নয়
সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করল রানা। তারপর কাফে থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করল ধীর পায়ে। ঘণ্টাখানেক আগে রাস্তার শেষ প্রান্তের বাড়িটা থেকে গোটা পরিবার ট্রেইলরে চড়ে রওনা হয়ে গেছে। কবে ফিরবে আবার তারা জানা নেই ওর, তবে যাত্রার আয়োজন লক্ষ করে যতদূর ধারণা করা যায়, হপ্তাখানেকের মধ্যে ফিরছে না। ভিজে বিড়ালের মত হেঁটে গেল ও বাড়িটার সামনে দিয়ে। আড়চোখে দেখে নিল সদর দরজায় তালা ঝুলছে। নিচু বাউন্ডারি ওয়ালের ওপারে বাড়িটার সবগুলো জানালা দরজা বন্ধ। কোথাও এতটুকু আলোর আভাস নেই। ডানপাশে ছোট্ট একটা প্যাসেজ, বাঁক নিয়ে সেটা বাড়ির পিছন দিকে চলে গেছে। সুড়ুৎ করে গলিমুখের ভিতর ঢুকে পড়ল রানা। ভিজে বিড়াল হঠাৎ নেকড়ে হয়ে উঠল। বিশ গজ লম্বা প্যাসেজটা হন হন করে হেঁটে মেরে দিল রানা। বাঁক নিতেই পিছনে চলে এল। এদিকেও খুব নিচু পাঁচিল, পাঁচিলের ওপারে ফুলের বাগান।
পাঁচিলের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল রানা। সিগারেট ধরাচ্ছে। এই ফাঁকে দ্রুত দেখে নিল চারদিকটা। সরু গলিতে একা ও। উল্টো দিকের বাড়িগুলোর পিছনের বাগান, এবং বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও। বাগানে কেউ নেই। আর বাগানের ওপারে বাড়িটাকে আড়াল করে রেখেছে গাছপালা।
কেউ দেখছে না ওকে, তাই সিগারেট ধরাবার ঝুঁকিটা নিল না রানা। ঘুরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বসল বুক সমান উঁচু পাঁচিলের উপর, আরেক লাফ দিয়ে নামল বাগানের নরম মাটিতে।
ছায়ার মত নিঃশব্দে বাড়িটাকে কেন্দ্র করে ঘুরে এল একবার রানা। নিশ্চিত হলো, মানুষ বা একটা কুকুর বিড়ালও নেই। কিচেনের জানালার সামনে এসে থামল ও। শার্সি খুলতে দুই মিনিটের বেশি লাগল না।
বাড়িটা একতলা, তবে ছাদে ওঠার সিঁড়ি আছে। কিচেনের মেঝেতে নেমে প্রথমে জানালাটা বন্ধ করল রানা। মিটসেফ আর ফ্রিজ পরীক্ষা করল। একজন লোকের তিন দিনের জন্যে যথেষ্ট খাবার রয়েছে দেখে এতই খুশি হলো যে মনে মনে মস্ত এক স্যালুট ঠুকে দিল ভাগ্যকে। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে বিশেষ কোন অসুবিধে হলো না। দুটো শোবার ঘর, একটা বৈঠকখানা। টিভি এবং রেডিও দেখে সন্তুষ্ট বোধ করল ও।
দেরাজ হাতড়ে একটা পেন্সিল টর্চ পেয়ে গেল রানা। সেটা জ্বেলেই রাতের খাওয়াটা সেরে নিল। ড্রয়িংরূমে ফিরে এসে অন করল টিভি। নব ঘুরিয়ে স্তব্ধ করে দিল সাউন্ড। শুধু ছবি ফুটে উঠল টিভির পর্দায়। গানের অনুষ্ঠান চলছে। সেটটা অফ করে দিয়ে শোবার ঘরে ফিরে এল ও।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দাড়ি না কামিয়েই শাওয়ার সারল রানা। কিচেনে ঢুকে টুলের উপর বসল পা ঝুলিয়ে। দক্ষ, অভ্যস্ত বাবুর্চীর ভঙ্গি ফুটে উঠল তার ব্রেকফাস্ট তৈরির ব্যস্ততার মধ্যে। অবশ্য গরম বাটার অয়েলে হাত পুড়ে যেতেই ‘দুত্তোরি ছাই’ বলে তিরস্কারও করল নিজেকে। এসব মেয়েলি কাজ কি পুরুষকে সাজে? অমনি সোহানার অনিন্দ্যসুন্দর মুখটা ভেসে উঠল মানসপটে। হঠাৎ বাচ্চার কান্না শুনে রান্নাঘর থেকে পাখির মত উড়ে বেরিয়ে আসছে সোহানা শাড়ির আঁচলে ভিজে হাত মুছতে মুছতে, এই ছবিটা প্রায়ই মনের পর্দায় এঁকে নিয়ে বিভোর হয়ে দেখে ও। আর চিন্তা করে, এই ছবিটা সত্যিই কি কোনদিন তার জীবনে জলজ্যান্ত বাস্তব হয়ে উঠবে? বুকের ভিতর থেকে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর। ভাবল, রাতারাতি তার জীবনটা যদি নিষ্কণ্টক হয়ে উঠত, যদি হঠাৎ করে সমস্ত বিপদের ভয় দূর হয়ে যেত—কি ভালই না হত! কিন্তু তা কোনদিন হবার নয়। শুধু কি তাই? সেরকম নির্বিঘ্ন জীবন ও নিজেও কি চায়? না চায় না। রোমাঞ্চ, ভয়, বিপদ এবং সোহানা, এই চার প্রেয়সীর কাউকে কারও চেয়ে কম ভালবাসে না ও।: অথচ প্রথম তিন প্রেয়সীর সাথে শেষ প্রেয়সীর সহাবস্থান সম্ভব নয়। তাতে দুই পক্ষের সম্পর্ক দাঁড়ায় সতীনের মত।
এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। কত আর বয়ে যেতে দেয়া যায় সময়কে। সমস্যার ফয়সালা ভবিষ্যতের জন্যে তুলে রেখে ব্রেকফাস্ট সেরে বৈঠকখানায় ফিরে এল রানা। বুক কেস থেকে ক’টা বই নামাল। উল্টে পাল্টে বইগুলো দেখার ফাঁকে রিস্টওয়াচ দেখল দু’বার। বেলা এগারোটায় অন করল টেলিভিশন।
টিভির পর্দায় ঘোষকের ছবি ফুটে উঠল। নব ঘুরিয়ে সাউন্ড বাড়াল রানা। দু’চারটে শব্দ কানে ঢুকতেই ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা। ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। ব্যারনেস সিবা আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে খুন হয়েছেন, ঘোষক জানাচ্ছে, এখনও তাঁর হত্যাকারীকে ধরা সম্ভব হয়নি। তবে পুলিস সূত্রে জানানো হয়েছে আগামী বারো ঘণ্টার মধ্যে তাকে অবশ্যই গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
পরমুহূর্তে টিভির পর্দা জুড়ে অন্য এক লোকের মুখ ফুটে উঠল। সুদর্শন এক যুবকের চেহারা। মাথায় নারকেল ছোবড়ার মত ব্রাউন রঙের চুল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। নেপথ্য থেকে আসছে ঘোষকের কণ্ঠস্বর, ‘এখন যে লোকটার ফটো পর্দায় দেখতে পাচ্ছেন আপনারা এই-ই হলো ব্যারনেস সিবার হত্যাকারী। এর বর্তমান পরিচয়—মার্কিন ছাত্র, নাম স্মার্টি টোয়েন। আপনারা কেউ যদি এই লোককে কোথাও দেখেন, বা এর সম্পর্কে যদি কোন খবর জানা থাকে…’
সোফা থেকে উঠে কার্পেটের উপর পায়চারি করছে রানা। এই মুহূর্তে নিজের বিপদের কথা ভুলে গেছে ও। কিভাবে মারা গেছে সিবা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না ওর। এই নিষ্প্রয়োজন মৃত্যুর জন্যে সম্পূর্ণ নিজেকে দায়ী করছে ও। গভীর রাত পর্যন্ত হুইস্কি খেয়েছিল ওরা। এই অবস্থায় বৈশি ডোজের ঘুমের ওষুধ নিলে নিদারুণ প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। জানা ছিল রানার। কিন্তু কথাটা তখন মনে পড়েনি। মনে পড়লে সাথে সাথে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারত। সিবা হয়তো এভাবে মারা যেত না। ভাবতে গিয়ে বিস্মিত হচ্ছে রানা, শুধু ওর কাছে বিশ্বস্ত থাকার জন্যে এমন একটা কাণ্ড করে বসল মেয়েটা, পরিণামে চলেই গেল দুনিয়া থেকে। দুঃখ হচ্ছে রানার।
সোফায় ফিরে এসে বসল আবার রানা। টিভি অফ করে দিয়ে সিগারেট ধরাল। কোলের উপর তুলে নিল একটা বই।
দুটো দিন এই বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতে হবে ওকে।
.
দু’দিন ধরে গোটা প্যারিস তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হলো। সস্তা দরের হোটেল থেকে শুরু করে পাঁচ তারা মার্কা বিলাসবহুল প্রত্যেকটি হোটেল, বেশ্যাপাড়া, পেনসন এবং বোর্ডিং হাউজ, হোস্টেল, বার, রেস্তোরাঁ, নাইট ক্লাব, ক্যাবারে এবং কাফেতে হানা দিল সশস্ত্র পুলিস। প্রতিষ্ঠানের মালিক, ম্যানেজার, কর্মচারী এবং গেস্টদেরকে আলাদা আলাদা করে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে দেখানো হলো স্মার্টি টোয়েনের ফটো। জিজ্ঞেস করা হলো, এই লোককে বা এই লোকের সাথে চেহারার মিল আছে এমন কাউকে তারা দেখেছে কিনা অথবা এর সম্পর্কে কারও কাছে কিছু শুনেছে কিনা। একই জায়গায় কিছু সময়ের ব্যবধানে বারবার হানা দিল একের পর এক বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের লোকেরা। ফ্রেঞ্চ এসপিওনাজ বিদায় নিতেই ঢুকল অ্যাকশন সার্ভিসের বদমেজাজী সদস্যরা। বিস্ময় আর অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল গোটা প্যারিস। তিনশো ত্রিশজন লোককে পুলিসের ভ্যানে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে। কারণ হত্যাকারীর সাথে কিছুটা মিল রয়েছে তাদের চেহারার। পরে অবশ্য নিঃসন্দেহ হয়ে এদের সবাইকেই ছেড়ে দেয়া হয়।
প্যারিসের রাস্তায় বেরিয়েছে এমন সমস্ত ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার এবং বাসকে দু’এক মাইল পর পর একবার করে দাঁড় করানো হলো। গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল প্রতিটি প্যারিসবাসীর। পুলিস কাগজপত্র পরীক্ষা না করে ছাড়ল না কাউকে। প্যারিস থেকে বেরিয়ে যাবার প্রতিটি রাস্তায় রোড ব্লকের পিছনে সাব – – মেশিনগানধারী অ্যাকশন সার্ভিসের লোকেরা পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
ওদিকে ইউনিয়ন কর্সের দুই লক্ষের উপর সদস্য বিশেষ জরুরী নির্দেশ পেয়ে নেমে পড়েছে রাস্তায়। ট্রেনিংপ্রাপ্ত, শিকারী হাউন্ডের মত শহর চষে বেড়াচ্ছে তারা। সাদা পোশাকে ঘুর ঘুর করছে খারাপ পাড়ায়, যাচ্ছে পকেটমারদের গোপন আস্তানায়, বস্তি এলাকায়।
রাষ্ট্রের হোমরাচোমরা আমলা থেকে শুরু করে সিনিয়র জুনিয়র অফিসার, সাধারণ কর্মী, পুলিস এবং সিপাইরা হত্যাকারীর খোঁজে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যার যার দায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করে গেল। সিনেমা-থিয়েটারের কর্মচারী, পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে ডেকে চোখ কান খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হলো। ছাত্রদের কাফে, বার, টকিং ক্লাব, সোস্যাল গ্রুপ, পাড়া ভিত্তিক ক্লাব, শ্রমিক ইউনিয়ন প্রভৃতি জায়গায় সুদর্শন ইনফর্মার এবং সাদা পোশাক পরা গোয়েন্দা পুলিস পাঠানো হলো। বিদেশী ছাত্রদেরকে আশ্রয় দেয় এমন প্রতিটি পরিবারে হানা দিল পুলিস, পরিবারের সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হলো।
চব্বিশে অক্টোবর সন্ধ্যায় একটা ফোন পেল অ্যাকশন সার্ভিসের চীফ কর্নেল বোল্যান্ড। ইউনিয়ন কর্সের কাপু স্বয়ং উ সেন কথা বলবেন তার সাথে।
দুরু দুরু বুকে লাল রিসিভারটা কানে তুলল সে। ব্যর্থতার কি কৈফিয়ৎ দেবে সে?
কিন্তু কাপু তাকে রানা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করলেন না। কাপুর কণ্ঠস্বরে নিরুদ্বেগ উদারতা ফুটে উঠতে দেখে বিষম খাবার অবস্থা হলো তার
কেঁদে পায়ে পড়েছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরি, কাপু উ সেন বললেন, ‘রানাকে ধরার জন্যে আরেকটিবার সুযোগ ভিক্ষা চায় সে। এ ব্যাপারে তোমাদেরকে যদি সত্যি কোন সাহায্য করতে পারে, এ যাত্রা প্রাণ ভিক্ষা পাবে সে।’ কথা শেষ হতেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন উ সেন।
এক ঘণ্টা পর। ফ্রেঞ্চ প্রশাসনের কর্সিকান উপপ্রধানদের নিয়ে বৈঠকে বসেছে কর্নেল বোল্যান্ড। বৈঠকে নতুন একটা মুখ দেখা যাচ্ছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরির। অভ্যাস মত মস্ত ভুঁড়িতে হাত বুলাচ্ছে সে।
সভাপতির এখন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কর্নেল বোল্যান্ড। তার কণ্ঠস্বর কাঁপা কাঁপা শোনাচ্ছে। চেহারায় অস্থিরতা ফুটে উঠেছে। ‘সে নেই হয়ে গেছে। আমরা কোথাও তাকে খুঁজে পাচ্ছি না,’ শুরু করল সে। ‘স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে সে, কোনরকম চিহ্ন না রেখে বেমালুম উবে গেছে মাটির বুক থেকে। একই কথা কয়েকবার বলা হয়ে গেল এর মধ্যে বন করল সে, কিন্তু সেজন্যে সঙ্কোচ বোধ করল না। ‘গোটা ফ্রেঞ্চ প্রশাসন এখনও মরিয়া হয়ে খুঁজছে তাকে, তাদের সাথে রয়েছে আমাদের দুই লক্ষের ওপর ইউনিয়ন কর্সের লোক—অথচ এখন পর্যন্ত তার ছায়া পর্যন্ত দেখা যায়নি। কোথায় সে? প্যারিসে আছে? আমার তা মনে হয় না। প্যারিসে যদি থাকত…’
‘এখানেই কোথাও আছে সে,’ ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরি, বলল, ‘কিন্তু এ ব্যাপারে তর্কে না গিয়ে আমি জানতে চাই কাপুকে রক্ষা করার জন্যে আগামীকাল কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে?’
‘আগামীকাল?’ একটু বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে বলল কর্নেল বোল্যান্ড, ‘বিশেষ করে আগামীকালকের কথা জানতে চাওয়ার কারণ কি তোমার?’
‘আগামীকাল কাপুর অভিষেক অনুষ্ঠান, কথাটা আপনারা সবাই ভুলে গেছেন নাকি?’ বলল লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরি। বছরের এই একটি দিন জনসমক্ষে বেরুতেই হবে কাপুকে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বশরীরে তাঁকে হাজিরা দিতেই হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রথম থেকেই এই বিশেষ দিনটিকে বেছে রেখেছে মাসুদ রানা আঘাত হানার জন্যে।
সবাইকে হতভম্ব করে দিয়েছে জাঁ থেরি। তাইতো! ভাবছে সবাই।
‘এই একটি দিন যদি রানার আঘাত থেকে কাপুকে আমরা রক্ষা করতে পারি, তিন বছরের জন্যে তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদেরকে আর মাথা ঘামাতে হবে না। পরশুদিন থেকে আগামী তিন বছরের জন্যে যে-কোন আততায়ীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন কাপু। এবং এই তিনটি বছর হাতে পাব আমরা মাসুদ রানাকে খুঁজে বের করে ধরার জন্যে।’
‘মাই গড!’ প্রায় চিৎকার করে উঠল কর্নেল বোল্যান্ড। ‘তোমার কথার প্রতিটি অক্ষর বাস্তব সত্য বলে মনে হচ্ছে, থেরি। ইশ্, পানির মত সহজ অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা আমাদের কারও মাথায় আসেনি!’
‘কর্নেল বোল্যান্ড;’ গম্ভীর হয়ে বলল জাঁ থেরি, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও আমি পাইনি।
‘আজ আর নতুন করে প্রসঙ্গটা আমি তুলিনি;’ ম্লান মুখে বলল, কর্নেল বোল্যান্ড। ‘কিন্তু গতকাল কাপুর সাথে আলোচনার সময় পরিষ্কার বুঝেছি, অভিষেকের দিন অর্থাৎ আগামীকাল রীতি অনুযায়ী প্রতিটি অনুষ্ঠানে যাবেন তিনি—এ ব্যাপারে কারও কোন কথা শুনবেন না। তাঁর প্রোগ্রামের চূড়ান্ত সূচী পেয়েছি আমি, ‘ কোটের পকেট থেকে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ বের করল সে। ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করল, ‘অভিষেক অনুষ্ঠান শেষ করেই সকালবেলা আর্ক ডি ট্রায়াম্পের নিচে চিরঞ্জীব অগ্নিশিখার সামনে দুই মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। বেলা এগারোটায় নটরডেম ক্যাথেড্রেলে প্রার্থনায় বসবেন। সাড়ে বারোটায় মন্তভ্যালেরিনের গণ কবরে যাবেন। এখান থেকে সুরক্ষিত দুর্গে ফিরবেন লাঞ্চের জন্যে। বিকেলে মাত্র একটা অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে ইউনিয়ন কর্মের বীর এবং কীর্তিমান সদস্যদেরকে পদক এবং উপহার দান করবেন তিনি।
‘বিকেল চারটের সময় বরাবরের মত গার মন্তপারনাসের সামনে চৌরাস্তায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। গত কয়েকশো বছর ধরে এই অনুষ্ঠানের জন্যে এটাই নির্দিষ্ট জায়গা ছিল, কিন্তু আগামী বছর এই অনুষ্ঠান এখানে আর হবে না। তার কারণ আপনারা সবাই জানেন। পুরানো রেলওয়ে স্টেশনকে পাঁচশো মিটার পিছিয়ে নিয়ে আসার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
‘ভিড় সামলাবার ব্যাপারে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?’ জানতে চাইল জাঁ থেরি।
সব কিছু মুখস্থ করা আছে কর্নেল বোল্যান্ডের। গড় গড় করে বলে যাচ্ছে সে, ‘প্রতিটি অনুষ্ঠানের কেন্দ্র থেকে দুশো গজের মধ্যে ইউনিয়ন কর্সের বিশেষ পরিচয় পত্রধারী লোকজন ছাড়া বাইরের কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না। ইস্পাতের তৈরি ব্যারিয়ারের সাহায্যে প্রতিটি জায়গা অনুষ্ঠান শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ঘিরে ফেলা হবে, তারপর ব্যারিয়ারের ভিতর ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত প্রতিটি ইঞ্চি তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হবে। নালা, আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন, প্রতিটি ফ্ল্যাট, চিলেকোঠা, ছাদ—সার্চ করতে কিছুই বাকি রাখা হবে না। দায়িত্বটা একাধিক দলকে দেয়া হয়েছে, যাতে প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা কয়েকবার করে সার্চ করা হয়। প্রতিটি অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে এবং চলাকালে সাব-মেশিনগান এবং রাইফেলধারী কর্সিকানরা কাছেপিঠের ছাদ থেকে উল্টোদিকের ছাদ এবং জানালাগুলোর দিকে নজর রাখবে। অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহণ করছে তারা এবং উচ্চপদস্থ কর্সিকানরা ছাড়া ব্যারিয়ার টপকে ভিতরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না।
‘এবার আমরা কোনরকম ঝুঁকি নিচ্ছি না। কাপু উ সেনের সাথে যারা থাকবেন, যারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন, অর্থাৎ প্রায় প্রত্যেককে সার্চ করার ঢালাও নির্দেশ দিয়েছি আমি। কাল সকালে চল্লিশ হাজার বিশ্বস্ত কর্সিকানকে স্পেশাল আইডেনটিটি কার্ড সরবরাহ করা হবে। সে-কার্ডটা দেখতে কেমন তা এইমুহূর্তে কারও জানা নেই। মাসুদ রানা যাতে একজন কর্সিকান প্রহরীর ছদ্মবেশ নিয়ে ব্যারিয়ার টপকাতে না পারে সেজন্যে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই কার্ড হাই অফিশিয়াল এবং যারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে তাদেরকেও দেয়া হবে।
‘অত্যন্ত গোপনে কাপু উ সেনের রোলস রয়েসে বুলেট প্রুফ কাঁচ ফিট করার কাজটা শেষ করেছি আমরা। দোহাই আপনাদের, একথা যেন কাপুর কানে না যায়। তাহলে রক্ষা থাকবে না কারও। কাপুর গাড়ি চালাবে মেরেক্স। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে অন্যান্য দিনের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে যেন গাড়ি চালায় সে। গাড়ি থেকে কাপু নামার আগেই অস্বাভাবিক লম্বা কিছু কর্সিকান গাড়িটাকে ঘিরে ফেলবে। কাপু যখন যেখানেই থাকুন না কেন, তালগাছের মত উঁচু কিছু লোক সবসময় তাঁকে ঘিরে রাখবে।
‘এছাড়া, কার্পূর দুশো মিটারের মধ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা কেউ করলেই তাকে সাথে সাথে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হবে, এবং কোন প্রশ্ন না করে চ্যাংদোলা করে তুলে অপেক্ষমাণ গাড়িতে তোলা হবে। যতবড় লাটসাহেবই হোক, নির্দেশ লঙ্ঘন করলে ঠিক এই ব্যবহার করা হবে তার সাথে। সাংবাদিকদের কাল সকালে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হবে অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, অনুষ্ঠানের পাঁচশো গজের মধ্যে কারও হাতে কোন প্যাকেট বা লম্বা আকারের কোন জিনিস থাকলে দেখামাত্র তাকে কর্সিকানরা ঘিরে ফেলবে এবং নিকটবর্তী গাড়িতে তুলে নেবে। সংক্ষেপে মোটামুটি এইরকম ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তোমার বিশেষ কোন সাজেশন আছে, থেরি?’
‘খুন হবার ঝুঁকি নেবে রানা,’ চিন্তিতভাবে বলল জাঁ থেরি, ‘এ আমি বিশ্বাস করি না। আঘাত হেনে’ নিরাপদে ফিরে যেতে চায় সে। সেজন্যে অনেক আগে থাকতেই নিজের প্ল্যান সাজিয়ে নিয়েছে। তার সেপ্টেম্বরের শেষ আট দিনের প্যারিস ভ্রমণের কথা বলছি আমি। তার মনে যদি কোন সন্দেহ থাকত অভিযানের সাফল্য সম্পর্কে বা কাজ সেরে নিরাপদে কেটে পড়ার ব্যাপারে, আগেই পিছু হটত সে।
থামল জাঁ থেরি। সবাই অপেক্ষা করছে তার মুখ থেকে আরও কিছু শোনার আশায়।
‘সুতরাং কোন একটা উপায়ের কথা জানা আছে তার,’ খেই ধরে আবার শুরু করল জাঁ থেরি। ‘তিন বছরের মধ্যে অন্তত একটা দিন, অভিষেকের দিন, কাপুকে বাইরে বেরুতেই হবে, একথা জানা আছে তার। তাই এই দিনটাকেই বেছে নিয়েছে। কিন্তু এখন সে জানে তার পরিচয় এবং উদ্দেশ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। জানে গোটা ফ্রেঞ্চ প্রশাসন এবং ইউনিয়ন কর্স তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ঠেকাবার চেষ্টা করছে। অথচ, তবু সে পিছু হটেনি।’
অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করল জাঁ থেরি।
‘পিছু হটেনি। হটবেও না। কেন? আত্মহত্যার শখ গজিয়েছে? পিছু হটছে না, তার কারণ তার ধারণা কাজটায় সে সফল হবেই, কাজটা শেষ করে নিরাপদে সরে যেতে পারবেই। অর্থাৎ এমন একটা বুদ্ধি করেছে সে যা আমাদের মাথায় আসছে না। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বোমা ফাটাবে? নাকি দূর থেকে রাইফেল ছুঁড়বে? বোমার অস্তিত্ব গোপন রাখা সম্ভব নয়। বোমা নিয়ে অনুষ্ঠানের কাছেপিঠে ঘেঁষার আগেই ধরা পড়ে যাবে সে। তারমানে রাইফেল না হয়েই যায় না। সেজন্যেই ফ্রান্সে ঢোকার জন্যে গাড়ি ব্যবহার করার দরকার হয়েছিল তার। রাইফেলটা গাড়িতেই ছিল, সম্ভবত চেসিসের সাথে বা প্যানেলিংয়ের ভিতরে কোথাও ওয়েল্ড করে আটকে নিয়েছিল।’
‘কিন্তু কাপুর কাছাকাছি রাইফেল নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’ নিজের অজান্তে চিৎকার বেরিয়ে এল কর্নেল বোল্যান্ডের গলা থেকে। ‘অল্প কয়েকজন ছাড়া কাপুর কাছে যেতেই পারছে না কেউ-এবং এদেরকেও একাধিকবার সার্চ করার ব্যবস্থা হয়েছে। ক্রাউড ব্যারিয়ারের ভিতর রাইফেল নিয়ে ঢুকবে কিভাবে সে?
পায়চারি থামিয়ে কর্নেল বোল্যান্ডের দিকে তাকাল জাঁ থেরি। বলল, ‘কিভাবে ঢুকবে তা আমি জানি না। কিন্তু সে মনে করে ঢুকতে পারবে। এবং আপনাদের সবাইকে আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এ পর্যন্ত যা সে ভেবেছে তাই করেছে—করতে পেরেছে। এখন পর্যন্ত কোথাও হার হয়নি তার, সর্বত্র সে আমাদেরকে টেক্কা মেরে উতরে গেছে। এটা কম কথা নয়। পৃথিবীর অন্যতম দুই বৃহৎ শক্তির প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাদের সমস্ত আয়োজন ব্যর্থ করে দিয়ে এই প্যারিসে পৌঁচেছে সে। রাইফেল নিয়ে লুকিয়ে আছে সে, হয়তো আরেক নতুন চেহারা, নতুন এক প্রস্থ পরিচয়পত্র নিয়ে। একটা ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, কর্নেল। যেখানেই ঘাপটি মেরে থাকুক, গর্ত থেকে আগামীকাল বেরুবেই সে। এবং বেরুলে তাকে আমাদের ধরতেই হবে। প্রথম সুযোগেই।
‘না, কর্নেল, দেবার মত নতুন কোন সাজেশন নেই আমার। আগামীকালের আয়োজন ফুলপ্রুফ, না মেনে উপায় দেখছি না। এই ব্যাপক এবং নিশ্চিত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস আমার মত দুঃসাহসী এক হাজার জাঁ থেরিরও হবে না। অথচ একা রানা ঠিক তাই করেছে। ভাবতে গেলে লোকটাকে উন্মাদ মনে হয়। কিন্তু উন্মাদ যে সে নয়, তাও ইতিমধ্যে একের পর এক পাহাড় সমান বাধা টপকে প্রমাণ করে দিয়েছে। একমাত্র ওপরওয়ালা জানেন কি সে… মানুষ নাকি অলৌকিক শক্তি…’
তাকে ধরার ব্যাপারে তুমি নিজে কি করতে যাচ্ছ, থেরি?’ জানতে চাইল কর্নেল বোল্যান্ড।
‘প্রতিটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকব আমি,’ জানাল জাঁ থেরি। ‘এখানে সেখানে ঘুর ঘুর করব। নির্দিষ্ট কিছু ভাবিনি। তবে, চোখ-কান খোলা রেখে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া করার কিছু বাকিও নেই, তাই নয় কি?’
এর দুই ঘণ্টা পর সভা মুলত্রী ঘোষণা করা হলো।
.
শুতে যাবার আগে আগামীকালকের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে রানা। বিছানার উপর পড়ে রয়েছে একজোড়া কালো জুতো, গ্রে রঙের উলেনের মোজা, ট্রাউজার, গলা খোলা শার্ট, লম্বা গ্রেটকোট, তার সাথে একসার ক্যাম্পেন রিবন, এবং প্রাক্তন ঝানু ফ্রেঞ্চ যোদ্ধা মার্ক রোডিনের কালো বেরেট। এগুলোর উপর ছুঁড়ে রাখল সে ব্রাসেলসে জাল করা কাগজপত্র। হারনেস এবং পাঁচটা ইস্পাতের টিউব, যেগুলো দেখতে অ্যালুমিনিয়ামের মত, বিছানার এক পাশে রাখল ও। পাঁচটা টিউবে রয়েছে ওর রাইফেলের স্টক, ব্রীচ, ব্যারেল, সাইলেন্সার এবং টেলিস্কোপিক সাইট। এগুলোর পাশে পড়ে আছে কালো রাবারের মাথা-মোটা একটা টুকরো, কাঠের বা ধাতুর তৈরি পায়ার গোড়া মুড়তে ব্যবহার করা হয়। এর ভিতর রয়েছে পাঁচটা এক্সপ্লোসিভ বুলেট।
রাবারের ভিতর থেকে দুটো বুলেট বের করে নিল রানা। খুঁজে পেতে কিচেন থেকে একটা প্লায়ার্স আগেই যোগাড় করে রেখেছে। সেটা দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বুলেট দুটোর নাক ভাঙল। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল দুটো চিকণ করডাইটের পেন্সিল। পেন্সিল দুটো রেখে অকেজো কার্টিজ দুটো ফেলে দিল অ্যাশ-ক্যানে। হাতে থাকল এখন মোট তিনটে বুলেট। ওর কাজের জন্যে তিনটেই যথেষ্ট বলে মনে করছে ও।
দু’দিন দাড়ি কামায়নি রানা, ফলে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে গাল ভরে উঠেছে। এবার প্যারিসে পৌঁছেই যে ধারাল ক্ষুরটা কিনেছে সেটা দিয়ে অযত্নের সাথে পরিষ্কার করে ফেলল মুখটা। বাথরূমের শেলফে আফটার-শেফ লোশনের ফ্লাস্কটা রয়েছে, তবে ওতে লোশন নেই, রয়েছে গ্রে হেয়ারটিন্ট যা ধর্মযাজক বেনসনের চুল রাঙাবার জন্যে একবার ব্যবহার করেছে ও। এর পাশেই রয়েছে সলভেন্ট স্পিরিট। চুল ধুয়ে নারকেল ছোবড়ার রঙটা আগেই উঠিয়ে ফেলেছে রানা। এবার আয়নার সামনে বসে একটু একটু করে ছেঁটে নিজের চুলের দৈর্ঘ্য কমিয়ে ফেলছে।
সবশেষে প্রস্তুতিটা সম্পূর্ণ হয়েছে কিনা চেক করে নিল রানা। সকালের জন্যে কোন কাজ বাকি পড়ে নেই দেখে সন্তুষ্ট হলো। একটা ওমলেট তৈরি করে বৈঠকখানায় ফিরে এসে টিভি খুলে বসল ও। বিছানায় যাবার আগে পর্যন্ত উপভোগ্য একটা ভ্যারাইটি শো দেখে সময়টা কাটাল।
.
পঁচিশে অক্টোবর। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। পরিষ্কার নীল আকাশ। প্রতিটি অনুষ্ঠানে অস্বাভাবিক দীর্ঘদেহী একদল লোক ঘিরে রেখেছে ইউনিয়ন কর্সের হেড কাপু উ সেনকে। অভিষেক অনুষ্ঠান শেষ করে সুরক্ষিত দুর্গ প্রাসাদ থেকে অবশ্য পালনীয় আরও কয়েকটা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে বেরিয়েছে সে।
প্রথম অনুষ্ঠান আর্ক ডি ট্রায়াম্পে।
অসংখ্য দেহরক্ষীদের নিয়ে এক ঝাঁক গাড়ির মাঝখানে রয়েছে ঝকঝকে একটা রোলস রয়েস। রোলস রয়েস থামতেই চারদিকের হুডখোলা গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝপাঝপ সাব-মেশিনগানধারী দেহরক্ষীরা নেমে পড়ল নিচে। অস্বাভাবিক লম্বা আকৃতির লোকগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল রোলস রয়েসকে। গাড়িটাকে ঘিরে সশস্ত্র প্রহরীদের আরও একটা দেয়াল তৈরি হয়ে গেল দশ গজ দূরে। গায়ে গা ঠেকিয়ে, রোলস রয়েসের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীরা। প্রত্যেকের হাতে সাব-মেশিনগান। বিপদের চিহ্ন দেখামাত্র ট্রিগার টেনে ধরার জন্যে সদা প্রস্তুত সবাই।
রোলস রয়েসের দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়াল কর্নেল বোল্যান্ড। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে ইউনিয়ন কর্সের হাই অফিশিয়ালরা। গাড়ি থেকে নামল কাপু। ঝাড়া সাড়ে ছয় ফিট লম্বা। সরু কোমর। চোখে অত্যন্ত গাঢ় সবুজ রঙের চশমা। মুখের চেহারায় হিমালয়ের গাম্ভীর্য ফুটে আছে। উদ্ধত ভঙ্গিতে একবার এদিক, একবার ওদিক তাকাল। মাথার পিছন দিকে চামড়ার নিচে স্টীল প্লেট থাকায় ঘাড় ফেরাতে পারে না সে, ফলে পর পর দু’বার, একবার এদিক একবার ওদিক ঘুরে গেল পুরো শরীর। সাবলীল ভঙ্গিতে এগিয়ে এল অপেক্ষমাণ হাই অফিশিয়ালদের সারির দিকে।
এরা সবাই ইউনিয়ন কর্সের এক একটা স্তম্ভ। কাপুর দিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছে প্রত্যেকে। সবাই জানে, কাপু অন্ধ, কিছুই দেখতে পান না তিনি। কিন্তু দেখতে না পেলেও, কিছুই তাঁর অগোচরে থাকে না। তিনি সাউন্ড ট্র্যান্সমিটার যন্ত্রের সাহায্যে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা ভাবে চিনে ফেলেন। রাতের অন্ধকারেও তাঁকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়।
দুই আড়ষ্ট কাঁধ আর খাড়া পিঠ নিয়ে যান্ত্রিক মানুষের শু এগিয়ে এসে সারির প্রথম লোকটার সামনে দাঁড়াল উ সেন। কাঁপা হাতজোড়া দিয়ে কাপুর বাঁ হাতটা ধরল লোকটা, মুখের সামনে তুলে নিয়ে এসে কাঁপা ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমো খেল আলতোভাবে। ক্ষীণ একটু হাসি ফুটে উঠল কাপু উ সেনের ঠোঁটে। ‘এত মুটিয়ে গেলে কাজ করবে কিভাবে, রেমন্ড?’
প্রত্যেকের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিল কাপু। সূক্ষ্মতম পরিবর্তনও তার অগোচরে থাকে না। প্রত্যেককে কিছু না কিছু বলল সে, এবং চমকে দিল।
শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে উপায় থাকল না কারও। প্রত্যেকের আত্মবিশ্বাস আরও দৃঢ় হলো—আমাদের কাপু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। তার আড়ষ্ট দুই কাঁধ, খাড়া পিঠ এবং হাঁটার ভঙ্গিতে প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে কি এক অদ্ভুত রহস্য—আতঙ্কে শিরশির করে শরীর। কণ্ঠস্বর অনুচ্চ, কিন্তু গুড় গুড় মেঘের ডাকের মত ভরাট, গুরুগম্ভীর। উপরে থেকে গলা বাঁকা করে নিচের দিকে তাকাচ্ছে সে। সবার চেয়ে লম্বা দেখাচ্ছে তাকে। সবার মাথার উপরে তার মাথা।
চারদিকের সব ক’টা উঁচু ছাদে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে ইউনিয়ন কর্সের প্রহরীরা। তাদের প্রত্যেকের চোখে বিনকিউলার, সামনে রাইফেল। সকলের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে এলাকা, যার যার এলাকার উপর চোখ রেখেছে সবাই। চোখের দৃষ্টি পৌছায় এমন প্রতিটি ইঞ্চির উপর নজর রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। এক সময় শেষ হলো কাপু উ সেনের অনুষ্ঠান। তার রোলস রয়েসকে ঘেরাও করে নিয়ে গেল দেহরক্ষীদের হুড তোলা গাড়িগুলো। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল।
একই দৃশ্যের অবতারণা হলো ক্যাথেড্রেলে। আগে থেকেই প্রহরীরা যার যার জায়গা নিয়ে ফেলেছে। কারও চোখে পলক নেই ওদের।
ক্রাউড ব্যারিয়ারের বাইরে, ক্যাথেড্রেলের দরজা থেকে দুশো গজ তফাতে কয়েক সহস্র দর্শকের ভিড় দেখা যাচ্ছ। এদের মধ্যে থেকে এগারো জনের ঘাড় ধরে তোলা হলো অপেক্ষমাণ গাড়িতে। এগারো জনের একজন বগলের তলায় হাত ঢোকাতে যাচ্ছিল চুলকাবে বলে, বাকি দশজন পকেটে হাত ঢোকাতে যাচ্ছিল সিগারেট বের করার জন্যে। কেউই পকেটে হাত ঢুকিয়ে তা বের করার সময় পায়নি। আশেপাশেই ছিল ইউনিয়ন কর্সের লোকেরা।
এখানেও কোন ঘটনা ঘটল না। না শোনা গেল একটা রাইফেলের আওয়াজ, না ঘটল কোন বোমার বিস্ফোরণ। কর্সিকানরাও একজন আরেকজনকে তীব্র দৃষ্টিতে পরখ করে নিতে ছাড়ছে না। প্রত্যেকের কাঁধে নতুন ব্যাজ শোভা পাচ্ছে। এই ব্যাজ দেখেই বুঝে নিচ্ছে সবাই এরা তাদের নিজেদের লোক, মহান কাপু সেনের একনিষ্ঠ ভক্ত। তা সত্ত্বেও সন্দেহ হলেই একজন আরেকজনের পরিচয় পত্র দেখতে চাইছে—যেটা মাত্র আজ সকালে ইস্যু করা হয়েছে প্ৰত্যেককে।
ইউনিয়ন কর্সের একজন হাই অফিশিয়াল, দ্বিতীয় সারির নেতাকে গ্রেফতার করা হলো, চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো একটা ভ্যানে। তার অপরাধ, আজ সকালে ইস্যু করা নতুন পরিচয়পত্রটা প্রহরীকে দেখাতে পারেনি সে, কোথায় নাকি হারিয়ে ফেলেছে।
মন্তভ্যালেরিনের পরিবেশটা হয়ে উঠল বিদ্যুতের মত স্পর্শকাতর। তার কারণ, এখানে সবচেয়ে কঠোরতম প্রহরার ব্যবস্থা করেছে কর্নেল বোল্যান্ড। কাপু উ সেন ব্যাপারটা যদি টেরও পেয়ে থাকে, মুখ দেখে তার কিছুই বোঝা গেল না। সিকিউরিটি চীফেরা এক ফাঁকে কর্নেল বোল্যান্ডকে জানাল ব্যারিয়ারের ভিতর কাপু উ সেন যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ মানুষ তো দূরের কথা, প্রাকৃতিক কোন অঘটনও তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ছাদের উপর যারা রয়েছে তারা পিঠ দিয়ে ঠেকাবে ঝড় তুফান, রাইফেলের বুলেট ছুঁড়ে দিভ্রান্ত করবে বজ্রকে।
কর্নেল বোল্যান্ড তাদেরকে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘গুড। কিন্তু আমরা সবাই ধরে নেব এইখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে মাসুদ রানা। সুতরাং চোখকান খোলা রাখব।
কিন্তু রানা তখন অন্যখানে।
.
খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে পেরি তেসিয়ারের। তার উপর রোদ মাথায় নিয়ে ঝাড়া দু’ঘণ্টা ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে পা দুটোয় ব্যথা ধরে গেছে তার। জিনসের শার্ট ঘামে ভিজে চট চট করছে পিঠে লেগে। সাবমেশিন কারবাইনের স্ট্র্যাপটা কাঁধের মাংসে গেঁথে বসেছে। পিপাসায় ছাতি ফেটে যাবার দশা হয়েছে, অথচ এক ঢোক পানি খেতে যাবার উপায় নেই। কাপু উ সেন আসবেন, কিন্তু কখন আসবেন কেউ বলতে পারে না। আজ সকালে সহকর্মীরা বলাবলি করছিল, যে-কোন মুহূর্তে কাপুর প্রোগ্রামে অদল বদল ঘটানো হতে পারে।
ইস্পাতের তৈরি ক্রাউড ব্যারিয়ারটাকে পাহারা দেবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাকে, সঠিক ব্যাজ এবং সঠিক পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকে এপারে ঢুকতে দেয়া চলবে না। তা যতই তার খিদে পেয়ে থাকুক আর মেজাজ বিগড়ে থাকুক, ভাবছে সে, তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে এপারে কেউ ঢুকতে পারবে বলে মনে করলে মস্ত ভুল করবে সে। সে চেষ্টা কেউ একবার করেই দেখুক, নির্ঘাত বুটের লাথি মেরে পাঁজর গুঁড়িয়ে দেবে তার। বেশি চালিয়াতি করলে দেবে ফুটো করে মাথার খুলি …
ঘুরে দাঁড়িয়ে রু দে রেনেসের দিকে তাকাল পেরি। দুটো বিল্ডিংয়ের মাঝখানের রাস্তায় ইস্পাতের লম্বা চেন ঝুলিয়ে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। প্লেস দু এইটিন জুন-এর কাছ থেকে দূরত্ব প্রায় আড়াইশো মিটার। চৌরাস্তা থেকে আরও একশো মিটার পিছনে রেলওয়ে স্টেশনের সামনের দিকটা। ওটার মস্ত চাতালের সামনেই অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেদিকে তাকিয়ে কিছু লোকের নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে সে। কীর্তিমান কর্সিকানরা পদক নেবার জন্যে কোথায় দাঁড়াবে, কাপুকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে হাই অফিশিয়ালরা কোথায় অপেক্ষা করবে ইত্যাদি নির্ধারণ করছে চিহ্ন দিয়ে। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনও তিনঘণ্টা বাকি, যদি প্রোগ্রাম বদল করা না হয়। ইস্, তার মানে সারাটা দিন আজ না খেয়েই কাটাতে হবে তাকে!
ব্যারিয়ারের ওপারে দু’ একজন করে লোক এসে দাঁড়াচ্ছে। ছোট খাটো একটা ভিড় জমে উঠতে দেরি হলো না। কোন কোন মানুষের ধৈর্যের সীমা নেই, ভাবছে পেরি। তিনশো মিটার দূর থেকে ইউনিয়ন কর্সের কাপুকে দেখার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে কি যে মজা পায় এরা! বোকার দল, সন্দেহ নেই। দাঁড়িয়ে থাকাই সার, এদের একজনও দেখতে পাবে না কাপুকে। দেহরক্ষীরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে আড়াল করে রাখবে।
ভিড়টা আরও একটু বাড়ল। ঠিক এই সময় বুড়ো লোকটার উপর চোখ পড়ল পেরির। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া, হাঁপাচ্ছে। খানিকটা হেঁটে দম নেবার জন্যে থামছে। এদিক ওদিক পিট পিট করে তাকাচ্ছে, যেন পথ ভুল করল কিনা
বুঝে নিতে চেষ্টা করছে। একই দিকে বারবার মুখ উঁচু-নিচু করে তাকাবার ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারল পেরি, চোখেও কম দেখে বুড়ো। ওই, আবার দাঁড়িয়ে পড়েছে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে না যায়, ভয় হলো পেরির।
ব্যারিয়ারের কাছে চলে এসেছে বুড়ো। ঘামের দাগ লেগে বিচ্ছিরী চেহারা হয়েছে কালো বেরেটটার। লম্বা গ্রেটকোটটা হাঁটুর নিচে ঝুলছে। বুকের কাছে একগাদা মেডেল এদিক ওদিক দুলছে, টুংটাং শব্দ করছে পরস্পরের গায়ে বাড়ি খেয়ে। ব্যারিয়ারের ওপারে দাঁড়ানো কয়েকজন লোক সহানুভূতি ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুড়োর দিকে।
ব্যারিয়ারের কাছে এসে ইতস্তত করছে বুড়ো। পেরির মনে হলো, বুড়ো যেন জায়গাটা ঠিক চিনতে পারছে না। হ্যাঁ, ঠিক তাই, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। চলে যাচ্ছে।
চোখ ফিরিয়ে নিতে যাবে পেরি, এমন সময় দেখল আবার এদিকে ফিরছে বুড়ো। এগিয়ে আসছে আবার। খুব কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে। তা তো হবেই, ভাবছে পেরি, এক পায়ে হাঁটা কি চাট্টিখানি কথা? আহা, বেচারা! যুবক বয়সে এই লোকই দু’পায়ে কেমন ছুটোছুটি করেছে, বীরের মত লড়াই করেছে, অথচ আজ হয়তো যুদ্ধেই বেচারা হারিয়েছে পা’টা।
ইস্পাতের চেনটা টপকে ব্যারিয়ারের ভিতর ঢুকছে বুড়ো। গটমট করে তার দিকে এগোল পেরি। ‘কি হচ্ছে?’ চেহারায় রাগ রাগ ভাব, কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য এনে জানতে চাইল সে।
‘কে, বাবা?’ বারকয়েক মুখ উঁচু-নিচু করে ভাল করে দেখতে চেষ্টা করল বুড়ো পেরিকে। অ্যালুমিনিয়ামের ক্রাচের উপর ভর দিয়ে ঘনঘন হাঁপাচ্ছে এখনও। একটু চিন্তিত ভাবে আবার বলল, ‘পথই ভুল করলাম, না কি…’ সামনের বাড়িগুলোর দিকে আঙুল তুলল সে, ওই ওদিকটায় যেতে চাই আমি…’
‘দেখাও, বাবা, তোমার কাগজপত্র বের করো।’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল পেরি। কাঁপা কাঁপা একটা হাত শার্টের পকেটে ঢোকাল বুড়ো। নাক কুঁচকে উঠল পেরির। শার্টটা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। পকেট থেকে দুটো কার্ড বের করল বুড়ো। হাতে নিয়ে সেগুলো দেখছে পেরি। প্রথম কার্ডে বুড়োর পেশাগত পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। কর্মজীবী একজন মানুষ। অর্থাৎ, শ্রমিক। দ্বিতীয় কার্ডে তার পরিচয় ছাপা রয়েছে মার্ক রোডিন, ফ্রেঞ্চ সিটিজেন, বয়স তিপ্পান্ন, জন্ম কোলমারে, বাস করে প্যারিসে। কার্ডের নিচের দিকে একটা ঝাপসা হয়ে যাওয়া সীল, সেটা দেখেই টনক নড়ে গেল পেরির। কাপু উ সেনের সীল, সাথে তাঁর সইও রয়েছে। বিস্ময় এবং শ্রদ্ধা ফুটে উঠল তার চেহারায়।
দুটো কার্ডে ফটো পরীক্ষা করল পেরি। একই লোকের ছবি, কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তোলা। মুখ তুলে তাকাল সে।
‘বেরেট খোলো।’
বেরেট খুলে হাত দিয়ে দুমড়ে ধরে রাখল সেটাকে বুড়ো। ফটো দুটোর সাথে লোকটার চেহারা মিলিয়ে দেখে নিচ্ছে পেরি। কোন অমিল নেই। তার সামনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে অবশ্য অসুস্থ দেখাচ্ছে। দাড়ি কামাতে গিয়ে এখানে সেখানে কয়েক জায়গায় চামড়া কেটে ফেলেছে, খুদে টয়লেট পেপার সেঁটে রেখেছে জায়গাগুলোয়। সাদা টয়লেট পেপারে ক্ষীণ রক্তের দাগও দেখা যাচ্ছে। মুখের রঙ গ্রে, এবং ঘামে পিচ্ছিল হয়ে আছে। কপালের উপর চারদিকে শুঁড় বিস্তার করে রেখেছে চুলগুলো, দ্রুত বেরেটটা নামাবার সময় সৃষ্টি হয়েছে এই বিশৃঙ্খলা।
‘ওদিকে কেন যেতে চাইছ তুমি?’
‘ওখানে আমি থাকি,’ বলল বুড়ো। ‘একটা চিলেকোঠায়।’
ছোঁ মেরে কার্ড দুটো কেড়ে নিল বুড়োর হাত থেকে পেরি। দেখল আইডেনটিটি কার্ডে বুড়োর ঠিকানা লেখা রয়েছে একশো চুয়ান্ন রু দে রেনেস, প্যারিস। মুখ তুলে মাথার উপরের বাড়িটার দিকে তাকাল পেরি। দরজায় নম্বর লেখা রয়েছে একশো বত্রিশ। বাজে কথা বলেনি বুড়ো, একশো চুয়ান্ন নম্বর বাড়ি নিশ্চয়ই রাস্তার আরও ওদিকে হবে। যেতে দেয়া যায়। বুড়ো একজন লোককে তার বাড়িতে ফিরতে না দেয়ার কোন কারণ নেই। সে-রকম কোন হুকুম দেয়া হয়নি তাকে।
‘ঠিক আছে, তুমি বুড়ো মানুষ, তাছাড়া এদিকেই যখন থাকো, ঢুকতে বাধা দিচ্ছি না। কিন্তু কোনরকম গোলমাল কোরো না যেন। দু’এক ঘণ্টার মধ্যেই আসছেন কাপু।’
মুখ টিপে একটু হাসল বুড়ো। কার্ড দুটো শার্টের পকেটে রাখতে গিয়ে নড়ে গেল ক্রাচটা, পড়ে যাবার উপক্রম করল। ঝট্ করে তাকে পেরি ধরে ফেলল বলে, তা নাহলে নির্ঘাত একটা আছাড় খেত।
‘জানি,’ বলল বুড়ো। ‘আমার এক বন্ধু মহান কাপুর কাছ থেকে আজ একটা মেডেল পাবে। আমারটা পেয়েছি আমি দশ বছর আগে।’ বুকে ঝুলানো একটা মেডেলের গায়ে টোকা দিল সে।
‘আচ্ছা, আচ্ছা।’ অধৈর্যের, সুরে বলল পেরি। ‘এবার তুমি যাও, বাপু, ঝামেলা বাড়িয়ো না। সাবধান, এদিক সেদিক ঘুরঘুর কোরো না যেন আবার। সোজা চিলেকোঠায় চলে যাও।’ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পেরি। দেখল সুযোগ সন্ধানী আরেক লোক ব্যারিয়ার টপকে এপারে আসার চেষ্টা করছে। মারমুখো হয়ে তেড়ে গেল তার দিকে সে। ‘এ্যাই। তবে রে…’
বিশ সেকেন্ড পর ভিড়টাকে ব্যারিয়ারের কাছ থেকে দশ গজ হটিয়ে দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল পেরি তেসিয়ার। রাস্তার শেষ প্রান্তে চৌরাস্তার কাছাকাছি.একটা দরজার ভিতর অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে এক পলকের জন্যে গ্রেটকোটটাকে দেখতে পেল সে।
.
মাদাম আর্থা তার পোষা কালো বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে বকবক করছে। আগাম নোটিশ দিয়ে আজকের জন্যে সবাইকে বাড়ি খালি করতে বলা হয়েছিল, বিনা প্রতিবাদে সে-নির্দেশ পালন করেছে সবাই। এলাকার প্রায় সব ক’টা দালান কর্সিকানদের। তাদের গুরু কাপু উ সেন কি এক অনুষ্ঠানে আসবেন এদিকে, তার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্যেই এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, বলা হয়েছে তাকে। সকাল থেকে তিন দফায় তিনটে দল সার্চ করে গৈছে গোটা ফ্ল্যাট বাড়ি। ছাদের উপর কমপক্ষে পঁচিশ জন সশস্ত্র লোক উঠে বসে আছে। আজ আর দরজা পাহারা দেবার দরকার নেই তার। হাতে তেমন করার কাজও কিছু নেই, তাই ইহজগতের একমাত্র ঘনিষ্ঠ আপনজন কালো বিড়ালটার সাথে গল্পগুজব করে সময়টা কাটাচ্ছে মাদাম আর্থা। দাঁতহীন মাড়ি বেরিয়ে পড়ছে বুড়ীর যোয়ান বয়সের রঙিন সব অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে। ‘বুঝলি রে, ছেলেটা যেমন ছিল ইয়া তাগড়া, তেমনি ছিল হৃদয়টা। তা আমি তাকে পাত্তা না দিলে কি হবে, সে আমাকে এত ভালবাসত, এতই ভালবাসত…’
ঘ-র-ঘ-র আওয়াজ বেরিয়ে এল কালো বিড়ালের গলা থেকে।
একগাল হাসল বুড়ী। চটিস কেন? আমি কি বলেছি তোর চেয়ে বেশি ভালবাসত সে আমাকে?’ হঠাৎ খোলা দরজার দিকে তাকাল বুড়ী। খট্ করে একটা শব্দ হলো। কেন? কিসের শব্দ? মনে হলো সিঁড়ি থেকে এল।
‘আয় তো দেখি,’ বলে ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠল বুড়ী। বিড়ালটাকে বুকে নিয়ে কামরা থেকে বেরোল সে। সিঁড়ির দিকে তাকাল। নেই কেউ। আর কোন শব্দও পেল না।
কিন্তু এখনও কানে বাজছে শব্দটা—খট্! বাড়ি খালি দেখে ছিঁচকে চোর হয়তো লোভ সামলাতে পারেনি, ভাবল বুড়ী। সিঁড়ির দিকে এগোল সে। বিড়ালের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। বলল, ‘চল, তালাগুলো ঠিক আছে কিনা দেখে আসি ঘুরে।
নিঃশব্দে বেরিয়ে এল রানা সিঁড়ির নিচ থেকে। বুড়ীর কামরার পাশেই চার ফিট একটা অন্ধকার জায়গায় বসে ছিল ও। জায়গাটা সিঁড়ির তলায়; তাই দাঁড়াবার উপায় নেই। সোজা বুড়ীর কামরায় ঢুকে পড়ল ও। টেবিলের উপর চোখ পড়তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখটা। এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে ছোট্ট, পুরানো হাত ব্যাগটা তুলে নিল ও। সেটা খুলতেই ভিতরে দেখা গেল চাবির গোছাটা।
যে তালাটা খুলতে হবে সেটার নাম্বার মনে আছে রানার। গোছা থেকে বাছাই করে নির্দিষ্ট নাম্বারের একটা চাবি খুলে নিল ও। সেটা পকেটস্থ করে চাবির গোছাটা হাতব্যাগে ফেলল, তারপর হাতব্যাগটা রেখে দিল যথাস্থানে।
বিশ সেকেন্ডও হয়নি বুড়ীর কামরায় ঢুকেছে রানা। তালা পরীক্ষা করতে ছয় তলা পর্যন্ত যদি ওঠে সে, ফিরে আসতে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট লাগবে তার। একমুহূর্ত চিন্তা করল রানা। কামরার অপর দরজা দিয়ে দ্রুত বাথরূমে ঢুকে পড়ল ও।
কোটের সামনেটা খুলল রানা। হাত ঢুকিয়ে কোমরের কাছ থেকে হারনেসের হুকটা খুলল। ভাঁজ করা ডান পা টা নিতম্বের নিচ থেকে ঝট করে নেমে এল নিচের দিকে। হাঁটুর নিচ থেকে অবশ্ হয়ে গেছে পা, কিন্তু হাঁটুর উপর প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে, চোখ মুখ বিকৃত হয়ে উঠল ওর। দেয়ালে ঠেস দিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্যে পা’টা ম্যাসেজ করতে শুরু করল।
তিন মিনিট পর বাথরূম থেকে বেরোল রানা। বুড়ী ফেরেনি এখনও। ক্রাচটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল কামরার বাইরে। মাথা নিচু করে ঢুকল অন্ধকার সিঁড়ির তলায়।
থপ্ থপ্ পায়ের শব্দ শুনে বুঝল রানা, ফিরে আসছে বুড়ী। গলা বাড়িয়ে ‘হাউ’ করে উঠে বুড়ীর পিলেটা পরীক্ষা করলে কেমন হয়? ছেলেমানুষী দুষ্টামি এখনও ত্যাগ করেনি ওকে, এই ভেবে হাসল মনে মনে। গলাটা বাড়াল একটু। বকবক করছে বুড়ী। কি যেন বোঝাচ্ছে বিড়ালটাকে। কামরার ভিতর ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজাটা। ক্রাচ হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ির তলা থেকে বেরিয়ে এল ও। নিঃশব্দে ধাপ টপকে উঠে যাচ্ছে উপরে।
ছয়তলায় উঠে থামল রানা। একটা ফ্ল্যাটের দরজায় নক করল। সাড়া নেই কারও। আবার নক করল রানা। চারদিক নিস্তব্ধ। কেউ নেই ভিতরে। পাশের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল এবার। নক করল। খানিক অপেক্ষা করে এটাতেও টোকা মারল দ্বিতীয়বার। সাড়া নেই কারও। প্রথম ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলল। ভিতরে ঢুকে আবার বন্ধ করল দরজা, তালা লাগিয়ে দিল। হাতের ক্রাচটা দরজার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে খোলা জানালার দিকে এগোল ও।
রাস্তার ওপারের দালানগুলোর ছাদে শুয়ে রয়েছে অনেক লোক। একটু পিছিয়ে এল রানা। অনেকটা দূরে রয়েছে ওরা, ঘরের ভিতর আধো অন্ধকারে কেউ থাকলেও দেখতে পাবার কথা নয় ওদের। হাত বাড়িয়ে জানালার শার্সির ক্লিপ খুলে ফেলল ও। শার্সির ফ্রেম দুটো ধরে উন্মুক্ত করল, টেনে আনল দুই দিকের দেয়ালের গায়ে। আরও দু’পা পিছিয়ে এল ও। কার্পেটের উপর চারকোনা একটা আলো পড়েছে। তবে ঘরের বাকি অংশ এরপরও অনালোকিতই থাকল। চারকোনা আলোর বাইরে থাকবে ও, স্থির করল মনে মনে, তাহলে বিনকিউলার দিয়েও কর্সিকানরা দেখতে পাবে না ওকে।
চারকোনা আলোটাকে এড়িয়ে জানালার একপাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। স্টেশনের সামনের চাতাল এখান থেকে একশো ত্রিশ মিটার দূরে। সরাসরি সামনে নয়, একপাশে। কিন্তু উপর থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে পুরোটা। জানালা থেকে আর্ট ফিট পিছনে এবং একটা দিক ঘেঁষে লিভিং-রূমের টেবিলটাকে দাঁড় করাল ও। টেবিল ক্লথ এবং প্লাস্টিকের ফুলদানীটা সরিয়ে বদলে সেখানে আনল আর্মচেয়ারের কুশন। এগুলো ওর ফায়ারিং রেস্ট হিসেবে কাজ করবে।
গ্রেটকোটটা খুলে ফেলল রানা। শার্টের আস্তিন গুটিয়ে নিল। ক্রাচটাকে দরজার কাছ থেকে তুলে নিয়ে ফিরে এল টেবিলের কাছে। এক এক করে সেটাকে কয়েক টুকরোয় বিচ্ছিন্ন করল ও। গোড়ার রাবার থেকে বের করল চকচকে তিনটে এক্সপ্লোসিভ বুলেট। আগের চেয়ে এখন সুস্থ বোধ করছে রানা। ঘামছে না সে এখন। বমি বমি ভাবটাও নেই আর। করডাইটের প্রতিক্রিয়া কেটে যাচ্ছে দ্রুত।
স্ক্রু খুলে ক্রাচের পরবর্তী অংশটা খুলে সাইলেন্সারটা বের করল রানা। এরপর এক এক করে বেরিয়ে এল টেলিস্কোপিক সাইট, ব্যারেল এবং রাইফেল স্টক। সবশেষে রাইফেলের ট্রিগার বের করল রানা প্যাড দিয়ে মোড়া ক্রাচের যে অংশটা বগলের নিচে থাকে সেখান থেকে। প্যাড দিয়ে মোড়া এই আর্মপিট সাপোর্টটারও একটা ভূমিকা আছে, এটা শোল্ডার-গার্ড হিসেবে ব্যবহার করবে রানা!
অত্যন্ত যত্নের সাথে বিচ্ছিন্ন অংশগুলো জোড়া দিয়ে রাইফেলটা তৈরি করতে বসল রানা। বীচ এবং ব্যারেল, স্টকের উপর এবং নিচের অংশ, শোল্ডারগার্ড, সাইলেন্সার এবং ট্রিগার এক এক করে জোড়া লেগে গেল। সবশেষে রাইফেলের উপর ফিট করে নিল রানা টেলিস্কোপিক সাইট।
টেবিলের পিছনের একটা চেয়ারে বসে আছে রানা। সামান্য একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। রাইফেলের ব্যারেলটা উপরের কুশনে বিশ্রাম নিচ্ছে। একটা চোখ বন্ধ করে ফেলল রানা। অপর চোখটা কুঁচকে টেলিস্কোপের ভিতর দিয়ে তাকাল। জানালার নিচে একশো ত্রিশ মিটার দূরের রোদ ঝলমলে চৌরাস্তাটা লাফ দিয়ে চলে এল দৃষ্টি পথে। সাইটের রেখার উপর দিয়ে একটা লোকের মাথা চলে, গেল। লোকটা এখনও মেহমানদের দাঁড়াবার জায়গা চিহ্নিত করছে। একটু দূরে সরে দাঁড়িয়েছে লোকটা। ব্যারেলটা চুল পরিমাণ সরিয়ে লোকটাকে দৃষ্টিপথে নিয়ে এল রানা। মাথাটা বড় এবং পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। মস্ত একটা তরমুজের মত।
সন্তুষ্ট হয়ে টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে নিল রানা। টেবিলের কিনারায় কার্তুজ তিনটে সাজিয়ে রাখল, এক লাইনে দাঁড়ানো তিনজন সুসজ্জিত সোলজার যেন ওরা। তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে রাইফেলের বোল্টটাকে টেনে পিছু হটিয়ে দিল রানা, তারপর প্রথম শেলটা ঢোকাল ৱীচে। এই একটা বুলেটই যথেষ্ট তবু অতিরিক্ত দুটো সাথে রেখেছে ও। সামনে ঠেলে দিল বোল্টটাকে আবার, যতক্ষণ না কার্ট্রিজের গোড়ায় এসে জায়গা মত বসল। ঝট্ করে একটু মোচড় দিতেই লক্ হয়ে গেল সেটায়। সবশেষে অত্যন্ত সাবধানে কুশনের উপর রাইফেলটা রেখে সিগারেট আর লাইটারের জন্যে হাত ভরল পকেটে।
সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল রানা। হেলান দিল চেয়ারে। চোখের সামনে রিস্টওয়াচ তুলে সময় দেখল। এখনও পোনে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে ওকে।