সেই উ সেন – ১.৯

নয়

মঙ্গলবার।

ঠিক এগারোটার সময় প্যারিসগামী বিমানে উঠে বসল বিশালদেহী ম্যাটাপ্যান। অবজারভেশন টেরেস থেকে কর্নেল বোল্যান্ডের দু’জন এজেন্ট ম্যাটাপ্যানকে প্লেনের পেটের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল। আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করল ওরা। প্লেন আকাশে উঠল ঠিক এগারোটা পনেরো মিনিটে। লোক দু’জন মেন হলরূমে নেমে এসে একটা টেলিফোন বুদে ঢুকল। রোমের স্থানীয় একটা নাম্বারে ডায়াল করছে একজন, আরেকজন বুদের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে।

অপর প্রান্তের লোকটা নিজের পরিচয় দিল না। শুধু জানতে চাইল, ‘এয়ারপোর্ট থেকে?

কর্নেল বোল্যান্ডের এজেন্ট বলল, ‘হ্যাঁ। রওনা হয়েছে ও। আলিটালিয়া ফোর-ফাইভ-ওয়ান। ল্যান্ডিং অরলি অ্যাট টুয়েলভ-টেন।’

দশ মিনিটের মধ্যে মেসেজটা পৌঁছে গেল প্যারিসে।

বাইরে বেরনো দায় ম্যাটাপ্যানের, চিড়িয়াখানার জীব মনে করে সবাই বিদঘুটে কৌতূহল দেখাতে শুরু করে। বিশেষ করে মেয়েদের জ্বালায় অস্থির হয়ে ওঠে সে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। এয়ারহোস্টেস মেয়েটা ওর কাছে প্রতি এক মিনিট অন্তর আসছে, হাসছে, পাশের খালি সীটে বসে পড়ছে। চোখ, মুখ, কণ্ঠ, ভুরু, ঠোঁট—ভাব প্রকাশের এই পাঁচটা মাধ্যমকেই কাজে লাগাতে চাইছে মেয়েটা, ‘কিছু লাগবে না আমার,’ কর্কশ গলায় কথাটা বলে তাকে একটু ভয় পাইয়ে দিল ম্যাটাপ্যান।

পুরুষরা কেউ প্রেম নিবেদন করতে এল না, কিন্তু তাজ্জব হয়ে প্রকাণ্ড গরিলাটাকে দেখছে তো দেখছেই, চোখের আশ আর তাদের মেটে না।

নির্দিষ্ট সময়ে এয়ারপোর্টে নেমে টার্মিন্যাল ভবনের সামনে থামল প্লেন। আরোহীরা টারমাক পেরিয়ে কাঁচের একটা দরজা দিয়ে একটা টিন শেডে ঢুকছে। শেডের মাঝখানে মুখোমুখি বসে আছে দু’জন পুলিস অফিসার। সাদা পোশাক পরা এক টেকো লোক অগ্রসরমান আরোহীদের দিকে চোখ রেখে একজন পুলিস অফিসারের দিকে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আসছে গরিলা। কালো বেরেট পরে।’ এই মেসেজ আরও লোককে দিতে হবে, সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত ভঙ্গিতে চলে গেল টেকো।

অফিসাররা ফ্রেঞ্চ সিকিউরিটি পুলিসের লোক। রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে এদের কাঁধে। বিদেশী আগন্তুক এবং ফেরত আসা দেশবাসীদের কাগজপত্র পরীক্ষা করা সেই দায়িত্বেরই একটা অংশ বিশেষ। দু’জন অফিসারের মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যাটাপ্যান। কেউই ভাল করে তাকাল না তার দিকে। ম্যাটাপ্যানের হলুদ ডিজএম্বারকেশন কার্ডে ঘটাং করে সীল মারল একজন অফিসার, অপরজন আইডেনটিটি কার্ডে নাম মাত্র চোখ বুলিয়ে ঘাড় নেড়ে এগিয়ে যেতে বলল তাকে।

এগিয়ে গিয়ে কাস্টমস অফিসারদের সামনে এসে দাঁড়াল ম্যাটাপ্যান। টেকো লোকটা এইমাত্র কয়েকজন অফিসারের সাথে ফিস ফিস করে কথা বলে দূরে সরে গেছে।

সাথে লুকানো রিভলভার আছে, সেজন্যে একটু অস্বস্তি বোধ করছে ম্যাটাপ্যান। জিনিসটা বোধহয় নিয়ে আসা উচিত হয়নি। নিয়ে আসার ইচ্ছাও তার ছিল না। কিন্তু অভ্যাসবশত বেরোবার আগে শোল্ডার হোলস্টারে ভরে নিয়েছিল, খেয়ালই করেনি। ভুলটা ধরা পড়েছিল প্লেনে চড়ার পর। তখন কিছু করার ছিল না।

ভাগ্যটা ভাল, ভাবল ম্যাটাপ্যান। কাস্টমসের লোকরা ওর প্রকাণ্ড শরীর দেখে এমন মুগ্ধ হলো যে ওকে চেক করার কোন চেষ্টাই করল না।

এয়ারফ্রান্সের বাসে চড়ে শহরের মাঝখানে এসে নামল ম্যাটাপ্যান। একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে চড়ে বসে ভিক্টর কাউলাস্কির দেয়া ঠিকানাটা বলল ড্রাইভারকে।

মেইন রোড লা লিবারেশন থেকে দু’বার বাঁ দিকে মোড় নিয়ে একটা সরু গলির মুখে এসে থামল ট্যাক্সি। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গলিতে ঢুকল ম্যাটাপ্যান। খানিকদূর এগিয়ে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে দাঁড়াল ও। কাউলাস্কির দেয়া ঠিকানা মিলে যাচ্ছে। ফ্ল্যাটবাড়িটা নতুন। দরজা পেরিয়ে লম্বা একটা হলরূমে ঢুকল ম্যাটাপ্যান। এক পাশে লিফট, আরেক পাশে সিঁড়ি। দরজার কাছে দেয়ালে দুই সারি লেটারবক্স। ভিক্টর কাউলাস্কির নাম লেখা লেটার বক্সটাও দেখতে পেল ম্যাটাপ্যান। তিন তলার তেইশ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকে কাউলাস্কি ফ্যামিলি। সিঁড়ির দিকে এগোল ম্যাটাপ্যান।

ভ্যালেন্টিনাকে কেমন অবস্থায় দেখবে ভাবতে গিয়ে আশঙ্কায় কেঁপে উঠল বুকটা। ইতোমধ্যেই মেয়েটা…অলক্ষুণে কথাটা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করল ম্যাটাপ্যান।

তিন তলায় উঠে সরু একটা প্যাসেজে ঢুকল সে। নাক বরাবর একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। সামনে গিয়ে দাঁড়াল ম্যাটাপ্যান। এটাই তেইশ নম্বর ফ্ল্যাট। আর সব দরজার মতই এটারও গায়ে একটা কলিংবেলের বোতাম, তার নিচে ভাড়াটের নাম লেখা টাইপ করা একটা কাগজ সাঁটা রয়েছে। কাউলাস্কির এই ফ্ল্যাট প্যাসেজের শেষ মাথায়। ম্যাটাপ্যানের দু’পাশে আরও দুটো ফ্ল্যাটের দরজা রয়েছে, বাইশ এবং চব্বিশ নম্বর। কলিংবেল বাজাল ও ।

ওর সামনের দরজাটা এক পলকে ছয় সাত ইঞ্চি খুলে গেল। লোহার একটা রড বিদ্যুৎবেগে নেমে এল ফাঁকটার উপর থেকে ম্যাটাপ্যানের মাথার দিকে Į

প্রস্তুত ছিল না ম্যাটাপ্যান, কিন্তু আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তি সাহায্য করল তাকে। চমকে উঠে মাথাটা পিছিয়ে নিতে গেল সে। পুরোপুরি সফল হলো না। লোহার রডটা কপালের হাড়ে লেগে পিছলে নেমে এল পুরু চামড়া সাথে নিয়ে ম্যাটাপ্যানের দু’দিকের দরজা দুটো নিঃশব্দে খুলে গেছে এরই মধ্যে। লোকজন বেরিয়ে আসছে। পুরো চেহারা নিয়ে বিপদটা উদয় হতে সময় নিল মাত্র আধ সেকেন্ড। কিন্তু ম্যাটাপ্যানের জন্যে এই আধ সেকেন্ডই যথেষ্ট। বুদ্ধির ঘাটতি থাকতে পারে, কিন্তু যুদ্ধের সমস্ত কৌশল রপ্ত আছে তার।

বিপদটা দেখার মুহূর্তেই একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিল ম্যাটাপ্যান। প্যাসেজটা সংকীর্ণ। তার গায়ে যত শক্তিই থাকুক, নড়াচড়ার জায়গা না পেলে কিছুই সে করতে পারবে না। কপালের লম্বা ক্ষতটা থেকে ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে দুই চোখে, তবু দু’পাশের দরজা দিয়ে দু’জন করে লোক বেরিয়ে আসছে, দেখতে ভুল করেনি সে। সামনের দরজায় রয়েছে আরও দু’জন লোক। চিন্তাভাবনার জন্যে কোন সময় না নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে সামনের দিকে আধ খোলা দরজার উপর।

কপালে কবাটের ধাক্কা খেয়ে আর্তনাদ করে উঠল একজন লোক, ছিটকে ঘরের মাঝখানে গিয়ে পড়ল সে। দরজার কবাট দুটো প্রচণ্ড শব্দে বাড়ি খেল দু’পাশের দেয়ালে। পিছন থেকে বিদ্যুৎবেগে কয়েকটা হাত এগিয়ে এল ম্যাটাপ্যানের জ্যাকেট ধরার জন্যে। একটা হাত জ্যাকেটটাকে স্পর্শও করল, কিন্তু ধরে রাখতে পারল না। প্রচণ্ড দমকা বাতাসের মত হুড়মুড় করে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল ম্যাটাপ্যান। এক সেকেন্ড আগে তার সামনে থেকে সরে যেতে পেরেছে ঘরের দ্বিতীয় লোকটা।

ঘরে ঢুকেই একটানে শোল্ডার হোলস্টার থেকে রিভলভারটা বের করে ঘুরে দাঁড়াল ম্যাটাপ্যান, গুলি করল দরজার দিকে। নল থেকে বুলেট বেরিয়ে যাবে, ঠিক এই সময় ঘরের দ্বিতীয় লোকটা ম্যাটাপ্যানের রিভলভার ধরা হাতের কব্জিতে লোহার রডের একটা প্রচণ্ড ঘা বসিয়ে দিল। ঝাঁকি খেয়ে নিচু হয়ে গেল রিভলভারের নল। ঘরে যারা ঢুকছে তাদের মধ্যে সবার আগে রয়েছে যে লোকটা তার হাঁটুতে গিয়ে লাগল গুলি। ঝাঁকি খেয়ে কোমর বাঁকা হয়ে গেল লোকটার, দু’হাত দিয়ে ধরতে গেল গুঁড়িয়ে যাওয়া হাঁটুটা, কিন্তু ধরতে পারেনি—পড়ে যাচ্ছে হুমড়ি খেয়ে।

এখনও মেঝেতে পড়েনি লোকটা। তাকে পাশ কাটিয়ে ম্যাটাপ্যানের দিকে ছুটে আসছে তিনজন লোক। আবার গুলি করার জন্যে ট্রিগার টিপতে যাচ্ছে ম্যাটাপ্যান, এই সময় রিভলভার ধরা হাতের কব্জিতে লোহার রডের দ্বিতীয় বাড়িটা এসে লাগল। হাতের রিভলভারটা ছিটকে পড়ে যেতে হকচকিয়ে গেল ম্যাটাপ্যান। মুহূর্তে পাঁচজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর।

একজনের বিরুদ্ধে পাঁচজনের লড়াইটা ঝাড়া তিন মিনিট স্থায়ী হলো। লড়ল আসলে একা ম্যাটাপ্যান, বাকি সবাই সারাক্ষণ আত্মরক্ষার জন্যে ঘরময় ছুটোছুটি করে বেড়াল, এবং সুযোগ পেলেই সাইকেলের চেন, লোহার রড, এবং সেই সাথে অবিরাম ঘুষি ও লাথির সাহায্যে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার চেষ্টা করতে লাগল। এই তিন মিনিটে সম্পূর্ণ বদলে গেল ম্যাটাপ্যানের চেহারা। মুখে ছয়টা গুরুতর ক্ষতের সৃষ্টি হলো তার। একটা কান ছিঁড়ে গেছে, সামান্য একটু চামড়ায় আটকে ঝুলছে সেটা। নাকটা ভেঙে গেছে। কপালের মাঝখানে এবং এক পাশের ক্ষত দুটো থেকে অনবরত রক্ত গড়াচ্ছে। বাম চোখের নিচে থেকে চোয়াল পর্যন্ত মাংস কেটে বসে গেছে সাইকেলের চেনের দাগ। নিচের ঠোঁটটা মাঝখান থেকে দু’ফাঁক হয়ে গেছে, সেই সাথে সামনের দুটো দাঁত ঝরে পড়ে গেছে মেঝেতে।

চামড়ার তৈরি বালি ভর্তি ব্যাগের আঘাতগুলো মাথায় কোন ক্ষতের সৃষ্টি করেনি বটে, কিন্তু এই আঘাতগুলোই সবচেয়ে বেশি কাহিল করল ম্যাটাপ্যানকে। শরীরের এখানে সেখানে গোটা পঞ্চাশ রক্তাক্ত ক্ষত নিয়েও বীরবিক্রমে লড়ল সে। চোখের পলকে, বিদ্যুৎ গতিতে ঘরময় ধাওয়া করে বেড়াল সে একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে। দু’বারই একটুর জন্যে রিভলভারটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিতে গিয়েও পারল না সে। লাথি মেরে প্রতিপক্ষরা সরিয়ে দিল রিভলভারটা তার নাগালের বাইরে। শেষ পর্যন্ত উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে যখন জ্ঞান হারাল সে, তখন প্রতিপক্ষদের মাত্র দু’জন পায়ের উপর ভর দিয়ে কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি চারজনের একজন শেষ, দ্বিতীয়জন প্রায় শেষ, বাঁচার কোন আশাই নেই তার-ম্যাটাপ্যান এক হাতে তার গলা আঁকড়ে ধরে মাংসে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে কণ্ঠনালী টেনে ছিঁড়ে আনতে চেষ্টা করেছিল। সুবিধে হচ্ছে না দেখে লোকটাকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর একটা পা রেখে দাঁড়িয়ে ছিল সে। মট্ মট্ করে এক পাশের প্রায় সব ক’টা পাঁজরের হাড় দু’টুকরো হয়ে গেছে তার। তৃতীয়জন হাঁটুতে গুলি খেয়ে অচল হয়ে বসে আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে, ব্যথায় ককাচ্ছে। চতুর্থ লোকটার জ্ঞান নেই—দেয়ালের সাথে ঠুকে দিয়ে তার খুলি ফাটিয়ে দিয়েছে ম্যাটাপ্যান।

হাত-পা ছড়িয়ে ঘরের মেঝেতে নিঃসাড় পড়ে আছে ম্যাটাপ্যান। ক্ষতস্থানগুলো থেকে মন্থর বেগে রক্ত গড়াচ্ছে দেখে বোঝা যাচ্ছে মরেনি, এখনও বেঁচে আছে সে।

কর্নেল বোল্যান্ডের অ্যাকশন সার্ভিসের দু’জন লোক দ্রুত পরীক্ষা করল ম্যাটাপ্যানকে। বেঁচে আছে, কিন্তু জ্ঞান নেই। পরস্পরের দিকে মুখ তুলে তাকাল তারা। কথা হলো না, দু’জনেই এখনও হাপরের মত হাঁপাচ্ছে, কিন্তু একজন আরেকজনের উদ্বেগের হৈতু পরিষ্কার অনুধাবন করতে পারল

ইটালিয়ান গরিলাটার জ্ঞান আর কখনও ফিরবে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না তাদের।

দলনেতা লোকটা উঠে দাঁড়াল দ্রুত। টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইশ নম্বর ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকল সে। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। ক্র্যাডল থেকে রিসিভার তুলে নিয়ে স্থানীয় একটা নাম্বারে ডায়াল করল সে, বলল, ‘…হ্যাঁ, কাবু করা গেছে। …লড়েছে? একজনকে খুন করেছে ও। আরেকজন বাঁচবে না। আরও দু’জনের অবস্থা সাংঘাতিক গুরুতর। বাকি আমাদের দু’জনের অবস্থাও খুব ভাল নয়।’ দম নেবার জন্যে থামল লোকটা। কি? হ্যাঁ, ইটালিয়ান বেঁচে আছে। বাঁচিয়ে রাখার অর্ডার দিয়েই তো সর্বনাশ করা হয়েছে, তা নাহলে –হ্যাঁ, জখম করতে হয়েছে বৈকি…শোনো, সালাদের ঝুড়ি (পুলিস ভ্যান) দরকার নেই আমাদের, দরকার একজোড়া অ্যাম্বুলেন্স। কুইক।’ খটাশ করে রিসিভার নামিয়ে রাখল সে।

পনেরো মিনিট পর একজন ডাক্তারসহ দুটো অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে। ইতোমধ্যে হাত-পা বাঁধা হয়ে গেছে ম্যাটাপ্যানের। ডাক্তার পাঁচ মিনিট ধরে পরীক্ষা করল ওকে। বিহ্বলতা ফুটে উঠল তার চেহারায়। ম্যাটাপ্যানকে একটা ইঞ্জেকশন দিল। ইতোমধ্যে নিহত এবং আহতদেরকে স্ট্রেচারে তুলে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ম্যাটাপ্যানের হাতের মাংস থেকে সূচটা টেনে বের করে নিয়ে দলনেতার দিকে তাকাল ডাক্তার। ‘আমার কোন কেরামতিই এর ক্ষেত্রে খাটবে না। এখানে কিছুই করতে পারব না আমি। এক্ষুণি একে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিন।’

দলনেতা অ্যাম্বুলেন্স কর্মীদেরকে নিঃশব্দে ইঙ্গিত দিল।

অজ্ঞান ম্যাটাপ্যানকে স্ট্রেচারে তুলে নিচে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো, তার সাথে নেমে গেল ডাক্তারও। প্যাসেজে বেরিয়ে এসে দলনেতার সাথে যোগ দিল তার সহকারী। ‘ভাগ্যিস গোটা ফ্ল্যাটটা খালি করে নিয়েছিলাম, তা নাহলে ভাবতে পারো…

কর্কশ গলায় দলনেতা বলল, ‘কে চায় ভাবতে? লোকাল অফিসকে ফোন করে লোক পাঠাতে বলো। এটা ওদের ফ্লোর, সাফ সুতরো ওরাই যা করার করবে।

.

প্যারিসের বাইরে প্রাচীন এক দুর্গ। মিলিটারি ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে দুর্গটাকে। দুর্গের নিচে আলাদা একটা জগৎ তৈরি করেছে অ্যাকশন সার্ভিস। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকি বলে মনে করা হয় যাদেরকে, তাদের আটক করে রাখা হয় এখানে। বিশেষ ধরনের একটা জেলখানা এটা। জেলখানাটা আবার কয়েক ভাগে ভাগ করা। নির্দিষ্ট একটা অংশে অ্যাকশন সার্ভিসের অনুমতি ছাড়া অন্য কোন ডিভিশনের কর্মকর্তাদেরও প্রবেশাধিকার নেই, এমন কি জেলখানার ডাক্তারদেরও ওদিকে পা বাড়ানো নিষেধ।

সেদিনেরই দু’ঘণ্টা পরের ঘটনা। দুর্গের নিচের একটা নোংরা, ভিজে চার দেয়াল দিয়ে ঘেরা কামরা। প্রস্রাব, ঘাম আর কারবোলিক অ্যাসিডের তীব্র গন্ধ বাতাসে। সরু একটা লোহার কটে শুয়ে আছে ম্যাটাপ্যান। কটের পায়াগুলো কংক্রিটের মেঝের ভিতর ঢোকানো। মোটা চটের একটা বিছানা, ভাঁজ করা তেল চিটচিটে একটা চাদর ছাড়া কটের উপর কিছু নেই। ম্যাটাপ্যানের দুই পায়ের গোড়ালি কটের দুটো পায়ার সাথে লেদার স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা। ঊরু এবং হাতের কব্জি দুটোয় দু’জোড়া স্ট্র্যাপ দেখা যাচ্ছে, আরেকটা দেখা যাচ্ছে বুকের সাথে বাঁধা। এখনও জ্ঞান ফেরেনি তার, কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস গভীর ও অনিয়মিত ভাবে চালু আছে।

মুখ এবং শরীর থেকে রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলা হয়েছে। ক্ষতগুলোর কোনটায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, কোনটায় প্লাস্টার সাঁটা হয়েছে।

সাদা কোট পরা লোকটা একজন ডাক্তার। প্রায় একঘণ্টা ধরে ম্যাটাপ্যানকে পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়াল সে। নিঃশব্দে অনুসরণ করল দীর্ঘদেহী, সুবেশ এক লোককে, কামরা থেকে বেরিয়ে এল করিডরে। দীর্ঘদেহী কর্নেল বোল্যান্ড ঘুরে দাঁড়াল, মুখোমুখি হলো ডাক্তারের।

‘কিসের সাথে ধাক্কা খেয়েছে বলুন তো লোকটা?’ ডাক্তারই কথা বলছে প্রথম। ‘ট্রেনের সাথে নয়তো?’ তার কণ্ঠস্বরে প্রচ্ছন্ন তিরস্কার ফুটে উঠল ।

গায়ে মাখল না কর্নেল। হাতের জ্বলন্ত সিগারের ডগায় চোখ রেখে বলল, ‘লোকটাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই আমি, ডাক্তার।’

‘এই অবস্থায়?’ আঁতকে উঠল ডাক্তার। ‘আপনি পাগল হয়েছেন, স্যার? ডান কব্জির হাড় ফেটে গেছে, বাম কান ফেলে দিয়েছি কেটে, নাক ভেঙে গেছে, কপালের হাড়ে ‘চিড় ধরেছে, শরীরে তিপ্পান্নটা ক্ষত, স্লাইট ইন্টারন্যাল হেমোরেজিং, যার পরিণতি গুরুতর আকার ধারণ করে ওর মৃত্যু ঘটাতে পারে, অথবা আপনাআপনি রক্তপাত বন্ধ হয়ে যেতে পারে—সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কথা ওর মাথাটাকে নিয়ে। প্রচণ্ডভাবে নাড়া খেয়েছে মগজ, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। খুলিটা ফাটেনি, তার একমাত্র কারণ সম্ভবত ওটা ইস্পাত দিয়ে তৈরি—আপনার লোকজনের কোন কৃতিত্ব নেই এতে। যাই হোক, এই অবস্থায় আপনি ওকে প্রশ্ন করতে পারবেন বলে মনে করলে ভুল করবেন কর্নেল…’ স্পষ্টবাদী ডাক্তার কাঁধ ঝাঁকাল।

মুখ তুলে তাকাল কর্নেল বোল্যান্ড। ‘জ্ঞান ফিরবে কখন?’

‘বলা সম্ভব নয়। আগামীকালও ফিরতে পারে, দু’চারদিন নাও ফিরতে পারে। জ্ঞান ফিরলেও সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থায় পাবেন না ওকে—মেডিক্যালি ফিটনেস আসতে কমপক্ষে দিন পনেরো লাগবে, যদি কংকাশনটা হালকা টাইপের হয়।’

‘ওষুধপত্রের সাহায্যে কিছু করা যেতে পারে,’ মৃদু কণ্ঠে বলল কর্নেল বোল্যান্ড।

যেতে পারে। সে-ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়। কিন্তু আমি ব্যবহার করি না। আপনি হয়তো অন্য কোন ডাক্তারকে দিয়ে ওসব প্রয়োগ করাবেন, কিন্তু তাতে ক্ষতি হবার ষোলোআনা আশঙ্কা থাকবে। ওষুধ প্রয়োগ বা অন্য কোন উপায়ে কথা বলাতে পারবেন ওকে, কিন্তু কথাগুলো হবে সম্ভবত প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত রোগীর আবোলতাবোল প্রলাপের মত। ওর ব্রেনের ভিতরটা প্যাঁচ খেয়ে গেছে, লেজে- গোবরে জড়িয়ে গেছে—ভবিষ্যতে কখনও পরিষ্কার হতেও পারে, নাও পারে। তাছাড়া, ওষুধ ব্যবহার কার ওপর করবেন? আগে হুঁশ তো ফিরুক, বলা যায় না, জ্ঞান ফিরতেই হয়তো এক হপ্তার বেশি লেগে যাবে ওর।’

‘হুঁ।’

কিন্তু ডাক্তারের অনুমান ঠিক হয়নি। নানান ধরনের ওষুধ ইঞ্জেক্ট করায় তিনদিন পর চোখ মেলল ম্যাটাপ্যান। সেদিন অক্টোবর মাসের দশ তারিখ। সেদিনই প্রথম এবং শেষবারের মত অ্যাকশন সার্ভিসের প্রশ্নকর্তাদের সম্মুখীন হতে হলো তাকে।

.

ফ্রান্স মিশনে রওনা হবার জন্যে প্রস্তুতি পর্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে রানা। ব্রাসেলস থেকে লন্ডনে ফিরে এসে তিনটে দিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটল ওর। আলেকজান্ডার জেমস কোয়েনটিন অরগ্যানের নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পকেটস্থ করে অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের হেডকোয়ার্টার ফানাম হাউজে এল ও, এখান থেকে সংগ্রহ করল একই নামে একটা ইন্টারন্যাশন্যাল ড্রাইভিং লাইসেন্স।

একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড দোকান থেকে দুটো লেদার সুটকেস কিনল ও। একটা সুটকেসে পাদ্রীর পোশাক পরিচ্ছদ ভরল, প্রয়োজনে কোপেনহেগেনের ধর্মযাজক বেনসনের ছদ্মবেশ নেবার জন্যে। সুটকেসে কাপড়চোপড় তোলার আগে কোপেনহেগেন থেকে কেনা সাধারণ তিনটে শার্ট থেকে প্রস্তুতকারক কোম্পানীর লেবেল তুলে নিয়ে লন্ডনে কেনা ক্যারিকাল শার্ট, ডগ কলার এবং কালো বিবে লাগিয়ে নিল। ওই তিনটে কাপড় থেকে লন্ডনের প্রস্তুতকারক কোম্পানীর লেবেল আগেই সরিয়ে ফেলেছে ও। একই সুটকেসে জায়গা করে নিল মার্কিন ছাত্র স্মার্টি টোয়েনের স্নেকার্স, মোজা, জিনস, সুইট-শার্ট এবং উইন্ডচিটার। সুটকেসের লাইনিং চিরে চামড়ার দুটো পর্দার মাঝখানে লুকিয়ে রাখল দুই বিদেশী পাসপোর্ট, অদূর ভবিষ্যতে একদিন হয়তো এদের ছদ্মবেশ গ্রহণ করতে হবে ওকে। কাপড়- চোপড়ে ঠাসা এই সুটকেসটায় এরপর তোলা হলো ফ্রেঞ্চ ক্যাথেড্রালস সম্পর্কে লেখা ডেনিশ বই, দুই সেট চশমা—একটা ডেনিশ পাদ্রীর, অপরটা মার্কিন ছাত্রের—টিসু পেপারে সযত্নে মোড়া দুই ধরনের কন্ট্যাক্ট লেন্স এবং চুল রাঙাবার প্রয়োজনীয় কেমিকেলস্।

প্যারিসের ফ্রিয়া মার্কেট থেকে কেনা ফ্রান্সের তৈরি জুতো, মোজা, শার্ট এবং ট্রাউজার ঢুকল দ্বিতীয় সুটকেসে, সাথে থাকল হাঁটু পর্যন্ত লম্বা গ্রেট কোট এবং কালো বেরেট। লাইনিং চিরে ভিতরে ঢুকে গেল মধ্য বয়স্ক ফ্রেঞ্চবাসী মার্ক রোডিনের জাল পরিচয়পত্রগুলো। সুটকেসটার কিছুটা অংশ খালি রাখল রানা, অচিরেই এতে জায়গা দিতে হবে গোটা একটা স্নাইপার’স রাইফেল এবং অ্যামুনিশন ভর্তি কয়েক খণ্ড স্টীল টিউবকে।

তৃতীয় আরেকটা, একটু ছোট সুটকেসে আলেকজান্ডার অরগ্যানের জুতো, আন্ডারওয়্যার, শার্ট, টাই, রুমাল এবং তিনটে কমপ্লিট স্যুট ভরা হলো। এটার লাইনিঙের ভিতর লুকিয়ে রাখা হলো একশো পাউন্ড নোটের মোটাতাজা একটা তাড়া। ব্রাসেলস থেকে ফিরে ওর ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে দশ হাজার পাউন্ড তুলেছে রানা।

তিনটে সুটকেসে তালা লাগিয়ে চাবিগুলো রিঙে গলিয়ে রাখল ও। ডাভ-গ্রে রঙের স্যুটটা পরিষ্কার করে ইস্ত্রী করা হয়েছে, দেয়াল আলমারিতে একটা হ্যাঙ্গারে ঝুলছে সেটা। ওটার বুক পকেটে রয়েছে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং পাঁচ ও দশ পাউন্ডের দুটো তাড়া, মোট পাঁচশো পাউন্ড।

ছোট্ট একটা হাতব্যাগে খুঁটিনাটি কিছু জিনিস, দাড়ি কামাবার যন্ত্র, পাজামা, স্পঞ্জের ব্যাগ ও তোয়ালে, এবং সবশেষে কেনা মিহি সুতো দিয়ে বোনা হালকা একটা হারনেস, দু’পাউন্ড ওজনের প্লাস্টার অভ প্যারিসের একটা ব্যাগ, কয়েক প্যাকেট ব্যান্ডেজ, আধডজন আঠা লাগানো প্লাস্টার রোল, তিন প্যাকেট, কটন উল, একখানা ছোট কাঁচি ইত্যাদি ভরে নিল রানা।

প্রস্তুতি পর্বের সমস্ত কাজ শেষ। এখন টেলিফোন নাম্বার লেখা ছোট্ট একটা চিরকুটের জন্যে অপেক্ষা শুধু। ওটা এসে পৌঁছলেই আসল কাজে বেরিয়ে পড়তে পারে রানা।

অক্টোবরের নয় তারিখে অপেক্ষার অবসান ঘটল। ঢাকা থেকে এসেছে চিঠিটা। তাতে টাইপ করা একটা মাত্র লাইন, ‘পারুর সাথে Mol।tor 5900- তে যোগাযোগ করো, দসুমা নারা। গুড লাক।’

দসুমা নারা ওরফে মাসুদ রানার বুঝতে অসুবিধে হলো না যে পার বলতে রূপাকে বোঝানো হচ্ছে।

দেরি না করে সকালেই টেলিফোন যোগে এয়ার প্যাসেজ বুকিংয়ের কাজটা সেরে ফেলল রানা। আগামীকাল বারোই অক্টোবর। সকালের ফ্লাইটে রওনা হয়ে যাচ্ছে ও।

প্যারিস। মাটির নিচে জেলখানার একটা সেল। একটা টেবিলের একধারে বসে আছে পাঁচজন লোক। টেবিলের সামনে ওক কাঠের ভারী একটা চেয়ার। চেয়ারের সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে প্রকাণ্ডদেহী ম্যাটাপ্যানকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায়। মাথাটা অস্বাভাবিক নিচু হয়ে আছে তার, বুক ছুঁয়ে আছে চিবুক। দীর্ঘ, ভারী নিঃশ্বাসের সাথে ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসছে গলার ভিতর থেকে। সেলের ভিতর আর কোন শব্দ নেই।

টেবিলের বাঁ দিকের কিনারায় ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে একটা টেবিল- ‘ল্যাম্প। পাঁচশো পাওয়ারের অত্যুজ্জ্বল একটা বালব জ্বলছে। শেড দিয়ে ঢাকা ল্যাম্পের আলো টেবিলের সামনে ছয় ফিট দূরে চেয়ারের উপর গোল হয়ে পড়েছে, সেলের বাকি অংশে আলো নেই। আলোর বড়সড় বৃত্তের কিনারা এখানে সেখানে ছুঁয়ে আছে টেবিলটাকে। টেবিলে পড়ে থাকা একজনের কয়েকটা আঙুল, একজনের কব্জিসহ হাত, আরেকজনের আঙুলের ফাঁকে ধরা জলন্ত সিগারেট দেখা যাচ্ছে, পাক খেতে খেতে সিলিংয়ের দিকে উঠে যাচ্ছে চিকন নীলচে ধোঁয়া।

ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল ম্যাটাপ্যান। চোখ দুটো প্ৰায় বুজে আছে, কুঁচকে আছে দু’চোখের চারপাশের চামড়া। তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তার। টেবিলের খানিকটা দেখতে পাচ্ছে সে। কিন্তু টেবিলের ওদিকে বসা লোকদের কাউকে দেখতে পাচ্ছে না।

আবছা ভাবে মনে পড়ছে তার, ধরাধরি করে এই প্রকাণ্ড চেয়ারটায় তুলে দেয়া হয়েছে তাকে। চেয়ারের পায়াগুলো কংক্রিটের মেঝের সাথে স্থায়ীভাবে আটকানো। দুটো পায়ার সাথে তার পা দুটো বেঁধে রাখা হয়েছে স্ট্র্যাপ দিয়ে স্ট্র্যাপগুলো শক্ত চামড়া দিয়ে তৈরি, কিন্তু ভিতর দিকে তুলোর স্তর সাঁটা আছে। টান টান করে বাঁধা হলেও কোন রকম ব্যথা এখনও বোধ করছে না ম্যাটাপ্যান শরীরটা হালকা তুলোর মত লাগছে তার। কোথাও কোন বেদনা নেই। বুঝতে পারছে সে, ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে তীব্র, অসহ্য ব্যথাগুলোকে। ওষুধের প্রভাব শেষ হলেই আবার শুরু হবে সারা শরীর জুড়ে নির্দয় কামড়াকামড়ি।

চেয়ারটার দুই হাতলের সাথে ম্যাটাপ্যানের কব্জি দুটো স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা রয়েছে। আরেকটা স্ট্র্যাপ কোমরে আটকানো। তার বিশাল, লোমশ বুকের উপর আড়াআড়ি ভাবে বাঁধা হয়েছে শেষ স্ট্র্যাপটা। সবগুলো স্ট্র্যাপ ভিজে গেছে ঘামে।

কয়েক জোড়া দীর্ঘ, পেশীবহুল, লোমশ হাত এবং একটা যন্ত্র ছাড়া টেবিলটা খালি। যন্ত্রটা ছয় ইঞ্চি লম্বা, এক ইঞ্চি চওড়া। চার পাশে চকচকে পিতলের উঁচু কিনারা, মাঝখানটা গভীর। ভিতর থেকে পিতলের দু’ইঞ্চি লম্বা একটা আঙুল উঠে এসেছে, মাথায় প্লাসটিকের একটা সাদা নব। আঙুলটার পাশে একটা সুইচ, অফ এবং অন করার জন্যে। যন্ত্রটার দৈর্ঘ্য বরাবর চিকন মাছের কাঁটার মত অসংখ্য খুদে সরল রেখা টানা রয়েছে, তার নিচে লেখা রয়েছে বিভিন্ন সংখ্যা। সব শেষের চেয়ারে বসা লোকটার ফর্সা, লোমশ হাত পড়ে আছে যন্ত্রের কন্ট্রোলের কাছে, অলস ভঙ্গিতে ঠকঠক করে মৃদু টোকা মারল সে টেবিলের উপর আঙুল দিয়ে।

সুইচ এবং কারেন্ট কন্ট্রোল থেকে দুটো তার বেরিয়ে এসে টেবিলের তলা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঢুকেছে অদূরবর্তী ছোট একটা ইলেকট্রিক্যাল ট্র্যান্সফরমারে। সেটা থেকে কালো শক্ত রাবারে মোড়া একটা তার বেরিয়ে এসেছে, চেয়ারে বসা পাঁচজন লোকের পিছন দিকের দেয়ালে ফিট করা সকেটটার ভিতর গিয়ে ঢুকেছে।

সেলের দূর প্রান্তে ছোট্ট একটা টেবিল সামনে নিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে আছে আরেক লোক। তার সামনে একটা টেপ-রেকর্ডার। সবুজ রঙের ‘অন’ লেখা ছোট্ট আলোটা জ্বলছে, কিন্তু স্পুলগুলো এখনও অচল।

সেলের ভিতর ভাপসা গরম। ঘাম, ধোঁয়া, বমি আর ধাতব পদার্থের উৎকট গন্ধ বাতাসে।

মাঝখানের চেয়ারে বসা লোকটা হঠাৎ কথা বলতে শুরু করল। কণ্ঠস্বর শান্ত, মার্জিত কিন্তু উচ্চারণ স্পষ্ট এবং সুরটা দৃঢ়।

‘মুখ খোলো, ম্যাটাপ্যান। যা জানো সব বলো।’

এক চুল নড়ছে না ম্যাটাপ্যান।

বক্তা একটু হাসল। ‘তুমি আশ্চর্য এক সাহসী লোক, আমরা জানি, ম্যাটাপ্যান। সেজন্যে তোমার ওপর আমাদের শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু ব্যথা সহ্য করারও তো একটা সীমা আছে, তাই না? কি দরকার নিজেকে খামোকা কষ্ট দিয়ে? তারচেয়ে তাড়াতাড়ি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও, বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সেটাই তো ভাল হবে তোমার জন্যে। কি বলো?’

দাঁতে দাঁত চেপে অনড় বসে আছে ম্যাটাপ্যান। মুখ তুলে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করছে না। তীব্র আলোয় মুক্তোর মত ঝিকমিক করছে তার কপালের অসংখ্য ঘামের ক্ষুদ্র বিন্দুগুলো। আগের চেয়ে ঘন ঘন ওঠা নামা করছে তার বুক, ভারী শব্দ হচ্ছে নিঃশ্বাস পতনের।

‘তুমি তো জানো,’ ঘরোয়া, খোশ-আলাপের সুরে মৃদু গলায় আবার কথা বলছে লোকটা, ‘আমরা অ্যাকশন সার্ভিসের ডানপিটে কর্সিকান। একবার যখন আমাদের হাতে পড়েছ, তোমার আর কোন আশা নেই। সব রহস্য ফাঁস করে দাও, দেখবে, কত ভালবাসব তোমাকে আমরা।’ একটু বিরতি নিল বক্তা, তারপর আচমকা প্রশ্ন করতে শুরু করল, ‘আগস্টের শেষ ক’টা দিন কে ছিল তোমাদের সাথে, ম্যাটাপ্যান? কাকে পাহারা দিচ্ছিলে তোমরা? কোথায় গেছে সে? কোথায় আছে সে এখন? বলো, ভাই! সব কথা বলে নিজেকে বিপদ থেকে উদ্ধার করো। প্লীজ!’ শেষ দিকে আবেদনের সুর ফুটে উঠল লোকটার কণ্ঠস্বরে, কিন্তু তা হাস্যকর শোনাল না মোটেও।

ধীরে ধীরে মুখ তুলল ম্যাটাপ্যান। চোখ দুটো বন্ধ। মুখের আসল রঙ ঢাকা পড়ে গেছে অসংখ্য ক্ষতচিহ্নের আড়ালে। প্রকাণ্ড মুখটা আরও মস্ত দেখাচ্ছে এখানে সেখানে বেঢপভাবে ফুলে ওঠায়। মুখের ক্ষতগুলো থেকে লালচে রস বেরিয়ে ঘামের সাথে মিশে আছে, তীব্র আলোয় অদ্ভুত রঙচঙে চেহারা পেয়েছে মুখটা। দুই চোখের নিচে নীলচে ক্ষতের জন্যে, নাকি চোখ ধাঁধানো আলোর জন্যে, বলা মুশকিল, চোখ দুটো বুজে রেখেছে ম্যাটাপ্যান। মুখটা টেবিলের দিকে তুলে কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে থাকল সে। ধীরে ধীরে ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হলো, কথা বলতে চেষ্টা করছে সে। ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে নেমে এল খানিকটা কফের সাথে এক দলা থুথু, কোন শব্দ বেরোল না। পরমুহূর্তে ‘অঁক করে উঠল ম্যাটাপ্যান, পিচকারী দিয়ে বেরিয়ে এল তামাটে রঙের তরল, দুর্গন্ধময় বমি, কোলের উপর পড়ে দুই ঊরুর গা বেয়ে দু’পাশে গড়িয়ে নামছে। চুলগুলো এদিক ওদিক দুলছে তার, প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে নিঃশব্দে, মাথা নেড়ে।

তুমি সাংঘাতিক শক্ত মানুষ, ম্যাটাপ্যান, আবার শুরু করল বক্তা। ‘আজ পর্যন্ত কেউ তোমাকে ভাঙতে পারেনি, জানি আমরা। কিন্তু ইস্পাতের কাঁকড়াগুলোর কথা ভুলে যেয়ো না, প্লীজ। এমনিতেই ভয়ঙ্কর পাজী ওগুলো; তার ওপর ওদের ঘাড়ে ভর করে আছে আরেক তুখোড় বদমাশ—ইলেকট্রিসিটি একবার কামড় দিলে ছাড়তে চায় না। কি, মুখ খুলবে, ম্যাটাপ্যান? কে ছিল? কি নাম তার? তাকে লুকিয়ে রেখেছিলে, না? কেন, ম্যাটাপ্যান? বলো ভাই! সব কথা খুলে বলো আমাদেরকে।’

চিবুকটা লোমশ বুকে ঘষা খাচ্ছে ম্যাটাপ্যানের। চোখ দুটো আগের মতই বন্ধ। চুলগুলো দুলছে। মাথাটা এদিক ওদিক নড়ছে। ধীরে ধীরে স্থির হলো সে। কিন্তু চিবুক ঠেকেই থাকল বুকের গায়ে। একটু কাত হলো মাথাটা। যেন ঝুঁকে পড়ে বন্ধ চোখ দিয়ে বুকে ডান দিকের এবং তারপর বাম দিকের বোঁটায় আটকে থাকা ইস্পাতের কাঁকড়া দুটোকে দেখছে। আরও একটু সামনে ঝুঁকল মাথাটা, এবারও যেন বন্ধ চোখ দিয়ে পুরুষাঙ্গ কামড়ে থাকা কাঁকড়াটাকে দেখার চেষ্টা করছে।

বক্তার ফর্সা দুই হাত টেবিল থেকে উপরে উঠল। বাম হাতের তালুতে ডান হাতের বুড়ো আঙুল চেপে ধরেছে সে, বাকি চারটে আঙুল প্রসারিত।

ইঙ্গিত পেয়ে টেবিলের শেষপ্রান্তে বসা লোকটার একটা হাত নড়ে উঠল ইলেকট্রিক সুইচের কাছে। পিতলের খাড়া আঙুলটার সাদা মাথা ধরে স্কেলের বাম দিক থেকে ডান দিকে খানিকটা সরাল সে। দুই লেখার ঘরে ছিল আঙুলটা, এখন সেটা চার লেখা ঘরের সামনে চলে এল। লোকটা এবার তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরল সুইচটা। পরমুহূর্তে সেটা অন করল সে।

ইস্পাতের কাঁকড়াগুলোর সাথে যোগাযোগ রয়েছে সুইচ থেকে বেরনো তারগুলোর। সুইচ অন হতেই ভোমরের মত মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল সেলের ভিতর, সাথে সাথেই জ্যান্ত হয়ে উঠল কাঁকড়াগুলো।

প্রকাণ্ড নগ্ন শরীরটা নিঃশব্দে, গ্যাস বেলুনের মত চেয়ার ছেড়ে উঠে যাচ্ছে, অদৃশ্য দুটো হাত যেন ধীরে ধীরে তুলে ধরছে ম্যাটাপ্যানকে। হাত এবং পায়ের স্ট্র্যাপগুলো মাংস কেটে বসে আছে ভিতরে, হাড় কেটে বেরিয়ে যাবে যেন। দুই চোখের চার পাশ ফুলে থাকায় সামনের দিকে দৃষ্টি চলছে না ম্যাটাপ্যানের। ধীরে ধীরে উঁচু হলো মুখটা। আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখ দুটো চেয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে। যেন প্রচণ্ড বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে মুখটা। মাত্র আধ সেকেন্ড পর দানবীয় আর্তচিৎকার উঠে এল গলায় অনেক নিচের ফুসফুস থেকে। চিৎকার আর চিৎকার, ক্রমশ সেটা বাড়ছে। চেয়ারে বসা পাঁচজন লোকের গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। সাউন্ড প্রুফ সেলের ভিতর দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে তীক্ষ্ণ, কানের পর্দা ফাটানো অমানুষিক আর্তনাদ। থামছে না, বেড়েই চলেছে, অবিরাম, অবিরত

বিকেল চারটে বেজে দশ মিনিটে হেরে গেল ম্যাটাপ্যান। জীবনে এই প্রথম আত্মসমর্পণ করল সে। স্বীকার করল, হ্যাঁ, আগস্টের শেষ ক’টা দিন একজন লোক ছিল তাদের সাথে। না, লোকটাকে চেনে না সে, জীবনে কখনও দেখেনি। নাম? না, লোকটার নাম জানানো হয়নি তাকে

তখনও টেপ-রেকর্ডার চালু করা হয়নি। কথাটা ম্যাটাপ্যানকে জানানো হলো। মাঝখানের চেয়ারে বসা লোকটা মৃদু হেসে বলল, ‘তুমি যে প্রথম দিকে সত্য কথা বলবে না, এ আমরা জানি। সৈজন্যে টেপ রেকর্ডার চালু করিনি আমরা। কষ্ট কাকে বলে সে-অভিজ্ঞতা তো হয়েছে তোমার। আর একটু স্বাদ নাও।’

দশ সেকেন্ডের জন্যে ইলেকট্রিক কাঁকড়াগুলো আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল। এক ইঞ্চি লম্বা, আধ ইঞ্চি চওড়া এবং পোনে এক ইঞ্চি গভীর মাংস সহ ম্যাটাপ্যানের বাম বুকের বোঁটাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল শরীর থেকে।

‘আহা-হা, চু-চু,’ সহানুভূতি প্রকাশ করল বক্তা লোকটা। ‘বড় দুঃখের কথা, যাই বলো। ঠিক আছে, মেঝে থেকে কাঁকড়াটাকে তুলে তোমার নাভির ওপর বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। খেয়াল রাখা হবে যাতে নাভিটাকেও কুটুস করে কেটে না নেয়।’

রাত আটটার সময় শেষবারের মত অন করা হলো সুইচ, অমনি আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল কাঁকড়াগুলো। এর মধ্যে ম্যাটাপ্যানোর পুরুষাঙ্গ দু’বার কাটা পড়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। দরদর ঝরছে রক্ত।

আটবারের বার কোন চিৎকার করল না ম্যাটাপ্যান। শুধু চুল পরিমাণ ঘাড়টা কাত করল একবার। দ্রুত অফ করা হলো সুইচ।

‘কে?’ বক্তার কণ্ঠস্বর এখন আর আগের মত মৃদু নয়। কর্কশ হিংস্র ভঙ্গিতে প্রশ্ন করছে সে, ‘কে ছিল তোদের সাথে?’

‘এ-ক-জন ই-টা-লি-য়া-ন…,’ বিড় বিড় করে বলল ম্যাটাপ্যান।

কয়েক ঘণ্টায় দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে তার। জ্ঞান হারায়নি, তার কারণ দশ মিনিট পর পর ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়েছে তার শরীরে। কিন্তু জ্ঞান না হারালেও শরীরে প্রাণ শক্তির বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। চাদরের উপর পড়ে আছে হাড়-মাংসের বাঁকাচোরা একটা পিণ্ড।

‘নাম?’

ম্যাটাপ্যান নিথর।

‘সুইচ অন করব, উত্তর দিতে তিন সেকেন্ডের বেশি দেরি হলে,’ আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠল বক্তা। ‘নাম?’

থেমে থেমে, অতি কষ্টে এক একটা শব্দ উচ্চারণ করছে ম্যাটাপ্যান। ইচ্ছা শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে তার। নিজের উপর কন্ট্রোল নেই। কি বলছে যেন জানে না নিজেই।

‘সা-ন-তি-নো ভ্যা-লে-ন্টি…’

‘লুকিয়ে ছিল কেন?’ বক্তা প্রশ্ন করল। ‘উদ্দেশ্য কি তা?’

‘উ-সে-ন-কে আ-ঘা-ত- হা-ন-বে…

কোথায় এখন সে?’

‘ই-ং-ল্যা-ন্ডে…’

‘ওখান থেকে কোথায় যাবে?’

‘জা-নি-না…’

ইংল্যান্ডে কোথায় গেছে?’

‘ল-ন্ড-নে…’

‘ঠিকানা জানো?’

হুঁশ নেই ম্যাটাপ্যানের, যা জানে সব সত্য কথা বলে দিচ্ছে সে।

‘জা-নি-না…

একটু বিরতি নিল বক্তা, তারপর আবার প্রশ্ন করল, ‘সান্তিনো ভ্যালেন্টির আসল পরিচয় বলো।’

‘মা-সু-দ রা-না…’

‘ওহ্ গড!’ অ্যাকশন সার্ভিসের পাঁচজন পদস্থ কর্মকর্তা আঁতকে উঠল একযোগে।

বেঁচে আছে তাহলে সে?’

‘হ্যাঁ…’

‘কবে আঘাত হানবে?’

‘জা-নি-না…’

‘তার প্ল্যান কি?’

‘জা-নি-না…’

মাটির নিচে জেলখানার ঠিক বাইরে শহরতলি প্যারিস বহুবর্ণ আলোর ঝলমলে সাজ পোশাক পরে রাত্রিকালীন উৎসবে মেতে উঠেছে তখন। কাছেই একটা পার্ক। জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অল্প বয়েসী যুবক যুবতীরা। ঝর্ণার ধারে বসে চোখে চোখে কথা বলছে প্রেমিক প্রেমিকারা। চার ঠোঁট এক করে স্বাদ নিচ্ছে স্বর্গ-সুধার। উচ্ছ্বাস ভরা চাপা নারী-কণ্ঠের সুরেলা হাসি বাতাসে কি অদ্ভুত মূর্ছনা তুলছে!

আরও পনেরো মিনিট জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো দুর্গন্ধময় বমিতে ভেজা রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড—ম্যাটাপ্যানকে। প্রথম দশ মিনিট কয়েকশো প্রশ্নের উত্তরে মাত্র পাঁচবার ‘জা-নি-না’ বলল সে। শেষের পাঁচ মিনিট কিছুই বলল না। কারণ, পাঁচ মিনিট আগেই মারা গেছে ম্যাটাপ্যান।

নিশ্চিন্তে মরা সাপের মত ঘুমোচ্ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি ফ্রান্সের প্রচণ্ড শক্তিশালী প্রশাসন যন্ত্রটা। সেদিনই ভোর রাতের দিকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল তার, বিশাল দেহটা আড়মোড়া ভেঙে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। শুরু হলো মাত্র একজন লোকের বিরুদ্ধে বিশ্বের এক বৃহৎ শক্তির ব্যাপক অভিযান, স্মরণীয় কালের ভয়ঙ্করতম ম্যানহান্ট।

রাত আড়াইটা।

ফ্রেঞ্চ অ্যাকশন সার্ভিসের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী চীফ কর্নেল বোল্যান্ডের বেডরূম। টেলিফোনের রিসিভার ধরা কর্নেলের বাঁ হাতটা থরথর করে কাঁপছে ক্রাডলে রিসিভারটা এমন আলতোভাবে নামিয়ে রাখল, যেন হীরের চেয়েও দামী সেটা। তারপর ঝট করে সিধে হয়ে দাঁড়াল সে, প্রকাণ্ড মুখটা আক্রোশে বিকৃত, ভীতিকর দেখাচ্ছে, খাঁচায় বন্দী হিংস্র বাঘের মত পায়চারি শুরু করল কামরার ভিতর।

মাত্র দশ মিনিট আগে কাঁচা ঘুম ভাঙানো হয়েছে কর্নেলের। পরনে এখনও স্লিপিং গাউন। গাউনের ফিতেটা কোমরে বাঁধা হয়নি, ঘরের কার্পেটে লুটাচ্ছে সেটা, একান্ত অনুগত লেজের মত এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক আসা যাওয়া করছে কর্নেলের পিছু পিছু।

কামরার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাকশন সার্ভিসের পাঁচজন পদস্থ অফিসার। পাঁচ জোড়া চোখ নিঃশব্দে অনুসরণ করছে অস্থিরভাবে পায়চারিরত কর্নেল বোল্যাডকে

বেড সাইড টেবিলে জেমস ক্লিপ দিয়ে আটকানো কয়েকটা কাগজ পড়ে রয়েছে। ম্যাটাপ্যানের স্বীকারোক্তি

পায়চারি থামিয়ে বাঁ হাতটা চোখের সামনে তুলে রিস্টওয়াচ দেখল কর্নেল বোল্যান্ড। চেহারায় অধৈর্যের ছাপ ফুটে উঠল তার। কাপুকে ফোন করার আগেই সে খবর পাঠিয়েছে পার্সোন্যাল সেক্রেটারিকে। অথচ এখনও তার দেখা নেই। চরকির মত আধ পাক ঘুরে আবার টেলিফোনের দিকে এগোল সে। এমন সময় মৃদু নক হলো দরজায়।

‘কাম ইন!’ দরজার দিকে ফিরে হুঙ্কার ছাড়ল কর্নেল 1

রাইটিং প্যাড আর কলম হাতে নিয়ে কামরায় ঢুকল মেয়েটা। সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে। পাকা টসটসে আঙুরের মত লাগছে দেখতে। প্রসাধন নেই মুখে, তাজা ফুলের মত স্নিগ্ধ চেহারাটা। এক নজর দেখে নিল গম্ভীর-দর্শন পাঁচজন অফিসারকে। হাঁটার গতি না কমিয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে বসের সামনে দাঁড়াল সে।

হাত তুলে বেডসাইড টেবিলটা দেখল কর্নেল বোল্যান্ড। ‘বিছানায় বসে নোট নাও।

‘জ্বী, মশিয়ে,’ বিছানায় বসে রিপোর্টটা একপাশে সরিয়ে রাখল পার্সোন্যাল সেক্রেটারি। টেবিলে রাইটিং প্যাড রেখে কলম বাগিয়ে ধরে ঝুঁকে পড়ল সেটার উপর।

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বেডসাইড টেবিলের সামনে দাঁড়াল কর্নেল বোল্যান্ড। তার ভাবভঙ্গি এবং চেহারা থেকে সমস্ত উত্তেজনার ছাপ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আশ্চর্য শান্ত, গভীর চিন্তান্বিত দেখাচ্ছে তাকে। এটা তার একটা বৈশিষ্ট্য, কাজের সময় ভাবাবেগকে কখনও প্রশ্রয় দেয় না। কাপুর কাছ থেকে এইমাত্র পাওয়া নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে যাচ্ছে সে।

‘ও-এ-এস সম্পর্কে সব জানা আছে তোমার, তাই না, জিনি?’ মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল কর্নেল।

‘জী, মশিয়ে,’ প্রশ্ন শুনে একটু বিস্মিত হলো জিনি, কিন্তু উত্তর দিতে দেরি করল না।

সিক্রেট আর্মি অরগানাইজেশন, সংক্ষেপে এবং উল্টো করে বলা হয় OAS, আলজিরিয়াকে স্বাধীনতা দেয়ার সময় জেনারেল দ্য গল বিরোধী এই গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটি সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত লোকজনদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। ও- এ-এস গোটা ফ্রান্স জুড়ে এক সময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল দ্য গল বেঁচে থাকতেই। দ্য গলের মৃত্যুর পরও এদের কর্মতৎপরতা কমেনি। তবে মূল লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে.ও-এ-এস। আলজিরিয়াকে আবার ফ্রান্সের অন্তর্ভুক্ত করার শপথ ভুলে এরা এখন লুটপাট, ডাকাতি, খুন-খারাবি, কিডন্যাপ ইত্যাদি অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েছে।

জেনারেল দ্য গলকে খুন করার জন্যে মোট ছয়বার চেষ্টা করে সিক্রেট আর্মি অরগানাইজেশন, প্রতিবারই ব্যর্থ হয় তারা। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিসকার দেস্তার উপরও তাদের বিদ্বেষ কম নয়, কেননা তিনিও একজন দ্য গল পন্থী হিসেবে পরিচিত। দেস্তা প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকে বহুবার গুজব রটেছে যে ও-এ-এস তাঁকে খুন করার ষড়যন্ত্র করছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর প্রাণের উপর কোন হামলা হয়নি। তা সত্ত্বেও সিক্রেট আর্মি অরগানাইজেশন সম্পর্কে বর্তমান ফ্রেঞ্চ প্ৰশাসন দারুণ উদ্বিগ্ন। ওয়াকিফহাল মহলের ধারণা, ফ্রান্সের আইনরক্ষক বাহিনীগুলো দেশ জুড়ে ও-এ-এস-এর পরিচালিত হাঙ্গামার ধাক্কা সামলাতেই অধিকাংশ সময় এবং শ্রম ব্যয় করে। ও-এ-এস অত্যন্ত শক্তিশালী একটি সংগঠন, গোটা ফ্রান্স জুড়ে তুমুল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা এদের পক্ষে সম্ভব

‘প্রথমে বিস্তারিত একটা রিপোর্ট তৈরি করবে,’ শুরু করল কর্নেল বোল্যান্ড। ‘রিপোর্টের মূল বক্তব্য—-প্রেসিডেন্ট জিসকার দেত্তার বিরুদ্ধে ও-এ-এসের ষড়যন্ত্র নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, এবার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্ল্যান এঁটেছে ওরা। ওদের প্রায় সমস্ত লোককে আমরা চিনি। তাই প্রেসিডেন্টকে খুন করার জন্যে তারা সংগঠনের বাইরে থেকে একজন বিদেশী খুনীকে ভাড়া করেছে। এ ব্যাপারে তারা সম্ভাব্য সবরকম সাবধানতা অবলম্বন করে এগোচ্ছে। সংগঠনের চীফ ছাড়া এই ভাড়াটে খুনীর পরিচয় সম্পর্কে কারও কিছু জানা নেই, এবং চীফ লোকটার হদিস আমাদের জানা নেই। ভাড়াটে খুনী সম্পর্কে আমরা শুধু জানতে পেরেছি সান্তিনো ভ্যালেন্টি ছদ্মনাম নিয়ে রোম থেকে লন্ডনে পৌঁছেছে সৈ। এই মুহূর্তে সে কোথায়, আমরা তা জানি না। গোপনে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। প্রথম রিপোর্ট এখানেই শেষ। রিপোর্টের নিচে ফুটনোট থাকবে।’ একটু বিরতি নিল কর্নেল। কি যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘ফুটনোটে পরিষ্কার অফিশিয়াল নিৰ্দেশ থাকবে, এই রিপোর্ট সাধারণ্যে প্রকাশ করা নিষেধ। ফ্রেঞ্চ প্রশাসন টের পেয়ে গেছে, এ-খবর ও-এ-এস-এর কর্মকর্তা বা তার নিযুক্ত ভাড়াটে খুনীর কানে যদি যায়, তারা সাবধান হয়ে যাবে, এবং সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের হবু খুনীকে আটকানোর কোন আশাই থাকবে না।’

থামল কর্নেল। টেবিলের কিনারায় দু’হাত রেখে সামনের দিকে ঝুঁকল একটু, তারপর আবার বলল, ‘এই রিপোর্টের একটা করে টাইপড্ কপি, আমার সই-সহ, মন্ত্রীসভার প্রত্যেক সদস্য ও সব মন্ত্রণালয়ের প্রত্যেক চীফ সেক্রেটারির কাছে যাবে। এছাড়া একটা করে কপি SDECE-এর চীফ, প্রেসিডেন্ট হাউজের চীফ সিকিউরিটি অফিসার, চীফ অভ পারসোন্যাল স্টাফ, ডিরেক্টর অভ সুরেত, চীফ অভ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, চীফ অভ মেট্রোপলিটান পুলিস, চীফ অভ ডিটেকটিভ ফোর্স, চীফ অভ হোমিসাইড ডিভিশন এবং সুরেতের পাঁচ বিভাগের পাঁচ প্রধানের কাছেও পাঠাতে হবে।’

শর্টহ্যান্ডে দ্রুত সব লিখে নিয়েছে জিনি। কর্নেল থামতে সে-ও রাইটিং প্যাড থেকে মুখ তুলে তাকাল।

অন্যমনস্কভাবে সিধে হয়ে দাঁড়াল কর্নেল বোল্যান্ড। টেবিল থেকে চুরুটের বাক্সটা তুলে নিয়ে একটা চুরুট ধরাল। পায়চারি শুরু করল আবার।

নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে অ্যাকশন সার্ভিসের পাঁচজন অফিসার গম্ভীর, থমথমে প্রত্যেকের চেহারা।

কর্নেলকে অনুসরণ করছে জিনির দৃষ্টি।

ধীরে ধীরে টেবিলের কাছে ফিরে এল কর্নেল বোল্যান্ড। ‘এবার একটা সংক্ষিপ্ত নোটিস তৈরি করো। আজ সকাল আটটায় আমার এই বাড়িতে টপ সিক্রেট মীটিং বসবে। বৈঠকে অংশ গ্রহণ করার জন্যে নোটিস যাবে সুরেতের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর কর্নেল প্যাপন, ফ্রেঞ্চ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ জেনারেল মনরো, মেট্রোপলিটান পুলিস ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ ম্যাক্স বার্না, ডিটেকটিভ ফোর্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ গ্রিমাউদ, প্রেসিডেন্ট হাউজের অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ সিকিউরিটি অফিসার লেফটেন্যান্ট রঁদে এবং সুরেতের পাঁচ বিভাগের পাঁচজন উপপ্রধানসহ পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের তিনজন সরকারী সচিবের কাছে। কথা শেষ করে ভুরু কুঁচকে ভাবছে কর্নেল বোল্যান্ড, বৈঠকের আলোচ্য বিষয় কি হবে তা নোটিসে উল্লেখ করার দরকার আছে কি?…না নেই—কারণ, কাপু রাত শেষ হবার আগেই এদের সবাইকে সাক্ষাৎ দেবেন, তাঁর কাছ থেকে প্রত্যেকে নির্দিষ্ট নির্দেশ পাবে। মাসুদ রানার এই গোপন এবং নীরব হুমকিটা মোকাবিলা করার জন্যে তিনি নিজেই নেতৃত্ব দেবেন বলে ঠিক করেছেন। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো ‘পাঁচজন অফিসারের দিকে তাকাল কর্নেল বোল্যান্ড। বলল, নোটিসগুলো তোমরা যার যার হাতে দিয়ে আসবে।’

নিঃশব্দে মাথা কাত করল পাঁচজন।

জেমস ক্লিপ দিয়ে আটকানো রিপোর্টটা জিনিকে দেখাল কর্নেল বোল্যান্ড। ‘ডজন দুই কপি করতে হবে এটার। স্ব কাজ শেষ হলে এখানে অপেক্ষা করবে আমার জন্যে।’

কথা শেষ করে দ্রুত পাশের কামরায় গিয়ে ঢুকল কর্নেল। দশ মিনিট পর নিচে থেকে ভেসে এল একটা গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ। কর্নেল বোল্যান্ডকে নিয়ে গেট পেরোল গাড়িটা, তীরবেগে ছুটে চলল কাপু উ সেনের দুর্গম দুর্গ অভিমুখে।

.

সকাল আটটা। কর্নেল বোল্যান্ডের স্টাডিরূমে গুরুত্বপূর্ণ টপ-সিক্রেট বৈঠক চলছে। নোটিস পেয়ে প্রত্যেকে যথাসময়ে হাজির হতে গাফলতি করেনি। এরা সবাই কাপু উ সেনের একান্ত অনুগত, ইউনিয়ন কর্সের একনিষ্ঠ সেবক। পরবর্তী কাপু হবার সম্ভাবনা আছে, এদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে দু’একজন।

বৈঠকের শুরুতেই সবাইকে পড়তে দেয়া হলো ম্যাটাপ্যানের টাইপ করা স্বীকারোক্তি। নিঃশব্দে পড়া শেষ করল সবাই।

মাসুদ রানাকে খুঁজে বের করার জন্যে কোন্ পন্থা সবচেয়ে বেশি উপযোগী, সে-পন্থা অবলম্বন করতে হলে কোন্ পথে এগোতে হবে তা পরিষ্কার ভাবে প্রত্যেককে বুঝিয়ে দিয়েছে কাপু উ সেন। সুতরাং, চলতি গোপন বৈঠকে কথা এবং সময় কোনটাই বেশি খরচ করতে হলো না। সর্বসম্মতিক্রমে কর্নেল বোল্যান্ডকে সমন্বয় সাধনকারীর দায়িত্ব দেয়া হলো। এখন থেকে প্রত্যেকের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট করবে সবাই তার কাছে, সে সরাসরি সেই রিপোর্ট দাখিল করবে কাপুর কাছে। সভাপতির আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল কর্নেল বোল্যান্ড। তাকে অবিচল, গম্ভীর দেখাচ্ছে। অনুচ্চ, ভরাট গলায় কথা বলতে শুরু করল সে।

‘মাসুদ রানা সম্পর্কে আপনাদেরকে নতুন করে কিছু বলার নেই আমার। তাকে জীবিত ধরার জন্যে কাপু স্বয়ং তাঁর মহামূল্যবান সময় দিচ্ছেন, এ-থেকেই বোঝা যায় লোকটার ওপর তাঁর কী ভীষণ ক্রোধ রয়েছে।’ একটু বিরতি নিল কর্নেল। প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার করে তাকাল। তারপর আবার শুরু করল, ‘কাপুর নির্দেশ আমরা সবাই পেয়েছি, তবু তাঁর নির্দেশ বুঝতে যাতে কারও ভুল না হয়, তাই আমি সংক্ষেপে তাঁর নির্দেশগুলোই আবার সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি। এক, গোটা ফ্রেঞ্চ প্রশাসনকে মাসুদ রানার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে হবে। সেজন্যেই রটানো হয়েছে, মাসুদ রানা প্রেসিডেন্ট জিসকার দেস্তাকে খুন করতে আসছে। দুই,…কিন্তু গোটা ব্যাপারটা চেপে রাখতে হবে, সাধারণ্যে প্রকাশ করা চলবে না। উদ্দেশ্য: মাসুদ রানা সতর্ক হবার সুযোগ যেন না পায়। তিন, নিরুদ্দেশ একজন লোক, যে সম্ভাব্য সব উপায়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে, তাকে খুঁজে বের করা পুলিস, স্পাই, সেনাবাহিনী—কারও পক্ষে সম্ভব নয়—এটা একটা বিশেষ ধরনের কাজ, সেজন্যে বিশেষ ধরনের লোক দরকার। মহামান্য কাপুর ধারণা, কাজটা গোয়েন্দা বিভাগের। বুদ্ধিমান একজন গোয়েন্দাই শুধু মাসুদ রানাকে খুঁজে বের করতে পারে।

‘কিন্তু,’ সুরেতের উপপ্রধান বিশাল বপু কর্নেল প্যাপন তার মাথা-জোড়া মন্ত টাকে হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘কাপু যে গোয়েন্দার ওপর এই কাজের দায়িত্ব চাপাতে চাইছেন সে লোক কর্সিকান নয়। তাকে আমরা কি ভাবে রাজি করাব…’

বিরক্তি ফুটে উঠল কর্নেল বোল্যান্ডের চেহারায়। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেল না, ‘হ্যাঁ, কাপু ক্লড র‍্যাঁবোর নাম বলেছেন। সে কর্সিকান নয়। তার মত উপযুক্ত গোয়েন্দা, কাপুর ধারণা, গোটা বিশ্বে দ্বিতীয়টি বোধহয় নেই। সেজন্যেই তিনি এই লোককে দায়িত্বটা দিতে চেয়েছেন।’ এতক্ষণে বিশাল বপু কর্নেল প্যাপনের দিকে তাকাল কর্নেল বোল্যান্ড। আপনি বুঝতে ভুল করেছেন, কর্নেল প্যাপন। হোমিসাইড, ডিটেকটিভ ফোর্স এবং ব্রিগেড-ক্রিমিনেলির চীফ ক্লড র‍্যাঁবো জানবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জিসকার দেস্তার জীবন বিপন্ন, এবং তাকে দায়িত্বটা নিতে বলবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চীফ সেক্রেটারি অথবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী স্বয়ং। তার মানে, আমরা নিজেরা তাকে রাজি করাতে যাচ্ছি না।

‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বা তার চীফ সেক্রেটারি,’ বলল কর্নেল প্যাপন, ‘এরাও কেউ কর্সিকান নয়।’

‘আমরা সবাই তা জানি,’ বলল কর্নেল বোল্যান্ড। ‘সেজন্যে কিভাবে কি করতে হবে তাও আমাকে বলে দিয়েছেন কাপু। আমরা এখানে যারা উপস্থিত রয়েছি তারা আজ অফিশিয়াল আওয়ার শুরু হবার সাথে সাথে যার যার বিভাগের প্রধানকে নিয়ে মীটিং করব। প্রধানরা ইতিমধ্যে ও-এ-এস-এর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে রিপোর্ট পেয়েছে, সুতরাং অধস্তনদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্যে অস্থির হয়ে আছে তারা। গোটা দায়িত্বটা ক্লড র‍্যাঁবোর ওপর ছেড়ে দেয়া হোক, একমাত্র সেই প্রেসিডেন্টকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে, এই পরামর্শ আমরা সবাই যার যার প্রধানকে দেব। পনেরো আনা কাজ এতেই হাসিল হয়ে যাবে। এরপর প্রধানরাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে রাজি করাবে, অথবা তারা সরাসরি প্রস্তাব দেবে ক্লড র‍্যাঁবোকে। ব্যাপারটা শুনেই ক্লড র‍্যাঁবো বুঝতে পারবে, কাজটা বিশেষভাবে তার, একজন গোয়েন্দার—সুতরাং, দায়িত্বটা নিতে উৎসাহই বোধ করবে সে।’

ডিটেকটিভ ফোর্সের উপপ্রধান মরিস গ্রিমাউদ গদি মোড়া চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। ছোটখাট শরীর, খুব কম কথা বলে। কাপু একে মাঝে মধ্যে বুদ্ধির সাগর বলে ডাকে। কর্নেল বোল্যান্ড থামতেই সে বলল, ‘গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেও পরিষ্কার হলো না। মাসুদ রানাকে যদি বিপদ বলে মেনেও নেই, তাকে ধরার জন্যে বাইরের লোকের সাহায্য চাওয়ার দরকার পড়ছে কেন? তার মানে কি এই যে কাপু আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না?

‘না, ব্যাপারটা তা নয়,’ বলল কর্নেল বোল্যান্ড। ‘রানাকে ধরার আগে অনেক বাধার প্রাচীর টপকাতে হবে। কাপু চাইছেন বাধা টপকাবার কাজগুলো অন্যের দ্বারা সম্পন্ন হোক। আসল কাজে হাত আমরাই দেব।

ফ্রেঞ্চ এসপিওনাজের বাঘা জেনারেল তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দাঁত দিয়ে পাইপ কামড়ে ধরে থাকা অবস্থায় বলে উঠল, ‘কাপুর বিপদটা যে কোথায়, সেটাই দেখতে পাচ্ছি না আমি। অনেক দিন পর আজ আবার কাপুর আস্তানায় ঢোকার সৌভাগ্য হলো আমার। কি দেখলাম? মাই গড, একেই বলে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কাপু নিজে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, তবু পঁচিশ জায়গায় দাঁড় করিয়ে চেক করা হয়েছে আমাকে। ওই দুর্গম দুর্গে মাসুদ রানা ঢুকতে পারবে? পারবে—তবে সাতশো কারবাইনধারীর লাশ টপকাতে হবে ব্যাটাকে।’

‘তাই তো!’ একযোগে বলে উঠল কয়েকজন।

কর্নেল বোল্যান্ডের চেহারায় কোন পরিবর্তন ঘটল না। আগের মতই গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে। মৃদু গলায় সে বলল, ‘কাপুর প্রাসাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা স্মরণ করে এই একই প্রশ্ন উদয় হয়েছিল আমার মনে। প্রশ্নটা তুলে কাপুর কড়া ধমক খেতে হয়েছে আমাকে। সে যাই হোক, ভুল ধারণাটার এখুনি অবসান হওয়া দরকার। মাসুদ রানা কাপুর জন্যে কোনরকম বিপদ নয়। কাপুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন নিখুঁত যে আকাশ থেকে বজ্রপাত হলেও তা বাধা পাবে, কাপুকে স্পর্শ করতে পারবে না।

‘তাহলে এই তোড়জোড়, গোটা প্রশাসনকে লেলিয়ে দেয়া…’ বিশাল বপু কর্নেল প্যাপনের চর্বিসর্বস্ব থলথলে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। ‘…এসবের দরকার কি?’

‘এসব দরকার তাকে ধরার জন্যে। যাতে সে কোনমতেই বিপদ আঁচ করতে পেরে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে সফল না হয়। গোপনে ছোবল মারার চেষ্টা করবে সে, কিন্তু কাজটা অসম্ভব, এই সত্য বুঝতে পারবে সে এক সময়, তখনই পিছু হটতে চাইবে, কিন্তু তাকে পিছু হটতে দেয়া হবে না। তাছাড়া আর একটা ব্যাপার আছে। কে বলতে পারে সে কি ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে কোনদিক থেকে আক্রমণ করবে? আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোথাও সামান্য একটা ছিদ্র রয়ে গেছে কিনা কে বলতে পারে? আশ্চর্য বুদ্ধিমান ওই বাঙালী যুবক একবার পরাজিত করেছিল কাপুকে—আবারও করবে না, সে-নিশ্চয়তা কোথায়?’ মৃদু হাসি ফুটল কর্নেল বোল্যান্ডের পুরু ঠোঁটে। ‘অবশ্য আমার মনে হয়, বিপদটা কাপুর, একথা ভাবা হাস্যকর বোকামি ছাড়া কিছুই নয় আমাদের। বিপদ আসলে মাসুদ রানার। সে পাগল হয়ে গেছে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু এক সময় তার হুঁশ ফিরবে, তখনই চেষ্টা করবে সে পালিয়ে যেতে, কিন্তু তার ফিরে যাওয়ার সমস্ত পথ আমরা বন্ধ করে দেব।

একটু বিরতি নিল কর্নেল বোল্যান্ড। পুরু ঠোঁট থেকে মুছে গেছে হাসির রেশ, এখন আবার তাকে আগের মত গম্ভীর দেখাচ্ছে! বলল, ‘কাপুর শেষ নির্দেশটাই সবচেয়ে জরুরী। মাসুদ রানাকে জীবিত অবস্থায় তাঁর সামনে হাজির করতে হবে। এর অন্যথা তিনি সহ্য করবেন না।’

তিন মিনিট পর বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো।

.

লন্ডন। সেদিনেরই বিকেল। চারটে বাজতে বিশ মিনিট বাকি। লন্ডনের সেরা সী- ফুড বিশেষজ্ঞদের তৈরি ব্যয়বহুল লাঞ্চ খেয়ে কানিংথাম থেকে কার্জন স্ট্রীটে বেরিয়ে এল রানা। এক হাতে স্টিয়ারিং হুইল, অপর হাতে সিগারেট। বাঁক নিয়ে সাউথ অডলি স্ট্রীটে ঢোকার সময় ভাবছে, লন্ডনে এটাই সম্ভবত শেষ লাঞ্চ ওর। আবার কবে আসা হবে, কে জানে।

হাতের সব কাজ শেষ, মনটা হালকা থাকারই কথা। কিন্তু আজ সকাল থেকে কেন যেন ম্রিয়মাণ হয়ে আছে, মুষড়ে আছে মনটা। দু’একবার অদ্ভুত একটা সন্দেহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে—কোথায় যেন কি সব আয়োজন চলছে তার বিরুদ্ধে। সাধারণত এমন হয় না। কিন্তু কোথাও যদি ওর বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হয়, কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় ও। মনের এই কুঁকড়ে থাকা ভাবটা কি তারই পূর্বাভাস দিচ্ছে?

ও বেঁচে আছে, দেশত্যাগ করেছে উ সেনকে খুন করার জন্যে—এখবর ইউনিয়ন কর্স পাবার পরমুহূর্ত থেকে ফ্রান্স জুড়ে কি ঘটতে শুরু করবে, অনুমান করতে পারে রানা। ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবে উ সেন। সম্ভাব্য সব কৌশল প্রয়োগ করে তার কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করবে রানা, এটা বুঝতে পেরে উ সেনও সম্ভাব্য সব উপায়ে ওকে ঠেকাবার বা খুন করার চেষ্টা করবে। তার প্রথম কাজই হবে যেভাবে হোক ফ্রান্সের প্রশাসনকে ওর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা। অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী উ সেনের পক্ষে কাজটা পানির মত সহজ।

ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত একটু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। রানা জানে, ওর সম্পর্কে কোন নতুন খবর ইউনিয়ন কর্স পাবে না। বিদেশীদের মধ্যে মাত্র তিনজন জানে ও বেঁচে আছে। গগলকে বাদ দিলে দু’জন—ম্যাটাপ্যান এবং মোনিকা এদের কারও কাছ থেকে খবরটা আদায় করার কোন সম্ভাবনা নেই ইউনিয়ন কর্সের। সন্দেহবশত এদেরকে যদি ধরেও কর্স, মোনিকা স্রেফ আত্মহত্যা করবে, কিন্তু মুখ খুলবে না। আর ম্যাটাপ্যান? গভীরভাবে চিন্তা করছে রানা। কি করবে ম্যাটাপ্যান? না, আত্মহত্যা করবে না সে। প্রথমে কয়েকজন কর্সিকান খুন করবে সে, তারপর বাকিগুলোর হাতে খুন হবে।

সে যাই হোক, মনের এই নিস্তেজ ভাবটা কিন্তু ভাল লক্ষণ নয়, ভাবছে রানা। ফ্রান্সে যদি ওর বিরুদ্ধে ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া হয়ও, তাতেই বা ভয় পাবার কি আছে? সে-ধরনের ভয়ঙ্কর বিপদ দেখা দিতে পারে ভেবেই তো অতিরিক্ত সময় নিয়ে সম্ভাব্য সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করে এগোচ্ছে ও।

আবার নিজের প্ল্যান এবং পন্থাটা খুঁটিয়ে বিচার করল রানা। আত্মবিশ্বাস ফিরে এল ওর মনে। কোন ফুটো, কোন খুঁত নেই ওর প্ল্যানে। প্রস্তুতি পর্বের কোথাও এখন পর্যন্ত কোন ভুল করেনি ও। হালকা হয়ে গেল মনটা। যেখানে যত খুশি পরিকল্পনা নেয়া হোক ওর বিরুদ্ধে, কিছুই এসে যায় না তাতে। ওর খোঁজ পাওয়ার, ওকে ধরার সাধ্য কারও নেই।

তাছাড়া, ন্যায়ের পক্ষে রয়েছে ও, ভাবল রানা, ভাগ্য তো ওকেই সাহায্য করবে। অর্থাৎ ওর এই ব্যক্তিগত অ্যাসাইনমেন্টে বড় একটা ভূমিকা রয়েছে ভাগ্যের, মনে মনে একথাটা স্বীকার করতেই হলো রানাকে।

.

প্যারিস। রাত দশটা

বিস্ময়ে আচ্ছন্নের মত কনফারেন্স রূম থেকে বেরিয়ে এলেন দুনিয়ার সেরা গোয়েন্দা ক্লড র‍্যাঁবো। অদ্ভুত একটা কাজের দায়িত্ব চাপানো হয়েছে তাঁর ঘাড়ে। কাজটার ধরন, এর সাফল্যের গুরুত্ব, ব্যর্থতার খেসারত এবং গোটা ব্যাপারটা গোপন রাখার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটানা সত্তর মিনিট তাঁকে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী।

কনফারেন্স রূমে ঢুকতেই তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, এগিয়ে এসে তাঁর সাথে করমর্দন করেন, এবং সাদরে টেনে নিয়ে গিয়ে টেবিলের শেষ মাথায় নিজের পাশের চেয়ারটিতে বসান। সভার কাজ শুরু হবার আগে তাঁকে একটা রিপোর্ট পড়তে দেয়া হয়। রিপোর্টটা রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ও-এ-এস-এর ষড়যন্ত্র এবং তার ভাড়াটে খুনী সম্পর্কে। এটা অ্যাকশন সার্ভিসের চীফ কর্নেল বোল্যান্ডের তৈরি। আজ সকালে অফিসে পৌঁছেই এর একটা কপি নিজের টেবিলে দেখেছেন তিনি, এবং পড়েছেন, সুতরাং দ্বিতীয়বার আর পড়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না। রিপোর্টটায় দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। এবং লক্ষ করলেন, উপস্থিত হোমড়া চোমড়া ছত্রিশজন বিভাগীয় প্রধান ও উপপ্রধানরা তাঁর দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে আছে। ক্লড র‍্যাঁবোর মনে ঝনঝন করে এখনও একটা প্রশ্নই বাজছে, আমাকে ডাকার কারণ কি? সবার উন্মুখ দৃষ্টি আমার দিকে কেন?

এমন সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তাঁকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর বলার ভঙ্গিতে পরামর্শ বা অনুরোধের সুর ফুটল না। মৃদু, কিন্তু গম্ভীর গলায় তিনি শুধু জানালেন ঠিক কি করতে হবে তাঁকে: এই জাতীয় গুরুত্ববহনকারী দায়িত্ব পালন করার জন্যে হাতের সমস্ত কাজ এই মুহূর্ত থেকে স্থগিত রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য সরবরাহ করার জন্যে ফ্রেঞ্চ প্রশাসনের প্রতিটি বিভাগ দিবারাত্র একপায়ে খাড়া থাকবে, যখন তখন যে-কোন তথ্য চাইতে পারবেন তিনি, এবং সম্ভাব্য অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে তা সরবরাহ করা হবে। উপস্থিত ছত্রিশজন প্রধান এবং উপপ্রধানদের একত্রিত প্রশাসনিক ক্ষমতা তাঁর অধীনে ন্যস্ত করা হচ্ছে, এঁরা সবাই তাঁর দেয়া কাজের নির্দেশ বিনা বাক্যে সম্পন্ন করতে রাজি। দায়িত্বটা পালন করতে খরচপাতি যা লাগে লাগবে, কোন রকম সীমা বেঁধে দেয়া হচ্ছে না।

রাষ্ট্রপ্রধানের প্রাণ বিপন্ন, এ খবর গোপন রাখার একান্ত প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একবার নয়, তিনবার ব্যাখ্যা দিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। তাঁর কথা শুনে ক্রমশ দমে যেতে লাগল ক্লড র‍্যাঁবোর মন। এরা চাইছে—না, দাবি করছে যা সম্ভব নয় তাই। কোন্ পথে এগোবে সে? সূত্র কোথায়? অপরাধই সংঘটিত হয়নি এখনও – সূত্র আসবে কোত্থেকে? সাক্ষী, তাও নেই। দু’জন সাক্ষীর একজন নাকি দুর্ঘটনাবশত মারা গেছে। আরেকজন ও-এ-এস-এর চীফ, তার অজ্ঞাতবাস সম্পর্কে কারও কোন তথ্য জানা নেই। জানা থাকলেও লোকটার সাথে কথা বলার সুযোগ হত না তাঁর। থাকার মধ্যে আছে শুধু একটা নাম, তাও সেটা একটা ছদ্মনাম এবং নির্ঘাত পরিবর্তনশীল। দুনিয়ার যে কোন জায়গায় থাকতে পারে এই লোক। কোথায় তাকে খুঁজবেন তিনি?

রোগা পাতলা শরীরের ক্লড র‍্যাঁবো অত্যন্ত সাধারণ চেহারার, সাধারণ পোশাকধারী পঞ্চাশোত্তীর্ণ একজন প্রৌঢ়, কিন্তু অসাধারণ প্রতিভাবান একজন পুলিসের সমস্ত গুণ তাঁর মধ্যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। ভদ্রলোক মৃদুভাষী। কথা বলার সময় তাঁর হাবভাবে অদ্ভুত একটা বিনয় ফুটে ওঠে। কিন্তু তাঁকে যারা চেনে তারা জানে, ন্যায় এবং সত্যের সমর্থনে তাঁর মত জেদী লোক ফ্রান্সে আর দ্বিতীয়টি নেই।

চেহারায় অদ্ভুত একটা দেবসুলভ সহনশীলতার ছাপ রয়েছে র‍্যাঁবোর। কোন পরিস্থিতিতেই তিনি ধৈর্য হারান না। অপরাধীর প্রতি ঠাণ্ডা অথচ নির্মম মনোভাব তাঁর মজ্জাগত। তাঁর সাফল্যের মূলে রয়েছে কাজের প্রতি একাগ্র মনোযোগ, এবং নিষ্ঠা। যে কোন কাজকেই একটা সাঙ্কেতিক ধাঁধা হিসেবে গ্রহণ করেন। প্ৰথমে অঙ্কটা জেনে নেন, তারপর নিয়ম ধরে তার উত্তর পাবার চেষ্টা করেন। একটা কেস শেষ করতে অন্যদের চেয়ে কিছুটা বেশি সময় নিয়ে থাকেন তিনি, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে ভুল হবার যেমন সম্ভাবনা থাকে, তাঁর ক্ষেত্রে সে ধরনের কোন সম্ভাবনা একেবারে থাকে না বললেই চলে। এখানেই তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য। ব্লুড র‍্যাঁবো আত্মপ্রচারকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করেন।

অত্যন্ত সাদামাঠা জীবন তাঁর। শহরতলির ছোট একটা বাড়িতে থাকেন। প্রচুর, অগুণতি আইনের এবং ক্রিমোনোলজির বই ছাড়া উল্লেখযোগ্য আর কিছু এই বাড়িতে নেই। তিনি বিয়ে করেননি। বই এবং কাজ ছাড়া আরও একটা জিনিসের সাথে গভীর প্রেম আছে তাঁর, সেটা হলো তাঁর ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। ক্লড র‍্যাঁবোর দাড়িটা মেহদী দিয়ে রাঙানো বলে মনে হয়।

সোনালী ফ্রেমের বাইফোকাল একটা চশমা পরেন তিনি। ঘুমের সময়টা ছাড়া তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হলো ক্যান্সারের দোসর জ্বলন্ত চুরুট।

বাইরে বেরিয়ে এসে ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে অফিসে ফিরে যেতে বললেন তিনি। কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তাঁকে একটা লিফট দেবার প্রস্তাব দিয়েছেন। কালো মার্সিডিজের ব্যাক সীটে বসে চোখ বুজে মন্ত্রী মহোদয় কি যেন ভাবছেন। আর ক্লড র‍্যাঁবো ঘন ঘন চুরুটে ফুঁক দিয়ে সুগন্ধী ধোঁয়া ছাড়ছেন এবং মাঝে মাঝে তাঁর মেহদী রঙের দাড়িতে হাত বুলাচ্ছেন।

‘আপনার কি নতুন একটা অফিসের দরকার হবে?’ চোখ মেলে পাশে বসা রোগা পাতলা লোকটার দিকে তাকালেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ।

‘প্রয়োজন দেখি না,’ মৃদু গলায় বললেন ক্লড র‍্যাঁবো।

‘যখনই যা প্রয়োজন হবে, সরাসরি আমাকে জানাতে পারেন আপনি,’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন।

‘একজন সহকারী দরকার হবে আমার,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। আমার একান্ত সচিব চার্লস ক্যারনকে নিতে পারি?’

একটু ভাবলেন মন্ত্রী মহোদয়, তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে। আর কাউকে দরকার হবে?

‘না। কিন্তু চার্লসকে সব কথা জানাতে হবে আমার।’

‘ঠিক আছে। তবে ঘণ্টাখানেক পর সব জানাবেন ওকে। এ ব্যাপারে আর সবার মতামত চাইব আমি, দেখি ওদের কারও আপত্তি আছে কিনা। ফলাফল এক ঘণ্টার মধ্যেই আপনাকে জানাতে পারব বলে আশা করি। তবে, চার্লস ক্যারন ছাড়া আর কারও কিছু জানা চলবে না। যত বেশি লোক জানবে ততই বাড়বে ব্যাপারটা সংবাদপত্রে রটে যাবার ভয়।

‘আর কেউ জানবে না,’ চুরুট কামড়ে ধরে অন্যমনস্কভাবে বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘শুধু ক্যারন।

‘শেষ আরেকটা কথা,’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন, ‘আপনি সভায় উপস্থিত হবার আগেই সবাই আলোচনাক্রমে ঠিক করেছে আপনার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একটা করে রিপোর্ট দাখিল করতে হবে গোটা গ্রুপের সামনে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আমার কনফারেন্স রূমে মীটিং বসবে, আপনি সবাইকে পড়ে শোনাবেন রিপোর্টটা। রাত ঠিক দশটার সময়।

‘কিন্তু…’

‘এর প্রয়োজন আছে,’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বললেন, ‘আপনার ওপর দায়িত্ব চাপানো হলেও, আর সব বিভাগ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকছে না। প্রতিদিন একবার সবার মিলিত হওয়া দরকার, তাহলে পরস্পরের অগ্রগতি সম্পর্কে সবাই জানতে পারবে।’ একটু বিরতি নিলেন তিনি, তারপর বললেন, ‘সবাই যার যার পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ শুরু করলেও, আমরা কিন্তু আপনার ওপরই ভরসা করছি। প্রেসিডেন্টের কোন রকম ক্ষতি করার আগেই লোকটাকে ধরতে হবে আপনার। কাজটা খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব, জানি। লোকটার নির্দিষ্ট কোন টাইম-টেবল আছে কিনা, থাকলে সেটা কি, এসব কিছুই আমরা জানি না। হয়তো আগামীকাল সকালকেই বেছে নিয়েছে সে, কিংবা হয়তো আগামী মাসের শেষ দিকের কোন একটা দিনে আঘাত হানবে বলে ঠিক করেছে।

‘আমার একটা প্রশ্ন আছে,’ কথা বলার সময় ক্লড র‍্যাঁবোর মুখ থেকে মৃদু ধোঁয়া বেরোল।

‘বলুন,’ সাগ্রহে জানতে চাইলেন মন্ত্রী মহোদয়।

‘লোকটাকে খুঁজে দিলাম, সেখানেই কি আমার দায়িত্ব শেষ?’

‘হঠাৎ এ-প্রশ্ন কেন, মশিয়ে র‍্যাঁবো?

একটু চিন্তা করলেন বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা, তারপর মৃদু হেসে বললেন, ডেকে নিয়ে এসে আমার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপাবার ভঙ্গিটার মধ্যে অদ্ভুত একটা অস্বাভাবিকতা আছে। তাই কেন যেন মনে হচ্ছে, কাজটা পুরোপুরি শেষ করার আগেই বোধহয় আমার ঘাড় থেকে তুলে নেয়া হবে দায়িত্বটা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ক্লড র‍্যাঁবোর দিকে। ধীরে ধীরে তিনি বললেন, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন, মশিয়ে র‍্যাঁবো। অ্যাকশন সার্ভিসের ইচ্ছা, আপনি শুধু লোকটার হদিস জানাবেন, বাকি কাজ, তারাই করবে।

কাঁধ ঝাঁকালেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘তাতে আমার আপত্তি নেই।

স্বস্তির একটা হাঁফ ছাড়লেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। বললেন, ‘ধন্যবাদ, মশিয়ে র‍্যাঁবো। মনে রাখবেন, ফ্রান্সের সবচেয়ে ক্ষমতাবান পুলিস এখন আপনি। এই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে জাতির কর্নধারকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার ওপর। আমি আপনার সাফল্য কামনা করি।’

নিঃশব্দে নতুন একটা চুরুট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন ক্লড র‍্যাঁবো। গাড়ি ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তিনি নামতে উদ্যত হয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ, মশিয়ে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

.

ছোট্ট অফিসের সর্বত্র ক্লড র‍্যাঁবোর ব্যক্তিগত সরল রুচির ছাপ সুস্পষ্ট। কামরাটা এতই সাদাসিধে ভাবে সাজানো যে মনেই হয় না এখানে বসে একজন লোক ফ্রান্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটে বিভাগকে পরিচালনা করেন। কামরাটা দৈর্ঘ্যে চোদ্দ ফিট, প্রস্থে বারো ফিট। দক্ষিণ দিকে দুটো ভারী পর্দা টাঙানো জানালা। জানালাগুলোর সামনে দাঁড়ালে বুলেভার্ড সেন্ট মিবেল, তারপর নদীটাকে দেখতে পাওয়া যায়। কামরায় দুটো ডেস্ক। একটা জানালার সামনে, অপরটা পুবদিকের দেয়াল ঘেঁষে—কুড র‍্যাঁবোর ব্যক্তিগত সচিবের জন্যে। দরজাটা জানালাগুলোর উল্টো দিকে।

ডেস্কের পিছনে রিভলভিং চেয়ার দুটো ছাড়া আসবাব বলতে আর রয়েছে কাঠের একটা খাড়া পিঠওয়ালা হাতলহীন চেয়ার, দরজার পাশে একটা আর্ম চেয়ার, বড় আকারের ছয়টা ফাইলিং কেবিনেট দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিম দেয়াল জুড়ে, এগুলোর মাথায় সুন্দরভাবে সাজানো রেফারেন্স আর ল বুক, জানালার পাশে লম্বা একটা বুক কেস, তাতে মোটা মোটা অসংখ্য বই সাজানো রয়েছে। দেয়ালের উপরের অংশে, জানালা দুটোর মাথার কাছে দুটো বড় বড় তৈলচিত্র শোভা পাচ্ছে। একটা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল দ্য গলের, অপরটি বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিসকার দেস্তার।

রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন ক্লড র‍্যাঁবো। ছোটখাট মানুষটা প্রায় ডুবে গেছেন মস্ত চেয়ারের কোলে। একটা হাত চেয়ারের হাতলে লম্বা হয়ে পড়ে আছে, আঙুলের ফাঁকে ধরা চুরুটটা আপন মনে নীলচে ধোঁয়া ছাড়ছে। চোখ বুজে আছেন ক্লড র‍্যাঁবো। দেখে মনে হতে পারে ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি।

অফিসে প্রবেশ করার পর প্রায় এক ঘণ্টা উত্তীর্ণ হতে চলেছে। এর মধ্যে দুটো মাত্র কাজ করেছেন ক্লড র‍্যাঁবো। তাঁর ব্যক্তিগত সচিবকে টেলিফোনে জানিয়েছেন, ঠিক একঘণ্টা পাঁচ মিনিট পর সে যেন তাঁর সাথে দেখা করে। এবং নিজের ডেস্ক থেকে সমস্ত ফাইল সরিয়ে ফেলেছেন।

ঠিক এক ঘণ্টা পর ঝন ঝন শব্দে ফোন বাজল। চোখ খুলে টেলিফোনের দিকে তাকালেন ক্লড র‍্যাঁবো। দ্বিতীয়বার রিঙ হবার পর হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা নিলেন তিনি, কানের কাছে ধরে জানতে চাইলেন, ‘মশিয়ে?’

অপরপ্রান্ত থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘মশিয়ে ক্লড, আপনার ব্যক্তিগত সচিবকে আপনি সহকারী হিসেবে নিতে পারেন।

‘ধন্যবাদ, মশিয়ে,’ দুটো মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে রিসিভারটা ক্র্যাডলে রেখে দিলেন ক্লড র‍্যাঁবো। চুরুটে মৃদু একটা টান দিয়ে আবার তিনি হেলান দিলেন চেয়ারে। চোখ বুজলেন। নাক দিয়ে মিহি ধোঁয়া বেরোচ্ছে।

ঠিক পাঁচ মিনিট পর মৃদু নক হলো দরজায়।

চোখ মেললেন ক্লড রাবো। দেখতে পাচ্ছেন, ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে যাচ্ছে। দীর্ঘদেহী, সুদর্শন এক যুবক প্রবেশ করল কামরায়। সবিনয়ে একটু মাথা নোয়াল সে, তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে এসে কড র‍্যাঁবোর ডেস্কের সামনে দাঁড়াল।

সিধে হয়ে বসলেন ক্লড ব্যাবো। তাঁর সরল মুখে স্নেহের হাসি ফুটে উঠেছে। ‘বসো, ক্যারন,’ মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি। চার্লস ক্যারন হাতলহীন কাঠের চেয়ারে নিঃশব্দে বসল, তারপর বলো, আমার নাতনী সুসনা আর আমার বেটি পদেমা ভাল তো?’ ব্যগ্রভাবে আরেকটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু কেমন যেন সঙ্কোচে জড়িয়ে পড়ে চুপ করেই থাকলেন।

‘ওরা দু’জনেই ভাল আছে,’ মুখস্থ বুলির মত বলল চার্লস ক্যারন। কাজ শুরুর আগে প্রতিদিন এই প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তাকে। ‘মজার একটা খবর আছে,’ বলল ক্যারন। লক্ষ করল, মুহূর্তে আগ্রহে উজ্জ্বল হয়ে উঠল বসের মুখটা, চোখ দুটো কি এক আশায় চক চক করছে। ‘আপনি ড্রয়িং-এর যে সরঞ্জাম উপহার দিয়েছিলেন, তার প্রতিদান হিসেবে সুসনা এক কাণ্ডই করেছে…’

‘কি ব্যাপার?’ সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়লেন ক্লড র‍্যাঁবো।

‘ফটো দেখে হুবহু আপনার একটা ছবি এঁকে ফেলেছে…’

টেবিলে চাপড় মেরে ছেলেমানুষের মত হোঃ হোঃ করে হেসে ফেললেন ক্লড র‍্যাঁবো। তারপর বললেন, ‘কি, আমি বলিনি? তোমার মেয়ের লম্বা লম্বা আঙুল দেখে তখনই আমি বুঝেছিলাম, এ মেয়ে জাত শিল্পী হয়ে জন্মেছে।’ হঠাৎ গম্ভীর হলেন ক্লড র‍্যাঁবো। বললেন, ‘দুনিয়াজোড়া যখন খ্যাতি হবে ওর, আমাকে নিয়ে আলোচনা না করে শিল্প-সমালোচকদের কোন উপায় থাকবে না তখন। শিল্পীর প্রথম সৃষ্টি একজন বুড়ো লোক, যার একমাত্র শখ রসুনের চাটনি তৈরি করা…’ অত্যন্ত কৌশলে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করলেন ক্লড র‍্যাঁবো। গত হপ্তায় এক বোতল রসুনের চাটনি নিজের হাতে তৈরি করে চার্লস ক্যারনের স্ত্রী পদেমাকে পাঠিয়েছেন। তাঁর তৈরি চাটনির প্রশংসা পাবার জন্যে ছেলেমানুষের মত ব্যগ্র হয়ে ওঠেন তিনি। কেউ যদি তাঁর চাটনি খেয়ে কোন মন্তব্য না করে, তিনি প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান। অবশ্য চাটনির প্রশংসা পাবার জন্যে তাঁর এই দুর্বলতার কথা খুব কম লোকই জানে। চার্লস ক্যারনেরও ব্যাপারটা জানা নেই। জানা থাকলে আজ তাকে এই তিরস্কার সহ্য করতে হত না।

ক্যারন ইতস্তত করছে। কি যেন বলতে চায় সে, কিন্তু সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারছে না।

‘কিছু বলবে, ক্যারন?

‘হ্যাঁ…না, মানে-পদেমা আপনাকে ফোন করতে চেয়েছিল, কিন্তু ধমক দিয়ে ওকে আমি…

‘কেন?’

‘আপনি ব্যস্ত মানুষ, আপনাকে এসব ব্যাপারে বিরক্ত করা অন্যায়— ‘কিন্তু ফোন করতে চেয়েছিল কেন?’

‘আপনার রসুনের চাটনির ব্যাপারে,’ ইতস্তত করছে চার্লস। ‘খুব নাকি ভাল লেগেছে…’

‘আচ্ছা!’ খুশিতে অদ্ভুত বদলে গেল প্রৌঢ়, ক্লড র‍্যাঁবোর চেহারা। চশমার ভিতর চোখ দুটো প্রায় বুজে এসেছে, ফুলে উঠেছে দু’দিকের গাল, ঠোঁটের দুই কোণ কানের লতি ছোঁয় ছোঁয়। আনন্দ উপচে পড়ছে তাঁর চেহারা থেকে। ‘খুব ভাল লেগেছে, তাই বলল বুঝি? বেশ বেশ, আর এক বোতল তাহলে পাঠাতে হবে। ঠিক আছে, আমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না, সময় হলেই…’ হঠাৎ তাঁর খেয়াল হলো, পদেমা ফোন করতে চেয়েছিল। ‘কেন?’ জানতে চাইলেন তিনি। ‘ফোন করতে চেয়েছিল কেন?’

ইতস্তত করছে এখনও চার্লস ক্যারন। বলল, ‘আরেক বোতল চাটনি চাইবে…কিন্তু ওকে আমি ধমক…’

শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল ক্লড র‍্যাঁবোর। দপ্ করে জ্বলে উঠল চোখ দুটো। নিমেষে প্রচণ্ড রাগে মুখটা লাল হয়ে উঠল তাঁর। ‘তুমি একটা অপদার্থ!’ গর্জে উঠলেন তিনি। ‘কমনসেন্স কি জিনিস, তাই তোমার জানা নেই! তুমি…’

অবাক বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছে চার্লস ক্যারন। কার সঙ্গে বসে রয়েছে সে? ইনিই কি ক্লড র‍্যাঁবো, তার বস্? বিশ্বাস করতে হিমশিম খাচ্ছে সে। ক্লড র‍্যাঁবোকে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলতে শোনেনি কেউ কোনদিন, রাগ করতে দেখা তো দূরের কথা, সেই ব্যক্তি রাগে অন্ধ হয়ে গেছেন, তার দিকে তর্জনী তুলে শাসাচ্ছেন! সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার, অথচ বাস্তব সত্য। কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল ক্যারন।

‘ছি-ছি-ছি!’ ক্লড র‍্যাঁবো তার সচিবকে ঠাস করে একটা চড় মারা থেকে অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছেন। ‘সুস্বাদু একটা খাবার জিনিস, মেয়েটার ভাল লেগেছে বলেই না আরেক বোতল চাইছে—আর তুমি কিনা তাকে ধমক মেরে..তারপর স্পর্ধার বলিহারি, আমাকে আবার শোনাচ্ছ!’ একটা হাত উঁচু করলেন তিনি, তর্জনী খাড়া করে শাসাতে শুরু করলেন, ‘ফের যদি ওকে টেলিফোন করতে বাধা দাও, পস্তাতে হবে তোমাকে। যদি ভাল চাও, মাফ চেয়ে নিয়ো পদেমার কাছে। এবং, এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যাও তুমি।’

কথা শেষ করেই ঝপ করে চেয়ারে হেলান দিলেন ক্লড র‍্যাঁবো। চোখ বুজে চুপচাপ, নিঃসাড় বসে রইলেন।

বোকার মত নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল চার্লস ক্যারন। বিস্ময়ের ছাপ এখনও লেগে রয়েছে মুখে। জীবনে যা কল্পনাও করা যায় না, এই মুহূর্তে তাই ঘটে গেছে। কিসের লক্ষণ এটা? তার বস্ কি পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছেন? হঠাৎ মনে পড়ল, তাকে চলে যেতে বলেছেন বস্। ধীরে ধীরে, যন্ত্র চালিত পুতুলের মত ঘুরে দাঁড়াল সে, এগোল দরজার দিকে। ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার? ভাবছে সে।

দরজা খুলে বেরিয়ে যাবে ক্যারন, পিছন থেকে অতি পরিচিত মৃদু, নরম, স্নেহের ডাক শুনতে পেল সে; ‘ক্যারন, এদিকে এসো।

ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল ক্যারন। দেখল চেয়ারে সিধে হয়ে বসেছেন ক্লড র‍্যাঁবো। ধীরেসুস্থে তিনি একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগ করছেন। ঠোঁটের কোণে সেই বিখ্যাত সরল হাসিটা লেগে রয়েছে। ত্রিশ সেকেন্ড আগের মানুষটাকে চেনার কোন উপায়ই নেই।

এগিয়ে এসে ডেস্কের সামনে দাঁড়াল ক্যারন। তার দিকে মুখ তুলে তাকালেন ক্লড র‍্যাঁবো। একটু হেসে বললেন, বসো। তোমার সাথে অত্যন্ত জরুরী আলাপ আছে।’

ধীরে ধীরে বসল ক্যারন। বসের স্বাভাবিক আচরণটাকেও কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখছে সে।

কিন্তু রসুনের চাটনি সম্পর্কে ক্লড র‍্যাঁবো আর কোন কথাই তুললেন না। ক্যারন চেয়ারে বসতেই ডেস্কের তালা খুলে কর্নেল বোল্যান্ডের রিপোর্টটা বের করে তার সামনে রাখলেন তিনি। বললেন, ‘পড়ো।’

এক বিস্ময়ের ধাক্কা কাটতে না কাটতে আরেক বিস্ময়ের ধাক্কা। দেশের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ও-এ-এস-এর ষড়যন্ত্রের রিপোর্টটা পড়তে পড়তে মুখ থেকে রক্ত নেমে গেল ক্যারনের, ফ্যাকাসে হয়ে গেল চেহারা। পড়া শেষ হতেই ঝট্ করে মুখ তুলে তাকাল সে বসের দিকে।

‘এবার মন দিয়ে শোনো,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো, ‘এ ব্যাপারে আমার ওপর কি দায়িত্ব চাপানো হয়েছে।’ স্বভাবসুলভ মৃদু কণ্ঠে ধীরে ধীরে কথা বলে যাচ্ছেন তিনি। আজ বিকেলের মীটিংয়ে যা যা ঘটেছে, প্রায় সবই শোনালেন ক্যারনকে।

নিঃশব্দে শুনে যাচ্ছে ক্যারন।

আধঘণ্টা পর থামলেন ক্লড র‍্যাঁবো।

‘মাই গড!’ আঁতকে উঠে বলল ক্যারন। ‘মশিয়ে, ওরা আপনার ওপর অন্যায় করেছে।’ মাথা নিচু করে কি যেন ভাবল সে, তারপর মুখ তুলে দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের দৃষ্টিতে তাকাল বসের দিকে। ‘মশিয়ে, এর একটাই অর্থ—দায়িত্বটা ওরা আপনার ঘাড়ে চাপিয়েছে, তার কারণ কেউ তার নিজের ঘাড়ে এটা নিতে চায়নি। এটা একটা অসম্ভব কাজ। শুনতে সাধারণ, মাত্র একজন লোককে খুঁজে বের করা, কিন্তু কাজটায় সফল হওয়া না হওয়া স্রেফ ভাগ্যের ব্যাপার। ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেই ঝুঁকিটা ওরা কেউ নিতে চায়নি।’ একটু বিরতি নিল ক্যারন, তারপর বলল, ‘মশিয়ে, আপনি ব্যর্থ হলে তার পরিণতি কি হবে, বুঝতে পারছেন তো? ওরা সব দোষ চাপাবে আপনার একার ঘাড়ে।’

‘জানি, ক্যারন,’ খুব সহজ গলায় বললেন ক্লড রাবো। ‘ওরা দোষ দেবে সে ভয়ে নয়, আমরা ব্যর্থ হলে আমাদের প্রেসিডেন্ট মারা যাবেন এই কথা ভেবে এ- কাজে সফল হবার চেষ্টা করব আমরা। আর দেরি না করে এখুনি আমি কাজে হাত দিতে চাই।’

কিন্তু, মশিয়ে, আমরা শুরু করব কোথা থেকে?’ সবিস্ময়ে জানতে চাইল ক্যারন।

‘ফ্রান্সের সবচেয়ে ক্ষমতাবান দু’জন পুলিস আমরা, সেই ক্ষমতা আমরা পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করব,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘কোথা থেকে শুরু করব? কেন, তুমি তোমার ডেস্কের পিছন থেকে আর আমি আমার ডেস্কের পিছন থেকে শুরু করব। যাও, নিজের জায়গায় বসে প্যাড টেনে নাও।

চেয়ার ছেড়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল ক্যারন। নিজের ডেস্কের পিছনে গিয়ে বসল।

‘নোট নাও,’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো। ‘পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত বিভাগীয় কোন কাজের ব্যাপারে আমাকে বিরক্ত করা চলবে না। এই কামরায় যতগুলো টেলিফোন আছে সবগুলোর কানেকশন কেটে দিতে হবে। পরিবর্তে মাত্র একটা নতুন টেলিফোন আনতে হবে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জে যাও, ওদেরকে বলো দশটা বাইরের লাইন আমাদেরকে ছেড়ে দিতে হবে, সাথে একজন স্থায়ী অপারেটর দরকার। কোন রকম অজুহাত দেখাবার চেষ্টা করলে চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে আলাপ করে নিতে বলবে। অন্যান্য যে কোন ব্যাপারে আমার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে যদি বাধা বা অসুবিধের সম্মুখীন হও, সরাসরি ডিপার্টমেন্টাল চীফের সাথে গিয়ে দেখা করবে, এবং আমার নাম বলবে। লিখিত অফিশিয়াল নির্দেশ কাল সকালের মধ্যে সব বিভাগে পৌঁছে যাবে। তাতে আমার যে কোন অনুরোধ সাথে সাথে রক্ষা করার সুষ্পষ্ট নির্দেশ থাকবে। একটা সার্কুলার মেমোরানডাম তৈরি করো, প্রত্যেক বিভাগীয় প্রধানের কাছে যাবে, যারা আজকের বিকেলের মীটিংয়ে উপস্থিত ছিল। তাতে ঘোষণা থাকবে এখন থেকে তুমি আমার ব্যক্তিগত সহকারীর দায়িত্ব বহন করছ, কোন কাজে তুমি কোন বিশেষ সুবিধে চাইলে সবাইকে মনে করতে হবে সেটা আমারই অনুরোধ। বুঝেছ?’

লেখা শেষ করে মুখ তুলল ক্যারন। ‘বুঝেছি, মশিয়ে। রাত শেষ হবার আগেই শেষ করতে পারব সব। কোটা আগে?’

‘টেলিফোন লাইন। সবচেয়ে ভাল অপারেটরকে যেন দেয় এরা।

‘ঠিক আছে, মশিয়ে। লাইনের ব্যবস্থা হলে?

চিন্তাভাবনার জন্যে এক মুহূর্তও ব্যয় করছেন না ক্লড র‍্যাঁবো। তা লক্ষ করে ক্যারন বুঝল, কি করতে হবে না হবে তা আগেই মনে মনে স্থির করে রেখেছেন বস্।

‘লাইন পাবার পর সাতটা দেশের হোমিসাইড ডিভিশনের প্রধানদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইব আমি, চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে কথা বলছেন ক্লড ব্যাবো। ‘ইন্টারপোলের বৈঠকগুলোয় এঁরা প্রায় সবাই উপস্থিত হন, তাই এঁদের প্রায় প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে চিনি আমি। কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্য শুধু ডেপুটি চীফকে চিনি। একজনকে না পেলে আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করবে।’

মুখ তুলে প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল ক্যারন।

‘দেশগুলোর নাম: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অর্থাৎ ওয়াশিংটনের ডোমেস্টিক ইন্টেলিজেন্স হেডকোয়ার্টার। বৃটেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অ্যাসিস্ট্যান্ট (ক্রাইম) কমিশনার। বেলজিয়াম। হল্যান্ড। ইটালি। ওয়েস্ট জার্মানী। সাউথ আফ্রিকা। বাড়িতে বা অফিসে, যাকে যেখানে পাও তার সাথে সেখানে যোগাযোগ করো।’

চুপ করে গেলেন ক্লড র‍্যাঁবো, সহকারীকে লিখে শেষ করার সময় দিচ্ছেন। তারপর আবার বললেন, ‘এঁদের প্রত্যেকের সাথে একে একে যোগাযোগ করার সময় জানাবে ইন্টারপোলের কমিউনিকেশন রূম থেকে আমার সাথে তাঁদের টেলিফোন যোগাযোগ ঘটবে সকাল সাতটা থেকে দশটার মধ্যে, বিশ মিনিট পর পর। হোমিসাইড চীফেরা কে কখন তাঁর কমিউনিকেশন রূমে উপস্থিত থাকতে পারবেন সেই সময়টা জেনে নিয়ে ইন্টারপোল কমিউনিকেশন রূমে গিয়ে তাঁর সাথে আমার কথা বলার জন্যে কল বুক করে রেখো। কলগুলো পারসন-টু পারসন হতে হবে, ফ্রীকোয়েন্সি UHF, কোন মতেই অন্য কেউ যেন শুনতে না পায়। প্রত্যেককে বোঝাবে আমি যা বলতে চাই তা শুধুমাত্র তাঁর একার কানের জন্যে বলা হবে, মেসেজটা শুধু ফ্রান্সের জন্যে নয়, সম্ভবত তাঁর দেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করবে। সাতটা কলের সিডিউল ছ’টার আগেই লিখিতভাবে জানাবে আমাকে।’

দ্রুত সব নোট করে নিল ক্যারন।

চুরুট ধরাবার জন্যে একটু থেমেছেন ক্লড র‍্যাঁবো। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে তিনি বললেন, ‘এখন আমি হোমিসাইডে যাচ্ছি। উদ্দেশ্য, ফ্রান্সে কোন দুষ্কর্মের জন্যে সন্দেহ করা হয়েছিল, অথচ গ্রেফতার করা হয়নি এমন কোন বিদেশী খুনী সম্পর্কে কোন খবর পাওয়া যায় কিনা দেখা। তোমার কোন জিজ্ঞাস্য, আছে?’

‘না, মশিয়ে,’ ক্যারন বলল। ‘আমি বরং কাজ শুরু করে দিই।’ কথা শেষ করে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল সে।

‘রসুনের চাটনি, …’ বললেন ক্লড র‍্যাঁবো।

মাঝপথে থেমে গেল ক্যারনের হাত। সবিস্ময়ে ঝট করে মুখ তুলে বসের দিকে তাকাল সে।

‘…পেতে একটু দেরি হবে পদেমার, কথাটা তাকে জানিয়ে দিয়ো।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ক্লড র‍্যাঁবো।

‘ঠিক আছে, মশিয়ে,’ বেশি কথা বলার ঝুঁকি নিল না ক্যারন। বসের পিছন দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে, যতক্ষণ না তিনি ছোট ছোট পদক্ষেপে কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন। দূরের গির্জায় তখন এগারোই অক্টোবরের শেষ বারোটা ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে।