ছয়
কালো আকাশের গায়ে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য তারা! রাত একটা। স্যাত করে ছুটে এসে মাঝপথে নিভে গেল একটা উল্কা। অশুভ লক্ষণ—বিশ্বাস করে না, তবু কুসংস্কারটার কথা মনে পড়ে গেল রানার। উজেলে পৌঁছে গেছে আলফা রোমিও। প্লেস দে লা জার-এর রাস্তা ধরে এগোচ্ছে। চৌরাস্তার কাছাকাছি রেলওয়ে স্টেশনে ঢোকার মুখে একটা কাফে খোলা রয়েছে দেখে গাড়ি থামাল ও। ট্রেনের জন্যে অপেক্ষারত নিশাচর কয়েকজন লোক জড়োসড়ো হয়ে বসে গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে ঢুকল রানা। অধিকাংশ চেয়ার তুলে দেয়া হয়েছে টেবিলের উপর। সেগুলোর পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল বার কাউন্টারের দিকে।
ঠাণ্ডা পাহাড়ী বাতাসের ভিতর দিয়ে ষাট মাইল বেগে গাড়ি চালিয়ে এসেছে রানা। শীতে কাঁপুনি ধরে গেছে হাড়ে। উঁচু-নিচু, বাঁক-সর্বস্ব দুর্গম রাস্তাটা গাড়ির ভিতর সারাক্ষণ ঝাঁকি দিয়েছে ওকে, ইচ্ছামত থেঁতলেছে। ঊরু, কোমর, হাত আর গর্দানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে ও। আর খিদেও পেয়েছে বটে। মাখনের পৌঁচ দেয়া এক রোল রুটি ছাড়া আটচল্লিশ ঘণ্টায় পেটে পড়েনি কিছু আর।
বড় সাইজের দুটো মাখনের টুকরো, লম্বা একটা পাউরুটি আর চারটে সেদ্ধ ডিম চাইল রানা। হুইস্কি খেতে ইচ্ছে করছে ওর, কিন্তু কাজটা শেষ না করা পর্যন্ত ও জিনিস ছোঁবে না স্থির করায় ইচ্ছাটাকে গলা টিপে মারল। বদলে মগ ভর্তি সাদা কফি চাইল ও।
‘স্থানীয় টেলিফোন ডাইরেক্টরী আছে নাকি?’
কাজে ব্যস্ত বারম্যান রানার দিকে না তাকিয়ে বুড়ো আঙুল বাঁকা করে কাউন্টারের পিছন দিকটা দেখাল। ‘হেলপ ইওরসেলফ।’
দুর্গই। নিঃসন্দেহ হলো রানা। ফোন গাইডে ব্যারনেস সিবার পরিচয় ছাপা হয়েছে একজন ব্যারনের স্ত্রী হিসেবে। কয়েকটা ফোন রয়েছে দুর্গ-প্রাসাদে। এলাকার নামটা জানা ছিল রানার, এখন গ্রামটার নাম জানা হলো। ঈগলটন ছাড়িয়ে যেতে হবে ওকে। আর এন এইটি-নাইন ধরে উজেল থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে ঈগলটন। তারও পরে ব্যারনেস সিবার দুর্গ-প্রাসাদ।
একটা পা ঝুলিয়ে বসল রানা। গোগ্রাসে খেতে শুরু করল।
রাত দুটোয় রাস্তার ধারে একটা খাড়া পাথর দেখল রানা, তাতে লেখা রয়েছে: ঈগলটন—৬ কিলোমিটার। আরও খানিক এগিয়ে রাস্তার পাশের বনভূমিতে গাড়িটাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিল ও। কিন্তু ঘন জঙ্গল, গাড়ি ঢোকার মত চওড়া ফাঁক কোথাও দেখছে না। অস্বস্তি এবং অস্থিরতা বাড়ছে ওর মধ্যে। ছয়শো মিটার এগিয়ে এল আরও। একটা ফাঁক দেখা গেল বটে, কিন্তু কাঠের লম্বা একটা পোল দিয়ে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে পথটা। পোলের সাথে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডও ঝুলছে। তাতে ফ্ৰেঞ্চ ভাষায় লেখা রয়েছে: এটা ব্যক্তি মালিকানাধীন এলাকা।
গাড়ি দাঁড় করাল রানা। পোলটা সরাল। তারপর জঙ্গলের ভিতর কিছুদূর এগিয়ে গাড়ি থামিয়ে ফিরে এসে আবার পথটা আটকে দিল পোল দিয়ে। গাড়িতে উঠে রওনা হলো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।
জঙ্গলের আধ মাইল ভিতরে ঢুকল নীল আলফা রোমিও। দুই হেড লাইটের উজ্জ্বল আলোয় ভূতের মত নিঃশব্দে নড়াচড়া করছে গাছ আর ঝোপ-ঝাড়ের ছায়াগুলো। গাড়ি দাঁড় করিয়ে আলো নিভিয়ে দিল রানা। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে তার কাটার যন্ত্র আর টর্চ নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
কয়েক মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল রানা। আশপাশে কোন বাড়ি বা বনরক্ষীদের আস্তানা আছে কিনা জানা নেই ওর। যদি থাকে, নিশ্চয়ই কারও না কারও কানে গেছে ইঞ্জিনের আওয়াজ। পাঁচ মিনিট কেটে গেল। বনভূমি নিথর। কোথাও কোন শব্দ নেই। হঠাৎ অদ্ভুত সব চিন্তার উদয় হলো রানার মাথায়। গহীন রাত এখন। দেশ থেকে কত শত মাইল দূরে রয়েছে ও। অজানা জঙ্গলে। সে একা। একজন মানুষ খুন করা তার উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যের পিছনে কাজ করছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ। ঘন অন্ধকার ঘিরে রেখেছে তাকে। পিছনে ফ্রান্সের গোটা প্রশাসন যন্ত্র আর ইউনিয়ন কর্স ডালকুত্তার মত গন্ধ শুঁকে শুঁকে ছুটে আসছে দ্রুতবেগে, লালাসিক্ত জিভ বেরিয়ে পড়েছে তাদের। দেখামাত্র ধারাল দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ওকে। শিউরে উঠল রানা। এবং ঠিক তখুনি সংবিৎ ফিরে পেল ও। হচ্ছেটা কি! নিজেকে তীব্র তিরস্কার করল ও। কাজের সময় আবোল তাবোল চিন্তা কেন!
গাড়ির তলায় ঢুকল রানা। শিশির ভেজা ঘাসে পিঠ দিয়ে শুয়ে দেড় ঘণ্টা একনাগাড়ে কাজ করল ও। ষাট ঘণ্টা পর রাইফেলের বিচ্ছিন্ন অংশ ভর্তি স্টীল টিউবগুলো লুকানো জায়গা থেকে অবশেষে বেরোল এক এক করে।
সুটকেসে আবার প্যাক করল টিউবগুলো রানা। এই সুটকেসেই রয়েছে সেকেন্ডহ্যান্ড নোংরা কাপড়-চোপড় আর মিলিটারি গ্রেটকোটটা। ভিতর এবং বাইরে থেকে গাড়িটাকে সার্চ করল রানা। না, এমন কিছু ফেলে যাচ্ছে না ও যা ওর পরিচয় সম্পর্কে কোন ইঙ্গিত দেবে। বুনো রডোডেনড্রনের মস্ত ঝোপের মাঝখানে গাড়িটাকে ঢোকাল ও। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ি সেখানে চাকার গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, তা ঢাকার জন্যে আশপাশ থেকে ঝরা পাতা কুড়িয়ে এনে ফেলল ও।
টাই খুলে দুটো সুটকেসের হাতল বাঁধল দুই প্রান্ত দিয়ে, তারপর টাইটা ঝুলিয়ে নিল কাঁধে। একটা সুটকেস ওর বুকের উপর, অপরটা পিঠে ঝুলছে। বাকি দুটো দু’হাতে নিয়ে রওনা হলো ও রাস্তার দিকে
পঁচিশ পঞ্চাশ গজ পর পরই থামতে হচ্ছে রানাকে। হাত এবং কাঁধের বোঝা নামিয়ে রেখে ফিরে যাচ্ছে পিছন দিকে। ঘাসের উপর গাড়ির চাকার দাগ ঢেকে দিচ্ছে শুকনো ঝরা পাতা দিয়ে। ঝাড়া দেড় ঘণ্টা লাগল কাজটা সারতে। শুকনো ঝরা পাতা পড়ে অধিকাংশ ঘাস ঢাকা পড়ে আছে, তাই চাকার দাগ সে-সব জায়গায় স্পষ্ট হয়ে পড়েনি, তা নাহলে দাগ ঢাকতে আরও অনেক বেশি সময় লাগত।
মাথা নিচু করে কাঠের পোলটার তলা দিয়ে বেরিয়ে এল রানা। রাস্তায় উঠে আধ মাইল এগিয়ে থামল ও।
কাদা-মাটি লেগে চেক স্যুটটার চেহারা বিগড়ে গেছে। শিশির আর ঘামে ভিজে পোলো সোয়েটারটা সেঁটে আছে পিঠের সাথে। শরীরের সমস্ত পেশী টনটন করছে ব্যথায়। রাস্তার ধারে একটার উপর একটা সুটকেস রেখে তার উপর বসল রানা। পুব আকাশে ফিকে হয়ে আসছে অন্ধকার। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ওকে। দিনের আলো আরও পরিষ্কার না হলে বাস চলাচল শুরু হবে না।
সাড়ে পাঁচটার দিকে খড় বোঝাই একটা ট্রাক দেখা গেল রাস্তায়। স্পীড কমিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে গলা বাড়াল ড্রাইভার, জানতে চাইল, ‘গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে বুঝি?’
হেসে ফেলল রানা। বলল, ‘না। ক্যাম্প থেকে সাপ্তাহিক ছুটির পাস পেয়ে বোকার মত বেরিয়ে পড়েছি। লিফট নিয়ে গত রাতে উজেল পৌঁছে ঠিক করেছিলাম তুল-এ আঙ্কেলের কাছে একবার ঢুঁ মেরে যাই।’ বোকার মত হাসল আবার রানা। ‘পা চালিয়ে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। যাব আরও অনেক দূর—
‘এ আপনার স্রেফ পাগলামি, মশিয়ে। সন্ধ্যার পর এদিকে একা কেউ আসে না। পিছনে উঠে পড়ুন। ঈগলটন পর্যন্ত পৌছে দিতে পারব। ওখান থেকে আর কোন গাড়ি ধরে…’
ছোট্ট শহরটায় সকাল সাতটায় পৌঁছল ট্রাক। ড্রাইভারকে ধন্যবাদ আর একমুখ সরল হাসি উপহার দিয়ে স্টেশনে ঢুকল রানা, ঘুরপথে আবার বেরিয়ে এল প্রধান সড়কে। ইতোমধ্যে ট্রাক নিয়ে নিজের পথে চলে গেছে ড্রাইভার।
একটা কাফেতে ঢুকল রানা। বারম্যানকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ শহরে ট্যাক্সি পাবার উপায় কি বলুন তো?’
বারম্যান ওকে একটা ট্যাক্সি কোম্পানীর ফোন নাম্বার দিল। যোগাযোগ করল রানা। ওকে জানানো হলো আধঘণ্টা পর পৌছে যাবে একটা ট্যাক্সি। টয়লেটে ঢুকে ঠাণ্ডা পানিতে হাত মুখ ধুয়ে নিল ও, দাঁত ব্রাশ করল, নতুন স্যুট পরল।
ইঁদুর ধরার খাঁচার মত একটা রেনোয়া ট্যাক্সি কাফের সামনে এসে দাঁড়াল সাড়ে সাতটায়। ‘হাউতে শেলনেয়ার গ্রামটা কোথায় জানা আছে তোমার?’ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘হুঁ-উ।’
‘কদ্দূর?’
‘আঠারো কিলোমিটার,’ বুড়ো আঙুল বাঁকা করে পাহাড়ের দিকটা দেখাল ড্রাইভার। ‘ওদিকের পাহাড়ে
‘নিয়ে চলো আমাকে, বলল রানা। তিনটে সুটকেস ট্যাক্সির ছাদের র্যাকে তুলে দিল ও। একটা সুটকেস নিয়ে ঢুকল ভিতরে।
গ্রামের চৌরাস্তায় কাফে দে লা পোস্টের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামল রানা। ছোট্ট শহরটায় পিছিয়ে পড়া এলাকার পরিচিত ছাপ ফুটে আছে। রাস্তাটা মেরামত হয়নি, দাঁত বের করে আছে ইঁটগুলো, এখানে সেখানে খানখন্দ ভর্তি। শহরের বাউন্ডারি ওয়ালটা ধসে পড়েছে কোন কালে। দুটো গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার উপর। চার চাকার কোন যানবাহন দেখছে না রানা।
সুটকেসগুলো নিয়ে কাফেতে ঢুকল রানা। বেশ ক’জন লোক বসে আছে। কারও দিকে না তাকিয়েও বুঝল রানা, তাকে ঢুকতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে সবাই।
কালো ব্লাউজ আর হলুদ গাউন পরা মোটাসোটা এক মেয়েলোক বসে আছে কাউন্টারে। ‘মশিয়ে?’ রাজ্যের প্রশ্ন চোখে নিয়ে রানার দিকে তাকাল সে।
সুটকেসগুলো নামিয়ে রাখল রানা। আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল গেঁয়ো টাইপের লোকগুলো বেঢপ সাইজের নোংরা পোশাক পরে লাল মদ পান করছে। মুচকি হেসে ডান হাতের দুটো আঙুল খাড়া করল রানা। ‘দুটো বোতল দাও, বলল ও। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘দুর্গটা এখান থেকে কদ্দূর?’
‘দুই কিলোমিটার, মশিয়ে।
অথচ ড্রাইভার আমাকে বলল এদিকে নাকি কোন দুর্গ নেই। ব্যাটা আমাকে চৌরাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।’
ঈগলটনের লোক বুঝি?’ রানাকে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে দেখে মেয়েলোকটার চেহারায় তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। ‘ও! হারামির হাড় ওরা। ধাপ্পাবাজ।’ এইটুকু বলেই চুপ মেরে গেল সে।
দুর্গ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর যাব আমি,’ একটু গলা চড়িয়ে বলল রানা কাফের সবাই যাতে শুনতে পায়। ওখানে এক জায়গায় আমার জন্যে অপেক্ষা করার কথা একটা গাড়ির। কিন্তু এই দুই কিলোমিটার যাব কিভাবে? কোন গাড়ির ব্যবস্থা করা যায়?’
চাষাভুষো লোকগুলো একচুল নড়ল না বা সাড়া দিল না।
কড়কড়ে একশো ফ্র্যাঙ্কের তিনটে নোট বের করল রানা। জানতে চাইল ও, ‘ওয়াইনের দাম কত, মাদাম?’
চোখ দুটো বড় হয়ে উঠল মেয়েলোকটার। নোটগুলোর দিকে চোখ রেখে বলল, ‘ভাঙতি নেই আমার কাছে।’
পিছনে শব্দ পাচ্ছে রানা। চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়েছে কেউ। পাঁচ সেকেন্ড পর পাশে একজনের অস্তিত্ব অনুভব করল ও।
‘একটা গাড়ি দরকার আমার,’ অন্যমনস্কভাবে বলল রানা।
‘একটা নোট আর একটা বোতলের বিনিময়ে?’ পাশ থেকে জানতে চাইল লোকটা।
এতক্ষণে সরাসরি লোকটার দিকে তাকাল’রানা। এদিক ওদিক মাথা নাড়াল ও। বলল, ‘না। একটা নোট আর দুটো বোতলের বিনিময়ে।’
ঝট্ করে নিজের পিছন দিকে তাকাল আধবুড়ো গেঁয়ো লোকটা। হাঁক ছেড়ে বলল, ‘অ্যাই বেনোইদ, শুনছিস না? যা জলদি, ভ্যানটা নিয়ে আয়, পৌঁছে দে মশিয়েকে।’
চেয়ার সরাবার আওয়াজ পেল রানা। তারপর দ্রুত পায়ের শব্দ—বেরিয়ে গেল কেউ কাফে থেকে।
ভ্যানে বসে পাহাড়ে চড়ার সময় ভাবছে রানা। কাফের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, দূর্গ ছাড়িয়ে অনেক দূর যাবে ও, কিন্তু ভ্যানের ড্রাইভার বেনোইদ তো দেখবে কোথায় সে নামছে। ঐ ব্যাটা গিয়ে গল্প করবে সবার কাছে। আইনের বা ইউনিয়ন কর্মের লোক যদি গন্ধ শুঁকে ঈগলটন পর্যন্ত চলে আসে, জিজ্ঞেস করা মাত্র গল্পটা সে কেউ শুনিয়ে দেবে তাদেরকে। সে-রাস্তা বন্ধ করা যায় কিভাবে? ভাবছে রানা।
.
সেই সুপুরুষকে স্বপ্নে দেখে খোশ মেজাজে ঘুম ভাঙল ব্যারনেস সিবার। স্বপ্নের আমেজ তখনও কাটেনি, তাই সকালের পাখ পাখালির কলকাকলি, তাজা ঠাণ্ডা বাতাস, বেড-টি—সবই বড় ভাল লাগল তার। ঠোঁটে আশ্চর্য একটা মধুর হাসির রেখা ফুটে উঠল। জীবনটাকে বড় ভাল লাগছে। বেঁচে থাকার মধ্যে কি যে অসীম আনন্দ, তা যেন আজ বিশেষ ভাবে অনুভব করছে তার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই হঠাৎ সেই বলিষ্ঠ সুপুরুষের কথা মনে পড়ে গেল। অমনি ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকের ভিতরটা। একটা হাহাকার জেগে উঠল মনের মধ্যে। নেই! এক রাতের জন্যে তার জীবনে এসেছিল সেই পরদেশী, তারপর আবার হারিয়ে গেছে! আর কি কখনও দেখা হবে তার সাথে? কোথায় সে? মাথা খুঁড়ছে একটা উত্তরহীন প্রশ্ন। রাগ হচ্ছে এখন নিজের ওপরে—কেন খামখেয়ালের বশে খেইটা হারিয়ে বসল সে? সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। দেখা হলো, প্রেম হলো, তারপর হারিয়ে গেল দু’জন দু’জনের কাছ থেকে। তার ঠিকানা জানা হয়নি, পরিচয় জানা হয়নি—ইচ্ছা করেই জানতে চায়নি সে। আসলে ভয় পেয়েছিল। জানত, নাম ঠিকানা জানা থাকলে নিজেকে সামলাতে পারবে না সে, একদিন সেখানে তার কাছে গিয়ে হাজির হবে। অথচ তা উচিত হবে না। সে বিবাহিতা, একজনের স্ত্রী। তাছাড়া, প্রথাসিদ্ধ নয় এমন কোন আচরণ করলে লোকটাকেও হয়তো বিড়ম্বনায় ফেলা হবে। এইসব কথা ভেবে তখন মনে হয়েছিল দরকার নেই পরিচয় জেনে। হঠাৎ এসেছে, হঠাৎ-ই আবার হারিয়ে যাক অজানা জগতে।
কিন্তু তখনকার বোকামির কথা ভেবে এখন তার মাথা ঠুকতে ইচ্ছা করছে দেয়ালে। তখন বোঝেনি, ঘুমে এবং জাগরণে এমন ভয়ঙ্করভাবে উতলা করবে তার স্মৃতি।
সবকিছু তিক্ত লাগতে শুরু করে ব্যারনেস সিবার। এই বিশাল দুর্গে কয়েকজন চাকর চাকরানী ছাড়া সে একা। লোকালয় এখান থেকে অনেক দূরে। কেউ এখানে আসে না, কোথাও তার যাবার জায়গা নেই। এখানে সে বন্দিনীর জীবন কাটাচ্ছে। এই বন্ধন ছিঁড়ে বেরোবার সাধ্য তার নেই। এতদিন সে-ইচ্ছাও কোনদিন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেনি। কিন্তু দুর্গে ফেরার পথে সেই যে লোকটাকে দেখল, একটা রাত কাটাল তার সাথে, তারপর থেকে কেমন যে ওলোটপালট হয়ে গেল সব। এখন মনে হচ্ছে, সবই সে মেনে নেবে, যদি সেই পরদেশীকে কাছে বসিয়ে দু’চোখ ভরে দেখার অধিকার পায় সে। বছরে দু’বছরে একবারও যদি সে আসে, তাহলেও সুখী হয় সে, সার্থক হয় তার এই বন্দিনী জীবন। নিজেকে ধিক্কার দেয় ব্যারনেস সিবা—তুই নিজেই তো সে-রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিস। দেখা না হওয়াই উচিত, কেন তুই সে-কথা বলতে গেলি তাকে!
নিচে থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে এল। মেজাজটা আরও তিক্ত হয়ে ওঠে ব্যারনেস সিবার। নিশ্চয়ই ব্যারনের কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয় সাহায্যের প্রার্থনা নিয়ে এসেছে। মন ভাল নেই তার, সুতরাং যেই এসে থাকুক, কপালে আজ তার খারাবি আছে। ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে নামল ব্যারনেস সিবা। ড্রেসিং রূমে ঢুকে মাথায় চিরুনি বুলিয়ে ফিরে এল বেডরুমে। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কে এল দেখার জন্যে তাকাল নিচের দিকে। কে!
রানাকে ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্ময়ে, আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ল ব্যারনেস সিবা। ‘প্রিয় জানোয়ার! সুন্দর, আদিম, প্রিয় জানোয়ার! পিছু নিয়ে চলে এসেছ তুমি!’ বিড় বিড় করছে ব্যারনেস সিবা। অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গেল তার শরীরে।
ভ্যানের পিছন থেকে কয়েকটা সুটকেস বের করছে ড্রাইভার। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল সে। এটুকু দেখেই দ্রুত জানালার কাছ থেকে সরে এল ব্যারনেস সিবা। ছুটে গিয়ে ঢুকল বাথরূমে পোশাক পাল্টাবার জন্যে। বাথরূম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে গিয়ে দাঁড়াল। নিচের হলঘর থেকে সেই পরিচিত ভরাট পুরুষকণ্ঠ ভেসে আসছে। মেড-সারভেন্ট নেস্তাইন নবাগতকে প্রশ্ন করছে, ‘মশিয়ে কাকে চান?’
এক মুহূর্ত পর ব্যারনেস সিবা দেখল মেয়েটা দুপ্ দাপ্ ধাপ বেয়ে উঠে আসছে উপরে। তাকে দেখে থমকে দাঁড়াল সে। চাপা কণ্ঠে বলল, ‘একজন ভদ্রলোক। বিদেশী, ইংরেজ বলে মনে হলো- আপনাকে চায়।
.
স্বরাষ্ট্র দফতরের কনফারেন্স রূমে সেদিন রাতের মীটিংটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ক্লড র্যাঁবো তাঁর স্বভাবসুলভ মৃদু কণ্ঠে জানালেন, ‘রিপোর্ট করার মত কিছুই নেই আমার হাতে।’ অর্থাৎ কাজের কোন অগ্রগতি হয়নি।
রুটিন মাফিক সাদা ইটালিয়ান আলফা রোমিওর বর্ণনা গোটা ফ্রান্সের সর্বত্র পাঠানোর কাজ শেষ হয়েছে, এতে সময় লেগেছে চব্বিশ ঘণ্টা। রেখে-ঢেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পাঠানো হয়েছে মেসেজ, যাতে কারও মনে কোনরকম অবাঞ্ছিত সন্দেহের উদ্রেক না হয়। একই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে প্রতিটি রিজিওন্যাল হেডকোয়ার্টারকে নির্দেশ দানের ব্যাপারে। প্রতিটি হেডকোয়ার্টার তাদের অধীনস্থ পুলিস স্টেশনকে নির্দেশ দিয়েছে যার যার এলাকার সমস্ত হোটেল রেজিস্ট্রেশন কার্ড সংগ্রহ করে সকাল আটটার মধ্যে জমা দিতে হবে। ইতোমধ্যেই ত্রিশ হাজার কার্ড পৌঁচেছে বিভিন্ন রিজিওন্যাল হেডকোয়ার্টারে। অরগ্যানের নাম খোঁজা হচ্ছে কার্ডগুলোয়। এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ক্লড র্যাঁবোর ধারণা, গতরাতে অরগ্যান কোন হোটেলে ওঠেনি। তবে নিশ্চিত করে বলা যায় না, অন্য কোন নামে উঠতে পারে।
হোটেল দ সার্ফ হঠাৎ সে ত্যাগ করল কেন? এটা খুব রহস্যময় ব্যাপার।’ চুরুট ধরালেন ক্লড র্যাঁবো, তারপর আবার বললেন, ‘ব্যাপারটা যদি কাকতালীর হয়ে থাকে তাহলে এখনও আলফা রোমিওর গাড়িটাই ব্যবহার করার কথা তার। অরগ্যান নামেই হোটেলে উঠতেও কোন বাধা নেই তার। সেক্ষেত্রে অচিরেই তার সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু, হোটেল দু সার্ফ ত্যাগ করার পিছনে যদি অন্য কোন কারণ থাকে…’
‘অন্য কোন কারণ?’ বিশাল বপু কর্নেল প্যাপন বাধা দিল ক্লড র্যাঁবোকে। ‘অন্য আর কি কারণ থাকতে পারে, শুনি?’
‘আমরা তার বর্তমান পরিচয় জানি এ খবর যদি সে পেয়ে থাকে…’
‘কিভাবে পাবে?’ তীব্র ব্যঙ্গের সুরে আবার জানতে চাইল কর্নেল প্যাপন। ‘কিভাবে পাবে তা যদি জানতাম,’ শান্ত ভঙ্গিতে বললেন ক্লড র্যাঁবো, ‘তাহলে তো সব সমস্যার ফয়সালা এতক্ষণে হয়েই যেত। আমি ফ্যাক্ট নিয়ে আলোচনা করছি না, আলোচনা করছি সম্ভাবনা নিয়ে।’
মাঝখান থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন, ‘আপনি বলে যান, মশিয়ে ক্লড র্যাঁবো।’
‘অরগ্যানকে কেউ যদি সতর্ক করে দিয়ে থাকে,’ আবার শুরু করলেন ক্লড র্যাঁবো, ‘তাহলে গাড়িটাকে নিশ্চয়ই সে ত্যাগ করেছে। এখন তার সামনে দুটো পথ খোলা আছে। এক, হয় সে হোটেলে লুকাবার চেষ্টা করবে, নয়তো সীমান্ত পেরিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইবে ফ্রান্স থেকে। দুই,…অথবা তার কাছে আরেক সেট ভুয়া পরিচয়পত্র ইত্যাদি আছে। এখন সে সেই পরিচয়পত্র কজে লাগাবে। অর্থাৎ আবার সে চেহারা পরিচয় ইত্যাদি বদল করবে বা ইতিমধ্যেই করেছে। সেক্ষেত্রে,
এখনও সে মহামান্য প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার জন্যে ভয়ঙ্কর একটা হুমকি।
‘তার কাছে আরও এক সেট পরিচয়পত্র আছে একথা আপনি ভাবছেন কেন?’ জানতে চাইল অ্যাকশন সার্ভিসের চীফ কর্নেল বোল্যান্ড।
ক্লড র্যাঁবোর মুখে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ল একরাশ হাসি। অ্যাশট্রেতে চুরুটের ছাই ঝেড়ে তিনি বললেন, ‘লোকটাকে আপনারা খুব ছোট করে দেখছেন। কিন্তু, ভাবুন একবার, মহামান্য প্রেসিডেন্টকে খুন করতে চাইছে যে-লোক তার অভিজ্ঞতার ঝুলি কতটা ভারী হতে পারে। কড়া নিরাপত্তাধীন ব্যক্তিদেরকে খুন করার অনেক অভিজ্ঞতা এ লোকের না থেকেই পারে না। আমার তো বদ্ধমূল বিশ্বাস, এ ব্যাপারে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ একজন বিশেষজ্ঞ সে। অথচ পৃথিবীর কোন দেশের কোন পুলিসের খাতায় তার নাম নেই। অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার, তাই নয় কি? কিভাবে, আমি জানতে চাই, কিভাবে সে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও পুলিসের নজরকে এড়িয়ে থাকতে পারল?’
সবাই চুপ।
‘এটা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে একটি মাত্র উপায়ে,’ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ক্লড র্যাঁবো। তা হলো, প্রতিটি অ্যাসাইনমেন্টে সে মিথ্যে নাম এবং নকল চেহারা ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ ছদ্মবেশ গ্রহণেও পাক্কা ওস্তাদ লোক সে।’ একটু বিরতি নিলেন ক্লড র্যাঁবো। এখন আর তাঁর মুখে হাসি নেই। বললেন, ‘তার আসল পরিচয় আমরা এখনও কেউ জানি না। সে সান্তিনো ভ্যালেন্টি নয়। সে অরগ্যান ও নয়। দু’বার চেহারা আর পরিচয় বদল করেছে এই লোক। হয়তো আবার সে তাই করেছে। করেনি—একথা ভাবলে বোকামি করব আমরা।’
‘কিন্তু কেউ তাকে সতর্ক করে দিয়েছে একথা মনে করার কোন কারণ নেই,’ কর্নেল প্যাপন বলল, ‘আমার বিশ্বাস পাহাড়ে, জঙ্গলে অথবা কোন বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটিয়েছে সে। অরগ্যান নামেই আবার কোন হোটেলে উঠবে। ব্যস, তখনই মুঠোয় পেয়ে যাব আমরা। মশিয়ে তাকে যতবড় হুমকি বলে মনে করছেন আসলে সে তা নয়। তাকে ভয় পাবার কিছু নেই।‘
গম্ভীর দেখাল ক্লড র্যাঁবোকে। সত্যি কথা বলতে কি, এই বিশেষ লোকটাকে আমি সাংঘাতিক ভয় করছি, থেমে থেমে কথা বলছেন তিনি। ‘একে যতক্ষণ না জেলখানায় ভরতে পারছি, ততক্ষণ শান্তি পাব না আমি। লোকটার বুদ্ধি আর কৌশলের যে-টুকু নমুনা পেয়েছি, এক কথায় অতুলনীয়। তার সাহসের নমুনা যে- কোন বীরকেও লজ্জা দেবে। এখনও তার নিষ্ঠুরতার পরিচয় আমি পাইনি, তবে অনুমান করতে পারি সেটাও বিশ্বের অনেক রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। হ্যাঁ, স্বীকার করতে সঙ্কোচ নেই আমার, এই লোকটাকে আমি ভয় করি।
হো হো করে হেসে উঠল কর্নেল প্যাপন। বলল, ‘সত্যিই যদি বুদ্ধি বলে কিছু থাকে তার মগজে, বেঁচে থাকতে থাকতে ফ্রান্স ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করবে সে।’
এরপরই সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো মীটিংয়ের।
‘বাস্তব অবস্থাটা কি?’ নিজের অফিসে ফিরে এসে একান্ত সচিব চার্লস ক্যারনের সাথে কথা বলছেন ক্লড র্যাঁবো। সে বেঁচে আছে। স্বাধীনভাবে। তার কাছে অস্ত্র আছে। এই মুহূর্তে সে কোথায়? আমরা জানি না। তার বর্তমান পরিচয় কি। অরগ্যান? না, অন্য কিছু? জানি না। শুধু জানি, মহামান্য প্রেসিডেন্টকে খুন করতে চায়। কবে? কখন? কোথায়? জানি না, জানি না, জানি না। এই কি সর্বশেষ পরিস্থিতি নয়, মাই ডিয়ার বয়?’
অনুগত শিষ্যের মত সবিনয়ে মাথা কাত করল চার্লস ক্যারন, ‘ইয়েস, চীফ, সর্বশেষ পরিস্থিতি ঠিক তাই।’
‘সেক্ষেত্রে,’ ক্লড র্যাঁবো নতুন একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগ করে লালচে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে হাত বুলাতে শুরু করলেন, ‘বৎস চার্লস, নতুন করে তার খোঁজ শুরু করতে হবে আমাদেরকে। প্রথম কাজ তার গাড়িটাকে খুঁজে বের করা। তিনটে সুটকেস আছে তার সাথে, এগুলো নিয়ে পায়ে হেঁটে খুব বেশি দূর যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। হয় সে গাড়িতেই আছে, নয়তো গাড়িটা ফেলে দিয়ে অন্য কোন উপায়ে কোথাও যাচ্ছে। গাড়িটাকে খুঁজে পাওয়াই এখন সবচেয়ে জরুরী। ওটা যেখানে পাওয়া যাবে সেখান থেকে শুরু হবে আমাদের পরবর্তী কাজ।’
.
ফ্রান্স যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে সে এখন করেজের মধ্যিখানে বিশাল দুর্গের ভিতর মখমলের বিছানায় শুয়ে পরম শান্তিতে বিশ্রামরত। শাওয়ার সেরে শরীরটাকে তাজা ঝরঝরে করে নিয়েছে রানা। ব্রেকফাস্টের ঢালাও রাজকীয় অর্ডার দিয়েছিল ব্যারনেস সিবা, দু’ঘন্টার মধ্যে দু’জনের জন্যে মুরগীর সৃপ, মাখনের পোঁচ দেয়া রুটি, হাফ-বয়েল ডিম, পনির, জেলি, ঘরে তৈরি কেক, কালো কফি, লাল মদ আর শত বছরের পুরানো ব্র্যান্ডি পরিবেশন করেছে দুর্গের পরিচারিকারা। ভরপেট খেয়ে আলস্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে রানা। ব্যারনেস সিবা ওকে এক প্যাকেট দামী হাভানা চুরুট দিয়ে গেছে, সেটার একটা ধরিয়ে বিছানায় গড়াচ্ছে ও, অদূর ভবিষ্যতে কি করতে হবে সে-ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করছে। এক হপ্তার মধ্যেই আবার রওনা হতে হবে তাকে। কিন্তু এখান থেকে বেরোতে পারা বেশ কঠিন হয়ে দেখা দিতে পারে। ভেবে চিন্তে একটা উপায় ঠিক করে রাখতে হবে।
নিঃশব্দে খুলে গেল দরজাটা। নিজের সুসজ্জিত বেডরূমে প্রবেশ করল ব্যারনেস সিবা। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা…দুই কাঁধের উপর দিয়ে বুকের উপর এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঢোলা একটা সিল্কের ফ্রক পরেছে সে, গলার কাছে জোড়া লেগে আছে, কিন্তু সামনেটা খোলা। তার হাঁটার সাথে সাথে শরীরে যৌবনের উথাল পাথাল ঢেউ জাগে, পলকের জন্যে সরে যায় পোশাকের সামনের ফাটলটা। ঢোলা পোশাকের নিচে আর কোন জামা নেই, তবে বাথরূম থেকে যে মোজাটা আর হাইহিল কোর্ট ও পরে বেরিয়ে ছিল সেটা এখনও খোলেনি। একটা হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথাটা বালিশ থেকে তুলল রানা, ওর দিকে পিছন ফিরে ঘরের দরজায় খিল লাগাচ্ছে ব্যারনেস সিবা, লোভাতুর দৃষ্টিতে তাই দেখছে ও। ঘুরে দাঁড়াল সিবা। এগিয়ে আসছে। ঠোঁটে এসে জমা হচ্ছে অদ্ভুত একটা চাপা হাসি।
নিঃশব্দে বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল সিবা। নিচের দিকে, রানার চোখে তাকিয়ে আছে। দুটো হাত ধীরে ধীরে উঠে গেল তার গলার কাছে। রিবনের বো- টা পোশাকটাকে আটকে রেখেছে ওখানে। বো খুলে দিতেই উন্নত ভরাট বুক উন্মুক্ত হলো। হাত বাড়িয়ে সিবার কোমরের কাছে পোশাকটা খামচে ধরে মৃদু টান দিল রানা, নিঃশব্দে সিবার কাঁধ থেকে মেঝেতে খসে পড়ল সেটা।
ঝুঁকে পড়ে রানার কাঁধে চাপ দিল সিবা, বিছানায় শুয়ে পড়ল আবার রানা। রানার দুই হাতের কব্জি ধরে বালিশের সাথে চেপে ধরল সিবা, উঠে এল বিছানায়। জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো।
‘প্রিয় জানোয়ার! সুন্দর, আদিম, জানোয়ার!’ ফিসফিস করে বলল সে রানার কানে কানে। ‘পাগল করে দিয়েছ তুমি আমাকে!’
.
এক দুই করে তিনটে দিন কেটে গেল, অরগ্যানের চিহ্নমাত্র খুঁজে পাচ্ছেন না ক্লড র্যাঁবো। রাতের মীটিংগুলোয় ক্রমশ এই মতই জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে পায়ের মাঝখানে লেজ লুকিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত অরগ্যান ফ্রান্স ত্যাগ করেছে সংগোপনে। উনিশ তারিখ রাতের মীটিংয়ে ক্লড র্যাঁবোর বক্তব্য সমর্থন করার মত একজন লোককেও পাওয়া গেল না। এখনও তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, অরগ্যান ফ্রান্সের ভিতরই কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে। অপেক্ষা করছে সে। সময় হয়েছে বলে মনে করলেই আবার সে গর্ত ছেড়ে বেরোবে।
‘কিসের জন্যে অপেক্ষা করছে?’ তীব্র ব্যঙ্গের সুরে জানতে চাইল বিশাল বপু কর্নেল প্যাপন। ‘যদি বলেন বর্ডার টপকাবার সুযোগের জন্যে অপেক্ষা করছে তাহলে আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করব না। কিন্তু যদি বলেন…
ট্রাফিক পুলিসের মত একটা হাত তুলে কর্নেল প্যাপনকে থামতে নির্দেশ দিলেন ক্লড র্যাঁবো। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। চোখ দুটো জবা ফুলের মত লাল। ঘুম হয়নি কতদিন! উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় চেহারার লাবণ্য উবে গেছে। তিনি জানেন, তাঁর মতামত যদি মিথ্যে, মূল্যহীন প্রমাণিত হয় তাহলে তাঁর ক্যারিয়ার খতম হয়ে যাবে। যাতে খতম হয় তার সম্ভাব্য সমস্ত আয়োজন এই মীটিংয়ে উপস্থিত উচ্চপদস্থ আমলারা সম্পন্ন করতে কসুর করবে না। কিন্তু এর চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হবু খুনীটাকে নিয়ে। মহামান্য প্রেসিডেন্ট নিরাপদ, তাঁর বিপদ কেটে গেছে—একথা তিনি মুহূর্তের জন্যেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাঁর ধারণা অরগ্যান প্রেসিডেন্টের পিছু ছাড়েনি। জাল ছিন্ন করে যদি সে ভিতরে ঢুকে পড়ে, প্রেসিডেন্টের কাছাকাছি পৌঁছে যায়? তিনি জানেন, তেমন কিছু যদি ঘটে; টেবিল ঘিরে বসে থাকা এই হামবাগগুলো সব দোষ একজনের ঘাড়ে চাপাবার জন্যে চেষ্টার কোন ত্রুটি করবে না। সেই একজন হবেন তিনি। দু’দিক থেকেই গোয়েন্দা হিসেবে তাঁর কর্ম জীবনের সর্বনাশ ঘটে যাবে—যদি তিনি লোকটাকে খুঁজে বের করে আটক করতে পারেন, তবেই শেষ রক্ষা সম্ভব।
তাঁর ঘাড়ে দায়িত্বটা চাপবার পর থেকে আজ আটদিন পেরিয়ে যাচ্ছে, এই ক’দিনে উত্তরোত্তর লোকটার প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর বেড়েই চলেছে। অদ্ভুত গুণী একটা লোক, ভাবছেন তিনি। কখন কি করতে হবে সে সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আগে থেকেই সমস্ত ঠিকঠাক করে রেখেছে সে।
কেন অপেক্ষা করছে জানি না,’ কাঁপা হাতে চুরুটে অগ্নিসংযোগ করে উত্তর দিনে ক্লড র্যাঁবো। ‘কিন্তু আমার ধারণা—অপেক্ষা করছে সে। হয়তো আগে থেকে একটা দিন ঠিক করে রেখেছে। সেই নির্দিষ্ট দিনের অপেক্ষায় আছে। অরগ্যান সম্পর্কে সর্বশেষ খবর পেয়েছি আমরা, একথা আমি বিশ্বাস করি না। এটা আমার অনুভূতি। এর ব্যাখ্যা দিতে পারব না।’
‘অনুভূতি!’ হো হো করে বিশ্রীভাবে হেসে উঠল কর্নেল প্যাপন। ‘মাই গড়, মশিয়ে, রোমান্টিক থ্রিলার পড়ে নিজের বারোটা বাজিয়েছেন দেখতে পাচ্ছি। এটা ডিটেকটিভ উপন্যাস নয়, মাই ডিয়ার মশিয়ে, এটা বাস্তব। ব্যাটা ভেগেছে, লেজ গুটিয়ে কেটে পড়েছে, আর আপনি কিনা তারই ভয়ে কুঁকড়ে আছেন।’
হাতের চুরুটের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধ ক্লড র্যাঁবো। কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল। সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে। ধীরে ধীরে মুখ তুললেন তিনি। সকলের মুখের উপর একবার করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনারা সবাই যদি মনে করেন আমার বিশ্বাসটা অমূলক, এর কোন ভিত্তি নেই, তাহলে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক আমাকে।’
দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে। সবাই তাঁর বক্তব্য শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে। খানিক ইতস্তত করার পর মন্ত্রী মহোদয় বললেন, মশিয়ে ক্লড র্যাঁবো, সত্যিই কি আপনি মনে করেন বিপদ এখনও কাটেনি?’
‘বিপদ দেখাই দেয়নি এখনও, মৃদু, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ক্লড র্যাঁবো। হাতে ধরা চুরুটের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। ‘সুতরাং বিপদ কেটে গেছে কিনা এ প্রশ্ন ওঠেই না। আমার বিশ্বাস, স্পষ্টভাবে, প্রমাণসহ কিছু না জানা পর্যন্ত অরগ্যানকে খুঁজে বের করার চেষ্টা পুরোদমে চালিয়ে যাওয়া উচিত।’
‘সেক্ষেত্রে,’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ‘আমি চাই মশিয়ে ক্লড র্যাঁবো তাঁর বর্তমান দায়িত্ব পালন করতে থাকুন। দয়া করে এ ব্যাপারে কেউ তাঁকে বিদ্রূপ করবেন না।’
বেলা এগারোটায় একজন বনরক্ষী একটা নধর খরগোশকে তাড়া করতে গিয়ে নীল ইটালিয়ান আলফা রোমিওটাকে দেখে ফেলল। খবরটা গ্রামের পুলিস কনস্টেবল পেল দুপুর দুটোর দিকে। নিজের বাড়ি থেকে উজেল-এর থানা অফিসারকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাল সে।
‘গাড়িটা কি সাদা?’ থানা অফিসার জানতে চাইল।
‘না। নীল।’
থানা অফিসারের সামনে একটা নোট বুক খোলা রয়েছে, সেটার দিকে চোখ রেখে কথা বলছে সে টেলিফোনে। ‘গাড়িটা কি ইটালিয়ান?’
‘না। ফ্রেঞ্চ রেজিস্টার্ড।
‘ঠিক আছে,’ বলল অফিসার, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উদ্ধারকারী একটা ট্রাক পাঠানো হচ্ছে। তুমি স্পটে হাজির থাকবে। এখান থেকে কোন লোক পাঠানো সম্ভব নয়। সাদা একটা আলফা রোমিওর খোঁজে সবাই বেরিয়ে গেছে সারাদিনের জন্যে।’
‘ঠিক আছে, মশিয়ে,’ কনস্টেবল জানাল। ‘স্পটে থাকব আমি।’
বেলা চারটের সময় নীল আলফাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হলো উজেল-এর সরকারী যানবাহন রক্ষণাগারে। বেলা পাঁচটার সময় আইডেনটিফিকেশনের জন্যে একজন মেকানিক গাড়িটাকে চেক করতে গিয়ে আবিষ্কার করে বসল রঙটা আনাড়ী হাতে করা। স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে একটা উইংয়ে ঘষা দিল সে, অমনি নীলের নিচে ঝকঝকে সাদা রঙ দেখা গেল। হতভম্ব মেকানিক এবার পরীক্ষা করল নাম্বার প্লেটটা। দেখল উল্টোদিকেও একটা নাম্বার রয়েছে। কয়েক মিনিট পর প্লেটটাকে উল্টোমুখো হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল উঠানে, সাদা অক্ষরে পরিষ্কার লেখা রয়েছে- M।-61741. ত্রস্ত পায়ে এগোচ্ছে মেকানিক অফিসের দিকে
ছ’টার পরপরই খবরটা পেলেন ক্লড র্যাঁবো। সংবাদটা তাঁকে দিল অভার্ন-এর রাজধানী ক্লারমন্ট ফেরান্ট-এর রিজিওন্যাল হেডকোয়ার্টারের কমিশেয়ার ভ্যালমি। ভ্যালমির কথা শুনেই ঝাঁকি খেয়ে শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে উঠল ক্লড র্যাঁবোর।
‘রাইট, শোনো, ব্যাপারটা সাংঘাতিক জরুরী। কিন্তু গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।…হ্যাঁ, মাই ডিয়ার চ্যাম্পু, আমি জানি তুমি আধখানা নও, পুরো একজন কমিশেয়ার, এবং কারণ না জানিয়ে কোন কাজ তোমাকে করতে বলা নিয়ম-বিরুদ্ধ। কিন্তু এটা একটা বিশেষ পরিস্থিতি। এর সাথে জাতীয় নিরাপত্তা ও ভাল মন্দ জড়িত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন করলেই জানতে পারবে আমার নির্দেশ বিনা বাক্যে পালন করার জন্যে তোমার ওপরওয়ালাদেরকেও অনুরোধ করা হয়েছে।
কয়েক সেকেন্ড বিরতির পর কমিশেয়ার ভ্যালমি জানতে চাইল, ‘ঠিক আছে, মশিয়ে। এখন বলুন কি করতে হবে আমাকে।’
‘একটা দল নিয়ে এক্ষুণি উজেলে চলে যাও। সব ক’জন বুদ্ধিমান এবং কাজের লোক হওয়া চাই, সংখ্যায় যত বেশি সম্ভব। গাড়িটা যেখানে পাওয়া গেছে সেখান থেকে এনকোয়েরী শুরু করো। ওই বিন্দুটা থেকে চতুর্দিকে সম্ভাব্য সব জায়গায় সন্ধান নাও।’প্রত্যেক ফার্ম হাউজ, প্রত্যেক কৃষক, যারা ওই রাস্তা ধরে নিয়মিত গাড়িতে যাওয়া আসা করে, গ্রামের সব ক’টা দোকান, কাফে, সবগুলো হোটেল, সরাইখানা এবং কাঠুরেদের তাঁবুতে লোক পাঠাও।
দীর্ঘদেহী একজন লোককে খুঁজছ তোমরা। মাথায় সোনালী চুল। সম্ভবত ইংরেজ, অন্তত পাসপোর্টে তাই লেখা আছে। যে-কোন ইংরেজের মতই পরিষ্কার ইংরেজী বলে, তবে ফ্রেঞ্চ ভাষাতেও দখল আছে তার। সাথে তিনটে সুটকেস এবং একটা হ্যান্ডগ্রিপ আছে। বিস্তর টাকা রয়েছে তার কাছে। দামী পোশাক পরে। চেহারায় অনিদ্রার ছাপ থাকতে পারে।
তোমার লোকেরা প্রশ্ন করে জানতে চেষ্টা করবে কোথায় সে ছিল, কোনদিকে, কোথায় গেছে, কি কি জিনিস কেনাকাটা করেছে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ, প্রেসকে এ সম্পর্কে কিছুই জানানো চলবে না। লোকটা কোথায় আছে তা জানা মাত্র জায়গাটা ঘেরাও করে ফেলবে। কিন্তু, সাবধান, তার কাছে যাবার চেষ্টা যেন কেউ না করে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি আমি।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে একান্ত সচিবের দিকে তাকালেন ক্লড র্যাঁবো। বললেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে ফোন করো। জানাও তিনি যেন মীটিংয়ের সময় আটটায় এগিয়ে নিয়ে আসেন। তারপর এয়ারফোর্সে ফোন করে সেই হেলিকপ্টারটাকে তৈরি রাখতে বলো। রাতে আমি উজেলে যাব। হেলিকপ্টার কোথায় নামবে তাও জেনে নিয়ো। ওখান থেকে একটা গাড়ি তুলে নেবে আমাকে। এদিকটা দেখার জন্যে তোমাকে রেখে যাচ্ছি।’
গাড়িটা যেখানে পাওয়া গেছে সেখান থেকে সবচেয়ে কাছের গ্রামে সদলবলে পৌছল কমিশেয়ার ভ্যালমি, অস্থায়ীভাবে তার হেডকোয়ার্টার হয়ে উঠল জায়গাটা। সূর্য অস্ত যাই যাই করছে। রেডিওর ভ্যানে বসে দুই ডজন স্কোয়াড কারকে নির্দেশ দিচ্ছে ভ্যালমি। পাঁচ বর্গ মাইল এলাকায় সারারাত ধরে অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যাবে ঠিক করেছে সে।
.
মধ্যরাত। কমিশেয়ার ভ্যালমির একদল লোক বুদ্ধি খরচ করে একজন কৃষকের বাড়িতে গেল। গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে তারা খবর পেয়েছে এই কৃষকের নিজস্ব ট্রাক আছে। এবং প্রায়ই সে জঙ্গলের পাশের রাস্তাটা দিয়ে ঈগলটনের দিকে যায়।
ল্যাম্পের লালচে আলোয় কৃষক ঘরের দরজায় দাঁড়ানো গ্যাস্টনকে অস্বাভাবিক গম্ভীর আর সতর্ক দেখাচ্ছে।
‘শুক্রবার সকালে ওই রাস্তা দিয়ে ঈগলটনে গিয়েছিলে নাকি?’
‘হয়তো।’
‘গিয়েছিলে, না যাওনি?’
‘মনে নেই।’
‘রাস্তায় একজন লোককে দেখেছিলে?’
‘এদিক ওদিক তাকাই না আমি।’
‘সেকথা জিজ্ঞেস করছি না আমরা। কাউকে দেখেছিলে কি?’
‘না।’
‘সোনালী চুল লোকটার মাথায়, লম্বা, সুদর্শন। তিনটে সুটকেস আর একটা হ্যান্ডগ্রিপ আছে সাথে।’
‘না।’
বিশ মিনিট ধরে এই রকম চলল। পুলিসরা বুঝল, কৃষক লোকটা ভীষণ একগুঁয়ে আর কম কথার মানুষ।
পুলিসরা চলে যেতে বিছানায় ফিরে স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়ল লোকটা।
‘লিফট দিয়েছিলে যাকে, তাকে খুঁজছে ওরা, তাই না? কেন বলো তো?’
‘জানি না!’ তাচ্ছিল্যের সাথে বলল লোকটা। ‘মরুকগে শালারা! ওই শয়তানদের হাতে একজন লোককে তুলে দিতে সাহায্য করব তেমন বান্দা আমি নই!’ গরম কম্বলটা বুক পর্যন্ত টেনে নিল সে। বলল, ‘যেখানেই থাকো তুমি, দোস্ত, প্রার্থনা করি ভাল থাকো, নিরাপদে থাকো।’
.
কাগজ থেকে মুখ তুললেন ক্লড র্যাঁবো।
‘সভাকে জানাচ্ছি,’ মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি, ‘সার্চ তদারক করার জন্যে একটু পরই রওনা হয়ে যাব আমি উজেলে।’
প্রায় এক মিনিট কেউ কথা বলল না।
‘মনে হচ্ছে নতুন মোড় নিয়েছে ঘটনা,’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন। ‘এর তাৎপর্য দয়া করে ব্যাখ্যা করবেন, মশিয়ে ক্লড র্যাঁবো?’
‘তাৎপর্য দুটো, মশিয়ে। গাড়ির চেহারা বদল করার জন্যে রঙ কিনতে হয়েছে তাকে। আমার সন্দেহ, বৃহস্পতিবার রাত এবং শুক্রবার সকালের মধ্যে যদি গ্যাপ থেকে উজেলে এসে থাকে, এর আগেই গাড়ির রঙ বদলে ফেলেছিল সে। তদন্তে প্রমাণ হবে, গ্যাপে থাকতেই রঙ কিনেছিল সে। তাই যদি হয়, নিশ্চয়ই কেউ তাকে সাবধান করে দিয়েছিল এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে। হয় কেউ তাকে ফোন করেছিল, নয়তো সে কাউকে ফোন করেছিল—অপর ফোনটা কোথাকার, প্যারিসের নাকি লন্ডনের, জানা নেই আমাদের। ছদ্মনাম অরগ্যান আর ছদ্ম নেই এই খবর পেয়েছিল সে। বুঝতে পারে, বিকেলের মধ্যেই তাকে এবং তার গাড়িকে খুঁজে বের করে ফেলব আমরা। গাড়িটা পরিত্যাগ করা ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর।
একচুল নড়ছে না কেউ। ক্লড র্যাঁবোর কণ্ঠস্বর কোমল হলে কি হবে, তাঁর কথার মধ্যে যে অভিযোগ রয়েছে তা অনুধাবন করে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছে সবাই। যেন এখুনি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটবে, আশঙ্কা করছে ওরা।
কিন্তু কেউ কথা বলছে না। ক্লড র্যাঁবোর মনে হলো, অসহ্য নিস্তব্ধতার প্রচণ্ড চাপে কনফারেন্স রূমের কংক্রিটের ছাদটা ফেটে গিয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে মাথার উপর।
‘আপনি সিরিয়াস, মশিয়ে?’ কেউ যেন কয়েক লক্ষ মাইল দূর থেকে জানতে চাইল, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন এই কামরায় আমরা যারা উপস্থিত রয়েছি তাদের মধ্যে কোন ফাঁক রয়েছে, এবং সেই ফাঁক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে গোপনীয় তথ্য?’
‘তা আমি বলতে পারি না, মশিয়ে,’ ক্লড র্যাঁবো তাঁর দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন। ‘সুইচবোর্ড অপারেটর, টেলেক্স অপারেটর, মাঝের এবং নিচের এগজিকিউটিভরা রয়েছে এই সভার বাইরে, তাদের মাধ্যমে আদেশ নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে—কে জানে তাদের কেউ একজন ও-এ-এস-এর লোক কিনা।’
সবাই স্তব্ধ। আধ মিনিট পর কথা বললেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, ‘মশিয়ে র্যাঁবো, দয়া করে দ্বিতীয় তাৎপর্য সম্পর্কে কিছু বলুন আমাদেরকে।’
‘অরগ্যান হিসেবে তার পরিচয় জানাজানি হয়ে গেছে, অথচ তবু সে ফ্রান্স ত্যাগ করার চেষ্টা করেনি। বদলে সে রওনা হয়েছে ফ্রান্সের হৃৎপিণ্ডের দিকে। অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য থেকে সে একচুল নড়েনি। সহজ ভাষায় ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, গোটা ফ্রান্সের প্রশাসন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সে এককভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। নিজের কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছেন তিনি। বললেন, ‘মশিয়ে ক্লড র্যাঁবো, আপনাকে আমরা দেরি করিয়ে দেব না। ধরুন তাকে। ধরুন আজ রাতেই। যদি প্রয়োজন মনে করেন দেখামাত্র গুলি করুন তাকে। কিল হিম। প্রেসিডেন্টের নামে এই হচ্ছে আমার অর্ডার।
কথা শেষ করে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি
এক ঘণ্টা পর ক্লড র্যাঁবোকে নিয়ে আকাশে উঠল এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার কালো আকাশের নিচ দিয়ে দক্ষিণ দিকে ছুটছে সেটা।
.
‘শালা বদমাশ! ক্ষমতা হাতে পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে! ফ্রান্সের টপমোস্ট অফিশিয়াল আমরা, আমাদেরকে বলে কিনা ডাবল এজেন্ট! ঠিক আছে, প্রেসিডেন্টকে রিপোর্ট করব আমি …
উন্মুক্ত বুকে কর্নেল প্যাপনের মাথাটা তুলে নিল লুইসা পিয়েত্রো। ‘এত উত্তেজিত হয়ো না তো,’ মৃদু কণ্ঠে বলল সে। ‘বোকার মত কিছু একটা করে হাস্যাস্পদ হয়ো না। সব শুনি আগে, তারপর বলে দেব কি করতে হবে।’