নিম্নোক্ত কাব্যগ্রন্থগুলি সাজানো হয়নি

সেই উপত্যকায়

করতলে ভয়ার্ত এক পাখি নিয়ে
পড়ি-মরি ক’রে আমি পালিয়ে এসেছিলাম
বিশাল সেই উপত্যকা থেকে।
একদা আমার পর্যটনের কোনো এক পর্যায়ে
হঠাৎ পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই উপত্যকায়,
যেখানে বসবাস করে একই মাপের
হাজার হাজার মানুষ।
সেখানে পৌঁছেই মনে হয়েছিল
কী চমৎকার নিসর্গশোভা। এমন নতুন সবুজ
আমি কখনো দেখিনি,
শুনিনি পাখির এমন মধুর গান। আগে
এখানে কেন আসিনি, এই আক্ষেপ
আমাকে ভয়ানক কাতর করেছিল, বলা যায়।
সেখানকার বাসিন্দাদের গায়ের রঙ
আরশোলার রঙের মতো, শালিখের চোখ যেন
বসিয়ে দেয়া হয়েছে ওদের চোখে।
ওদের সবার পরনে একই ধরনের পোশাক
ওরা সবাই কথা বলে অভিন্ন কায়দায়,
ওদের তাকানোর ভঙ্গি হুবহু এক এবং
একজনের হাসি থেকে অন্যজনের হাসি
আলাদা কিছু নয়।

এক এলাহি ঘন্টা ওদের শাসন করে
প্রহরে প্রহরে। দল বেঁধে ওরা
নির্ধারিত সময়ে এক সঙ্গে খায় দায়, একই রকম
বিছানায় শুতে যায়,
ভোরবেলা সবাই বিছানা ছাড়ে ঠিক একই সময়ে। সেখানে
পান থেকে চুন খসে না কখনো।
অতিকায় সেই ঘন্টার শাসন
আমাকে বেঁধে ফেলতে চাইতো
আষ্টেপৃষ্ঠে।
ঢং ঢং ঘন্টা বাজলেই খাবার টেবিলে
সবার সঙ্গে এক কাতারে বসা
আমার ধাতে নেই।
গাছগাছালি আর নক্ষত্রপুঞ্জকে উপেক্ষা ক’রে
একটা মস্ত হলঘরে সবার সঙ্গে গাদাগাদি ক’রে
নির্ধারিত সময়ে
চোখের পাতা বন্ধ করা আমার পক্ষে মুশকিল।

সেখানে দিন কাটতে চায় না, রাত চায় না পোহাতে।
বরাবর খুব বেলা করে ওঠা আমার অভ্যাসঃ কোনো নির্দেশে
সেই অভ্যাস আমি ছাড়তে পারিনি, আর
আমার নিজস্ব পোশাক আশাকও আমি পাল্টাইনি।

ওরা সবাই যখন একই সময়ে একই ধরনে হাসতো,
তখন বিষণ্নতা দখল করতো আমাকে।
যখন ওরা অদ্ভুত ব্যায়ামের ভঙ্গিতে
একই জায়গায় কদম চালাতো
আমি তখন শুয়ে শুয়ে পাখির ওড়াউড়ি
দেখতে চেষ্টা করতাম, ভাবতাম-
কী করে একচক্ষু নিয়মের ঊর্ণাজাল থেকে
মুক্তি পাবে আমার বন্দী সত্তা?

সত্যি বলতে কি, ওরা আমাকে নিয়ে
বেশ ফাঁপরে পড়েছিল।
নিয়ম-না-মানা লোকটাকে নিয়ে কী করবে, ওরা
দীর্ঘদিন সে বিষয়ে মনস্থির করতে পারেনি।
গোল টেবিল বৈঠক হলো বারবার,
অবিশ্যি তর্কের তুফান ওঠেনি কোনো;
কেননা, সেখানে সবাই সকল বিষয়ে নিখাদ একমত।
বিশেষ্ণগণ দামি মাথা নেড়ে নেড়ে
বললেন, ‘লোকটার মগজের কোষে আছে এক
খাপছাড়া তন্তুজাল এবং সেটাই
সকল এলেবেলে ব্যাপারের উৎস।
অস্ত্রোপচার ক’রে সেটি উপড়ে ফেললেই
অন্ধতাকে সে আর বলবে না দৃষ্টিহীনতা,
শস্যহীনতাকে বলবে না দুর্ভিক্ষ,
আকাশের তারা কিংবা জোনাকির স্ফুরণ
দেখার জন্যে সে রাত জাগবে না কখনো,
রহস্য বনদেবীর মতো ওর কাছ ঘেঁষে হেঁটে যাবে,
অথচ সে এতটুকু শিহরিত হবে না;
আমাদের মতের উজানে কস্মিনকালেও কাটবে না সাঁতার।

দৈবদয়ায়
সেই অস্ত্রোপচারের নির্ধারিত দিনের আগেই
করতলে ভয়ার্ত এক পাখি নিয়ে
পড়ি-মরি ক’রে পালিয়ে আসতে পেরেছিলাম
সেই উপত্যকা থেকে।
ঠিক কীভাবে সম্ভব হয়েছিল
আমার এই পলায়ন, বলতে পারবো না।
তবে এতকাল পরেও মাঝে-মাঝে
সেই উপত্যকা আমার স্মৃতিতে
নড়ে ওঠে জল-আলোড়নকারী হাঙরের মতো।