আমাদিগের এই মাসিক পত্রখানি অতি ক্ষুদ্র। এত ক্ষুদ্র পত্রের একটা বিস্তারিত মুখবন্ধ লেখা কতকটা অসঙ্গত বোধ হয়। বড় বড় এবং ভাল ভাল এত মাসিক পত্র থাকিতে আবার একখানি এমন ক্ষুদ্র পত্র কেন? সেই কথা বলিবার জন্যই এই সূচনাটুকু আমরা লিখিলাম।
এ কথা কতকটা আমরা বিজ্ঞাপনেই বলিয়াছি। পৃথিবীতে হিমালয়ও আছে, বল্মীকও আছে। সমুদ্রে জাহাজও আছে, ডিঙ্গীও আছে। তবে ডিঙ্গীর এই গুণ, জাহাজ সব স্থানে চলে না, ডিঙ্গী সব স্থানে চলে। যেখানে জাহাজ চলে না, আমরা সেইখানে ডিঙ্গী চালাইব। চড়ায় ঠেকিয়া বঙ্গদর্শন—জাহাজ বান্চাল হইয়া গেল—প্রচার ডিঙ্গী, এ হাঁটু জলেও নির্বিঘ্নে ভাসিয়া যাইবে ভরসা আছে।
দেখ, ইউরোপীয় এক একখানি সাময়িক পত্র, আমাদের দেশের এক একখানি পুরাণ বা উপপুরাণের তুল্য আকার;—দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, গভীরতা এবং গাম্ভীর্য কল্পান্তজীবী মার্কণ্ডেয় বা অষ্টাদশ পুরাণ-প্রণেতা বেদব্যাসেরই আয়ত্ত বলিয়া বোধ হয়। আমরা যদি মনে করিতে পরিতাম যে, রাবণ কুম্ভকর্ণ মেগেজিন পড়িতেন, তাহা হইলে তাঁহারা কণ্টেম্পোরারি বা নাইণ্টীন্থ সেঞ্চুরি পড়িতেন সন্দেহ নাই। ইউরোপে বা লঙ্কায় সে সব সম্ভবে, ক্ষুদ্র-প্রাণ বাঙ্গালীর দেশে, সে সকল সম্ভবে না। ক্ষুদ্র-প্রাণ বাঙ্গালী বড় অধ্যয়নপর হইলেও ছয় ফর্মা সুপার-রয়ল মাসে মাসে পাইলে পরিতোষ লাভ করে। তাহাতেও ইহা দেখি যে, মাসে মাসে অল্পলোকই ছয় ফর্মা সুপার-রয়ল আয়ত্ত করিতে পারেন। যাহাদিগকে শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রম করিয়া দিনপাত করিতে হয়, অর্থচিন্তায় এবং সংসারের জ্বালায় শশব্যস্ত, মহাজনের তাড়নায় বিব্রত,—এক মাসে ছয় ফর্মা পড়া তাঁহারা বিড়ম্বনা মনে করেন। তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই টাকা দিয়া বা না দিয়া ছয় ফর্মার মাসিক পত্র লইয়া দুই এক বার চক্ষু বুলাইয়া তক্তপোষের উপর ফেলিয়া রাখেন। তারপর সেই জ্ঞানবুদ্ধিবিদ্যারসপূর্ণ মাসিক পত্রখণ্ড ক্রমে ক্রমে গড়াইতে গড়াইতে তক্তপোষের নীচে পড়িয়া যায়। স্রুয়মান দীপতৈল তাহাকে নিষিক্ত করিতে থাকে। বুভুক্ষু পিপীলিকা জাতি তদুপরি বিহার করিতে থাকে। এবং পরিশেষে বালকেরা তাহা অধিকৃত করিয়া কাটিয়া, ছাঁটিয়া, ল্যাজ বাঁধিয়া দিয়া ঘুড়ী করিয়া উড়াইয়া দেয়;—হেম বাবু, রবীন্দ্রবাবু, নবীন বাবুর কবিতা, দ্বিজেন্দ্র বাবু, যোগেন্দ্র বাবুর দর্শনশাস্ত্র; বঙ্কিম বাবুর উপন্যাস, চন্দ্র বাবুর সমালোচনা, কালীপ্রসন্ন বাবুর চিন্তা সূত্রবদ্ধ হইয়া পবনপথে উত্থানপূর্বক বালকমণ্ডলীর নয়নানন্দ বর্ধন করিতে থাকে। আর যে খণ্ড সৌভাগ্যশালী হইয়া অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিল, তাহার ত কথাই নাই। উনন ধরান, মশলা বাঁধা, মোছা, মাজা, ঘষা প্রভৃতি নানাবিধ সাংসারিক কার্যে নিযুক্ত হইয়া, সে পত্র নিজ সাময়িক জীবন চরিতার্থ করে। এমন হইতে পারে যে, ইহা সাময়িক পত্রের পক্ষে সদ্গতি বটে, এবং ছয় ফর্মার স্থানে তিনি ফর্মার আদেশ করিয়া ‘প্রচার’ যে গত্যন্তর প্রাপ্ত হইবেন, এমন বোধ হয় না; গত্যন্তরও বেণের দোকান ভিন্ন আর কিছু দেখা যায় না। তবে তিন ফর্মায় এই ভরসা করা যাইতে পারে যে, ছেলের ঘুড়ী হইবার আগে, বাপের পড়া হইতে পারে; এবং পাকশালের কার্যনির্বাহে প্রেরিত হইবার পূর্বে গৃহিণীদিগের সহিত প্রচারের কিছু সদালাপ হইতে পারে।
তারপর টাকার কথা। বৎসরে তিন টাকা অতি অল্প টাকা—অথচ সাময়িক পত্রের অধিকারী ও কার্যাধ্যক্ষগণের নিকট শুনিতে পাই যে, তাহাও আদায় হয় না। সাহিত্যানুরাগী বাঙ্গালীরা যে স্বভাবতঃ শঠ বঞ্চক এবং প্রতারক, ইচ্ছাপূর্বক সাময়িক পত্রের মূল্য ফাঁকি দেন, ইহা আমাদিগের বিশ্বাস হয় না, সুতরাং আমরা ইহাই সিদ্ধান্ত করিয়াছি যে, তিন টাকাও সাধারণ বাঙ্গালী পাঠকের ক্ষমতাতীত। সকলের তিন টাকা জোটে না, এই জন্য দেন না, দিতে পারেন না বলিয়াই দেন না। যাঁহারা তিন টাকা দিতে পারেন না, তাঁহারা দেড় টাকা দিতে পারিবেন এমত বিবেচনা করিয়া, আমরা এই নূতন সাময়িক পত্র প্রকাশ করিলাম।
অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, যদি লোক পড়েই না, টাকাই দেয় না, তবে এত ভস্মরাশির উপর আবার এ নূতন ছাইমুঠা ঢালিবার প্রয়োজন কি? সাময়িক সাহিত্য যদি আমরা ছাই ভস্মের মধ্যে গণনা করিতাম, তাহা হইলে অবশ্য আমরা এ কার্যে হাত দিতাম না। আমাদের বিবেচনায় সভ্যতা-বৃদ্ধির এবং জ্ঞানবিস্তারের সাময়িক সাহিত্য একটি প্রধান উপায়। যে সকল জ্ঞানগর্ভ এবং মনুষ্যের উন্নতিসাধক তত্ত্ব, দুষ্প্রাপ্য, দুর্বোধ্য এবং বহু পরিশ্রমে অধ্যয়নীয় গ্রন্থ সকলে, সাগর-গর্ভ-নিহিত রত্নের ন্যায় লুক্কায়িত থাকে, তাহা সাময়িক সাহিত্যের সাহায্যে সাধারণ সমীপে অনায়াসলভ্য হইয়া সুপরিচিত হয়। এমন কি, সাময়িক পত্র যদি যথাবিধি সম্পাদিত হয়, তাহা হইলে সাময়িক পত্রের সাধারণ পাঠকের অন্য কোন গ্রন্থ পড়িবার বিশেষ প্রয়োজন থাকে না। আর সাময়িক পত্রের সমকালিক লেখক ও ভাবুকদিগের মনে যে সকল নূতন তত্ত্ব আবির্ভূত হয়, তাহা সমাজে প্রচারিত করিবার সাময়িক পত্রই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। তাহা না থাকিলে লেখক ও ভাবুকদিগকে প্রত্যেককে এক একখানি নূতন গ্রন্থ প্রচার করিতে হয়। বহু সংখ্যক গ্রন্থ সাধারণ পাঠক কর্তৃক সংগৃহীত এবং অধীত হইবার সম্ভাবনা নাই। অতএব সাময়িক পত্রই প্রাচীন জ্ঞান এবং নূতন ভাব উভয় প্রচারপক্ষেই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। এই জন্যেই আমরা সর্ব-সাধারণ-সুলভ সাময়িক পত্রের প্রচারে ব্রতী হইয়াছি। আমাদের অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় যে, এই সময়ে, “নবজীবন” নামে অত্যুৎকৃষ্ট উচ্চদরের সাময়িক পত্রের প্রকাশ আরম্ভ হইয়াছে। আমরা সেই মহদ্দৃষ্টান্তের অনুগামী হইয়া এই ব্রত পালন করিতে যত্ন করিব। ‘সত্য, ধর্ম’ এবং ‘আনন্দের’ প্রচারের জন্যই আমরা এই সুলভ পত্র প্রচার করিলাম এবং সেই জন্যই ইহার নাম দিলাম “প্রচার।”
যখন সর্বসাধারণের জন্য আমরা পত্র প্রচার করিতেছি, তখন অবশ্য ইহা আমাদিগের উদ্দেশ্য যে, প্রচারের প্রবন্ধগুলি সর্বসাধারণের বোধগম্য হয়। আমাদিগের পূর্ববর্তী সম্পাদকেরা এ বিষয়ে কত দূর মনোযোগী হইয়াছিলেন, তাহা বলিতে পারি না—আমাদের এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ থাকিবে ইহা বলিতে পারি। কাজটি কঠিন, কৃতকার্য হইতে পারিব, এমন ভরসা অতি অল্প। তবে সাধারণপাঠ্য বলিয়া আমরা বালকপাঠ্য প্রবন্ধ ইহাতে সন্নিবেশিত করিব না। ভরসা করি, প্রচারে যাহা প্রকাশিত হইবে, তাহা অপণ্ডিত ও পণ্ডিত উভয়েরই আলোচনীয় হইবে। অনেকের বিশ্বাস আছে যে, যাহা অকৃতবিদ্য ব্যক্তি পড়িবে বা বুঝিবে বা শুনিবে, তাহা পণ্ডিতের পড়িবার বা বুঝিবার বা শুনিবার যোগ্য নয়। আমাদিগের এ বিষয়ে অনেক সংশয় আছে। আমরা দেখিয়াছি, মহাভারতের ব্যাখ্যা পণ্ডিতে ও মূর্খে তুল্য মনোভিনিবেশপূর্বক শুনিয়াছেন। ভিতরে সর্বত্রই মনুষ্য-প্রকৃতি এক। আমরা কিঞ্চিৎ জ্ঞানলাভ করিলে, অজ্ঞানীকে যতটা ঘৃণা করি, বোধ হয়, ততটার কোন উপযুক্ত কারণ নাই। অজ্ঞ এবং জ্ঞানী উভয়ে কান পাতিয়া শুনিতে পারেন আজকার দিনে এ বাঙ্গালা দেশে এমন অনেক বলিবার কথা আছে।
এ শিক্ষা শিখাইবে কে? এ পত্রের শিরোভাগে ত সম্পাদকের নাম নাই। থাকিবারও কোন প্রয়োজন দেখি না। সম্পাদক কে, পাঠকের জানিবারও কোন প্রয়োজন নাই; কেন না পাঠকেরা প্রবন্ধ পড়িবেন, সম্পাদককে পড়িবেন না। সম্পাদকের এমন কোন দাবি দাওয়া নাই যে, তিনি আত্মপরিচয় দিয়া পাঠকদিগের সম্মুখীন হইতে পারেন। তাঁহার কাজ, যাঁহারা বিদ্বান্, ভাবুক, রসজ্ঞ, লোকহিতৈষী এবং সুলেখক, তাঁহাদের লিখিত প্রবন্ধ সকল সংগ্রহ করিয়া পাঠকদিগকে উপহার প্রদান করেন। এ কাজ তিনি পারিবেন, এমন ভরসা করেন। আমরা মনুষ্যের নিকট সাহায্যের ভরসা পাইয়াছি। এক্ষণে যিনি মনুষ্যের জ্ঞানাতীত, যাঁহার নিকট মনুষ্যশ্রেষ্ঠও কীটাণুমাত্র, তাঁহার সাহায্যের প্রার্থনা করি। সকল সিদ্ধিই তাঁহার প্রসাদমাত্র এবং সকল অসিদ্ধি তাঁহার কৃত নিয়মলঙ্ঘনেরই ফল।
—‘প্রচার’, শ্রাবণ ১২৯১, পৃ. ১-৬।