নেই?
সপ্তাহখানেক পর দৈনিক প্রথম খবরে হাসান জামিল নামে একজন দুর্বোধ্য কৈশোর নামে একটি বড় প্রতিবেদন লিখল। গত মাসখানেকের মাঝে কমবয়সী কিশোর–কিশোরী নিয়ে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে, ঘটনাগুলো সত্যিই অস্বাভাবিক এবং দুর্বোধ্য। একজন খুন করেছে, আরেকজন খুন করার চেষ্টা করেছে। দুজন আত্মহত্যা করেছে, তিনজন নিখোঁজ। অন্তত আধডজন কিশোর–কিশোরী অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে। এ ছাড়াও বড় একটা সংখ্যার। কিশোর–কিশোরী কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে একধরনের বিষণ্ণতায় ভুগছে। ঠিক কী কারণ কেউ জানে না। এই কিশোর–কিশোরীদের সবাই সচ্ছল পরিবারের, তুলনামূলকভাবে। সবাই পড়াশোনায় ভালো, মেধাবী। সবাই শহরের ছেলেমেয়ে, একটা বড় অংশ খানিকটা নিঃসঙ্গ। হাসান জামিল নামক ভদ্রলোক ব্যাপারটি নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারে নি। বেপরোয়া নগরজীবন, ড্রাগস, নিঃসঙ্গতা, পারিবারিক অশান্তি, পাশ্চাত্য জগতের প্রলোতন, টেলিভিশন, প্রেম–ভালবাসা কিছুই বাকি রাখে নি, কিন্তু হঠাৎ করে কেন এতগুলো কিশোর–কিশোরীর এ ধরনের একটা পরিণতি হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে দিতে পারে নি।
শিরীন প্রতিবেদনটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল, এবং ঠিক কী কারণ জানা নেই পড়ার পর থেকে সে কেমন যেন শঙ্কা অনুভব করতে থাকে। দুর্বোধ্য কিশোর–কিশোরীর যে প্রোফাইলটা দেওয়া হয়েছে তার সাথে তপুর কেমন যেন একটা মিল রয়েছে। সবচেয়ে যেটা ভয়ের কথা, ইদানীং শিরীনের মনে হচ্ছে তপুর সাথে তার কেমন জানি একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে।
রাত্রে খাবার টেবিলে শিরীন ইচ্ছে করে তপুর সাথে একটু বেশি সময় নিয়ে কথা বলল; তার স্কুলের, বন্ধুবান্ধবের খোঁজখবর নিল। শিরীন লক্ষ করল তপুকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে কিন্তু নিজে থেকে কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে খানিকটা অন্যমনস্ক প্রশ্ন করলেও মাঝে মাঝে উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে, প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করতে হচ্ছে। শিরীন কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, কী হয়েছে তোর? কথা বলছিস না কেন?
কে বলেছে কথা বলছি না?
দশটা প্রশ্ন করলে একটা উত্তর দিচ্ছিস। কী হয়েছে?
কিছু হয় নাই।
শিরীন লক্ষ করল তপু জোর করে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু কথায় যেন প্রাণ নেই। জোর করে, চেষ্টা করে কষ্ট করে বানিয়ে বানিয়ে বলছে। বলার ইচ্ছে করছে না কিন্তু শিরীনকে খুশি করার জন্যে বলছে।
রাত্রে ঘুমানোর আগে শিরীন তপুর ঘরে গিয়ে দেখে সে কম্পিউটারের মনিটরের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে। মনিটরে বিচিত্র একটি নকশা খুব ধীরে ধীরে নড়ছে, তার সাথে সাথে স্পিকার থেকে খুব হালকা একটি সঙ্গীত ভেসে আসছে। তপুর দৃষ্টি সম্মোহিত, মুখ অল্প খোলা। কিছু একটা দেখে যেন সে ভারি অবাক হচ্ছে, নিচের ঠোঁট অল্প অল্প নড়ছে। শুধু তাই নয়, শিরীন অবাক হয়ে দেখল, তপু যেন ফিসফিস করে কিছু–একটা বলছে, যেন অদৃশ্য কারো সাথে কথা বলছে। শিরীন কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল, চাপা গলায় ডাকল, তপু।
তপু শুনতে পেল বলে মনে হল না, শিরীন তখন আবার ডাকল, তপু। আগের থেকে জোরে ডেকেছে তপু তবুও ঘুরে তাকাল না। শিরীন এবারে তপুকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তপু, এই তপু, কী হয়েছে তোর?
তপু খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে শিরীনের দিকে তাকাল, শিরীন তার দৃষ্টি দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠে। শূন্য এবং অপ্রকৃতিস্থ একধরনের দৃষ্টি, শিরীনের দিকে তাকিয়েছে কিন্তু মনে হচ্ছে সে কিছু দেখছে না। শিরীন আবার চিৎকার করে তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকল, তপু,এই তপু।
তপু কাঁপা গলায় বলল, কী!
কী হয়েছে তোর?
তপু সম্মোহিতের মতো বলল, কিছু হয় নি।
কার সাথে কথা বলছিস তুই?
সেভারের সাথে।
সেভার? সেতার কে?
স্ক্রিন সেভার। লাইফ সেভার। নেট সেভার। সোল সেভার।
শিরীন চিৎকার করে বলল, কী বলছিস তুই পাগলের মতো? তপু, কী হয়েছে তোর?
তপু হঠাৎ করে যেন জেগে উঠল, অবাক হয়ে তাকাল শিরীনের দিকে, বলল, কী হয়েছে আম্মু?
তোর কী হয়েছে?
আমার? আমার কিছু হয় নি।
তাহলে এখানে এভাবে বসে ছিলি কেন? কার সাথে তুই কথা বলছিলি?
তপুকে হঠাৎ যেন কেমন বিভ্রান্ত দেখায়, কী যেন চিন্তা করে ভুরু কুঁচকে তারপর মাথা নেড়ে বলল, মনে নেই আম্মু। কী যেন একটা খুব ইম্পরট্যান্ট একটা ব্যাপার। খুব। জরুরি–
শিরীন হঠাৎ করে কেমন জানি খেপে গেল, চিৎকার করে বলল, বন্ধ কর কম্পিউটার। এক্ষুনি বন্ধ কর। বন্ধ কর বলছি।
তপু কেমন জানি ভয় পেয়ে কম্পিউটার বন্ধ করে শিরীনের দিকে তাকাল। শিরীন হিংস্র গলায় বলল, আর কোনোদিন তুই কম্পিউটারের সামনে বসতে পারবি না। নেভার। বুঝেছিস?
তপু অবাক হয়ে শিরীনের দিকে তাকিয়ে রইল, সে যেন ঠিক বুঝতে পারছে না তার আম্মু কী বলছে।
.
রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে শিরীন শুনতে পেল তপু ঘুমের মাঝে বিছানায় ছটফট করছে। মনে হয় বুঝি কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। শিরীন তপুর মাথার কাছে বসে রইল, শেষ পর্যন্ত যখন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তখন সে নিজের বিছানায় এল শোয়ার জন্যে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইল–তার চোখে কিছুতেই ঘুম আসছে না।
.
পরদিন দুপুরের পর শিরীন তাদের অফিসের সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটর শাহেদ আহমেদকে খুঁজে বের করল। যে–কোনো সিস্টেম এডমিনের মতোই শাহেদ কমবয়সী, উৎসাহী এবং হাসিখুশি মানুষ। শিরীনকে দেখে বলল, কী হয়েছে আপা? সিস্টেম ডাউন?
না, না, সিস্টেম ঠিকই আছে।
তাহলে?
আপনি তো কম্পিউটারের এক্সপার্ট, আপনাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি।
কী জিনিস?
শিরীন ইতস্তত করে বলল, কম্পিউটার কি ছোট বাচ্চাদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে?
অবশ্যই পারে। শাহেদ উজ্জ্বল চোখে বলল, কম্পিউটার হচ্ছে একটা টুল। এই টুলটা ব্যবহার করে কতকিছু করা যায়, কতকিছু শেখা যায়–
না, না– শিরীন মাথা নেড়ে বলল, আমি ভালো প্রভাবের কথা বলছি না, খারাপ প্রভাবের কথা বলছি।
শাহেদ এবারে সরু চোখে শিরীনের দিকে তাকাল, বলল, কীরকম খারাপ প্রভাব?
ধরুন, পাগল হয়ে যাওয়া?
শাহেদ হেসে বলল, না, সেরকম কিছু আমি কখনো শুনি নি।
কোনো কম্পিউটার গেম কি আছে যেটা খেললে বাচ্চাদের ক্ষতি হয়?
সেটা তো থাকতেই পারে। আজকাল কী ভয়ানক ভয়ানক ভায়োলেন্ট গেম তৈরি করেছে। এত গ্রাফিক যে সেগুলো খেলে খেলে বাচ্চারা ইনসেনসেটিভ হয়ে যেতে পারে। ভায়োলেন্সে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে। গত বছর দুটি ছেলে আমেরিকার স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের গুলি করে মারল–তারা নাকি কী একটা কম্পিউটার গেম থেকে খুন করার আইডিয়াটা পেয়েছে?
শিরীন ইতস্তত করে বলল, কিন্তু কম্পিউষ্টার গেম নয়–স্ক্রিন সেভার থেকে কি কোনো ক্ষতি হতে পারে?
শাহেদ হেসে বলল, স্ক্রিন সেভারটা তৈরি হয়েছে স্ক্রিনের ফসফরকে বাঁচানোর জন্যে। কোনো একটা ডিজাইন, নকশা, এটা দেখে আর কী ক্ষতি হবে। তবে
তবে?
যাদের এপিলেন্সি আছে তাদেরকে কম্পিউটার গেম খেলতে নিষেধ করে। কোথায় নাকি স্টাডি করে দেখেছে মনিটরের ফ্লিকার দেখে তাদের সিজুর ট্রিগার করতে পারে। আমি নিজে দেখি নি, শুনেছি।
শাহেদ কথা থামিয়ে একটু অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ আপনি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?
শিরীন পুরো ব্যাপারটি খুলে বলবে কিনা চিন্তা করল, কিন্তু হঠাৎ তার কেমন জানি সংকোচ হল। সে মাথা নেড়ে বলল, না, এমনিই জানতে চাচ্ছিলাম।
.
শাহেদের সাথে কথা বলে শিরীন নিজের টেবিলে এসে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে থাকে। তার মাথায় কয়দিন থেকেই একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই সন্দেহটা আরো প্রবলভাবে নিজের উপর চেপে বসছে। শেষ পর্যন্ত সে সন্দেহটা মিটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, ডাইরি থেকে টেলিফোন নাম্বার বের করে দৈনিক প্রথম খবরে ফোন করে হাসান জামিলের সাথে কথা বলতে চাইল। কিছুক্ষণের মাঝেই টেলিফোনে একজনের ভারী গলা শুনতে পেল, হ্যাঁলো হাসান জামিল।
শিরীন এর আগে কখনো খবরের কাগজের অফিসে ফোন করে নি, খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি আপনাদের পত্রিকার একজন পাঠক।
জি। কী ব্যাপার?
বেশ কয়েকদিন আগে আপনি আপনাদের পত্রিকায় দুর্বোধ্য কৈশোর নামে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলেন।
হ্যাঁ লিখেছিলাম। অনেক টেলিফোন কল পেয়েছিলাম তখন।
আমিও সেটা নিয়ে কথা বলতে চাইছি। শিরীন একটু ইতস্তত করে বলল, সেই ব্যাপার নিয়ে আমি একটা জিনিস জানতে চাইছি।
কী জিনিস?
আপনি যেসব কিশোর–কিশোরীর কথা লিখেছেন, আই মিন যারা খুন করেছে বা আত্মহত্যা করেছে বা অন্যভাবে ডিস্টার্ব তাদের কি কোনোভাবে কম্পিউটারের সাথে সম্পর্ক আছে? মানে তারা কি এর আগে কোনোভাবে কম্পিউটার দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে?
হাসান জামিল টেলিফোনের অন্য পাশে দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলল, খুব অবাক ব্যাপার যে আপনি এটা জিজ্ঞেস করলেন। ব্যাপারটা আমরাও লক্ষ করেছি– যারা যারা ডিস্টার্বড সবাই কম্পিউটারে অনেক সময় দেয়, কিন্তু সেটাকে আমরা কোনো কো–রিলেশান হিসেবে ধরি নি।
কেন ধরেন নি?
মনে করুন সবাই তো নিশ্চয়ই সকালে নাস্তা করে, দুপুরে ভাত খায়; তাহলে কি বলব যারা সকালে নাস্তা করে কিংবা দুপুরে ভাত খায় তারা সবাই ডিস্টার্বড।
শিরীন একটু ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, এটা খুব বাজে যুক্তি।
যুক্তি পছন্দ না হলেই আপনারা বলেন বাজে যুক্তি।
আপনি যেসব কিশোর-কিশোরীর কথা লিখেছেন তাদের সবাই কি ঘটনার আগে আগে কম্পিউটারের কোনো একটা বিশেষ জিনিস নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে ছিল না? সামথিং ভেরি স্পেসিফিক?
হাসান জামিল আমতা আমতা করে বললেন, ইয়ে সেরকম একটা কথা আমরা শুনেছি। কনফার্ম করতে পারি নি।
সাংবাদিক হিসেবে আপনাদের কি দায়িত্ব ছিল না কনফার্ম করা?
দেখুন আমরা সাংবাদিক, তার অর্থ এই নয় যে আমরা সমাজের বাইরে। সমাজের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। আমরা চেষ্টা করছি দেশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে নিতে। এখন যদি কম্পিউটার নিয়ে একটা ভীতি ছড়িয়ে দিই–অকারণ ভীতি–
অকারণ ভীতি? অকারণ?
যেটা প্রমাণিত হয় নি
আপনারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নি
হাসান জামিল আবার আমতা আমতা করে কিছু–একটা বলতে চাইছিল কিন্তু শিরীনের আর কিছু শোনার ধৈর্য থাকল না। সে রেগেমেগে টেলিফোনটা রেখে গুম হয়ে টেবিলে বসে রইল।
.
একটা চাপা দুশ্চিন্তা নিয়ে শিরীন বাসায় ফিরে এসে দেখে তপু বসে বসে হোমওয়ার্ক করছে। শিরীনকে দেখে হাত তুলে বলল, আম্মু, তুমি এসেছ!
হ্যাঁ, বাবা। তোর কী খবর?
বাংলা খবর বলে তপু হি হি করে হাসল। এটা একটা অত্যন্ত পুরাতন এবং বহুলব্যবহৃত রসিকতা, তবুও শুনে শিরীনও হাসল এবং হঠাৎ করে তার মন ভালো হয়ে গেল। শিরীন তপুর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে খানিকক্ষণ এটা–সেটা নিয়ে কথা বলে আসল প্রসঙ্গে চলে এল। বলল, তপু।
কী আম্মু!
আমি ঠিক করেছি তুই এখন কয়েকদিন কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবি না।
শিরীন ভেবেছিল তপু নিশ্চয়ই চিৎকার করে আপত্তি করবে, নানারকম ওজর-আপত্তি তুলবে, নানা যুক্তি দেখাবে। কিন্তু সে কিছুই করল না, অত্যন্ত বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে আম্মু।
.
গভীর রাতে হঠাৎ শিরীনের ঘুম ভেঙে গেল। ঠিক কেন ঘুম ভেঙেছে সে বুঝতে পারল না, তার শুধু মনে হল খুব অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে কিন্তু সেটা কী সে বুঝতে পারছে না। সে চোখ খুলে তাকাল। তার মনে হল সারা বাসায় হালকা নীল একটা আলো। শুধু তাই নয়, মনে হল খুব চাপাস্বরে কেউ একজন কাঁদছে, ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না। শিরীন ধড়মড় করে উঠে বসল। আলোটা মনের ভুল নয়, সত্যিই হালকা নীল রঙের একটা আলো। কিসের আলো এটা?
শিরীন বিছানা থেকে নেমে নিজের ঘর থেকে বের হতেই দেখল তপুর ঘরের দরজা আধখোলা, আলোটা তার ঘর থেকে আসছে। শিরীন প্রায় ছুটে সেই ঘরে ঢুকে আলোর উৎসটা আবিষ্কার করল, কম্পিউটারের মনিটরের আলো। মনিটরে বিচিত্র একটা ছবি, সেটি ধীরে ধীরে নড়ছে এবং স্পিকার থেকে চাপা কান্নার মতো একটা শব্দ হচ্ছে মনে হচ্ছে। ঝড়ো বাতাসের শব্দ, তার মাঝে কেউ একজন ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। মনিটরের অপার্থিব নীল আলোতে তপুর ঘরটিকে একটি অপার্থিব জগতের দৃশ্য বলে মনে হচ্ছে। শিরীন অবাক হয়ে তপুর বিছানার দিকে তাকাল, বিছানার এক কোনায় তপু গুটিশুটি মেরে বসে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছে। শিরীন কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোর, তপু? কী হয়েছে?
তপু কাঁদতে কাঁদতে বলল, ভয় করছে আম্মু। আমার খুব ভয় করছে।
ভয় কী বাবা? তোর ভয় কিসের?
শিরীন ঘরের লাইট জ্বালিয়ে তপুর কাছে এগিয়ে যায়। মশারি তুলে তপুর কাছে গিয়ে বসল। হাঁটুর ওপরে মুখ রেখে বসেছে, চোখ থেকে পানি বের হয়ে গাল ভিজে আছে। চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতিস্থের মতো, একধরনের আতঙ্ক নিয়ে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে আছে। হাত দুটি পিছনে, অত্যন্ত বিচিত্র একটি বসে থাকার ভঙ্গি। শিরীন তপুর পিঠে হাত রেখে বলল, তোকে না কম্পিউটার চালাতে নিষেধ করেছিলাম?
আমি চালাই নি আম্মু। বিশ্বাস কর আমি চালাই নি।
তাহলে কে চালিয়েছে?
তপু ফেঁপাতে ফেঁপাতে বলল, আমি জানি না।
ঠিক আছে বাবা, কম্পিউটার বন্ধ করে দিচ্ছি।
তপু হঠাৎ চিৎকার করে বলল, না।
না! শিরীন অবাক হয়ে বলল, কেন না?
আমার ভয় করে আম্মু–আমি বলতে পারব না—
শিরীন অবাক হয়ে তপুর পিঠে হাত বুলিয়ে হাতটা নিচে আনতেই হঠাৎ সেখানে একটা ধাতব শীতল স্পর্শ অনুভব করল। পিছনে তাকাতেই সে অবাক হয়ে দেখল তপু দুই হাতে একটা চাকু ধরে রেখেছে। রান্নাঘরে এই চাকু দিয়ে সে শাকসজি কাটে। শিরীনের মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় এবং কিছু বোঝার আগে হঠাৎ করে তপু দুই হাতে চাকুটা উপরে তুলে শিরীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করল।
শিরীন প্রস্তুত ছিল বলে ঝটকা মেরে একপাশে সরে গেল এবং তপুর চাকুটা বিছানার ভেতরে ঢুকে গেল। শিরীন চিৎকার করে তপুর হাতটা খপ করে ধরে ফেলল কিন্তু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল এইটুকু মানুষের শরীরে ভয়ঙ্কর জোর। তপু হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিয়ে আবার চাকুটা উপরে তুলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে বলল, আম্মু আমি মারতে চাই না আম্মু কিন্তু আমি কী করব। আমাকে বলেছে মারতেই হবে– তপু কথা শেষ করার আগেই আবার চাকুটি নিয়ে শিরীনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শিরীন ঝটকা মেরে আবার সরে গিয়ে টেবিলের নিচে ঢুকে গেল। ভয়ংকর আতঙ্ক নিয়ে দেখল তপু চাকুটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। সে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে–কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে আসছে, তার কিছু করার নেই, তাকে কেউ একজন আদেশ দিচ্ছে, সেই আদেশ সে অমান্য করতে পারবে না।
শিরীন দেখল তপু আরো একটু এগিয়ে এসেছে, ঠিক তখন সে কম্পিউটারের পাওয়ার কর্ডটা টান দিয়ে খুলে ফেলল। একটা চাপা শব্দ করে মনিটরটি অন্ধকার হয়ে গেল এবং সাথে সাথে তপু মাটিতে টলে পড়ে গেল। শিরীন কাছে গিয়ে দেখে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তপুকে বুকে চেপে ধরে সে বের হয়ে আসে হামাগুড়ি দিয়ে সে টেলিফোনের কাছে ছুটতে থাকে– তাকে এখন হাসপাতালে নিতে হবে। তাকে বাঁচাতে হবে।
.
মাসখানেক পরের কথা। শাহেদের রুমে শিরীন তার সাথে কথা বলছে। শাহেদ হাসিমুখে বলল, আপনার অনুমান সত্যি। আপনার কথা বিশ্বাস করলে আরো অনেক মানুষকে বাঁচানো যেত।
শিরীন কোনো কথা বলল না। শাহেদ বলল, কিন্তু ব্যাপারটি বিশ্বাস করবে কীভাবে? এটা তো বিশ্বাস করার কথা নয়। একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম বাচ্চাদের সম্মোহিত করে ভয়ংকর ভয়ংকর ব্যাপার ঘটাচ্ছে, এটা কি বিশ্বাস করা যায়?
শিরীন মাথা নাড়ল। বলল, তা যায় না।
আপনার ছেলে এখন কেমন আছে?
ভালো। প্রতিদিন বিকেলে এখন আমি ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিই খেলার জন্যে। দৌড়াদৌড়ি করার জন্যে।
ভেরি গুড। ঐ রাতের ঘটনা কিছু মনে করতে পারে?
না, পারে না। আমি চাইও না তার মনে পড়ুক।
শাহেদ হাসার চেষ্টা করে বলল, ঠিকই বলেছেন।
শিরীন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঐ স্ক্রিন সেভারটা কে তৈরি করেছে সেটা কি বের করতে পেরেছে?
শাহেদ মাথা নাড়ল, বলল, না। অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু এখনো বের করতে পারে নি। স্ক্রিন সেভারটা এত অদ্ভুত এত অস্বাভাবিক যে সবাই একটা অন্য জিনিস সন্দেহ করছে।
কী সন্দেহ করছে?
এটা কোনো মানুষ লেখে নি।
তাহলে কে লিখেছে?
ইন্টারনেট।
ইন্টারনেট?
হ্যাঁ–ইন্টারনেট হচ্ছে অসংখ্য কম্পিউটারের একটা নেটওয়ার্ক–ঠিক মানুষের মস্তিষ্কের মতো। অনেকে মনে করছে পৃথিবীর ইন্টারনেটের বুদ্ধিমত্তা এখন মানুষের বুদ্ধিমত্তা থেকে বেশি।
মানে?
তার মানে মানুষ নেটওয়ার্ককে নিয়ন্ত্রণ করছে না। নেটওয়ার্কই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
শিরীন চমকে উঠে বলল, কী বলছেন আপনি!
হ্যাঁ, সবাই ধারণা করছে এই স্ক্রিন সেভারটি ছিল তাদের প্রথম চেষ্টা–পরের বার আক্রমণটা হবে আরো পরিকল্পিত। আরো ভয়ানক।
শিরীন কোন কথা না বলে চোখ বড় বড় করে শাহেদের দিকে তাকিয়ে রইল।