প্রথম পরিচ্ছেদ – সুর এবং অসুর
আজ থেকে দু-শো বছর আগেকার কথা। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে অবাধে চলছে ডাকাতি, চলছে লুঠতরাজ। ইংরেজের পুলিশ ও সেনাবিভাগ মাঝে মাঝে দস্যুদের পাকড়াও করার চেষ্টা করছে, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারছে না। সেযুগের লোক পুলিশি ব্যবস্থার উপর খুব বেশি আস্থা রাখতে শেখেনি, তার চেয়ে বেশি ভরসা করত তারা জোয়ানের হাতের লাঠির উপর। তারা জানত বীরভোগ্যা বসুন্ধরায় শক্তিই একমাত্র যুক্তি…।
চৈত্রমাস। ভুবনডাঙা গ্রামটা শেষ হয়ে যে মস্ত মাঠটা চোখে পড়ে, রোদের তেজে সেদিকে আর তাকানো যায় না। মাথার উপর আগুন ছড়িয়ে হাসছে চৈত্রের প্রখর সূর্য–জ্বলছে আকাশ, জ্বলছে বাতাস আর সেই জ্বলন্ত নরকে যোগ দিতে মাঝে মাঝে ছুটে আসছে পাগলা হাওয়ার ঘূর্ণি ঝড়, সঙ্গে উড়িয়ে আনছে যত রাজ্যের আবর্জনা, শুকনো পাতা আর ধুলোবালি…
মাঠের শেষে যে-জঙ্গলটা শুরু হয়েছে, সেখানে প্রবেশ করলে অবশ্য আরাম পাওয়া যায়। কিন্তু মাঠের বুকে, খাঁজে খাঁজে ও গর্তের মধ্যে যে বুকে-হাঁটা জীবগুলো বাস করে, তারা সবাই এসে এখন আশ্রয় নিয়েছে ঠান্ডা জঙ্গলের মধ্যে; তাদের কথা মনে পড়লেই ক্লান্ত পথিকের বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছা আর থাকে না–কারণ, যদিও দিনের বেলা এত গরমে তাদের বাইরে আসার নিয়ম নেই, তবু দু-একটি অবাধ্য নাগসন্তান যদি হঠাৎ কোনো বেআইনি কাজ করে ফেলে তবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার ফুরসত হবে না–
ওর নাম সাপ, ঠেকালেই সোনা!
শুধু তাই নয়; এই ছোটো জঙ্গলের মধ্যে অতিকায় বিড়ালগুলি দিনমানেও বেড়াতে আসে–যাদের গাঢ় কমলা-হলুদ চামড়ার উপর কালো কালো গোল ছাপগুলি গাছের ছায়ায় ছায়ায় ঝোপঝাড়ের মধ্যে মিশে যায়, যাদের মখমল-কোমল পায়ের গদিতে লুকিয়ে থাকে ছুরির চেয়েও ধারালো বাঁকা বাঁকা নখ–হঠাৎ মানুষের সামনাসামনি পড়ে গেলে তারা গেরস্ত বাড়ির মিনি কিংবা পুষির মতো চুপচাপ সরে পড়বে এমন কথা বলা যায় না
চিতাবাঘ বড়ো হিংস্র জানোয়ার।
তবু এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে লোক চলাচল করে, করতে বাধ্য হয়। কিন্তু শখ করে কোনো মানুষ ওই জ্বলন্ত নরক পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকে সংগীতচর্চা করতে আসবে এমন উৎকট কথা চিন্তা করা যায় না।
হ্যাঁ, শখটা উৎকট হলেও নীলকণ্ঠের গলাটা উৎকট নয়, মধুর মতো মিষ্টি।
এইখানে নীলকণ্ঠ নামে মানুষটির একটু পরিচয় দরকার। তার বাপ ছিল মস্ত জোয়ান। হাতে লাঠি নিয়ে হাঁক ছাড়লে এক-শো মরদের বুক চমকে উঠত। তার ভয়ে ভুবনডাঙার জমিদারবাড়িতে কখনো ডাকাতি হয়নি।
লাঠিয়ালের-বংশ; বাঘের বাচ্চা বাঘ। মা-মরা ছেলে নীলকণ্ঠ বাপের কাছে তালিম নিয়ে বড়ো হল। বারো বছরের ছেলের হাতে শিস দিয়ে ঘুরত লাঠি, ছুরির ফলায় চমকে উঠত বিদ্যুৎ পাকা জোয়ান চোখে সরষের ফুল দেখত, আচ্ছা-আচ্ছা মরদ পিছিয়ে আসত ভয়ে।
ভয় শুধু তার অস্ত্রকে নয়, হাতিয়ার হাতে নিলেই ছেলেটার চোখ-মুখ কেমন বদলে যেত–সে যেন সবার পরিচিত নীলে নয়, এ আর এক নীলকণ্ঠ! তখন তার শরীরটা কুঁকড়ে যেত, উজ্জ্বল চোখ দুটো হয়ে পড়ত ম্লান, নিষ্প্রভ।
মাঝে মাঝে খেলা থামিয়ে বাপ হুংকার দিয়ে উঠত, এই বেটা নীলে, হতভাগা খুনে– ফেলে দে লাঠি, ফেল বলছি।
বাপের চোখের দিকে তাকিয়ে হাতিয়ার ফেলে দিত নীলকণ্ঠ আর তার সমস্ত শরীর কাপত থর থর করে মনে হত একটা দুরন্ত ঝড় অধীর আগ্রহে মুক্তি চাইছে তার দেহের ভিতর থেকে, ব্যর্থ আক্রোশে দাপাদাপি করছে তার বুকের মধ্যে!
সর্দারের অন্য শাগরেদরা বলাবলি করত, এই ছেলে বড়ো হয়ে বাপকেও ছাড়িয়ে যাবে।
সেই কথা শুনে বদন লাঠিয়ালের বুক গর্বে ফুলে ওঠার কথা কিন্তু উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে সর্দার শুধু অন্যমনস্ক হয়ে যেত, দাড়িতে হাত বুলিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলত, হু।
নীলকণ্ঠ নামটারও একটা ইতিহাস আছে। বদন সর্দারের ছেলের নাম মদন হওয়াই স্বাভাবিক, বড়জোর অর্জুন হতে পারে–নীলকণ্ঠ হয় না। ওই নাম রেখেছিলেন বৃন্দাবন ঠাকুর গ্রামের পুরোহিত, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ। তিনি বলেছিলেন, ওরে ও যখন গান গায়, তখন ওর চোখ দুটো দেখেছিস?… ওই চোখ লাঠিয়ালের চোখ নয়, খুনির চোখ নয়–ওই চোখ উদাস বাউলের। বিষ পান করে মহাদেব নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন, আমি ওর নাম রাখলুম নীলকণ্ঠ।
তাই পাঁচ বছরের অর্জুন নাম বদলে একদিন নীলকণ্ঠ হয়ে গেল। কিন্তু দেবতার নামে নাম রাখলেই মানুষ দেবতা হয়ে যায় না। যুগ যুগ ধরে যে হিংস্র বিষাক্ত রক্ত আশ্রয় নিয়েছে নীলকণ্ঠের দেহে, সাধ্য কী সেই বিষ সে হজম করে? হাতিয়ার হাতে পড়লেই ছেলেটা বদলে যেত, ভাববিভোর বাউলের কণ্ঠে গর্জে উঠত বনের বাঘ–জিগির দিয়ে বারো বছরের ছেলে যখন খেলার মাঠে লাঠি হাতে লাফিয়ে পড়ত, তখন বদন সর্দারের সেরা শাগরেদ করিমের বুকটাও একবার চমকে উঠত।
সেই নীলকণ্ঠ বদলে গেল। বাপের মৃত্যুর পর হঠাৎ বদলে গেল নীলকণ্ঠ। মানুষ বদলায়, কিন্তু এমন আকস্মিক পরিবর্তন ভাবা যায় না। যাত্রার দলে কেষ্ট সেজে গান গেয়ে বেড়ায়। নীলকণ্ঠ, হাঁটুর কাপড় নেমে আসে গোড়ালির দিকে, গায়ে ওঠে ফিনফিনে ফতুয়া, বেনিয়ান, অথবা চাদর–আর পায়ে জুতো। আঠারো বছরের নীলকণ্ঠকে কেউ খালি গায়ে দেখেনি, তার নাকি লজ্জা করে।
গাঁয়ের মেয়েরা তাকে ভালোবাসে; বাড়িতে ডেকে গান শুনতে চায়। জোয়ান ছেলেরা সামনাসামনি টিটকারি দেয়, বলে, এ যেন বাঘের ঘরে ভেড়ার ছানা। বদন-সর্দারের নাম ডোবাল ছেলেটা।
নীলকণ্ঠ প্রতিবাদ করে না, মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে সরে যায়…
এই হল নীলকণ্ঠ নামে মানুষটির পরিচয়। চৈত্রমাসের সেই আগুন ঝরা দুপুরে বনের মধ্যে একটা গাছের ছায়ায় বিভোর হয়ে গান গাইছে ঘোর শাক্ত বংশের ছেলে নীলকণ্ঠ, কে যায়, বৃন্দাবনের কুঞ্জপথে কে যায় গো, কনক বরণী কে অভি–
আচম্বিতে সংগীত সাধনায় বাধা দিয়ে একটা তীব্র শিসের শব্দ বেজে উঠল কর্কশ ঝংকারে, রিক-রিক-চুঁঈঈ!
ভীষণ চমকে দুই হাতে কান চেপে ধরে নীলকণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, উঃ! কে রে? জঙ্গল ঠেলে নীলকণ্ঠের সামনে যে-লোকটি লাঠি হাতে আত্মপ্রকাশ করল, তার চেহারা দেখে আর বলে দিতে হয় না সে কেমন মানুষ। চোখের দৃষ্টি উগ্র রক্তিম, দক্ষিণ জ্বর উপর থেকে কপালের মাঝ বরাবর চলে গেছে একটা শুষ্ক ও গভীর ক্ষতচিহ্নের রেখা, ঠোঁটের দু-পাশে কামড় দিয়ে একজোড়া মস্ত গোঁফ সরু হয়ে উঠে গেছে গালের দিকে আর মাথার উপর থেকে ঘাড়ের উপর বাবরি হয়ে নেমে এসেছে লম্বা চুলের রাশি। আড়ে-বহরে মানুষটা খুব বড়ো নয়, কিন্তু তার কঠিন স্থূল মাংসপেশিগুলির মধ্যে যে জান্তব শক্তি লুকিয়ে আছে এক নজরেই তা ধরা পড়ে যায়।
লোকটির নাম বাঘা মৃত বদন সর্দারের এক প্রিয় অনুচর, জমিদার কালীচরণের বেতনভোগী লাঠিয়াল।
হা হা শব্দে হেসে উঠে বাঘা বলল, কীরে নীলে, কান দুটো ফেটে গেল নাকি?
কুঞ্চিত মুখে নীলকণ্ঠ বলল, ঝামেলা থেকে বাঁচতে জঙ্গলে পালিয়ে এলাম, এখানেও জ্বালাতে এসেছিস?
তা আমি কী করব? বাঘা বলল, কত্তামশাই বললেন–যেখান থেকে পারিস নীলেকে এখনই নিয়ে আয়।
কেন রে?
সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করিস। আমি কী করে জানব?
তা বটে। আচ্ছা চল।
নীচু হয়ে মাটি থেকে কী যেন তুলে নিল নীলকণ্ঠ। ওটা কী রে? বাঘার গলায় স্পষ্ট বিদ্রূপ, বাঁশি নাকি?… সত্যি নীলে, তুই একেবারে না-মরদ হয়ে গেছিস।
নীলকণ্ঠের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার হেসে ওঠে বাঘা, কী হয়ে গেছিস তুই যাত্রা করিস, বাঁশি বাজাস, গান করিস ইনিয়েবিনিয়ে, গায়ে অষ্টপ্রহর জামা চড়িয়ে রাখিস ছি, ছি, ছি, কে বলবে তুই বদন লাঠিয়ালের বেটা।
হেসে নীলকণ্ঠ মাঠের দিকে পা বাড়ায়। পেছন থেকে ভেসে আসে বাঘার তিক্ত কণ্ঠস্বর, বো বামুনই তোর মাথাটা খেল নীলু।
একটা কালো ছায়া পড়ে নীলকণ্ঠের মুখে? কয়েকটা কঠিন রেখা কি ফুটে ওঠে কপালে, চোখের তলায়, আড়ষ্ট চোয়ালের ভাঁজে ভাঁজে?..
পিছন থেকে ওই পরিবর্তন বাঘার চোখে পড়েনি, পড়লে সে সাবধান হত। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঘার মুখোমুখি যখন কথা বলে নীলকণ্ঠ, তখন তার মুখ স্বাভাবিক, ঠোঁটের তরল হাসিটিও আবার ফিরে এসেছে যথাস্থানে, তোর বড়ো ভুললামন বাঘা, ঠাকুরের পুরো নামটা মনে রাখতে পারিস না। ঠাকুরের নাম বেন্দা নয়, শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্র ঠাকুর।
লে, লে, চল, ওই হল, অপরিসীম অবজ্ঞায় হাতটা একবার শূন্যে ঘুরিয়ে আনল বাঘা, তোকে আর যাত্রার বক্তিমে করতে হবে না।
স্থির চোখে কিছুক্ষণ বাঘার দিকে তাকিয়ে থাকে নীলকণ্ঠ, তারপর ঠান্ডা গলায় বলে, মাইরি বলছি বাঘা, মাঝে মাঝে আমার রাগ হয়ে যায়। যাক, আজ চলি–শুনে আসি কর্তামশাই কেন ডাকছেন।
তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাটির উপরে সশব্দে থুথু ফেলে বাঘা লাঠিয়াল, রাগ হয়ে যায় রাগ হলে তুই কী করবি রে? এক চড় মারলে আর এক চড় মারার জায়গা থাকে না, তোর রাগের ভয়ে আমি ইঁদুরের গর্তে নুকুব?… নেহাত বদন সর্দারের বেটা, তাই কিছু বলি না।