সেই উ সেন – ১.১

এক

প্যারিস। হোটেল হিলটন।

আগস্ট মাসের বাইশ তারিখ। পশ্চিম দিগন্তরেখার কাছাকাছি নেমে ইতস্তত করছে প্রকাণ্ড সূর্যটা। সাতটা বেজে চল্লিশ মিনিট।

লম্বা কালো ঝকঝকে একটা সিটন ডি-এস নাইনটিন গ্যারেজ থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। থামল রিসেপশন হলের দরজার সামনে। তরতর করে সিঁড়ির ধাপ ক’টা টপকে নেমে এল একজন পোর্টার। গাড়ির দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কেতা দুরস্ত ভঙ্গিতে একটু ঝুঁকল সে, হাতল ধরে খুলল দরজাটা। গাড়ি থেকে নামছে রানা এজেন্সীর প্যারিস শাখার একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মী এক্স মিলিটারি-ম্যান আঁদ্রে পল।

চেহারা আর ব্যক্তিত্বের অদ্ভুত একটা সমন্বয় ঘটেছে আঁদ্রে পলের মধ্যে। ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা হলেও, ঠিক ততটা লম্বা বলে মনে হয় না তাকে। ব্যাকব্রাশ করা চুল সমতল মাথায় এমনভাবে সেঁটে আছে, জমাট আলকাতরার একটা স্তর বলে মনে হয়। অস্বাভাবিক চওড়া শরীর তার। ক্লিনশেভ, বিখ্যাত হিটলারী গোঁফ। কান দুটো প্রায় সেঁটে আছে খুলির সাথে। সাদা ট্রপিক্যাল স্যুট পরে আছে সে। গাড়ি থেকে নেমে পোর্টারের স্যালুটের উত্তরে স্মিত হাসল সে। ঘন ভুরু জোড়ার ভিতরে চোখের মণি দুটো সারাক্ষণ চঞ্চলভাবে কি যেন খুঁজে ফিরছে। পাঁচ সেকেন্ডে চারদিক দেখা হয়ে গেল তার।

‘পিরো,’ পোর্টারের নাম ধরে সম্বোধন করল আঁদ্রে পল, ‘গাড়ির কাছ থেকে নোড়ো না।’

‘ঠিক আছে, ক্যাপটেন!’ সসম্ভ্রমে বলল পোর্টার। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেবার আগের দিন পর্যন্ত ক্যাপটেন আঁদ্রে পলের অধীনে চাকরি করেছে সে। আর সব সহকর্মীর মত তারও বিশ্বাস, ফ্রেঞ্চ সেনাবাহিনীতে আঁদ্রে পলের মত দুঃসাহসী, মেধাবী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ক্যাপটেন তখনও ছিল না, আজও নেই, ভবিষ্যতেও হবে না।

সিঁড়ির ধাপ টপকে উঠে যাচ্ছে পল। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল পোর্টার পিরোর। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছে অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপটেন। উনিশশো তেষট্টিতে জেনারেল দ্য গলের প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে বাঁ পায়ের গোড়ালিতে গুলি খেয়েছিল পল। স্রেফ তার একার অসমসাহসিকতার ফলে সিক্রেট আর্মি অরগানাইজেশনের নিখুঁত অ্যামবুশ ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্টের প্রাণ রক্ষার জন্যে পদক পেয়েছিল পল, কিন্তু শারীরিক ত্রুটিজনিত কারণে চাকরিটা হারাতে হয়েছে তাকে। সব কথা মনে পড়ে গেল পোর্টার পিরোর। দুঃখ হয়।

ঠিক সেই সময় এলিভেটরে চড়ে ষোলো তলায় উঠছে আদ্রে পল। দুঃখ নেই, গর্বে প্রসন্ন হয়ে আসছে তার মন। এক মহানুভব বঙ্গ সন্তানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে আছে সে। চাকরিচ্যুত হয়ে বোকা বনে গিয়েছিল সে। তার আজন্মের সাধ, রোমাঞ্চকর কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাবে, সেই সাথে দেশের সেবা করবে। সেজন্যেই সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল সে। ধাপে ধাপে উঠেও যাচ্ছিল ক্রমশ, এমন সময় অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো তাকে।

উদ্ভ্রান্ত আঁদ্রে পল পাগলের মত রাস্তায় ঘোরে, ঘরে ফিরে চুপিচুপি কাঁদে। এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা বছর। তারপর নৈরাশ্যে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণায় এমনকি আত্মহত্যার কথাও একদিন সে ভাবল। এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবে এল একটি চিঠি। রানা এজেন্সীর হেডকোয়ার্টার ঢাকা থেকে। চিঠির শেষে এজেন্সীর চীফ স্বয়ং মাসুদ রানার নিজ হাতের স্বাক্ষর।

বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল আঁদ্রে পল। রানা এজেন্সীর নাম আগেই শোনা ছিল তার, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটার কর্মদক্ষতা সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না। চিঠি পড়ে চোখ কপালে উঠল। পরিষ্কার বুঝল, তার জন্ম-তারিখ থেকে শুরু করে জীবনের উল্লেখযোগ্য সমস্ত ঘটনার কথা রানা এজেন্সীর ফাইলে সযত্নে টোকা আছে। শুধু তাই নয়, তার মনের আশা, স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সে নিজে যতটা না জানে, তার চেয়ে যেন বেশি জানে রানা এজেন্সী। চিঠির শেষ অংশটা পড়ে আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল সে। নতুন করে শুধু দেশের নয়, গোটা পৃথিবীর সেবা করার, রোমাঞ্চকর জীবন বেছে নেবার প্রস্তাব ছিল সেই অংশে, ছিল রানা এজেন্সীতে যোগ দেবার সাদর আমন্ত্রণ। কালবিলম্ব না করে চিঠিটার উত্তর লিখেছিল আঁদ্রে পল। মশিয়ে মাসুদ রানাকে সকৃতজ্ঞ চিত্তে লিখেছিল, ‘আপনি আমাকে নবজন্ম দান করেছেন, আপনার ‘এই মহানুভবতা চিরকাল মনে রাখব আমি। নিজেকে রানা এজেন্সীর একজন কর্মী ভাবতে পেরে আমি গর্বিত। আপনি আমার অসংখ্য ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।’

এলিভেটর থেকে বেরিয়ে এল আঁদ্রে পল। নিঃশব্দ পায়ে খানিকটা এগিয়ে করিডরের তেমাথায় দাঁড়াল। দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখে নিল চারদিক। ফাঁকা করিডর। আবার এগোল সে। অদ্ভুত একটা সতর্কতার ভাব ফুটে আছে তার চোখেমুখে, হাঁটার ভঙ্গিতে। একশো বত্রিশ নম্বর স্যুইটের সামনে থামল সে। রিস্টওয়াচ দেখার সময় আড়চোখে করিডরের দুটো দিক দেখে নিল আরেকবার। তারপর মাথা তুলে দরজায় নক করল পর পর দু’বার, একটু থেমে আবার পরপর তিনবার।

‘কাম ইন,’ স্যুইটের ভিতর থেকে ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

সিটিংরুমের দক্ষিণ দেয়ালে লম্বা জানালা, মখমলের পর্দা সরানো রয়েছে। জুতো, প্যান্ট আর শার্ট পরে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ রানা। বাঁ হাতে সরু লম্বা একটা গ্লাস। পাইপ ধরা ডান হাতটা বুকের কাছে। জানালা দিয়ে দূরে, বহুদূরে চলে গেছে ওর দৃষ্টি। পাশেই একটা স্টেরিও থ্রী-ইন-ওয়ানে বোনি এম-এর গান বাজছে, ‘নো উওম্যান, নো ক্রাই।

পায়ের শব্দে বহুদূর থেকে ফিরে এল রানা। ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, মেঝেতে রাখা সুটকেস দুটোর পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে পল। মৃদু হাসল ও। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একটা টেবিলের সামনে।

ড্রয়ার থেকে পিস্তল ভরা হোলস্টারটা বের করে বাঁ কাঁধে ঝুলিয়ে নিল রানা। পিস্তলটা খুব দ্রুত কয়েকবার হোলস্টার থেকে বের করে লক্ষ্য স্থির করল বাতির সুইচে। সন্তুষ্ট হলো হাতটা পিস্তলের বাঁটে ঠিক জায়গা মতই পড়ছে দেখে। তারপর রোজকার অভ্যাস মত স্লাইডটা আটবার টেনে একে একে আটটা বুলেট বের করে পরীক্ষা করল সে ইজেক্টার স্প্রিংটা ঠিকমত কাজ করছে কিনা। ম্যাগাজিন রিলিজটা টিপতেই সড়াৎ করে বেরিয়ে এল খালি ম্যাগাজিন। আবার স্লাইড টেনে চেম্বারে একটা বুলেট ঢুকিয়ে আস্তে হ্যামারটা টেনে দিল রানা। ঠিক ফায়ারিং পজিশনে এনে রাখে ও সব সময় তার বিপদসঙ্কুল রোমাঞ্চকর জীবনের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু এই পয়েন্ট থ্রী-টু ক্যালিবারের ডাবল অ্যাকশন অটোমেটিক ওয়ালথার পি. পি. কে পিস্তলটা।

ম্যাগাজিনে সাতটা বুলেট ভরে যথাস্থানে ঢুকিয়ে দিল রানা। ক্যাচের সাথে আটকে একটা ক্লিক শব্দ হতেই সন্তুষ্টচিত্তে আবার শোল্ডার হোলস্টারে ভরে রাখল সে তার খুদে সাথীকে। এবার চারকোল গ্রে রঙের কোট গায়ে চাপাতেই কমপ্লিট হয়ে গেল স্যুট, সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ল হোলস্টারটা। মুখ তুলে তাকাল সে পলের দিকে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রানার রুটিন-প্র্যাকটিস লক্ষ করছে সে। কোন কথা না বলে সুটকেস দুটো তুলে নিল দু’হাতে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথাভর্তি ঘন চুল ব্রাশ করে নিল রানা। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘লেটস গো।’

করিডর থেকে এলিভেটর পর্যন্ত রানার পাশে থাকল পল। ভাবভঙ্গিতে কোন রকম চাঞ্চল্য নেই, কিন্তু চারদিকটা তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিচ্ছে সে। এলিভেটরের দরজা খুলে গেল। ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটু সরে করিডরের দিকে মুখ করে দাঁড়াল সে। রানা চড়ল এলিভেটরে। এবার দু’পা পিছিয়ে পলও ঢুকল ভিতরে।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে থামল এলিভেটর। দরজা খুলে গেল। চট করে নেমে দ্রুত এদিক ওদিক দেখে নিল পল। তারপর একপাশে একটু সরে গিয়ে পথ করে দিল রানাকে। এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা রিসেপশন কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রানা। পিছনে ছায়ার মত চলেছে পল

কাউন্টারে স্যুইটের চাবি জমা দিল রানা, ট্রাভেলার্স চেক ভাঙিয়ে বিল মেটাল। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা পরিচিত, তাই শুধু পেশাদারী ভদ্রতার খাতিরে নয়, আন্তরিকতার সাথে ব্যক্তিগত দু’একটা কুশল প্রশ্ন করল। এই ফাঁকে নিভে যাওয়া পাইপে অগ্নিসংযোগ করল রানা। ‘রোম থেকে?’ মেয়েটার প্রশ্নের উত্তরে বলল ঠিক নেই তারপর কোথায় যাব। চরকির মত ঘুরে বেড়ানোই তো আমার কাজ তিনদিন আগে এখান থেকে ফোন করে এয়ার ফ্রান্সের রোম ফ্লাইটের টিকেট বুক করেছে রানার জন্যে পল। আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল পলের, ভাবল রানা। ঘুরে দাঁড়াল ও। দরজার দিকে এগোল। নিজের ভুলটা ধরতে পেরে পল মন খারাপ করে ফেলেছে, মুখ দেখে বুঝতে পারল ও। মৃদু হেসে বলল, ‘যা হবার হয়েছে, ও নিয়ে ভেব না। তবে, আরও সাবধান হতে হবে আমাদের।’

দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল পল। পোর্টার পিরোকে যেখানে রেখে গিয়েছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে সে। নিঃশব্দে হাত নেড়ে তাকে সরে যেতে বলল, পল। চোখে শ্যেনের দৃষ্টি, চারপাশের সবকিছু দেখে নিচ্ছে। গাড়ির পাশে থামল সে। ব্যাক সীটের দরজা খুলে ধরল।

পাইপ টানতে টানতে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল রানা। হোটেলের মস্ত কংক্রিটের উঠানে ছায়া নেমে এসেছে। সাদা দেয়ালের শেষ মাথায়, প্রায় একশো ফিট উপরে, হলুদ রঙের পোঁচের মত দেখা যাচ্ছে বেলা শেষের রোদ। গাড়িতে উঠে বসল রানা। প্যারিসবাসীদের দিনটা আজ বড়ই কষ্টে কেটেছে, ভাবল ও। এত গরম অনেকদিন নাকি পড়েনি।

ড্রাইভিং সীটে উঠে বসেছে পল। স্টার্ট দিয়ে ছেড়ে দিল ও লম্বা কালো ডি-এস নাইনটিন স্টিন। সাতটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট এখন।

এভিনিউ দ্য ম্যারিগ্নি-এ পড়ল গাড়ি। পথের দু’পাশে সারিসারি নারকেল গাছ। সমতল, পরিষ্কার প্রশস্ত রাস্তা। ফুটপাথ নেই, তাই পথচারী বিশেষ চোখে পড়ছে না। সামনে অসংখ্য গাড়ি। ভিউমিররে তাকাল পল। পিছনেও তাই। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সামনে তাকাল আবার।

নারকেল গাছের আড়াল থেকে কালো ডি-এস নাইনটিন সিট্রনকে দেখতে পেয়েই শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল হোন্ডা ফাইভ হানড্রেড স্পোর্টস মডেল মোটর সাইকেলে বসা লোকটার। দ্রুত রিস্টওয়াচ দেখল সে। আপন মনে মাথা নাড়ল লোকটা, ঠিক সময়ই রওনা হয়েছে মাসুদ রানা। ঝট্ করে তাকাল আবার। মাত্র বিশ গজ সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে স্ট্রিন। দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করল সে। তারপর স্টার্ট দিল মোটর সাইকেলে। সাদা ক্র্যাশ হেলমেটটা নেড়েচেড়ে ঠিকমত বসিয়ে নিল মাথায়। সরু পথটা দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে উঠে এল রাস্তায়। অনুসরণ করতে শুরু করল কালো সিট্রনকে।

আজ শনিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে শহর ছেড়ে প্যারিসবাসীরা পালাচ্ছে সৈকতের দিকে, অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা পরিবেশের লোভে। রাস্তায় যানবাহনের এত ভিড় সেজন্যেই। সন্দেহের উদ্রেক না করে স্ট্রিনকে অনুসরণ করতে কোন অসুবিধেই হচ্ছে না মোটর সাইক্লিস্টের।

গাড়ির স্পীড বাড়াল পল। পন্ট আলেকজান্ডার থ্রী-র দিকে তীর বেগে ছুটছে এখন। ব্রিজ পেরিয়ে এভিনিউ জেনারেল গ্যালিনি, তারপর চওড়া বুলেভার্ড দ্য ইনভ্যালিডে পড়ল ট্রিন। এই পর্যন্ত অনুসরণ করেই মোটর সাইক্লিস্টের যা জানার দরকার ছিল জানা হয়ে গেল। বুলেভার্ড দ্য ইনভ্যালিড আর রু দ্য ভারেনেস-এর মুখে পৌঁছে মোটর সাইকেলের স্পীড কমিয়ে আনল সে। ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড় করাল দু’চাকার শক্তিশালী গাড়িটাকে। লাফ দিয়ে নেমেই হন হন করে হেঁটে এগিয়ে গেল একটা কাফের দিকে।

কাফেতে ঢুকে সোজা পিছন দিকে চলে গেল লোকটা। টেলিফোন বুদটা এদিকেই। স্থানীয় একটা নাম্বারে ডায়াল করছে সে এখন।

.

মিউডন। শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে জায়গাটা। একটা কাফেতে বসে মস্ত ভুঁড়িতে হাত বুলাচ্ছে প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরি। লক্ষণটা ভাল নয়, কাফের বয়-বেয়ারা, ম্যানেজার, এমন কি কিছু খদ্দেরদেরও জানা আছে ব্যাপারটা। কুমতলব থাকলে, অথবা সাংঘাতিক কোন ব্যাপারে উদ্বিগ্ন বোধ করলে, বা কারও উপর প্রচণ্ড রাগ হলেই শুধুমাত্র ভুঁড়িতে হাত বুলায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরি। নিয়মিত খদ্দেররা তাই কেটে পড়েছে, আর বয়-বেয়ারারা পারতপক্ষে এদিকে বড় একটা ঘেঁষছে না।

মাঝে মধ্যে বিয়ারের গ্লাসটা তুলে চুমুক দিচ্ছে জাঁ থেরি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে না, শুধু কান দুটো সজাগ হয়ে আছে তার। ফোনের বেল বেজে উঠতেই লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়ল সে।

ক্র্যাডল থেকে রিসিভার তুলল বারম্যান। কানে ঠেকিয়ে এক মুহূর্ত শুনল, তারপর লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে ডাকার জন্যে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে গিয়েই অপ্রতিভ হলো সে। জাঁ থেরি এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে কাউন্টারের সামনে। প্রায় ছোঁ মেরে কেড়ে নিল সে রিসিভারটা। সেটা কানে না ঠেকিয়ে কটমট করে তাকিয়ে থাকল বারম্যানের দিকে। তাড়াতাড়ি বারের অপর প্রান্তে চলে গিয়ে টেলিভিশন সেটটা অ্যাডজাস্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বারম্যান।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড অপরপ্রান্তের বক্তব্য শুনল লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরি। বলল, ‘বেশ ভাল, ধন্যবাদ।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল সে। বিয়ারের বিল আগেই পরিশোধ করেছে। সোজা হেঁটে বেরিয়ে এল কাফের বাইরে।

পেভমেন্টে পৌঁছে থামল জাঁ থেরি। বগলের তলা থেকে ভাঁজ করা একটা খবরের কাগজ বের করল। এবং অত্যন্ত সাবধানে দু’বার ভাঁজ খুলল সেটার।

রাস্তার অপর পারে ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি। জানালার বাইরে মুখ বের করে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের কাগজের ভাঁজ খোলাটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল একটা মেয়ে। সড়াৎ করে মাথাটা ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে জানালার পর্দা ফেলে দিল সে। ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকাল অপেক্ষারত বারোজন ডানপিটে চেহারার লোকের দিকে। ‘রুট নাম্বার টু ধরে এয়ারপোর্টে যাচ্ছে মাসুদ রানা,’ এক নিঃশ্বাসে বলল মেয়েটা।

বারোজনের মধ্যে পাঁচজনের বয়স অল্প, আঠারো থেকে তেইশের মধ্যে। খুন- খারাবিতে এরা এখনও নতুন হলেও, সাহসের দিক থেকে একেকজন বয়স্কদের কয়েকগুণ। চেয়ারে বসে ছটফট করছিল এতক্ষণ, মেয়েটার কথা শেষ হতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল একসাথে পাঁচজন।M

বাকি সাতজন অপেক্ষাকৃত বয়স্ক। এরা কেউ ওদের মত নার্ভাস হয়ে পড়েনি। এই ষড়যন্ত্রকে সাফল্যমণ্ডিত করার দায়িত্বে সিনিয়রদের মধ্যে রয়েছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ খেরির পরই, সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড, লেফটেন্যান্ট (প্রাক্তন) ডে লা পেত্রো। লোকটা বেঁটে। গোটা মাথা জুড়ে টাক।

কামরার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লোক জর্জ আঁতিন। বয়স পঁয়ত্রিশ। কাঁধ দুটো মস্ত, চারকোনা চোয়াল। ইউনিয়ন কর্সের একটা স্তম্ভ বলে মনে করা হয় তাকে। ডান চোখের মণিটা অপেক্ষাকৃত ছোট বলে আদর করে তাকে ট্যারা বলে ডাকা হয়।

কামরা থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে খিড়কী দরজার দিকে ছুটছে বারোজনের দলটা। দরজার কাছ থেকে সামান্য দূরে ছয়টা গাড়ি অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে। এর প্রত্যেকটি হয় চুরি, নয়তো বেনামে ভাড়া করা। ছুটে গিয়ে ওরা সবাই টপাটপ উঠে পড়ল গাড়িগুলোতে।

সাতটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরি নিজেই তিনটে দিন কঠোর পরিশ্রম করে প্ল্যানটাকে সাজিয়েছে। তার প্রথম কাজ ছিল অ্যামবুশের জায়গা নির্বাচন। সেটা খুব সহজেই বেছে নেয়া গেল। তারপরই শুরু হলো কঠিন ঝামেলার কাজগুলো। কোন্ অ্যাঙ্গেলে গুলিবর্ষণ করতে হবে এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত চলমান গাড়ির দূরত্ব আর গতির উপর। গাড়িটা কত দূরে থাকবে তাও মোটামুটি নিখুঁতভাবে আন্দাজ করা গেল। কিন্তু গতি কি হবে তা জানতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে ওদেরকে। রানাকে ছেড়ে ওর শিষ্য আঁদ্রে পল সম্পর্কে সম্ভাব্য তথ্য যোগাড় করতে হয়েছে জাঁ থেরিকেশ অবশ্য পরিশ্রমটা একেবারে বৃথা যায়নি। আঁদ্রের একটা বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পেরে লাভবানই হয়েছে সে। ফাঁকা রাস্তায় ঘণ্টায় ষাট মাইলের কমে গাড়ি চালায় না আঁদ্রে পল। গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় আনুমানিক ষাট মাইল ধরেই প্রয়োজনীয় হিসেব করা হয়েছে। তার পরের সমস্যা, গাড়িটাকে থামানো। এই কাজে ফায়ার পাওয়ারের ডিগ্রী কি হবে তাও হিসেব করে বের করে নিয়েছে জাঁ থেরি। কোন কাজে খুঁত রাখা তার স্বভাবে নেই, সেজন্যেই এত বড় দায়িত্বটা চাপানো হয়েছে তারই কাঁধে।

অ্যামবুশের জায়গা হিসেবে এভিনিউ দ্য লা লিবারেশনকে বেছে নিয়েছে সে। দীর্ঘ সরল রেখার মত সোজা রাস্তাটা। এই রাস্তাটাই এগিয়ে গিয়ে মিলিত হয়েছে শহরতলি পেটি-ক্লামার্টের প্রধান ক্রস-রোডগুলোর সাথে।

প্ল্যানটা সাজিয়েছে সে এই ভাবে:

লক্ষ্যভেদে অব্যর্থ রাইফেলধারী কিছু লোক সহ প্রথম দলটি গুলি বর্ষণ শুরু করবে গাড়ির উপর, গাড়িটা ক্রস-রোডগুলোর দুশো গজ এদিকে থাকতেই। রাস্তার ধারে প্রকাণ্ড একটা বেডফোর্ড ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকবে, দলটা সেটার পিছনে গা ঢাকা দিয়ে গুলিবর্ষণের ইঙ্গিতের জন্যে অপেক্ষা করবে। প্রত্যেককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে অগ্রসরমান গাড়ির দিকে খুব নিচু অ্যাঙ্গেলে গুলি ছুঁড়তে হবে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল জা থৈরির ক্যালকুলেশন অনুযায়ী বেডফোর্ড ভ্যানের পাশে সিট্রন পৌঁছবার আগেই একশো পঞ্চাশটা বুলেট গাড়ির ভিতর দিয়ে বেরিয়ে যাবে। মাসুদ রানা স্ট্রিনের ফ্রন্ট সীটে বা ব্যাক সীটে যেখানেই বসুক, কিছু আসে যায় না, কম করেও ডজনখানেক বুলেট আহত করবে তাকে। তাছাড়া, সিট্রন তো দাঁড়িয়ে পড়বেই।

সাবধানতা অবলম্বনে জাঁ থেরির জুড়ি ত্রিভুবনে নেই। এত কিছুর পরও খানিক দূরের একটা সাইড রোডে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে সে দ্বিতীয় দলটাকে। কয়েকশো দুর্লঙ্ঘ্য বাধা টপকে স্ট্রিন যদি ছুটে পালাবার চেষ্টা করে সফল হয়, তখন এই দ্বিতীয় দলটা গলিমুখ থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এসে পথরোধ করবে সিট্রনের, গাড়ি দিয়ে গাড়ি ঠেকাবে। গাড়িতে আরেকজন থাকবে, তার কাজ ক্লোজ রেঞ্জ থেকে রানাকে আহত করা। অবশ্য, তার কোন দরকার হবে না, জানে সে। প্রথম অ্যামবুশ থেকে রেহাই পাবার কোন আশা স্ট্রিনের নেই।

মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই গোটা প্ল্যানটা সফল হবে, সাথে সাথে আহত রানাকে নিয়ে ছুটে যাবে সবাই পিছন দিকের একটা সাইড রোডে। সেখানে ওদেরকে বুকে তুলে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেবার জন্যে অপেক্ষা করছে তিনটে গাড়ি। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরিকে নিয়ে দুটো দলের সর্বমোট জনসংখ্যা তেরোয় দাঁড়াল। সিগন্যাল দেয়ার গুরু দায়িত্বটা নিজের হাতে রেখেছে জাঁ থেরি।

আটটা বেজে পাঁচ মিনিট। যার যার পজিশনে পৌঁছে গেছে গ্রুপ দুটো। প্ৰথম গ্রুপটার কাছ থেকে একশো গজ পিছিয়ে একটা বাসস্ট্যান্ডের পাশে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে জাঁ থেরি।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল খবরের কাগজ নেড়ে সিগন্যাল দেবে প্রথম কমান্ডো লীডার সার্জেন্ট (প্রাক্তন) বেনেকে। বেডফোর্ড ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। রাইফেলধারীদেরকে সে-ই গুলি বর্ষণের অর্ডার দেবে। তার পায়ের কাছে ঘাসের উপর এক সারিতে শুয়ে আছে তারা।

দ্বিতীয় কমান্ডো দলে মাত্র দু’জন রয়েছে। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ডেলা পেত্রো এবং বৃষস্কন্ধ জর্জ আঁতিন। দু’জনই দুশো লোকের সমান। যদি প্রয়োজন হয় নিজেদের গাড়িটাকে চালিয়ে সিট্রনের সামনে চলে যাবে তারা। গাড়িটা চালাবে ডেলা পেত্রো। পাশে সাব-মেশিনগান হাতে তৈরি থাকবে জর্জ আঁতিন।

.

মধ্য প্যারিস পিছনে ফেলে শহরতলি পেটি-ক্লামার্টের প্রায় যানবাহনহীন রাস্তায় উঠে এসে গাড়ির স্পীড আরও বাড়িয়ে দিল আঁদ্রে পল। ঘণ্টায় এখন প্রায় ষাট মাইল স্পীড।

ঠিক আটটা বেজে সতেরো মিনিটে পেটি-ক্লামার্টের একটা রাস্তা, এভিনিউ দ্য লা ডিভিশন লেক্লার্কে স্টিন প্রবেশ করল সত্তর মাইল স্পীডে

ওদিকে এক মাইল সামনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাঁ থেরি নিজের মস্ত একটা ভুল বুঝতে পেরে মনে মনে হায় হায় করছে। অ্যামবুশের সময় নির্ধারণ করার জন্যে হাতের কাছে পাওয়া একটা পঞ্জিকার সাহায্য নিয়েছে সে। তাতে পরিষ্কার লেখা আছে আগস্ট মাসের বাইশ তারিখে সন্ধ্যা নামে আটটা পঁয়ত্রিশে। মাসুদ রানার ফ্লাইট আটটা চল্লিশে, এটা জানা থাকায় সিগন্যাল দেবার জন্যে লাইটার বা টর্চ ব্যবহার করার কথা ভাবেনি সে, কেননা ফ্লাইট ধরার জন্যে এই রাস্তা দিয়ে রানা যখন যাবে তখন দিনের আলো থাকার কথা।

কিন্তু নেই। আটটা দশেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

ভুলটা কোথায় হয়েছে বুঝতে পারছে জাঁ থেরি। হাতের কাছে যে পঞ্জিকাটি ছিল, সেটা এ-বছরের নয়, সম্ভবত গত বছরের।

ভুল যা হবার হয়ে গেছে, এখন তা আর শোধরাবার নয়। আটটা বেজে আঠারো মিনিটের সময় জাঁ থেরি দুটো হেডলাইট দেখতে পেল। এভিনিউ দ্য লা লিবারেশন ধরে সত্তর মাইল বেগে তার দিকে ছুটে আসছে। আবছাভাবে গাড়িটাকে কালো স্ট্রিন বলে মনে হলো তার। যেন বিদ্যুতের ধাক্কা খেয়ে কেঁপে উঠল সে, উন্মত্তের মত হাতের কাগজটা নেড়ে সিগন্যাল দিল। শরীরের কাঁপুনিটা থামছে না তার। সার্জেন্ট বেনেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না সে, তার মানে সার্জেন্ট বেনেও তাকে দেখতে পাচ্ছে না। আশঙ্কায় ধড়াস ধড়াস করে বুকের ভিতর লাফাচ্ছে হৃৎপিন্টা

একশো গজ দূরে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রাগে ফুলছে সার্জেন্ট বেনে। গলাটাকে লম্বা করে দিয়ে দূরের বাসস্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়ানো জাঁ থেরির অস্পষ্ট মূর্তিটাকে আরও ভালভাবে লক্ষ করতে চেষ্টা করছে সে। কিন্তু সন্ধ্যার ঘন ছায়ায় কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। ‘কর্নেল কি সিগন্যাল দিলেন, নাকি চোখের ভুল?’ কাউকে নয়, আপন মনে প্রশ্নটা করল সে। প্রস্তুতির কোন সুযোগ পেল না বেচারা, হঠাৎ করেই দেখল দুটো হেডলাইট তীরবেগে বাসস্ট্যান্ডের পাশ ঘেঁষে ছুটে আসছে। হকচকিয়ে গিয়ে আরও দু’তিন সেকেন্ড দেরি করে ফেলল সার্জেন্ট বেনে, তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘ফায়ার!’

স্ট্রিন তখন একবারে সামনে চলে এসেছে, গুলিবর্ষণ শুরু হলো। নব্বই ডিগ্ৰী কোণ থেকে সত্তর মাইল বেগে ধাবমান একটা গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলি করছে ওরা। এক্ষেত্রে লক্ষ্য ভেদ করা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। কিন্তু সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করল ওরা। বারোটা বুলেট আঘাত করল ট্রিনকে। প্রায় সবগুলোই পিছন থেকে ছুটে এসে লাগল গাড়ির গায়ে। দুটো টায়ার ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ভিতরে সেলফ-সিলিং টিউব থাকলেও আচমকা প্রেশার কমে যাওয়ায় ধাবমান গাড়িটা কাত হয়ে গেল একদিকে, সেই সাথে সামনের চাকা পিছলাতে শুরু করেছে। এই চরম সঙ্কটে মাথা ঠাণ্ডা রেখে অদ্ভুত নৈপুণ্য দেখান আঁদ্রে পল। আশ্চর্য মনোবল লোকটার, থামল না, দক্ষ হাতে চালিয়ে নিয়ে চলল টালমাটাল গাড়িটাকে।

কর্সিকানদের একজন যখন স্ট্রিনের টায়ার ফুটো করছে, বাকিরা তখন পলায়নপর গাড়ির পিছনের জানালায় গুলি ছুঁড়ছে। কয়েকটা বুলেট গাড়িটার ধাতব আচ্ছাদন ফুটো করে ঢুকল ভিতরে। একটা বুলেট জানালার কাঁচ চুরমার করে দিয়ে ঢুকে পড়ল, বেরিয়ে গেল সিলিং ফুটো করে, সিকি ইঞ্চির জন্যে ছুঁতে পারেনি রানার নাকের চকচকে ডগাটা।

প্রথম গুলির শব্দ শুনেই পিছন দিকে মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল আঁদ্রে পল, ‘গেট ডাউন!’

‘যা ভেবেছিলাম!’ বিদ্যুৎবেগে শোল্ডার হোলস্টার থেকে অটোমেটিক পিস্তলটা বের করে পিছন দিকে তাকিয়েছিল রানা। এমনি সময়ে বিন্‌ন্‌ শব্দে বাতাস কেটে নাকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট।

ফাস্ট-মোশন ছায়াছবির মত ঘটে যাচ্ছে সব। রানাকে সাবধান করে দিয়েই শোল্ডার হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করে ফেলেছে পল। একহাতে ধরা স্টিয়ারিং হুইলটা পোষ মানছে না কোনমতে, অবিরাম গা ঝাড়া দিচ্ছে। বাঁ দিকে বিপজ্জনক ভাবে পিছলাতে শুরু করল গাড়িটা, যে কোন মুহূর্তে উল্টে যেতে পারে। খুবই ধীরে যেদিকে স্কিড করছে সেই দিকে হুইল ঘুরাল খানিকটা, সেই সাথে আস্তে করে চাপ বাড়াচ্ছে অ্যাকসিলারেটর পেডালের উপর। আরও কিছুটা পিছলে বাঁ পাশে সরল স্ট্রিন, তারপর সামলে নিল যেন অনেকটা অলৌকিক ক্ষমতা বলে। রিভলভারটা কোলের উপর ফেলে দু’হাত দিয়ে স্টিয়ারিং হুইল ধরল পল বাঁক ঘুরেই আবার তুফানের মত ছুটতে শুরু করল গাড়ি। সামনে ইন্টার-সেকশন। সাইড রোড এভিনিউ দ্য বয়-র পাশ ঘেঁষে যাবে পল। ইউনিয়ন কর্সের দ্বিতীয় কমান্ডো দল ওখানে অপেক্ষা করছে।

এভিনিউ দ্য বয়।

গলি মুখে স্টার্ট দেয়া গাড়িতে বসে আছে ডেলা পেত্রো এবং জর্জ আঁতিন। বিদ্যুৎবেগে স্টিনকে ছুটে আসতে দেখে হকচকিয়ে গেল ওরা। কথা ছিল গলিমুখ থেকে বেরিয়ে স্ট্রিনের পথ রোধ করবে, কিন্তু তা করতে গেলে ধাক্কা খেয়ে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবে ওদের গাড়ি। হাতে সাব-মেশিনগান নিয়ে সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে আঁতিন, জানালা দিয়ে কোমর পর্যন্ত গাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে সে।

চোখের পলকে কাছে চলে এসেছে স্ট্রিন। সাব-মেশিনগানের নল ঘুরিয়ে গুলি করছে সে। সাঁ করে বেরিয়ে গেল ট্রিন, একটা বুলেটও স্পর্শ করতে পারল না গাড়িটাকে।

বাঁক নিয়ে তুমুল গতিতে একটানা ছুটে যাচ্ছে স্ট্রিন। ভিউমিররে একবারের বেশি তাকাল না আঁদ্রে পল। একটা বোতাম টিপে ওয়্যারলেস সেটটা অন করল সে। রানা এজেন্সীকে ঘটনাটার কথা জানিয়ে ছোট্ট একটা নির্দেশ দিল। তারপর অফ করল সেটটা।

গাড়ির ভিতর জমাট নিস্তব্ধতা। ব্যাক সীটে হেলান দিয়ে বসে আছে রানা। থমথম করছে মুখের চেহারা। ঠোঁট জোড়া চেপে আছে পরস্পরের সাথে। হাতে এখন পিস্তলের জায়গায় টোবাকো পাইপ। কিন্তু আগুন ধরাবার কথা ভুলে বসে আছে।

কম কথার মানুষ আঁদ্রে পল চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। ঠাণ্ডা মেজাজের লোক সে, কিন্তু এখন চেহারা দেখে মনে হচ্ছে চাপা আক্রোশে ছটফট করছে তার ভিতরটা।

সোজা এয়ারপোর্ট টারম্যাকের এক ধারে গিয়ে থামল স্ট্রিন। সাথে সাথে চারদিক থেকে দশ পনেরো জন স্বাস্থ্যবান, সুবেশ, তীক্ষ্ণ চেহারার লোক দ্রুত এগিয়ে এসে ঘিরে ফেলল গাড়িটাকে। এরা সবাই রানা এজেন্সীর প্যারিস শাখার কর্মী।

দরজা খুলে যেতে গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হলো রানা। চেহারায় সেই থমথমে ভাব কোথায় উধাও হয়ে গেছে। মৃদু হাসি ওর মুখে। নামার সময় কোলের উপর জমে থাকা একগাদা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল টারম্যাকে।

‘মাসুদ ভাই আপনি….

একসাথে অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা চারদিক থেকে উচ্চকিত হয়ে উঠল। হাত তুলল রানা। অমনি চুপ হয়ে গেল সবাই। পরমুহূর্তে বিস্ময়ে হতভম্ব করে দিল সবাইকে রানা। এইমাত্র যে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটে গেল সে বিষয়ে নয়, সামনে যাকে দেখছে তাকেই ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে একে একে সবার কুশল জেনে নিচ্ছে ও।

বিস্ময়ের ভাবটা কাটিয়ে উঠতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল ওদের। তারপর সবাই প্রতিবাদের সুরে মুখ খুলল। কিন্তু রানা কথা বলতে যাচ্ছে দেখে নিজেরাই আবার চুপ করে গেল!

‘হ্যাঁ,’ বলল রানা, ‘এইবার নিয়ে পাঁচবার হলো। এবার এর একটা বিহিত না করলেই নয়, এ ব্যাপারে তোমাদের সাথে আমি একমত।’ তারপর মুচকি হেসে একটু রসিকতা করল; ‘যাই বলো, সোজাসুজি গুলি ছুঁড়তে পারে না ওরা।’ রিস্টওয়াচ দেখল রানা। ব্যস্ত ভাবে বলল, ‘পরে সব জানতে পারবে। ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে।

কথা শেষ করে এগোল রানা। সরে গিয়ে পথ করে দিল ওরা। কিন্তু দাঁড়িয়ে রইল না কেউ। রানাকে ঘিরে রেখে কাস্টমস-এর শেডের দিকে এগোচ্ছে সবাই। রানার পাশেই রয়েছে আঁদ্রে পল। তার কাঁধে একটা হাত রাখল রানা। বলল, ‘ধন্যবাদ, পল, আজ তোমার জায়গায় আর কেউ গাড়ি চালালে কি হত বলা যায় না।’

অদম্য আবেগে শরীরটা শিরশিরিয়ে উঠল আঁদ্রে পলের। মশিয়ে রানার কাছে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলল সে। চোখে তার পানি এসে গেছে।