সে একলা হাঁটে, হেঁটে হেঁটে যেতে থাকে যোজন যোজন দূরে।
ফুটপাত, আইল্যান্ড, দালানের ভিড়, ফ্ল্যাটরাজি,
অজস্র দোকানপাটি ছেড়ে সে একলা হাঁটে, যায়
প্রান্তরের কাছে,
নদীর কিনারে।
পানির গভীরে চোখে মেলে কী-যে খোঁজে সূর্যাস্তের
রঙের আড়ালে, কম্পমান নৌকোগুলি বুঝি তার
স্মৃতির নিঝুম খাল বেয়ে সদ্য এসেছে এখানে।
তার হাতে বাদ্যযন্ত্র নেই কোনো, তবু তার কাছ থেকে সুর
ভেসে আসে, বুঝি রিস্টওয়াচের থেকে বংশীধ্বনি সৃষ্টি হয়,
না কি তার তন্দুরের মতো লাল চোখ থেকে, হৃৎপিণ্ডের থেকে?
যখন সে পেয়ালায় ওষ্ঠ রাখে, পেয়ালা উপচে পড়ে সুর,
আবার কখনো বুক জমে যায় পাথরের মতো, উদাসীন
প্রাণের সকল তন্ত্রী, সংগীত ও ভীষণ ক্রূর মূক হতে পারে।
মাঝে-মাঝে তাকে
সরাইখানার আলো, ম্যান্ডোলিন পারে না থামাতে, সবকিছু
ছেড়ে ছুড়ে সে একলা হাঁটে। দ্যাখে স্বপ্নের রঙের মতো গাভি
ওড়ে পূর্ণিমায় আর কে যেন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে
পথপ্রান্তের, কেউ কেউ দোলনায় দুলে দুলে করছে বিলাপ।
মেঘে মেঘে মেহগনি কফিনের মিছিল এবং
সিংহের খণ্ডিতে মাথা, এক গুচ্ছ সোনালি চাবির ঐকতান,
এনামেল-রঙ দেবদূত।
মাথার ভেতরে তার বাবুই পাখির তছনছ বাসা, কালো
পেন্সিলের আঁকাবাঁকা রেখার মতোন পিঁপড়ে-সারি,
ছিন্নভিন্ন একরাশ ভ্রমণ কোমল, কিছু দুর্গের প্রাকার-
দু’তিন শতাব্দী তার মাথার ভেতরে খেলে যায়।
সন্দেহপ্রবণ তার প্রতি অনেকেই এমন কি কৃষ্ণচূড়া
কোকিল, পাহাড়ি ঝরণা তাকে কতিশয় ঘাঘু এক
গোয়েন্দা ঠাউরে নেয়। সে একলা হাঁটে, কখনো বা
দুপুর সাঁতরে এসে বিকেলের ঘাটে বসে চুপে
ঘাসের ওপরে ঝুঁকে গোপন রিপোর্ট লেখে কিছু
খরগোশ, কোকিল আর রজনীগন্ধার, কেউ কেউ
দু’পাশে মার্জিনে পায় ঠাই।
অকস্মাৎ ফিরে আসে মানুষের ভিড়ে একা-একা।
যদি কেউ কোনো প্রশ্ন করে তাকে, তবে সে নীরবই
থাকে বেশি, মাথা নাড়ে মাঝে-মধ্যে, আবার কখনো
ইচ্ছে হ’লে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলে উত্তরের দায় সারে।
যখন সবাই থাকে চুপচাপ, তখন হঠাৎ তারস্বরে
আকাশ ফাটিয়ে
একাকী সে লোক সহস্র জনের মতো-আজ
আমরা সর্বস্ব দিয়ে কিনেছি এ কোন
সোনালি সাপের মতো পণ্য ভয়ংকর?
সে একলা হাঁটে। ফিরে গেলে গৃহকোণে, প্রভুভক্ত
বয়েসী কুকুর তাকে শুঁকবে কি পুরোনো স্মৃতির মতো আজ
এতকাল পরে?
কোনো সঙ্গী নেই পাশে। কেউ চোরাবালি, কেউ ধুধু
প্রান্তরে অথবা দৈত্যকবলিত গুহায়, কেউ বা সমুদ্রে চিরলীন।
সে একলা হাঁটে। হেঁটে হেঁটে যেতে থাকে, বুঝি কেউ তার
প্রতীক্ষায় আছে চুল খুলে আর ওঁৎ পেতে আছে প্রতিদ্বন্দ্বী
থামের আড়ালে বহুজন।