সেই উ সেন – ১.৪

চার

বেলজিয়াম। এখানে খেলনার দোকানেও আগ্নেয়াস্ত্র কেনাবেচা হয়, জানে রানা। বৈধ নাগরিকের পরিচয়পত্র দেখিয়ে রিভলভার, পিস্তল, বন্দুক বা রাইফেল যে-কেউ কিনতে পারে, সেজন্যে লাইসেন্স লাগে না। বৈধ নাগরিক নয় যারা, যেমন চোর, ডাকাত, হাইজ্যাকার, সন্ত্রাসবাদী, গ্যাঙস্টার, স্মাগলার বা বিদেশী, আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের পথ এদের জন্যেও খোলা রয়েছে। নাগরিকত্বের ভুয়া পরিচয়পত্র সহজেই সংগ্রহ করা যায়। ক্রেতাকে এ ব্যাপারে খেলনার বা আগ্নেয়াস্ত্রের দোকানদারও সাহায্য করার জন্যে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সাধারণ, প্রচলিত আগ্নেয়াস্ত্রের দরকার নেই রানার, তাছাড়া অস্ত্র সংগ্রহের গোটা ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপন রাখতে চায় ও, তাই ইটালিতে থাকতেই ভিনসেন্ট গগলের সাথে দেখা করে বিশ্বস্ত একজন অস্ত্র বিক্রেতা এবং পরিচয়পত্র জালে ওস্তাদ একজন লোকের নাম ঠিকানা চেয়ে নিয়েছে ও।

আগস্টের বাইশ তারিখে প্যারিস থেকে একবার রোমে গিয়েই গগলের খোঁজ করেছিল রানা। কোথায় গিয়ে কাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, আগে থেকেই তা জানা ছিল ওর। একসাথে ধ্বংস করেছিল ওরা মাদাম দালিয়ার ড্রাগ-রিঙ, তারপর আর দেখা হয়নি ওর সাথে। তবে বিদায় নেবার আগে রানাকে সে বলেছিল, যদি কখনও কোন কারণে দরকার হয় তাহলে ইউরোপ বা আফ্রিকার যে-কোন দেশের রাজধানীতে গিয়ে বা লোক পাঠিয়ে একটা নির্দিষ্ট মহলের নির্দিষ্ট কিছু লোকের যে কোন একজনকে খুঁজে বের করে নির্দিষ্ট একটা কোড নাম্বার উচ্চারণ করলেই সে রানাকে তার বর্তমান অবস্থান এবং যোগাযোগের মাধ্যম জানিয়ে দেবে।

মাত্র একঘণ্টা ব্যয় করে সঠিক লোকের সাথে দেখা করতে পেরেছিল রানা। তার কাছ থেকে জানতে পারল গগল এখন ইরান-ইরাক বর্ডারে কুর্দদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে বড়ই ব্যস্ত। লোকটার মাধ্যমেই একটা মেসেজ পাঠাল রানা। মেসেজে বলল: ঠিক এক হপ্তা পর আবার আমি রোমে আসছি, তোমাকে আমার দরকার।

ঢাকা থেকে দ্বিতীয় বার রোমে এসে গগনের সাক্ষাৎ পেয়েছিল রানা। রানার মেসেজ পেয়ে অস্ত্র এবং গোলাবারুদের চোরা ব্যবসায়ে ব্যস্ততার মাঝেও সময় করে নিয়ে ইরান থেকে ছুটে এসেছে গগল। কি ধরনের সাহায্য লাগবে শুনে হেসেই অস্থির হলো ভিনসেন্ট গগল। বলল, ‘আমার নাম বলে বেলজিয়ামের যে কোন বড় অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং কুখ্যাত ফরজারের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে পারো তুমি, কেউ বেঈমানী করতে সাহস পাবে না। সবাই জানে গগলের বন্ধুর সাথে বেঈমানী করা যায় না। ‘

রানা গম্ভীর ভাবে বলেছিল, ‘ব্যাপারটা অত্যন্ত সিরিয়াস, গগল। আমি কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাই না। যে দু’জনকে আমার কথা বলবে তুমি তারা ইচ্ছে করলেই আমার প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে। সুতরাং তোমাকে ভয় করে এমন লোকের কাছে সাহায্যের জন্যে আমাকে যেতে বোলো না। তোমাকে ভক্তি করে, শ্রদ্ধা করে এমন লোকের কাছ থেকে সাহায্য চাই আমি। তাকে রীতিমত যোগ্য লোক হতে হবে। সাধারণ অস্ত্রে কাজ চলবে না, বিশেষ ধরনের অস্ত্র চাই।’

রানার কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ল গগল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমাকে শ্রদ্ধা করে এমন একজন বেলজিয়ান অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছে তোমাকে পাঠাতে পারি আমি, কিন্তু সে-রকম কোন ফরজার নেই যে আমাকে শ্রদ্ধা বা ভক্তি করে। এই দঙ্গলের সবাই আমাকে ভয় করে, কিন্তু শ্রদ্ধা করে না।

‘অস্ত্র-ব্যবসায়ী এই লোকটা নিজে একজন কারিগর তো?’ জানতে চাইল রানা।

ইউরোপের শ্রেষ্ঠ কারিগর।’

সেক্ষেত্রে ঠিক এই লোককেই আমার দরকার,’ বলল রানা। ‘এবার তোমার ভয়ে সবচেয়ে ভীত একজন ফরজারের নাম ঠিকানা দাও আমাকে। আমিও তার মনে কিছুটা ভয় ঢুকিয়ে দেব, যাতে সে বেঈমানী করার চেষ্টা না করে।

দু’জনের নাম ঠিকানা টুকে নিল রানা। গগল কথা দিল দু’জনকেই সে টেলিফোনে প্রয়োজনীয় নির্দেশ জানিয়ে দেবে, জানিয়ে দেবে কবে, কোথায়, কখন রানা দেখা করবে তাদের সাথে।

রানার ব্যক্তিগত ব্যাপারে আশ্চর্য একটা নিস্পৃহ ভাব আছে গগলের। এত কিছু আলাপ হলো, অথচ একবারও সে জানতে চাইল না এসরের পিছনে রানার উদ্দেশ্যটা কি। শুধু বলল, ‘একে সাহায্য করা বলে না। সত্যিকার সাহায্য কিছু লাগবে কিনা বলো, তুমি জানো, সাধ্যমত চেষ্টা করব আমি।’

গগলের কাঁধে হাত রেখে রানা বলল, ‘ধন্যবাদ, বন্ধু। আর কোন সাহায্য লাগবে না।

ওই পর্যন্তই, গগল আর কোনরকম কৌতূহল প্রকাশ করেনি।

অস্ত্র ব্যবসায়ীর নাম ম্যানিকিন পীস। ইউরোপ জোড়া আন্ডারগ্রাউন্ডের অস্ত্র- যাদুকর হিসেবে পরিচিত যে। চুল দাড়ি সব পাকা, বয়স ষাটের উপর। চোদ্দ বছর বয়স থেকে আজ পর্যন্ত আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া আর কিছু নাড়াচাড়া করেনি লোকটা। মেয়ে নয়, মদ নয়, জুয়া নয়, ঘর-সংসার নয়, তার একমাত্র ধ্যান এই অস্ত্র। বিয়ের বয়স কবে পেরিয়ে গেছে, খেয়ালই নেই। অস্ত্র মেরামত এবং তৈরির কাজে যাদুকর হিসেবে নাম কিনে ফেলায় গোটা ইউরোপের ভয়ঙ্কর গ্যাঙস্টার, সন্ত্রাসবাদী, খুনে এবং হাইজ্যাকাররা তার কাছে আসে, এদের দ্বারা যে কোন মুহূর্তে তার প্রাণ বিপন্ন হতে পারে, কিন্তু ঝুঁকিটাকে সে গ্রাহ্যই করে না। বিপদ আসতে পারে পুলিসের তরফ থেকেও কিন্তু অস্ত্র-পাগল ম্যানিকিন পীস পুলিসকেও ডরায় না। ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার জন্যে প্রতি মাসে মোটা টাকা ঘুষ দেয় সে স্থানীয় পুলিস ইন্সপেক্টরদেরকে, বিনিময়ে তারা পীসের দোকান এবং কারখানার ত্রিসীমানায় পা ফেলা তো দূরের কথা, দূর থেকে দৃষ্টি নিক্ষেপও করে না।

বয়সে ভিনসেন্ট গগল ছোট হলেও ম্যানিকিন পীস তাকে পরম হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে শ্রদ্ধা করে। গগল তার যে উপকার করেছে, জীবনে কখনও সে ঋণ শোধ হবার নয়। বছর বিশেক আগে গুগলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল স্রেফ ব্যবসায়িক। আর্মস স্মাগলিংয়ের ব্যবসাতে ঢোকার জন্যে গগল জুতসই একটা ফোকার খুঁজছে তখন, কিন্তু ঠিক মত কায়দা করতে পারছে না। অল্প পুঁজি, এখান ওখান থেকে কিছু অস্ত্র সস্তায় কিনে আন্ডারগ্রাউন্ডে বিক্রি করে। এই সময় হঠাৎ পুলিসের কাছে ধরা পড়ে গেল সে। খবর পেয়ে ম্যানিকিন পীস তাকে পুলিসের খপ্পর থেকে ছাড়িয়ে আনে। ব্যস এইটুকু সাহায্য করেছিল সে গুগলের। কিন্তু গগল এর বিনিময়ে তাকে নবজন্ম দান করেছে।

এই ঘটনার পাঁচ বছর পর একদিন পেটে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো ম্যানিকিন পীস। ডাক্তাররা বলল, তার দুটো কিডনীই নষ্ট হয়ে গেছে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে নতুন একটা কিডনী সংযোজন করতে না পারলে বাঁচার কোন আশাই নেই। মানুষের শরীরে দুটো কিডনী থাকে বটে, কিন্তু একটাতেই কাজ চলে। যাই হোক, কিডনীর খোঁজে চারদিকে সম্ভাব্য জায়গায় খবর পাঠানো হলো, কিন্তু কোথাও একটা কিডনী পাওয়া গেল না। আঠারো ঘণ্টা পেরিয়ে যাবার পর হাन ছেড়ে দিয়ে ম্যানিকিন পীস অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল। মৃত্যু অবধারিত বুঝতে পেরে আয়ুর শেষ ছয়টি ঘণ্টা প্রিয়জনদের মাঝখানে বসে কাটাবে, এই ইচ্ছা নিয়ে নার্স এবং ডাক্তারদের চোখকে কৌশলে ফাঁকি দিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে নিজের দোকানে চলে এল সে। বহু বছরের পুরানো রিভলভার, পিস্তল, শটগান, বন্দুক, রাইফেল ইত্যাদি মেঝেতে নামিয়ে সেগুলোর মাঝখানে বসল সে, প্রতিটির গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আর কোমল স্বরে সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছে, দুঃখ করিস না, মরে গেলেও তোদের কথা আমার মনে থাকবে…’ ইত্যাদি। আর চোখ থেকে অঝোর ধারায় নামছে পানি। ঠিক এই সময় কোত্থেকে যেন এসে ঢুকল দোকানে গগল। পীসের কাণ্ড দেখে তার তো চক্ষু স্থির, ‘ব্যাপার কি পীস?’

প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি, এখন আমাকে বিরক্ত কোরো না,’ মুখ না তুলেই বলল পীস।

থমকে গেল গগল। কিন্তু কৌতূহলের পরিমাণ শতগুণ বেড়ে গেল তার। ধমক গ্রাহ্য না করে একই প্রশ্ন বারবার করতে লাগল সে। অবশেষে বেজায় চটে গিয়ে গগলকে ভাগাবার জন্যে আসল কথাটা বলল পীস, ‘…কিডনী পাওয়া যায়নি, আর ক’ঘণ্টা পর আমি চলে যাচ্ছি। দয়া করে এই সময়টুকু আমাকে এদের সাথে একা থাকতে দাও।’

পীস পাগল হয়ে গেছে, ভাবল গগল! অনেকক্ষণ বোকার মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে বলল, ‘তোমার কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

পীস নির্বাক। সে তার প্রিয় অস্ত্রদের গায়ে সান্ত্বনার হাত বুলাচ্ছে।

গগল বলল, ‘যা বলছ তা যদি সত্যিও হয় হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এলে কেন?’

খেপে উঠে পীস বলল, ‘কিডনী পাওয়া যায়নি জেনেও ওখানে কোন্ দুঃখে থাকব?’

চলো তাহলে, হাসপাতালে যাই,’ বলল গগল। ‘ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, একটা কিডনী দিয়ে দেব আমি তোমাকে।

মৃত্যুকে যে গ্রাহ্যই করছিল না, গগলের কথা শুনে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল সে। আসলে দুনিয়াতে এমন কেউ নেই যে তার এই চরম সঙ্কট মুহূর্তে সাহায্য করবে, এই নির্মম সত্যের প্রচণ্ড আঘাতে অদ্ভুত একটা অভিমান জন্ম নিয়েছিল পীসের মনে, যার ফলে মৃত্যুকে অতি নিকটে দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছিল সে এতক্ষণ। কিন্তু অন্তত একজন লোক নিজের শরীরের একটা অঙ্গ দিয়ে তাকে বাঁচাতে চায়, এটা জানতে পারার সাথে সাথে সমস্ত অভিমান নিমেষে উবে গেল, বাঁচার আকুতি বিস্ফোরণ হয়ে বেরিয়ে এল গলা থেকে, চিৎকার করে কেঁদে বলে উঠল, ‘আমি মরতে চাই না।’

সেই গগল, যে তাকে নিজের কিডনী দিয়ে নবজন্ম দান করেছিল, এক বন্ধুর জন্যে সামান্য একটু সাহায্য চেয়ে টেলিফোন করেছে। আজ ২১ সেপ্টেম্বর, গুগলের বন্ধুর আসার কথা। দোকান খুলে তার জন্যে অপেক্ষা করছে ম্যানিকিন পীস। আজ আর কারও সাথে দেখা করবে না। দোকানের সামনে বেচাকেনা বন্ধ’ লেখা সাইনবোর্ডটা ঝুলিয়ে রেখেছে সে। কর্মচারীদেরকে গতকালই জানিয়ে দিয়েছে, আজ তাদের ছুটি। একা অপেক্ষা করছে সে দোকানে।

গগলের বন্ধু যথাসময়ে অর্থাৎ ঠিক দুপুর বেলা এসে পৌঁছল। সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে হলঘরের ভিতর দিয়ে অফিসে নিয়ে গিয়ে বসাল তাকে পীস। তারপর মৃদু গলায় বলল, ‘আমি না খেলেও অতিথিদের জন্যে সব রকম মদ রাখি, মশিয়েকে কি দেব?’

‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘আগে আমি কাজের কথা শেষ করতে চাই। হাতে সময় কম।’

কাজকে গুরুত্ব দেয়-এমন লোকই আমার প্রিয়, মনে মনে ভাবল পীস। বলল, মশিয়ে, চোখ থেকে চশমাটা নামাবেন কি?’ রানা ইতস্তত করছে দেখে বৃদ্ধ মৃদু হেসে আবার বলল, ‘দেখুন আপনি যদি সত্যি কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে এসে থাকেন তাহলে পরস্পরের ওপর আমাদের বিশ্বাস থাকতে হবে।

নিঃশব্দে চোখ থেকে চশমাটা খুলে ডেস্কের উপর রাখল রানা। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ওর চোখে, মুখ দেখে পীসের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করছে।

‘এবার বলুন, মশিয়ে, আপনার কি উপকারে লাগতে পারি আমি।’

‘গগল আপনাকে কতটুকু বলেছে?’ জানতে চাইল রানা।

‘আপনি তার বন্ধু, আপনার একটা ফায়ার আর্ম দরকার—এইটুকু।’

ধীর ভঙ্গিতে উপর নিচে মাথা ঝাঁকাল একবার রানা। বলল, ‘হ্যাঁ, আমার একটা বিশেষ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দরকার। কেন, তারও একটা আভাস আপনাকে দিচ্ছি, তা নাহলে ঠিক কি চাই আপনি বুঝবেন না। আমার পেশায় আমি একজন বিশেষজ্ঞ। বিশেষজ্ঞরাই অসম্ভবকে সম্ভব করার ঝুঁকি নেয়, নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। আমি সেই রকম একটা অসম্ভব কাজ করতে যাচ্ছি। যাকে সরাতে চাই সে একজন মস্ত হোমরাচোমরা লোক, নিজের নিরাপত্তার জন্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। এ ধরনের কাজে সফল হতে হলে নিখুঁত পরিকল্পনা এবং সঠিক অস্ত্রের দরকার হয়। আমারও একটা বিশেষ ধরনের রাইফেল দরকার।

পাকা ভুরুর ভিতর আগ্রহে চকচক করছে পীসের সরল দুটো চোখ। সুন্দর! গুছিয়ে বলতে পেরেছেন।’ একদিকে মাথাটা একটু কাত্ করে হাসল। ‘বুঝলাম, একজন বিশেষজ্ঞের কাছে এসেছেন আরেকজন বিশেষজ্ঞ। কেন যেন মনে হচ্ছে, আনোর কাজটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে আমার কাছে। খুশির ব্যাপার তা মশিয়ে ঠিক কি ধরনের রাইফেলের কথা ভাবছেন আপনি?’ সাগ্রহে ডেস্কের উপর ঝুঁকে পড়ল পীস।

রাইফেলের টাইপ কি হবে সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়,’ বলল রানা। পকেট থেকে চেস্টারফিল্ড সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করল। সান্তিনো ভ্যালেন্টির পাসপোর্টটা লন্ডনের বাড়িতে রেখে এসেছে ও, ভ্রমণ করছে অরগ্যানের পাসপোর্ট নিয়ে। পরিচয় বদলের সাথে সাথে ব্যক্তিগত রুচিরও পরিবর্তন ঘটিয়েছে ও। সিগারেট ধরিয়ে আবার বলল, ‘কাজটায় অনেক বাধা-বিঘ্ন আছে, আছে সুযোগের সীমাবদ্ধতা। রাইফেলটাকে হতে হবে ছদ্মবেশী এবং লক্ষ্যভেদে অব্যর্থ।’

আনন্দে চকচক করছে পীসের চোখ দুটো। ‘একটা বুলেটেই কাজ সারতে চাইছেন মশিয়ে,’ রানার মনের কথা গড়গড় করে বলে যাচ্ছে সৈ, ‘কারিগরের নিপুণ ওস্তাদী দিয়ে এমন একটা রাইফেল তৈরি করতে হবে যেটা একজন লোক একটা কাজে মাত্র একবার একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে ব্যবহার করবে, রিপিট করবে না। মশিয়ে, আপনি সঠিক লোকের কাছে এসেছেন। যা ভেবেছিলাম, আপনার ফরমাশ দারুণ উত্তেজনাকর একটা চ্যালেঞ্জই বটে। আমার কাছে এসেছেন, সেজন্যে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।

‘ঠিক যা চাই তা পেলে আমিও নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করব,’ মৃদু হেসে বলল রানা।

‘ঠিক,’ বৃদ্ধ গম্ভীর হলো। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে রানার দিকে।

‘প্রধান অসুবিধে হলো সাইজ,’ বলল রানা। ‘দৈর্ঘ্য নয়, ওয়ার্কিং পার্টসের শারীরিক স্ফীতি। চেম্বার এবং বীচ এর চেয়ে বড় হলে চলবে না…’ ডান হাত উপরে তুলল রানা, মধ্যমা আঙুলের ডগা দিয়ে বুড়ো আঙুলের আগা স্পর্শ করে একটা বৃত্ত তৈরি করে পীসকে দেখাল, ডায়ামিটারে আড়াই ইঞ্চিরও কম সেটা। ‘এর চেয়ে একটা গ্যাস চেম্বার অনেক বড়, সুতরাং রাইফেলটার রিপিটার হওয়ার কোন উপায় নেই। একই কারণে মোটাসোটা স্প্রিং-মেকানিজম এতে থাকবে না।’ একটু থেমে বলল আবার, ‘মনে হচ্ছে, নিশ্চয়ই এটাকে বোল্ট অ্যাকশন রাইফেল হতে হবে।

সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আপন মনে মাথা নাড়ছে ম্যানিকিন পীস। ক্রেতার কথা শুনে কল্পনায় চাক্ষুষ করে নিচ্ছে রোগা-পাতলা ওয়ার্কিং পার্টস বিশিষ্ট একটা রাইফেলের ছবি। ‘বলে যান, বলে যান,’ অস্ফুটে বলল সে।

‘অপর দিকে,’ বলল রানা, ‘মাউজার 7.92 বা এনফিল্ড -303-এর মত পাশ থেকে বেরিয়ে থাকা হাতলওয়ালা বোল্ট এই রাইফেলে থাকা চলবে না। বোল্টটাকে অবশ্যই সরাসরি পিছু হটে যেতে হবে, শোল্ডারের দিকে। ব্রীচে বুলেট ঢোকাবার জন্যে যাতে তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে শক্ত করে ধরা যায়। এছাড়া, কোন ট্রিগার গার্ড থাকা চলবে না এবং ট্রিগারটাকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে গুলি করার ঠিক আগের মুহূর্তে ওটা ফিট করা যায়।’

‘কেন?’ প্রশ্ন করল যাদুকর।

‘সমস্ত মেকানিজম গোল, লম্বা একটা কম্পার্টমেন্টে ভরে রাখতে চাই আমি, ‘ বলল রানা। ‘সে-অবস্থাতেই ক্যারি করব ওটাকে। কম্পার্টমেন্টটা কারও চোখে পড়লে চলবে না। এইমাত্র যে সাইজটা দেখালাম ডায়ামিটারে তার চেয়ে বেশি হতে পারবে না ওটা। কারণটা আরও পরিষ্কার করে বলব পরে। আলাদা করে রাখা যায় এমন একটা ট্রিগার দেয়া সম্ভব?’

‘সম্ভব। প্রায় সব কিছুই সম্ভব। সিঙ্গেল-শট রাইফেলের ডিজাইন যে কেউ তৈরি করতে পারে। শটগানের মত পিছন ভেঙে লোডিংয়ের জন্যে পথ খোলার ব্যবস্থা থাকবে। তাতে বোল্টের ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়া যাবে, কিন্তু বদলে আসবে একটা হিঞ্জ—ফলে সমস্যা হয়তো থেকেই যাবে। স্টীলের ওপর ডিজাইন খোদাই করে তৈরি করতে হবে রাইফেলটা, এক খণ্ড মেটাল মিলিং করে বের করে আনতে হবে গোটা ব্রীচ এবং চেম্বার। ছোট একটা কারখানার জন্যে কঠিন কাজ, কিন্তু সম্ভব।’

‘কি রকম সময় লাগবে তাতে?’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেলজিয়ান বৃদ্ধ বলল, ‘কয়েক মাস তো লাগবেই।

‘অত সময় নেই আমার।’

সেক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা বেছে নিতে হবে আমাদের। বাছ বিচার করে একটা রাইফেল কিনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে নিতে হবে। ঠিক আছে, আপনার কথা শেষ করুন আগে।

আরেকটা সিগারেট ধরাল রানা। বলল, ‘জিনিসটা খুব হালকা হতে হবে। হেভী ক্যালিবার না হলেও চলবে। আমি নির্ভর করব বুলেটের ওপর। ব্যারেলটা ছোট বটে, বারো ইঞ্চির বেশি যেন কোনমতেই না যায়।

কতটা রেঞ্জের মধ্যে থাকবে আপনার টার্গেট, মশিয়ে?’

জানা নেই,’ বলল রানা, ‘তবে সম্ভবত একশো তিরিশ মিটারের বেশি নয়।’

‘বুক, না মাথা—কোনটা পছন্দ আপনার?’

বুকেও গুলি করতে পারি, কিন্তু মাথায় করার সম্ভাবনাই বেশি।’

‘হ্যাঁ, তাতে মৃত্যুর সম্ভাবনাও অনেক বেশি,’ বলল পীস। ‘কিন্তু বুকের বেলায় আবার লক্ষ্য অব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি—বিশেষ করে কেউ যখন হালকা ওজনের শর্ট-ব্যারেল অস্ত্র দিয়ে একশো ত্রিশ মিটার দূরবর্তী টার্গেটকে সম্ভাব্য বাধা সত্ত্বেও ভেল করতে চায়।’ একটু বিরতি নিল বৃদ্ধ, তারপর বলল, ‘বুকে না মাথায় এ ব্যাপারে আপনাকে অনিশ্চিত দেখে আমার মনে হচ্ছে, আপনার এবং টার্গেটের মাঝখানে হয়তো কেউ যাওয়া-আসা করবে, তাই কি?’

‘হ্যাঁ, সে সম্ভাবনা আছে।’

‘আচ্ছা, মশিয়ে, ধরুন,’ বলল পীস, ‘বাতিল কার্ট্রিজটা ফেলে দিয়ে তাজা আরেকটা ঢোকাতে, ব্রীচ বন্ধ করতে এবং লক্ষ্যস্থির করতে যদি মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে, তাহলে কি দ্বিতীয় বার গুলি করার সুযোগ আপনি পাবেন?’

‘বোধহয় পাব না, না পাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি,’ বলল রানা। ‘সাইলেন্সার ব্যবহার করে প্রথমবার যদি ব্যর্থ হই, এবং টার্গেটের আশপাশে যারা থাকবে তারা যদি ভাগ্যগুণে ব্যাপারটা টের না পায়, বড়জোর দু’তিন সেকেন্ড সময় পেলেও পেতে পারি আমি দ্বিতীয়বার গুলি করার জন্যে, তার বেশি নয়। কিন্তু ওরা যদি টের পেয়ে যায়, সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। চারদিক থেকে এক নিমেষে ঘিরে ফেলা হবে আমার টার্গেটকে। কয়েক সেকেন্ড কেন, কয়েক বছরের মধ্যেও দ্বিতীয়বার গুলি করার কোন সুযোগ আমি পাব না। তবে, নিরাপদে কেটে পড়ার জন্যে সাইলেন্সার আমাকে ব্যবহার করতেই হবে। প্রথমবার যদি কপাল ফুটো করতে পারি, আসল সমস্যাটা মিটে যাবে। কোন্ দিক থেকে বুলেট এসেছে তা আবছাভাবে অনুমান করতেও কয়েকটা মিনিট লেগে যাবে ওদের। এই কয়েকটা মিনিটই কেটে পড়ার জন্যে যথেষ্ট।’

উপর নিচে মাথা দোলাচ্ছে বৃদ্ধ, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এখন তার ডেস্ক প্যাডের উপর। ‘সেক্ষেত্রে আপনি এক্সপ্লোসিভ বুলেট ব্যবহার করলে ভাল করবেন। রাইফেলের সাথে এক মুঠো তৈরি করে দেব’খন। ঠিক কি বলতে চাইছি, মশিয়ে বুঝতে পারছেন তো?’ মুখ তুলে তাকাল পীস।

বৃদ্ধের চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল রানা, ‘গ্লিসারিন, না কি মার্কারী?

‘মার্কারীই তো ভাল। যেমন পরিষ্কার তেমনি পরিচ্ছন্ন। রাইফেল সংক্রান্ত আর কোন পয়েন্ট আছে?’

‘আছে,’ বলল রানা। ‘রাইফেলটাকে সরু করার স্বার্থে ব্যারেলের নিচে থেকে হ্যান্ডগ্রিপের সমস্ত কাঠের কাজ সরিয়ে ফেলতে হবে। ফায়ারিঙের জন্যে অবশ্যই এটাতে একটা স্টেনগানের মত ফ্রেম-স্টক থাকতে হবে। সামনের অংশ, পিছনের অংশ এবং শোল্ডার-রেস্ট, স্ক্রু খুলে তিনটে রড় আলাদা করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া, নিখুঁত একটা সাইলেন্সার এবং একটা টেলিস্কোপিক সাইট চাই। এ- দুটোও খোলা অবস্থায় রাখতে চাই আমি।’

গালে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করছে পীস। অধৈর্য হয়ে উঠছে রানা। ‘কি, পারবেন?’

রানার কথায় ধ্যান ভাঙল বৃদ্ধের। মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে হাসল। ‘কিছু মনে করবেন না, মশিয়ে। আপনি আমাকে ঘাবড়ে দিয়েছেন। জীবনে এতবড় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করিনি। কোন কাজ পারব না, একথা বলা আমার প্রকৃতি-বিরুদ্ধ পারব। বিশেষ জাতের একটা রাইফেল কিনতে হবে আমাকে। খুব দামী। দুষ্প্রাপ্য। তবে ব্রাসেলসে পাওয়া যাবে। খুবই নিখুঁত, যন্ত্রপাতিগুলো অদ্ভুত সুন্দর ভাবে ফিট করা অথচ হালকা এবং রোগা-পাতলা। আচ্ছা, মশিয়ে, বলুন দিকি, মানে, আপনার টার্গেট স্থির, নাকি ধীরে চলমান, নাকি দ্রুত মুভ করবেন?

‘স্থির।’

‘কোন সমস্যাই নেই তাহলে। ফ্রেম-স্টককে তিন ভাগে খুলে ফেলার ব্যবস্থা করা আর ট্রিগারে স্ক্রু লাগানো নগণ্য কারিগরির ব্যাপার মাত্র। সাইলেন্সারের জন্যে ব্যারেলের পিছনটা ট্যাপিং করা আর ব্যারেল হেঁটে আট ইঞ্চি কমিয়ে ফেলা, এ দুটো কাজ নিজেই করতে পারব আমি। ব্যারেল আট ইঞ্চি কমিয়ে ফেলা মানে লক্ষ্য নিখুঁত হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে ফেলা। মশিয়ে, আপনি একজন মার্কস-ম্যান তো?’

মাথা একটু কাত করল রানা।

‘তাহলে সমস্যা নেই। টার্গেট স্থির, দূরত্ব একশো ত্রিশ মিটার, চোখ টেলিস্কোপ-সাইটে—নো প্রবলেম। সাইলেন্সারটাও আমি নিজের হাতে তৈরি করব। এবার, মশিয়ে, লম্বা এবং গোল কম্পার্টমেন্টের কথা বলুন, বিচ্ছিন্ন রাইফেলটাকে যেটায় ভরে নিয়ে যেতে চান আপনি।’

বৃদ্ধ ম্যানিকিন পীসের চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল রানা নিঃশব্দে। ধীর পায়ে ডেস্ক ঘুরে এগোচ্ছে ও। থামল পীসের চেয়ারের পাশে। চোখ দুটো এখনও তার চোখে স্থির হয়ে আছে। ধীরে ধীরে জ্যাকেটের পকেটে একটা হাত ঢোকাচ্ছে রানা।

মুহূর্তের জন্যে পীসের সাদা ভুরুর ভিতর চোখ দুটোয় আতঙ্ক ফুটে উঠল আগন্তুকের চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু দেখতে পেল সে, সারা শরীরে ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল, খাড়া হয়ে উঠল রোম।

পকেট থেকে একটা কাঠপেন্সিল বের করল রানা। ডেস্কের উপর ঝুঁকে পীসের রাইটিং প্যাডে দ্রুত একটা স্কেচ আঁকল। তারপর প্যাডটা বৃদ্ধের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘জিনিসটা চিনতে পারছেন?’

স্কেচের উপর একবার চোখ বুলিয়ে মাথা ঝাঁকাল পীস। অস্ফুটে বলল, ‘পারছি।’

‘ফাঁপা কয়েকটা অ্যালুমিনিয়ামের টিউব স্ক্রু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে এটা তৈরি করা হবে,’ বলল রানা। এখানে ঢুকবে…’ পৈন্সিল ঠুকে ডায়াগ্রামের একটা জায়গার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল ও ….রাইফেল স্টকের একটা অংশ। এখানে অপরটা। দুটোই টিউবের ভিতর লুকানো থাকবে। এই অংশটায় আর কিছু থাকবে না।’ ডায়াগ্রামের আরেক জায়গায় পেন্সিলের চোখা শিষ ছোঁয়াল রানা। ‘রাইফেলের পুরো শোল্ডার রেস্টটা ঢুকে যাবে এই টিউবটার ভিতর।

বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেছে ম্যানিকিন পীসের চোখ জোড়া। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বলে যাচ্ছে রানা, ‘এই পয়েন্টটা সবচেয়ে মোটা, এখানে রয়েছে মোটা ডায়ামিটারের টিউব, এতে ঢুকে যাবে বোল্ট সহ রাইফেলের ব্রীচ। এই সেকশনে ব্যারেল, এবং শেষ দুটো সেকশনে…এখানে আর এখানে…ঢুকে যাবে টেলিস্কোপ সাইট আর সাইলেন্সার। সবশেষে বুলেট। নিচের এই কাঠের গোড়ায় লুকিয়ে রাখতে হবে বুলেটগুলোকে। বিচ্ছিন্ন রাইফেলের প্রতিটি অংশ ভিতরে ঢুকিয়ে টিউবগুলোকে পরস্পরের সাথে জোড়া লাগানো হবে।’ ডায়াগ্রামের উপর বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে টোকা মারল ও, ‘এটা যা, দেখতে যেন ঠিক তাই থাকে—এক চুল এদিক ওদিক হলে চলবে না। যখন দরকার হবে স্ক্রু খুলে টিউব থেকে একে একে বের করব বুলেট, সাইলেন্সার, টেলিস্কোপ, রাইফেল; এবং তিন ভাগে ভাগ করা অবলম্বন, তেঁকোণা ফ্রেম-স্টক। প্রতিটি জিনিস আবার জোড়া লাগালেই গুলি করার জন্যে প্রস্তুত একটা সম্পূর্ণ রাইফেল পেয়ে যাব। ও. কে?’

আরও কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ বিস্ময়ে ডায়াগ্রামটার দিকে তাকিয়ে থাকল ম্যানিকিন পীস, তারপর ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রানার দিকে বাড়িয়ে দিল একটা হাত। ‘মশিয়ে,’ অভিভূত বৃদ্ধ বলল, ‘এরকম একটা ধারণার জন্ম শুধুমাত্র একজন সত্যিকার প্রতিভাবানের মাথাতেই হতে পারে। ইউনিক! সন্দেহের ঊর্ধ্বে। অথচ কত সহজ। হ্যাঁ, পারা যাবে।’

রানার চেহারায় আনন্দ বা বিরক্তি কিছুই ফুটল না। নির্বিকার দেখাচ্ছে ওকে। বলল, ‘গুড। এবার সময়ের প্রশ্ন। চোদ্দ দিনের মধ্যে রাইফেলটা ডেলিভারি চাই ‘আমি। সম্ভব?’

একটু চিন্তা করে পীস বলল, ‘সম্ভব। তিনদিনের মধ্যে রাইফেলটা যোগাড় করতে পারব। টেলিস্কোপ সাইট কেনা কোন সমস্যাই নয়। সাইলেন্সার তৈরি, বুলেট মডিফাই এবং বহিরাবরণ তৈরি—হ্যাঁ, চোদ্দ দিনে সম্ভব, যদি মোমবাতির দু’দিকেই আগুন ধরাই। তবে, দু’একদিন আগে এসে একবার যদি দেখে যান, ভাল হয়। যদি কোন সমস্যা দেখা দেয়, আলোচনা করা যাবে। বারো দিনের দিন আসতে পারবেন, মশিয়ে?’

‘সাত থেকে চোদ্দ দিনের মাঝখানে যে-কোন একদিন আসব,’ বলল রানা। কিন্তু আজ থেকে তেরো দিন পর ডেলিভারি চাই আমি। অক্টোবরের চার তারিখে লন্ডনে ফিরে যেতে হবে আমাকে।’

অক্টোবরের চার তারিখ সকালে পাবেন আপনি ডেলিভারি,’ বলল পীস, ‘যদি এক তারিখে এসে শেষ আলোচনাটা করে যান।

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘এবার, আপনার খরচ এবং ফি সম্পর্কে বলুন। কত দিতে হবে?’

একগাল হাসল বৃদ্ধ। ‘কাজটা করে আমি অপার আনন্দ পাব, মশিয়ে, সেটাই আমার মজুরি। আপনি ভিনসেন্ট গুগলের বন্ধু, আপনার কাছ থেকে কিছু নিতে পারি না।

‘তা হয় না,’ বলল রানা, ‘সময় এবং টাকা, দুটোই বিস্তর খরচ করতে হবে আপনাকে। সব আমি দেব। কত দিতে হবে বলুন।’

মুচকি হাসল বৃদ্ধ। বলল, ‘তাহলে সত্যি কথাটাই বলি। টাকার অঙ্ক লেখার জায়গাটা খালি রেখে গগল একটা ক্রসড চেক পাঠিয়ে দিয়েছে আমার নামে।’

গম্ভীর হলো রানার চেহারা। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর ম্যানিকিন পীসের দিকে ঝুঁকে পড়ল হঠাৎ।

কৃতার্থ হাসি নিমেষে মুছে গেল পীসের মুখ থেকে। ঢোক গিলে বলল সে, ‘আর কিছু বলবেন, মশিয়ে? বলুন, আপনাকে আর কি সাহায্য করতে পারি?

‘না,’ অকস্মাৎ জলদগম্ভীর হয়ে উঠল রানার কণ্ঠস্বর। নিষ্পলক চোখের ঠাণ্ডা হিম দৃষ্টি বিদ্ধ হচ্ছে বৃদ্ধের চোখ ভেদ করে অন্তরের অন্তস্তলে। ‘মন দিয়ে শুনুন। আমার ব্যাপারে গগলের সাথে আপনি আর যোগাযোগ করবেন না, তাকে বা আর কাউকে জিজ্ঞেস করবেন না আমি কে বা আমার সত্যিকার পরিচয় কি। কার হয়ে কার বিরুদ্ধে কাজ করছি, কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাব, কি অস্ত্র নিয়ে যাব, কেন নিয়ে যাব—এসব ব্যাপারে কোন রকম কৌতূহল প্রকাশ করবেন না বা খবর সংগ্রহের চেষ্টা করবেন না। করলে আমি জানতে পারব। সেক্ষেত্রে আপনি মারা যাবেন। যেদিন ফিরে আসব সেদিন যদি পুলিস ডাকেন বা কোন ফাঁদ পেতে রাখেন, আপনি মারা যাবেন। কথাটা বুঝেছেন?’

ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ম্যানিকিন পীস। ছোটখাট শরীরটা হঠাৎ যেন আরও অর্ধেক হয়ে গেছে। খুনে, ডাকাত আর সন্ত্রাসবাদীদের সাথেই তার ব্যবসা, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তাকে কোন রকম হুমকি দিয়ে সুবিধে করতে পারেনি। ভয় কাকে বলে জানা নেই তার। কিন্তু গুগলের বন্ধু শান্ত গলায় যা বলল, শুনে ঘাম ছুটে যাচ্ছে তার।

ধীরে ধীরে চোখে মুখে ব্যথার ছাপ ফুটে উঠল বৃদ্ধের। ‘মশিয়ে, আমাকে সাবধান করে না দিলেও পারতেন। নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। হ্যাঁ, যা বলেছেন সব পরিষ্কার বুঝেছি আমি।’ মৃদু হাসল সে। বলল, ‘প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা আপনাকে জানাতে চাই। আপনি যেমন আপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে সাবধান, আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে আমিও তেমনি সাবধান। যে রাইফেল আপনাকে দেব, তাতে কোন সিরিয়াল নাম্বার থাকবে না, যাতে আপনি ধরা পড়লেও কর্তৃপক্ষ সূত্র ধরে আমাকে খুঁজে বের করতে না পারে। শুড বাই,, মশিয়ে।’

অ্যাশট্রেতে সিগারেটটা গুঁজে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রানা। ‘গুড বাই,’ বলে হলরুম পেরিয়ে বেরিয়ে এল উজ্জ্বল সূর্যালোকে। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটা একটু দূরে। এইটুকু পথ হেঁটে এল। কেউ অনুসরণ করছে না। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা হোটেলে ফিরল না। লাঞ্চের সময় হয়নি, কিন্তু গলাটা ভিজিয়ে নেয়া যেতে পারে। বিখ্যাত বার অ্যান্ড রেস্তোরাঁ ভিভা সানলাইটে ঢুকে আধঘণ্টা পর চাঙা হয়ে বেরিয়ে আবার ট্যাক্সি নিল। ফিরল ফাইভ স্টার হোটেল অ্যামিগোতে।

হোটেলের বারো তলায় সুইমিং পুল। পুলের ধারে শুয়ে বসে আছে টু-পীস বিকিনি পরা মেয়েরা। প্রায় সবারই নাভির নিচে চার ইঞ্চি পর্যন্ত উন্মুক্ত। সামান্য একটু ছাড়া বুকেরও প্রায় সবটুকুই দৃশ্যমান। চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে সরে এল রানা। শীতল পানিতে অবগাহন করার লোভটুকু দমন করতে হচ্ছে ওকে। সুইমিং পুলে মেলা ভিড়, যেচে পড়ে কেউ আলাপ করতে চাইতে পারে, সে-ঝুঁকি নিতে পারে না ও।

বিকেলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে এল রানা। এখানে দাঁড়িয়ে কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বেলজিয়ামে কোন্ জিনিসটা সবচেয়ে জনপ্রিয়? নিজের চারদিকে একবার তাকিয়ে উত্তরদাতাকে বলতেই হবে: চুমো।

স্বামী স্ত্রীকে, প্রেমিকা প্রেমিককে, ছাত্র ছাত্রীকে কত বিভিন্ন কায়দায় জাপটে ধরে চুমো খাচ্ছে, দেখলে থ হয়ে যেতে হয়। আড়াল-আবডালেই, অর্থাৎ ভদ্রতাসূচক আৰু বজায় রেখেই কর্মটি করছে সবাই, কিন্তু এদের প্রাইভেসির সংজ্ঞা একটু অন্যরকম। উপস্থিত ভিড়ের দিকে পিছন ফেরাটাই যথেষ্ট, তাতেই আব্রু রক্ষিত হলো বলে মনে করা হয়। বাগানে অল্পবয়েসী এক শ্রেণীর মেয়ের ভিড়ই বেশি, নানান সূক্ষ্ম কৌশল করে খদ্দের আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

রানাকে একা টহল মারতে দেখে কয়েকটা ফাঁদ পাতা হলো বটে, কিন্তু প্রত্যেকটি ফাঁদ সুচতুরভাবে ব্যর্থ করে দিয়ে আগে থেকে ঠিক করা একটা জায়গায় পৌছে গগলের নির্বাচিত ফরজার লোকটার সাথে দেখা করল ও।

ফোন করে সাক্ষাৎকারের জায়গাটা মাত্র দশ মিনিট আগে নির্ধারণ করেছে রানা। নিজের স্টুডিও ছাড়া আর কোথাও দেখা করতে রাজি হয়নি লোকটা প্রথমে। তাহলে তোমার সার্ভিস আমার দরকার নেই, রানা এ-কথা বলতেই গলা নামিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে দেখা করতে রাজি হয়ে গেছে সে।

লোকটা বেলজিয়ান। নাম-পিসিক। ছদ্মনাম, সন্দেহ নেই রানার। বেঁটে লোক তেমন পছন্দ করে না ও। পিসিক বেঁটে, রোগা ও হাড্ডিসার। চোয়াল দুটো ভীতিকর রকম উঁচু, চোখ দুটো ঘোলাটে। পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে বয়স। এই লোকের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে কোন গ্যারান্টি দিতে পারেনি গগল। মনটা সেজন্যে খুঁত খুঁত করছে রানার। চেহারা যাই হোক, দামী স্যুট পরে আছে পিসিক। বাঁ হাতে হীরে বসানো তিনটে আঙটি। হারামের রোজগার ভালই করে সে। বিশ্বস্ত হোক বা না হোক, গগল জানিয়েছে, নিজের পেশায় লোকটা নাকি তুলনাহীন। সেজন্যেই এর কাছে আসা।

নিজের পরিচয় দিয়েই বলল রানা, ‘একটা রেস্তোরাঁয় আমাদের জন্যে টেবিল রিজার্ভ করা আছে। সেখানে আলাপ হবে।

প্রস্তাবটা পছন্দ না হলেও ভাল রোজগার হবে আশা করে রানার পিছু পিছু বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে বেরিয়ে এল পিসিক।

রুনিউভি রেস্তোরাঁয় ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছতে দশ মিনিট লাগল। বেয়ারা ওদেরকে রিজার্ভ করা কেবিনে নিয়ে গিয়ে বসাল। বিয়ারের অর্ডার দিন রানা। পিসিক হুইস্কি চাইল।

বেয়ারা চলে যেতে পকেট থেকে একটা লাল ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে টেবিলে রাখল রানা। লাইসেন্সটা মাসুদ রানার নামে। দু’বছর আগে লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল থেকে ইস্যু করা। মেয়াদ শেষ হতে আরও ক’মাস বাকি আছে।

‘যার নামে এই লাইসেন্স,’ পিসিককে বলল রানা, ‘অর্থাৎ মাসুদ রানা মারা গেছে। আমার নাম অরগ্যান। গাড়ি চালাবার নিয়ম ভঙ্গ করায় আমাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর দেয়া হবে না। তাই মাসুদ রানার লাইসেন্সের ফ্রন্ট পেজটা বদলে ফেলতে চাই। নতুন ফ্রন্ট পেজ চাই, আমার নামে।’ কথা শেষ করে পকেট থেকে অরগ্যানের পাসপোর্ট বের করে টেবিলে রাখল ও।

মাত্র তিনদিন আগে ইস্যু করা নতুন পাসপোর্টটা ঝকঝক করছে, দৃষ্টি এড়াল না পিসিকের। খুলে দেখল সেটা। তারপর ড্রাইভিং লাইসেন্সটা হাতে নিল। পাতা উল্টে দেখে নিল সেটাও। বলল, ‘সহজ কাজ। অফিশিয়াল ডকুমেন্টস্ জাল করা হবে ইংলিশ অথরিটি তা আশা করে না, তাই এ ব্যাপারে তারা তেমন সাবধান নয়।’ লাইসেন্সের প্রথম পৃষ্ঠায় টোকা মারল সে। এখানে ছোট একটুকরো কাগজ আঠা দিয়ে সাঁটা রয়েছে, তাতে লাইসেন্স নাম্বার আর হোল্ডারের পুরো নাম ছাপা হয়েছে। ‘বাচ্চাদের প্রিন্টিং সেটের সাহায্যে আপনার নাম ছেপে নেয়া যাবে। ওয়াটার মার্কটা কোন সমস্যাই নয়।’ মুখ তুলল পিসিক। ভুরু কুঁচকে বলল, মশিয়ে, নিশ্চয়ই এই সামান্য কাজের জন্যে লন্ডন থেকে এখানে আসেননি?’

‘না। আরও দুটো কাজ আছে।’ সিগারেট ধরাল রানা। তারপর পরবর্তী কাজ দুটোর বিশদ বর্ণনা দিল।

হাড্ডিসার কপালের চামড়া কুঁচকে উঠল পিসিকের, চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। অনুমতি না নিয়েই অন্যমনস্কভাবে চেস্টারফিল্ডের প্যাকেট আর লাইটার রানার সামনে থেকে আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে এল নিজের সামনে, খুলে একটা সিগারেট বের করছে। ‘আপনার বক্তব্য ঠিক মত যদি বুঝে থাকি, কাজ দুটো খুবই কঠিন হবে,’ সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান মারল সে, গিলে ফেলল সবটুকু ধোঁয়া। আবার যখন কথা বলতে শুরু করল, শব্দের সাথে সাথে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া। ‘ফ্রেঞ্চ আইডেন্টিটি কার্ড; একজন শ্রমিকের পরিচয়-পত্র, তেমন সমস্যার সৃষ্টি করবে না। অরিজিন্যাল একটা কপি যোগাড় করতে হবে, সেটা দেখে জাল করলে কাজটার কোথাও খুঁত থাকবে না। কিন্তু দ্বিতীয় যে কার্ডের কথা বলছেন, কখনও চোখে পড়েনি আমার। অসাধারণ একটা ফরমাশ নিয়ে এসেছেন আপনি, মশিয়ে।

বেয়ারা বিয়ার আর হুইস্কি দিয়ে চলে গেল।

তারপর, ফটোর ব্যাপারটা,’ গ্লাসে দুটো চুমুক দিয়ে বলল পিসিক। ‘কঠিন কাজ! বয়স অনেক বেশি দেখাতে হবে, চুলের রঙ আর দৈর্ঘ্যে মিল থাকা চলবে না।’

নিঃশব্দে নিজের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে রানা।

‘নকল ডকুমেন্টের জন্যে যারা আসে তারা প্রায় সবাই চায় ডকুমেন্টে তাদের নিজেদের বর্তমান বয়সের ছবি থাকবে, কিন্তু ব্যক্তিগত বিবরণগুলো মিথ্যে তথ্য বহন করবে। কিন্তু আপনি আপনার বর্তমান বয়সের ফটো ডকুমেন্টে না রেখে রাখতে চাইছেন আগামী বিশ বছর পর আপনার যে চেহারা হবে সেই চেহারার ফটো। এখানেই জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে।

হুইস্কির গ্লাসে জোড়া চুমুক দিয়ে সেটা খালি করল পিসিক। চেস্টারফিল্ডের প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে একটা বাড়িয়ে দিল রানাকে, আরেকটা নিজে ধরাল। কথা বলছে রানার চোখে চোখ রেখে, ‘কার্ড দুটো যার সঙ্গে থাকবে তার যা বয়স প্রায় সেই বয়সের একজন লোককে খুঁজে বের করতে হবে আমার শুধু বয়সের মিল থাকলে চলবে না, আপনার চেহারার সাথেও তার মিল থাকতে হবে, বিশেষ করে মুখ আর মাথার মিল থাকতে হবে। সেই লোকের চুল কেটে ছোট করতে হবে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী। তারপর সেই লোকের ছবি তুলে কার্ডে লাগাতে হবে। এর পরের করণীয় আপনার। ফটোর ওই লোকের আসল চেহারা দেখে নিজের চেহারা বদলে নিতে হবে আপনাকে। কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন তো, মশিয়ে?’

‘পারছি—’

‘এ-কাজে সময় লাগবে। ব্রাসেলসে কদ্দিন আছেন?’

‘অক্টোবরের এক তারিখে ফিরে আসতে পারি,’ একটু চিন্তা করে বলল রানা, ‘তখন হয়তো দু’তিন দিন থাকব।’

পাসপোর্টটা খুলে ফটোর দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে থাকল পিসিক। খানিকপর পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে তাতে পাসপোর্টে লেখা নামটা টুকে নিল: আলেকজান্ডার জেমস কোয়েটিন অরগ্যান।

কাগজের টুকরো আর ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পকেটে ভরল সে। পাসপোর্টটা ঠেলে দিল রানার দিকে। বলল, ‘ঠিক আছে। করে দেয়া যাবে। তবে আপনার বর্তমান চেহারার দুটো পোরট্রেট ফটোগ্রাফ দরকার হবে আমার, ফুল ফেস অ্যান্ড প্রোফাইল। সময় এবং বিস্তর খরচ সাপেক্ষ কাজ। খরচের কথাটা বলছি এই জন্যে যে দ্বিতীয় যে-কার্ডটা চাইছেন আপনি সেটা যোগাড় করার জন্যে আমাকে হয়তো ফ্রান্সের পকেটমারদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এখানে পাওয়া গেলে তো ভালই, তা না হলে ফ্রান্সের দিকে হাত বাড়াতে…’

‘কত?’ বাধা দিয়ে জানতে চাইল রানা।

‘ফিফটি থাউজেন্ড বেলজিয়ান ফ্র্যাঙ্ক।’

একমুহূর্ত চিন্তা করল রানা। ‘প্রায় তিনশো পাউন্ড স্টার্লিং। ঠিক আছে। দুশো পাউন্ড জমা রেখে যাব, বাকিটা ডেলিভারির সময় পাবে।

টেবিলে ঠক্ ঠক্ করে গ্লাস ঠুকল পিসিক।

আওয়াজ শুনে বেয়ারা বিল নিয়ে এল। বিলের সাথে মোটা বকশিশ দিন রানা। আড়চোখে ব্যাপারটা লক্ষ করতে করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পিসিক। চেস্টারফিল্ডের প্যাকেটটা তুলে নিতে ভোলেনি।

রেস্তোরাঁর বাইরে বেরিয়ে এসে রানাকে বলল, ‘পোরট্রেট দুটো এখনই তুলে ফেলতে চাই। চলুন, আমার নিজের স্টুডিও আছে।

ট্যাক্সি নিয়ে মাইল দুই দূরের একটা ছোটখাট বেসমেন্ট ফ্ল্যাটে পৌছল ওরা। স্টুডিওর সামনে কাঁচের শো-কেসে প্রায়-উলঙ্গ মেয়েদের ফটো সাজিয়ে রেখেছে পিসিক। ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে: এখানে পাসপোর্ট সাইজের ছবি তোলা হয়। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নিচে নামল ওরা। দরজার তালা খুলে একটু সরে দাঁড়িয়ে স্টুডিওতে ঢুকতে দিল পিসিক রানাকে।

ছবি তুলতে একটানা দু’ঘণ্টা সময় নিল পিসিক। প্রকাণ্ড একটা ট্রাঙ্ক খুলে বের করল অত্যন্ত দামী একটা ক্যামেরা এবং ফ্ল্যাশ ইকুইপমেন্ট। অসংখ্য শেলফে সাজানো রয়েছে ছদ্মবেশ ধারণের বিচিত্র সরঞ্জাম : কলপ, কসমেটিকস, টুপি, উইগ, চশমা, মুখোশ ইত্যাদি।

এক ঘণ্টা পর পিসিকের মাথায় এক বুদ্ধি চাপল। মেকআপের সাহায্যে আপনারই বয়সটা যদি বাড়িয়ে নিয়ে ছবি তুলি, কেমন হয়? আপনার কাঠামো, চেহারা ইত্যাদির সাথে মিল আছে অথচ বয়স পঞ্চাশ-ষাটের কাছাকাছি, এমন লোক পাওয়া সহজ হবে না. মশিয়ে। তারচেয়ে, দাঁড়ান, চেষ্টা করে দেখি মেক- আপের ফলে কতটা বয়স বাড়ানো কমানো যায় আপনার।

ত্রিশ মিনিট ধরে রানার মুখের উপর মেকআপ চড়াল পিসিক। ব্যস্তভাবে খুঁজে পেতে বের করল একটা আয়রন গ্রে রঙের গোল করে ছাঁটা চুল ভর্তি উইগ। রানার চোখের সামনে সেটাকে ধরে গম্ভীরভাবে বলল, ‘ভাল করে দেখুন এটাকে। তারপর বলুন আপনার চুল কেটে, তাতে কলপ লাগালে ঠিক এই রকম দেখাবে কি না?’

উইগটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল রানা। ‘মাথায় পরে ফটো তোলা যাক, রেজাল্ট দেখে বলতে পারব।’

ছয়টা ছবি তুলল পিসিক। ডার্করূম থেকে আধ ঘণ্টা পর বেরিয়ে এসে ফটোগুলো রাখল ডেস্কে। দু’জনেই ঝুঁকে পড়ল সেগুলোর উপর। ফটোতে একজন বুড়ো, ক্লান্ত লোককে দেখা যাচ্ছে। ত্বকের রঙ ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে, চোখের নিচে ক্লান্তি আর বেদনার কালিমা। দাড়ি-গোঁফ নেই, কিন্তু মাথায় গ্রে রঙের চুল দেখে বোঝা যায় কম করেও এই লোকের বয়স পঞ্চাশ তো হবেই।

‘কাজ হবে,’ পিসিক বলে উঠল

‘কিন্তু সমস্যা হলো,’ বলল রানা, ‘কসমেটিকস লাগাতে তুমি আধ ঘণ্টা ব্যয় করেছ। তারপর, উইগের ব্যাপারটাও রয়েছে। আমি একা মেকআপ নিলে এতটা নিখুঁত নাও দেখাতে পারে। এখানে কৃত্রিম আলোয় রয়েছি আমরা, কিন্তু খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কার্ডগুলো দেখাতে হবে আমাকে।’

হাসছে পিসিক। বলল, ‘ফটোর সাথে চেহারার হুবহু মিল কেউ খোঁজে না, মিস্টার। তাছাড়া, আরও একটা ব্যাপার আছে। যে লোক পরিচয়-পত্র পরীক্ষা করে সে প্রথমে চেহারাটা দেখে নেয়, তারপর পরিচয়-পত্র চেয়ে নিয়ে ফটোটা দেখে। ফটো দেখার আগেই আপনার চেহারার একটা ছাপ তার মনের ক্যানভাসে আঁকা হয়ে যাবে, মনের ক্যানভাসে আঁকা চেহারাটার সাথে ফটোর চেহারা মিলিয়ে দেখবে সে। সেই চেহারার সাথে ফটোর চেহারার আকাশ পাতাল পার্থক্য না থাকলে তার মনে কোন সন্দেহের উদয় হবে না। তাছাড়া, আপনার চেহারার সাথে ফটোর চেহারায় মিল খুঁজবে সে, অমিল নয়—সুতরাং, অমিল এক-আধটু থাকলেও তা তার চোখে ধরা পড়বে না।

চেস্টারফিল্ডের প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ধরাল পিনিক। ‘আরও অনেক পয়েন্ট আছে। এই ফটোটার সাইজ টোয়েনটি ফাইভ বাই টোয়েনটি সেন্টিমিটার। কিন্তু আইডেনটিটি কার্ডে যে ফটোটা থাকবে সেটা হবে থ্রী বাই ফোর সাইজের। এরপর ধরুন, কার্ড ইস্যুর তারিখ যদি কয়েক বছর আগের হয়, বর্তমান চেহারার সাথে ফটোর চেহারা এক-আধটু অমিল থাকাই স্বাভাবিক। ফুটোয় দেখা যাচ্ছে, আপনি বুক খোলা কলার লাগানো স্ট্রাইপ শার্ট পরে আছেন, কিন্তু যখন আপনার কাছ থেকে কার্ড দেখতে চাওয়া হবে তখন আপনার গায়ে এই শার্ট থাকবে না। সম্ভব হলে বুক খোলা শার্ট ব্যবহারই করবেন না। টাই স্কার্ফ বা গলাবন্ধ সোয়েটার পরতে পারেন।’

একটু বিরতি নিয়ে ঘন ঘন লম্বা টান দিয়ে সিগারেটটাকে ফিলটার টিপের গোড়া পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিল পিসিক, তারপর নতুন একটা সিগারেট ধরাল। ‘এরপর আসুন মেকআপ আর উইগের ব্যাপারে। একা একাই পারবেন আপনি। চুলটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার জন্যে কার্ড দাখিল করার আগে ছোট করে অবশ্যই ছেঁটে নিতে হবে আপনার চুল, কলপ লাগিয়ে গ্রে করে নিতে হবে। ফটোতে যতটা গ্রে দেখাচ্ছে তারচেয়ে বেশি রঙ চড়াতে হবে, কম তো নয়ই। চেহারায় বয়সের ছাপ ফোটাবার জন্যে আমার দুটো পরামর্শ আছে। এক, তিনদিন দাড়ি কামাবেন না, তারপর ধারাল ক্ষুর দিয়ে চেঁছে সাফ করবেন, তাতে দু’এক জায়গায় সামান্য কেটে যাবে, সেটাই দরকার। বয়স্ক লোকেরা দাড়ি কামাতে গিয়ে তাই করে। ক্ষুর দিয়ে কামালে ত্বকের চেহারা সামান্য হলেও বদলাবে, এই বদলটুকু আপনার জন্যে অনুকূল হবে। দুই…মশিয়ে কি দু’এক টুকরো করডাইট যোগাড় করতে পারবেন?’

অভিজ্ঞ লোকের মত কথা বলছে পিসিক, শুনছে রানা, এবং মনে মনে প্রশংসা করছে, কিন্তু চেহারাটা হয়ে আছে ভাবলেশহীন। গগল এক্ষেত্রেও দক্ষ একজন প্রফেশন্যালের কাছেই পাঠিয়েছে ওকে। উপযুক্ত ধন্যবাদ দিতে হবে তাকে, ভাবল ও, কাজ শেষ হবার পর। ‘হয়তো,’ মৃদু কণ্ঠে বলল রানা!

‘দুই কি তিন টুকরো করডাইট চিবিয়ে যদি গিলে ফেলেন,’ পিসিক বলল, ‘আধ ঘণ্টার মধ্যে বমি বমি ভাব দেখা দেবে—অস্বস্তিকর, তবে অসহ্য কিছু নয়। এর ফলে আপনার চামড়ার রঙ আশ্চর্য ম্লান হয়ে যাবে, ঘাম দেখা দেবে সারা মুখে। রুট-মার্চের কষ্ট থেকে বাঁচার জন্যে সৈন্যরা এই করডাইট খেয়ে অসুস্থ হবার ভান করে।’

‘তথ্যটার জন্যে ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘আমি জানতে চাই সময় মত ডকুমেন্টগুলো ডেলিভারি পাব কি না।’

‘টেকনিক্যাল কাজগুলো সারতে খুব একটা সময় লাগবে না,’ বলল পিসিক ‘সমস্যা একটাই থেকে গেল, সেটা হলো, আপনার দ্বিতীয় ডকুমেন্টের অরিজিন্যাল একটা কপি যোগাড় করা। চারদিকে খবর পাঠাতে হবে। যাই হোক, অক্টোবরের এক দুই তারিখে এলে সব ডেলিভারি দিতে পারব আমি।’

‘কি ভাবে যোগাযোগ করব?’

‘সরাসরি এখানে চলে আসবেন, বলল পিসিক।

না। ফোন করে জানাব আমি কোথায় দেখা হবে।

একটু ইতস্তত করে পিসিক বলল, ‘আপনার কাছে আমার যে ফোন নাম্বারটা আছে সেটা আমার জন্যে তেমন নিরাপদ নয়। এই নাম্বারে ফোন করলে আমাকে নাও পেতে পারেন।’ একটু চিন্তা করল সে, তারপর বলল, ‘এক কাজ করলে হয়। আজকে যে রেস্তোরাঁয় আলাপ হলো, সেই রুনিউভিতে অক্টোবরের এক তারিখ থেকে তিন তারিখ পর্যন্ত রোজ সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমি। আপনি যদি না আসেন, মনে করব চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে।

ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পাঁচ পাউন্ডের বিশটা নোটের দুটো বান্ডিল বের করে ছুঁড়ে দিল রানা। লুফে নিল পিসিক, দ্রুত ভরে ফেলল পকেটে।

ঘুরে দাঁড়িয়েছে রানা। মাথা থেকে উইগ খুলে স্পিরিটে ভেজানো তোয়ালে দিয়ে মুখের মেকআপ তুলছে। নিঃশব্দে জ্যাকেট আর টাইটা পরে নিল। তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল বেলজিয়ানের দিকে

পিসিককে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে রানা। লোকটার চেহারার মধ্যে ফুটে আছে শেয়ালের ধূর্ততা।

মৃদু গলায়, শান্ত ভঙ্গিতে শুরু করল রানা, ‘একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝে নাও তুমি। কাজ শেষ করে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রুনিউভিতে যাবার জন্যে অপেক্ষা করবে। একা। ওখানেই আমাকে ফেরত দেবে পুরানো লাইসেন্সের বাতিল ফ্রন্ট পেজ এবং নতুন লাইসেন্স। তার সাথে দেবে আজ তোলা ফটোর সবগুলো প্রিন্ট এবং নেগেটিভ।’ একটু বিরতি নিল রানা। ওর চোখে ব্যাঙের গভীর দৃষ্টি, চেয়ে আছে পিসিকের চোখে। অরগ্যান এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের অরিজিন্যাল মালিকের নাম তুমি ভুলে যাবে। ডকুমেন্ট দুটোয় মার্ক বোডিনের নাম থাকবে, এই নামটাও মন থেকে মুছে ফেলবে তুমি। আমার সম্পর্কে কারও সাথে কোন রকম আলোচনা করবে না তুমি। এই নির্দেশগুলো একটাও যদি অমান্য করো, মারা যাবে। বুঝতে পারছ?’

রানার দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকল পিসিক। এতক্ষণ সে ভেবেছে, লোকটা একজন স্মাগলার, ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে ড্রাগস বা ডায়মন্ড পাচার করার জন্যে জাল কাগজপত্র সংগ্রহ করতে এসেছে। কিন্তু খুন-খারাবির কথা শুনে টনক নড়ে গেল তার। আরে, এ যে আরও গভীর পানির মাছ!

চেহারায় ভীতি ফুটিয়ে তুলে পিসিক বলল, ‘বুঝেছি, মিস্টার।’ ভয় নয়, পিসিকের মনে সেঁধিয়ে গেছে লোভ।

ঘুরে দাঁড়াল রানা। দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল এক তলায়, রাস্তায় বেরিয়ে মিশে গেল অন্ধকারে।

আধ মাইল হেঁটে এল রানা। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে ফিরল অ্যামিগোয়। রূম সার্ভিসকে টেলিফোনে ডেকে কোল্ড চিকেন আর এক বোতল Moselle-এর অর্ডার দিল। মেকআপের শেষ বিন্দুটা নিশ্চিহ্ন করার জন্যে প্রথমে গরম তারপর ঠাণ্ডা পানিতে স্নান করল। বিছানায় উঠে ঘুমিয়ে পড়ল রাত বারোটায়।

পরদিন সকালে হোটেল ছেড়ে প্যারিসগামী বারব্যান্ট এক্সপ্রেসে চড়ে বসল রানা। আজ সেপ্টেম্বরের বাইশ তারিখ