এক
প্যারিস
সকাল ছ’টার একটু পর নিজের অফিসে ফিরে এলেন কমিশেয়ার ক্লড র্যাঁবো। তাঁর একান্ত সচিব চার্লস ক্যারন তখনও শার্টের আস্তিন কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে ডেস্কে বসে কাজ করছে।
ফাইলিং কেবিনেটের উপর একটা ইলেকট্রিক কফি পারকুলেটর রয়েছে, পাশেই একসার কাগজের কাপ, এক টিন কনডেন্সড মিল্ক, এবং ছোট এক ব্যাগ চিনি। নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসে প্রৌঢ় ক্লড র্যাঁবো সেদিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, ‘এক কাপ কফি হলে মন্দ হত না, কি বলো?’
সকালের তাজা বাতাস ফুর ফুর করে জানালা দিয়ে ঢুকে ক্লড র্যাঁবোর উদ্ধ- খুষ্ক একমাথা কাঁচাপাকা চুলকে আরও ফাঁপিয়ে-ফুলিয়ে দিচ্ছে। চার্লস ক্যারন বসের চেহারায় রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি লক্ষ করে তাড়াতাড়ি চেয়ার ছাড়ল।
সহকারী কফি তৈরি করছে, এই ফাঁকে ডেস্কের উপর একরাশ কাগজের ভাঁজ খুলে সেগুলোর উপর ঝুঁকে পড়লেন ক্লড র্যাঁবো, কথা বলতে শুরু করলেন, ‘গত পনেরো বছরের রেকর্ডপত্র ঘেঁটে কিছুই পাওয়া গেল না। এই সময়ের মধ্যে মাত্র একজন বিদেশী খুনী ফ্রান্সের মাটিতে তৎপর হবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আজ সে বেঁচে নেই। এই লোকটা ছাড়া ভাড়াটে চারজন খুনীর সন্ধান পেয়েছি, এদের তিনজনই জেল খাটছে এখনও, চতুর্থ জন যাবজ্জীবন খাটছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। তাছাড়া, এরা সবাই সাধারণ খুনী, ফ্রান্সের একজন প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার যোগ্যতা রাখে না।’
ফাইলিং কেবিনেটের কাছে দাঁড়িয়ে বসের দিকে ভুরু কুঁচকে, চিন্তিতভাবে তাকিয়ে আছে চার্লস ক্যারন। বলল, ‘ওর পরিচয় জানতে হলে বিদেশেই খোঁজ- খবর করতে হবে তাহলে।’
‘হ্যাঁ,’ বললেন ক্লড র্যাঁবো। ‘এ-ধরনের একজন লোক নিশ্চয়ই উপযুক্ত কোন জায়গা থেকে ট্রেনিং পেয়েছে, এবং তার অভিজ্ঞতার ঝুলিও বেশ ভারী হতে বাধ্য। দুনিয়ার সেরা একজন খুনী না হলে তাকে ও-এ এস ভাড়া করত না। প্রেসিডেন্টদেরকে না হলেও, সমমানের নিরাপত্তা প্রহরাধীন ব্যক্তিদেরকে খুন করার অভিজ্ঞতা তার না থেকেই পারে না। যাই হোক, তোমার অ্যারেঞ্জমেন্ট সম্পর্কে বলো এবার।’
বসের ডেস্কে ধূমায়িত এক কাপ কফি রেখে নিজের ডেস্কে ফিরে গেল চার্লস ক্যারন। টাইপ করা একটা কাগজ তুলে নিল সে। কাগজের ডান দিকে সাতটা দেশের নাম টাইপ করা, প্রতিটি দেশের নামের সাথে সে-দেশের হোমিসাইড ডিভিশনের প্রধান বা উপ-প্রধানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কাগজটার বাঁ দিকে কার সাথে কখন টেলিফোন যোগাযোগ করবেন ক্লড র্যাঁবো তার নির্ধারিত সময়সূচী টাইপ করা রয়েছে। বসের নির্দেশ পাবার পর নির্দেশটার অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কে কিছু ভাবনা চিন্তা করতে হয়েছে ক্যারনকে। সান্তিনো ভ্যালেন্টি রোম থেকে লন্ডনে পৌঁচেছে, সুতরাং, ক্লড র্যাঁবো তার খোঁজ ইংল্যান্ডের কাছেই চাইবেন, এটা বুঝতে তার অসুবিধে হয়নি। তাই সবার আগে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ক্রাইম সেকশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের সাথে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করেছে সে। সান্তিনো ভ্যালেন্টির আসল পরিচয় কি জানার জন্যে বাকি ছয়টা দেশের সাথে যোগাযোগ করবেন বস্, এটা বুঝতেও অসুবিধে হয়নি তার।
‘মশিয়ে,’ ক্যারন বলল, ‘লন্ডন মেট্রোপলিটান পুলিসে আলাদা কোন হোমিসাইড সেকশন নেই, তাই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ক্রাইম সেকশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর…’
‘খুব ভাল করেছ,’ মুচকি হেসে বললেন ক্লড র্যাঁবো। অ্যান্থনী গ্যালিভার আমার বিশেষ বন্ধু। অনুরোধ করলে গোপনীয়তা রক্ষা করবে, এ বিশ্বাস করা যায়। ক’টার সময়?’
‘সাড়ে সাতটা।’
তোমার তালিকায় সবশেষে কে রয়েছেন?’
‘ইটালির বিলি গফ,কমিশনার হোমিসাইড ডিভিশন, সাড়ে দশটায়।’
রিস্টওয়াচ দেখলেন ক্লড র্যাঁবো। শেষ চুমুক দিলেন কফির কাপে। একটা নতুন চুরুট ধরালেন। লালচে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িতে চোখ বুজে হাত বুলালেন ক’বার। তারপর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কি জানো, আসলে কাজটা তেমন কঠিন নয়। কিন্তু আমি অদৃশ্য একটা হাতের কারসাজি অনুভব করছি। কি যেন লুকানো হচ্ছে আমাকে। যাই হোক, এটা আমার সন্দেহপ্রবণ মনের অনুমান মাত্র, সত্য নাও হতে পারে। চলো, বেরিয়ে পড়া যাক এবার।
বসের কথা শুনে বিস্মিত হলো ক্যারন। কিন্তু যতটুকু তিনি বলেন তার বেশি জানার কৌতূহল কেউ প্রকাশ করলে তিনি বিরক্ত হন, একথাটা জানা থাকায় বসকে সে কোন প্রশ্ন করল না। নতুন একটা চিন্তার খোরাক পাওয়া গেছে, এতেই সে খুশি।
লন্ডন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। ক্রাইম সেকশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অ্যান্থনী গ্যালিভার টেলিফোনের রিসিভার রেখে কয়েক সেকেন্ড পাথরের মূর্তির মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কপালে চিন্তার রেখা, গভীর তন্ময়তার সাথে কি যেন ভাবছে। ‘মাই গড!’ অস্ফুটে বিস্ময় ধ্বনি বেরিয়ে এল তার গলা থেকে। মাথা নিচু করে দ্রুত বেরিয়ে এল সে কমিউনিকেশন রূম থেকে। একসাথে তিনটে করে সিঁড়ির ধাপ টপকে উঠে গেল দোতলায়, নিজের অফিসে।
খবরটা হজম করার জন্যে পাঁচ মিনিট সময় নিল সে। এমন একটা দুনিয়া কাঁপানো সংবাদ, অথচ বন্ধু ক্লড র্যাঁবো তার কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছেন, এ-খবর ছড়ানো চলবে না। মুচকি একটু হাসল অ্যান্থনী গ্যালিভার। ছড়াতে হবে না, এ খবরের গায়ে পাখা গজাবে।
পার্সোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, একজন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরকে ডেকে পাঠাল সে। কালো কমপ্লিট স্যূট পরা পি-এ, হাতে নোট বুক নিয়ে তখুনি এসে পৌঁছল।
‘এক্ষুণি সেন্ট্রাল রেকর্ডে যাও। কথা বলবে স্বয়ং চীফ সুপারিনটেনডেন্টের সাথে। বলবে, এটা আমার ব্যক্তিগত অনুরোধ, এই মুহূর্তে এর বেশি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। কাজটা হলো, এ-দেশের জীবিত সব ক’টা পেশাদার আততায়ী সম্পর্কে…
‘আততায়ী, স্যার?’ চোখ কপালে উঠে গেল পি-এ-র
‘হ্যাঁ, আততায়ী, অ্যান্থনী গ্যালিভার গম্ভীর হয়ে বলল, ‘সাধারণ খুনী নয়, কড়া নিরাপত্তাধীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, দেশের মাথা—এদেরকে খুন করার যোগ্যতা রাখে এমন একজন আততায়ীকে খুঁজছি আমরা।
কিন্তু, স্যার, এ-ধরনের কাজ সাধারণ স্পেশাল ব্রাঞ্চ …’
‘জানি,’ বলল অ্যান্থনী গ্যালিভার। ‘রুটিন চেক শেষ করে স্পেশাল ব্রাঞ্চকেই দেব দায়িত্বটা। শোনো, দুপুরের আগে রেজাল্ট পেলে খুশি হব, চীফ সুপারিনটেনডেন্টকে এ-কথাটা জানাতেও ভুলো না।
‘ইয়েস, স্যার।’
পি-এ বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর পরই অ্যান্থনী গ্যালিভার ফোন করল স্পেশাল ব্রাঞ্চের চীফ অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ওয়ার্ডকে। ওয়ার্ড জানাল দশ মিনিটের মধ্যে ছুটি নিয়ে গলফ খেলতে রওনা হবে সে। গ্যালিভার বলল, ‘সিরিয়াস টাইপের টপ সিক্রেট ব্যাপার। প্রধান মন্ত্রীর বিদেশী বন্ধুর বিপদ।
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর স্পেশাল ব্রাঞ্চের চীফ বলল, ‘কি চাও তুমি?’
‘আধ ঘণ্টার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট।’
‘চলে এসো।’
আধঘণ্টার জায়গায় দেড় ঘণ্টা স্থায়ী হলো ওদের আলোচনা। দ্রুত গরম কফি খেতে গিয়ে দু’জনেরই জিভ পুড়ে গেল। স্পেশাল ব্রাঞ্চের দায়িত্ব দেশীয় এবং দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে আগত বিদেশী রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুতরাং সম্ভাব্য পলিটিক্যাল কিলার সম্পর্কে তাদের জ্ঞান স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অন্য যে-কোন শাখার চেয়ে অনেক বেশি। ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখার আগেই অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ওয়ার্ড অ্যান্থনী গ্যালিভারকে নিরাশ করল।
বলল, ‘ফ্রান্স যে-ধরনের খুনীকে খুঁজছে সে ধরনের কোন খুনীকে ইংল্যান্ড জন্ম দেয়নি, থ্যাঙ্কস গড। সান্তিনো ভ্যালেন্টি ব্রিটিশ নয়, এ আমি হলপ করে বলতে পারি। তবে, সাবধানের মার নেই, তাই ফাইল পত্র ঘেঁটে দেখব। তার আগে সান্তিনো ভ্যালেন্টির খবর যোগাড় করার জন্যে একজন ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্টকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছি। তারও আগে জানতে চাই, ব্যাপারটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানালে আমাদের ওপর ভবিষ্যতে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে বলে মনে করো তুমি?’
অ্যান্থনী গ্যালিভার হাসল। বলল, ‘ক্লড র্যাঁবো আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে, সে-দায়িত্ব আমি তোমার কাছে হস্তান্তর করছি। এ-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার মালিক তুমি। প্রতিক্রিয়া বিরূপ হবে মনে করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারো। তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে না জানাবারই অনুরোধ করব তোমাকে।
‘কেন?’
‘দরকার মনে করলে ফ্রান্সের উর্ধ্বতন মহল থেকেই আমাদের ঊর্ধ্বতন মহলকে জানানো হবে,’ -বলল অ্যান্থনী গ্যালিভার। ব্যাপারটা এখনও বোধহয় তেমন গুরুত্ব লাভ করেনি। তাই তারা জানাতে চাইছে না।’
‘হুঁ’ গম্ভীর হলো স্পেশাল ব্রাঞ্চের চীফ। কিন্তু এ ব্যাপারে তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সে সম্পর্কে কোন আভাস দিল না।
অ্যান্থনী গ্যালিভার বিদায় নিয়ে নিজের অফিসে ফিরে এল। লাঞ্চের আগেই স্পেশাল ব্রাঞ্চের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ফোনে তাকে জানাল, আমার অনুমানই সত্য। আমাদের রেকর্ডে প্রথম শ্রেণীর পলিটিক্যাল কিলার একজনও নেই।
‘কুড র্যাঁবোর তদন্ত পরিচালনা পদ্ধতি চিরকালই উদ্ভট, জানোই তো,’ ক্রাইম সেকশনের অ্যান্থনী গ্যালিভার বলল, ‘লোকটাকে ধরা ওর কাছে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার লোকটার জন্ম, দেশ, নাগরিকত্ব, অভিজ্ঞতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা। যাই হোক, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে যেটার ওপর, সে-ব্যাপারে আমরা ওকে সাহায্য করতে পারছি না, একথা ওকে জানিয়ে দেব আমি। সান্তিনো ভ্যালেন্টির ব্যাপারে কি জানাব ওকে? স্পেশাল ব্রাঞ্চ কি লোকটাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিচ্ছে?’
‘অবশ্যই,’ ওয়ার্ড জানাল, ‘ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট ম্যালকম লয়েডকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি আমি। দায়িত্বটা জাতীয় গুরুত্ব বহন করছে, পরিষ্কার বুঝেছে সে। ইতিমধ্যে দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাজে।
‘ধন্যবাদ, ওয়ার্ড,’ স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল অ্যান্থনী গ্যালিভার নিজের কাঁধ থেকে ঝামেলাটা নেমে যাওয়ায় আরাম বোধ করছে সে। ‘এ ব্যাপারে ম্যালকম লয়েডই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি, কোন সন্দেহ নেই।
অ্যান্থনী গ্যালিভারের পি-এ সেন্ট্রাল রেকর্ড থেকে নিরাশ হয়ে ফিরে এল লাঞ্চ আওয়ারে। তার কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল গ্যালিভার। এবার প্যাড আর কলম টেনে নিয়ে মেসেজ লিখতে বসল সে। লিখল, ‘আজকের তারিখে আপনার বিশেষ অনুরোধের উত্তরে জানাচ্ছি সমস্ত ক্রিমিন্যাল রেকর্ডপত্র খুঁজেও সে ধরনের কোন ব্যক্তির সন্ধান আমরা পাইনি। আরও তথ্যানুসন্ধানের জন্যে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ছদ্মনামধারী লোকটাকে খুঁজে বের করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট ম্যালকম লয়েড। কোন সুখবর পাওযা মাত্র তিনি আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন।’ মেসেজ পাঠাবার সময়— ‘১২ অক্টোবর, বেলা সাড়ে বারোটা।
ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে দুপুর ঠিক বারোটার সময় রানাকে নিয়ে নামল প্লেন। মেইন টার্মিন্যাল বিল্ডিংয়ের একটা অটোমেটিক লকারে সুটকেস তিনটে রেখে শহরে ঢুকছে ও। সাথে থাকছে শুধু হ্যান্ডগ্রিপটা, তাতে নিত্য ব্যবহার্য ব্যক্তিগত জিনিস ছাড়া রয়েছে প্লাস্টার অভ প্যারিস, কটন উলের প্যাড এবং ব্যান্ডেজ। ট্যাক্সি নিয়ে মেইন রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছল ও, ট্যাক্সিকে বিদায় করে দিয়ে হাজির হলো লেফট লাগেজ অফিসে
রাইফেল ভরা ফাইভার সুটকেসটা একহপ্তা আগে কেরানী যে শেলফে তুলে রেখেছিল সেখানেই পড়ে রয়েছে দেখতে পেল রানা। স্লিপ দেখিয়ে সুটকেসটা ফেরত নিল ও। বাইরে বেরিয়ে এসে স্টেশনের কাছাকাছি ঘুর ঘুর করে সস্তা, নোংরা একটা হোটেল খুঁজে বের করল। দুনিয়ার সব প্রধান রেলওয়ে স্টেশনের কাছেপিঠে এই ধরনের হোটেল থাকে, যেখানে বোর্ডারদেরকে কোন অহেতুক প্রশ্ন করা হয় না, নগদ পয়সা ঢাললে যে-কেউ এখানে আশ্রয় এবং আহারের নিশ্চয়তা পেতে পারে।
শুধু এক রাতের জন্যে সিঙ্গেল একটা কামরা ভাড়া নিল রানা। স্থানীয় বেলজিয়ান টাকায় অগ্রিম মিটিয়ে দিল ভাড়া (এয়ারপোর্টে নেমেই কিছু ব্রিটিশ মুদ্রা বেলজিয়ান মুদ্রায় রূপান্তরিত করে নিয়েছে ও)। পোর্টারের সাহায্য না নিয়ে সুটকেসটা নিজেই বয়ে নিয়ে গেল দোতলায় নিজের কামরায়। কামরায় ঢুকে প্রথমেই ভাল ভাবে বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল দরজায়। বেসিনের ঠাণ্ডা পানির কল ছেড়ে দিয়ে হ্যান্ডগ্রিপ থেকে বের করল প্লাস্টার এবং ব্যান্ডেজ। তারপর কাজে বসল।
কাজ শেষ করার পর দু’ঘণ্টার উপর সময় লাগল প্লাস্টারটা শুকাতে। দীর্ঘ এই সময়টা শান্তশিষ্ট লক্ষ্মী ছেলের মত ভারী পা-টা একটা টুলের উপর তুলে বসে রইল রানা। ফিলটার টিপড্ সিগারেট পোড়াল কয়েকটা, জানালা দিয়ে তাকিয়ে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘের গায়ে শিশুর মত সরল একটা বয়স্ক লোকের মুখ দেখল বারবার। অদ্ভুত একটা জ্বালা অনুভব করছে ও। গিলটি মিয়া, সালমা, সালমার প্রেমিক—এদের কথা মনে পড়লেই মাথায় আগুন ধরে যায় ওর, শরীরের ভিতর শিরায় উপশিরায় অন্ধ আক্রোশে ছুটোছুটি শুরু করে দেয় রক্ত প্রবাহ। এই প্রতিক্রিয়া শুভ লক্ষণ নয়, জানে রানা। তাই ভয় পায়। ভাবাবেগ প্রশ্রয় পেলে কাজে ভুল থেকে যাবার সম্ভাবনা বাড়বে। এই কাজটায় অন্তত কোন ভুল করার ঝুঁকি নিতে চায় না রানা। মেঘের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ও। বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে পরীক্ষা করল আবার প্লাস্টারটা। না, আরও শক্ত না হলে পা-টা নাড়াচাড়া করা উচিত হবে না।
রাইফেল ভরা ফাইবার সুটকেসটা এখন খালি অবস্থায় পড়ে আছে মেঝেতে। হঠাৎ যদি মেরামতের কাজে কখনও দরকার হয় ভেবে অবশিষ্ট কয়েক আউন্স প্লাস্টারের সাথে বেঁচে যাওয়া খানিকটা ব্যান্ডেজ় হ্যান্ডগ্রিপে ভরে রেখেছে সে। সোয়া দুই ঘণ্টা পর প্লাস্টারটা পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলো রানা। লোহার মত শক্ত হয়ে গেছে জিনিসটা। দুহাত দিয়ে ধরে ধীরে ধীরে টুল থেকে নামাল ভারী পা-টা। দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল, সামলে নিল কোনমতে। হাঁটতে গিয়ে হেসে ফেলল রানা। ভান করার দরকার হবে না, এমনিতেই খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে তাকে। সস্তা দরের ফাইবার সুটকেসটা খাটের নিচে ঢুকিয়ে দিল ও, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করল কামরায় এমন কিছু থেকে যাচ্ছে কিনা যা সন্দেহের কারণ হতে পারে। সিগারেটের অবশিষ্টাংশ আর ছাই জানালা গলিয়ে ফেলে দিয়ে যথাস্থানে রেখে দিল অ্যাশট্রেটা। তারপর তৈরি হলো বেরিয়ে পড়ার জন্যে।
সিঁড়ির নিচে নেমে ডেস্কের পিছনের কামরায় কেরানীকে বসে লাঞ্চ খেতে দেখে খুশি হলো রানা। কিন্তু হলঘর থেকে বেরিয়ে যাবার দরজা মাত্র একটাই. এবং সেটার কাছে যেতে হবে ডেস্কের পাশ ঘেঁষে, তখন এদিকে তাকালে তাকে পরিষ্কার দেখতে পাবে লোকটা। কামরার ভিতর থেকে ওর পা দেখতে না পেলেও, এগোবার ভঙ্গি দেখেই টের পেয়ে যাবে খুঁড়িয়ে হাঁটছে ও। খানিক আগে যে লোককে দিব্যি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে দেখেছে তাকে খোঁড়াতে দেখলে বিস্মিত হবে সে, হয়তো খাবার ফেলেই ছুটে বেরিয়ে আসবে ব্যাপার কি জানার জন্যে। ঝুঁকিটা নিতে রাজি নয় রানা। বেরিয়ে যাবার দরজা দিয়ে কেউ ঢুকছে না, লক্ষ করল ও। কাঁচের কবাট দুটোর উপর চোখ রেখে হ্যান্ডগ্রিপটা বুকের সাথে চেপে ধরে দুই হাতের কনুই আর দুই পায়ের হাঁটু মেঝেতে রাখল ও, হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে এগোল।
ডেস্কের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে উঠে দাঁড়াল রানা। কাঁচের কবাট খুলে বেরিয়ে এল ঝাঁ ঝাঁ রোদে।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মেইন রোড পর্যন্ত হেঁটে এল রানা। ঝড় তুলে ধাবমান একটা ট্যাক্সি ঘ্যাঁচ্ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল ওর সামনে। সেটায় উঠে পড়ল রানা। আবার ছুটে চলল ট্যাক্সি এয়ারপোর্ট অভিমুখে।
হাতে পাসপোর্ট নিয়ে আলিটালিয়া এয়ার-লাইন্সের কাউন্টারে হাজির হলো রানা। মেয়েটার মুখে কোমল, মমতা মাখানো সহানুভূতির হাসি ফুটল।
অরগ্যানের নামে মিলানের একটা টিকেট রিজার্ভ করা হয়েছে দু’দিন আগে, দেখো তো,’ বলল রানা।
বিকেলের মিলান ফ্লাইটের বুকিং চেক করে দেখল মেয়েটা। দেড় ঘণ্টা পর ছাড়বে প্লেন। ‘হ্যাঁ, মশিয়ে,’ বলল সে। ‘টিকেট রিজার্ভ করা হয়েছে, কিন্তু দাম দেয়া হয়নি। এখন দেবেন?’
এখানেও নগদ টাকা দিয়ে টিকেট নিল রানা। একজন পোর্টারের সাহায্যে লকার থেকে সুটকেস তিনটে আনিয়ে নিয়ে কাস্টমস শেডে ঢুকল। বেলজিয়াম ত্যাগ করছে ও, সুতরাং চেকিংটা তেমন খুঁটিয়ে করা হলো না, শুধু পাসপোর্ট দেখে ছাড়পত্র দেয়া হলো ওকে। প্যাসেঞ্জার ডিপারচার লাউঞ্জের কাছে একটা রেস্তোরাঁয় বসে ধীরেসুস্থে লাঞ্চ খেয়ে হাতের সময়টা ব্যয় করল ও।
এই ব্যস্ততার যুগেও মানুষের দুর্দশা দেখে মানুষ কাতর হয়, তার প্রমাণ পাচ্ছে রানা। ওর পায়ের অবস্থা দেখে সবাই ওর সাথে অযাচিত ভাবে ভাল ব্যবহার করছে। কোচে ওঠার সময় অনেকগুলো সাহায্যের হাত এগিয়ে এল। প্লেনের কাছে কোচ থামতে সবাই নামতে সাহায্য করতে চাইলেও সবিনয়ে জানাল রানা, একাই নামতে পারবে সে। সিঁড়ি বেয়ে প্লেনের দরজা পর্যন্ত উঠতে অস্বাভাবিক সময় নিল রানা। ওর চোখমুখ দেখে কারও বুঝতে বাকি থাকল না যে বেচারার ভারি কষ্ট হচ্ছে। সুন্দরী ইটালিয়ান এয়ারহোস্টেস ওর হাত ধরে মৃদু চাপ দিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করল, ওকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে প্লেনের মাঝখানে দুই সারি মুখোমুখি সীটের একটিতে বসিয়ে দিল, এখানে পা নাড়াচাড়া করার জন্যে সবচেয়ে বেশি জায়গা রয়েছে।
আরোহীরা রানার সামনে দিয়ে নিজেদের সীটে যাবার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে, যাতে রানার পায়ের সাথে ধাক্কা-টাক্কা লেগে না যায়। রানা ওদিকে সীটে হেলান দিয়ে হাসছে, সবাইকে বোঝাতে চাইছে নিজের দুর্দশায় মন খারাপ করে নেই সে।
চারটে পনেরো মিনিটে প্লেন আকাশে উঠল। এয়ারপোর্টটাকে একপাক ঘুরে দক্ষিণ-মুখো হয়ে উড়ে চলল মিলানের দিকে।
.
লন্ডন। বারোই অক্টোবর। দুপুর একটা।
কাজ-পাগল লোক বলতে যা বোঝায়, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট ম্যালকম লয়েড ঠিক তাই। দীর্ঘদেহী, ক্লিনশেভ, উন্নত নাসিকার অধিকারী ম্যালকম লয়েডের সবচেয়ে বড় গুণ কোন্ কাজের কি গুরুত্ব তা বুঝতে কখনও সে ভুল করে না। কাজটা যত বড়ই হোক, যত জটিল আর অসম্ভব বলেই মনে হোক, ভয় পায় না সে।
চীফের কাছ থেকে নতুন দায়িত্বটা বুঝে নিয়ে দ্রুত নিজের অফিসে ফিরে এল সে। চেহারার বর্ণনা, ছদ্ম একটা নাম—ব্যস, এর বেশি কিছু জানানো হয়নি তাকে। কুছ পরোয়া নেই, কাজ শুরু করার জন্যে এটুকুই তার জন্যে যথেষ্ট। নিজস্ব নিয়মে লোকটাকে সে খুঁজে বের করে ফেলবে, এ আত্মবিশ্বাস তার আছে।
রিসার্চের কাজ করছে এমন দু’জন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরকে হাতের কাজ বাক্সবন্দী করে রাখার নির্দেশ দিয়ে ডেকে পাঠাল সে। যাকে খুঁজতে হবে তার চেহারার বর্ণনা দিল, ছদ্মনামটা জানাল, কিন্তু কেন তাকে খোঁজা হচ্ছে তা বলল না! ঠিক কোন্ সূত্র ধরে এগোতে হবে সে-সম্পর্কেও নির্দিষ্ট নির্দেশ পেল তারা ডিটেকটিভ সুপারিনটেনডেন্ট ম্যালকম লয়েডের কাছ থেকে।
কাজ বুঝিয়ে দেবার এমনই গুণ, ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর দু’জন দায়িত্বটাকে জলবৎ তরলং জ্ঞান করল। সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে তারা পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চি লম্বা সান্তিনো ভ্যালেন্টিকে খুঁজে বের করে ফেলবে, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল কাজে।
.
মিলান। লিনেট এয়ারপোর্টে রানার প্লেন নামল বিকেল ছ’টার একটু পর। সিঁড়ির পাদদেশে নামতে ওকে সাহায্য করল মমতাময়ী এয়ারহোস্টেস মেয়েটা। টারমাক থেকে ওর হাত ধরে মেইন টার্মিন্যাল বিল্ডিংয়ে নিয়ে এল একজন গ্রাউন্ড হোস্টেস।
পাসপোর্ট চেকিংটা স্রেফ একটা অনুষ্ঠানিকতা মাত্র, বিনা ঝামেলায় চুকে গেল। এরপরই শুরু হলো বিপজ্জনক কাস্টমস চেকিং। মুহূর্তে বুঝে নিল রানা, রাইফেলের পার্টসগুলো এত যে কায়দা করে লুকানো হয়েছে, এখনই প্রমাণ হয়ে যাবে তার কোন প্রয়োজন ছিল কিনা, এবং লুকাবার কায়দাটা নিখুঁত হয়েছে কিনা। হোল্ড থেকে সুটকেসগুলো নিয়ে এসে রাখা হলো কাস্টমস বেঞ্চে। হ্যান্ডগ্রিপটা আগেই রানা রেখেছে ওখানে।
প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে ঝুঁকি। রানার মুখ দেখে কেউ কিছু টের পাচ্ছে না. কিন্তু বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করছে ওর। ট্রাউজারের দু’পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে ঘামে ভেজা হাত দুটো কাপড়ের উপর দিয়ে উরুর সাথে ঘসে মুছে নিচ্ছে রানা। ঢোক গিলে হাত দুটো বের করল। ইঙ্গিতে একটা পোর্টারকে ডেকে সুটকেস তিনটেকে এক সারিতে সাজিয়ে রাখতে বলল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোল ও। আশ্চর্য ভারী আর অবশ লাগছে শরীরটা। টেবিলে বসা একজন তরুণ কাস্টমস অফিসার মুখ তুলে তাকাল। রানার চেহারাটা বোধহয় পছন্দ হলো না তার, কেমন যেন ভারী হয়ে উঠল মুখটা।
‘সিনর, এর সবগুলোই আপনার ব্যাগেজ?’ রুক্ষ গলায় প্রশ্ন করল অফিসার ।
‘হ্যাঁ, তিনটে স্যুটকেস আর একটা হ্যান্ডগ্রিপ।’
আইন সম্মত নয় এমন কিছু সাথে আছে?
‘না, নেই’।’
ভ্রমণের উদ্দেশ্য, সিনর? বিজনেস?’
‘না, ছুটিতে বেড়াতে এসেছি। ইচ্ছা আছে লেকের পাড়ে বসে মাছেদের সাথে সময় কাটাব।’
তরুণ কাস্টমস অফিসারের গাম্ভীর্য অম্লান। হাত পাতল সে। ‘পাসপোর্ট দেখি।’
পকেট থেকে পাসপোর্টটা বের করে অফিসারের হাতে দিল রানা। দেবার সময় চোখাচোখি হলো। লক্ষ করল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর মুখের উপর তাকিয়ে মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে লোকটা। পাসপোর্টটা হাতের তালুতে পড়তেও চোখ নামাল না সে। আরও কয়েক সেকেন্ড অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারপর তাকাল পাসপোর্টের দিকে। খুঁটিয়ে, গভীর মনোযোগের সাথে পরীক্ষা করল সেটা। কোন খুঁত আবিষ্কার করতে না পেরেই যেন মেজাজ তার আরও এক ডিগ্রী চড়ে গেল। অবশ্য চেহারাতেই শুধু তার ছাপ পড়ল, মুখে কিছু বলল না। পাসপোর্টটা নিঃশব্দে ফিরিয়ে দিল সে রানাকে।
‘ওটা খুলুন,’ বড় তিনটে সুটকেসের একটার দিকে আঙুল তুলে বলল সে।
কোনরকম ব্যস্ততা বা জড়তা প্রকাশ পেল না রানার আচরণে। ঠোঁটে একটা সিগারেট তুলেছিল, কিন্তু ধরানো হয়নি। প্রথমে সেটায় আগুন ধরাল। তারপর চাবির গোছা বের করে রিঙ থেকে বেছে নিল নির্দিষ্ট একটা চাবি, খুলে দিল সুটকেসটা। পোর্টার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, হাত বাড়িয়ে সে-ই সুটকেসের ডালাটা তুলে সরিয়ে দিল পিছন দিকে
‘নামাও সব,’ কর্কশ গলায় হুকুম করল পোর্টারকে অফিসার। ।
খুশি হয়ে উঠল রানার মন। ভাগ্য সম্ভবত বেঈমানী করবে না, ভাবছে ও, ছোকরা অফিসার নিজের হাতে চেক করছে না স্যুটকেসগুলো। ওর খুশি হবার আরেকটা কারণ, ডেনিশ ধর্মযাজক এবং আমেরিকান ছাত্রের কাপড়-চোপড় ছাড়া সুটকেসটায় বিশেষ কিছু নেই। ডার্ক-গ্রে সুট, আন্ডারঅয়্যার, সাদা শার্ট, স্নেকার, কালো ওয়াকিং জুতো, উইন্ডচিটার, মোজা ইত্যাদি দেখতে দেখতে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসল অফিসারকে। ডেনিশ ভাষার বইটাও উত্তেজিত করতে পারল না তাকে। উঁকি মেরে খালি সুটকেসটা দেখল বটে একবার, কিন্তু সাইড লাইনিংয়ের উপর সযত্নে করা রানার দ্বিতীয় সেলাইটা তার চোখেই পড়ল না, অতএব নকল পরিচয়পত্রগুলো প্রকাশ হয়ে পড়ার কোন আশঙ্কা দেখা দিল না। খোঁজার মত খুঁজলে ওগুলো বেরিয়ে পড়বে, জানে রানা, কিন্তু এও জানে যে এক নজরে দেখার সময় সন্দেহজনক কিছু চোখে না পড়লে কোন কাস্টমস অফিসারই খোঁজার মত করে খোঁজার কষ্টটুকু স্বীকার করে না।
স্বয়ংসম্পূর্ণ রাইফেলের বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যার যার গোপন খোপে মাত্র তিন ফিট দূরে টেবিলের এপারে রয়েছে, কিন্তু অফিসারের মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। পোর্টারকে ইঙ্গিত করল সে। পোর্টার দ্রুত এবং সযত্নে আবার সব তুলে রাখতে শুরু করল সুটকেসে।
পোর্টারকে দিয়েই বাকি দুটো সুটকেস এবং হ্যান্ডগ্রিপটা চেক করল ইটালিয়ান অফিসার। ইতোমধ্যে রানার প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে সে। মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে, বেশ একটু তাচ্ছিল্যের সাথেই হাত নেড়ে জানিয়ে দিল, পরীক্ষা করা শেষ হয়েছে, আপদ এবার বিদায় হতে পারে।
ট্যাক্সিতে চড়ে মোটা বকশিশ দিল পোর্টারকে রানা। সগর্জনে ধাবমান হাজার হাজার যানবাহনের স্রোতে মিশে গেল ওর ট্যাক্সি। মিলান শহরটার প্রায় কিছুই দেখা হলো না, ট্যাক্সি পৌঁছে গেল সেন্ট্রাল স্টেশনে।
এখানে আরেকজন পোর্টারের সাহায্য নিল রানা। লোকটাকে সাথে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাজির হলো লেফট-লাগেজ অফিসে। ট্যাক্সিতে থাকতেই হ্যান্ডগ্রিপ থেকে ইস্পাতের কাঁচিটা বের করে পকেটে ভরে নিয়েছে ও। লেফট-লাগেজ অফিসে হ্যান্ডগ্রিপ এবং দুটো সুটকেস জমা রাখল, সাথে রাখল লম্বা ফ্রেঞ্চ মিলিটারি ওভারকোট ভরা সুটকেসটা। এটায় এখনও প্রচুর জায়গা খালি পড়ে আছে।
আলজিরীয় পোর্টারকে আসসালামালেকুম জানিয়ে পুরুষদের টয়লেটে ঢুকল রানা। বাঁ দিকের ওয়াশবেসিনগুলোর পাশে প্রস্রাবের কমোডে এক লোক দাঁড়িয়ে পানি ছাড়ছে। সুটকেসটা রেখে একটা বেসিনের সামনে দাঁড়াল রানা। কল ছেড়ে দিয়ে ঘষে ঘষে হাত ধুচ্ছে। কিন্তু যেই প্যান্টের বোতাম আঁটতে আঁটতে বেরিয়ে গেল লোকটা অমনি সুটকেসটা তুলে নিয়ে সবচেয়ে কাছের একটা ল্যাট্রিনে ঢুকে পড়ে দ্রুত বন্ধ করে দিল দরজাটা।
ল্যাভেটরি সীটের উপর পা তুলে দিয়ে প্লাস্টার খসাতে শুরু করল রানা। নিঃশব্দে দশ মিনিট চেষ্টার পর পা-টা তুলোর প্যাড আর প্লাস্টার মুক্ত হলো। সিল্কের মোজা আর সরু লেদার মোকাসিন জোড়া পায়ে গলিয়ে নিল ও। প্যাড আর প্লাস্টারের জঞ্জালগুলো ফেলে দিল প্যানে।
টয়লেটের উপর সুটকেসটা রেখে খুলল সেটা রানা। গোল ইস্পাতের টিউবগুলো ওভারকোটের ভাঁজের ভিতর পাশাপাশি সাজিয়ে রাখল। ভরাট হয়ে গেছে সুটকেস, ভিতরের স্ট্র্যাপ টান টান হয়ে উঠেছে, ঝাঁকি খেলেও টিউবগুলো পরস্পরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ধাতব আওয়াজ তুলবে না।
সুটকেসটা বন্ধ করে নিজের চারদিক ভাল করে দেখে নিল একবার রানা, কিছুই পড়ে নেই। নিঃশব্দে খুলল এবার দরজাটা। কবাট দুটো আধ ইঞ্চি ফাঁক করে বাইরে তাকিয়ে দেখল চারজন লোক ওর দিকে পিছন ফিরে ওয়াশবেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আরও দু’জন বেরিয়ে যাচ্ছে।
নিঃশব্দে কবাট দুটো আরও উন্মুক্ত করল রানা, চৌকাঠ পেরোল, তারপর পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল টয়লেট থেকে।
ভাল পা নিয়ে এখন আর লেফট-লাগেজ অফিসে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই একজন পোর্টারের সাহায্য নিল রানা। তাকে ব্যাখ্যা করে বলল, হাতে সময় কম, টাকা ভাঙিয়ে, সুটকেসগুলো উদ্ধার করে দ্রুত ট্যাক্সি ধরতে হবে ওকে। কাগজের স্লিপটার সাথে এক হাজার লিরার একটা নোট পোর্টারের হাতে গুঁজে দিয়ে লেফট- লাগেজ অফিসের কেরানীটাকে চোখ-ইশারায় দেখিয়ে দিল। বলল, ইংলিশ পাউন্ড লিরায় রূপান্তরিত করার জন্যে ওদিকের কাউন্টারে যাচ্ছে ওঁ।
সানন্দে ঘাড় নেড়ে লেফট-লাগেজ অফিসের দিকে চলে গেল পোর্টার কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ইংলিশ পঁচিশ পাউন্ডের বিনিময়ে ইটালিয়ান মুদ্ৰা নিল রানা, এই সময় বাকি তিনটে লাগেজ নিয়ে ফিরে এল পোর্টার।
দু’মিনিট পর। মেইন রোড p।azza Duca d’ Aosta-এর উপর দিয়ে বিপজ্জনক গতিতে হোটেল কন্টিনেন্টালের দিকে ছুটছে রানার ট্যাক্সি।
হোটেলের ফ্রন্ট হলে রজনীগন্ধার মত ধবধবে সাদা পোশাক পরা গোলাপের মত লাল টুকটুকে রিসেপশনিস্ট মেয়েটা ওকে দেখে নিঃশব্দে এক পশলা হাসি ছড়াল।
দু’দিন আগে লন্ডন থেকে ফোনে অরগ্যানের নামে একটা কামরা রিজার্ভ করা হয়েছে,’ বলল রানা।
‘আপনি?’
‘অরগ্যান।
এক মিনিটের মধ্যে নিজের কামরায় পৌঁছে গেল রানা। আটটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে মনের সুখে ভিজল ও। দাড়ি কামাল। দুটো সুটকেস ওয়ারড্রোবে ভরে সাবধানে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ওর কাপড়- চোপড়ে ভরাট হয়ে থাকা তৃতীয় সুটকেসটা খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে বিছানায় আজ রাতে পরার জন্যে নেভী-ব্লু উল-অ্যান্ড-মোহায়ের সামার লাইটওয়েট স্যুটটা ওয়ারড্রোবের বন্ধ দরজার গায়ে ঝুলছে। ডাভ-গ্রেরঙের স্যুটটা স্পঞ্জ ও ইস্ত্রী করার জন্যে তুলে দেয়া হয়েছে হোটেলের ভ্যালিটের জিম্মায়।
আজ আর হাতে কোন কাজ নেই রানার। ককটেল নিয়ে বসবে ও ডিনার খাবে, এবং বেশি রাত না করে ঘুমিয়ে পড়বে—–কেননা পরদিন, তেসরা অক্টোবর, সাংঘাতিক ব্যস্ততার মধ্যে কাটবে ওর।