তিন
ইটালি। ঐতিহাসিক রোম নগরীর অভিজাত এলাকার ছোট্ট একটা দোতলা বাড়ি। নিচের তলায় রানা এজেন্সীর ব্রাঞ্চ। দোতলায় শাখা-প্রধান কন্টেসা (সাবেক) মারদাস্ত্রোয়ানি মোনিকা আলবিনো থাকে। মোনিকার সাথেই থাকে ইস্পাত কঠিন পেশীর অধিকারী বিশালদেহী গরিলা সাবানা ম্যাটাপ্যান। ম্যাটাপ্যানও রানা এজেন্সীর কর্মী। মোনিকার সাথে তার সম্পর্ক বাপ-বেটির মত। কোন রকম আপদ বিপদের আঁচ যাতে মোনিকাকে স্পর্শ করতে না পারে সেজন্যে মোনিকার শৈশব থেকে গত ত্রিশটা বছর সে ছায়ার মত সাথে লেগে আছে তার সাথে।
আজ সেপ্টেম্বর মাসের তিন তারিখ। গত একটা হপ্তা রানা এজেন্সীর এই শাখায় তালা ঝুলছে, কাজকর্ম সব বন্ধ। যে-সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, সব বাতিল করে দেয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে শাখা-প্রধান মোনিকা অসুস্থ।
অফিস বন্ধ হলেও রানা এজেন্সীর কর্মচারীদের আনাগোনা আরও নিয়মিত হয়েছে এই ক’দিন। ভোর পাঁচটার সময় একদল ঢোকে বাড়িতে, আরেকদল বেরিয়ে যায়। আবার বিকেল পাঁচটায় আসে একদল, একটু পরই বেরিয়ে যায় আগের দলটি—এভাবে পালাক্রমে গোটা বাড়িটাকে পাহারা দিচ্ছে প্রায় ত্রিশ জন স্বাস্থ্যবান, সুবেশ, কঠোর চেহারার সশস্ত্র যুবক। কিন্তু বাইরে থেকে দেখে কারও মনে কোন সন্দেহ জাগার কোন কারণ নেই। ওদের প্রিয় ‘দৈত্য শিশু’ ম্যাটাপ্যান ভাই পাহারা দেবার জন্যে এমন সব জায়গা বেছে প্রত্যেকের দাঁড়াবার ব্যবস্থা করেছে যে বাইরের কেউ, এমন কি প্রতিবেশীরাও তাদের অস্তিত্ব টের পায় না। হঠাৎ কেন এই কঠোর প্রহরার ব্যবস্থা, এ-সম্পর্কে এজেন্সীর কর্মীরাও কিছু জানে না। অবাঞ্ছিত কৌতূহল প্রকাশ করা স্বভাব নয় এদের কারও। তাই এ সম্পর্কে তারা ম্যাটাপ্যান বা মোনিকাকে কোন প্রশ্ন করেনি। এই ক’দিন ম্যাটাপ্যানকেই শুধু দেখতে পাচ্ছে তারা, মোনিকাকে খুব কম—মাঝে মধ্যে দেখা যায়। কোন একটা গোপন রহস্য আছে, এর বেশি কিছু জানে না কেউ। জানতে চায়ও না।
আসল রহস্য মাসুদ রানা। ছদ্মবেশ নিয়ে মোনিকার আস্তানায় উঠেছে ও। গত মাসে প্যারিস থেকে রোম হয়ে ঢাকায় যাবার সময় মোনিকাকে ইউনিয়ন কর্স এবং বর্তমান কাপু উ সেন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যাদি পাওয়া যাবে এমন সব বই এবং পত্র-পত্রিকার একটা তালিকা দিয়ে গিয়েছিল ও। বিস্তর ঘোরাঘুরি করে প্রচুর বই এবং পত্রিকা সংগ্রহ করেছে মোনিকা। রানার তালিকার বাইরেও যেখানে ওদের সম্পর্কে যা পেয়েছে, যোগাড় করে রেখেছে। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ বই ও পত্রিকা নিজে পড়ে ইউনিয়ন কর্স এবং তার বর্তমান কাপু উ সেন সম্পর্কে যেখানেই কোন তথ্য দেখেছে সে, লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করে রেখেছে। এতে অনেক পরিশ্রম বেঁচে গেছে রানার। সারাদিন বিছানায় শুয়ে-বসে দাগ দেয়া লাইনগুলো পড়ে যাচ্ছে ও। মাঝে মধ্যে নোট করছে। ওদিকে মোনিকারও ছুটি নেই। পত্রিকার স্তূপের মধ্যে বসে দিনের মধ্যে বারো ঘণ্টা পড়ছে, দাগ দিচ্ছে।
রানার অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করে প্রথম দিকে ঘাবড়ে গিয়েছিল মোনিকা। কাজের ফাঁকে কি এক গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে সে। কখনও অস্থিরভাবে পায়চারি করে। আড়াল থেকে একবার দেখে ফেলেছে মোনিকা, প্রচণ্ড আক্রোশে হিংস্র হয়ে উঠেছিল রানার মুখের চেহারা। দুম্ করে টেবিলে ঘুসি মেরে বিড়বিড় করে বলছিল, ‘তোমার রক্ত পান করতে পারলে আমার শান্তি হত। খেয়ে-দেয়ে তাজা থাকো উ সেন, আমি আসছি।’ কথা প্রায় বলেই না রানা। একবারও তাকে হাসতে দেখেনি মোনিকা। ভয়ে ভয়ে একবার জিজ্ঞেস করেছিল সে, ‘ঠিক কি করতে চাইছ তুমি, রানা?’
আমার জীবনে উ সেন একটা সমস্যা। উপড়ে ফেলতে চাই।’ এর বেশি কিছু বলেনি ও।
চার তারিখ রাতে শেষ হলো কাজ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দু’জন। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারেনি রানা। উ সেন সম্পর্কে বিশেষ নতুন কিছু জানতে পারেনি ও। ইউনিয়ন কর্সের কাপু সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে হলে লন্ডনে যেতে হবে ওকে। যাবার ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছে। ম্যাটাপ্যানকে দিয়ে আজ রাতের লন্ডন ফ্লাইটের টিকেট বুক করানো হয়েছে। প্যাসেঞ্জার হিসেবে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে ও–সান্তিনো ভ্যালেন্টি, একজন ইটালিয়ান, ট্যুরিস্ট হিসেবে লন্ডনে যাচ্ছে।
লন্ডনে কোন হোটেলে উঠবে না রানা। চিঠির মাধ্যমে লন্ডনের একটা এজেন্সীর সাহায্যে প্যাডিংটনের প্যারেড স্ট্রীটের একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে ও। এই রোম থেকে চিঠি পাঠিয়ে আরও একটা কাজ সেরে রেখেছে। রয়্যাল লাইব্রেরী সহ লন্ডনের বেশ কয়েকটা বড় লাইব্রেরীকে অনুরোধ করেছে, লন্ডনে ওর সদ্য ভাড়া নেয়া বাড়ির ঠিকানায় তারা যেন পৃথিবী কুখ্যাত গুপ্ত সংগঠনগুলো সম্পর্কে সম্ভাব্য সমস্ত বই-পত্র পাঠিয়ে দেয়। প্রত্যেক লাইব্রেরীর নামে বই-পত্রের দাম হিসেবে কিছু কিছু টাকা চেকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছে ও।
চার তারিখ রাত এগারোটায় লন্ডন এয়ারপোর্টে নামল রানা। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে গেল প্যাডিংটন এলাকার প্যারেড স্ট্রীটে, ভাড়া করা সেই বাড়িতে।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে বাড়িটার গেটের পাশে লেটার বক্সের সামনে দাঁড়াল রানা। ফোকর দিয়ে ভিতরে হাত ঢোকাতেই চাবির গোছাটা পাওয়া গেল।
ছোট্ট বাড়িটা। হালকা কিন্তু দামী আসবাবপত্রে ছিমছামভাবে সাজানো। পরদিন সকালের ডাকেই অধিকাংশ লাইব্রেরী থেকে পত্র-পত্রিকা এসে পৌঁছল। টেলিফোন ব্যবহার করে নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র সব আনিয়ে নিল রানা স্থানীয় একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে। মাছ ধরার জন্যে হুইল, রড ও আর্টিফিশিয়াল বেইটের একটা দামী সেট এবং আনুষঙ্গিক আরও কিছু জিনিসও আনাল। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ নতুন ভাড়াটের সাথে পরিচয় করতে এলে রানা তাদেরকে কথা প্রসঙ্গে জানিয়ে দিল কয়েকদিনের মধ্যেই আইসল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হবে সে, উদ্দেশ্য: মৎস্য শিকার।
লন্ডনের এই বাড়িটা ছেড়ে প্রথম দিকে প্রায় বেরোলই না রানা। একটানা ক’দিন পড়াশোনা করে ইউনিয়ন কর্স এবং তার কাপু সম্পর্কে যা কিছু জানল সে, সব স্মৃতির মধ্যে গেঁথে রাখল সযত্নে, প্রয়োজনের মুহূর্তটিতে যাতে মনে পড়ে যায়।
কিন্তু বিষয় দুটো নিয়ে এত পড়াশোনা করেও অদৃশ্য হবার পর থেকে যে প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজছে তার কোন হদিস পায়নি ও। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম হপ্তা পেরিয়ে গেল, কিন্তু এখনও ঠিক করতে পারেনি—আঘাতটা কখন, কোথায় এবং কিভাবে হানবে ও।
সবশেষে, দশ তারিখ সকালে, নোটবুকটা নিয়ে বসল ও। গত চোদ্দ-পনেরো দিন ধরে যা পড়াশোনা করেছে তার সারাংশ এতে টোকা আছে। গভীর মনোযোগের সাথে নোটবুকের পাতাগুলো পড়তে পড়তে বিদ্যুৎ চমকের মত একটা তারিখের কথা মনে পড়ে গেল ওর। সাথে সাথে পানির মত সহজ উত্তরটা ধরা দিল ওর মগজে। এতগুলো দিন নষ্ট হবার আগেই কেন এত সহজ একটা ব্যাপার ওর মাথায় আসেনি ভেবে নিজেকে একটু তিরস্কার করল ও। কিন্তু উত্তরটা পাবার আনন্দে নিজেকে মাফও করে দিল সাথে সাথে।
প্রতি বছর অন্তত একটা দিন ইউনিয়ন কর্সের কাপুকে জনসমক্ষে বের হতেই হবে। খারাপ আবহাওয়া থাকুক, শারীরিক অসুস্থতা হোক, ভয়ঙ্কর ব্যক্তিগত বিপদের ঝুঁকি থাকুক, সেদিন কাপুকে লোকে লোকারণ্য একটা অনুষ্ঠানে আসতেই হবে। গত তিনশো বছরে প্রায় একশো কাপু এই অলঙ্ঘনীয় নিয়ম পালন করে এসেছে, ব্যতিক্রমের কোন দৃষ্টান্ত নেই। এরপর রানার প্রস্তুতি পর্বে যুক্ত হলো প্র্যাকটিক্যাল প্ল্যানিং এবং গ্রাউন্ড ওয়র্ক।
কখন?
কোথায়?
একই সাথে উত্তর পাওয়া গেছে দুটো প্রশ্নের। এবার তৃতীয়, শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে রানা:
কিভাবে?
বিদ্যুৎ চমকের মত কোন ধারণা হঠাৎ মাথায় এসে পড়বে, এরকম কিছু আশা করা এক্ষেত্রে বৃথা। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে একের পর এক চুরুট পুড়িয়ে ছাই করছে রানা, ফ্লাস্ক ভর্তি উত্তপ্ত কফি শেষ করছে, আর ভাবনা চিন্তা করছে। এক এক করে কয়েক’ ডজন পদ্ধতির কথা ভাবল ও, খুঁটিয়ে বিচার করল প্রত্যেকটি, তারপর এক এক করে বাতিল করে দিল সবগুলো। বাতিল করল বটে, প্রতিটি পদ্ধতির পছন্দসই কিছু অংশ কাজে লাগবে ভেবে মনের একধারের একটা কুঠুরিতে জমা করে রাখল। সেই ক্ষুদ্র অংশগুলো জোড়া লাগিয়ে, তার সাথে আরও কিছু যোগ করে শেষ পর্যন্ত নিটোল একটা প্ল্যান তৈরি করে ফেলল ও। নানান দিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্ল্যানটা নিয়ে ভাবল ও। কোন খুঁত পেল না কোথাও। গোটা ব্যাপারটা খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। কখন? কোথায়? কিভাবে? উত্তর মিলে গেছে তিন প্রশ্নেরই।
‘উফ্!’ স্বস্তির একটা হাঁফ ছাড়ল রানা। কিন্তু পরমুহূর্তে চমকে উঠল ও। ধীরে ধীরে কালো হয়ে গেল মুখের চেহারা। মনে পড়ে গেছে রক্তাক্ত গিলটি মিয়ার চেহারাটা। হুড়মুড় করে ফিরে এল কতদিনের কত কি রাজ্যের স্মৃতি। শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে, কিছুই জানা নেই ওর। বেঁচে আছে গিলটি মিয়া? মনে হয় না। বড় দুর্বল শরীর তার। পরক্ষণে ভাবল, মার খাওয়া শরীর, বেঁচে যেতেও পারে। হঠাৎ লজ্জা পেল রানা। নিজেকে শাসাল, এ্যাই, কি হচ্ছে, ভাবাবেগে আক্রান্ত হচ্ছ কেন? ভিজে চোখের দুই কোণ মুছল রানা। ঢাকা ছাড়ার পর থেকে গিলটি মিয়া সম্পর্কে কোনরকম ভাবনা চিন্তার অবকাশ দেয়নি সে নিজেকে। কারণ গিলটি মিয়ার সূত্র ধরে মনে পড়বে সালমার কথা। মনে পড়বে সালমার প্রেমিকের কথা। তাতে মন খারাপ হয়ে যাবে, দুর্বল হয়ে পড়বে ও। কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। নিজেকে ভাবাবেগ মুক্ত রাখার স্বার্থেই মন থেকে ওদের কথা মুছে ফেলতে চেষ্টা করছে ও।
অতি কষ্টে নিজেকে সামলাল রানা। ধীরে ধীরে চেহারা বদলাচ্ছে আবার ওর। দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ ফুটে উঠল মুখে। চোখ দুটো নিষ্পলক। সাদা দেয়ালের গায়ে নিবদ্ধ। হাত দুটো আপনা আপনি মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে। টকটকে লাল মুখের রঙ। ধীরে ধীরে মৌন একটা আক্রোশ ফুটে উঠল দুই চোখের দৃষ্টিতে। বিড় বিড় করে বলল রানা, ‘যত নিরাপদেই তুমি থাকো, উ সেন, আমি আসছি।’
কাপু উ সেন সম্পর্কে একচুল ভুল ধারণা নেই রানার। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ব্যক্তি এখন সে। আমেরিকার নিহত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নিরাপত্তা প্রহরা প্রায় নিখুঁত ছিল, কিন্তু পুরোপুরি নিখুঁত ছিল না। সেই সামান্য একটু খুঁতের কারণেই উনিশশো তেষট্টি সালে সাধারণ এক আততায়ী ডালাসে তাঁকে খুন করতে সমর্থ হয়। ইউনিয়ন কর্স এ সম্পর্কে পূর্ণ সজাগ, প্রাপ্ত তথ্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আততায়ীর হাতে নিহত বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধানদের নিরাপত্তা প্রহরা সম্পর্কে যা কিছু জানার সবই জানা আছে’ কাপু উ সেনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের। শুধু তাই নয়, বর্তমান বিশ্বের জীবিত রাষ্ট্রপ্রধানদের সর্বশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর পায় তারা এবং যেটা নিখুঁত বলে মনে হয় সেটাকে উ সেনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে যোগ করে নিতে মুহূর্তমাত্র দেরি করে না। আরেকটা ব্যাপারে রানা সচেতন। তা হলো ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী ছাড়াও উ সেনকে সম্ভাব্য আততায়ীর বুলেট থেকে রক্ষা করার জন্যে ফ্রেঞ্চ পুলিস, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ, সিক্রেট সার্ভিস, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স সদা প্রস্তুত হয়ে আছে। বিস্ময়কর এবং অবিশ্বাস্য শোনালেও এই তথ্যের মধ্যে একবিন্দু অতিরঞ্জন নেই যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জিসকার দেস্তার নিরাপত্তা প্রহরার চেয়ে কয়েকশো গুণ কড়া প্রহরার ব্যবস্থা রয়েছে কাপু উ সেনের। কারণটা সহজেই অনুমেয়—শত্রুর সংখ্যা সীমা নেই কাপুর। কেবল বাইরে নয়, ঘরেও রয়েছে তার শত্রু।
যে কোন সুস্থ মস্তিষ্ক মানুষের মনে হবে, এই যখন পরিস্থিতি, উ সেনকে হত্যা করার পরিকল্পনা পাগল ছাড়া আর কেউ করবে না। এবং সেই পাগলের একমাত্র পরিণতি মৃত্যু।
কিন্তু নিজেকে রানা পাগল বলেও মনে করছে না, মরতেও রয়েছে ওর ঘোর আপত্তি; ও ভরসা করছে পরিস্থিতির অনুকূল দিকটার উপর। এই অনুকূল দিকটাকে দু’ভাগে ভাগ করে নিয়েছে ও। এক, ওর অস্তিত্ব এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইউনিয়ন কর্স কিছুই জানে না। দুই, নির্বাচিত দিনে ক্ষমতার গর্বে গর্বিত, শক্তিমদমত্ত কাপু কয়েক শতাব্দীর রীতি অনুযায়ী নিরাপদ দুর্গ ছেড়ে কয়েক মিনিটের জন্যে হলেও বাইরে বেরিয়ে আসবে, বিপদের যত বড় ঝুঁকিই থাকুক না কেন।
.
ক্যাস্ট্রাপ কোপেনহেগেন থেকে আগত SAS-এর প্রকাণ্ড যাত্রীবাহী বিমানটা ধীরে ধীরে থামল লন্ডন এয়ারপোর্টের টার্মিনাল ভবনের সামনে। আরও কয়েক সেকেন্ড শোনা গেল ইঞ্জিনের বিকট গর্জন, তারপর আস্তে আস্তে তাও থেমে গেল। চাকা লাগানো সিঁড়ি দুটো ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বিমানবন্দর কর্মীরা। বিমানের দোরগোড়ায় সে দুটো লাগানো হলো। দরজা খুলে হাসি মুখে বেরিয়ে এল এয়ারহোস্টেস। সার বেঁধে বেরিয়ে আসছে আরোহীরা। এয়ারহোস্টেসের পাশ ঘেঁষে নামার সময় মুখস্থ বুলি শুনে সৌজন্যের মৃদু হাসি ফুটছে প্রত্যেকের মুখে।
উঁচু অবজারভেশন টেরেসে এক মাথা সোনালী চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বাস্থ্যবান, সুবেশ এক ইটালিয়ান। গাঢ় রঙের চশমাটা ঠেলে কপালে তুলে দিল সে, চোখের সামনে একটা বিনকিউলার তুলন।
এটা নিয়ে আজ ছয়টা বিমানের আরোহীদের দূর থেকে এভাবে লক্ষ করছে সান্তিনো ভ্যালেন্টি ওরফে রানা। অবজারভেশন টেরেসে আরও অনেক লোক অপেক্ষা করছে সদ্য আগত আরোহীদের মধ্যে থেকে নিজেদের আত্মীয়, বন্ধুদের চিনে নেবার জন্যে, রানার আচরণ তাই কারও মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক করছে না।
একটু নিচু হয়ে বিমানের দরজা টপকে আলোয় বেরিয়ে এসে সিধে হলো আট নম্বর আরোহী। লোকটাকে দেখেই শরীরের পেশীতে একটু টান পড়ল রানার, লোকটাকে অনুসরণ করে সিঁড়ির নিচে পর্যন্ত নেমে এল ওর দৃষ্টি। পোশাক দেখে মনে হলো আরোহী ডেনমার্কের একজন ধর্মযাজক। ডগ কলার লাগানো গ্রে রঙের ক্ল্যারিক্যাল স্যুট পরনে। লোহায় ধরা মরচের মত রঙ চুলের, মাঝারি করে ছাঁটা, কপাল থেকে পিছন দিকে পরিপাটিভাবে ব্রাশ করা। বয়স অনুমান করল রানা-বাইশ। তবে মুখের চেহারা সজীব, আরও অল্পবয়স্ক মনে হচ্ছে। দীর্ঘদেহী, সরু কোমর, কাঁধ দুটো চওড়া। প্রায় রানার মতই কাঠামো শরীরের।
আরোহীরা পাসপোর্ট আর কাস্টমস্ ক্লিয়ারেন্সের জন্যে অ্যারাইভ্যাল লাউঞ্জে লাইন দিচ্ছে। চোখ থেকে বিনকিউলার নামান রানা। পাশ থেকে ব্রীফকেসটা তুলে নিয়ে খুলল। বিনকিউলারটা ব্রীফকেসে ভরে আবার বন্ধ করল সেটা। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি বেয়ে নামল মেইন হলে।
পনেরো মিনিট পর ডেনিশ পাদ্রী কাস্টমস্ হল থেকে বেরিয়ে এল মেইন হলে। একহাতে হ্যান্ডব্যাগ, অপর হাতে সুটকেস। তাকে রিসিভ করার জন্যে কেউ আসেনি। সোজা হেঁটে এসে ব্যাঙ্কের কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াল সে চেক ভাঙাবার জন্যে।
একটা বুকস্টলের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে রানা। ব্রীফকেসটা পায়ের সামনে রেখে সামনে মেলে ধরেছে একটা দৈনিক পত্রিকা, পড়ছে না, রঙিন চশমার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে আছে ডেনিশ ধর্মযাজকের দিকে। ব্যাঙ্ক কাউন্টার থেকে সরে এসে মেইন হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে লোকটা। কাগজটা ভাঁজ করে বগলের নিচে ঢুকিয়ে রাখল রানা। ব্রীফকেসটা তুলে নিয়ে অনুসরণ করল পাদ্রীকে
এয়ারপোর্ট ভবন থেকে বেরিয়ে সোজা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চলে এল লোকটা। তার পিঠ ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে একটা ওপেন স্পোর্টস মডেল গাড়ির সামনে দাঁড়াল রানা। দরজা খুলে ব্যাকসীটে রাখল ব্রীফকেসটা। উঠে বসল ড্রাইভিং সীটে। ঘাড় ফেরাতেই দেখল একটা ট্যাক্সিতে চড়ছে পাদ্রী।
ট্যাক্সিটা স্টার্ট নিল, নাক ঘুরিয়ে ছুটল কিংসব্রীজের দিকে। অনুসরণ করছে রানা।
হাফমুন স্ট্রীটের ছোট্ট কিন্তু সুদৃশ্য একটা হোটেলের সামনে থামল ট্যাক্সি। সেটার পাশ ঘেঁষে ছুটে গেল স্পোর্টস কার। কয়েক মূহূর্ত পর কার্জন স্ট্রীটের মাঝামাঝি জায়গায় একটা পার্কিং লট দেখে গাড়ি থামাল রানা। ব্রীফকেস হাতে নিয়ে নামল ও। পিছনের বুটে ব্রীফকেস রেখে তালা লাগিয়ে দিল। ছোট হোটেলটায় হেঁটে ফেরার পথে শেফার্ড মার্কেটের বুক-শপ থেকে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডের দুপুর সংস্করণ কিনল একটা। হোটেলের রিসেপশন হলে পৌঁছতে পাঁচ মিনিট লাগল ওর।
একটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছে রানা। পঁচিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো ওকে। তারপর সিঁড়ির মাথায় দেখতে পেল ডেনিশ ধর্মযাজককে। নিচে নেমে এসে রিসেপশনিস্টের হাতে কামরার চাবি তুলে দিল সে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা একটা হুকে গলিয়ে দিল চাবির রিঙটা। চাবির গোছাটা দুলছে। ধীরে ধীরে থামল সেটা। এখন রানা পরিষ্কার পড়তে পারছে চাবির নম্বরটা – সাতচল্লিশ
একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে রেস্তোরাঁয় গিয়ে ঢুকছে ধর্মযাজক।
বসেই আছে রানা। এক দুই করে আরও পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল। কাউন্টারের সামনে একজন গেস্টের সাথে কথা বলছে রিসেপশনিস্ট। গেস্ট লোকটা স্থানীয় একটা থিয়েটার হলের ঠিকানা, অনুষ্ঠান-সূচী এবং অনুষ্ঠানের সময় জানতে চাইছে। তাকে অপেক্ষা করতে বলে মেয়েটা ভিতরের কামরায় চলে গেল তথ্য সংগ্রহ করতে। এই সুযোগে চেয়ার ছেড়ে দ্রুত সিঁড়ির দিকে এগোল রানা।
দোতলার সাতচল্লিশ নম্বর কামরার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে মাথার কাছে সামান্য একটু বাঁকানো এবং দু’ভাগ করা দু’ইঞ্চি লম্বা একটা ইস্পাতের টুকরো বের করল সে। ফুটোয় সেটা ঢুকিয়ে এদিক ওদিক ক’বার ঘোরাতেই ক্লিক করে খুলে গেল তালা।
কামরায় ঢুকেই বেডসাইড-টেবিলের উপর পাসপোর্টটা দেখল রানা। পাশেই মানিব্যাগ এবং ট্র্যাভেলার্স চেকের ফোল্ডার পড়ে রয়েছে। পাসপোর্টটা তুলে পকেটে ভরে নিয়ে ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে করিডরে বেরিয়ে এল ও। টাকা পয়সা ছোঁয়নি। ও আশা করছে, কিছুই চুরি যায়নি দেখে হোটেল ম্যানেজমেন্ট ধর্মযাজককে বোঝাবার চেষ্টা করবে পাসপোর্টটা সে অন্য কোথাও হারিয়েছে।
ঘটলও তাই। মাথাভর্তি সোনালী চুল বিশিষ্ট দীর্ঘদেহী ইটালিয়ানকে ধর্মযাজকের কামরায় ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি কেউ। লাঞ্চ সেরে আধঘণ্টা পর নিজের কামরায় ফিরল ধর্মযাজক, কিন্তু টেবিলে পাসপোর্ট আছে কি নেই তা সে লক্ষই করল না, বিকেলে শহর দেখতে যাবার সময় হুঁশ হলো তার। কামরার সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরও যখন পাসপোর্টের কোন হদিস মিলল না। নিচে নেমে এসে ম্যানেজারকে সে জানাল ব্যাপারটা। ম্যানেজার সব শুনে বলল টাকা পয়সা যখন সব ঠিক আছে, তাহলে মনে করতে হবে কামরায় চোর ঢোকেনি, পাসপোর্ট আপনি অন্য কোথাও হারিয়ে এসেছেন। তাই হবে, আত্মভোলা পাদ্রী মনে মনে ভাবল। পরদিন সে ব্যাপারটা জানাল ডেনিশ কনস্যুলেট-জেনারেলকে। এখান থেকে তাকে কিছু ট্রাভেল ডকুমেন্টস দেয়া হলো, যার সাহায্যে ভ্রমণ শেষ করে পনেরো দিন পর কোপেনহেগেন ফিরে যেতে পারবে সে। কনস্যুলেট-জেনারেলের একজন কেরানী অভিযোগের খাতায় লিখল Sankt Kjeldsk।rke, Copenhagen -এর Pastor Per Benson তার পার্সপোর্ট হারিয়ে ফেলেছেন। ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেল। সেদিন ১৪ সেপ্টেম্বর।
দু’দিন পরই একই ধরনের আরেকটা ঘটনা ঘটল। এবার পাসপোর্ট হারাল একজন আমেরিকান ছাত্র। নিউ ইয়র্ক স্টেট থেকে একটা প্লেন নামল হিথরো বিমানবন্দরে, থামল এয়ারপোর্টের ওসেনিক বিল্ডিংয়ের সামনে। প্লেন থেকে নেমে কাস্টমসের ঝামেলা চুকিয়ে মেইন হলে ঢুকে সোজা সে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্কের কাউন্টারে চলে এল ট্র্যাভেলার্স চেক ভাঙাবার জন্যে। নিয়ম অনুযায়ী পাসপোর্টটা বের করে কাউন্টারে রাখল সে। চেক ভাঙিয়ে জ্যাকেটের ভিতরের পকেটে টাকাগুলো রাখল, পাসপোর্টটা রাখল চেনওয়ালা একটা পাউচে। তারপর পাউচটা ছোট একটা হ্যান্ডব্যাগের বাইরের পকেটে ঢুকিয়ে দিল। কয়েক মিনিট পর, একজন পোর্টারকে হাত ইশারায় ডাকার জন্যে, হ্যান্ডব্যাগটা কাউন্টারের উপর রাখল, এর তিন সেকেন্ড পর কাউন্টার থেকে সেটা ভোজবাজির মত গায়েব হয়ে গেল। হকচকিয়ে গিয়ে ছাত্রটি পোর্টারকেই প্রথমে জানাল ব্যাপারটা। পোর্টার তাকে সাথে করে নিয়ে গেল প্যান আমেরিকান এনকোয়েরি ডেস্কে। ছাত্রটিকে উপদেশ খয়রাত করা হলো, নিকটতম টার্মিন্যাল সিকিউরিটি পুলিস অফিসারের কাছে গিয়ে রিপোর্ট করো। ছাত্রটি তাই করল। সিকিউরিটি অফিসার তাকে সাথে করে নিয়ে গেল একটা অফিসে।
ভুলক্রমে নিজের মনে করে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে যেতে পারে কেউ, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে সিকিউরিটি পুলিস তৎক্ষণাৎ একটা অনুসন্ধান চালাবার ব্যবস্থা করল। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় না হওয়ায় খাতায় রিপোর্ট লেখা হলো: একটা পাসপোর্ট চুরি গেছে।
পকেটমার আর ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য ইদানীং কি রকম বেড়েছে তা বর্ণনা করে দীর্ঘ এবং ব্যায়ামপুষ্ট শরীরের অধিকারী মার্কিন ছাত্রটির কাছে আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা করা হলো। কর্তৃপক্ষের ক্ষমা প্রার্থনার বহর দেখে মুগ্ধ হয়ে ছাত্রটি মিছিমিছি স্বীকার করল যে হ্যাঁ, এ ধরনের ঘটনার শিকার তার এক বন্ধুও একবার হয়েছিল, গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন নিউ ইয়র্কে।
হ্যান্ডব্যাগ চুরি যাওয়ার ঘটনাটা নিছক রুটিন অনুযায়ী লন্ডন মেট্রোপলিটান পুলিসের সমস্ত ডিভিশনকে জানানো হলো। কিন্তু কয়েক হপ্তা পর যখন হ্যান্ডব্যাগ বা পাসপোর্ট কিছুরই হদিস পাওয়া গেল না, সংশ্লিষ্ট সবাই বেমালুম ভুলে গেল ব্যাপারটা।
এরমধ্যে মার্কিন ছাত্র স্মার্টি টোয়েন গ্রসভেনর স্কয়ারে নিজেদের কনস্যুলেটে গিয়ে পাসপোর্ট চুরির ঘটনা জানিয়ে ট্র্যাভেল ডকুমেন্টস সংগ্রহ করে নিল, একমাস পর স্কটল্যান্ড থেকে ফিরে এসে সে পাসপোর্ট ছাড়াই আমেরিকাগামী প্লেনে চড়তে পারবে।
পাদ্রী বেনসন এবং ছাত্র টোয়েনের বয়সের ব্যবধান বিস্তর হলেও শারীরিক কাঠামো এবং চেহারাগত ব্যাপারে দু’জনের মধ্যে মিল অনেক। দু’জনই প্রায় ছয় ফিট লম্বা, চওড়া কাঁধের অধিকারী, সরু কোমর, চর্বিহীন সুঠাম শরীর, চোখের মণি কালো। এসব বিষয়ে এদের দু’জনের সাথে প্রায় হুবহু মিল রয়েছে পাসপোর্ট চোর ইটালিয়ান সান্তিনো ভ্যালেন্টি ওরফে মাসুদ রানার। তবে পাদ্রীর বয়স চল্লিশ, চুলের রঙ গ্রে, সে গোল্ডরিমের চশমা ব্যবহার করে পড়াশোনার জন্যে। আর স্মার্টি টোয়েনের বয়স বিশ, চুলের রঙ নারকেল ছোবড়ার মত ব্রাউন, সবসময় মোটা রিমের চশমা ব্যবহার করে সে।
প্যাডিংটনের প্যারেড স্ট্রীটের বাড়িতে বসে প্রচুর সময় নিয়ে পাসপোর্টের ফটো দুটো খুঁটিয়ে দেখে কি কি কিনতে হবে তার একটা তালিকা তৈরি করল রানা। পরদিনটা সম্পূর্ণ ব্যয় করল কেনাকাটার কাজে। কসমেটিকসের দোকানে ঢু মারতে হলো কয়েকবার। চশমার দোকানে যেতে হলো। ওয়েস্ট এন্ড এলাকার এমন একটা জেন্টস ক্লোদিং শপ খুঁজে বের করল যারা আমেরিকান টাইপের পোশাক তৈরির ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ, এবং আমেরিকা থেকে আমদানী করা পোশাক খুচরো বিক্রি করে।
চশমার দোকান থেকে দু’জোড়া চশমা কিনল ও। একটা গোল্ডরিমের, অপরটি ভারী কালো ফ্রেমের, দুটোর জন্যে ক্লিয়ার লেন্স নিল। আরেক সেট ব্লু টিন্টেড ক্লিয়ার ভিশন কন্ট্যাক্ট লেন্সও নিতে ভুল করল না।
পোশাকের দোকান থেকে কিনল একজোড়া কালো চামড়ার স্নেকার, টি- শার্ট, আন্ডারপ্যান্টস, অফ-হোয়াইট স্ন্যাকস, আকাশ-নীল রঙের একটা নাইলন উইন্ডচিটার (সামনেটা জিপ-আপ এবং কলার কাফ যথাক্রমে লাল এবং সাদা উলের) সব নিউ ইয়র্কের তৈরি। এরপর নিল ধর্মযাজকের সাদা শার্ট, তারকাখচিত ভগ-কলার এবং কালো বিব। শেষ তিনটে থেকে অত্যন্ত সাবধানে প্রস্তুতকারক কোম্পানীর লেবেল সরিয়ে ফেলল ও।
দিনের শেষ টুটা মারল রানা চেলসী-র একটা পুরুষদের টুপি এবং উইগ এম্পোরিয়ামে। চুলের রঙ মিডিয়াম গ্রে এবং নারকেল ছোবড়ার মত ব্রাউন করার জন্যে বিশেষ ভাবে তৈরি দুই বোতল কলপ কিনল এখান থেকে। তরল কলপ চুলে লাগাবার জন্যে ছোট সাইজের কয়েকটা হেয়ার-ব্রাশ-ও কিনে নিল। এরপর, আমেরিকান পোশাকের কমপ্লিট সেট ছাড়া, আর কোন দোকান থেকে আর একটা জিনিসও কিনল না ও।
পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর। সান্তিনো ভ্যালেন্টির ছদ্মবেশ নিয়ে প্যাডিংটনের প্যারেড স্ট্রীটের বাড়িতে দৈনিক পত্রিকা লে ফিগারো-র উপর চোখ বুলাচ্ছে রানা, মাঝে মধ্যে মৃদু চুমুক দিচ্ছে বাঁ হাতে ধরা স্কচ হুইস্কির গ্লাসে। ভিতরের পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা হেডিংয়ের উপর চোখ পড়তে মৃদু কৌতূহলী হয়ে খবরটা পড়ল ও।
খবরে বলা হয়েছে প্যারিসে পুলিস জুডিশিয়ারির শাখা ব্রিগেড ক্রিমিনেল-এর ডিপুটি চীফ কমিসেয়ার হাইপোলাইট দ্যুবে তাঁর কোয়াই ডি অরফেরেস অফিসে আচমকা হৃত্যন্ত্র বিকল হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং হাসপাতালে স্থানান্তরের সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কমিসেয়ার হাইপোলাইটের আকস্মিক অন্তর্ধানের ফলে ব্রিগেড ক্রিমিনেল-এর গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব কমিসেয়ার ক্লড র্যাঁবোর উপর দেয়া হয়েছে। এখন থেকে তিনি চীফ অভ হোমিসাইড ডিভিশনের দায়িত্ব সহ এই নতুন দায়িত্ব পালন করবেন।
প্যারিসের হোমিসাইড ডিভিশনের প্রধান প্রৌঢ় ক্লড র্যাঁবো সম্পর্কে অনেকদিন থেকেই অনেক কথা শুনে আসছে রানা। ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হবার সৌভাগ্য অবশ্য কখনও হয়নি ওর। শুনেছে জীবিতদের মধ্যে সারা বিশ্বে এতবড় গোয়েন্দা নাকি আর নেই। গোটা ফ্রান্সের আন্ডারওয়ার্ল্ডে ক্লড র্যাঁবোকে নাকি আজরাইল বলে ডাকা হয়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর উদ্যমের এমন সমন্বয় সাধারণত দেখা যায় না। তদন্ত পরিচালনার ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব একটা ধারা আছে। ব্যাপক প্রস্তুতিই সেই ধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অতি সাধারণ চেহারার, সাদামাঠা টাইপের, নিতান্ত বিনয়ী স্বভাবের এই ভদ্রলোক নাকি নিজে সরেজমিনে তদন্ত পরিচালনা করে অসংখ্য জটিল রহস্যের সমাধান করে থাকেন, কিন্তু আত্মপ্রচার পছন্দ করেন না। ব্যক্তিগতভাবে নিজেও একজন গোয়েন্দা বলে হোক, অথবা গুণী লোকদের কদর করার সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই হোক, ব্লড ব্যাবোর সাথে পরিচিত হবার ইচ্ছে রানার অনেক দিন থেকেই। কিন্তু সময় এবং সুযোগ না পাওয়ায় ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেছে।
আরও কিছুদিন অপূর্ণ থাকবে, কাগজটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে ভাবল রানা। পরমুহূর্তে ক্লড র্যাঁবোর কথা ভুলে গেল। যদি জানত অচিরেই এই প্রতিভাবান গৌয়েন্দাপ্রবরই ওর চরম শত্রু হয়ে দেখা দেবেন, এত তাড়াতাড়ি তাঁর কথা ভুলত না ও।
লন্ডন এয়ারপোর্টে দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণ শুরু করার আগেই একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে রানা। তা হলো, অভিযানে সে একটা জাল পরিচয় ব্যবহার করবে। বৃটেনে জাল পাসপোর্ট সংগ্রহ করা কিছু সময় সাপেক্ষ হলেও, অসম্ভব নয়। অনায়াসে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরোবার জন্যে মার্সেনারি, স্মাগলার এবং সন্ত্রাসবাদীরা যে পদ্ধতিতে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে থাকে, সে-ও সেই পদ্ধতির শরণাপন্ন হলো 1
গ্লাসের হুইস্কিটুকু এক ঢোকে শেষ করে উঠে পড়ল রানা। বাড়িতে তালা লাগিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও। টেমস ভ্যালির হোম কাউন্টির ভিতর ঢুকে ছোট ছোট অনেকগুলো গ্রামে গেল। এইসব গ্রামগুলো একটার কাছ থেকে আরেকটা অনেক দূরে। প্রত্যেকটি স্বনির্ভর, স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম। প্রতিটি গ্রামেরই নিজস্ব সমাধিক্ষেত্র আছে। কয়েকটি সমাধিক্ষেত্র থেকে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বেরিয়ে এল ও। অবশেষ সপ্তম সমাধিক্ষেত্রে কবরের উপর শ্বেত-পাথরের একটা ফলক দেখে খুশি হয়ে উঠল মনটা। ফলকের উপর লেখা রয়েছে আলেকজান্ডার অরগ্যান, উনিশশো বিয়াল্লিশ সালে আড়াই বছর বয়সে মারা গেছে। সমাধিক্ষেত্রে গির্জার একজন ভাতা-ভোগী প্রতিনিধি থাকে, তার কাজ কাদেরকে কবর দেয়া হয় তাদের পরিচয় ইত্যাদি সংগ্রহ করে রাখা এবং সমাধিক্ষেত্রের উপযুক্ত ধর্মীয় রীতি পালনে সহায়তা করা। এদেরকে ভিকার বলা হয়। গ্রামেই তার বাড়ি এবং বাড়ির সাথে অফিস। লোকটা বৃদ্ধ এবং পরোপকারী। তাকে রানা জানাল যে সে একজন সৌখিন জেনিয়্যালজিস্ট, অরগ্যান পরিবারের বংশানুক্রম আবিষ্কারের ইচ্ছা নিয়ে এখানে এসেছে। নানান সূত্রে সে জানতে পেরেছে এই গ্রামে অনেক বছর আগে একটা অরগ্যান ফ্যামিলি আস্তানা গেড়েছিল। শ্রদ্ধেয় ভিকারের কাছে জানতে চায় তার অনুসন্ধানে সাহায্য করার মত কোন তথ্য রেকর্ডে লিপিবদ্ধ আছে কিনা।
পরিবেশটাকে আরও খানিক নিজের অনুকূলে আনার জন্যে সমাধিক্ষেত্রের উন্নতির জন্যে চাঁদা সংগ্রহের বাক্সে উদার হস্তে কিছু দান করল রানা। দাঁতহীন মাড়ি বের করে এক গাল হাসল বৃদ্ধ। পুরানো ফাইল ঘেঁটে বের করে রানাকে জানাল আলেকজান্ডার অরগ্যানের মা এবং বাবা দু’জনেই সাত বছর আগে পরলোক গমন করেছে। তাদের একমাত্র সন্তান ছিল আলেকজান্ডার অরগ্যান। ফাইল চেয়ে নিয়ে ম্লান মুখে অলস ভঙ্গিতে পাতা উল্টে দেখছে রানা। বকর বকর করে যাচ্ছে বৃদ্ধ। আজকাল আগের মত ধর্ম সম্পর্কে কাউকে কাতর হতে দেখা যায় না, ইত্যাদি উনিশশো চল্লিশ সালে জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যুর খতিয়ানের উপর চোখ বুলাচ্ছে রানা। এপ্রিল মাসের ছকের ভিতর অরগ্যান নামটা চোখে পড়ল। পুরো বাক্যটা ঝরঝরে হস্তাক্ষরে এইভাবে লেখা : আলেকজান্ডার জেমস কোয়েনটিন অরগ্যান, জন্ম তেসরা এপ্রিল, উনিশশো চল্লিশ সালে, স্যামবোর্ন ফিশলের সেন্ট মার্কের একটা বাড়িতে।
কাগজ কলম বের করে সমস্ত তথ্য টুকে নিল রানা। তারপর বৃদ্ধকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিল।
লন্ডনে ফিরে এসে জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যু সম্পর্কিত সেন্ট্রাল রেজিস্ট্রি অফিসে হাজির হলো রানা। একজন সহকারী করণিক ওর দেয়া ভিজিটিং কার্ডে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি আমি?’
ভিজিটিং কার্ডে রানার পরিচয় হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, সোর্প-শায়ার, মার্কেট ড্রাইটন-এর একটা সলিসিটরস্ ফার্মের একজন পার্টনার সে। করণিকের প্রশ্নের উত্তরে ব্যাখ্যা করে বলল, ওর ফার্মের একজন মহিলা মক্কেলের নাতি-নাতনীদেরকে খুঁজে বের করতে চাইছে সে। মক্কেল সম্প্রতি মারা গেছে এবং তার যাবতীয় স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তি সব এই নাতি-নাতনীদেরকে উইল করে দিয়ে গেছে। নাতিদের মধ্যে একজন হলো আলেকজান্ডার জেমস কোয়েনটিন অরগ্যান, জন্ম স্যামবোর্ন ফিশলের সেন্ট মার্কে, তেসরা এপ্রিল, উনিশশো চল্লিশ সালে।
পুরানো রেকর্ড-পত্র ঘেঁটে করণিক জানাল অরগ্যান বেঁচে নেই; উনিশশো বিয়াল্লিশ সালের আটই নভেম্বর এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কয়েকটা শিলিং জমা দিয়ে অরগ্যানের বার্থ এবং ডেথ সার্টিফিকেট দুটো হস্তগত করল রানা। তারপর বিদায় নিল।
বাড়ি ফেরার পথে কয়েক জায়গায় থামল রানা। শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটা শাখা অফিস থেকে পাসপোর্টের জন্যে একটা অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম নিল। খেলনার দোকান থেকে পনেরো শিলিং দিয়ে কিনল বাচ্চাদের একটা প্রিন্টিং সেট। পোস্ট-অফিস থেকে কিনল এক পাউন্ডের একটা পোস্টাল অর্ডার।
বাড়িতে ফিরে এসে অরগ্যানের নামে ফিল-আপ করল অ্যাপ্লিকেশন ফর্মটা সঠিক বয়স, জন্ম তারিখ ইত্যাদি সব দিল, কিন্তু চেহারার বর্ণনা দিল নিজের। নিজের উচ্চতা, চুল এবং চোখের রঙ লিখল, পেশার ঘরে লিখল : ব্যবসায়ী। ফর্মে অরগ্যানের বার্থ-সার্টিফিকেট থেকে পাওয়া তার মা-বাবার পুরো নাম লিপিবদ্ধ করল। উল্লিখিত সমস্ত তথ্য যাচাই করার জন্যে সাহায্য পাওয়া যাবে এমন একজনের নাম হিসেবে লিখল রেভারেন্ড জেমস বোল্ডারলি, স্যামবোর্ন ফিশলে, সেন্ট মার্কের ভিকার। বৃদ্ধের পুরো নামটা রানা আজ সকালে চার্চের গেটের নেমপ্লেট থেকে টুকে এনেছে। ভিকারের স্বাক্ষর জাল করল ও মোটা নিবের সাহায্যে। ঘন কালি দিয়ে প্রিন্টিং সেটের সাহায্যে একটা স্ট্যাম্প তৈরি করে স্বাক্ষরের পাশে ছাপ মারল ও St. Marks Par।s Church Sambourne F।shley.
পেটি ফ্রান্সের পাসপোর্ট অফিসে বার্থ-সার্টিফিকেট এবং পোস্টাল-অর্ডারসহ অ্যাপ্লিকেশন ফর্মটা ডাকযোগে পাঠিয়ে দিল ও। ডেথ-সার্টিফিকেটটা পুড়িয়ে ফেলল। প্যাডিংটনের আরেক ঠিকানায় ডাকযোগে আনকোরা নতুন পাসপোর্টটা এসে পৌঁছল চারদিন পর, তখন সকাল, দৈনিক লে ফিগারোর প্রভাত সংস্করণের উপর চোখ বুলাচ্ছিল রানা। লাঞ্চের আগে পাসপোর্টটা সংগ্রহ করল ও।
লাঞ্চের পর বিছানায় একটু গড়িয়ে নি রানা, তারপর পোশাক পরে বাড়িতে তালা লাগাল, স্পোর্টস কার হাঁকিয়ে পৌছল লন্ডন এয়ারপোর্টে, উঠে বসল কোপেনহেগেনগামী ফ্লাইটে। চেক-বই ব্যবহার না করে নগদ টাকা দিয়ে টিকিট কিনল ও। ওর সুটকেসের তলার নিচে আরেক তলা আছে, সাধারণ আকারের একটা পত্রিকা অনায়াসে ঢুকিয়ে দেয়া যায় ভিতরে, মরিয়া হয়ে না খুঁজলে সেটার অস্তিত্ব টের পাবে না কেউ—সেখানে ঠাসা আছে দু’হাজার পাউন্ড। আজ সকালে হলবর্ণের একটা সলিসিটর ফার্মের নিরাপদ ভল্টে ওর প্রাইভেট ডিড-বক্স থেকে এই টাকাটা তুলেছে ও।
সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে কোপেনহেগেন পৌছে খুব ব্যস্ততার মধ্যে সময়টা কাটল রানার। ক্যাস্ট্রাপ এয়ারপোর্টে নেমেই পরবর্তী বিকেলের ব্রাসেলসগামী সাবেনা ফ্লাইটের একটা টিকিট বুক করল ও। ডেনিশ রাজধানীতে কেনাকাটার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, তাই ট্যাক্সি নিয়ে সরাসরি পৌঁছল কংস নাই টর্ভে হোটেল ডি অ্যাঙ্গলেটেরে।
কাপড়চোপড় খুলে বাথরুমে ঢুকল রানা। ঝর্নার ঝির ঝির মৃদু ঝঙ্কারের সাথে গুনগুন করছে ও, শরীর জুড়িয়ে দিয়ে নামছে শীতল বারিধারা—আহ্ কি শান্তি!
কমপ্লিট স্যুট পরে, দামী সেন্ট মেখে হোটেল থেকে বেরোল ও। গটমট করে ঢুকল প্রখ্যাত অভিজাত রেস্তোরাঁ সেভেন নেশনসে, প্রচুর সময় ব্যয় করে সেরে নিল রাজকীয় ডিনার। দামী চুরুট ধরিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে ঢুকল ধীর পদক্ষেপে টিভোলি বাগানে, স্বর্ণকেশী দুই ডেনিশ যুবতীর সাথে হালকা রসিকতা করল কয়েক মিনিট, তারপর হোটেলে ফিরে এসে বিছানায় উঠল রাত একটায়।
পরদিন সেন্ট্রাল কোপেনহেগেনের নামকরা এক দোকান থেকে একটা লাইট ওয়েট ক্ল্যারিক্যাল গ্রে স্যুট, একজোড়া সোবার ব্ল্যাক ওয়াকিং শু, একজোড়া মোজা, এক সেট আন্ডারঅয়্যার এবং কলার লাগানো তিনটে সাদা শার্ট কিনল রানা। প্রতিটি জিনিসে ডেনিশ প্রস্তুতকারকের নাম লেখা লেবেল আছে দেখে নিয়ে তবে কিনেছে ও। সাদা শার্ট তিনটে দরকার নেই। তবু কিনতে হলো ওগুলো থেকে লেবেল খুলে লন্ডনে কেনা ক্ল্যারিক্যাল শার্ট, ডগ কলার আর বিবে লাগাতে হবে বলে।
সবশেষে কিনল ফ্রান্সের উল্লেখযোগ্য সমস্ত চার্চ আর গির্জার পরিচিতি দেয়া আছে ডেনিশ ভাষায় লেখা এমন একটা বই। টিভোলি বাগানে, লেকের ধারে নিরিবিলি এক রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ সারল ও। তারপর তিনটে পনেরো মিনিটের ফ্লাইট ধরে উড়াল দিল ব্রাসেলস-এর দিকে।