দুই
২৫ আগস্ট। সকাল দশটা।
ঢাকা। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স। সাততলায় মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের চেম্বার। টপ সিক্রেট মীটিং চলছে!
বংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের ইতিহাসে আজকের এই মীটিংটা নানা দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। সাধারণত চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে মীটিং কল করে সোহেল, কিন্তু আজকের এই মীটিং ডেকেছেন স্বয়ং চীফ মেজর জেনারেল রাহাত খান। প্রতিষ্ঠানের সমস্ত হাই অফিশিয়ালরা এতে অংশ গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে রয়েছে, অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং আমেরিকার অপারেশন্যাল চীফ জাহেদ, ইউরোপের অপারেশন্যাল চীফ সলিল, হেডকোয়ার্টারের স্পেশাল এজেন্টদের চীফ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অপারেশন্যাল চীফ সোহানা, এবং বিভিন্ন এলাকার দুই অপারেশন্যাল চীফ হাসান এবং তিমির। এছাড়া রয়েছে চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সোহেল এবং মেজর জেনারেল রাহাত খানের বিশেষ আমন্ত্রণে বিভিন্ন বিষয়ের ছ’জন বিশেষজ্ঞ। এদের সাথে রয়েছে প্রতিষ্ঠানের বাছাই করা প্রতিভাবান বারোজন স্পেশাল এজেন্ট: রূপা, পাশা, শাহেদ, জিয়া, শান্তি, শিউলী, রাশেদ, তারেক, শহিদ, মামুন, প্যাটেল এবং পারভিন।
আজকের এই টপ সিক্রেট মীটিংয়ের আলোচ্য বিষয়: মাসুদ রানার নিরাপত্তা এবং ইউনিয়ন কর্স।
হাই অফিশিয়ালদের সাথে এক সারিতে সোহানা এবং সোহেলের মাঝখানে বসে আছে রানা।
কাগজ নাড়াচাড়ার খসখসে আওয়াজ হচ্ছে কামরার ভিতর। এইমাত্র চীফের প্রাইভেট সেক্রেটারি ইলোরা প্রত্যেককে একটা করে ফাইল পড়তে দিয়েছে। প্রতিটি ফাইলের উপর লেখা: চীফ অভ ইউনিয়ন কর্স: কাপু উ সেন।
একটা ফাইল খোলা অবস্থায় মেজর জেনারেলের সামনেও রয়েছে। কিন্তু সেটা তিনি পড়ছেন না। তাঁর ডান পাশে বসা কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত একজন বিশেষজ্ঞের সাথে নিচু গলায় কথা বলছেন তিনি। আসলে কথা বলছেন বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোক, মেজর জেনারেল শুনছেন এবং কদাচ উপর-নিচে মাথা নাড়ছেন।
ফাইল খুলে কামরার বাকি সবাই পড়ছে বা পড়ার ভান করছে। উপস্থিত অনেকেরই আগেই পড়া আছে কাপু উ সেনের ফাইল।
ফাইলে সম্ভাব্য সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য ঢোকানো আছে। সেগুলো এভাবে সাজানো হয়েছে:
উ সেন
জন্মস্থান: তৎকালীন ফ্রেঞ্চ উপনিবেশ ভিয়েতনাম।
জন্ম তারিখ: উনিশশো তেইশ সাল, ১ জানুয়ারি। বৈবাহিক অবস্থা: চিরকুমার।
জাতীয়তা: : ফ্রেঞ্চ। তবে নকল নামে মার্কিন এবং অন্য কয়েকটি দেশেরও নাগরিক।
মাতা-পিতা: মা ভিয়েতনামী, বাবা ফ্রেঞ্চ—একজন কর্সিকান (ইউনিয়ন কর্সের আঞ্চলিক শাখা-প্রধান পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত)।
চেহারার বর্ণনা: সাড়ে ছয় ফিট লম্বা। সরু কোমর। মস্ত কাঁধ, কিন্তু আড়ষ্ট। পিঠটা খাড়া। চেহারায় বয়সের ছাপ নেই। প্রকাণ্ড মাথায় ঘন পাকা এলোমেলো চুল।
শারীরিক ত্রুটি: দুই চোখই অন্ধ। চোখে অত্যন্ত গাঢ় সবুজ রঙের সানগ্লাস, হ্যান্ডেল থেকে একটা সরু তার বেরিয়ে থাকে, সেটা কোট বা শার্টের
বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। অন্ধ হলেও লাঠি ব্যবহার করে না বা দু’হাত সামনে বাড়িয়ে ঠাহর করার চেষ্টা করে না। অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে স্বাভাবিক মানুষের মতই সাবলীল ভঙ্গিতে চলাফেরা করতে পারে। একটা প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে চোখ দুটো হারাবার পর থেকে গাঢ় সবুজ রঙের চশমাটা ব্যবহার করছে সে। ওটা দিয়ে দেখতে পায় না, কিন্তু বাদুড়ের মত শুনতে পায়। চশমাটা আসলে একটা সাউন্ড ট্র্যান্সমিটার যন্ত্র। এর মেকানিজম অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল। রেঞ্জ আশপাশের দশ গজ পর্যন্ত। দশ গজের মধ্যেকার প্রত্যেকটা জিনিস থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে বীমগুলো ফিরে আসে তার বাম কানের পাশে বসানো একটা রিসিভারে। রিসিভারটা আবার সরু তার দিয়ে যুক্ত করা আছে তার পকেটে রাখা একটা মিনিয়েচার অ্যাম্পলিফায়ারের সাথে। সব বস্তুর ঘনত্ব সমান নয়, তাই দেয়াল, চেয়ার, টেবিল, কাঁচ, তরল পদার্থ, মানুষ—প্রত্যেকটা জিনিস আলাদা আলাদাভাবে চিনতে কোন অসুবিধে হয় না তার। যে কোন অভিজ্ঞ ড্রাইভারের মত যানবাহনে ঠাসা প্যারিসের রাস্তায় ফুল স্পীডে গাড়িও চালাতে পারে সে। চক্ষুষ্মান মানুষের চেয়ে কিছু বেশি সুবিধে পাচ্ছে সে। চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার শ্রবণশক্তি বেড়ে গেছে চারগুণ। তাছাড়া, তার কাছে রাত্রি বা অন্ধকার বলে কিছু নেই। রাতের ঘন অন্ধকারেও কে কোথায়, বা কি কোথায় আছে সব পরিষ্কার টের পায় সে। এ ধরনের আরও অনেক সুবিধে ভোগ করে।
কাঁধ দুটো আড়ষ্ট এবং পিঠটা খাড়া হওয়ার কারণ: অডন্টয়েড প্রসেসকে প্রোটেকশন দেয়ার জন্যে মাথার পিছন দিকে চামড়ার নিচে স্টীল প্লেট আছে।
শিক্ষা জীবন: ইউরোপে লেখাপড়া শিখেছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী নিয়ে ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়।
কর্মজীবন: সেনাবাহিনীতে থাকতেই বাপের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইউনিয়ন কর্সে যোগ দেয়। কাপু অর্থাৎ ইউনিয়ন কর্সের চীফ হবার সাধ পূরণ না হওয়ায় বাপ চেয়েছিল ছেলে যেন একদিন কাপু হতে পারে, বাপের এই ইচ্ছা পূরণ করার যোগ্যতা এবং উদ্যম দুই-ই ছিল উঁ সেনের মধ্যে। তাই ইউনিয়ন কর্সের তৎকালীন কাপুর নির্দেশ পাওয়া মাত্র সেনাবাহিনী থেকে কর্নেল পদমর্যাদা ত্যাগ করে দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার ইউনিয়ন কর্সের শাখা প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে ফ্রান্স ত্যাগ করে সে।
একটানা দীর্ঘ দশ বছর ধরে বার্মা, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং হংকঙে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে উ সেন। আনুমানিক হিসেবে জানা যায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর প্রায় তেরো হাজার লোককে এই দশ বছরে খুন করেছে সে। তার আমলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন গুপ্ত সংগঠন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। উ সেনের নেতৃত্বে দশ বছরে এই এলাকা থেকে ইউনিয়ন কর্স আয় করে কয়েক হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ড্রাগস, মেশিনারী, সোনা, জুয়েলারী এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন—প্রধানত এই সব জিনিস স্মাগল করত উ সেন। ব্যবসায় সুবিধের জন্যে সে একটা সমুদ্রগামী জাহাজের বহর গঠন করেছিল। এই সময় কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করেনি যে উ সেন ইউনিয়ন কর্সের প্রতিনিধিত্ব করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার অভূতপূর্ব সাফল্য দেখে তৎকালীন কাপু প্যারিস থেকে অভিনন্দন বাণী পাঠায় এবং ইউরোপ ও আমেরিকা জয় করার জন্যে তার ঘাড়ে নতুন দায়িত্ব চাপায়।
ইউরোপে মাত্র দু’বছর ছিল উ সেন। এই স্বল্প সময়েই প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সবগুলো মাথাকে গুঁড়ো করে দেয় সে, এবং ড্রাগ ও সোনা স্মাগলের ব্যবসায় ইউনিয়ন কর্সের একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে। এরপর তাকে আরও গুরু দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় আমেরিকার বেআইনী ব্যবসার বাজার দখল করতে।
জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয় উ সেন এই আমেরিকাতে। শক্তিমদমত্ত ইটালীর সিসিলীয় পরিবারগুলোর সংস্থা Un।one S।c।l।ano অর্থাৎ বিশ্ব-কুখ্যাত মাফিয়ার অপারেশন্যাল হেডকোয়ার্টার এই আমেরিকাতেই। উ সেন আমেরিকায় পা দিতে না দিতেই মাফিয়া পরিবারগুলোর সাথে সরাসরি রক্তক্ষয়ী সংঘাত বেধে যায় ইউনিয়ন কর্সের। উ সেন টিকতে পারবে তা ভুলেও আশা করেনি কেউ। কিন্তু মাত্র শ’দুয়েক লোক নিয়ে প্রচণ্ড সাইক্লোনের মত মাফিয়া পরিবারগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। কল্পনাতীত ধূর্ততা ও নিখুঁত পরিকল্পনার সাহায্যে অল্প সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার মাফিয়া সদস্যকে বেমালুম গায়েব করে ফেলে সে। জানা যায়, তার নিজের দুশো লোককে সে কোন বিপজ্জনক কাজের ঝুঁকি নিতেই দেয়নি। আসলে আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়ার বিরোধী গ্রুপগুলোকে একত্রিত করে মাফিয়ার বিরুদ্ধে সামগ্রিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে উসকে দেয় উ সেন, এবং নেপথ্যে থেকে আশ্চর্য দক্ষতার সাথে তাদেরকে মাফিয়াদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করে।
অপ্রত্যাশিত বিপদ দেখে হকচকিয়ে যায় মাফিয়া পরিবারগুলো। হামলার প্রথম দফাতেই তাদের অকল্পনীয় ক্ষতি হয়ে গেছে, যা কোন দিন পূরণ হবার নয়। ঠিক এই সময় আসে উ সেনের সন্ধি প্রস্তাব।
উ সেন সব ক’টা মাফিয়া পরিবারকে আলোচনা বৈঠকে বসতে বাধ্য করে। তার প্রস্তাবের বিরোধিতা করার মত ক্ষমতাধর কেউ তখন বেঁচে নেই, প্রায় সব ক’টা পরিবারের ডন এবং ক্যাপরেজিমিদেরকে আগেই খতম করে ফেলেছে সে। বৈঠকে আমেরিকায় ইউনিয়ন কর্সের ব্যবসাগত অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে মাফিয়া এবং ইউনিয়ন কর্সের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন সমাধা হয়।
এই সময়েই ইউনিয়ন কর্সের হেডকোয়ার্টারে উ সেনকে নিয়ে ব্যাপক জল্পনা- কল্পনা শুরু হয়। মাফিয়ার সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের খবর প্যারিসে পৌঁছতেই পরবর্তী কাপু হিসেবে উ সেনের পদোন্নতি একরকম নিশ্চিত হয়ে ওঠে।
পরের বছর অভিষেক অনুষ্ঠানে ইউনিয়ন কর্সের পরিচালকমণ্ডলীর সর্বসম্মতি- ক্রমে উ সেন কাপু নির্বাচিত হয়। পরিচালকমণ্ডলীর সবার অনুকূল রায় পেয়ে কাপু নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য শত বছরের ইতিহাসে আর কারও হয়নি, একমাত্র ব্যতিক্রম উ সেন।
মাসুদ রানার সাথে উ সেনের বিরোধ: উ সেন তখন বার্মায় ইউনিয়ন কর্সের শাখা-প্রধান। পাকিস্তানের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা পেয়ে মুসলিম গেরিলা ফৌজে’র অস্ত্রশস্ত্র, রসদ এবং যোদ্ধা সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিল সে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের বিরুদ্ধে এটা ছিল একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার জন্যে বার্মায় পাঠানো হয় রানাকে। ঘটনার নানান ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে ষড়যন্ত্রটাকে ব্যর্থ করে দেয় রানা। আহত উ সেন রানাকে সাবধান করে দিয়ে এই কথা ক’টি বলে :
‘মাসুদ রানা, তুমি মস্ত ক্ষতি করলে আমার। পৃথিবীর যেখানেই থাকো, যত সাবধানেই থাকো, বাঁচতে পারবে না তুমি আমার হাত থেকে। প্রস্তুত থেকো, আজ হোক, কাল হোক, দশ বছর পর হোক—প্রতিশোধ নেব আমি।
ইউনিয়ন কর্স: ফ্রান্সের একটা দ্বীপ কর্সিকা বা কর্স, এই দ্বীপের অধিবাসীদের নিয়ে গঠিত গুপ্ত সংগঠনের নাম ইউনিয়ন কর্স। এই সংগঠনের জন্ম কবে তা সঠিক জানা নেই কারও। তবে অপরাধ জগতের ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা বয়সের দিক থেকে মাফিয়ার চেয়ে ইউনিয়ন কর্স অনেক প্রাচীন।
উ সেনের নেতৃত্বে ইউনিয়ন কর্স: বর্তমান কাপু সিংহাসনে বসার পর তিন বছর গত হতে চলেছে। এই তিন বছরে সংগঠনকে সে এগিয়ে নিয়ে গেছে বিশ বছর। দলের অভ্যন্তরে গত দশ বছর ধরে দানা বেঁধেছিল কোন্দল, উ সেন তার ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে সমস্ত কোন্দলের সুষম মীমাংসা করে দলটাকে শতধা বিভক্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে। তার সাংগঠনিক প্রতিভার তুলনা হয় না। প্যারিসে ইউনিয়ন কর্সের নামে মাত্র এক লাখ সদস্য ছিল, সঠিক নেতৃত্বের অভাবে এদেরকে কাজে লাগানো যায়নি। উ সেন কাপু হবার পর এদের সংখ্যা দ্বিগুণে উন্নীত করে এবং এলাকা ভাগ করে দিয়ে প্রতি দশ হাজার সদস্যের জন্য একজন করে লীডার নিযুক্ত করে। এই দুই লক্ষ সদস্যের বেশির ভাগই পুলিস, মিলিটারি অথবা কাস্টমসে চাকরি করে। ফ্রেঞ্চ পুলিস বাহিনীতে কর্সিকান অর্থাৎ ইউনিয়ন কর্সের সদস্যরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। একই অবস্থা সেনাবাহিনীতেও।
কাপু হিসেবে উ সেনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন এদিকটায় ইউনিয়ন কর্ম দুর্বল ছিল। উ সেন অত্যন্ত কৌশলে সংগঠনের লোকদের সরকারী প্রশাসনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অনুমান করা হয় মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন দফতরের সেক্রেটারি, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকর্তা পর্যায়ে ইউনিয়ন কর্সের নিজস্ব লোক রয়েছে। ফ্রান্সের দূত হিসেবে বিদেশে যারা রয়েছে তাদের মধ্যেও একটি বড় সংখ্যা উ সেনের লোক। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সবচেয়ে শক্তিশালী গুপ্ত দল বলতে এখন ইউনিয়ন কর্মকেই বোঝায়। মাফিয়া পরিবারগুলোর সম্মিলিত শক্তির চেয়েও এই সংগঠনের শক্তি বেশি। বিশ্বের সর্বত্র মাফিয়া এখন ইউনিয়ন কর্সের সাথে ক্ষমতা ভাগ করে নিয়েছে। তাদের একচেটিয়া প্রতিপত্তি কোথাও নেই আর।
কাপু উ সেনের ক্ষমতা সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলার উপায় নেই। কারও কারও মতে স্বদেশে সে তাদের প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান। সরকার উৎখাতের কোন চেষ্টা এখন পর্যন্ত সে করেনি, করার দরকারও নেই, কেননা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট না হওয়া সত্ত্বেও যে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করছে সে প্রয়োজনের তুলনায় তাই যথেষ্ট। তবে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করলে তার সফল হবার সম্ভাবনাই বেশি।
‘বাংলাদেশে ইউনিয়ন কর্সের তৎপরতা: তৎপরতা আছে বলে আজ পর্যন্ত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
.
প্রায় একই সময় পড়া শেষ করে যার যার ফাইল বন্ধ করে নড়েচড়ে বসল সবাই, মুখ তুলে তাকাল চীফের দিকে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে বসা সোহেলের দিকে তাকালেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। নিভে যাওয়া পাইপটা তার কপালের দিকে তুলে বললেন, তুমি বলো, সমস্যার সমাধান কিভাবে হতে পারে।’
তৈরি হয়েই ছিল সোহেল। মৃদু কণ্ঠে নিজের ধারণা প্রকাশ করল, ‘স্যার, আমার ধারণা, সরকারীভাবে এ ব্যাপারে কিছু করার নেই। আমরা ফ্রান্স সরকারকে ব্যাপারটা জানাতে পারি, কিন্তু তাতে কোন ফল হবে না। ফ্রান্স সরকারের সমস্ত দফতরের হোমরাচোমরাদের মধ্যে উ সেনের লোক আছে। তারা ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেবে না, ধামাচাপা দিয়ে রাখবে। আমি মনে করি সমস্যার একমাত্র সমাধান উ সেনের মৃত্যুর মধ্যে নিহিত। লোকটা যদ্দিন বেঁচে থাকবে, রানার বিপদ কাটবে না। উ সেনকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দেয়া বি.সি.আই- এর পক্ষে সম্ভব। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবার আগে গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক দিক ভেবে দেখতে হবে আমাদেরকে।’
‘যেমন?’ রাহাত খান পাইপে অগ্নিসংযোগ করছেন।
লোকটাকে নিশ্চিহ্ন করতে কম করেও তিন মাস সময় লাগবে আমাদের, ‘ অত্যন্ত সাবধানে, ভেবেচিন্তে কথা বলছে সোহেল। ‘এই তিনমাসের বেশিরভাগটাই ব্যয় হবে প্ল্যান পরিকল্পনায়। একাজে প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব যোগ্য লোককে দায়িত্ব নিতে হবে। অর্থাৎ অন্তত তিন মাস বি.সি.আইকে খুঁড়িয়ে চলতে হবে।
মেজর জেনারেল রাহাত খান জাহেদের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন। ‘রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে কিছু করা যায় কিনা… চীফকে এদিক ওদিক মাথা নাড়তে দেখে মাঝ পথে চুপ করে গেল জাহেদ।
‘আমাদের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের মতে,’ রাহাত খান বললেন, ‘তা সম্ভব নয়।‘
‘সেক্ষেত্রে, দায়িত্বটা বি.সি.আই-এর নেয়া উচিত,’ বলল জাহেদ। ‘আমারও বিশ্বাস এই সঙ্কট থেকে রানাকে উদ্ধার করার একমাত্র উপায় উ সেনকে সরিয়ে দেয়া।’
‘তুমি?’ সোহানার দিকে তাকালেন রাহাত খান
‘সমস্যার একমাত্র সমাধান সম্পর্কে সোহেল এবং জাহেদ যা বলল তার সাথে আমি একমত,’ মৃদু কণ্ঠে বলল সোহানা, পরমুহূর্তে তার কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল
দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সুর। ‘কিন্তু, স্যার, বি.সি.আই-কে সব কাজ ফেলে দিয়ে উ সেনের পিছনে লাগতে হবে, এ ধারণা আমি সমর্থন করি না। বারোজন স্পেশাল এজেন্টের দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মী হিসেবে আমি বলতে পারি, ওদের সাহায্যে উ সেনকে সরিয়ে দিতে দুই মাসের বেশি লাগবে না আমার।’
রাহাত খানের মুখ দেখে কিছুই বোঝা গেল না, তিনি নিঃশব্দে বি.সি.আই-এর ইউরোপ এলাকার অপারেশন্যান চীফ সলিল সেনের দিকে তাকালেন।
সলিল সাথে সাথে বলল, ‘আমার একটা প্রস্তাব আছে, স্যার। সকলের সাথে সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে একমত হয়ে বলছি, রানার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রটা পরিচালিত হচ্ছে ইউরোপ অর্থাৎ আমার এলাকা থেকে, তাই সমস্ত দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। সোহানার সাহায্য নেব আমি, সময় নেব ওই দু’মাস।’
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এলাকার অপারেশন্যাল চীফের দিকে তাকালেন রাহাত খান। তিমির বলল, ‘মরণ বাড় বেড়েছে উ সেন। কিন্তু আস্তানা থেকে ওকে বের করা মুশকিল। ধৈর্য ধরে মাস কয়েক অপেক্ষা করলে হয়তো বাগে পাওয়া যাবে। ওকে বাইরে পেলে প্রথম সুযোগেই আমার গ্রুপ ধ্বংস করতে পারবে, একথা জোর দিয়ে বলতে পারি।’
হাসান বলল, ‘দু’মাস সময় পেলে আমিও পারব।’
‘রানা?’ রাহাত খান বললেন।
খাড়া পিঠের চেয়ারে যেমন বসে ছিল, তেমনি বসে রইল রানা, এক চুল নড়ল না। আমার ওপর উ সেনের এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আক্রোশ,’ মৃদু কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল রানা। ‘এর সাথে আমি বি.সি.আই-কে জড়াতে চাই না।’
রানার কথা শেষ হতেই কামরার চারদিক থেকে বিস্ময় মেশানো প্রতিবাদের গুঞ্জন ধ্বনি উঠল।
বুঝতে ভুল করছিস তুই,’ অধৈর্যের সাথে বলন সোহেল, ‘বি.সি.আই-এর একজন সদস্যের বিরুদ্ধে লাগা মানে বি.সি.আই-এর বিরুদ্ধে লাগা….
গুঞ্জনের মধ্যে সলিনেরও কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘উ সেন তার ইউনিয়ন কর্সের সমস্ত শক্তি নিয়ে তোর পিছনে লেগেছে, এ থেকেই প্রমাণ হয় শুধু তোকে নয়, বি.সি.আইকেও চ্যালেঞ্জ করছে সে।’
আর ব্যক্তিগত আক্রোশ হলেই বা কি,’ বলে উঠল সোহানা, ‘শয়তানটাকে শায়েস্তা করার জন্যে আমাদের সবাইকে উঠে পড়ে লাগতে হবে, তা নাহলে ….
‘ওর বোধহয় আরও কিছু বলার আছে।’
রাহাত খানের গলা শুনে সাথে সাথে নিস্তব্ধতা নেমে এল কামরার ভিতর রানার দিকে তাকিয়ে সবাই সজাগ হয়ে উঠল
মৃদু একটু হাসল রানা। তারপর বলল, ‘আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে সবাইকে উদ্বিগ্ন দেখে গর্ব ও কৃতজ্ঞ বোধ করছি। ধন্যবাদ।’ একটু বিরতি নিল ও!
রাগে মুখটা লাল হয়ে উঠেছে সোহেলের। নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভাবছে সে, সাংঘাতিক কোন ঝুঁকি নেবার মতলব এঁটেছে শালা। নিজের ঘাড়ে সমস্ত বিপদ তুলে নেবার সর্বনেশে প্রবণতাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে আবার। কি যেন ভেবে শিউরে উঠল সোহেল। ভাবল, যেভাবেই হোক, ঠেকাতে হবে রানাকে। অন্তত উ সেনের ব্যাপারে কোনরকম ঝুঁকি নিতে দেয়া যাবে না ওকে।
‘আবার বলছি আমি, আমার ওপর এটা উ সেনের ব্যক্তিগত আক্রোশ,’ বলল রানা। আমার এই কথার স্বপক্ষে প্রমাণও আছে।’
‘প্রমাণ আছে?’ ভুরু কুঁচকে উঠল সোহেলের।
আছে,’ বলল রানা। আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে সে পাঁচবার। প্রতিবারই ছুটিতে থাকার সময় আক্রান্ত হয়েছি আমি। প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পরে বি.সি.আই-এর কাজ নিয়ে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, সিসিলি এবং প্যারিসে গেছি আমি, এসব জায়গায় ইউনিয়ন কর্সের শক্তিশালী আস্তানা রয়েছে, অথচ সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও ওরা আমার ওপর হামলা করেনি। কিন্তু যেই কাজ শেষ করে ছুটি নিয়েছি, অমনি আক্রমণ এসেছে। এ থেকে কি প্রমাণ হয়?’
রানার অকাট্য যুক্তি খণ্ডন করতে না পেরে মাথা ঝাঁকিয়ে সোহেল বলল, ‘ঠিক আছে, না হয় তোর ওপর উ সেনের এটা ব্যক্তিগত আক্রোশই, কিন্তু তাই বলে বি.সি.আই. তোকে কোনরকম সাহায্য করতে পারবে না, একথা ভাবছিস কেন?’
আবার মৃদু হাসল রানা। বলল, ‘এই ভাবনার পক্ষেও যুক্তি আছে আমার।’
চ্যালেঞ্জের সুরে সোহেল বলল, ‘কি যুক্তি বল্!’
আপন মনে পাইপ টানছেন রাহাত খান। চিন্তিতভাবে তাকিয়ে আছেন সিলিঙের দিকে। কিন্তু কান দুটো সজাগ, কে কি বলছে শুনছেন তিনি।
‘সবার কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, সমস্যাটার সমাধান করতে বি.সি.আই-এর কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে,’ মুচকি হাসি ফুটল রানার ঠোঁটের কোণে। দুঃখের বিষয়, এত সময় উ সেন আমাকে দিচ্ছে না।
‘মানে? পরিষ্কার করে …’
আগামী অক্টোবরের পঁচিশ তারিখে ইউনিয়ন কর্স তার নতুন কাপু নির্বাচন করবে,’ বলল রানা। ‘এবারও হয়তো উ সেন আগামী তিন বছরের জন্যে নির্বাচিত হবে। কিন্তু কাপু নির্বাচনের আগে যে রকম খুনোখুনি হয় প্রতিবার, এবারও তাই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কে বাঁচবে, কে মরবে কেউ বলতে পারে না আগে থেকে। তাই মেয়াদ শেষ হবার আগে কি কি কাজ সারতে হবে তার একটা তালিকা সে বহু আগেই তৈরি করে রেখেছে বলে আমার বিশ্বাস। সেই তালিকার সব শেষ কাজটা সম্ভবত আমাকে খুন করা। তার মানে, আগামী পঁচিশে অক্টোবরের আগেই যা করার করতে হবে। কিন্তু বি.সি.আই-এর পক্ষে তা সম্ভব নয়, একথা আমরা জানতে পেরেছি একটু আগেই সহকর্মীদের মুখ থেকে।
সোহেল, সোহানা, জাহেদ, সলিল এবং কামরায় উপস্থিত স্পেশাল এজেন্টরা রানার কথা শুনে বোকা বনে গেল। কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না কেউ। কি বলবে, ভেবেই পাচ্ছে না ওরা।
‘এর চেয়েও বড় যুক্তি আছে আমার,’ বলল রানা। এখন আর ঠোঁটে হাসি নেই ওর। গম্ভীর হয়ে উঠেছে চেহারা, কণ্ঠস্বর ভারী শোনাচ্ছে। ‘বি.সি.আই-এর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখেই বলছি, ইউনিয়ন কর্সের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ বাধানো উচিত হবে না আমাদের। এই গুপ্ত সংগঠনটিকে সি.আই.এ. সহ পৃথিবীর সমস্ত ইন্টেলিজেন্স বিভাগ এড়িয়ে চলে, ঘাঁটাবার ঝুঁকি নেয় না। সে-ঝুঁকি আমাদেরও নেয়া উচিত হবে না। ভয় পেয়েছি, তাই এসব কথা বলছি, ব্যাপারটা ভা নয়। ইউনিয়ন কর্সকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি বি.সি.আই-এর আছে। শেষ পর্যন্ত আমরাই জিতব, এ ব্যাপারেও আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু জিতব কিসের বিনিময়ে? দেখা যাবে ইউনিয়ন কর্সকে দমন করা গেছে, কিন্তু আমাদেরকে হারাতে হয়েছে ইউরোপে ছড়িয়ে থাকা অনেক এজেন্টকে, স্পেশাল এজেন্টদের বেশিরভাগই মারা গেছে, অফিসাররা গায়েব হয়ে গেছে। খুব কম করে বলছি আমি। ক্ষতির পরিমাণ এর শতগুণ বেশি হওয়ারই সম্ভাবনা।’ একটু বিরতি নিল রানা, তারপর দুঢ় গলায় বলল, ‘আমার একার নিরাপত্তার জন্যে বি.সি.আই-কে এতবড় বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে দিতে আমি রাজি নই।
সবাই চুপ। কামরার ভিতর পিন পতন স্তব্ধতা।
চিকন ধোঁয়া ছাড়ছেন রাহাত খান সিলিঙের দিকে। কাঁচাপাকা ভুরুর ভিতর থেকে একজোড়া চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামনে বসা অফিসারদের উপর পড়ল। একে একে সবগুলো থমথমে মুখের দিকে তাকালেন তিনি। তাঁর দৃষ্টি ফিরে এসে এবার স্থির হলো রানার মুখের উপর। কিছুই বললেন না তিনি, কিন্তু রানা তাঁর দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারল। চীফ জানতে চাইছেন ওর আরও কিছু বলার আছে কিনা।
‘সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বি.সি.আই. যদি মাঠে নামে,’ বলল রানা, ইউনিয়ন কর্সকে কেটেছেঁটে অর্ধেক করে দেয়া সম্ভব, তবে তাতে সময় লাগবে কয়েক বছর। কিন্তু যতই ক্ষতি করি না কেন আমরা, সে-ক্ষতি পূরণ করতে খুব বেশি সময় লাগবে না উ সেনের। সুতরাং, ইউনিয়ন কর্সের বিরুদ্ধে লেগে লাভ নেই। লাগতে হবে উ সেনের বিরুদ্ধে। কিন্তু,’ একটু থেমে বলল রানা। উ সেনের কাছে পৌছানো এক কথায় অসম্ভবই। পৃথিবীর সবচেয়ে ওয়েল প্রটেকটেড ব্যক্তি এখন সে। তার কাছাকাছি যেতে হলে কয়েক শো ট্রেনড দেহরক্ষীর লাশ ডিঙিয়ে যেতে হবে। এক ডজন স্পেশাল এজেন্টের পক্ষে তা সম্ভব নয়।
রানা থামতেই গম্ভীর গলায় বলল সোহেল, ‘মনে হচ্ছে তোর নিজের কোন প্ল্যান আছে।
‘আছে,’ বলল রানা। ‘এক ডজন বা কয়েক ডজন স্পেশাল এজেন্টের পক্ষে যা সম্ভব নয়, একজন এজেন্টের পক্ষে তা সম্ভব। ব্যাখ্যা করছি। ধরা যাক, একই উদ্দেশ্য নিয়ে দুটো দল একই দিকে এগোচ্ছে। একটা দলে মাত্র একজন, অপর দলে অসংখ্য লোক রয়েছে। কোন্ দলটা শত্রুর চোখে ধরা পড়বে?’ থামল রানা, কিন্তু কেউ জবাব দিচ্ছে না দেখে নিজেই উত্তরটা দিল, ‘ধরা পড়বে দ্বিতীয় দলটা। কেননা অসংখ্য লোক গা ঢাকা দিয়ে বেশিক্ষণ শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। কিন্তু একজন লোক পারে। বুদ্ধি করে চললে ফাঁক ফোকর দিয়ে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনেক কাছে চলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব।’
‘সেই একজন বুদ্ধিমান লোকটা নিশ্চয়ই তুই?’ রাগ সামলাতে না পেরে সোহেলের মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল কথাটা।
অমায়িক হাসল রানা। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক ধরেছিস।’
‘দিস ইজ ম্যাডনেস!’ মেজর জেনারেল রাহাত খানের উপস্থিতি ভুলে প্রায় চিৎকার করে উঠল সোহেল। ‘তুই স্রেফ আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিস।
গমগম করে উঠল রাহাত খানের কণ্ঠস্বর, ‘তোমার প্ল্যানটা আর একটু ব্যাখ্যা করো, রানা।’
থমকে গেল সোহেল। চীফের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ব্যাপারটা কি বোঝার চেষ্টা করছে সে। চীফ রানাকে কথা বলতে উৎসাহ দিচ্ছেন, ভাবছে সে, তার মানে ওর প্ল্যানের মধ্যে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। হাউ অ্যাবসার্ড! রানা পাগল হয়েছে বলে কি…ওকে যে কোনমতেই একা ছেড়ে দেয়া যায় না তা কি উনি বুঝতে পারছেন না?
সোহেল একা নয়, কামরার সবাই হতবাক হয়ে গেছে।
দেয়ার ইজ নো ম্যান ইন দি ওয়ার্ল্ড হু ইজ প্রুফ এগেনস্ট অ্যান অ্যাসাসিন’স বুলেট,’ শুরু করল রানা। ‘বাইরে খুব কম বেরোয় উ সেন। তবে আততায়ীর একটা বুলেট পৃথিবীর যে কোন লোককে খুন করতে পারে, এ-কথা আমি আগেই বলেছি। তাকে খুন করা সম্ভব। কিন্তু খুন করার চেয়ে কঠিন নিরাপদে সরে আসা। সেজন্যে নিখুঁত পরিকল্পনা দরকার। আঘাত হানার সময়, আঘাত হানার পদ্ধতি, তারপর এস্কেপ রুট নির্বাচন–এসব আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে। পরিকল্পনাটাকে নিখুঁত করার স্বার্থেই মাত্র একজন লোকের ঘাড়ে সবটা দায়িত্ব থাকা উচিত। তাতে ভুল হবার ভয় কম, আর ভুল হলেও তা ধরা পড়া মাত্র তার পক্ষে সংশোধন করে নেয়া সম্ভব, একাধিক লোক হলে যা সম্ভব নয়।’ একটু হাসল রানা, তারপর রাহাত খানের চোখে চোখ রেখে দুম করে একটা প্রশ্ন করে বসল, ‘স্যার, আমাদের আজকের এই মীটিং সম্পর্কে বাইরের আর কেউ জানে?’
কাঁচা-পাকা ভুরু কুঁচকে দুই সেকেন্ড রানাকে দেখলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। ‘না।’
সেক্ষেত্রে,’ বলল রানা, ‘এই কামরায় উপস্থিত রয়েছেন যাঁরা তাঁরা ছাড়া বাইরের আর কেউ যেন এ ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে না পারে। আজকের মীটিংয়ের সমস্ত সিদ্ধান্ত, ডোশিয়ার, ফাইল নষ্ট করে দিতে হবে। উপস্থিত সকলের উদ্দেশে বলছি, এখানে যা কিছু আলোচনা হচ্ছে বাইরে বেরুবার সাথে সাথে সব ভুলে যাবেন।
গোগ্রাসে গিলছে সবাই রানার কথা।
‘কিভাবে কি করব তার প্ল্যান আমিই তৈরি করব, অপারেশনেও যার আমি একা,’ নিচু গলায় কথা বলছে রানা, কিন্তু পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে সবাই ওর থমথমে ভারী কণ্ঠস্বর। ‘এ বিষয়ে কাউকে কিছু জানাব না আমি—স্যার, এমন কি আপনাকেও নয়। এক কথায় আমি অদৃশ্য হয়ে যাব।’
উপস্থিত সকলের বুক ছ্যাৎ করে উঠল। বলে কি রানা! মেজর জেনারেল রাহাত খানকেও নিজের প্ল্যান জানাতে চায় না ও! এত বড় কথা মুখ থেকে বেরোল কিভাবে!! কড়া ধমক দেবে বস্, এই ভেবে দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে সবাই।
স্পেশাল এজেন্টদের সারি থেকে একটা সপ্রতিভ কণ্ঠস্বর দৃঢ় ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘মাসুদ ভাইকে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাপোর্ট করি। আমার ধারণা শুধু এভাবেই সম্ভব হতে পারে কাজটা।’ কথাটা বলল রূপা, অসমসাহসী এবং ভাবাবেগশূন্য বলে যার খ্যাতি আছে।
অদৃশ্য হয়ে যাবার পর আমার সাথে কারও কোন রকম যোগাযোগ থাকবে না,’ বলল রানা। ‘এরপর সম্ভাব্য দুটো খবর পেতে পারেন আপনি, স্যার। এক, উ সেন নেই। দুই, আমি নেই।’
সবাই স্তব্ধ।
‘বলে যাও,’ মৃদু গলায় বললেন রাহাত খান।
‘উ সেনকে আমি বিশ্বাস করি না,’ বলল রানা, ‘আমি তার দিকে রওনা হয়েছি এ খবর যদি আগেভাগে পেয়ে যায় সে, আমাকে ঠেকাবার জন্যে অত্যন্ত নীচ একটা কৌশল অবলম্বন করবে। সেই কৌশলটা কি হবে, তা আমি এখনই অনুমান করতে পারি।’ একটু থামল রানা, ইতস্তত করল খানিক, তারপর বলল, ‘স্যার, আপনাকে সে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করতে পারে। তার জানা আছে, একমাত্র এই দুঃসংবাদ পেলেই আমি প্ল্যান বাতিল করে ফিরে আসব দেশে। আমাকে মাফ করবেন, স্যার, তবু বলছি, সম্ভাব্য দুটো খবরের একটা না পাওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা কয়েকগুণ জোরদার করতে হবে আপনাকে।’
নিমেষে চোখ খুলে গেল সকলের। রানার স্পর্ধা দেখে নয়, ওর সতর্কতা লক্ষ করে। ইউনিয়ন কর্স যে কী ভয়ঙ্কর একটা শক্তি তা যেন এই প্রথম পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করছে ওরা।
‘তোমাদের কারও কোন প্রশ্ন আছে?’ সোহেলের দিকে তাকালেন মেজর জেনারেল।
গভীর চিন্তান্বিত সোহেল চীফের কথায় সংবিৎ ফিরে পেল। রানাকে বোঝাবার চেষ্টা করে লাভ নেই, তাই চীফের কাছে ধরনা দিল ও, বলল, ‘স্যার, এ ব্যাপারে বি.সি.আই-এর একটা দায়িত্ব আছে। ও যাই বলুক, আমরা সে-দায়িত্ব পালন করব। প্ল্যানিং এবং অপারেশন ওর নিজের, সে-সম্পর্কে যদি কাউকে কিছু জানাতে না চায়, ঠিক আছে, জানতে চাইব না—কিন্তু বি.সি.আই-এর সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করা চলবে না ওর। যদি কোন বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেয়…
‘কোন বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেবে না,’ বলল রানা। ‘বিপদ যদি হয়, এখান থেকে হবে। আমি কোথায়, কি করতে যাচ্ছি এ কথা প্রকাশ না হলে সব ঠিক থাকবে’। এখানে কেউ যদি মুখ না খোলে, আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না।’
‘কিন্তু গোপনে যোগাযোগ থাকলে ক্ষতিটা কি?’ সোহানার অসহিষ্ণু প্ৰশ্ন কোন যোগাযোগই শেষ পর্যন্ত গোপন থাকে না, সেটাই আমার ভয়,’ বলল রানা।
‘কিন্তু শত্রুপক্ষের মুভমেন্ট সম্পর্কে তোকে জানতে হবে না?’ ঝট্ করে রানার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল সোহেল।
‘তা নাহলে,’ পিছনের সারি থেকে বলল বিশাল ছাতি রাশেদ, ‘আপনাকে অ্যাসিস্ট করার জন্য কাউকে সাথে নিন।
সলিল সায় দিয়ে বলল, ‘ওটা আমার এলাকা, আমি সাথে থাকলে সবার চেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারব ওকে।’
রেগে উঠে সোহানা বলল, ‘এত কথা না বলে নিয়ম অনুসারে যা হওয়া উচিত তাই হোক। বিশেষ গুরুতর পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান সবসময় তার স্পেশাল এজেন্টদের ওপর নির্ভর করে এসেছে। আজ কেন তার ব্যতিক্রম হবে?
‘পরিস্থিতি গুরুতর আমার জন্যে,’ বলল রানা, ‘প্রতিষ্ঠানের জন্যে নয়।’ সকলের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে এবার সে-ও সরাসরি মেজর জেনারেল রাহাত খানের শরণাপন্ন হলো, স্যার, এই কাজটায় আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাব বলে আশা করি। অফিশিয়াল নির্দেশ দিয়ে আমার গতিবিধি যদি নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেটা আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ারই সামিল হবে।’
রাহাত খান গম্ভীর মুখে তাকালেন সোহেলের দিকে। অদ্ভুত একটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন তিনি। মুখ দেখে বোঝা না গেলেও ঝগড়াটা তিনি উপভোগ করছেন সন্দেহ নেই।
‘অফিশিয়াল নির্দেশকে এত ভয় পাবার কিছু নেই,’ শেষ পর্যন্ত রানাকেই অনুরোধের সুরে বলল সোহেল, ‘তোর যা খুশি করবি, কেউ বাধা দেবে না—তবু যোগাযোগ একটা থাকা দরকার।’
মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল রানা। তারপর মুখ তুলে বলল, ‘ঠিক আছে। আমার লন্ডনের ঠিকানা আর টেলিফোন নাম্বার দেব আমি। কখন দেব, এখনই তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ইমার্জেন্সী ছাড়া কোন অবস্থাতেই এই নাম্বারে ফোন করা চলবে না। ওই ঠিকানায় ডাকে একটা চিঠি পাঠাবি, চিঠিতে এমন একটা ফোন নাম্বার দিবি যে নাম্বারে ফ্রান্সের যে-কোন জায়গা থেকে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারি আমি। এই ফোনটার সাথে টেপ-রেকর্ডার রাখার ব্যবস্থা করবি, যাতে কোন ইনফরমেশন দিলে তা টেপ হয়ে যায়। ফোনের ধারে যে থাকবে, আমার সাথে যোগাযোগ করার কোন সুযোগ সে পাবে না, দরকার হলে এবং আমার নিজের সময়মত আমিই যোগাযোগ করব।’ একটু বিরতি নিল রানা, তারপর কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল, ‘ফোনের ধারে কে থাকবে তা এখনই আমাকে জানিয়ে দে। তবে সে যেই হোক, আমি তাকে আমার মুভমেন্ট, পরবর্তী পদক্ষেপ ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুই জানাব না।’
‘ঠিক আছে,’ মেনে নিল সোহেল। রানার কাছ থেকে এইটুকু আদায় করতে পেরেই খুশি ও। ‘কিন্তু তবু শেষ আরেকবার আমি তোকে মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি, একা যাওয়াটা কি তোর উচিত হচ্ছে? তুই রাজি হলে আমরা একশো এজেন্টকে তোর হাতে…’
‘না! ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি,’ বলল রানা।
মৃদু কাঁধ ঝাঁকাল সোহেল।
সলিল বলল, ‘নকল কাগজপত্র দরকার হবে তোর, এ ব্যাপারে আমি তোকে সাহায্য করতে পারি।’
‘নিজেই যোগাড় করব,’ বলল রানা। ‘ধন্যবাদ।’ সোহেলের দিকে ফিরল। ‘ফোনের কাছে কে থাকবে?’
‘আমি,’ গলা বাড়িয়ে বলল সোহানা।
হাত দিয়ে না হলেও কথার চড়টা ঠাস করে মেরে বসল রানা, ‘না।’
নিমেষে কালো হয়ে গেল সোহানার মুখ। সাথে সাথে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটল কামরার উপস্থিত আর সবার মধ্যেও।
এক সেকেন্ডের জন্যে কাঁচাপাকা ভুরু জোড়া কুঁচকে রানার দিকে তাকালেন মেজর জেনারেল রাহাত খান।
রাগে লাল হয়ে উঠেছে রাশেদের মুখটা।
অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ! কেউ কথা বলছে না।
থমথমে গলায় সোহেলই নিস্তব্ধতা ভাঙল, ‘তাহলে তুই-ই যাকে ইচ্ছা বেছে নে।’
‘রূপা,’ মৃদু কণ্ঠে বলল রানা।
আলোচনার আর কিছু বাকি নেই, মীটিংয়ের এবার সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।
চীফ কিছু বলবেন, এই আশায় অপেক্ষা করছে সবাই।
পাইপে আগুন ধরিয়ে রাহাত খান সোহেলের দিকে তাকিয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাতটা সামান্য একটু নাড়লেন।
আজকের মীটিং এখানেই শেষ,’ বলল সোহেল।
সবাই চেয়ার ছাড়ছে। রানাও।
‘বসো,’ চীফের ভারী গলা শুনে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল রানার। অপরাধীর মত ধীরে ধীরে আবার বসে পড়ল ও।
সবাই কামরা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শুকনো মুখে একা বসে আছে রানা। ঢোক গিলছে। ভাবছে, না জানি কোন্ পয়েন্টে ধরে বসে বুড়ো।
.
পাঁচ মিনিট পর হাসিমুখে চীফের কামরা থেকে বেরিয়ে এল রানা। আউটার অফিসে টেপ-রেকর্ডার ছেড়ে দিয়ে আজকের মীটিংয়ের বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করছে ইলোরা। রানার পায়ের শব্দে মুখ তুলে মৃদু হাসল, কিন্তু কথা না বলে আবার মন দিল কাজে।
কামরা থেকে করিডরে বেরিয়ে এল রানা। সামনে সোহানা পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে থমকে গেল মুহূর্তের জন্যে। কিন্তু ঝট করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পাশ কাটিয়ে এগোল আবার। করিডর ফাঁকা, আর কেউ নেই।
হাত বাড়িয়ে রানার শার্টের আস্তিন ধরে ফেলল সোহানা।
‘দাঁড়াও।’
বাধা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে রানা। কিন্তু মুখ ফেরাল না। বলল, ‘ছাড়ো!’
‘না,’ নিচু গলায় বলল সোহানা। ‘আমার কথা আজ শুনতে হবে তোমাকে।’
মুখ ফেরাল রানা। তোমার স্বামী যদি…’ তীব্র ব্যঙ্গের সুরে কিছু বলতে যাচ্ছিল রানা।
অবরুদ্ধ কাঁপা গলায় বাধা দিল সোহানা, ভুল বুঝেছিলাম, সে-ভুল আমার ভেঙেছে, কিন্তু তোমার ভুল ভাঙবে কবে?
‘কিসের ভুল?’ রূঢ় গলায় বলল রানা।
‘সালমার সাথে ওভাবে তোমাকে মিশতে দেখে…কিন্তু সে-ভুল আমার ভেঙে গেছে। জেনেছি, ওকে তুমি নিজের বোনের মত স্নেহ করো।’ আরও কি যেন বলতে চাইছে সোহানা, ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে, কিন্তু বলতে পারছে না।
‘তোমার ভুল ভাঙুক, না ভাঙুক তাতে আমার কিছু এসে যায় না, কঠোর কণ্ঠে বলল রানা। ‘বিয়ে থা হয়ে গেছে, এবার সংসারের দিকে একটু মন দেয়াটাই তোমার জন্যে মঙ্গল বলে মনে করি।’ কথাটা বলে নিজের কামরার দিকে এগোল রানা। থেমে দাঁড়াল আবার। ‘তাছাড়া, তোমার দেওরের সংখ্যাও তো কম নয়। আমাকে ওই দলে না টানলেও চলবে।’
‘সবাই আমাকে ভাবী বলে ডাকে, কিন্তু কেন? সে-প্রশ্ন একদিনও তো জিজ্ঞেস করোনি কাউকে?’
সোহানার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এখনও রানা। ‘কেন?’ নিজের অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল ওঁর মুখ থেকে।
‘এখনও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে তোমার?’ নিচু গলায় বলল সোহানা। ‘কোথায় গেল তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি? নাকি সব জেনেও না জানার ভান করছ? তোমার জীবনে যদি আর কেউ এসে থাকে, সে-কথা পরিষ্কার করে বললেই তো পারো। তাহলে অন্তত ওদেরকে ভাবী বলতে নিষেধ করে দিয়ে প্রতিদিন অপমান হওয়া থেকে বাঁচতে পারি।’
পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিস্ময়ের একটা ধাক্কা অনুভব করল রানা। এক সেকেন্ডের জন্যে চক্কর দিয়ে উঠল মাথাটা। কোথায় যেন মস্ত একটা গোলমাল হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ঘুরল ও।
নেই, চলে গেছে সোহানা অদূরেই তার কামরা, দরজায় পর্দা ঝুলছে। পর্দাটা কাঁপছে। পাথরের মূর্তির মত সেদিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল রানা। তারপর উদ্ভ্রান্তের মত এগোল সেদিকে।
কামরার কাছে পৌঁছে দাঁড়াল ও। দ্রুত করিডরের দু’দিক দেখে নিল। কেউ লক্ষ করছে না ওকে। পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল ভিতরে
ডেস্কে মাথা রেখে চেয়ারে বসে আছে সোহানা। ডেস্কের উপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কালো চুল, মুখটা ঢাকা পড়ে গেছে তাতে।
নিঃশব্দ পায়ে ভিতরে ঢুকল রানা। কোন শব্দ না করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সোহানার পাশে।
অদম্য আবেগে পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে সোহানার
একটা হাত বাড়াল রানা, কিন্তু ইতস্তত করে সেটা ফিরিয়ে নিল আবার। নাম ধরে ডাকতে গিয়ে আবিষ্কার করল, গলা বুজে আছে, বুকে সাহসেরও বড় অভাব। আবার হাত বাড়াল ও। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে হাতটা।
মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়েই চমকে উঠে মুখ তুলল সোহানা।
‘আমাকে মাফ করো,’ সোজাসাপ্টা ক্ষমা চাইল রানা। ‘ভুল বুঝে হোক, না বুঝে হোক, অন্যায় করেছি, …লক্ষ্মী, এবারটি আমাকে মাফ করে দাও।’
সোহানার অনিন্দ্যসুন্দর মুখে চোখের পানির সাথে লেপটে আছে ক’গাছি চুল। চেহারা থেকে দ্রুত খসে পড়ছে ম্লানিমার ছায়া, আশ্চর্য উজ্জ্বল একটা হাসি ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে।
চিবুক ধরে উঁচু করল রানা শিশির ভেজা তাজা ফুলের মত মুখটাকে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ব্যস্ত সমস্ত ভঙ্গিতে চোখের পানি মুছছে সে সোহানার—যেন সব দুঃখ মুছে দিতে পারবে ও।
আসলে কেউ কি পারে তা কোনদিন?
.
বেলা এগারোটা।
নীল ডাটসান নিয়ে রওনা হলো রানা। মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকারই মস্ত এক বিল্ডিংয়ের সাততলায় ওর গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান ‘রানা এজেন্সী—প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার্স’। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চার কামরার একটা স্যুইটে সাজানো অফিস। অফিস সেক্রেটারি সালমা, শাখা প্রধান গিল্টি মিয়া, তত্ত্বাবধায়ক ও নিজে।
অনেকদিন পর মনটা আজ ভাল ওর। সোহানা ওরই ছিল, আজও আছে, চিরকাল থাকবে—এটা উপলব্ধি করার পর থেকে অদ্ভুত এক পুলকে শরীর মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে ওর। সব গোলমাল আর ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটেছে। ওকে যেদিন বি.সি.আই. থেকে এক বছরের জন্যে দূরে সরিয়ে দেয়া হলো সেদিনই ভুল বোঝাবুঝিটা চরমে পৌঁছেছিল। ওর অফিসরূমে রাশেদকে নিয়ে যে নাটকটা সেদিন করেছিল সোহানা তার ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। ‘নাম্বার ওয়ান পাগলী!’ ভাবছে রানা, ‘ও ভেবেছিল আমাকে অবহেলা করলেই আমি ওর দিকে নতুন করে আকৃষ্ট হব। তাতে হিতে বিপরীতই ঘটেছিল। মন উঠে গেছে সোহানার, এই ধরে নিয়েছিল রানা। যাক বাবা, আসল কথা জানা গেছে, হারানো লক্ষ্মী আবার ফিরে পেয়েছে। কিন্তু, এবার হয়তো সোহানা বজ্র আঁটুনি দিয়ে সম্পর্কের গিঁটটাকে শক্ত করে বেঁধে নিতে চাইবে, এই যা একটু দুশ্চিন্তার কথা। আবার কি না কি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়, এই ভেবে ভয় পাচ্ছে ও। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, ‘অদৃশ্য হও আর যাই হও, আমাকে সাথে নিতে হবে। মরলে দু’জন মরব একসাথে।
মাথায় হাত বুলিয়ে যুক্তি তর্কের অবতারণা করে শেষ পর্যন্ত একটা আপস রফা করা গেছে। দুই শর্তে রানার সাথে যাবে না সোহানা। শর্ত দুটো হলো–এক, উ সেনের বিরুদ্ধে এই জীবন মরণ যুদ্ধে মরা চলবে না রানার। দুই, নির্দিষ্ট একটা তারিখের মধ্যে ওর কাছে ফিরে আসতে হবে।
মস্ত দালানটার সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল রানা। স্টার্ট বন্ধ করে শিস দিতে দিতে নামল। রাইফেলধারী দারোয়ান কপালে হাত তুলে আদাব করল ওকে। মাথাটা একটু নুইয়ে মৃদু হেসে ধাপ ক’টা টপকে এলিভেটরের দিকে এগোল রানা। এলিভেটরে চড়ে রিস্টওয়াচ দেখল ও। ছয় মিনিট দেরি হয়ে গেছে পৌঁছতে ওর। ঢাকায় যখন থাকে ও, ঘড়ির কাঁটা ধরে এগারোটার সময় রানা এজেন্সীর অফিসে আসে প্রতিদিন একবার। এক মিনিট দেরি হলেই গিল্টি মিয়া আর সালমা ধরে নেয় বস্ আজ আসবেন না। আজ ওকে দেখে দু’জনেই খুব অবাক হবে, এই ভেবে মুচকি হাসল রানা।
সাততলায় উঠে এল এলিভেটর। লম্বা করিডর। বাঁ দিকে সবশেষ দরজার মাথায় ঝকঝকে পিতলের উপর খোদাই করা ‘রানা এজেন্সী—প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার্স’।
দরজা ঠেলে পুরু কার্পেটে মোড়া ঘরে ঢুকতেই ডোর-বেলের মিষ্টি টুং-টাং একটা আওয়াজ হলো। হাফ হাতা সাদা শার্ট, হালকা নীল জিনসের সরু-পা প্যান্ট পরে সালমার চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগের সাথে একটা প্যাডে কি যেন লিখছে রানা এজেন্সী ঢাকার শাখা-প্রধান গিলটি মিয়া। সালমাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ভিতরের একটা কামরা থেকে ভেসে আসছে চুড়ির মৃদু টুং-টাং, তার সাথে অস্পষ্ট একটা পুরুষ কণ্ঠ।
ডোর-বেলের শব্দে মহা বিরক্ত হয়ে গজ্জ্ করে উঠল গিলটি মিয়া, ‘যা ভেবেচি। শুব কাজে বাদা… মুখ তুলে রানাকে এগিয়ে আসতে দেখেই সরল দুই চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল, পরমুহূর্তে প্যাড থেকে হ্যাঁচকা টানে পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সে। কাগজ ধরা হাতটা উঠে গেল কপালে, ‘আ-আদাব, স্যার। আ-আমি ভেবেচিলুম…’
সালমার টেবিলের সামনে দাঁড়াল রানা। পাইপটা অ্যাশট্রেতে ঠুকে ছাই ঝাড়ছে। ‘শুভ কাজটা কি, গিলটি মিয়া?’
‘জী?’ ঢোক গিলল গিলটি মিয়া। হড়বড় করে বলল, ‘কিছুই নয়, স্যার। এই মানে, বিয়ে।
ভুরু কুঁচকে উঠল রানার। ‘কিছু নয় মানে বিয়ে?’ উপর নিচে মাথা দোলাল একবার ও। আচ্ছা, এ্যাদ্দিনে তাহলে বিয়ে করতে যাচ্ছ তুমি?’
দাঁত দিয়ে জিভ কাটল গিলটি মিয়া। পরমুহূর্তে সড়াৎ করে জিভটা ঢুকিয়ে নিল মুখের ভিতর। ভুল বুজচেন, স্যার। আমার লয়, বিয়েটা সালমা বেগমের।’ কথা শেষ করে ভয়ে ভয়ে ভিতরের কামরার দরজার দিকে তাকাল সে।
‘সালমার সাথে আর একজন রয়েছে ওখানে–কে?’ জানতে চাইল রানা।
অপরাধীর মত মুখ করে রানার দিকে ফিরল গিলটি মিয়া। ‘পাশের আপিসের লোক, স্যার। বয়স আপনার চেয়ে কিচু কম, দেখতে রাজপুত্তুর, আপনি আপিসে না থাকলে সালমা বেগমের কাচে ভিক্ চাইতে আসে।
‘ভিক্ষা চাইতে আসে? মানে?’
মুখটা একটু লাল হয়ে উঠল গিলটি মিয়ার। ইতস্তত করছে। তারপর বলল, মানে স্যার, ঠিক বুজিয়ে বলতে পারচি না—প্রেম না কি ছাই যেন বলে, সেইটা চাইতে আসে আর কি। আড়াল থেকে শুনতে পেলুম, সালমা বেগম রাজি হয়েচেন, তাই…’ নিজের হাতে ধরা প্যাডের কাগজটার দিকে বোকার মত তাকাল সে।
‘কি ওটা?’ গিলটি মিয়ার হাত থেকে কাগজটা টেনে নিল রানা। চোখের সামনে মেলে ধরতে দেখল আঁকাবাঁকা অক্ষরে তাতে লেখা রয়েছে: শুভ বিবাহ কেনাকাটার ফর্দ॥ তালিকার শীর্ষে লেখা: বিয়ের শাড়ি, একখানা জামদানী=২৫০০.০০ (আড়াই হাজার টাকা), তার নিচে লেখা: গহনা (স্বর্ণের দোকান বন্ধ, তাই রাঙার মার কাচ থেকে কিছু গহনা ধার হিসেবে চেয়ে লিতে হবে।)
ভুরু কুঁচকে উঠল রানার। ‘রাঙার মা গহনা পাবে কোথায়?’
অনাবিল সকৌতুক হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল গিলটি মিয়ার মুখ। সংক্ষেপে জানাল, ‘আচে।’
‘আছে মানে?’
‘হে-হে,’ হাসছে গিলটি মিয়া। ‘আপনার কাচ থেকে বাজার খরচার টাকা চেয়ে নিয়ে জমায়, হাজার টাকা হলেই আদ-ভরি করে সোনা কিনিয়ে লেয় আমাকে দিয়ে। সোহানাদির সাতে আপনার বিয়ে দেবে কিনা, তাই…’
আরে, সবিস্ময়ে ভাবল রানা-ভিতরে ভিতরে এতদূর এগিয়ে গেছে এরা! সবাই তো জানত, শুধু ওরই কিছু জানা ছিল না। আশ্চর্য!
গালভর্তি হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে গিলটি মিয়া। মুখে গাম্ভীর্য টেনে এনে দরজার দিকে ইঙ্গিত করল রানা। ‘নাও, আমি এসেছি বলে পিলে দুটো চমকে দাও ওদের।’
সুড় সুড় করে এগিয়ে গেল গিলটি মিয়া। দরজা দিয়ে নিজের কামরায় ঢুকল, তারপর এগোল রানার চেম্বারের দিকে। সালমা আর তার প্রেমিক সেখানেই মগ্ন হয়ে আছে নিজেদেরকে নিয়ে।
সালমার সুরেলা গলার অস্পষ্ট হাসি শুনতে পাচ্ছে রানা। তারপরই শোনা গেল খুক্ করে গিলটি মিয়ার কাশির আওয়াজ!
মুচকি একটু হেসে পাইপটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল রানা। লাইটার জ্বালল। পাইপে আগুন ধরাতে যাবে, বুম্ করে বিকট বিস্ফোরণ হলো। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল রানা। দড়াম করে ধাক্কা খেল গিয়ে ছয় হাত দূরের দেয়ালের গায়ে। কানে তালা লেগে গেছে। গোটা বিল্ডিংটা থরথর করে কাঁপছে এখনও। হুড়মুড় করে ধসে পড়ে গেছে একদিকের দেয়াল। ধুলোবালি উড়ছে কামরার ভিতর, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না রানা। অস্পষ্ট ভাবে যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে গিলটি মিয়ার গোঙানির শব্দ।
টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল রানা। এক হাত দিয়ে ঘাড়টা ডলছে। পার্টেক্সের পার্টিশনগুলো ভেঙেচুরে স্তূপের আকারে জড় হয়ে আছে সামনে। দুটো কামরার কিছুই অবশিষ্ট নেই। শ্রবণশক্তি ফিরে আসছে ধীরে ধীরে। টলতে টলতে করিডরের দরজার দিকে এগোল- ও। ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে মাথার ভিতর। প্রথম কাজ দরজাটা বন্ধ করা।
দরজা বন্ধ করার সময় অসংখ্য লোকের শোরগোল, চেঁচামেচি কানে ঢুকল ওর। দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে খ্যাঁচ করে ব্যথা লাগল ঘাড়ে। এগোল ধ্বংস স্তূপের দিকে।
পাশের দেয়ালটা ধসে পড়েছে, ওপাশে নির্জন কামরা দেখা যাচ্ছে একটা। রানা এজেন্সীরই ভাড়া নেয়া কামরা ওটা, কিন্তু বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ওটা ব্যবহার করা হয় না। ওটা যে রানা এজেন্সীর কামরা, ওরা তিনজন এবং বিল্ডিংয়ের ম্যানেজার ছাড়া আর কারও জানা নেই।
দ্বিতীয় কামরার ধ্বংস স্তূপের মাঝখানে হাঁটু মুড়ে বসল রানা। দ্রুত হাতে ইঁট, বালি, পার্টেক্সের টুকরো সরিয়ে ফেলল, তারপর টেনে হিঁচড়ে বের করল অজ্ঞান গিলটি মিয়াকে। মাথা ফেটে গেছে তার। বুকে এবং পাঁজরে সাংঘাতিক আঘাত পেয়েছে সে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। এই মুহূর্তে হাসপাতালে না পাঠাতে পারলে বাঁচানো যাবে না।
সালমা আর তার পাণি প্রার্থী যুবকটিকে পরীক্ষা করার দরকার নেই। পার্টেক্সের পার্টিশন সরিয়েই বুঝে নিল রানা, সালমার ঘাড় মটকে গেছে, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে তার। যুবকটিকে চেনার কোন উপায় নেই। খুলি ফেটে মগজ বেরিয়ে পড়েছে তার। দেয়াল ধসে পড়ে থেঁতলে গেছে মুখ, চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।
এক মুহূর্ত পাথরের মত স্থির হয়ে বসে রইল রানা। দ্রুত কি যেন ভাবল। তারপর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফিরে এল প্রথম কামরায়।
ক্রাডল থেকে রিসিভার তুলে দেখল ডায়াল টোন রয়েছে এখনও। দ্রুত একটা বিশেষ নাম্বারে ডায়াল করছে ও।
অপর প্রান্ত থেকে সোহেল আহমেদের কণ্ঠস্বর ভেসে এল রানার কানে, ‘ইয়েস?’
‘রানা। রানা এজেন্সীতে এইমাত্র একটা টাইম বম্ব ফেটেছে। সালমা নেই। আরেক লোক, মনে কর আমি, নেই। গিলটি মিয়াকে এক্ষুণি হাসপাতালে পাঠানো দরকার। আমি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি, প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করবি তুই।’
সোহেলকে কোন প্রশ্ন করার অবকাশ না দিয়ে খটাশ করে ক্রাডলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল রানা। শেষবারের মত দেখে নিল সালমা ও গিলটি মিয়ার মুখ। গাল দুটো কুঁচকে উঠছে দেখে ঝট করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল অন্যদিকে
এবং সেই মুহূর্ত থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে গেল ও।
পাঁচ মিনিট পর দুটো অ্যাম্বুলেন্স এসে থামল মস্ত বিল্ডিংটার সামনে। হাসপাতালের ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন লোক লাফ দিয়ে নামল গাড়ি থেকে স্ট্রেচার নিয়ে ছুটল তারা এলিভেটরের দিকে।
রাস্তা লোকে লোকারণ্য। ভিড়ের মধ্যে একজন বিদেশীকেও দেখা যাচ্ছে। বিস্ফোরণের শব্দে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এসেছে সে-ও। লোকটা ইউরোপীয়ান, হাতে একটা ক্যামেরা। দর্শকরা তাকে সাংবাদিক বলেই ধরে নিল।
স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হচ্ছে আপাদ মস্তকে চাদরে ঢাকা লাশ। বিদেশী সাংবাদিক দুটো লাশেরই ছবি তুলল। গিলটি মিয়া বেঁচে আছে তখনও, কিন্তু জ্ঞান নেই। মারা যায়নি বলে চাদর দিয়ে ঢাকা হয়নি তাকে। বিদেশী লোকটা আহত গিলটি মিয়ারও ছবি তুলল একটা।
লাশ দুটো অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো। হুশ করে বেরিয়ে গেল সেটা। তার পিছু নিল দ্বিতীয় অ্যাম্বুলেন্সটা। এটায় গিলটি মিয়া আছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে।