সৃষ্টির ধারা
আমাদের দেহ সসীম, মজ্জা সসীম, তাই জ্ঞানও সসীম। অসীম ও অনন্তকে আমরা কল্পনা করিতে পারি না। যেহেতু জীবনের যত সব কারবার আমাদের সসীমকে লইয়া। সসীম কল্পনায়ই আমরা অভ্যস্ত। পরম বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলিয়াছেন, “বিশ্ব সসীম অথচ অসীম”। মহাসমুদ্রের মাঝে দাঁড়াইয়া চাহিলে সমুদ্রকে মনে হয় অসীম। কিন্তু যে দ্বীপে বা জাহাজে দাঁড়াইয়া দেখা যায়, তাহাকে দেখা যায় সসীম। সেইরূপ গ্রহ-নক্ষত্র বা নীহারিকা জগতও সসীম। কিন্তু বিশ্ব সসীম নহে। বিশ্ব যেমন সীমাহীন, তেমনি আদি ও অন্তহীন। অনন্ত বিশ্বসাগরে গ্রহ, তারা ও নীহারিকাগুলি যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ মাত্র। ইহাদেরই আছে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়। বিজ্ঞানীগণ ইহাদেরই সৃষ্টি বিষয়ে আলোচনা করিয়া থাকেন, বিশ্ব সম্বন্ধে নহে। বিশ্বের সৃষ্টি ও প্রলয় অর্থাৎ আদি ও অন্ত নাই, আছে শুধু স্থিতি।
সৃষ্টিতত্ত্ব নির্ণয়ের ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে সামান্য মতভেদ আছে। সেই মতভেদ উপেক্ষা করিয়া আমরা উহাদের মধ্যে বহুজন স্বীকৃত মতবাদ-এর ভিত্তিতে সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনা করিব। বলা বাহুল্য যে, বিজ্ঞানীদের সকলের সকল মতবাদের মূল একই, অর্থাৎ বস্তুবাদ।
বিজ্ঞানীদের মতে –বর্ণনাতীত কালে অনন্ত বিশ্বের সর্বত্র বিরাজ করিত নিরাকার এক শক্তি বা তেজ। কালক্রমে তেজশক্তি রূপান্তরিত হয় তড়িৎশক্তিতে, যাহার পরিবাহক ইলেকট্রন প্রোটনাদি শক্তিকণিকা। ইহারা সম্পূর্ণ নিরাকার নহে এবং সাকারও নহে। ইহারা সাকার ও নিরাকারের মাঝামাঝি অর্থাৎ ইহারা পদার্থও নহে এবং অপদার্থও নহে। ইহারা সতত চঞ্চল ও গতিশীল।
কালক্রমে মহাশূন্যে ঐ সকল শক্তিকণিকা সংহত হয়, অর্থাৎ বিভিন্ন সংখ্যায় জোড় বাধিয়া যায়। ইহাতে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ধরণের পরমাণুর। ইহারাও চঞ্চল ও গতিশীল। এই পরমাণুময় জগতটিই নীহারিকা জগত।
হয়তো অনেকেই দেখিয়া থাকিবেন যে, জলা মাঠের কর্দম শুকাইতে থাকিলে মাটিতে ফাটল ধরে। কিন্তু কেন ধরে? জলসহ কাদামাটির যে আয়তন থাকে, মাটিস্থ জল বাষ্প হইয়া উড়িয়া যাওয়ায় তাহার সে আয়তন থাকে না, কমিয়া যায়। কিন্তু মাঠের পরিধি কমে না। অর্থাৎ মাঠের প্রান্তসীমা ঠিকই থাকিয়া যায়। কাজেই ফাটলের মাধ্যমে জলের ঐ ঘাটতি পূরণ হয়। পক্ষান্তরে ইতস্তত ফাটলের যোগাযোগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষেত্র উৎপন্ন হয় এবং ক্ষেত্রগুলির আকৃতিতে মোটামুটি সাদৃশ্য থাকে। কিন্তু আয়তন হয় বিভিন্ন।
উক্তরূপ — অখণ্ড নীহারিকা জগতের ইলেকট্রন ও প্রোটনাদি পরস্পর জোড় বাধিয়া সংহত হওয়ার ফলে হাইড্রোজেনাদি বায়বীয় পদার্থের সৃষ্টি হয় এবং ইহাতে নীহারিকার আয়তন কমিবার দরুন স্থানে স্থানে ফাটলের সৃষ্টি হয়। ইহার ফলে অখণ্ড নীহারিকা জগত বহু খণ্ডে বিভক্ত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন নীহারিকার উদ্ভব হয়।
কালক্রমে অন্যান্য মৌলিক পদার্থের ভারি পরমাণুগুলির সৃষ্টি হয় এবং খণ্ডিত নীহারিকার আয়তন আরো কমিতে থাকে। ইহার ফলে পরমাণুদের নৈকট্য বৃদ্ধি পায় এবং পরস্পর সংঘর্ষের ফলে নীহারিকা রাজ্যে সৃষ্টি হয় তাপ-এর।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হইলেও পরমাণুর গঠন সম্বন্ধে এইখানে কিছু বলা আবশ্যক মনে করি। পরমাণুদের গঠনোপাদান প্রধানত ইলেকট্রন ও প্রোটন; কিছু নিউট্রন, পজিট্রন, নিউট্রিনো এবং মিসোটুনও থাকে। কিন্তু উহারা এলোমেলোভাবে থাকে না, থাকে সুসংবদ্ধভাবে। পরমাণুর কেন্দ্রে। থাকে পজিটিভ বিদ্যুযুক্ত প্রোটন এবং বাহিরের বৃত্তাকার কক্ষে ভ্রমণ করে নেগেটিভ বিদ্যুৎযুক্ত ইলেকট্রন। ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যার উপর নির্ভর করে যাবতীয় মৌলিক পদার্থের রূপায়ণ। বাহিরে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে ভ্রমণরত ইলেকট্রনের সংখ্যা থাকে যত, কেন্দ্রে প্রোটনের সংখ্যা থাকে তত।
হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে একটি প্রোটন ও বাহিরের কক্ষে থাকে একটি মাত্র ইলেকট্রন। তাই বিশ্বের যাবতীয় পদার্থের মধ্যে হাইড্রোজেনই বেশি হাল্কা। এই রকম ইলেকট্রন বা প্রোটনের সংখ্যা হিলিয়ামে ২, লিথিয়ামে ৩, বেরিলিয়ামে ৪; বরাবর যাইয়া সোনায় সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৯, পারদে ৮০, ইউরেনিয়ামে ৯২ এবং নোবেলিয়ামে ১০২। এক একটি পরমাণু যেন এক একটি ছোট সৌরজগত। সূর্যকে কেন্দ্রে রাখিয়া যেমন গ্রহগণ ঘুরিতেছে, প্রোটনকে কেন্দ্রে রাখিয়া তেমন ইলেকট্রনরা প্রতি সেকেণ্ডে ১৩০০ মাইল বেগে ঘুরিতেছে।
একটি জলপূর্ণ পাত্রে কয়েক টুকরা শোলা বা অনুরূপ কিছু ঘুরাইয়া জলের উপর আলাদা আলাদাভাবে ছাড়িয়া দিলে দেখা যায় যে, উহারা জলের উপর ভাসিয়া পৃথক পৃথক ঘুরিতে থাকে এবং কোনো কৌশলে উহাদের পরস্পরকে সংলগ্ন করিয়া রাখিলে দেখা যায় যে, উহারা পৃথক থাকিয়া যে পাকে ঘুরিতেছিল, সমবেতভাবে এখন সেই একই পাকে ঘুরিতেছে। উক্তরূপ ঘূর্ণায়মান গতিবিশিষ্ট ইলেকট্রনে গঠিত পরমাণুরা হয় ঘূর্ণিগতিশীল এবং পরমাণুগঠিত নীহারিকারাজিও হয় ঘূর্ণায়মান ও গতিশীল।
কালক্রমে নীহারিকারাজি তাহাদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে আয়তনে ছোট হইতে থাকে এবং উহাতে তাহাদের তাপ ও ঘূর্ণিবেগ বৃদ্ধি পাইতে থাকে। এইভাবে নীহারিকার তাপবৃদ্ধি হইয়া কয়েক লক্ষ বা কোটি ডিগ্রী হইলে উহারা হইয়া দাঁড়ায় এক একটি নক্ষত্র। তবে সকল নক্ষত্র সমান তাপ ও আয়তন বিশিষ্ট হয় না, উহাতে যথেষ্ট পার্থক্য থাকে।
প্রজ্জ্বলিত বাষ্পীয়দেহধারী নক্ষত্র বা সূর্যের আবর্তনবেগ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাইলে উহাদের কেন্দ্ৰাপসারণী শক্তির (centrifugal force) প্রভাবে নিরক্ষদেশ স্ফীত হইতে থাকে এবং মেরুদেশ চাপিয়া যায়। ক্রমসকোচনের ফলে কেন্দ্ৰাপসারণী শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং নিরক্ষদেশ হইতে অভগুরীয় আকারে খানিকটা অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। বিচ্ছিন্ন অংশও দূরে যাইয়া আবর্তিত হইতে থাকে এবং পরে উহাই হইয়া দাঁড়ায় এক একটি গ্রহ।
আমাদের সৌরজগতটিও একটি খণ্ড নীহারিকা মাত্র। ইহার আবর্তনবেগে (মতান্তরে অন্য কোনো নক্ষত্রের আকর্ষণে) ক্রমশ ১১টি অঙ্গুরীয় খসিয়া ১১টি গ্রহের সৃষ্টি হইয়াছে। এই এগারোটি গ্রহের মধ্যে একটি আমাদের এই পৃথিবী এবং অপর গ্রহসমূহ –বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো, পসিডন ও ভালকান (ইহাদের বিষয় পরে আলোচিত হইবে)। আমাদের সৌরজগতের ব্যাস প্রায় ৭৩৪ কোটি মাইল।
জ্বলন্ত সূর্যের বাষ্পীয় দেহ হইতে জন্ম লইবার সময় পৃথিবীও জ্বলন্ত দেহধারী ছিল এবং পৃথিবীর তাপমাত্রাও সূর্যের তাপমাত্রার সমান ছিল। বিশেষত আয়তনেও বর্তমানের তুলনায় বহুগুণ বড় ছিল। কালক্রমে তাপ ত্যাগ করিয়া পৃথিবীর দেহ সঙ্কুচিত হইতে থাকে এবং ভারি ধাতুর পরমাণুগুলি বায়বীয় অবস্থা ত্যাগ করিয়া তরল অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। যে সকল ধাতু অপেক্ষাকৃত ভারি, তাহা পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে এবং অপেক্ষাকৃত হাল্কা ধাতু-পদার্থগুলি উপরে থাকিয়া ভিন্ন ভিন্ন স্তরে সজ্জিত হয়।
ভূবিজ্ঞানীরা বলেন যে, ভূগর্ভে প্রধান স্তর তিনটি। প্রথম –ভূ-কেন্দ্র হইতে ‘তরল ধাতু স্তর’ ২২০০ মাইল, ইহার আপেক্ষিক গুরুত্ব (জলের তুলনায়) প্রায় ১১; দ্বিতীয়– ‘নমনীয় ব্যাসল্ট স্তর’ ১৮০০ মাইল, ইহার আপেক্ষিক গুরুত্ব ২.৮৬; তৃতীয় –‘কঠিন গ্রানাইট স্তর ৩০ মাইল, ইহার আপেক্ষিক গুরুত্ব ২.৬৫। পৃথিবীর যাবতীয় পদার্থের গড় আপেক্ষিক গুরুত্ব ৫.৫২।[১০]
বর্তমানে ভূপৃষ্ঠের গড় উত্তাপ প্রায় ৬৮° ফারেনহাইট বা ২০° সেন্টিগ্রেড। কিন্তু ভূগর্ভের ৩০ মাইল নিচের উত্তাপ প্রায় ১২০০° সে. এবং কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা ৬০০০° সে.। ইহা সূর্যের বহিরাবরণের তাপের সমান।[১১]
পৃথিবী সূর্যের প্রজ্জ্বলিত বাষ্পীয় দেহের স্খলিত অংশ হইতে জন্ম লইয়া ক্রমশ তাপ ত্যাগ করিয়া শীতল ও সঙ্কুচিত হইতে থাকে এবং ইহার ফলে পৃথিবীর আবর্তন (rotation) বেগ বৃদ্ধি পাইতে থাকে। আবর্তন বেগ বৃদ্ধির ফলে নিরক্ষদেশ স্ফীত ও মেরুদেশ চাপা হইতে থাকে। নিরক্ষদেশ অতিমাত্রায় স্ফীত হইলে, স্ফীত অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া (মতান্তরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গ্রানাইট স্তরের খানিকটা অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া) যায় এবং তাহা হইতে চন্দ্রের জন্ম হয়।
“কোনো গোলকের ব্যাস বা পরিধি এবং আপেক্ষিক গুরুত্ব জানা থাকিলে, উহার ওজন নির্ণয় করা সম্ভব।” এই সূত্রটি অনুসারে বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর ওজন নির্ণয় করিয়াছেন। উহা টনের হিসাবে লিখিতে হইলে ৬-এর ডানে ২১টি শূন্য বসাইতে হয়।
যথা –৬,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০, ০০০,০০০ টন।[১২]
পৃথিবীর পরিধি প্রায় ২৫ হাজার মাইল এবং ভূপৃষ্ঠের মোট আয়তন ১৯.৬৯ কোটি বর্গমাইল। ইহার মধ্যে জলভাগ ১৩.৯৪ এবং স্থলভাগ ৫.৭৫ কোটি বর্গমাইল। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের শতকরা ৭০.৭৮ ভাগ জল ও ২৯.২২ ভাগ স্থল।
কতিপয় ফল শুকাইলে যেমন তাহার পৃষ্ঠদেশ কুঁচকাইয়া যায়, অর্থাৎ উঁচুনিচু হইয়া নানাবিধ ভাঁজ পড়ে, তেমন পৃথিবী ক্রমশ শীতল ও সঙ্কুচিত হইয়া ভূপৃষ্ঠের গ্রানাইট স্তরে ভাঁজ পড়ে। কথাটি আর একটু পরিষ্কার করিয়া বলি।
মনে করা যাক, একটি ফলের ত্বকের পরিধি হইল ৬ ইঞ্চি এবং তাহার মাংসল অংশের পরিধি ৫ ইঞ্চি। ঐ ফলটি শুকাইয়া তাহার মাংসল অংশের পরিধি হইল ৪ ইঞ্চি। কিন্তু উহার ত্বকের পরিধি বিশেষ কমিল না। এমতাবস্থায় ফলটির মাংসল অংশের সহিত সমতা রাখিয়া উহার একাংশে ১ ইঞ্চি ভাজ পড়িবে। হয়তো উহার ২ ইঞ্চি উঁচু ও ২ ইঞ্চি নিচু হইয়া ভাজ পড়িবে। ভঁজের রকম ও সংখ্যা যতই হউক না কেন, উহাদের যোগফল হইবে ১ ইঞ্চি।
এককালে পৃথিবীর অবস্থাও ঐরূপই হইয়াছিল। তাপ ত্যাগ করিয়া ভূগর্ভস্থ তরল পদার্থ যে পরিমাণ সঙ্কুচিত হইল, বাহিরের ত্বকাংশ (কঠিন গ্রানাইট স্তর) সেই অনুপাতে সঙ্কুচিত হইতে না পারায় উহাতে ভঁজের সৃষ্টি হইল। ইহাতে ভূপৃষ্ঠের কোথায়ও উঁচু এবং কোথায়ও নিচু হইল ও কিছুটা সমতল থাকিল। বলা বাহুল্য যে, উঁচু স্থানগুলি পর্বত, নিচু স্থানগুলি সমুদ্রগহবর এবং অবশিষ্টভাগ সমতল ভূমি হইল।
ভূবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, কোনো পর্বতই চিরকাল স্থায়ী থাকে না। পদার্থের ক্ষয় বা রূপান্তর অনিবার্য। তাপ, আলো ও বায়ুর প্রভাবে কঠিন প্রস্তর, এমনকি লৌহেরও রূপান্তর ঘটে। পর্বতের প্রস্তরাদি নিয়ত ক্ষয় হইয়া নানা উপায়ে উহা সমুদ্রে পতিত হয় ও সমুদ্রকে ভরাট করিতে থাকে। ইহার ফলে পর্বতের উচ্চতা এবং সমুদ্রের গভীরতা কমিয়া কালক্রমে ভূপৃষ্ঠ প্রায় সমতলে পরিণত হয়। পৃথিবীর ক্রমিক সঙ্কোচনের ফলে কালক্রমে আবার নূতন ভাজ পড়িতে আরম্ভ করে এবং পুনঃ পর্বত ও সাগরের সৃষ্টি হয়।
এক একবার পাহাড়াদির সৃষ্টি ও বিলয়কে বলা হয় এক একটি বিপ্লব। প্রতিটি বিপ্লবের ব্যাপ্তিকাল কোটি কোটি বৎসর। সৃষ্টির পর পৃথিবীতে এইভাবে পর্বতাদির সৃষ্টি ও বিলয় হইয়াছে দশবার। ইহার মধ্যে জীব সৃষ্টির পূর্বে ছয়বার এবং পরে চারিবার বিপ্লব ঘটিয়াছে। সর্বশেষ বিপ্লব অর্থাৎ বর্তমান বিপ্লবটি শুরু হইয়াছে প্রায় ৭ কোটি বৎসর আগে। তাই আধুনিক সাগর ও পাহাড়গুলির বয়স সাত কোটি বৎসরের কিছু কম। ভূবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, বর্তমান বিপ্লবটি। এখনও শেষ হয় নাই অর্থাৎ পর্বতাদি এখনও বৃদ্ধি পাইতেছে। তবে উহা পাঁচ-দশ হাজার বৎসরে নজরে পড়ে না।
পৃথিবীর যাবতীয় সাগর ও পাহাড়ের পরিমাণ প্রায় সমান। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতের উচ্চতা প্রায় ৫ মাইল এবং গভীরতম সমুদ্রের গভীরতাও প্রায় ৫ মাইল।
হাল্কা-পরমাণুঘটিত পদার্থগুলি ভারি-পরমাণুঘটিত পদার্থের সহিত সমান তালে জমাট বাঁধিতে পারে না। ভূপৃষ্ঠে পর্বতাদি সৃষ্টির সময় পর্যন্ত হাইড্রোজেনাদি হাল্কা বায়বীয় পদার্থগুলি জমাট বাধিতে পারে নাই। অতঃপর পৃথিবীর তাপ আরও কমিলে বায়বীয় পদার্থ জমিতে আরম্ভ করে। ২টি হাইড্রোজেন ও ১টি অক্সিজেন পরমাণু যুক্ত হইয়া জলের অণুর সৃষ্টি হয় এবং কালক্রমে আকাশের তাপ আরও কমিলে জলের অণুগুলি সংযুক্ত হইয়া বৃষ্টির আকারে ভূপতিত। হয় এবং উহা নিচু গহ্বরগুলিতে আশ্রয় লইলে সাগরাদির সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর সমস্ত জলের আয়তন ১৫০ কোটি ঘনকিলোমিটার।
মৌলিক পদার্থগুলির অধিকাংশই বায়বীয় অবস্থা ত্যাগ করিয়া কঠিন ও তরল আকারে পৃথিবীতে আশ্রয় লইলে, অবশিষ্ট নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, আর্গন, নিয়ন, ক্রিপ্টন, হিলিয়াম, ওজন, জেনন ইত্যাদি বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়া সৃষ্টি হয় বাতাসের।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪০০ কোটি বৎসর। কোনোও মতে ৫০০ কোটি বৎসর। সৃষ্টির আদিতে পৃথিবীর আবর্তন (rotation) কাল ছিল ৪ ঘণ্টা এবং চন্দ্র ছিল মাত্র ৮ হাজার মাইল দূরে। উহা কালক্রমে বৃদ্ধি পাইয়া বর্তমানে পৃথিবীর আবর্তনকাল হইয়াছে ২৪ ঘণ্টা এবং চন্দ্র গিয়াছে প্রায় ২৩৯ হাজার মাইল দূরে। পৃথিবীর আবর্তনকাল এবং চন্দ্রের দূরত্ব এখনও বাড়িতেছে। প্রতি একশত বৎসরে চন্দ্র ৫ ইঞ্চি দূরে সরিয়া যায় এবং ১২০ হাজার বৎসরে পৃথিবীর দিন এক সেকেণ্ড বাড়ে।[১৩]
বর্তমানে পৃথিবীর মেরুরেখা ২৩ ১/২ ডিগ্রী হেলিয়া আছে। কিন্তু ইহা চিরকাল একই রূপ থাকে।, বাড়ে ও কমে। এই বাড়া ও কমা একবার শেষ হইতে প্রায় ৪০ হাজার বৎসর সময় লাগে। এই মেরুরেখা পরিবর্তনের জন্য প্রতি ২৬ হাজার বৎসর পর পর পৃথিবীতে শীত ঋতুতে গ্রীষ্ম ঋতু এবং গ্রীষ্ম ঋতুতে শীত ঋতু আসে।
বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথ ডিম্বাকার। কিন্তু ইহা চিরকাল একই আকৃতিতে থাকে না, কখনও গোল এবং কখনও ডিম্বাকার হয়। এইরূপ কক্ষপথের একবার আকার পরিবর্তনে সময় লাগে ৬০ হাজার হইতে ১২০ হাজার বৎসর।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, পৃথিবীর বর্তমান গড় উত্তাপ ৬৮° ফা.। কিন্তু ইহা চিরকাল একই মাত্রায় থাকে না, কোনো কোনো সময় অতিমাত্রায় কমিয়া যায়। এই সময়কে বলা হয় হিমযুগ। একলক্ষ বৎসরেরও কম সময় পর পর এক একটি হিমযুগ আসে। বর্তমান কালের হিমযুগটি গিয়াছে ৩০ হাজার বৎসর আগে এবং আগামী ৭০ হাজার বৎসরের মধ্যে আর একবার হিমযুগ আসিবে।[১৪]
হিমযুগের আগমনে পৃথিবীতে বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে। হিমযুগে পৃথিবীর স্থলভাগের অধিকাংশ জায়গাই তুষারে ঢাকা পড়ে, তাই ঐ সব জায়গার উদ্ভিদাদি বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। বৃক্ষারোহী জন্তুরা সমতল ভূমিতে নামিয়া আসিতে বাধ্য হয় এবং তুষারাবৃত জায়গার বাসিন্দারা কেহ অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে চলিয়া যায়, কেহ গুহাবাসী হইয়া হিমকে গা-সহা করিয়া লয়; আর যাহারা উহার একটিও পারে না, তাহারা মারা পড়ে। যাহারা বাঁচিয়া থাকে, আবহাওয়া ও দেশ পরিবর্তনের ফলে তাহাদের আকৃতি ও প্রকৃতির পরিবর্তন হইয়া অনেক নূতন জীবের উদ্ভব হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে খননকার্যের দ্বারা যে সকল জীবাশ্ম পাওয়া গিয়াছে, জীববিজ্ঞানীগণ তাহা পর্যবেক্ষণ পূর্বক জানিতে পারিয়াছেন যে, কোনো কোনো অঞ্চলে হিমযুগের পূর্ববর্তী বহু জন্তু লুপ্ত হইয়া গিয়াছে এবং হিমযুগের পূর্বে যে সব অঞ্চলে কোনো জীবের বসতি ছিল না, হিমযুগোত্তর কালে সেখানে কোনো কোনো জীবের বসবাস আরম্ভ হইয়াছে এবং অনেক অভিনব জীবের আবির্ভাব হইয়াছে। তাহারা আরও বলেন যে, বিগত হিমযুগে মানুষের বৃক্ষচারী পূর্বপুরুষগণ বৃক্ষশাখা ত্যাগ করিয়া গুহাবাস শুরু করিয়াছিল।
আর দুইটি মাত্র কথা বলিয়া এই আলোচনা শেষ করিব।
১. বিজ্ঞানের কতগুলি সিদ্ধান্ত আজগুবি ও অসম্ভব বলিয়া কাহারও মনে হইতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানের কোনো সিদ্ধান্তই আজগুবি নহে, প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তের পিছনে একাধিক প্রমাণ ও যুক্তি আছে। স্থানাভাবে এইখানে যুক্তি-প্রমাণের কোনোরূপ ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় নাই। বিজ্ঞানের বিবিধ পুস্তকে উহার সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যাইতে পারে।
২. বিজ্ঞানে শেষ বলিয়া কিছু নাই। আজ যাহা সত্য বলিয়া গৃহীত হইল, ভবিষ্যতে তাহা মিথ্যা প্রমাণিত হইতে পারে এবং আজ যেখানে শেষ বলিয়া মনে হয়, তারপর আরও থাকিতে পারে; বিজ্ঞান এই সম্ভাবনাটিকে মানিয়া চলে। আর এইটিই বিজ্ঞানের বিশেষত্ব। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দূরবীক্ষণাদি যন্ত্র আবিষ্কারের সাথে সাথে বিশ্বের দৃষ্টিগোচর আকার ও আয়তন দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে। কাজেই অত্রপুস্তকের আলোচনাসমূহে যে সীমা ও সংখ্যা ব্যবহার করা হইল, ভবিষ্যতে তাহার পরিবর্তন অসম্ভব নহে।
————
১০. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ৫০।
১১. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ৬০,৬১।
১২ পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ১৩৬।
১৩. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ৫, ৬, ২৮।
১৪. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ১৮১-১৮৪।