সুলক্ষণা

সুলক্ষণা

পাঠক ধরে নেবেন না একটা গল্প লেখার তাগিদে বাইশ বছর বাদে শেষে হরির দুয়ারে এসে তার সঙ্গে হঠাৎ এভাবে দেখা হয়ে গেল। হরির দুয়ার বলতে হরিদ্বার। আর তার সঙ্গে মানে সুলক্ষণা দয়ালের সঙ্গে। খবরটা আমাকে দিয়েছিল ছেলেবেলার বন্ধু জয়ন্ত রঙ্গ। নতুন বয়সের কালে কোনো রাজনীতির দলে ভিড়েছিলাম। হালকা গোছের ব্যাপার সেটা। তবু উৎসাহ আর উদ্দীপনা কম ছিল না। জায়গাটা এলাহাবাদ। সর্ব ব্যাপারেই বেশ নিরাপদ গোছের পটভূমি। শাসক দলের সব কাজে প্রতিবাদের ঝড় তুললেও গর্দান যাবার ভয় ছিল না। এমন কি হাজত বাসের ঝুঁকিও যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতাম। বেকার জীবনের স্বল্পমেয়াদী শৌখিন রাজনীতির অধ্যায় বললে যতটুকু বোঝায়। যুক্তির থেকে তর্কের ঝোঁক বেশি ছিল। শোনার থেকে শোনানোর।

জয়ন্ত রঙ্গ সেই সময়ের আর সেই দলের অন্তরঙ্গ একজন। পেশার ক্ষেত্রে এখনো সতীর্থই বলা চলে তাকে। ইউ. পি-র এক নামী কাগজের হোমরাচোমরা সাংবাদিক। বছরে দু-একবার কলকাতায় আসে। তখন দেখা হয়। মন-খোলা গল্পও হয়। গেল মাসে এসেছিল। খবরের কাগজের মানুষ। প্রথমেই জোরদার খবর দেবার মতো করে বলল, মাঝে দিন কয়েকের জন্য হরদোয়ার বেড়াতে গেছলাম, সেখানে হর কী পিয়ারার ঘাটে হঠাৎ তোমার সুলক্ষণার সঙ্গে দেখা

কার কথা বলছে বা কি বলছে ভেবে না পেয়ে আমি অবাক একটু।আমার সুলক্ষণা। সে আবার কে?

চোখ পিটপিট করে জয়ন্ত বলল, ক্যা তাজ্জব কি বা–এলাহাবাদের সেই সুলক্ষণা দয়াল-কৃষ্ণকুমারের বোন-ভুলে গেলে? তোমার সেই ঝুমরি।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মগজের মধ্যে একটা ওলটপালট কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। যার ফলে তখনো বোধ হয় হাঁ করে চেয়েই ছিলাম ওর দিকে। এবারে হালছাড়া গলায় চোস্ত উর্দুতে জয়ন্ত রঙ্গ রসিকতা করে উঠল, কি রকম রসের কারবারী তুমি, যে মেয়ের মন পাবার জন্য আমাকে কাটতি দিয়ে গায়ে আতর মেখে দু বেলা কৃষ্ণকুমারের বাড়ি পলিটিক্স কপচাতে যেতে, আর হঠাৎ নিপাত্তা হয়ে যেতে যার। খোঁজে তামাম এলাহাবাদ চষে বেড়িয়ে শেষে আমার গলা চেপে ধরলে–সেই পহেলী চিড়িয়াকে বেমালুম ভুলে মেরে দিলে।

ভুলিনি। বিস্মরণের পলস্তরা পড়ে ছিল। শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাইশ বছরের একটা ভারী পর্দা চোখের সামনে থেকে সরে গেছে। এক বাড়ির মেয়ে পুরুষ ছেলে বুড়ো সক্কলের গায়ের চামড়া চোখে লাগার মতো ধপধপে ফর্সা। সকলের মধ্যে ব্যতিক্রম শুধু উনিশ-কুড়ি বছরের একটি মেয়ে। যার গায়ের রঙ ফর্সা নয়। তা বলে কালোও ঠিক নয়। কিন্তু বাড়ির লোকের পাশে কালোই দেখাতো। বাড়ির মানুষেরা তার গায়ের রং নিয়ে খুঁতখুঁত করত। কিন্তু সেই মেয়ের আয়তপক্ষ্ম নিবিড় কালো চোখের তারায় আমি যে আলো ঠিকরোতে দেখেছি, আর তার সুচারু দুই ঠোঁটের ফাঁকে যে অধরা হাসির ঝিলিক দেখেছি, এই খুঁতখুঁতুনির কথা শুনলে বাড়ির মানুষগুলোকে আমার অন্ধ মনে হত। কৃষ্ণকুমার অবশ্য বলত, ঝুমরির গায়ের রং একটু চাপা হলেও অমন রূপ কটা মেয়ের হয়। এরা সব মিথ্যে ভাবে, ওর খুব ভালো বিয়ে হবে আমি বলে দিলাম।

ঝুমরি বা সুলক্ষণা কৃষ্ণকুমারের মামাতো বোন। এ-বাড়ির সমাদরের আশ্রিতা। বছর দুই আগে কলেজে পড়ার নাম করে বাপের বাড়ির সংস্রব ছেড়ে এলাহাবাদে পিসির কাছে চলে এসেছিল। কলেজে পড়ছিলও। কিন্তু পড়াশুনায় তেমন মতি আছে। আমার মতো নীরব ভক্তও সে-কথা বলবে না। কৃষ্ণকুমার বলত, ঝুমরির মাথা খুব, একটু পড়লেই ভাল রেজাল্ট করতে পারে, কিন্তু পড়তে ডাকলেই ওর গায়ে জ্বর আসে

যেটুকু বলত তার থেকেও বেশি বিশ্বাস করতাম আমি। ঝুমরির মাথা খুব, বুদ্ধি ধ্ব। এত বুদ্ধি আর এত মাথা বলেই যেন ওর নিয়ম করে কৃষ্ণকুমারের কাছে বই। নিয়ে বসার দায়টাকে বড় কর্তব্য ভাবতাম না। ওর নাম সুলক্ষণা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবটকই যেন তাই। আবার সুলক্ষণার ভিতরটা যদি নদীর মতো খরস্রোতা হয় তাহলে ওই পোশাকী নাম ছেড়ে ঝুমরি নামটাই যেন সব থেকে মানায় ভাল। আমার চোখে ও আড়াল হলে সুলক্ষণা, সামনে এলে ঝুমরি।

বাড়ির লোকের অবিবেচনাপ্রসঙ্গে কৃষ্ণকুমার ওর রূপের কথা তুললে ঝুমরি মিটিমিটি হাসত আর আড়ে-আড়ে আমাকে লক্ষ্য করত। আমার মুখ থেকে নীরব সমর্থন ভিন্ন কোনো রকম মন্তব্য আশা করত না। দু-একটা কটাক্ষেই বুঝে নিত ভিতরে ভিতরে কতগুণ বেশি, সায় দিলাম। তারপর আরো বেশি মজা পেত যেন। চোখের তারায় আর ঠোঁটের ফাঁকের হাসির ছোঁয়াটুকু আরো তীক্ষ্ণ মনে হত, তখন। ফাঁক পেয়ে চাপা ঝাঝালো গলায় ঝিলিক তুলে একদিন আমাকে বলেছিল, আমার চেহারা নিয়ে কৃষ্ণদার তোমার কাছে মাথা ব্যথা কেন–আমাকে ভেতো বাঙালীর কাছে গছাবার মতলব নাকি!

জবাব হাতড়ে না পেয়ে হাসতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার বুকের তলায় যে ঝড় উঠেছিল সেও ওই মেয়ে ঠিকই আঁচ করেছিল মনে হয়।–

কৃষ্ণকুমারের মনে মুখে লাগাম নেই। ঝুমরির দুঃখের খবরও শুনিয়েছে আমাদের। আর একই প্রসঙ্গে নিজের মামারও রূঢ় সমালোচনা করেছে। মামার শিক্ষা-দীক্ষা আছে, কিন্তু স্বভাব-চরিত্র ভাল নয়। হৃদয় বলেও কিছু নেই। মামাটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে অকালে চোখ বুজেছে। বছর না ঘুরতে মামা একটা বাজে মেয়েছেলেকে বিয়ে করে ঘরে এনে তুলেছে। দুজনে মিলে মেয়েটাকে নির্যাতন করত। কিন্তু ঝুমরি মায়ের মতো মুখ বুজে সহ্য করার মেয়ে নয়। স্কুলের পরীক্ষা সারা হতেই এক জামাকাপড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। এলাহাবাদ থেকে খবর যেতে মারমুখী বাপ মেয়েকে শাসন করতে আর নিয়ে যেতে এসেছিল। সেই মামাকে কৃষ্ণকুমার বলতে গেলে ঘাড় ধাক্কা দিয়েই তাড়িয়েছে। রাজনীতিতে কৃষ্ণকুমার আমার থেকে অন্তত ঢের বেশি মাথা গলিয়েছিল। টানা ছমাস জেলও খেটেছে একবার। তাছাড়া তখনো কাল রোগে ধরেনি তাকে। নীতিগত ব্যাপারে সেই নরম-সরম মিষ্টি ছেলেটার এক ধরনের অনাপোস মেজাজ ছিল। গোঁ ছিল। ফলে আত্মীয় পরিজনেরা বেশ সমীহ করে চলত তাকে। মামা সেই যে প্রস্থান করেছে আর কোনোদিন মেয়ের খোঁজও নেয়নি।

জয়ন্ত রঙ্গ খুব মিথ্যে ঠাট্টা করেনি। সুলক্ষণাকে নিয়ে ওর সঙ্গে বেশ একটা রেষারেষি ছিল আমার। বলত, মনে ধরলেই বা ইউ. পি-র মেয়েকে নিয়ে বাঙালীবাবুর কি আশা! সুলক্ষণার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দেখলে সামনে চোখ পিটপিট করত, আড়ালে বিচ্ছিরি করে হাসত। রাজনীতির আলোচনায় গলা চড়ালেই টিপ্পনী। কাটত, ঝুমরি তো কাছেই বসে আছে, অত চেঁচিয়ে গলার শিরা ফোলানোর কি দরকার? ঝুমরির অনুপস্থিতিতে চুপ মেরে গেলেও জয়ন্ত হুল ফোঁটাতে ছাড়ত না। বলত, মেঘ দেখলে তবে ময়ুর নাচে। শ্ৰীমতী কাছে না থাকলে বাঙালীবাবুর। জিভ নড়ে না। কৃষ্ণকুমারকে চুপিচুপি একবার সতর্কও করে দিতে চেষ্টা করেছিল। শুনেছি। ঝুমরির ব্যাপারে আমার হাবভাব নাকি ভাল নয়। কৃষ্ণকুমার কানে তোলেনি। ঝুমরিকেই বলে দিয়েছিল। সে-কথা শুনে ঝুমরির কি রাগ। আমাকেই বলেছিল, ফাঁক পেলেই ও আমাকে কি জ্বালান জ্বালায় তোমরা তার খবর রাখো? কৃষ্ণদাকে বলি না বলে–

বললে খুশি হতাম। আমার হাবভাব যা-ই হোক তাতে কোনোরকম নোংরামি ছিল না। তবু এ-কথা ঠিক, আচমকা অতবড় একটা অঘটন ঘটে না গেলে ওই মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়ির লোকের সঙ্গে বড় রকমের কোনো বিদ্রোহের সূচনা হত কিনা বলা যায় না। ঝুমরিকে নিয়ে আমি সম্ভব অসম্ভব অনেক রকমের কল্পনার জালে জড়িয়ে পড়ছিলাম।

কৃষ্ণকুমারের ভবিষ্যৎবাণী ঠিক হয়নি। ঝুমরির ভালো বিয়ে হওয়া দূরে থাক, এ-ভাবে যে ও নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনতে পারে কেউ কল্পনাও করেনি। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই বিমূঢ় হয়ে গেছলাম আমরা। ও বাড়ির লোকেরাও। এ আশ্রয় ছেড়ে, বিশেষ করে কৃষ্ণকুমারের মায়া ছেড়ে হঠাৎ এক রাতে ও নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে–এমন অবিশ্বাস্য কাণ্ড কে ভাবতে পারে? কৃষ্ণকুমারের অবস্থা তখন ভাল নয়। কাল ব্যাধি। গলা দিয়ে প্রায়ই রক্ত ওঠে। ঝুমরির তার জন্য দুশ্চিন্তার। অন্ত ছিল না। কৃষ্ণকুমারের বাবা ছিলেন গোঁড়া কবিরাজ। নাম যশও ছিল। গোঁ ধরে ছেলের কবিরাজি চিকিৎসাই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মতে আয়ুর্বেদের ওপর আর কোনো চিকিৎসা নেই। কৃষ্ণকুমারও তাই মেনে নিয়েছিল কিনা জানি না। নিজের চিকিৎসা নিয়ে বাপের ওপর কখনো কথা বলেনি। কিন্তু আমরা বলতাম। ঘর ছাড়ার দিন কতক আগেও ঝুমরি আমাদের ওপরেই ফুঁসে উঠেছিল, কৃষ্ণদাকে তোমরা এখান থেকে নিয়ে চলে যেতে পারো না? অন্য চিকিৎসা করাতে পারো না? কৃষ্ণদা মরতে চলেছে দেখেও বুঝতে পারছ না?

 বুঝতে পেরেও আমরা কিছুই করিনি বা করতে পারিনি। কিন্তু ঝুমরি এ কি করল? তার কৃষ্ণদাকে পর্যন্ত এত বড় আঘাত দিয়ে চলে গেল! শোনার পরেও ও সত্যি কারো সঙ্গে স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে চলে গেছে এ কিছুতে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না। ক্ষেপে গিয়ে কৃষ্ণকুমারের বাবা বার বার বলেছে, রক্তের দোষ। রক্তের দোষ যাবে কোথায়! বাপ যেমন মেয়ে তেমন। কৃষ্ণকুমারের মা বেচারীর লজ্জায় আর অপমানে মাথা নীচু। রক্তের দোষ বললে তারও লাগার কথা। নিজের ভাইয়ের মেয়ে, রক্তের যোগ তার সঙ্গেও আছে। ঝুমরির খোঁজে আমার ছোটাছুটি আর হয়রানি দেখে কৃষ্ণকুমারও শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়েই বলেছে, কোথাও পাবে না, যেখানেই যাক ও নিজের ইচ্ছেতেই গেছে। শুনে আমি দমে গেছি, কিন্তু বিশ্বাস হয়নি। ঝুমরির মধ্যে কোনো মন্দের ছিটেফোঁটাও আছে ভাবতে পারতাম না। হাসি-খুশি বুদ্ধিমতী মেয়েটা প্রয়োজনে তীক্ষ্ণ হতে পারে, কঠিন হতে পারে, সেটা বুঝতে পারতাম। বাপের কারণে হোক বা যে-কারণেই হোক ওর ভিতরটা যে খুব সুস্থির নয় তাও অনুভব করতে পারতাম। কিন্তু তা বলে ঝুমরির এমন মতি হবে, কৃষ্ণকুমার বললেও মন সেটা মেনে নিতে চায়নি। উল্টে বরং মনে হয়েছে বিপাকে পড়ে ঝুমরি হয়তো আমাকেই সব থেকে বেশি স্মরণ করছে। আমি আছি বলেই হয়ত তার উদ্ধারের প্রত্যাশা।

ফলে কৃষ্ণকুমার যা বলেছে সেটা আমাকে বিচলিত করলেও মনের সায় মেলেনি। সন্দেহটা প্রথমে যার ওপর ঘোরালো হয়ে উঠেছিল সে এই জয়ন্ত রঙ্গ। ও যে রসিকতা করল তা অবশ্য করিনি। গলায় হাত দিইনি। তবে তার দিক থেকে গলদ কিছু থাকলে গলা যে কাটা যাবেই হাবভাবে সেটা ওকে ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। বড়লোকের ছেলে। চটুল মতি। মুখের কথা খসালে ঝুমরির জন্য অনেক খরচ করত। প্রায়ই সিনেমা দেখাতে চাইত, রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে চাইত। ঝুমরি ওকে একেবারে যে বাতিল করত তা নয়, কিন্তু আড়ালে বলত, পাজির পা-ঝাড়া একটা। কিন্তু আমি যদি কখনো বলি, ওকে প্রশ্রয় দাও কেনঝুমরি ফোঁস করে উঠেছে, বেশ করি, তোমার গায়ে জ্বালা ধরে কেন?

ঝুমরির চোখের আগুন আর ঠোঁটের হাসির এই রীতি। আর আমার চোখে এও তার রূপ। ও নিখোঁজ হবার পর জয়ন্তকে ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেক জেরা করেছি। আর আড্ডা দেবার ছলে কম করে পনের দিন কড়া নজরে রেখেছি ওকে। ওকে সঙ্গে করেই ঝুমরির খোঁজে এলাহাবাদ চষেছি।

জয়ন্ত রঙ্গকে বাতিল করার পর আর একটা বাজে লোককেও সন্দেহ হয়েছিল আমার। তার নাম মধু যাদব। বিহারের লোক। জীবিকার তাগিদে কেমন করে কৃষ্ণকুমারদের বাড়ি এসে জুটেছিল জানা নেই। ঝুমরি আসারও বছর দুই আগে থেকে ও-বাড়িতে ছিল সে। বয়সে আমাদের থেকে বছর তিনেক বড় হতে পারে। খাওয়া থাকা ছাড়া কৃষ্ণকুমারের বাবা সেই দিনে মাসে চল্লিশ টাকা মাইনে দিত ওকে। ফলে ঠিক চাকরের পর্যায়ে পড়ে না লোকটা। তবে বাড়ির লোক ফরমাশ করলে মুখ বুজে চাকরের কাজও করত। আর ঝুমরি বললে তো কথাই নেই। মুখের কথা খসালে গন্ধমাদন বয়ে নিয়ে আসবে। আড়ালে আবডালে আমরা ঠাট্টা করতাম সীতা দেবীর হনুমানের মতোই সুলক্ষণার ভক্ত হনুমান মধু যাদব। শুনে ঝুমরিও হাসত খুব। কখনো বলত, দাঁড়াও বলছি ওকে।

লোকটার গায়ের জোর কখনো পরখ করে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে দেখলেই মনে হত অসুরের শক্তি রাখে। ঝুমরি উসকে দিলে আমাদের ধড় থেকে মাথা ছিঁড়ে নেওয়াও ওর পক্ষে অসম্ভব নয় হয়তো। মিশকালো গায়ের রঙ। খুব লম্বা নয় আবার বেঁটেও নয়। এক মাথা ঝাকড়া চুল, ড্যাবডেবে দুটো চোখ। সে-চোখে পলক পড়তে দেখা যায় না বড়। মুখের দিকে চেয়ে থাকলে অস্বস্তি হয়। ওর মধু নাম একটা বিতিকিচ্ছিরি রসিকতা যেন।

ওর আসল কাজ কবিরাজির মালমশলা সংগ্রহ করা আর ওষুধ বানানোর ব্যাপারে কৃষ্ণকুমারের বাবাকে সাহায্য করা। বনবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে ওষুধের শিকড়-বাকড়, লতাপাতা, ফলমূল যোগাড় করে আনে। কোন জিনিসগুলো মনিবের বেশি দরকার এ ক বছরে ভালই বুঝে নিয়েছে। ওর অপলক ড্যাবডেবে চাউনির কথা উঠলে কৃষ্ণকুমার হেসে বলত, ওর চোখ আছে, বাবা একবার যা ওকে দেখিয়ে দেয় সহজে ভোলে না। ঠিক চিনে নিয়ে আসে। কৃষ্ণকুমারের বাবা শুধু বিচক্ষণ নয়, টাকা-কড়ির ব্যাপারেও বেশ একটু হাত-টান আছে। তা সত্ত্বেও ভদ্রলোক সেই দিনে খাওয়া পরার ওপরে মাসে চল্লিশ টাকা মাইনে কেন ওকে দেন সেটা আঁচ করা যেত। বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মধু যা সংগ্রহ করে আনত সে-সব আর বাজার থেকে কিনতে হত না। ফলে অনেক সাশ্রয় হত। তারপর সেসব বাছাবাছি করে ধুয়ে শুকিয়ে গুঁড়িয়ে পিষিয়ে কবিরাজ মশায়ের হাতের কাছে এনে মজুত করা কম ধকলের ব্যাপার নয়। কিন্তু মধু যাদব অনায়াসেই তা করত। যেন কলের মানুষ একটা যন্ত্রের মতোই খাটতে পারে।

এ-হেন মানুষের একটু রসজ্ঞানের পরিচয়ও আমরা পেতাম, আর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতাম। সুলক্ষণা বা ঝুমরির গানের গলাটি ভাল ছিল। যেমন লোকই হোক, গান-বাজনার প্রতি ঝোঁক ছিল ওর বাবার। মাস্টার রেখে মেয়েকেও একটু আধটু। শেখাতে চেষ্টা করেছিল। এখানে আসার পর কৃষ্ণকুমার সে-ব্যবস্থা বাতিল হতে দেয়নি। সামান্য মাইনেয় তার খাতিরের এক বুড়ো ওস্তাদের বাড়ি গিয়ে ঝুমরি গান শিখত। মাঝে মাঝে ওস্তাদও বাড়িতে আসতেন। কৃষ্ণকুমারের বাবা ওই কটা টাকাই বাজে খরচ ভাবত। কিন্তু ছেলের ব্যবস্থা নাকচ করার সাহস তার ছিল না। এই গান শেখার ব্যাপারেও ঝুমরির খুব যে একটা নিষ্ঠা ছিল তা নয়। তবে ওর গলা মিষ্টি, আর গানের ঢংটুকু আমার চোখে অন্তত আরো মিষ্টি। মেজাজ এসে গেলে গান গাইতে গাইতে অল্প অল্প দুলত, কালো চোখের গভীরের হাসির ছোঁয়াটুকু তখন অদ্ভুত মায়াচ্ছন্ন মনে হত। ঝুমরির গানের সব থেকে সেরা আর নারব ভক্ত ছিল বোধকরি মধু যাদব। বাইরের অন্ধকার দাওয়ায় একখানা পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ বসে থাকত। যতক্ষণ গান চলত ওর নড়াচড়া নেই। সে-সময় কেউ কোনো কাজের ফরমাশ করলে ও একদম কালা বনে যেত। নেহাত বাড়ির কর্তা বা কর্তীর ডাক না পড়লে দাওয়া থেকে ওকে নড়ানো যেত না। আগে শুনেছি, ঝুমরির গানের সময় ও নাকি দরজার সামনেই এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। ঝুমরি নিষেধ করার পর আর দাঁড়ায় না। নিষেধ না করে উপায় কি, চোখের ওপর ও-রকম সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে ঝুমরির হাসি পেয়ে যায়।

ঝুমরি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হবার মাত্র তিন সপ্তাহ আগে এই মধু যাদবকে বাড়ি থেকে তাড়ানো হয়েছিল। তার আগে দস্তুরমতো থানা পুলিস করা হয়েছিল ওকে নিয়ে। চুরির ব্যাপার। ঝুমরির হার চুরি। সে-চুরি ঝুমরি বলতে গেলে স্বচক্ষেই দেখেছে। ওর মায়ের হার। মায়ের স্মৃতি। ওটার ওপর যে ঝুমরির অত মায়া জানতাম না। আমার ধারণা মধুকে তলায় তলায় একটু স্নেহই করত ও। কিন্তু হার খোয়া যাওয়া আর প্রায় হাতে-নাতে ধরা পড়ার পরেও মধুকে অস্বীকার করতে দেখে ঝুমরি রাগে ঠক ঠক করে কাঁপছিল। দু চোখে আগুন ছুটেছিল। বাথরুম থেকে সবে স্নান সেরে বেরিয়েছে। হারটা খুলে তাকের ওপর রেখেছিল। ওটা ফেলে এসে নিজের ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছে গলায় হার নেই। তক্ষুনি আবার ফিরে আসতে দেখে বাথরুমে মধু কলের নিচে বালতি বসিয়েছে। মনিবের স্নানের জল রোদে দেবে। বাথরুমের দোরগোড়া থেকেই ঝুমরি দেখে তাকের ওপর হারটা নেই। ধরেই নিল, হার পড়ে আছে দেখে মধু তাকে দেবার জন্যেই নিয়েছে ওটা। হাত বাড়িয়ে বলেছে, দাও

জবাবে মধু ড্যাব ড্যাব করে মুখের দিকে চেয়ে রইল শুধু।

 বিরক্ত হয়ে ঝুমরি আবার বলেছে, কি হল, হারটা দাও?

এবারে মধু নিজে থেকেই ঘুরে দেয়ালের তাকটা দেখেছে। তারপর তার দিকে ফিরেছে। আবার অপলক চাউনি, মুখে কোনো রকম ভাববিকার নেই।

ঝুমরিকে সহিষ্ণু মেয়ে কেউ বলবে না। ঝাঁঝিয়ে উঠল, হাঁ করে দেখছ কি চেয়ে, ওই তাক থেকে তুমি হারটা তোলোনি?

মধু মাথা নেড়েছে। তোলেনি।

আর যায় কোথায়। ঝুমরির মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠল, চালাকি পেয়েছ? এক মিনিট হয়নি, আমি ঘরে গেছি আর এসেছি, এর মধ্যে তুমি ছাড়া আর এখানে কে ঢুকেছে? হারটা আকাশে উড়ে গেল? ভাল চাও তো এক্ষুনি দিয়ে দাও!

মধু আবার মাথা নাড়ল। সে নেয়নি, অথবা সে কিছু জানে না।

ক্ষিপ্ত হয়ে ঝুমরি পিসির কাছে ছুটল। বাড়িতে এ-সময় ঝি-চাকর কেউ নেই। এর মধ্যে একমাত্র পিসী যদি বাথরুমে ঢুকে থাকে আর হার তুলে থাকে। যদিও জানে তা হতে পারে না, কারণ পিসী তখন রান্নায় ব্যস্ত। মোটা শরীর নিয়ে তার রান্নাঘর থেকে এ-পর্যন্ত আসতেই দু-চার মিনিট লাগার কথা।

যা ভেবেছিল তাই। পিসীও শুনে আকাশ থেকে পড়ল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে ঝুমরি আবার এদিকে ছুটে এলো। সেই সঙ্গে হাঁকডাক করে আমাদেরও ডাকল। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যেই বাথরুম ছেড়ে মধু হাওয়া। সব শুনে আমরা স্তম্ভিত। বাড়িতে আর কাক-পক্ষী নেই। এক মিনিটের মধ্যে ফিরে গিয়ে ঝুমরি ওকেই দেখেছে বাথরুমে। হারের খোঁজ নেবার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা তাকের দিকে তাকিয়েছে বোকার মতো। অর্থাৎ যেখানে হার ছিল সেখানে আপনা থেকেই চোখ গেছে। আর ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বালতি ফেলে ও নিখোঁজ। ও যে হার নিয়েছে তাতে আর সন্দেহের কি থাকতে পারে? কিন্তু আমরা আরো হতবাক এই কারণে, মধু শেষ পর্যন্ত ঝুমরির জিনিস চুরি করতে পারে। এর থেকে অবিশ্বাস্য আর যেন কিছু নেই। আর ঝুমরিরও হয়তো এত রাগ সেই কারণেই। তলায় তলায় ওই লোকটাকে সে নিজের দাসানুদাস ভাবত। রাগে জ্বলে জ্বলে বার বার বলতে লাগল, এই চুরি একরকম স্বচক্ষেই দেখেছি আমি–যখন চাইলাম তখন হার ওর কাছেই ছিল–বোকার মতো মামীর কাছে ছুটে যেতেই হার সরানোর জন্য ও চোখে ধুলো দিয়ে গেল।

বেশ একটা উত্তেজনার হাওয়া থিতিয়ে উঠল বাড়িতে। কৃষ্ণকুমারের বাবাও সব শুনে স্তম্ভিত। কৃষ্ণকুমারও নির্বাক। মোট কথা, মধু এ-রকম কাজ করতে পারে কারো কল্পনার মধ্যেও ছিল না।

বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না। আধ ঘন্টার মধ্যে ও মূর্তি নিজেই এসে হাজির আবার। তেমনি ড্যাবডেবে চাউনি, ভাবলেশশূন্য মুখ। এ-রকম বিশ্বাসঘাতকতার ফলে বাড়ির কর্তা অর্থাৎ কৃষ্ণকুমারের বাবারও অগ্নিমূর্তি। সে আসার সঙ্গে সঙ্গে হুমকি দিয়ে উঠলো, হার বার কর।

মধু মাথা নাড়ল। নেয়নি বা জানে না।

কর্তা ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল গালে।–নিসনি তো হার গেল কোথায়? বার কর শিগগির।

কালো মুখে চড়ের লালচে দাগ পড়ে গেল। চুপচাপ কৰ্তার মুখের দিকেই চেয়ে। রইল সে।

কর্তা গর্জে উঠলো, এই আধঘণ্টা কোথায় ছিলি তুই? কোথায় গেছলি?

 মধু জবাব দিল, দিদিমণি চোর বলাতে দুঃখ হল, তাই বাগানে বসেছিলুম।

এর মধ্যে আমরা ওর খোঁজে বাগানে ঘুরে এসেছি। এই মিথ্যেও হাতে-নাতে ধরা। পড়ল। অব্যক্ত রাগে হাত আমাদেরও নিশপিশ করছিল। কিন্তু আমাদের চেঁচামেচির জবাবে ও যে-ভাবে তাকাচ্ছিল এত বড় অপরাধের পরেও কি জানি কেন গায়ে হাত তোলার সাহস আমাদের হল না।

কর্তাই আরো কটা চড়চাপড় বসালো, অনেক ভয় দেখালো, ভাল কথায়। হার ফেরত দিতে বললো, কিন্তু মধুর কানে তুলো, পিঠে কুলো। শেষে পুলিসে খবর দেওয়া হল। তারা ওকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে তিন দিন আটকে রেখে অনেক জেরা করল, মারের চোটে হাড় গুঁড়িয়ে দেবার উপক্রম করল, কিন্তু কবুল। করাতে পারল না। ফলে ছেড়ে দিয়ে ওর ওপর চোখ রাখার মতলব ফাঁদল তারা। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। বাড়ির দাওয়ায় না এসে মধু সোজা বাগানে নিজের ঘরে। গিয়ে ঢুকল। রাতে খেতেও এলো না। কেউ ডাকেনি ওকে। পরদিন ভোরে ওর আর টিকি দেখল না কেউ। আবার পুলিসে খবর গেল। কিন্তু পুলিসও তার নাগাল পেল না।

মধু যাদবের অধ্যায় এখানেই শেষ। আর কখনো কেউ তাকে এলাহাবাদেই দেখেনি। মায়ের স্মৃতি ঝুমরির সেই হার খোয়া যেতে আমাদেরও একটু দুঃখ হয়েছিল। বটে, কিন্তু ওই মূর্তি বিদেয় হবার ফলে এক ধরনের স্বস্তি বোধ করেছিলাম। লোকটা যেন জানত, অসুখের দরুন কৃষ্ণকুমারকে সঙ্গ দিতে আসা, বা রাজনীতি আলোচনার লোভে এ-বাড়িতে ছুটে-ছুটে আসার লোভটাই সব নয়, এ ছাড়াও আরো কিছু বাড়তি আকর্ষণ আছে। ভাবলেশশূন্য মুখে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থেকে ও যেন এটুকুই ভাল করে বুঝিয়ে দিত আমাদের। এমনও মনে হয়েছে, কখন না জানি টুটি টিপে ধরে। সোজা যমের দোর দেখিয়ে দেয়।

এই লোক গেছে আপদ গেছে।

মধু যাদব বিদেয় হবার তিন সপ্তাহের মধ্যে সুলক্ষণা উধাও। আগের দিনও তাকে দেখেছি, কথা বলেছি। আমাদের মনে এতটুকু খটকা লাগার মতো কোনো কারণ ঘটেনি। ওর হাব-ভাব আচরণের কিছুমাত্র ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি আমাদের। কেবল শেষের দিন দশ-বারো কৃষ্ণকুমারের সেবাযত্ন বেশি করছিল। আর, একটা জলজ্যান্ত লোক বাপের চিকিৎসার দম্ভের চোটে কোন খেয়া পাড়ি দিতে চলেছে, অথচ আমরা চোখ কান বুজে বসে আছি–ইদানীং সেই ঝঝের কথাও একটু বেশি শোনা যাচ্ছিল। এর কোনোটাই ও-মেয়ের ভিতরের কোনো মতলবের নজির নয়। তাই খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হকচকিয়ে গেছি, দিশেহারা হয়েছি। কৃষ্ণকুমারেরও একই রকম অবস্থা প্রথম। তারপর হঠাৎ কি রকম যেন ঠাণ্ডা মেরে গেছে। বিবর্ণ পাংশু মুখ। তার পাশে বসেই তার বাবার তর্জন-গর্জন শুনেছি। স্ত্রীর মানসিক অবস্থা দেখে ভদ্রলোকের মেজাজ আরো বেশি তপ্ত। চিৎকার করে থেকে থেকে এক কথাই বলেছিলো।–কার জন্য এমন হা-হুঁতাশ করছ, কি জন্য খবর করতে বলছ? যে মেয়ে এ-ভাবে মুখে চুন-কালি দিয়ে চলে গেল, খুঁজে-পেতে তাকে ধরে এনে আবার ঘরে ঢোকাব? একেবারে মুখ বুজে বসে থাকো, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে বাপের বাড়ি চলে গেছে। গেছে কিনা তোমার ভাইকে একটা চিঠি লিখে দেখতে পারো। যাক না যাক, এখানে আর জায়গা হবে না এও পষ্ট করে জানিয়ে দিও।

এ-ঘরে বসে সবই শোনা যাচ্ছিল। বিমনার মতো কৃষ্ণকুমার আমার মুখের দিকেই। চেয়েছিল। একটা ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, ঝুমরি সেখানে যায়নি, যেতে পারে না।

কৃষ্ণকুমারের বিবেচনার ওপর আমার অটুট আস্থা। সঙ্গে সঙ্গে সেই সম্ভাবনা আমিও বাতিল করেছি। আর তিন দিনের মধ্যে খবরও এসেছে ঝুমরি সেখানে নেই। সেখানে যায়নি। কিন্তু কৃষ্ণকুমারের বাবার কথার মধ্যেও সত্যের ছিটে-ফেঁটা আছে। বলে ভাবিনি। নিজের এত বড় সর্বনাশ ঝুমরি স্বেচ্ছায় ঘটাতে পারে না। বড় রকমের অঘটনই ঘটে গেছে কিছু। চরম কোনো বিপদে পড়ে ঝুমরি হয়তো নিঃশব্দে আর্তনাদ করছে, হাহাকার করছে। ঝুমরির চোখে যে-আগুন জ্বলে, নরক-যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে দিবা-রাত্র এখন হয়তো সেই আগুন জ্বলছে। কৃষ্ণকুমারের বাবার কথা শুনে উল্টে ভদ্রলোককে নির্মম নিষ্ঠুর মনে হয়েছে আমার। চেনা-জানা মুখগুলো আঁতিপাতি করে খুঁজেছি তারপর। কে হতে পারে? ঝুমরির এত বড় সর্বনাশ কে করতে পারে?

জয়ন্ত রঙ্গ খুব একটা জোরালো লোক নয়। কিন্তু বাপের টাকার জোর আছে। ঝুমরিকে ঘিরে ওর বাসনার আঁচও পেতাম। বাসনা বেপরোয়া হয়ে উঠলে মানুষ অমানুষ হতে কতক্ষণ। তাছাড়া এ-পর্যন্ত তার দেখা নেই কেন? এ-পর্যন্ত বলতে পরদিন এই সকাল পর্যন্ত। সব দিনের মতোই ঝুমরি খেয়েদেয়ে কলেজ গেছল। সেই কলেজ থেকে আর ফেরেনি। একটা রাত কেটে গেছে। পরদিন সকাল নটায় কৃষ্ণকুমারের কাছে এসে দেখি, নির্বাক বিবর্ণ মুখ। বাড়ির হাওয়া থমথমে। কিছু বোঝার আগেই কৃষ্ণকুমার বিড়বিড় করে বলেছে, ঝুমরি আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, কাল কলেজ থেকে আর বাড়ি ফেরেনি।

খবরটা এমন আকস্মিক যে আমার বুঝতেই সময় লেগেছিল। ফ্যাল ফ্যাল করে ওর দিকেই চেয়েছিলাম আমি। কৃষ্ণকুমার আবার বলল, কলেজে খোঁজ করা হয়েছিল, ঝুমরি কাল কলেজে মোটে যায়ইনি।

আমি হতভম্ব। বুকের তলায় ঠক-ঠক কাপুনি ধরেছিল। ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে ঘরে ফিরেছে কৃষ্ণকুমারের বাবা। গনগনে ধারালো মুখ। ছেলের মুখের ওপর একটা বিরক্তির ঝাপটা মেরে ভিতরে চলে গেছে। তারপর ভিতর থেকে ওই তর্জন গর্জন শোনা গেছে।

ঝুমরি বাপের বাড়ি যায়নি, যেতে পারে না, কৃষ্ণকুমারের মুখে কথা শোনার পর আর বেশিক্ষণ ওর কাছে বসে থাকতে পারিনি। জয়ন্ত রঙ্গর চপল মুখ বার বার চোখের সামনে এগিয়ে আসছিল। সাইকেল নিয়ে সোজা তার বাড়ি ছুটেছি। ধমনীর রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে। আমার সবুজ পৃথিবী নিমেষে বর্ণশূন্য হয়ে গেছে। সেই রিক্ত আগুন-ঝরা পৃথিবীর এখন ভেঙে ফেটে চৌচির হবার প্রতীক্ষা শুধু।

কিন্তু দিন-কয়েক যেতেই বোঝা গেছে জয়ন্ত রঙ্গ নয়। ওর সেই সাহস নেই, সেই মেরুদণ্ড নেই। তারপরে আরো মনে হয়েছে, জয়ন্তর মতো ছেলেকে ঝুমরি। অনায়াসে নিজেই ঢিট করতে পারে। ওর ওপর দখল নিতে পারে এমন মরদ এই ছেলে নয়।

জয়ন্ত রঙ্গকে বাতিল করার পরে চকিতে আর একটা সন্দেহ মনে এসেছে আমার। আর তক্ষুনি সেই সম্ভাবনাই অবধারিত মনে হয়েছে। এর ঢের আগেই ঝুমরির বাপের। বাড়ি থেকেও খবর এসেছে সে সেখানেও যায়নি। তাহলে?

তাহলে মধু যাদব। একমাত্র সে ছাড়া কার আর এত বড় দুঃসাহস হতে পারে? হার চুরি দূরের কথা, আমার বদ্ধ ধারণা অনায়াসে ওই শয়তান মানুষও খুন করতে পারে। একটাও স্নায়ু কাপবে না, একটুও হাত কাঁপবে না। সে ভিন্ন বাড়ি ছাড়ার মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে এত বড় অঘটন ঘটে কি করে? এই পৃথিবীতে ঝুমরির ওপরেই তো সব থেকে বেশি রাগ তার। ওর জন্যেই পুলিস তাকে তিন দিন থানায় আটকে বেদম মার মেরেছে। সে-মারের এ-রকম প্রতিশোধ একমাত্র ওই লোকই নিতে পারে। তা ছাড়াও আমার স্থির বিশ্বাস ঝুমরিকে নিয়ে প্রথম থেকেই খারাপ মতলব ছিল ওর। ঝুমরি যদি সীতা দেবী হয়, ও তার হনুমান নয়। রাবণ। এ-কাজ ওর ছাড়া আর কারো নয়।

মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আগুন জ্বলেছে। আবার অসহায় বোধ করেছি কেমন। ওই নৃশংস মানুষটার কবল থেকে ঝুমরির মুক্তির আশা দুরাশাই বুঝি।

..কিন্তু এ-সম্ভাবনার কথা কৃষ্ণকুমারের বাবা মায়ের মনে এলো না কেন? বিশেষ করে কৃষ্ণকুমারের মাথায় এলো না কেন? থানায় খবর দিয়ে মধুর নামে হুলিয়া বার করা হল না কেন? এখনো সময় আছে। কৃষ্ণকুমারের কাছে ছুটে এলাম আমি।

সন্দেহের কথা শুনে কৃষ্ণকুমার চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। এতটুকু উত্তেজনার আভাস না পেয়ে উল্টে অবাক। একটু বাদে ও ক্লান্ত স্বরে জবাব দিল, তা নয়, ঝুমরি নিজের ইচ্ছেতে অন্য কারো সঙ্গে চলে গেছে।

অবিশ্বাসের সুরে আমি জোর দিয়ে বলে উঠলাম, তুমি কি করে জানলে? এ হতেই পারে না–আমি এক্ষুনি থানায় গিয়ে যা করার করে আসি।

কৃষ্ণকুমার আবার খানিক চুপ করে থেকে মাথা নাড়ল শুধু। অর্থাৎ আমাকে নিষেধ করল। তারপর আস্তে আস্তে যে কথাগুলো বলল, শুনে ভয়ানক দমে গেলাম আমি।…সেদিন সকালে কলেজ যাবার আগে পর্যন্ত ঝুমরি নাকি প্রায় সারাক্ষণ কৃষ্ণকুমারের কাছেই ছিল। এগারোটায় কলেজ, সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত। তার সেবা যত্ন করেছে, নিয়ম করে ওষুধ-পত্র খাওয়া আর সময়ে ঘুমনোর ব্যাপারে পাকা গিন্নীর মতো উপদেশ দিয়েছে। বেলা সাড়ে দশটার সময় উঠে গিয়ে সামান্য কিছু নাকে মুখে গুঁজে কলেজ যাবার জন্য তৈরি হয়ে আবার ঘরে এসেছে। বলেছে, মাথাটা। একটু তোলো দেখি

কিছু না বুঝেই কৃষ্ণকুমার উঠে বসেছিল। বলা নেই কওয়া নেই ঝুমরি তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে একটা প্রণাম সেরে নিল। অবাক হয়ে কৃষ্ণকুমার জিজ্ঞাসা করেছে, কি ব্যাপার রে, পরীক্ষা-টরীক্ষা কিছু নাকি?

ঝুমরি হেসেই জবাব দিয়েছে, দারুণ পরীক্ষা, জীবন-মরণ নির্ভর একেবারে।

 হাসতে হাসতে চলে গেছে।

বেদনা-বিবর্ণ মুখে কৃষ্ণকুমার বলেছে ও আর ফিরবে না জেনেই প্রণাম করে গেছে আর ওই কথা বলে গেছে। তারপর কৃষ্ণকুমার ওর কলেজের দুজন পরিচিতা শিক্ষয়িত্রীকে ডেকে খবর নিয়েছে। পরীক্ষা-টরীক্ষা কিছুই ছিল না সেদিন। তাদের মুখ থেকেই শুনেছে, পাঁচ-সাতদিন আগে থেকেই মাঝে মাঝে ক্লাস পালানো শুরু করেছিল ঝুমরি। ওই শিক্ষয়িত্রীদের একজনের মেয়ে ঝুমরির সঙ্গে পড়ে। সে নাকি তার মাকে বলেছে, একটা মস্ত ঝকঝকে বিলিতি গাড়িতে একজনের পাশে বসে ঝুমরিকে এখানে-সেখানে যেতে দেখেছে। কলেজের অনেক মেয়েই দেখেছে।

আমার মুখে আর একটিও কথা সরেনি। কৃষ্ণকুমারকে আর কোনো সান্ত্বনার কথা বলতে পারিনি। নিজের বুকের তলায় যে কাটা-ছেঁড়া চলেছিল তাও প্রকাশ। করতে পারিনি। কৃষ্ণকুমারদের বাড়ি আসাই কমিয়ে দিয়েছিলাম এর পর। একটা মেয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেছে বলে নয়, কৃষ্ণকুমারের মুখখানা বড় বেশি অসহায় আর করুণ মনে হত। মেয়েটা যেন ওর জীবনের শেষ সলতেটা নিভিয়ে দিয়ে চলে গেছে।

বিতৃষ্ণা-ভরা একটা আক্রোশ নিয়েই সেই মেয়েকে আমি মন থেকে হেঁটে দিচ্ছিলাম। কিন্তু মাঝেসাঝে চেনা-পরিচিত মুখের মারফত দু-একটা খবর কানে আসত। সুলক্ষণা দয়ালকে কখনো লক্ষৌর ওমুক অভিজাত হোটেলে দেখা গেছে, কখনো বেনারসে কখনো বা আলমোড়ায়। আমার মনে হত, ওই রসের খবর যারা দিচ্ছে। তলায় তলায় তারা মুচকি-মুচকি হাসছেও। আমাকে বিধতে চায়। কিন্তু আমি আর বিদ্ধ হতে রাজি নই। কে সুলক্ষণা দয়াল তাই যেন চট করে মনে পড়ত না আমার।

কিন্তু ঘর ছাড়ার ঠিক এক বছর দু মাস বাদে এক বিজাতীয় আক্রোশে ওই সুলক্ষণা দয়ালকেই মনে মনে সব থেকে বেশি খুঁজেছিলাম আমি। কৃষ্ণকুমার মারা গেল। শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে ওর শূন্য দু চোখ একবার ঘরের মধ্যে চক্কর খেয়ে কাউকে যেন খুঁজেছিল। এর পরেই যদি সুলক্ষণা দয়ালের দেখা পেতাম কোথাও, আর এ-খবরটা যদি সকলের আগে হেসে হেসে তার কানে তুলে দিতে পারতাম!

বাইশ বছর বাদে জয়ন্ত রঙ্গর মুখে আবার সেই সুলক্ষণা-প্রসঙ্গ।

এবারে গোড়ায় হঠাৎ ঠাওর করতে না পারাটা ভনিতা কিছু নয়। বাইশ বছরে গঙ্গায় অনেক জল বয়ে গেছে, বুকের তলার অনেক নরম জায়গায় শুকনো চড়া পড়ে গেছে। কিন্তু মানুষের একটা বয়েস চিরকালই বোধহয় নিজের অগোচরে কোনো এক জায়গায় আটকে থাকে। বিস্মৃতির পর্দাটা সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আগের দিনের মতোই নাড়াচাড়া খেলাম একপ্রস্থ। ভিতরটা উন্মুখ হয়ে উঠল।

 হেসে একটা চোখ একটু ছোট করে জয়ন্ত বলল, কত হবে বলো তো তোমার। ঝুমরির বয়েস এখন? কম করে বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ না?…কিন্তু এখনো বেশ মাইরি! আগের থেকে সামান্য মোটা হয়েছে, গায়ের রং এখন ফর্সাই বলতে পারো, এক-পিঠ খোলা চুল, ইচ্ছে করলে এখনো সেই আগের মতো হাসতে পারে–তাকাতেও পারে।

শ্লেষের সুরে জিজ্ঞাসা করলাম, হরিদ্বারে কি করছে–জপ-তপ আর প্রায়শ্চিত্ত?

-তাই তো বলল। আমি খোঁজ নিতে দিব্যি হেসে জবাব দিলে, সব খুইয়ে আমার মতো মেয়েরা শেষে কাশী মথুরা বৃন্দাবন বা হরিদ্বার ছাড়া আর কোথায় এসে ঠেকবে?

কিন্তু খুব একটা প্রায়শ্চিত্ত করছে বলে জয়ন্তর মনে হয়নি। রসিকতার মেজাজটি এখনো নাকি দিব্যি আছে।

…জয়ন্ত রঙ্গর সঙ্গে সুলক্ষণা দয়ালের দেখা হয়েছিল বিকেলের হর-কী-পিয়ারী ঘাটে। সকালের দিকে সেখানে পুণ্যার্থীদের চিড়ে-চ্যাপ্টা ভিড়, বিকেলের দিকে হাওয়া বিলাসীদের। জয়ন্ত রঙ্গ চুপচাপ দাঁড়িয়ে গঙ্গার শোভা দেখছিল, ছেলে-ছোকরাদের শিকল-ধরে গঙ্গায় হুটোপুটি খাওয়া দেখছিল। কোত্থেকে একজন মহিলা পাশে এসে রাজ্যের বিস্ময় গলায় ঢেলে জিজ্ঞাসা করল, ও মার সাহেব না?

তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে রঙ্গ চিনেছে, কারণ চেহারায় শুধু বয়েসের প্রসন্ন ছোঁয়া লেগেছে একটু–কিছুই খোয়া যায়নি।

অনেক কাল বাদে অন্তরঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে যেমন হয় তেমনি আনন্দ সুলক্ষণার। জয়ন্তকে ঘাট থেকে একটা নিরিবিলি দিকে টেনে নিয়ে গেছে। গঙ্গার ধারে দুজনে পাশাপাশি বসেছে। নিজের প্রসঙ্গে প্রায় কোনো কথাই বলেনি বা বলতে চায়নি। জয়ন্ত কিছু জিজ্ঞাসা করলে মুখ টিপে হেসেছে, আর শেষ বয়সে তাদের মতো মেয়েদের যে এ-সব জায়গাতে আশ্রয়–সেই কথাই বলেছে। কিন্তু সেই বলার। মধ্যেও কোনো পরিতাপ ছিল না।

জয়ন্ত ঠাট্টা করেছে, শেষ বয়েস বলে তো একটুও মনে হচ্ছে না তোমাকে দেখে?

জবাবে হেসে ভ্রূকুটি করেছে সুলক্ষণা। বলেছে, এখনো তোমার চোখের দোষ। রোসো, নিজের এই চুলের বোঝা ছেটে ফেলব ভাবছি, তাহলে তোমাদের আর অসুবিধে। হবে না।

নিজের কথা কিছু না বললেও বিশেষ করে আমার কথা নাকি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করেছে সুলক্ষণা। কৃষ্ণকুমারের নামও মুখে আনেনি। এই থেকেই বোঝা গেছে সে-যে নেই সেটা ও জানে। জয়ন্ত বলল, তুমি লিখে নাম-টাম করেছ শুনে সুলক্ষণা যেমন অবাক তেমনি খুশি। তোমার বউয়ের কথা আর ছেলেপুলের কথা শুনতে চাইল–আমি আর কতটুকু জানি যে বলব।

আবার দেখা করার জন্য জয়ন্ত রঙ্গ তার হরিদ্বারের আস্তানার হদিস পেতে চেয়েছিল। ঘুরিয়ে সে-আবেদন নাকচ করেছে সুলক্ষণা। তরল জবাব দিয়েছে, ঠিকানা আর কোথায়, ঠিকানাই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি। যদি থাকো তো এই হর-কী-পিয়ারীর ঘাটেই দেখা হবে আবার।

আরো তিনদিন হরিদ্বারে ছিল জয়ন্ত রঙ্গ। তিনদিনই ঘাটে এসে ঘণ্টা-দুঘণ্টা করে অপেক্ষা করেছে। সুলক্ষণা দয়াল আর আসেনি। আর দেখা হয়নি।

জয়ন্ত রঙ্গ চলে যাবার পর এক মাস কেটে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই সুলক্ষণা দয়ালের কথা আবার ভুলেছি। এক মাস বাদে হঠাৎ দিল্লীতে একটু কাজ পড়ে গেল আমার। আর দুদিনের মধ্যে সে-কাজও শেষ হয়ে গেল। আমার ফিরতি টিকিটের তারিখে পৌঁছুতে মাঝে পাঁচটা দিন বাকি এখনো। এই পাঁচ-পাঁচটা দিন কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। দিল্লী আমার কাছে প্রায় কলকাতার মতোই পুরনো।

রাতের নিরিবিলিতে হঠাৎ সুলক্ষণা দয়ালের কথা মনে পড়ে গেল। আবার দেখা হওয়াটা ভবিতব্য ছিল বলেই হয়তো মনে পড়ল। ছেলেবেলার মতো এখন আর তে রকম ভাবপ্রবণ তাড়না কিছু থাকার কথা নয়–ছিলও না। তাছাড়া মনের যে আসন থেকে সেই মেয়ে সরে গিয়ে প্রবৃত্তির পাতালে ডুব দিয়েছে–তারপর সে হরিদ্বারেই থাকুক বা মথুরা বৃন্দাবন করে বেড়াক–সেই আসনে আর সে কোনোদিন ফিরে আসবে না জানি। তবু তাকে আর একটি বার দেখার জন্য ভিতরটা কেমন উন্মুখ হয়ে উঠল।

দিল্লী থেকে সকালে হরিদ্বারের লাক্সারি বাস ছাড়ে। ভিড়ের সময় নয়, বাসের টিকিট পেলাম। বাস নুটায় ছাড়ে, আড়াইটে তিনটের মধ্যে হরিদ্বারে পৌঁছয়।

বাসে বসেও অনেক বার মনে হয়েছে নেমে যাই। ফিরে যাই। বাইশ বছর আগের সব স্মৃতি বুকের তলায় আজও যে তেমনি তাজা আছে কে জানত? কেন যাচ্ছি, কি জন্যে দেখতে যাচ্ছি? একদিন যেমন চেয়েছিলাম তেমনি করে কৃষ্ণকুমারের মৃত্যুর ছবিটা মর্মান্তিক করে তোলার অকরুণ লোভে? না, সেই মেজাজ এখন আর নেই। আবার মন বলছে রওনা হয়েছি যখন যাওয়াই যাক না! সুলক্ষণার সঙ্গে দেখা যে হবেই তার কি মানে! জয়ন্ত রঙ্গর সঙ্গে আর তো দেখা হয়নি। সে যে ইচ্ছে। করেই ওকে নিজের বাড়ির হদিস দেয়নি বা আর এসে দেখাও করেনি, তাতেও আমার মনের তলায় বিস্ময়ের আঁচড় পড়েছে। প্রায়শ্চিত্তের তাগিদেই সে-যে হরিদ্বারে এসেছিল এই বা, কে জোর দিয়ে বলতে পারে? প্রদীপের নিচেটাই তো অন্ধকার। পুণ্যস্থানে এ-যাবৎ পাপের মিছিলও আমি কম দেখিনি। দেখা হলে হবে, নয়তো দিন দুই একটু বেড়িয়ে আবার ফেরা যাবে।

কিন্তু এও জানি, এ-সবই আমার নিজেকে ভোলানোর চিন্তা। নিজের বিবেক একটু পরিষ্কার রাখার তাড়না। নইলে ভিতরে ভিতরে ওকে দেখার একটু ইচ্ছে যে ছিলই সেটা মিথ্যে নয়।

হরিদ্বার আমার মোটামুটি চেনা জায়গা। চেনা বলতে বেড়াবার জায়গাগুলো আর স্নানের ঘাট-টাটগুলো চিনি। কিন্তু বাড়ির হদিস বা ঠিকানা জানা না থাকলেও সেখান থেকে এক রমণীকে খুঁজে বার করতে পারব এমন ভরসা ছিলই না। একটা হোটেলে আস্তানা নিয়েছিলাম। তারপর সকালে বিকেলে ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা হর-কী-পিয়ারীর ঘাটে হাজিরা দিচ্ছিলাম। প্রথম বিকেলটা কাটল, পরের দুটো দিনের সকাল বিকেলও কাটল। হর-কা-পিয়ারীর ঘাটে দুবেলা আমার দুটো চোখ অভদ্রের মতো মেয়েদের দিকে ধাওয়া করেছে। দেখা মিলল না। আর মিলবেও না ধরেই নিয়েছিলাম। কালকের দিনটা দেখে আবার দিল্লী ফেরার সঙ্কল্প। আমার বাইরেটা মোটামুটি নির্লিপ্ত। সুলক্ষণার দেখা না পেয়ে খুব হতাশ হয়েছি, নিজের কাছে সেটা স্বীকার করতেও সংকোচ। জায়গাটা ভালো। দেখা হলে আরো ভালো হত। হল না যখন কি আর করা যাবে। দু-বেলা ওই হর-কী-পিয়ারীর ঘাটও একটা দেখার জায়গা, বেড়ানোর জায়গা। দুপুরের রোদ চড়া না থাকলে এখানে তিন-চার মাইল হেঁটে বেড়ানোর মধ্যেও আনন্দ আছে।

দেখা হল। পরদিন নয়, এই বিকেলেই। ঘণ্টাখানেক ঘাটে পায়চারি করার পর নেমে সোজা একদিকে পা চালিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা কোন দিক আমি জানি না। রাস্তটা নির্জন। ফাঁকায় ফাঁকায় এক-একটা ডেরা। হঠাৎ এক জায়গায় এসে পা দুটো মাটির সঙ্গে যেন আটকে গেল।

যে জায়গার কথা বলছি, ঘাট থেকে কম করে মাইল তিনেক দূরে। এখানে। সন্ধ্যা নামে দেরিতে। সবে তখন বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। চারদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট একটা আঙিনা। তার এক প্রান্তে একটা টালির দালান। তার সামনের প্রাঙ্গণে ঘাসের ওপর বসে আছে পাঁচ-ছটি রমণী। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, কেউ কেউ হাসছে। ঠিক তাদের পিছনেই দাওয়ার ওপর যে বসে, তাকেই আমি খুঁজছি, তার জন্যেই দিল্লী থেকে এখানে আসা।

বেড়ার বাইরে কোনো পুরুষ যদি দাঁড়িয়ে গিয়ে গুটিকতক মেয়েকে দেখতে থাকে, সেটা চোখে পড়তে সময় লাগে না বোধহয়। ঘাসের ওপর যারা বসেছিল, তাদের বয়েস অনুমান বাইশ-চব্বিশ থেকে চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। আর এখান থেকে অন্তত সকলকেই বেশ সুশ্রী মনে হল আমার। তারাই প্রথম দেখেছে আমাকে। কারণ আমি যাকে দেখছি তার হাতে একখানা বই কি বাঁধানো খাতা বোঝা যাচ্ছিল না। তার দৃষ্টি সেদিকেই।

মেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে হয়তো বলাবলি করল কিছু। আগেও হাসছিল। আমাকে দেখার পরের হাসিটা ভিন্ন বিষয়গত কিনা জানি না। দুই-একটি বয়স্কার বেশ বিরক্ত মুখও দেখলাম। তাদেরই একজন মুখ ফিরিয়ে পিছনের দাওয়ায় বসা রমণীটিকে বলল হয়তো কিছু। কারণ বই বা খাতা থেকে তার দৃষ্টিটা এই বাঁশের ফটকের দিকে ঘুরল।

ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মনে হল স্থির নিশ্চল কয়েক মুহূর্ত। তারপর উঠল। তারপর বেশ ধীরেসুস্থে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

আমি চেয়েই আছি। জয়ন্ত রঙ্গ খুব বাড়িয়ে বলেনি। সামান্য মোটার দিক ঘেঁষলেও শ্ৰী যেন আগের থেকেও বেড়েছে।..এক পিঠ খোলা চুল। তেলের সঙ্গে যোগ কম বলেই হয়তো লালচে দেখাচ্ছে একটু। গায়ের রংও আগের থেকে ফর্সাই মনে হয়। পরনে চওড়া হলদে ছাপা পাড়ের পাতলা সাদা শাড়ি। গায়ে মুগো রঙের ব্লাউস। হাতে কিছু কাঁচের চুড়ি।

…সেই সুলক্ষণা দয়াল এখন তাহলে এই। আসতে আসতে একবারও আমার দিক থেকে চোখ ফেরায়নি সে। আমিও না। ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসি চোখেও। আগের মতো তীক্ষ্ণ নয় আদৌ। উল্টে কৌতুকমাখা।

সামনে এলো। দেখল আর একবার। হাসল আবার একটু। দড়ি বাঁধা গেটটা খুলে দিয়ে ডাকল, এসো।

বাইশ বছর নয়, যেন কিছুদিন আগেই আমাকে দেখেছে সে। আজ আবার দেখল। এখন ভিতরে ডাকছে।

স্থান কাল ভুলে আমি ওর দিকেই চেয়ে আছি। ওকেই দেখছি। সবার আগে আমার মগজে যে চিন্তাটা ঘা দিয়েছে, নিজের অগোচরে এরই মধ্যে হয়তো তার জবাবও খুঁজছি। বিগত বাইশটা বছরের মধ্যে এই মেয়ের কতগুলো বছর পুরুষের অশুচি বাসনার সহচরী হয়ে কেটেছে জানি না। এখনো যেমনটি দেখছি, পুরুষের চোখে না পড়ার মতো নয়– ডাক পড়ে কিনা জানি না। কিন্তু কোনো ব্যভিচারিণী মেয়ের চোখে মুখে হাসিতে এই প্রসন্নতা লেগে থাকে কি করে?

–কি হল, এসো? ওই মেয়েগুলো ভাবছে কি?

ভিতরে এলাম। তারপর পাশে পাশে টালি ঘরগুলোর দিকে এগোলাম। সুলক্ষণা হালকা হেসে বলল, তোমার সঙ্গে শীগগিরই একদিন দেখা হয়ে যাবে আমি ঠিক জানতাম।

–কি করে

–বাঃ তোমার সঙ্গে জয়ন্তর দেখা হয়নি?

 মাথা নাড়লাম।–হয়েছে। কলকাতায়।

–সে তোমাকে আমার কথা বলেনি?

-বলেছে। বলেছে, হর-কী-পিয়ারীর ঘাটে হঠাৎ সুলক্ষণার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কে সুলক্ষণা আমি হঠাৎ বুঝতেই পারিনি।

ঘাড় ফিরিয়ে ভূ-ভঙ্গি করে তাকালো মুখের দিকে।-বা-ব্বাঃ, তাহলে তুমি মস্ত একজনই হয়েছ বটে। তারপর কি করে বুঝলে?

–ও যখন বলল, ঝুমরির সঙ্গে দেখা হয়েছে।

ইচ্ছে করেই আমাদের চলার গতি শিথিল। আবার সেই হাসিমাখা ভূ-ভঙ্গি।–ওই মেয়েদের সামনে তুমি আবার আমাকে ঝরি-টুমরি ডেকে বোসো না যেন! ওদের কাছে আমি সুলক্ষণাদিদি।

আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম শুধু একবার। ও আবার ঘাড় ফিরিয়ে ফিক করে হেসে নিল একটু।–কি দেখলে? সুলক্ষণা ডাকার মতো কিছু চোখে পড়ছে না বুঝি?

মনে মনে বললাম, সবটাই সুলক্ষণা দেখছি–আর সেই জন্যেই অবাক লাগছে। মুখে বললাম, আমার সঙ্গে শীগগিরই দেখা হবে ভাবলে কি করে, জয়ন্তর মুখে তোমার কথা শুনে কলকাতা থেকে ছুটে আসব ধরে নিয়েছিলে?

মাথা নেড়ে সুলক্ষণা জবাব দিল, অত ভাগ্যি ভাবিনি, তবে এদিকে এলে একবার খোঁজটোজ করবে আশা ছিল।

বললাম, তাই বা করব ভাবলে কি করে, জয়ন্তকে তো নিজের বাড়ির হদিস দাওনি। হর-কী-পিয়ারীর ঘাটে আবার দেখা হবে বলেও আর সেদিক মাড়াওনি। দেখা হতে পারে ভেবে আমিও ওই ঘাটে দুদিন দুবেলা করে হাজিরা দিয়েছি। কাল ফিরব, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

ঘাড় ফিরিয়ে দু চোখ বড় বড় করে তাকালো সুলক্ষণা। সেই চোখে হাসি উপচে পড়ছে। মুখে বিড়ম্বনার ছোঁয়া।–কি কাণ্ড! আমারই পোড়া কপাল, ইস, দু-দুটো দিন এ-ভাবে পণ্ড হয়ে গেল!…জয়ন্তর কাছে শুনে সত্যিই কি কলকাতা থেকে চলে এসেছ নাকি?

–না, দিল্লী থেকে, দিল্লীতে কাজে এসেছিলাম। একটু শ্লেষের লোভ সামলানো গেল না, বললাম, তা হঠাৎ জয়ন্তকে ওভাবে কাটতে দিলে কেন-লজ্জায় ভয়ে?

হাসতে লাগল। ওই মেয়েদের কাছে পৌঁছনোর আগে একটু সময় নেবার জন্যেই হয়তো সামনের বাগান ঘুরে চলেছে। যেখানে ফুল বেশি ফুটে আছে, সেখানে দাঁড়াচ্ছেও দুই-এক মিনিট করে। হাসিমুখে সাদা-সাপটা জবাবও দিল। বলল, কাটান দিলাম, কারণ জয়ন্ত এখনো সেই আগের জয়ন্তই আছে মনে হল, আর আমি কেমন। মেয়ে জানে বলেই কথার ফাঁকে ফাঁকে আমার মুখ থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে নিতেও ছাড়েনি–আর, বাড়ির সন্ধান পেলে ওর হয়তো দুই-এক রাত আমার কাছে কাটিয়ে যেতেও আপত্তি হত না।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণায় ভিতরটা রি-রি করে উঠল আমার। এই কথাগুলো এমন অনায়াস কৌতুকে বলতে পারল বলেই রাগ। দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম, দেখা তো হল, আজ চলি তাহলে?

দাঁড়িয়ে গিয়ে থমকে তাকালো আমার দিকে। তারপর তেমনি পলকা রসিকতার সুরেই পাল্টা জবাব দিল, যাবে যাও–অত ভয় দেখাচ্ছ কি? তারপরেই হেসে বলল, তোমাকে জয়ন্ত ভাবছি না, এসো–

এর পরেও আঘাত দেবার ইচ্ছেটাই প্রবল আমার। বললাম, জয়ন্ত হলে বা জয়ন্ত ভাবলেই বা তোমার এমন কি সাংঘাতিক ক্ষতি আর আপত্তি?

আবারও দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক পলকের জন্য সমস্ত মুখ লাল একটু। আমার মনে হল কালো চোখের তারায় সেই আগের মতো আবার এক ঝলক বিদ্যুতও ঝলসে উঠতে পারে। না, তা উঠল না, একটু দেখেই নিল শুধু। তারপর মুখ টিপে হেসে। বলল, এই বাইশ বছর বাদেও তোমার ভয়ানক রাগ দেখছি আমার ওপর। কেন গো?

এবারে নিজেরই কানের কাছটা গরম ঠেকছে। সুলক্ষণা বলল, চলে এসো, ওই মেয়েগুলো কি ভাবছে ঠিক নেই

তার সঙ্গ ধরে আবারও শ্লেষ মাখানো জবাব দিলাম, তোমার পুরনো কোনো প্রীতির পাত্র ভাবছে হয়তো।

হেসে ফেলল। মাথা দুলিয়ে জবাব দিল, তাহলে তো ঠিকই ভাবছে।

 জিজ্ঞাসা করলাম, ওই মেয়েরা কারা?

-আমার কাছেই থাকে, আর আমাকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করে। বড় ভালো মেয়েগুলো। কিন্তু ওদের এক-একজনের কথা শুনলে তুমি হয়তো এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে সোজা কলকাতার গাড়িতে চেপে বসবে।

যা বোঝার এটুকু থেকেই বোঝা গেল।

আমরা সামনে আসতে মেয়েগুলো উঠে দাঁড়াল। তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধার পাত্রটি অমন হাসিমুখে এতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে আঙিনা পাড়ি দিল, তলায় তলায় হয়তো সেই কৌতূহলও আছে।

সুলক্ষণা বলল, এই মেয়েরা, কাকে দেখে তোরা হাসাহাসি করছিলি! কলকাতার একজন নামকরা লেখক। বামুন মানুষ, প্রণাম কর।

আমার অস্বস্তির একশেষ। ওরা একে একে পা ছুঁয়ে প্রণাম সারল। আমার দিকে চেয়ে সুলক্ষণা হেসে জিজ্ঞাসা করল, আমিও ঠুকব নাকি একটা?

গম্ভীর মুখে আমি আঙুল দিয়ে নিজের পা দেখিয়ে দিলাম। ও ছদ্ম কোপে ফোঁস করে উঠল, উঃ! বয়ে গেছে

আগন্তুক দেখে ভিতর থেকে আরো তিন-চারটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব না হোক, এরাও মোটামুটি সুশ্রী। আর বয়েস বাইশ থেকে ছাব্বিশের মধ্যে। আমি বাঙালী লেখক পরিচয় পেলেও আমার সঙ্গে তাদের সুলক্ষণাদিদিটির সম্পর্ক কি এরা জানে না। আর সুলক্ষণারও আর বেশি পরিচয় দেবার উৎসাহ দেখা গেল না। সকলের উদ্দেশেই সে বলল, চা কর, তোরাও খা আমাদেরও দে–এঁর জন্যে একটু খাবার-টাবারও করিস। আমাদের আজ বাইরে কোনো প্রোগ্রাম নেই তো?

ওরা মাথা নাড়ল। নেই।

–বাঁচা গেল। আমি এঁকে নিয়ে একটু ঘরে বসছি, সময় হলেই ডাকিস

কিসের সময় হলে কেন ডাকবে বোঝা গেল না। দিনের আলো এখন শেষ প্রায়। টালির ঘরগুলোতে আলো জ্বালা হয়েছে। একটি পরিচারিকা ঘরে ঘরে লণ্ঠন রেখে যাচ্ছে দেখলাম।

আমাকে নিয়ে সুলক্ষণা দাওয়ার সামনের ঘরটাতেই ঢুকে পড়ল। পাশাপাশি একই সাইজের চারটে ঘর। তারপর শেষের দিকে আর একটা বড় হলঘরের মতো। টালির ছাদ হলেও ঘরের মেঝে সিমেন্টের, আর ইট-সুরকির দেয়াল। পরিষ্কার তকতকে ঘর। দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেণ্ডারে গোপালের মূর্তি। কোণের দিকে একটা নেয়ারের খাঁটিয়া পাতা। তাতে পরিচ্ছন্ন সাদাসিধে শয্যা বিছানো। আলনায় খান-দুই শাড়ি আর জামা ঝুলছে। এদিকের দেয়ালে একটা আয়না টাঙানো।

কোথাও এতটুকু আতিশয্য নেই। এ-রকম একটা ঘরে এসে দাঁড়ালে ভিতরটা আপনা থেকে খুশী হয়।

সুলক্ষণা জানালো, এটা তার ঘর। এতগুলো মেয়ের মধ্যে শুধু তারই একলার। একখানা ঘর। অন্য ঘরগুলোর এক- একটায় তিন-চারটে করে মেয়ে থাকে।

রসিকতা করে বললাম, প্রমীলারাজ্যে এসে গেলাম মনে হচ্ছে।

হেসে মাথা নেড়ে সুলক্ষণা, সায় দিল। বলল, সমস্ত বাড়িতে পুরুষও একজন আছেন–তিনি গোপাল। আর দ্বিতীয় পুরুষ তুমি এলে।

বললাম, গোপালের তাতে হিংসে হবে না?

–একটু হলেই বা, সেও তো খুব সুবিধের পুরুষ নয়। হাসিমুখে একটা আসন। টেনে নিয়েও থমকালো একটু, তারপর হেসে আসনটা আবার যথাস্থানে রাখতে রাখতে বলল, যাকগে, তুমি ওই বিছানাতেই বসো-গোপালের আর একটু বেশি হিংসে হোক!

আমিও ঠাট্টা করলাম, ঠাকুর দেবতার হিংসে কুড়িয়ে কাজ কি!

–আচ্ছা তুমি বসো তো, ঠাকুর দেবতা আমি মেয়েটা কেমন ভালো করেই চেনে।

শয্যার এক ধারে বসলাম। একটা ভাজ করা কম্বলের ওপর চাদর বিছানো। নিজেকে নিয়ে ও অনায়াসে যে ইঙ্গিত করল, সেটুকুর জন্যেই আমার বাইশ বছরের ক্রোধ আর পরিতাপ। অথচ আশ্চর্য, সব জানা থাকা সত্ত্বেও সুলক্ষণার দিকে চেয়ে আমার বার বার মনে হচ্ছিল, একটা শুচিতা যেন ওকে ঘিরে আছে।

ও সামনে এসে দাঁড়াল। চাউনিটা গভীর একটু।

–কি দেখছ?

–তোমাকে। সেই বাইশ বছর আগের মতোই কাঁচা কাঁচা লাগছে। বিয়ে করেছ শুনেছি–বউ কেমন?

হেসে জবাব দিলাম, বিয়ে তো সেই কোন যুগে করেছি–এখন আর কেমন-এর কি আছে?

চোখ পাকালো।–তার মানে বউ পুরনো হয়ে গেছে? হাসলও সঙ্গে সঙ্গে। –ছেলে মেয়ে পড়ছে?

মাথা নাড়লাম।

ও ছেলেমানুষের মতোই বলে উঠল, আমার ছুটে গিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে করছে!

–চলো না!

–ইস, কি পরিচয় দেবে?

–বলব, তোদের অদেখা অনেককাল আগের এক হারানো মাসি।

হেসে উঠে লঘু সুরে সুলক্ষণা বলল, কেন পিসী বলবে না?

বাইশ বছরের সঠিক ইতিবৃত্ত কিছুই জানি না। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যেই আমার ভালো লাগছে, হালকা লাগছে। মাথা নাড়লাম, নাঃ, অতটা নীরস হতে পারব না।

সুলক্ষণা হাসছে। চেয়ে আছে। বললাম, বসো

তেমনি চেয়ে থেকেই রসিকতা করল, এক্ষুনি চা দিতে আসবে, তুমি ওখানে বসে আছ দেখেই অবাক হবে, পাশে আমাকে দেখলে তো কথাই নেই। সামনে দাঁড়িয়েই ভালো লাগছে। জয়ন্ত বলছিল, অনেক নাকি বই-টই লিখেছ?

–লিখেছি।

–কি বই?

–গল্প, উপন্যাস।

 টিপ্পনীর সুরে একটু বিস্ময় প্রকাশ করল সুলক্ষণা, তোমার মধ্যে এত রস আছে জানতাম না।…দু-একখানা পাঠাও না, এককালে তো আমাকে বাংলা শেখানোর কি ঝোঁক ছিল তোমার–ঠেকে ঠেকে ঠিক পড়ে নিতে পারব।

–হিন্দী অনুবাদও আছে, তাই পাঠাব, ঠেকে ঠেকে পড়তে হবে না।

সুলক্ষণা ছেলেমানুষের মতোই খুশী হয়ে উঠল। মুখে বলল, তুমি এখান থেকে বেরিয়েই ভুলে যাবে। বাইশ বছরের মধ্যে একদিনও আমার কথা মনে পড়েছে?

–তোমার পড়েছে?

–আমার! হু। তাহলে তো খুব উপন্যাস লেখো তুমি! কি মনে হতেই আবার হাসি-আমার গল্প লিখবে না?

বললাম, তুমি সদয় হলেই লিখতে পারি।

 ছদ্ম ভয়ে দু চোখ বড় করে ফেলল একটু, সদয় হলে মানে? কি করতে হবে?

-মাঝের বাইশটা বছরের ফারাক জুড়তে হবে, অর্থাৎ বাইশ বছরের খবর সব বলতে হবে।

সুলক্ষণা বলল, না শুনেই তো ঘেন্নায় চলে যেতে চাইছিলে, শুনলে তো এ নাম আর মুখেও আনবে না–কলম ধরা তো দূরের কথা!

সেই বিরূপ অনুভূতিটা এরই মধ্যে নিঃশেষে মিলিয়ে গেল কি করে ভেবে পাচ্ছিলাম না। এখন থেকে থেকে কেন যেন কেবলই মনে হচ্ছে শোনার মতো অনেক কথা আছে, আর শুনলে পর কলমও ধরা যাবে। গম্ভীর বক্তৃতার সুরে বললাম, লেখক হিসেবে আমি ভালো-মন্দ সুন্দর-কুৎসিত সব দেখি আর শুনি, শেষে তাই থেকেই জীবন-সোনা ঝালিয়ে তুলি।

সুলক্ষণা তেমনি চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখতে লাগল। তারপর বলল, ও বাবা। থাক, এটুকু শুনেই আমি ঘাবড়ে যাচ্ছি।

চায়ের ট্রে হাতে একটি মেয়ে ঘরে ঢুকল। দু পেয়ালা চা, একটা ডিশে কিছু ঘরের তৈরি খাবার। একটা কাগজ পেতে দিয়ে সেই ট্রেও শয্যার ওপরেই রাখতে বলল সুলক্ষণা। এটুকুও ব্যতিক্রম মনে হল আমার। কারণ, মেয়েটির মুখে বিস্ময়। মাখা সম্ভ্রম দেখলাম।

মেয়েটি চলে যেতে সুলক্ষণা ট্রে থেকে নিজের পেয়ালাটা শুধু তুলে নিল। বললাম, আর কিছু নেবে না?

নাঃ, তোমার খাতিরে চা খাচ্ছি, নইলে এ-সময় কিছুই চলে না। তুমি খাও

একটু বাদে হালকা সুরে জিজ্ঞাসা করল, জয়ন্ত আমার কথা আর কি বলেছে তোমাকে?

-বলেছে, বয়েস হলেও এখনো বেশ মাইরি, চোখ ফেরানো যায় না।

হাসতে গিয়ে চা আটকে বিষম খেল সুলক্ষণা। তারপর আধা-খাওয়া পেয়ালা ঘরের কোণে সরিয়ে রাখতে রাখতে হেসেই রাগ দেখালো, বরাবর ওটা পাজির পা-ঝাড়া একটা

আমি নরম প্রতিবাদ করলাম, কেন, খুব মিথ্যে তো বলেনি।

হ্যাঁ, চাইলে ওর চোখে বাইশ বছর আগের সেই হাসি এখনো ঝিলিক দিয়ে উঠতে পারে বটে। মুখে তরল ঝাঝালো সুরে বলল, দেখো, তুমি ওর সঙ্গে গলা মিলিও না বলছি।

খেতে খেতে নিরীহ প্রশ্ন ছুঁড়লাম, মেলালে ওর মতোই গলাধাক্কা দেবে?

ও মা, ওকে গলাধাক্কা কখন দিলাম!

 বাড়ির হদিস দিলে না, আসবে বলে এলেও না–গলাধাক্কা আর কাকে বলে?

 ও হাসতে লাগল। তারপর বলল, নাঃ, তোমার সঙ্গে ওর মতো ব্যবহার করব, হাজার হোক দুর্বলতা একদা ছিলই

-কার ছিল, তোমার না আমার?

-তুমি বড় জেরা করো। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এখানে কোথায় উঠেছ?

বললাম। একটু ভেবে নিয়ে সুলক্ষণা বলল, লোভ হলেও এখানে তোমাকে থাকতে বলতে পারছি না, জানলে কত জনের চোখ টাটাবে ঠিক নেই। তার থেকে দুপুরে আর রাতে এখানে এসে খাবে–বেশি দূর নয়, টাঙায় মিনিট দশেক লাগে।

-আমি তো কালই দিল্লী চলে যাচ্ছি।

যেন আমার ওপর এখনো জোর আছে, এমনি করে সুলক্ষণা বলল, কাল তুমি মোটেই যাচ্ছ না।

আপত্তি নেই খুব, কারণ সুলক্ষণার জীবনের মাঝের এই বাইশটা বছর নিয়ে এখন দুর্বার কৌতূহল আমার। এতগুলো মেয়ের মধ্যে ওকে ঠিক এই পরিবেশে না দেখলে এত আগ্রহ হত না হয়তো।

একটু বাদেই ওদিক থেকে শাঁখের আওয়াজ কানে এলো। একটি মেয়ে সাঁঝের ধূপধুনো দিয়ে গেল। তারপরেই খোলকরতালের আওয়াজ শুনলাম। সুলক্ষণা আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরুলো। শেষের বড় ঘরটায় এসে ঢুকলাম ওর সঙ্গে। সেখানে এ-মাথা ও-মাথা শতরঞ্জীর ওপর ফরাস পাতা। সেই ফরাসে এখন তিরিশ-চল্লিশটি মেয়েছেলে বসে। বেশির ভাগই বয়স্কা আর বিধবা। ঘরের এক মাথায় মালা গলায় বেশ বড়সড় গোপাল মূর্তি। তার সামনে হারমোনিয়াম, তবলা, খোল করতাল। সেখানে এখানকার অর্থাৎ এই ডেরার মেয়েরা বসে। তাদের সামনে বেশ সুন্দর একটা আসন পাতা।

আমাকে সামনের দিকে বসিয়ে সুলক্ষণা এগিয়ে গিয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে গোপাল প্রণাম করল। কম করে তিন-চার মিনিট মাথা ঠেকিয়ে পড়ে রইল সে। তারপর উঠে আস্তে আস্তে সেই খালি আসনটায় গিয়ে বসল।

গান শুরু হল। একটানা ভজন গান। মূল গায়িকা সুলক্ষণা। অন্য মেয়েরাও থেকে থেকে সুর মেলাচ্ছে, সুলক্ষণা থামলে তারা সেই বিরতিটুকু ভরাট করে রাখছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলল এই গান। না, এরকম গান আমি খুব বেশি শুনিনি। গলা বরাবরই মিষ্টি ছিল সুলক্ষণার। সেই গলা কত যে ভালো হয়েছে আরো, কানে না শুনলে বিশ্বাস হত না। কিন্তু এই গানের গলা আর সুরই যেন সব নয়, সমষ্টিগত সত্তার নিবিড় যোগ না থাকলে এমন গান হয় না, এ-রকম পরিবেশ সৃষ্টি হয় না।

বাইরের মহিলারা সব উঠে উঠে গোপাল প্রণাম করে টাকা আধুলি সিকিটা ফেলে চলে যেতে লাগলেন।

আমি উঠে পায়ে পায়ে আবার সুলক্ষণার ঘরে এসে বসলাম। বাইশ বছর আগের সুলক্ষণার সঙ্গে একে যেন কিছুতে মেলাতে পারছিলাম না।

মিনিট পনের বাদে সুলক্ষণা ঘরে এলো। চোখে মুখের সেই তন্ময় ভাবটুকু গেছে। হালকা সুরেই জিজ্ঞাসা করল, কেমন লাগল?

-বেশ।

 ঠিক এইটুকু জবাব আশা করেনি হয়তো। মুখের দিকে চেয়ে রইল। ভিতরটা আমার হঠাৎই আবার কেন যে অসহিষ্ণু হয়ে উঠল জানি না। হয়তো, সুলক্ষণার বাইশ বছর আগের ঘর ছাড়া, আর এই গোপাল চরণে আত্মসমর্পণ–এর কোনোটার সঙ্গেই আপোস নেই আমার।

বললাম, সবটুকুই ভক্তি না এর সঙ্গে জীবিকার যোগও আছে?

থমকে তাকালো মুখের দিকে। মনে হল বেদনার ছায়াও পড়ল একটু। জবাব দিল, জীবিকার ব্যবস্থা না থাকলে ভক্তি আসবে কোত্থেকে?

-কিন্তু এই দিয়েই তোমাদের এতগুলো মেয়ের দিন চলে যায়?

হয়তো এই প্রশ্নে তির্যক কটাক্ষ ছিল একটু। কিন্তু সুলক্ষণা দয়ালের একটা পরিবর্তন স্পষ্ট। আগের মতো সহজে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে না, ঝলসে ওঠে না, হয়তো বা অনেক নিগ্রহের পরে এই সংযমটুকু আয়ত্ত করেছে। যাক, আমার কথার জবাবে ও যা বলল, সেও অবাক হবার মতোই। সপ্তাহে কম করে তিন-চারদিন বাইরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গানের প্রোগ্রাম থাকে তাদের। হরিদ্বারে কোথাও না কোথাও সে রকম অনুষ্ঠান লেগেই আছে। সবার আগে তাদেরই ডাক পড়ে। সুলক্ষণাদের বিশেষ কিছু দাবিদাওয়া নেই, যারা যেমন দেয়। এখন নাম হয়েছে বলে খুব কমও দেয় না কেউ। এমন কি হরিদ্বারের বাইরেও বহু জায়গায় গাইতে যেতে হয়। দিন বেশ ভালোই। চলে যায় তাদের, অভাব-টভাব নেই।

জিজ্ঞাসা করলাম, এই গানের দল তুমি কতদিন গড়েছ?

একটু ভেবে নিয়ে ও বলল, তা প্রায় বছর নয় হবে।

এবারে আমি সত্যিই অবাক একটু। নবছর আগে হলে তখন তেত্রিশ চৌত্রিশ হবে ওর বয়েস। এখন যা দেখছি, সে-সময় নিশ্চয় ওর ভরা যৌবন, ভরা রূপ। সব ছেড়ে সেই সময় থেকে ও গোপাল আশ্রয় করেছে–এটা স্বাভাবিক ব্যাপার নয় আদৌ। আমি চেয়ে আছি, ওর মুখ থেকেই সেই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা টেনে বার করতে চেষ্টা করছি। শেষে বলেই ফেললাম, ও-বয়সে এ-রকম তো হবার কথা নয়, গোপাল এমন টানা টানলে, কি ব্যাপার?

মুখের দিকে চেয়ে টিপটিপ হাসতে লাগল। তারপর বলল, গোপাল টানলে এমনিই হয়।…তখন ভর-ভরতি অবস্থা আমার, পায়ে করে পুরুষের মন মাড়িয়ে যেতেই আনন্দ, তারই মধ্যে কি কাণ্ড–একেবারে চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে নিজের পায়ে মুখটা আচ্ছা করে ঘষে দিয়ে তবে ছাড়লে–ছাড়লেই বা বলছি কেন, এখনো এই দুষ্টুমিই চলছে।

শুনতে ভালো লাগছে, কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। আমি চেয়েই আছি।

আত্মস্থ হয়ে সুলক্ষণা বলল, অত ব্যস্ত কেন, সব শোনাব বলেই তো ধরে রেখেছি। রোসো, নিজের ভিতরটা আরো ভালো করে খুঁজে দেখে নিই আগে

হেঁয়ালির মতো লাগল। ভিতরের তাগিদ সত্ত্বেও আর জোর করলাম না। কি মনে হতে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার এই মেয়েদের পেলে কোথায়?

নিঃসঙ্কোচে সুলক্ষণা দয়াল জবাব দিল, নিজে থেকেই এসেছে, আগে মাত্র একটি চেনা মেয়ে ছিল, এখন ওরা নজন।…সবই আমার মতো, কেউ নিজে ভুল করেছে, কাউকে বা জোর করে ভুল করানো হয়েছে।

জিজ্ঞেস করলাম, ওদেরও ভিতর-বার এখন গোপালের পায়ে?–

হেসে ফেলল।তাই যাতে হয় আমি তো চেষ্টা করি, আর নেবার আগে যতটা পারি যাচাই বাছাই করে নিই। তবু গণ্ডগোল কি হয় না, এ-পর্যন্ত দু-দুটো মেয়ে ফের আবার লোভে পড়ে এখান থেকে সরে গেছে–আর তোমাদের পুরুষের লোভও বলিহারি, ঠাকুরঘরে থাকো আর যেখানেই থাকো, জাল ফেলার কামাই নেই, পুণ্যিস্থানে। যেন আরো বেশি পাপের বাসা।

সুলক্ষণার সঙ্গে দেখা হবার পরেও চার দিন চার রাত হরিদ্বারে ছিলাম। বলতে গেলে দু বেলাই ওদের এখানে এসেছি। বাড়ির বাইরে দুদিন গানের প্রোগ্রাম ছিল সেখানে ও গেছি। এখানকার মেয়েরা আমাকে শুভার্থী আত্মায় ভেবেছে। সুলক্ষণা তাদের কি বলেছে জানি না, কিন্তু আমার প্রতি তাদেরও কোনো রকম পলকা কৌতূহল। দেখিনি। উল্টে অবিমিশ্র শ্রদ্ধাই দেখেছি।

ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথা হয়েছে সুলক্ষণার সঙ্গে, কিন্তু একটি বারও সে এর মধ্যে কৃষ্ণকুমারের বা তাদের বাড়ির কারো নামও উচ্চারণ করেনি। ক্রমে আমারই ধৈর্য কমে আসছিল। ফঁক পেলেই তাগিদ দিচ্ছি, বলবে বলেও তো কিছুই বললে না–এবার যেতে হচ্ছে আমাকে।

গতকালও বলেছিলাম। ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে একটু চেয়ে থেকে ঝাঁঝ দেখিয়েছে, আমি কি তোমাকে ধরে রেখেছি?

বলেছিলাম, তা অবশ্য রাখোনি–

তেমনি করেই ও আবার বলেছিল, পুরুষের স্বভাবই ওই রকম, এতবড় দেবস্থানে। এসেও নরকের কথা শোনার লোভ।

আমি হেসেই জবাব দিয়েছিলাম, নরকের কথা তো নয়, নরক থেকে ওঠার। কথা। সেটা শোনার মধ্যে পুণ্যি আছে।

–ছাই আছে। ওঠা তো ভারি, এই যে তুমি চলে যাবেই, তোমার বাড়ি-ঘর স্ত্রী ছেলেমেয়ে আছে–অথচ তোমাকে সত্যি ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে।

দু কান ভরে শোনার মতো কথা, একটু চুপ করে থেকে বলেছিলাম, করলেই বা, এ ইচ্ছের মধ্যে তো নরক নেই।

..ওর চোখেমুখে যে সুন্দর হাসিটুকু দেখেছিলাম তাও ভোলার নয়।

আজ সকালে আবার বললাম, কাল সকালে আর না গেলেই নয়, কাজের খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে–রিজারভেশান পেলে সোজা এখান থেকে কলকাতাই চলে যাব।

সুলক্ষণা বলল, ঠিক আছে, নাম-গানের দৌলতে আমার একটু চেনা-জানা আছে, একেবারে অসম্ভব না হলে রিজারভেশান পেয়ে যাবে।

সন্ধ্যেয় রিজারভেশানের টিকিট আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, নিশ্চিন্ত?

আমিও হেসেই মাথা নাড়লাম।

এই রাতটুকুই প্রত্যাশা আমার। ছিলামও রাত প্রায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত। কিন্তু এ-দিন দেখলাম একলা পাওয়াই ভার ওকে। মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত, আমার খাওয়ার ব্যাপারে ব্যস্ত। কাল ট্রেনে আমার সঙ্গে কি কি খাবার যাবে–মেয়েদের সেই নির্দেশও দিচ্ছে।

রাতে হোটেলে ফেরার মুখে ওকে কাছে দেখলাম না। একটি মেয়ে বলল, দিদি এইমাত্র তার ঘরে গেলেন–

পায়ে পায়ে তার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভিতরে এসে দাঁড়ালাম। স্টীলের বাক্স খুলে ওদিক ফিরে কিছু একটা করছে ও।

ঝুমরি…।

চমকে ফিরে তাকালো। তারপর হেসেই ফেলল। বলল, বাইশ বছর বাদে এ ডাক শুনে ভয়ানক চমকে গেছলাম।

চললে?

–হ্যাঁ।

এগিয়ে এলো। হাসছে তখনো।–ঠিক আছে। তোমার খাবার নিয়ে সকালে ঠিক সময়ে আমি স্টেশনে যাবখন।

এসেছে। একলাই। ট্রেন ছাড়তে তখন আর মিনিট দশেক মাত্র বাকি। খাবারের পাত্রটা জায়গা মতো রেখে এ-দিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, জল কোথায়?

–আছে। বসো তুমি। আমি ভাবলাম আর এলেই না।

কুপেতে তখন পর্যন্ত আমি একা। আমার হাতখানেক তফাতে বসে সুলক্ষণা বলল, তোমাদের তো ওই রকমই ভাবনার দৌড়।..কলকাতায় পৌঁছে চিঠি দেবে তো?

–চিঠি দিলে জবাব পাব?

হাসিমুখেই মাথা নাড়ল, তা অবশ্য পাবে না। আচ্ছা তোমাকেও চিঠি লিখতে হবে না, দেখা হল, এই ভালো। গোপালের দয়ায় নিরাপদে পৌঁছুবে জানিই তো।

ঘড়ি দেখলাম। আর পাঁচ মিনিট মাত্র বাকি। অভিমানহত সুরে বললাম, আমারই শেষ পর্যন্ত কিছু জানা হল না।

-হবে, হবে। হাতের ঝোলা খুলে বাদামী রংয়ের বড় খাম বার করল একটা।-তুমিও যেমন, এ-সব কথা মুখে বলা যায় নাকি! খামটা হাতে দেবার আগে থমকালো একবার।–কিন্তু একটা কথা, আমাকে নিয়ে কোথায়ও কিছু লিখবে না!

–কেন?

লিখলে তুমি ঠিক আমাকে বাড়াবে জানি। সব কবুল করতে পেরে আমার মনে একটু শান্তি এলো–ব্যস, এর বেশি আর কিছু চাই নে। রাস্তায় যেতে যেতে পড়বে, তারপর ছিঁড়ে কুচি কুচি করে জানলা দিয়ে ফেলে দেবে। ঠিক তো?

হাত বাড়িয়ে ওর হাত থেকে খামটা নিলাম। বললাম, সেটা না পড়া পর্যন্ত বলতে পারছি না–তবে বাড়াবো না, কথা দিলাম।

ঘড়ি ধরে গাড়ি ছেড়েছে। তার আগে সুলক্ষণা নেমে জানলার কাছে দাঁড়িয়েছে। চলন্ত ট্রেন থেকে যে কয়েক সেকেন্ড দেখা গেছে তাকে, দেখেছি। তারপর খাম খুলে বসেছি।

কথার খেলাপ করব না। বাড়ানোর ভয় আছে বলেই, সুলক্ষণা দয়াল যা লিখেছে। সেটুকুই শুধু তুলে ধরছি।

বাঙালীবাবু রাতে যাবার আগে তুমি ঝুমরি বলে ডাকলে, আমারও বাইশ বছর আগের প্রিয় নামে তোমাকে ডাকার সুবিধে হয়ে গেল। আমার মেয়েদের কাছে এ. কদিন তোমাকে বাঙালীবাবুই বলেছি, আর আমার নিজেরই দু কান যেন ভরে গেছে।

তোমার অনেক জানতে চাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বড় নোংরা ব্যাপার সব। সাধকরা বলেন, পাপ ধুয়ে ফেলতে চাও তো পাপ স্বীকার করো। কিন্তু কার কাছে স্বীকার করব? ঘরের দেওয়ালের কাছে? তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তোমার জানার লোভ থেকে আমার জানানোর লোভটা কম ছিল না। কিন্তু দোহাই তোমার, সবটুকু পড়ার আগেই ঘেন্নায় ছিঁড়ে ফেলে দিও না।

..জীবনে প্রথম যে মানুষকে দেখলে আমার দুচোখ ঘৃণায় ঠিকরতো, আর মাথায় খুন চাপতো, সে আমার বাবা। একদিন আমি এই বাবাকেই দুনিয়ার সেরা সুন্দর পুরুষ ভাবতাম। বাবা যখন গান-বাজনা নিয়ে বসত, আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম আর ভাবতাম ওরকম গানের আসরে কবে আমারও জায়গা হবে।

বাবা মদ খেত তাও আমার কাছে খুব একটা দোষের কিছু নয়। মা রাগ করত, আর আমি ভাবতাম মা-ই ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধায়। আমার পনের বছর বয়সের সময় মায়ের শরীর একেবারেই ভেঙে গেল। চড়া ডায়বেটিস। উঠতে বসতে মাথা। ঘোরে। একদিন বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। বাড়িতে কেউ নেই, উৰ্বশ্বাসে আমি ছুটলাম দুর্গা মাসির বাড়ি। বাবা সেখানে আড্ডা দিতে যায়। এই দুর্গা মাসির সম্পর্কেও পাড়ার লোকে ভালো বলে না। দুর্গা মাসির কেন বিয়েই হল না, তাই নিয়েও এক-একজন এক-এক রকম বলে। কিন্তু ও-সবেও আমি কান দিই না। কারণ দুর্গা মাসি হাসে খুব, আমি গেলে আদর করে কাছে টেনে নেয়। ভালো ভালো খেতে দেয়।

বাড়ি থেকে পনের মিনিটের হাঁটা পথ এক ছুটে চলে এসেছি। বেদম হাঁপাচ্ছি। কিন্তু দুর্গা মাসির বাড়ি এসে মনে হল, কেউ নেই। দুটো ঘরই অন্ধকার। সামনের ঘরের দরজা খোলা, পিছনের অর্থাৎ দুর্গা মাসির ঘরের দরজা ভেজানো। ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালোম।

তারপরে কয়েক পলকের জন্য যেন পাথর আমি। কি দেখলাম তা আর বলে কাজ নেই। ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম আবার। আরো দ্বিগুণ ছুটে সোজা বাড়ি। এর মধ্যে বিকেলের ঠিকে ঝিটা এসেছিল। মাকে ওই অবস্থায় দেখে সেই পাড়ার লোক ডাকাডাকি করে তাকে ঘরে এনেছে।

আমি সে-ঘরেও আর থাকতে পারলাম না। বাইরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। সমস্ত পৃথিবীটা আমার কাছে একটা দগদগে ঘায়ের মতো বীভৎস লাগছে।

মিনিট কুড়ির মধ্যে বাবা এলো। এসেই আমার গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল। এমন চড় যে আমি ঘুরে পড়ে গেলাম।

মা আর সে-যাত্রা রক্ষা পেল না। তার তিন মাসের মধ্যে বিয়ে করে বাবা দুর্গা মাসিকে ঘরে নিয়ে এলো। দুর্গা মাসি গোড়ায় গোড়ায় আমার মন পেতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাকে দেখলেই আমার দুচোখে গলগল করে ঘৃণা ঠিকরতো। ফলে বাবা আমাকে শাসন করত। তার ফলও উল্টো হত।

ভালবাসা ঠিক কাকে যে বলে আমি তখনো জানি না। শুনলে তুমি কানে আঙুল দেবে কিনা জানি না, আমার জীবনে প্রথম ভালবাসার মানুষ কৃষ্ণদাদা। ওই কাজিন বিয়ে না কি বলে, আমাদের সমাজে সেটা চালু থাকলে যে করে তোক কৃষ্ণদাকে নিয়ে আমি পালাতাম, প্রাণ দিয়ে চিকিৎসা করতাম, তাকে ভালো করে তুলতাম। কৃষ্ণদাদার ঝাঁঝরা বুকের সঙ্গে নিজের বুকটা বদলাবদলি করা সম্ভব হলে তাও করতাম বোধহয়। আমার ভালবাসা কৃষ্ণদাকে শুধু সুস্থ করে তুলতে চেয়েছে, আর কিছু না। এই ভালবাসা কি পাপ?

কিন্তু এখানেও নিজের বাবার মতোই একজনকে আমি ঘৃণা করতে শুরু করলাম। সে কৃষ্ণকুমারের বাবা। আমার পিসেমশাই। তার সেই বড় আদরের বন্ধু যজ্ঞেশ্বরবাবুকে নিশ্চয় মনে আছে তোমার? বয়সে পিসেমশাইয়ের থেকে পাঁচ-ছ বছরের ছোট, পিসেমশাইকে দাদা-দাদ করত। পয়সাঅলা মানুষ, আমি এলাহাবাদে আসার আগেই তার বউ মরেছে শুনেছিলাম। তখন উনিশ পেরিয়ে সবে কুড়িতে পা দিয়েছি আমি, বোনকে একদিন আমাকে দেখাতে নিয়ে এলো যজ্ঞেশ্বরবাবু। ওই বোনের ছেলে মস্ত সরকারী চাকুরে, তার বিয়ে দেওয়া হবে। ভালো মেয়ে চাই। দাবিদাওয়া নেই। পিসেমশাই আর পিসির অনুরোধ ঠেলতে না পেরে যজ্ঞেশ্বরবাবু বোনকে নিয়ে এলো মেয়ে দেখাতে। মানে আমাকে দেখাতে। আমি জোর করে বলতে পারি সেই বোনের আমাকে পছন্দ হয়েছিল। নানাভাবে আমাকে যাচাই করে দেখে আর গান শুনে খুশীতে আটখানা হয়ে চলে গেছল। কিন্তু পরে গম্ভীরমুখে পিসেমশাই এসে খবর দিল তার নাকি মেয়ে পছন্দ হয়নি।

পছন্দ না হওয়ার কারণটা দুদিন না যেতেই বেশ বোঝা গেল। সন্ধ্যায় পিসেমশাই কেমন যেন চুপিচুপি এক জায়গায় যেতে হবে বলে আমাকে ধরে নিয়ে গেল। রাস্তায়। বলল, যজ্ঞেশ্বরের শরীরটা ভালো না, তোর গান শোনার ইচ্ছে হয়েছে, তাই

তখনো সাদা মনেই গেছি আমি। বিরাট চক-মিলানো দালান। যজ্ঞেশ্বরবাবুর ঐশ্বর্যের কথা বলতে বলতে পিসেমশাই আমাকে তার কাছে নিয়ে গেল। যজ্ঞেশ্বরবাবুর ছেলে তিনটে কাছাকাছিই ছিল, বড় ছেলেটা আমার থেকে বড় হবে বয়সে–সে আমাকে চোখ দিয়ে গিলতে গিলতে আর একদিকে চলে গেল।

যজ্ঞেশ্বরবাবুকে একটুও অসুস্থ মনে হল না আমার। দিব্যি হাসিখুশি ফুর্তির মেজাজ। আমাকে আর পিসেমশাইকে একরাশ খেতে দিল। তারপর গান নিয়ে বসলাম। গাইতে গাইতে ওই লোকটার সঙ্গে বার কয়েক চোখাচোখি হতেই আমার মনে হল কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে পড়তে চলেছি। গান একটুও ভালো হল না। কিন্তু যজ্ঞেশ্বরবাবু প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একে একে অনেকগুলো গান গাইয়ে ছাড়লে।

ফেরার সময় পিসেমশাই আমাকে খোলাখুলি যা বলল, তার সার কথাযজ্ঞেশ্বরের মতো অত ভালো লোক আর হয় না, যেমন পয়সা তেমনি দরাজ মন। বয়েস একটু হয়েছে, তাও পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশের মধ্যে–ব্যাটাছেলের সেটা এমন কিছু বয়েস নয়। তার খুব পছন্দ তোকে, রানীর হালে থাকবি-মাথা ঠাণ্ডা করে ওকেই বিয়েটা করে ফেলা উচিত।

শোনার পর সর্বাঙ্গ রি-রি করে উঠল আমার। জবাব না দিয়ে আমি শুধু মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ তা হবে না।

তাইতেই পিসেমশাই রেগে উঠল। আমার অবাধ্য হবি? আমি তোর ভালো বুঝি না?

আমাকে চুপ দেখে একরকম শাসিয়েই দিল তারপর। যা হবার পরে ভেবে চিন্তে হবে, কিন্তু এ নিয়ে যেন বাড়ির কাউকে একটি কথাও না বলি।

তার ভয় কৃষ্ণদাদাকে। কিন্তু তাকেও কিছু বলতে পারা গেল না। বললে কতবড় অশান্তির সৃষ্টি হত জানি। আর তখন কৃষ্ণদার যা শরীরের হাল।

কদিন না যেতে পিসেমশাই আবার আর একদিন যজ্ঞেশ্বরবাবুর বাড়ি নিয়ে যেতে চাইল। আমি গেলাম না। পিসেমশাই রাগে ফুঁসতে লাগল। এর একদিন পরেই যজ্ঞেশ্বরবাবু বাড়ি এসে হাজির। পিসেমশাইও ঘটা করে তার আদর আপ্যায়ন করল। তারপর আমার ডাক পড়লো, গান শোনাতে হবে। কৃষ্ণদাই আমাকে ঠেলে পাঠালো, ভদ্রলোক এসেছেন বাড়ি বয়ে, গান শোনাবি না তো গান শিখিস কেন?

এক ঘণ্টা ধরে গান হল। আর সেই এক ঘণ্টা ধরে দুই চোখ দিয়ে আমার শরীরটা যেন চেটেপুটে খেল যজ্ঞেশ্বরবাবু। চলে যাবার পর পিসেমশাই আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে প্রায় শাসিয়েই দিল, আমার অবাধ্যপনা বরদাস্ত করা হবে না, দুদিন আগে হোক পরে হোক বিয়ে ওখানেই হবে। তোর পিসিকেও আমি বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করিয়েছি–এর থেকে ভালো যে আর কিছু হয় না সেটা সেও বুঝেছে। আর তার শেষ কথা, ছেলে এখন অসুস্থ, তাকে যেন এখন এসব কথা শুনিয়ে একটুও বিরক্ত না করা হয়। আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে এটুকুই তার নির্দেশ।

আমি চারদিকে তখন অন্ধকার দেখছি। এর ওপর পরদিনই আবার কৃষ্ণদার গলগল করে রক্ত পড়ল গলা দিয়ে। আমার মনে হল কৃষ্ণদা দশ-বিশ দিনের মধ্যেই চলে যাবে। তারপর? ওই পিসেমশাই আর ওই যজ্ঞেশ্বরের হাত থেকে কে আমাকে রক্ষা করবে? বিশ্বাস করো বাঙালীবাবু, আমার তখন প্রথমেই তোমার কথা মনে হয়েছিল। তোমাকে ভালো লাগে, বাঁচার তাগিদে তোমাকে নিয়ে পালাতে আমার একটুও আপত্তি হত না। আর সেভাবে আঁকড়ে ধরতে পারলে তুমিও আমাকে ছাড়তে পারতে না। কিন্তু তারপরেই মনে হল, তোমার অন্য রকম সমাজ, অন্য রকম পরিবার। আমার প্রতি তোমার একটু দুর্বলতা আছে বলে এমন একটা শাস্তি তোমার ওপর চাপিয়ে দেব! নিজের সমাজ, সংসার থেকে বঞ্চিত হয়ে একদিন তুমিই কি আমাকে ঘৃণা করবে না?

তোমাকেও বাতিল করে দিলাম। তখন থাকল আর একজন। তার খবর তোমরা কেউ রাখো না। তার নাম কিশোর শেঠ। যে ওস্তাদের কাছে আমি গান শিখতাম, তারই আর এক শিষ্য। মাখনখানার মতো চেহারা। দুহাতের পাঁচ আঙুলে পাঁচটা আংটি ঝকমক করত। জামায়ও হীরের বোতাম পরত। নিজের ঝকমকে একখানা গাড়ি হাঁকিয়ে আসত সে। আমার সপ্তাহে যে দুদিন গান শেখার পালা, তার সেদিন আসার কথাও নয়। কিন্তু দু-চারবার দেখা হয়ে যাওয়ার পর ক্রমে দেখা গেল ওই দু-দিনই সে সব থেকে নিয়ম করে আসত। গুরুর কাছে আসবে, তালিম দেওয়া শুনবে–তাতে আর কার কি বলার আছে। তাছাড়া ওই ওস্তাদের মতো ভালো মানুষও কম হয়।

কিশোর শেঠ কেন যে আসত আমিই শুধু ভালো বুঝতাম। এক-একদিন গাড়ি নিয়ে সে একটু দূরে অপেক্ষা করত। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাইত। আমি তার সঙ্গে কথা বলতাম না, চোখ দিয়ে চাবকে অন্য দিকে ফিরে চলে আসতাম।

কলেজ যাবার সময়ও এক-একদিন তার গাড়ি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যেত। গাড়িতে আমাকে কলেজে পৌঁছে দেবার জন্য অনুনয়ই করত। আমি ঝাঁঝিয়ে উঠতাম, ফের এ-ভাবে আমার পিছু নিলে মুশকিল হবে। কিশোর শেঠ হাসত, বলত, তুমি নারাজ, এর থেকে মুশকিল আর কি হতে পারে?

বড়লোক শিষ্যকে গুরু যে একটু বেশি খাতির করতেন সে আমার নিজের চোখেই দেখা। সেখানে বলে কিছু সুবিধে হবে না। বাড়িতে কৃষ্ণদার এই হাল। মাঝখান থেকে লোক জানাজানি হয়ে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হবে। আমি রাগে ফুলতাম, কিন্তু সহ্যও করতে হত। লোকটারও মুণ্ডু যে ভালোভাবেই ঘুরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গুরুর বাড়ির আর কলেজ যাওয়ার পথ যে আকুতি নিয়ে গাড়িতে বসে থাকত, তাই দেখে সময় সময় হাসিও পেত। আমাকে একটু চোখের দেখা দেখতে পেলেও যেন জীবন ধন্য ওর।

আমার সেই সংকটের সময় ওর কথাই মনে এলো আমার। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভাঙচুরের নেশা যেন পেয়ে বসল আমাকে। এই করলে বাবার ওপর শোধ নেওয়া হবে, পিসেমশাইয়ের ওপরেও।

সেদিনও কলেজের পথে কিশোর শেঠের গাড়ি দাঁড়িয়ে দেখলাম। সোজা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে তার পাশে বসলাম। এ-রকম ভাগ্য ওর কল্পনার বাইরে। আনন্দে ডগমগ হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কলেজে তো?

-না। যেখানে খুশি।

হাওয়ায় ভেসে চলল কিশোর শেঠের গাড়ি। আমি সোজা ঘুরে বসলাম তার দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি ঠিক ঠিক কি চাও বলো?

ও বলল, তোমাকে।

–বিয়ে করবে?

 দম বন্ধ করে ও মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিল, করব।

–তোমাদের বাড়িতে আপত্তি হবে না?

 মুখ কাচুমাচু করে ও বলল, তা একটু হবে হয়তো…।

-তাহলে?

— ও প্রাণপণে এই তাহলের জবাব হাতড়ে বেড়াতে লাগল। আমিই রাস্তা দেখালাম, আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে?

ও লাফিয়ে উঠল। তক্ষুনি রাজী। আমি বললাম, আজ নয়, সময়ে বলব। বাড়িতে বলে রেখো কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছ, নইলে তোমার বাড়ি থেকেও আবার। খোঁজাখুঁজি শুরু হবে। আর বেশ কিছুদিন চলার মতো টাকাকড়ি সঙ্গে নিও।

অত বলার দরকার ছিল না। ব্যবস্থামতো আমরা চলে এলাম বেনারসে। এক নাগাড়ে কোথাও বেশিদিন থাকতাম না। ইউ পি-র সর্বত্র প্রায় মাসখানেক ঘোরাঘুরি করে কাটল। কিশোর শেঠ আমার কেনা গোলাম যেন। যা বলি তাই শোনে। আমার একটু সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আর আনন্দের জন্য দেদার খরচ করে। ওকে যতটুকু পাগল করা দরকার করেছি। বিকেল হতে না হতে রাতের প্রত্যাশায় বসে থাকত। কিন্তু বিয়ের কথা তুললেই ওর মুখ ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যেত। বলত, হবে, খুব শীগগিরই হবে, তুমি অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন?

আমার সন্দেহ বাড়তে থাকল। শেষে জেরার ফলে একদিন ধরা পড়ে গেল। দু-বছর আগেই ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ঘরে বউ আছে। হাঁটু গেড়ে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে ওর সে-কি আকুতি। বিয়ে করলেও আমিই ওর ধ্যান জ্ঞান, আমিই সব। বিয়ে ও আমাকে ঠিকই করবে, কিন্তু তার আগে সব দিক গুছিয়ে নেবার জন্য ওর কিছু সময় দরকার।

আমার মাথায় আকাশ ভেঙেছে। ওর বুকে একটা ধারালো ছোরা বসিয়ে দিতে পারলে মন ঠাণ্ডা হত। সেই রাতে আমার শয্যার দিকে ওকে ঘেঁষতে দিলাম না। সমস্ত রাত বসে ভাবলাম। একদিন ওই কিশোর শেঠ আমাকে ছেড়ে চলে যাবে ঠিক জানি। কিন্তু তার আগে ওকে অবলম্বন করেই আমাকে দাঁড়াতে হবে, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। এটুকু যদি না পারি, আমার রূপ যৌবন চোখের আগুন। সব মিথ্যা।

পরদিনই আবার ওকে কাছে টেনে নিলাম। খুব হাসলাম। খুব আদর করলাম। বললাম, তুমি এত ছেলেমানুষ আমি জানতাম না, প্রথমেই সব আমাকে খুলে বললে পারতে–সত্যিকারের ভালবাসার মানুষকে ওটুকুর জন্যে কেউ কি ফেলে দিতে পারে, না কি সত্যিকারের ভালবাসা সমাজসংসারের পরোয়া করে?

কিশোর শেঠ বর্তে গেল।

আমি আরো নিশ্চিন্ত করে দিলাম তাকে। বললাম, যাকগে, বিয়ের ভাবনা আর তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি তোমার প্রেয়সী হয়েই থাকব–কিন্তু তুমি আমাকে তোমার রুচির যোগ্য করে তোলো, এই যৌবনের ফুল শুধু তোমার জন্যেই যেন সম্পূর্ণ হয়ে ফুটতে পারে সেই ব্যবস্থা করো।

ব্যবস্থাটা কি প্রথমে বোঝেনি, পরে বোঝার পর আনন্দে আত্মহারা হয়েছে। হবে না কেন, টাকার তো অঢেল জোর। ওকে নিয়ে আমি লক্ষ্ণৌ চলে এসেছি। সেখানে অনেক খরচ করে গুণী ওস্তাদ রেখে আবার গান বাজনার তালিম নিতে শুরু করেছি। নাচও বাদ দিইনি। নামী বাঈজীর কাছে সহবৎ শিক্ষা করেছি। না, বোকার মতো কিশোর শেঠকে আমি সেখানে আটকে রাখিনি। সে তারই ইচ্ছে মতো বাড়িতে গেছে,এসেছে। যখনই এসেছে দু পকেট বোঝাই টাকা এনেছে। আমি অম্লান বদনে সে-টাকা নিজের দখলে রেখেছি, আর প্রতি বারের থেকে প্রত্যেক বারে বেশি প্রেমের অভিনয় করেছি। ওকে পাগল করাটাই আমার লক্ষ্য। পাগল করেছি।

খুব বেশি সময় লাগেনি। গলা তো অনেকটা তৈরিই ছিল, বছর চারেকের মধ্যেই আমাকে নিয়ে টানাটানি পড়তে লাগল। আমার রূপ যৌবন কটাক্ষ সবই কাজ করত, ফলে টাকাও বেশি পেতাম। নাচ গান তো আছেই, আরো প্রত্যাশায় টাকার মানুষেরা। পায়ে এসে গড়াগড়ি খেত। প্রাপ্যগণ্ডা মনের মতো হলে তাদেরও করুণা করতে আমার আপত্তি হত না। আমার ভিতরে সেই থেকেই শুধু ধ্বংসের আগুন জ্বলছে। সেই আগুনে নিজেকে পোড়ানো আর মত্ত উল্লাসে পুরুষ পোড়ানোই একমাত্র লক্ষ্য। সে-সময়ে যদি তোমার দেখা পেতাম বাঙালীবাবু, তাহলে তোমারও কি সর্বনাশ যে হত কে জানে। কৃষ্ণদা অনেক আগেই মারা গেছে সে-খবর কিশোর শেঠ আমাকে এনে দিয়েছিল। আমার কাছে দুনিয়ার বাকি সব পুরুষ নরকের জীব। তারা যত বেশি জ্বলবে আমার তত উল্লাস।

এর পর আমার প্রথম কাজ কিশোর শেঠকে ছিবড়ের মতো বাতিল করা। আমার আশা ছেড়ে তাকেও একদিন জ্বলতে জ্বলতে ঘরে ফিরতে হয়েছে। আমার ব্যাঙ্কের জমা টাকা বাড়ছেই, অলঙ্কারের ঐশ্বর্যও বাড়ছেই। পুরনো হয়ে যাবার ভয়ে খুব বেশিদিন কাউকে আমি এক নাগাড়ে ধরে রাখি না। ফলে নতুন নতুন মানুষের ধর্ণা দেওয়া আর মাথা খোঁড়ারও বিরাম নেই।

এবারে নিশ্চয় ঘৃণায় শিউরে উঠছ বাঙালীবাবু। আরো একটু বাকি–শোনো। তখন। আমার বয়েস বত্রিশ পেরিয়েছে। অর্থাৎ এলাহাবাদ ছাড়ার পর তের-চোদ্দ বছর কেটে গেছে। কিন্তু পুরুষ তুখনো আমাকে নিয়ে এমনি মত্ত যে বয়েস দেখার চোখ কারো। নেই। এদিক-থেকে ভুগর্বানের কিছু মাত্র কার্পণ্য ছিল না বলে বয়েস চোখে পড়ার কারণও নেই। সেবারে এক ধনীর দুলালের সঙ্গে এসেছি মধ্যপ্রদেশের কোনো এক জায়গায়। টাকার অঙ্ক সে-রকম হলে তাতেই বা আপত্তি কি? এ-রকম কত সময়। কত জায়গায় গেছি, ঠিক নেই।

জঙ্গলের মধ্যেই মাঝারি আকারের একটা ডাক-বাংলো। ফুর্তির জায়গা হিসেবে। আমার সঙ্গী সেই বাংলোটাই বেছে নিয়েছে। বাংলোয় আমি আর সে ছাড়া আর যে লোকটার অবস্থান, মানুষ না বলে তাকে জানোয়ারই বলা চলে। বছর সাঁইতিরিশ আটতিরিশ হয়তো বয়েস, পা থেকে গলা পর্যন্ত গরম কম্বল জড়ানো, মাথার চুল পিছন দিকে পিঠে এসে নেমেছে, আর গাল বোঝাই দাড়ি বুকের দিকে। গায়ের আর চুল দাড়ির রং মিলেমিশে একাকার। এখানে আসার পর এমনি হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়েছিল যেন জীবনে আর কখনো মেয়েছেলে দেখেনি। আমার সঙ্গী ধমকে উঠতে তবে সে আত্মস্থ হয়েছে।

লোকটা এই বাংলোর চৌকিদার।

আমরা বিকেলের দিকে এসেছি। দিন দুই থাকার ইচ্ছে। সন্ধ্যা নামতেই সঙ্গী মদের গেলাস নিয়ে বসেছে। ওরা যত মদ গেলে আমার তত সুবিধে। হামলা হুজ্জোত কম। হয়। ওকে সঙ্গ দেবার জন্য আমিও গেলাস নিয়ে বসেছি। আর খাচ্ছিও একটু বেশিই। সেই সঙ্গে গুনগুন করে রসের গানও গেয়ে উঠছি। এক-একবার উঠে নাচার চেষ্টাও করছি।

রাত তখন নটা-দশটার বেশি নয়। কিন্তু এখানে তখন নিঝুম রাত। খাওয়াদাওয়ার পরে আবার এক-প্রস্থ মদ গিলল লোকটা। তারপর আমার দিকে এগলো। ঘরে সবুজ আলো জ্বলছে। আমার ঘুম পাচ্ছে। কতক্ষণে অব্যাহতি পাব ভাবছি।

হঠাৎ ঠাস করে ঘরের ভেজানো দরজা দুটো খুলে গেল। কেউ যেন প্রচণ্ড এক লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলল। ঘরে এসে দাঁড়াল যমদূতের মতো সেই চৌকিদার। জন্তুর মতোই জ্বলছে তার দুটো চোখ। গায়ের কম্বল ফেলে এগিয়ে এসে আমার বুকের ওপর থেকে সঙ্গীকে যেন ছোঁ মেরে টেনে তুলে নিয়েই এক আছাড়। লোকটা আর্তনাদ করে উঠল। আমি কাঠ। যমদূতের মতো ওই চৌকিদার আবারও এগিয়ে গেল তার দিকে, আবারও টেনে শূন্যে তুলে নিল। তারপর তাকে নিয়ে চোখের পলকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমি কাঁপছি থরথর করে। কি চায় লোকটা? কি মতলব ওর? একে একে দুজনকেই খুন করবে আমাদের?

একটু বাদেই মোটর স্টার্ট দেবার শব্দ কানে এলো। কি হল? আমাকে রেখে সঙ্গীকে গাড়িসুদ্ধ তাড়িয়ে দিল। ওই শীতেও আমি ঘামছি। শয্যায় উঠে বসে কাঁপছি।

সাক্ষাৎ যমের মতো ওই চৌকিদার ফিরল আবার। আমার দু হাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে অপলক চেয়ে রইল। এখন আর ওই দুটো চোখ জানোয়ারের মতো জ্বলছে না। তার বদলে গলগল করে যেন ঘৃণা ঠিকরোচ্ছে। সেই ঘৃণা আমার চোখে মুখে ঝাপটা মেরে যাচ্ছে।

কিন্তু এরকম অপলক চাউনি আমি আর কি দেখেছি? কার দেখেছি? কবে দেখেছি? কোথায় দেখেছি? এ কাকে দেখছি আমি? আমার সামনে দাঁড়িয়ে এ কে?

লোকটা নিজের মোটা ময়লা জামার পকেটে হাত ঢোকালো। কি যেন বার করল। তারপর সেটা আমার সামনে, সজোরে আমার বিছানার ওপর আছড়ে ফেলল।

জিনিসটা চিকচিক করে উঠল। দু চোখ বিস্ফারিত করে আমি দেখলাম একটা হার। আমার মায়ের দেওয়া সেই চুরি যাওয়া হার।

মুখ তুলে দেখলাম, লোকটা ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

 এবারে চিনলাম। সেই মধু। সেই মধু যাদব।

তার পর থেকে বাঙালীবাবু, তুমি যা দেখলে আমি তাই। এক বছর বাদে। মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলের সেই বাংলোয় আর একবার গেছলাম মধুর খোঁজে। সে নেই। কোথায় গেছে কেউ জানে না। আমি এখনো গান গাই আর গোপাল পুজো করি। আমার গোপালের মুখ আর মধুর মুখ আজও মাঝে মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সেও কি পাপ?

আমি জানি না।